এক
—ধুৎ! তুই কি পাগল হয়ি গেলি রে বিশে! তু ‘কান’ শুনতি ‘ধান’ শুনিছিস। অ্যাই বুড়ো বয়সে দাদু টোপর পরতি যাবে কেনে, ক?
হাসির দমকে হিজবিজবিজের মতো মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছিল বিশে। দু-হাতে পেট চেপে ধরে। সেই অবস্থাতেই বলে, যা তু। নিজি-কানে শুনি আয়, মাইরি বুলছি দিদি।
ফুটকি রান্নাঘরের মেজে মুছছিল। ন্যাতাটা বালতিতে ডুবিয়ে হাতটা আঁচলে মুছতে মুছতে চলে আসে বাইরের ঘরে। দরজার আড়াল থেকে কান পেতে শুনতে থাকে। বিশেও উঠে এসেছে দিদির পিছু পিছু। দুজনেই দরজার ফাঁকে আড়ি পেতেছে।
বাইরের বারান্দায় ওঁরা সাড়ে-চারজনে ব্রেকফাস্টে বসেছেন। মিঠুর জন্য বাইরের বারান্দায় একটা দোলনা টাঙানো হয়েছে। তাতেই দোল খাচ্ছে। সেটাই যেন তার ব্রেকফাস্ট। বাসু কফিপট থেকে পেয়ালায় গরম পানীয় ঢালতে ব্যস্ত। সুজাতা রানী দেবীকে জিজ্ঞাসা করে, কী মামিমা, আপনি রাজি আছেন তো? বেনারসী শাড়ি, মাথায় মুকুট, কপালে চন্দনের ফোঁটা…
রানী কর্তার দিকে একটা চোরা-চাহনি হেনে বললেন, উপায় কি? তোমাদের শখ হয়েছে, আবদার করছ, রাজি না হয়ে পারি? একটা সন্ধ্যার তো মামলা—আর তাও জীবনে একবারই…
এবার সুজাতা বাসু-সাহেবের দিকে ফিরে বলে, তাহলে আপনিই বা গররাজি কেন? চুনট করা ধুতি, সিল্কের গুরুপাঞ্জাবি, গলায় গোড়ে মালা, আর মাথায় টোপর, ব্যস্! মাত্র একটা সন্ধ্যার মামলা! কী মামু?
বাসু গম্ভীর হয়ে বলেন, বাঁদরামো কর না। যা হয় না, তা হয় না। উনি রাজি আছেন তো ওঁকে নিয়েই উৎসব কর তোমরা। আমাকে টানাটানি করছ কেন?
—বা—রে! বিবাহের সুবর্ণ-জয়ন্তী বলে কথা! ও কি একা-একা হয়? আমাদের শখ হয়েছে—
বাসু বলেন, শখ হয়েছে তো শখ মেটাও, শুধু মামিকে নিয়ে। তাই বলে ‘টোপর’? তোমরা ফটো তুলবে নিশ্চয়!
—ওমা! ফটো কেন? ভি. ডি. ও ক্যামেরায়…
—দেন মাই আনসার ইজ: নো! অ্যান এম্ফাটিক্ নো!
—কিন্তু কেন? কারণ তো দেখাবেন একটা?
—এই বুড়ো বয়সে…….
এবার সুজাতাকে মদৎ দিতে আলোচনায় যোগ দেয় কৌশিক। বলে, কিছু মনে করবেন না, মামু। এবার আপনার যুক্তিগুলো পরস্পরবিরোধী হয়ে পড়ছে। সেইরকম—’গুড়- ফ্রাইডের ছুটিটা এ বছর রবিবারে পড়ায় নষ্ট হলো। যুবা বয়সে কারও বিবাহের গোল্ডেন জুবিলি হতে পারে? হওয়া সম্ভব? আপনাদের বিয়ে হয়েছে নাইনটিন ফট্টিনাইনে। শতাব্দীর এই শেষ বছরে আপনাদের বিবাহের গোল্ডেন জুবিলি হচ্ছে—তাই আমরা একটু ফূর্তিফার্তা করতে চাইছি, ভালমন্দ খেতে চাইছি। মামি রাজি, শুধু আপনিই বাগড়া দিচ্ছেন? আপনি এত নিষ্ঠুর কেন?
বাসু বলেন, তা বেশ তো! তোমরা খাওয়া-দাওয়া করতে চাও, কর। আমি খরচপাতি দেব। কিন্তু তাই বলে ‘টোপর’! দ্যাটস অ্যাবসার্ড।
সুজাতা কৌশিককে চোখ টিপে বারণ করল। নিজে বলল, বেশ হাফাহাফি রফা হক। টোপর বাদ, কিন্তু আর সব কিছু থাকবে—চুনট করা ধুতি, গুরুপাঞ্জাবি, কপালে চন্দন…
—না, না, চন্দন-টন্দন চলবে না!
সুজাতা উঠে দাঁড়ায়। বলে, আমাদের সব প্রস্তাবই যদি আপনি এভাবে উড়িয়ে দেন, তাহলে আমরা অনশন ধর্মঘট করতে বাধ্য হব। মামিমা, ফুটকিকে বলে দেবেন আমি আজ দুপুরে খাব না।
—আম্মো না!—সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দেয় কৌশিক।
বাসু বলেন, গাড়িতে তেল কম আছে, ভরে নিও। আর রেস্তোরাঁর টেলিফোন নাম্বারটা জানিয়ে যেও। যাতে এমার্জেন্সিতে যোগাযোগ করতে পারি।
—বাঃ! কিসের রেস্তোরাঁ? আমরা তো অনশন করছি…
ঠিক এই সময় গেটের সামনে এসে থামল একটি ট্যাক্সি। রানী তাঁর টেবিলের তলায় যে সুইচটা আছে সেটা টিপে দিলেন। এক লহমায় ড্রইংরুম থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল বিশে। দাঁড়ালো অ্যাটেনশনের ভঙ্গিতে।
ততক্ষণে ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে মেয়েটি গেট পার হয়ে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে। একাই এসেছে সে। কাঁধে একটা শান্তিনিকেতনী ব্যাগ। ব্যুটিক করা তাঁতের শাড়ি। শাড়িরই অংশ থেকে কেটে বানানো ম্যাচিং-ব্লাউজ। পায়ে চপ্পল। বেশ সুশ্রী চেহারা। সুন্দরীই বলা চলে। রঙ অবশ্য খুব ফর্সা নয়। শ্যামলা-ঘেঁষা। শহুরে সাজগোজ সত্ত্বেও কেমন যেন একটা গ্রাম- বাংলার ছাপ। বয়স আঠারো-বিশের কাছাকাছি।
রানী বিশেকে বললেন, ওকে নিয়ে গিয়ে অফিস-ঘরে বসা। আমি এক্ষুণি আসছি। রানীর কথা শেষ হবার আগেই মেয়েটি সিঁড়ির দুটি ধাপ উঠে এসেছে। যুক্তকরে নমস্কারও করেছে। রানী দেবীর কথাগুলো সে শুনেছে। বিশের দিকে ফিরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়, যেন জানতে চায়: অফিস-ঘরটা কোনদিকে?
রানী বলেন, তুমি যদি আমাদের সঙ্গে এক পেয়ালা চা বা কফিতে যোগ দিতে চাও তাহলে এখানে এসেই বসতে পার।
মেয়েটি বললে, ধন্যবাদ মামিমা, এইমাত্র আমি ব্রেকফাস্ট খেয়ে এসেছি। চল বিশ্বনাথ, আমাকে অফিস-ঘরে নিয়ে চল।
বিশে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার পর কৌশিক নিচু গলায় বলে :ব্বাস রে! এ যে দেখছি শার্লকী হোমা।’ শার্লক হোমস্ স্ত্রীয়াম্ আপ্। দর্শনমাত্র সমঝে নিল আমাদের গৃহভৃত্যটির নাম : বিশ্বনাথ।
সুজাতা বললে, সচরাচর মামির বয়সী অপরিচিতা মহিলাকে ‘মাসিমা’ সম্বোধন করে ওই বয়সের মেয়েরা। এ কিন্তু ‘মাসিমা’ না বলে ‘মামিমা’ বলেছে…
বাসু বললেন, এ থেকে সিদ্ধান্তে আসা যায় : এবছর কৌশিক তার ‘কাঁটা সিরিজের’ জন্য আরও বেশি রয়্যালটি পাবে। ভাল, ভাল। গোত্রং নঃ বর্ধতাম্। ‘সুকৌশলী’র শ্রীবৃদ্ধি হোক। বলে, নিজেও উঠলেন। রানী দেবীর হুইল চেয়ারের পিঠে হাত লাগাল ফুটকি। সেও ইতিমধ্যে বার হয়ে এসেছে।
.
প্রথামতো রানী দেবী মেয়েটির প্রাথমিক পরিচয় প্রথমে রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করে নিলেন, আজকের তারিখে।
নাম : দেবযানী মজুমদার। বয়স একুশ। যাদবপুরে অর্থনীতিতে অনার্স নিয়ে সবে ভর্তি হয়েছে। ফার্স্ট ইয়ার। থাকে গড়িয়ায়, এক সহপাঠিনীর বাড়িতে পেইং-গেস্ট হিসাবে। ঠিকানা দিল, টেলিফোন নম্বরটাও। বান্ধবীর নাম রেখা নিয়োগী।
রানী ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললেন, একটু অপেক্ষা কর, দেবযানী। আমি একটা ফোন সেরে নিই।
রানী ক্র্যাডল্ থেকে টেলিফোনটা তুলে নিয়ে সাতটা নম্বর ডায়াল করলেন। ওপ্রান্তে মহিলাকণ্ঠে ‘বলুন?” শুনে বললেন, মিসেস্ রেখা নিয়োগী বলছেন?
—হ্যাঁ এবং না। অর্থাৎ আমি রেখা নিয়োগীই বলছি। তবে মিসেস্ নই, আমি মিস্।
—ও আয়াম সরি। ওখানে কি দেবযানী আছে? দেবযানী মজুমদার?
—না, সে একটু বেরিয়েছে। আপনি কে ফোন করছেন?
রানী বললেন, ঠিক আছে, তাড়াহুড়ো নেই, আমি বরং পরে ফোন করব।
বলেই লাইনটা কেটে দিলেন। দেখলেন, দেবযানী হাসি-হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই বলল, এই ড-চেকিংটা বুঝি ‘কৌতূহলী কনের কাঁটা’র পর থেকে চালু করেছেন, মামিমা?
রানী বললেন, তুমি ‘কাঁটা সিরিজের’ অনেক বই পড়েছ মনে হচ্ছে।
—প্রত্যেকটি। একাধিকবার। সুতরাং বুঝতেই পারছেন আমার সমস্যাটা ঠিক কী, তা আমি এ-ঘরে বলব না। চলুন, মামুর কাছে যাই—
রানী হাসলেন। বললেন, চল-
—এ কি? আপনি শর্টহ্যান্ড নোটবইটা নিলেন না?
—না! প্রযুক্তিবিদ্যা দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, দেবযানী। আমাকে আর মক্কেলের জবানবন্দী শর্টহ্যান্ডে লিখে নিতে হয় না।
—এ খবরটা তো জানা ছিল না।
ফুটকি ওঁকে পৌঁছে দিয়ে চলে গিয়েছিল। রানী নিজেই চাকা ঘুরিয়ে বাসু-সাহেবের চেম্বারের দিকে যেতে চাইলেন। দেবযানী বাধা দিল। সে ওঁর পিছনে দাঁড়িয়ে হুইল-চেয়ারটা ঠেলতে ঠেলতে ওঁকে সংলগ্ন বাসু-সাহেবের প্রাইভেট চেম্বারে নিয়ে এল। এ কামরাটি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত এবং শব্দনিরোধক। ঘরের একপ্রান্তে একটা সেক্রেটারিয়েট টেব্ল। বাসু- সাহেবের ঘূর্ণমান চেয়ার। বিপরীতে তাঁর অতিথিদের জন্য গদিমোড়া পাশাপাশি তিনটে চেয়ার। বাসু-সাহেবের চেয়ারের পিছনে এবং ঘরের দু-পাশে শুধু বই আর বই। শুধু আইনের নয়। বিভিন্ন বিষয়ের। বাসু বললেন, এস দেবযানী। বস ওই চেয়ারটায়।
দেবযানী একটু অবাক হলো। বলল, আপনি আমার নাম জানলেন কী করে? আমি তো আপনাকে আমার নাম বলিনি।
—বাঃ! তুমি আমার বাড়ির কাজের লোকটার নাম পর্যন্ত জানতে পার, আর আমি তোমার নামটা জানব না?
দেবযানীর বিহ্বল দৃষ্টি দেখে রহস্যটা ভেঙে দেন। বলেন, রানীকে তুমি ও-ঘরে যে প্রশ্নটা করেছিলে—ওই শর্টহ্যান্ড নোটবইয়ের ব্যাপারে, সেটাও পরিষ্কার করে দিই। এ-ঘরে তুমি- আমি যা বলব তা একটা ক্যাসেটে বন্দী হয়ে থাকবে। ভবিষ্যৎ রেফারেন্সের জন্য। তাই রানীকে আজকাল আর শর্টহ্যান্ড নোট নিতে হয় না। তবে এই ছোট্ট ক্লিপটা তোমার ব্লাউজের উপরের বোতামের কাছাকাছি আটকে নাও।
দেবযানী বলল, ও হ্যাঁ, বুঝেছি। টি. ভি. রেকর্ডিং-রুমে এমন করে দেখেছি।
বাসু বললেন, নাউ স্টার্ট টকিং। আগে তোমার বিশদ পরিচয়টা দাও। পিতৃ-মাতৃ পরিচয়, বাল্যকালের কথা। কোথায় পড়েছ স্কুলে থাকতে ইত্যাদি। যে-কারণে এসেছ সেটা পরে শুনব।
.
দেবযানী মজুমদারের দেশ আদমগড়। আজিমগঞ্জের কাছাকাছি। আজিমগঞ্জ থেকে বিশ কিলোমিটার দক্ষিণে। আদমগড় ভাগীরথীর পশ্চিমপারে—ছাতরা আর লালগোলার মধ্যবর্তী অবস্থানে। আদমগড় গ্রামও নয়, শহরও নয়—মাঝামঝি অবস্থা। আম-জাম-কাঁঠাল গাছে পথঘাট ছায়ানিবদ্ধ। আবার পাকাবাড়ির ছাদে দূরদর্শনের অ্যান্টেনাও নজরে পড়ে। ইদানীং বহু দোকানপাট হয়েছে, দ্রুত উন্নতি হচ্ছে গণ্ডগ্রামটির। ইলেকট্রিসিটি এসেছে, টেলিফোন এসেছে। তবে দূরদর্শনের চ্যানেল ভালভাবে ধরা যায় না। দেবযানী ওই গণ্ডগ্রামের বিদ্যালয় থেকে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে যাদবপুরে পড়তে এসেছে। ওর বাবা দীনেশচন্দ্র মজুমদার আদমগড় উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক।
বাসু বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, বল কী! আদমগড়ে হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল পর্যন্ত আছে? গ্রামের পপুলেশন কত?
–লোকসংখ্যা কত তা জানি না। তবে আদমগড় একটি অতি প্রাচীন জনপদ। ওখানকার জমিদারদের এককালে ‘রাজাই’ বলা হতো। ‘পাঠক-কা’ একটা দেখবার মতো জিনিস। যদি যান কখনো আমি ওদের কিউরিও আর কালেকশান সব দেখাব আপনাকে। সত্যিই দেখবার মতো।
—জমিদারদের উপাধি বুঝি ‘পাঠক’?
—হ্যাঁ, পাঠক। তবে ওঁরা বর্ণহিন্দু নন। রোমান ক্যাথলিক ক্রিশ্চিয়ান। গ্রামে নিওগথিক স্টাইলের গীর্জা আছে। প্রকাণ্ড সিমেটারি আছে। জমিদারি অ্যাবলিশনের পর ওঁরা এগ্রিকালচারে মনোনিবেশ করেছেন। আদমগড়ে একটা মিনি-কোল্ড স্টোরেজ পর্যন্ত আছে।
—আমার কৌতূহলটা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে, দেবযানী। এবার বল, সংসারে তোমাদের কে কে আছেন?
—বাবা রিটায়ার করে আবার এক্সটেনশান পেয়েছেন। বিল্কাকু ওঁকে কিছুতেই অবসর নিতে দেবেন না।
—’বিলকাকু’ টি কে?
—উইলিয়াম পাঠক। গ্রামের প্রাক্তন জমিদার। বস্তুত গোটা অঞ্চলের দণ্ডমুণ্ডের বিধাতা। স্কুল-কমিটির তিনিই প্রেসিডেন্ট।
—বুঝলাম। আর কে আছেন তোমাদের সংসারে?
—মা নেই। আমার এক ছোট ভাই আছে, বঙ্কু। আমার এক বালবিধবা পিসিমাও আছেন—বাবার দূরসম্পর্কের বোন : গিরি পিসিমা।
—তুমি বললে আদমগড় ভাগীরথীর পশ্চিমপাড়ে। গ্রাম থেকে গঙ্গা কত দূরে?
—মাইল দশেক। তবে অবগাহন স্নানের জন্য গ্রামেই আছে ‘মেমসায়র’—বিরাট একটা দীঘি। টলমলে নির্মল জল।
বাসু বলেন, তোমাদের গ্রাম গণ্ডগ্রাম বা গঞ্জ যাই হোক— আদমগড়ের একটা ছবি পেয়েছি। তোমাদের পরিবারের একটা ভার্বাল স্কেচও। এবার বল, তোমার সমস্যাটা কী? কীজন্যে কলেজ কামাই করে আমার কাছে ছুটে এসেছ।
–কলেজ কামাই করতে হয়নি, স্যার। স্টুডেন্টস্ ইউনিয়ান স্ট্রাইক ডেকেছে।
—সে তো তারা সারা বছর ধরেই ডাকে, ছুটির দিনগুলো বাদে। আর তাছাড়া মনে হচ্ছে তারা ধর্মঘট না ডাকলেও তুমি আজ কলেজের বদলে এখানেই আসতে, তাই নয়? নাউ স্টার্ট টকিং…
দেবযানী অধোবদন হলো। বেশ কিছুক্ষণ ইতস্তত করল। তারপর নিম্নকণ্ঠে বলল, আমি…আমি…এক্ষেত্রে কী করব বুঝতে পারছি না। তাই আপনার কাছে ছুটে এলাম। অবশ্য আপনি আমাকে কীভাবে সাহায্য করবেন তাও বুঝে উঠতে পারছি না।
—বেশ তো, তুমি কী করবে সেটা আমাকেই নির্ধারণ করতে দাও না? অর্থাৎ ব্যাপারটা শোনাই যাক।—বাসুর কণ্ঠে স্নেহের সুর।
দেবযানী নতনেত্রে বললে, প্রায় বছর তিনেক আগে একটি ছেলের সঙ্গে—আমাদের গ্রামেরই ছেলে—আমার একটা ইয়ে…মানে এনগেজমেন্ট হয়েছিল। ঠিক বিলাতী কায়দায় নয়। দেশী কায়দায়। সে প্রথম প্রপোজ করেছিল, কিংবা আমি, তা আজ আর মনে নেই। তবে দুজনেই দুজনকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম যে, আমরা পরস্পরকে বিবাহ করব। কোনো প্রতিবন্ধকতাকেই আমরা মানব না এবং যতদিন না আমরা উভয়েই সম্পূর্ণ প্রস্তুত হচ্ছি ততদিন অভিভাবকদের পীড়াপীড়িতে অন্যত্র বিবাহ করব না।
—বুঝলাম। ছেলেটি কি তোমাদের গ্রামের? আদমগড়ের?
—আজ্ঞে হ্যাঁ। বস্তুত উইলিয়াম পাঠক কাকুর একমাত্র পুত্র : হিমু।
—গুড নিউজ! তারপর?
নতনেত্রে দেবযানী বলল, হিমু এখন এনগেজমেন্টটা ভেঙে দিতে চাইছে। সে বলছে যে, সে বিয়ে করবে না!
বাসু নিঃশব্দে টেবিলের উপর মিনিট-খানেক দশ আঙুলে টরেটক্কা বাজালেন। তারপর বললেন, আই সী। সে এখন তোমাকে বিয়ে করতে চাইছে না। এনগেজমেন্টটা ভেঙে দিতে চাইছে। তা—সে কী করে? কোথায় আছে?
—সে আমার চেয়ে ছয় বছরের বড়। বরাবর দার্জিলিঙে কনভেন্ট স্কুলে পড়াশুনা করেছে। ছুটিছাটায় দেশে আসত। বি. এসসি পাশ করে সে মিলিটারিতে যোগ দেয়। ইনফ্যাক্ট, ওদের পরিবারে একটা ট্রাডিশন যে, প্রতি জেনারেশনেই একজন মিলিটারিতে যাবে। ওর বাবা কর্নেল, ঠাকুর্দাও ছিলেন মেজর, তাঁর বাবা ব্রিগেডিয়ার। তাই সেই প্রথা মেনে ও নিজেও মিলিটারিতে গেছিল। মাত্র এক বছরে সে সেকেন্ড লেফটানেন্ট পদে প্রমোশন পেয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ কী জানি কী হলো, বিল্কাকু তাকে রিজাইন করতে বাধ্য করলেন। কমিশনে পদত্যাগ করে ও এখন আদমগড়ে ফিরে এসেছে। খুবই ফ্রাস্ট্রেটেড। ও এখন বলছে যে, আমাকে বিয়ে করবে না।
—ও কি আর কাউকে জীবনসাথী করতে চায়? মানে মিলিটারিতে জয়েন…
—না, না, না! আপনি যা ভাবছেন তা মোটেই না। ও বলছে যে, ও আজীবন বিবাহই করবে না; বিশেষ কারণে।
—সেই বিশেষ কারণটা কী, তা কি ও বলেনি?
—বলেছে।
—সেটা কী?
একটু ইতস্তত করল দেবযানী। যেন একটা রুদ্ধ কান্নার বেগকে অনেক কষ্টে চেপে রেখেছে। তারপর ধীরে ধীরে বললে, হিমুর ধারণা যে, সে পাগল হয়ে যাচ্ছে। ওর ধারণা, এটা ওর পাগলামির প্রথম স্টেজ। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ সে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাবে। এটা নাকি ওদের হেরিডেটারি একটা অসুখ। দু-এক পুরুষ অন্তর এই ব্যাধিটা…
হঠাৎ থেমে পড়ে দেবযানী চোখে আঁচল চাপা দেয়। বাসু অপেক্ষা করলেন। পাশে বসা রানী দেবী আস্তে করে ওর পিঠে একটা হাত রাখলেন। দেবযানী সামলে নিল। চোখ থেকে চশমাটা খুলে নিয়ে কাচটা মুছে আবার নাকে চড়াল। ধরা গলায় বলল, আমি জানি…আপনি আমাকেই পাগল ভাবছেন।…আই শুড হ্যাভ কনসাল্টেড এ সাইকিয়াট্রিস্ট রাদার দ্যান অ্যা ক্রিমিনাল ল-ইয়ার…
—বাসু ওকে সামলাবার সময় দিয়ে বললেন, না, দেবযানী। আমি তোমাকে আদৌ পাগল ভাবছি না। তবে তোমার ও-কথাটাও ঠিক। আমার কাছে না এসে একজন বড় মনঃস্তত্ত্ববিদ চিকিৎসকের কাছেই তোমার যাওয়া উচিত ছিল।
দেবযানী নীরবে মাথা নাড়তে থাকে।
—কী না?
—বিলকাকু কিছুতেই কোনও অ্যালোপ্যাথ ডাক্তারকে দিয়ে ওকে দেখাবেন না। উনি নিজে গ্রামে হোমিওপ্যাথি প্র্যাকটিস্ করেন। বিনা পয়সায়। বেশ সুনামও আছে। উনি অ্যালোপ্যাথ ডাক্তারদের মনে করেন রক্তচোষা বাদুড়। তারা নাকি শুধু টাকার জন্যই পেশেন্টদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলে—’অমুক টেস্ট করান, তমুক টেস্ট করান—তবে আমি যে ল্যাবরেটেরির নাম লিখে দিচ্ছি সেখান থেকে।’ কারণটা ডাক্তারবাবুরা স্বীকার করেন না। তাঁরা বাঁ-হাতে ওই ল্যাবরেটরি থেকে কমিশন পান। এই হচ্ছে তাঁর ধারণা!
–তোমারও কি তাই ধারণা?
—না। অনেকে তা করে থাকেন। তবে নিশ্চয় সবাই নয়।
—তাহলে তুমি হিমুকে কলকাতায় নিয়ে এসে তেমন কোনো সাইকিয়াট্রিস্টকে দিয়ে দেখাচ্ছ না কেন? তুমি যদি চাও আমি দু-চারজনের নাম আর টেলিফোন নাম্বার লিখে দিচ্ছি।
—তা হবার নয়, মামু। কারণ হিমু নিজেই তার বাবার সিদ্ধান্তটা মেনে নিয়েছে। ওর নিজেরও ধারণা : ও ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যাচ্ছে। এ রোগ কিছুতেই সারবার নয়। দু-দশ বছরে ও বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাবে। তাই ও নিজের বংশের এই অভিশাপকে নির্মূল করতে নিজেই শহিদ হতে চাইছে
—কেন? ওর কোনো ভাই-টাই নেই? জেঠতুতো, খুড়তুতো? যদি এটা বংশানুক্রমিক রোগই হয় তাহলে ও একা সারাজীবন ব্যাচিলার থেকে এ দুর্ভাগ্যকে কেমন করে ঠেকাবে?
—তাই ঠেকাবে। কারণ ও হচ্ছে বিল্কাকুর একমাত্র সন্তান। ওর জন্মের চার বছরের মাথায় ওর মা মারা যান। বিল্কাকুর কোনও ভাই নেই। মানে খুড়তুতো, জেঠতুতো ভাইও নেই।
—বংশানুক্রমিক অসুখ বলছ, তা ওর বাবা…
—না। বিল্কাকু সম্পূর্ণ সুস্থ। তাঁর বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। আমাদের আদমগড়ে খুবই পপুলার, যদিও সবাই তাঁকে বাঘের মতো ভয়ও করে। তবে তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ। কিন্তু তাঁর বাবা—নেভিল দাদু বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছিলেন। শেষ দিকের প্রায় বিশ বছর তাঁকে ওই পাঠক- কা-এর একটি ঘরে চেন দিয়ে বেঁধে রাখতে হতো। আমি তাঁকে দেখিনি। উনি যখন মারা যান তখনো আমার জন্ম হয়নি। কিন্তু হিমু তাঁকে দেখেছিল। সে বীভৎস দৃশ্যটা ওর বালকমনে প্রবল ছাপ ফেলেছিল। ও তাঁকে ভুলতে পারে না। খাঁচাবন্দি বাঘের মতো তিনি উলঙ্গ অবস্থায় পায়চারি করতেন। সিংহের কেশরের মতো একমাথা পাকাচুল। একবুক দাড়ি। মাঝে মাঝে জান্তব আর্তনাদ করতেন। মানুষ দেখলে আঁচড়ে কামড়ে দিতে আসতেন। শুনেছি, বাঘ- সিংহের খাঁচার মতো ওঁর সেই খাঁচায় ডব্ল ডোর ছিল। তার মাধ্যমেই তাঁকে খাবার আর জল দিয়ে আসা হতো। কিন্তু ঘরটা পরিষ্কার করার কাজটা ছিল বীভৎস রকমের। হোসপাইপ দিয়ে জলের তোড়ে। কেউ তাঁর খাঁচায় ঢুকতে সাহস পেত না। হিমুর ভয় হয়, শেষ জীবনে ওর অবস্থাও ওই রকম হয়ে যাবে। সেই বীভৎস-জীবনকে এড়াতেই হয়তো ও একদিন আত্মহত্যা করে বসবে।
বাসু জানতে চান, নেভিল পাঠক ছাড়া ওদের বংশে অন্য কেউ কি পাগল হয়ে গিয়েছিলেন?
—হ্যাঁ, দু-তিন পুরুষ অন্তর এটা হয়। নেভিল-দাদুর এক পিসিমা পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। সব হিসেব আমি জানি না। সেসব তো অনেক-অনেকদিন আগেকার কথা। বাবা জানেন। তিনি ইতিহাসের এম.এ—ওই পাঠক পরিবার নিয়ে গবেষণা করেছেন। দুশ’ বছরের ইতিহাস। বংশের আদিপুরুষ আদম থেকে তার সূত্রপাত।
বাসু বলেন, আদম? আদম-ঈভের আদম নন নিশ্চয়। বংশের আদিপুরুষ কোন সময়ের লোক? মানে কত বছর আগেকার কথা?
দেবযানী বলল, না, ‘আদম’ নয়, লোকের মুখে-মুখে নামটা বিকৃত হয়ে গেছে। বংশের আদিপুরুষের নাম মেজর অ্যাডামস্। তিনি নাকি ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির তরফে মীর কাসেমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। সাল-শতাব্দী আমি বলতে পারব না—বাবা জানেন….
বাসু উঠে দাঁড়ালেন। বিড়-বিড় করতে করতে— মেজর অ্যাডাম্স্! মীর কাসেম! তোমাদের গ্রামটা আজিমগঞ্জের বিশ কিলোমিটার দক্ষিণে, লালগোলা আর ছাতরার মাঝামাঝি? ভাগীরথীর পশ্চিমপারে বললে, তাই নয়?
—আজ্ঞে হ্যাঁ,-
—জাস্ট আ মিনিট। শুধু তোমার বাবা কেন, রমেশচন্দ্রও বলতে পারবেন। এ ঘরে বসেই তোমাদের আদমগড়কে হয়তো ‘অস্থিতে অস্থিতে’ চিনে নিতে পারব। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষপাদ—অ্যারাউন্ড সেভেনটিন সিক্সটি…হ্যাঁ, প্রায় ওই সময়েই গিরিয়ার দ্বিতীয় যুদ্ধ হয়েছিল…
কথা বলতে বলতে তিনি পিছনের আলমারি থেকে একটা মোটা বাঁধানো বই বার করে আনলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত রমেশচন্দ্রের তিন খণ্ডে বঙ্গদেশের ইতিহাস। পাতা উলটাতে উলটাতে আবার বসলেন তাঁর ঘূর্ণী-চেয়ারে।
বললেন, ইয়েস! আয়্যাম অলমোস্ট কারেক্ট।
‘ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে গঙ্গার সহিত বাঁশলই নদীর সঙ্গমের নিকট নবাব মীর কাসেম ও ইংরেজ সৈন্যের মধ্যে 1763 খ্রীস্টাব্দের আগস্ট মাসে গিরিয়ার দ্বিতীয় যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ইহা ‘সূতীর যুদ্ধ’ নামেও অভিহিত। মুর্শিদাবাদে মোতিঝিলের নিকট মীর কাসেমের সৈন্যদল পরাজিত হয়। পরে মীর কাসেম প্রেরিত সসৈন্য সেনাপতি সমরু, মার্কার, আসাদুল্লা প্রভৃতির সহিত সূতীর নিকটে মিলিত হয়। মেজর অ্যাডসের অধীনে ইংরেজগণ ভাগীরথী পার হইয়া উত্তরে আগাইয়া যুদ্ধ করেন। এই যুদ্ধে মীর কাসেমের সেনাদল পরাজিত হইয়া রাজমহলের নিকট উধুয়ানালায় শিবির স্থাপন করেন। সেখানকার শিবির আক্রমণ করিয়া নবাবপক্ষকে অ্যাডাম্স্ একেবারে বিপর্যস্ত করিয়া দেন। রিভারিজ এই সূতীর যুদ্ধ ও গিরিয়া প্রান্তরের যুদ্ধকে মুর্শিদাবাদের পানিপথ বলিয়াছেন।”
—নাউ য়ু সী? খুব সম্ভবত এই মেজর আডাম্স-এর নামানুসারে তোমাদের গ্রামের নাম হয়েছে : আদমগড়। আগে হয়তো তার নাম ছিল ‘সূতীগ্রাম’।
রানী দেবী শান্ত স্বরে বাধা দিয়ে বললেন, আমি বলেছিলাম কি যে, এসব ঐতিহাসিক গবেষণাটা…
—ও ইয়েস্! বাই অল মীনস্! আমি একটু ইয়ে…মানে ক্যারেড অ্যাওয়ে হয়ে গেছিলাম। হ্যাঁ বল দেবযানী, কী যেন বলছিলে?
—আমি বলছিলাম বংশের আদিপুরুষ আদম—এখন শুনছি, তাঁর নাম মেজর অ্যাডাম্স্—তিনি নাকি…
বাধা দিয়ে রানী বলেন, তিনি দু-আড়াই’শ বছর আগে চিরশান্তি পেয়েছেন। তাঁর কথা থাক দেবযানী। তুমি হিমুর কথা বল। ওর ভাল নামটা কী?
—হেমন্তকুমার পাঠক।
বাসু একটু অবাক হলেন। জানতে চান, নেভিল, অ্যাডাম্স্-এর মধ্যে হঠাৎ অকাল- হেমন্ত এসে পড়ল কী করে?
দেবযানী জবাবে বলে, নামটা ওর মায়ের দেওয়া, গায়ত্রী কাকিমার। বাবার কাছে শুনেছি গত শতাব্দী পর্যন্ত ওঁদের উপাধি ছিল প্যাট্রিক— বস্তুত কিপ্যাট্রিক। হিমুর ঠাকুরদার দাদা, রবিনসন, কি জানি কেন—এফিডেবিট করে উপাধিটা বদল করে ‘পাঠক’ উপাধি গ্রহণ করেন।
বাসু বলেন, হিমু কি নিজে তোমাকে বলেছে যে, সে পাগল হয়ে যাচ্ছে? সে জন্যেই সে তোমাকে প্রত্যাখান করছে।
নতনেত্রে দেবযানী ঘাড় নেড়ে স্বীকার করল।
—তাহলে একই প্রশ্ন আবার জিজ্ঞেস করি : তুমি আমার কাছে এলে কেন? কোনও নামকরা মনঃস্তত্ত্ববিদ ডাক্তারের কাছে হিমুকে নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল না কি?
—কিন্তু ও কিছুতেই যাবে না। ওর বাবাও ওকে যেতে দেবেন না।
—কেন?
এইমাত্র তো সে কথাই বললাম : বিলকাকুর ধারণা অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তারের দ্বারা হবে না। হিমুরও এখন তাই বিশ্বাস।
—’হিমুরও এখন তাই বিশ্বাস?’ তার মানে, এ বিশ্বাসটা তার সম্প্রতি হয়েছে? আগে ছিল না?
—আজ্ঞে হ্যাঁ। মিলিটারি চাকরি থেকে রিজাইন দেবার পর থেকে হয়েছে। ধরুন মাস- ছয়েক হলো। তার আগে ওর এরকম ধারণা ছিল না।
একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল বাসু-সাহেবের। তারপর বললেন, এক্ষেত্রে আমি কী করতে পারি, দেবযানী? আমি তো ক্রিমিনাল ল-ইয়ার—
—কিন্তু আমি তো কোনও ক্রিমিনাল ল-ইয়ারের কাছে আসিনি।
—আসনি? তবে কার কাছে এসেছ? আমি লোকটা কে?
—সত্যান্বেষীর উত্তরসূরী। ব্যোমকেশের প্রয়াণে আপনিই তো একমাত্র লোক— যিনি খুঁজে দেখতে পারেন : ভিতরের আসল ব্যাপারটা কী? বিল্কাকা রিটায়ার্ড কর্নেল, হিমু বি. এসসি পাশ। তাঁরা কেন বুঝতে পারছেন না যে, এ সমস্যার একমাত্র সমাধান কোনও সাইকিয়াট্রিস্টট-এর শরণাপন্ন হওয়া।
একটু চিন্তা করে নিয়ে বাসু বললেন, শোন দেবযানী, কাজটা হচ্ছে গোয়েন্দার, মানে প্রাথমিক পর্যায়ে; উকিল-ব্যারিস্টারের নয়। আমার এই বাড়িতেই ওদিককার উইংয়ে…
বাধা দিয়ে দেবযানী বলে ওঠে, জানি। ‘সুকৌশলী’র অফিস। কৌশিকদা আর সুজাতাদির। সকালবেলা তো দেখলামই তাঁদের বাইরের বারান্দায়।
বাসু হেসে বললেন, ওরে বাবা। ‘ক’ বলার আগেই যে তুমি কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা হয়ে পড়লে। তা সেই ‘সুকৌশলীকে এখানে ডেকে পাঠাচ্ছি। তোমার প্রবলেমটা তাদের বুঝিয়ে বলতে হবে। তুমি কিছুটা বলবে, আমিও কিছু ইন্সট্রাকশন দেব। তোমার ক’ দিন কলেজ কামাই হবে বাপু। তুমি ওদের নিয়ে একবার আদমগড় ঘুরিয়ে আনো। প্রাথমিক তদন্তটা ওরা করে এলে আমার কাজের সুবিধা হবে। তারপর প্রয়োজন হলে আমিও যাব—
দেবযানী বলে, কিন্তু ‘মিঠু? মিঠু কার কাছে থাকবে?
এবার ওঁরা দুজনেই একসঙ্গে হেসে ওঠেন। বাসু বলেন, কাল রাতে আমরা কী দিয়ে ভাত খেয়েছি সেটাও কি তুমি জানো?
দেবযানী লজ্জা পায়। বলে, বা―রে! আপনার প্রথম ‘ফেলিওর টার কথাটুকু জানব না আমি?
—প্রথম ‘ফেলিওর’?—সোজা হয়ে ওঠেন বাসু, বলেন, মানে?
—নার্সিং হোমে প্রথম দেখে তো আপনি ‘গ্যেস’ করতে পারেননি—আপনার নাতি হয়েছে না নাতনি। বাজি হেরেছিলেন মামিমার কাছে। এটা তো আপনার সব ‘ফ্যান্’ এতদিনে জেনে ফেলেছে!
বাসু প্রাণ-খোলা হাসি হাসলেন। বললেন, তা ঠিক। কিন্তু আমার প্রথম ব্যর্থতা আমার নিজের নাতনির কাছে। সে আত্মগোপন করতে পেরেছিল। এতে আমার লজ্জার কিছু নেই। সে যাক, তাহলে ওদের ডেকে পাঠাই?
—না। তার আগে একটা কাজের কথা। আপনাকে কী ‘রিটেইনার’ দেব?
বাসু আবার চেয়ারে এলিয়ে বসলেন। বললেন, তা হয় না দেবযানী। তুমি কোনও ‘ক্রিমিনাল কেস’ নিয়ে আসনি আমার কাছে। দ্বিতীয়ত, তুমি এসেছ ‘সত্যান্বেষীর উত্তরসূরী’ সন্ধানে। তৃতীয়ত, তুমি আমাদের মামা-মামি ডেকেছ। তোমার কাছে আমি তো কোনও ফী নেব না, নিতে পারি না।
—ফি না নেন, ‘এক্সপেন্সেস্’ তো নেবেন?
—না। আমি নেব না। ‘সুকৌশলী’র খরচপাতি বা তাদের ফী সম্বন্ধে কথা তাদের সঙ্গেই বলে নিও। তাছাড়া তোমার কেসটা আমার কাছে একটা পার্সোনাল ব্যাপার হয়ে উঠল কি না। তোমার সমস্যা ছাড়াও আরও অনেক সমস্যা। পাগলামির সঙ্গে হেরিডিটির কতটা সম্পর্ক? তাছাড়া আলেকজান্ডার অ্যাডাম্স নামে একজন ইংরেজ নাবিক ‘মিউটিনি অন দ্য বাউন্টি তে বিদ্রোহের নায়ক ছিলেন। দুজনে কি একই ব্যক্তি? ওই বিদ্রোহটা হয় গিরিয়া যুদ্ধের বিশ-পঁচিশ বছর পরে।
রানী বাধা দিয়ে বলেন, এসব ঐতিহাসিক গবেষণা….
—বটেই তো! বটেই তো! সে সব কথা দেবযানীর বাবার সঙ্গে হবে। উনি ইতিহাসের এম. এ। পাঠকদের বংশাবলী নিয়ে গবেষণাও করেছেন। তাছাড়া…ইয়ে…আরও একটা কথা। ‘প্যাট্রিক’ কী করে পাঠক হলো তা আমরা জেনেছি। হিমুর ঠাকুর্দার দাদা এফিডেবিট করেছিলেন। বাট্ দ্য আদার চেঞ্জ? ‘অ্যাডাম্স্’ কী করে ‘কিপ্যাট্রিক’ হলো? দ্যাটস্ অসো এ মিস্ত্রি!
রানী তাগাদা দেন, কৌশিকদের কি এবার ডাকতে পাঠাব?
—শ্যিওর! ওসব ঐতিহাসিক গবেষণা তো প্রাথমিক আলোচ্য বিষয় নয়। পরেও হতে পারে। তুমিই সব উল্টোপাল্টা করে দিচ্ছ।
রানী সবিস্ময়ে বলেন, আমি?
দেবযানী হেসে ফেলে।
—হাসছ কেন? জানতে চান বাসু-সাহেব!
—আপনাকে তো আগে কখনো দেখিনি। মনগড়া একটা ছবি এঁকেছিলাম। আপনি হুবহু তাই!
বাসু বলেন, এইসব ছেঁদো কথায় সময় নষ্ট করে কী লাভ? রানু, তুমি ওদের ডেকে পাঠাও।
একটু পরেই সুজাতা আর কৌশিক এল। বাসু ওদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। দেবযানী এতক্ষণে উঠে চারজনকেই প্রণাম করে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল। বাসু সমস্যাটা ব্যাখ্যা করলেন না। টেপ-রেকর্ডারটা চালিয়ে দিলেন। এ পর্যন্ত যা কথোপকথন হয়েছে তা সুন্দরভাবে পুনরায় শোনা গেল। তারপর সুইচটা অফ্ করে দিয়ে বাসু বললেন, তোমরা দুজন দেবযানীর সঙ্গে দিন-দুয়েকের জন্য আদমগড় ঘুরে এস। আজিমগঞ্জ থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে যেও।
কৌশিক বলে, আমরা কী বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করব? কী খুঁজতে যাচ্ছি?
—আই ডোন্ট নো। ‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই…’। দেখ : আমাদের মূল লক্ষ্যটা হচ্ছে জেনে নেওয়া—কী কারণে হিমু হঠাৎ বিয়ে করতে অস্বীকৃত হচ্ছে। তার অনেকগুলি বিকল্প সমাধান হয়ে পারে। এক : হিমু ইতিমধ্যে একটি সুন্দরী, গ্ল্যামারাস মেয়ের প্রেমে পড়েছে। সেকথা সে দেবয়ানীর কাছে স্বীকার করতে লজ্জা পাচ্ছে—
দেবযানী বলে, আমি একটা কথা বলব স্যার?
—না, বলবে না। আমরা এখন অ্যাকাডেমিক ডিস্কাশান করছি। তুমি রক্তমাংসের দেবযানী এ প্রবলেমে শুধুমাত্র ‘D,’ হেমন্ত ‘H’, তার বাবা কর্নেল “C”! যাক, যে কথা বলছিলাম। দ্বিতীয় সম্ভাবনা : ‘C’একটি জবরদস্ত পাত্রীর সন্ধান পেয়েছেন। টাকার কুমির ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টের একমাত্র কন্যা। সেও সুন্দরী, গ্ল্যামারাস। ‘H’ তাকে দেখেছে। মজেছে। এখন বাপ-বেটা উঠে পড়ে লেগেছেন প্রথমে ‘D’-কে পাত্রস্থ করতে। সে বখেড়া মিটে গেলে ‘H’- এর আর চক্ষুলজ্জা থাকবে না।
দেবযানী বাধা দিয়ে বলে ওঠে, কিন্তু আপনারা যা বলছেন…
—ওফ্! এর সামনে অ্যাকাডেমিক ডিস্কাশানটা করা যাবে না।
কৌশিক দেবযানীর দিকে ফিরে বলে, তুমি বললে…তোমাকে তুমিই বলছি দেবযানী…
-–বাঃ! তাই তো বলবেন। প্রণাম করলাম না তখন?
—হ্যাঁ, যা বলছিলাম। তুমি বললে, হিমু বলেছে যে তার ধারণা সে পাগল হয়ে যাচ্ছে। এই ‘শোনা-কথা’ ছাড়া তুমি নিজে তার কোনও পাগলামির লক্ষণ দেখেছ? অসংলগ্ন কথাবার্তা? অসংলগ্ন ব্যবহার? অথবা কথা বলতে বলতে অপ্রাসঙ্গিক কোনও বিষয়ের অবতারণা করা।
দেবযানী বলল, না। দেখিনি। কিন্তু শেষের ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না।
রানী দেবী শান্ত সিরিয়াস ভাবে বললেন, এই ধর আলোচনা হচ্ছে কোনো পেশেন্টের রোগের লক্ষণ নিয়ে। তার মধ্যে হঠাৎ কেউ ‘মিউনিটি অন দ্য বাউন্টি -র প্রসঙ্গ টেনে নিয়ে এলেন। এই রকম অপ্রাসঙ্গিক অসঙ্গতি।
দেবযানী ভয়ে ভয়ে বাসু-সাহেবের দিকে দৃকপাত করল। তিনি তখন পাইপে আগুন জ্বালাতে ব্যস্ত। রানী দেবীর কথায় কতটা খোঁচা খেলেন তা বোঝা গেল না। যেন একাগ্রমনে একটা অ্যাকাডেমিক ডিস্কাশান শুনছেন। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে এতক্ষণে বললেন, বলতে পার, দেবযানী, পাগলামির সংজ্ঞা কী? ম্যাডনেসের ডেফিনিশান কী?
দেবযানী বলে, আমার মনে আছে, মামু। আপনার কাছেই শেখা। ‘ড্রেস রিহার্সালের কাঁটায়’ আপনি ডেফিনিশানটা বলে দিয়েছিলেন : ‘এ ম্যাড ম্যান ইজ ওয়ান, হু হ্যাজ নো সিকোয়েন্স ইন হিজ থ।’ অর্থাৎ যার চিন্তাধারায় কোনো পারম্পর্য নেই, সে পাগল।
—কারেক্ট। এখন বল, হিমুর কথাবার্তায়, আচার-আচরণে কখনো তোমার কি মনে হয়েছে যে, তার চিন্তাধারার মধ্যে পারম্পর্য হারিয়ে যাচ্ছে? একটা এক্জাম্পল দিই :1763- তে যে মেজর অ্যাডাম্স সুতীর যুদ্ধে মীর কাসেমের বাহিনীকে হারিয়ে দিয়েছিলেন তিনি শেষ জীবনে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন, এটা ফ্যাক্ট; আবার 1784-এর ‘মিউটিনি অন দ্য বাউন্টির’ বিদ্রোহীদলের প্রধান নায়ক আলেকজান্ডার অ্যাডাও নাকি শেষ জীবনে পাগল হয়ে গেছিলেন। একুশ বছর আগে-পরের ঘটনা। এঁরা যদি পিতাপূত্র হন, তাহলে হেরিডিটি ও পাগলামির আলোচনায় এঁদের প্রসঙ্গ উত্থাপন করা হান্ড্রেড পার্সেন্ট রেলিভেন্ট! এমন সু- সংলগ্ন আলোচনার কথা কৌশিক কিন্তু জানতে চায়নি।
বাসু-সাহেব এই দীর্ঘ ব্যাখ্যার ভিতর একবারও রানী দেবীর দিকে তাকিয়ে দেখেননি; কিন্তু দেবযানী চোরাচাহনিতে দেখে নিয়েছিল : রানী মরমে মরে আছেন। সে বললে, না, আমি কোনোদিনই ওর কোনো পাগলামির লক্ষণ দেখিনি।
কৌশিক পুনরায় প্রশ্ন করে, হিমু কি তোমাকে বুঝিয়ে বলেছে, সে নিজে কী করে বুঝতে পারছে যে, সে পাগল হয়ে যাচ্ছে?
—হ্যাঁ বলেছে। সে ইদানীং বীভৎস দুঃস্বপ্ন দেখে, নাইট-মেয়ার।
—সে তো আমরা সবাই মাঝে মাঝে দেখি। বিশেষ, নৈশাহার বেশি হলে।
—ও দিনের বেলাতেও তা দেখে। কখনো দুনিয়া আঁধার হয়ে আসে, প্রখর রৌদ্রের মধ্যেই। কখনো ডব্ল্-ইমেজ দেখে!
বাসু সোজা হয়ে উঠে বসেন, ডব্লু-ইমেজ? দূরের জিনিসের না কাছাকাছি?
—দু’রকমই। একেবারে পাশে বসে থাকা মানুষেরও।
—ও ড্রিংক করে?
—আগে করত, এখন করে না। এক্কেবারে ছেড়ে দিয়েছে।
— স্মোকিং?
—না! কোনোদিনই করেনি।
–এনি ড্রাগস্?
—না। -না!
—তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছ দেবযানী—এই শেষ প্রশ্নটা হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। হিমুর কোনোরকম ড্রাগের নেশা নেই, এ বিষয়ে তুমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর?
—টু হান্ড্রেড পার্সেন্ট!
—কিন্তু তুমি তো ওর সঙ্গে চব্বিশ ঘন্টা একসঙ্গে থাকনি। পুরো চব্বিশ ঘন্টা ওকে নজরবন্দি করে রাখনি। এক ঘরে রাত কাটাওনি। তাহলে তুমি কী করে জানলে? কী করে আন্দাজ করলে?
—আপনি সেটা কী করে জানলেন? কী করে আন্দাজ করলেন?
—কী?…ও আই আন্ডারস্ট্যান্ড…আয়াম সরি।
—নাথিং টু বি সরি ফর, স্যার! ডাক্তার আর উকিলের কাছ থেকে কোনো কিছু গোপন করতে নেই। আপনারা চারজনেই আমার হিতাকাঙ্খী। আমার দশ বছরের পরিচিত— যদিও বইপড়া বিদ্যা। আপনাদের কাছে সব কথা স্বীকার করব না কেন?
কৌশিক জানতে চায়, তোমাদের ওখানে ডাকবাংলো বা থাকার মতো হোটেল পাব তো?
—ওমা, হোটেলে থাকতে যাবেন কোন দুঃখে! বাবার হেডমাস্টার্স কোয়ার্টার্সে তিন- তিনটে বেড-রুম। একটায় বাবা, একটায় আমরা ভাই-বোন, তৃতীয়টা তো খালিই পড়ে থাকে।
—কেন? তোমার পিসিমা?
—গিরি-পিসিমা ঠাকুরঘরে একটা নেয়ারের খাটিয়া পেতে শোন। সে আপনাদের কোনও অসুবিধা হবে না। ওই শয়নকক্ষের সংলগ্ন স্নানাগারও আছে। পিসিমা দারুণ নিরামিষ রাঁধেন। আর মেম-সায়রের রুইমাছের দইমাছ রাঁধব আমি। দেখবেন কেমন রাঁধি।
বাসু বলেন, শুনে আমারই তো জিভে জল এসে যাচ্ছে।
—তা চলুন না আপনারও—বলেই অপ্রস্তুত হয়ে যায়।
মনে পড়ে যায় রানী দেবীর অসহায়ত্বের কথা
বাসু কথা ঘোরাতে বলেন, ওরা ঘুরে আসুক। তারপর না হয় আমিও যাব। খুব লোভ হচ্ছে আদমগড়টা দেখতে।
সুজাতা বাসু-সাহেবের দিকে ফিরে বলে, আমরা কি পরিচয় গোপন করে যাব?
একটু চিন্তা করে বাসু বলেন, সেটাই ভাল। আজকাল গ্রামে-গঞ্জেও ‘কাঁটা সিরিজের’ বই লোকে পড়ে। নাম শুনে কেউ হয়তো চিনে ফেলতে পারে। তখনই মানুষ সজাগ হয়ে যাবে। সরাসরি প্রশ্নের জবাব দেবে না। তারা ভাবতে থাকবে : ‘সুকৌশলী’ কিসের তদন্তে এসেছে।
কৌশিক বলে, আমি তাহলে হব প্রফেসর সুব্রত মিত্র। যাবদপুরে ইতিহাস পড়াই। সুজাতা আমার স্ত্রী, নাম সুস্মিতা। কলেজের সূত্রে দেবযানীর সঙ্গে আলাপ। ওর সঙ্গে আদমগড়ের ‘পাঠক-প্যালেস’ দেখতে এসেছি—হিস্টরিক্যাল ইন্টারেস্টে।
বাসু বলেন, কী বুদ্ধি! পাঁচ-মিনিটে ধরা পড়ে যাবে দীনেশবাবুর কাছে। উনি বলবেন, দিল্লীর সিংহাসনে তুঘলক বংশ এসেছিল লোদী বংশের ঠিক পরেই, এটা তো মানবেন?…আপনি কী জবাব দেবেন ইতিহাসের অধ্যাপক সুব্রত মিত্র মশাই? তার চেয়ে তুমি বরং যাদবপুরের সিবিল এঞ্জিনিয়ারিঙের অধ্যাপকের চরিত্রটা অভিনয় কর। সেটা তোমার দ্বারা হবে।
কৌশিক রুমাল দিয়ে কপালের ঘামটা মুছে নিয়ে বলে, ঠিক আছে, ঠিক আছে! বাই দ্য ওয়ে, মামু? তুঘলকরা কি লোদী বংশের পরে সিংহাসন দখল করে? না আগে?
—তুঘলকী শাসন তিরানব্বই বছরের। শেষ হয় 1413-এ। তারপর সৈয়দবংশ এবং তারপর লোদীরা। পানিপথের প্রথম যুদ্ধতক। সেটা কবে জান?
—আজ্ঞে না। তবে গিরিয়ার দ্বিতীয় যুদ্ধটা কবে হয়েছিল সেটা জানি : 1763-তে। “বিভারিজ ইহাকে মুর্শিদাবাদের পানিপথ বলিয়াছেন।”
বাসু-সাহেব কর্ণপাত করলেন না। দেবযানীর দিকে ফিরে বললেন, আচ্ছা, হেমন্ত রিজাইন করে ফিরে আসার পর আদমগড়ে কি কোনও চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছে? এই বছরখানেকের ভিতর? কোনো স্ক্যান্ডালাস ব্যাপার? বা অলৌকিক কোনো কিছু—যার ব্যাখ্যা সাধারণ মানুষে খুঁজে পায়নি। হিমু ফিরে আসার পর?
—কী রকম ঘটনার কথা বলছেন?
–কোনো অহৈতুকী আত্মহত্যা, বা অর্থহীন হত্যা, সাঁতার জানা মানুষ পুকুরে ডুবে মারা গেল, অথবা আগুন লেগে অ্যাক্সিডেন্টে…
—আত্মহত্যার কেস একটা হয়েছে। কিন্তু সে আদৌ অহৈতুকী নয়। মৃত্যুপথযাত্রী পরিষ্কার ভাষায় স্বীকারোক্তি দিয়ে গেছে কেন সে আত্মহত্যা করছে।
—না, ও রকম না। মিস্টিরিয়াস্ কোনো কিছু? যার ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায়নি?
—হ্যাঁ, আরও একটা ঘটনা ঘটেছিল। অবশ্য সামান্য ব্যাপার। তবে মিস্টিরিয়াস! যার ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায়নি। কলিমুদ্দিন চাচার একটা পাঁঠার গলায় কেউ ক্ষুর দিয়ে নালিটা কেটে দিয়ে গিয়েছিল। রাতের বেলা। চুপি চুপি। পাঁঠাটা চুরি করে নিয়ে যায়নি কিন্তু পুলিশের ধারণা এ কাজ কলিমুদ্দিন চাচার কোনও শত্রুর। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে। কিন্তু গ্রামের সব্বাই জানে, কলিমচাচা নির্বিরোধী অজাতশত্রু মজুর চাষী। একা থাকে। নিতান্ত ধর্মভীরু।
—তুমি কলিমুদ্দিনকে প্রশ্ন করনি কেমন করে এমনটা হলো?
—করেছিলাম। ও কোনও সদুত্তর দিতে পারেনি। ওকে আমি পঞ্চাশ টাকা সাহায্য দিতে চেয়েছিলাম। ও নেয়নি। বলেছিল, কর্নেল-কর্তা ওকে ডেকে পাঠিয়ে নানান প্রশ্ন করেছিলেন। তাঁর রাজ্যে এতবড় দুঃসাহস কার হলো সেটা খুঁজে বার করতে চান তিনি। যাবতীয় তত্ত্বতালাস নিয়েছিলেন। এবং শেষমেশ পাঁঠার পুরো দামটা তাকে ধরে দিয়ে বলেছিলেন, ‘তোর পাঁঠার জানটা আমি ফেরত দিতে পারব না রে কলিম, কিন্তু আমার রাজ্যে এই যে অন্যায়টা ঘটল—পুলিশ কিছুই করতে পারল না—এটা আমার জরিমানার টাকা! তুই নিলে আমার কলজেটা ঠাণ্ডা হবে।”
বাসু বলেন : আজব মানুষ! অজ্ঞাত অপরাধীর জন্য উনি অযাচিত প্রায়শ্চিত্ত করলেন!
দেবযানী বলল, এটাই তো ভারতীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্য মামু। শ্রীরামচন্দ্রের রাজত্বে অকালমৃত্যু হলে অযোধ্যারাজকে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হতো। কর্নেল কাকু ক্রিশ্চিয়ান। তবু ভারতবর্ষের সেই ট্র্যাডিশনটা মেনে চলেন। তাঁর বিশ্বাস সরকার জমিদারী কেড়ে নিক না নিক, তিনিই দেশের রাজা! প্রজার দুঃখ তাঁরই দুঃখ। প্রজার আর্থিক ক্ষতি তাঁকেই পূরণ করতে হবে।
দুই
হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল-চৌহদ্দির একান্তে হেডমাস্টার-মশায়ের কোয়ার্টার্স। ছোট্ট দ্বিতল বাড়ি। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। সামনে ঢালাই লোহার গেট। সেখান থেকে লাল কাঁকর বিছানো রাস্তাটা আগন্তুককে পৌঁছে দেয় সদর দরজায়। দু-পাশে রজনীগন্ধা, দণ্ডকলস আর অ্যাকাসিয়া পামের ঝাড়। বাগানে আম, জাম, পেয়ারা তো আছেই তাছাড়া একটি সযত্ন-রক্ষিত পান্থপাদপ। দীনেশচন্দ্র ইতিহাসের অধ্যাপক, বটানির নয়। কিন্তু স্বভাবে বোধহয় তিনি বৃক্ষপ্রেমী। বাগানটাকে যত্ন নিয়ে সাজিয়েছেন। সবচেয়ে অবাককরা ওঁর বাগানে ঘাসের ‘লন’। সপ্তাহান্তে স্বহস্তে লন- মোয়ার চালিয়ে ঘন-সবুজ আস্তরণের যেন টেনিস-কোর্ট বানিয়ে রেখেছেন।
ওদের ট্যাক্সিটা যখন দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াল তখন হেডমাস্টারমশাই খালি গায়ে কী .একটা গাছের গোড়া খুঁড়ে দিতে ব্যস্ত। গাড়িটা দোরগোড়ায় আসার পর উনি খুরপি হাতে উঠে দাঁড়ালেন। বাঁ হাতে চশমাটাকে স্বস্থানে স্থাপন করতে গিয়ে নাকে এঁটেল মাটির কাদা লাগালেন।
ওরা তিনজন একে একে ট্যাক্সি থেকে নামল। ডিকি থেকে স্যুটকেসগুলো নামাতে কৌশিক ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দেবযানী সুজাতার দিকে ফিরে বসে, ভুল করে বসবেন না সুজাতাদি। উনি আমার বাবা, বাগানের মালি নন।
সুজাতা ছদ্ম ভর্ৎসনা করে, তোমাকে পাকামো করতে হবে না। গোয়েন্দারা একনজরেই বুঝে নেয় কে মালি, কে হেডমাস্টারমশাই!
দীনেশচন্দ্র অত্যন্ত সমাদরের সঙ্গে ওদের দুজনকে নিয়ে গিয়ে বসালেন বৈঠকখানায়। বললেন, দেবী এস. টি. ডি. করে কাল রাত্রেই আমাকে জানিয়ে রেখেছিল আপনারা দুজন আসছেন। আমাদের এখানে বড় একটা কেউ তো আসে না। তাই অতিথি পেলে আমরা বর্তে যাই, কৌশিকবাবু।
কৌশিক জিজ্ঞাসু নেত্রে দেবযানীর দিকে তাকাল। সে ট্যাক্সি ফেয়ার মিটিয়ে সবে ঘরে ফিরেছে। একগাল হেসে বলল, কৌশিকদা, আমার একুশ বছরের জীবনে বাবাকে কোনোদিন কখনো মিছে কথা বলিনি। আমার তো মা নেই—উনিই আমার বাবা এবং মা!
কৌশিক জানতে চায়, বঙ্কু? পিসিমা?
—সক্কলের কাছে আপনি অধ্যাপক সুব্রত মিত্র। সুজাতাদি হচ্ছেন সুস্মিতাদি। বাবা! তুমিও ওঁদের ওই নামেই ডেক। নাহলে…
—অল রাইট। অল রাইট!—এককথায় মেনে নেন হেডমাস্টারমশাই।
বঙ্কু তখনো স্কুল থেকে ফেরেনি। পিসিমা ঠাকুরঘরে।
সদর-দরজা বন্ধ করে দীনেশবাবু ওদের দ্বিতলে নিজের ঘরে নিয়ে এসে বসালেন। দেবযানী গেল চায়ের এন্তাজামে। দীনেশচন্দ্র বললেন, দেখুন আপনারা দুজন চেষ্টা করে। যদি কোনও সমাধান খুঁজে পান। আপনারা দুজন, আমাদের পরিবারে খুবই পরিচিত। দেবী যাবতীয় কাঁটা-সিরিজের বই কিনে আনে। আমি পড়ি, দিদি পড়েন, বঙ্কুও পড়ে।
–বঙ্কুর কোন ক্লাস?
—ক্লাস সেভেন। আমি বারণ করি না। টি.ভি-তে অবাস্তব ঢিসম্-টিসম্ এর চেয়ে আপনার রচনা অনেক বুদ্ধিদীপ্ত, তা কি বলে ভাল, আপনার মুখের উপরই বললাম।
প্রসঙ্গটা বদলাতে সুজাতা জানতে চায়, আপনার কী ধারণা মাস্টারমশাই? হিমু হঠাৎ এখন বিয়েতে গররাজি হচ্ছে কেন? সে কি অন্য কোনও মেয়ের প্রেমে পড়েছে?
—আমি জানি না, মা। নাহং বেদ। আই ডোন্ট নো!
—জানেন না। আন্দাজ তো করতে পারেন। ও তো আপনার ছাত্র ছিল এককালে।
—না। ভুল হলো তোমার। হিমু আমার ছাত্র ছিল না কোনোকালেই। আড়াই-তিন বছর বয়সে হতেই কর্নেল-সাহেব ওকে এ গ্রামেই মিস্ অ্যাগনেসের নার্সারী স্কুলে ভর্তি করে দেন। ওই গীর্জা সংলগ্ন ক্রিস্টিয়ান মন্টেসারি স্কুলে। সেখান থেকে সে সরাসরি চলে যায় দার্জিলিঙে। আমার স্কুলে সে কোনোদিন ভর্তিই হয়নি। তবে ছেলেটিকে আমি বড় ভালবাসতাম। দারুণ কৌতূহলী। ছুটিতে এখানে এলে আমার লাইব্রেরিতে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইংরেজি বই পড়ত। তাকে আমি ভালবাসতাম, বাসি। সেও আমাকে শ্রদ্ধা করে, ভক্তি করে, ভালবাসে। সে আমার জামাই হলে আমি ধন্য হয়ে যেতাম। কিন্তু কী বলব, সুজাতা মা-আই মীন সুস্মিতা মা। তা হবার নয়। হিমু বেঁকে বসেছে।
সুজাতা জানতে চায়—এটা কি ইটার্নাল ট্রায়াঙেল হয়ে গেল মাস্টারমশাই? তৃতীয় কোনো সুন্দরী, গ্ল্যামারাস কুমারী—
কথার মাঝযখানেই দীনেশদন্দ্র বলে ওঠেন, বলেছি তো, নাহং বেদ! আমি জানি না। খবর পাইনি—
ঠিক সেই সময়েই একটা ট্রেতে চার কাপ কফি আর দু-প্লেট এগ-পাকোড়া নিয়ে রান্নাঘরের দিক থেকে এসে ঘরে ঢুকল দেবযানী। ট্রেটা সেন্ট্রাল টেবিলে নামিয়ে দিতে দিতে বললে, বাট আই নো! দ্য আনসার ইজ অ্যান এম্ফাটিক : নো।
কৌশিক বললে, বস তুমি। প্রথমে বল, এত নিশ্চিতভাবে তুমি কেমন করে জানলে? হিমু গত দু-তিন বছর যে মিলিটারি ক্যাম্পাস-এ ছিল, সেখানে তার সঙ্গে কোনো মেয়ের ঘনিষ্ঠ আলাপ হওয়া কি এতই অসম্ভব?
—হ্যাঁ। তাহলে হিমু সে-কথা আমাকে খোলাখুলি বলত। ফিরে আসার পর ও দিন দিন বদলে যাচ্ছে। মুখ-চোখের এক্সপ্রেশন পর্যন্ত। ওর গালে কেমন যেন লাল র্যাশ বেরিয়েছে। এখন যেন সে সর্বদাই একটা চাপা উত্তেজনায় অমন লাল হয়ে থাকে। ও খোলাখুলি আমাকে জানিয়েছে কেন সে বিয়ে করবে না। ওর ঠাকুর্দার সেই ভয়াবহ শেষ জীবনটা ওকে হন্ট করে ফিরছে। আমার আশঙ্কা হয়, ও যদি নিশ্চিত বুঝতে পারে যে, এই মর্মান্তিক দুর্ভাগ্য থেকে ওর পরিত্রাণ নেই, তাহলে….
কথাটা সে শেষ করতে পারল না। দীনেশবাবু বললেন, আপাতত ও কথা থাক, মা, সবাইকে কফি-টফি দে—
সুজাতা আর দেবযানী প্লেট আর কফি এগিয়ে দিতে থাকে।
হঠাৎ বেজে উঠল টেলিফোনটা। হেড়মাস্টারমশাই তুলে নিয়ে আত্মঘোষণা করলেন। বললেন, সুপ্রভাত ঘোষমশাই…অ্যাঁ? হ্যাঁ, এসেছে। আজ সকালেই। ওর সঙ্গে ওর কলেজের এক অধ্যাপকও এসেছেন। সস্ত্রীক।…অ্যাঁ? না, এমনি বেড়াতে।…আচ্ছা বলব। দেবযানীকে বলব ওঁদের দুজনকে আপনার দোকানে নিয়ে যেতে।…আমার শরীর ভালই আছে। আচ্ছা রাখি।
দেবযানী মুখ তুলে জানতে চাইল, বসন্তকাকা?
—হ্যাঁ, আজিমগঞ্জ থেকে একটা ট্যাক্সিতে তোকে বুঝি আসতে দেখেছেন। তুই কিনা কনফার্ম করে নিলেন।
কৌশিক পাকোড়া চিবাতে চিবাতে বললে, এই বসন্তকাকাটি কে? স্থানীয় ভদ্রলোক তা তো বোঝাই যায়। কী করেন? আপনাদের সঙ্গে সম্পর্কটাই বা কী?
দীনেশবাবু বসন্ত ঘোষের বিস্তারিত পরিচয় দিলেন। দেবযানীও নানান সংবাদ যোগান দিল। জানা গেল : এই বসন্তকুমার ঘোষ কর্নেল বিল্ পাঠকের বাল্যবঙ্কু ও সহপাঠী। শুধু তাই নয়, দুজনের প্রগাঢ় বঙ্কুত্ব। এই গ্রামেরই বাসিন্দা। সংসারে কেউ নেই। একেবারে একা মানুষ। বিয়ে-থা করেননি। স্টেশন রোড যেখানে বাজার রোডে পড়েছে সেখানে প্রকাণ্ড একটা স্টেশনারি স্টোরস। নাম :’গায়ত্রী ভাণ্ডার’। তিনতলা বাড়ি। একতলায় শোরুম ও দোকান। দোতলায় গুদাম। তিনতলায় দু’কামরা ফ্লাটে একটি কম্বাইন্ড হ্যান্ডকে নিয়ে কনফার্মড ব্যাচিলার বসন্তবাবু বাস করেন। কম্বাইন্ড হ্যান্ডের কাজ সামান্যই। কারণ দিনের বেলা ‘পাঠক-প্যালেস’ থেকে টিফিন-ক্যারিয়ারে ওঁর মধ্যাহ্ন আহার আসে। আর সন্ধ্যায় মেমসায়রের পাড়ে লম্বা একটা চক্কর মেরে বসন্তকাকু পাঠক-প্যালেসে উপস্থিত হন। দু-বঙ্কুতে দু-তিন হাত দাবা খেলা চলে। দেশের রাজনীতি, শেয়ার বাজার, ভোটের বাজার ইত্যাদির হদ্দমুদ্দ করে দুই বঙ্কুতে সায়মাসে বসেন। রাত নয়টা নাগাদ একটা পাঁচ সেলের টর্চ জ্বেলে বসন্তকাকু ‘আফটার ডিনার ওয়াক আ মাইল’ সারেন। বাঁধা জীবন। নিতান্ত নিরুপদ্রব। কর্নেল-সাহেবের অত্যন্ত বিশ্বস্ত, নির্ভরযোগ্য বয়স্য। তাঁর সঙ্গে পরামর্শ না করে কর্নেল কিছু করেন না।
সুজাতা দীনেশবাবুর কাছে জানতে চায়, তা কর্নেল পাঠকের এই ফ্রেন্ড, ফিলসফার অ্যান্ড গাইডটি হিমুর অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা বা সাইকিয়াট্রিস্টকে দিয়ে দেখানোর বিষয়ে কী বলেন?
দেবযানী উপরপড়া হয়ে বলল, তবেই হয়েছে। বসন্তকাকু একজন আউট অ্যান্ড আউট ফেটালিস্ট! আমি কতবার বলেছি—কিন্তু ওঁর সেই ভদ্রলোকের এককথা :এ সব ভবিতব্য মা! ‘ললাটঙ্ক লিখন’। হরিদ্বারে গুরুদেবকে লিখেছি। দেখি তিনি কী জবাব দেন!
দীনেশবাবু বললেন, বসন্তবাবু অত্যন্ত দৈব-নির্ভর। তাঁর দশ আঙুলে আটটি গ্রহবারণ আঙটি। হরিদ্বারে ওঁর এক গুরুবাবা আছেন, তিনি যদি বলেন, ব্রাহ্মমুহূর্তে শয্যাত্যাগ করে নাকে কাঠি দিয়ে তিনবার হাঁচবে, তাহলে বালিশের পাশে কাঠি রেখে উনি ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে শোবেন। তিনবার হাঁচবেন। চতুর্থ হাঁচিটি থামাতে যদি তাঁর মৃত্যু হয় সো ভি আচ্ছা। আশ্চর্য মানুষ! শান্তি-স্বস্ত্যয়ন-গ্রহ-তাবিজ আর যজ্ঞভস্মে ঘি ঢালা।
—আর কর্নেল পাঠক?
—তিনি তো হ্যানিম্যানের হদ্দমুদ্দ করে ছেড়েছেন ছেলের চিকিৎসার জন্য। আজ পালসেটিলা, তো কাল নাক্স ভমিকা, তার পরেই সালফার থাট্টি, বেলেডোনা টু হান্ড্রেড! হ্যানো ওষুধ নেই যা হিমুকে খাওয়াননি।
সুজাতা জানতে চায়, হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার হিসাবে ওঁর পশারটা কেমন?
—টাকার মাপকাঠিতে শূন্য। কারণ উনি ফী নেন না। তবে হ্যাঁ, স্বীকার করতেই হবে, ডক্টর বিল্ পাঠকের উপর গ্রামের মানুষের অগাধ বিশ্বাস। সকাল আটটা থেকে দশটা উনি বৈঠকখানায় বসে রুগী দেখেন। গোনাগুনতি একশোটি। ভোর রাত থেকেই সবাই লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার দুটি কারণ। এক : উনি একটি কপর্দকও নেন না, ফী বা ওষুধ বাবদ। সবই মানবহিতার্থে ওঁর দান। বাইরে একটা দরিদ্রভাণ্ডারের কৌটো আছে। তাতে যে-যা ইচ্ছে ফেলতে পারে। নাও পারে। দুই : ওঁর ওষুধ কথা বলে। সেদিক থেকে ধন্বন্তরি। একমাত্র ওঁর নিজের ছেলের চিকিৎসার ক্ষেত্রে উনি বোধহয় ব্যর্থ হয়েছেন!
একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে কৌশিক বলে, আপনাদের গ্রামটার নাম, ‘আদমগড়’ না হয়ে হওয়া উচিত ছিল ‘আজবগড়’।
—তা যা বলেছেন।
মেনে নিলেন হেডমাস্টারমশাই।
তিন
মফঃস্বল আধা-শহর অনুপাতে দোকানটি প্রকাণ্ড। ডিপার্টমেন্টাল স্টোরস্। স্টেশনারি, জামা-কাপড়, বিছানাপত্র সব কিছুই একঠাঁই পাওয়ার ব্যবস্থা। দোকানে ঢুকে কৌশিকের মনে হলো—বসন্তকাকু একজন বিরাট ধনী লোক। এতবড় তিনতলা বাড়ির মালিক এবং এত প্রকাণ্ড দোকানের অধিকারী যখন। দেবযানী ওদের দুজনকে নানান গলিপথ দিয়ে দোকানের পিছন দিকে নিয়ে গেল। সেখানে একটা বিরাট সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপ্রান্তে বসেছিলেন বসন্তবাবু। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। একহারা পাকানো চেহারা। প্রায় ছয় ফুটের কাছাকাছি। গৌরবর্ণ। ধুতি-পাঞ্জাবি পরে তিনি বসেছিলেন। ওদের এগিয়ে আসতে দেখে সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়ালেন। যুক্তকরে নমস্কার করে বললেন, আসুন, প্রফেসর সাহেব। মা লক্ষী, আপনিও বসুন ওই চেয়ারটায়।
তিনজনেই বসল ওঁর দর্শনার্থীদের জন্য নির্দিষ্ট চেয়ারে। বসন্তবাবু বললেন, প্রথমেই বলুন, কী আনতে বলব? গরম না ঠাণ্ডা?
সুজাতা বলে, আমরা এইমাত্র দেবযানীদের বাড়িতে কফি আর জলখাবার খেয়ে এসেছি। আপাতত আর কিছু খেতে পারব না। তবে আমরা তো দিন-দুয়েক থাকছি। আবার যখন আসব-
—ঠিক আছে মা, তাই হবে। কিন্তু আদমগড়ে আপনারা কী দেখতে এলেন বলুন তো মশাই?
কৌশিক কৈফিয়ত দেয়, কলেজে ছেলেরা স্ট্রাইক করেছে। দিন সাতেক ক্লাস-টাস্ হবে না। দেবযানী জানতে চাইল, আদমগড়ে যাবেন, স্যার? আমি তো যাব দিন-তিনেকের জন্য। ও বলল, এখানে ‘পাঠক-প্যালেসে’ অনেক দর্শনীয় কিউরিও আছে-
—তা আছে। আদমগড় একটি প্রাচীন জনপদ। ‘আদম’ নামে এক সাহেব এর পত্তন করেন। আগে নাম ছিল সূতীগ্রাম। পরে ওই আদম-সাহেবের নামেই গ্রামটার নাম হয়ে যায় আদমগড়।
কৌশিক জানতে চায়, আপনারা বোধহয় এখানকার অনেক দিনের বাসিন্দা?
—আরে না, না। দু-পুরুষের বাস। বিলুর জ্যাঠামশাই, আমার বাবাকে তাঁর সেক্রেটারি হিসাবে এখানে নিয়ে আসেন স্বাধীনতার পরের বছর। আমার জন্ম তার তিন বছর পরে।
—বিলু কে?— ন্যাকা সাজে কৌশিক।
—’বিলু’ মানে বিল্, উইলিয়াম পাঠক। আমার বাল্যবঙ্কু। সেই এখন পাঠক-কা-এর মালিক। আমরা দুজনেই এখানকার স্কুলে একই ক্লাসে পড়েছি। তারপর বিলু মিলিটারিতে যোগ দেয়—
—এ দোকানটাও তাহলে দু-পুরুষের?
—এবারও আন্দাজে ভুল হলো আপনার। এ দোকানটা বিলুই তৈরি করেছে। আমি দেখভাল করি মাত্র। এটা বিলুর গড়া একটা তাজমহল। “গায়ত্রী ভাণ্ডার”! গায়ত্রী ওর স্ত্রীর নাম। মাত্র একুশ বছর বয়সে বেচারি মারা যায়। অপঘাতে। বিয়ের মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে।
—মিস্টার উইলিয়াম পাঠক তারপর আর বিয়ে করেননি?
—না। ও তো মিলিটারিতে চলে গেল। গায়ত্রীর মৃত্যুর সময় তার বাচ্চাটা নিতান্ত শিশু। তাকে মানুষ করে তোলে তার পিসিমা, বাতাসী। তারও এক বিরাট কাহিনী….
দেবযানী বাধা দিয়ে বলে, আমি জানি। বাতাসী পিসির গল্পটা আমি ওঁদের শুনিয়ে দেব’খন।
বসন্তবাবু যেন একটু ক্ষুণ্ন হলেন। জমাটি একটা কিস্সা বর্ণনার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়ে। মধ্যাহ্ন আহারের সময় হয়ে এসেছিল। আরও খানিকক্ষণ এ-কথা সে কথার পর ওরা ফিরে এল হেডমাস্টার মশায়ের কোয়ার্টার্সে।
আজ আর দইমাছ বানানোর সময় পায়নি দেবযানী। গিরি পিসিমার নিরামিষ রান্নাই আহার করলেন ওঁরা তিনজন। দেবযানী কিছুতেই একসঙ্গে বসল না, বলল, আমি পিসির সঙ্গে খেয়ে নেব’খন।
আসলে সে পরিবেশনের দায়িত্বটা পিসির ঘাড় থেকে নামাতে চেয়েছে মাত্র।
সুজাতা আর কৌশিক ভদ্রতাসূচক প্রশংসা করল নিরামিষ রান্নার। আদমগড়ে ভাল রাঘবসাই পাওয়া যায়। ওপার-বাঙলা, সম্ভবত রাজসাহী বা নাটোর থেকে কেউ এসে মিষ্টির দোকান দিয়েছে। দই-রাঘবসাই দিয়ে উপসংহারটা জমল জবর।
আহারান্তে দেবযানী এসে জানতে চাইল, দুপুরে একটু ঘুমিয়ে নেবেন নাকি?
কৌশিক বলে, দিবানিদ্রার অভ্যাস আমাদের দুজনের কারও নেই। তুমি বিলু কাকাকে জানিয়ে রেখেছ তো যে, আমরা বিকালে তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে যাচ্ছি, আর কিউরিও দেখতে?
—হ্যাঁ রেখেছি। কিন্তু বিকালে নয়, সাড়ে চারটের সময়। আর সাড়ে চারটে মানে চারটে ত্রিশ মিনিট। বিল্ কাকুর একেবারে মিলিটারি-টাইমিং। চারটে পঁয়ত্রিশে গেলে হয়তো গিয়ে শুনবেন সাহেব এইমাত্র গাড়ি নিয়ে কোথায় যেন বেরিয়ে গেছেন। উনি ধরে নিয়েছিলেন যে আজ আপনারা আসবেন না।
কৌশিক বলে, ঠিক আছে। আমার হাতঘড়ি আই. এস. টি. দিচ্ছে। আমরা দুজন ঠিক চারটের মধ্যে তৈরি হয়ে নেব। চা-পর্বটা নিশ্চয় পাঠক-প্যালেসে হবে। তুমি বরং ওই বাতাসী পিসির গল্পটা শুনিয়ে দাও ততক্ষণ।
বাতাসীর জীবনটা বড় করুণ। ওর বাবা ছিলেন আলিনগরের একজন ধনবান বণিক জাতিতে সাহা। প্রকাণ্ড মদের দোকান ছিল তাঁর। বাতাসী তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যা। সুপাত্রে তার বিবাহের ব্যবস্থাও করেছিলেন—মোটা নগদ পণ দিয়ে। আলিনগর গ্রামটা আদমগড়ের পশ্চিমে, মাইল পঁচিশ দূরে। সম্ভবত সিরাজউদদৌলার মাতামহের নামে। বাঙলা-বিহারের সীমান্তে। পশ্চিম বাঙলায়।
বিবাহরাত্রে বহু লোকের নিমন্ত্রণ ছিল। বস্তুত সাহামশাই আলিনগরের যাবতীয় ভদ্রসমাজকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। প্রবেশদ্বারের উপর রসুন চৌকি। সকাল থেকে সেখানে সানাই বাজছে। সাহামহাশয়ের বিরাট বাড়ি। প্রকাণ্ড বাগান। দু-প্রান্তে দুটি প্যান্ডেল। একটি বরাসন। সেখানে ফোল্ডিং চেয়ারে জমিয়ে বসেছেন বরযাত্রীদল। ও-পাশে বিরাটতর নৈশভোজনের প্যান্ডেল। পংক্তি ভোজনের আয়োজন। বিবাহ-লগ্ন একপ্রহর রাত্রে। পংক্তি ভোজন শুরু হয়ে গেছে। ভিতরে চকমিলানো বাড়ির উঠানে ছাঁদনাতলা। সেখানে পুরললনাদের সম্মিলিত হুলুধ্বনি আর শঙ্খনিনাদে স্ত্রীআচার সাড়ম্বরে শেষ হতেই কনেকে পিঁড়ির উপর বসিয়ে নিয়ে এল সাহাবাবুর পুত্র, ভাইপো প্রভৃতিরা। সাতপাক ঘুরিয়ে কনেকে আলপনা দেওয়া পিঁড়িতে বসিয়ে দিল তারা।
সালঙ্কারা কন্যা বসে আছে আলপনা-দেওয়া পিঁড়িতে। কনের জেঠামশাই সম্পদান করবেন। পুরোহিত মশাই ঘড়ি ধরে বসে আছেন—মাহেন্দ্র লগ্ন আসতে বিলম্ব নেই। বরযাত্রী- কন্যাযাত্রী মিলিয়ে বিবাহ মণ্ডপে তখন অন্তত শতখানেক মানুষ। এমন সময় রে-রে করে এসে পড়ল দুই জিপ ভর্তি সশস্ত্র ডাকাতের দল। তাদের হাতে বন্দুক নয়, সদ্য-আমদানি অটোমেটিক স্টেনগান : খ্যাটা-খাটা-খাটা-খ্যাটা করে মিনিটে পঞ্চাশজনকে জমি সই-সই করে দিতে পারে। সাহাবাবুর পাইক-বরকন্দাজেরা প্রতিবাদের সূচনা করতেই ওরা শুরু করে দিল—খ্যাটা-খ্যাটা-খাটা-খাটা…
দুদ্দাড়িয়ে পালাল সকলে—যে যেখানে পারে। তবে ডাকাতরা ভদ্র। দু-পাঁচজন মহিলার গলার হার, হাতের চুড়ি, কান ছিঁড়ে ঢেঁড়ি ঝুমকো কেড়ে নেওয়া ছাড়া সর্বসমক্ষে কারও শ্লীলতাহানি করেনি। সাহামশাই যে নগদ পণ দিয়েছিলেন সেটা দর্শনধারী করতে রৌপ্যমুদ্রায় পিতলের কলসিতে ভর্তি ছিল। ডাকাতরা সেটা উঠিয়ে নিয়ে গেল।…আর উঠিয়ে নিয়ে গেল সালঙ্কারা হবু নববধূকে।
এই হৈ চৈ-এর মধ্যে বোধহয় মাহেন্দ্রক্ষণটা এসেছে এবং চলেও গেছে। বিবাহমণ্ডপে নেমে এসেছে শ্মশানের স্তব্ধতা। পুলিশ কিছুই করতে পারেনি। খুঁজেই পায়নি ডাকাতদের আস্তানা। বিল্ পাঠক—তখন তিনি কর্নেল নন, মেজরও নন,—ক্যাপ্টেন পাঠক, তাঁর নিজস্ব গুপ্তচর বাহিনীর মাধ্যমে সন্ধান পেলেন ডাকাতদের গোপন আস্তানার। সেটা ওই আলিনগরের উত্তরে একটা ঘন জঙ্গলের ভিতরে। জঙ্গলটার নাম ‘কঙ্কালীতলা’। ক্যাপ্টেন উইলিয়াম পাঠক তখনো ছিলেন এলাকার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। মাত্র সাতজন দুঃসাহসী কমান্ডো অনুচরকে নিয়ে তিনি হানা দিলেন ডাকাতদলের আস্তানায়। অপারেশন ‘নববধূ উদ্ধার’। ওরা অপ্রস্তুত ছিল। এ আক্রমণের আশঙ্কাই করেনি। অধিকাংশ প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল—তিনজন প্রাণ দিয়েছিল প্রতিবাদ করতে গিয়ে। নগদ বা গয়না উদ্ধার করতে পারেননি; কিন্তু বন্দিনী নববধূকে উদ্ধার করে আনতে পেরেছিলেন।
আনন্দের কথা : পুলিশ ক্যাপ্টেন পাঠকের বিরুদ্ধে নরহত্যার চার্জ ফ্রেম করেনি। তেমনি দুঃখের কথা : বাতাসীকে কোনোপক্ষই ফিরিয়ে নিতে রাজি হলো না। না পিতৃপক্ষ, না শ্বশুরবাড়ি। বাতাসী কাঁদতে কাঁদতে এসে আশ্রয় নিল পাঠক-প্যালেসে।
বাতাসীর দুঃখের কাহিনীর পরিণতি সেই গ্রাম্য ছড়াটিতে বিধৃত : ‘সুন্দরীরে বিয়ে দিলেম ডাকাত দলের মেলে।’ ছড়া শেষ হলেও জীবন চলতে থাকে। বিল্ পাঠক একদিন হঠাৎ জানতে পারলেন : ডাকাতদলের বন্দিদশা থেকে যে হতভাগিনীকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছিলেন, সে তার পেট-কোঁচড়ে নিজের অজান্তে নিয়ে এসেছিল একটি অজাত ভ্ৰূণ!
কী কেলেঙ্কারি!
তখনো বিল্ পাঠক বিবাহ করেননি।
বাতাসী আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। দৃঢ়মুষ্টিতে তাকে বাধা দিয়েছিলেন পুরুষসিংহ উইলিয়াম পাঠক। না! বাতাসী আত্মহত্যা করলে তাঁর চরম পরাজয়। উনি পরামর্শ করলেন ওঁর বাল্যবঙ্কুর সঙ্গে। ফ্রেন্ড, ফিলসফার অ্যান্ড গাইড বসন্ত ঘোষের সঙ্গে। বসন্তকুমার নাকি বলেছিলেন—দেবযানী অবশ্য সন্দেহাতীতভাবে জানে না, তবে এটাই গ্রামের সকলের বিশ্বাস : বসন্তকুমার বঙ্কুকে বলেছিলেন, তুমি যদি চাও তাহলে আমি ওই বাতাসীকে হিন্দু ধর্মমতে বিবাহ করতে প্রস্তুত। ওর সন্তানকে আমার সন্তান বলেই পরিচয় দেব আমি।
বিল্ পাঠক স্বীকৃত হননি। তিনি একজন বিহারী পাত্রকে ধরে আনলেন। সে লোকটা স্বীকার করল সামাজিক বিবাহে সে মন্ত্রপাঠ করবে, বরপণটা নগদ গুণে নেবে এবং ফুলশয্যার লোভনীয় আকর্ষণকে দমন করে চিরকালের মতো হাওয়া হয়ে যাবে। বরপণটা সে নিচ্ছে—বাতাসীর অজাত সন্তানকে বৈধতা দান করতে। তাকে একটি পিতৃপরিচয় দিতে। এইমাত্র। ক্যাপ্টেন পাঠক তাকে জনান্তিকে ডেকে বলেছিলেন, নগদ টাকা গুণে নিয়ে তুমি তোমার ছাপড়া জিলার গ্রামে ফিরে যাও। বিয়ে-সাদি করো। ঘর-সংসার পাত। যদি কোনোদিন শুনি তুমি ধর্মপত্নীর সন্ধানে এখানে ঘুরঘুর করছ আমি কিন্তু তোমার মাথার খুলি উড়িয়ে দেব।
লোকটা গরুড়-পক্ষীর মতো জোড়হস্তে মহাবীরজির নামে শপথ করেছিল, য়্যাদ রহেগা, সরকার! ম্যয় কভি নেহি লটুঙ্গা।
সত্যিই সে কোনোদিন ফিরে আসেনি আর। বাতাসীর সন্তান—হিমুর প্রায় সমবয়সী সে—পিতার উপাধিটা পেয়েছিল এভাবে : শরৎকুমার পাণ্ডে।
হিমুর নামটা হেমন্ত—ওই শরতের সঙ্গে মিলিয়ে। শরৎ মানুষ হয়েছে এই পাঠক- কালেই।
তার তথাকথিত পিতৃদেব বোধকরি তাঁর মাথার খুলির মায়ায় আর কোনোদিন এ গ্রামে ফিরে আসেননি।
চার
ভারতীয় সময় বিকাল চারটে সাতাশ মিনিটে পাঠক-প্যালেসের কল- বেল-এ আঙুল ছোঁয়াল কৌশিক। ভিতরে বহুদূরে একটা সুরেলা মিষ্টি গানের রেশ বাজতে শুরু হতেই সদর দরজা গেল খুলে। একজন প্রৌঢ় মতো লোক দ্বারের ওপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। নিচু হয়ে নমস্কার করে বলল, আসুন বাবু, আসুন মাঠান। সাহেব আমারে জানিয়ে রেখেছিলেন, আপনারা সাড়ে চারটের সময় আসপেন। আসুন—এবাগে—এই বোঠকখানা ঘরে।
কৌশিক, দেবযানী আর সুজাতা চওড়া করিডোর পার হয়ে একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। প্রৌঢ় লোকটা দরজা খুলে একপাশে সরে দাঁড়িয়ে দু’হাত চিতিয়ে এমন ভঙ্গি করল যার আক্ষরিক অভিধা : আস্তে আজ্ঞা হোক।
দেবযানী জানতে চাইল, ভাল আছো তো বটুকদা?
—আছি, দিদিমণি। তবে খোকার মায়ের শরীর গতিকটা ভাল যাচ্ছে না।
—কী হয়েছে বৌদির?
–কী যে হয়েছেন তা কেমন করে বুঝব বলুন? কলেরা হলেও সাদাসাদা বড়ি, সাপে কামড়ালেও তাই। এ তল্লাটে কীজাতের চিকিচ্ছে হয় তা তো আপনে ভালই জানেন।
–হাঁটতে চলতে পারে? তাহলে ওকে একবার শ্রীধর জেঠুর কাছে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখিয়ে আনো না? সন্ধ্যাবেলা, সাহেব যখন দাবায় বুঁদ হয়ে থাকেন?
বটুক দু-হাতে নিজের দুই কর্ণমূল স্পর্শ করে বললে, আমার ঘাড়ে একটাই মাতা, দিদিমণি।
তারপর কৌশিকের দিকে ফিরে বললে, সাহেবরা এখনি আসপেন। আমি খপরটা দে- আসি।
—’সাহেবরা’ মানে?—জানতে চায় সুজাতা।
—কাকাবাবুও আজ সকাল-সকাল এসে গেছেন। বসেন আপনেরা-
বটুক ঘর ছেড়ে নিষ্ক্রান্ত হতেই কৌশিক জানতে চায়, কাকাবাবু নিশ্চয়ই সেই মিস্টার ঘোষ, কিন্তু শ্রীধর জেঠুটি কে?
—আদমগড়ের একমাত্র অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তার। বৃদ্ধ। নেভিল দাদুর আমল থেকে এখানে প্র্যাকটিস্ করছেন! বিলকাকু তাঁকে আদমগড় থেকে বিতাড়িত করেননি।
—তা, তাঁকে দিয়েই হেমন্তকে একবার দেখানো যায় না?—ওই তোমার বিলকাকু যখন বসন্তকাকুর সঙ্গে দাবায় বুঁদ হয়ে থাকেন?
দেবযানী হেসে বললে, আমার ঘাড়েও একটাই ‘মাতা’, স্যার।
তখনই ফিরে এল বটুক। বললে, সাহেব ‘টয়লেটে গেছেন, এক্ষুণি এসে পড়বেন।
তারপর একটু ইতস্তত করে কৌশিককে বললে, আপনি…মানে, আমারে চিনতে পারলেন না বাবু? আমারে আপনি একদিন ব্যারিস্টার সাহেবের ঘর থিকে খ্যাদায়ে দেছিলেন, মনে নেই? আমি…ইয়ে, বটুক মণ্ডল…তারাতলার সন্তোষী-মা যখন খাড়া হচ্ছিলেন তখন ওখানে আমার একটা পানের দোকান ছিল।
কৌশিক এতক্ষণে ওকে লক্ষ্য করে দেখে। হ্যাঁ, লোকটাকে তাই প্রথম থেকে চেনা-চেনা লাগছিল। ‘কৌতূহলী কনের কাঁটা’-কেসে আদালতে সাক্ষী দিয়েছিল লোকটা। ওর সাক্ষ্য দেবার আগের দিন বাসু-সাহেবের চেম্বারে এসে মিথ্যে সাক্ষ্য দেবার একটা তির্যক-প্রস্তাব দিতে গিয়ে বাসু-সাহেবের কাছে ধমক খায়। এতক্ষণে সব কথা মনে পড়েছে কৌশিকের। কিন্তু সে-কথা অস্বীকার করে বলে, না! তারাতলার সন্তোষী-মা অ্যাপার্টমেন্টে আমি তো কোনোদিন যাইনি।
—আজ্ঞে না, আপনে যাননি। গেছিলেন তো আপনার মামা, সেই ব্যারিস্টার-সাহেব।
কৌশিককে জবাব দিতে হলো না, কারণ সেই মুহূর্তেই করিডোরে যুগল পদশব্দ শ্রুত হলো। আর তৎক্ষণাৎ বটুক সুরুৎ করে সরে পড়ল। বৈঠকখানায় ঘড়িতে ঢং করে সাড়ে চারটে বাজল।
উইলিয়াম পাঠকের পরনে সাদা পায়জামা, ঊর্ধ্বাঙ্গে একটি সিল্কের গাউন। হাতে চুরুট। শ্যামবর্ণ, কিছুটা খর্বকায়, তবে অত্যন্ত বলিষ্ঠ দেহাবয়ব। দাড়ি কামানো, চোখে বাহারে চশমা, আর নাকের ডগায় একজোড়া মিলিটারি সূচ্যগ্র গোঁফ। ঘরে প্রবেশ করতে করতেই বলছিলেন, গুড আফটারনুন, গুড আফটারনুন, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টেলমেন!
পিছন-পিছন এলেন বসন্তবাবু, তাঁর দীর্ঘ সুগৌর দেহাবয়ব নিয়ে। পরিধানে ধুতি-পাঞ্জাবি। দু-হাতে আধডজন গ্রহবারণ অঙ্গুরীয়। ওঁরা এসে বসেছেন-কি বসেননি চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে হাজির হলো একজন অবগুণ্ঠনবতী। তার পিছন-পিছন আর একজন ভদ্রমহিলা। প্রথমজনের সাজপোশাকে বোঝা যায় যে, সে ভৃত্যশ্রেণীর; কিন্তু পশ্চাৎবর্তিনী আভিজাত্যমণ্ডিত। বয়স আন্দাজ পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ। ইনিও শ্যামবর্ণা, কিছুটা স্থূলকায়া, কিন্তু মুখটি ভারি মিষ্টি। যৌবন এখনো বিদায় নেয়নি তাঁর দেহমন থেকে। সবাইকে সমবেতভাবে যুক্তকরে নমস্কার করলেন। দেবযানী বলে, কেমন আছেন পিসিমা?
বাতাসী-পিসি সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন, তুমি এমন অসময়ে চলে এলো যে? কলেজ-কামাই হবে না?
—না। ছাত্ররা স্ট্রাইক করেছে। শরৎদা কোথায়?
—ও এখন কলকাতায়। গেস্টকিন উইলিয়াম্সে একটি চাকরি পেয়ে গেছে!
—ওমা, তা তো জানতাম না! কবে? ওর টেলিফোন নাম্বারটা দেবেন। কলকাতায় ফিরে যোগাযোগ করব। তাহলে তো আপনার কাছে একটা জব্বর খাওয়া পাওনা হয়েছে—তাই না পিসিমা?
—তা তো হয়েইছে। কাল দুপুরেই সেটা হতে পারে। তাহলে এঁদের দুজনকেও নিয়ে এস। হেডমাস্টার-মশাইকেও। গিরি-পিসিমা তো আমার হাতে খাবেন না—
সুজাতা বলে, এ তো ভারি মজার কথা! আপনার সঙ্গে ভাল করে আলাপ হবার আগেই নেমন্তন্নের অফার?
বসন্ত ঘোষ বলে ওঠেন, এটাই পাঠক-প্যালেসের ট্র্যাডিশান। আদমগড়ে নবাগত কেউ এলেই তার নিমন্ত্রণ হয়। আলাপ-পরিচয়টা হয় আহারের টেবিলে। কী বল বিলু?
উইলিয়াম পাঠক বলেন, আমাকে তো কথা বলার কোনও সুযোগই দিচ্ছ না তোমরা। মধ্যাহ্ন আহার তো পরের কথা, আপাতত কে চা নেবেন, কে কফি, কে চিনি খান আর কার ‘র’-লিকার তাই তো স্থির হয়নি এখনো।
সুজাতার নজর পড়ল টেবিলের দিকে। অবগুণ্ঠনবতী ততক্ষণে কাপ-ডিশ, টী-পট, কফি- পট, দুধ-চিনির পাত্র সাজিয়ে ফেলেছে। ওই সঙ্গে একটা প্লেটে তিন-চার রকমের বিস্কুট আর ফিশ্-ফিঙ্গার। সুজাতা নিজের জন্য এক কাপ চা ঢেলে নিল। কৌশিক বলল, আমারটা র- কফি। অবগুণ্ঠনবতীর বাকিটা জানা ছিল। কর্তামশাই এবং কাকাবাবু চায়ে কে কতটা চিনি নেন তার হিসাব। দেবযানীর দিকে ফিরে ফিসফিস্ করে জানতে চায়, আপনারে কী দেব, দিদিমণি? দেবযানী তার দিকে ফিরে বললে, আমি নিজেরটা বানিয়ে নিচ্ছি, তোমাকে ভাবতে হবে না। কিন্তু কী হয়েছে গো তোমার? বটুকদা বলল, তোমার নাকি অসুখ করেছে। কী অসুখ?
বটুকের স্ত্রী জবাব দেবার সুযোগ পেল না। কারণ তার আগেই কর্নেল বলে ওঠেন, ওই তোমাদের দোষ, দেবি! মানুষের শরীরে নানাজাতের উপসর্গ হয়, তার নিরাময়ের ব্যবস্থা করতে হয়। উপসর্গগুলিকে একত্র করে এক-একটা অ্যালোপ্যাথিক অসুখের তকমা সেঁটে দেওয়া হচ্ছে প্রাচীন চিন্তাধারা। সৌদামিনীর কী জাতীয় উপসর্গ আর তার নিরাময়ের জন্য কত পোটেনশিয়ালের কোন ওষুধ দিয়েছি তা শুনলে কিছু বুঝবে?
কৌশিক প্রসঙ্গটা পরিবর্তন করে জানতে চায়, হেমন্তবাবুকে দেখছি না যে? সে কি বাড়ি নেই?
কর্নেলের স্পষ্টতই ভ্রূকুঞ্চন হলো। কৌশিকের দিকে ফিরে বললেন, হিমুর কথা দেবযানী আপনাদের বলেছে দেখছি। হ্যাঁ, সে বাড়িতেই আছে। তবে তার শরীরটা আজ ভাল নেই। নিজের ঘরে শুয়ে আছে। ঘুমোচ্ছে।…তারপর, এখানে কতদিন থাকছেন? আমার কিউরিও কালেকশান যদি দেখার ইচ্ছে থাকে তাহলে আলো থাকতে থাকতে এখনি উঠে পড়তে হবে। সন্ধ্যার ঝোঁকে প্রায়ই লোডশেডিং হয় আজকাল।
স্পষ্টই বোঝা গেল হিমুর প্রসঙ্গ তিনি আলোচনা করতে অনিচ্ছুক।
চা-পানাত্তে কর্নেল-সাহেব ওদের গোটা বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখালেন।
দ্বিতল প্রাসাদ। সামনের দিকে একসার ডোরিক স্তম্ভ সোজা দোতলা পর্যন্ত উঠে গেছে। তার উপর নানা কারুকার্যখচিত এন্টারেচার। পঙ্খের কাজ করা। দু-প্রান্তে ‘কর্নকোপিয়া’-হাতে দুটি ডানা-মেলা পরী। মার্বেলের নয়, চুনসুরকির কাঠামোতে পঙ্খের কাজ!
একতলায় প্রবেশপথের এক-এক পাশে দুটি করে প্রকাণ্ড হল-কামরা। এখানে বাস করে না কেউ। প্রতিটি ঘরের দরজায় কোলাপসেবল গেটে ভারী তালা। প্রথম কামরাটি বোধহয় সে-কালে নাচঘর ছিল, পরে বিলিয়ার্ড-রুম। ইদানীং সেটি কিউরিও রুম। তার পাশেরটি অস্ত্রাগার। করিডোরের বিপরীতে প্রথম কামরাটি মিউজিয়াম আর তার পাশেরটি চিত্রশালা। বাড়ির বয়স আন্দাজ করা শক্ত। তবে শতখানেকের বেশিই হবে। পিছন দিকে কিছু আউট হাউস। সেখানে দ্বারপাল, ড্রাইভার, ঠাকুর, চাকরদের বাস। এপাশে একটু দূরে, যেটা এককালে অশ্বাবাস ছিল, সেটি ভেঙে ফেলে বানানো হয়েছে মটোর গ্যারেজ। কর্নেল- সায়েবের গাড়িখানা আদমগড়ের সরু রাস্তার তুলনায় নিতান্ত বেমানান : সিডানবডি সেকেলে ব্যুইক। তার পাশেই রাখা আছে হিমুর হিরোহন্ডা। আর শরতের মারুতি সুজুকি।
কর্নেল-সাহেব ওদের প্রথমেই নিয়ে গেলেন অস্ত্রশালায়। দু-আড়াই শত বছরের পুরাতন নানান মারণাস্ত্র সার দিয়ে সাজানো। নবাবী আমলের গাদাবন্দুক থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্টেনগান পর্যন্ত। এই সংগ্রহশালাটি নাকি সযত্নে গড়ে তোলেন ব্রিগেডিয়ার পাঠক। একটি কাচের শো-কেসে রাখা আছে বংশের আদিপুরুষ মেজর অ্যাডসের ব্যক্তিগত তলোয়ারটি। বাঁকা নবাবী তরবারি নয়, ভিক্টোরিয়া-যুগের ‘ড-এজেড স্ট্রেট সোর্ড’। তার মুঠে হাতির দাঁতের কাজ করা। নানান জাতের একনলা, দোনলা বন্দুক, রাইফেলের ভিড়ে সেটিকে রাখা হয়েছে একটা উঁচু পাদপীঠের উপর। তেমনি বিশেষভাবে প্রদর্শিত হয়েছে আর একটি রিভলভার। এটিও মণিমুক্তা খচিত শৌখিন মৃত্যুদূত। কাচের শো-কেসের নিচে পিতলের প্লাক-এ ইংরেজিতে খোদাই করা আছে :
“ক্যাপ্টেন হোরেস কিপ্যাট্রিকের ব্যক্তিগত রিভলভার।”
কৌশিক সুযোগটা ছাড়ল না। জানতে চাইল, আপনাদের আদিপুরুষ ছিলেন ‘অ্যাডাম্স্’ তারপর ‘কিলপ্যাট্রিক’ হলেন কী করে?
কর্নেল জবাব দিলেন না। তাকিয়ে দেখলেন বঙ্কুবর বসন্তের দিকে। বসন্ত বললেন, বিস্তারিত আপনারা জানতে পারবেন হেডমাস্টার-মশাইয়ের কাছে। সংক্ষেপে বলতে পারি : প্রায় শতখানেক বছর ধরে আদি পাত্তনিদার অ্যাডাম্স-সাহেবের বংশপুরুষরা এই আদমগড়ের জমিদার ছিলেন। শুনেছি, পঞ্চম পুরুষের কোনও পুত্রসন্তান ছিল না। তাঁর একমাত্র কন্যা বিবাহ করেছিল ওই ক্যাপ্টেন হোরেস কিপ্যাট্রিককে। সেটা নীলকর সাহেবদের আমল। কিপ্যাট্রিক এখানে নীলের চাষ শুরু করেন। কিন্তু দু-এক পুরুষের মধ্যেই নীল-চাষের ব্যবসায় মন্দা পড়ে যায়। জার্মানিতে ‘সিন্থেটিক নীল’ আবিষ্কৃত হবার পর। ক্লিপ্যাট্রিকদের রবরবা কমে যায়। তাঁরা ধানের জমি কিনে চাষবাসে মন দেন। পরে—অনেক পরে, বিলুর জেঠা রবিন কিপ্যাট্রিক এফিডেফিট করে কিল্প্যাট্রিক থেকে ভারতীয় ‘পাঠক’ উপাধি গ্রহণ করেন। দীনেশবাবু বলতে পারবেন, ‘রবিন-নামটা উনি ‘রবীন্দ্রনাথ’-এর নামের খাতিরে পরিবর্তন করেন কিনা। আর বঙ্কিমচন্দ্রের ভবানী ‘পাঠকের’ উপাধিটা ‘প্যাট্রিকের’ ধ্বনিসাযুজ্যের খাতিরে উনি লেখকের বদলে পাঠক হতে চেয়েছিলেন কিনা।
দ্বিতীয় হল-কামরাটা যাদুঘরের অনুকরণে। সেটাতে নানান জাতের জীবজন্তু, পশুপাখি, পোকা-মাকড়, প্রজাপতি ও সরীসৃপ ‘স্টাফ’ করে সাজানো। কাঠবেড়ালী, বনবিড়াল, হরিণ, বাঘ-পাখির মধ্যে ময়ূর, বেনেবউ, হাঁড়িচাচা, হাড়গিলে, ধনেশ। একটি কাচের শো-কেস কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা দেওয়া ছিল। সুজাতা জানতে চায় : এটায় কী আছে?
কর্নেল হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। ধীর পদে তিনি যাদুঘরের বাইরের করিডোরে গিয়ে দাঁড়ালেন চুরুট ধরাতে। যাদুঘরের ভিতর ধূমপান নিষেধ
বসন্তবাবু নিচু হয়ে কালো কাপড়ের ঢাকাটা সরিয়ে দিলেন।
দেখা গেল : একটা সাপ। কৃত্রিম গুহা থেকে বিঘৎখানেক মাথা বার করে আছে। মাথাটা ত্রিকোণাকৃতি, তাতে একটা সাদা তীরচিহ্ন। ধূসর পাটলবর্ণের দেহাবয়ব। তার কিনার দিয়ে ইংরেজি V-অক্ষরের আলিম্পন। সুজাতা জিজ্ঞেস করল, কী সাপ এটা? ঢাকা দিয়ে রাখা ছিল কেন?
বসন্তবাবু আড়চোখে বঙ্কুবরকে দেখে নিয়ে নিম্নস্বরে বললেন, আজ থেকে তেইশ বছর আগে ওই বিষধর সাপটির দংশনেই গায়ত্রী মারা যায়।
সুজাতা নিজের অজান্তেই প্রশ্ন করে বসে, সর্পদংশনে? কোথায়?
একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল বসন্তবাবুর। বললেন, বিস্তারিত পরে বলব। আসুন, বিল বাইরে অপেক্ষা করছে।
সুজাতা তবু বলে, কী জাত এই সাপটার?
বসন্তবাবু বললেন, বাঙলা নাম ‘বঙ্করাজ’। ইংরেজি নামটা মনে থাকে না। ওই পেতলের প্লাকে লেখা আছে। আসুন—
কৌশিক আগেই নেম্প্লেটটা লক্ষ্য করেছে। স্মরণশক্তির উপর আস্থা না রেখে নোটবুকে চট করে টুকে নিয়েছে, ‘স-স্কেড্ ভাইপার—একিস কারিনাটুস।
করিডোরের ও-পাশে চিত্রশালা। লম্বাটে ঘর। তাতে শুধুই পূর্বপুরুষদের চিত্র। কিছু তৈলচিত্র, কিছু পেন-অ্যান্ড-ইংক, শেষ যুগেরগুলি ফটোগ্রাফ। হলঘরের এক প্রান্তে মেজর অ্যাডামসের একটি তৈলচিত্র। মোটা সোনালী কাজ করা লাক্ষার বর্ডার দিয়ে বাঁধানো। অশ্বারোহী মূর্তি। সামরিক সজ্জায় সজ্জিত। পশ্চাৎপট গাঢ় কালিমায় লিপ্ত, অশ্বটি ফেনশুভ্র। অ্যাডাম্স-এর পরিধানে কোম্পানি আমলের মিলিটারি পোশাক। কোমরবন্ধে ঋজু তরবারি, পিঠে আগ্নেয়াস্ত্র, হাতে একটি বাইনোকুলার।
এই চিত্রের বিপরীত প্রাচীরে প্রলম্বিত আছে ক্যাপ্টেন হোরেস কিপ্যাট্রিকের একটি ‘এচিং’। ইনিও অশ্বারোহী, তবে যুদ্ধের পোশাক নয়, শিকারীর। তাঁর দুপাশে চার-পাঁচটি শিকারী কুকুর। সম্ভবত ‘পয়েন্টার’। এই দুটি বিপরীত চিত্র প্রাচীরে পরস্পরের মুখোমুখি। আকারে চিত্রশালার বৃহত্তম চিত্রত্রয়ীর দুটি। তৃতীয়টি প্রবেশপথের বিপরীতে। এটিও প্রকাণ্ড। ক্যানভাসের উপর তেলরঙে আঁকা। চওড়া কারুকার্যখচিত লাক্ষার উপর সোনালী কাজ করা বর্ডার। অপরূপ সুন্দরী একটি ষোড়শীর আবক্ষ আলেখ্য। আবক্ষ ঠিক নয়, জানুর উপর তার হাত দুটিও আঁকা হয়েছে। বাম তালুর উপর দক্ষিণ করতালটি স্থাপন করে সে শিল্পীর দিকে তাকিয়ে রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসছে। হাসিটা তার ওষ্ঠপ্রান্তে নয়, চোখের কোণে। আশ্চর্য! শিল্পী ল্যুভ-চিত্রশালার সর্ববিখ্যাত বিশ্ববন্দিত আলেখ্যর ভঙ্গিতে মেয়েটিকে ধরেছেন। রহস্যময়ীর আলেখ্যে একটা তারিখ আছে। শিল্পীর স্বাক্ষর নেই কিন্তু।
সকলেই নির্বাক মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ছবিখানির দিকে। বলা শক্ত সে মুগ্ধতার জন্য কতখানি দায়ী যুবতীর ঈশ্বরদত্ত সৌন্দর্য আর কতখানি রূপদক্ষের ঈশ্বরদত্ত বর্ণিকাভঙ্গ। নীরবতা ভঙ্গ করে প্রথম কথা বলল দেবযানী, গায়ত্রী কাকিমা!
সেটা আন্দাজ করা গিয়েছিল প্রথমেই। সুজাতা জানতে চায়, এটা কি ওঁর কুমারী জীবনে আঁকা? নাকি বিবাহের পর?
বসন্তবাবু জবাব দিলেন না। কর্নেল বললেন, এটুকু বলতে পারি আমি কোনও প্রফেশনাল চিত্রকরকে অর্থমূল্যে বিনিয়োগ করিনি।
—তার মানে, এটি ওঁর কুমারী জীবনের পোট্রেট?
—তার মানে কি তাই? আমি বরং একটা প্রতিপশ্ন করি : ছবিতে কিন্তু একজন নয়, দুজন আছে। আপনাদের নজরে পড়ছে?
দুজন? অসম্ভব! গোয়েন্দা-দম্পতি রীতিমতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেও দ্বিতীয় কোনও প্রাণীর সন্ধান পেল না।
স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কর্নেল-সাহেবই রহস্যটা সহাস্যে ভেদ করে দিলেন : গায়ত্রীর এ আলেখ্যটি যখন আঁকা হয় তখন সে ছিল অন্তঃসত্ত্বা। তার দেহের অভ্যন্তরে প্রাণবন্ত হচ্ছিল একটি অজাত ভ্রুণ। মাত্র দু’-মাস বয়স তার : হেমন্ত। শিল্পী তা নিশ্চয় জানতেন না, জানত গায়ত্ৰী নিজে।
সুজাতা বলে, বোধকরি তাই ওঁর মোনালিজা-মার্কা মাতৃত্বের হাসিটি!
কৌশিক প্রতিবাদ করে, আর য়ু শ্যিওর? মোনালিজা হাসিতে শুধু মাতৃত্বের ব্যঞ্জনা? লেঅনার্দো যখন তার ছবি আঁকেন তখন মোনালিজা কিন্তু অন্তঃসত্ত্বা ছিল না।
কর্নেল বলেন, মোনালিজার কথা থাক। গায়ত্রী তাই ছিল। ওর ওষ্ঠপ্রান্তে—না, ওষ্ঠে নয়, চোখের কোণায় যে হাসির আভাস তা হচ্ছে তার আসন্ন মাতৃত্বের।
কৌশিক বলে, এটা এই চিত্রশালার কোনও স্মরণাতীত কালের শিল্পকর্ম নয়। প্রফেশনাল অর অ্যামেচার—শিল্পীর নামটি কী?
কর্নেল বলেন, শিল্পী যে তাঁর নিজের নামটি গোপন রাখতে চান সেকথা সহজেই বোঝা যায়—চিত্রে তাঁর কোনও স্বাক্ষর না থাকায়। এটুকু শুধু জানাতে পারি যে, সৃষ্টির আনন্দেই শিল্পী এই অনবদ্য তৈলচিত্রটি এঁকেছিলেন এবং আরও জানাতে পারি : এই তৈলচিত্রটিই শিল্পীর জীবনে সর্বশেষ শিল্পসৃষ্টির প্রয়াস।
—সর্বশেষ শিল্পসৃষ্টি! তার মানে? এর পরে তিনি আর কোনও ছবি আঁকেননি? কেন? কোনও দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু?
সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বসন্তবাবু আলোচনার যবনিকাপাত ঘটালেন। বঙ্কুর দিকে ফিরে বললেন, বিলু, তুমি একবার দোতলায় যাও! হিমু অনেকক্ষণ একা-একা পড়ে আছে।
এদের দিকে ফিরে বলেন, আসুন আপনারা। আমরা বরং বৈঠকখানা ঘরে গিয়ে বসি।
ওঁরা চিত্রশালা থেকে নির্গত হয়ে করিডোর ধরে এগিয়ে যান। খিদমদ্গারেরা কোল্যাপসি গেটে তালা লাগাতে থাকে। সুজাতা বসন্তবাবুকে প্রশ্ন করে, কৌশিকের প্রশ্নের জবাবটা কিন্তু মুলতুবি আছে—ওই ছবিখানা আঁকার পরেই আকস্মিক দুর্ঘটনায় কি শিল্পীর মৃত্যু হয়েছিল?
বসন্তবাবু একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, হ্যাঁ। শিল্পীর, শিল্পের এবং শিল্পের বিষয়বস্তুর।
সুজাতা জানতে চাইছিল, তার মানেটা কি? কিন্তু সে প্রশ্ন করার আগেই দেবযানী অন্য একটা কথা বলে ওঠে। কর্নেল হনহনিয়ে দ্বিতলে উঠে যাচ্ছিলেন; তাঁর পিছন-পিছন প্রায় দৌড়ে ছুটে গেল দেবযানী। শোনা গেল তার উদ্গ্রীব কণ্ঠস্বর : আঙ্কেল?
সিঁড়ির ল্যান্ডিঙে দাঁড়িয়ে পড়েছেন কর্নেল। দেবযানী তাঁর কাছাকাছি এসে অনুচ্চস্বরে কী যেন অনুমতি চাইল। কথাগুলো শোনা গেল না।
কিন্তু বোঝা গেল। কারণ তারপর ওঁরা দুজন একসঙ্গে দ্বিতলে উঠে গেলেন।