দশ
রাত তখন কত খেয়াল নেই। মনে হলো কে যেন তাঁকে ঠেলা দিচ্ছে। ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন বাসু। বেড-সুইচটা জ্বেলে দিতে সমস্যাটা আলোকিত হয়ে গেল। বললেন, কী হয়েছে দেবযানী?
দেবযানীর মুখটা সাদা হয়ে গেছে। বলে, আমার ভীষণ ভয় করছে, মামু!
—ভয় করছে! ওমা, সে কী কথা? খামোকা ভয় করতে যাবে কেন?
—না, খামোকা নয়। আপনি শুনতে পাননি? একটা টিয়াপাখির মরণান্তিক আর্তনাদ?
—না শুনিনি তো। তাতে এতো ভয় পাবার কী আছে? জঙ্গলে কোনো টিয়াপাখিকে হয়তো প্যাঁচায় ধরেছে।
—না মামু! জঙ্গলে নয়! এ বাড়িতে। এই দোতলাতেই। সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ একটা টিয়াপাখির খাঁচা ছিল দেখেননি?
—তুমি কী করে জানলে যে, মরণান্তিক আর্তনাদটা সেই পোষা টিয়াপাখিটারই?
—শব্দটা যে সেদিক থেকে এল। তাছাড়া টিয়াপাখির আর্তনাদটা থেমে যাবার পরই কে যেন আমার ঘরের দরজায় দুম দুম করে ধাক্কা দিতে শুরু করল।
—ধাক্কা দিতে শুরু করল! করিডোরের দিকের ওই দরজাটায়? যেটা আমি খুলতে বারণ করেছিলাম তোমাকে?
—একজ্যাক্টলি! তাই তো আমি মাঝের দরজা খুলে এঘরে চলে এলাম। আপনাকে ঠেলে তুললাম।
—ঠিকই করেছ! দ্যাট ওয়াজ মাই ইনস্ট্রাকশন্স্। ওয়েল, লেট্স্ গো টু য়োর রুম। চল, তোমার ঘরে গিয়ে দেখা যাক কে দরজা ধাক্কাচ্ছিল। আমি এসব কিছুই জানি না। ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়েছি তো।
দেবযানীকে নিয়ে মাঝের দরজা দিয়ে ও-ঘরে পৌঁছানোর পরমুহূর্তেই বাসু-সাহেবের ঘরের দরজায় কে-যেন একই রকম দুমদাম শব্দ করতে থাকে। বাসু ঘুরে দাঁড়ালেন। দেবযানীকে বললেন, তুমি তোমার খাটের উপর বসে থাক! আগন্তুক মনে হচ্ছে তোমার ঘরের দরজা খুলতে না পেরে আমার ঘরে হানা দিয়েছে। আমি দেখছি।
উনি ফিরে এলেন নিজের ঘরে। মাঝের দরজাটা খোলাই পড়ে রইল। বাসু তাঁর ঘরের দরজাটা খুলে দেখলেন করিডোরের বাতিটা জ্বলছে। আর তাঁর দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে দুই প্রৌঢ় বাল্যবঙ্কু— বসন্তবাবু ও কর্নেল। বসন্ত’ঘোষের মুখ পান্ডুর। তাঁর পরনে একটা পায়জামা, উর্ধ্বাঙ্গে ফতুয়া। কর্নেলের পরিধানে স্লিপিং স্যুট। কর্নেল বেশ যেন ধমকের সুরে চাপা গর্জন করে ওঠেন, নাউ কাম আউট মিস্টার ব্যারিস্টার! আসুন! নিজে চোখে দেখে যান আপনার কীর্তিটা!
—আমার কীর্তিটা?
কর্নেল তর্জনী-সঙ্কেতে দেবযানীর ঘরের সামনে কী একটা দ্রষ্টব্যের দিকে ইঙ্গিত করলেন। বাসু-সাহেব সেদিকে এগিয়ে যান। নজরে পড়ে দেবযানীর রুদ্ধদ্বারের সামনে উপুড় হয়ে পড়ে আছে হেমন্ত। পরনে ঢিলা পায়জামা—সেটা রক্তে মাখামাখি—উর্ধ্বাঙ্গে হাতকাটা গেঞ্জি। ওর নিশ্বাসের গতি সামান্য দ্রুত। জ্ঞান নেই তার। ডান হাতটা মাথার উপর ছড়ানো। সে হাতে একটা রক্তাক্ত ছোরা। আর—কী বীভৎস! ওর বাঁ হাতের মুঠোয় বাড়ির পোষা টিয়াপাখিটার কর্তিত মুণ্ড। তা থেকে এখনো রক্ত ঝরছে।
কর্নেল চাপা গর্জন করে ওঠেন আবার, এ জন্যই আমি কাল সন্ধ্যারাত্রে দেবযানীকে তার বাড়িতে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। বুঝলেন স্যার? আমার আশঙ্কা ছিল : আজ রাত্রেই পাগলটা একটা কিছু কেলেঙ্কারি কাণ্ড করবে। থ্যাংক গড়! দেবযানী তার দরজা খুলে দেয়নি।
বাসু চট্ করে বসে পড়লেন হেমন্তর পাশে। ওর বাঁ-হাতে থেকে টেয়াপাখির মুণ্ডুটা বার করে নিয়ে মণিবন্ধের নাড়ির গতিটা দেখতে গেলেন।
আবার গর্জে ওঠেন কর্নেল। এবার উচ্চৈঃস্বরে, প্লিজ, ডোন্ট টাচ হিম। যা করণীয় তা গৃহকর্তাকেই করতে দিন!
—ওর…ওর হাতে এত রক্ত কেন?
প্রশ্নটা করেছে দেবযানী। সে বাসু-সাহেবের নির্দেশটা মানেনি। দুরন্ত কৌতূহলে মাঝের দরজা দিয়ে এ ঘরে এসে এখন বার হয়ে এসেছে করিডোরে। দাঁড়িয়েছে সবার পিছনে।
কর্নেল আগুন-ঝরা চোখে তার দিকে একবার দৃকপাত করলেন। তারপর বসে পড়লেন হেমন্তর পাশে। খর্বকায় হলেও গরিলার মতো অসীম বলশালী তিনি। অনায়াসে পাঁজকোলা করে হিমুর মূর্ছিত দেহটা তুলে নিলেন দু’হাতে। ধীর দৃঢ় পদক্ষেপে চলে এলেন তার শোবার ঘরে। শুইয়ে দিলেন খাটে।
ওঁরা তিনজনও নিঃশব্দে অনুগমন করলেন কর্নেলকে।
ইতিমধ্যে খবরটা রটে গেছে। বটুক ও সৌদামিনী গিয়ে নিচ থেকে ডেকে এনেছে বাতাসীকে। হেমন্তর ঘরে সমবেত হলেন সবাই। হিমুর মুখে কয়েকবার জলের ঝাপটা দেবার পর তার জ্ঞান ফিরে এল। বোধকরি বোধের উন্মেষ তখনো হয়নি। সে বিহ্বল দৃষ্টিতে সকলের মুখের দিকে পর্যায়ক্রমে তাকিয়ে দেখল। কী হয়েছে, সে কোথায় শুয়ে আছে, যেন বুঝে নেবার চেষ্টা করছে। বাসু এগিয়ে গিয়ে ঘরের পুবদিকের জানলাটা খুলে দিলেন। সূর্যোদয়ের দেরি আছে। পুব-আকাশ ক্রমশ ফর্সা হয়ে আসছে। অমাবস্যায় আকাশভরা তারা যেন এসে মুখ লুকাচ্ছে আসন্ন দিনের আগমনীতে। একটা ঠাণ্ডা বাতাস বইতে শুরু করেছে। গাছে গাছে পাখ- পাখালির কলতান তখনো শুরু হয়নি। ভুল্কো তারাটা তখনো জ্বলজ্বল করছে পূর্বদিগন্তে।
ধীরে ধীরে বোধশক্তি ফিরে এল হেমন্তের। সে একটা নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন পেশ করল রুদ্ধঘরের আবহাওয়াকে : আমি কি আবার কিছু কেলেঙ্কারি করে বসে আছি?
সবার আগে জবাব দিল বাতাসী : না-রে। সব ঠিক আছে। তুই বরং আর একটু ঘুমোবার চেষ্টা কর।
হঠাৎ নিজের হাতের দিকে নজর পড়ায় হিমু প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে, এ কী! আমার হাতে আবার এত রক্ত এল কোথা থেকে? এ কার…কার রক্ত?
এবারও সবার আগে বাতাসীই জবাব দিল, না, না, রক্ত কোথায়? এ তো দোয়াতের লাল- কালি। কই দেখি তোর হাত দুটো…
আঁচল দিয়ে ওর হাতের রক্তটা মুছে নেয়। বেসিনে গিয়ে আঁচলটা ভিজিয়ে এনে ঘষে ঘষে ওর রক্তাক্ত হাত দুটো পরিষ্কার করে দিল।
দেবযানী তখন ওর খাটের বাজু ধরে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে।
হঠাৎ হিমু বাতাসীর কাছে জানতে চায়, দেবী…দেবী কোথায়? সে কেমন আছে? তাকেই কি আমি…
দেবযানী ওর কথাটা শেষ হতে দেয় না। সে দাঁড়িয়ে ছিল হিমুর মাথার দিকে। হঠাৎ ঝুঁকে পড়ে হিমুর ভিজা হাতটা নিজের মুঠিতে তুলে নিয়ে বলে, না হিমুদা! এই তো আমি! আমার কিছু হয়নি। এই দেখ—
হিমু ঘোলাটে দৃষ্টি মেলে ওর দিকে তাকায়। বোধকরি ওর দৃষ্টিতে কিছু একটা আবরণ পড়েছে। চিনে নিতে একটু দেরি হলো। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে বলে, হ্যাঁরে দেবী, আমি তোর ঘরের দরজায় খুব জোরে জোরে ধাক্কা মারছিলাম। তাই না?
দেবযানী কী জবাব দেবে বুঝে উঠতে পারে না।
—তুই খুব বুদ্ধিমতীর মতো কাজ করেছিস। দোর খুলে দিলেই…আচ্ছা আমার হাতে একটা ভোজালি ছিল না? সেটা কোথায় গেল…
এবারও জবাব দিল বাতাসী, না তো! ভোজালি কোথায় পাবি তুই?
হিমু তার ডান হাতটা তুলে দেখল। না, তার হাতে বাস্তবে কোনো ভোজালি নেই। এবার
সে নিশ্চিন্ত হয়ে দু-চোখ বুজল।
স্তব্ধতা ঘনিয়ে এল ঘরে।
কর্নেল বসন্তের দিকে ফিরে বললেন, হি নীড্স্ রেস্ট! ওকে এখন কিছুক্ষণ ঘুমতে দেওয়া উচিত। আপনারা বরং পাশের ঘরে গিয়ে অপেক্ষা করুন।
‘আপনি’ সম্বোধনে বোঝা গেল গৃহস্বামী তাঁর বাল্যবঙ্কুর দিকে ফিরে কথাটা বললেও নির্দেশটা দিয়েছেন এ প্রাসাদের অবাঞ্ছিত অতিথিটিকেই।
বাসু বিনা বাক্যব্যয়ে এগিয়ে গেলেন দ্বারের দিকে। বসন্তবাবু তাঁর পিছু পিছু। দেবযানী ওঁদের অনুগমন করবার উপক্রম করতেই হিমু যেন তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে সেটা বুঝে ফেলল। চোখ-বোজা অবস্থাতেই বলে ওঠে, না! দেবী এ ঘরে থাকবে! তুমিও চলে যেও না দেবী।
দেবী থমকে থেমে পড়ে।
হিমু আবার বলে, আমার মাথার কাছে ব’স। আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেবে?
কর্নেলের মুখ বেজার হলো। হয়তো তিনি কিছু বলতেন, কিন্তু তার আগেই বাতাসী বলে, তুই এখানটায় বস, দেবী।
দেবযানী আদেশটা পালন করে।
হিমু বাতাসীকে বলে, আমাকে একটু জল দেবে, পিসি?
কিন্তু জলের গ্লাসটা হাতে নিয়েও সে পান করতে পারল না।
একটু জল মুখে টেনে নিল বটে, কিন্তু গিলতে পারল না। থু থু করে ফেলে দিল। উচ্ছ্বসিত কান্নায় ভেঙে পড়ল তারপরে। দেবযানী ধীরে ধীরে ওর চুলের মধ্যে বিলি কাটাতে থাকে।
কর্নেল একটা চুরুট ধরালেন।
বাসু বসন্তবাবুর হাত ধরে টেনে নিয়ে এলেন নিজের ঘরে।
বললেন, বসুন, স্থির হয়ে, কথা আছে।
বসন্ত বসলেন একটা চেয়ার টেনে নিয়ে। বললেন, নতুন কথা আর কী শোনাবেন ব্যারিস্টার সাহেব? এ সমস্ত ভবিতব্য। আমি তো করিডোরের ওপ্রান্তে ছিলাম, কিছুই টের পাইনি। কিছুই বুঝতে পারিনি। না টিয়াপাখির মরণান্তিক আর্তনাদ, না হিমুর দোর ধাক্কানো। আপনি শুনতে পেয়েছিলেন?
বাসু তখন তাঁর সুটকেসে ওঁর জিনিসপত্র গুছিয়ে তুলতে ব্যস্ত। কথা দিয়ে রেখেছেন রাত্রি প্রভাত হলেই তিনি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন। বলেন, টিয়াপাখিটার মুণ্ডুটাই শুধু দেখলাম, তার বাকি ধড়টা কোথায়?
—সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ। বিলুই আমাকে ঘুম থেকে টেনে তুলল, তার আগেই ঘুম ভেঙে গেছিল। আমাকে টেনে নিয়ে এসে পাখিটাকে দেখাল—হিমুকেও। সে তখন উপুড় হয়ে পড়ে আছে দেবযানীর দোরের সমুখে। মা তারা রক্ষা করেছেন। দেবযানী দোর খুলে দেয়নি। দিলে যে কী হতো ভাবতেই গায়ে কাঁটা দেয়।
বাসু জবাব দিলেন না। আপন মনে স্যুটকেস গুছিয়ে চলেছেন।
বসন্তবাবুই আবার বলেন, একটা কথা কিন্তু আমার মাথায় ঢুকল না। হিমু যখন টিয়াপাখিটাকে খাঁচা থেকে বার করে গলা কাটতে গেল তখন পাখিটা ওর হাতে আঁচড়ে- কামড়ে দিল না কেন?
বাসু নিজের কাজ করতে করতেই বলেন, ওটা তাড়াহুড়োয় একটা মারাত্বক ভুল হয়ে গেছে।
—ভুল হয়ে গেছে! মানে? কার ভুল? পাখিটার?
—না, না, পাখিটার নয়। যে ওর গলাটা কেটেছে। আর ভুলটা হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। এই ক্রিটিক্যাল রাত্রে অতটা হুইস্কি খাওয়া ঠিক হয়নি।
বসন্তবাবু এবার কী বলবেন তা বুঝে উঠতে পারেন না।
বাসু নিজে থেকেই বলেন, আপনি ঠিকই ধরেছেন ঘোষমশাই। হিমু অজ্ঞান হয়ে যাবার পর ওর হাতে ছোরা দিয়ে কিছু কাটা দাগ এঁকে দেওয়া উচিত ছিল! মানে — পাখির আক্রমণের চিহ্ন। ইয়েস! এটা একটা বিশ্রী এবং মারাত্বক এভিডেন্স। হেতুটা তো আগেই বলেছি : অতিরিক্ত মদ্যপান!
বসন্ত নিজেকে গুছিয়ে এতক্ষণে বলেন, আপনার কোনো কথাই আমি বুঝতে পারছি না ব্যারিস্টার-সাহেব!
বাসু এবার এদিকে ফিরলেন। বললেন, পাখিটাকে যে হত্যা করেছে তার হাতে পরা ছিল ক্রিকেট খেলার উইকেট-কীপিং গ্লাভস। এখনি বাড়িটা যদি সার্চ করা যেত তাহলে সেটা পাওয়া যাবে। গ্লাভস্ পরে প্রথমে টিয়াপাখিটার ঘাড় মটকে দেওয়া হয়েছে। পাখিটা মরে যাবার পর তার গলাটা বিচ্ছিন্ন করে ধড়টা সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে। এবার বুঝলেন?
—আজ্ঞে না! পাখিটাকে কে মেরেছে? হিমু নয়, বলতে চান?
বাসু এবার এসে ওঁর মুখোমুখি বসলেন। বলেন, আপনি মশাই তখন থেকে এক নাগাড়ে প্রশ্ন করে চলেছেন। কেন? আমি কি কাঠগোড়ায় উঠে সাক্ষী দিচ্ছি? এবার আপনি আমার একটা প্রশ্নের সরাসরি জবাব দিন তো?
—কী প্ৰশ্ন?
—আপনি কি এতদিনেও হিমুকে তার পিতৃপরিচয়টা জানিয়ে দিতে পারেননি?
বসন্তবাবু স্থিরদৃষ্টিতে পুরো বিশ সেকেন্ড ওঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর কোনোক্রমে বললেন, মানে?
—আমি জানি, ঘোষমশাই। কাল রাত থেকে দেবযানীও জানে : হিমুর পিতৃপরিচয়। আমি শুধু জানতে চাইছি হিমু নিজে সেটা জানে কি না
বসন্ত আমতা-আমতা করে বলেন, কী বলছেন? হিমুর বাবা কে?
বাসু বললেন, আপনি তা জানেন! তবু যদি আমাকে দিয়েই বলাতে চান তো বলি : হিমুর বাবার নাম বসন্তকুমার ঘোষ। সেটা সত্য কিনা একথা আমি জানতে চাইছি না। আমি শুধু জানতে চাই— এই দীর্ঘ সাতাশ বছরের ভিতরে আপনি সাহস করে হিমুকে সে-কথা জানাতে পারেননি! আশ্চর্য!
ধীরে ধীরে মাথাটা নিচু হয়ে গেল বসন্ত ঘোষের।
বাসু বলেন, প্রচণ্ড ভুল করেছেন। ইন ফ্যাক্ট অন্যায় করেছেন।
বসন্ত চমকে ওঠেন। এবার চোখ তুলে শুধু বলেন, অন্যায়?
—নয়? ভেবে দেখুন—এ তথ্যটা জানা থাকলে হিমু নিজেই বুঝতে পারত তার অসুখটা বংশানুক্রমিক নয়, হতে পারে না। ইট্স্ সায়ান্টিফিক্যালি বাইওলজিক্যালি অ্যাবসার্ড! কারণ বসন্ত ঘোষ বা গায়ত্রী দেবীর কোনও পূর্বপুরুষ পাগল ছিলেন না। এই তথ্যটা জানা থাকলে সে সাবধান হতে পারত। আত্মরক্ষায় সচেতন হতে পারত।
এতক্ষণে ঘোষমশাই তথ্যটা স্বীকার করে নিলেন। অনুতপ্তকণ্ঠে বললেন, তা ঠিক! জানি না আপনি কেমন করে এটা আন্দাজ করলেন। আমার বিশ্বাস ছিল একমাত্র গায়ত্রী ছাড়া এ গোপন কথাটা আর কেউ জানতে পারেনি। আশঙ্কাই করেনি।
বাসু বলেন, সেটাও আপনার হিমালয়ান্তিক ভ্রান্তি, বসন্তবাবু। কর্নেল তথ্যটা জানতেন। তেইশ বছর ধরে সেটা গোপন রেখেছেন।
—তেইশ বছর?
—গায়ত্রীর মৃত্যুদিন থেকে। সম্ভবত বাতাসীও সেটা জানে। আপনি কি বুঝতে পারেননি—সর্প-দংশনে গায়ত্রীর মৃত্যু হয়নি!
—মানে?
—বিসজর্নের দিন নির্জনতার সুযোগে হতভাগিনীকে নানাভাবে দৈহিক আর মানসিক পীড়ন করে প্রকৃত তথ্যটা জানতে পেরেছিল কর্নেল। হয়তো আপনাদের ঘনিষ্ঠতায় সন্দেহ জেগেছিল তার। হয়তো মেডিক্যাল অ্যানালিসিস্ করে সে বুঝতে পেরেছিল গায়ত্রীর গর্ভে যে ভ্রূণ সে তার সন্তান হতে পারে না। সেই বিসর্জনের দিন গায়ত্রী ভেঙে পড়ে, স্বীকার করতে বাধ্য হয়! তার আগেই অবশ্য কূটচক্রী কর্নেল যাবতীয় ব্যবস্থা করে রেখেছিল। হয়তো গায়ত্রীকে সে কিছু সিডেটিভ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। তারপর ঘুমন্ত হতভাগিনীর পায়ে একটা ইন্ট্রাভেনাস ইনজেকশান দিয়ে দেয়। বঙ্করাজ সাপের বিষ!
—কিন্তু…মানে…সে বিষ ও কোথায় পাবে?
—টাকার বিনিময়ে। ‘পাকুড়-কেস’-এ প্লেগ ইন্সটিট্যুট থেকে ‘ব্যুবনিক প্লেগের’, অতি দুর্লভ জীবাণু কীভাবে সংগৃহিত হয়েছিল তা জানেন না? অবশ্য এটা আমি প্রমাণ করতে পারব না। কারণ সেবার তো কর্নেল মাত্রাতিরক্ত মদ্যপান করেনি। তাই মৃত স্ত্রীর পায়ে নির্দিষ্ট দূরত্বে সে সাপের দংশন-চিহ্ন এঁকে দিয়েছিল। আবার বলছি : এটা নিছকই আমার অনুমান। তা আমি প্রমাণ করতে পারব না। কিন্তু এটা নিশ্চিত যে, কর্নেল জানে—হিমু তার বংশের কেউ নয়। আর সেজন্যেই হিমুকে সে সারাজীবন সহ্য করতে পারেনি। দূরে দূরে রেখেছে। দার্জিলিং-এ কনভেন্টে রেখে পড়িয়েছে। অথচ শরতের প্রতি তার প্রগাঢ় দুর্বলতা। তার হেতুটা নিশ্চয় আপনি জানেন! জানেন না?
বসন্ত বিহ্বলভাবে বললেন, আজ্ঞে না। জানি না। সেটা কেন?
—সহজ যুক্তি। কঙ্কালীতলা থেকে বাতাসীকে কর্নেল উদ্ধার করে আনেন, শনিবার সাতই মার্চ 1970; এবং শরতের জন্মতারিখ-আপনিই বলেছেন— চৌঠা এপ্রিল 1971; তাই না? অর্থাৎ ডাকাতদলের আস্তানায় যদি বাতাসী গর্ভবতী হয়ে থাকে, তাহলে ভ্রূণের গর্ভবাসকাল পাক্কা তের মাস। সেক্ষেত্রে তার উল্লেখ পাওয়া যেত ‘গিনেস বুক অব রেকর্ডস’-এ।
বসন্তবাবু অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলেন না। তারপর সামলে নিয়ে বললেন, কিন্তু আমার উপর প্রতিশোধ নিয়ে ও এভাবে হিমুকে পাগল করে তুলছে? ও আসলে…. কী চায়?
—বৈরিনির্যাতন! হিমুকে তিল তিল করে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করা। গায়ত্রীকে হত্যা করে বোধকরি ওর প্রতিশোধস্পৃহা তৃপ্ত হয়নি। হিমুর ধমনীতে নেই, কিন্তু ওর রক্তে আছে সেই অত্যাচারী নীলকর সাহেবদের রক্ত! ও আপনাকে পুত্রশোক দিতে বদ্ধপরিকর। পৈশাচিক পদ্ধতিতে! আমার আশঙ্কা : তবুও ওর তৃপ্তি হবে না। এরপর সে আপনাকে পাগল করে তুলবে। গায়ত্রী স্টোর্স থেকে আপনাকে তাড়িয়ে দেবার ষড়যন্ত্র করবে। খুব সম্ভবত তহবিল তছরুপের অভিযোগে! আপনি ও-বাড়ির ভাড়াটে পর্যন্ত নন। কর্নেলের এমপ্লয়ীও নন। ইনফ্যাক্ট, আপনাকে ও তাড়িয়ে দিতে চাইলে রুখে দাঁড়াবার মতো কোনো লীগ্যাল স্ট্যাটাস নেই আপনার। আমি জানি না—আন্দাজ করছি—বৃদ্ধ বয়সের কথা ভেবে আপনি হয়তো সঞ্চয়ও করেননি কিছু! ধনকুবের বাল্যবঙ্কুর ফ্রেন্ড-ফিলসফার হয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন হয় তো। আয়াম সরি টু সে—আপনাকে পথের ভিখারি করে ওর প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চাইছে কর্নেল! আপনাকে তাড়িয়ে ও নিজের সন্তানকেই পাঠক-প্যালেসের মালিক বানিয়ে যেত….
এই সময় বটুক এসে জানাল, সাহেব আপনাদের দু’জনকে ওঘরে ডাকছেন, আসেন।
ওঁরা দুজন চলে এলেন এ ঘরে। বাসু কিন্তু ঘরে প্রবেশ করলেন না। দ্বারের বাইরে করিডোরে দাঁড়িয়ে থাকেন।
হেমন্ত এতক্ষণে অনেকটা সুস্থ হয়েছে। সে খাট থেকে নেমে মাটিতে দাঁড়িয়েছে। দেবযানীকে সে বলছিল; আমার কিন্তু কিছুই মনে পড়ছে না। ঘুমের ঘোরে কেনই বা আমি মিঠুকে ওভাবে মারলাম, আর কেনই বা তোমার দরজায় ওই রকম অসভ্যের মতো ধাক্কালাম। অথচ ঘটনাটা ঘটেছে। আমিই করেছি। কারণ আর সবাই তা শুনেছে। তুমিও মিঠুর আর্তনাদ স্বকর্ণে শুনেছ বললে, আর…আর…মিঠুও সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ মরে পড়ে আছে!…
কী বীভৎস! আমি….আমি….ঘুমের মধ্যে কেন এমন সব কাণ্ড করি…
কর্নেল এপাশ থেকে বলে ওঠেন, ওসব কথা নিয়ে এখন অহেতুক চিন্তা করিস না, হিমু। ভুলে যাবার চেষ্টা কর…
হিমু ধমকে ওঠে, ভুলে যাব কী করে ড্যাড? আমি তো অতীত নিয়ে ব্রুড করছি না। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করছি। ভেবে দেখ তো, দেবী যদি দরজাটা খুলে দিত….
কর্নেল বাধা দিয়ে বলেন, কিন্তু তা তো ঘটেনি। দেবযানী বুদ্ধিমতী। তাই দোর খুলে দেয়নি।…শোন্! তুই কি এখন একটু গরম চা খাবি অথবা এক গ্লাস গরম দুধ?
—গিলতে পারছি কই? দেখছ না আমি ঢোক গিলতে পারছি না? এ আমার কী যে হলো…
—তবু একটু চা খাবার চেষ্টা কর, সিপ দিয়ে দিয়ে।
—নো ড্যাডি, চা-টা এখন কিচ্ছু খেতে ইচ্ছে করছে না। আমার এখন একটা লম্বা ঘুমের দরকার। খুব লম্বা একটা টানা ঘুম। তুমি যাই বল ড্যাড, দেবযানী আজ রক্ষা পেয়েছে শুধুমাত্র মায়ের আর্শীবাদে। কাল সন্ধ্যাবেলায় মা-কে সে যে গানটা শুনিয়েছিল…তোমার চাবির থোকাটা একটু দাও তো। আমি নিচে গিয়ে মায়ের ছবিটায় একটা প্রণাম করে এখনি ফিরে আসব। তারপর আমি ঘুমাব। খুব লম্বা টানা একটা ঘুম।
কর্নেল বললেন, চাবি? সে তো তোর কাছে। কাল রাতে তোরা কীসব প্ল্যাঞ্চেট -ম্যাঞ্চেট করলি না রাত বারোটা পর্যন্ত? আমি তো তার অনেক আগেই…
—ও ইয়েস। চাবির থোকাটা আমার কাছেই আছে।
বালিশের তলা থেকে চাবির গোছাটা সে উঠিয়ে নিল।
কর্নেল বললেন, আর্মারির চাবিটা রিং থেকে খুলে দে। তুই তো যাবি শুধু পিকচার-গ্যালারিতে।
—না, ও চাবিটা থাক। বন্দুকগুলোয় অয়েলিং করা হয়নি অনেকদিন। মরচে ধরে যাচ্ছে—
বসন্ত ধমক দিয়ে ওঠেন, বেশ তো, সেটা কালকে করিস! আজ তোর অসুস্থ শরীরে সে কাজটা নাই করলি?
হিমু বলে, না কাকু। কাজটা সেরে আসি। কাজের মধ্যেই আমি তবু নিজের অসুখের কথাটা ভুলে থাকি।
বাতাসী বাধা দেয়, কিন্তু তুই যে এখন বললি, টানা একটা ঘুম দিতে হবে তোকে।
কোথাও কিচ্ছু নেই হঠাৎ হিমু বাতাসীকে একটা প্রণাম করল। বাতাসী অবাক হয়ে বলে এটা কি হলো?
ম্লান হাসল হিমু। বলল, জ্ঞান হবার পর থেকে তোমাকেই তো ‘মা’ জেনে এসেছি। গর্ভধারিণীকে প্রণাম করতে যাচ্ছি। তোমাকেও না-হয় একটা করে গেলাম।
দেবযানী আকুলভাবে বলল, আমিও তোমার সঙ্গে যাব হিমুদা?
হিমু জবাব দেবার আগেই কর্নেল বলে ওঠেন, না! ওকে একটু একলা থাকতে দাও, দেবযানী। নিজের মনের সঙ্গে ও একটা বোঝাপড়া করতে চাইছে। না হলে আমিই ওর সঙ্গে যেতাম।
হিমু সামলে নিল। সকলের উপর একবার দৃষ্টি বুলিয়ে ধীর পদক্ষেপে সে ঘর ছেড়ে বার হয়ে গেল।
কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। এগিয়ে গেলেন জানলার দিকে। পুবের জানলা। দু-হাতে জানলার দুটি রড ধরে সবে ফর্সা হয়ে ওঠা পুব-আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন কয়েকটা নিস্পন্দ মুহূর্ত।
বাতাসী ওপাশ থেকে বলে ওঠে, ওর মন-মেজাজ ভাল নেই, এখন ওর হাতে বন্দুক- ঘরের চাবিটা দেওয়া কি ঠিক হল?
কর্নেল এ-পাশ ফিরলেন না। দূর দিগন্তের দিকে দৃষ্টিমেলা অবস্থাতেই বললেন, শুনলে না, ও বলল কাজের মধ্যেই ও নিজের অসুখের কথাটা ভুলে থাকে।
বসন্তবাবু উঠে দাঁড়িয়েছেন। বলেন, তা তো বুঝলাম, কিন্তু ওর বর্তমান মানসিক অবস্থায় বন্দুক নিয়ে নাড়াচড়া করাটা কি ঠিক?
দেবযানী এতক্ষণে বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। হঠাৎ উঠে বসে। আর্ত কণ্ঠস্বরে বসন্তবাবুকে বলে, আপনি ওকে রুখে দিন কাকু! ও…ও নিশ্চয় কিছু একটা ভালমন্দ করতে যাচ্ছে।
কর্নেল এতক্ষণে এ-পাশে ফিরলেন। হঠাৎ চমকে ওঠেন তিনি। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে আপনমনেই বলে ওঠেন, বাট…বাট…হোয়্যার্স দ্যাট হামবাগ অব এ ব্যারিস্টার?
না, বাসু-সাহেব ত্রি-সীমানার মধ্যে তখন নেই।
এগারো
চিত্রশালার দরজাটা এখন হাট করে খোলা। হেমন্ত বোধকরি তার শেষ সিদ্ধান্তে আসার পর ইতিপূর্বেই মায়ের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে জীবনের অন্তিম প্রণামটা সেরে নিয়েছে। ধীর কিন্তু দৃঢ় পদক্ষেপে সে চলে এসেছে পাশের সংগ্রহশালায়। অস্ত্রাগারে।
দারোয়ানরা এখন কেউ নেই। কাল রাত্রে মালিককে চাবি বুঝিয়ে দিয়ে যে-যার আউট-হাউস কোয়ার্টার্সে ফিরে গেছে। বাইরে বাগানের দূরপ্রান্তে অবশ্য বন্দুকধারী প্রহরী পাহারায় আছে। সেখানে অতন্দ্র প্রহরায় তিন-সিটে নিরাপত্তার ব্যবস্থা।
অস্ত্রাগারের তালা খুলে হিমু ঘরে ঢুকল। ঘরের ভিতরটা তখনো অন্ধকার। সুইচ টিপে আলো জ্বালল। সারি-সারি বন্দুক, রাইফেল, পিস্তল, রিভলভার। বেছে বেছে ওর প্রিয় ডাব্লু- ব্যারেল রাইফেলটা টেনে নিল। ভাঁজ করে চেম্বারে একজোড়া টোটা ভবতে যাবে, হঠাৎ কে পিছন থেকে ওর কাঁধে হাত রাখল।
হিমু ঘুরে দাঁড়ায়। স্পষ্টতই বিরক্ত হয়। অমন একটা চরম সিদ্ধান্তের পর ও জাতীয় বাধায় কে না বিরক্ত হবে? ঝাঁঝালো-স্বরে উষ্মা প্রকাশ করে বলে, আহ্! এখানেও এসেছেন আপনি?
শান্ত কণ্ঠে বাসু বললেন, রাইফেলটা আমার হাতে দাও। পাগলামি কর না।
একেবারে ক্ষেপে ওঠে হিমু : পাগলামি! পাগলামি! শুনতে শুনতে আমার কান পচে গেছে। হ্যাঁ, আমি পাগলামি করি, করব: আপনি জানেন না : কেন আমি পাগলামি করি? এ তো আপনাদের সেই পরমকরুণাময়টির অহৈতুকী আর্শীবাদ। তিনি তো আমাদের নাগালের বাইরে। তাই নয়?
বাসু দৃঢ়মুষ্টিতে রাইফেলটা ওর হাত থেকে কেড়ে নিলেন। বললেন, তোমার কথাটা অর্ধসত্য, হেমন্ত। শেষ বক্তব্যটা বাদে। যিনি তোমাকে পাগল করে তুলেছেন তিনি আদৌ তোমার-আমার নাগালের বাইরে নন, হিমু! টেক ইট ফ্রম মি, হেমন্ত : তুমি পাগল নও! বংশানুক্রমিক ব্যাধিতে তুমি পাগল হয়ে যাচ্ছ না, যাবে না। যেতে পার না! দ্যাটস্ আ বায়োলজিক্যাল অ্যাবসার্ডিটি! দিস্ ইজ দ্য টুথ!
—কিন্তু সাময়িক ভাবে আমি যে পাগল হয়ে যাই, পাগলামি করি—দ্যাটস্ অলসো ইজ টু!
—মানছি! কিন্তু তার কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। যুক্তিনির্ভর—
—কী যুক্তি? বলুন, কেন আমি মিঠুকে ওভাবে মারলাম?
—তুমি মেরেছ? কিন্তু টিয়াপাখি প্রাণীটাকে কি তুমি চেন না? খাঁচার ভিতর হাত ঢুকিয়ে কেউ যদি একটা জ্যান্ত টিয়াপাখিকে বার করে আনে, তার গলায় কোপ মারতে যায়, তাহলে পাখিটা তাকে বাধা দেবে না? আত্মরক্ষার চেষ্ট করবে না? আঁচড়ে-কামড়ে তাকে রক্তাক্ত করে তুলবে না? ঠোটের জোরে টিয়াপাখি আখরোটের খোলা ভেঙে যায়, এ-কথা কি তুমি জান না? ও-ভাবে খালি হাতে তুমি একটা টিয়াপাখিকে মারতে পার, নিজে সম্পূর্ণ অক্ষত থেকে।
হিমু থমকে যায়। তার হাত দুটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে। বলে, এর মানে?
—একটাই মানে হয়। তুমি মিঠুকে ওভাবে হত্যা করনি।
—তাহলে? কে হত্যা করেছে? আর কী করে করল? কারও হাত তো ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়নি?
এ-পাশ থেকে কে যেন বলে উঠল, কে মেরেছে আমরা জানি না, কিন্তু তার হাতে পরা ছিল ক্রিকেট খেলার উইকেট-কীপারের গ্লাভস্। বাড়িটা সার্চ করলে এখনি তা খুঁজে পাওয়া যাবে।
হিমু চোখ তুলে দেখে বক্তা : বসন্তকাকু।
নিঃশব্দে প্রবেশ পথের সামনে এতক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছেন বসন্তরাবু, বাতাসী, দেবযানী আর সবার পিছনে—চিরকাল যিনি সামনের সারিতে থাকেন : কর্নেল পাঠক।
বাসু হিমুর হাতটা বজ্রমুষ্টিতে ধরে বললেন, এখন এসব কথা থাক, হিমু। চল তুমি, নিজের ঘরে চল। তুমি মেন্টালি টায়ার্ড। এখন তোমার একটা লম্বা ঘুমের দরকার। অবশ্য যে অর্থে তুমি তখন বলছিলে, সে অর্থে নয়।
প্রায় জোর করেই হাত ধরে ওকে অস্ত্রাগারের বাইরে নিয়ে এলেন। সদলবলে সকলে এগিয়ে যায় সিঁড়ির দিকে। হঠাৎ থমকে থেমে পড়েন বাসু। পিছন ফিরে বলেন, আপনি আসবেন না কর্নেল। অস্ত্রাগারের তালাটা বন্ধ করা হয়নি। আগে ওটা বন্ধ করে আসুন।
কর্নেল জবাব দিলেন না। পিছন ফিরে একবার দেখে নিলেন—হ্যাঁ, অস্ত্রাগারের কোল্যাপসিবল গেটটা তালাবন্ধ নয়। তালার গায়ে চাবির থোকাটা ঝুলছে।
কর্নেল জবাব দেন না। কৌতূহলী দৃষ্টিতে বাসুর দিকে একবার তাকিয়ে দেখেন।
বাসু পকেট থেকে একটা মুখবন্ধ ম্যানিলা খাম বার করে ওঁর দিকে বাড়িয়ে ধরেন। বলেন, আমার সেই প্রতিশ্রুত রিপোর্টখানা। সব সমস্যার যুক্তিপূর্ণ সমাধান। এটা এখানেই বসে পড়ে নিন। পড়া শেষ হলে আমারিতে তালা দিয়ে বরং বৈঠকখানায় চলে আসুন। আমরা সেখানেই আপনার জন্য প্রতীক্ষা করব। ফর সাবসিকোয়েন্ট লীগ্যাল অ্যাকশন্স। সেগুলো আপনার পরামর্শ অনুসারেই করা হবে।
কর্নেল সন্দিগ্ধ দৃষ্টি মেলে বলেন, কী বিষয়ে লীগ্যাল পরামর্শ?
—সেটা আমার ওই রিপোর্টখানা পড়লেই বুঝতে পারবেন।
কর্নেল কী-একটা কথা বলতে গিয়েও বললেন না। পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেন অস্ত্রাগারের দিকে। এঁরা গেলেন বিপরীত দিকে। প্রথমেই দ্বিতলে উঠলেন না। সবাই এসে বসলেন বৈঠকখানায়। হিমুকে শুইয়ে দিলেন একটা ‘সেটি’তে। বটুক চায়ের ট্রে হাতে এল ঘরে। দেবযানী প্রথম কাপটা বাড়িয়ে ধরল হেমন্তর দিকে। বাসুকে এক কাপ চা দেবার উপক্রম করতেই তিনি বলে ওঠেন, সরি দেবী! আমি আমার প্রতিশ্রুতি ভাঙতে পারি না।
—প্রতিশ্রুতি? কিসের প্রতিশ্রুতি!
—তোমার মনে নেই? কাল সন্ধ্যারাতে আমি কর্নেলকে কথা দিয়েছিলাম, সকালের ‘বেড-টী’ সার্ভ করার আগেই আমি পাঠক-প্যালেস ছেড়ে চলে যাব।
বসন্তবাবু বলেন, হেতুটা বুঝতে পেরেছি। কিন্তু পদ্ধতিটা কী ছিল?
বাসু-সাহেব অপেক্ষা করলেন বটুকের প্রস্থান পর্যন্ত। তারপর বটুক চলে যেতেই দেবযানীকে বললেন, দরজাটা বন্ধ করে দাও দেবযানী। তোমাদের কিছু গোপন এবং জরুরী কথা বলার আছে।
দেবযানী দরজাটা বন্ধ করতে গেল। বাসু টেলিফোনটা তুলে নিয়ে একটা লোকাল নম্বর ডায়াল করলেন। ও-প্রান্তে সাড়া জাগতেই বলেন, গুড মর্নিং ডাক্তারসাহেব। বাসু বলছি, পাঠক-প্যালেস থেকে। এখানে একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটেছে। আপনার একবার আসার দরকার। …হ্যাঁ, এখনি। জরুরী প্রয়োজন।…কী? হ্যাঁ, মেডিক্যাল ব্যাগটা সঙ্গে করেই আনবেন আর সেই সঙ্গে কাঁকুড়গাছির ফোরেনসিক রিপোর্টখানা।…হ্যাঁ আমি ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই কলকাতা ফিরে যাচ্ছি।… থ্যাংকস্!
টেলিফোনটা ক্র্যাডেলে নামিয়ে রাখতেই বসন্ত বলেন, আপনি কী যেন জরুরী আর গোপন কথা বলবেন বলছিলেন?
বাসু বলেন, হ্যাঁ, বলছি। আমি এখনি কলকাতায় ফিরে যাব। যে-কাজ করতে এসেছিলাম তা সুসম্পন্ন হয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস : হেমন্ত এবার রাজি হয়ে যাবে দেবযানীকে বিবাহ করতে…না না। তোমরা এখনি কোন কথা বল না। আমার গোটা বক্তব্যটা আগে শোন। প্রথম কথা : হেমন্ত কোনো বংশানুক্রমিক ব্যাধিতে ভুগছে না, ভুগতে পারে না। সেটা সায়েন্টিফিক্যালি অ্যাবসার্ড। তবে হ্যাঁ, সে একটা মানসিক ব্যাধিতে ভুগছে—ইন ফ্যাক্ট তাকে ঔষুধ প্রয়োগে ওই ব্যাধিতে ভুগতে বাধ্য করা হচ্ছে। আপনারা কেউ জানেন না—হিমু জানে, দেবযানীও জানে—কর্নেল কিছুদিন আগে হেমন্তকে নিয়ে কলকাতায় যান। গোপনে একজন সাইকিয়াট্রিস্টকে দিয়ে তাকে পরীক্ষাও করান। কিন্তু ডাক্তারবাবুর প্রেসক্রাইব করা ওষুধ কর্নেল ওকে খাওয়াননি। প্রথম কেনা ওষুধগুলোর একটা ট্যাবলেটও খরচ হয়নি। সবই ওঁর ওষুধের ক্যাবিনেট-বক্সে অস্পর্শিত পড়ে আছে। ডাক্তারবাবু হিমুকে একদিন-অন্তর একটা ইনট্রাভেনাস ইনজেকশানও দিতে বলেন। কর্নেল তা দেননি। তার পরিবর্তে হিমুর দেহে ইনজেক্ট করে গেছেন বেলেডোনার মাদার-টিঞ্চার। এসবের তর্কাতীত প্রমাণ আমার কাছে আছে। বেলেডোনার ওভার-ডোজ হলে রোগীর ওই সব লক্ষণ দেখা যায়। মুখটা ‘ফ্লাস’ হয়ে যায়, লালচে দেখায়। সে ড-ইমেজ দেখে, তার ঢোক গিলতে কষ্ট হয়, সে জলপান করতে পারে না। মাঝে মাঝে তার চোখের সামনে সব কিছু অন্ধকার হয়ে যায়!
বসন্ত বাধা দিয়ে বলেন, আর ওই ‘সোমনামবোলিজম্’? মানে ঘুমের মধ্যে হাঁটা?
–না, হিমুর সে রোগলক্ষণ আদৌ দেখা দেয়নি। কলিমুদ্দিনের পাঁঠার গলা যে কেটেছে, মুর্গিগুলোকে যে মেরেছে সেই ষড়যন্ত্রকারীই আজ ভোররাত্রে টিয়াপাখিটাকে মেরেছে। বারে বারে হিমুর হাতে বা জামা-কাপড়ে রক্ত মাখিয়েছে।
বসন্ত আবার বলে ওঠেন, কিন্তু আমি শুনেছি কলিমুদ্দিনের পাঁঠাকে যে ছোরা দিয়ে মারা হয়েছে তাতে হিমুর ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেছে—
—কারেক্ট! কিন্তু শুনেছেন কার কাছে? সেই ব্যক্তিই তো ষড়যন্ত্রটা পাকাচ্ছে। সেই তো রক্তমাখা ছোরায় ঘুমন্ত অবস্থায় ওর ফিঙ্গারপ্রিন্ট তুলে নিয়ে এক্সপার্টকে পরীক্ষা করতে পাঠিয়েছিল!
হিমু হঠাৎ সোজা হয়ে উঠে বসে। বিহ্বলের মতো বলে, বাট হোয়াই? কেন? ড্যাডি কেন এভাবে আমাকে পাগল করে তুলবে? কী তার স্বার্থ?
—যাতে সহ্যের শেষ সীমান্তে পৌঁছে তুমি নিজে-হাতে নিজেই—
—কিন্তু সেটাই বা কেন? দিস্ ইজ্ প্রিপসটারাস্। আটার্লি অ্যাবসার্ড! আমাকে মেরে ফেলার কী উদ্দেশ্য?
বাসু বললেন, বিশ্বাস কর হিমু, আমি যা বলছি—তা সত্য, পূর্ণ সত্য! হেতুটা কী তা সময়মতো তোমাকে বুঝিয়ে দেবেন তোমার বসন্তকাকু। তাঁকে আমি সেকথা বলেছি।
হিমু তার বসন্তকাকুকে বলে, সত্যি কথা কাকু? আপনি জানেন?
বসন্ত মেদিনীনিবদ্ধ দৃষ্টিতে বললেন, জানি! তোমাকে পরে আমি বুঝিয়ে বলব।
বাসু বলেন, তুমিও কারণটা আন্দাজ করতে পেরেছ। তুমিও তা জান, না বাতাসী?
বাতাসী জবাব দিতে পারল না। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে সে কাঁদতে থাকে।
বাসু বলেন, তোমার অসহায় অবস্থাটা আমি বুঝতে পারি, বাতাসী! কী করবে তুমি? তিনকুলে তোমার তো কেউ নেই—
বাতাসী মুখ থেকে আঁচলটা সরিয়ে দেয়। বলে, না, দাদা। এতদিন ছিল না। এখন আমার একটা আশ্রয় হয়েছে। আমি এ নরককুণ্ডে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। মাসখানেকের ভিতরেই আমি শরতের কাছে চলে যাব। কলকাতায়।
—কিন্তু শরত কি তার নিজের কথাটা জানে? তুমি কি সেটা তাকে বলেছ?
থমকে গেল বাতাসী।
বিহ্বল হয়ে চারিদিকে তাকিয়ে দেখল। তবে সে খুব বুদ্ধিমতী। বুঝে নিল যে, বাসু-সাহেব তার গোপনতম কথাটাও জেনে ফেলেছেন। কেমন করে জেনেছেন তা ও জানে না। তাই বললে, না, দাদা, জানে না। এবার জানবে।
ঠিক সেই মুহূর্তেই অস্ত্রাগারের দিক থেকে শোনা গেল প্রচণ্ড একটা ফায়ারিং-এর শব্দ! লাফ দিয়ে উঠে পড়ে সবাই, হুড়মুড়িয়ে সেদিকে ছুটতে থাকে।
একমাত্র ব্যতিক্রম বৃদ্ধ ব্যারিস্টারটি। তাঁর একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। এই শব্দটার প্রতীক্ষাতেই ছিলেন তিনি। ধীরে-সুস্থে পকেট থেকে পাইপ আর পাউটা বার করে পাইপে তামাক ঠেশতে থাকেন।
ঠিক সেই মুহূর্তেই কলকণ্ঠে জেগে উঠল গাছ-গাছালিতে পাখপাখালি। কিন্তু সেটা কি রাইফেলের আকস্মিক মৃত্যু-সংকেতে?
না কি পূর্ব-দিগন্তে নূতন সূর্যের আগমন বন্দনায়?