মোল্লা গজনফর আলী
আমি কলিংবেলে চাপ দিয়ে বিল্টুকে বললাম, বুঝলি বিল্টু, যদি দেখা যায় সায়রা বাসায় নাই, কিংবা বাসায় আছে কিন্তু দরজা খুলছে না কিংবা দরজা খুলছে কিন্তু ভেতরে আসতে বলছে না কিংবা ভেতরে আসতে বলছে কিন্তু খেতে বলছে না তা হলে কিন্তু অবাক হবি না।
বিল্টু ভুরু কুঁচকে বলল, কেন মামা।
কারণ এইটাই সায়েন্টিস্টদের ধরন। সব সময় কঠিন কঠিন জিনিস নিয়ে চিন্তাভাবনা করে তো, তাই সাধারণ জিনিসগুলি তারা ভুলে যায়।
এইটা কি সাধারণ জিনিস হল? আমাদের খেতে দাওয়াত দিয়েছে-এখন ভুলে গেলে চলবে?
আমি মাথা নেড়ে বললাম, সাধারণ মানুষের বেলায় চলবে না-কিন্তু সায়েন্টিস্টদের বেলায় কিছু বলা যায় না। সবকিছু ভুলে যাওয়া হচ্ছে তাদের কাজ।
তুমি কেমন করে জান?
সিনেমায় দেখেছি।
আমার কথা বিল্টু পুরোপুরি বিশ্বাস করল বলে মনে হল না, সে নিজেই এবারে কলিংবেল টিপে ধরল, যতক্ষণ টিপে ধরে রাখা ভদ্রতা তার থেকে অনেক বেশিক্ষণ। এবারে কাজ হল, কিছুক্ষণের মাঝেই খুট করে দরজা খুলে গেল এবং সায়রা মাথা বের করে বলল, ও! আপনারা চলে এসেছেন?
আমি বললাম, হ্যাঁ, মানে ইয়ে, আমরা একটু আগেই চলে এলাম।
ভালো করেছেন। আপনারাও তা হলে দেখতে পারবেন।
বিল্টু জিজ্ঞেস করল, কী দেখতে পারব?
আমার রান্না করার মেশিন। সায়রা গম্ভীর হয়ে বলল, এখন পর্যন্ত তিনটা ইউনিট রেডি হয়েছে। ভাত, ডাল আর ডিমভাজি।
বিল্টুর চক্ষুলজ্জা স্বাভাবিক মানুষ থেকে অনেক কম। সে জিজ্ঞেস করল, তার মানে আমরা শুধু ভাত, ডাল আর ডিমভাজি খাব?
আমি ধমক দিয়ে বললাম, মেশিন যেটা রাঁধে সেটাই তো খাবি, গাধা কোথাকার!
বিল্টু মুখটা প্যাচার মতো করে বলল, বিরিয়ানি রাঁধতে পারে এরকম একটা মেশিন তৈরি করলেন না কেন সায়রা খালা?
সায়রা কিছু বলার আগেই আমি বললাম, বিরিয়ানিতে কত কোলেস্টেরল জানিস না বোকা? খেয়ে মারা যাবি নাকি?
সায়রা বলল, আস্তে আস্তে হবে। রান্নার বেসিক অপারেশন হচ্ছে তিনটা-সিদ্ধ, ভাজা এবং পোড়া। কাজেই যে মেশিন সিদ্ধ করতে পারে, ভাজতে পারে এবং পোড়াতে পারে, সেটা দিয়ে পৃথিবীর সবকিছু রান্না করা যাবে। মেশিনের সামনে একটা ডায়াল থাকবে, সেখানে শুধু টিপে দেবে-ব্যস, অটোমেটিক রান্না হয়ে যাবে।
সবকিছু রান্না হবে?
সায়রা মাথা নেড়ে বলল, অবশ্যই সবকিছু রান্না হবে।
বিল্টু মুখ গম্ভীর করে বলল, আপনার এমন একটা মেশিন তৈরি করা উচিত যেটা সবজি রাধবে না, দুধ গরম করবে না। তা হলে দেখবেন সেটা কত বিক্রি হবে! বাচ্চারা পাগলের মতো কিনবে।
আমি বিল্টুকে ধমক দিয়ে বললাম, থাক তোকে আর উপদেশ দিতে হবে না।
সায়রা একটু হাসল। তাকে আমি হাসতে দেখেছি খুব কম। আমি আবিষ্কার করলাম সে হাসলে তাকে বেশ সুন্দর দেখায়।
আমি বললাম, চলেন আপনার যন্ত্রটা দেখি।
চলেন।
ঘরের মাঝামাঝি প্রায় ছাদ-সমান উঁচু বিশাল একটা যন্ত্র। নানা রকমের বাতি জ্বলছে এবং নিবছে। উপরে বেশ খানিকটা অংশ স্বচ্ছ, সেখানে অনেকগুলো খোপ। খোপগুলোর একেকটাতে একেকটা জিনিস। কোনোটাতে চাল, কোনোটাতে ডাল, কোনোটাতে ডিম। এ ছাড়াও আছে পেঁয়াজ, রসুন, কাঁচা মরিচ, শুকনো মরিচ, লবণ এবং তেল। সামনে একটা ডায়াল, সেখানে লেখা-ভাত, ডাল এবং ডিমভাজি। সায়রা জিজ্ঞেস করল, আগে কোনটা রাঁধব?
আমি কিছু বলার আগেই বিল্টু বলল, ডিমভাজি। ঠিক আছে। সায়রা ডায়ালটা দেখিয়ে বলল, এখানে চাপ দাও।
বিল্টু ডায়ালটা চেপে ধরল-সাথে সাথে মনে হল মেশিনের ভেতর ধুন্ধুমার কাজ শুরু হয়ে গেল। ডিমের খোপ থেকে ডিমগুলো গড়িয়ে আসতে থাকে বিশাল একটা পাত্রে। সেগুলো টপটপ করে পড়ে ভেঙে যেতে থাকে। ছাঁকনির মতো একটা জিনিস ডিমের খোসাগুলোকে তুলে নেয় এবং বিশাল একটা ঘুটনির মতো জিনিস সেটাকে খুঁটতে শুরু করে। অন্য পাশ থেকে পো পো করে একটা শব্দ হয় এবং প্রায় কয়েক কেজি পেঁয়াজ গড়িয়ে। আসতে থাকে, মাঝামাঝি আসতেই ধারালো একটা তরবারির মতো জিনিস পেঁয়াজটাকে কুপিয়ে ফালাফালা করে দেয়। সেটা শেষ হবার সাথে সাথে কাঁচা মরিচ নেমে আসে এবং ছোট একটা চাকু সেটাকে কুচি কুচি করে ফেলে। উপরে কী একটা খুলে যায় এবং ঝুরঝুর করে খানিকটা লবণ এসে পড়ল। হঠাৎ সাইরেনের মতো একটা শব্দ হতে থাকল, দেখলাম বিশাল একটা কড়াইয়ের ভেতর গলগল করে প্রায় দুই লিটার তেল এসে পড়ল। বিস্ফোরণের মতো একটা শব্দ হল এবং কড়াইয়ের নিচে হঠাৎ ফার্নেসের মতো আগুনের শিখা বের হয়ে এল। দেখতে দেখতে তেল ফুটতে থাকে এবং বিদঘুটে একটা শব্দ করে খুঁটে রাখা ডিম সেখানে ফেলে দেওয়া হল। প্রচণ্ড শব্দ করে ডিম ভাজা হতে থাকে। সারা ঘর ভাজা ডিমের গন্ধে ভরে যায়। সায়রা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছিল, এবারে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, সাবধান! সবাই দূরে সরে যান।
বিল্টু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন সায়রা খালা?
ডিমভাজিটা এখন প্লেটে ছুঁড়ে দেবার চেষ্টা করবে, মাঝে মাঝে মিস করে, তখন বিপদ হতে পারে।
ব্যাপারটা নিশ্চয়ই ভয়ংকর, কারণ উপরে অ্যাম্বুলেন্সের মতো লালবাতি জ্বলতে ঔ করে। মাঝামাঝি একটা জায়গায় কাউন্টডাউন শুরু হয়ে যায়, দশ নয় আট সাত…।
আমরা দূরে সরে গিয়ে নিশ্বাস বন্ধ করে রইলাম। হঠাৎ প্রচও একটা বিস্ফোরণের মতো শব্দ হল এবং মনে হল বিছানার ভোশকের মতো হলুদ রঙের একটা জিনিস আকাশের দিকে ছুটে গেল। চাকার মতো সেটা ঘুরতে থাকে-ঘুরতে ঘুরতে সেটা ঘরের এক কোনায় বিশাল এক গামলার মাঝে এসে পড়ল। সায়রা হাততালি দিয়ে বলল, পারফেক্ট ল্যান্ডিং।
আমি আর বি সায়রার পিছু পিছু ডিমভাজিটা দেখতে গেলাম। এর আগে আমি কিংবা মনে হয় পৃথিবীর আর কেউ এত বড় ডিমভাজি দেখে নি। আড়াআড়িভাবে এটা পচ ফিট থেকে এক ইঞ্চি কম হবে না। আমি আমতা-আমতা করে বললাম, এত বড় ডিমভাজি?
সায়রা মাথা নেড়ে বলল, আস্তে আস্তে মেশিনটা ছোট করতে হবে। প্রথমে শুরু করার জন্য সব সময় একটা বড় মডেল তৈরি করতে হয়।
বিল্টু ভয়ে ভয়ে বলল, আমাদের পুরোটা খেতে হবে?
সায়রা হেসে বলল, না না, পুরোটা খেতে হবে না। যেটুকু ইচ্ছে হবে সেটুকু খাবে।
বিল্টু খুব সাবধানে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, এই ডিমভাজিটা কমপক্ষে চল্লিশ জন খেতে পারবে।
সায়রা মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। এটা তো ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইন, সবকিছু বেশি বেশি করে হয়।
সায়রা যে মিথ্যে বলে নি একটু পরেই তার প্রমাণ পেলাম-কারণ রান্না করার পর ভাত এবং ডাল ডাইনিং রুমে বড় বড় বালতি করে আনতে হল। আমরা খাবার টেবিলে খেতে বসেছি-চামচ দিয়ে মেঝেতে রাখা বালতি থেকে ভাত-ডাল তুলে নিতে হল। ডিমভাজি চাকু দিয়ে কেটে আলাদা করতে হল।
আমরা খেতে করা মাত্রই সায়রা চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল, কেমন হয়েছে?
মিথ্যে কথা বললে পাপ হয় এবং সেই পাপের কারণে নাকি দোজখের আগুনে শরীরের নানা অংশ পুড়তে থাকবে, কিন্তু আমার ধারণা-কারো মনে কষ্ট না দেবার জন্য মিথ্যে কথা বললে পাপ হয় না। আমি খুব তৃপ্তি করে খাচ্ছি এরকম ভান করে বললাম, খুব ভালো হয়েছে। একেবারে ফার্স্ট ক্লাস।
বিল্টু আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ফার্স্ট ক্লাস? কী বলছ মামা! খাবার মুখে দেওয়া যায় না। কোনো স্বাদ নাই।
বিল্টুকে থামানোর জন্য আমি টেবিলের তলা দিয়ে তার পায়ে লাথি মারার চেষ্টা করলাম, লাথিটা লাগল সায়রার পায়ে এবং সে মৃদু আর্তনাদ করে উঠল। বিল্টু অবিশ্যি ভ্রূক্ষেপ করল না, বলল, সায়রা খালা, আপনার মেশিনের রান্নার স্বাদ যদি এরকম হয় তা হলে তার একটাও বিক্রি করতে পারবেন না।
সায়রা খানিকক্ষণ হতচকিত হয়ে বিল্টুর দিকে তাকিয়ে থেকে ইতস্তত করে বলল, আমি তো আসলে ঠিক বিক্রি করার জন্য এটা আবিষ্কার করি নাই। এটা আবিষ্কার করেছি নারী জাতিকে রান্নাঘর থেকে মুক্ত করার জন্য।
কীভাবে কথাবার্তা বলতে হয় সেটা যে বিকে শেখানো হয় নি আমি এবারে সেটা আবিষ্কার করলাম, সে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, এটা দিয়ে নারী জাতির মুক্তি হবে না সায়রা খালা, বরং উল্টোটা হতে পারে।
উল্টোটা?
হ্যাঁ। যে এটা দিয়ে রান্না করবে তাকে ধরে সবাই পিটুনি দিতে পারে। গণপিটুনি।
আমি এবারে ভাবনাচিন্তা করে বিল্টুর পা কোনদিকে নিশ্চিত হয়ে একটা লাথি কশালাম। বিল্টু ককিয়ে উঠে বলল, উহ! মামা লাথি মারলে কেন?
আমি থতমত খেয়ে বললাম, লাথি মারি নি। পা লেগে গেছে।
খাবার টেবিলে বসে তুমি কি পা দিয়ে ফুটবল খেল? এত জোরে পা লেগে যায়!
সায়রার চোখ এড়িয়ে আমি বিল্টুর চোখে চোখ রেখে একটা সিগন্যাল দেওয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কোনো লাভ হল না। বিল্টু বলতেই লাগল, সায়রা খালা, তোমার এই মেশিন বিক্রি করলে লাভ থেকে ক্ষতি হবে বেশি।
কেন?
কারণ কেউ এর রান্না খাবে না। যদি কাউকে খাওয়াতে চাও তোমাকে টাকাপয়সা দিয়ে খাওয়াতে হবে। এক প্লেট ভাত দশ টাকা এক বাটি ডাল বিশ টাকা। ডিমভাজি পঞ্চাশ টাকা। কমপক্ষে সত্তর টাকা।।
আমি আর না পেরে বিল্টুকে ধমক দিয়ে বললাম, কী আজেবাজে কথা বলছিস বিল্টু? সবকিছু নিয়ে ঠাট্টা?
বিলু গম্ভীর হয়ে বলল, না মামা, আমি একটুও ঠাট্টা করছি না। সত্যি কথা বলছি। একেবারে কিরে কেটে বলছি।
আমি খাচ্ছি না? আমি জোর করে মুখে কয়েক লোমা ভাত ঠেসে দিয়ে বললাম, আমার তো খেতে বেশ লাগছে!
তোমার কথা আলাদা মামা। তুমি নিশ্চয়ই পাগল। আম্মা সব সময় বলে তোমার জন্মের সময় ব্রেনে নাকি অক্সিজেন সাপ্লাই কম হয়েছিল, সেজন্য তুমি কোনো কিছু বোঝ না।
সায়রাকে বেশ চিন্তিত দেখাল। সে একটা বড় কাগজ দেখতে দেখতে বলল, আমার মেশিনের রিপোর্ট তো ঠিকই দিয়েছে। এই দেখেন-ডিমভাজার সালফার কন্টেন্ট লিমিটের মাঝে। ডালের পিএইচ পারফেক্ট। ভাতের সারফেস টেক্সচার অপটিমাম।
আমি উৎসাহ দেবার জন্য বললাম, মেশিন যেহেতু বলেছে ঠিক, এটা অবিশ্যি ঠিক। বিল্টু সেদিনের ছেলে, সে কী বোঝে? তার কোনো কথা শুনবেন না।
বিল্টু মুখ বাকিয়ে বলল, সব ঠিক থাকতে পারে কিন্তু কোনো স্বাদ নাই।
সায়রা হঠাৎ করে অন্যমনস্ক হয়ে গেল, কিছুক্ষণ কী একটা ভেবে হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা জাফর ইকবাল সাহেব, স্বাদ মানে কী?
হঠাৎ করে এরকম একটা জটিল প্রশ্ন শুনে আমি একেবারে ঘাবড়ে গেলাম। আমতা আমতা করে বললাম, স্বাদ মানে হচ্ছে-যাকে বলে-আমরা যখন খাই তখন মানে- ইয়ে-যাকে বলে–
আরো কিছুক্ষণ হয়তো এরকম আমতা-আমতা করতাম কিন্তু সায়রা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, এটা হচ্ছে একটা অনুভূতি। আমরা যখন কিছু খাই তখন জিব তার একটা অনুভূতি পায়, নাক একটা গন্ধ পায়। দাঁত-মাঢ়ী এক ধরনের স্পর্শ অনুভব করে, তার সবগুলো নার্ত দিয়ে আমাদের মস্তিষ্কে পৌঁছায়। সেখানে নিউরনে এক ধরনের সিনান্স কানেকশন হতে থাকে। মস্তিষ্কের সেই অনুভূতি থেকে আমরা বলি স্বাদটি ভালো কিংবা স্বাদটি খারাপ।
সায়রার চোখ দুটো এক ধরনের উত্তেজনায় জ্বলজ্বল প্রতে থাকে। আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল, তার মানে বুঝতে পারছেন?
আমি ভয়ে ভয়ে মাথা নেড়ে বললাম, না।
তার মানে একটা জিনিসের স্বাদ ভালো করার জন্য কষ্ট করে সেটাকে ভালো করে রান্না করার দরকার নেই। আমরা যদি খুঁজে বের করতে পারি ব্রেনের কোন জায়গাটাতে আমরা খাবারের স্বাদ অনুভব করি সেখানে যদি আমরা এক ধরনের স্টিমুলেশন দিই তা হলে আমরা যেটা খাব সেটাকেই মনে হবে সুস্বাদু।
বিল্টু চোখ বড় বড় করে বলল, সত্যি?
এক শ বার সত্যি। তার মানে আমি যদি সেরকম একটা মেশিন তৈরি করতে পারি যেটা দিয়ে ব্রেনের নির্দিষ্ট জায়গায় স্টিমুলেশন দেওয়া যায় তা হলে খবরের কাগজ ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেলে মনে হবে কোরমা-পোলাও খাচ্ছি!
আমি চমকে উঠে বললাম, খবরের কাগজ?
হ্যাঁ। স্পঞ্জের স্যান্ডেল খেলে মনে হবে সন্দেশ খাচ্ছেন। কেরোসিন খেলে মনে হবে অরেঞ্জ জুস খাচ্ছেন। পৃথিবীতে একটা বিপ্লব ঘটিয়ে দেওয়া যাবে!
বিল্টু ঢোক গিলে বলল, কিন্তু সেটা মাথার ভেতরে বসানোর জন্য আপনাকে ব্রেনের অপারেশন করতে হবে! আপনাকে আগে ব্রেনের সার্জারি শিখতে হবে। যদি শিখেও যান তারপরও আমার মনে হয়।
সায়রা ভুরু কুঁচকে বলল, কী মনে হয়?
খবরের কাগজ, স্পঞ্জের স্যান্ডেল আর কেরোসিন খাবার জন্য কেউ ব্রেনের সার্জারি করতে রাজি হবে না।
রাজি হবে না?
উঁহু।
সায়রাকে হঠাৎ খুব চিন্তিত মনে হল।
আমাদের খাওয়ার দাওয়াতটা মোটামুটিভাবে মাঠে মারা গেল বলা যায়। ব্রেনের ভেতরে স্টিমুলেশন দেওয়ার কথা সায়রার মাথায় আসার পর থেকে সে অন্যমনস্ক হয়ে রইল, ভুরু কুঁচকে চিন্তা করতে লাগল এবং মাঝে মাঝে মাথা নাড়তে লাগল। আমরা তাকে আর ঘাটালাম না, বিদায় নিয়ে চলে এলাম।
বিল্টু আর আমি একটা ফাস্টফুডের দোকান থেকে হ্যাঁমবার্গার খেয়ে সে রাতে বাসায় ফিরেছিলাম।
.
বিজ্ঞানের ব্যাপারে আমি আগে যেরকম হাবাগোবা ছিলাম এখন আর সেরকম বলা। যাবে না। সায়রা সায়েন্টিস্টের সাথে পরিচয় হওয়ার জন্যই হোক আর বিল্টুর জ্বালাতনের কারণেই হোক আমি মোটামুটিভাবে বিজ্ঞানের লাইনে এক্সপার্ট হয়ে গিয়েছি। সেদিন বাথরুমের বা ফটাশ শব্দ করে ফিউজ হয়ে গেল। আমি একটুও না ঘাবড়ে একটা বাল্ব কিনে নিজে লাগিয়ে দিলাম আমার জীবনে প্রথম। বিল্টু একদিন আমাকে দেখিয়ে দিল, তারপর থেকে আমি নিজে মোড়ের একটা সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে ই-মেইল পাঠানো শুরু করে দিয়েছি। প্রথমে পাঠানোর লোক ছিল মাত্র দুজন-সায়রা সায়েন্টিস্ট আর বিল্টু। বিল্টু আরেকদিন আমাকে শিখিয়ে দিল কেমন করে অন্য মানুষের ই-মেইল বের করতে হয়- সেটা জানার পর আমি অনেক জায়গায় ই-মেইল পাঠাতে রু করে দিলাম। প্রথমেই আমেরিকার প্রেসিডেন্টের কাছে খুব কড়া ভাষায় তাদের পররাষ্ট্রনীতি ঠিক করার জন্য উপদেশ দিয়ে একটা ই-মেইল পাঠিয়ে দিলাম। জার্মানির চ্যান্সেলরের কাছে ই-মেইল পাঠিয়ে তাদের ইমিগ্রেশন পলিসি ঠিক করার জন্য অনুরোধ করলাম। ব্রাজিল ওয়ার্ল্ডকাপে জিতে যাবার পর তাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে ই-মেইল পাঠিয়ে লিখে দিলাম, শুধু ফুটবল খেললেই হবে না-পড়াশোনাতেও মনোযোগ দিতে হবে, কারণ শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। আমাদের দেশের মন্ত্রীদের বোকামির তালিকা দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটা ই-মেইল পাঠাব ভাবছিলাম কিন্তু সবাই নিষেধ করল। তা হলে নাকি এসএসএফ-এর লোকজন এসে কঁ্যাক করে ধরে ডিবি পুলিশের হাতে দিয়ে দিবে। তারা রিমান্ডে নিয়ে রামধোলাই দিয়ে অবস্থা কেরোসিন করে দেবে। তবে আমি নিয়মিতভাবে বিভিন্ন পত্রিকায় ই-মেইলে সম্পাদকদের কাছে চিঠি পাঠাতে লাগলাম। কয়েক দিনের মাঝেই দৈনিক মোমের আলো পত্রিকায় একটা চিঠি পা হয়ে গেল। চিঠিটা এরকম–
শৃঙ্খলাবোধ এবং জাতির উন্নতি
পৃথিবীর সকল জাতি যখন উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করিতেছে তখন আমরা শৃঙ্খলাবোধের অভাবে ক্রমাগত পশ্চাদমুখী
হইয়া পড়িতেছি।
উদাহরণ দেওয়ার জন্য বলা যায়, ট্রাফিক সার্জেন্ট
যখন রাস্তার মোড়ে একটি ট্রাক ড্রাইভারকে আটক করিয়া ঘুষ আদায় করে তখন
কখনো পঞ্চাশ কখনো এক শ কখনো-বা
দুই শ টাকা দাবি করেন। ট্রাক ড্রাইভাররা এই অর্থ দিতে গড়িমসি করেন। ইহাতে ট্রাফিক
সার্জেন্টদের মূল্যবান সময় নষ্ট হয়। তাহারা তাহাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করিতে পারেন
না। আন্তর্জাতিক টেন্ডার পাওয়ার ব্যাপারে মন্ত্রী
মহোদয়দের ঘুষ দেওয়া হইতে
রু করিয়া সচিবালয়ের
পিয়নদেরকে পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। ঘুষের রেট নির্ধারিত
নয় বলিয়া দর কষাকষি করিতে হয়। উভয় পক্ষের মূল্যবান সময় নষ্ট
হয়।
কাজেই আমি প্রস্তাব করিতেছি-অবিলম্বে ঘুষের রেট নির্ধারণ
করিয়া জাতীয় সংসদে পাস করানোর পর তাহা সরকারি গেজেটভূক্ত করিয়া দেওয়া হোক। যাহারা এই রেট অনুযায়ী ঘুষ
দিতে আপত্তি করিবেন তাহাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হোক। পুরো প্রক্রিয়াটি একটি শৃখলার ভিতরে
আনিয়া জাতিকে উন্নতির দিকে অগ্রসর করানোর পথ সুগম করানো হোক।
জাফর ইকবাল
পল্লবী, মিরপুর
শুধু যে পত্রিকায় ই-মেইল ব্যবহার করে চিঠি পাঠাতে শুরু করলাম তা নয়, পরিচিত লোকজনকে আমার নতুন প্রতিভার কথা জানাতে শুরু করলাম। নতুন কারো সাথে পরিচয় হলেই তার ই-মেইল অ্যাড্রেস কী জিজ্ঞেস করতে শুরু করলাম এবং ই-মেইল অ্যাড্রেস না থাকলে সেটি নিয়ে বাড়াবাড়ি ধরনের অবাক হতে শুরু করলাম।
আমি যত ই-মেইল পাঠাতে শুরু করলাম সেই তুলনায় উত্তর আসত খুব কম। বিন্দু এবং সায়রা ছাড়া আর কেউ উত্তর দিত না, তাদের উত্তরও হত খুব ছোট তিন-চার শব্দের। তবুও যেদিন একটা ই-মেইল পেতাম আমি উৎসাহে টগবগ করতে শুরু করতাম, রক্ত চনমন করতে করত। সায়রার বাসায় সেই দাওয়াত কেলেঙ্কারির প্রায় এক মাস পর হঠাৎ তার কাছ থেকে একটা ই-মেইল পেলাম, সেটাকে বাংলায় অনুবাদ করলে এরকম দাঁড়ায়-
মস্তিষ্কে স্টিমুলেশন সমস্যা
সমাধান।
ট্রান্সক্রেনিয়াল
স্টিমুলেটর। প্রোটোটাইপ
প্রস্তুত।
গিনিপিগ প্রয়োজন।
দেখা করুন। জরুরি।
সায়রা
সায়রার ই-মেইল বোঝা খুব কঠিন–বিল্টুর কাছে নিয়ে গেলে হয়তো মর্মোদ্ধার করে দিত কিন্তু আমি আর তাকে বিরক্ত করতে চাইলাম না। অনেকবার পড়ে আমার মনে হল, সে একটা যন্ত্র তৈরি করেছে যেটা পরীক্ষা করার জন্য গিনিপিগ দরকার। সে দেখা করতে বলেছে। গিনিপিগসহ নাকি গিনিপিগ ছাড়া যেতে বলেছে ঠিক বুঝতে পারলাম না। এক হালি গিনিপিগ নিয়েই যাব যাব চিন্তা করে কাঁচাবাজারে বিকেলবেলা খুঁজে দেখলাম, কেউ জিনিসটা চিনতেই পারল না। অনেক ভেবেচিন্তে শেষ পর্যন্ত গিনিপিগ ছাড়াই সায়রার বাসায় হাজির হলাম।
আমাকে দেখে সায়রার মুখ এক শ ওয়াট বাল্বের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। দরজা খুলে বলল, এই তো আমার গিনিপিগ চলে এসেছে।
আমি থতমত খেয়ে বললাম আসলে আনতে পারি নাই। কাঁচাবাজারে খোঁজ করেছিলাম, সেখানে নাই।
কী নাই?
গিনিপিগ।
সায়রা আমার কথা শুনে হি হি করে হেসে উঠল, মেয়েটা হাসে কম, কিন্তু যখন হাসে তখন দেখতে বেশ ভালোই লাগে। আমি বললাম, হাসছেন কেন?
আপনার কথা শুনে।
আমি কি হাসির কথা বলেছি?
হ্যাঁ।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কখন?
এই যে আপনি বললেন, কাঁচাবাজার থেকে গিনিপিগ আনতে চেয়েছেন। এটাই হাসির কথা–কারণ কাঁচাবাজার থেকে গিনিপিগ আনতে হবে না। আপনিই গিনিপিগ!
আমি থতমত খেয়ে বললাম, আমিই গিনিপিগ?
যার ওপরে এক্সপেরিমেন্ট করা হয় সে হচ্ছে গিনিপিগ। আপনার ওপর আমার ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটরটা পরীক্ষা করব–তাই আপনি হবেন আমার গিনিপিগ।
আমি আঁতকে উঠে বললাম, আমার ওপরে পরীক্ষা করবেন?
তা না হলে কার ওপরে করব? কে রাজি হবে?
যুক্তিটার মাঝে কিছু গোলমাল আছে, কিন্তু আমি তাড়াতাড়ি চিন্তা করতে পারি না, তাই এবারেও গোলমালটা ধরতে পারলাম না। আমতা-আমতা করে বললাম, ইয়ে মানে ব্রেনের মাঝে স্টিমুলেশন-কোনো সমস্যা হবে না তো?
এক্সপেরিমেন্টের ব্যাপার, কখন কী সমস্যা হয় সেটা কি কেউ আগে থেকে বলতে পারে? পারে না।
তা হলে?
সায়রা মুখ গম্ভীর করে বলল, আমিও সেটা বলতে চাচ্ছি। ব্রেনের মাঝে সরাসরি স্টিমুলেশন দেওয়া কি চাট্টিখানি কথা? লেভেলের তারতম্য হতে পারে, বেশি হয়ে যেতে পারে, ব্রেন ড্যামেজ হয়ে যেতে পারে-সেটা টেস্ট করার জন্য আমি ভলান্টিয়ার কোথায় পাব? সারা পৃথিবীতে কেউ রাজি হত না। তখন হঠাৎ আপনার কথা মনে পড়ল-আপনাকে ই-মেইল পাঠালাম, আপনি এক কথায় রাজি হয়ে চলে এলেন। কী চমৎকার ব্যাপার।
আমি আমতা-আমতা করে বললাম, না, মানে ইয়ে-বলছিলাম কী-
সায়রা বলল, না না আপনার কিছু বলার দরকার নেই, আমি জানি আপনি কী বলবেন। আপনি বলতে চাইছেন যে আপনি বিজ্ঞানের বও জানেন না কিন্তু বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য আপনি জীবন পর্যন্ত দিতে রাজি আছেন। ঠিক কি না?
আমি ঢোক গিলে কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু আমার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হল না। সায়রা মধুর ভঙ্গিতে হেসে বলল, বিজ্ঞানের উন্নতি কি একদিনে হয়েছে? হয় নি। হাজার হাজার বছর লেগেছে। আমরা শুধু বিজ্ঞীদের নাম জানি কিন্তু এই হাজার হাজার বছর ধরে যে লক্ষ লক্ষ ভলান্টিয়ার বিজ্ঞানের জন্য তাদের জীবন দিয়েছে তাদের নাম আমরা জানি না। জানার চেষ্টাও করি না
ভ-ভ-ভলান্টিয়াররা মারা যায়?
যায় না? অবশ্যই যায়। সায়রা মৃদু হেসে বলল, কিন্তু এখন সেটা নিয়ে আপনার সাথে কথা বলতে চাই না-আপনি নার্ভাস হয়ে যাবেন। আসেন আমার সাথে।
তেলাপোকা যেভাবে কাঁচপোকার পিছু পিছু যায় আমি অনেকটা সেভাবে সায়রার পিছু পিছু তার ল্যাবরেটরি ঘরে গেলাম। একটা টেবিলের উপর নানারকম যন্ত্রপাতি। মনিটরে নানারকম তরঙ্গ খেলা করছে, নানারকম আলো জ্বলছে এবং নিবছে। যন্ত্রপাতিগুলো থেকে ভোঁতা এক ধরনের শব্দ বের হচ্ছে। টেবিলের পাশে ডেন্টিস্টের চেয়ারের মতো একটা চেয়ার। তার কাছে একটা টুল, সেই টুলে মোটরসাইকেল চালানোর সময় যেরকম হেলমেট পরে সেরকম একটা হেলমেট। হেলমেট থেকে নানা ধরনের তার বের হয়ে এসেছে, সেগুলো যন্ত্রপাতির নানা জায়গায় গিয়ে লেগেছে। সায়রা হেলমেটটা দেখিয়ে বলল, এই যে জাফর ইকবাল সাহেব, এইটা হচ্ছে আমার নিজের হাতে তৈরি ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর।
ট্রা-ট্রা-ট্রা- আমি কয়েকবার যন্ত্রটার নাম বলার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়ে বললাম, কী হয় এই যন্ত্রটা দিয়ে?
মনে আছে, খাবারের স্বাদ নিয়ে আমরা কথা বলেছিলাম?
হ্যাঁ, মনে আছে।
মনে আছে, আমি বলেছিলাম ব্রেনের নির্দিষ্ট কোনো একটা জায়গায় স্টিমুলেশন দিয়ে খাবারের স্বাদ পাওয়া সম্ভব?
হ্যাঁ, মনে আছে।
মনে আছে, তখন বিল্টু বলেছিল সেটা করার জন্যে ব্রেন সার্জারি করে ব্রেনের ভেতরে কোন ধরনের ইলেকট্রড বসাতে হবে?
আমি আবার মাথা নাড়লাম, হ্যাঁ, মনে আছে।
সায়রা একগাল হেসে বলল, আসলে ব্রেনের ভেতরে গিয়ে স্টিমুলেশন দিতে হবে না। বাইরে থেকেই দেওয়া সম্ভব।
বাইরে থেকেই?
হ্যাঁ। খুব হাই ফ্রিকোয়েন্সির ম্যাগনেটিক ফিল্ড দিয়ে বাইরে থেকে ব্রেনের ভিতরে স্টিমুলেশন দেওয়া যায়। সত্যি কথা বলতে কি, যন্ত্রটা এর মাঝে আবিষ্কার হয়ে গেছে। আমেরিকার ল্যাবরেটরিতে সেটা ব্যবহার হয়। যন্ত্রটার নাম ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর। এটা কীভাবে তৈরি করতে হয় সেটা ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে এনে এখানে তৈরি করেছি। সবকিছু রেডিএখন শুধু পরীক্ষা করে দেখা।
পরীক্ষা করে দেখা?
হ্যাঁ। আপনার মাথায় লাগিয়ে হাই ফ্রিকোয়েন্সি ম্যাগনেটিক ফিল্ড দেব–আপনি এক ধরনের স্বাদ অনুভব করতে থাকবেন। মনে হবে পোলাও পাচ্ছেন।
যদি মনে না হয়? আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, যদি অন্য কিছু হয়?
তা হলে সেটা দেখতে হবে অন্য কী হচ্ছে। কেন হচ্ছে? কীভাবে হচ্ছে, এটাই হচ্ছে গবেষণা। এটাই হচ্ছে বিজ্ঞান।
আমার একেবারেই ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু সায়রার সামনে আমি না করতে পারলাম না। আমাকে রীতিমতো জোর করে ডেন্টিস্টের চেয়ারে বসিয়ে সে বলল, চেয়ারের হাতলে হাত রাখেন।
আমি হাতলের উপর হাত রাখতেই নাইলনের দড়ি দিয়ে সায়রা হাতগুলো বেঁধে ফেলল। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, হাত বাঁধছেন কেন?
ব্রেনের মাঝে স্টিমুলেশন দিচ্ছি– কী হয় কে বলতে পারে? হয়তো হাত-পা ছুঁড়ে আপনার শরীরে খিঁচুনি শুরু হয়ে যাবে। রিস্ক নিয়ে লাভ আছে?
আমি আর কোনো কথা বলার সাহস পেলাম না। চুপচাপ চেয়ারে বসে রইলাম। বুক ঢাকের মতো শব্দ করে ধকধক করতে লাগল, গলা শুকিয়ে কাঠ। সায়রা কাছে এসে আমার মাথায় হেলমেটটি পরিয়ে দিয়ে স্টাপ দিয়ে সেটা থুতনির সাথে বেঁধে দিয়ে তার যন্ত্রপাতির সামনে চলে গেল। নানারকম সুইচ টেপাটিপি করে বলল, জাফর ইকবাল সাহেব, আপনি চেয়ারে মাথা রেখে রিলাক্স করেন।
আমি চিঁ চিঁ করে বললাম, করছি।
স্টিমুলেশন দেওয়ার পর আমি আপনাকে প্রশ্ন করব। আপনি তখন সেই প্রশ্নের উত্তর দেবেন। ঠিক আছে?
আমি আবার চিঁ চিঁ করে বললাম, ঠিক আছে।
সায়রা একটা হ্যান্ডেল টেনে বলল, এই যে আমি স্টিমুলেশন দিতে শুরু করেছি। দশ ডিবি পাওয়ার, কিছু টের পাচ্ছেন?
আমি ভেবেছিলাম মাথার ভেতরে সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটতে শুরু করবে কিন্তু কিছুই ঘটল না। বললাম, না।
ঠিক আছে পাওয়ার বাড়াচ্ছি। বারো, তেরো, চৌদ্দ ডিবি। এখন কিছু টের পাচ্ছেন?
আমি কিছুই টের পেলাম না, শুধু হঠাৎ করে একটা দুর্গন্ধ নাকে ভেসে এল। বললাম, না, কিছুই টের পাচ্ছি না। তবে কোথা থেকে জানি দুর্গন্ধ আসছে।
সায়রা অবাক হয়ে বলল, দুর্গন্ধ?
হ্যাঁ।
কী রকম দুর্গন্ধ?
ইঁদুর মরে গেলে যেরকম দুর্গন্ধ হয়।
সায়রা এদিক-সেদিক শুঁকে বলল, নাহ কোনো দুর্গন্ধ নেই তো? যাই হোক, পরে দেখা যাবে দুর্গন্ধ কোথা থেকে আসছে। এখন আমার ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটরটা পরীক্ষা করি। আপনি যেহেতু কোনো কিছু টের পাচ্ছেন না, সিগন্যালটা আরেকটু বাড়াই। এই যে ষোলো-সতেরো-আঠারো ডিবি।
হঠাৎ একটা বিদঘুটে জিনিস ঘটে গেল-কোথা থেকে একটা মরা ইঁদুর কিংবা ব্যাঙ লাফিয়ে আমার মুখের ভেতর ঢুকে গেল। প্রচণ্ড দুর্গন্ধে আমার বমি এসে যায়। আমি ওয়াক থু করে মুখ থেকে মরা ব্যাঙ কিংবা ইঁদুরটা বের করতে চেষ্টা করলাম কিন্তু বের করতে পারলাম না। হাত-পা বাঁধা, তাই হাত দিয়েও টেনে বের করতে পারলাম না। আমি গোঙানোর মতো শব্দ করতে লাগলাম। সায়রা উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
মুখের ভিতরে
মুখের ভিতরে কী?
কী যেন একটা ঢুকে গেছে। পচা ইঁদুর, না হয় ব্যাঙ। ছি, কী দুর্গন্ধ! আমি প্রায় বমি করে দিচ্ছিলাম।
সায়রা আমার কাছে এসে মুখের ভেতরে উঁকি দিয়ে বলল, না! আপনার মুখে তো কিছু নেই। সব আপনার কল্পনা।
আমি জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললাম না, না, আছে। ভালো করে দেখেন। আমি মুখ বড় করে হাঁ করলাম।
সায়রা বলল, আপনার চমৎকার একটা স্বাদের অনুভূতি পাওয়ার কথা। যতক্ষণ না পাচ্ছেন ততক্ষণ পাওয়ার বাড়াতে থাকি।
আমি চিৎকার করে না করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু সায়রা আমার কথা শুনল না। হ্যান্ডেলটা টেনে পাওয়ার আরো বাড়িয়ে দিল। আর আমার মনে হল কেউ যেন আমাকে হাঁ করিয়ে এক বালতি পচা গোবর আমার গলা দিয়ে ঠেসে দিতে রু করেছে। আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে চাইল, ছটফট করে আমি একটা গগনবিদারী চিৎকার দিলাম। আমার চিৎকার শুনে সায়রা নিশ্চয়ই হ্যান্ডেলটা নামিয়ে স্টিমুলেটরের পাওয়ার বন্ধ করে দিয়েছিল, তখন হঠাৎ করে ম্যাজিকের মতো পচা গোবর, মরা ইঁদুর আর ব্যাঙ, দুর্গন্ধ সবকিছু চলে গেল। আমি এত অবাক হলাম যে বলার মতো নয়-রাগ হলাম আরো বেশি। সায়রার দিকে চোখ পাকিয়ে বললাম, আপনার এই যন্ত্র মোটেই কাজ করছে না। ভালো স্বাদ পাবার কথা অথচ পচা দুর্গন্ধ পাচ্ছি।
সায়রা চোখ বড় বড় করে বলল, কী বলছেন আপনি! ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর পুরোপুরি কাজ করছে। শুধুমাত্র ম্যাগনেটিক স্টিমুলেশন দিয়ে আপনাকে স্বাদের অনুভূতি দিয়েছি। ভালো না থোক খারাপ তো দিয়েছি।
সেটা এক জিনিস হল?
এক না হলেও কাছাকাছি।
পচা ইঁদুরের স্বাদ আর পোলাওয়ের স্বাদ কাছাকাছি হতে পারে?
সায়রা বিশ্ব জয় করার মতো একটা ভঙ্গি করে বলল, হতে পারে। ব্রেনের যে অংশে স্বাদের অনুভূতি সেখানে ভালো আর খারাপ অনুভূতি খুব কাছাকাছি। খারাপটা যখন পেয়েছি কাছাকাছি খুঁজলে ভালোটাও পাব।
খুঁজলে? কীভাবে খুঁজলে?
ট্রায়াল এন্ড এরর। আপনার ব্রেনে যেখানে স্টিমুলেশন দিয়েছি, এখন তার থেকে একটু সরিয়ে অন্য জায়গায় দেব। সেখানে না হলে অন্য জায়গায়, এভাবে খোঁজাখুঁজি করলেই পেয়ে যাব।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, আমি রাজি না। আমার ব্রেনে আপনাকে আমি আর ঘাঁটাঘাঁটি করতে দেব না।
সায়রা মধুরভাবে হেসে বলল, আপনি এটা কী বলছেন? এত আগ্রহ নিয়ে ভলান্টিয়ার হয়েছেন অথচ এখন বলছেন রাজি না। বিজ্ঞানের জগতে এটা জানাজানি হয়ে গেলে কী হবে আপনি জানেন?
যা হয় হোক।
ছেলেমানুষি করবেন না জাফর ইকবাল সাহেব বলে সায়রা আমার মাথার কাছে এসে মাথায় লাগানো হেলমেটটার মাঝে কী একটা করতে লাগল। খানিকক্ষণ পর তার যন্ত্রপাতিগুলোর কাছে ফিরে গিয়ে বলল-এখন অন্য জায়গায় গিয়ে স্টিমুলেশন দিচ্ছি। দেখি কী হয়?
আমি প্রচণ্ড রেগেমেগে বললাম, না, কিছুতেই না।
কিন্তু তার আগেই সায়রা হ্যান্ডেলটা টেনে ধরেছে এবং হঠাৎ করে আমার সমস্ত রাগ কেমন করে জানি উবে গেল। শুধু যে রাগ অদৃশ্য হয়ে গেল তাই নয়, আমার হঠাৎ করে কেন জানি হাসি পেতে শুরু করল। আমি সায়রার দিকে তাকালাম এবং তার চেহারাটা এত। হাস্যকর মনে হতে লাগল যে আমি আর হাসি আটকে রাখতে পারলাম না, হঠাৎ খিকখিক করে হেসে ফেললাম।
সায়রা ভুরু কুঁচকে বলল, কী হল, আপনি হাসছেন কেন?
না, না এমনি।
এখন একটা বৈজ্ঞানিক গবেষণা হচ্ছে-এর মাঝে যদি হাসি-তামাশা করেন তা হলে কাজ করব কেমন করে?
ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমি আর হাসব না- বলেও আমি আবার হেসে ফেললাম, হাসতে হাসতে বললাম, আসলে আপনি একটু সরে দাঁড়ান। আপনাকে দেখলেই হাসি পেয়ে যাচ্ছে।
সায়রা চোখ পাকিয়ে বলল, কী বললেন আপনি? আমাকে দেখলেই হাসি পেয়ে যাচ্ছে?
হ্যাঁ, আপনার চেহারাটা-হি হি হি-
সায়রা বেজার মুখ করে বলল, কী হয়েছে আমার চেহারায়?
আয়নাতে কখনো দেখেন নি? মনে হয় নাকটা কেউ অন্য জায়গা থেকে তুলে সুপার গ্লু দিয়ে লাগিয়ে দিয়েছে! আমি হাসি থামাতে পারি না, হি হি করে হাসতেই থাকি।
সায়রা থমথমে গলায় বলল, সুপার গ্লু দিয়ে?
আমি কোনোমতে হাসি থামিয়ে বললাম, হ্যাঁ। সুপার গ্লু দিয়ে লাগানোর পর মনে হয় দেড়টনি একটা ট্রাক আপনার নাকের ওপর দিয়ে চলে গেছে। পুরো নাকটা ফ্ল্যাট, চ্যাপ্টা এবং ধ্যাবড়া। হি হি হি।
সায়রা খানিকক্ষণ আমার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে রইল, তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, দেখেন জাফর ইকবাল সাহেব, আমার ধারণা ছিল আপনি খুব বুদ্ধিমান মানুষ হলেও মোটামুটি একজন ভদ্র মানুষ। আমার সাথে ভদ্রতাটুকু বজায় রাখবেন। আপনি আমার চেহারা নিয়ে হাসাহাসি করবেন সেটা আমি কখনোই আন্দাজ করতে পারি নি।
আমি অনেক কষ্ট করে হাসি থামিয়ে বললাম, আই অ্যাম সরি, সায়রা। আমার অন্যায় হয়েছে এই যে আমি মুখে ছিটকিনি লাগিয়ে দিলাম, আর আমি হাসব না।
হ্যাঁ, শুধু শুধু ফ্যাক ফ্যাক করে হাসবেন না। আপনার ব্রেনে এখন দশ ডিবি পাওয়ার যাচ্ছে। এটাকে বাড়িয়ে দিচ্ছি, আপনার কী অনুভূতি হয় বলবেন। ঠিক আছে?
সায়রার মাষ্টারনীর মতো কথা বলার ভঙ্গি দেখে হাসিতে আমার পেট ভুটভুট করছিল, কিন্তু আমি অনেক কষ্ট করে হাসি আটকে রেখে বললাম, ঠিক আছে।
সায়রা হ্যান্ডেলটা টেনে বলল, দশ থেকে বাড়িয়ে চৌদ্দ ডিবি করে দিলাম।
সাথে সাথে আমি অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম।
সায়রা রেগে গিয়ে বলল, কী হল? আপনাকে বললাম হাসবেন না-শুধু বলবেন কেমন লাগছে। আবার আপনি হাসছেন?
হাসতে হাসতে আমার চোখে পানি এসে গেল, কোনোমতে নিজেকে থামাতে পারছি না। সায়রা ধমক দিয়ে বলল, কেন আপনি হাসছেন?
আমি হাসতে হাসতে বললাম, হি হি হি-আপনার চোখ!
আমার চোখ?
হ্যাঁ, মনে হয় ইঁদুরের চোখ। কুতকুত করে তাকিয়ে আছেন। হি হি হি।
সায়রা কঠিন মুখ করে বলল, আমি কুতকুত করে তাকিয়ে আছি?
হ্যাঁ। আমি কোনোমতে হাসি আঁটকে বললাম, আপনার চোখ দেখলে কী মনে হয় জানেন?
কী?
কেউ যেন দুইটা তরমুজের বিচি লাগিয়ে দিয়েছে। কালো কালো দুইটা বিচি। হি হি হি
সায়রার মুখ এবারে রাগে লাল হয়ে গেল এবং তখন তাকে দেখে আমার হঠাৎ করে পাকা টম্যাটোর কথা মনে পড়ে গেল। আমি অনেক কষ্ট করে হাসি থামিয়ে রাখলাম। সায়রা পাথরের মতো মুখ করে বলল, আপনাকে নিয়ে কাজ করা খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে জাফর ইকবাল সাহেব। আপনি কোনোরকম সাহায্য তো করছেনই না শুধু আমাকে অপমান করার চেষ্টা করছেন।
আর করব না। আর করব না সায়রা। খোদার কসম। হাত দুটো খোলা থাকলে দুই হাত জোড় করে আপনার কাছ থেকে মাফ চাইতাম।
ঠিক আছে। এবারে একটু মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করেন। আপনার অনুভূতিটি কী বোঝার চেষ্টা করে আমাকে বলার চেষ্টা করুন। বুঝেছেন কী বলেছি?
বুঝেছি। একেবারে জলবৎ তরলং।
এইবারে পাওয়ার আরেকটু বাড়িয়ে দিচ্ছি। চৌদ্দ ডিবি থেকে বাড়িয়ে একেবারে বিশ ডিবি। কেমন লাগছে এখন?
আমি কোনো কথা না বলে অনেক কষ্ট করে হাসি আটকে রাখার চেষ্টা করলাম। হঠাৎ করে আমার মনে হতে লাগল, সায়রার থুতনিতে যদি ছাগলের মতো একগোছ দাড়ি থাকত তা হলে কী হত? ব্যাপারটা মাথা থেকে যতই সরিয়ে রাখার চেষ্টা করি না কেন তাতে যেন কোনো লাভ হল না-দৃশ্যটা বারবার আমার চোখের সামনে ভাসতে লাগল এবং আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে হঠাৎ করে হাসিতে গড়িয়ে পড়লাম। সায়রার চোখ দিয়ে এবারে একেবারে আগুন বের হতে লাগল-সে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, এবারে আমার কোন জিনিসটা দেখে হাসছেন?
আমি হাসি থামিয়ে বললাম, সেটা শুনলে আপনিও হাসতে হাসতে গড়াগড়ি যাবেন।
তাই নাকি? সায়রা ঠাণ্ডা গলায় বলল, শুনি ব্যাপারটা।
আপনার থুতনিতে যদি ছাগলের মতো একটু দাড়ি থাকত তা হলে কী কাণ্ড হত চিন্তা করতে পারেন? এরকম হাসির একটা ব্যাপার শুনেও সায়রা একটুও হাসল না–কিন্তু আমি হাসির দমকে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলাম।
সায়রা খানিকক্ষণ আমার দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, বেশ! আপনি যদি ঠিক করে থাকেন আমাকে সাহায্য করবেন না তা হলে তাই হোক। আপনি যদি আপনার অনুভূতিটা বলতে না চান তা হলে বলবেন না। সায়রার নাকের পাটা ফুলে উঠল, চোখ থেকে আগুন বের হতে লাগল, দাতে দাঁত ঘষে বলল, আপনাদের মতো মানুষের সাহায্য ছাড়াই আমি আমার রিসার্চ চালিয়ে যাব। আমি আমার স্টিমুলেটর বন্ধ করে দিচ্ছি আপনি আপনার বাসায় যান।
সায়রার রাগ হয়ে কথা বলার ভঙ্গিটা এত মজার যে হাসিতে আমার পেট ফেটে যাচ্ছিল। আমি দেখলাম সার্কাসের জোকারদের মতো সে তার যন্ত্রের হ্যান্ডেলটা টেনে ধরে স্টিমুলেটরের পাওয়ার বন্ধ করে দিল। মুহূর্তে আমার সমস্ত হাসি থেমে গেল। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম-মানুষ কত বড় গাধা হলে আমার মতন এরকমভাবে বোকার মতো। হাসতে পারে? শুধু কি হাসি-নির্বোধের মতো সায়রার চেহারা নিয়ে কী সব বলেছি? আমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? আমি ফ্যালফ্যাল করে সায়রার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
সায়রা আমার কাছে এসে আমার হাতের বাঁধন খুলতে খুলতে বলল, আপনাকে এখানে আসতে বলাটাই আমার অন্যায় হয়েছে। শুধু বলবেন আপনার স্বাদের অনুভূতিটি কী, ঝাল না মিষ্টি, টক না তেতো, কিন্তু তা না করে আমার চেহারা নিয়ে টিটকারি মারতে লাগলেন।
আমার লজ্জায় মাথা কাটা যেতে লাগল। আমি কেমন করে এরকম আজেবাজে কথা বলতে পারলাম? সায়রার নাক তো এমন কিছু চ্যাপ্টা নয়, চোখগুলোও বেশ সুন্দর। অথচ একটু আগে একেবারে গাধার মতো সেগুলো নিয়ে হাসাহাসি করেছি। কী লজ্জা! কী। লজ্জা!
লজ্জার ব্যাপারটা বিশ্লেষণ করতে গিয়েই হঠাৎ করে পুরো ব্যাপারটা আমার পরিষ্কার হয়ে গেল। সায়রার এই যন্ত্র স্টিমুলেশন দিয়ে ঝাল মিষ্টি স্বাদ নয়-আমার হাসির ব্যাপারটা বের করে এনেছে। কী আশ্চর্য! এই সহজ জিনিসটা আমি বুঝতে পারছি না, সায়রাও বুঝতে পারে নি। আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম, সায়রা!
সায়রা একেবারে আইসক্রিমের মতো ঠাণ্ডা গলায় বলল, বলুন।
আপনি বুঝতে পেরেছেন, কী হয়েছে?
হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি। আমার নাকের ওপর দিয়ে দেড়টনি ট্রাক চলে গেছে। আমার চোখগুলো ইঁদুরের মতো কুতকুতে আর আমার থুতনিতে একগোছা ছাগল দাড়ির খুব দরকার।
না না, না না। আমি প্রবল বেগে মাথা নেড়ে বললাম, আপনার এই যন্ত্র এটা করেছে। আমাকে হাসাতে শুরু করেছে। তুচ্ছ কারণে হাসি। অকারণে হাসি। পাগলের মতো হাসি!
সায়রা খানিকক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি সত্যি বলছেন? আপনি আমার সাথে কোনো ধরনের মশকরা করছেন না?
আপনার সঙ্গে কেন আমি মশকরা করব? সত্যিই এটা হয়েছে।
ধীরে ধীরে হঠাৎ করে সায়রার মুখ একেবারে টিউবলাইটের মতো জ্বলে উঠল, চোখ বড় বড় করে বলল, তার মানে আমার ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর দিয়ে মানুষের সবরকম অনুভূতি তৈরি করে দিতে পারব। হাসি কান্না রাগ ভালবাসা
হ্যাঁ। আমি মাথা নাড়লাম, সুখ দুঃখ জ্বালা যন্ত্রণা।
সায়রা বলল, ন্যায় এবং অন্যায়। সৎ এবং অসৎ।
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, সত্যি? সৎ মানুষকে অসৎ অসৎ মানুষকে সৎ বানাতে পারবেন?
সায়রা টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, অবশ্যই পারব। অবশ্যই!
আমি ভেবেছিলাম সায়রা একটু বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলছে, কিন্তু সে যে সত্যি কথা বলছে। সেটা কয়দিন পরেই আমি টের পেয়েছিলাম।
.
পরের একমাস আমি সায়রার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখলাম। আমি হচ্ছি তার গিনিপিগ, আমি যদি যোগাযোগ না রাখি কেমন করে হবে? অনেক সময় নিয়ে ঘেঁটেঘুঁটে সে আমার মস্তিষ্কের সবকিছু বের করে ফলল। যেমন আমার মস্তিষ্কের একটা জায়গা আছে, সেখানে স্টিমুলেশন দিলে কেমন জানি কান্না পেতে থাকে। তখন আমার সারা জীবনের সব দুঃখের কথাগুলো মনে পড়ে গেল, সেই ছোটবেলায় একটা ফুলদানি ভেঙেছিলাম বলে আমার মা কানে ধরে একটা চড় মেরেছিলেন, সেই কথাটা মনে পড়ে বুকটা প্রায় ভেঙে যাবার মতো অবস্থা হল। পাওয়ার একটু বাড়িয়ে দিতেই আমি এত বড় ধাড়ি মানুষ ভেউভেউ করে কেঁদে ফেললাম-জিনিসটা একটা বৈজ্ঞানিক গবেষণার ব্যাপার, তা না হলে তো লজ্জাতেই মাথা কাটা যেত! কান্না পাবার অংশের কাছাকাছি আর একটা জায়গাতে স্টিমুলেশন দিতেই বুকের ভেতরে কেমন যেন ভালবাসার জন্ম হয়। বিল্টুর জন্য ভালবাসা, অফিসের বড় সাহেবের জন্য ভালবাসা, সায়রার জন্য ভালবাসা, এমনকি গত রাতে মশারির ভেতরে ঢুকে পড়া যে বেয়াদব মশাটাকে রাত দুটোর সময় মারতে হয়েছিল সেটার জন্যও কেমন যেন ভালবাসা এবং মায়া হতে থাকে।
অনুভূতির এইসব জটিল জায়গা থেকে সরে যাবার পর সায়রা আমার মস্তিষ্কের সৃজনশীল জায়গাগুলো বের করে ফেলল। সেখানে এক জায়গায় স্টিমুলেশন দিতেই আমার ভেতরে একটা চিত্রশিল্পীর জন্ম হয়ে গেল। কাগজে একটা ছবি আঁকার জন্য হাত নিশপিশ করতে শুরু করল। বন্ধুর পাল্লায় পড়ে একবার চিত্রপ্রদর্শনীতে গিয়ে যে আধুনিক পেইন্টিংগুলোর মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝি নি হঠাৎ করে সেটার অন্তর্নিহিত অর্থ আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। মস্তিষ্কের এই এলাকার কাছাকাছি নিশ্চয়ই কবিতা লেখার ব্যাপারটি আছে, সেখানে স্টিমুলেশন দিতেই আমার মাথার মাঝে কবিতা গুড়গুড় করতে লাগল। সত্যি কথা বলতে কি, আমি সায়রার দিকে তাকিয়ে মুখে মৃদু মৃদু হাসি নিয়ে বললাম-
হে সায়রা
তোমার আবিষ্কার
যেন আকাশের পায়রা
.
আমার নিজেকে একেবারে কবি কবি মনে হতে লাগল। দাড়ি না কামিয়ে চুল লম্বা। করার জন্য হঠাৎ করে ভেতর থেকে কেমন যেন চাপ অনুভব করতে থাকলাম।
মস্তিষ্কের মাঝে কবিতার এলাকার খুব পাশেই নিশ্চয়ই গানের এলাকা। সেখানে স্টিমুলেশন দিতেই আমার গান গাইবার জন্য গলা খুশখুশ করতে লাগল। বেসুরো গান নয়, একেবারে তাল-লয়-ছন্দ মিলিয়ে গান। গুনগুন করে দুই লাইন গেয়েও ফেলেছিলাম কিন্তু তার আগেই সায়রা মাথার মাঝে জায়গা পাল্টে দিল।
ছবি, কবিতা এবং গানের কাছাকাছি জায়গায় আমার অঙ্কের এলাকাটা পাওয়া গেল। সেখানে স্টিমুলেশন দিতেই আমি জীবনের এই প্রথমবার বুঝতে পারলাম যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগ মিলিয়ে বিদঘুটে এবং জটিল অঙ্ককে কেন সরল অঙ্ক বলে! শুধু তাই না, বানরের তেল মাখানো একটা বাঁশ বেয়ে ওঠা এবং পিছলে পড়ার একটা অঙ্ক আছে যেটা আমি আগে কখনোই বুঝতে পারি নি–সেই অঙ্কটা হঠাৎ করে আমার কাছে পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। আমার মস্তিষ্কের এই জায়গায় ভালোমতো স্টিমুলেশন দিলে আমি নিশ্চয়ই ল. সা. গু. গ. সা. গু. ব্যাপারটাও বুঝে ফেলতাম কিন্তু সায়ার তার আর চেষ্টা করল না।
মস্তিষ্কের এরকম মজার মজার জায়গা খুঁজে বের করার সাথে সাথে কিছু বিপজ্জনক জায়গাও বের হল। তালুর কাছাকাছি একটা জায়গায় স্টিমুলেশন দিতেই আমি হঠাৎ করে এত ভয় পেয়ে গেলাম যে আর সেটা বলার মতো নয়। সায়রার ল্যাবরেটরিটিকে মনে হতে লাগল একটা অন্ধকার গুহা, সায়রাকে মনে হতে লাগল একটা পিশাচী। তার চোখের দিকে আমি তাকাতে পারছিলাম না। মনে হতে লাগল, সে বুঝি এক্ষুনি আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গলার রগ কামড় দিয়ে সব রক্ত শুষে খেয়ে ফেলবে। ভয় পেয়ে আমি যা একটা চিৎকার। দিয়েছিলাম সেটা আর বলার মতো নয়। ব্যাপারটা টের পেয়ে সায়রা সাথে সাথে পাওয়ার বন্ধ করে আমার জান বাঁচিয়েছে।
মাথার সামনের দিকে একটা অংশে স্টিমুলেশন দিতেই আমি কেমন জানি অসৎ হয়ে গেলাম। গালকাটা বক্কর, তালুছোলা ফাক্ এরকম সব সন্ত্রাসী, পাজি সাংসদ আর অসৎ মন্ত্রীদের কেমন জানি নিজের মানুষ বলে মনে হতে লাগল! সায়রাকে একটা চেয়ারের সাথে বেঁধে কীভাবে তার বাসার সবকিছু খালি করে নিয়ে ধোলাইখালে বিক্রি করে দেওয়া যায় তার একটা পরিষ্কার পরিকল্পনা আমার মাথায় চলে এল। শুধু তাই না, আমার মনে হতে লাগল খামকা কাজকর্ম করে সময় নষ্ট না করে একটা ব্যাংক ডাকাতি করলে মন্দ হয় না। কোথা থেকে সস্তায় সেজন্য অস্ত্র কেনা যাবে সেই ব্যাপারটাও মাথার মাঝে চলে এল। এতদিন কেন। চুরিচামারি করি নি-সেটা ভেবে কেমন যেন দুঃখ দুঃখ লাগতে লাগল। আরো বেশি সময় স্টিমুলেশন দিলে কী হত কে জানে, কিন্তু সায়রা হ্যান্ডেল টেনে পাওয়ার কমিয়ে আনল।
তবে আমার মস্তিষ্কের সবচেয়ে ভয়ংকর জায়গাটা ছিল মাথার তালু থেকে একটু ডানদিকে। সায়রা যখন আমার এই জায়গাটা বের করে স্টিমুলেশন দিয়েছে তখন হঠাৎ করে। আমার কেমন জানি রাগ উঠতে থাকে। কেন ফ্যানটা ঘুরছে সেটা নিয়ে রাগ, কেন আমি ডেন্টিষ্টের চেয়ারের মতো চেয়ারে আধশোয়া হয়ে আছি সেটা নিয়ে রাগ, কেন মাথায় হেলমেটের মতো এই জিনিসটা সেটা নিয়ে রাগ, সায়রা কেন যন্ত্রপাতির সামনে বসে আছে সেটা নিয়ে রাগ। শুধু তাই নয়-হঠাৎ করে একটা টিকটিকি ডেকে উঠল আর আমি সেই টিকটিকির ওপরে এমন রেগে উঠলাম যে বলার মতো নয়। আমি যে রেগে উঠেছি সায়রা সেটা বুঝতে পারে নি। সে হ্যান্ডেল টেনে পাওয়ারটা একটু বাড়িয়ে দিল। সাথে সাথে আমি রাগে একেবারে অন্ধ হয়ে গেলাম। কী করছি বুঝতে না পেরে আমি আঁ আঁ করে চিৎকার করে সায়রার গলা টিপে ধরার জন্য ছুটে গেলাম। ভাগ্যিস সায়রা হ্যান্ডেল টেনে পাওয়ার কমিয়ে দিল, তা না হলে কী যে হত চিন্তা করেই হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়! কে জানে হয়তো খুনের দায়ে বাকি জীবনটা জেলখানাতেই কাটাতে হত!
যাই হোক শেষ পর্যন্ত মাসখানেক পরে যন্ত্রটা যখন শেষ হল সেটা দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। একটা বাক্সের মতো জিনিসে সব ধরনের ইলেকট্রনিক্স, সেখান থেকে একটা মোটা তার গিয়েছে লাল রঙের একটা হেলমেটে। হেলমেটটা মাথায় দিলে খুব হালকা টুংটাং একটা বাজনা শোনা যায়। এই যন্ত্রটা কন্ট্রোল করার জন্য টিভির রিমোট কন্ট্রোলের মতো একটা জিনিস, সেখানে লেখা আছে, হাসি, রাগ, ভালবাসা, কবিত্ব ভাব এই ধরনের কথাবার্তা। নির্দিষ্ট সুইচটা টিপে ধরলেই হেলমেট পরা মানুষের মাথায় সেই অনুভূতিগুলো আমার মস্তিষ্ক ব্যবহার করে বের করা হয়েছে চিন্তা করেই গর্বে আমার বুক দশ হাত ফুলে উঠতে লাগল।
সবকিছু দেখে আমি সায়রাকে বললাম, এই আবিষ্কারের কথাটা খবরের কাগজে দিতে হবে।
খবরের কাগজে?
হ্যাঁ। আমি একগাল হেসে বললাম, বড় করে একটা রঙিন ছবি থাকবে। আমি হেলমেট পরে হাসিমুখে বসে আছি, পাশে আপনি যন্ত্রের হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। নিচে ব্যানার হেডলাইন-
বাঙালি মহিলার যুগান্তকারী আবিষ্কার–
মানুষের অনুভূতি এখন হাতের মুঠোয়।
সায়রা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি এতটুকু নিরুৎসাহিত না হয়ে বললাম, ভেতরে লেখা থাকবে, বাঙালি মহিলার যুগান্তকারী আবিষ্কারের কারণে এখন মানুষের অনুভূতি হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারে তার অন্যতম সহযোগী বিজ্ঞানের জন্য নিবেদিতপ্রাণ, নিস্বার্থ, জনদরদি, সাহসী, অকুতোভয়, স্বেচ্ছাসেবক মুহম্মদ জাফর ইকবাল!
সায়রা মাথা নেড়ে বলল, আপনার নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়েছে। খবরের কাগজের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই-এইসব খবর ছাপবে! এক্সপেরিমেন্ট করার সময় যদি কোনোভাবে আপনার ব্রেন সিদ্ধ হয়ে যেত তা হলে হয়তো ছাপাত!।
আমি বললাম, কে জানে, হয়তো খানিকটা সিদ্ধ হয়েছে।
সায়রা উদাস মুখে বলল, হয়তো হয়েছে। আপনি যখন থুথুড়ে বুড়ো হবেন তখন বোঝা যাবে। ততদিনে সেটা তো আর খবর থাকবে না!
আমি মাথা নেড়ে বললাম, আপনি যাই বলেন না কেন–আমার মনে হয় এটা গরম। একটা খবর হতে পারে।
সায়রা মাথা নেড়ে বলল, বিজ্ঞানের আবিষ্কারের খবর, খবরের কাগজে ছাপানোর কথা -সেটা ছাপানোর কথা জার্নালে!
কথাটা আমার একেবারেই পছন্দ হল না, ছোট ছোট টাইপে লেখা খটমটে বিজ্ঞানের ভাষায় লেখা জিনিস জার্নালে ছাপা হলেই কি, আর না হলেই কি? জার্নালে ছাপালে নিশ্চয়ই আমার ছবি ছাপা হবে না। আমি বললাম, জার্নালে-ফার্নালে না, এটা খবরের কাগজেই ছাপাতে হবে, তার সাথে টেলিভিশনে একটা সাক্ষাৎকার।
আমি খুব একটা হাস্যকর কথা বলেছি-সেরকম ভান করে সায়রা হি হি করে হাসতে শুরু করল।
আমি অবশ্য হাল ছাড়লাম না, পরদিন কাজে লেগে গেলাম।
.
প্রথমে যে খবরের কাগজের সম্পাদক আমার সাথে দেখা করতে রাজি হলেন তাকে দেখে আমি ঘাবড়ে গেলাম মাথায় বিশাল পাগড়ি এবং প্রায় দেড়ফুট লম্বা দাড়ি। দাড়ি একসময় সাদা ছিল, এখন মেহেদি দিয়ে টকটকে লাল। আমি যখন ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে শুরু করলাম, ভদ্রলোক আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, কী বললেন? মহিলা সায়েন্টিস্ট? নাউজুবিল্লাহ!
আমি বললাম, নাউজুবিল্লাহ কেন হবে? মেয়েরা কি সায়েন্টিস্ট হতে পারে না? হাদিসে আছে-
পুরুষ এবং মহিলার পড়াশোনা নিয়ে হাদিসটা সম্পাদক সাহেব শুনতে রাজি হলেন না। বললেন, আমাদের পত্রিকা চলে মিডলইস্টের টাকাতে। সেই দেশের মেয়েরা ভোট দিতে পারে না-আর আমি লিখব মহিলা সায়েন্টিষ্টের কথা? আমার রুটিরুজি বন্ধ করে দেব? আমার মাথা খারাপ হয়েছে?
কাজেই আমাকে অন্য একটি পত্রিকা অফিসে যেতে হল। সম্পাদক সাহেব আমার সব কথা শুনে অনেকক্ষণ সরু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, কোন পার্টি?
আমি থতমত খেয়ে বললাম, কোন পার্টি মানে?
মানে কোন পার্টি করে? আমাদের এইটা পার্টির পত্রিকা। আমাদের পার্টি না হলে ছাপানো যাবে না।
কিন্তু সে তো পার্টি করে না।
গুড! আজকেই তা হলে পার্টির মেম্বার হয়ে যেতে বলুন। মহিলা শাখা আছে, তাদের মিটিং-মিছিলে যেতে হবে কিন্তু
সম্পাদক সাহেব আরো অনেক কিছু বলতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু আমার আর শোনার সাহস হল না। তাড়াতাড়ি চলে এলাম।
এর পরের পত্রিকার সম্পাদকের সাথে দেখা করার জন্য অনেক ঘোরাঘুরি করতে হল। শেষ পর্যন্ত যখন দেখা হল, ভদ্রলোক আমার কথা শোনার সময় সারাক্ষণ একটা ম্যাচের কাঠি দিয়ে দাঁত খুঁটতে লাগলেন। আমার কথা শেষ হবার পর বললেন, ভালো একটা নিউজ হতে পারে।
আমি উৎসাহ পেয়ে বললাম, আরো অনেক আবিষ্কার আছে। সব শুনলে আপনারা অবাক হয়ে যাবেন।
সম্পাদক সাহেব আরেকটা ম্যাচের কাঠি বের করে কান চুলকাতে চুলকাতে বললেন, তবে আমাদের পত্রিকা তো ট্যাবলয়েড, আমরা একটু রগরগে জিনিস ছাপাতে পছন্দ করি। পাবলিক ভালো খায়, পত্রিকা বেশি বিক্রি হয়।
রগরগে?
হ্যাঁ। নিউজটা ইন্টারেস্টিং করার জন্য খবরটা একটু রগরগে করতে হবে। কিছু স্ক্যান্ডাল ঢোকাতে হবে।
আমি অবাক হয়ে মুখ হাঁ করে বললাম, স্ক্যান্ডাল?
হ্যাঁ। খুঁজলেই পাওয়া যায়। ভদ্রলোক কান চুলকানো বন্ধ করে খুব মনযোগ দিয়ে ম্যাচের কাঠিটা পর্যবেক্ষণ করে বললেন, আর না থাকলে ক্ষতি কী? আমরা বানিয়ে বসিয়ে দেব। পাবলিক কপ কপ করে খাবে।
পত্রিকার খবর আমি এতদিন পড়ার জিনিস বলে জানতাম, এখানে এসে শুনছি সেটা খাবার জিনিস। আরো নতুন জিনিস শেখার একটা সুযোগ ছিল কিন্তু স্ক্যান্ডাল বানানো নিয়ে সম্পাদক সাহেবের উৎসাহ দেথে আমার আর থাকার সাহস হল না। বিদায় না নিয়েই সরে এলাম।
এর পরে অনেক খোঁজখবর করে যে পত্রিকা অফিসে গেলাম সেটার নাম দৈনিক মোমের আলো। এই পত্রিকায় আমার একটা চিঠি ছাপা হয়েছিল বলে আমার ধারণা পত্রিকার ওপর আমার একটু দাবিও আছে। সম্পাদক সাহেব খুব ব্যস্ত আমি কথা শুরু করতেই বললেন, বিজ্ঞানের আবিষ্কারের ওপর খবর?
হ্যাঁ। খুব সাংঘাতিক আবিষ্কার
সম্পাদক সাহেব হা হা করে হেসে বললেন, আমি তো বিজ্ঞানের ব-ও জানি না, তাই আবিষ্কারের মাথামুণ্ডু কিছু বুঝব না। তবে
তবে কী?
আমাদের বিজ্ঞানের পাতা দেখার জন্য আমরা ইউনিভার্সিটির একজন প্রফেসরের সাথে যোগাযোগ রাখি। সেই প্রফেসর সাহেব এইসব ব্যাপারগুলো দেখে দেন। সবচেয়ে ভালো হয় আপনি যদি আগে এই প্রফেসরের সাথে দেখা করেন।
কী নাম প্রফেসরের?
এস প্রফেসর এম. জি. আলী।
আমি প্রফেসর এম. জি, আলীর বাসার ঠিকানা নিয়ে এলাম–তার ভালো নাম মোল্লা গজনফর আলী। ইউনিভার্সিটির মাস্টার কিন্তু মনে হল ঢাকা শহরের সব স্কুল-কলেজ-ট্রেনিং সেন্টারে পড়ান। অনেক কষ্ট করে তাকে একদিন টেলিফোনে ধরতে পারলাম। কী জন্য ফোন করেছি বলার পর গজনফর আলী বললেন, বুঝতেই পারছেন, মোমের আলো এত বড় একটা পত্রিকা তো আর সোজা ব্যাপার না, ইচ্ছা করলেই তো সেখানে কিছু ছাপানো যায় না। আমার কথায় কাজ হয়
আমি বিনয় করে বললাম, সেই জন্যই তো আপনার কাছে ফোন করেছি।
গজনফর আলী বললেন, ফোনে কি আর কাজ হয়? পত্রিকায় ছাপা হলে ন্যাশনাল ব্যাপার হয়ে যায়। বিজনেস কমিউনিটি ইন্টারেস্ট দেখায়-লাখ লাখ টাকার ট্রানজেকশন হতে পারে-হে হে হে-
বাক্য শেষ না করে হঠাৎ করে তিনি কেন হাসলেন বুঝতে পারলাম না। বললাম, আবিষ্কারটা আমি নিয়ে আসব?
আবিষ্কার কি নিয়ে আসার জিনিস? যেটা আনলে কাজ হবে সেটা নিয়ে আসেন। একটা পেটমোটা এনভেলপ। হে হে হে।
গজনফর আলী কেন এনভেলপের কথা বললেন আর আবার কেন হাসলেন আমি বুঝতে পারলাম না। বললাম, যিনি আবিষ্কার করেছেন তাকে সহ নিয়ে আসব?
আপনি মনে হয় বুঝতে পারছেন না। গজনফর আলী একটু অধৈর্য হয়ে বললেন, আমি আপনাকে দেখব। আপনি আমাকে দেখবেন। এইটা দুনিয়ার নিয়ম। বুঝেছেন?
জি জি বুঝেছি। আমি কালকেই আপনার বাসায় চলে আসব তখন আপনি আমাকে দেখবেন আমিও আপনাকে দেখব। সামনাসামনি দেখে পরিচয় হবে।
ঠিক বুঝতে পারলাম না কেন জানি গজনফর আলী হঠাৎ করে আমার ওপর খুব বিরক্ত হয়ে উঠলেন। আমি অবিশ্যি কিছু মনে করলাম না-গরজটা যখন আমার কিছু তো সহ্য করতেই হবে! মোল্লা গজনফর আলীকে যদি নরম করতে পারি তা হলেই পত্রিকায় একটা ছবি ছাপানো যাবে। সারা জীবনের শখ পত্রিকায় একটা ছবি ছাপানো কাজেই আমি তার বিরক্তিটা হজম করে নিলাম।
তবে ঝামেলাটা হল সম্পূর্ণ অন্য জায়গায়-সায়রা বেঁকে বসল। মাথা নেড়ে বলল, আমি কোথাও যেতে পারব না।
না গেলে কেমন করে হবে? পত্রিকায় একটা নিউজ করতে চাইলে একটু কষ্ট করতে হবে না?
আমি কি খুন করেছি না মার্ডার করেছি যে পত্রিকায় নিউজ হতে হবে?
কী বলছেন আপনি? আমি কাঁদো কাঁদো হয়ে বললাম, এই একটা সুযোগ, পত্রিকায় আপনার সাথে আমার একটা ছবি ছাপা হত দশজনকে দেখাতাম।
সায়রা মুচকি হেসে বলল, আপনার যখন এত শখ ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর নিয়ে আপনি চলে যান।
আমি? সায়রা ঠাট্টা করছে কি না আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না, বললাম, আমি যন্ত্রটার নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করতে পারি না আর আমি সেটা নিয়ে যাব?
আপনাকে আমি সব শিখিয়ে দিচ্ছি। কেমন করে চালায় সেটাও শিখিয়ে দেব।
আমি এখনো নিজে নিজে টেলিভিশন চালাতে পারি না
সায়রা হেসে বলল, ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর চালানো টেলিভিশন চালানো থেকে সোজা!
যন্ত্রপাতিকে আমি খুব ভয় পাই-কিছুতেই আমি রাজি হতাম না, কিন্তু পত্রিকায় ছবি ছাপা হবে ব্যাপারটা আমাকে এমনভাবে পেয়ে বসেছে যে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেলাম।
.
গজনফর আলীর বাসার বাইরে থেকেই ভেতরে একটা তুলকালাম কাণ্ড হচ্ছে বলে মনে হল, একজন মহিলা খনখনে গলায় বলল, তোমার সাথে বিয়ে হয়ে আমার জীবন বরবাদ হয়ে গেছে। আমার বাবা যদি হাত-পা বেঁধে পানিতে ফেলে দিত তা হলেই আমি ভালো থাকতাম।
শুনতে পেলাম গজনফর আলী বলছেন, তোমাকে না করেছে কে? হাত-পা বেঁধে এখন নদীতে লাফাও না কেন? আমার জানে তা হলে পানি আসে।
কী? যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা? তুমি জান আমার বাবার ড্রাইভারের বেতন তোমার থেকে বেশি?
গজনফর আলী বললেন, শুধু বেতন কেন? সবকিছুই তো বেশি।
মহিলা খনখনে গলায় বললেন, কী বলতে চাইছ তুমি?
বলতে চাইছি যে তোমার মায়ের ওজন চিড়িয়াখানার হাতির ওজনের থেকে বেশি। তোমার ওজন
গজনফর আলী কথা শেষ করতে পারলেন না মনে হল তাকে কিছু একটা আঘাত করল। আরো বেশি সময় অপেক্ষা করলে অবস্থা আরো খারাপ হতে পারে তাই আমি কলিংবেলটা চেপে ধরলাম। ভেতরে হইচই এবং তুলকালাম কাণ্ড হঠাৎ করে থেমে গেল। গজনফর আলী নাকি গলায় বললেন, কে?
আমি।
আমি কে?
ঐ যে কালকে যে আবিষ্কার নিয়ে কথা বলেছিলাম সেটা নিয়ে এসেছি।
মনে হল ভেতরে কেউ গজগজ করে নিচু স্বরে কথা বলল, তারপর দরজা খুলে দিল। প্রফেসর গজনফর আলী একটা রুমাল দিয়ে নাক চেপে দাঁড়িয়ে আছেন। নাকের ওপর একটা আঘাত এসেছে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। পাশের ভদ্রমহিলা নিশ্চয়ই তার স্ত্রী সাইজে গজনফর আলীর দ্বিগুণ। ভদ্রলোকের সাহস আছে মানতে হয়, তা না হলে কেউ এরকম একজন স্ত্রীর সাথে এভাবে ঝগড়া করে?
গজনফর আলী রুমাল দিয়ে নাক চেপে ধরে নাকি গলায় বললেন, যেটা আনতে বলেছি সেটা এনেছেন?
না, মানে ইয়ে-সায়েন্টিস্ট? তিনি আসতে রাজি হলেন না, আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
গজনফর আলী খুব বিরক্ত হয়ে বললেন, আমি কি সায়েন্টিস্টের কথা বলেছি? আমি এনভেলপের কথা বলছি। আপনাদের দিয়ে কোনো কাজ হবে না, শুধু শুধু আমাদের সময় নষ্ট করেন।
আমি থতমত খেয়ে বললাম, একবার এই যন্ত্রটা দেখেন! এটার নাম হচ্ছে ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর
আমাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে গজনফর আলী বললেন, এটা ছাতামাতা যাই হোক আপনি রেখে যান। আমি দেখে নেব।
আপনি নিজে নিজে দেখতে পারবেন না। কীভাবে কাজ করে দেখিয়ে দিই।
গজনফর আলী মুখ বাঁকা করে বললেন, একটা সিস্টেম কীভাবে কাজ করে সেটা আপনি জানেন না–আর আপনি আমাকে এই যন্ত্র কীভাবে কাজ করে সেটা শিখাবেন?
আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ মুখ ফসকে বলে ফেললাম, আপনাদের ফ্যামিলির জন্য এটা খুব দরকারি হতে পারত
গজনফর আলী নাক থেকে রুমাল সরিয়ে বললেন, আপনি কী বলতে চাচ্ছেন?
না মানে ইয়ে-বলছিলাম কী, বাইরে থেকে শুনেছিলাম দুইজনে ঝগড়া করছিলেন।
এবারে গজনফর আলীর স্ত্রী হাত মুষ্টিবদ্ধ করে এক পা এগিয়ে এসে বললেন, আপনার এত বড় সাহস? দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আমাদের ব্যক্তিগত কথা শোনেন?
আমি কাঁচুমাচু হয়ে বললাম, আসলে চোখের যেরকম পাতি আছে কানের তো সেটা নেই। তাই চোখের পাতি ফেলে দেখা বন্ধ করে ফেলা যায়, কিন্তু শোনা তো বন্ধ করা যায় না
তাই বলে আপনি
আমি বাধা দিয়ে বললাম, কিন্তু এই যন্ত্রটা ব্যবহার করে দেখেন আপনাদের ঝগড়াঝাটি বন্ধ হয়ে যাবে।
গজনফর আলীর স্ত্রী চোখ ছোট ছোট করে বললেন, কীভাবে সেটা সম্ভব হবে? তিনি গজনফর আলীকে দেখিয়ে বললেন, এই চামচিকে যে বাসায় থাকে সেই বাসায় কি ঝগড়াঝাটি বন্ধ হতে পারে?
গজনফর আলী হাত নেড়ে বললেন, মুখ সামলে কথা বলল, না হলে কিন্তু খুনোখুনি হয়ে যাবে
কী? তুমি আমাকে খুন করবে? তোমার এত বড় সাহস?
আবার দুজনের মধ্যে একটা হাতাহাতি ব্রু হতে যাচ্ছিল, আমি কোনোমতে থামালাম। বললাম, ঝগড়া না করে এই যন্ত্রটা ব্যবহার করে দেখেন।
গজনফর আলীর স্ত্রী বললেন, কী হবে এই যন্ত্রটা ব্যবহার করলে?
আমি রিমোট কন্ট্রোলের মতো জিনিসটা দেখিয়ে বললাম, এই যে দেখছেন এখানে লেখা আছে ভালবাসা–এই বোতামটা টিপলেই আপনার হাজব্যান্ডের জন্যে ভালবাসা হবে।
বোতাম টিপলেই?
আগে যন্ত্রটার পাওয়ার অন করে এই হেলমেটটা পরে নিতে হবে।
তা হলেই এই চামচিকার জন্য আমার ভালবাসা হবে?
হ্যাঁ।
তারপরে যে ঘটনাটা ঘটল আমি সেটার জন্যে প্রস্তুত ছিলাম না। হঠাৎ করে ভদ্রমহিলা হি হি করে হাসতে হাসতে একেবারে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। হাসতে হাসতে প্রথমে তার চোখে পানি এসে গেল এবং শেষের দিকে তার হেঁককি উঠতে লাগল। কোনোমতে বললেন, এই চামচিৎকার জন্য ভালবাসা? যাকে দেখলেই মনে হয় ছারপোকার মতো টিপে মেরে ফেলি, তার জন্য ভালবাসা? যার চেহারাটা ছুঁচোর মতো, স্বভাবটা চিৎকার মতো তার জন্য ভালবাসা? হি হি হি।
আমি কী করব বুঝতে পারলাম না, বলা যেতে পারে বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। গজনফর আলীর স্ত্রী হাসতে হাসতে মনে হয় একসময় ক্লান্ত হয়ে সোফার মাঝে বসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিক আছে! লাগান আমার মাথায়, দেখি এটা কী করে?
গজনফর আলী খুব রাগ রাগ চোখে আমার দিকে আর তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি তার মাঝেই ভয়ে ভয়ে যন্ত্রটার সুইচ অন করে হেলমেটটা গজনফর আলীর স্ত্রীর মাথায় পরিয়ে দিলাম। তারপর কন্ট্রোলটা হাতে নিয়ে হালকাভাবে ভালবাসা বোতামটিতে চাপ দিলাম।
এতক্ষণ গজনফর আলীর স্ত্রীর মুখে এক ধরনের তাচ্ছিল্য আর ঘৃণার ভাব ছিল, বোতামটা টিপতেই সেটা সরে গিয়ে তার মুখটা কেমন জানি নরম হয়ে গেল। গজনফর আলীও তার স্ত্রীর নরম মুখটা দেখে কেমন জানি অবাক হয়ে গেলেন।
আমি বোতামটা আরো একটু চাপ দিয়ে মস্তিষ্কে স্টিমুলেশন আরেকটু বাড়িয়ে দিলাম, সাথে সাথে গজনফরের স্ত্রীর গলা দিয়ে বাঁশির মতো এক ধরনের সুর বের হল, তিনি তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ওগো! তুমি ওরকম মুখ শুকনো করে দাঁড়িয়ে আছ কেন? আমার পাশে এসে বস।
স্ত্রীর গলার স্বর শুনে গজনফর আলী একেবারে হকচকিয়ে গেলেন, কেমন জানি ভয়ের চোখে একবার আমার দিকে আরেকবার তার স্ত্রীর দিকে তাকালেন। তার স্ত্রীর চোখ কেমন জানি ঢুলুঢুলু হয়ে এসেছে, একরকম মায়া মায়া গলায় বললেন, ওগো! তোমার সাথে আমি কত খারাপ ব্যবহার করেছি। কত নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছি! তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও গো!
আমি সুইচ টিপে পাওয়ার আরেকটু বাড়াতেই গজনফর আলীর স্ত্রীর গলা দিয়ে একেবারে মধু ঝরতে লাগল, ওগো গজু। ওগো সোনামণি। ওগো আমার আকাশের চাঁদ আমি কত নিষ্ঠুরের মতন তোমার নাকে ঘুসি মেরেছি। আমার হৃদয়ের টুকরোর ওপর কেমন। করে এই অত্যাচার আমি করতে পারলাম! হাবিয়া দোজখেও তো আমার জায়গা হবে না। আমি কোথায় যাব গো গভু! আমার কী হবে গো গজু!
গজনফরের স্ত্রী এবারে ফ্ল্যাশ ফাঁশ করে কাঁদতে লাগলেন, কাঁদতে কাঁদতে বললেন, বলো আমাকে ক্ষমা করেছ? বলো গো সোনার টুকরা। চাঁদের খনি। তুমি বলো, তা না। হলে আমি তোমার পায়ে মাথা ঠুকে আত্মঘাতী হব। এই জীবন আমি রাখব না কিছুতেই। রাখব না
গজনফর আলীর স্ত্রী সত্যি সত্যি সোফা থেকে উঠে তার স্বামীর পায়ের ওপর আছড়ে পড়তে যাচ্ছিলেন, আমি তাড়াতাড়ি সুইচ থেকে হাত সরিয়ে স্টিমুলেশন বন্ধ করে দিলাম।
গজনফর আলীর স্ত্রী কেমন জানি ভ্যাবাচেকা মেরে সোফায় বসে রইলেন। একবার আমার দিকে তাকান, একবার ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর যন্ত্রের দিকে, আরেকবার তার স্বামী। গজনফর আলীর দিকে তাকান। অনেকক্ষণ পর ফিসফিস করে বললেন, কী আশ্চর্য! কী আচানক ব্যাপার!
আমি তখন মোটামুটি যুদ্ধজয়ের ভঙ্গি করে গজনফর আলীর দিকে তাকিয়ে বললাম, দেখেছেন? এটার নাম হচ্ছে ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর। সায়রা যেসব জিনিস মুখস্থ করিয়ে দিয়েছিল, সেগুলি মুখস্থ বলতে শুরু করলাম। মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট জায়গায় উচ্চ কম্পনের চৌম্বকীয় তরঙ্গ দিয়ে এটার স্টিমুলেশন দেওয়া হয়। স্টিমুলেশন দিয়ে একেক রকম অনুভূতি জাগিয়ে তোলা যায়। যেমন মনে করেন
গজনফর আলী আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, এটা কে তৈরি করেছে?
একজন মহিলা সায়েন্টিস্ট তার নাম হচ্ছে সায়রা সায়েন্টিস্ট।
গজনফর আলী খুব তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে আর যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কী কী অনুভূতি তৈরি করা যায়?
আমি রিমোট কন্ট্রোলের মতো যন্ত্রটা দেখিয়ে বললাম, এই যে দেখেন, এখানে সব লেখা আছে। হাসি কান্না ভালবাসা থেকে শুরু করে রাগ দুঃখ ভয় সবকিছু। আমি তারপর গজনফর আলীকে সাবধান করে দিয়ে বললাম রাগ দুঃখ ভয় এইসব অনুভূতি থেকে খুব সাবধানে থাকতে বিপদ হয়ে যেতে পারে। গজনফর আলী খুব মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনে বললেন, এটা কেমন করে চালায়?
আমি গজনফর আলীকে ট্রান্সক্রেনিয়াল ষ্টিমুলেটর চালানোটা শিখিয়ে দিলাম। গজনফর আলীর চোখ কেমন জানি চকচক করতে লাগল, একটা নিশ্বাস আটকে রেখে বললেন, ঠিক আছে জাফর ইকবাল সাহেব, আপনার যন্ত্রটা আপনি আজকে রেখে যান, আমি দেখি। কালকে আপনি একবার আসেন, তখন ঠিক করা যাবে এটা নিয়ে কী ধরনের রিপোর্ট লেখা যায়।
সায়রা সায়েন্টিস্টের তৈরি এই যন্ত্রটা আমার একেবারেই রেখে যাওয়ার ইচ্ছে করছিল, কিন্তু আমি না করতে পারলাম না। এই মানুষটা না বলা পর্যন্ত দৈনিক মোমের আলো পত্রিকায় রিপোর্ট ছাপা হবে না-আমার ছবি ছাপা হবে না, কাজেই কিছু করার নেই। তবে মোল্লা গজনফর আলী আজকে একেবারে নিজের চোখে এটার কাজ দেখেছেন, কাজেই ভালো একটা রিপোর্ট না লিখে যাবেন কোথায়?
.
পরের দিন অফিস থেকে একেবারে সোজা গজনফর আলীর বাসায় চলে গেলাম। আজকে আর ভেতরে হইচই হচ্ছে না, আমি তাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে কলিংবেল টিপলাম। বেশ কয়েকবার টেপার পর গজনফর আলী দরজা খুললেন। আমাকে দেখে কেমন যেন ভঙ্গি করে বললেন, কাকে চান?
আমি অবাক হয়ে বললাম, আমাকে চিনতে পারছেন না? গতকাল ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর নিয়ে এসেছিলাম!
ও! ও! হঠাৎ মনে পড়েছে সেরকম ভান করে বললেন, ঐ যে খেলনাটা নিয়ে এলেন!
খেলনা? আমি প্রায় আর্তনাদ করে বললাম, খেলনা কী বলছেন? যুগান্তকারী আবিষ্কার।
গজনফর আলী মুখ বাঁকা করে হেসে বললেন, আপনাদের নিয়ে এই হচ্ছে সমস্যা। কোনটা আবিষ্কার আর কোনটা খেলনা তার পার্থক্য ধরতে পারেন না।
কী বলছেন আপনি? আমি অবাক হয়ে বললাম, আপনার স্ত্রীর মাথায় লাগিয়ে পরীক্ষা করলাম আমরা, মনে নাই? আপনাকে ভালবেসে গজু বলে ডাকলেন-।
গজনফর আলী হাত নেড়ে বললেন, ঠাট্টা সব ঠাট্টা। আমার স্ত্রী খুব রসিক, সে ঠাট্টা করছিল, আমাকে বলেছে।
অসম্ভব! আমি গলা উঁচিয়ে বললাম, হতেই পারে না।
গজনফর আলী চোখ পাকিয়ে বললেন, আপনি আমার বাসায় এসে আমার ওপর গলাবাজি করছেন, আপনার সাহস তো কম নয়।
আমি গলা আরো উঁচু করে বললাম, আপনি আমার সাথে মিথ্যা কথা বলবেন আর আমি সেটা সহ্য করব? (স।
গজনফর আলী ঠাণ্ডা গলায় বললেন, আপনি চলে যাবার পর আপনার ঐ খেলনাটা আমি এক ঘণ্টা ধরে পরীক্ষা করেছি। কোনো কাজ করে না। মাঝে মাঝে হালকা টুংটাং শব্দ শোনা যায়। উল্টো হেলমেটের সাইডে ধারালো একটা জিনিসে ঘষা লেগে আমার গাল কেটে গেছে। এই দেখেন…। গজনফর আলী তার গালে একটা কাটা দাগ দেখালেন।
আমি বললাম, মিথ্যা কথা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে শেভ করতে গিয়ে কেটেছে।
শেভ কীভাবে করতে হয় আমি জানি। আপনার জন্মের আগে থেকে আমি শেভ করি। গজনফর আলী চোখ পাকিয়ে বললেন, এই পুরো জিনিসটা হচ্ছে একটা ভাঁওতাবাজি। মানুষকে ঠকানোর একটা বুদ্ধি। আপনাদের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে কেস করা উচিত। চার শ বিশ ধারার কেস।
রাগে আমার মাথা গরম হয়ে উঠল, ইচ্ছে করল গজনফর আলীর নাকে ঘুসি মেরে চ্যাপ্টা নাকটা আরো চ্যাপ্টা করে দিই। অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করে বললাম, ভাওতাবাজি কে করছে আমি খুব ভালো করে জানি।
জানলে তো ভালোই। গজনফর আলী ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি আমার অনেক সময় নষ্ট করে ফেলেছেন।
ঠিক আছে আর সময় নষ্ট করব না। আমি যাচ্ছি। আমার ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটরটা দেন।
গজনফর আলী হাত নেড়ে বললেন, আপনার ঐ যন্ত্র নিয়ে আমি বসে আছি নাকি?
আমি অবাক হয়ে বললাম, মানে?
আমার বাসায় আপনাদের সব জঞ্জাল ফেলে রাখবেন আর আমি সেটা সহ্য করব?
গজনফর আলী কী বলছেন আমি তখনো বুঝতে পারলাম না, অবাক হয়ে বললাম, কী বলছেন আমি বুঝতে পারছি না।
বলছি যে আপনার ঐ জঞ্জাল আমি ফেলে দিয়েছি।
আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না, রীতিমতো আর্তনাদ করে বললাম, ফেলে দিয়েছেন?
হ্যাঁ।
আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না, কয়েকবার চেষ্টা করে বললাম, কোথায় ফেলে দিয়েছেন?
বাসার সামনে ময়লা ফেলার জায়গায়।
আমি রাগে একেবারে অগ্নিশর্মা হয়ে বললাম, আপনি আমাদের জিনিস ফেলে দিলেন মানে?
আপনাদের জিনিস কে বলেছে? আপনি গতকাল আমাকে দিয়ে গেলেন না?
দেখতে দিয়েছি। ফেলে দিতে তো দেই নি।
গজনফর আলী চোখ ছোট ছোট করে বলল, আপনি কী জন্য দিয়েছেন সেটা তো আর আমার জানার কথা না। আপনার কাজ আপনি করেছেন, আমার কাজ আমি করেছি। আবর্জনা ফেলে দিয়েছি।
আমি এত খেপে গেলাম যে সেটা আর বলার কথা নয়। এই লোকটা-যে নাকি ইউনিভার্সিটির একজন প্রফেসর, যে এরকম চোখের ওপর ডাহা একটা মিথ্যা কথা বলতে পারে আমি নিজের চোখে না দেখলে কখনো বিশ্বাস করতাম না। সায়রার এই সাংঘাতিক আবিষ্কারটা সে চুরি করেছে। চুরি না বলে বলা উচিত ডাকাতি। একেবারে দিনদুপুরে ডাকাতি। আমি কী করব বুঝতে না পেরে বললাম, আপনার নামে আমি কেস করব। থানায় জিডি করব।
গজনফর আলী খ্যাকখ্যাক করে হেসে বললেন, করেন গিয়ে, তখন টের পাবেন কত ধানে কত চাল! পুলিশের লোকেরা কাউকে ভয় পায় না, শুধু খবরের কাগজকে ভয় পায়। আমি হচ্ছি সেই খবরের কাগজের লোক। এই টেলিফোন দিয়ে আমি একটা ফোন করব, আর আপনি থানায় যাওয়ামাত্র আপনাকে ক্যাঁক করে অ্যারেস্ট করে হাজতে নিয়ে যাবে। তারপর শুরু হবে রিমান্ড। রিমান্ড কী জিনিস আপনি জানেন?
এটা কি মগের মুল্লুক নাকি?
গজনফর আলী মুখে মধুর একটা হাসি ফুটিয়ে বললেন, আপনি মনে হয় খবরের কাগজ পড়েন না, তাই দেশের অবস্থা জানেন না। দেশের অবস্থা এখন মগের মুল্লুক থেকে খারাপ। হে হে হে।
আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। গজনফর আলী গলার স্বর নরম করে বললেন, আপনাকে একটা উপদেশ দেই। এটা নিয়ে কোনো তেড়িবেড়ি করবেন না, তা হলে অবস্থা খারাপ হবে। প্রথমে আপনাকে নিয়ে আর সেই মহিলা সায়েন্টিস্টকে নিয়ে পত্রিকায় জঘন্য জঘন্য রিপোর্ট বের হবে! তাতেও যদি শান্ত না হন আমার অন্য ব্যবস্থা আছে।
অন্য কী ব্যবস্থা?
গালকাটা বক্করের নাম শুনেছেন?
আমি শুকনো গলায় বললাম, শুনেছি।
সাতাশটা কেস আছে, তার মাঝে বারোটা মার্ডার কেস। পুলিশের বাবার সাধ্য নাই তাকে ধরে। সবার নাকের ডগা দিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে গালকাটা বক্করের?
আমার কথায় ওঠে-বসে। আমার মোবাইলে নম্বর ঢোকানো আছে। খালি একটা মিস কল দিব, ব্যস। গজনফর আলী হাত দিয়ে গলায় পোচ দেবার একটা ভঙ্গি করলেন। আমি অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
.
সায়রা যখন শুনবে তার এই ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর প্রফেসর গজনফর আলী চুরি করে রেখে দিয়েছে-তখন কী করবে সেটা চিন্তা করে আমার পেটের ভাত একেবারে চাল হয়ে গেল। খুব দুশ্চিন্তা নিয়ে আমি তাকে খবরটা দিতে গেলাম। কিন্তু সায়রা দেখলাম ব্যাপারটার কোনো গুরুত্বই দিল না। গজনফর আলীর পাহাড়ের মতো স্ত্রী গজু বলে মধুর গলায় ডাকছিল সেই অংশটা শুনে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, আপনি হাসছেন? দিনদুপুরে এরকম ডাকাতি করল আর আপনি সেটা শুনে হাসছেন?
ছোট একটা যন্ত্র চুরি করে রেখেছে, রাখতে দিন! বউয়ের ভালবাসার জন্য করেছে- আহা বেচারা!
আমি লাফিয়ে উঠে বললাম, কাকে আপনি বেচারা বলছেন? গজনফর আলী কত বড় বদমাশ আপনি জানেন? এই লোকের এক শ বছর জেল হওয়া উচিত!
সায়রা একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, সোসাইটিতে সবাই যদি একরকম হয় তা হলে লাইফটা বোরিং হয়ে যাবে। এই জন্য কাউকে হতে হয় ভালো, কাউকে খারাপ আর কাউকে হতে হয় গজনফর আলীর মতো বদমাশ!
আমি অবাক হয়ে সায়রার দিকে তাকিয়ে রইলাম, সায়রা যদি বিজ্ঞানীর সাথে সাথে দার্শনিক হতে শুরু করে তা হলে তো মহাবিপদ হয়ে যাবে। আমি বললাম, কিন্তু আপনার এত মূল্যবান একটা যন্ত্র
কে বলেছে মূল্যবান! কয়টা কয়েল, একটা পুরোনো পাওয়ার সাপ্লাই, একটা সস্তা হেলমেট-সব মিলিয়ে দুই হাজার টাকার জিনিস আছে কি না সন্দেহ!
কিন্তু আপনার পরিশ্রম?
কে বলেছে পরিশ্রম। এসব কাজ করতে ভালো লাগে, কোনো পরিশ্রম হয় না।
তাই বলে ঐ বদমাশ গজনফর আলী এত সুন্দর একটা জিনিস নিয়ে যাবে?
আপনি চিন্তা করবেন না। ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর কীভাবে তৈরি করতে হয় আমি জানি। দরকার হলে আমি ডজন ডজন তৈরি করে দেব।
কিন্তু একটা মানুষ এত বড় অন্যায় করে পার পেয়ে যাবে? কোনো শাস্তি পাবে না?
অন্যায়? শাস্তি? হঠাৎ করে সায়রা অন্যমনস্ক হয়ে কী একটা ভাবতে লাগল। আমি সায়রার দিকে তাকালাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, কিন্তু আমাকে দেখছে না! গভীর কোনো একটা চিন্তায় ডুবে গেছে।
বিজ্ঞানীরা যখন গভীর চিন্তায় ডুবে যায় তখন তাদের ঘটানো ঠিক না, তাই তাকে বিরক্ত না করে আমি চলে এলাম।
.
কয়েক সপ্তাহ পরের কথা, দৈনিক মোমের আলো পত্রিকার সাহিত্যপাতায় দেখি একটি কবিতা ছাপা হয়েছে। কবিতার নাম তোমাকে স্পর্শ করি এবং কবিতাটি লিখেছেন মোল্লা গজনফর আলী। দেখে আমি রীতিমতো আঁতকে উঠলাম–মোল্লা গজনফর আলীর মতো মানুষ কবিতা লিখে ফেলেছে? সেই কবিতা আবার ছাপাও হয়েছে? আমি কবিতাটি পড়ার চেষ্টা করলাম, শুরু হয়েছে এভাবে
বুকের ভেতর খেলা করে আমার সকল বোধ
তোমাকে
স্পর্শ করি–
কবিতাটি পড়ে আমার কোনো সন্দেহই থাকল না যে আসলে এই বদমাশ মানুষটা সায়রার ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর ব্যবহার করে কবিতাটা লিখে ফেলেছে। রাগে আমার ব্লাড প্রেসার বেড়ে গেল কিন্তু কিছুই করতে পারলাম না। কিছু করার চেষ্টা করলে মোল্লা গজনফর আলী নিশ্চয়ই গালকাটা বক্করকে কাটা রাইফেল দিয়ে আমার বাসায় পাঠিয়ে দেবে।
ব্যাপারটা আমার একেবারে সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল যখন দেখলাম বইমেলায় মোল্লা গজনফর আলীর একটা কবিতার বই বের হয়েছে, বইয়ের নাম অনুভূতির চেনা বাতাস। শুধু যে বের হয়েছে তা নয়, বই নাকি একেবারে মার মার কাট কাট করে। বিক্রি হচ্ছে। দৈনিক মোমের আলোর শেষ পৃষ্ঠায় ছবি বের হল–মোল্লা গজনফর আলী পাঞ্জাবি পরে বইয়ে অটোগ্রাফ দিচ্ছেন আর তার চারপাশে কমবয়সি মেয়েরা ভিড় করে। আছে।
বইমেলার শেষের দিকে বিশেষ বই নিয়ে আলোচনা বের হল, সেখানে অনুভূতির চেনা বাতাস বইয়ের ওপর বিশাল-আলোচনা। লেখা হয়েছে, আমাদের কাব্য অঙ্গনের স্থবিরতা দূর করতে যে মানুষটি প্রায় হঠাৎ করে উপস্থিত হয়েছেন তার নাম মোল্লা গজনফর আলী। কবিতার জগতে তার পদচারণা ফারুনের ঝড়ো হাওয়ার মতো সাহসী এবং বিক্ষুব্ধ…
আমি শেষ পর্যন্ত পড়তে পারলাম না, খবরের কাগজটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিলাম।
মাসখানেক পর নীলক্ষেত থেকে রিকশা করে আসছি, আর্ট ইনস্টিটিউটের সামনে দেখি মানুষের ভিড়। সুন্দর জামাকাপড় পরা মানুষজন গাড়ি থেকে নামছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখি গেটের পাশে ফেস্টুন, বড় বড় করে লেখা–
মোল্লা গজনফর আলীর একক চিত্রপ্রদর্শনী।
আমি রিকশায় বজ্রাহতের মতো বসে রইলাম। রাগে-দুঃখে ঐ এলাকা দিয়েই হাঁটাচলা বন্ধ করে দিলাম। কিন্তু তাতে কি আর রক্ষা আছে? একদিন টেলিভিশন দেখছি, হঠাৎ দেখি টেলিভিশনের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানে এক উপস্থাপিকা মোল্লা গজনফর আলীকে নিয়ে এসেছে। দেখলাম তাকে জিজ্ঞেস করছে, আপনি বিজ্ঞানের প্রফেসর, হঠাৎ করে কবিতা এবং ছবি আঁকায় উৎসাহী হলেন কেন?
মোল্লা গজনফর আলী হাত দিয়ে মাথার এলোমেলো চুলকে সোজা করতে করতে বললেন, আসলে সৃজনশীলতা একটি অনুভবের ব্যাপার। আমার হঠাৎ করে মনে হল, সারা জীবন তো বিজ্ঞানের সেবা করেছি-সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতির অন্য মাধ্যমগুলোয় একটু পদচারণা করে দেখি।
উপস্থাপিকা ন্যাকা ন্যাকা গলার স্বরে ঢং করে বলল, কিন্তু আপনার পদচারণা তো ভীরু পদচারণা নয়, সাহসী পদচারণা, দৃপ্ত পদচারণা-
মোল্লা গজনফর আলী স্মিত হেসে বললেন, প্রতিভার ব্যাপারটি তো আসলে নিয়মকানুন দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না-
এই পর্যায়ে আমি লাথি দিয়ে আমার টেলিভিশনটা ফেলে দিলাম, সেটা উল্টে পড়ে ভেতরে কী একটা ঘটে গেল, বিকট একটা শব্দ হল এবং কালো ধোঁয়া বের হতে লাগল।
.
মোল্লা গজনফর আলী যখন রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটা সিডি বের করে ফেললেন, তখন ব্যাপারটা আমি আর সহ্য করতে পারলাম না, সায়রার কাছে গিয়ে নালিশ করলাম।
পুরো ব্যাপারটা শুনে সায়রা হেসে কুটিকুটি হয়ে বলল, আপনি এত রেগে যাচ্ছেন কেন?
রাগব না? এই বেটা বদমাশ শুধু যে আপনার যন্ত্র চুরি করল তাই নয়, এখন সেটা ব্যবহার করে কবি হয়েছে, আর্টিস্ট হয়েছে এখন গায়ক হচ্ছে?
হলে ক্ষতি কী?
কোনো ক্ষতি নাই?
না।
আমিও তো গজনফর আলীর মতো কবি, শিল্পী আর গায়ক হতে পারতাম–পারতাম না?
সায়রা আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, উঁহু, আপনি পারতেন না। মানুষকে ঠকানোর জন্য যে ফিচলে বুদ্ধি দরকার, আপনার সেটা নাই। আপনি হচ্ছেন সাদাসিধে মানুষ।
কাজেই সায়রাকে কোনোভাবেই কিছু একটা ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য রাজি করানো গেল না।
.
যত দিন যেতে লাগল মোল্লা গজনফর আলী ততই বিখ্যাত হতে লাগলেন। ম্যাগাজিনে তার সাক্ষাৎকার ছাপা হতে লাগল, বিভিন্ন সংগঠন থেকে পুরস্কার পেতে লাগলেন। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হল, যখন দেখলাম, মোল্লা গজনফর আলী প্রধান অতিথি হয়ে বিভিন্ন স্কুল কলেজে গিয়ে বাচ্চা ছেলেমেয়েদের পুরস্কার দিচ্ছে। পুরস্কার দিয়ে তাদেরকে সুনাগরিক হয়ে দেশ এবং সমাজের সেবা করার উপদেশ দিচ্ছে। আমার জীবনের ওপর ঘেন্না ধরে গেল। মনে হতে লাগল, মোল্লা গজনফর আলীকে খুন করে ফাঁসিতে ঝুলে যাই। কিন্তু তাতেও সমস্যার সমাধান হবে না। ব্যাটা বদমাশ তখন শহীদ হয়ে যাবে তার নামে স্মৃতিসৌধ তৈরি হয়ে যাবে!
মোল্লা গজনফর আলীর উৎপাতে যখন দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবার কথা চিন্তাভাবনা করছি তখন হঠাৎ করে পত্রিকায় একটা খবর ছাপা হল যেটা দেখে আমার পুরো চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। খবরটি এরকম, উপরে হেডলাইন
বাঙালি বিজ্ঞানীর যুগান্তকারী আবিষ্কার
মানুষের অনুভূতি এখন হাতের মুঠোয়
তার নিচে ছোট ছোট করে লেখা–
বাংলাদেশের বিজ্ঞানী যিনি একাধারে কবি, শিল্পী এবং গায়ক হিসেবে এই দেশের সাহিত্য এবং সংস্কৃতির অঙ্গনে সুপরিচিত, তার যুগান্তকারী আবিষ্কারের কথা জাতির। সামনে প্রকাশ করছেন। প্রফেসর মোল্লা গজনফর আলী। জানিয়েছেন, মানুষের মস্তিষ্কে উচ্চ কম্পনের চৌম্বকীয় তরঙ্গ দিয়ে তাদের অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করার একটি পদ্ধতি তিনি আবিষ্কার করেছেন। আগামী মঙ্গলবার স্থানীয় প্রেসক্লাবে তিনি তার আবিষ্কারটি জনসমক্ষে প্রকাশ করবেন।
পাশেই একটি রঙিন ছবি, মোল্লা গজনফর আলী রিমোট কন্ট্রোলের মতো দেখতে কন্ট্রোলটি হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন, পাশে তার স্ত্রী হেলমেটটি মাথায় দিয়ে বসে আছে। দুইজনের মুখেই স্মিত হাসি। নিচে মোল্লা গজনফর আলীর জীবনবৃত্তান্ত।
খবরটি দেখে আমার মাথার ভেতরে একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেল। আমি তখন তখনই কাগজটা হাতে নিয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে সায়রার বাসায় হাজির হলাম। আমাকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে সায়রা ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
আমি কাগজটা তার হাতে দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, এই দেখেন!
সায়রা ছবিটা দেখল এবং খবরটা পড়ল। তারপর একটা নিশ্বাস ফেলল। প্রত্যেকবার সে যেরকম পুরো ব্যাপারটা হেসে উড়িয়ে দিয়েছে, এবারে সেরকম হেসে উড়িয়ে দিল না, তার মুখটা কেমন জানি গম্ভীর হয়ে গেল। আমি বললাম, কী হল?
মানুষটাকে শাস্তি দেওয়ার একটা সময় হয়েছে। কী বলেন?
আমি হাতে কিল দিয়ে বললাম, এক শ বার।
ঠিক আছে। মঙ্গলবার দেখা হবে।
কোথায় দেখা হবে?
প্রেসক্লাবে।
সায়রা কী করবে সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই, কিন্তু এই মেয়েটার ওপরে আমার বিশ্বাস আছে। আমি মঙ্গলবারের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম মনে হতে লাগল ঘণ্টা, মিনিট আর সেকেন্ডগুলো এত আস্তে আস্তে আসছে যে মঙ্গলবার বুঝি কোনোদিন আসবেই না!
.
প্রেস কনফারেন্সের সময় দেওয়া ছিল বিকেল চারটা, আমি তিনটার সময় হাজির হয়ে গেলাম। গিয়ে দেখি আমি আসার আগেই আরো অনেকে চলে এসেছে। গজনফর আলী আমাকে চিনে ফেলতে পারে বলে আমি একটু পিছনের দিকে বসলাম। আমার পাশের চেয়ারটি সায়রার জন্য বাঁচিয়ে রাখলাম।
স্টেজটি একটু সাজানো হয়েছে, পেছনে একটা বড় ব্যানার, সেখানে লেখা-
বিজ্ঞানী মোল্লা গজনফর আলীর যুগান্তকারী আবিষ্কার
সামনে একটা টেবিল, সেই টেবিলে সায়রার তৈরি করা ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর যন্ত্রটি। পাশে গদি আঁটা একটি চেয়ার। সেই চেয়ারের উপর হেলমেটটি সাজানো। গজনফর আলী বলেছিলেন তিনি নাকি এগুলোকে আবর্জনা হিসেবে ফেলে দিয়েছিলেন।
সায়রা এল ঠিক সাড়ে তিনটার সময়।
আমি ভেবেছিলাম হাতে যন্ত্রপাতি বোঝাই একটা ব্যাগ থাকবে, কিন্তু সেরকম কিছু নেই। কীভাবে সে গজনফর আলীকে শায়েস্তা করবে বুঝতে পারলাম না। আমি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, কী হল?
কীসের কী হল?।
আপনার যন্ত্রপাতি কই?
কীসের যন্ত্রপাতি?
গজনফর আলীকে শায়েস্তা করার জন্য?
সায়রা আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, আমার তাকে শায়েস্তা করতে হবে কে বলেছে?
তা হলে কে শায়েস্তা করবে?
নিজেই নিজেকে শায়েস্তা করবে!
মেয়েটা ঠাট্টা করছে কি না আমি বুঝতে পারলাম না। আমি একটু ভয় নিয়ে সায়রার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
ঠিক চারটার সময় মোল্লা গজনফর আলী এসে হাজির হলেন। আজকে চকচকে একটা চকোলেট রঙের সুট পরে এসেছেন। সাথে তার স্ত্রী, এমনভাবে সেজেগুজে এসেছেন যে দেখে মন হয় বারো বছরের খুকি। তারা দুইজন স্টেজে গিয়ে বসলেন। তখন তেইশ চব্বিশ বছরের একটা মেয়ে মাইকের সামনে গিয়ে প্রেস কনফারেন্সের কাজ শুরু করে দিল। সে প্রথমে একটা লিখিত রিপোর্ট পড়ে শোনাল-সেখানে বর্ণনা করা আছে মোল্লা গজনফর আলী জিনিসটা কেমন করে আবিষ্কার করেছেন, সেটি তার কত দীর্ঘদিনের সাধনা, এটা দিয়ে পৃথিবীর কী কী মহৎ কাজ করা হবে ইত্যাদি শুনে আমার সারা শরীর একেবারে তিড়বিড় করে জ্বলতে লাগল।
এরপর গজনফর আলী উঠে দাঁড়ালেন এবং তখন সবার মাঝে একটা মৃদু গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। গজনফর আলী মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, উপস্থিত সুধী মহল এবং সাংবাদিকবৃন্দ, আমি নিশ্চিত এতক্ষণে এই রিপোর্টে যা বলা হল আপনারা তার সবকিছু বিশ্বাস করেন নি। আপনাদের জায়গায় থাকলে আমি নিজেও বিশ্বাস করতাম না-এটি কেমন করে সম্ভব, যে অনুভূতিটুকু এতদিন আমরা আমাদের একেবারে নিজস্ব বলে জেনে এসেছি সেটি একটি যন্ত্র দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়? তা হলে মানুষের অস্তিত্বই কি অর্থহীন হয়ে যায় না?
গজনফর আলী উপস্থিত সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই প্রশ্নের উত্তর আমি জানি। আপনারা নিজের চোখে দেখুন, তারপর প্রশ্নের উত্তর বের করে নিন। মোল্লা গজনফর আলী একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে বললেন, প্রথমে আমার দরকার একজন ভলান্টিয়ার। হাসিখুশি ভলান্টিয়ার, যে মনে করে পৃথিবীতে দুঃখ বলে কিছু নেই!
অন্যেরা হাত তোলার আগেই প্রায় তড়াক করে লাফ দিয়ে একটা হাসিখুশি মেয়ে উঠে দাঁড়াল। গজনফর আলী তাকে স্টেজে ডাকলেন। স্টেজে যাবার পর তাকে গদি আঁটা চেয়ারে বসিয়ে মাথায় হেলমেটটা পরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার মনের অনুভূতিটি কী?
আনন্দের।
ভেরি গুড। দেখি আপনি আপনার এই আনন্দের অনুভূতিটি ধরে রাখতে পারেন কি।
গজনফর আলী একটু দূরে দাঁড়িয়ে ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটরের রিমোট কন্ট্রোলের মতো জিনিসের সুইচটা টিপে ধরলেন, দেখতে দেখতে মেয়েটার মুখ একেবারে বিষণ্ণ হয়ে গেল। গজনফর আলী কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন আপনার এখন কেমন লাগছে?
খুব মন খারাপ লাগছে।
কেন?
জানি না। মেয়েটা হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
গজনফর আলী বিশ্বজয়ের ভঙ্গি করে সবার দিকে তাকালেন এবং উপস্থিত সবাই হাততালি দিতে শুরু করল। গজনফর আলী মাথা নুয়ে সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে সুইচটা ছেড়ে দিতেই মেয়েটা চোখ মুছে অবাক হয়ে তাকাল। গজনফর আলী তার মাথা থেকে হেলমেটটা খুলে তার কাছে মাইক্রোফোন নিয়ে বলেন, আপনি কি উপস্থিত সবাইকে আপনার অভিজ্ঞতাটুকু বলবেন?
মেয়েটা উত্তেজনায় ছটফট করতে করতে বলকী আশ্চর্য! একেবারে অবিশ্বাস্য ব্যাপার! আমি বুকের মাঝে আনন্দের অনুভূতি নিয়ে বসে আছি, হঠাৎ কী হল একটা গভীর দুঃখ এসে ভর করল। কী গভীর দুঃখ আপনার চিন্তাও করতে পারবেন না। আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে কাঁদতে শুরু করেছিলাম– আমি জীবনে কখনো কেঁদেছি বলে মনে করতে পারি না। তারপর ম্যাজিকের মতো হঠাৎ করে সেই দুঃখ চলে গেল। একেবারে অবিশ্বাস্য ব্যাপার।
যারা সামনে বসেছিল আবার আনন্দে হাততালি দিতে থাকে। গজনফর আলী হাত তুলে তাদের থামিয়ে বললেন, এবারে আমার আরেকজন ভলান্টিয়ার দরকার, যে বাঘের বাচ্চার। মতো সাহসী। যে কোনো কিছুতে ভয় পায় না।
গাট্টাগোট্টা টাইপের একজন এবারে উঠে দাঁড়াল। গজনফর আলী তাকে স্টেজে নিয়ে চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। মাথায় হেলমেটটি পরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি সাহসী?
মানুষটি দাঁত বের করে হেসে বলল, হ্যাঁ আমি সাহসী।
আমাকে দেখে আপনার কি ভয় লাগছে?
নাহ! কেন ভয় লাগবে?
ভেরি গুড। দেখা যাক সত্যি আপনি সাহসী থাকতে পারেন কি না।
গজনফর আলী কন্ট্রোলটা নিয়ে একটু দূরে সরে গিয়ে সুইচটা টিপে ধরতেই মানুষটা দুই হাত দুই পা নিজের ভেতরে নিয়ে এসে ভয় পাওয়া গলায় এমন চিৎকার দিল যে উপস্থিত যারা ছিল সবাই চমকে উঠল। গজনফর আলী মানুষটাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কি ভয় লাগছে?
মানুষটা দুই হাত দিয়ে নিজের চোখ ঢেকে একটা বিকট আর্তনাদ করে উঠল। গজনফর আলী সবার দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে সুইচটা ছেড়ে দিয়ে বললেন, আপনারা সবাই নিশ্চয়ই আমার সাথে একমত হবেন যে, ভয়ের অনুভূতিটি কিন্তু এই যন্ত্র থেকে এসেছে।
দর্শক এবং সাংবাদিকরা আবার হাততালি দিতে শুরু করে। গজনফর আলী মাইক্রোফোনটা হেলমেট মাথায় মানুষটির হাতে দিয়ে বললেন, আপনার অনুভূতির কথাটি শুনি?
মানুষটা তখনো দরদর করে ঘামছে, মাথা থেকে হেলমেটটা খুলে পাংশু মুখে বলল, কী ভয়ংকর একটা অভিজ্ঞতা! আমি নিশ্চিত ছিলাম পুরো ব্যাপারটা আসলে বানানো। একেবারেই বিশ্বাস করি নি। চেয়ারে বসেছিলাম হঠাৎ করে এমন একটা অমানুষিক ভয় এসে ভর করল যে ভাষায় সেটার বর্ণনা করা যায় না। মনে হল এটা অন্ধকার একটা শ্মশান, চারপাশে ভূতপ্রেত, আর বিজ্ঞানী গজনফর আলী একজন দৈত্য!
খুব মজার একটা রসিকতা হয়েছে এরকম ভান করে গজনফর আলী হা হা করে হাসতে হাসতে বললেন, আমার মনে হয় এখন নতুন কোনো ভলান্টিয়ার পাওয়া খুব মুশকিল হবে! কাজেই আমিই হব ভলান্টিয়ার। এই যন্ত্রটা আমি মাথায় দেব এবং আমার স্ত্রী কন্ট্রোলটা দিয়ে আমার অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করবেন।
একজন জিজ্ঞেস করল, আপনার কীসের অনুভূতি?
গজনফর আলী চেয়ারে বসে মাথায় হেলমেটটা পরে বললেন, এতক্ষণ আপনাদের যা দেখানো হয়েছে সেটা মজার ব্যাপার হতে পারে, কৌতূহলের ব্যাপার হতে পারে কিন্তু তার কোনো বাস্তব গুরুত্ব নেই। এখন আপনাদের দেখাব কীভাবে এই যন্ত্রটি দিয়ে যুগান্তকারী ঘটনা ঘটানো যায়। মানুষের ভেতরে গাণিতিক প্রতিভা কীভাবে বের করে নেওয়া যায়! আমি একজন সাধারণ মানুষ আপনাদের চোখের সামনে গাণিতিক প্রতিভা হয়ে যাব।
গজনফর আলী তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, সুইচটা টিপে দাও।
গজনফর আলীর স্ত্রী কন্ট্রোলটা হাতে নিয়ে ঠিক সুইচটা টিপে ধরলেন। গজনফর আলীর মুখ হঠাৎ করে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি বললেন, আপনারা আমাকে দেখে বুঝতে পারছেন না, কিন্তু আমি হঠাৎ করে একটা গাণিতিক প্রতিভা হয়ে গেছি! আমি ইচ্ছে করলে এখন মুখে মুখে ডিফারেন্সিয়াল ইকুয়েশন সলভ করতে পারি। পাইয়ের গঠন শত ঘর পর্যন্ত বলতে পারি। মুখে মুখে বড় বড় গুণ ভাগ করে ফেলতে পারি।
সায়রা তার ব্যাগ থেকে কিছু একটা বের করে তার শাড়ির আঁচলে ঢেকে নিয়ে ফিসফিস করে বলল, বাছাধনকে এখন বোঝাব মজা।।
আমিও ফিসফিস করে বললাম, কীভাবে?
গজনফরের ওয়াইফের কাছে যে কন্ট্রোলটা আছে সেটা এখন জ্যাম করে দিয়ে আমি কন্ট্রোল করব।
আমি উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী কন্ট্রোল করবেন?
আপনি দেখেন।
গজনফর আলী তখনো বলছে, আপনারা ইচ্ছে করলে আমাকে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। বড় বড় গুণ ভাগ দিতে পারেন, যে কোনো সংখ্যার নাম জিজ্ঞেস করতে পারেন।
সামনে বসে থাকা একজন বলল, ছেচল্লিশের নামতা বলেন দেখি!
ছেচল্লিশ তো সোজা। গজনফর আলী বলতে রু করল, ছেচল্লিশ একে ছেচল্লিশ, ছেচল্লিশ দ্বিগুণে বিরানব্বই, তিন ছেচল্লিশে–
সায়রা ফিসফিস করে বললেন, এই যে, সুইচ টিপে দিলাম।
সাথে সাথে গজনফর আলী থেমে গিয়ে সোজা হয়ে বসলেন। দর্শকদের মাঝে একটা মৃদু গুঞ্জন উঠল, একজন জিজ্ঞেস করল, কী হল? থেমে গেলেন কেন?
গজনফর আলী বললেন, একটা খুব বিচিত্র ব্যাপার ঘটেছে।
কী বিচিত্র ব্যাপার?
হঠাৎ করে আমার অঙ্ক করার ক্ষমতা চলে গিয়ে অন্য একটা ক্ষমতা এসেছে।
কী ক্ষমতা?
সত্যি কথা বলার ক্ষমতা। এখন আমি কোনো সত্যি কথা বলতে ভয় পাব না।
উপস্থিত দর্শক সাংবাদিক সবাই চুপ করে গেল কিন্তু গজনফর আলী থামলেন না, সামনে বসে থাকা একজনের দিকে তাকিয়ে বললেন, যেমন আপনাকে বলতে পারি, আপনি যে দাড়ি রেখেছেন সেটাকে বলে ছাগলদাড়ি, আপনাকে তাই ছাগলের মতো দেখাচ্ছে। আর ঐ যে ডান পাশে বসে আছেন নীল শাড়ি পরে পাউডার দিয়ে না হয় আপনার কালো রঙকে ঢাকলেন, কিন্তু বোচা নাককে সোজা করবেন কীভাবে?
দর্শকদের মাঝে হঠাৎ একটা গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। একজন সাংবাদিক দাঁড়িয়ে একটু রেগে বলল, আপনি হঠাৎ করে এরকম আপত্তিকর কথা বলতে শুরু করলেন কেন? আমাদের অপমান করছেন কেন?
গজনফর আলী একটুও রাগলেন না। হাসি হাসি মুখে বললেন, আমি মোটেও অপমান করছি না, সত্যি কথা বলছি।
তা হলে আপনি নিজের সম্পর্কে কিছু সত্যি কথা বলেন।
অবশ্যই বলব। আপনি কি ভাবছেন আমি ভয় পাব? এই যে দেখছেন আমার নাক, এটা এরকম চ্যাপ্টা হয়েছে কেমন করে জানেন?
দর্শকেরা মাথা নাড়ল, তারা জানে না।
গজনফর আলী বললেন, আমার স্ত্রীর ঘুসি খেয়ে। আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন আমার স্ত্রী হচ্ছে একটা গরিলার মতো সাইজের, যখন রেগে ওঠে তখন কোনো কাণ্ডজ্ঞান থাকে না, আমাকে পিটিয়ে লাশ বানিয়ে দেয়!
সবাই একেবারে বজ্রাহতের মতো চুপ করে রইল। গজনফর আলী থামলেন না, বলতেই থাকলেন, এরকম গরিলার মতো একটা বউকে আমি কেমন করে কন্ট্রোল করি জানেন? গজনফর আলী মাথায় টোকা দিয়ে বললেন, বুদ্ধি দিয়ে। আপনারা সবাই যেরকম একটু বেকুব টাইপের, হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে আমার কথা শুনছেন, আমি যেটাই বলছি সেটাই বিশ্বাস করছেন আমি সেরকম না। আমি খানিকটা ধুরন্ধর। গজনফর আলী একটু দম নিয়ে বললেন, এই যে যন্ত্রটা দেখছেন আপনারা ভাবছেন সেটা আমি তৈরি করেছি?
সাংবাদিকরা এবারে চঞ্চল হয়ে উঠল, কয়েকজন দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, কে তৈরি করেছে?
ঠিক জানি না। হাবাগোবা টাইপের একজন মানুষ নিয়ে এসেছিল পত্রিকায় রিপোর্ট করার জন্য, বলেছিল একটা মহিলা সায়েন্টিস্ট তৈরি করেছে। আমি তাকে ঠকিয়ে রেখে দিয়েছি।
একজন মেয়ে সাংবাদিক দাঁড়িয়ে বলল, আপনি এটা আবিষ্কার করেন নাই? এটা আরেকজনের আবিষ্কার?
ঠিকই বলেছেন। আমার মেধা খুব কম। চা চামচের এক চামচ থেকে বেশি হবে না। তবে আমার ফিচলে বুদ্ধি অনেক। মানুষ ঠকিয়ে খাই। টাকাপয়সা নিয়ে পত্রিকায় রিপোর্ট ছাপাই–ব্ল্যাকমেইল করি।
বয়স্ক একজন সাংবাদিক দাঁড়িয়ে বললেন, আপনি যে সবার সামনে এগুলো বলছেন আপনার সম্মানের ক্ষতি হবে না?
সম্মান থাকলে তো ক্ষতি হবে। আমি একজন চোর। আমার কথা বিশ্বাস না করলে আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেন। আমি যে কবিতা লিখেছি, ছবি এঁকেছি, গান গেয়েছি সব এই যন্ত্র দিয়ে। আমার নিজের কোনো প্রতিভা নাই!
গজনফরের স্ত্রী এতক্ষণ চোখ বড় বড় করে এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন, এবারে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, তুমি কী করছ? সবকিছু বলে দিচ্ছ কেন?
আমার কোনো কন্ট্রোল নাই! দেখছ না আমার সত্যি কথা বলার রোগ হয়েছে।
না, তুমি আর কিছু বলবে না। গজনফরের স্ত্রী তার স্বামীর দিকে ছুটে এলেন, তার মুখ চেপে ধরার চেষ্টা করলেন। গজনফর আলী হঠাৎ করে বললেন, ভয়ের কিছু নেই, সত্যি কথা বলতে কোনো ভয় নেই। তুমিও পারবে।
না, খবরদার, চুপ কর।
ঠিক আছে তা হলে এই হেলমেটটা পর–তা হলে পারবে। এবং কেউ কিছু বোঝার আগে গজনফর আলী হেলমেটটা তার স্ত্রীর মাথায় পরিয়ে দিলেন। তার স্ত্রী একবার চোখ ঘুরিয়ে তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিকই বলেছিস, চামচিকার বাচ্চা চামচিকা, তুই হচ্ছিস চোর ডাকাত গুণ্ডা বদমাশ! মানুষ ঠকানো তোর স্বভাব। তোকে দেখলে পাপ হয়
সায়রা ফিসফিস করে বলল, মহিলাকে একটু রাগিয়ে দেওয়া যাক।
এমনিতেই তো রেগে আছে!
এটা কি রাগ হল? দেখেন মজা। সায়রা রাগের সুইচ টিপে দিল, তারপর যা একটা কাও হল সেটা দেখার মতো দৃশ্য। গজনফর আলীর স্ত্রী একটা হুঙ্কার দিয়ে গজনফর আলীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন, নাকে এবং পেটে ঘুসি মেরে একেবারে ধরাশায়ী করে দিলেন। গজনফর আলীকে বাঁচানোর জন্য কয়েকজন স্টেজে ওঠার চেষ্টা করছিল, চেয়ার দিয়ে তাদের পিটিয়ে তিনি তাদের লম্বা করে ফেললেন। মাইকের স্ট্যান্ড ঘুরিয়ে ছুঁড়ে মারলেন। ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেললেন। আঁ আঁ করে বুকে থাবা দিয়ে চেয়ার ঘুরাতে ঘুরাতে তিনি স্টেজ থেকে নিচে নেমে এলেন।
চেয়ারে বসে থাকা দর্শক এবং সাংবাদিকরা কোনোভাবে সেখান থেকে পালিয়ে রক্ষা পেল! আমিও সায়রার হাত ধরে টেনে কোনোভাবে সেই ভয়াবহ কাণ্ড থেকে পালিয়ে এসেছি।
পরের দিন সব পত্রিকায় খবরগুলো খুব বড় করে এসেছিল।
মোল্লা গজনফর আলীর কুকীর্তি শিরোনামে দৈনিক মোমের আলোতে নিয়মিত ফিচার বের হতে শুরু করেছে।
সব সাংবাদিক এখন যে হাবাগোবা লোকটি এই যুগান্তকারী আবিষ্কারটি মোল্লা গজনফর আলীর কাছে প্রথম নিয়ে গিয়েছিল তাকে খুঁজছে।
নিজেকে হাবাগোবা মানুষ বলে পরিচয় দিতে ইচ্ছে করে না বলে কাউকে আর পরিচয় দিই নি– তা না হলে এবারে বিখ্যাত হবার খুব বড় একটা সুযোগ ছিল।
তবে সায়রা সায়েন্টিষ্টের সাথে যোগাযোগ রাখছি। সে নিশ্চয়ই আরেকটা সুযোগ করে দেবে। ঠিক করেছি সেই সুযোগটা আমি আর কিছুতেই গুবলেট করে ফেলব না।