বিংশ পরিচ্ছেদ
আমি প্রায় অর্দ্ধেক পথ আসিয়াছি, এই সময়ে পশ্চাতে কাহার পদশব্দ শুনিতে পাইলাম, যেন কে আমার পশ্চাতে ছুটিয়া আসিতেছে। ডাক্তার নলিনাক্ষবাবু ভাবিয়া আমি ফিরিলাম, কারণ এখানে আর কেহ আমায় চিনিত না; কিন্তু দেখিলাম, এক অপরিচিত ব্যক্তি আমার দিকে খুব দ্রুত পদক্ষেপে আসিতেছে।
লোকটি বাঙ্গালী ভদ্রালোক, গোঁফদাড়ী কামানো, বেশ বলিষ্ঠ, খৰ্ব্ব দেহ, চক্ষু দুইটী তীক্ষ্ণ ও উজ্জ্বল, বোধ হয়, বয়স ছত্রিশ বৎসরের কম হইবে না, তাহার হাতে একটা ফুলের সাজি, তন্মধ্যে অনেক ফুল সংগ্রহ করিয়াছেন।
তিনি নিকটে আসিয়া বলিলেন, ‘ডাক্তারবাবু, আমি উপযাচক হইয়া আপনার সঙ্গে আলাপ করিতেছি বলিয়া কিছু মনে করিবেন না, এখানে আমরা পাড়াগেঁয়ে মানুষ, সহরের নিয়ম-কানুন বড় জানি না, কোন লোক পাইলেই তাহার সঙ্গে আলাপ করিতে ব্যস্ত হই। বোধ হয়, আপনি নলিনাক্ষবাবুর কাছে আমার নাম শুনিয়া থাকিবেন। আমার নাম সদানন্দ।”
আমি বলিলাম, “হাঁ, নলিনাক্ষবাবু আপনার কথা বলিয়াছিলেন। আপনি আমাকে চিনিলেন কিরূপে?”
তিনি বলিলেন, “আমি নলিনাক্ষবাবুর বাড়ীতে গিয়াছিলাম, আপনি তাঁহার বাড়ীর সম্মুখ দিয়া আসিতেছিলেন, তাহাই জানালা হইতে তিনি আপনাকে আমায় দেখাইয়া দিলেন। আমাকেও এই পথে যাইতে হইবে, তাহাই ভাবিলাম, আপনার সঙ্গে কথা কহিতে কহিতে যাই। আশা করি, রাজা মণিভূষণ ভাল আছেন।”
আমি। হাঁ, বেশ ভাল আছেন।
তিনি। এখানে আমরা সকলেই মনে করিয়াছিলাম, রাজা অহিভূষণের হঠাৎ মৃত্যুর কথা শুনিয়া হয় ত রাজা মণিভূষণ এখানে বাস করিবেন না। তাঁহার ন্যায় বড় লোকের, বিশেষতঃ সৌখীন যুবকের পক্ষে এরূপ ভাঙ্গা গড়ে বাস করা সুখের নহে, তাহা জানি, তবে জমিদার বিদেশে থাকিলে দেশের প্রজাদের অনেক হানি—নয় কি?
আমি। হাঁ, এ কথা ঠিক।
তিনি। বোধ হয়, রাজা মণিভূষণের ভূতের ভয় নাই?
আমি। খুব সম্ভব, নাই।
তিনি। আপনি নিশ্চয়ই এই রাজবংশের ভৌতিক কুকুরের গল্প শুনিয়াছেন?
আমি। হাঁ, নলিনাক্ষবাবুর কাছে শুনিয়াছি।
তিনি বলিলেন, “এখানকার ছোটলোকমাত্রেই ইহা বিশ্বাস করে। অনেকে শপথ করিয়া বলে যে, তাহারা মাঠে এই রকম ভৌতিক কুকুর দেখিয়াছে।”
এই বলিয়া তিনি মৃদুহাস্য করিলেন। কিন্তু আমি তাঁহার মুখের ভাব দেখিয়া বুঝিলাম, তিনিও যে এ কথা বিশ্বাস করেন না, তাহা নহে।
তিনি বলিলেন, “রাজা অহিভূষণ এ কথা বিশ্বাস করিতেন, আর সেইজন্যই তাঁহার মৃত্যু ঘটিল।”
আমি। কেমন করিয়া?
তিনি। তিনি এই ভূতের কথা এতই বিশ্বাস করিতেন যে, কোন কুকুরকে অন্ধকারে দেখিয়াই ভয়ে তাঁহার মৃত্যু হইতে পারিত। আমার বিশ্বাস, তাঁহার মৃত্যুর দিন, রাত্রে তিনি নিশ্চয়ই এই রকম কিছু দেখিয়াছিলেন। আমার সর্ব্বদাই এ ভয় ছিল, তাঁহার হৃৎপিণ্ডের বল কিছু মাত্র ছিল না।
আমি। আপনি তাহা কি রূপে জানিলেন?
তিনি। আমার বন্ধু নলিনাক্ষবাবুর নিকট শুনিয়াছিলাম।
আমি। তাহা হইলে আপনি মনে করেন যে, কোন কুকুর রাজা অহিভূষণকে তাড়া করিয়াছিল, আর সেই ভয়েই তাঁহার মৃত্যু হইয়াছিল?
তিনি। আমার ত তাহাই বোধ হয়, আপনার কি মনে হয়?
আমি। আমি এ সম্বন্ধে কিছুই স্থির করি নাই।
তিনি। গোবিন্দরামবাবু কি বলেন?
এই কথায় আমি এতই বিস্মিত হইলাম যে, বলা যায় না। এই লোক কিরূপে জানিল যে, গোবিন্দরাম এ সম্বন্ধে অনুসন্ধানের ভার লইয়াছেন, আর আমি সেইজন্য এখানে আসিয়াছি? আমি তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সদানন্দের মুখের দিকে চাহিলাম। কিন্তু তিনি যে আমাকে বিস্মিত করিবার জন্য হঠাৎ গোবিন্দরামের নাম করিয়াছেন, তাহা তাঁহার মুখ দেখিয়া বোধ হইল না।
তিনি বলিলেন, “ডাক্তার বাবু আপনাকে চিনি না বলা বৃথা, আপনার বন্ধুর কীর্ত্তি আপনি প্রকাশ করিতেছেন, এই পাড়াগাঁয়েও তাহার দুই-একটা প্রবেশ করিয়াছে। নলিনাক্ষবাবু আপনার নাম বলিবামাত্র আমি বলিয়া উঠিলাম, ‘সেই ডাক্তার, যিনি বিখ্যাত গোবিন্দরামের কাহিনী প্ৰকাশ করিয়াছেন।’ নলিনাক্ষবাবুকে তখন সে কথা স্বীকার করিতে হইল। যখন আপনি এখানে আসিয়াছেন, তখন বুঝিতে পারা যায় যে, গোবিন্দরামবাবু ও বিষয়ে হাত দিয়াছেন, সুতরাং তিনি এ সম্বন্ধে কি ভাবিয়াছেন, তাহা স্বভাবতই জানিতে ইচ্ছা হয়।
আমি কহিলাম, “তিনি কি ভাবিয়াছেন, তাহা আমি জানি না।”
তিনি। নিশ্চয়ই তিনি একবার এখানে আসিবেন।
আমি। এখন তিনি কলিকাতায় বিশেষ ব্যস্ত আছেন।
তিনি। দুঃখের বিষয়—নিতান্ত দুঃখের বিষয়—তাঁহার মত ক্ষমতাশালী লোক একবার আসিলে বোধ হয়, অতি সহজেই এ রহস্য ভেদ হইয়া যাইত। যাহা হউক, আপনার যদি কোন সাহায্য করিতে পারি, তাহা হইলে বলিবেন, আমি সৰ্ব্বদাই প্রস্তুত আছি। যদি আপনি কাহাকে সন্দেহ করেন বা কি ভাবে অনুসন্ধান করিতে ইচ্ছা করিয়াছেন, তাহা আমায় বলেন, তাহা হইলে আমিও বোধ হয়, আপনাকে কিছু পরামর্শ দিতে পারি।
আমি। আমি কোন অনুসন্ধানে আসি নাই। রাজা মণিভূষণ’নিমন্ত্রণ করায় তাঁহার সঙ্গে কেবল কয়েক দিনের জন্য বেড়াইতে আসিয়াছি।
“ওঃ! নিশ্চয়ই আপনার খুব সাবধান হওয়া উচিত। যাহা হউক, কিছু মনে করিবেন না। এ সম্বন্ধে আর কোন কথা আপনাকে বলিব না। আমি ভাল ভাবেই বলিয়াছিলাম।”
আমরা যেখানে আসিয়াছিলাম, সেইখান হইতে একটি ক্ষুদ্র পথ মাঠের উপর দিয়া গিয়াছে, দূর হইতে সেই পথের সীমান্তে একটী ক্ষুদ্র অট্টালিকা দেখিতে পাইলাম, সদানন্দবাবু অঙ্গুলি নিৰ্দ্দেশে সেই বাড়ী দেখাইয়া বলিলেন, “ঐ বাড়ীতে আমি থাকি, অনুগ্রহ করিয়া আমার বাড়ীতে একবার পদার্পণ করিয়া যান, বেশী দূর নয়।”
আমার প্রথম মনে হইল যে, রাজা মণিভূষণের পাশ ছাড়িয়া থাকা আর আমার উচিত নহে; কিন্তু তিনি রাশীকৃত কাগজপত্র লইয়া বসিয়াছেন, সমস্ত দেখিয়া শেষ করিয়া উঠিতে অনেক সময়ের প্রয়োজন, এদিকে গোবিন্দরাম আমায় বিশেষ করিয়া বলিয়াছেন যে, রাজার সমস্ত প্রতিবেশীকে খুব ভাল করিয়া দেখা প্রয়োজন; সদানন্দ একজন প্রতিবেশী, ইহার সম্বন্ধেও দেখা আবশ্যক, সুতরাং এই সুবিধা, ইহার বাড়ীতে কিয়ৎক্ষণের জন্য গেলে ক্ষতি কি? আমি বলিলাম, “চলুন, আপনার বাড়ী দেখিয়া আসি।”
তখন আমরা দুই জনে মাঠের ক্ষুদ্র পথ ধরিয়া চলিলাম।
একবিংশ পরিচ্ছেদ
মাঠের উভয় পার্শ্বই কঙ্করবালুকাকীর্ণ, সেই কঙ্কর ও বালুকার সহিত ক্ষুদ্র বৃহৎ কত প্রস্তরখণ্ড চারিদিকে বিক্ষিপ্ত। স্থানে স্থানে প্রস্তরস্তূপ ও গহ্বর রহিয়াছে।
সদানন্দবাবু বলিলেন, “আমাদের এই স্থানের ন্যায় বাঙ্গালা দেশে আর কোন স্থান নাই, এটাকে একটা মরুভূমি বলিলেও চলে, অনেক স্থানে কি আছে না আছে, তাহা কেহই জানে না। ঐ যে ঐ দিক্টা দেখিতেছেন, ওখানে একটা জলা আছে; বোধ হয়, কোন সময়ে একটা বড় নদী ছিল, এখন কেবল বালি—কেবল বালি, তাহাও চোরাবালি, কেহ ঐ বালিতে পড়িলে আর তাহার রক্ষা পাইবার কোন উপায় নাই; কিন্তু এই সকল স্থান কেহ ভাল করিয়া দেখে নাই।”
আমি। আপনি দেখিয়াছেন?
সদানন্দ। আমি কেবল দুই বৎসর হইল, এখানে আসিয়া বাস করিতেছি। তবে ছেলেবেলা হইতে নির্জ্জন স্থানে বেড়াইতে আমার সখ, তাহাই আমি এ স্থানটা যতদূর দেখিয়াছি, বোধ হয়, এদেশের আর কেহ তত দেখে নাই।
আমি। যে রকম স্থান—দেখাও বড় সহজ নহে।
স। ঠিক কথা, ঐ যে মাঠটা ধু ধু করিতেছে, দেখিতেছেন—
আমি। হাঁ, দূর হইতে বোধ হয়, যেন ঘোড়দৌড়ের মাঠ।
সদানন্দ হাসিয়া বলিলেন, “ঘোড়দৌড়ের মাঠই বটে? ঐটী হইল, বড় বাঁকির চোরাবালি। মাঠ ভাবিয়া কত লোক যে ওখানে গিয়া মরিয়াছে, তাহার সংখ্যা হয় না। কত জন্তু যে জল খাইতে গিয়া মরিয়াছে, তাহাও বলা যায় না। কাল একটা গরু মারা গিয়াছে, অথচ আমি ঐ চোরাবালির মধ্য দিয়া যাইতে পারি। আবার প্রাণ লইয়া ফিরিয়া আসিতে পারি। উহার কোন্খানটা শক্ত আর কোন্খানটা চোরাবালি তাহা আমি ব্যতীত আর কেহ জানে না—কি ভয়ানক! ঐ দেখুন ঐ চোরাবালিতে আবার আজ একটা গরু পড়িয়াছে।”
আমি দেখিলাম, একখণ্ড শুভ্র বস্ত্রের মত কি যেন একটা মাঠের উপর গড়াগড়ি দিতেছে। পরক্ষণে একটা গরুর কাতর আর্ত্তনাদে সেই প্রান্তরের চারিদিক্ প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। এই ভয়াবহ দৃশ্যে আমার প্রাণ কাঁপিয়া উঠিল, কিন্তু দেখিলাম, সদানন্দবাবু কিছুমাত্র বিচলিত হইলেন না।
তিনি বলিলেন, “ঐ গেল—গিয়াছে, চোরাবালি গিলিয়া ফেলিয়াছে! এই দুই দিনে দুইটা গেল। বেচারিরা জলের লোভে গিয়া প্রাণ হারায়। এই রকম কত যে মরেছে, তাহা কে বলিবে? ভয়ানক স্থান, বড় বাঁকির চোরাবালি—বড় ভয়ানক স্থান।”
আমি। আর আপনি বলিতেছেন যে, আপনি এই ভয়ানক স্থানে যাইতে পারেন।
সদানন্দ। হাঁ, দুই-একটা সহজ পথ ইহার ভিতর দিয়া আছে, আমি তাহা খুঁজিয়া বাহির করিয়াছিলাম।
আমি। এ রকম ভয়ানক স্থানে আপনি গিয়াছিলেন কেন?
স। চোরাবালির ওপারে ঐ পাথরের স্তূপগুলিতে সুন্দর সুন্দর ফুল ফোটে, ফুল সংগ্রহ করা আবার আমার একটা মস্ত সখ, তাই মাঝে মাঝে যাই। আপনি একদিন যাবেন?
আমি। (সহাস্যে) রক্ষা করুন, মহাশয়। আমার এমন সাংঘাতিক সখ নাই।
স। খুব ভাল—খুব ভাল। আমি ভিন্ন আর কাহারও সেখানে গেলে রক্ষা পাইবার সম্ভাবনা নাই।
সহসা সমস্ত নিৰ্জ্জন প্রান্তর প্রতিধ্বনিত করিয়া একটা কি ভয়ানক কর্কশ ধ্বনি উত্থিত হইল। আমি বিস্ময়চকিত ভাবে বলিয়া উঠিলাম, “একি—একি!” সেই ভীষণ শব্দ ক্রমে দূরে— বহু দূরে গিয়া বাতাসে মিলিয়া গেল। সদানন্দবাবু আমার মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “মহাশয়, আমাদের এ মাঠ অতি অদ্ভুত স্থান।
আমি জিজ্ঞাসিলাম, “এ কি! এ কিসের শব্দ?”
সদানন্দবাবু বলিলেন, “এ দেশের চাষারা বলে, রাজবংশের কুকুর-ভূত আহারের জন্য চীৎকার করিতেছে। আমিও এ শব্দ দুই-একবার শুনিয়াছিলাম, কিন্তু কোনবারই এমন ভয়ানক চীৎকার শুনি নাই।”
আমি সভয়ে চারিদিকে চাহিলাম। চারিদিকেই—যতদূর দৃষ্টি যায়, কেবলই সেই জনশূন্য প্রান্তর—বিস্তৃত মরু-ভয়াবহ স্থান! যতদূর দেখা যায়, একটী পাখী পৰ্য্যন্ত নাই! আমি তাঁহাকে বলিলাম, “আপনি শিক্ষিত লোক, আপনিও কি এই সকল পাগলামী বিশ্বাস করেন? এরূপ অদ্ভুত শব্দের কারণ কি আপনি মনে করেন?”
তিনি বলিলেন, “ঠিক বলিতে পারি না, এই মাঠের মধ্যে অনেক অদ্ভুত গহ্বর আছে, তাহাতে বাতাস গিয়াও এই রকম শব্দ হইতে পারে।”
আমি বলিলাম, “ —না, এ শব্দ সে রকম শব্দ নয়, ইহা নিশ্চয়ই কোন জীবিত প্রাণীর শব্দ।”
“খুব সম্ভব, এ দেশে একরকম পাখী আছ, তাহারা অদ্ভুত রকম ডাকে। আপনি এ রকম পাখীর ডাক কখনও শুনিয়াছেন?”
“না, এ রকম পাখী দেখি নাই।”
“আমার বোধ হয়, সেই রকম কোন পাখীর শব্দ আমরা শুনিলাম।”
“এ রকম শব্দ আমি আর কখনও শুনি নাই।”
“এ স্থানটাই অদ্ভুত—আঃ কি চমৎকার ফুল!”
এই বলিয়া পথ ছাড়িয়া মাঠে নামিয়া সদানন্দবাবু ছুটিলেন। তিনি সেই চোরাবালির দিকে ছুটিলেন, আমার প্রাণ কাঁপিয়া উঠিল, আমি দেখিতে পাইলাম, অতি দূরে একস্থানে কতকগুলি ফুল ফুটিয়া রহিয়াছে, কিন্তু তাহা এতদূরে রহিয়াছে যে, সে যে কি ফুল, তাহ বুঝিতে পারিলাম না। সদানন্দবাবু দিগ্বিদিক্ জ্ঞানশূন্য হইয়া মাঠের উপর দিয়া সেই ফুলগুলির দিকে ছুটিলেন। কেহ ফুলের জন্য এমন পাগল হইতে পারে, তাহা আমার বিশ্বাস ছিল না।
আমি কি করিব, গড়ের দিকে ফিরিয়া যাইব, না সদানন্দবাবুর জন্য অপেক্ষা করিব ভাবিতেছি, এই সময়ে পশ্চাতে পদশব্দ শুনিয়া ফিরিলাম। দেখিলাম, একটী পরম রূপবতী রমণী।
দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ
সেই রমণীর পরিধানে একখানি শুভ্র থান, দেহে একখানিও অলঙ্কার নাই, সীমন্তে সিন্দুরচিহ্নও নাই। সুতরাং এই সুন্দরী, যে বিধবা, তাহা তাহাকে দেখিলেই বুঝিতে পারা যায়। কথায় কথায় আমরা প্রায় সদানন্দবাবুর বাড়ীর নিকট আসিয়াছিলাম, নিকটে আর কোন বাড়ী নাই, নলিনাক্ষবাবুর নিকট শুনিয়াছিলাম, সদানন্দবাবুর এক বিধবা ভগিনী আছেন, সুতরাং ইহাকে দেখিয়া আমি মনে করিলাম, ইনিই সদানন্দের সেই বিধবা ভগিনী হইবেন।
সহসা এই নির্জ্জন প্রান্তর মধ্যে ইঁহাকে দেখিয়া আমি কি বলিব, কি করিব, তাহা স্থির করিতে পারিলাম না, পথ ছাড়িয়া সরিয়া দাঁড়াইতেছিলাম, কিন্তু তিনি অর্দ্ধস্ফুট স্বরে বলিলেন, “যাও—পার ত আজই কলিকাতায় ফিরিয়া যাও।”
আমি অতি বিস্ময়ে বিস্ফারিত নয়নে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলাম। এই স্ত্রীলোক একি বলিতেছে?
রমণী আরও অধীর হইয়া বলিল, “এখনই—এখনই চলিয়া যাও—কলিকাতায় ফিরিয়া যাও।
আমি এবার কথা কহিলাম, বলিলাম, “কেন, আমি কালকাতায় ফিরিয়া যাইব কেন?”
রমণী হাঁপাইতে হাঁপাইতে কহিল, “কেন তাহা বলিবার উপায় নাই। ভাল চাও ত আজই এখনই কলিকাতায় ফিরিয়া যাও, কখনও এই মাঠে আসিও না।”
আমি। আমি কেবল নূতন এখানে আসিয়াছি।
রমণী। (ব্যাকুল ভাবে) তা জানি—তা জানি। ভালর জন্য বলিলেও কি তাহাতে সন্দেহ হয়? যাও,—আজই এখান হইতে চলিয়া যাও—পালাও—প্রাণের মায়া থাকে ত পালাও—চুপ, আমার ভাই আসিতেছে। উহাকে যেন আমার কথা কিছুতেই বলিও না—আমি চলিলাম।”
রমণী মুহূর্তমধ্যে অন্তর্হিত হইল। আমি কিছুই বুঝিতে না পারিয়া স্তম্ভিত হইয়া সেইখানে দণ্ডায়মান রহিলাম।
এই সময়ে ফুল লইয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে সদানন্দবাবু তথায় উপস্থিত হইলেন। তাঁহার ফুলের সাজি সুন্দর ফুলে পরিপূর্ণ; তিনি সগর্ব্বে বলিলেন, “ডাক্তার বাবু, এমন সুন্দর ফুল আর দেখিয়াছেন কি? আমি ফুলের জন্য পাগল, আমি ফুল যত ভালবাসি, তত আর কিছু ভালবাসি না। আসুন, গরিবের আস্তানাটা একবার দেখিয়া যান।”
তখন আমরা দুইজনে কিয়দ্দূর অগ্রসর হইয়া একটা সুন্দর ক্ষুদ্র অট্টালিকার সম্মুখে আসিলাম, বাড়ীর সম্মুখে একটী ক্ষুদ্র সুন্দর পুষ্পোদ্যান; দেখিলেই স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায় যে, এই গৃহের গৃহস্বামী ফুল বড়ই ভালবাসেন। বাগানময় নানা রঙ্গের সুন্দর ফুল ফুটিয়া আছে।
তবে বাড়িটা বড়ই নিৰ্জ্জন, নিকটে আর কাহারও বাড়ী নাই, যতদূর দেখা যায়, কেবলই কঙ্করপূর্ণ জনশূন্য মাঠ। এমন শিক্ষিত লোক কেন এমন নিৰ্জ্জনস্থানে আসিয়া বাস করিতেছেন, তাহা আমি ভাবিয়া স্থির করিতে পারিলাম না।
সদানন্দ যেন আমার মনের ভাব বুঝিয়াই বলিলেন, “বড় নিৰ্জ্জন স্থান, নয় কি ডাক্তার বাবু?”
আমি বলিলাম, “খুব নিৰ্জ্জন স্থান সন্দেহ নাই।”
তিনি কহিলেন, “এক সময়ে পশ্চিমে আমি স্কুল-মাষ্টারী করিতাম, কিন্তু চিরকাল স্কুলে পড়াইতে আর ভাল লাগিল না। পৈত্রিক সম্পত্তি কিছু ছিল, তাহাই ভাবিলাম, কোন নিৰ্জ্জন স্থানে গিয়া জীবনের শেষাংশটা কাটাইয়া দিব। তাহার পর এই স্থানটা বড় ভাল লাগায় এই বাড়ীটা কিনিয়া সেই পৰ্য্যন্ত এখানে এই ফুলের মধ্যে জীবন কাটাইতেছি।”
আমি জিজ্ঞাসিলাম, “স্থানটা এমন নিৰ্জ্জন বলিয়া আপনার কষ্ট হয় না?”
তিনি কহিলেন, “বিন্দুমাত্র না, ফুল আর বই লইয়া আছি। তাহার পর ডাক্তার নলিনাক্ষ বাবু আছেন, তিনি বড় ভাল লোক, সর্ব্বদাই তাঁহার বাড়ীতে যাই। এখন আবার এই নূতন রাজা হইলেন, আমি তাঁহার সঙ্গে দেখা করিতে গেলে তিনি বোধ হয়, বিরক্ত হইবেন না।”
আমি কহিলাম, “কেন হইবেন? এখানে ভদ্রলোকের বাস নাই বলিলেই হয়। আপনার সঙ্গে আলাপ হইলে তিনি খুব খুসী হইবেন।”
তিনি বলিলেন, “তাহা হইলে তাঁহাকে বলিবেন, আমি তাঁহার সঙ্গে দেখা করিতে যাইব। এ রকম স্থানে থাকিতে তাঁহার মত লোকের নিশ্চয়ই প্রথম প্রথম বড় কষ্ট হইবে, তবে আমাদের দ্বারা যতদূর হয়, তাঁহার যাহাতে এখানে আসিতে কষ্ট না হয়, তাহা আমরা করিব। আসুন, এইবার আমার বইগুলি দেখুন।”
আমি বহুক্ষণ রাজা মণিভূষণকে একাকী ফেলিয়া আছি, গোবিন্দরামের ইহা হুকুম নহে, সুতরাং আমার আর সদানন্দবাবুর বাড়ী অধিকক্ষণ বিলম্ব করা কর্ত্তব্য নহে। তাহার নিকট হইতে আমি বিদায় লইলাম।
ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ
আমি সেই ক্ষুদ্র পথ দিয়া অনেকদূর আসিয়াছি, একটা বাঁক ফিরিয়া দেখি, সম্মুখে সেই পূর্ব্বদৃষ্টা শুক্লবসনা রমণী—সদানন্দবাবুর ভগিনী। তিনি আমার পূর্ব্বে এখানে কিরূপে উপস্থিত হইলেন? বুঝিলাম, মাঠ দিয়া এমন কোন পথ আছে, যাহাতে এই স্থানে সহজে ও শীঘ্র আসা যায়।
আমাকে দেখিয়া তিনি বলিলেন, “আপনার সঙ্গে দেখা করিবার জন্য আমি ছুটিয়া আসিয়াছি। আমি দেরী করিব না, তাহা হইলে আমার ভাই সন্দেহ করিবেন, আমার অনুসন্ধান করিবেন। আমি আপনাকে আমার নিজের ভুলের কথা বলিতে আসিয়াছি, আমি আগে মনে করিয়াছিলাম, আপনি এখানকার নূতন রাজা, পরে আমার ভাইএর কাছে শুনিলাম, তাহা নহে, আপনি তাঁহার বন্ধু। আমি যাহা আপনাকে বলিয়াছিলাম, তাহা ভুলিয়া যান।”
আমি বলিলাম, “আপনার কথা ভুলিয়া যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। আমি রাজা মণিভূষণের বন্ধু, তাঁহার বিষয় যাহা আমার বিষয়ও তাহাই। আপনি কেন ইচ্ছা করেন যে, তিনি এখান হইতে চলিয়া যান, এ কথা আমার জানা উচিত।”
রমণী। স্ত্রীলোকের বাজে কথায় কান দিবেন না। আমার স্বভাবই ঐ রকম। যা তা একটা বলিয়া ফেলি, আর তার মানে খুঁজিয়া পাওয়া যায় না।
আমি। না, আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা প্রকৃত কথা নহে। আপনি যদি মণিভূষণের প্রকৃত হিতাকাঙ্ক্ষিণী হয়েন, তাহা হইলে আপনার সমস্ত কথা আমাকে খুলিয়া বলা উচিত। এখানে আসিয়া পৰ্য্যন্ত আমি দেখিতেছি, যেন আমাদের উপরে অলক্ষ্যে কি একটা ষড়যন্ত্র হইতেছে। এই নির্জ্জন মাঠের মত, আমার মনও সম্পূর্ণ যেন শূন্য হইয়া পড়িয়াছে। রাজার কি বিপদের আশঙ্কা আপনি করিতেছেন, আমার খুলিয়া বলুন। আমি আপনার কথা তাঁহাকে বলিব।”
রমণী কয়েক মুহূর্ত্তের জন্য যেন ইতস্ততঃ করিলেন, তাহার পর বলিলেন, “আপনি সামান্য কথাকে অতি গুরুতর করিয়া তুলিতেছেন। আমার ভাই ও আমি আমরা দুইজনেই মৃত রাজাকে বড় ভক্তি ও মান্য করিতাম, তাঁহার এই রকম হঠাৎ মৃত্যুতে আমাদের মনে কেমন এক রকম ভয় হইয়াছে। এখানে আসিলে নূতন রাজারও মৃত্যু হইতে পারে, ভয়ে আমি না বুঝিয়া অবোধ স্ত্রীলোকের ন্যায় ঐ কথা বলিয়াছিলাম। আপনি সে কথা ভুলিয়া যান। স্ত্রীলোকের বাজে কথায় আপনি মন দিবেন না।”
আমি। তবুও দেখিতেছি, আপনি নূতন রাজার কোন বিপদ্ হইবার আশঙ্কা করিতেছেন। কি বিপদের ভয় করেন, বলুন।
র। আপনি এখানকার কুকুর ভূতের কথা শুনিয়াছেন কি?
আমি। শুনিয়াছি—এ রকম পাগলামী কথা আমি বিশ্বাস করি না।
র। আপনি না করেন, আমি করি। যদি নূতন রাজা আপনার কথা শুনেন, তাহা হইলে এখনই তাঁহাকে এখান হইতে লইয়া যান, বিপদের মধ্যে আসিতে তাঁহার ইচ্ছা কেন?
আমি। তিনি বিপদকে ভয় করেন না।
রমণী। কেন?
আমি। ভূত ছাড়া প্রকৃত কোন বিপদের প্রমাণ না পাইলে তিনি এখান হইতে একপদ নড়িবেন না।
র। (হতাশ ভাবে) তাহা হইলে আমি আর কি বলিব?
আমি। আমি আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাহি। ইহা ছাড়া যদি আর কিছু আপনার মনে না থাকিবে, তবে আপনি আপনার ভাইএর নিকট এ কথা লুকাইতে এত বাগ্ৰ হইয়াছিলেন কেন? অবশ্যই আরও কিছু আছে।
র। আমার ভাইএর ইচ্ছা নয় যে গড়ে নূতন রাজা না থাকুক, তিনি না থাকিলে এ দেশের অনেক হানি, এইজন্য আমি রাজাকে চলিয়া যাইতে বলিতেছি, শুনিলে তিনি রাগ করিবেন, তাহাই তাঁহাকে কোন কথা বলিতে বারণ করিয়াছিলাম, আর দেরি করিব না, তিনি হয়ত আমায় খুঁজিতেছেন, আমি যাই।
আমাকে আর কোন কথা বলিবার অবসর না দিয়া রমণী মাঠের নিম্নবর্ত্তী খাদের পথে অন্তর্হিত হইয়া গেল। পরে জানিয়াছিলাম, এই স্ত্রীলোকের নাম মঞ্জরী।
আমি এই অদ্ভুত স্থানের অদ্ভুত ব্যাপারের কিছুই বুঝিতে না পারিয়া চিন্তিত মনে ধীরে ধীরে গড়ে ফিরিলাম। দেখিলাম তখনও রাজা তাঁহার কাগজপত্র লইয়া মহা ব্যস্ত আছেন। তাঁহাকে নিরাপদ দেখিয়া আমার মন স্থির হইল। গোবিন্দরাম বিশেষ করিয়া বলিয়া দিয়াছিলেন, যেন আমি এক মুহূর্ত্তের জন্যও রাজাকে ছাড়িয়া অন্যত্রে না যাই, সুতরাং এতক্ষণ তাঁহার নিকটে অনুপস্থিত থাকায়, আমি প্রকৃতই বিশেষ চিন্তিত ও ব্যগ্র হইয়াছিলাম। এক্ষণে তাঁহার নিকট আসিয়া নিশ্চিন্ত হইলাম।
চতুৰ্ব্বিংশ পরিচ্ছেদ
এখন হইতে আমি গোবিন্দরামকে সে সময় নন্দনপুরের যে সকল বিষয় পত্রে লিখিয়াছিলাম, তাহাই এখানে অবিকল উদ্ধৃত করিতেছি। এই সকল পত্রের কেবল একটামাত্র পৃষ্ঠা হারাইয়া গিয়াছে, নতুবা আর সমস্তই ঠিক আছে। নন্দনপুরে যাহা কিছু করিয়াছিলাম, যাহা কিছু শুনিয়াছিলাম, সে সম্বন্ধে যাহা কিছু ভাবিয়াছিলাম, তাহা সমস্তই আমি এই সকল পত্রে লিপিবদ্ধ করিয়াছিলাম।
প্রথম পত্র—প্ৰথমাংশ।
নন্দনপুরের গড়।
প্রিয় গোবিন্দরাম,
এই নির্জ্জন স্থানে যাহা কিছু ঘটিয়াছে, তাহা সমস্তই তুমি আমার পূর্ব্ব পত্রে জানিতে পারিয়াছে। এখানে যত অধিক দিন থাকিতেছি, ততই যেন এ নির্জ্জন মরুসম মাঠের নির্জ্জনতা আমার প্রাণের ভিতর বসিয়া যাইতেছে। এরূপ ভয়াবহ নিৰ্জ্জন স্থান যে সংসারে কুত্রাপি আছে, তাহা আমি পূর্ব্বে কখনও ভাবি নাই। তবে এই দুরতিক্রম্য মাঠের বিষয় বর্ণন করিবার জন্য তুমি আমাকে পাঠাও নাই, সুতরাং রাজা মণিভূষণ সম্বন্ধে যাহা ঘটিয়াছে, তাই লিখিতেছি।
এ কয়দিন যে, পত্র লিখি নাই, তাহার কারণ এ কয়দিন কিছুই লিখিবার মত ছিল না, তবে সম্প্রতি একটা ব্যাপার ঘটিয়াছে, তাহার বিষয় পরে লিখিতেছি, উপস্থিত অন্য দুই-একটা কথ বলি।
সুরীর জেল হইতে একজন দুৰ্দ্দান্ত ডাকাত পলাইয়াছে, তাহার নাম হারু। অনেক জেলার লোকেই তাহার উপদ্রবে অস্থির হইয়া উঠিয়াছিল। তাহার পর হারু ধরা পড়িয়া সুরীর জেলে ছিল, তাহার বিচার হইতেছিল, এই সময়ে সে পালাইয়াছে।
সকলেই ভাবিয়াছিল যে, সে-ই এই দুর্গম মাঠের কোনখানে লুকাইয়া আছে। লুকাইয়া থাকিবার এমন চমৎকার স্থানও আর নাই। এই মাঠে এত গৰ্ত্ত খানা ডোবা আছে যে, এখানে কেহ লুকাইলে, তাহাকে খুঁজিয়া বাহির করা অসম্ভব। তবে প্রায় পনের দিন হইল, সে জেল হইতে পলাইয়াছে, এতদিন সে অনাহারে এই মাঠে কখনই বাঁচিয়া থাকিতে পারে না, তাই সকলে ভাবিতেছে যে, সে কোন রকমে অন্যত্র পলাইয়া গিয়াছে। তাহার ভয়ে এ দেশের সকলে সশঙ্ক ছিল, এখন তাহারা অপেক্ষাকৃত নিরুদ্বিগ্নচিত্তে নিদ্রা যাইতেছে।
আমাদের গড়ে তাহাকে ভয় করিবার কোন কারণ ছিল না; সে আসিলে আমরা অনায়াসেই তাহার ব্যবস্থা করিতে পারিতাম, তবে সদানন্দবাবুর জন্য আমি ও মণিভূষণ উভয়েই একটু চিন্তিত হইলাম। তিনি কেবলমাত্র একজন চাকর লইয়া এই নির্জ্জন বাড়ীতে বাস করেন। হারু ডাকাতের ন্যায় ভয়ানক লোক তাঁহার বাড়ীতে কোন রাত্রে আবির্ভূত হইলে তাঁহাদের রক্ষা পাওয়া অসম্ভব। তাই রাজা রাত্রে সদানন্দবাবুর বাড়ীতে থাকিবার জন্য দুইজন লোক সেখানে পাঠাইয়া দিয়াছিলেন—কিন্তু সদানন্দবাবু তাহাদের ফিরাইয়া দিয়াছেন। তিনি বলেন, হারু ডাকাতের মত একশত ডাকাত তাঁহার কি করিবে? বিশেষতঃ তাঁহার কি আছে যে, সে লইবে?
নূতন রাজার, সদানন্দ বাবুর দিকে এত টানিবার একটা কারণও হইয়াছে। তিনি মঞ্জরীকে দেখিয়াছেন, মঞ্জরী সুন্দরী, রূপবতী, যুবতী, মণিভূষণের ন্যায় যুবকের মন যে তাহার দিকে আকৃষ্ট হইবে, তাহাতে আশ্চর্য্য কি। তবে সদানন্দ ভগিনীকে চোখে চোখে রাখেন; যতদূর দেখিয়াছি, তাহাতে মঞ্জরীকে সচ্চরিত্রা বলিয়া বোধ হয়। আরও যতদূর দেখিলাম, সদানন্দের ইচ্ছা নহে যে, নূতন রাজা কোনরূপে তাঁহার ভগিনীর সহিত আলাপ করিতে পান। আর ইহাও তাঁহার কর্তব্য।
এখন সদানন্দবাবু প্রায়ই গড়ে আসেন, আমরা দুইজনে তাঁহার সঙ্গে গড়ের চারিদিকে এবং এই নির্জ্জন মাঠের নানাস্থানে বেড়াইয়াছি। যে স্থানে মৃত রাজার দেহ পাওয়া গিয়াছিল, তিনি মণিভূষণকে তাহা দেখাইয়াছেন; মাঠের এক স্থান দেখাইয়া বলিয়াছেন, “শোনা যায়, এইখানে নাকি আপনার সেই খুল্লতাত কুকুর-ভূতের হাতে মারা যান।”
মণিভূষণবাবু সদানন্দকে জিজ্ঞাসা করিয়াছেন, “আপনি এ সব বিশ্বাস করেন?”
সদানন্দ বলিয়াছেন, “বিশ্বাস করি না—তবে কিছু বুঝিতেও পারিতেছি না।”
সদানন্দবাবু ছাড়া ভূতনাথ বলিয়া একজন বৰ্দ্ধিষ্ণু কৃষকের সহিত আমার আলাপ হইয়াছে। তুমি নিকটস্থ সকল লোকের সন্ধান লইতে বলিয়াছিলে বলিয়া ইহারও সহিত আলাপ করিয়াছি। এই লোকটার চরিত্র অতি অদ্ভুত, ইহার বেশ জমি-জমাও আছে, বাড়ীতে পাঁচ-সাতটা ধানের মরাই—তবে ইহার এক মহা রোগ—মোকদ্দমা। সত্য মিথ্যা কোন-না-কোন মোকদ্দমা লইয়াই আছে—যেন মোকদ্দমাই তাহার জপমালা; এখনও আসামী ও ফরিয়াদী হিসাবে বোধ হয়, সাত-আটটা মোকদ্দমা চালাইতেছে। কথায় কথায় মোকদ্দমা ও সর্ব্বদাই আদালত-ঘর করিয়া সে খুব সন্তুষ্ট আছে।
যাহা হউক, এখন হারু ডাকাত, সদানন্দ বাবু, ডাক্তার নলিনাক্ষ, আর এই ভূতনাথের কথা রাখিয়া তোমাকে এখন অনুপ ও তাহার স্ত্রীর সম্বন্ধে দুই-একটা কিছু বলিব। বিশেষতঃ কাল রাত্রে যাহা হইয়াছে, এখন তাহাই বলিতেছি।
পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ
প্রথম পত্র—দ্বিতীয়াংশ।
প্রথমে সেই টেলিগ্রামের কথা হইতে আরম্ভ করি। সেদিন অনুপ গড়ে ছিল কি ছিল না, দেব মের পোষ্টমাষ্টারের কথায় কিছুই প্রমাণ পাওয়া যায় না। আমি মণিভূষণকে সমস্তই বলিয়াছিলাম। তিনি তখনই অনুপকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “টেলিগ্রামখানা পাইয়াছিলে?”
অনুপ বলিল, “হাঁ, পাইয়াছিলাম।”
“পিয়ন তোমার নিজের হাতে সেখানা দিয়াছিল?”
অনুপ বিস্মিতভাবে মনিবের মুখের দিকে চাহিল, চাহিয়া বলিল, “না, আমি তখন ভিতরে ছিলাম। আমার স্ত্রী পিয়নের কাছ থেকে লইয়া আমাকে দিয়া দিয়াছিল।”
“তুমি কি নিজে জবাব দিয়াছিলে?”
“হাঁ, নিজে দিয়াছিলাম।”
তখন আর এ সম্বন্ধে কোন কথা হইল না। সন্ধ্যার পর অনুপ নিজে আবার একথা তুলিল, বলিল, “আপিন কিজন্য টেলিগ্রামখানার কথা এভাবে জিজ্ঞাসা করিতেছেন, তাহা আমি জানি না। আপনি কি আমায় অবিশ্বাস করিতেছেন?”
রাজা বলিলেন, “না—না—তোমার অবিশ্বাস করিব কেন? তোমরা আমাদের বংশের পুরাতন কৰ্ম্মচারী।”
তাহাকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য মণিভূষণ নিজের অনেক ভাল ভাল জামা, কাপড়, জুতা বকসিস্ দিলেন। অনুপ অনেক আশ্বস্ত হইল।
অনুপের স্ত্রীর উপর আমি বিশেষ নজর রাখিয়াছিলাম; তাহার মুখ দেখিলে তাহাকে ধূৰ্ত্তা বলিয়া বোধ হয় না, তবুও তাহাকে সন্দেহ করিবার বিশেষ কারণ ছিল। সে-ই যে সেদিন কাঁদিয়াছিল, তাহাতে আমার কোন সন্দেহ নাই। পরন্তু দুই-একদিন তাহার মুখ দেখিয়া ক্রন্দনের চিহ্ন দেখিয়াছি। কখনও আমার মনে হয় সে কোন গর্হিত কার্য্যের জন্য অনুতাপে কাঁদে, কখনও আমার মনে হয় যে, অনুপ হয়ত তাহাকে গোপনে প্রহার করে, তাহার উপর অত্যাচার করে। ইহা সত্য হউক, মিথ্যা হউক, অনুপ লোকটা যে সন্দেহজনক তাহাতে আমার কোন সন্দেহ নাই। আর কাল রাত্রে সে যাহা করিয়াছে, তাহাতে আমার সন্দেহ আরও বৃদ্ধি পাইয়াছে। তবে দেখিতে গেলে ব্যাপারটা কিছুই নয় বলিলেও হয়। তুমি ত জান যে রাত্রে আমার ভাল ঘুম হয় না, একটুতেই জাগিয়া উঠি। কাল রাত্রি দুইটার সময় সে আমার ঘরের সম্মুখের বারান্দা দিয়া পা টিপিয়া টিপিয়া যাইতেছিল, তাহাতেই আমার ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল।
আমি নিঃশব্দে বিছানা হইতে উঠিয়া দরজা দিয়া উঁকি দিয়া দেখিলাম, কে একজন একটা প্রদীপ হাতে লইয়া পা টিপিয়া টিপিয়া যাইতেছে। সে যেভাবে যাইতেছিল, তাহাতে তাহাকে দেখিলেই সন্দেহ হয় যে, নিশ্চয়ই তাহার মনে কোন দুরভিসন্ধি আছে।
বারান্দাটা ঘুরিয়া বাহিরের দিকে গিয়াছে—লোকটাও সেইদিকে গেল, সে দৃষ্টির বাহিরে যাইবামাত্র, আমিও নিঃশব্দে পা টিপিয়া টিপিয়া তাহার অনুসরণ করিলাম। ঘুরিয়া অন্যদিকে আসিয়া দেখিলাম, সে একটা ঘরে প্রবেশ করিয়াছে।
বাড়ীর এই সকল ঘরে কেহ থাকিত না, সুতরাং এই খালি ঘরে অনুপকে এত রাত্রে আসাটা আরও সন্দেহজনক হইয়া উঠিল। আমি উঁকি দিয়া দেখিলাম, জানালার কাছে আলোটা রাখিয়া, সে জানালায় মুখ বাড়াইয়া মাঠের দিকে কি দেখিতেছে—যেন কি দেখিবার জন্য ভারি ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছে; প্রায় তিন-চারি মিনিট সে এই ভাবে দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার পর একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া, আলোটা নিবাইয়া দিল। আমিও অন্ধকারে পা টিপিয়া টিপিয়া নিজের ঘরে আসিয়া শুইয়া পড়িলাম।
যখন আবার আমার তন্দ্রা আসিয়াছে, তখন যেন শুনিলাম, কে দূরে কোন একটা ঘরে চাবি লাগাইতেছে। কোথায় কে চাবি লাগাইতেছে, তাহা ঠিক করিতে পারিলাম না। অনুপের কাৰ্য্যকলাপ সম্বন্ধে কোনরূপ বিশদ তাৎপৰ্য্য গ্রহণে আমি আপাততঃ অক্ষম হইলেও সে যে এই বাড়ীতে কোনও গুরুতর রহস্যে জড়িত আছে, সে বিষয়ে আমার আর কোন সন্দেহ রহিল না। এই রহস্য কি তাহা অবগত হইবার জন্য আমি বিশেষ ব্যগ্র হইলাম। আমি নিজে এ সম্বন্ধে কি ভাবিতেছি, তাহা বলিয়া তোমায় বিরক্ত করিব না, তুমি তাহা শুনিতেও চাও নাই। হয়ত তাহাতে আমি তোমাকে ভুলপথে লইয়া যাইতে পারি; সুতরাং নিজের মন্তব্য অনাবশ্যক। যাহা প্রকৃত পক্ষে এখানে ঘটিতেছে, আমি তোমায় তাহাই লিখিতেছি, তুমিও কেবল তাহাই শুনিতে চাহিয়াছ। আমি রাজা মণিভূষণকে গত রাত্রের সমস্ত ঘটনা বলিয়াছি, তাহার পর আমাদের কৰ্ত্তব্য সম্বন্ধে বিশেষ পরামর্শ করিয়া যাহা স্থির করিয়াছি, সে কথা এখন বলিব না—পরে যে পত্র লিখিব, তাহাতেই সে সমস্ত লিখিব
ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ
প্রিয় গোবিন্দরাম,
দ্বিতীয় পত্র-প্রথম অংশ।
পূর্ব্বে তোমায় অধিক কিছু লিখিতে পারি নাই, তাহার কারণ তখন বিশেষ কিছু লিখিবার ছিল না। এখন ঘটনার উপর ঘটনা, রহস্যের উপর রহস্য ঘটিতেছে। সুতরাং এখন লিখিবার অনেক বিষয় হইয়াছে। আমার আগেকার পত্রে অনুপের গভীর রাত্রে নিৰ্জ্জন ঘরে যাইবার কথা তোমার লিখিয়াছিলাম, এখন তাহার সম্বন্ধে আরও অনেক কথা লিখিবার হইয়াছে।
যাহা আমি কখনও ভাবি নাই, তাহাই ঘটিয়াছে—তুমিও শুনিয়া নিশ্চয়ই আশ্চৰ্য্যান্বিত হইবে। এখন তাহার রহস্যজনক কার্য্যের অনেকটা অর্থ জানিতে পারা গিয়াছে—কিন্তু কোন কোন বিষয়ে রহস্য আরও গভীর হইয়া উঠিয়াছে।
রাত্রে যে ঘরে অনুপ গিয়াছিল, আমি দিনের বেলায় সে ঘর ভাল করিয়া দেখিলাম। যে জানালায় সে উঁকি দিয়া দেখিতেছিল, দেখিলাম, সে জানালার একটু বিশেষত্ব আছে; অন্য জানালা হইতে মাঠটা দেখা যায় না, কিন্তু এই জানালা হইতে মাঠের শেষ পর্য্যন্ত দেখা যায়। ইহাতে বোঝা যায় যে, অনুপ এই জানালা হইতে মাঠের মধ্যস্থিত কোন দ্রব্য বা কাহাকে দেখিবার জন্য চেষ্টা পাইতেছিল। রাত্রি ঘোরতর অন্ধকারে পূর্ণ ছিল, সেই অন্ধকারে দূরস্থ কিছু সে যে কিরূপে দেখিতে পাইত, তাহা আমি ভাবিয়া পাইলাম না। আমার মনে হইল যে, হয় ত অনুপ কোন প্রেমলীলায় মনোযোগ করিয়াছে, তাহার এইরূপ রাত্রে শুভ অভিসার, তাহার উপর তাহার স্ত্রীর ক্রন্দন, ইহাতে এ সন্দেহ করা একেবারে অসঙ্গত নহে। রাত্রে যে দরজা খুলিবার শব্দ শুনিয়াছিলাম, তাহাতে এ সন্দেহ আমার মনে আরও দৃঢ়তর হইল, নিশ্চয়ই অনুপ দরজা খুলিয়া কাহাকে বাড়ীর ভিতরে লইয়াছিল।
আমার মনে যাহা হইয়াছিল, আমি সমস্তই মণিভূষণকে বলিয়াছিলাম; পরে যাহা প্রকাশ পাইল, তাহাতে আমি যে সন্দেহ করিয়াছিলাম, তাহা সম্পূর্ণ মিথ্যা বলিয়াই বুঝিতে পারিলাম।
মণিভূষণকে অনুপের কথা বলায়, তিনি বিশেষ বিস্মিত হইলেন না। বলিলেন, “আমি জানি, অনুপ রাত্রে বাড়ীর ভিতর এই রকম ঘুরিয়া বেড়ায়। আমিও মনে মনে স্থির করিয়াছি, তাহাকে এ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করিব। আমিও তাহার পায়ের শব্দ রাত্রে শুনিতে পাইয়াছি।”
আমি বলিলাম, “তাহা হইলে সে প্রত্যহ রাত্রে ঐ জানালায় যায়।”
মণিভূষণ বলিলেন, “খুব সম্ভব। তাহা যদি হয়, আজ রাত্রেই তাহাকে বলিতে পারিব, সে কি করে, তাহাও জানিতে পারিব। আপনার বন্ধু গোবিন্দরামবাবু এখানে থাকিলে, তিনি কি করিতেন, তাহাই আমি ভাবিতেছি।”
আমি বলিলাম, “আপনি যাহা বলিতেছেন, বোধ হয়, তিনিও ঠিক তাহাই করিতেন। তিনিও নিশ্চয় অনুপের পিছু পিছু গিয়া দেখিতেন যে, সে এইরূপ রাত্রে কি করে।”
“তাহা হইলে আমরাও তাহাই করিব।”
“সে আমাদের পায়ের শব্দ শুনিয়া সাবধান হইয়া যাইতে পারে।”
“না, আমরা খুব সাবধানে যাইব, আর অনুপও কানে ভাল শুনিতে পায় না। আজ আপনি আমার সঙ্গে থাকিবেন, সে আমার ঘরের সম্মুখের বারান্দা দিয়া গেলে আমরা তাহার পিছু পিছু যাইব।”
রাত্রে এইরূপ কথা স্থির করিয়া আমি দেখিলাম, মণিভূষণ বাহির হইয়া যাইবার বন্দোবস্ত করিতেছেন, আমিও তাঁহার সঙ্গে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইলাম।
তিনি অন্যদিন আপত্তি করেন না, আজ বলিলেন, “ডাক্তার বাবু, আপনিও যাইবেন?” আমি বলিলাম, “মাঠের দিকে গেলে আমাকে আপনার সঙ্গে যাইতে হইবে- গোবিন্দরামের হুকুম। আপনি কি মাঠের দিকে যাইবেন?”
“হাঁ—ঐ দিকে একটু বেড়াইব, মনে করিতেছি।”
“তাহা হইলে আমাকেও সঙ্গে যাইতে হইবে। গোবিন্দরাম আমাকে কি বলিয়াছেন, তাহা বোধ হয় আপনি জানেন। আমি কিছুতেই আপনাকে মাঠে একা যাইতে দিতে পারি না।”
মণিভূষণ হাসিয়া বলিলেন, “গোবিন্দরাম বাবু খুব বিচক্ষণ হইতে পারেন, তবে তিনি সবই কি বুঝিতে পারেন? ডাক্তারবাবু, বুঝিতেই ত পরিতেছেন—যাহা হউক, আপনাকে অধিক কিছু বলিতে হইবে না; যে উদ্দেশ্যে যাইতেছি, তাহাতে আমার একা যাওয়াই দরকার হইতেছে; আপনি অন্তরায় হইবেন না।”
এ কথার উপর কথা নাই। আমি বুঝিতে পারিয়াছিলাম যে, সদানন্দ যতই সাবধান হউন না কেন, মণিভূষণ মঞ্জরীর সহিত আলাপ-পরিচয় করিয়াছেন। নিশ্চয়ই সুন্দরী মঞ্জরীর সহিত রাজা মণিভূষণ মধ্যে মধ্যে মাঠে নিৰ্জ্জনে দেখা সাক্ষাৎ করেন। মণিভূষণ যাহা বলিলেন, তাহাতে আমি কি বলিব? আমার এ অবস্থায় কি করা উচিত, তাহা আমি স্থির করিতে পারিলাম না। আমি কোন উত্তর দিবার পূর্ব্বেই তিনি ছড়ী তুলিয়া লইয়া ঘুরাইতে ঘুরাইতে গড় হইতে বাহির হইয়া গেলেন।
তিনি চলিয়া গেলে আমার মনে বড়ই কষ্ট হইল। তুমি চব্বিশ ঘণ্টা কেবল তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে থাকিবার জন্য আমাকে এই দূরদেশে পাঠাইয়াছ, বিশেষতঃ মাঠে কখনই মণিভূষণকে একাকী যাইতে দিতে নিষেধ করিয়াছে, আর আমি তাঁহাকে অনায়াসে একাকী মাঠে যাইতে দিলাম। আমার প্রাণে বড়ই কষ্ট হইল; আমি মনে করিলাম, এখনও মণিভূষণ অধিক দূর যান নাই, এখনও গেলে তাহাকে ধরিতে পারিব, আমি আর ক্ষণমাত্র বিলম্ব না করিয়া সত্বর গড় হইতে বাহির হইলাম।
বাহিরে আসিয়া মাঠের পথে মণিভূষণকে দেখিতে পাইলাম না। আমি মনে করিলাম, হয়ত তিনি অন্য কোনদিকে গিয়াছেন। তিনি কোন্ দিকে গিয়াছেন, তাহা দেখিবার জন্য আমি একটা উঁচু মাটির ঢিপির উপরে উঠিলাম। এই উচ্চস্থানে উঠিবামাত্রই আমি তাঁহাকে দেখিতে পাইলাম।
তিনি অনেক দুরে মাঠের এক নির্জ্জন স্থানে একটী স্ত্রীলোকের সঙ্গে কথা কহিতে কহিতে যাইতেছেন। দেখিলেই বোধ হয়, এই স্ত্রীলোকের সঙ্গে তাঁহার বিশেষ ঘনিষ্ঠতা জন্মিয়াছে— স্ত্রীলোকটীর ভাব দেখিয়া বুঝিলাম যে, সে বিশেষ কোন গুরুতর কথা বলিতেছে, মণিভূষণ তাহা বিশেষ মনোযোগের সহিত শুনিতেছেন এবং মধ্যে মধ্যে মস্তকান্দোলন করিয়া নিজের মতামত প্রকাশ করিতেছেন।
সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ
দ্বিতীয় পত্র—দ্বিতীয়াংশ।
আমি সেই মাটির উঁচু ঢিপির উপর দণ্ডায়মান রহিলাম; কি করিব কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। এ সময়ে তাঁহাদের নিকট গিয়া উভয়কেই লজ্জিত করা বিশেষ অন্যায় বলিয়া মনে করিলাম, অথচ এরূপভাবে ইহাদের দুইজনের গুপ্ত মিলন দেখাও যে খুব অন্যায়, তাহাও বুঝিলাম। অথচ কি করি—বাধ্য হইয়া তাহা দেখিতেও হইতেছে; ভাবিলাম ইহার পর মণিভূষণকে সকল বলিব, তাহা হইলে তিনি বিরক্ত বা রাগত হইবেন না।
তবে হঠাৎ যদি তাঁহার কোন বিপদ হয়? আমি তাঁহার নিকট হইতে এত দূরে রহিয়াছি যে, তাঁহার কোন বিপদ ঘটিলে আমি সহসা তাঁহার কোনই সাহায্য করিতে পারিব না; অথচ এ অবস্থায় উপায় কি?
আমার সম্মুখে দূরে মণিভূষণ এই স্ত্রীলোকের সহিত কথা কহিতেছেন; আমি দেখিলাম যে, কেবল আমিই এ দৃশ্য দেখিতেছি না, আর একজন লোকও তাঁহাদের দেখিতে পাইয়াছিল; আমি তাঁহাকে দেখিবা মাত্রই চিনিতে পারিলাম—তিনি সদানন্দ।
সদানন্দ তাঁহাদের দিকে যাইতেছিলেন। রাজা মণিভূষণ ও মঞ্জরী এত মনোযোগের সহিত কথা কহিতে ছিলেন যে, তাঁহারা সদানন্দের আগমন আদৌ জানিতে পারেন নাই। সহসা সদানন্দকে নিকটে দেখিয়া তাঁহারা চকিতভাবে দুইদিকে দুইজনে সরিয়া দাঁড়াইলেন। তাহার পর তাঁহাদের কি কথা হইল, তাহা আমি জানিতে পারিলাম না। তবে সদানন্দের হাত পা নাড়া দেখিয়া বুঝিলাম যে, তিনি খুব রাগত হইয়া কি বলিতেছেন। তিনি যে, মণিভূষণকে তিরস্কার করিতেছেন, তাহা তাঁহার ভাব দেখিয়া বেশ বুঝিতে পারিলাম। যাহা হউক, শেষে সদানন্দ মঞ্জরীকে লইয়া বাড়ীর দিকে চলিয়া গেলেন। মণিভূষণ কিয়ৎক্ষণ সেইখানে দাঁড়াইয়া রহিলেন, তাহার পর তিনি ফিরিলেন। আমি যেখানে দাঁড়াইয়া ছিলাম, তিনি হতাশভাবে সেইদিকে আসিতে লাগিলেন।
ইহার অর্থ কি আমি কিছুই বুঝিতে পারিলাম না; তবে আমি আমার বন্ধুর এই ব্যাপার যে, তাঁহার অসাক্ষাতে দেখিয়াছিলাম, তাহাতে বিশেষ লজ্জিত হইলাম। এ কথা তাঁহাকে বলা উচিত বিবেচনা করিয়া আমি তাঁহার সহিত দেখা করিতে চলিলাম।
দেখিলাম, রাগে তাঁহার মুখ তখনও লাল রহিয়াছে, তাঁহার মুখ দেখিলেই বুঝিতে পারা যায় যে, তিনি কিংকৰ্ত্তব্যবিমূঢ় হইয়াছেন। তিনি আমাকে দেখিয়া বলিয়া উঠিলেন, “ডাক্তার বাবু, আপনি কোথা হইতে হঠাৎ এখানে আসিলেন? আপনি কি আমার সন্ধানে আসিয়াছিলেন?”
আমি যাহা যাহা দেখিয়াছিলাম; সমস্তই তাঁহাকে বলিলাম। প্রথমে তিনি খুব রাগত হইয়া উঠিলেন; তবে আমি তাঁহাকে সকজ কথা স্পষ্ঠভাবে বুঝাইয়া বলিলাম, তিনি রাগ প্রকাশ করিবার সুবিধা পাইলেন না– অন্যমনস্কভাবে হোঁ হোঁ করিয়া হাসিয়া উঠিলেন।
তিনি বলিলেন, “আমি মনে করিয়াছিলাম, এই মাঠটা নিৰ্জ্জন স্থান, এখন দেখিতেছি তাহা নহে। আপনি কোথায় ছিলেন?”
আমি বলিলাম, “ঐ উঁচু জায়াগার উপর দাঁড়াইয়া ছিলাম।”
“আপনি তবু ত কতকটা দূরে ছিলেন। তাহার দাদা একেবারে ঘাড়ের উপরে আসিয়া পড়িয়াছিল। আপনি তাহাকে দেখিতে পাইয়াছিলেন?
“হাঁ, অগত্যা সবই দেখিতে পাইয়াছিলাম।”
“আপনার কি মনে হয় যে, এই সদানন্দের মাথা খারাপ?”
“মাথা খারাপ? কই তাহা ত আমার কখনও বোধ হয় নাই।”
“আমারও কখনও মনে হয় নাই, তবে আজ তাহার যে ভাবে দেখিলাম, তাহাতে হয় তাহার মাথা খারাপ, না হয় আমারই মাথা খারাপ। যাক্, এসব কথায় আর কাজ নাই, তবে এই মঞ্জরীর ভাবও কিছুই বুঝিলাম না, আমি পরিহাস করিয়া অন্যভাবের দু’ একটা কথা বলিতে গিয়াছিলাম কিন্তু সে সে কথায় একেবারেই কান দিল না। এখানে আসিলে আমার বিপদ্ ঘটিতে পারে, পুনঃপুনঃ তাহাই বলিতে লাগিল, অথচ কি বিপদ্, কেন আমার বিপদ হইবে, তাহা সে কিছুই বলিল না। এই সময়ে তাহার দাদা আসিয়া উপস্থিত হইল, আমি আত্মসংযম না করিলে একটা হাতাহাতি হইত।”
আমরা উভয়ে তখন বাড়ী ফিরিলাম। সেখানে ক্ষণপরে সদানন্দ আসিয়া মণিভূষণের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিলেন। হঠাৎ রাগত হইয়াছিলেন বলিয়া দুঃখ প্রকাশ করিলেন। মণিভূষণের সহিত তাঁহার যে মনোমালিন্য ঘটিয়াছিল, তাহা দূর হইল। আগামী রবিবার রাত্রে তিনি আমাদের ভোজনের নিমন্ত্রণ করিয়া গেলেন।
অষ্টবিংশ পরিচ্ছেদ
দ্বিতীয় পত্র—তৃতীয়াংশ
তিনি চলিয়া গেলে মণিভূষণ বলিলেন, “লোকটার যে মাথা একটু খারাপ আছে, তাহার আর সন্দেহ নাই। তখন যেভাবে আমায় আক্রমণ করিয়াছিল, আমি মনে করিলাম, একটা হাতাহাতি আরম্ভ হয় আর কি? যাক্, এখন ক্ষমা চাহিয়া গেল, কাহারও সহিত ঝগড়া-বিবাদ রাখিতে আমারও ইচ্ছা নাই। বিশেষতঃ এ অবস্থায় রাগ করাও আশ্চর্য্য নহে।”
“সদানন্দ বাবু কিছু বলিলেন?”
“হাঁ তিনি বলিলেন, তাঁহার সংসারে এই ভগিনী ব্যতীত আর কেহ নাই, মঞ্জরী তাঁহার সংসারের একমাত্র বন্ধন। এ অবস্থায় তাহার সম্বন্ধে কিছু ঘটিলে তাঁহার প্রাণে দারুণ কষ্ট হইবে; বিশেষতঃ স্ত্রীলোকদিগের মন বড়ই দুর্ব্বল, নতুবা তাহার সহিত আমার আলাপ-পরিচয়ে বিশেষ কোন বাধা ছিল না। যাহাই হউক, তাঁহারও ভাব বুঝিলাম না-মঞ্জরীর কথারও কোন অর্থ বুঝিতে পারিলাম না।”
মণিভূষণের সহিত এ সম্বন্ধে আর কোন কথা হইল না, এক্ষণে অনুপ ও তাহার স্ত্রী সম্বন্ধে যাহা আমি জানিতে পারিয়াছি, তাহাই লিখিতেছি। বোধ হয়, আমি যাহা করিয়াছি, তাহা শুনিয়া তুমি সন্তুষ্ট হইবে।
অনুপের স্ত্রী রাত্রে ঘুমায় না—কেবল কাঁদে, আর অনুপই বা এত রাত্রে গোপনে কেন সেই জানালার কাছে যায়, এ সমস্ত রহস্যই এখন আমি ভেদ করিয়াছি। তুমি আমায় এখানে যে কাজে পাঠাইয়াছ, তাহাতে বোধ হয়, আমি সম্পূর্ণ নিষ্ফল হই নাই।
প্রথমবার রাত্রে আমরা অনুপের পিছু লইয়া কিছুই জানিতে পারি নাই। পরে আমি ও মণিভূষণ রাত্রি তিনটা পৰ্য্যন্ত জাগিয়া বসিয়াছিলাম, কিন্তু সে রাত্রে আর কাহার পায়ের শব্দ বা কোন শব্দই শুনিতে পাইলাম না। ক্রমে রাত্রি শেষে আমরা দুইজনেই ঘুমাইয়া পড়িলাম, কিন্তু ইহাতে আমরা হতাশ হইলাম না; আবার পরদিন রাত্রে সেই রকম অবস্থায় রহিলাম।
ঘণ্টার পর ‘ঘণ্টা কাটিয়া যাইতে লাগিল, ক্রমে একটা বাজিল, আমরা আজও গতরাত্রের ন্যায় হতাশ হইতেছিলাম—এই সময়ে দূরে কাহার পদশব্দ হইবা মাত্র আমরা কান পাতিয়া শুনিতে লাগিলাম।
আমরা যে ঘরে বসিয়াছিলাম তাহার সম্মুখস্থ বারান্দা দিয়া কে যেন পা টিপিয়া টিপিয়া চলিয়া গেল। আমরা দুইজনে তখনই উঠিয়া তাহার অনুসরণ করিলাম।
লোকটা তখন বারান্দার অপর দিকে চলিয়া গিয়া ছিল, বারান্দায় আলো ছিল না, আমরা নিঃশব্দে পা টিপিয়া টিপিয়া চলিলাম; দেখিলাম, লোকটী পূর্ব্বের ন্যায় সেই ঘরে প্রবেশ করিল। আমরা তাহার পশ্চাদ্দিক্ মাত্র দেখিতে পাইলাম, কিন্তু সে যে অনুপ তাহা বুঝিতে আমাদের কিছুমাত্র বিলম্ব হইল না।
আমরা জুতা খুলিয়া আসিয়াছিলাম, সে জন্য অনুপ আমাদের পায়ের শব্দ শুনিতে পাইল না। আমরা ঘরে উঁকি মারিয়া দেখিলাম, সে পূর্ব্বের ন্যায় জানালায় আলোটা ধরিয়া মাঠের দিকে কি দেখিবার চেষ্টা পাইতেছে।
আমরা অনুপকে দেখিতে পাইলে কি বলিব, তাহা পূর্ব্বে স্থির করি নাই; কিন্তু মণিভূষণ কাজের কোন কারচুপি বুঝিতেন না, তিনি একেবারে সটান্ সেই গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন। তাঁহাকে দেখিয়া অনুপ লম্ফ দিয়া ঘুরিয়া দাঁড়াইল, তাঁহার আপাদমস্তক কাঁপিতে লাগিল। সে সভয়ে বিস্ফারিত নয়নে আমাদের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
মণিভূষণ অতি গম্ভীরভাবে বলিলেন, “অনুপ, এত রাত্রে তুমি এখানে কি করিতেছ?” সে কম্পিতস্বরে বলিল, “না—কিছু নয়।”
তাহার হাত এত কাঁপিতেছিল—আমার রোধ হইল যে, তাহার হাত হইতে যেন আলোটা পড়িয়া যায়। সে ভয়ে থতমত ভাবে বলিল, “এই জানালাটা—এই আমি—রাত্রে দেখি যে—সব এই জানালা বন্ধ আছে কি না।”
“এই উপরের ঘরের জানালা?”
“সব—ঘর জানালা দেখি।”
“দেখ অনুপ, মিথ্যাকথ্যা বলিয়া কোন ফল নাই। তুমি এত রাত্রে কি জন্য এই ঘরে আসিয়াছ, তাহা আমরা জানিতে চাহি। মিথ্যাকথা বলিলে রক্ষা পাইবে না, সত্যকথা বল। তুমি এত রাত্রে এই ঘরে কি করিতে ছিলে?” রাজা মণিভূষণ অতীব কঠোরকণ্ঠে এই কথাগুলি বলিয়া অনুপের মুখপ্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি স্থাপন করিয়া রহিলেন।
লোকটা ভয়ে যেন একেবারে বিহ্বল হইয়া পড়িল—কি বলিবে, কি করিবে, ক্ষণকাল কিছুই স্থির করিতে পারিল না, পরে স্পষ্টকণ্ঠে বলিল, “আমি অন্যায় কাজ কিছু করি নাই; আমি এই আলোটা কেবল জানালায় ধরিয়াছিলাম।”
“কেন—জানালায় আলো ধরিবার মানে কি?”
“আমাকে অনুগ্রহ বরিয়া এ কথা জিজ্ঞাসা করিবেন না। বলিবার কথা হইলে আমি পূৰ্ব্বেই আপনাকে বলিতাম।”
হঠাৎ আমার মনে একটা কথা উদিত হইল। আমি তাহার হাত হইতে সেই আলোটা লইয়া বলিলাম, “নিশ্চয়ই অনুপ কাহাকে সঙ্কেত করি বার জন্য এই আলোটা দেখাইতেছিল—দেখি, মাঠ হইতে কেহ ইহার উত্তর দেয় কি না।”
আমি আলোটা জানালায় ধরিয়া অন্ধকারে দেখিবার চেষ্টা পাইলাম। মাঠে কেবল অন্ধকার, কিছুই মাঠে দেখা যায় না, আমি হতাশ হইয়া আলো সরাইয়া লইতেছিলাম, সেই সময়ে সহসা দূরে একটা ক্ষুদ্র আলো দেখিতে পাইলাম, আমি বলিয়া উঠিলাম, “ঐ যে—ঐ একটা আলো!”
অনুপ ব্যাকুল হইয়া বলিল, “ও কিছু নয়—ও কিছু নয়, আমি আপনাকে বলিতেছি— মণিভূষণ বলিলেন, “ডাক্তারবাবু, আপনি আলোটা নাড়িতে থাকুন—ঐ দেখুন, মাঠের আলোও নড়িতেছে। (অনুপের প্রতি) অনুপ, এখনও তুই মিথ্যাকথা বলিতেছিস! কে ঐ মাঠে আলো জ্বালিয়া ইসারা করিতেছে কে সে, আর তাহার সঙ্গে কি বদমাইসি মতলব করিতেছিস?”
এবার অনুপ রাগত হইয়া বলিল, “ইহার সঙ্গে আপনাদের কোন সম্বন্ধ নাই। আমি আপনাকে কিছুতেই বলিব না।”
মণিভূষণ রাগত হইয়া উঠিলেন, “বটে? এত বড় স্পর্দ্ধা। কালই তুমি এ বাড়ী হইতে দূর হও।”
অনুপ মস্তক অবনত করিয়া অস্পষ্টস্বরে বলিল, “তাহাই হইবে।”
মণিভূষণ অত্যধিক উত্তেজিত হইয়া বলিলেন, “নিশ্চয়ই তাহাই হইবে, কালই তোকে দূর করিয়া দিব। আমাদেরই সংসারে খেয়ে মানুষ, আর আমারই সর্ব্বনাশের চেষ্টা করিতেছিস্?”
“আপনার বিরুদ্ধে আমি কিছুই করি নাই।”
“এই সময়ে তথায় ব্যস্ত-সমস্ত হইয়া অনুপের স্ত্রী সুমঙ্গলা উপস্থিত হইল, সে ঘোমটা দিয়া কুণ্ঠিত ভাবে আমাদের সম্মুখে বাহির হইত বটে, কিন্তু এরূপ ভাবে কখনও বাহির হয় নাই, কোন কারণে যেন সে পাগলের মত হইয়াছে। অনুপ তাহাকে দেখিয়া বলিল, “রাজা আমাদের তাড়াইয়া দিতেছেন, তোমারই জন্য এই ঘটিল!”
সুমঙ্গলা এক নিশ্বাসে বলিল, “ওঁর কোন দোষ নাই। ওঁর কোন দোষ নাই? আমার স্বোয়ামী আমার কথামতই এইরূপ করিতেছিল।”
মণিভূষণ বলিলেন, “কি করিতেছিল, সব খুলিয়া বল।”
সুমঙ্গলা উদ্বিগ্নমুখে বলিল, “আমার ভাই ঐ মাঠে না খাইয়া মরিতেছে—কেমন করিয়া তাহাকে চোখের উপর মরিতে দিই! আলোটা দেখিলে সে জানিতে পারে যে, তাহার খাবার ঠিক হইয়াছে। সে সেখান থেকে আলো দেখালে আমরা জানিতে পারি, সে কোথায় লুকাইয়া আছে।”
“তাহা হইলে তোমার ভাই—”
“হাঁ—সেই হারু ডাকাত, যে জেল হইতে পলাইয়া আসিয়াছে।”
অনুপ বলিল, “আমার স্ত্রী সত্যকথাই বলিতেছে। এখন দেখিতেছেন, কেন আমি এ কথা আপনাকে বলিতে পারিতেছিলাম না। এখন সকলই ত শুনিলেন—দেখিতেছেন, আপনার বিরুদ্ধে আমরা কোন ষড়যন্ত্র করি নাই।”
আমরা উভয়ে বিস্মিতভাবে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলাম। কি আশ্চর্য্য! এই স্ত্রীলোকের ভাই সেই বিখ্যাত হারু ডাকাত! তাহা হইলে ভাইএর জন্যই সে রাত্রে কাঁদিত। ভাইকে খাবার দিবার জন্য এই রাত্রে এই কাণ্ড করিতেছে।
ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ
দ্বিতীয় পত্র—চতুর্থ অংশ।
প্রথমে তাহার কথা আমরা বিশ্বাস করিতে পারিলাম না, তাহার পর সে তাহার ভাই-এর ইতিহাস সমস্তই বলিল;—তাহা এই—
“আমার ভাই আমার চেয়ে ছোট, ছেলেবেলায় আদর পাইয়া সে কম বয়স হইতেই খারাপ হইয়া গিয়াছিল, শেষে ডাকাত হইল, তবুও সে আমার ভাই—সে যাহাই হউক, আমি তাহাকে প্রাণের সহিত ভালবাসি। তাহাই সে জেল হইতে পলাইয়া এখানে আসিল, মাঠে লুকাইয়া থাকে, বাহির হইলেই ধরা পড়িবে, অথচ মাঠে থাকিলে না খাইয়া মরিবে, তাহাই আমরা তাহাকে মাঠে খাবার দিয়া আসিতাম। আমরা এখান হইতে আলো দেখাইলে, সে-ও আলো দেখাইত, তাহাতেই জানিতে পারিতাম, সে কোথায় লুকাইয়া আছে তখন সেইখানে গিয়া তাহার খাবার দিয়া আসিতাম। প্রত্যহই মনে করিতাম, সে এখান হইতে পালাইতে পারিয়াছে, কিন্তু যখন পালাইতে পারিতেছে না, তখন তাহাকে খাবার না দিয়া কিরূপে থাকিতে পারি? আপনাকে সকল কথাই বলিলাম, এখন যাহা ভাল বিবেচনা করেন, করুন।”
সে এই কথাগুলি যে ভাবে বলিল, তাহাতে তাহার কথা অবিশ্বাস করিবার কোন কারণ ছিল না। তথাপি মণিভূষণ অনুপকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন, এ কথা সত্য?”
সে বলিল, “হাঁ, ইহার একটা কথাও মিথ্যা নহে।”
মণিভূষণ বলিলেন, “আমি ইহার জন্য তোমাদের কোন দোষ দিতে পারি না, যাহাই হউক, আমি রাগে যাহা বলিয়াছিলাম তাহার জন্য কিছু মনে করিও না। কাল এ সম্বন্ধে কথা হইবে, যাও আজকের মত শোওগে।”
তাহারা দুই জনে চলিয়া গেলে আমরা আবার মাঠের দিকে চাহিলাম, দূরে তখনও সে ক্ষুদ্র আলো জ্বলিতেছিল।
মণিভূষণ বলিলেন, “আশ্চর্য্য, লোকটা এরূপ ভাবে আলো দেখাইতে সাহস করে!” আমি বলিলাম, “বোধ হয়, এই জানালা ছাড়া আর কোনখান হইতে এই আলো দেখিতে পাওয়া যায় না।”
“খুব সম্ভব। আলোটা এখান হইতে কতদূরে বলিয়া বোধ হয়?”
“বোধ হয়, আধ ক্রোশ দূরে হইবে।”
“বেশী দূর নয়, বেশী দূর হইলে রাত্রে অনুপ এই ডাকাতকে খাবার দিতে যাইতে পারিত না। আর সেই পাষণ্ডটা এখনও ঐ আলো ধরিয়া আছে। ডাক্তার—এই রাত্রেই আমি এই ডাকাতকে ধরিব।”
আমার মনেও এই কথা হইয়াছিল। হারুর ন্যায় ডাকাত ছাড়া থাকিলে আরও কত জনের সর্ব্বনাশ করিবে। বিশেষতঃ অনুপ কি তাহার স্ত্রী ইচ্ছা করিয়া হারুর কথা আমাদিগকে বলে নাই। সুতরাং এ অবস্থায় এই হারু ডাকাতকে ধরিতে যাওয়ায় আমাদের অন্যায় কাজ করা হইতেছে না। এরূপ লোককে না ধরাই অন্যায়।
আমি বলিলাম, “চলুন, আমিও সঙ্গে যাইব।”
মণিভূষণ বলিলেন, “দুটো করিয়া পিস্তল সঙ্গে লওয়া আবশ্যক, লোকটা সহজ নহে। আর আমাদের এক মিনিট দেরি করা উচিত নয়। সে আলোটা নিবাইয়া দিতে পারে।”
আমরা দুইজনে তখনই অন্ধকারে বাড়ী হইতে বাহির হইলাম। গড় হইতে বাহির হইয়া সেই আলোর দিকে দ্রুতবেগে চলিলাম।
চারিদিক নীরব নিস্তব্ধ। ক্বচিৎ কৃষ্ণসপ্তমীর ম্রিয়মান চন্দ্র মেঘান্তরাল হইতে বাহির হইয়া গগনবিস্তৃত মেঘতরঙ্গের মধ্যে ডুবিয়া যাইতেছে।
প্রায় হারু ডাকাতের নিকটস্থ হইয়া আমি বলিলাম, “হঠাৎ লোকটাকে ধরিতে হইবে; নতুবা নিজেদের খুব আশঙ্কা আছে।”
মণিভূষণ বলিলেন, “ডাক্তারবাবু, আপনার বন্ধু গোবিন্দরামবাবু এ কথা শুনিলে কি বলিবেন? এখন ত এই অন্ধকার রাত্রি—সেই মাঠ, এই ত ভূত বাহির হইবার সময়।”
যেন তাঁহার কথার সার্থকতা সম্পাদন করিবার জন্য তৎক্ষণাৎ চারিদিকে… প্রতিধ্বনি জাগাইয়া একটা বিকট ধ্বনি আকাশ ভেদ করিয়া উঠিল। সেই শব্দে সেই নিৰ্জ্জন মাঠের সর্বত্র যেন এক ভয়াবহ বিভীষিকা ছড়াইয়া দিল।
মণিভূষণ আমার হাত ধরিয়া রুদ্ধকণ্ঠে বলিলেন, “ডাক্তার বাবু, এ কি! এ কিসের শব্দ?”
আমি বলিলাম, “কিরূপে বলিব? এই মাঠে নাকি মধ্যে মধ্যে এরূপ শব্দ হয়। আমি এ শব্দ আর এক দিনও শুনিয়াছিলাম।”
শব্দ থামিয়া গেল, তাহার পর মাঠের নিস্তব্ধতা যেন অধিকতর বৃদ্ধি হইল, আমরা কোন পাতিয়া শুনিতে লাগিলাম, কিন্তু আর কোন শব্দই শুনিতে পাইলাম না।
মণিভূষণ বলিলেন, “ডাক্তারবাবু, এ নিশ্চয়ই কুকুরের ডাক।”
সত্যকথা বলিতে কি, এ কথায় আমার শরীরের রক্ত যেন জল হইয়া গেল। আমি মণিভূষণের স্বরে বুঝিলাম, তিনিও বিশেষ ভীত হইয়াছেন। তিনি কম্পিতস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এই শব্দ কিসের, কে কি বলে?”
“কে কি বলিবে?”
“এখানকার লোকে কি বলে?”
“মূর্খ চাষা সব, তাহাদের যেমন জ্ঞান বুদ্ধি—তেমনই বলে, যাহা নয় তাহাই বলে। “তবু কি বলে?”
আমি ইতস্ততঃ করিতে লাগিলাম, তাহার পর বলিলাম, “তাঁহারা বলে যে এই শব্দ আপনাদের বংশের সেই কুকুর-ভূতের ডাক, নিতান্ত মূর্খ না হইলে কেহ কখনও এ কথা বিশ্বাস করিবে না।”
মণিভূষণ কিয়ৎক্ষণ কোন কথা কহিলেন না, তাহার পর ধীরে ধীরে বলিলেন, “এ যে কুকুরের ডাক তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। তবে বোধ হইল, যেন খুব দূর হইতে ডাকিতেছে— এদিকে খুব দূরে—”
আমি। কোথা হইতে শব্দটা উঠিয়াছিল, তাহা ঠিক বলা যায় না।
মণি। হাঁ, তবে ঐ দূরের পাহাড়গুলোর ভিতর বলিয়া বোধ হয়।
আমি। খুব সম্ভব।
মণি। নিশ্চয়ই, ডাক্তারবাবু। আপনার কি মনে হইল না যে, শব্দটা কুকুরের ডাক, আমি ছেলেমানুষ নই যে ভয় পাইব, সুতরাং আপনি এ সম্বন্ধে যাহা শুনিয়াছেন, সব আমায় বলুন।
আমি। আগে যেদিন আমি এই শব্দ শুনিয়াছিলাম, সেদিন আমার সঙ্গে সদানন্দ বাবু ছিলেন, তিনি বলেন যে, শব্দটা কোন পাখীরও হইতে পারে।
মণি। (ব্যগ্রভাবে) না-না-কুকুরের ডাক—তাহাতে আর সন্দেহ নাই। এই ভূতের কথার ভিতর যথার্থই কি কিছু আছে নাকি? আমার কোন বিপদ্ হইবার আশঙ্কা সত্যসত্যই আছে নাকি? ডাক্তার বাবু, আপনি কি ইহা বিশ্বাস করেন?
আমি। পাগল আর কি! এ সব বাজে কথা কোন শিক্ষিত লোক কি বিশ্বাস করিতে পারে? কিছুতেই নয়।
মনি। হাঁ, কলিকাতার মত নিরাপদ সহরে বসিয়া এ কথা শুনিয়া হাসিতে পারা যায়, আর এই অন্ধকার রাত্রে এই ভয়ানক নিৰ্জ্জন মাঠে এই ভয়াবহ শব্দ শোনা আর এক কথা! আর আমার জেঠামহাশয়—সত্যই ত তাঁহার মৃতদেহের কাছে একটা কুকুরের পায়ের দাগ দেখা গিয়াছিল। আমি কাপুরুষ নই, তবুও এই শব্দ শুনিয়া যেন আমার রক্ত জল হইয়া গিয়াছে!
আমি। এ সব কথা মনে করাই অন্যায়।
মনি। আমার মাথার ভিতর শব্দটা যেন ঢুকিয়া এখনও ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। ডাক্তার বাবু, এখন কি করা উচিত?
আমি। চলুন—না হয় ফিরিয়া বাড়ী যাই।
মণি। না—কিছুতেই নয়, আমরা ডাকাত ধরিতে বাহির হইয়াছি, একটা বাজে শব্দ শুনিয়া ভয়ে ফিরিয়া যাইব? না—কিছুতেই নয়—আসুন।