মৃত্যু-বিভীষিকা – ৪০

চত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

ক্ষণপরে আকাশে চাঁদ উঠিল, আমরা দুই জনে সেই উচ্চ স্থানে দাঁড়াইয়া সেই বিস্তৃত উপলবন্ধুর তরঙ্গায়িত তৃণলেশহীন প্রান্তরের চারিদিকে চাহিলাম—সৰ্ব্বত্র শূন্যতা—সৰ্ব্বত্র নিৰ্জ্জনতা—সর্বত্র জ্যোৎস্নালোক ধু ধু করিতেছে। যতদূর দেখা যায়,—কোন দিকে জনমানবের চিহ্ন মাত্র নাই। কেবল দূরে—অতি দূরে, একটী ক্ষুদ্র আলোক মাত্র দেখা যাইতেছিল। আমি বুঝিলাম, সেই আলোটা সদানন্দের বাড়ী হইতে দেখা যাইতেছে।

রাগে আমার সর্ব্বাঙ্গ কাঁপিতে লাগিল, আমি বলিলাম, “এই পাষণ্ডকে কেন এখনই ধরিতেছ না।”

গোবিন্দরাম চিন্তিত ভাবে বলিলেন, “ইহার বিরুদ্ধে সন্দেহ ভিন্ন আমরা এখনও কোন প্রমাণ পাই নাই। লোকটা খুব চালাক ও বুদ্ধিমান, আমরা যাহা জানিতে পারিয়াছি, তাহাতে সে দণ্ড পাইবে না; আমরা তাহার বিরুদ্ধে কি প্রমাণ করিতে পারিব, তাহাই আমাদের দেখিতে হইবে। যদি আমরা সামান্য ভুল করি, তাহা হইলে এই দুর্বৃত্ত আমাদের হাত হইতে পলাইবে।”

“তাহ হইলে আমাদের এখন কি করা উচিত?”

“কাল যথেষ্ট কাজ আছে, আজ উপস্থিত আমাদের এই নূতন বন্ধুর দেহ সম্বন্ধে যাহা কৰ্ত্তব্য, তাহাই করা উচিত।”

তখন আমরা দুই জনে সেই গর্ভের মধ্যে অতি সাবধানে ও কষ্টে নামিলাম, তলদেশ প্রস্তরখণ্ডে পরিপূর্ণ, এই স্থানে পড়িলে কাহারও রক্ষা পাইবার সম্ভাবনা মাত্র ছিল না।

আমরা নিম্নে আসিয়া দেহটাকে সেই অবস্থায় দেখিলাম, যাঁহার সহিত আজ সকালেও কথা কহিয়াছি, তাঁহার এরূপ ভয়াবহ মৃত্যুতে আমার চক্ষু জলে পূর্ণ হইয়া আসিল।

আমি বলিলাম, “আমাদের লোক ডাকা উচিত, আমরা দুই. জনে ইহাকে কিরূপে গড়ে লইয়া যাইব—একি, তুমি কি ক্ষেপিলে?”

আশ্চর্য্য! এই দুঃসময়ে সহসা গোবিন্দরামকে পাগলের মত হাস্যনৃত্যপরায়ণ দেখিলাম। এই কি সেই মহা গম্ভীর গোবিন্দরাম! ব্যাপার কি, কিছুই বুঝিতে না পারিয়া তাঁহার মুখের দিকে অবাঙ্মুখে চাহিয়া রহিলাম।

গেবিন্দরাম বলিয়া উঠিলেন, “দাড়ী—দাড়ী—লোকটার দাড়ী আছে।”

আমিও বিস্ময়ে বলিয়া উঠিলাম, “দাড়ী—দাড়ী?”

“না—না—এ রাজা মণিভূষণ নয়, এ যে দেখিতেছি আমাদের হারু ডাকাত!”

আমি সত্বর দেহটা উল্টাইয়া ফেলিলাম, তখন জ্যোৎস্নার আভায় তাহার মুখ স্পষ্ট দেখিতে পাইলাম,—হাঁ, এ মণিভূষণ নহে, এক দিন এ মুখ দেখিয়াছিলাম, এ সেই হারু ডাকাত, তাহাতে আর কোন সন্দেহ নাই। তবে ইহার পরিধানে মণিভূষণের জামা কাপড় কোথা হইতে আসিল?

পর মুহূর্ত্তে আমার স্মরণ হইল যে, মণিভূষণ তাঁহার কাপড় জামা জুতা অনুপকে রাখিতে দিয়াছিলেন; সে নিশ্চয়ই সেগুলি তাহার শ্যালককে কোন সুযোগে পৌঁছাইয়া দিয়াছিল; ভাবিয়াছিল, ইহাতে তাহার পলাইবার সুবিধা হইবে, কিন্তু সেইগুলিই হতভাগ্য হারুর পক্ষে কালস্বরূপ হইয়া তাহার মৃত্যু ঘটাইল, যাহা হউক, এই দুৰ্দ্দান্ত লোক বাঁচিয়া থাকিলেও কোন না কোন দিন ফাঁসী কাষ্ঠে লম্বিত হইত, কাজেই তাহার মৃত্যুতে দুঃখিত হইবার কারণ নাই। মণিভূষণের যে মৃত্যু হয়. নাই, ইহাতেই আমার সমগ্র হৃদয় আনন্দে পরিপূর্ণ হইয়া গেল। ব্যাপার কি হইয়াছে, আমি গোবিন্দরামকে বলিলাম। শুনিয়া তিনি বলিলেন, “কেবল এই কাপড় আর জামা হতভাগার কাল হইয়াছে। যাহাতে কুকুরটা ঘ্রাণের সাহায্যে মণিভূষণকে আক্রমণ করিতে পারে, সেজন্য তাঁহার কাপড় জামা জুতা কেহ সংগ্রহ করিয়া লইয়াছিল, এবং তাহাই কলিকাতায় তাঁহার একখানা জুতা হারাইয়াছিল—তবে একটা কথা এই, হারু ডাকাতের মত লোক কেমনে জানিল যে, তাহাকে কুকুরে তাড়া করিয়াছে!”

“নিশ্চয়ই সে কুকুরটার ডাক শুনিয়াছিল।”

“কেবল ডাক শুনিয়াই যে তাহার মত লোক ভয়ে আৰ্ত্তনাদ করিবে, তাহা বোধ হয় না। তাহার চীৎকারে বোধ হয়, সে অনেক দূর হইতে কুকুরটার ভয়ে চেঁচাইতে চেঁচাইতে পলাইয়া আসিতেছিল; কিন্তু কথা হইতেছে, অন্ধকারে এ তিপান্তর মাঠে সে কুকুরটাকে দেখিল কিরূপে?”

“আমার মনে হয়—”

গোবিন্দরাম বাধা দিয়া বলিলেন, “আমার উপস্থিত কিছুই মনে হয় না।”

আমি বলিলাম, “কেন কুকুরটা আজ রাত্রেই মাঠে বাহির হইল। নিশ্চয়ই জানিত যে আজ কোন কারণে মণিভূষণ মাঠে বাহির হইবেন।”

গোবিন্দরাম বলিলেন, “ইহার উত্তর শীঘ্রই পাইব, কিন্তু আমি যাহা জানিতে চাই, তাহা হয় ত চিরকাল রহস্যই রহিয়া যাইবে। এখন কথা হইতেছে, এই লোকটার দেহ লইয়া কি করা উচিত। কুকুর শেয়ালের আহারের জন্য অবশ্যই ইহাকে এখানে রাখিয়া যাওয়া উচিত নহে।”

“তোমার সেই গহ্বরের ভিতর ইহাকে রাখিয়া যাই, বোধ হয় আমরা দুই জনে ইহাকে সে পর্যন্ত লইয়া যাইতে পারিব। তাহার পর গিয়া পুলিশে খবর পাঠাইয়া দেওয়া যাইবে।”

“সেই ভাল কথা। আমরা দুই জনে ইহাকে সে পৰ্য্যন্ত লইয়া যাইতে পারিব; তবে ইহাকে এ গৰ্ত্ত হইতে তুলিতে হইলে দড়ী বাঁধিয়া টানিয়া ভুলিতে হইবে; কিন্ত এখন এখানে দড়ী দুর্লভ, দাও ডাক্তার, তোমার উড়ানীখানা দাও।”

তখন গোবিন্দরাম আমার উত্তরীয়খানি লইয়া পাকাইয়া দড়ীর মত করিতে লাগিলেন; এমন সময়ে দূরে সম্মুখের দিকে চাহিয়া গোবিন্দরাম মহা বিস্ময়ে বলিয়া উঠিলেন; “একি—কি দুঃসাহস! লোকটা স্বয়ং এইদিকে আসিতেছে, খুব সাবধান, যেন কোন রকমে জানিতে না পারে যে, আমরা তাহাকে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করিয়াছি।”

আমি বিস্মিত হইয়া দেখিলাম জ্যোৎস্নার মধ্য দিয়া অতি গম্ভীর পাদবিক্ষেপে সদানন্দ— আমরা যেখানে দাঁড়াইয়া আছি, সেইদিকে আসিতেছে। এরূপ দুঃসাহসিক লোক আমি আর কখনও দেখি নাই।

একচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

আমাদের দেখিয়াই সদানন্দ দ্রুতপদে আমাদের নিকটে আসিলেন, বলিলেন, “কে ডাক্তার বাবু, আপনি এত রাত্রে এই মাঠে-এ কি—এ কে? কি হইয়াছে? রাজা মণিভূষণ নাকি?”

তিনি সত্বর মৃতদেহের নিকটে উপস্থিত হইলেন, তাঁহার মুখ হইতে এক অব্যক্ত অস্পষ্ট শব্দ নির্গত হইল, তৎপরে রুদ্ধকণ্ঠে বলিলেন, “এ কে—এ কে?”

আমি বলিলাম, “এ হারু ডাকাত।”

মুহূর্ত্তের জন্য তাঁহার মুখ পাঙ্গাশ বর্ণ হইয়া গেল। তাহার পর তিনি আত্মসংযম করিয়া বলিলেন, “কি ভয়ানক! কিরূপে এমন অবস্থা হইল?”

আমি বলিলাম, “উপর হইতে পড়িয়া গিয়া ইহার ঘাড় ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। আমি আমার এই বন্ধুর সঙ্গে মাঠে বেড়াইতেছিলাম, এই সময়ে তাহার চীৎকার শুনিয়া এইখানে ছুটিয়া আসিয়াছিলাম।”

“আমিও কাহার আৰ্ত্তনাদ শুনিয়াছিলাম, তাহাই দেখিতে আসিলাম। বিশেষতঃ রাজা মণিভূষণের জন্য চিন্তিত হইয়াছিলাম।”

আমি না বলিয়া থাকিতে পারিলাম না, “কেন?”

“আমার বাড়ীতে তাঁহার আসিবার কথা ছিল, না আসায় ভাবিত হইয়া দেখিতে বাহির হইয়াছিলাম। মাঠে এ সময়ে কে চীৎকার করে, তাহাই দেখিতে আসিলাম, ইহার চীৎকার ছাড়া আপনারা আর কোন চীৎকার শুনিতে পাইয়াছেন কি?”

গোবিন্দরাম বলিলেন, “কই না, আপনি কিছু শুনিয়াছেন?”

সদানন্দ সহজে বলিলেন, “আমিও কিছু শুনি নাই।”

গোবিন্দরাম বলিলেন, “তবে ও কথা জিজ্ঞাসা করিবার মানে কি?”

সদানন্দ বলিলেন, “এখানকার সকল লোক এক কুকুর ভূতের কথা বলে, বলে নাকি রাত্রে তাহার ডাক মাঠে শোনা যায়, তাহাই জিজ্ঞাসা করিতেছিলাম, যদি আপনারা সেরূপ কোন শব্দ শুনিতে পাইয়া থাকেন।”

গোবিন্দরাম বলিলেন, “কই না-আমরা কিছু শুনিতে পাই নাই।”

সদানন্দ বলিলেন, “এ বেচারা এরূপে মরিল কি রকমে? এ সম্বন্ধে আপনারা কি মনে করেন?”

গোবিন্দরাম বলিলেন, “ভয়ে, ভাবনায়, অনাহারে কষ্টে পাগল হইয়া মাঠে ছুটিয়া বেড়াইতেছিল, তাহার পর এই গাড়ায় পড়িয়া মারা গিয়াছে।”

সদানন্দ বলিলেন, “তাহাই সম্ভব—গোবিন্দরামবাবু যখন বলিতেছেন, তখন তাহাই নিশ্চয়।”

গোবিন্দরাম মৃদু হাসিয়া বলিলেন, “আপনার লোক চিনিবার ক্ষমতা খুব আছে দেখিতেছি।”

সদানন্দ হাসিয়া বলিলেন, “ডাক্তারবাবু যখন এখানে আসিয়াছেন, তখন আমরা সকলেই জানি, আপনি শীঘ্রই এখানে আসিবেন। আসিয়াই একটা লোমহর্ষণ মৃত্যু দেখিলেন।”

গো। নিশ্চয়ই-প্রথমে এখানে আসিয়াই একটা মৃত্যু দেখিতে হইল। কাল সকালেই এখান হইতে ফিরিয়া যাইতেছি, সুতরাং এই হতভাগ্যের মৃত্যু সম্বন্ধে আর কোন কথারই জানিবার সুবিধা হইবে না।

স। কালই ফিরিয়া যাইতেছেন?

গো। হাঁ—এই রকম ত ইচ্ছা আছে।

স। আমরা সকলে যে রহস্যভেদ করিতে পারিতেছি না, আশা করি, আপনি এখানে আসিয়া তাহার কিছু গূঢ় মৰ্ম্ম জানিতে পারিয়াছেন।

গোবিন্দরাম বিষণ্ণ ভাবে ঘাড় নাড়িলেন, বলিলেন, “সব সময়ে কৃতকাৰ্য্য হওয়া সম্ভব নহে।”

সদানন্দ আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “এই মৃতদেহটা আমার বাড়ী লইয়া যাইতে পারিতাম। কিন্তু আমার ভগিনী দেখিলেই ভয়ে মূৰ্চ্ছা যাইবে, বোধ হয় উপস্থিত ইহাকে ঢাকিয়া রাখিয়া গেলে আর শেয়াল-কুকুরে খাইবে না।”

অগত্যা আমরা এই হতভাগ্যের দেহ ঢাকিয়া, একটা গর্ভের মধ্যে রাখিয়া গড়ের দিকে চলিলাম। সদানন্দ তাঁহার বাড়ী গিয়া পান তামাক খাইয়া যাইবার জন্য বিশেষ অনুরোধ করিলেন, কিন্তু আমরা তাঁহার হাত এড়াইয়া আসিলাম।

কিয়দ্দূর আসিয়া গোবিন্দরাম বলিলেন, “আমরা এখন সম্পূর্ণ হাতাহাতি লড়াইতে নিযুক্ত হইয়াছি। লোকটার কি সাহস, কি ক্ষমতা। ভুলক্রমে আর একজন খুন হইয়াছে, দেখিয়াও কেমন আত্মসংযম করিল। তোমায় ডাক্তার আগেও বলিয়াছিলাম, এখনও বলি, লোকটা মহা ক্ষমতাপন্ন।”

“তা হউক কিন্তু লোকটা তোমাকে দেখিয়া ফেলিল। না দেখাই ভাল ছিল।”

“আমারও তাহাই ইচ্ছা ছিল, কিন্তু এখন আর উপায় নাই।”

“তুমি এখানে উপস্থিত হইয়াছ দেখিয়া, এখন সে কি করিবে, মনে কর?”

“দুই হওয়া সম্ভব, এক খুব সাবধান হইয়া যাইবে, দ্বিতীয় যাহা করিবে স্থির করিয়াছে, তাহাতে আর তিলার্দ্ধ বিলম্ব করিবে না। অনেক বুদ্ধিমান্ বদমাইস্ যাহা করে, সে-ও তাহাই করিতে পারে। কি কিছু সন্দেহ করে নাই, তাহার গভীর গূঢ় মতলব কেহ বুঝিতে পারে নাই ভাবিয়া নিঃসন্দিগ্ধভাবে কাজ করিতে থাকিবে।”

“এখনই ইহাকে গ্রেপ্তার করিতেছ না কেন?”

“কতবার বলিব বল। ইহার বিরুদ্ধে প্রমাণ কোথায়, প্রমাণ না পাইলে কে ইহার কি করিতে পারিবে। যতক্ষণ আমরা ইহার এই কুকুরকে টানিয়া বাহির করিতে পারিতেছি না, ততক্ষণ ইহার কিছু করার সম্ভাবনাই আমাদের নাই।”

“কিছু প্রমাণ আছে?”

“কিছু মাত্র না; কেবল অনুভব, অনুমান, সন্দেহ। এই কথা লইয়া আদালতে গেলে, লোকে হাসিবে মাত্র।”

“রাজা অহিভূষণের মৃত্যু ত আছে।”

“তাহার মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল এইমাত্র, দেহে কোন আঘাতের চিহ্ন ছিল না, তাহার হৃদ্রোগে মৃত্যু হইয়াছিল, তবে আমরা জানি, ভয়েই, তাঁহার মৃত্যু ঘটিয়াছিল, আর সেই ভয়, তিনি কেন পাইয়াছিলেন, তাহাও আমরা জানি, কিন্তু ভৌতিক কুকুরের কথা কেহ কি বিশ্বাস করিবে? আমরা যাহা জানি বা জানিতে পারিয়াছি, তাহা আমাদের প্রমাণ করিতে হইবে, নতুবা আমরা এই লোকের কি করিতে পারি?”

“এই মাত্র যাহা জানিলাম?”

“তাহাতেই বা কি প্রমাণ হইতেছে, কুকুরের ভয়ে লোকটা দিগ্বিদিক্ জ্ঞানশূন্য হইয়া ছুটিয়া গর্ভে পড়িয়া যে মারা গিয়াছে, তাহার প্রমাণ কি? উপস্থিত এই লোকের বিরুদ্ধে আমরা কোনই প্রমাণ পাই নাই, সুতরাং আরও দুই চারিদিন ধৈর্য্যাবলম্বন করিয়া থাকিতে হইবে।”

“তবে কি করিতে চাও?”

“নবদুর্গার দ্বারা অনেক সাহায্য হইবে, এ আশা আমার আছে। যাক—এই পৰ্য্যন্ত আজ থাক, পরে এ সম্বন্ধে আলোচনা করা যাইবে।”

যতক্ষণ তিনি গড়ের দ্বার পর্য্যন্ত না আসিলেন, ততক্ষণ আর একটি কথাও কহিলেন না, চিন্তিত ভাবে নীরবে চলিলেন। গড়ের দ্বারে আসিলে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “গড়ে আসিতেছ ত?”

গোবিন্দরাম বলিলেন, “হাঁ, অজ্ঞাতবাসে লাভ নাই—চল। এই কুকুরের কথা মণিভূষণকে বলিও না, সে পাগল হইয়া গাড়ায় পড়িয়া মরিয়াছে, তাহাই এখন সকলে জানুক। কাল রাত্রিতে সদানন্দের বাড়ী মণিভূষণের নিমন্ত্রণ আছে, তাহার জীবনের কাল ঘোর সমস্যা,

“আমারও নিমন্ত্রণ আছে।”

“তাহা হইলে কোন ছুতা করিয়া তোমায় তাহার বাড়ী যাওয়া বন্ধ করিতে হইবে। এখন চল, মণিভূষণের সঙ্গে দেখা করা যাক।”

দ্বিচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

গোবিন্দরামকে দেখিয়া মণিভূষণ বিশেষ আনন্দিত হইলে, তাঁহাকে অতি সমাদরে আহ্বান করিয়া লইলেন, তবে তাঁহার সঙ্গে কোন মাল-পত্র নাই দেখিয়া বিস্মিত হইলেন।

হারু ডাকাতের মৃত্যুর কথা শুনিয়া তিনি বলিলেন, “একটা পাপ বিদায় হইল।”

কিন্তু তাহার মৃত্যুর কথা শুনিয়া সুমঙ্গলা অজস্র চক্ষের জল ফেলিতে লাগিল।

আহারাদির পর আমরা তিনজনে বসিয়া ধূমপান আরম্ভ করিলাম, মণিভূষণ বলিলেন, “ডাক্তার, অঙ্গীকার করিয়াছিলাম, তাহাই একলা বাড়ীর বাহির হই নাই, না হইলে আজ সন্ধ্যার সময় সদানন্দবাবু তাঁহার বাড়ী যাইবার জন্য অনুরোধ করিয়া পাঠাইয়াছিলেন। এখানে একলা বসিয়া প্রাণান্ত হইতেছিলাম।”

গোবিন্দরাম সে কথায় কান না দিয়া বলিলেন, “আর আমারও প্রাণান্ত হইয়াছে, ভাবিয়া তখন অপর এক নির্জ্জন স্থানে আমরা দুই জনে অত্যন্ত দুঃখ প্রকাশ করিতেছিলাম।”

মণিভূষণ বিস্মিতভাবে গোবিন্দরামের মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “সে কি?”

গোবিন্দ। এই হতভাগার গায় আপনার জামা কাপড় ছিল। আপনার চাকর নিশ্চয় তাহাকে এই কাপড় জামা দিয়াছিল, তাহাকে লইয়া পুলিস টানাটানি করিতে পারে।

মণি। কিরূপে জানিবে আমার কাপড়—কোন দাগ নাই।

গো। তাহা হইলে ভাল, কারণ আপনারা সকলেই এ ব্যাপারে আইন বিরুদ্ধ কাজ করিয়াছেন।

তৎপরে হাসিয়া বলিলেন, “ডিটেটিভ হিসাবে আপনাদের সকলকেই আমার এখনই গ্রেপ্তার করা উচিত।”

মণিভূষণ হাসিয়া বলিলেন, “তাহা অবশ্যই আপনি পারেন, তাহার পর আমাদের পারিবারিক রহস্য সম্বন্ধে কতদূর কি করিলেন। এখানে আসিয়া আমি বা ডাক্তার যে নূতন কিছু জানিতে পারিয়াছি, তাহা বলিয়া বোধ হইল না।”

গো। বোধ হয়, শীঘ্রই রহস্য ভেদ করিতে পারিব। ব্যাপারটা অতি কঠিন, কতক বিষয় কিছু কিছু জানিতে পারিয়াছি, কিন্তু অনেক বিষয়েই এখনও অন্ধকারে রহিয়াছি।

ম। বোধ করি, ডাক্তারের কাছে শুনিয়াছেন যে, আমরা একদিন এই কুকুরের ডাক শুনিতে পাইয়াছিলাম, তাহাতে আশঙ্কা হয় যে, এ ব্যাপারে সমস্তই মিথ্যা নহে, ঐ কুকুরটাকে ধরিয়া শিক্‌লি লাগাইতে পারিলে আপনি যথার্থই পৃথিবীর মধ্যে সর্ব্বাপেক্ষা বড় ডিটেক্‌টিভ হইবেন।

গো। কোন ভয়, নাই, আপনার সাহায্য পাইলে আমি উহাকে শীঘ্রই শিক্‌লিতে বাঁধিতে পারিবে।

ম। আমি সৰ্ব্বদাই আপনাকে সাহায্য করিতে প্রস্তুত আছি।

গো। বেশ ভাল, তবে উপস্থিত এখন কোন কারণ জিজ্ঞাসা করিতে পারিবেন না।

ম। আপনি যেমন বলিবেন, তাহাই করিব।

গো। তাহা হইলে শীঘ্রই এ রহস্যের একটা মীমাংসা হইয়া যাইবে—তবে আমার— সহসা তিনি একদৃষ্টে গৃহ-প্রাচীরের দিকে চাহিয়া রহিলেন, সহসা যেন তাঁহার দেহ পাষাণে পরিণত হইল, আমরা উভয়েই বিস্মিতভাবে বলিয়া উঠিলাম, “ব্যাপার কি?”

প্রাচীরে কয়েকখানা পুরাতন বড় ছবি ঝুলিতেছিল, তিনি তাহা দেখাইয়া দিয়া বলিলেন, “ছবি আমি বড় ভালবাসি, ডাক্তার তাহা জানে—ছবিগুলি বেশ।”

মণিভূষণ বলিলেন, “ছবি-টবি দেখিবার সুবিধা হয় নাই, এ সব আমার জন কয়েক পূর্ব্ব-পুরুষের ছবি, বহুকাল হইতে এইরূপে ঝুলিতেছে।”

গো। ইহারা কে—ইহাদের কাহার কি নাম জানেন?

কে কোন্‌টী তাহা অনুপ আমাকে বলিয়াছে।

গোবিন্দরাম একখানি ছবি দেখাইয়া দিয়া বলিলেন, “এখানি কাহার ছবি?”

“ও—ইহার বিষয় আপনার জানিবার অধিকার আছে, ইনি সেই গল্পের কুকুরের কর্তা; ইহাকে আমাদের ভুলিবার সম্ভাবনা নাই।”

আমি বিস্মিতভাবে ছবিখানির দিকে চাহিয়া রহিলাম।

গোবিন্দরাম বলিলেন, “কি আশ্চৰ্য্য। দেখিলে ইঁহাকে খুব ভাল মানুষ বলিয়া বোধ হয়, তবে চক্ষের ভাব বড় ভাল নয়। আমার বিশ্বাস ছিল যে, ইনি খুব বলবান ও দুর্দান্ত!”

গোবিন্দরাম আর কিছু বলিলেন না, তবে আমি দেখিলাম, তিনি অন্যান্য কথা বলিবার মধ্যে মধ্যে এই ছবির দিকে চাহিয়াছিলেন। ক্রমে রাত্রি অধিক হইলে মণিভূষণ শয়ন করিতে গেলেন, তখন আমি বুঝিলাম যে, গোবিন্দরাম এই ছবিখানি কেন এই ভাবে দেখিতেছিলেন।

ত্রিচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

মণিভূষণ চলিয়া যাইবার পর গোবিন্দরাম ছবিখানি আমায় দেখাইয়া বলিলেন, “ডাক্তার, ইহাতে কোন বিশেষত্ব দেখিতে পাও?”

আমি এই কথায় ছবিখানি আবার ভাল করিয়া দেখিতে লাগিলাম, কই, এমন কি বিশেষত্ব ইহাতে আছে, বরং ছবি দেখিলে লোকটী খুব ভাল মানুষই বোধ হয়। এই লোক হইতে যে এরূপ ভয়ানক কান্ড হইয়াছে, তাহা ছবি দেখিলে বুঝিতে পারা যায় না।

আমি বহুক্ষণ ছবিখানি বিশেষ করিয়া দেখিয়া বলিলাম, কই,—তেমন কিছু বিশেষত্ব তো দেখিতে পাইতেছি না।

তিনি বলিলেন, “ইহার সহিত কাহারও আকৃতির কিছু সাদৃশ্য আছে, এমন বোধ হয়?”

“কই, বিশেষ কিছু এমন দেখিতেছি না।”

“আরও ভাল করিয়া দেখ,—মুখের নীচের দিকটা খুব ভাল করিয়া দেখ।”

আমি তাঁহার কথামত আবার ছবিখানি বিশেষ করিয়া দেখিলাম,—সহসা আমি বিস্মিতস্বরে বলিয়া উঠিলাম, “সত্যই তো—তাহাই তো।

তখন আমি স্পষ্ট সদানন্দের মুখ সেই ছবিতে দেখিতে পাইলাম। গোবিন্দরাম বলিলেন, “এখন তাহা হইলে তুমি দেখিতে পাইতেছ? আমি প্রথমেই ইহা লক্ষ্য করিয়াছিলাম। যে ডিটেক্‌টিভ হইতে চাহে, তাহার বিভিন্ন মুখের বিভিন্নতা লক্ষ্য করিতে শিক্ষা করা প্রথম আবশ্যক।

“কি আশ্চৰ্য্য! এখন দেখিতেছি, এখানা ঠিক যেন সদানন্দের ছবি।”

“হাঁ—ইহাতেই পুনর্জন্ম বিশ্বাস হয়। ইহাতে বোধ হয়, বহু বৎসর পরে এই লোক সদানন্দ হইয়া জন্ম লইয়াছে। অন্য কিছু না হউক, এখন নিশ্চিত জানা গেল যে, সদানন্দেরও এই রাজবংশে জন্ম।”

“তাহাই জমিদারী পাইবার জন্য এই সকল ভয়ানক কান্ড করিতেছে।”

“নিশ্চিত,—এই ছবি দ্বারাই তাহার মতলব জানা গেল,—এত দিন পরে আমরা তাহার উদ্দেশ্য খুঁজিয়া পাইলাম। এখন আর সে যায় কোথায়?”

এই বলিয়া গোবিন্দরাম হাসিতে লাগিলেন, বলিলেন, “শঠে শাঠ্যং—এই চির নিয়ম।”

*****

আমি পরদিন প্রাতে অতি প্রত্যূষে জাগরিত হইলাম। জাগিয়া দেখিলাম, আমার আগেই গোবিন্দরাম উঠিয়াছেন। আমায় দেখিয়াই তিনি বলিলেন, “আজ সমস্ত দিন অনেক কাজ আছে, জাল ঠিক ফেলা হইয়াছে, এখন কেবল ঠিক করিয়া টানিয়া তুলিতে পারিলেই হয়। আজ রাত্রি গত হইবার পূর্ব্বেই জানিতে পারিব যে, আমাদের জালে কালা পড়িয়াছে, না জাল ছিঁড়িয়া পালাইয়াছে।

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “ইহার মধ্যে কি মাঠে বেড়াইতে গিয়াছিলে?”

“হাঁ, পুলিসে হারুর বিষয় খবর দিয়াছি, সে বিষয়ে আর কোন গোল হইবে না; আর আমার ছোকরাকেও খবর দিয়া আসিয়াছি, না হইলে সে আমার জন্য ভাবিত।”

“এখন কি করিবে মনে করিতেছ?”

“প্রথমে মণিভূষণের সঙ্গে দেখা করা আবশ্যক। এই যে তিনিই আসিতেছেন।”

মণিভূষণ নিকটে আসিয়া হাসিয়া বলিলেন, গোবিন্দরামবাবু, আপনাকে দেখিলে বোধ হয়, যেন কোন সেনাপতি যুদ্ধের বন্দোবস্ত করিতেছেন।”

গোবিন্দ। কতকটা ঠিক তাহাই—ডাক্তার হুকুম চাহিতেছে।

মনি। আমিও তাহাই।

গো। না—আমাকে ও ডাক্তারকে এখনই কলিকাতায় রওনা হইতে হইবে। ম। বলেন কি?

গো। বিশেষ কাজ আছে।

মণিভূষণের মুখ বিষণ্ণ হইল, তিনি দুঃখিত ভাবে বলিলেন, “আমার আশা ছিল, আপনারা আমাকে এই গোল হইতে নিষ্কৃতি দিয়া কলিকাতায় যাইবেন। বুঝিতেই ত পারিতেছেন, এখানে একা থাকা বড় সুখের নহে।”

গো। আপনি আমার উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করিবেন বলিয়া অঙ্গীকার করিয়াছেন, সুতরাং আমার উপর নির্ভর করুন, আমি যাহা বলি, তাহাই করুন। জানিবেন, আমি যাহা করিতেছি, আপনার ভালর জন্যই করিতেছি। সদানন্দবাবুকে বলিবেন যে, আমরা দুইজনে বিশেষ কাজে বাধ্য হইয়া কলিকাতায় যাইতেছি, এ কথাটা তাঁহাকে বলিতে কিছুতেই ভুলিবেন না।

ম। আপনি যদি বলেন—তো অবশ্যই বলিব।

গো। হাঁ—আমার বিশেষ অনুরোধ।

ম। তাহা হইলে আপনাদের যাইতেই হইবে?

গো। উপায় নাই।

মণিভূষণের মুখ বিষণ্ণ হইল, তিনি বলিলেন, “কখন তাহা হইলে যাইবেন মনে করিতেছেন?”

গো। এই যত শীঘ্র হয়,—তবে ডাক্তার যে শীঘ্রই ফিরিয়া আসিবেন, তাহার প্রমাণ স্বরূপ তাঁহার সমস্ত জিনিষ পত্র এখানে থাকিল।

তাহার পর তিনি আমার দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “ডাক্তার, তোমারও নিমন্ত্রণ ছিল না?” আমি বলিলাম, “হাঁ—ছিল, কিন্তু যাইতে পারিতেছি কই?”

গোবিন্দরাম বলিলেন, “তাহা হইলে এক কাজ কর—এখনই তাঁহাকে একখানা পত্র লিখ।”

আমি বলিলাম, “যখন তুমি বলিতেছ, তখন এখনই তাঁহাকে পত্র লিখিতেছি।”

মণিভূষণ বলিলেন, “আমারও ইচ্ছা হইতেছে, আপনাদের সঙ্গে কলিকাতায় যাই, এই ভয়ানক স্থানে একা থাকিয়া লাভ কি?

গোবিন্দরাম বলিলেন, “আপনার এখানে থাকা কর্ত্তব্য—আরও কথা হইতেছে, আপনি অঙ্গীকার করিয়াছেন যে, আমি আপনাকে যাহা করিতে বলিব, আপনি বিনা বাক্যব্যয়ে তাহা করিবেন। আমি আপনাকে এখানে থাকিতে বলিতেছি।”

মণিভূষণ হতাশভাবে বলিলেন, “তাহা হইলে কাজেই থাকিব।”

গো। আরও একটা কথা-রাত্রে আপনি হাঁটিয়া বাড়ী ফিরিবেন।

ম। অত রাত্রে মাঠ দিয়া?

গো। হাঁ—প্রয়োজন আছে।

ম। আপনিই ইহা কতবার নিষেধ করিয়াছেন।

গো। হাঁ—কিন্তু এবারে আপনার কোন ভয় নাই—আমার বিশ্বাস আপনার সাহসের কোন অভাব নাই, তবুও নিতান্ত প্রয়োজন না হইলে এ অনুরোধ করিতাম না।

ম। কাজেই তাহাই হইবে।

গো। আরও এক কথা,—দেখিবেন, কোন মতে সোজা পথ ছাড়িয়া অন্য পথে যাইবেন না।

ম। আপনি যাহা বলিতেছেন—ঠিক তাহাই করিব।

গো। এখন এই পর্য্যন্ত,—এখন আমরা রওনা হই।

চতুশ্চত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

আমি গোবিন্দরামের উদ্দেশ্য কিছুই বুঝিতে না পারিয়া অতিশয় বিস্মিত হইলাম। আমার মনে পড়িল, গোবিন্দরাম গত রাত্রে একবার সদানন্দকে বলিয়াছিলেন যে, তিনি কালই কলিকাতায় ফিরিবেন, কিন্তু তিনি আমাকেও যে সঙ্গে লইবেন, তাহা আমার মনে হয় নাই। তিনি নিজেই বলিতেছেন যে, মণিভূষণের ঘোরতর সঙ্কটকাল উপস্থিত, অথচ তাঁহাকে একা ফেলিয়া, আমাকে পর্যন্ত সঙ্গে লইয়া এরূপভাবে কলিকাতায় ফিরিতেছেন কেন, তাহা আমি কিছুই বুঝিতে পারিলাম না, তবে তাঁহার স্বভাব আমি জানিতাম, তাঁহার কথায় আপত্তি করা বৃথা, কাজেই আমরা দুইজনে বিষণ্ণ মণিভূষণকে রাখিয়া তাঁহারই গাড়ীতে রেল ষ্টেশনের দিকে চলিলাম।

ষ্টেশনে আসিলে এক ছোকরা আসিয়া বলিল, “কোন্ হুকুম?”

“হাঁ—এই গাড়ীতে পরের ষ্টেশন গিয়া রাজা মণিভূষণকে এই টেলিগ্রাফখান পাঠাইয়া দিয়া আবার এখানে ফিরিয়া আসিবে।”

টেলিগ্রাফে গোবিন্দরাম লিখিয়াছেন, “আমার জরুরি পকেট বই ফেলিয়া আসিয়াছি। শীঘ্র ডাকে কলিকাতায় পাঠাইবেন।”

তিনি তখন মণিভূষণের গাড়ী বিদায় করিয়া দিলেন, ষ্টেশনের টেলিগ্রাফ আফিসে গিয়া তাঁহার নামে কোন তার আছে কি না অনুসন্ধান করিলে, তার বাবু একখানি টেলিগ্রাফ তাঁহাকে দিলেন। তিনি তাহা পাঠ করিয়া আমাকে দিলেন, আমি পড়িলাম,—”তার পাইয়াছি। এই গাড়ীতে রওনা হইলাম। নাম শূন্য ওয়ারেন্ট সঙ্গে লইয়াছি। ডিটেকটিভ ইনস্পেক্টর—অক্ষয়।”

গোবিন্দরাম বলিলেন, “অক্ষয়বাবুর সাহায্য এক্ষণে আমাদের দরকার হইয়াছে, তাঁহার আসিবার এখনও বিলম্ব আছে, এখান হইতে দেবগ্রাম বেশীদূর নয়, চল একখানা গাড়ী করিয়া গিয়া তোমার নবদুর্গার সঙ্গে দেখা করিয়া আসা যাক্।”

তাঁহার উদ্দেশ্য এখন আমি অনেকটা বুঝিলাম। তিনি মণিভূষণকে দিয়া সদানন্দের ধ্রুব বিশ্বাস জন্মাইবেন যে, আমরা দুইজন প্রকৃতই কলিকাতায় চলিয়া গিয়াছি। ছোকরা যে টেলিগ্রাফ পাঠাইবে, তাহার কথা মণিভূষণের নিকট শুনিলে সদানন্দের এ সম্বন্ধে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকিবে না। তাহার পর তিনি একটা কৌশল বিস্তার করিতেছেন, তাহা এতক্ষণে আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম।

নবদুর্গার সহিত দেখা করিতে বিশেষ কষ্ট পাইতে হইল না, সে পূর্ব্বের ন্যায় ঘোমটায় কতক মুখ ঢাকিয়া আমাদের সম্মুখে দাঁড়াইল। গোবিন্দরাম অতি মিষ্টস্বরে বলিলেন, “আমরা মৃত রাজা অহিভূষণের মৃত্যু সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিতেছি। আমার এই বন্ধুটীকে তুমি মৃত রাজার বিষয় যতদূর যাহা বলিয়াছ, ইনি তাহা সমস্তই আমাকে বলিয়াছেন, আর যাহা বল নাই, তাহাও বলিয়াছেন।”

নবদুর্গা বলিল, “আমি এমন কিছু বলি নাই।”

গোবিন্দ। তুমি স্বীকার করিয়াছ যে, তুমি রাত্রি দশটার সময় গড়ের সাঁকোর নিকট তাঁহাকে তোমার সঙ্গে দেখা করিতে পত্র লিখিয়াছিলে, আর ঠিক সেই সময়ে সেইখানে তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে, ইহার কারণ কি তুমি বল নাই।

নব। ইহার কারণ আমি কিছুই জানি না।

গো। কারণ বিশেষ আছে, দেখ বাছা, তোমার কাছে আমি কিছু গোপন করিতে ইচ্ছা করি না, আমাদের বিশ্বাস, রাজা খুন হইয়াছেন ইহার জন্য তুমি ও তোমার বন্ধু সদানন্দবাবু ও তাঁহার স্ত্রী তিনজনেই বিপদে পড়িতে পারেন।

ন। সদানন্দবাবুর স্ত্রী?

গো। হাঁ—ইহা এখন আর গোপন নাই। তিনি যাহাকে নিজের ভগ্নী বলিয়া পরিচয় দেন— সে স্ত্রীলোকটী তাঁহার স্ত্রী।

নবদুর্গা কিয়ৎক্ষণ কথা কহিল না, কেবল অর্দ্ধস্ফুটস্বরে দুই তিনবার বলিল, “মিথ্যা কথা–মিথ্যা কথা,—সে আমাকেই—”

গোবিন্দরাম বলিলেন, “মিথ্যা কথা নহে,—সম্পূর্ণ সত্য কথা—”  

এই বলিয়া সদানন্দর পূর্ব্ব ইতিহাস সমস্তই তাহাকে বলিলেন,—নবদুর্গা একটী কথাও বলিল না, নীরবে শুনিয়া গেল।

গোবিন্দরাম বলিলেন, “এখন এই লোকের চরিত্র বুঝিতে পারিলে? ইহার সঙ্গে জড়িত থাকিলে বিপদে পড়িবে, যাহা জিজ্ঞাসা করি, সমস্ত সত্য বলিলে বিপদের আশঙ্কা নাই।”

“কি জিজ্ঞাসা করিবেন, করুন।

“রাজাকে তুমি সদানন্দের পরামর্শে পত্র লিখিয়াছিলে?”

“হাঁ—তিনি যাহা লিখিতে বলিয়াছিলেন, তাহাই লিখিয়াছিলাম।

“সদানন্দ তোমাকে বলিয়াছিল যে, দেখা করিলে রাজা তোমাকে সাহায্য করিবেন?”

“হাঁ—তখন আমি বড় কষ্টে পড়িয়াছিলাম।”

“পত্র লেখার পর সেই তোমাকে রাজার নিকট যাইতে নিষেধ করে?”

“হাঁ-তিনি বলিয়াছিলেন, ইহাতে দশ জন দশ কথা বলিতে পারে, বিশেষতঃ তাঁহার কিছু টাকা আসিয়াছে, এখন তিনিই আমায় সাহায্য করিতে পারিবেন।”

“তাহার পর তুমি আর কিছুই জান না?”

“পর দিন শুনিলাম, রাজা মারা গিয়াছেন।

‘সদানন্দ আপনাকে বলিল যে, তুমি যেন পত্রের কথা কাহাকে না ব’ল।”

“হাঁ—তিনি বলিলেন, রাজা হঠাৎ মারা গিয়াছেন, পত্রের কথা বাহির হইলে আমি ভারি গোলে পড়িব।”

“ঠিক কথা,—তবে কিছু-না-কিছু সন্দেহ করিয়াছিলেন?”

নবদুর্গা ইতস্ততঃ করিতে লাগিলেন,—গোবিন্দরাম বলিলেন, “ইহাতেই হইবে, তুমি যে তাহার হাতে এখনও বাঁচিয়া আছ, ইহাই তোমার পক্ষে পরম ভাগ্য।”

পঞ্চচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

ষ্টেশনের দিক যাইতে যাইতে গোবিন্দরাম বলিলেন, “ডাক্তার, বুঝিতে পারিলে, ব্যাপারটা অনেক পরিষ্কার হইয়া আসিতেছে? কিন্তু এই ভয়ানক দুর্বৃত্বের ভয়াবহ খুনের রহস্য আমরা সম্পূর্ণরূপে ভেদ করিতে পারি নাই; এখনও ইহার বিরুদ্ধে ফাঁসি হইবার মত কোন প্রমাণ সংগৃহীত হয় নাই; যখন হইবে তখন জগতের লোকে এরূপ অদ্ভুত খুনের প্রথা আর কখনও কেহ শুনে নাই, তাহাই বলিতে বাধ্য হইবে। যাহা হউক, আর বিলম্ব নাই, এইবার এই বদমাইশের সকল বুদ্ধিরই একটা সীমা পাওয়া যাইবে।”

আমরা ষ্টেশনে পৌঁছিবার কিয়ৎক্ষণ পরে কলিকাতার গাড়ী আসিয়া উপস্থিত হইল। অক্ষয় বাবু লম্ফ দিয়া গাড়ী হইতে নামিলেন, তিনি গোবিন্দরামকে অতিশয় শ্রদ্ধা করিতেন, তাঁহাকে সসম্ভ্রমে সম্ভাষণ করিয়া বলিলেন, “খবর ভাল?”

গোবিন্দরাম বলিলেন, “খুব ভাল, অনেক কাল এরূপ অদ্ভুত ব্যাপার দেখা যায় নাই— এস, আর দেরি করিবার সময় নাই, আজ রাত্রে যে মাঠ আর যে দৃশ্য দেখিবে, তাহা জীবনে কখন দেখিতে পাইবেন না, ভুলিতেও পারিবে না।

আমরা আবার সেই মাঠের দিকে ফিরিলাম। গোবিন্দরাম নিজে কখন কি করিবেন, তাহা কখনও কাহাকে বলিতেন না, কাজেই তাঁহার সঙ্গে যাঁহারা থাকেন, তাঁহাদের অনেক সময়ে এই জন্য বিরক্ত হইতে হইত। তিনি কি করিবেন, তাহা আমি বা অক্ষয়বাবু কিছুই জানি না, অন্ধের ন্যায় তাহার সঙ্গে সঙ্গে যাইতেছি মাত্র।

আমরা একখানা ভাড়াটীয়া গাড়ীতে যাইতেছিলাম। গোবিন্দরাম নীরব, কাজেই আমরা দুই জনে এ কথা সে কথা কহিয়া সময় কাটাইতেছিলাম। সদানন্দের বাড়ীর প্রায় আধ ক্রোশ দূরে আসিয়া গোবিন্দরাম গাড়ী বিদায় করিয়া দিলেন।

তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়; আমরা প্রকাশ্য পথ ত্যাগ করিয়া মাঠের পথে চলিলাম।

কিয়দ্দুর আসিয়া গোবিন্দরাম বলিলেন, “অক্ষয়বাবু, সঙ্গে পিস্তল আছে তো?”

অক্ষয়বাবু হাসিয়া বলিলেন, “যতক্ষণ আমার গায়ে কোট আছে, ততক্ষণ তাহার তিন চারটা পকেটও আছে, যখন পকেটগুলি আছে, তখন পকেটগুলিতে নিশ্চয়ই কিছু আছে।”

গোবিন্দ। খুব ভাল, ডাক্তারের আর আমার পকেটও খালি নয়।

অক্ষয়। গোবিন্দরামবাবু, ব্যাপারটা বিন্দুবিসর্গ বুঝিতেছি না, এ পর্য্যন্ত তো এক কথাও বলেন নাই—উপস্থিত ব্যাপারটী কি?

গো। উপস্থিত ব্যাপার—ধৈর্য্য।

অ। ধৈর্য্য—বুঝিলাম না।

গো। এখনই বুঝিবেন।

অ। কি ভয়ানক মাঠ, এমন দুর্গম স্থানও সংসারে আছে, জনমানবের চিহ্ন নাই—তবু দূরে আলো দেখা যাইতেছে, বোধ হয় একটী বাড়ী।

গো। হাঁ, ঐ বাড়ীটা আমাদের লক্ষ্য, খুব সন্তর্পণে পা টিপিয়া চল, আস্তে কথা কও।

আমরা অতি নিশব্দে সদানন্দের বাড়ীর নিকটস্থ হইলাম, তখন বোধ হয় রাত্রি আটটা। বাড়ীর কাছে আসিলে গোবিন্দরাম মৃদুস্বরে বলিলেন, “চুপ—আর না, এই গাছের ঝোপটা লুকাইয়া থাকিবার বেশ জায়গা, এস এখানে।”

অ। এখানে অপেক্ষা করিতে হইবে?

গো। হাঁ, এইখান হইতে পাহারা দিতে হইবে। ডাক্তার, তুমি বাড়ীটা আগে দেখিয়াছ, যে ঘরে আলো জলিতেছে, সে ঘরটা কি?

আমি। বৈঠকখানা।

গো। এস আস্তে আস্তে—দেখি ভিতরে কে।

আমরা পা টিপিয়া টিপিয়া প্রায় জানালার কাছে আসিলাম; দেখিলাম, গৃহমধ্যে কেবল দুই জন লোক বসিয়া আছে; দেখিবামাত্রই চিনিলাম, একজন সদানন্দ অপর নবীন রাজা মণিভূষণ

তাহারা আমাদের দিকে পিছন ফিরিয়া বসিয়াছিলেন; তবে ভাবে বুঝিলাম, উভয়ে কথাবার্তা হইতেছে, সঙ্গে সঙ্গে পান ও তামাক চলিতেছে। ইহাতে বোধ হইল, ইহাঁদের ভোজন ব্যাপারটা ইহারই মধ্যে শেষ হইয়াছে।

এই সময় দেখিলাম, সদানন্দ উঠিয়া সেই ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল, এবং মণিভূষণ তাকিয়ায় ঠেসান দিয়া ধুমপান করিতে লাগিলেন। তাহার পরেই একটা দরজা খুলিবার শব্দ পাইলাম। বোধ হইল, কে যেন বাড়ীর বাহির হইয়া আসিল। সত্য সত্যই সদানন্দ বাড়ীর বাহির হইয়া আসিয়া আমার সম্মুখ দিয়া বাড়ীর পশ্চাদ্দিকে গেল; সেখানে সে একটা ঘরের চাবি খুলিয়া প্রবেশ করিল, সে ঘর হইতেও কি একটা শব্দ শুনিতে পাইলাম; কিন্তু পরক্ষণেই সদানন্দ সেই ঘর হইতে বাহির হইয়া দ্রুতপদে গৃহে প্রবেশ করিল।

আমরা নিঃশব্দে আবার ঝোপের নিকটে আসিলাম। তখন গোবিন্দরাম বলিলেন, “ইহার স্ত্রীকে দেখিতে পাইলে?”

আমি বলিলাম, “কই না।”

গোবিন্দরাম চিন্তিতভাবে বলিলেন, “অন্য কোন ঘরে আলো দেখিতে পাইতেছি না—সে কোথায় তবে?”

আমি বলিলাম, “কেমন করিয়া বলিব?”

গোবিন্দরাম কিয়ৎক্ষণ নীরব থাকিয়া বলিলেন, “আমাদের আরও একটু দূরে গিয়া থাকা উচিত, এস।”

আমরা তিনজনে সদানন্দের বাড়ী হইতে এই নিৰ্জ্জনতায় ভয়ানক প্রান্তরের মধ্য দিয়া যে সরল কঙ্করাকীর্ণ পথ গড়ের দিকে গিয়াছে, সেই পথে অগ্রসর হইলাম—কোন দিকে একটী গাছ পর্যন্ত নাই; অনেক দূর অসিয়া একটা খাদ দেখিয়া গোবিন্দরাম বলিলেন, “লুকাইয়া থাকিবার এই উপযুক্ত স্থান, এস এইখানে অপেক্ষা করা যাক—মণিভূষণ শীঘ্রই এই পথে যাইবে। আর বেশী দূরে যাওয়া উচিত নহে—কি জানি কি হয়।”

আমরা নীরবে স্পন্দিত হৃদয়ে প্রায় অৰ্দ্ধ ঘণ্টা কাল সেই গর্তের ভিতর অপেক্ষা করিতে লাগিলাম, কিন্তু কোন দিকে কোন শব্দ শুনিতে পাইলাম না।

ষট্‌চত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

সহসা গোবিন্দরাম ব্যগ্রভাবে বলিয়া উঠিলেন, “এই বার বোধ হয়, মণিভূষণ আসিতেছে!” তখন আমরা কান পাতিয়া শুনিয়া বুঝিলাম যে, দূরে কেহ দ্রুতপাদবিক্ষেপে আসিতেছে; আমরা তিন জনেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেই অন্ধকারে চাহিলাম, কিন্তু কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না। তৰে পদশব্দ ক্রমেই নিকটবর্ত্তী হইয়া আসিতে লাগিল; একটু পরে আমরা দেখিলাম, দূরে মাঠের উপর দিয়া মণিভূষণ বিস্মিত ও ভীতভাবে পশ্চাতের দিকে ঘন ঘন চাহিতে চাহিতে যথাসম্ভব শীঘ্র চলিয়াছেন। আমরা উঠিয়া দাঁড়াইতে উদ্যত হইলে গোবিন্দরাম এক হাতে আমার কাঁধ ও অপর হাতে অক্ষয়বাবুর হাত চাপিয়া ধরিয়া নিম্ন কণ্ঠে বলিলেন, “চুপ।” আমরা যেখানে লুকাইয়া ছিলাম, মণিভূষণ সত্বর পদে তথা হইতে গড়ের দিকে চলিয়া গেলেন।

পর মুহূর্ত্তেই আমি পিস্তলের ঘোড়া তুলিবার শব্দ পাইলাম, গোবিন্দরাম বলিলেন, “আসিতেছে—পিস্তল—পিস্তল—”

তৎক্ষণাৎ আমরা পিস্তল বাহির করিলাম।

তখন সেই মাঠ হইতে যেন কি একটা আমাদের দিকে ছুটিয়া আসিতেছে, এরূপ পদশব্দ পাইলাম—কি বিভীষিকা আমাদের দিকে আসিতেছে, তাহা না জানিতে পারিয়া আমাদের প্রায় নিশ্বাস বন্ধ হইয়া আসিল। আমি সভয়ে গোবিন্দরামের মুখের দিকে চাহিলাম। তাঁহার চক্ষু তখন নক্ষত্রের মত অন্ধকারে তীব্রভাবে জ্বলিতেছিল, কিন্তু সহসা তাহা ঘোরতর বিস্ময়ে পরিণত হইল, এই সময়ে অক্ষয়বাবু ভীতিব্যঞ্জক অস্ফুট শব্দ করিয়া উঠিলেন।

গোবিন্দরাম লম্ফ দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন, আমিও তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রচালিতের ন্যায় লম্ফ দিয়া উঠিয়াছিলাম; কিন্তু যাহা সম্মুখ দেখিলাম, তাহাতে আমার দেহের সমস্ত রক্ত যেন গলিত তুষারবৎ শীতল হইয়া গেল—কি দেখিলাম তাহার বর্ণনা হয় না,—সে কি ভয়াবহ—কি ভীষণ — কি ভয়ঙ্কর!

অন্ধকার হইতে যাহা বাহির হইল; তাহা কুকুর নিশ্চয়—তবে সেই কুকুরটা প্রায় বাঘের মত বড়, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, এরূপ জন্তু কেহ কখন দেখে নাই। ইহার মুখ অগ্নিময়, ইহার চক্ষু হইতে অগ্নিধারা বিকীর্ণ হইতেছে, ইহার সর্ব্বাঙ্গ হইতে অগ্নিশিখা নির্গত হইতেছে, এরূপ ভয়াবহ বিভীষিকা আর কখনও দেখি নাই।

এই অদৃষ্টপূর্ব্ব ভয়ঙ্কর পশু লম্ফে লম্ফে ছুটিয়া মণিভূষণের অনুসরণ করিতেছে। আমরা উভয়েই এই ভয়ঙ্কর জন্তু দেখিয়া এতই স্তম্ভিত হইয়াছিলাম যে, আমরা ইহাকে আমাদের সম্মুখ দিয়াও নির্বিঘ্নে যাইতে দিলাম, তাহার পরেই গোবিন্দরাম ও আমি দুই জনে এক সঙ্গে পিস্তল ছুড়িলাম। বিকট জন্তুটা একটা বিকট শব্দ করিয়া উঠিল; তাহাতে আমরা বুঝিলাম, হয় আমার—না হয় গোবিন্দরামের পিস্তলের গুলি তাহার গায়ে লাগিয়াছে। আমরা আর এক নিমেষও বিলম্ব করিলাম না। উর্দ্ধশ্বাসে সেই জন্তুর দিকে ছুটিলাম।

দূরে মাঠের পথে আমরা মণিভূষণকে দেখিতে পাইলাম, তিনি এক একবার সভয়ে পশ্চাদ্দিকে চাহিয়া দেখিতেছেন; ভাবে বোধ হইল, তিনি আরও ভীত হইয়াছেন।

কিন্তু কুকুরটা সেই ভয়াবহ আর্তনাদ করায় আর আমাদের ভয় নাই, গুলিটা নিশ্চয় সাংঘাতিক ভাবে লাগিয়াছে—নিশ্চয় সেটাকে এবার মরিতে হইবে। আমি আর কখনও গোবিন্দরামকে এরূপ প্রবলবেগে ছুটিতে দেখি নাই। আমিও খুব ছুটিতে পারিতাম, কিন্তু গোবিন্দরাম আমাকে পশ্চাতে ফেলিয়া ছুটিতেছিলেন।

আরও কিছুদূরে গিয়া শুনিলাম, মণিভূষণ প্রাণভয়ে আর্ত্তনাদ করিয়া উঠিলেন; এ কি— তিনি এই ভয়ঙ্কর কুকুরের কবল হইতে রক্ষা পাইলেন না!

কুকুরটা মণিভূষণের উপর গিয়া পড়িল, তিনি ধরাতলে পড়িয়া গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে গোবিন্দরাম পুনঃ পুনঃ কুকুরটার দেহের উপরে, মস্তকে গুলি করিলেন। কুকুরটা একটা বিকট চিৎকার করিয়া সেইখানে গড়াইয়া পড়িল, আমিও গিয়া কুকুরের মস্তকে পিস্তল চাপিয়া ধরিলাম, কিন্তু আর গুলি চালাইতে হইল না—দেখিলাম, তাহার লীলাবসান হইয়াছে।

মণিভূষণ মূৰ্চ্ছিত হইয়াছিলেন। আমরা দেখিলাম, কুকুরটা তাঁহাকে কামড়াইতে পারে নাই, তিনি কেবল ভয়ে অজ্ঞান হইয়াছেন। এই সময়ে অক্ষয় বাবুও ছুটিয়া তথায় আসিলেন; তাঁহার পকেটে সর্ব্বদাই এক শিশি ব্রাণ্ডী থাকিত, উনি তাহাই মণিভূষণের মুখে ঢালিয়া দিলেন। তখন মণিভূষণ ধীরে ধীরে চক্ষু মেলিলেন, অস্পষ্ট স্বরে বলিলেন, “কি—কি ভয়ানক—সেটা কি?” গোবিন্দরাম বলিলেন, “সেটা যাহাই হউক, আর নাই—সেটা মরিয়াছে। এনার বংশের ভূতের দফা আজ আমরা রফা করিয়াছি।”

যে জন্তুটা আমাদের সম্মুখে মৃত পড়িয়া আছে, তাহা অতি বৃহৎ হইলেও কুকুর বটে, এই জাতীয় কুকুর কোন লোকের কোন দ্রব্য হইতে তাহার গন্ধ পাইলে, সে যেখানেই যাউক না কেন, তাহার গন্ধ অনুসরণ করিয়া গিয়া ধরে ও ক্ষুধার্ত থাকিলে তাহাকে অনায়াসে হত্যা করে। কুকুরটার মুখ দেখিয়া আমি বেশ বুঝিলাম যে, সদানন্দ ইহাকে বহু দিন অনাহারে রাখিয়াছে।

তখন তাহার মুখের চারিদিক্ হইতে আগুন বাহির হইতেছিল, আমি তাহার মুখে হাত দিলাম, আমার অঙ্গুলিতে কি লাগিয়া গেল, তাহাও অন্ধকারে আমার অঙ্গুলিতে জ্বলিতে লাগিল। আমি বলিয়া উঠিলাম, “ফস্ফরাস।”

গোবিন্দরাম তৎক্ষণাৎ মৃত কুকুরের মুখের কাছে মুখ লইয়া বলিয়া উঠিলেন, “নূতন ‘ রকমে প্রস্তুত, দেখিতেছ না যে গন্ধ নাই। রাজা মণিভূষণ, আমি ইচ্ছা করিয়া যে আপনাকে এ বিপদে ফেলিয়াছিলাম, তাহার জন্য আমাকে মাপ করুন। আমি জানিতাম যে, একটা কুকুরের সঙ্গে আমাদিগকে বোঝাপড়া করিতে হইবে, কিন্তু এমন ভয়ানক ব্যাপার লইয়া যে কাজ করিতে হইবে, তাহা মনে হয় নাই।”

সপ্তচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

মণিভূষণ তখনও আত্মসংযম করিতে পারেন নাই, তখনও ভীতিবিহ্বল নেত্রে কুকুরটার দিকে চাহিতেছিলেন। গোবিন্দরামের কথা শুনিয়া বলিলেন, “আপনি আমার প্রাণরক্ষা করিয়াছেন।”

গোবিন্দ। প্রথমে আপনাকে বিপদে ফেলিয়া—যাহা হউক, এখন উঠিয়া দাঁড়াইতে পারিবেন কি?

মণি। হাঁ, এখন সুস্থ হইয়াছি। এখন কি করিতে চাহেন?

গো। আপনার আর কোন ভয় নাই—আপনি এখানে একটু অপেক্ষা করুন, আমরা এখনই আসিতেছি; আর এক মুহূর্ত্ত বিলম্ব করিলে দুর্বৃত্ত পলাইবে।

মণিভূষণের তখনও চলিবার মত অবস্থা হয় নাই, তিনি সেইখানে বসিয়া রহিলেন, আমরা তিনজনে সদানন্দের বাড়ীর দিকে ছুটিলাম।

ছুটিতে ছুটিতে গোবিন্দরাম বলিলেন, “খুব সম্ভব, আমরা তাহাকে বাড়ীতে পাইব না। নিশ্চয়ই সে বন্দুকের শব্দ শুনিয়াছে।”

আমি বলিলাম, “এখান হইতে তাহার বাড়ী দূরে, আর হাওয়া অন্য দিকে,—নাও শুনিতে পারে।”

গোবিন্দরাম ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, “সে নিশ্চয়ই কুকুরটার পিছনে পিছনে আসিয়াছে, সে আমাদের বন্দুকের শব্দ শুনিয়া তাহার লীলাখেলা ফুরাইয়াছে জানিয়া এতক্ষণে পলাইয়াছে, তবু প্রথমে তাহার বাড়ীটা দেখাই আমাদের উচিত।”

আমরা সদানন্দের বাড়ীর সম্মুখে আসিয়া দেখিলাম, সদর দরজা খোলা রহিয়াছে, আমরা সত্বর বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া ঘরের পর ঘর খুঁজিতে লাগিলাম, তাহার দুইজন চাকর সভয়ে আমাদের দিকে চাহিয়া রহিল, আমাদের সকলের হাতেই পিস্তল।

বাড়ীর একটা ঘর ভিন্ন আর কোন ঘরে আলো ছিল না; গোবিন্দরাম আলোটা তুলিয়া লইয়া প্রত্যেক ঘর দেখিতে লাগিলেন। একটা ঘরের দরজা বন্ধ ছিল। গোবিন্দরাম বলিলেন, “নিশ্চয়ই এই ঘরে কেহ আছে। ভিতরে শব্দ হইতেছে, খোল—এই দরজা।”

ভিতরে যেন কে ক্ষীণস্বরে গেঙাইতেছিল। গোবিন্দরাম মুহূর্তমধ্যে দরজা খুলিয়া ফেলিলেন, কিন্তু সে ঘরে সে দুর্দান্ত দুর্বৃত্ত নাই—তাহার পরিবর্তে আমরা যে দৃশ্য দেখিলাম, তাহাতে ক্ষণকাল স্তম্ভিত হইয়া দণ্ডায়মান ছিলাম।

গৃহের এক পার্শ্বে একটা থাম ছিল, সে থামে একটা মূর্ত্তি আবদ্ধ রহিয়াছে, তার সর্ব্বাঙ্গ— পদ হইতে মস্তক পৰ্য্যন্ত এমনই ভাবে কাপড়ে বেষ্টিত যে, সে কি স্ত্রীলোক, তাহা জানিবার উপায় নাই। গোবিন্দরাম নিমেষমধ্যে মূর্ত্তির মুখ হইতে কাপড় ছিনাইয়া লইলেন, তখন আমরা দেখিলাম, মঞ্জরী—সদানন্দের স্ত্রী।

আমরা তাহার বন্ধন খুলিয়া দিলে সে অবসন্নভাবে মাটিতে বসিয়া পড়িল, পৃষ্টে আমরা স্পষ্ট বেত্রাঘাতের চিহ্ন দেখিলাম। অক্ষয়বাবু অবসন্না মঞ্জরীর মুখেও খানিকটা ব্রাণ্ডী ঢালিয়া দিলেন।

পরে মুঞ্জুরী চক্ষু মেলিল, ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞাসা করিল, “তাঁহার কোন ক্ষতি হয় নাই—তিনি তো পলাইতে পারিয়াছেন?”

গোবিন্দরাম গম্ভীর ভাবে বলিলেন, “আমাদের হাত হইতে পলায়ন করা কাহারও পক্ষে সহজ হইবে, এমন বোধ হয় না।”

মঞ্জরী। আমি আমার স্বামীর কথা বলিতেছি না, আমি—আমি—রাজার কথা বলিতেছি। গো। রাজা রক্ষা পাইয়াছেন।

মঞ্জরী। আর কুকুরটা?

গো। কুকুরটা আমাদের গুলিতে মরিয়াছে।

মঞ্জরী। ভগবান আছেন—ভগবান আছেন।

মঞ্জরী অঞ্চলে মুখ ঢাকিয়া কাঁদিতে লাগিল; কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, “দেখুন, আমার স্বামী—সে আমার কি দশা করিয়াছে!”

গোবিন্দরাম বলিলেন, “তাহা দেখিতেছি, যখন আপনার স্বামীর উপর ভক্তি নাই, যখন আপনি তাহার দুর্বৃত্ততা সব জানিয়াছেন, তখন আশা করি, আপনি আমাদের বলিবেন, তিনি কোথায় লুকাইয়াছেন।”

মুঞ্জরী কিয়ৎক্ষণ নীরব থাকিয়া বলিল, “আমার সে যে দশা করিয়াছে, আমাকে এত কাল যে জ্বালা দিয়াছে, তাহাতে তাহার উপর আমার বিন্দুমাত্র মমতা নাই। বোধ হয়, সে তাহার সেই গুপ্তস্থানে লুকাইয়াছে।”

গো। কোথায় সে গুপ্তস্থান?

মু। এই মাঠের উত্তর দিকে যে চোরাবালি আছে—তাহারই মধ্যে একটা পাহাড়ের মত আছে, এই পাহাড়ের ভিতর একটা গহ্বর আছে, সেইখানেই তাহার আড্ডা, নিশ্চয়ই সে সেইখানে পলাইয়াছে।

গো। চোরাবালির দিকে এই রাত্রে গেলে কাহারও কি রক্ষা পাইবার সম্ভাবনা আছে? মু। একটা পথ আছে—সে পথ আর কেহ জানে না,—কেবল সে-ই জানে।

আমরা বুঝিলাম, আজ রাত্রে আর এই দুর্বৃত্তের অনুসন্ধান করা বৃথা, সে কখনই রেলে পলাইবার চেষ্টা পাইবে না, তাহার ন্যায় চালাক লোক অনায়াসেই বুঝিয়াছে যে, গোবিন্দরামের ন্যায় লোক কখনই রেলের পথ বন্ধ না করিয়া নিশ্চিন্ত নাই। প্রকৃতই গোবিন্দরাম পূর্ব্ব হইতে রেল স্টেশন—কেবল রেল-ষ্টেশন কেন, এখান হইতে পলাইবার সকল পথই বন্ধ করিয়াছিলেন, সকল পথেই লোক রাখিয়াছিলেন; আর এখানে থাকিয়া কোন ফল নাই, ভাবিয়া আমরা মণিভূষণের নিকট চলিলাম।

অষ্টচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

সদানন্দের সকল কথা-ই আমরা মণিভূষণকে বলিতে বাধ্য হইলাম; কিন্তু সেই রাত্রেই তাঁহার প্রবল জ্বর হইল, প্রায় পনের দিন পরে তিনি সুস্থ হইয়া উঠিলেন। তখন তিনি নলিনাক্ষ বাবুকে সঙ্গে লইয়া সেইদিন গড় পরিত্যাগ করিয়া পশ্চিমে হাওয়া খাইতে চলিয়া গেলেন, আর বহুদিন গড়ে ফিরেন নাই।

.

এক্ষণে আমি এই ভয়াবহ ইতিহাসের উপসংহার ভাগে আসিয়া পড়িয়াছি। এই ব্যাপারে লিপ্ত হইয়া কখন আমার মনের কিরূপ অবস্থা হইয়াছিল, আমি তাহাই যথাসাধ্য সরলভাবে বর্ণন করিতে চেষ্টা পাইয়াছি, এবং আমার অদ্ভুতকর্ম্মা বন্ধু গোবিন্দরাম কখন কি করিয়াছিলেন, তাহাও লিখিয়াছি। এখন পরে কি হইল, তাহাই সংক্ষেপে বলিব।

পরদিন আমরা চোরাবালির দিকে চলিলাম। মঞ্জরীর কাছে শুনিলাম যে, এই চোরাবালির মধ্যস্থ পাহাড়ের গহ্বরেই সদানন্দ কুকুরটাকে লুকাইয়া রাখিয়াছিল, সে নিজে রাত্রে তাহাকে খাবার দিয়া আসিত; কেবল যে রাত্রে কুকুরটাকে তাহার দরকার হইত, তাহার আগের রাত্রে বাটীতে আনিয়া বাটির পশ্চাদ্দিকের একটা ঘরে বাঁধিয়া রাখিত, আমরা আরও শুনিলাম, চোরাবালির ভিতর যে পথ ছিল—তাহা ঠিক রাখিবার জন্য সে এই পথে বরাবর ছোট কাঠ পুঁতিয়া রাখিয়াছিল।

আমরা তিনজনে এই ভয়াবহ চোরাবালির নিকট আসিয়া দাঁড়াইলাম, তাহার পর এই পথ খুঁজিতে লাগিলাম, বহুক্ষণ চেষ্টার পর এক স্থানে দেখিলাম যে, যথার্থই একটা কাঠ পোতা রহিয়াছে, তাহার পর বিশেষ করিয়া দেখিয়া দেখিলাম যে, একটার পর একটা কাঠ বরাবর রহিয়াছে, ইহা ক্রমে সেই পাহাড়ের দিকে গিয়াছে। পথটী নিশ্চয়ই অতি অপ্রশস্ত।

ভয় কাহাকে বলে, তাহা গোবিন্দরামের জন্ম-পত্রিকায় লেখে না। সুতরাং তিনি সেই পথে অগ্রসর হইলেন, অগত্যা আমরাও তাঁহার অনুসরণ করিতে বাধ্য হইলাম, তবে সত্যকথা বলিতে কি, এই ভয়াবহ পথে অগ্রসর হইতে প্রতিক্ষণে আমার প্রাণ কাঁপিয়া উঠিতে লাগিল।

কিয়দ্দূর যাইতে না যাইতে গোবিন্দরামের একটা পা হাঁটু পর্যন্ত বসিয়া গেল, আমরা দুইজনে সবলে তাঁহাকে টানিয়া না তুলিলে বোধ হয়, তাঁহাকে সেইখানেই অনন্তকালের জন্য থাকিতে হইত, তবে তিনি সেইখানকার বালি হইতে একপাটি পুরাতন জুতা টানিয়া বাহির করিলেন।

তিনি হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “বালির ভিতর যাওয়ায় লাভ ভিন্ন লোকসান হইল না। এই সেই মণিভূষণের হারাণ জুতা!”

আমি বলিয়া উঠিলাম, “নিশ্চয়ই সদানন্দ পলাইবার মুখে এ জুতাটা এখানে ফেলিয়া দিয়াছিল।”

“নিশ্চয়ই। কুকুরটাকে মণিভূষণের উপর লেলাইয়া দিবার জন্য সে ইহা হাতেই রাখিয়াছিল, তাহার পর যখন দেখিল যে, তাহার কাজ শেষ হইয়াছে, তখন সে এখানে ফেলিয়া দিয়াছিল। যাহা হউক, ইহাতে এখন জানা গেল যে, সে এইদিকে আসিয়াছিল।”

এই পৰ্য্যন্ত—সদানন্দ সম্বন্ধে আমরা আর কিছু জানিতে পারিলাম না, দুই এক স্থানে সেই ক্ষুদ্র পথে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত তাহার পদ চিহ্ন দেখিতে পাইলাম, তাহার পর কোন চিহ্ন নাই। এক্ষণে গোবিন্দরামও আর অগ্রসর হইতে ভীত হইলেন, আমরা প্রাণে প্রাণে অনেক কষ্টে নিরাপদ শক্ত জমিতে আসিয়া হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিলাম।

গোবিন্দরাম বলিলেন, “দেখিতেছি, দুর্বৃত্ত তাহার আড্ডায় রাত্রে পৌঁছিতে পারে নাই, সাধারণভাবে সাবধানে যাওয়া এক রকম—আর প্রাণভয়ে পলাইয়া যাওয়া আর এক রকম—সে এই পথে ছুটিয়া যাইবার সময় নিশ্চয়ই এই চোরাবালিতে পড়িয়াছিল—তাহার পা এখানে পড়িলে যাহা হয়, তাহার তাহাই ঘটিয়াছিল।”

তখন গরুর সেই বিকট আর্ত্তনাদ আমার মনে পড়িল, প্রাণ শিহরিয়া উঠিব।—পাপীর এইরূপেই দণ্ড হয়।

গড়ের দিকে ফিরিতে গোবিন্দরাম বলিলেন, “এরূপ বুদ্ধির সহিত খুন করা তোমরা আর কি কখনও শুনিয়াছ? আমি এ পৰ্য্যস্ত অনেক খুন দেখিয়াছি, কিন্তু খুন করিবার এমন সুবন্দোবস্ত আর পূর্ব্বে কখনও দেখি নাই।”

এ মতলব তাহার মাথায় নিশ্চয়ই গড়ের রাজবংশ হইতেই ঢুকিয়াছিল, তাহাই এই জাল কুকুর-ভূত দেখাইয়া রাজা অহিভূষণের মৃত্যু ঘটাইয়াছিল। আশ্চর্য্যের বিষয় কিছুই নয় যে, হতভাগ্য হারু ডাকাত এই ভয়াবহ কুকুরের ভয়ে খাদে পড়িয়া পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইয়াছিল। এ রকমে মানুষ খুন করিবার উপায় উদ্ভাবন যে খুব ক্ষমতার কাজ, তাহা সকলকেই স্বীকার করিতে হইবে। ডাক্তার, আমি তোমার কলিকাতায়ই বলিয়াছিলাম যে, এ রকম ভয়ানক লোক আমি আর কখনও দেখি নাই, এখন আমার কথা সত্য হইল না কি? দেখিলে তো!”

উনপঞ্চাশত্তম পরিচ্ছেদ

সেইদিন হইতে অনেক দিন গোবিন্দরাম আর এই বিষয় সম্বন্ধে কোন কথা উত্থাপন করিলেন না। আমি জানিতাম, তিনি যখন সে বিষয় বলিতে ইচ্ছা করিতেন না, তখন কেহ তাঁহার নিকট হইতে কোন কথা বাহির করিতে পারিত না; সেজন্য আমিও কখনও তাঁহাকে এ সম্বন্ধে কোন কথা সেই পর্য্যন্ত আর জিজ্ঞাসা করি নাই। এতদিন ধৈর্য্যাবলম্বন করিয়া বসিয়াছিলাম। সম্প্রতি মণিভূষণ নলিনাক্ষ ডাক্তারবাবুর সহিত পশ্চিম হইতে ফিরিয়া আসিয়া আমাদের সঙ্গে দেখা করিলেন; কাজেই পুরাতন গড়ের কথা উঠিল—সেই কুকুর, সেই সদানন্দের কথা উঠিল।

গোবিন্দরাম বলিলেন, “ডাক্তার, যে লোকটা সদানন্দ নাম লইয়াছিল, তাহার দিক্ দিয়া বিবেচনা করিলে, সকল কথাই সহজ বলিয়া বোধ হয়; কিন্তু আমরা এই ব্যাপারের ভিতরে কি উদ্দেশ্য আছে, তাহা না জানিতে পারায় সেই সমস্তই জটিল ও রহস্যপূর্ণ বলিয়া মনে করিয়াছিলাম। সেই সকল ঘটনার পর আমার সঙ্গে সদানন্দের স্ত্রীর দেখা হইয়াছিল; তুমি শুনিয়া নিশ্চয়ই সন্তুষ্ট হইবে যে, তাহার টাকার অনটন নাই, সে বিষয়ে সদানন্দ যথেষ্ট রাখিয়া গিয়াছে। সদানন্দের স্ত্রী এখন কাশী চলিয়া গিয়াছে।”

আমি বলিলাম, “আশা করি, তুমি আমাকে এ সম্বন্ধে সকল বিষয়েরই ব্যাখ্যা করিবে— আমি ইহার এখনও অনেক বিষয় জানি না।”

গোবিন্দরাম বলিতে লাগিলেন, “তুমি এ অনুরোধ করিতে পার; কিন্তু সত্যকথা বলিতে কি, আমি এ সম্বন্ধে সমস্ত কথা যে মনে করিয়া রাখিয়াছি, তাহা বলিতে পারি না–অনেক কথারই এখন আমার মন হইতে অন্তর্হিত হইয়া গিয়াছে। একজন উকীল আজ যে মোকদ্দমা সুদক্ষতার সহিত চালাইলেন, কাল তিনি অন্য মোকদ্দমার জন্য সে মোকদ্দমার সমস্ত কথায়ই ভুলিয়া গেলেন। আমার সম্বন্ধেও ঠিক তাহাই ঘটে, আমি এক ব্যাপার শেষ করিয়া অপর ব্যাপারে মনোনিবেশ করিলে, আর আগেকার ব্যাপার বড় মনে থাকে না। যাহা হউক, আমি এই মণিভূষণের ব্যাপার সম্বন্ধে যাহা যাহা মনে আছে, সমস্তই বলিতেছি, ইহা ছাড়া তোমার যদি কিছু আমায় জিজ্ঞাস্য থাকে, তবে জিজ্ঞাসা করিও।

“মণিভূষণের বাড়ীতে যে ছবিখানা ছিল, তাহা দেখিয়া আমি স্পষ্টই বুঝিতে পারি, আমাদের এই সদানন্দ মণিভূষণের বংশের লোক—ভূল নহে। তাহার পর অনুসন্ধানে জানিলাম, অহিভূষণের পিতার যে ভাই নিরুদ্দেশ হইয়া গিয়াছিলেন, তিনি বিনোদলাল নামে পশ্চিমে বাস করিতেছিলেন। সেইখানেই তিনি বিবাহ করেন; তাঁহারই পুত্র আমাদের চতুর চূড়ামণি, শঠ-শিরোমণি, নর-পিশাচ সদানন্দ।

“পিতার মৃত্যু হইলে সদানন্দ পশ্চিমে নানা জাল জুয়াচুরী করিতে আরম্ভ করে, তাহার পর সেখানে থাকা অসম্ভব দেখিয়া সেখান হইতে পলায়ন করে।

“পরে সদানন্দ এ দেশে আসিয়া বাঁকুড়ায় এক স্কুল খুলে; কিন্তু স্বভাব কখনও যায় না, সেখানেও নানা জুয়াচুরী করায় সে সেখান হইতেও পালাইতে বাধ্য হয়—তাহার পর স্ত্রীকে লইয়া সে মণিভূষণের দেশে আসিয়া সেই নির্জ্জন মাঠের নির্জ্জন বাড়ীতে বাস করিতে থাকে বলা বাহুল্য, তাহার পশ্চিমে এক নাম ছিল, বাঁকুড়ায় আসিয়া সে আর এক নাম লইয়াছিল, তাহার পর মণিভূষণের দেশে আসিয়া আর এক নাম ধারণ করে।

“এখন এখানে আসিয়া সে যাহা করিল, তাহারই সহিত আমাদের বিশেষ সম্বন্ধ। দেখা যাইতেছে, এ দেশে আসিয়া লোকটা অনুসন্ধান করিয়া জানিয়া ছিল যে, নন্দনপুরের জমিদারী ও গড় সে চেষ্টা করিলে পাইতে পারে। অহিভূষণের মৃত্যু হইলে এক অন্তরায় থাকিতেছে মণিভূষণ, অহিভূষণের মৃত্যুতে সম্পত্তি আইনানুসারে মণিভূষণ পাইলে, আর মণিভূষণের মৃত্যু হইলেই সম্পত্তির সে নিজেই ওয়ারিসান্ ইইতেছে; সুতরাং কোনরূপে এই দুইজনকে সরাইতে পারলে সে অনায়াসে নন্দনপুরের জমিদারী পাইতে পারে।

“সে যখন নন্দনপুরে আসিল, তখন কি উপায়ে এ কার্য্য সুসিদ্ধ করিবে, তাহা সে নিশ্চয়ই ঠিক জানিত না, তবে তাহার যে ভিতরে ভিতরে একটা ভয়ানক দুরভিসন্ধি ছিল, তাহা এক কারণে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়; তাহার যদি মনে কোন দুরভিসন্ধি না থাকিত, তাহা হইলে এ দেশে আসিয়া সে নিজের স্ত্রীকে ভগিনী বলিয়া পরিচয় দিত না। তাহার স্ত্রীকে এইরূপে যে তাহার উদ্দেশ্য সাধনে লাগাইবে, তাহা তাহার গোড়া হইতেই মনে ছিল। পরে কি ভাবে কিরূপে যে কার্য্যোদ্ধার করিবে, তাহা তখনও স্থির করিতে পারে নাই।

“সে প্রথমে নন্দনপুরের নিকটে আসিয়া বাস করিতে লাগিল। তাহার পর নানা উপায়ে রাজা অহিভূষণের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করিল।

“এইরূপে ক্রমে সদানন্দ অহিভূষণের নিকট হইতেই তাহাদের পৈতৃক কুকুরভূতের গল্প শুনিল। অহিভূষণ এই ভূতের কথা এত বিশ্বাস করিতেন যে, কাহা কেই বলিতে ছাড়িতেন না; তখন ভাবে নাই যে তিনি ইহাতেই তাঁহার নিজের মৃত্যুর উপায় গড়িতেছেন।

“সদানন্দ দেখিল, অহিভূষণ এই ভূতের কথা খুব বিশ্বাস করেন—কোন গতিকে এই ভূতের ভয় তাঁহাকে দেখাইতে পারিলে তখনই ভয়ে তাঁহার মৃত্যু হইবে। তখন সদানন্দের মনে হইল যে, তাহা হইলে অতি অনায়াসে এই অহিভূষণের মৃত্যু সংঘটিত করিতে পারা যায়। সে পূৰ্ব্ব হইতেই ভাবিতেছিল, অহিভূষণকে কিরূপে সরাইবে—তাঁহাকে সরান চাই—তাঁহাকে হত্যা করা প্রয়োজন—অথচ কেহ যেন জানিতে না পারে যে, সে তাঁহাকে খুন করিয়াছে; তাহা হইলেই তাহাকে ফাঁসী-কাষ্ঠকে আলিঙ্গন করিতে হইবে।

“তখন সে খুনের এক অতি অদ্ভুত নূতন উপায় উদ্ভাবন করিল। ডাক্তার, শতবার স্বীকার করিতেছি, আমি অনেক খুন দেখিয়াছি, অনেক খুনের নূতন নূতন প্রক্রিয়া দেখিয়াছি, কিন্তু এমন অতীব চমৎকার ব্যাপার কখনও দেখি নাই। এই অত্যাশ্চৰ্য্য উপায় মনে মনে স্থির করিয়া সদানন্দ তখন অতি সুদক্ষতার সহিত তাহার উদ্দেশ্য-সাধনে নিযুক্ত হইল।

“সাধারণের মত হইলে সদানন্দ একটা ভয়ানক কুকুর জোগাড় করিয়াই সন্তুষ্ট থাকিত, কিন্তু সদানন্দ অতীব অসাধারণ—সে ঠিক প্রকৃতির লোক ছিল না। সে সেই কুকুরকে প্রকৃতই ভূতের মত করিবার জন্য ব্যস্ত হইল।

“কোথা হইতে সে এই কুকুরটাকে সংগ্রহ করিয়াছিল, সন্ধানে তাহা আমি জানিতে পারিয়াছি। পাছে কেহ জানিতে পারে বলিয়া সে কুকুরটাকে রাত্রে চোরাবালির সেই পাহাড়ের গহ্বরে লুকাইয়া রাখে, এইজন্যই সে দেশের কেহ ওই কুকুরকে কখনও দেখিতে পায় নাই।

কুকুরটাকে এইখানে রাখিয়া সে সুবিধা খুঁজিতে লাগিল, কিন্তু সহজে সুবিধা হওয়ায় ত সহজ নহে। অহিভূষণ এই কুকুর-ভূতের ভয়ে এতই ভীত ছিলেন যে, তিনি কিছুতেই রাত্রে বাড়ীর বাহির হইতেন না, অথচ বাড়ীর বাহির না হইলে তাঁহাকে হত্যা করা সম্ভবপর নহে।

“রাজাকে রাত্রে বাড়ীর বাহিরে আনিবার জন্য সে তাহার স্ত্রীকে উৎপীড়ন করিয়াছিল, কিন্তু মঞ্জরী এ কার্য্যে সম্পূর্ণ অসম্মত হইল, তখন সদানন্দ অন্য উপায় খুঁজিতে লাগিল। নিৰ্দ্দয় ভাবে প্রহার করিলেও যখন মঞ্জরী সম্মত হইল না, তখন সে নবদুর্গাকে ঠিক করিল, নানা কৌশলে তাহার সহিত প্রণয় স্থাপন করিল, সে কথা তুমি আগেই শুনিয়াছ। তখন সদানন্দ নবদুর্গাকে দিয়া কার্য্যোদ্ধারে কৃতসঙ্কল্প হইল। নবদুর্গার দুঃখে গলিয়া গেল, তিনি মধ্যে মধ্যে তাহার সাহায্য করিতে লাগিলেন। এইরূপে নবদুর্গাকে দিয়া সে মধ্যে মধ্যে রাজাকে পত্র লিখাইতে লাগিল, উদ্দেশ্য—কোন গতিকে তাঁহাকে দিয়া রাজাকে রাত্রে বাড়ীর বাহিরে আনিবে। এই সময়ে সে শুনিল যে, অহিভূষণ পশ্চিমে চলিয়া যাইতেছেন, তাহা হইলে তো কাৰ্য্যে বিলম্ব পড়িয়া গেল। আর তাহার বিলম্ব সহিল না, সে তৎক্ষণাৎ সেইদিনেই রাজার মৃত্যু ঘটাইবার উপায় স্থির করিল। নানা প্রলোভনে ফেলিয়া নবদুর্গাকে দিয়া রাজাকে একখানা পত্র লিখাইল! পত্রে আবার নানা কথা বলিয়া বুঝাইয়া নবদুর্গাকে সে রাত্রে রাজার সঙ্গে দেখা করিতে যাইতে দিল না।

“সন্ধ্যার পর মাঠে গিয়া সদানন্দ কুকুরটাকে ফস্ফরাস মাখাইল, তখন কুকুরটার মুখ ও সৰ্ব্বাঙ্গ হইতে আগুন ছুটিতে লাগিল, রাত্রি দশটার সময় সে তাহার এই ভয়ানক কুকুর ল‍ইয়া গড়ের নিকট উপস্থিত হইল। করুণ-হৃদয় অহিভূষণ নবদুর্গার অনুরোধে যাহা তিনি কখনই করিতেন না, সেই রাত্রে তাহা করিলেন, তিনি রাত্রি দশটার সময় বাটীর বাহির হইয়া গড়ের সাঁকোর নিকট আসিলেন। সেই সময়ে এই নর-রাক্ষস সদানন্দ তাহার সেই ভয়াবহ কুকুর তাহার উপর লেলাইয়া দিল, তখন সেই ভয়ানক বিভীষিকা দেখিয়া রাজার ভয়ে মৃত্যু হইল। তিনি যে প্রাণভয়ে কতদূর ছুটিয়াছিলেন, তাহা আমরা নলিনাক্ষবাবুর কথায় জানিতে পারিয়াছি; তিনি রাজার পায়ের দাগ ও কুকুরটার পায়ের দাগ দুই-ই লক্ষ্য করিয়াছিলেন।

“কার্য্যেদ্ধার হইয়াছে দেখিয়া দুর্বৃত্ত সদানন্দ তখন তাহার কুকুরটাকে লইয়া আবার মাঠের সেই নিৰ্জ্জন স্থানে বাঁধিয়া রাখে। তাহার ডাক মধ্যে মধ্যে লোকে শুনিতে পাইত, তাহাই এই চির প্রসিদ্ধ কুকুর-ভূতের কথায় সেখানকার সকল লোকের আরও বিশ্বাস জন্মিয়াছিল।

“রাজা অহিভূষণের মৃত্যু সম্বন্ধে এই পর্য্যন্ত। তাহার পরেই এ ব্যাপার আমাদের হাতে আসিয়া পড়ে। দেখিতেছ, কি ভয়ানক লোক সে—খুন করিলেও তাহাকে খুনী বলিয়া কিছুতেই প্রমাণ করা যায় না। এই খুনে তাহার একমাত্র সঙ্গী যে, সে কখনই তাহার বিরুদ্ধে কিছুই বলিতে পারিবে না। কুকুরটা কখনই তাহার বিরুদ্ধে কিছুই বলিতে পারিবে না, আর তাহার এই ভয়ানক কাণ্ডের কথা এই কুকুর ব্যতীত আর কেহই জানিত না।

“যে দুইজন স্ত্রীলোক—সদানন্দের স্ত্রী আর নবদুর্গা আসল কথা কিছুই জানিত না, কেবল সদানন্দকে সন্দেহ করিত মাত্র। নবদুর্গা কুকুরের কথা আদৌ জানিত না; সদানন্দের স্ত্রী তাহা জানিত, আরও জানিত যে, সদানন্দ রাজাকে কোন রকমে খুন করিবার চেষ্টায় আছে; কিন্তু তাহার ভয়ে কোন কথা প্রকাশ করিতে সাহস করিত না; আর সদানন্দও জানিত, এই দুই স্ত্রীলোক, তাহার বিরুদ্ধে কখনও কিছু বলিতে সাহস করিবে না। এইরূপ সাহস পাইয়া সদানন্দ অতি সহজে নিরাপদে তাহার ভয়াবহ কুকুরের ভয় দেখাইয়া রাজা অহিভূষণকে হত্যা করিল, কেহ তাহাকে সন্দেহ করিল না; সে যে ভাবে কাজ করিতেছিল, তাহাতে তাহাকে সন্দেহ করিবার কোন উপায়ও ছিল না।

“আমার বোধ হয়, সদানন্দ প্রথমে মণিভূষণের কথা জানিত না। প্রথমে ভাবিয়াছিল, এক অহিভূষণকে সরাইতে পারিলেই তাহার অভীষ্ট সিদ্ধ হইবে; কিন্তু পরে জানিল যে, অহিভূষণের মৃত্যুতে তাহার এ জমিদারী পাইবার উপায় নাই, তাহার মৃত্যুর পর আইনানুসারে মণিভূষণ ওয়ারিসান।

“যখন সে এ কথা শুনিল, তখনও সে হতাশ হইল না, তখন কিরূপে মণিভূষণকেও হত্যা করিবে, তাহাই ভাবিতে লাগিল। মণিভূষণের সমস্ত কথাই সে অতি অনায়াসে নলিনাক্ষবাবুর কাছে শুনিতে পাইত, কেহ তাহাকে সন্দেহ করিত না, কাজেই সকলেই সকল কথা তাহাকে বলিত।

তাহার প্রথম অভিপ্রায় ছিল যে, লোকাকীর্ণ কলিকাতা সহরে মণিভূষণ উপস্থিত হইবামাত্র কোনরূপে তাহাকে হত্যা করিবে, তাহাই সে কলিকাতায় চলিল, স্ত্রীকে একা রাখিয়া গেলে কেহ সন্দেহ করে বলিয়া তাহাকেও সঙ্গে লইয়া চলিল। স্ত্রীকে সঙ্গে লইয়া যাইবার তাহার আরও একটা উদ্দেশ্য ছিল, সে তাহার স্ত্রীকে আদৌ বিশ্বাস করিত না, তাহাই তাহাকে মুহূর্ত্তের জন্য চোখের আড়াল করিতে সাহস পাইত না।

পরে কলিকাতায় আসিয়া সে পরচুলার জাল দাড়ী পরিল, তাহার পর কি করিয়াছিল, তাহা আমরা জানি, সর্ব্বদা নলিনাক্ষ ও মণিভূষণের পিছু পিছু থাকিয়া সুবিধা খুঁজিতেছিল, আমরা কলিকাতায় তাহাকেই গাড়ীতে দেখিয়াছিলাম।

“মঞ্জরী তাহার স্বামীর উদ্দেশ্য কর্তৃক সন্দেহ করিয়াছিল, কিন্তু সদানন্দের ভয়ে কিছুতই মণিভূষণকে সাবধান করিয়া দিতে পারিতেছিল না। তাহার পর সে কি উপায়ে মণিভূষণকে পত্ৰ লিখিয়াছিল, তাহা আমরা জানি। তখন এই পত্র লেখা রহস্যপূর্ণ বলিয়া বোধ হইয়াছিল, কিন্তু এই পত্রই আমাদের অনুসন্ধানের প্রথম সূত্র হইয়াছিল।

“মণিভূষণের উপর যদি কুকুরটা লেলাইয়া দিতে হয়, তাহা হইলে তাহার কোন একটা পরিধানের দ্রব্য সংগ্রহ করা আবশ্যক, সদানন্দ প্রথমে তাহারই চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইল। এখন নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, সে হোটেলের চাকরদের ঘুস দিয়া মণিভূষণের একপাটি জুতা সংগ্ৰহ করিয়াছিল। প্রথমবার জুতাটা নূতন হওয়ার, সে আবার আর একপাটি পুরাতন জুতাও লইয়াছিল, এই জুতা চুরি হইতেই আমার মনে হয় যে, যথার্থ ই এই ব্যাপারের ভিতর একটা কুকুর আছে, আর সেই কুকুর জীবন্ত, কুকুর ভূত নহে। যদি ইহা না হইবে, তবে কোন লোক মণিভূষণের ব্যবহারের একপাটি পুরাতন জুতা সংগ্রহের জন্য এত ব্যস্ত হইবে কেন? যখন কোন ঘটনার মধ্যে কোন সামান্য হাস্যজনক বা অর্থ শূন্য বিষয় দেখিতে পাওয়া যায়, তখন সেই বিষয়টাই অতি বিশেষরূপে বিবেচনা করা আবশ্যক হইয়া পড়ে; যাহার কোন অর্থ নাই বলিয়া প্রথমে মনে হয়, শেষে তাহারই আবার নানা রকম অর্থ বাহির হইয়া পড়ে আর তাহা হইতেই শেষে অনেক বিষয় জানিতে পারা যায়। হয় ত তুমি এই সকল আদৌ মনে আন নাই, কিন্তু আমি আগে হইতেই বুঝিয়াছিলাম যে, যথার্থই একটা কুকুর লইয়াই আমাদের কাজ।

“তাহার পর মণিভূষণ আমাদের সঙ্গে দেখা করিতে আসিলেন; সদানন্দও গাড়ী করিয়া তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিয়াছিল, সদানন্দ পূৰ্ব্ব হইতে আমাকে চিনিত, আমি কোথায় থাকি তাহা জানিত, ইহাতে আমার মনে হয় সদানন্দ প্রথম এইরূপ ভয়ানক কাজ করিতে উদ্যত হয় নাই। সে এই সকল কাজে নিশ্চয়ই সিদ্ধহস্ত। অনুসন্ধানে জানিয়াছিলাম যে, মণিভূষণদের দেশে এক বৎসরের মধ্যে চারিটা বড় চুরি হইয়া গিয়াছে, অথচ কোন চুরিরই চোর ধরা পড়ে নাই, ইহাতে আমার বিশ্বাস যে, সদানন্দ এইরূপ উপায়ে টাকা সংগ্রহ করিত।

“সে যে কিরূপ লোক, তাহার প্রমাণও আমরা সেই দিনেই জানিতে পারিয়াছিলাম। সে অনায়াসে আমাদের চোখে ধূলি দিয়া পলাইয়াছিল; কেবল ইহাই নহে, গাড়োয়ানকে আমার নাম বলিয়াছিল, সুতরাং আমি জানিলাম যে, আমি যে এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করিয়াছি, তাহা সে জানিতে পারিয়াছে। সুতরাং সাবধানও হইয়াছে, আরও বুঝিয়াছে যে, এখন সে কলিকাতায় মণিভূষণের কিছু করিয়া উঠিতে পারিবে না। সেই জন্য সে কলিকাতা হইতে সেই দিনই দেবগ্রামে চলিয়া গিয়াছিল।”