মৃত্যু-বিভীষিকা – ৫০

পঞ্চাশৎ পরিচ্ছেদ

আমি বলিলাম, “তুমি সমস্ত ঘটনাই বেশ ব্যাখ্যা করিয়াছ, কিন্তু একটা কথা—সদানন্দ এখানে আসিলে তাহার সে কুকুরটাকে দেখিত কে?”

গোবিন্দরাম বলিতে লাগিলেন, “আমি এ বিষয়ও বেশ বিবেচনা করিয়াছি, কারণ এটা জানাও নিতান্ত আবশ্যক ছিল, সন্দেহ নাই। ইহা নিশ্চিন্ত যে সদানন্দের একজন কোন না কোন সঙ্গী ও সাহায্যকারী আছে, তবে এটাও নিশ্চয় যে, সদানন্দ কোনমতেই এই লোককে তাহার সমস্ত মতলব জানিতে দেয় নাই; তাহার ন্যায় চালাক লোক সকল কথা কাহাকে জানিতে দিয়া কখনই তাহার হাতে গিয়া পড়িবে না।

“সদানন্দের একজন পুরাতন চাকর ছিল। আমি অনুসন্ধান করিয়া জানিলাম যে, এই লোকটা বহুকাল হইতে সদানন্দের সঙ্গে আছে, বাঁকুড়াতেও সঙ্গে ছিল, খুব সম্ভব সদানন্দ যখন পশ্চিমে থাকিত, তখনও এই চাকর তাহার সঙ্গে ছিল, সদানন্দের তিরোধানের সঙ্গে সঙ্গে সেও নিরুদ্দেশ হইয়াছে। আমার বিশ্বাস, সে সদানন্দের গুপ্ত-আড্ডায় যাইবার পথ জানিত; যখন সদানন্দ বাড়ীতে না আসিত, তখন সে মাঠে গিয়া কুকুরটাকে খাবার দিয়া আসিত। তবে সদানন্দ কুকুরটাকে কি উদ্দেশ্যে এভাবে লুকাইয়া রাখিয়াছে, তাহা সে সম্ভবতঃ জানিত না।

“তাহার পর আমি মণিভূষণের সঙ্গে তোমায় পাঠাইলাম; তোমরা দুইজনে নন্দনপুরের গড়ে উপস্থিত হইলে। তখন আমি কি করিলাম, তাহা বলা আবশ্যক। বোধ হয়, তোমার মনে পড়ে যে, মণিভূষণ যে পত্রখানা পাইয়াছিলেন, তাহা আমি বিশেষরূপে শুকিয়া দেখিয়াছিলাম, তাহাতে এক রকম তেলের গন্ধ পাই, স্ত্রীলোকের মাথার তেলের গন্ধ; সুতরাং বুঝিলাম, পত্রখানা কোন স্ত্রীলোক লিখিয়াছে, কিন্তু এই স্ত্রীলোক কে? আমি নলিনাক্ষবাবুর কাছে সদানন্দ ও তাহার ভগিনীর কথা শুনিয়াছিলাম, সুতরাং এই সময় হইতেই আমার মন তাহাদের দিকে আকৃষ্ট হইয়াছিল; তোমরা রওনা হইবার পূর্ব্বেই আমি কুকুরটার বিষয় স্থির-নিশ্চিত হইয়াছিলাম, আর কে যে চক্রান্ত করিতেছে, তাহাও বেশ সন্দেহ করিয়াছিলাম।

“তখন হইতে আমি এই সদানন্দের উপর দৃষ্টি রাখিতে লাগিলাম। কিন্তু আমি যদি তোমাদের সঙ্গে যাইতাম, তাহা হইলে সে সাবধান হইয়া যাইত; সেজন্য আমি সকলের চোখেই ধূলা দিলাম—এমন কি তোমায়ও কিছু বলিলাম না, আমি গোপনে নন্দনপুরে উপস্থিত হইয়া মাঠের গহ্বরে আড্ডা লইলাম। তুমি মনে করিয়াছিলে যে, ইহাতে আমার বিশেষ কষ্ট হইয়াছিল, তাহা সম্পূর্ণ ঠিক নহে, ছোকরা সঙ্গে ছিল, তাহাকেই দিয়াই আহারাদি সংগ্রহ করিতাম; তবে কষ্ট যে একেবারে হয় নাই, এমন নহে; কিন্তু কষ্টের কথা ভাবিলে কোন অনুসন্ধানই সম্ভব নহে—তাহা হইলে কোন দুর্বৃত্তকেই ধরা যায় না।

“আমি এইরূপে গোপনে সদানন্দের উপর নজর রাখিলাম, ছোকরা তোমার উপরে, মণিভূষণের উপরে নজর রাখিয়া আমাকে সর্ব্বদাই সমস্ত খবর আনিয়া দিত। এইজন্য তোমরা গড়ে বা গড়ের বাহিরে যেখানে যাহা করিতেছিলে, তাহা সমস্তই আমি জানিতে পারিতেছিলাম। ‘তোমাকে তো বলিয়াছি যে, তোমার চিঠী কলিকাতা হইতে ফিরিয়া আমার কাছে যাইত, ছোকরা ডাকঘর হইতে পত্র লইয়া আমাকে দিত, আমি তাহাতে সমস্তই জানিতে পারিতাম, আমারও কাজের খুব সুবিধা হইত। তোমার পত্রে সদানন্দের বিষয় জানিতে পারিয়াই আমি তাহার পূর্ব্ব-ইতিহাস সংগ্রহের জন্য পত্র লিখি। সেই সকল পত্রের উত্তরেই আমি জানিতে পারিয়াছিলাম যে, সে নিজে কোন্ মহাজন—আর মঞ্জরী তাহার ভাগিনী নহে—স্ত্রী; যখন আমি এই সকল ব্যাপার জানিতে পারিলাম, তখন বলা বাহুল্য যে, আমার সন্দেহ তখন বিশ্বাসে পরিণত হইতে লাগিল।

“তাহার পর একটা গোলযোগ ঘটিল। হারু ডাকাত মাঠে আসিল, তাহার পর তাহার সহিত অনুপের সম্বন্ধ প্রভৃতিতে এই ব্যাপার আরও জটিল বলিয়া বোধ হইতে লাগিল; তবে যাহা হউক, তোমরা নিজেরাই হারু ডাকাত ও অনুপ সম্বন্ধে রহস্য ভেদ করিয়া আমাকে পত্ৰ লিখিলে, কিন্তু সে সময়ে আমিও এ বিষয় এইরূপই জানিতে পারিয়াছিলাম, যদি মণিভূষণ ও সদানন্দের ব্যাপারে নিযুক্ত না থাকিতাম, আর হারুকে ধরিবার চেষ্টা পাইতাম, তাহা হইলে তাহাকে অনায়াসে ধরিতে পারিতাম। তোমরা একটু সতর্ক হইলে সে রাত্রে তোমরাও তাহাকে ধরিতে পারিতে।

“যখন তুমি আমায় মাঠে ধরিলে, তখন ব্যাপারটা যে কি তাহা আমি সম্পূর্ণই জানিতে পারিয়াছিলাম, কিন্তু আদালতে লইয়া যাইবার মত প্রমাণ তখনও আমি কিছুই সংগ্রহ করিতে পারি নাই। যে রাত্রে হারু ডাকাতকে ভুল করিয়া মণিভূষণ ভাবিয়া সদানন্দ কুকুরটা ছাড়িয়া দিয়াছিল, আর যাহাতে হতভাগা হারুর মৃত্যু ঘটিল, সে রাত্রের ঘটনাতেও সদানন্দের বিরুদ্ধে কিছু প্রমাণ হইল না, আমরা কেবল কুকুরটার ডাক শুনিয়াছিলাম, কুকুরটাকে দেখিতে পাই নাই, বিশেষতঃ কুকুরটা যে সদানন্দের, তাহারই বা প্রমাণ কি? এই দুর্বৃত্ত এমনই বুদ্ধি বাহির করিয়াছিল যে, তাহার বিরুদ্ধে বিন্দুমাত্র কিছু প্রমাণ করিবার উপায় রাখে নাই। সত্যই বলিতেছি, আমি এরূপ পাষণ্ড-বাহাদুরী আর কখনও দেখি নাই।

“সবই জানিতে পারিয়াছি, জানিয়াছি কুকুরের ভয় দেখাইয়া সদানন্দ রাজা অহিভূষণকে খুন করিয়াছিল, জানিয়াছি যে সেই উপায়ে মণিভূষণকেও খুন করিতে চাহে,—সবই জানিয়াছি, অথচ এই সকল প্রমাণ করি কিরূপে? তাহাকে হাতে নাতে না ধরিতে পারিলে তাহার বিরুদ্ধে কিছুই প্রমাণ করিবার উপায় নাই।

“অন্য উপায় আর কিছুই নাই দেখিয়া আমি শেষ উপায় অবলম্বন করিতে বাধ্য হইলাম, এ কাজ করিতে গেলে কতকটা মণিভূষণকে বিপদে ফেলিতে হয়; কিন্তু অন্য আর কোন উপায় নাই। তাহাই ছল করিয়া তোমাকে সঙ্গে লইয়া আসি, মণিভূষণকে রাত্রে সদানন্দের বাড়ী নিমন্ত্রণে যাইতে অনুরোধ করি, যাহাতে তাহার বিশ্বাস হয় যে, আমরা যথার্থই কলিকাতায় চলিয়া গিয়াছি, সেইজন্য ছোকরাকে দিয়া টেলিগ্রাফ পাঠাই। অক্ষয়বাবুকেও ডাকিয়া পাঠাই।

“আমি জানিতাম, আমরা মণিভূষণের নিকটেই থাকিব। সুতরাং সদানন্দ, তাহার কিছুই করিতে পারিবে না, কিন্তু এরূপ ভয়াবহ কুকুর যে বাহির হইবে, তাহা একবারও মনে হয় নাই। যাহা হউক নলিনাক্ষবাবু বলিয়াছেন যে, মণিভূষণ এখন সম্পূর্ণ সুস্থ হইয়াছেন।

“তবে মঞ্জরীর উপর তাহার যে ঝোঁক হইয়াছিল, সেজন্য এখন যদি কিছু মানসিক কষ্ট হইয়া থাকে, তবে সেজন্য আমি দায়ী নহি।

“এখন মঞ্জরী এই ব্যাপারে কতটা লিপ্ত ছিল, কেবল তাহাই বলিলে সব শেষ হয়। বলা বাহুল্য নানা উৎপীড়ন করিয়া সদানন্দ তাহার স্ত্রীকে দিয়া নানা কাজ করাইত, তাহার ভয়েই সে এমন কি তাহার ভগিনী বলিয়া পরিচয় দিতেও স্বীকার করিয়াছিল। তবে সে সদানন্দের মত ছিল না, তাহার মন ভাল ছিল, সে বাধ্য হইয়া সদানন্দের সাহায্য করিত বটে, কিন্তু সুবিধা পাইলেই তাহার বিরুদ্ধাচারণ করিতে ছাড়িত না। সে মণিভূষণকে কলিকাতায় পত্র লিখিয়া সাবধান করিয়া দিয়াছিল, প্রথম দিন তোমাকে মণিভূষণ ভাবিয়া নিজের বাড়ীর কাছে একবার সাবধান করিয়াছিল!

“সদানন্দ ইচ্ছা করিয়া মঞ্জরীর সহিত মণিভূষণের পরিচয় করিয়া দিয়াছিল; ভাবিয়াছিল, তাহার জন্য মধ্যে মধ্যে মণিভূষণ তাহার বাড়ী আসিবেন, তখন একদিন সুবিধামত তাহার মৃত্যু ঘটাইবে। মঞ্জরী তাহার উদ্দেশ্য বুঝিয়াছিল, তাহাই সে প্রাণপণে মণিভূষণকে রক্ষা করিবার চেষ্টা পাইয়াছিল, এমন কি তাহাকে প্রতিবন্ধক দিবার চেষ্টা পাইল, তাহাই সদানন্দ তাহাকে সে রাত্রে বাঁধিয়া রাখিয়া মণিভূষণকে হত্যা করিবার আয়োজন করিয়াছিল।

“মণিভূষণের মৃত্যু হইলে, তখন সদানন্দ নিজ পরিচয় দিয়া জমিদারী দখল করিত, তাহাকে খুনী বলিয়া কেহই সন্দেহ করিতে পারিত না। এ অবস্থায় সে তখন মঞ্জুরী সম্বন্ধে কি করিত বলা যায় না, যাহাকে ভগিনী বলিয়া পরিচয় দিয়াছে, তাহাকে আবার স্ত্রী বলিয়া কিরূপে পরিচয় দিত বলা যায় না। খুব সম্ভব, সে মঞ্জরীকেও কোন গতিকে হত্যা করিত।

“যাহাই হউক, আমরা মণিভূষণের প্রাণরক্ষা করিতে সক্ষম হইয়াছি। আর একটা দুর্দান্ত ভয়ানক দুরাত্মাকে পৃথিবী হইতে দূর করিয়াছি। ডাক্তার, এ ব্যাপার সম্বন্ধে যতদূর আমার মনে ছিল, আনুপূর্বিক সমস্তই তোমায় বলিলাম, আমি বলিতে পারি না যে, এখনও কোন বিষয়ের ব্যাখ্যা হয় নাই—এমন কিছু আছে কি না যদি থাকে, আমায় জিজ্ঞাসা কর।”

আমি বলিলাম, “অহিভূষণ বৃদ্ধ ছিলেন, তিনি ভূতের ভয় করিতেন, সদানন্দ তাহাই কুকুর ভূতের ভয় দেখাইয়া তাহার মৃত্যু ঘটাইতে সক্ষম হইয়াছিল কিন্তু মণিভূষণ যুবক, সাহসী তাঁহার ভূতের ভয়ে মৃত্যু হইবার সম্ভাবনা ছিল না।”

গোবিন্দরাম বলিলেন, “মৃত্যু না হইলেও—কি হইয়াছিল তাহা দেখিয়াছ, কুকুরটাকে সদানন্দ অনাহারে রাখিয়াছিল, আমরা তাহাকে গুলি না করিলে সে নিশ্চয়ই অজ্ঞান মণিভূষণের ঘাড় ভাঙ্গিয়া রক্তপান করিত। এরূপ হইলেও সদানন্দকে কেহ সন্দেহ করিত না।”

আমি বলিলাম, “এ কথা ঠিক, কিন্তু সে অন্য নাম লইয়া সেখানে বাস করিতেছিল, সে কিরূপে হঠাৎ জমিদারীর দাবী করিত, ইহাতে সকলেই সন্দেহ করিত, হয় তো তাহার পূর্ব্বে তাহার পূর্ব্ব-বৃত্তান্তও সব বাহির হইয়া পড়িত তাহার ন্যায় চালাকচন্দ্র লোক কি এটা ভাবে নাই?”

গোবিন্দরাম বলিলেন, “ডাক্তার, এ সম্বন্ধে সে যে কি ভাবিয়াছিল, ভবিষ্যতে সে যে কি করিত, তাহা বলা বড়ই কঠিন। গত বিষয় ও উপস্থিত বিষয় অনুসন্ধান করাই আমার কাজ, ভবিষ্যতে সে কি করিত বা করিবে, ভবিষ্যতে কি ঘটিবে ইহা বলা সহজ নহে। তবে এ সম্বন্ধেও আমি যে অনুসন্ধান করি নাই, তাহা নহে—আমি এ বিষয় মঞ্জরীকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। সে তাহার স্বামীকে অনেক সময়ে এ বিষয় আলোচনা করিতে শুনিয়াছে। সে বলে সদানন্দ তিন উপায় স্থির করিয়াছিল, প্রথম উপায়, সে পশ্চিমে চলিয়া যাইবে, তাহার পর সেইখান হইতে জামদারীর দাবি করিবে, এ দেশে আদৌ আসিবে না। জমিদারী পাইলে বেচিয়া পশ্চিম হইতেই টাকা লইবে, এখানে একজন উকীলকে মোক্তারনামা দিবে।

“দ্বিতীয় উপায়, সে কলিকাতায় গিয়া ছদ্মবেশে থাকিবে, সেইখান হইতে জমিদারীর দাবি করিবে, তাহার পর জমিদারী পাইলে তাহা সুবিধামত বেচিবে বা একজন ভাল ম্যানেজারের উপর ভার দিয়া অন্য গিয়া থাকিবে।

“তৃতীয় উপায়, সে অন্য একজন লোক খাড়া করিয়া তাহাকে প্রমাণের কাগজপত্র দিয়া তাহাকে দিয়াই জমিদারী দখল করিবে, ভিতরে তাহার সঙ্গে বন্দোবস্ত থাকিবে, তাহাতে সদানন্দই অধিকাংশ টাকা লইবে, ‘তাহাকে কিছু কিছু দিবে।

“যেরূপেই হউক, সে একটা কোন উপায় নিশ্চয়ই বাহির করিত, তাহার মত লোকের পক্ষে একটা উপায় বাহির করা কঠিন হইত না।

“এখন ডাক্তার, আর কিছু জানিবার নাই, এখন এস যাই, দুজনে একটু বেড়াইয়া আসি।”

***