মোনালিজার কাঁটা – ৫

পাঁচ

বৈঠকখানায় ফিরে এসে সকলে জমিয়ে বসার পর বসন্তবাবু জানতে চাইলেন, আর এক রাউন্ড চা-কফি হবে নাকি? প্রফেসর মিত্র যদি ইচ্ছে করেন, তাহলে ড্রিংসের ব্যবস্থাও করা যায়। কর্নেলের সব রকম আয়োজনই আছে।

কৌশিক বলে, সে-সব থাক। আপনি বরং বলুন, কীভাবে গায়ত্রী দেবী সর্প-দংশনে মারা গেলেন। ঘটনাটা কোথায় ঘটেছিল?

বসন্ত জানলা-পথে দূর দিগন্তে দৃষ্টি মেলে বললেন, এ বাড়িতেই। বিশে সেপ্টেম্বর, ছিয়াত্তর সাল। সেটা ছিল সে বছরের দুর্গপূজার বিজয়া দশমীর দিন। সন্ধ্যাবেলা। বাড়ির প্রায় সবাই গেছে মেম-সায়রে বিসর্জন দেখতে। বাড়িতে ছিলেন কর্নেল সস্ত্রীক, আর বাতাসী। সে বস্তুত ছিল গায়ত্রীর সহচরী—ইংরেজিতে যাকে বলে ‘কম্প্যানিয়ান’। কর্নেল বাড়ির পিছনের বাগানে বেতের পোর্টেবল চেয়ার পেতে সান্ধ্য চায়ের আসরে বসেছিলেন। বাতাসী রান্নাঘর থেকে বিস্কিট আনতে গেছে, কর্নেল পট থেকে কাপে চা ঢালছেন এমন সময় গায়ত্রী চিৎকার করে উঠল : উঃ! আমাকে কিসে যেন কামড়াল!

লাফিয়ে উঠলেন কর্নেল। টেবিলের উপর ছিল একটি পাঁচ-সেল বড় টর্চ। মাটিতে আলো ফেলতেই দেখতে পেলেন সাপটা এঁকে-বেঁকে লতিয়ে-লতিয়ে ঝোপ-ঝাড়ের দিকে লুকিয়ে পড়তে চাইছে। কর্নেল অকুতোভয়ে লাফ দিয়ে পড়লেন তার উপর। টর্চের প্রচণ্ড আঘাতে থেঁতলে দিলেন তার মেরুদণ্ডটা। প্রতিবর্তী-প্রেরণায় সাপটা মাথা ঘুরিয়ে দংশন করল ওঁর বাঁ- হাতের কব্জিতে। কিন্তু ছোবলটা আংশিকভাবে পড়ল ওঁর ঘড়ির মেটাল-ব্যান্ডের উপর। তাছাড়া গায়ত্রীকে দংশন করার ঠিক পরেই সাপটার বিষভাণ্ডে যথেষ্ট গরল সঞ্চিত হয়নি। ফলে কর্নেলের কিছুই হলো না। উনি স্ত্রীর দিকে পিছন ফিরে দেখলেন, গায়ত্রী নেতিয়ে পড়েছে। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। কর্নেল দেখলেন, গায়ত্রীর বাঁ-পায়ে ‘কাফ্-মাস্‌’-এ দুটি দংশন ক্ষত। চিৎকার করে উনি বাতাসীকে ডাকলেন। পকেট থেকে রুমাল বার করে দংশন-ক্ষতের একটু উপরে টর্নিকয়েট বেঁধে দিলেন। বাতাসী একটা গামছা নিয়ে এসেছিল। সেটা কর্নেল গায়ত্রীর উরুতেও বেঁধে দিলেন। টেলিফোন করলেন বসন্তবাবুকে। আর আদমগড়ের একমাত্র ডাক্তার শ্রীধর ধরকে।

বসন্তের মতে গায়ত্রীর মৃত্যুযোগ ছিল অবধারিত। বসন্তবাবু একটু পরেই এসে পড়লেন বটে, কিন্তু শ্রীধর সপরিবারে গেছেন বিসর্জন দেখতে। বসন্ত যখন এসে পৌঁছান তখন গায়ত্রীর জ্ঞান ছিল। মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বার হচ্ছিল। কথা বলতে পারছিল না। তবু কী-যেন একটা কথা সে বলতে চাইছিল—বসন্তের ধারণা—সে হিমুকে দেখতে চাইছিল। হিমু আর শরৎ দুজনেই দারোয়ানের সঙ্গে মেমসায়রে বিসর্জন দেখতে গেছে। গায়ত্রী ঠিক কী বলতে চায় তা বসন্তবাবুর শোনা হলো না; কর্নেলের পরামর্শ মতো তিনি সাইকেলে চেপে তৎক্ষণাৎ বার হয়ে পড়লেন ডাক্তার ধরের সন্ধানে।

শ্রীধর এসে পৌঁছালেন রাত দশটা নাগাদ। অর্থাৎ সর্পদংশনের প্রায় চার ঘন্টা পরে। তিনি বললেন, এর একমাত্র প্রতিষেধক ‘অ্যান্টিভেনাম’ ইনজেকশান। আদমগড়ে তা নেই। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে ছুটল আজিমগঞ্জে। মৃত্যুযোগ অনিবার্য ছিল গায়ত্রীর। আজিমগঞ্জেও তা পাওয়া গেল না। বহরমপুর থেকে ‘ভেনাম’-ইনজেকশান নিয়ে ড্রাইভার যখন ফিরে এল রাত তখন আড়াইটে! প্রয়োজন ছিল না। গায়ত্রীর সব যন্ত্রণার অবসান হয়েছে তার আগেই।

দীর্ঘ কাহিনী বর্ণনা করতে করতে বসন্তবাবু কেমন যেন উদাস হয়ে গেলেন। বারে বারে চোখ থেকে চশমাটা খুলে কাচ দুটি মুছে নিতে হচ্ছিল তাঁকে। কিন্তু থামলেন না তিনি। বললেন, বিসর্জনের পরদিন আবার বিসর্জন হলো। সারা আদমগড় ভেঙে পড়ল পাঠক- প্যালেসে।

ধর্মে ওঁরা রোমান ক্যাথালিক। গায়ত্রীকে তাই দাহ করা হলো না। প্রাসাদের পিছনে ওদের বংশের সিমেটারি। সেখানেই শুয়ে আছেন গায়ত্রী। ছোট্ট কিন্তু সুন্দর একটি শ্বেতমর্মরের কবরে।

সুজাতা জানতে চায়, তখন হেমন্তের বয়স কত হবে?

—মাত্র চার। শরৎ ওর চেয়ে দশ মাসের বড়।

কর্নেল একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন। পাঁচ-সাতদিন অন্নগ্রহণ করেননি। এমনকি ওঁর তখন একটা আত্মহত্যার পরিকল্পনাও বোধহয় ছিল। জীবনে হার স্বীকার করা তাঁর ধাতে নেই। বসন্তবাবু তখন দিবারাত্র ওঁকে চোখে-চোখে রাখতেন। বাতাসী আগলে রাখত দুটি শিশুকে। সে একটা দিন গেছে বটে!

অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না। ঘরে যেন সেই শোকাহত দিনগুলো আবার ফিরে এসেছে। শেষে সুজাতাই প্রশ্ন করে, কর্নেল পাঠক তো আপনার বাল্যবঙ্কু। গায়ত্রী দেবীকে আপনি কতদিন ধরে চিনতেন?

একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল আধার বসন্তের। বললেন, ওর বিয়ের পর থেকে।

—আপনিও গায়ত্রী দেবীকে খুব ভালবাসতেন, তাই নয়?

বসন্তু সুজাতার চোখে-চোখে তাকালেন। ম্লান হাসলেন। সেই হাসিতেই মিশে ছিল ওঁর প্রশ্নের উত্তর।

একটু নীরবতা। এবার কৌশিক স্তব্ধতা ভঙ্গ করে বলে, একটা প্রশ্নের জবাব কিন্তু এখনো আমরা পাইনি। গায়ত্রী দেবীর ছবিটা এঁকেছিলেন কে?

বসন্ত সরাসরি জবাব দিলেন না। বললেন, আমরা দুজন এখান থেকে হায়ার-সেকেন্ডারি পাস করে কলকাতায় যাই। বিলু খুব ভালভাবে পাস করেছিল। সে ভর্তি হলো মেডিকেল কলেজে। আমার রেজাল্ট তত ভাল হয়নি। তাই আমি ভর্তি হয়েছিলাম সরকারি আর্ট স্কুলে।

—তার মানে গায়ত্রী দেবীর অয়েলিংপেন্টিংটা আপনার হাতের কাজ?

—ওটাই আমার আঁকা শেষ ছবি। আমার যাবতীয় স্কেচ-খাতা,রঙ-তুলি সব ওর কফিনে ফেলে দিয়েছিলাম।

—সে কি? কেন? কেন?—জানতে চায় কৌশিক।

—মিসেস্ মিত্র কিন্তু কারণটা জানেন!

সুজাতা আর কৌশিক পরস্পরের দিকে তাকায়।

—ওদের বিয়ে হয়ছিল ফাল্গুন মাসে। একাত্তর সাল। আদমগড়ে সে কী প্রচণ্ড আনন্দ উৎসব। সারা শহরটাই মেতে উঠেছিল। বিলুর বয়স তখন কুড়ি। গায়ত্রীর ষোলো। কিন্তু মাসখানেকের ভিতরেই পাশের রাজ্যে ঘনিয়ে এল দুর্যোগের মেঘ। বঙ্গবঙ্কু মুজিবর রহমানকে বন্দী করল ইয়াহিয়া খান। শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ। পরের মাসে সেনাবিভাগ থেকে ডাক পেয়ে বিলুকে জয়েন করতে হলো। প্রথম কয়েক সপ্তাহ সে ছিল ফোর্ট উইলিয়ামে। তখন ছুটি নিয়ে মাঝে-মাঝে আদমগড়ে এসেছে। তারপর ইন্দিরা গান্ধী মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসায় বিলু হয়ে গেল গড়-ঠিকানার মানুষ। বিলুর অনুরোধে নিজের ডেরা-ডাণ্ডা গুটিয়ে আমাকে চলে আসতে হলো পাঠক-প্যালেসে। ওদিকে পরিস্থিতি ক্রমেই ঘোরালো হয়ে উঠেছিল। তেশরা ডিসেম্বর পাকিস্তান সরাসরি আক্রমণ করে বসল ভারতকে। বিলু তখন একটা মিলিটারি হাসপাতালের সঙ্গে অ্যাটাচ্‌ড়। সতেরই ডিসেম্বর শেষ হলো সেই যুদ্ধ। তার তিনদিন পরে ইয়াহিয়া খান ইস্তফা দিলেন পাক-রাষ্ট্রপতির পদ থেকে। খবর পাওয়া গেল এবার বিলু ফিরে আসবে। তাই এল। ক্রিস্টমাস-ঈভ্-এ। গোটা আদমগড় সেদিন তাদের হিরো ক্যাপ্টেন বিল্ পাঠককে যুদ্ধবিজয়ীর সম্মান দিয়েছিল। রাস্তায় সারি-সারি তোরণ। গায়ত্রীর নির্দেশে পাঠক-প্যলেসকে টুনি-বাল্ব দিয়ে আমরা সাজিয়ে দিয়েছিলাম আলোক মালায়।

অতীতের স্মৃতিচারণে চোখ দুটি আবেশে বুজে আসে বসন্ত ঘোষের। স্তব্ধ হয়ে যান তিনি।

সুজাতা প্রশ্ন করে, মিসেস্ পাঠকের ওই পোট্রেটটা কি সেই একাত্তর সালে আঁকা?

ম্লান হাসলেন বসন্তবাবু। চোখ থেকে চশমাটা খুলে কাচ দুটি আবার কোঁচার খুঁটে মুছতে মুছতে বললেন—ছবির নিচেই তো তারিখটা লেখা আছে, দেখেননি? কি জানেন, সময় তো কাটতে চাইতো না—না বিলের বঙ্কুর, না তার প্রোষিতভর্তৃকা প্রিয়ার। তাই ওই ছুতোয় সময়টা কাটানোর প্রচেষ্টা। শিল্পীর আর মডেলের।

কৌশিক জানতে চায়, বাতাসী পিসি কি তার আগে এ বাড়িতে আসেননি?

বসন্ত ঘোষ জবাব দেবার সুযোগ পেলেন না। তার আগেই দ্বিতল থেকে নেমে এলেন ওঁরা দুজন।

কৌশিক আর সুজাতা উঠে দাঁড়ায়।

কর্নেল পাঠক বলেন, উঠছেন যে? কাল মধ্যাহ্নে তাহলে এখানেই দুটি…আমি হেডমাস্টারমশাইকে ফোন করে দেব।

কৌশিক বললে, সরি, স্যার। আমরা হয়তো কাল দুপুরের ট্রেনেই ফিরে যাব।

–সে কি? কেন?

—দুপুরবেলা কলকাতা থেকে একটা এস. টি. ডি. টেলিফোন পেয়েছি, তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে হবে।

—কারও অসুখ-বিসুখ করেনি তো?

—না, না। সাংসারিক প্রয়োজন। তবে হয়তো কাজটা মিটিয়ে আমরা আবার একবার আসব। জায়গাটা আমাদের ভাল লেগেছে।

সুজাতা বললে, হেমন্তের শরীর এবেলা কেমন দেখলেন?

—অনেকটা ভাল। ঠিক আছে। আবার আসবেন আদমগড়ে

পিছন থেকে বাতাসী পিসি বললেন, শনি-রবিবারে হলেই ভাল হয়। তাহলে ওই সময় শরৎকেও আসতে বলব।

ছয়

ছোট্ট শহর আদমগড়। সাইকেল রিক্শা আছে। কিন্তু দূরত্ব বেশি নয়। আসার সময় পায়ে হেঁটেই এসেছিল। এখন একটু রাত হয়েছে, এই যা! আশঙ্কিত লোড-শেডিং কিন্তু হয়নি। বড় টর্চ সঙ্গে ছিল। হেঁটেই ফেরার সিদ্ধান্ত নিল ওরা। শুক্লপক্ষ, আকাশে চাঁদও ছিল। কৌশিক দেবযানীর কাছে জানতে চায়, কেমন দেখলে হিমুকে?

—একই রকম। বরং আরও ডিপ্রেস্ড। আসলে শরীর খারাপ-টারাপ কিছু নয়, আপনাদের অ্যাভয়েড করবার জন্যই ও নিচে নেমে আসেনি। মানুষজনের সঙ্গে ও দেখা করতে চায় না আজকাল।

পথে চলতে চলতে কথা হচ্ছিল। সুজাতা বলে, তোমার কি মনে হলো বিলকাকু তোমাকে আগলে রাখলেন, যাতে হেমন্তবাবুর সঙ্গে তোমার জনান্তিকে কোনও কথাবার্তা না হয়?

—হ্যাঁ, তাই। কিন্তু সেটা এমন দৃষ্টিকটুভাবে করলেন….

মাঝরাস্তায় চলতে চলতে সে-সব কথা আলোচনা করা চলে না। দেবযানী মনে মনে ঘটনাটা আবার পর্যালোচনা করতে থাকে। হেমন্ত মাঝে একবার বলেছিল, ‘ড্যাডি তুমি নিচে গিয়ে বস। সেখানে গেস্টরা তোমার অপেক্ষা করছেন।’ কর্নেল তার জবাবে বলেছিলেন, ‘বসন্তকে তাই বসিয়ে রেখে এসেছি। কিন্তু আমি বলি কি হিমু—তোদের এ সব জনান্তিকে আলাপ-টালাপ আমার আর ভাল লাগছে না। তোদের বিয়েটা যে হওয়া সম্ভবপর নয়, তা তুইও জানিস আমিও জানি। দেবযানী নিজেও তা এতদিনে বুঝেছে। ফলে…

এই সময় দেবযানী চট করে উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ‘ঠিক আছে, চলুন। আমিও নেমে যাচ্ছি। আপনাকে পাহারা দিতে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না।’ কর্নেল ওর পিঠে হাত দিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমাদের দুজনের ভালর জন্যই বলছি। যা হবার নয়, তা হবে না। অহেতুক বন্ধন বাড়িয়ে কী লাভ, দেবি?

কৌশিক হঠাৎ প্রশ্ন করে, কর্নেল পাঠক কি পাস-করা ডাক্তার?

—পাস-করা কি না জানি না। তবে হোমিওপ্যাথি ডাক্তার তো বটেই

—না, সে কথা নয়। বসন্তবাবু কথা প্রসঙ্গে দু’বার ইঙ্গিত দিয়েছেন—নিজের অজান্তে কি না জানি না—যে উইলিয়াম পাঠক অ্যালোপ্যাথ ডাক্তার। একবার তিনি বলেছিলেন, আদমগড় থেকে হায়ার সেকেন্ডারি পাস করে ওঁরা কলকাতায় গিয়েছিলেন কলেজে পড়তে। বিল্ ভর্তি হলেন মেডিকেলে, উনি আর্ট স্কুলে। দ্বিতীয়বার উনি বলেছিলেন একাত্তর সালে ক্যাপ্টেন পাঠক অ্যাটাচ্‌ড় ছিলেন একটি মেডিকেল হাসপাতালে। মিলিটারি ডাক্তারেরাও তো মেজর বা কর্নেল হয়, জানতে চাইছি।

দেবযানী বললে, ওঁর নেমেপ্লেটে বা লেটার হেডে কখনো কোনো মেডিকেল ডিগ্রির উল্লেখ দেখিনি। তবে আদমগড়ে অনেকে ওঁকে ‘ডাক্তারবাবু’ বলে উল্লেখ করেন—যেহেতু উনি বিনা-পয়সার হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করেন।

সুজাতা জানতে চায়, তুমি বসন্তবাবুর আঁকা কোনও ছবি কখনো দেখেছ?

—না। শুনেছি উনি খুব ভাল ছবি আঁকতেন। গায়ত্রী কাকিমার অপঘাত মৃত্যুর পর উনি সব ছবি নষ্ট করে ফেলেন। ওই একখানাই বেঁচে গেছে। বিল্কাকুর হেপাজতে থাকায়।

হঠাৎ বাঁ-দিকের একটা দ্বিতল বাড়ি দেখিয়ে দেবযানী বলে, ওইটা হচ্ছে শ্রীধর জেঠুর বাড়ি।

—চেম্বার? না ওখানে থাকেন উনি?

—একতলাটা চেম্বার। দোতলায় সপরিবারে থাকেন।

—তাহলে চল। দেখা করে যাই।

সুজাতা জানতে চায়, ডাঃ ধরের সঙ্গে আবার কী দরকার?

কৌশিক জবাবে বলে, মনে নেই? মামু বলেছিলেন, ‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই।’

চেম্বারটা দু-কামরার। সামনে রিসেপশান। একটি ভৃত্যশ্রেণীর লোক বসে আছে। এখনো ডাক্তারবাবুর অপেক্ষায় একজন মধ্যবয়সী দশনার্থী রুগী এঘরে বসে আছেন।

ছেলেটি বলে, আপনারা একটু বসুন। ওই ওঁর হয়ে গেলেই

এ-প্রান্তের দর্শনার্থী বললেন, দেবযানী যে! তোমার আবার কী হলো?

দেবযানী তাঁর দিকে ফিরে বলেন, না, কেশবকাকা, আমার কিছু হয়নি। এঁদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছি শুধু।

ঠিক তখনই ডাক্তারবাবুর চেম্বার থেকে একজন রুগী বার হয়ে গেলেন। কেশববাবুর ডাক পড়ল ভিতরে।

তারও খানিক পরে, কেশববাবুর প্রস্থানে সুজাতা-কৌশিককে নিয়ে দেবযানী প্রবেশ করল ডক্টর ধরের চেম্বারে।

—কী ব্যাপার দেবযানী? কবে এলে? আর অসুখটা কার? তোমার,না এঁদের কারও?

দেবযানী বলল, আমরা সবাই সুস্থ আছি জেঠু। আমি এঁদের দুজনকে আপনার সঙ্গে আলাপ করাতে নিয়ে এসেছি। ফর য়োর ইনফরমেশন, জেঠু, আপনার আজকের শেষ ভিজিটার ছিলেন কেশবকাকা।

—ইজ দ্যাট সো?

— পর্দা সরিয়ে ও ঘরটা এক নজর দেখে নিলেন ডক্টর ধর। তারপর ওঁর রিসেপশানিস্ট ছেলেটিকে বললেন, নিতাই, তুই এবার সদর দরজা বন্ধ করে উপরে যা। আজ আর রুগী দেখব না। একটু পরে এসে খোঁজ নিস। দেখি, এঁরা চা খাবেন না কফি।

বোঝা গেল—নিতাই ওঁর রিসেপশানিস্ট-কাম-গৃহভৃত্য।

ফিরে এসে নিজের চেয়ারে বসলেন। বললেন, আপনারা যে আদমগড়ের বাসিন্দা নন তা বলতে হবে না। নাহলে চিনতে পারতাম।

দেবযানী বলে, তা সত্ত্বেও ওঁরা দুজন আপনার চেনা—খুবই পরিচিত।

ডাক্তার আবার সুজাতা-কৌশিককে খুঁটিয়ে দেখে মাথা নাড়লেন। দেবযানী বলে, কাঁটা- সিরিজের এত এত বই আমার কাছ থেকে নিয়ে পড়েও আপনি ‘সুকৌশলী’কে চিনতে পারলেন না!

—মাই গড! মিস্টার কৌশিক অ্যান্ড সুজাতা মিত্র। আমি তো স্বপ্নেও ভাবিনি!

কৌশিক দেবযানীর দিকে ফিরে বলল, কিন্তু শর্ত ছিল তুমি আমাদের পরিচয়টা আদমগড়ের কাউকে জানাবে না।

দেবযানী বলে, কিন্তু ব্যতিক্রমই তো নিয়মের পরিচায়ক, কৌশিকদা। বাবা একজন ব্যতিক্রম। তাঁকে আগেই বলেছি। ডাক্তারজেঠুও তাই! রুগীর গোপন কথা উনি পাঁচজনকে বলে বেড়ান না।

ডাক্তারবাবু সায় দেন, সে-কথা একশো বার। আপনাদের দুজনকে….

বাধা দিয়ে কৌশিক বলে, ‘আপনি’ নয়, ‘তুমি’! আমরা দুজন আপনার পুত্র-পুত্রবধূর বয়সী।

—দ্যাটস কারেক্ট! এতক্ষণে আন্দাজ করেছি, তোমরা দুজন কেন এসেছ আদমগড়ে। অর্থাৎ দেবযানীর বিয়েটা যাতে ভেস্তে না যায়। তাই না?

—আজ্ঞে হ্যাঁ! এ বিষয়ে আমরা আপনার সাহায্যপ্রার্থী।

–প্রফেশনাল এথিক্সে না আটকালে আমি তোমাদের সব রকম সাহায্য করতে রাজি! দেবি আমার মেয়ের মতন। তাকে দারুণ ভালবাসি। তেমনি ভালবাসি হেমন্তকেও। কিন্তু তার আগে বল কী খাবে?

সুজাতা বলে, চা-কফি কিছু নয়। শুধু ‘সন্দেশ’! যা চিবিয়ে খেতে হয় না—কানে শুনতে হয়।

হো হো করে হেসে উঠলেন ডাক্তারবাবু।

ডক্টর ধরের কাছ থেকে জানা গেল, আদমগড়ে হায়ার সেকেন্ডারি আবাসিক স্কুল থাকা সত্ত্বেও একাধিক অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তার নেই। শ্রীধরকে নিয়ে এসে বসিয়েছিলেন কর্নেল পাঠকের পিতা—তাই একমাত্রই তিনিই টিকে আছেন। এখানে একটি প্রাইমারি হেল্থ্সেন্টার আছে বটে, কিন্তু অব্যবস্থার জন্য বিশেষ কেউ সেদিকে ভেড়ে না। ফলে, ডাক্তার-নার্স-কর্মীরা আসে-যায়। মাসান্তে মাহিনা নেয়। এরপর কৌশিক জানতে চায়, কর্নেল পাঠক কি মেডিকেল কলেজে পড়েছিলেন? উনি কি অ্যালোপ্যাথ ডাক্তার?

একটু ইতস্তত করে ডক্টর ধর বললেন, কথাটা আমার কাছ থেকে জেনেছ এ-কথা প্রচার হলে আমার ক্ষতি হবার আশঙ্কা। হ্যাঁ, ভর্তি হয়েছিল। চার বছর পড়েও ছিল। পাস করতে পারেনি।

—পরের বছর পরীক্ষা দেননি কেন?

—ও টোকাটুকি করতে গিয়ে ধরা পড়ে যায়। রাসটিকেটেড হয়েছিল। তাই পরে মিলিটারিতে জয়েন করে।

—বুঝলাম। আপনি কি পাঠক-প্যালেসের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান?

—আদৌ না। বাড়ির লোকদের সব চিকিৎসা বিল্ নিজেই করে

— হোমিওপ্যাথি?

— ব্যতিক্রম ক্ষেত্র বাদ দিলে।

—ব্যতিক্রম ক্ষেত্র? যেমন গায়ত্রী দেবীর সর্প-দংশন?

না। আমাকে সেবার ডেকে পাঠানো হয়েছিল চিকিৎসা করতে নয়। অ্যান্টিভেনাম ইনজেকশনের রিকিউজিশনটা দিতে। সেটা ডাক্তারের প্রেসক্রিপশান ছাড়া পাওয়া যায় না।

—তাহলে ব্যতিক্রম ক্ষেত্র বলতে কী বোঝাচ্ছেন?

এবার ডক্টর ধর দেবযানীর দিকে ফিরে বলেন, আমার মনে হয় সব কথাই আমার খুলে বলা উচিত, দেবযানী-মা! তোমরা যে আমার কাছ থেকে জানতে পেরেছ, সেটা প্ৰকাশ না পেলেই হলো।

ডক্টর ধর যে তথ্যটা জানালেন তা রীতিমতো বিস্ময়কর।

বাস্তবে বিল্ পাঠক তাঁর পুত্রকে প্রাণাধিক ভালবাসেন। অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসায় তাঁর যে আপত্তি, দৃঢ় অবিশ্বাস, সেটা একটা সাইকলজিক্যাল অবসেশান থেকে। বিলের চেয়ে ডক্টর ধর বছর দশেকের বয়োজ্যেষ্ঠ। বিল যখন মেডিকেল কলেজে পড়তেন তখন ছুটিছাটায় আদমগড়ে এলে ডক্টর ধরের কাছে মেডিকেল বই নিয়ে পড়তে আসতেন। সে হিসাবে উনি ওঁর গুরুস্থানীয়। বিল্ পাঠক ছাত্র ছিলেন ভালই। ফাইনাল ইয়ারে টোকাটুকি করতে গিয়ে ধরা না পড়লে তিনি অনায়াসে ভালভাবে পাস করে যেতেন। রাটিকেটেড হওয়ায় তাঁর একটা মানসিক বিপর্যয় ঘটে যায়। আগমগড়ের প্রাচীন বাসিন্দারা জানেন—অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে তিনি মেডিকেল পড়া ছেড়ে দেন। আসল কথাটা ওঁর ঘনিষ্ঠ বঙ্কু বসন্তকাকু পর্যন্ত জানেন না। বোধকরি আদমগড়ে ডক্টর ধরই একমাত্র ব্যক্তি যিনি প্রকৃত তথ্যটা জানেন। বিল্ পাঠক হোমিওপ্যাথি পড়ে তারই প্র্যাকটিস শুরু করেন। কিন্তু হিমুর ক্ষেত্রে তাঁর বিচিত্র ব্যতিক্রম হলো। হোমিওপ্যাথিতে যখন উনি হালে পানি পেলেন না তখন গোপনে এসে দেখা করেছিলেন ডক্টর ধরের সঙ্গে। আদ্যোপান্ত সব কথা খুলে বলেছিলেন। কলিমুদ্দিন মিঞার বাড়ি থেকে উনি একটা রক্তমাখা ক্ষুর উদ্ধার করে এনেছিলেন। তাতে ঘাতকের আঙুলের ছাপ ছিল। বিল্ পাঠক ডক্টর ধরের মাধ্যমে দুটি ফিঙ্গার-প্রিন্ট কলকাতার ফরেনসিক ল্যাবরেটারিতে পাঠিয়ে নিঃসন্দেহে হয়েছিলেন—অপকীর্তিটি হিমুরই। তার ‘সোমনাম্‌বোলিজম্’ ডেভেলপ করেছে। ঘুমের ঘরে সে বাড়ি থেকে ক্ষুর হাতে বার হয়ে কলিমুদ্দিনের ঝোপড়ায় যায়। পাঁঠার গলা কেটে ক্ষুরটা সেখানেই ফেলে রেখে বাড়ি ফিরে আসে। হাতটাত না ধুয়েই রাত্রে ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন সকালে ওকে রক্তমাখা অবস্থায় দেখে বিল্‌ পাঠক স্বয়ং তদন্তে যান, আর ক্ষুরটা কুড়িয়ে আনেন। কলিমুদ্দিনকে পাঁঠার দামটা মিটিয়ে দেন, কিন্তু প্রচণ্ড আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। সেদিনই ডক্টর ধরের সঙ্গে দেখা করেন। সকালে ঘুম ভেঙে নিজের জামা-কাপড়ে রক্ত দেখে হিমুও প্রচণ্ড খাবড়ে যায়। কলিমুদ্দিনের পাঁঠার কাহিনী তখন গ্রামসুদ্ধ লোকে জানে। সেও শিক্ষিত মানুষ। বুঝতে পারে ঘুমের ঘোরে সে নিজেই এই অপকর্মটি করেছে। কর্নেল পাঠক ওকে মিলিটারির কমিশন পদ থেকে পদত্যাগ করতে বলেন। হিমু এককথায় রাজি হয়ে যায়। কারণ যে দুর্ঘটনা ছুটিতে থাকাকালীন বাড়িতে ঘটেছে সেটা ওদের মিলিটারি ব্যারাকে ঘটলে কেলেঙ্কারির চূড়ান্ত হতো। পাঁঠার বদলে ডর্মিটারিতে পাশের খাটে ঘুমন্ত কোনও সহকর্মীর গলায় ক্ষুরটা বসালে ‘মার্ডার’ না হোক ‘হোমিসাইড’ চার্জে তার কোর্ট-মার্শাল হতো। প্রচণ্ড অবসাদে হিমু ভেঙে পড়ে।…এরপর কাউকে কিছু না জানিয়ে কর্নেল পাঠক ও ডক্টর ধর হিমুকে নিয়ে কলকাতা চলে আসেন। একজন প্রখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্ট ডক্টর রায়চৌধুরীর শরণ নেন। তাঁর মতে অসুখটা বংশানুক্রমিক হতে পারে। তিনি ওষুধপত্রের ব্যবস্থা দেন—দু’দিন অন্তর একদিন একটা ইন্ট্রাভেনাস ইনজেকশনের ব্যবস্থাও করেন। দু’দিন অন্তর ডক্টর ধরের পক্ষে পাঠক-প্যালেসে আসা ভাল দেখায় না, তাই কর্নেল পাঠক নিজেই দায়িত্বটা গ্রহণ করলেন। চার বছর মেডিকেল স্কুলেজে পড়া ছাত্রের পক্ষে ইন্ট্রাভেনাস ইনজেকশান দেওয়া কোনো শক্ত কাজ নয়। দিন-পনেরো ভালই কাটল। তারপর আবার ঘটল একটা দুর্ঘটনা। এবার প্যালেসের ভিতরেই। প্যালেস-কম্পাউন্ডের পিছন দিকে আছে ওঁর পোলট্রি। শেষরাত্রে সেখান থেকে মুর্গির মরণান্তিক আর্তনাদ অনেকেই শুনেছে। কিন্তু তখন প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল বলে ঠাকুর-চাকর বা দারোয়ানরা সরেজমিন তদন্তে যায়নি। কিন্তু বিল্ পাঠক স্থির থাকতে পারেননি। বিনা ছাতা বা বর্ষাতিতে ছুটে গিয়েছিলেন অকুস্থলে। গিয়ে দেখেন, পোলট্রির খাঁচা খোলা। মুর্গিগুলো বৃষ্টির মধ্যে সারা বাগানে দাপাদাপি করছে। আর একটা রক্তমাখা ভোজালি হাতে দাঁড়িয়ে আছে হিমু। তিনটে মুর্গির গলা কাটা হয়ে গেছে। হিমুর হাতে মুর্গির নখের বীভৎস ক্ষত। উনি গিয়ে ওকে জাপটে ধরতেই হিমুর জ্ঞান ফিরে আসে।

উপসংহারে ডক্টর ধর বলেন, সেদিন বিকালেই তুমি ওর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলে, দেবি। আর তখনই ও তোমাকে বলেছিল যে, সে তোমাকে বিয়ে করতে অস্বীকৃত!

—তারপর আর ওকে ডক্টর রায়চৌধুরীর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়নি?

—না। বাপ-বেটা দুজনেই চরম ফ্রাস্ট্রেশনের শিকার হয়ে পড়লেন। আমি বারে-বারে বলেও ওদের কাউকে রাজি করাতে পারিনি।

এরপর নিস্তব্ধতা ঘনিয়ে আসে। দেবযানী আঁচলে চোখ দুটি চাপা দেয়। ডক্টর ধর উঠে এসে ওর পিঠে একখানা হাত রেখে বললেন, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দাও দেবি। তোমাদের বিয়ের পরেও তো এ রোগের আক্রমণ হতে পারত, কিন্তু ততক্ষণে তো তুমি ওর সঙ্গে অচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে পড়তে। হয়তো তোমাকেই

দেবযানী টেবিলের উপর মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।

সাত

টেলিফোনের একটানা আওয়াজটা শুনেই বুঝতে পারেন এটা এস. টি. ডি., বাইরের কল। শিভ্যাস রিগ্যালের গ্লাসটা টি-পয়ে নামিয়ে রেখে টেলিফোনের কথামুখে বললেন : বাসু স্পিকিং…

—মামু, আমি কৌশিক, আদমগড় থেকে বলছি।

—কোনো টেলিফোন বুথ থেকে? না, দীনেশবাবুর বাড়ি থেকে? ঘরে আর কেউ আছে কি? যাতে আমাকে….

—না, মামু, ঘরে সুজাতা ছাড়া আর কেউ নেই। অনেক খবর জমেছে, একে-একে বলি শুনুন।

সারা দিন নানান সূত্র থেকে সংগৃহীত তথ্যের চুম্বকসার দাখিল করে। একটি কাগজে প্রধান ‘পয়েন্টস্’গুলো টুকে নিয়ে রেখেছিল।

বাসু জানতে চাইলেন, হিমুকে দেখে কী মনে হলো? ডিসব্যালেন্সড?

কৌশিক কুণ্ঠিত স্বরে জানায় যে, হিমুকে ওরা এখনো দেখেইনি!

বাসু বললেন, বুঝেছি! ‘সুকৌশলী’র দ্বারা হবে না এটাই বলতে চাইছ তো? অর্থাৎ আমাকেই যেতে হবে। শোন, আগামীকাল দুপুরের তিস্তা-তোর্সা ধরে সন্ধ্যা নাগাদ আমি আজিমগঞ্জে পৌঁছাব। একটা গাড়ি নিয়ে স্টেশানে থেক। তখন কথা হবে।

কৌশিক কুণ্ঠিতভাবে বলে, কিন্তু মামিমা ওখানে একা…

—সেটুকু কর্তব্যবোধ তোমার মামার আছে।

লাইনটা কেটে দিতেই রানী বলেন, কাল তুমি আদমগড়ে যাচ্ছ?

—উপায় কী বল? তুমি একবার টেলিফোনে নিখিল অথবা কাকলিকে ধর তো?

একটু পরেই নিখিল দাশকে ধরা গেল। বাসু বললেন, নিখিল, একটা বিশেষ কাজে কাল দুপুরের তিস্তা-তোর্সা ধরে আমাকে একবার আজিমগঞ্জে যেতে হবে। তোমাদের ওই ভি.আই.পি কোটায় আমার একখানা টিকিট কেটে দিতে পার?—এ.সি/ফার্স্ট ক্লাস যা পাওয়া যায়। না পেলে সেকেন্ড ক্লাস বার্থ। আপার বার্থ হলেও আপত্তি নেই।

নিখিল দাশ বর্তমানে কলকাতা পুলিশের মেজ-কর্তা। অর্থাৎ অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনার, ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট। বাসু-সাহেবের পরম ভক্তদের একজন। সে জানতে চাইল না, বাসু- সাহেব হঠাৎ কেন আজিমগঞ্জে যাচ্ছেন। বললে, কাল সকালেই আমার লোক আপনাকে টিকিট পৌঁছে দিয়ে আসবে। একখানা তো? কৌশিক-সুজাতা…

—তারা ওখানেই আছে। আমাকে রিসিভ করবে।

—সেকি! তাহেল মামিমা কার হেপাজতে থাকবেন?

—কাকলির। তাকে কাল পৌঁছে দিয়ে যেও। দু-তিন দিনের মধ্যেই ফিরে আসব আমি। অথবা ওরা দুজন। কাকলি অনেকদিন বাপের বাড়ি আসেনি তো, তাই এই ব্যবস্থা করলাম। বউকে রেখে যেতে তোমার অসুবিধা হবে না তো?

—এটা কী বলছেন, স্যার? তাই হবে। আর কিছু।

—হ্যাঁ। তোমাদের ডি.আই.জি. নর্দানা-রেঞ্জ এখন কে? তাঁর নাম আর টেলিফোন নাম্বারটা চাই—

নিখিল বলে, বর্তমানে ডি.আই.জি. নর্দার্ন রেঞ্জ আপনার বিশেষ পরিচিত এবং গুণগ্রাহী—বিকাশ রায়চৌধুরী, মানে আপনার কাছে যার পরিচয় : ‘বাচ্চু।

—বাচ্চু নর্থ বেঙ্গলে বদলি হয়েছে? কবে? এই তো সেদিন চিনসুরায় ছিল, বার্ডওয়ান রেঞ্জে। ওর টেলিফোন নাম্বারটা দিতে পার? রেসিডেন্সের!

একটু পরে বিকাশ রায়চৌধুরী, ওরফে ‘বাচ্চু কে তাঁর বাড়িতে পাকড়াও করা গেল। তিনি বিস্মিত হলেন শুনে যে, বাসু-সাহেবকে আদমগড় যেতে হচ্ছে সরেজমিন তদন্ত করতে—ভায়া আজিমগঞ্জ। জানতে চাইলেন, আদমগড়ে কোনও খুন-টুন হয়েছে বলে শুনিনি তো?

—আদমগড়ের কাউকে চেন তুমি?

—আলবাৎ! আমাদের খবর আগামীবার ওখানকার প্রাক্তন জমিদার কর্নেল উইলিয়াম পাঠক পার্টি-নমিনেশনে বিধানসভার ইেেলকশনে দাঁড়াবেন। তা ওখানে থাকবেন কোথায়? হোটেল বা ডাকবাংলো আছে বলে তো শুনিনি। থাকলেও সে তো আপনার পোষাবে না।

—না, বাচ্চু, হোটেল না, আমি ওই কর্নেলের পাঠক-প্যালেসেই উঠব। দু-একদিনের ব্যাপার তো।

—কিন্তু ওখানে কোনও খুন হয়েছে বলে তো—

—না, হয়নি। হতে চলেছে। হতে পারে। সেটাকে রুখতেই যাওয়া।

মুহূর্তমধ্যে ডি.আই.জি নর্দার্ন রেঞ্জ-এর কণ্ঠস্বর থেকে রসিকতার শেষ বাস্পটুকুও উপে গেল। অত্যন্ত সিরিয়াসলি বললেন, শড আই কাম ডাউন, অ্যাজ ওয়েল, স্যার?

—না, না, তুমি এসে কী করবে? তাহলে আততায়ী সাবধান হয়ে যাবে। তুমি বরং আজিমগঞ্জের এস.ডি.পি.ও.কে একটা টেলিফোন অথবা ফ্যাক্স করে দাও, আগামীকাল সন্ধ্যায় আজিমগঞ্জে তিস্তা-তোর্সা অ্যাটেন্ড করতে। আমি টিকিট হাতে পাইনি এখনো। কোন ক্লাসে যাব তা জানি না। সে যেন ফার্স্ট ক্লাস ওয়েটিং রুমে আমার জন্য অপেক্ষা করে। আর আমার পরিচয়টা তাকে জানিয়ে রেখ। পুলিস-রুলস্ ভায়োলেট না করে সে যেন আমাকে যেটুকু সম্ভব সাহায্য করে। দু-চারটে মিথ্যে কথা হয়তো তাকে বলতে হবে।—তা, পুলিসের এথিক্যাল- কোডে তো “সদা সত্য কথা বলিবে”–এ রকম কোনো নির্দেশ নেই, কী বল?

—আজ্ঞে না, নেই। বরং ইঙ্গিত আছে, উদ্দেশ্য মহৎ হলে ‘মিথ্যাং ব্রুয়াৎ, অনৃতং ব্রুয়াৎ, মা ব্রুয়াৎ সত্যক্ষতিকারকবাক্যম্!

—কারেক্ট। তাহলে আরও একটা কাজ কর। আগামীকাল রাত আটটা নাগাদ আদমগড়ে ওই কর্নেল পাঠককে এস.টি.ডি. করে জানিয়ে দিও যে, আমি ভারতীয় নিরাপত্তার কারণে একটা গোপন তদন্তে আদমগড় যাচ্ছি ‘অ্যাজ এ স্পেশাল অফিসার অফ দ্য হাইকোর্ট। ব্যাপারটা চূড়ান্ত গোপন। কেমন? সেটা সম্ভব?

—অতি সহজেই।

—থ্যাংক য়ু!

—য়ু আর ওয়েলকাম, স্যার।

.

আজিমগঞ্জে তিস্তা-তোর্সা যখন পৌঁছাল তার আগেই দিনান্তের ক্লান্ত সূর্য অস্ত গিয়েছেন। বাতি জ্বলে উঠেছে প্লাটফর্মে। বাসু-সাহেব দরজা খুলে দাঁড়িয়ে ছিলেন, ছোট সুটকেস হাতে। চলন্ত গাড়ি থেকেই দেখতে পেলেন কৌশিক-সুজাতা প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে। সঙ্গে একজন য়ুনিফর্মধারী পুলিশ অফিসার। বোঝা গেল, সে ওয়েটিং রুমে বসে থাকেনি। হয়তো ‘সুকৌশলী’কে চেনে।

বাসু-সাহেব নেমে পড়তেই সেই পুলিশ অফিসারটি এগিয়ে এসে নমস্কার করে বললে, আমি স্যার, আজিমগঞ্জ-সাব্‌ডিভিশানের এস.ডি.পি.ও. মুস্তাক আহমেদ।

বাসু তার সঙ্গে করমর্দন করে বললেন, গ্ল্যাড টু মীট য়ু অফিসার! তুমি কি আমাকে চিনতে?

আহমেদ মৃদু হাসল—জবাবটা বাহুল্য বোধে।

বাসু বললেন, কিছু আলোচনা করার আছে। চল, সকলে প্রথমে ফার্স্ট ক্লাস ওয়েটিং রুমে গিয়ে বসি।

সকলে ওয়েটিং রুমে গিয়ে বসলেন। এস.ডি.পি.-ওর নির্দেশে একজন পুলিশ ছুটল রেলওয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে চা-কফির ব্যবস্থা করতে, আর একজন পাহারায় থাকল ভেজানো দরজার সামনে। ওপাশে।

বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ। অন্যান্য ফার্স্টক্লাস টিকিটধারীরা এ দিগড়ে ভিড়লেন না।

বাসু সরাসরি তাঁর বক্তব্যে এলেন। বললেন, বাচ্চু, আই মীন, বিকাশ, নিশ্চয় তোমাকে জানিয়ে দিয়েছে যে, আমি এখান থেকে সোজা আদমগড় যাব। ওখানকার পাঠক-প্যালেসের ভিতর বিশ্রী একটা ষড়যন্ত্র ঘনিয়ে উঠছে। একজনের খুন হয়ে যাবার আশঙ্কা। সম্ভাব্য ভিকটিম্‌টি কে এবং কে, কীভাবে, কেন তাঁকে খুনের চেষ্টা করছে, তা-ও আমি আন্দাজ করেছি। তবে আমার হাতে যথেষ্ট এভিডেন্স নেই যাতে সেই সম্ভাব্য আততায়ীকে এখনই অ্যারেস্ট করাতে পারি। আমি ওখানে ছুটে যাচ্ছি সেই হত্যাকাণ্ডটি রুখতে!…বাই দ্য ওয়ে, আহমেদ, তুমি এঁদের দুজনকে চেন তো?

–ভালভাবেই চিনি, স্যার। বলুন কী বলছিলেন?

—তোমার সাহায্য আমার প্রয়োজন দুটি বিষয়ে। প্রথম কথা, কিছু ইনফরমেশন। প্রায় ত্রিশ বছর আগে-–1968 থেকে 1970-এর ভিতরে বাঙলা-বিহার সীমান্তের গঞ্জ শহর আলিনগরে একটা ডাকাতি হয়েছিল। সাম মিস্টার সাহার বাড়িতে। সাহার একটি ফরেন লীকার শপের দোকান ছিল। মস্ত বড়লোক। ঘটনা ঘটে তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যা বাতাসীর বিবাহ রাত্রে। ডাকাতেরা জীপে চেপে এসেছিল, স্টেনগান হাতে। প্রচুর অর্থ ছাড়াও সালঙ্কারা নববধূকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। তার পক্ষকালের মধ্যে ওই আদমপুরের কর্নেল বিল্‌ পাঠক—তখন তিনি ক্যাপ্টেন—নিজের জীবন বিপন্ন করে মেয়েটিকে উদ্ধার করে আনেন। এ কেসটার কথা তুমি জান?

—সে ঘটনা তো স্যার এ অঞ্চলের ‘লিভিং লিজেন্ড’! বাতাসী দেবী আজও জীবিতা। শুনেছি, ওই পাঠক-প্যালেসেই আছেন। আরও শুনেছি, কর্নেল পাঠক তাঁর সঙ্গে একজন বিহারী পাত্রের বিবাহ দিয়েছিলেন; কিন্তু তিনি সন্ন্যাস নিয়ে গৃহত্যাগ করেন।

—কারেক্ট। আমি যতদূর জানি, মেয়েটিকে উদ্ধার করা হয় আলিনগরের উত্তরে একটা জঙ্গল থেকে। জঙ্গলটার নাম ‘কঙ্কালীতলা’। আলিনগরের থানায় পুরনো রেকর্ডে কী পাওয়া যায়, দেখ। আমি জানতে চাই, ওই এনকাউন্টারে যে তিনজন ডাকাত মারা যায় তাদের নাম এবং তারিখটা। রাত্রে আলিনগর থানার ও.সি.র সঙ্গে কথা বল, সাহাদের মদের দোকানেও নিশ্চয় ফোন আছে। আমি আজ রাতটা থাকব আদমগড়ের হেডমাস্টারমশায়ের বাড়িতে। তাঁর নাম, ঠিকানা আর টেলিফোন নাম্বারটা এদের কাছ থেকে জেনে নাও। কাল সকাল সাড়ে ছয়টায়-সাতটায় আমাকে একটা টেলিফোন করে জানিও তুমি কতদূর কী জানেেত পারলে। কোনও প্রশ্ন আছে এ ব্যাপারে?

—না স্যার, আর কোনও নির্দেশ?

—ইয়েস। আমি কাল সকাল আটটা নাগাদ কর্নেল পাঠকের বাড়িতে যাব। তুমি অ্যারাউন্ড সাড়ে-আটটায় এস। ওঁর সঙ্গে টেলিফোনে কোনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট না করে। আমার মূল উদ্দেশ্য : কর্নেল পাঠকের বেডরুমটা—বিশেষ করে ওই ঘরে বা সংলগ্ন বাথরুমে কোনও মেডিসিন-ক্যাবিনেট থাকলে সেটা সার্চ করে দেখা। কোনও ‘আনকমন’ ‘ওষুধ, ট্যাবলেট বা আম্পুল দেখতে পেলে তার নামটা সংগ্রহ করা। আয়োডিন, ডেটল, বোরোলিন জাতীয় ওষুধ নয়। অচেনা কোনও ওষুধ—

আহমেদ কুণ্ঠিত হয়ে বললে, সেটা কেমন করে সম্ভব হবে স্যার? তাহলে তো সার্চ- ওয়ারেন্ট করিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

—না, আহমেদ, তার দরকার হবে না। তুমি সাড়ে-আটটা নাগাদ পাঠক-প্যালেসে এস। ধড়াচূড়া পরে, দুজন বুদ্ধিমান সহকারীকে নিয়ে। সেখানে ড্রইংরুমে আমাকে পাবে। দেখবে, আমি এমন একটা আষাঢ়ে গল্প কর্নেল-সাহেবকে শোনাব যে, তিনি নিজে থেকেই তোমাকে তাঁর ঘরটা সার্চ করে দেখতে বলবেন।

—এনিথিং মোর, স্যার?

—নো থ্যাংকস্। এবার তাহলে ওঠা যাক।

ঠিক সেই সময়েই আহমেদের এন্তাজামে রেলওয়ে রেস্তোরাঁ থেকে চা-কফি-বিস্কিটের প্লেট নিয়ে ঘরে ঢুকল তকমাধারী খিদমদারেরা।

.

পরদিন সকাল ঠিক আটটার সময় বাসু-সাহেব একাই এসে পৌঁছালেন পাঠক-প্যালেসের দোরগোড়ায়। কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট না করেই। কলবেল বাজানোর একটু পরে একটি পরিচারিকা এসে দোর খুলে দিয়ে মাথায় ঘোমটা তুলে দিল। বাসু আন্দাজ করলেন সেটি বটুকের স্ত্রী সৌদামিনী। বললেন, তোমার সাহেবকে এই ভিজিটিং কার্ডখানা দেখাও।

অবগুণ্ঠনবতী বললে, আপনে ওই বৈঠকখানায় বসেন, আমি উপরে খপর দে-আসি।

বৈঠকখানা ঘরটি প্রকাণ্ড। মাঝে একটা সেন্টার-টেল। তার চারপাশে ঘিরে আরামদায়ক সোফা-সেটি। একান্তে—জানলার ধারে একটি ইজিচেয়ার। ঘরের কেন্দ্রস্থলে সিলিঙ থেকে ঝুলছে একটি ঝাড়বাতি। সাবেকী-অনুকরণে। বাস্তবে তার ভিতর আছে একাধিক ইলেকট্রিক বাল্ব। পেলমেটের নিচে প্রতিটি জানলায় গোপন ফ্লুরেসেন্ট লাইট। দেওয়ালে নিসর্গ-চিত্র। অধিকাংশই তেলরঙে আঁকা। কোনও প্রতিকৃতি-চিত্র নজরে পড়ল না বাসু-সাহেবের। কারণটা অনুমান করলেন উনি। এমন সাবেকী জমিদার বাড়িতে প্রতিকৃতি-চিত্র প্রত্যাশিত। কিন্তু এ বাড়িতে তা বিশেষ চিত্রশালায় সুসজ্জিত।

মিনিট-খানেকের ভিতরেই ব্যস্ত-সমস্তভাবে কর্নেল নেমে এলেন, বাসু-সাহেবের সঙ্গে করমর্দন করে ইংরেজিতে বললেন, কী ব্যাপার বলুন তো? কাল রাত্রেই ডি.আই.জি. আমাকে ফোন করে জানিয়েছেন কী একটা জরুরী কাজে আপনি আমার সঙ্গে দেখা করতে আসছেন। ‘জরুরী’ মানে ব্যাপারটা কী?

বাসু বললেন ব্যস্ত হবার কিছু নেই। বসুন। অনেক কথা আছে। বাই দ্য ওয়ে—আপনি কি আমার নাম আগে শুনেছেন?

—নো, আয়াম সরি। ডি.আই.জি. বললেন, আপনি হাইকোর্টের একজন সিনিয়র ব্যারিস্টার—ক্রিমিনাল সাইডের। কী ব্যাপার মশাই?

—বলছি। তার আগে আমাকে কিছু তথ্য সরবরাহ করুন দেখি। বছর ত্রিশেক আগে আপনি কি আলিনগরের উত্তরে ‘কঙ্কালীতলা’ নামে একটা জঙ্গল থেকে একটি বন্দিনীকে উদ্ধার করে এনেছিলেন? ডাকাতদের কবল থেকে? আর সেই একাউন্টারে তিনজন ডাকাত মারা যায়?

—তা যায়। কিন্তু সে সব তো সত্যযুগের গল্প মশাই। আজ তা নিয়ে নতুন করে কথা উঠছে কেন?

—প্লিজ ডোন্ট আস্ক মি কোশ্চেনস নাউ। আপনার সব কৌতূহল আমি মিটিয়ে দেব। প্রথমে বলুন, সেই এন্কাউন্টারে ডাকাতদলের সর্দার আবদুল রেজ্জাক নিহত হয়েছিল?

—আমি জানি না। ইন ফ্যাক্ট ডাকাতদলের সর্দারের নামই জানি না। কে কে মারা গিয়েছিল তাও জানি না। তবে হ্যাঁ, সে-আমলে শুনেছিলাম, জনাতিনেক ডাকাত ওই এনকাউন্টারে মারা যায়। থ্যাঙ্ক গড়। এজন্য পুলিশ আমার বিরুদ্ধে কোনও চার্জ আনেননি—এনিথিং মোর?

—হ্যাঁ। তারিখটা আপনার মনে আছে?

—মনে নেই, লেখা আছে। দেখে এসে বলব?

—প্লিজ, স্যার!

কর্নেল দ্বিতলে গিয়ে কোনো রোজ-নামচা বা ডায়েরি দেখে এসে বললেন, তারিখটা : শনিবার, সাতই মাৰ্চ, 1970।

—তার মানে প্রায় উনত্রিশ বছর আগেকার কথা। এবার বলুন, গত সাতদিনের মধ্যে আপনার অপরিচিত কেউ কি কোনো ছুতোয়—ভেন্ডার হিসাবে অথবা মার্কেট-সার্ভেয়িং করতে পাঠক-প্যালেসে এসেছিল? বাড়ির ভিতরে ঢুকেছিল?

একটু ভেবে নিয়ে কর্নেল বলেন, না। আমার তো মনে পড়ে না।

–কোনো বেগানা ছুতোর, প্লাম্বার বা রাজমিস্ত্রি…

—জাস্ট আ মিনিট! হ্যাঁ একজন ইলেকট্রেশিয়ান এসেছিল বটে। বাড়ির সব আলো ফিউজ হয়ে যাওয়ায়। ঘণ্টা দুয়েক কাজ করেছিল। কেন বলুন তো?

হাত দিয়ে মাছি তাড়াবার ভঙ্গিতে বাসু যেন প্রশ্নটা উড়িয়ে দিলেন। উল্টে কর্নেলকেই জিজ্ঞেস করেন, সে আপনার অনেকদিনের চেনা মিস্ত্রি? লোকাল ইলেকট্রিশিয়ান?

—ন্‌না! আমার চেনা নয়। সচরাচর যে মিস্ত্রি পাঠক-প্যালেসে কাজ করে তাকে না পেয়ে আমার কাজের লোক ওকে ধরে এনেছিল। বোধহয় তার চেনা লোক, নিশ্চয়ই।

—হ্যাঁ, নিশ্চয়ই তার চেনা লোক, বোধহয়! তা ডাকুন তো আপনার কাজের লোকটিকে।

কর্নেল কলবেল বাজানোতে গরুড়পক্ষীর মতো জোড়হস্তে এসে দাঁড়াল বটুক। তাকে আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে বাসু বললেন, তোমার নাম বটুক না? তারাতলায় এককালে তোমার একটা পানের দোকান ছিল! তাই না?

একগাল হাসিতে বটুক দুটো প্রশ্নেরই জবাব দিয়ে ওঁর পায়ের ধুলো নিল।

—ভীম এখন কোথায়? জেলের ভিতরে না বাইরে?

বটুক আঁৎকে ওঠে। বলে, আজ্ঞে, কার কথা বললেন, হুজুর?

—তোমার শ্বশুরের নাম ভীমা কৈবর্ত নয়? সেই যার ডাকাতি কেসে সাত বছরের মেয়াদ হয়ে যায়?

বটুক মরমে মরে যায়। ঘাড় চুলকে বলে, ত্যানি সগ্যে গেছেন, ছার!

—অ। তা এখন যা জানতে চাইছি তার সঠিক জবাব দাও তো। কদিন আগে তুমি একজন ইলেকট্রিক-মিস্ত্রিকে ডেকে এনেছিল। তাকে তুমি চেন? কী নাম? কোথায় থাকে?

বটুক ঢোক গিলে বলে, আজ্ঞে ভালোনামটা জানি না। সবাই তারে ডাকে ‘কাল্লুমিস্ত্রি’ বলে। ‘বাতি-মহল’-এ ঠিকা কাজ করে। বোধহয় বাতি-মহলের মালিক তারে চিনবে নিশ্চয়। বাসু বললেন, আমারও তাই মনে হয়। নিশ্চয়ই বাতিঘরের মালিকের চেনা লোক, বোধহয় তা তুমি যাও, এক্ষুণি কালুমিস্ত্রিকে ডেকে নিয়ে এস। বলবে, পাম্পটা চলছে না, ছাদের ট্যাঙ্কে জল উঠছে না—খুব জরুরী ব্যাপার!

বটুক বলে, পাম্প তো খারাপ হয়নি ছার

—হয়নি বুঝি? তাহলে তো মুশকিল! তুমি তো আবার মিছে কথা বলতে পার না। সেবার কাঠগড়ায় উঠে মিথ্যে সাক্ষী….

কথাটা তাঁর শেষ হয় না। তার আগেই বাইরের দরজায় কলবেল বেজে ওঠে। বটুক পালাবার পথই খুঁজছিল। এই সুযোগে বলে ওঠে, কাল্লুরে এখনি ধরে আনছি, ছার। দেখি

আবার কে এল সাতসকালে।

ঘরে এলেন এস.ডি.পি.ও মিস্টার আহমেদ। কর্নেল তাঁকে সাদরে আহ্বান জানালেন। আহমেদ দুজনকে নমস্কার করে বাসুকে বললেন, আপনি আমার আগেই পাঠক-প্যালেসে পৌঁছে গেছেন দেখছি!

বাসু একটু বিস্মিত হবার অভিনয় করে বলেন, আমি কিন্তু আপনাকে ঠিক প্লেস করতে পারছি না—

কর্নেল পরিচয় করিয়ে দেন, উনি হচ্ছেন মিস্টার এম. আহমেদ, আমাদের আজিমগঞ্জের এস.ডি.পি.ও

বাসু উঠে দাঁড়িয়ে করমর্দন করে বললেন, গ্ল্যাড টু মীট য়ু। আপনি আমাকে চেনেন তা বুঝতে পারছি কিন্তু আমি যে আজ কর্নেল পাঠকের সঙ্গে দেখা করতে আসছি এটা জানলেন কেমন করে?

—স্যার, মানে ডি.আই.জি নর্দার্ন রেঞ্জ, মিস্টার রায়চৌধুরী, আমাকে এস. টি. ডি. করে জানিয়েছেন। আপনার কোনো পুলিশের সাহায্যের প্রয়োজন হলে যাতে আমি সজাগ থাকি। তাই সাতসকালেই আমি চলে এসেছি

—কিন্তু আমি কোন ব্যাপারে এখানে এসেছি তা কিছু বলেননি?

—বলেছেন। অতি সংক্ষেপে। সেই ‘কঙ্কালীতলার’র কেসটা নয় কি?

—হ্যাঁ তাই। কর্নেল পাঠক এখনো কিছুই জানেন না। তাই সবটাই ওঁর কাছে হেঁয়ালি মনে হচ্ছে। প্রথমে ব্যাকগ্রাউন্ডটা ওঁকে বুঝিয়ে বলা দরকার।

বাসু-সাহেব অতঃপর তাঁর চিরাচরিত প্রথায় একটি নিপাট আষাঢ়ে গপ্পো ফাঁদলেন। শুধু কর্নেল-সাহেব নয়, আহমেদও মুগ্ধ হয়ে গেল। তারও মনে হচ্ছিল সে একটি বাস্তব কাহিনী শুনছে।

কঙ্কালীতলায় ডাকাতদলের সর্দার আবদুল রেজ্জাক নিহত হবার পর দলটা ভেঙে যায়। কেউ যায় মেয়াদ খাটতে। কেউ পালিয়ে। সেই দলের ছিন্নবিচ্ছিন্ন ডাকাতেরা আবার এতদিনে ওই কঙ্কালীতলাতেই একটি দল পাকিয়েছে। বিহারে অনেকগুলি ট্রেন ডাকাতি করেছে। পশ্চিমবঙ্গেও। বর্তমানে সেই দলের নেতা হচ্ছে আবদুল রেজ্জাকের বেটা ‘মামুদ’। পিতার মৃত্যুর সময়ে সে ছিল নিতান্ত বালক। নেপাল সীমান্ত দিয়ে সম্প্রতি পাকিস্তানের আই.এস.আইয়ের একটি জঙ্গী দল ওই মামুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। প্রচুর অর্থ ও অস্ত্রশস্ত্র তারা যোগান দিয়েছে বহরমপুর-অঞ্চলে একটা বড় রকম হাঙ্গামা পাকাবার জন্য। ভোটের আগেই। মামুদের কোনও এজেন্ট এখানে একটা টাইম-বম্ব প্লান্ট করে যাবে। সেটা বিস্ফোরিত হবার আগেই ডাকাতেরা গোপনে পাঠক-প্যালস ঘিরে ফেলবে। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে যখন প্যালেসের একাংশ উড়ে যাবে তখন এ. কে. 47-ধারীরা আক্রমণ করবে সমবেত জনতাকে। তাতে বহু লোক হতাহত হবে নির্ঘাৎ এবং একই সঙ্গে পাঠক-প্যালেসের বিখ্যাত অস্ত্রাগারটিও লুণ্ঠিত হবে। একজন ধরা-পড়ে-যাওয়া ডাকাতের স্বীকারোক্তি থেকে ডি.আই.জি নর্দার্ন রেঞ্জ আগেভাগেই সে কথা জানতে পেরেছেন। সেনা-বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে তিনি কঙ্কালীতলায় অতর্কিত আক্রমণ প্রতিরোধের আয়োজন করছেন। একই সঙ্গে বাসু-সাহেবকে অনুরোধ করেছেন, এদিকটা সামলাতে।

সব কথা শুনে কর্নেল গম্ভীর হয়ে গেলেন। খুব যে ভয় পেয়েছেন তা মনে হলো না। তিনি বরং একটি সঙ্গত প্রশ্ন পেশ করলেন, সেক্ষেত্রে কোনো ছদ্মবেশী গোয়েন্দা-অফিসারকে না পাঠিয়ে আপনার মতো একজন সিনিয়ার কোর্ট অফিসারকে আমার কাছে পাঠালেন কেন?

বাসু বললেন, না, তিনি আমাকে পাঠাননি। সরকারী গোয়েন্দা পাঠালে ডাকাতেরা কিছু আন্দাজ করতে পারে, এই আশঙ্কা করে তিনি একটি ডিটেকটিভ এজেন্সিকে এমপ্লয় করেছিলেন, গোপনে খোঁজ নিয়ে দেখতে যে, আপনার শৌখিন অস্ত্রশালায় কী জাতের ব্যবহার্য অস্ত্রশস্ত্র আছে। আর যাতে এ প্যালেসে কেউ অতর্কিতে কোনো টাইম-বম্ব না রেখে যেতে পারে। সেই প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি আপনার অগোচরে এখানে অষ্ঠপ্রহর পাহারার বন্দোবস্ত করেছে। আপনার অস্ত্রশালার সংগ্রহও তারা দেখে গেছে।

—আমার অজ্ঞাতসারে?

—নো, কর্নেল। আপনি কি নিজেই তাদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব কিছু দেখাননি? যাদবপুরের প্রফেসর মিত্র আর মিসেস্ মিত্রকে?

কর্নেল গুম মেরে গেলেন।

বাসু এদিকে ফিরে বললেন, মিস্টার আহমেদ, আপনি কর্নেল-সাহেবকে নিয়ে উপরে যান। সার্চ করে দেখুন কাল্লুমিঞা কোনো কিছু প্লান্ট করে গেছে কি না। সিঁড়ির নিচে মিটার-ঘরটা বিশেষ করে দেখবেন। ওটা সচরাচর লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকে তো।

কর্নেল বললেন, দোতলায় ওঁর সঙ্গে আমার যাবার কোনও প্রয়োজন নেই। আমি বাতাসীকে ডেকে দিচ্ছি। সেই আপনাকে ঘরগুলি ঘুরিয়ে দেখাবে। উপরে পাশাপাশি পাঁচটা ঘর। একমাত্র তৃতীয় ঘরটিতে এখন আছে আমার ছেলে। বাকি ঘর তালাবন্ধ। বাতাসী খুলে দেবে।

বাসু ঝুঁকে পড়ে বলেন, আপনার ছেলে? কী নাম? কত বয়স?

কর্নেল সংক্ষেপে হেমন্তের নাম আর বয়সটা জানালেন। সে যে বর্তমানে অসুস্থ এটুকু স্বীকার করলেন, কিন্তু অসুখের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা স্পষ্টতই এডিয়ে গেলেন। এ প্রসঙ্গ পরিবর্তনের জন্যই বোধহয় এতক্ষণে হঠাৎ বাসুকে জিজ্ঞেস করে বসলেন, আপনি এখানে উঠেছেন কোথায়?

বাসু বললেন, না, উঠিনি কোথাও। কোনো হোটেল-মোটেল খুঁজে নেব। আমি একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে সোজা এসেছি।

কর্নেল আপত্তি করেন, তা কি হয়? এখানে সে রকম হোটেল বা রেস্টহাউস নেই। তাছাড়া আপনি তো মশাই আমার গেস্ট। হোটেলে উঠবেন মানে? আপনার লাগেজ নিশ্চয় গাড়িতেই আছে। সেটা আমার কাজের লোক…বাই দ্য ওয়ে…বটুককে আপনি চিনলেন কেমন করে?

—লোকটা তারাতলায় থাকত। একটা মার্ডার-কেস-এ সাক্ষী দিতে এসেছিল।

—ওর শ্বশুর সেই ভীমা কৈবর্তের কেস?

—না, না। ভীমা কৈবর্তকে আমি চিনিই না, দেখিনি কখনো।

এই সময়েই ফিরে এল বটুক। নিতান্ত কুণ্ঠিত হয়ে জানাল যে, কাল্লুমিঞার হদিস পাওয়া যায়নি। সে নাকি দেশে গেছে—মানে বাতি-মহলের মালিক তাই বললেন, দেশের ঠিকানা ওঁরা জানেন না।

বাসু বললেন, আমার তখনই মনে হয়েছিল বাতি-মহলের লোকেরা কাল্লুমিঞার হক হদিস নিশ্চয় জানে অথবা জানে না বোধহয়!

বটুক মাথা চুলকাল।

কর্নেল বললেন, বাইরের ট্যাক্সিতে ব্যারিস্টার সাহেবের ব্যাগ-স্যুটকেস আছে। সব নিয়ে আয়। উনি দোতলার দক্ষিণ-পুব কোনার গেস্ট-রুমটায় থাকবেন। সৌদামিনীকে বল, চাদর- টাদর পালটে দিতে। আর ও হ্যাঁ, ওই ট্যাক্সি-ড্রাইভারটাকেও ডেকে নিয়ে আয়। বাসু-সাহেব ওর বিলটা এবার মিটিয়ে দেবেন।

বাসু-সাহেব ওঁর দিকে ফিরে ইংরেজিতে বলেন, ট্যাক্সিটা থাক। আমি চাই না আপনার গাড়িতে এখানে ঘোরাঘুরি করতে। আপনার-আমার অলক্ষ্যে হয় তো পাঠক-প্যালেসে এখন অনেকেই নজর রাখছে।

বটুক গেল ট্যাক্সি থেকে মালপত্র নামিয়ে আনতে। কর্নেল তাকে আরও বললেন, ওই ট্যাক্সি-ড্রাইভারকে বলে দিস এখানেই দুপুরে দুটি খেয়ে নেবে। হোটেল খুঁজতে না যায় যেন

বটুক নিষ্ক্রান্ত হলে কর্নেল-সাহেব টেলিফোনটা তুলে নিয়ে একটা লোকাল নাম্বার ডায়াল করলেন। ও-প্রান্তে দেবযানী সাড়া দিতেই বললেন, প্রফেসর মিত্রকে একটু ডেকে দাও তো, দেবযানী।

দেবযানী বললে, আয়াম সরি আঙ্কল, ওঁরা কলকাতায় ফিরে গেছেন।

—ওঁরা দু’জনেই? প্রফেসর অ্যান্ড মিসেস মিত্ৰ?

দেবযানী কুণ্ঠিত স্বরে বলে, একটা কথা আঙ্কল। আপনার কাছে আমার কিছু কনফেশান আছে। ওঁরা দু’জন আমাদের কলেজের…

তাকে মাঝপথে থামিয়ে কর্নেল বলে ওঠেন, আই নো! ওঁরা দুজন একটা প্রাইভেট- ডিটেকটিভ এজেন্সির লোক। এই তো? কিন্তু তুমি আমার কাছে ওঁদের মিথ্যা পরিচয় দিলে কেন ওভাবে?…

দেবযানী তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, বিশেষ কারণ ছিল, আঙ্কল! আমার উপর সেই রকমই ইন্সট্রাক্‌শন ছিল। আপনার মঙ্গলের জন্যই। আমি এখনই আসব আপনার ওখানে? ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতে?

কর্নেল দৃঢ়স্বরে বললেন, নো! আমি এখন ব্যস্ত আছি। পরে তোমার সঙ্গে এ নিয়ে কথা হবে। তোমার বাবার সঙ্গেও কথা বলতে হবে। তিনি কি জানতেন যে, তুমি মিথ্যা পরিচয় দিয়ে দু’জন অচেনা লোককে পাঠক-প্যালেসে নিয়ে আসছ? আমাকে লুকিয়ে?

বাসু চিন্তিত হলেন। হেডমাস্টারমশাই এক্সটেনশানে আছেন। স্কুলের গভর্নিং-বডির প্রেসিডেন্ট একটি কলমের খোঁচায়-

দেবযানী কি যেন বলল। কর্নেল তার জবাব দিলেন না। সশব্দে রিসিভারটা ক্র্যাডেলে নামিয়ে রাখলেন।

ঠিক তখনই দ্বিতল থেকে নেমে এল মিস্টার আহমেদ, তাঁর দুই সহকারীকে নিয়ে। ওঁরা জানালেন, দ্বিতলে সন্দেহজনক কোনও কিছুই পাওয়া যায়নি। কাল্লুমিঞার হক-হদিস পাওয়া যাক বা না যাক, সে কোনও টাইম-বম্ব প্লান্ট করে যায়নি।

পাঠক-প্যালেসের অতিথি-বৎসলতার কোনো ত্রুটি হলো না। সৌদামিনী যথারীতি চা- খাবার নিয়ে এসে পুলিশ-সাহেবদের আপ্যায়ন করল। কর্নেল সৌদামিনীকে বললেন, বাইরে ট্যাক্সিতে ড্রাইভার আছে, আহমেদ-সাহেবের ড্রাইভারও আছে। বটুককে বল, ওদের চা-টা দিয়ে আসতে।

এস.ডি.পি.ও এবং তাঁর দুই সঙ্গীকেও কর্নেল পাঠক মধ্যাহ্ন আহারে নিমন্ত্রণ করলেন। আহমেদ সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করে বলল, লোকাল থানার ও.সি. হাজরা আগেই আমাদের দুপুরে খাবার নিমন্ত্রণ করেছে। আর তাছাড়া আপনার এখানে তো এলেই পাত পাড়ি…

তারপর বাসু-সাহেবের দিকে ফিরে বললে, আপনি এখন কী করবেন স্যার? দু-চার দিন থাকবেন এখানে?

—দু-চার দিন নয়, তবে দু-একদিন হয়তো থাকতে হবে। কর্নেল-সাহেবের কালেকশান ও তো এখনো দেখা হয়নি। আদমগড় ছেড়ে যাবার আগে তোমাকে টেলিফোনে জানাব। কঙ্কালীতলায় রেইড হলে হয়তো তুমি ব্যস্ত থাকবে।

আহমেদ বলে, আপনি কি স্যার, আমার সঙ্গে একবার লোকাল থানায় আসতে পারবেন? হাজরার সঙ্গে আপনার আলাপ করিয়ে দিতাম। আর আপনাকে তাহলে থানার লোকেরা চিনে রাখতে পারতো।

বাসু বলেন, ঠিক আছে, তুমি রওনা দাও। একসঙ্গে যাওয়াটা বাঞ্ছনীয় নয়। আমার গাড়ি আছে। আধঘন্টা পরে স্নানটা সেরে একটু ফ্রেশ হয়ে আমি থানায় আসছি। কর্নেলের সঙ্গে কিছু কথাও বাকি আছে।

আহমেদ সদলবলে প্রস্থান করার পর কর্নেল বাতাসীকে ডেকে পাঠালেন। বাসু-সাহেবের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, এর নাম বাতাসী। আমার স্ত্রী যখন মারা যান তখন হিমুর বয়স মাত্র চার বছর। এই বাতাসী পিসিই তাকে মানুষ করে তোলে।

বাতাসী বাসু-সাহেবকে প্রণাম করে বলল, আপনাকে সৌদামিনী ঘরটা দেখিয়ে দেবে। আপনি স্নানটান সেরে নিন। গীজার আছে, আর সুইচ-বোর্ডে ‘কলবেল’ও আছে। কোনো প্রয়োজন হলে বেল বাজিয়ে আমাদের ডাকবেন, দাদা। ও—আর একটা কথা। আপনার দুপুরের খাবারের কোনো রেসট্রিকশান আছে?

—তা আছে। আমি দিনের বেলা স্বল্পাহারী। একটা চিকেন-স্টু, সালাড আর হাতে গড়া খান দুই রুটি খাব, ব্যস্।

কর্নেল বলেন, দই, পুডিং বা মিষ্টি? এখানকার রাঘবসাই কিন্তু খুব বিখ্যাত।

বাসু বললেন, সে-সব ডিনারে হবে। তবে স্নান সেরে এসে আমি এক কাপ ‘র’-কফি পেলে খুশি হব, দুধ-চিনি ছাড়া।

বাতাসী ঘব ছেড়ে যাবার পর বাসু প্রশ্ন করেন, একেই কি আপনি বছর ত্রিশেক আগে কঙ্কালীতলা থেকে…

বাসু-সাহেবের মুখের কথাটা কেড়ে নিয়ে কর্নেল বলেন : একজ্যাক্টলি!

আট

আদমগড়ের থানা-অফিসার হাজরা এবং সেকেন্ড-অফিসারের সঙ্গে বাসু-সাহেবের আলাপ হলো। আহমেদ জনান্তিকে জানায় পাঠক- প্যালেসের দ্বিতলের ঘরগুলি সার্চ করার সময় সে তিনটি অপরিচিত ওষুধের সন্ধান পেয়েছিল কর্নেল-সাহেবের স্নানাগার-সংলগ্ন মেডিসিন- ক্যাবিনেটে। ওষুধগুলি সে যথাস্থানেই রেখে এসেছে। তবে নামগুলো টুকে এনেছে। একটির নাম ট্র্যাজালিন 25 mg, একটি রোজিয়াডাল 1 mg, তৃতীয়টি প্যাসিটন। তিনটি ওষুধই কিন্তু অব্যবহৃত। সদ্য কেনা। প্রতিটি পাতায় দশটা করে ট্যাবলেট।

—এনিথিং এলস্?

—ইয়েস স্যার। ওঁর ছেলে হেমন্তবাবুর ঘরে একটা ওয়েস্ট-পেপার বাস্কেটে কয়েকটি ইনফ্যাক্ট তিনটি—ইনজেকশনের ব্যবহৃত নীড্‌ল্ পেয়েছি। সেগুলি আমি নিয়ে এসেছি। আপনার কি কাজে লাগবে?

বাসু বলেন, ইনজেকশন দেবার পর ব্যবহৃত সূঁচগুলো ফেলে দেওয়াই বর্তমানের রীতি। এতে আশ্চর্য হবার কী আছে?

—আমি কিন্তু স্যার, অবাক হয়েছি অন্য কারণে। আদমগড়ের মানুষের ধারণা : কর্নেল- সাহেব অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার ঘোর বিরোধী। এটা অনেকটা বোষ্টমের আখড়ায় মুর্গি-ডিমের খোলা হয়ে গেল না?

বাসু স্বীকার করেন, সেদিকটা আমার খেয়াল হয়নি। ঠিক আছে, নীড়গুলো তুলোর প্যাকেটে জড়িয়ে দাও। স্যুটকেসে তুলে রাখি। …তা তোমাদের এস.পি.-র হেড কোয়ার্টর্স তো বহরমপুর? এখন কে এস. পি.?

হাজরা আগ বাড়িয়ে জানাল, মিস্টার অসীমকুমার মিত্র।

বাসু আহমেদের দিকে ফিরে বলেন, তিনি নিশ্চয় এতক্ষণে জেনেছেন যে, তুমি-আমি কর্নেল পাঠককে কী জাতের আষাঢ়ে গল্প শুনিয়েছি?

আহমেদ বাধা দিয়ে বলে, না স্যার, আপনি একাই গল্পটা ফেঁদেছেন। কপিরাইট আপনার আমি শুধু ‘সম’-এর মাথায় ‘ধা’ দিয়ে গেছি। আর তাঁকে তো বলতেই হবে সব কথা। এস.পি. আমার ‘বস’; তাঁর ‘বস’-এর হুকুম তামিল করার আগে প্রপার চ্যানেলে আমার ‘বস’কে জানিয়ে রাখতে হবে না?

—তা বটে! তা মিস্টার মিত্র নিশ্চয় আমাকে চেনেন?

—পশ্চিমবঙ্গে কোন গেজেটেড পুলিশ-অফিসার আপনাকে চেনে না?

—অতটা কমপ্লিমেন্টস্ দিও না আহমেদ। বেলুন ফেটে যাবে শেষমেশ। তা ধর দেখি তোমার এস.পি. সাহেবকে টেলিফোনে।

অচিরেই যোগাযোগ হলো। এস.পি. দপ্তরে ছিলেন। সৌজন্য বিনিময়ের পর বাসু- সাহেবের প্রশ্নের জবাবে তিনি জানালেন ডি.আই.জি মারফৎ তিনি জেনেছেন যে, বাসু-সাহেব আদমগড়ে এসেছেন কী একটা বিশেষ মিশনে। আহমেদের কাছ থেকে কঙ্কালীতলার ডাকাতদলের সম্বন্ধে যে রূপকথার ‘গপ্পোটি ফাঁদা হয়েছে সে-সম্বন্ধেও তিনি ওয়াকিবহাল।

বাসু জানতে চাইলেন এস.পি সাহেবের সারাদিনের প্রোগ্রামটা কী? মিস্টার মিত্র জানালেন তাঁকে ঘণ্টাখানেক পরে একবার জিয়াগঞ্জ যেতে হবে। একটা তদন্তে। ফিরে আসবেন রাত আটটা নাগাদ।

বাসু বলেন, উড য়ু ডু মি এ ফেভার, দেন?

—বলুন স্যার?

—পাঠক-প্যালেসে একটা ফোন করুন। কর্নেল পাঠককে জিয়াগঞ্জে চলে আসতে বলুন। এখনই। জিয়াগঞ্জে দেখা হলে বলবেন, কঙ্কালীতলার ডাকাতদলের বেশ কিছু লোক ধরা পড়েছে, আর কিছু পালিয়ে গেছে। মোট কথা, পাঠক-প্যালেস আক্রান্ত হবার কোনও আশঙ্কা এখন নেই।

—সেটার জন্য তাঁকে জিয়াগঞ্জে আসতে হবে কেন? টেলিফোন করে তাঁকে এখনি তো তা জানিয়ে দিতে পারি।

—পারেন; কিন্তু আমার উদ্দেশ্যটা তাতে সফল হবে না। আমি কর্নেলহীন ফাঁকা ময়দানে কয়েকটা গোল দিতে চাই। লোকটা তার অ্যাম্বিশাস গোঁফ জোড়া নিয়ে আমাকে গোলের দিকে এগুতেই দিচ্ছে না। খাড়া পাহারা দিচ্ছে!

—আই ফলো, স্যার। আমি এখনি তাঁকে ফোন করে জিয়াগঞ্জে পি. ডাবলু.ডি রেস্ট হাউসে ডেকে পাঠাচ্ছি। ঘণ্টা চার-পাঁচ আপনি ফাঁকা মাঠে ক্রমাগত গোল দিতে পারবেন। ধরুন বারোটা

—না, না, অতগুলো গোল দেব না। সেটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে।

—আজ্ঞে না, আমি বলেছিলাম : বেলা বারোটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা…

—থ্যাঙ্কু, স্যার।

থানা থেকে বাসু এলেন হেডমাস্টার-মশায়ের ডেরায়। তাঁকে বললেন, আদমগড়ের ইতিহাস নিয়ে একটা জবর গবেষণা আপাতত আস্তিনের তলায় লুকিয়ে রেখে তিনি আগে আর্জেন্ট কাজগুলো সেরে ফেলতে চান। দেবযানীর মাধ্যমে ডাক্তার শ্রীধর ধরকে ধবলেন। ডাক্তার ধর বাসু-সাহেবকে উপন্যাসের পাতায় চেনেন। সাক্ষাতে আলাপ করার আগ্রহ দেখালেন। দেবযানীকে উঠিয়ে নিয়ে বাসু এলেন ডাক্তার ধরের চেম্বারে। সৌজন্য বিনিময়ের পর বাসু-সাহেব ওঁর কাছে জানতে চাইলেন সেই তিনটি ওষুধের পরিচয়। ডাক্তার ধর বললেন, ট্রাজালিন হচ্ছে ট্রজোডোন হাইড্রোক্লোরাইড। রোজিয়াডাল হচ্ছে রিস্পেরিডন টাইটেনিয়াম ডায়োক্সাইড, আর প্যাসিটন হচ্ছে ট্রাইহেক্সিফোনিডিলহাইড্রো…

বাসু বলেন, থামুন, থামুন। আপনি শুধু আমাকে বলুন, এ ওষুধে কী হয়? ‘অপুত্রের পুত্র হয়, নির্ধনের ধন?’

ডক্টর ধর বলেন, প্লিজ ডোন্ট মেক জোকস্ অন মেডিকেল সায়েন্স, স্যার! আমি জানি, আপনি এই ওষুধগুলোর সম্বন্ধে কেন কৌতূহলী। এই ওষুধ আপনি দেখেছেন হিমুর ঘরে। হ্যাঁ, এই ওষুধগুলিই সাইকিয়াট্রিস্ট ডক্টর রায়চৌধুরী প্রেসক্রাইব করেছিলেন।

বাসু বললেন, আই ওয়াজ নট জোকিং অন মেডিকেল সায়েন্স, ডক্টর। আমি শুধু বলতে চাইছিলাম ওইসব অর্গ্যানিক কেমিস্ট্রির নামগুলো আমার কাছে গ্রীক। হ্যাঁ, আপনি ঠিকই আন্দাজ করেছেন—এগুলো হেমন্তের ঘরেই পাওয়া গেছে। সে যাহোক, আপনি এই বাতিল সুঁচগুলো একটু দেখুন তো।

অ্যাটাচি-কেস থেকে বোরিক-কটনে জড়ানো তিনটি ব্যবহৃত সূঁচ বার করে দেখান। বলেন, রিজেকটেড নীড্‌ল্‌স্‌। কিন্তু প্রত্যেকটিতেই ট্রেসেস অফ মেডিসিন রয়েছে। কাছাকাছি ফরেনসিক রিসার্চ ল্যাব কোথায় আছে? আমি জানতে চাই, ইনজেকশানগুলো কিসের।

ডক্টর ধর বললেন, প্রত্যেকটি সিলিন্ডারেই একটু-একটু ওষুধের ট্রেস রয়ে গেছে। কোনো ফরেনসিক ল্যাবেরটারিতে যেতে হবে না। আমার নিজস্ব প্যাথলজিকাল ল্যাব-এ পরীক্ষা করে বলে দেওয়া যায় কী ছিল ইনজেকশানটা। ট্রেড নাম নয়, কেমিক্যাল নেম। হয়তো তা আপনার কাছে মনে হবে গ্রীক। কিন্তু এগুলি যদি ওই হিমুর ঘর থেকেই পেয়ে থাকেন, তাহলে পরীক্ষা করার প্রয়োজন নেই। এগুলোও সেই ডাক্তার রায়চৌধুরীর প্রেসক্রাইব করা ইনজেকশান। নামটা আমার মনে নেই, তবে প্রেসক্রিশানখানা আমার ফাইলেই আছে। দেখে বলে দিতে পারব।

বাসু বললেন, না, না। পাঠক-প্যালেসে এগুলো পাওয়া যায়নি। আপনি ল্যাবরেটারিতে পরীক্ষা করে কী রেজাল্ট পেলেন আমাকে পাঠক-প্যালেসে টেলিফোন করে কাইন্ডলি জানাবেন। আর একটি কথা, ডক্টর। মিসেস্ পাঠক, আই মীন গায়ত্রী দেবীর মৃত্যুসময় আপনি কি উপস্থিত ছিলেন?

—ছিলাম। কেন বলুন তো?

—আপনার কি মনে হয়েছিল সর্প-দংশনের সিম্পটন স্পষ্ট?

—নিশ্চয়ই। সৰ্প-দংশনের সিম্পটন বলতে কী বোঝাতে চাইছেন?

—’স-স্কেলড ভাইপোর’ হচ্ছে ‘একিস কারিনাটুস’। তার বিষে এমন একটি উপাদান থাকে যা মূলত ‘এমনজাইমধর্মী’, তার নাম আপনি জানেন—Haemolysin রক্তকণিকার সংস্পর্শে এসে সেই এনজাইম হিমোগ্লোবিনকে স্থানচ্যুত ও স্বধর্মচ্যুত করে। ফলে রক্তকণিকা অক্সিজেন গ্রহণে অসমর্থ হয়ে পড়ে। রোগীর প্রথমে শুরু হয় শ্বাসকষ্ট, ক্রমে শ্বাসরোধ। মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ হতে থাকে। প্রতিটি স্টেজের সিম্পাটন বিভিন্ন। ড্যাম ইট— আপনি নিজেই জানেন, আমি কী বলতে চাইছি। ইন ফ্যাক্ট আমার চেয়ে আপনি এ বিষয়ে বেশিই জানেন।

ডক্টর ধর বললেন, ইয়েস ব্যারিস্টার সাহেব। এসব আমাদের পড়তে হয়েছে। এইসব লক্ষণই ফুটে উঠেছিল গায়ত্রী-মায়ের সর্বদেহে। ন্যাচারালি! কারণ সে সর্পদংশনেই মারা যাচ্ছিল। সাপটা—আপনি জানেন—’বঙ্করাজ’। সেটা মারাও পড়েছিল। এখানে স্টাফড্ হয়ে পড়ে আছে পাঠক-প্যালেসে।

—ইয়েস, ইয়েস। আই নো। গায়ত্রীর কি পোস্ট-মটার্ম হয়েছিল?

—পোস্ট-মর্টাম! গুড গড়! কেন? পোস্ট-মর্টাম হতে যাবে কেন?

—অ্যাকসিডেন্টাল ডেথ তো?

—সো হোয়াট? সে যে সর্পাঘাতে মারা গেছে এতে তো কোনো সন্দেহ ছিল না।

—তা বটে!

.

বেলা একটা নাগাদ বাসু ফিরে এলেন পাঠক-প্যালেসে। দেবযানীও ওঁর সঙ্গে এল। কর্নেল-আঙ্কেল তার উপর অসন্তুষ্ট হয়েছেন, তাই সে দেখা করতে এল দুপুরেই। কিন্তু দেখা হলো না। কর্নেল একটা চিরকুট রেখে বেরিয়ে গেছেন জিয়াগঞ্জের দিকে— কী একটা জরুরী কাজে। বাসু-সাহেবকে লিখে রেখে গেছেন হঠাৎ জরুরি দরকারে তাঁকে জিয়াগঞ্জে যেতে হচ্ছে। বাসু-সাহেব যেন আহারাদি সেরে বিশ্রাম করেন। সন্ধ্যার পর তিনি ফিরে আসবেন। কাল সকালে সংগ্রহশালা দেখা যাবে।

বাতাসী বলল, দেবযানী, তুমি এখানেই দুটি খেয়ে নাও। অনেক বেলা হয়ে গেছে।

দেবযানী বলে, না পিসি, বাড়িতে ওঁরা আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি বিশেষ কারণে আঙ্কলের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। তিনি ফিরে এলে বলে দেবেন। আমি বরং একটু হিমুদার সঙ্গে দেখা করে আসি।

দেবযানী দ্বিতলে উঠে গেল। বাতাসী জানতে চাইল, বাসু-সাহেবের জন্য টেবিলে খাবার সাজাবার ব্যবস্থা করবে কি না।

বাসু প্রতিপশ্ন করেন, তুমি আর হেমন্তও তো আমার সাথে একসঙ্গে খাবে, না কি? বাতাসী বলে, দেবযানী ফিরে আসুক, তারপর হিমুকে জিজ্ঞেস করব, সে নিচে এসে খাবে না তার খাবার উপরে পাঠিয়ে দেব।

বাসু বলেন, তাহলে এখানে বস। তোমার কাছ থেকেই কিছু খবর সংগ্রহ করি। কর্নেল- সাহেবকে তো এবেলায় আর পাওয়া যাবে না।

বাতাসী বসল ওঁর সামনে। বাসু ধীরে ধীরে নানান কথাবার্তার মাধ্যমে তার আড়ষ্টতা ভাঙবার চেষ্টা করতে থাকেন। বাতাসীর পূর্বজীবন— কঙ্কালীতলার প্রসঙ্গ ইত্যাদি আদৌ তুললেন না। শরৎ ও হেমন্তর বাল্যকালের প্রসঙ্গই আলোচিত হলো। বাতাসী স্বীকার করল, দেবযানীকে তার খুব পছন্দ। হিমুর সঙ্গে তার বিয়ে হলে রাজযোটক হতো; কিন্তু তা তো হবার নয়।

বাসু এবার সুযোগ বুঝে হেমন্তের প্রসঙ্গে এলেন। বাতাসীর মতে হিমুর অস্বাভাবিকতাটা অনস্বীকার্য। সে একটা মানসিক অসুখে ভুগছে, এতে সন্দেহ নেই। লোকজনের সঙ্গে মেলমেশা করতে চায় না। দিনরাত নিজের ঘরে স্বেচ্ছাবন্দী হয়ে পড়ে থাকে। টি.ভি. দেখে না, বই পড়ে না। সপ্তাহের মধ্যে মাত্র দু-একদিন নিচে নেমে আসে। তবে এই অস্বাভাবিকতাটা তার নিতান্ত সাম্প্রতিক কালের। ছেলেবেলায়, কৈশোরে সে ছিল সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, প্রাণচঞ্চল। মিলিটারি চাকরি থেকে রিজাইন করার পর থেকেই সে এই মানসিক বিপর্যয়ে পড়েছে। না—বাল্যে বা কৈশোরে ঘুমের ঘোরে সে কখনো বিছানা ছেড়ে বাইরে বার হয়ে যায়নি। এবারই হঠাৎ একদিন…

কথার মাঝখানেই বাতাসী থেমে যায়।

বাসু বলেন, আমি শুনেছি, কর্নেল আমাকে বলেছেন। সেই কলিমুদ্দিন মিঞার পাঁঠার গলা-কাটার ব্যাপারটা তো?

বাতাসী যখন শুনল যে কর্নেল-এ বিষয়ে বাসুর সঙ্গে ইতিপূর্বেই আলোচনা করেছেন, তখন সে আরও খোলামেলা কথাবার্তা বলতে শুরু করে। অনেক তথ্য সরবরাহ করল। না, হিমুর সঙ্গে আর কোনো মেয়ের ভাবসাব হয়নি। দেবীকে হিমু আজও ভালবাসে। বিবাহে তার অনিচ্ছার একমাত্র হেতু ওই একটাই। তার নিজের ধারণা, সে ধীরে ধীরে উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে। বংশানুক্রমিক ব্যাধিতে।

বাসু হঠাৎ প্রসঙ্গটা বদল করে জানতে চান, গায়ত্রী দেবীকে যখন সাপে কামড়ায় তখন বাতাসী কি বাগানেই ছিল?

বাতাসী বলে, না! আমি তখন বাড়িতে ছিলাম না। শরৎ আর হিমুকে নিয়ে দারোয়ানের সঙ্গে মেম-সায়রে বিসর্জন দেখতে গেছিলাম। গায়ত্রীকে সাপে কামড়ায় সূর্যাস্তের আগে, আর বাড়ির চাকর গিয়ে আমাদের ধরে নিয়ে আসে রাত সাতটা নাগাদ। ততক্ষণে গায়ত্রী একেবারে নেতিয়ে পড়েছে। ভাল করে কথা বলতে পারছে না।

বাসু সোজা হয়ে উঠে বসলেন। আশ্চর্য! বসন্তবাবুর জবানবন্দি অনুসারে গায়ত্রীকে যখন সর্প দংশন করে তখন বাতাসী ছিল বাড়িতেই। সে নাকি বিস্কুট আনতে রান্নাঘরের দিকে গিয়েছিল। অনেকদিন আগেকার কথা। ভুল হতেই পারে। কিন্তু কার স্মৃতিশক্তি ভুল করেছে? নাকি, দু’জনের একজন সজ্ঞানে মিছে কথা বলছে? কেন?

এই সময় দ্বিতল থেকে নেমে এল ওরা দু’জন। দেবযানী বলল, বাসু-মামু। হিমুদাকে জোর করে নিয়ে এলাম।

হিমু রীতিমতো সুপুরুষ। ফর্সা একহারা দীর্ঘদেহ। একটু যেন বিষণ্ণ।

বাসু বললেন, বেশ করেছ! এস হিমু। তোমার কথা অনেক শুনেছি। আলাপ করার আগ্রহ ছিল। কিন্তু তুমি যে উপরতলা থেকে নিচে নামতেই রাজি নও।

হিমু এসে প্রণাম করল ওঁকে। বাতাসীকেও। বললে, আপনার কথা অনেক পড়েছি কাঁটা- সিরিজে। চাক্ষুষ দেখার সৌভাগ্য এতদিনে হলো। কিন্তু আমার ধারণা ছিল আপনার ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি আছে, মামু!

—মামু?

—বাঃ, কৌশিকদা-সুজাতাদিও তো আপনাকে ‘মামু’ ডাকে। দেবীও তাই ডাকে দেখছি। আমাকেই বা ভাগ্নে বলে মেনে নিতে আপনার আপত্তি হবে কেন?

—হবে না। আমার ভাগ্নেকুল দিন-দিন বর্ধিত হোক।

বাতাসী তাগাদা দেয়। এবার লাঞ্চ সার্ভ করতে বলি?

আহারাদি সেরে বাসু তাঁর দ্বিতলের ঘরে এসে পাইপ ধরিয়ে খবরের কাগজটা খুলে বসেছেন। দেবযানী ফিরে গেছে বাড়িতে। বাতাসী তার একতলার ঘরে দিবানিদ্রা দিতে গেছে। হঠাৎ খোলা-দরজায় কেউ নক করায় বাসু চোখ তুলে চাইলেন। দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে হেমন্ত। বলে, দুপুরে কি আপনি একটু ঘুমিয়ে নেন?

—না, এস, ভিতরে এসে বস। শাস্ত্র বলেছেন : দিবা মা শান্সি।

হেমন্ত এসে বসল একটি চেয়ারে। বাসু বলেন, আমি এখানে কেন এসেছি সে-কথা কি তোমার বাবা তোমাকে জানিয়েছেন?

—না, ড্যাড কিছু বলেনি। আজকাল সে আমার সঙ্গে কথাই বলতে চায় না। আমাকে এড়িয়ে এড়িয়ে চলে।

—কেন বল তো?

—ড্যাড আমাকে প্রচণ্ড ভালবাসে। আমার এই অসুখটা হওয়ায় ড্যাড একেবারে মুষড়ে পড়েছে। এটা সহ্য করতে পারছে না। তাই পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়। আপনি বিশ্বাস করবেন, বাবা আমাকে নিয়ে কলকাতা গেছিল। ডাক্তার জেঠুকে সঙ্গে করে। তার আজন্মের অ্যালোপ্যাথি-বিদ্বেষ বিসর্জন দিয়ে সে আমাকে অ্যালোপ্যাথ-ওষুধ খাওয়ায় লুকিয়ে লুকিয়ে। ইনজেকশানও দেয়। এ কথা পিসি বা বসন্তকাকুও জানে না।

—তাহলে আমি কেন এসেছি তা তুমি জানো না?

—তা তো বলিনি আমি। বলেছি, ড্যাড সেকথা আমাকে বলেনি। কিন্তু আমি জানি। আপনি এসেছেন দেবযানীর ডাকে। সে আমাকে সব কথা খুলে বলেছে।

—তাহলে কৌশিক-সুজাতার সঙ্গে তুমি দেখা করনি কেন?

—কী লাভ? ওঁরা এ সমস্যার কোনো সমাধান করতে পারবেন না। আর তাছাড়া ওঁরা তো এসেছিলেন ছদ্মপরিচয়ে। আমার সমস্যার কথা তো তাঁদের বলতেই পারতাম না ড্যাড- এর উপস্থিতিতে। আমি প্রতীক্ষায় বসে ছিলাম আপনার পথ চেয়ে। আপনিই পারবেন দেবযানীকে বাঁচাতে!

—কী ভাবে?

—ওকে বুঝিয়ে বলুন, আমাকে সে ভুলে যাক। আমার মেয়াদ তো আর বছরখানেক। বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাবার আগেই আমি একদিন একতলার আলমারিতে বন্দুকগুলোয় তেল দিতে যাব—বরাবরই ওটা আমার কাজ। বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাচ্ছি এটা বুঝতে পারলে হঠাৎ হয়তো অ্যাসিডেন্টিালি আমার হাতের একটা রাইফেল থেকে—

—পাগলামি কর না, হিমু!

—পাগলামি! আমি করছি? আমাকে দিয়ে করাচ্ছেন যে ব্যক্তিটি তিনি তো পরমকরুণাময়। তিনি আপনার-আমার নাগালের বাইরে। উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি কিছু বিষাক্ত ‘জিন্‌স্‌’ পাঠিয়ে দিয়েছেন আমার রক্তকণিকায়। দায়ী কি আমি?

বাসু ওকে নানাভাবে সান্ত্বনা দিয়ে জানতে চাইলেন—হেমু কেন মনে করছে যে, সে ক্রমশ পাগল হয়ে যাচ্ছে। কী কী সিমটম সে লক্ষ্য করেছে?

হেমন্ত অকপটে সব কথা খুলে বলল। তার সাম্প্রতিক ‘সোনামবোলিজম্’-এর কথাও। কলিমুদ্দিনের পাঁঠার গলা কাটা। নিজেদের প্রাসাদে মুর্গিবধ। তাছাড়াও ওর মাঝে মাঝে সাময়িক আক্রমণ হয় দিনের বেলাতেও। জাগ্রত অবস্থায়। প্রত্যক্ষ বস্তু হঠাৎ দ্বিত্বলাভ করে। একটা মানুষকে সে দুটো করে দেখতে পায়। হঠাৎ অন্ধকার ঘনিয়ে আসে প্রখর রৌদ্রের মধ্যেই। তাছাড়া মধ্যরাত্রে দুঃস্বপ্ন দেখে ওর ঘুম ভেঙে যায়। প্রচণ্ড তৃষ্ণা, অথচ জলপান করতে পারে না। গলা দিয়ে জল নামতে চায় না। জলের গ্লাসে ও দেখতে পায় শুধু রক্ত—রক্ত আর রক্ত!

হঠাৎ ঝুঁকে পড়ে বাসু-সাহেবের হাত দুটি চেপে ধরে বলে, আপনি দেবীকে রাজি করান। ও শরৎকে বিয়ে করুক। আমার তো আর বছরখানেকের মেয়াদ। তারপর শরৎদাই হবে এই বিশাল সম্পত্তির যুবরাজ। পিসি দেবীকে খুব ভালবাসে, ড্যাডও। সে এ বাড়ির বধূ হলে সবাই সুখী হবে। দেবী নিজেও। শরৎদা লোক খুব ভাল।

—শরৎ তোমার চেয়ে বয়সে কত বড়?

—মাস দশেকের। আপনি দেবযানীকে রাজি করাবেন তো?

বাসু জবাব দেবার আগেই বটুক ঢুকল ঘরে। বলল, কাকাবাবু এয়েছেন। তিনি বললেন দেখে আসতে যে, আপনারা ঘুমাচ্ছেন কি না

বাসু হেমন্তের দিকে ফিরে বলেন, কাকাবাবুটি কে? বসন্ত ঘোষ?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। উনি নিশ্চয় আপনার আসার খবর পেয়ে দেখা করতে এসেছেন। ওঁকে উপরে ডেকে আনব? না কি আমরাই নিচে নেমে যাব?

বাসু বটুকের দিকে ফিরে বললেন, ওঁকেই উপরে আসতে বল।

দীর্ঘদেহী সুদর্শন বসন্তকুমার ঘরে এসে যুক্তকরে বাসু-সাহেবকে নমস্কার করে বললেন, বিলু জিয়াগঞ্জে রওনা হবার আগে আমাকে টেলিফোনে জানিয়েছে যে, আপনি এসেছেন। তাই ছুটে চলে এলাম। বিলু বাঙলা বই-টই পড়ে না, তার কাছে আপনি শুধুমাত্র একজন স্বনামধন্য ব্যারিস্টার। আমি কিন্তু আপনার সব পরিচয়ই জানি। দেবী-মায়ের কাছ থেকে নিয়ে একটা একটা করে কাঁটা-সিরিজের সব বইই আমি পড়ে ফেলেছি।

বাসু বললেন, আপনার পরিচয়ও আমি দেবযানীর মাধ্যমে মোটামুটি জেনেছি। কিন্তু আমি হঠাৎ কেন আদমগড়ে এসেছি, সে কথা কি কর্নেল সাহেব আপনাকে জানিয়েছেন?

—না, সে বলেনি। কিন্তু আমি আন্দাজ করেছি ঠিকই। দেবযানী আপনাকে মুশকিল- আসানে’র ভূমিকায় অভিনয় করতে ধরে এনেছে।

—তাহলে এখন ফাঁকা বাড়িতে সে কথাই আলোচনা করা যাক। হিমুর সঙ্গে সেই আলোচনাই এতক্ষণ হচ্ছিল। আপনি কি মনে করেন ও ধীরে ধীরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে?

—আমার মনে করা-করির কী আছে? সেটা তো এখন সূর্যোদয়ের মতো স্পষ্ট। হিমু নিজেও তা উপলব্ধি করেছে। আর হবে নাই বা কেন? মাস তিনেক আগে থেকে ওর যে শনির দশা শুরু হয়েছে। একটা শান্তি-স্বস্ত্যয়ন করা খুবই উচিত ছিল। কিন্তু বিলু এসবে একবারে বিশ্বাস করে না। তার ঘোরতর আপত্তি। কিছুতেই রাজী হলো না।

বাসু বলেন, কিন্তু হিমু বলছিল, শুধু হিমু কেন, বাতাসীও বলল যে বাল্যে, কৈশোরে ওর এ-সব উপসর্গ তো কিছুই ছিল না। এখন হঠাৎ

বাধা দিয়ে বসন্ত বলে ওঠেন, সে-কথাই তো বলছি মশাই। মাত্র তিন মাস হলো ওর শনির দশা শুরু হয়েছে। চলবে পাক্কা একটি বছর।

—তাহলে এক বছর পরে ও দেবযানীকে বিয়ে করলে সুখী দাম্পত্য জীবন কাটাতে পারবে?

—আলবাৎ। আমি দুজনেরই কোষ্ঠি বিচার করে দেখছি। একেবারে রাজযোটক, মশাই। ষষ্টাষ্টক মিলন হবে, অর্থাৎ মিত্র-ষড়াষ্টক-যোটক। বর্ণশুদ্ধি, তারাশুদ্ধি, যোনিকুট-মিলন শুভ থাকায়। এছাড়া দু’জনের কারও ভৌমদোষ নাই।

বাসু-সাহেবের মনে হলো, এর চেয়ে ডক্টর ধরের অর্গ্যানিক কেমিস্ট্রির ব্যাখ্যাগুলি অপেক্ষাকৃত সহজবোধ্য ছিল।

হিমু হঠাৎ জানতে চায়, শরৎদার সঙ্গে ওর কোষ্ঠিবিচার করে দেখেছেন কাকু?

বসন্তবাবু একটু চমকে ওঠেন। বলেন, শরৎদা? কেন? শরতের সঙ্গে তো দেবীর কোনও বিবাহ-প্রস্তাব ওঠেনি? কোনো পক্ষ থেকেই—

হেমন্ত বলে, ধরুন এই দুরারোগ্য ব্যাধির কারণে যদি আমার সঙ্গে দেবীর বিয়েটা না হয়, তখন…মানে, দেবযানীর একটি সম্ভাব্য সৎপাত্র হিসাবে…তাছাড়া পিসিও ওকে খুব ভালবাসে।

ঘোষমশাই মাথা নেড়ে বললেন, শরতের কোনো জন্মপত্রিকা নেই। ওর জন্মস্থান জানি: কাশী; জন্ম তারিখ জানি : একাত্তর সালের চৌঠা এপ্রিল; কিন্তু জন্মসময়টা জানি না।

বাসু জানতে চান, কেন? বেনারসে কেন?

—আদমগড় ছোট্ট জায়গা; তাই গর্ভলক্ষণ ভাল করে ফুটে ওঠার আগেই বিলু বাতাসীকে কাশীতে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে বাঙালিটোলায় পাঠকদের একটা মোকাম আছে। শরতের জন্ম সেখানেই। সঠিক জন্মসময়টা কেউ লিখে রাখেনি।… কিন্তু শরতের সঙ্গে দেবীর বিয়ে হতে যাবে কেন? তুমি ঠিক ভাল হয়ে যাবে।

বাসু একেবারে অন্যদিক থেকে হঠাৎ আক্রমণ করে বসলেন। বসন্তবাবুকে বললেন, একটা কথা বলুন তো? আপনি কি ‘প্ল্যানচেট -এ বিশ্বাস করেন, ঘোষমশাই?

বসন্তবাবু প্রথমটায় একটু থতমত খেয়ে যান। তারপর সামলে নিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, করি! আত্মাবতরণ’, ওই যাকে আপনি ‘প্লানচেট বললেন, তা আমার একাধিক বার প্রত্যক্ষকরা ঘটনা। আমি পারি না, কিন্তু আমার গুরুদেবকে (উদ্দেশ্যে যুক্তকর ললাটে স্পর্শ করালেন) বহুবার করতে দেখেছি। কিন্তু সে-কথা কেন?

বাসু বলেন, দেখুন, শান্তি-স্বস্ত্যয়ন করতে পারলে ভাল হতো মানছি। কিন্তু সে ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপারে কর্নেল বাধা দিচ্ছেন—

বসন্তও বাধা দিয়ে বলেন, না, ব্যয়ের জন্য নয়, সে এসব বিশ্বাসই করে না। বলে, তার বাড়িতে ওসব করতে দেবে না।

—বেশ তো, যজ্ঞ-টজ্ঞ নাই হলো, আমরা একটা ঘরোয়া আসরে যদি গায়ত্রী দেবীর ওই ‘আত্মাবতরণ’ করি, তাতে গৃহস্বামীর আপত্তি হবে কেন? মায়ের চেয়ে ছেলেকে কে বেশি ভালবাসে বলুন? হয়তো গায়ত্রী দেবীর আত্মাই বলে দিতে পারবে, কী-ভাবে হিমুর রোগমুক্তি হতে পারে। পারে না?

বসন্ত গম্ভীরস্বরে বলেন, পারে। আলবাৎ পারে! এমন অলৌকিক কাণ্ড-কারখানা আমি গুরুদেবের (যুক্তকরে প্রণাম করে) আশ্রমে স্বচক্ষে ঘটতে দেখেছি। স্বৰ্গত ব্যক্তি আত্মাবতরণ- মঞ্চে নেমে এসে জাগতিক পরামর্শ ও বিধান দিয়ে গেছেন। অসংখ্যবার। তাতে চোর ধরা পড়েছে, হারতে বসা মামলা জেতা গেছে, দুরারোগ্য অসুখ…

বাসু বললেন, আপনি শুধু আপনার বঙ্কুকে সামলান।

হিমু হঠাৎ জোর দিয়ে বলে উঠল, কাকাবাবু কেন? সামলাব আমি। ড্যাড কিছু এ বাড়ির ডিকটেটার নয়। আমরা সবাই মিলে একটা ঘরে একান্তে বসে এ বাড়ির এক প্রায়াতা পূণ্যশ্লোকাকে স্মরণ করব, তাঁর আর্শীবাদ ভিক্ষা করব, এতে ড্যাড বাধা দেবে কেন? দিলেই

বা আমরা শুনতে যাব কেন?

বসন্ত বলে ওঠেন, সে কথা একশোবার। গায়ত্রীর আত্মাকে নামাতে পারলে সে হয়তো রোগ-নিরাময়ের একটা পথ বাৎলাতে পারে। কিন্তু প্ল্যানচেট জানা লোক কেউ আদমগড়ে আছে বলে তো জানি না।

বাসু গম্ভীরভাবে বললেন, সে ভার আমার উপর ছেড়ে দিন, ঘোষমশাই। লাগবে একটা তে-পায়া টেবিল। এছাড়া কিছু ধূপকাঠি, ধুনোর আয়োজন, ফুল—সেসব বাতাসীই ব্যবস্থা করতে পারবে মনে হয়।

বসন্ত ঘোষ সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলেন, আত্মাবতরণ-পদ্ধতি আপনি জানেন?

—না-হলে এ প্রস্তাব রাখব কেন? তবে গায়ত্রীকে জীবিতাবস্থায় চাক্ষুষ দেখেছে, এমন তিনজন লোককে চাই।

বসন্ত বলেন, সেটা কোনো সমস্যাই হয়। বিলু, বাতাসী আর আমি।

হিমু আবার বলে ওঠে, ড্যাডি প্ল্যানচেটে বসতে রাজি হবে না। না হোক। আমার স্পষ্ট মনে আছে মা-কে। তখন আমার চার বছর বয়স।

বসন্ত বললেন, আজ রাতেই তাহলে হয়ে যাক। আজ তিথিটাও ভাল : অমাবস্যা। বাসু বলেন, কৃষ্ণা চতুর্দশী পার হয়ে অমাবস্যা কখন পড়ছে?

—রাত দশটা কুড়িতে। গুপ্তপ্রেস মতে।

—দ্যাটস ফাইন! আপনি শুধু একটা তে-পায়া টেবিলের যোগাড় দেখুন

ঠিক সেই সময়ে একটা কর্ডলেস টেলিফোন হাতে বটুক এসে হাজির। বাসু-সাহেবের দিকে সেটা এগিয়ে ধরে বলে, আপনার ফোন ধর।

বাসু যন্ত্রটার ‘কথামুখে’ আত্মঘোষণা করা মাত্র ও প্রান্তবাসী বলে ওঠেন, দিস ইজ ডক্টর

বাসু উঠে দাঁড়ান। দ্বারের দিকে চলতে চলতে বলেন, কাজটা কি শেষ হয়েছে?

—হয়েছে। কিন্তু ওই ইনজেকশানের বাতিল সূঁচগুলো আপনি কোথায় পেলেন ব্যারিস্টার সাহেব? আদমগড়ে?

বাসু ততক্ষণে ঘর ছেড়ে করিডোরে। বটুক সিঁড়ির ল্যান্ডিঙের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তার বিপরীত দিকে হাঁটতে হাঁটতে উনি অম্লান বদনে বলতে থাকেন, আরে না, না; কলকাতায়, কাঁকুড়গাছিতে। এক বৃদ্ধ ব্যবসায়ীর মৃত্যুর কারণ স্লো-পয়েজিং কি না পুলিশ তা খতিয়ে দেখতে চায়। কলকাতাতেই ওটা কোনো ফরেনস্কি ল্যাব-এ টেস্ট করতে দিয়ে আসার কথা ছিল। ভুলে আমার স্যুটকেসে থেকে গেছে। সে যাই হোক— সামান্য তলানি থেকে কি আন্দাজ করা গেছে ইনজেকশানটা কী ছিল?

—আন্দাজ নয়, স্যার। আমার স্থির সিদ্ধান্ত : ইট ওয়াজ অ্যাট্রোপিন সালফেট!

—সাদা-বাঙলায় যাকে বলা হয়, ‘বেলেডোনার মাদার-টিঞ্চার’?

—ইয়েস স্যার। বায়োকেমিক ওষুধ। নাইটযেড গ্রুপের গাছ থেকে তৈরি হয়। চোখের ডাক্তারেরা চোখের পাওয়ার দেখার আগে যে অ্যাট্রোপিন ড্রপ দেন তাও ওই একই জিনিস। কিন্তু এটা যদি পরিমাণ মতো ধীরে ধীরে কোনও মানুষের শরীরে…

—আই নো ডক্টর, আই নো। এটা আমার কাছে আর গ্রীক নয়। ক্রিমিনোলজির অংশ। কাল সকালে গিয়ে রিপোর্টটা সংগ্রহ করে আনব। কিপ ইট আন্ডার য়োর স্লিভস্ ওভারনাইট। -তা তো বুঝলাম। কিন্তু সাক্ষ্য দিতে কি আমাকে কলকাতা দৌড়াতে হবে নাকি। সেই কাঁকুড়গাছির হত্যামামলায়।

—ইয়েস ডক্টর। প্রসিকিউশানের খরচে। কিন্তু এটা আপনার কর্তব্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত। ডাক্তার হিসেবে এবং ভারতীয় নাগরিক হিসেবে।

—কারেক্ট। তাহলে কাল সকালে দেখা হচ্ছে।

বাসু ঘরে ফিরে আসতেই বসন্তু প্রশ্ন করেন, কার ফোন? বিলু করেছিল নাকি?

সত্যাশ্রয়ী সত্যান্বেষী আবার অম্লান বদনে বলেন, না। কলকাতার এক ক্লায়েন্ট।

তারপর হিমুর দিকে ফিরে বলেন, বাড়িতে টাইপ-রাইটার আছে নিশ্চয়ই। কর্নেল- সাহেবের স্টাডিতে? ওটা আমার আজ রাত্রে প্রয়োজন হবে—রাত জেগে একটা রিপোর্ট টাইপ করতে হবে। কাল-পরশুর মধ্যে হাইকোর্টে জমা দেওয়া দরকার।

হিমু বলে, ড্যাডির যন্ত্রটা ভারী। আমার একটা ছোট পোর্টেবল্ টাইপরাইটার আছে। পাঠিয়ে দিচ্ছি। আর কিছু?

—হ্যাঁ, একটি ম্যানিলা এনভেলাপ, কিছু কাগজ-কার্বন, সীল করার গালা আর মোমবাতি। দেশলাই লাগবে না। আমার কাছেই আছে।

নয়

কর্নেল পাঠক যখন ফিরে এলেন রাত তখন নটা। পথে ছোটখাটো একটা ব্রেকডাউন হয়েছিল। তাতেই এতটা দেরি হয়েছে। কর্নেল এসেই সংবাদ পেলেন, রাত্রে এখানে প্ল্যানচেটের আয়োজন হয়েছে। শুনেই ক্ষেপে গেলেন তিনি : ওসব বুজরুকি পাঠক-প্যালেসে চলবে না। যতসব বাঙ্কাম-বল্ডারড্যাশ্!

তাঁকে রুখে দিল হিমুই। যুক্তি দিয়ে বোঝাল, প্রাসাদের একান্তে যদি গুটি তিন-চার মানুষ একটি প্রয়াত আত্মাকে স্মরণ করে, তাঁর কাছে আর্শীবাদ ভিক্ষা করে, তাতে গৃহস্বামীর আপত্তি হবে কেন? তিনি যদি এতে যোগ দিতে না চান, তফাতে থাকুন। টি.ভি. দেখুন, বই পড়ুন।

কর্নেল দুটোর একটাও করলেন না। লীকার-ক্যাবিনেট থেকে একটা স্কচের বোতল বার করে নিজের শয়নকক্ষে অর্গলবদ্ধ ঘরে জমিয়ে বসলেন। বাসু-সাহেবের সঙ্গে একটিও বাক্যালাপ করলেন না।

টেলিফোনে খবর পেয়ে দেবযানীও এসে জুটেছে। রাত সাড়ে দশটায় প্লানচেট শুরু হবে, কে জানে হয়তো শেষ হবে মধ্যরাত্রে। তাই সে বাড়িতে বলেই এসেছে পাঠক-প্যালেসেই রাতটা কাটিয়ে ভোরবেলা ফিরে যাবে। এ ব্যবস্থাতেও ঘোরতর আপত্তি ছিল কর্নেলের। কিন্তু হেমন্তের জেদাজেদিতে এটাও মেনে নিতে হলো তাঁকে। স্থির হলো, প্ল্যানচেট মিটে গেলে সে বাসু-সাহেবের পাশের ঘরে সিংগল বেড খাটে শোবে। এটি এককালে ছিল গায়ত্রীর শয়নকক্ষ। বাসু-সাহেবের ঘরের সঙ্গে একটা কমুনিকেটিং-ডোর আছে। বাসু-সাহেবের জন্য নির্দিষ্ট ঘরটা—দক্ষিণপুবের বড় ঘরটা—এককালে ছিল কর্নেল-সাহেবের মাস্টার্স-রুম। স্ত্রীবিয়োগের পর থেকে তিনি আর এঘরে শয়ন করেন না।

সকাল-সকাল ডিনার সেরে ওঁরা রাত দশটার মধ্যে এসে বসলেন প্ল্যানচেট-টেবিলে। প্রথমে স্থির হয়েছিল তৃতীয় ঘরটিতে, অর্থাৎ হেমন্তের শয়নকক্ষে আসরটা বসবে; কিন্তু হিমুই সেটা বদল করল। বলল, না, আমরা প্ল্যানচেটে বসব একতলার চিত্রশালায়। মায়ের ছবিখানা ঠিক সামনে।

সেই মতোই আয়োজন হয়েছে। বাতাসীর ব্যবস্থাপনায় একটা সাদা পদ্মফুলের মালা পরানো হয়েছে ছবিটায়। গায়ত্রী নাকি পদ্মফুল খুব ভালবাসতো। মেম-সায়রের সাদা পদ্মফুল। ধুপধুনো নানান ব্যবস্থায় কোনো ত্রুটি রাখতে দেয়নি বাতাসী।

প্ল্যানচেট টেবিলে বসেছেন বসন্তবাবু, বাতাসী আর হিমু। একটু দূরে পাশাপাশি দুটি চেয়ারে বাসু-সাহেব আর দেবযানী। অমাবস্যা শুরু হতে তখনো মিনিট-কুড়ি দেরি। হেমন্ত ঘড়ি দেখে বলল, দেবী, শুরু হতে এখনো কিছু দেরি আছে। তুমি খালিগলায় একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনাও ততক্ষণ। অনেকদিন তোমার গান শুনিনি।

দেবযানী বলে, গান গাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছি, হিমুদা।

—তা হোক। এ তো কোনো আসরে গাইছ না। ঘরোয়া বৈঠক।

দেবযানী রাজি হলো। সে গান শুরু করল। ভারি মিষ্টি গলা ওর :

“তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে
যতদূরে আমি ধাই—
কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু,
কোথা বিচ্ছেদ নাই!…”

হিমু একদৃষ্টে তার মায়ের ছবিখানার দিকে তাকিয়ে বসে রইল। বসন্তবাবু বার বার রুমাল বার করে চশমার কাচ দুটো মুছতে থাকেন।

.

রাত প্রায় বারোটা পর্যন্ত চলল প্ল্যানচেটের আসর। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা। গায়ত্রী দেবীর আত্মার কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।

বাসু বললেন, আর চেষ্টা করে লাভ নেই। যে কোনো কারণেই হোক, উনি মর্ত্যে নেমে আসতে রাজি হলেন না।

বসন্তবাবু মাথা নেড়ে বললেন, আমি জানতাম। দুটি হেতুতে। প্রথম কথা অপঘাতে যাঁর মৃত্যু হয় তাঁর ‘আত্মাবতরণ’ করা যায় না। গুরুদেব বলেছিলেন। দ্বিতীয়ত গায়ত্রীর আত্মা হয়তো সপ্তমস্বর্গের শেষ স্তর অতিক্রম করে বিষ্ণুলোকে পৌঁছে গেছে। সেখানে জাগতিক কোনো বন্ধনের রেশ আর থাকে না। কোনো আবেদন পৌঁছায় না।

বাসু বললেন, তাই হবে হয়তো। কী জানি!

ওঁরা যে-যার ঘরে শুতে গেলেন। বাতাসী চলে গেল তার একতলার ঘরে।

বসন্তবাবু আশ্রয় নিলেন দ্বিতলে। করিডোরের একেবারে অপরপ্রান্তের ঘরটিতে। হিমু তার নিজের তিন নম্বর শয়নকক্ষে। বাসু দেবযানীকে নিয়ে দ্বিতলে এসে দেখলেন, সিঁড়ির মাথায় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছেন গৃহস্বামী। তাঁর এক হাতে হুইস্কির গ্লাস, অপর হাতে চুরুট। চোখাচোখি হতেই কর্নেল দৃঢ়স্বরে বলে ওঠেন, লুক হিয়ার ব্যারিস্টার-বাসু, আপনি আমার অতিথি। তা সত্ত্বেও আপনাকে অনুরোধ করছি, কাল সকালেই আপনি দয়া করে কলকাতায় ফিরে যাবেন। আপনি এখানে কেন এসেছিলেন, তা আমি সবিশেষ জানতে পেরেছি। আমার ছেলের সঙ্গে যাতে দেবযানীর বিয়েটা হয়, সেটা পাকা করতে। তাই না? ওসব কঙ্কালীতলার গল্প ইজ—বলডারড্যাশ্।

বাসু গম্ভীর হয়ে বললেন, অলরাইট! কাল সকালে বেড-টী সার্ভ করার আগেই আমি এ- বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। থ্যাংক্স্ ফর য়োর কর্ডিয়ালিটি। যে উদ্দেশ্যে আমি এসেছিলাম- দেবযানী আর হেমন্তের বিয়েটা পাকা করা—সেটা কিন্তু সুসম্পন্ন হয়েছে। একটি রিপোর্টে আমি তা লিখে রেখেছি। যাওয়ার আগে সেটা আপনাকে দিয়ে যাব। আপনার সৌজন্যের বিনিময়ে।

—আই ডোন্ট নীড ইট!

—বাট য়ু ডু নীড ইট, কর্নেল। কারণ রিপোর্টের একটা কপি যে আবার আমার কাছে থেকে যাবে। লীগ্যাল ডকুমেন্ট! ওটা পড়া থাকলে আপনার সুবিধা হতো। লীগ্যালি!

কর্নেল আগুনঝরা দৃষ্টিতে কয়েকটা মুহূর্ত তাকিয়ে দেখলেন বাসু-সাহেবকে। তারপর দেবযানীর দিকে ফিরে বলেন, দেবযানী! তুমি খুবই অন্যায় করেছ। মিথ্যা পরিচয়ে দু’জন গোয়েন্দাকে আমার প্যালেসে ঢুকিয়ে দিয়েছ। সে বোঝাপড়া আমি তোমার বাবার সঙ্গে করব। তোমাকে বরং বলে রাখছি, মানে,—আই ওয়ার্ন য়ু—এ প্যালেসে তুমি আর কোনোদিন মাথা গলাবে না। সেটা হয়ে যাবে ‘ট্রেসপাসিং’। তাছাড়া টেলিফোনেও তুমি হিমুর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করবে না। বুঝেছ?

দেবযানী মাথা খাড় রেখেই প্রত্যুত্তর করে, না, বুঝিনি, আঙ্কল। বাড়িটা আপনার, আপনি বারণ করে দিচ্ছেন, আমি এ বাড়িতে আর নিশ্চয় আসব না। কিন্তু হিমুদা আপনার নাবালক পুত্র নয়। আমিও অ্যাডাল্ট! আপনি আমাদের সাংবিধানিক অধিকারে হাত দেন কোন যুক্তিতে?

কর্নেল গর্জে উঠলেন, ইজ দ্যাট সো? তাহলে তুমি নিচে নেমে এস, তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসি। এরপর একটা রাতও …

কথাটা তাঁর শেষ হলো না। তিন নম্বর ঘরের দরজাটা খুলে গেল। করিডোরে বার হয়ে এসে হিমু দৃঢ়স্বরে বললে, ড্যাডি! আই থিংক য়ু আর থরলি ড্রাঙ্ক! দেবী রাতটা এখানেই থাকবে! য়ু বেটার গো ডাউনস্টেয়ার্স!

কর্নেল সকলের মুখে পর্যায়ক্রমে একবার তাকিয়ে দেখলেন। দেবযানী পাথরের মূর্তি। বাসু নির্বিকার। হিমু দু’পা ফাঁক করে নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও কিছু নেই কর্নেল তাঁর হাতের কাচের গ্লাসটা ছুঁড়ে মারলেন দেওয়ালে। টুকরো টুকরো কাচ আর হুইস্কি ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। কর্নেল অস্ফুটে গর্জন করে ওঠেন : ড্যাম ইট!

টলতে টলতে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেলেন তিনি। দেবযানী নিঃশব্দে বারান্দার ওপ্রান্ত থেকে একটা ওয়াইপার-ব্রাশ নিয়ে কাচের টুকরোগুলো নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে দিতে থাকে। বাসু এ-পাশ ফিরে হিমুকে বললেন, এবার তুমি শুতে যাও হিমু। রাত অনেক হয়েছে। দেবযানীর বাহুমূল ধরে তিনি তাকে নিয়ে এলেন নিজের ঘরে। দরজাটা ভিতর থেকে ছিটকিনি বন্ধ করে দেবযানীকে বললেন, তুমি ওই খাটে উঠে বস। তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে। অত্যন্ত জরুরী এবং বিশেষ গোপনীয়।

নিজেও বসলেন একটা চেয়ারে। দেবযানী নতনেত্রে বলে, কথার আর বাকি কী রইল বাসু-মামু? হিমুদার সঙ্গে আমার সব সম্পর্ক তো শেষ হয়ে গেল।

বাসু পাইপটা ধরাতে ব্যস্ত ছিলেন। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, নো! অ্যান এম্ফাটিক নো! কিছুই শেষ হয়নি। ইন ফ্যাক্ট, নতুন করে একটা চ্যাপ্টার আজ রাতে শুরু হলো। শোন দেবযানী! হেমন্তর অসুখটা ‘ফেক’— অবাস্তব, হয়নি। ওকে স্লো-পয়েজিং-এ ক্রমশ পাগল করে তোলা হচ্ছিল। এখন, মানে এই মুহূর্ত থেকে সেটা বন্ধ হলো। আই অ্যাশিওর য়ু : হেমন্ত কোনো বংশানুক্রমিক ব্যাধিতে আদৌ ভুগছে না।

দেবযানীর চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেছে। বললে, কে হিমুদাকে স্লো পয়েজিং করবে? কেনই বা করবে? আর কী করে আপনি আন্দাজ করছেন যে, ওর অসুখটা বংশানুক্রমিক নয়? বাসু বললেন, তুমি তিনটি প্রশ্ন করেছ। প্রথম দুটির জবাব কাল সকালে দেব। তৃতীয়টার জবাব এখনই দিয়ে দিচ্ছি : যেহেতু হেমন্তের দেহে অভিশপ্ত পাঠক-পরিবারের একবিন্দুও রক্ত নেই।

দেবযানী জবাব দিল না। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল শুধু।

বাসু বললেন, তুমি এতদিনেও আন্দাজ করতে পারনি? হিমুর মা গায়ত্রী, তাঁর ধমনীতে কোনো অভিশপ্ত রক্ত ছিল না। কেমন? আর ওর বাবা—তুমি কি জান না?

দেবযানী যেন পাথরে-গড়া মূর্তি। নির্বাক নিস্পন্দ।

—জান না দেখছি। হিমু নিজেও জানে কি না জানি না। ওর বাবা হচ্ছেন : বসন্তকুমার ঘোষ! গায়ত্রীর বিবাহের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কর্নেল যুদ্ধে চলে যান। তোমার বসন্তকাকা আসেন এ প্যালেসে, সদ্য বিবাহিতার দেখভাল করতে। সান্ত্বনা দিতে। শিল্পীর প্রতি মেয়ে মনের একটা আকর্ষণ থাকেই। বসন্তকুমার দীর্ঘদেহী, সুদর্শন, চার্মিং পারসোনালিটি! গায়ত্রীর বিয়ে হয়েছে বিশে মার্চ একাত্তর সালে, আর হিমুর জন্ম সাতই ফ্রেবুয়ারী বাহাত্তর সালে। এদিকে কর্নেল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে এসেছেন হেমন্তর জন্মের মাত্র দু-মাস আগে। তিনি মাঝে মাঝে হয়তো ছুটিছাটায় এসেছেন। স্ত্রীর সঙ্গে রাত্রিবাসও করেছেন; কিন্তু হেমন্তর চেহারা দেখছ না? কর্নেল শ্যামবর্ণ, খর্বকায়, অথচ হেমন্ত গৌরবর্ণ, দীর্ঘদেহী—ঠিক বসন্তবাবুর মতো।

দেবযানী রুখে ওঠে, এসব কী বলছেন, মামু? শুধুমাত্র চেহারার সাদৃশ্য থেকে আপনি এতবড় কথাটা বলতে পারলেন?

বাসু দু’দিকে মাথা নেড়ে বললেন, না, দেবযানী! এ কোনো আন্দাজে বলা নয়। আমি নানান দিক বিবেচনা করে স্থির-নিশ্চয় বুঝতে পেরেছি। হিমু কোনও বংশানুক্রমিক ব্যাধিতে ভুগেেছ না।

সমান তেজের সঙ্গে দেবযানী বলে, হিমুদা যে একটা কঠিন মানসিক ব্যাধিতে ভুগৄছে এটা প্রত্যক্ষ সত্য! তার হেতুটাও ডাক্তারবাবুরা বলছেন : বংশানুক্রমিক জিনসের প্রভাবে। আপনি কি ডাক্তারবাবুদের ডায়াগনোসিস্টাকেও উড়িয়ে দিতে চান?

—হ্যাঁ চাই। কারণ ডায়োগনোসিসটা বিজ্ঞানসম্মতভাবে দাঁড়াতেই পারে না, যদি হিমুর ধমনীতে পাঠক বংশের রক্ত না থাকে।

—কিন্তু সেটা তো আপনার আন্দাজ। অথচ তার পাগলামিটা প্রত্যক্ষ বাস্তব। কলিমুদ্দিন চাচার পাঁঠার গলা সে কাটবে কেন? সাময়িকভাবে পাগল না হয়ে গেলে? বাড়ির মুর্গিগুলো… বাসু বাধা দিয়ে বললেন, না দেবযানী, না। ফর য়োর ইনফরমেশনস্ তাদের মৃত্যুর জন্য তোমার হিমুদা আদৌ দায়ী নয়!

—আপনি জানেন না, মামু। ডাক্তার জেঠু আমার কাছে স্বীকার করেছেন যে ছোরার বাঁটে রক্তের উপর হিমুদার আঙুলের স্পষ্ট ছাপ পড়েছিল। কর্নেল কাকু এক্সপার্টস দিয়ে সেটা পরীক্ষা করিয়ে জেনেছেন যে, সে আঙুলের ছাপ হিমুদারই।

বাসু বাধা দিয়ে আবার বলে ওঠেন, না, আর কোনো কথা নয়। যেটুকু শুনেছ—বিশ্বাস করতে পার আর নাই পার—তাতেই আজ রাতে তোমার ঘুম হবে না। সব এক্সপ্লানেশান এখনি দেওয়া যাবে না। চল, তোমাকে বরং ওঘরে পৌঁছে দিই। না, ‘ওদিকে দিয়ে নয়, এই মাঝের ইন্টারকমুনেটিং দরজাটা দিয়ে।

দু-ঘরের মাঝখানে যে দরজাটা আছে সেই পথে বাসু-সাহেব দেবযানীকে পৌঁছে দিলেন তার নির্দিষ্ট শয়নকক্ষে। ওর ঘরের যে প্রধান প্রবেশ পথ, করিডোরের দিকের দরজাটা ছিটকিনি বন্ধ করে ফিরে এসে আবার বললেন, শোন দেবযানী, এঘরে সংলগ্নে টয়লেট আছে, টেবিলে খাবার জলও আছে। কোনো কারণেই আজ রাতে তুমি ওই করিডোরের দিকের দরজাটা খুলবে না। যদি মনে হয় কেউ সেদিকের দরজা ধাক্কাচ্ছে তাহলে তুমি এই মাঝের দরজা দিয়ে আমার ঘরে চলে আসবে। আমাকে ডেকে তুলবে। এ দরজায় আমার দিকে ছিটকিনি বন্ধ থাকবে না। তুমি তোমার দিকের ছিটকিনি বন্ধ করে শোবে। বুঝেছ?

দেবযানী অবাক হয়ে বলে, কেন মামু?

—আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে, আমরা নাটকের যবনিকা-মুহূর্তের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছি। সেই সিক্সথ সেন্সের নির্দেশেই আমি এখানে ছুটে এসেছি। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আজকের রাতটা একটা ক্রিটিক্যাল রাত্রি।

—আপনি তো এখানে এসেছেন আমার ডাকে। হিমুদা কেন আমাকে প্রত্যাখান করছেন সেটা খুঁজে বার করতে।

—না দেবযানী! শুরুটা সেভাবেই হয়েছিল বটে, কিন্তু ক্রমশ ঘটনাটা মনে হচ্ছে অন্য খাতে বইছে। আমি ছুটে এসেছি—তুমি হয়তো অবাক হবে শুনলে—একটা মৃত্যুকে প্রতিহত করতে। একটা হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে।

বজ্রাহত দেবযানীর ওষ্ঠাধর শুধু উচ্চারণ করল বাসু-সাহেবের শেষ শব্দটা : হত্যাকাণ্ড?

—হ্যাঁ, দেবযানী। আমার আশঙ্কা হয়েছিল যে, এখানে একজন আততায়ী কোনো একজনকে হত্যা করার পরিকল্পনা করছে। সেটা ঠেকাতেই আমি ছুটে এসেছি। কে, কেন, কাকে খুন করতে চায় তা এখনি তোমাকে জানাতে পারছি না, বিশেষ কারণে। কিন্তু এটাই আমার স্থির আশঙ্কা। এবার শুয়ে পড় তুমি

গ্রীবাভঙ্গিতে সম্মতি জানাল মেয়েটি।

বাসু বললেন, গুড নাইট। বাট ডোন্ট ফরগেট মাই লাস্ট ইনস্ট্রাকশান। বাড়িতে আগুন লাগলেও তুমি ওই করিডোরের দরজাটা খুলবে না। মাঝের দরজাটা খুলে আমার ঘরে চলে আসবে। কেমন?

দেবযানী ধীরে ধীরে খাটে উঠে বসল।

বাসু নিজের ঘরে ফিরে এলেন।

টাইপ করার কাজ তখনো কিছুটা বাকি ছিল। বিশেষ কারণে উনি আজ রাত্রেই টাইপ করে ফেলেেত চান। তাই বটুকের মাধ্যমে এক ফ্লাস্ক র-কফি বানিয়ে রেখেছিলেন। তার শেষ তলানিটুকু কাপে ঢেলে জানলার দিকে সরে এলেন। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলেন।

অমাবস্যার ঘনান্ধকারে গ্রাম্যপ্রকৃতি সুষুপ্তিমগ্ন। বহুদূরে অন্ধকারে এক সারমেয়-আর্তনাদ! আর সেই করুণ আবেদনের মূর্ছনা স্তব্ধ প্রকৃতির বক্ষপঞ্জরে যেন অনুরণিত হতে থাকে। গাছ- গাছালির ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে সে আর্তনাদ যেন এগিয়ে আসছে এই নিদ্রামগ্ন প্রাসাদের দিকে। কেউ সে কথা জানে না, কেউ আশঙ্কা করেনি। শুধুমাত্র এক বৃদ্ধ সত্যান্বেষীর মস্তিস্কে গ্রে- সেল’-এর তন্ত্রীতে তার রেসনেন্স মন্ত্রিত হয়ে উঠেছে। পৈশাচিক পরিকল্পনাটা উনি বুঝতে পেরেছেন। যাবতীয় এভিডেন্স সংগ্রহও করা গেছে—হত্যাকাণ্ডটা অনুষ্ঠিত হবার পূর্বেই। কিন্তু এ শত্রুদুৰ্গে কীভাবে সেটা বিশ্বাসযোগ্যরূপে উপস্থাপিত করবেন তাই যেন স্থির করে উঠতে পারছেন না। দেবযানী তো শত্রপক্ষের নয়; অথচ সেও ওঁকে বিশ্বাস করতে চাইল না। মেনে নিতে পারল না ওঁর যুক্তি।

ফিরে এলেন জানলা থেকে টেবিলের দিকে। বসলেন তাঁর রিপোর্টের শেষ দুটি পৃষ্ঠা টাইপ করতে। রাত্রির নৈঃশব্দ সেই রুদ্ধদ্বার কক্ষে যেন বার বার বিচূর্ণ হতে থাকে।

তাঁর টাইপের কাজ যখন শেষ হলো তার ঘন্টাখানেক আগেই ওঁর হাতঘড়ির কাঁটা দুটো ওঁকে যুক্তকরে প্রণাম করেছে। জানিয়েছে—তারিখটা পালটে গেল!