এগারো
দু’দিন পরের কথা।
সুড়ঙ্গের প্রবেশমুখে জটলা করছে মামার ওয়ার্কাররা।
মুসা আর মদিনা তাঁবুর চারপাশে ঘোরাঘুরি করে কাটিয়েছে এই দুটো দিন। পিরামিডের চারপাশ ঘুরে দেখেছে। কিন্তু আছে তো শুধু বালি আর বালি। বাইরে কিছু দেখার নেই।
আগের দিনটা মদিনার সঙ্গে দাবা খেলে কাটিয়েছে মুসা। কিন্তু মদিনার সঙ্গে কোনও খেলাতেই তেমন মজা পাওয়া যায় না। সে রক্ষণাত্মক খেলোয়াড়।
এই দু’দিনের প্রতিটি মুহূর্ত উত্তেজিত দেখা গেছে সায়েম মোর্শেদকে। মুসা বুঝতে পারছে কবর উন্মুক্ত করার সময় যত ঘনিয়ে আসছে, ততই নার্ভাস হয়ে পড়ছেন তিনি।
ডক্টর মোর্শেদ দু’দিনে মুসা আর মদিনার সঙ্গে তেমন কথা বলেননি। মুসার অচেনা কিছু লোকের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। কাজের ব্যাপারে মামা যে সিরিয়াস, বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না মুসার।
স্বভাবসুলভ হাসিখুশি ভাবটা একেবারেই নেই তাঁর। কৌতুক শোনানো যেন গায়েব হয়ে গেছে।
অবশ্য এরমধ্যে মামা অনেকটা সময় নীলা সুমাইয়ার সঙ্গে গল্প করে কাটিয়েছেন। প্রথমে নীলা পিরামিড নিয়ে মামার গবেষণা সম্পর্কে লেখার আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু সে আগ্রহ অন্যদিকে মোড় নিয়েছে। সে নাকি এখন মামা সম্পর্কেই লিখবে। মুসার ধারণা, মামার বলা প্রতিটি শব্দ সে টুকে নিচ্ছে মগজে।
মুসা আজ সকালে নাস্তা করার সময় দু’দিন পর মামাকে হাসতে দেখল।
‘আজ সেই দিন,’ ঘোষণা দিলেন সায়েম মোর্শেদ।
উত্তেজনা চেপে রাখতে পারছে না ভাই-বোন।
‘আমাদেরকেও সঙ্গে নেবেন তো?’ মুসা কথাটা বলেই বুঝতে পারল, প্রশ্নটা করা ঠিক হয়নি। কারণ মামা কবরটা ভাঙার আগেই ওকে চলে আসতে মোবাইল করেছিলেন।
মাথা ঝাঁকালেন সায়েম মোর্শেদ। ‘হ্যাঁ, তোমরাও থাকবে আমার সঙ্গে,’ বললেন। ‘আজ হয়তো একটা ইতিহাস সৃষ্টি করতে চলেছি আমরা। হয়তো এই দিনটার কথা তুমি জীবনেও ভুলতে পারবে না, মুসা।’ কাঁধ ঝাঁকালেন মামা। কী যেন ভাবলেন একমুহূর্ত। ‘হয়তো….
মামা কথা শেষ না করে থেমে গেলেন।
কয়েক মিনিট পর।
মরুভূমির ভেতর দিয়ে মামা কয়েকজন ওয়ার্কার নিয়ে এগিয়ে চলেছেন নির্দিষ্ট পিরামিডের দিকে। পেছন পেছন এগোচ্ছে মদিনা- মুসা।
মেঘলা দিন। কালো মেঘের চাদরে ঢাকা আকাশ। ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি নামতে পারে যে-কোন সময়।
দূর থেকে মনে হচ্ছে পিরামিডের চুড়ো যেন মেঘ ছুঁতে চাইছে। মুসারা যখন সুড়ঙ্গের মুখে পৌছল, পেছন থেকে দৌড়ে আসতে দেখা গেল নীলাকে। প্রতি পদক্ষেপে বুকের সঙ্গে বাড়ি খাচ্ছে তার ক্যামেরা।
আজ সে ঢিলেঢালা ফেড জিন্সের ওপর লম্বা হাতার নীল ডেনিম ওয়ার্ক শার্ট পরেছে।
মামা হেসে স্বাগত জানালেন নীলা সুমাইয়াকে। তবে সতর্ক করে দিয়ে বললেন, ‘ছবি তোলা যাবে না, মনে আছে তো?’
মামার দিকে চেয়ে মুচকি হাসল নীলা। তার সবুজ চোখে উত্তেজনার ছাপ। ‘খুব মনে আছে।’
ইকুইপমেণ্ট ডাম্প থেকে একটা করে হলুদ হেলমেট তুলে নিল সবাই।
মামার হাতে একটা বড় পাথরের হাতুড়ি। সুড়ঙ্গে ঢুকে গেলেন তিনি। বাকিরা অনুসরণ করল।
মুসা আর মদিনা পাশাপাশি এগোচ্ছে।
হার্টবিট বেড়ে গেছে মুসার। সরু সুড়ঙ্গে পড়ছে হেলমেটের আলো। সামনে থেকে ভেসে আসা ওয়ার্কারদের কথা শুনতে পাচ্ছে ও। ওদের খনন যন্ত্রপাতির ঘড়ঘড় শব্দ আসছে।
ও মদিনাকে বলল, ‘কেমন ভয়ঙ্কর লাগছে!’
‘কবরটা ধনরত্নে ভর্তি থাকতে পারে,’ ফিসফিস করে বলল মদিনা। সামনে বাঁক নিয়েছে সুড়ঙ্গ। ‘নীলকান্তমণি! রুবি! পান্না! আরও কী আছে কে জানে? প্রাচীন মিশরীয় প্রিন্সেসদের মত ওগুলো দিয়ে হয়তো একটা মুকুট গড়াতে পারব আমি।’
‘তোমার কী মনে হয় কবরের মধ্যে মমি পাব আমরা?’ প্রশ্ন করল মুসা। ধনরত্নের প্রতি তেমন আগ্রহ নেই ওর। ‘তোমার কী মনে হয় প্রিন্স খোর-রো’র মমি করা দেহটা ওখানে শুয়ে আছে? আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে?’
কপাল কোঁচকাল মদিনা। ‘মমি কারও অপেক্ষায় থাকে, তা-ই ভাবছ তুমি?’
‘আমরা এখন প্রাচীন মিশরীয় পিরামিডের পেটের মধ্যে আছি,’ গলায় পাল্টা ঝাঁঝ ফোটাল মুসা।
‘কোটি কোটি টাকার সোনা-দানা থাকতে পারে ওখানে,’ বলে চলেছে মদিনা। ‘অথচ ওগুলোর কথা না ভেবে তুমি ভাবছ এক মমির কথা, যে কিনা হাজার হাজার বছর ধরে গোউয-ব্যাণ্ডেজের তলায় বাঁধা পড়ে আছে।’ মাথা নেড়ে বলল মদিনা, ‘আট-নয় বছরের শিশুদের ভাবনা ভাবছ তুমি, মুসা।’
‘মামাও তা হলে আট-নয় বছরের শিশু?’ জবাব দিল মুসা।
এবার মদিনা জবাব খুঁজে পেল না।
আর কথা নেই ওদের মুখে। নীরবে অনুসরণ করে চলেছে ডক্টর মোর্শেদ আর নীলা সুমাইয়াকে।
সামনে ডানে বাঁক নিয়েছে সুড়ঙ্গ। বাঁক পেরোতেই গরম বাতাসের ছোঁয়া পেল ওরা নাকেমুখে।
আরও কিছুটা পথ এগোবার পর আলোর রেখা দেখতে পেল মুসা। দুটো ব্যাটারি-চালিত স্পটলাইট জ্বলছে। আলোর কাছাকাছি আসতেই একটা দরজা দেখা গেল।
দরজার কাছে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে চার ওয়ার্কার শাবল আর গাঁইতি দিয়ে কাজ করছে। জমে ওঠা জঞ্জাল সাফ করছে।
ওদের কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন সায়েম মোর্শেদ।
বেশ উত্তেজিত।
মামার দিকে তাকিয়ে হাসল মুসা।
অপেক্ষা করো,’ বললেন মামা। ‘আর দেরি নেই।’
মামার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে নীলা, মদিনা আর মুসা। প্রাচীন দরজাটার দিকে তাকিয়ে আছে ওরা। রুদ্ধশ্বাসে প্রতীক্ষা করছে।
দরজাটা যথেষ্ট উঁচু নয়।
ওটা পেরোতে মামাকে সামনে ঝুঁকে এগোতে হবে, বুঝল মুসা।
দরজাটা মেহগনি কাঠের তৈরি। অনেক দূর থেকে আনা হয়েছিল এই কাঠ। মেহগনি গাছ মিশরে জন্মায় না।
তবে চার হাজার বছর পর দরজাটা দেখে বোঝার কোনও উপায়ই নেই যে ওটা কাঠের তৈরি। পাথরের মত শক্ত হয়ে আছে কাঠ।
দরজার নীচ থেকে ওপর পর্যন্ত অদ্ভুত সব চিত্রলিপি।
তীক্ষ্ণ চোখে অনেকক্ষণ ধরে ওগুলো লক্ষ করল মুসা। কিছু পাখি, বেড়াল এবং আরও কিছু জীব-জন্তুর ছবি আবিষ্কার করল।
তবে একটা জিনিস সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। একটা সীল। ওটা দিয়েই লক করা আছে দরজা।
ওটা নিখাদ সোনার তৈরি একটা সিংহের মাথা। হাঁ করে যেন হুঙ্কার ছাড়ছে সিংহ। ওটার মুখটা ইচ্ছেকৃত ভাবে ভয়ঙ্কর করে তৈরি করা হয়েছে।
স্পট লাইটের আলোয় সূর্যের মত চকচক করছে মাথাটা।
‘নরম সোনা,’ এক ওয়ার্কার মামাকে বলল, শুনতে পেল মুসা। ‘সীল ভাঙতে বেশি অসুবিধে হবে না।’
ভারী হাতুড়িটা নামিয়ে রাখলেন মামা।
জ্বলজ্বলে সিংহের মাথার দিকে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন অপলকে। তারপর মুসাদের দিকে ঘুরলেন। ‘অনধিকার প্রবেশকারীদের ভয় দেখাবার জন্যে ওরা এতটা ভয়ঙ্কর করে সিংহের মাথা বানিয়েছে। এবং সফলও হয়েছে। এত বছর পরও কাজ করছে ওটা। দেখলেই ভয়ে দম বন্ধ হয়ে আসে।’
‘ডক্টর মোর্শেদ,’ এক পা এগিয়ে এসে বলল নীলা, সীলটা ভাঙার আগে ওটার একটা ছবি তুলতে চাই। আশা করি এ-কাজে আপনি অন্তত নিষেধ করবেন না। এরকম একটা ঐতিহাসিক মুহূর্ত ধরে রাখতে না পারলে…’
নীলা সুমাইয়ার অনুরোধ যে মামা ফেলতে পারবেন না, আগেই বুঝে ফেলেছে মুসা।
একটু আমতা আমতা করে রাজি হলেন মামা। ‘ঠিক আছে, তুলুন।’
হাসিতে ভরে গেল নীলার মুখ। কম্পিত হাতে ক্যামেরা তুলল সে।
ওয়ার্কাররা পেছনে সরে গেল।
তাদের একজন মামার হাতে একটা হাতুড়ি আর ডাক্তারদের স্ক্যালপেলের মত একটা বাটালি তুলে দিল। বলল, ‘সীলটা আপনিই ভাঙন, স্যার।’
সীলটার দিকে এগিয়ে গেলেন মামা।
‘সীল ভাঙব এখন আমি,’ ঘোষণা দিলেন তিনি। ‘দরজা খুলব। তারপর এমন একটা ঘরে ঢুকব, যেখানে চারটি হাজার বছর কারও পায়ের ছোঁয়া পড়েনি।
চোখের সামনে ক্যামেরা তুলেছে নীলা। সতর্কতার সঙ্গে লেন্স অ্যাডজাস্ট করছে।
মুসা আর মদিনা ওয়ার্কারদের পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
যেন মামা হাতুড়ি তুলতেই সিংহের মাথা আরও ঝিলিক দিয়ে উঠল।
হাতুড়ি তুলেছেন মামা।
কারও মুখে টু শব্দটিও নেই।
থমথমে নীরবতায় ডুবে আছে সুড়ঙ্গ-পথ
উত্তেজনা বোধ করছে মুসা। বুকের খাঁচায় দমাদম বাড়ি খাচ্ছে হৃৎপিণ্ড।
কী অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার!
টের পাচ্ছে মুসা, দম বন্ধ করে আছে ও। নীরবে বাতাস টেনে বুক ভরে নিল মুসা, ছাড়ল একটু একটু করে। মদিনার দিকে তাকাল। বোঝাই যাচ্ছে ও নার্ভাস হয়ে পড়েছে। গভীর চিন্তায় ডুবে নীচের ঠোঁট কামড়াচ্ছে। আড়াআড়িভাবে বুকের ওপর হাত রেখেছে সে।
‘খিদে পেয়েছে কারও?’ হঠাৎ বলে উঠলেন মামা কৌতুকের সুরে। ‘তা হলে আপাতত হাতের কাজ বন্ধ রেখে পিজা জোগাড় করা যাক, কী বলো?’
জোরে হেসে উঠল সবাই।
মামা জীবনের এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তেও কৌতুক করতে ছাড়েন না, হাসল মুসা।
আবার নীরবতায় ডুবে গেল চারদিক।
গম্ভীর হয়ে গেলেন ডক্টর মোর্শেদ। প্রাচীন সীলটার দিকে ঘুরলেন। সীলের পেছনে ঢুকিয়ে দিলেন ছোট্ট বাটালির প্রান্ত। তারপর ধীরে ধীরে তুলতে লাগলেন হাতুড়ি।
ঠিক সেই মুহূর্তে শোনা গেল একটা গম্ভীর ভরাট কণ্ঠের নির্দেশ
‘আমাকে শান্তিতে ঘুমাতে দাও!’
আওয়াজটা বজ্র নির্ঘোষের মত শোনাল। গমগম করে উঠল সুড়ঙ্গ-পথ। গায়ে কাঁটা দিল ওদের।
বারো
আঁৎকে উঠল মুসা।
‘আমাকে শান্তিতে ঘুমাতে দাও!’ আবারও শোনা গেল সেই গলা।
দেখতে পেল মুসা, বাটালি নামিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন মামা। হতভম্ব চেহারা। চোখে বিস্ময়। হাত একটু একটু কাঁপছে।
মুসা বুঝতে পারল, চিৎকারটা এসেছে পেছন দিক থেকে। ঘুরে তাকাতেই অপরিচিত এক লোককে দেখতে পেল ও। এখনও পুরো শরীর দেখা যাচ্ছে না তার। তবে মুখ দেখা যাচ্ছে স্পট লাইটের আলোয়। দ্রুত বেগে এদিকেই ছুটে আসছে সে।
ছিপছিপে লম্বা গড়ন লোকটার। এত লম্বা, নিচু হয়ে হাঁটতে হচ্ছে। কানের ওপরে আর পেছনে সরু ফিতের মত খানিকটা চুল ছাড়া পুরো মাথায় চকচকে টাক। চেহারা দেখে বোঝা যায় খুব রেগে আছে। ঠোঁটে ক্রুর হাসি।
শার্ট আর নেক-টাইয়ের ওপর ইস্ত্রি করা সাফারি জ্যাকেট পরে আছে সে। ছোট কুতকুতে চোখ দুটো মামার ওপরে স্থির।
মুসার মনে হলো লোকটা ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করে না বলেই তার শরীরের এমন ভগ্নদশা। একেবারে কঙ্কালের মত স্বাস্থ্য তার।
‘ওমর!’ মামার কণ্ঠে বিস্ময়। ‘কায়রো থেকে এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে যে?’
‘আমাকে শান্তিতে ঘুমাতে দাও!’ ডক্টর হাসান ওমর বললেন আবারও। গলার স্বর এখন নরম। ‘প্রিন্স খোর-রো’র কথা এটা। মনে নেই গত মাসে পাওয়া প্রাচীন এক শিলায় লেখা ছিল যুবরাজের এই ইচ্ছের কথা?’
‘এ-নিয়ে অনেক তর্কাতর্কি হয়েছে তোমার সঙ্গে,’ মামা বললেন। ‘আর নয়।’
মুসা আর মদিনাকে ঠেলে সরিয়ে মামার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন ডক্টর ওমর। বিরক্ত হলো মুসা।
টাকে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন ওমর, বেশ। দেখি কত সাহসী তুমি। আমি দেখতে চাই ওই সীল কী করে ভাঙো।’
‘আমি একজন বিজ্ঞানী,’ নরম শান্ত সুরে বললেন মামা। ‘সাহসের অভাব নেই। কারণ কোনও কুসংস্কার আমি পরোয়া করি না।’
দু’হাতে নেকটাই-এর নট শক্ত করে এঁটে নিয়ে জবাব দিলেন ওমর, ‘আমিও একজন বিজ্ঞানী। কিন্তু আমি চাই না এই প্রাচীন কবরটা কলুষিত হোক। আমি চাই না প্রিন্স খোর-রো’র ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করা হোক। এবং আমার এই দ্বিমত কুসংস্কার থেকে এসেছে, সে কথাও মানতে রাজি নই।’
‘এখানেই তোমার সঙ্গে আমার মতের অমিল,’ শান্তস্বরে বললেন সায়েম মোর্শেদ। চার ওয়ার্কারের দিকে আঙুল নির্দেশ করলেন তিনি। ‘দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়াবার জন্যেই কী আমরা মাসের পর মাস, বছরের পর বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি? অনেক পথ এগিয়ে এসেছি আমরা, ওমর। বাকি কাজটুকু করতে দাও, প্লিজ।’
নীচের ঠোঁট কামড়াচ্ছেন ওমর। দরজার ওপরের দিকে তিনি আঙুল তুলে দেখালেন। ‘ওই দেখো, মোর্শেদ। কী লেখা আছে দেখো। একই কথা লেখা ছিল সেই প্রাচীন শিলায়। একই সতর্কবাণী। আমাকে শান্তিতে ঘুমাতে দাও।’
‘জানি, জানি,’ অধৈর্য কণ্ঠে বললেন মামা।
‘পরিষ্কার সতর্কবাণী,’ বলে চলেছেন ডক্টর ওমর। ভ্রূ কুঁচকে মামার দিকে তাকিয়ে আছেন। ‘কেউ যদি প্রিন্সকে বিরক্ত করে, যদি কেউ কবরে খোদাই করে লেখা প্রাচীন শব্দগুলো পরপর পাঁচবার উচ্চারণ করে, তবে জীবন্ত হয়ে উঠবে মমি। এবং প্রতিশোধ নেবে সে।’
ডক্টর ওমরের কথায় চমকে উঠল মুসা। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল ও মামার দিকে।
মামা মদিনা আর আমাকে এসব কথা বলেননি কেন? ভাবল মুসা। প্রিন্সের খোদাই করে যাওয়া হুঁশিয়ারী সম্পর্কে বলেননি কেন? কেন বলেননি কিছু প্রাচীন শিলালিপি সম্পর্কে? ওরা ভয় পাবে বলে? তিনি নিজেই কি ভয় পেয়েছেন?
না, তা হতে পারে না।
মামা যেভাবে ডক্টর ওমরের সঙ্গে তর্ক করছেন, তাতে বোঝা যায় একটুও ভয় পাননি তিনি ওই সতর্কবাণীতে।
বোঝাই গেল, বিষয়টা নিয়ে আসাদ ওমরের সঙ্গে অনেকদিন থেকে তর্ক চলছে মামার।
এটাও বুঝতে পারছে মুসা, আসাদ ওমর মামাকে আটকাতে পারবেন না। মামা সীল ভেঙে ভেতরে ঢুকবেনই।
‘শেষবারের মত তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি, মোর্শেদ,’ বললেন ওমর। ‘এখানকার সবার নিরাপত্তার কথা ভেবে দেখো একবার,’ চার ওয়ার্কারের দিকে হাত তুললেন। ‘তোমার মেয়ে, ভাগ্নে, একজন সাংবাদিক, সবার কথা ভাবো, প্লীজ।’
‘স্রেফ কুসংস্কার,’ মামা বললেন। ‘কোন কুসংস্কার আমার কাজ বন্ধ করতে পারবে না। আমি একজন বিজ্ঞানী।’ হাতুড়ি-বাটালি তুললেন মামা। ‘সীল ভাঙব এখন আমি।’
‘বেশ। আমি তা হলে চললাম। তোমার সঙ্গে নেই আর আমি, ‘ বলেই ঘুরে অন্ধকার সুড়ঙ্গে অদৃশ্য হয়ে গেলেন ডক্টর আসাদ ওমর।
কয়েক পা এগিয়ে গেলেন মামা। ‘ওমর! ওমর!’ ডাকলেন।
কিন্তু ওমরের পায়ের আওয়াজ অস্পষ্ট থেকে অস্পষ্টতর হলো। সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মুসার দিকে ঝুঁকে এলেন মামা। ‘লোকটাকে কেন যেন আমি সহ্য করতে পারি না। আসলে ও কুসংস্কার মানে বলে মনে হয় না। আমার সন্দেহ, এই আবিষ্কারের কৃতিত্ব ও একা দখল করতে চাইছে। এ জন্যেই দরজা খোলার আগে আমাকে থামিয়ে দিতে চেয়েছিল।’
কী জবাব দেবে বুঝে উঠতে পারছে না মুসা।
ওর মনে হলো, মামা ঠিক কথাই বলেছেন। কিন্তু ব্যাপারটা অস্বাভাবিক। একজন বিজ্ঞানীর আবিষ্কারের ফসল আরেক বিজ্ঞানী তাঁর ঘরে তুলতে চাইবেন, তা কী করে হয়?
ডক্টর মোর্শেদ ফিসফিস করে নীলাকে কিছু বললেন, তারপর এগিয়ে গেলেন তাঁর ওয়ার্কারদের দিকে। মোলায়েম গলায় বললেন, ‘তোমরা যদি ডক্টর ওমরের সঙ্গে একমত হও, নির্দ্বিধায় চলে যেতে পারো। বাধা দেব না আমি।’
চোখ চাওয়া-চাওয়ি করল ওরা।
‘দরজায় লেখা সতর্কবাণীর কথা তোমরা জেনেছ,’ বলে চলেছেন মামা। ‘ডক্টর ওমরের সব কথা শুনেছ। জোর জবরদস্তি করতে চাই না আমি। ইচ্ছে করলেই সরে যেতে পারো।’
কিন্তু এতদিন ধরে প্রচুর খাটুনি দিয়েছি আমরা এর পেছনে, বলল তাদের একজন। ‘আপনার কাছ থেকে উপযুক্ত পারিশ্রমিকও পেয়েছি, সার। এতদূর এসে আমরা থেমে যেতে পারি না। তা ছাড়া, আমরা মনে করি দরজা খুলে ভেতরে ঢোকা আমাদের দায়িত্ব।’
প্রশান্তির হাসি ফুটল মামার মুখে। ‘বেশ,’ বলে এগোলেন সিংহের সীলের দিকে।
মদিনার দিকে তাকাল মুসা।
তাকিয়েই দেখল মদিনা ওর দিকেই চেয়ে আছে।
‘ভয় পাচ্ছ, মুসা?’ নিচু গলায় মদিনা বলল। ‘তোমাকেও জোর করে ভেতরে ঢোকাবেন না বাবা। ভয় পেলে কেটে পড়তে পারো।’
পিত্তি জ্বলে গেল মুসার। বলল, ‘হ্যাঁ, কেটে পড়ার জন্যেই তো আমেরিকা থেকে এতদূর এসেছি।’ বিরক্তি ঝরল ওর কণ্ঠে। ‘অবশ্য তুমি যদি ফিরে যেতে চাও, তাঁবুতে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারি।’
জোর একটা ঠুং শব্দ উঠতে দু’জনই একযোগে ঘুরে দরজার দিকে তাকাল। সায়েম মোর্শেদ সোনার সীলটা ভাঙার চেষ্টা করছেন।
ওদিকে ঘন ঘন ক্লিক ক্লিক শব্দ উঠছে নীলার ক্যামেরায়। সঙ্কীর্ণ জায়গায় থেকে থেকে ঝলসে উঠছে ক্যামেরার উজ্জ্বল ফ্ল্যাশের আলো।
চার ওয়ার্কার দাঁড়িয়ে ডক্টর মোর্শেদের প্রতিটি নড়াচড়া লক্ষ করছে।
অত্যন্ত ধীরে, সতর্কতার সঙ্গে কাজ করছেন মামা। কোনও তাড়াহুড়ো নেই। প্রাচীন সীলের পেছনে বাটালি ঠেকিয়ে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ওটা ভাল করে ঢুকিয়ে দিলেন তিনি। বাটালিফটটা বেশ কয়েকবার সামনের দিকে চাড় দিলেন।
কয়েক মিনিট পর সিংহের মাথাটা খুলে গেল। ওটা সাবধানে হাতে নিলেন মামা।
ওদিকে তখন একটার পর একটা ছবি তুলছে নীলা।
একজন ওয়ার্কারের হাতে সীলটা তুলে দিলেন মামা। কৌতুক করে বললেন, ‘তোমার ঈদের উপহার ভেব না যেন এটা। এটা আমি আমার ড্রইং রুমের দেয়ালে ঝোলাব।’
হেসে উঠল সবাই।
দরজার পালায় হাত রাখলেন মামা। প্রথমে আমি ঢুকছি,’ ঘোষণা দিলেন। ‘বিশ মিনিটের মধ্যে যদি ফিরে না আসি, ডক্টর ওমরের কাছে গিয়ে বলবে তার কথাই ঠিক।’
আরও জোরে হেসে উঠল ওয়ার্কাররা। মুসা চুপ করে থাকল। মদিনাও।
দু’জন ওয়ার্কার দরজা খোলায় মামাকে সাহায্য করতে এগিয়ে গেল। কাঁধ দিয়ে সজোরে ধাক্কা মারল প্রাচীন দরজায়।
পাথরের মত অনড় দরজা একচুল নড়ল না।
‘তেল দরকার হবে বলে মনে হচ্ছে,’ কৌতুক ঝরে পড়ল সায়েম মোর্শেদের গলায়। ‘চার হাজার বছরের জ্যাম। দরজা এত সহজে খুলবে না।’
হাতুড়ি-বাটালি দিয়ে ওটা খোলার চেষ্টা করল ওয়ার্কাররা।
ব্যর্থ হয়ে অন্য পথ ধরল। সবাই ভারী দরজায় কাঁধ ঠেকিয়ে একযোগে সজোরে ধাক্কা দিল।
‘নড়েছে!’ দরজা একচুল নড়তেই সোৎসাহে বলে উঠলেন মামা।
আরেকটু খুলল!
আরেকটু!
সবাই গভীর আগ্রহে এগিয়ে গেল। ভেতরে উঁকি দেবে।
একজন ওয়ার্কার দৌড়ে গিয়ে খননের কাজে ব্যবহৃত বড় বড় স্পট লাইট দুটো দরজার দিকে ঘুরিয়ে দিল।
দু’জন ওয়ার্কারের সাহায্যে দরজাটা আরেকটু খুললেন মামা।
নীলা সুমাইয়ার গা ঘেঁষে দাঁড়াল মুসা-মদিনা।
‘শিহরন জাগানো মুহূর্ত, তা-ই না?’ চাপা কণ্ঠে বলল নীলা। ‘আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে এখানে শুধু একজন সাংবাদিক উপস্থিত এবং সেই ভাগ্যবান মানুষটি আমি!’
আমিও ভাগ্যবান, মনে মনে ভাবল মুসা। আমি এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, আজ পর্যন্ত কটা ছেলে সেখানে পৌঁছতে পেরেছে? কটা ছেলের সৌভাগ্য হয়েছে চার হাজার বছরের সমাধি-ক্ষেত্র উন্মুক্ত করার সময় উপস্থিত থাকার। কজনের কপালে সুযোগ জোটে? তাও যে-সে কবর নয়, প্রাচীন মিশরের বিখ্যাত এক যুবরাজের কবরের বেলায়?
কিশোর-রবিন-রেমন আর শ্যারনের মুখ ভেসে উঠল মুসার মনের পর্দায়। দারুণ লাগত ওরা এখানে হাজির থাকলে!
মেঝের জঞ্জাল ঠেলে সশব্দে খুলে গেল দরজা।
আরেকটু!
আরেকটু!
একজন ঢোকার মত ফাঁক হয়েছে পালা দুটো।
‘লাইট দুটো আরেকটু ঘুরিয়ে দাও,’ বললেন মামা। ‘এখন আমরা ভেতরে ঢুকে প্রিন্সের সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করব।’
ঘষা খেয়ে আরেকটু খুলল দরজা।
সায়েম মোর্শেদের ওয়ার্কাররা গায়ের জোরে পালা আরেকটু ফাঁক করল।
‘হ্যাঁ, এবার স্বচ্ছন্দে ঢোকা যাবে,’ বললেন মামা।
ছবি তুলল নীলা।
গভীর কৌতূহলে সামনে এগোল সবাই।
প্রথমে ঢুকলেন মামা।
হঠাৎ মুসাকে টেনে থামিয়ে দিল মদিনা। ‘বড়রা আগে!’
বুক কাঁপছে মুসার। টের পাচ্ছে হাত দুটো ঠাণ্ডা হয়ে আসছে বরফের মত। কে আগে ঢুকল, তা নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই ওর। ঢোকা গেলেই হলো।
একজন একজন করে প্রাচীন চেম্বারে ঢুকল সবাই।
সবশেষে মুসার পালা।
লম্বা একটা দম নিয়ে ভেতরে ঢুকল মুসা, এবং দেখল-কিছুই নেই!
চারপাশে মাকড়সার ঘন জাল। শূন্য একটা চেম্বারে ঢুকেছে ওরা!
একদম শূন্য!
তেরো
দীর্ঘ একটা শ্বাস বেরিয়ে এল মুসার বুক চিরে।
হায়রে মামা! কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে ওর মামার দুঃখে। মাঠে মারা গেছে তাঁর এতদিনের অক্লান্ত শ্ৰম।
শূন্য চেম্বারের চারদিকে চোখ বোলাল মুসা।
স্পট লাইটের আলোয় রুপোর মত চকচক করছে মাকড়সার জাল।
ধুলোমলিন মেঝেতে ছায়া পড়েছে ওদের। ছায়াগুলো ক্যারিকেচারের মত লাগছে দেখতে।
ধীরে ধীরে মামার দিকে ফিরল মুসা।
ঘন-কালো মেঘে ছেয়ে যাওয়ার কথা তাঁর সারা মুখ।
কিন্তু এ কী!
বিস্মিত হলো মুসা।
এক টুকরো মুচকি হাসি ঝুলছে তাঁর ঠোঁটে!
মামা একজন ওয়ার্কারকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘লাইট ঘুরিয়ে দাও। হাতুড়ি-বাটালি নিয়ে এসো। আরেকটা সীল ভাঙতে হবে আমাদের।’
শূন্য ঘরটার পেছনের দেয়ালে আঙুল নির্দেশ করলেন সায়েম মোর্শেদ।
ধূসর আলোয় আরেকটা দরজার কাঠামো চোখে পড়ল মুসার।
ভয়ঙ্কর দর্শন সিংহের মাথার সীল আছে ওটাতেও।
‘এটা আসল সমাধি-ক্ষেত্র নয়,’ মুসার দিকে চেয়ে হেসে বলল মদিনা। ‘আমি জানতাম।’
‘মিশরীয়রা প্রায়ই এমন কাজ করত,’ ব্যাখ্যা করলেন মামা। ওরা কবর-চোরদের ধোঁকা দেয়ার জন্যে আসল চেম্বার লুকিয়ে রাখতে এ- ধরনের ফলস চেম্বার তৈরি করত।’ মাথা থেকে হেলমেট খুলে চুলে আঙুল চালালেন তিনি চিরুনির মত করে। ‘আসলে,’ বলে চলেছেন, ‘প্রিন্স খোর-রো’র প্রকৃত সমাধি-ক্ষেত্রে পৌছার আগে হয়তো আমাদের এ-ধরনের আরও কয়েকটা শূন্য চেম্বার পেরোতে হবে।’
মামার আবিষ্কৃত নতুন দরজাটার ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল নীলা সুমাইয়া। মুসার দিকে চেয়ে হাসল সে। ‘এত হতাশ কেন তুমি, মুসা? ভীষণ মনমরা দেখাচ্ছে তোমাকে।’
‘আসলে আমি ভেবেছিলাম…’ দ্বিতীয় সীলের সঙ্গে হাতুড়ি- বাটালির ঠোকাঠুকির শব্দ থামিয়ে দিল ওকে।
ঘুরে সেদিকে তাকাল সবাই।
মুসা ভাবছে, ওই দরজার ওপাশে কী আছে? আরেকটা শূন্য চেম্বার? অথবা চার হাজার বছর আগের এক রাজপুত্র? এবং তার ধনরত্ন?
ধীরে ধীরে কাজ এগিয়ে চলেছে।
কোনও তাড়া নেই সায়েম মোর্শেদের।
সবার পেটেই ছুঁচোর কীর্তন শুরু হয়ে গেছে।
লাঞ্চের জন্যে কিছুক্ষণ বিরতি দেয়া হলো কাজে।
পেট ঠাণ্ডা হতে আবার শুরু হলো কাজ।
মামা সতর্কতার সঙ্গে সীল ভাঙার কাজ শুরু করলেন। ওটার যাতে কোনও ক্ষতি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখছেন।
মামাকে সাহায্য করছে তাঁর ওয়ার্কাররা
মুসা আর মদিনা মেঝেতে বসে সেদিকে চেয়ে আছে।
বাতাস গরম আর স্যাঁতসেঁতে।
প্রাচীন বাতাস বলেই এরকম লাগছে, মুসা ভাবল।
ব্যস্ত হাতে ওদের ছবি তুলছে নীলা সুমাইয়া।
‘হয়ে গেছে প্রায়,’ ঘোষণা দিলেন মামা।
চূড়ান্ত মুহূর্তের জন্যে তৈরি হলো আবার সবাই।
উঠে দাঁড়াল মদিনা আর মুসা। ভাল করে দেখার জন্যে দরজার দিকে কয়েক পা এগোল।
দরজা থেকে খুলে এসেছে সিংহের মাথা। দুই ওয়ার্কার এক কোণে সাবধানে রেখে দিল ওটা, তারপর শুরু হলো দরজা খোলার কসরত।
মুসা বুঝল, এই দরজা খোলা আরও কঠিন হবে।
‘একেবারে সেঁটে আছে!’ মামা কাঁধ দিয়ে দরজাটা ঠেলতে ঠেলতে গুঙিয়ে উঠলেন।
তাঁরা সবাই একযোগে নানান যন্ত্রপাতির সাহায্যে দরজার মূল বাধা, এবড়োখেবড়ো মেঝে খুঁড়ে মসৃণ করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
ঝাড়া একঘণ্টা পর পালা একচুল নড়ানো গেল।
আরেকটু যখন খুলল দরজা, মামা হেলমেটের আলো খুলে হাতে নিলেন, দরজার ফাঁক দিয়ে ভেতরটা দেখার চেষ্টা করলেন।
উঁকি দিলেন ভেতরে।
এগিয়ে গেল ভাই-বোন।
আবার ধড়ফড় শুরু করেছে মুসার বুক। কী দেখতে পাচ্ছেন মামা? নীরবে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে কী দেখছেন উনি?
অবশেষে লাইট নিচু করে ওদের দিকে ঘুরলেন মামা। বিরাট এক ভুল হয়ে গেছে আমাদের!’ শান্তস্বরে বললেন তিনি।
চোদ্দ
নীরবতার সাগরে ডুবে গেল পুরো চেম্বার।
টু শব্দও নেই কারও মুখে। আসলে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না।
ডক্টর মোর্শেদের কথার অর্থ না বুঝে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে সবাই।
ধীরে ধীরে হাসি ফুটল মামার ঠোঁটে। বললেন, ‘আমরা আমাদের আবিষ্কার সম্পর্কে ভুল ধারণা করে এসেছি এতদিন। কিং তুতের সমাধি আবিষ্কারের চেয়ে অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার এটা। এই সমাধি-ক্ষেত্র আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ।’
সবার আনন্দ প্রকাশের আওয়াজ চেম্বারের পাথুরে দেয়ালে • প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরতে লাগল।
উৎফুল্ল ওয়ার্কাররা এগিয়ে গিয়ে হ্যাণ্ডশেক করল মামার সঙ্গে, অভিনন্দন জানাল তাঁকে।
‘অভিনন্দন শুধু আমার প্রাপ্য নয়,’ বলে উঠলেন মামা। ‘তোমরাও এর সমান অংশীদার।’..
হাসতে হাসতে, উত্তেজিতভাবে কথা বলতে বলতে দরজার দিকে এগোল সবাই।
ঢুকল পরের চেম্বারে।
আলোয় ভরে উঠল প্রকাণ্ড কক্ষটা।
সামনের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকল মুসা।
নানা রঙের দ্যুতিতে ঝকমক করছে কক্ষ।
কয়েক পরত ধুলো আর মাকড়সার ঘন জালও আড়াল করতে পারেনি মহামূল্যবান ধনরত্নের আসল রূপ।
সারা চেম্বার ভর্তি ধনরত্নে!
ধীরে ধীরে ঘুরছে মুসার বিস্ফারিত দু’চোখ। ওগুলোর ওপর দৃষ্টি স্থির রাখতে রীতিমত কষ্ট হচ্ছে। দেখে শেষ করা যায় না, মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে।
চার দেয়ালের মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত হায়রোগ্লিফিক ছবি। আসবাবসহ নানান জিনিসে ভরে আছে কক্ষ। মনেই হয় না এটা কোনও সমাধি-ক্ষেত্র। মনে হয় কোনও বিরাট ধনীর স্টোর রূম, বা মস্ত সিন্দুক।
অলঙ্কার-খচিত ঝলমলে একটা পিঠ-খাড়া সিংহাসনের ওপর নজর আটকে গেল মুসার।
ওটার মাথার ওপর বসানো রয়েছে একটা সোনার তৈরি অত্যুজ্জ্বল সূর্য।
সিংহাসনের পেছনে আরও কয়েকটা চেয়ার, বেঞ্চ আছে। আর আছে একটা লম্বা কাউচ।
এক – দেয়াল জুড়ে সাজিয়ে রাখা আছে পাথর আর চিনামাটির অসংখ্য মহামূল্যবান সোরাই জাতীয় গলা-উঁচু জার। ওগুলোর কয়েকটা ভাঙা।
কক্ষের মাঝখানের মেঝেতে একটা সোনার বাঁদরের মাথা দেখা গেল। ওটার পেছনে, আরেক দেয়ালে পাশাপাশি সাজানো রয়েছে কয়েকটা চেস্ট।
একজন ওয়ার্কারের সাহায্য নিয়ে সাবধানে একটা চেস্টের ঢাকনা খুলে ফেললেন মামা। ভেতরে তাকাতে তাঁর চোখ বড় বড় হয়ে গেল।
‘অলঙ্কার!’ চাপা কণ্ঠে বললেন মামা। ‘সোনার অলঙ্কারে ভর্তি!’ মদিনা এগিয়ে এসে মুসার পাশে দাঁড়াল। হাসি লেগে আছে তার মুখে।
‘কী সাঙ্ঘাতিক!’ বলল মুসা নিচু স্বরে।
‘হ্যাঁ, তা-ই!’ একমত হলো মদিনা।
চেম্বারে মুসা ও মদিনার ফিসফিস কথা আর নীলার ক্যামেরার শাটার টেপার শব্দ ছাড়া আর কোনও আওয়াজ নেই। মামা কখন নিলাকে ক্যামেরা আনার অনুমতি দিলেন? ভাবল মুসা।
ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দই এখনকার সবচেয়ে জোরাল শব্দ।
মদিনা আর মুসার মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন সায়েম মোর্শেদ। দু’হাত রাখলেন দু’জনের কাঁধে।
‘অবিশ্বাস্য, তা-ই না?’ বললেন তিনি। ‘এত বছর পরও সবকিছু ঠিকঠাক আছে। কারও হাতের ছোঁয়া লাগেনি এগুলোয়।
মামার চোখের দিকে চাইতে মুসা বুঝল, তাঁর চোখ ছলছল করছে। জীবনে সবচেয়ে স্মরণীয় দিন আজ.. তাই প্রচণ্ড আবেগে কেঁদে ফেলেছেন মামা।
‘আমাদের খুব সাবধান…’ কথা শেষ না করে থেমে গেলেন তিনি। গম্ভীর হয়ে গেলেন হঠাৎ করে। ওদের পুরো কক্ষ ঘুরিয়ে দেখালেন তিনি। ওরা বুঝল কেন হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেছেন ডক্টর মোর্শেদ।
দূরের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাথরের বিশাল মমি কেসটার দিকে চেয়ে আছেন তিনি।.
‘বাপরে!’ ওটার দিকে এগোবার সময় উচ্চারণ করল মুসা।
মসৃণ ধূসর পাথরের তৈরি ওটা। ঢাকনার ঠিক মাঝখানে গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত দীর্ঘ একটা ফাটল রয়েছে।
‘এটার ভেতরেই সমাধিস্থ করা হয়েছে প্রিন্সকে?’ মদিনা জানতে চাইল।
জবাব দিতে ডক্টর মোর্শেদ সময় নিলেন কয়েক মুহূর্ত। দু’জনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। কেসটার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন।
‘কিছুক্ষণের মধ্যেই জানা যাবে,’ অবশেষে জবাব দিলেন তিনি।
তিনি ওয়ার্কারদের নিয়ে মমি কেস খুলতে লেগে গেলেন।
ক্যামেরা নামিয়ে এগিয়ে এল নীলা। তার সবুজ চোখের দৃষ্টির সামনে ধীরে ধীরে খুলে গেল ঢাকনা।
ভেতরে মমির আকারের একটা কফিন দেখা যাচ্ছে। খুব বেশি বড় নয়। যতটুকু ধারণা করেছিল মুসা, তার চেয়েও সরু।
মমিটা দেখেই অস্ফুট একটা আর্তচিৎকার করল মুসা। চট করে মামার হাত চেপে ধরল ও।
খুব ছোট আর ভঙ্গুর ওটা।
মামা বিড়বিড় করে বললেন, ‘প্রিন্স খোর-রো।’ নজর মমিটার ওপর।
প্রিন্স চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। তার কাঠির মত সরু দু’হাত আড়াআড়ি ভাবে বুকের ওপরে রাখা। ব্যাণ্ডেজের ভেতর থেকে আলকাতরা গলে বেরিয়ে এসেছে। মাথার ব্যাণ্ডেজ খুলে গেছে কয়েক জায়গায়, ভেতরে খুলিফটটা দেখা যাচ্ছে। আলকাতরা গড়িয়ে নেমে ছড়িয়ে পড়েছে মুখমণ্ডলে।
কেসটার ওপর ঝুঁকে পড়তেই মুসার মনে হলো ওর হৃৎপিণ্ডটা গলায় এসে ঠেকেছে। মনে হলো আলকাতরা মোড়া চোখ দুটো অসহায় ভাবে চেয়ে আছে ওর দিকে।
জ্যান্ত কেউ শুয়ে আছে ভেতরে, ভাবতেই অদ্ভুত এক শিহরন বয়ে গেল মুসার শরীরে। ভাবল, প্রিন্সের দেহের গড়ন প্রায় আমারই মত। এবং সে মারা গেছে। তাকে গরম আলকাতরা আর কাপড় দিয়ে মুড়ে রাখা হয়েছে। সে প্রায় চার হাজার বছর ধরে এই কেসের মধ্যে ঘুমিয়ে আছে।
এক যুবরাজ।
বিবর্ণ আলকাতরা মোড়ানো মুখটার দিকে তাকাল মুসা। গোউয-ব্যাণ্ডেজ মলিন, হলদেটে হয়ে গেছে। ভেতরের খুদে, ভঙ্গুর দেহটাও তা-ই। একসময় জীবিত ছিল সে, ভাবছে মুসা। কখনও কি সে কল্পনা করতে পেরেছে চার হাজার বছর পর কেউ এ-কফিন খুলে তার মমিতে রূপান্তরিত দেহের দিকে চেয়ে থাকবে?
এক পা পিছিয়ে লম্বা একটা দম ছাড়ল মুসা। ব্যাপারটা সত্যি চরম উত্তেজনাকর।
নীলার দিকে তাকাল মুসা, দেখতে পেল চোখ ছলছল করছে তার। দু’হাতে মমি কেসের কোনা ধরে নিচু হয়ে প্রিন্সকে দেখছে সে। অপলকে চেয়ে আছে কালচে মুখের দিকে।
‘এ-পর্যন্ত পিরামিডে যতগুলো মমি পাওয়া গেছে,’ শান্ত স্বরে মামা বললেন, ‘সেগুলোর মধ্যে এটার অবস্থা সবচেয়ে ভাল বলে মনে হচ্ছে। অবশ্য এর পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্যে কিছু পরীক্ষা- নিরীক্ষা করতে হবে আমাদের। যদিও চেম্বারের সবকিছুর ওপর চোখ বুলিয়ে যতদূর বোঝা যাচ্ছে, তাতে…
কথা শেষ না করে থেমে গেলেন সায়েম মোর্শেদ। গলার আওয়াজ আসছে সুড়ঙ্গ থেকে। সেই সঙ্গে পায়ের আওয়াজ।
ঘুরে দরজার দিকে তাকাল মুসা। কালো ইউনিফর্ম পরা পাঁচজন পুলিশ অফিসারকে দেখা গেল দরজায়।
‘পিছিয়ে দাঁড়ান সবাই,’ আদেশ দিল তাদের একজন। ডানহাতটা কোমরে হোলস্টারের পাশে রেখেছে সে।
পনেরো
প্রচণ্ড বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল উপস্থিত সবাই।
ঘুরে দাঁড়িয়েছেন ডক্টর মোর্শেদ। দু’চোখে তাঁর রাজ্যের বিস্ময়। ‘কী হচ্ছে এসব?’ চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি। ‘কারা আপনারা?’
গম্ভীর মুখে, ধীর পায়ে চেম্বারের মাঝখানে এসে দাঁড়াল পাঁচ পুলিশ অফিসার।
‘সাবধান!’ ধমকে উঠলেন মামা। মমি কেস আগলে দাঁড়িয়ে আছেন। ‘কোনও কিছু ছোঁবেন না। এখানকার সবকিছু ভঙ্গুর।’
মাথা থেকে হেলমেট খুলে ফেললেন মামা। তাঁর দৃষ্টি পাঁচ অফিসারের মুখের ওপরে ঘুরে ফিরছে। ‘আপনারা এখানে কেন এসেছেন?
‘আমিই ওদের নিয়ে এসেছি,’ দরজার দিক থেকে ভেসে এল একটা গলা।
ভেতরে ঢুকলেন আসাদ ওমর। স্বস্তির ছাপ তাঁর চেহারায়।
‘আমি কিছু বুঝতে পারছি না, ওমর,’ তাঁর পার্টনারের দিকে কয়েক পা এগিয়ে গেলেন মামা।
‘এই সমাধি-কক্ষের নিরাপত্তার দরকার আছে,’ বললেন ওমর। চেম্বারের ধনরত্নের ওপর দিয়ে দ্রুত ঘুরে এল তাঁর দৃষ্টি। স্থির হলো মামার ওপর।
‘চমৎকার! সত্যিই চমৎকার!!’ উত্তেজিত গলায় বললেন আসাদ ওমর। দু’পা এগিয়ে নিজের মুঠোয় মামার দু’হাত তুলে নিলেন। ‘অভিনন্দন তোমাদের! চোখে যা দেখছি বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে!’
সায়েম মোর্শেদের চেহারা কিছুটা নরম হলো। ‘ওঁদের কী প্রয়োজন এখনও বুঝতে পারছি না আমি,’ গম্ভীরমুখো অফিসারদের দিকে ইশারা করে বললেন তিনি। ‘এই ঘরের কিছু কেউ চুরি করছে না।’
‘তা কে বলল, ছি-ছি,’ জবাবে বললেন ওমর। এখনও ধরে আছেন তিনি মামার হাত। তা হবে কেন! তবে তোমার আবিষ্কারের কথা শীগগির চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। তাই এগুলোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা আমাদের আগে-ভাগেই করে রাখা উচিত।’
একে একে পাঁচ অফিসারের মুখের ওপর দিয়ে ঘুরে এল মামার দৃষ্টি। কাঁধ ঝাঁকালেন তিনি। ‘হয়তো তুমি ঠিক কাজই করেছ, ওমর। বুদ্ধিমানের কাজ করেছ।’
‘এদের কথা আপাতত ভুলে যাও,’ অফিসারদের দেখিয়ে বললেন ওমর। বাচ্চা ছেলের মত আর্কিওলজিস্টের পিঠ চাপড়ে দিলেন। ‘আমার ভুল হয়ে গেছে, মোর্শেদ, এখন বুঝতে পারছি। তোমাকে বাধা দেয়া উচিত হয়নি আমার তখন। ব্যাপারটা বোঝা উচিত ছিল আমার। বিজ্ঞানী হিসেবে এই সমাধি পৃথিবীর সামনে উন্মুক্ত করাই আসলে আমাদের কর্তব্য, দায়িত্ব। আমাকে মাফ করে দাও। এখন আমাদের একসঙ্গে সেলিব্রেট করা উচিত, কী বলো?’
ষোলো
‘লোকটাকে কেন যেন আমি সহ্য করতে পারি না,’ সে-রাতে ডিনারের সময় বললেন মামা। ‘ব্যাটাকে একদম সহ্য করতে পারি না।’
পরিষ্কার রাত। আকাশে তারা ঝলমল করছে। বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। মৃদুমন্দ বাতাসে অল্প অল্প মাথা দোলাচ্ছে মরুভূমির খেজুর গাছগুলো। তাল মিলিয়ে নড়ছে তাঁবুর সামনের আগুন। কাবাব তৈরির জন্য বড় ক্যাম্পফায়ার ধরানো হয়েছে।
‘ডক্টর ওমর কি আমাদের ডিনারে আসবেন, বাবা?’ জিজ্ঞেস করল মদিনা। সবুজ রঙের চমৎকার একটা সোয়েটার পরেছে ও।
সায়েম মোর্শেদ মাথা নাড়লেন। ‘না, কায়রো ফোন করতে গেছে ও। আমার মনে হয় আমাদের কাজে যারা টাকা যোগান দিয়েছে, তাদের সুখবরটা জানানোর জন্যে উদ্গ্রীব হয়ে আছে ও।’
‘ভদ্রলোক মমি আর ধনরত্ন দেখে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন,’ বলল মুসা। রাতের আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা পিরামিডের দিকে চেয়ে থাকল আনমনে।
‘হ্যাঁ,’ একমত হলেন মামা। ‘হঠাৎ করে মত পরিবর্তন করেছে ও। ওর ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে। এরকম সময়ে ও মিশনের আসল দায়িত্ব ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে পারে। ওই পুলিশ অফিসারদের ওপরেও নজর রাখতে হবে।’
‘বাবা, আজকের রাতটা আনন্দের রাত,’ মদিনা বলল। ‘তুমি এখন বিশ্ববিখ্যাত, তা-ই না বাবা? ডক্টর ওমরের কথা বাদ থাকুক। তারচে’ বরং প্রিন্স খোর-রো’র কথা বলো।’
‘আচ্ছা, বেশ,’ বললেন সায়েম মোর্শেদ।
ক্যাম্পফায়ারের কাছে মুসাদের জন্য অপেক্ষা করছে নীলা সুমাইয়া। তাকে কাবাব খাওয়ার দাওয়াত করেছেন মামা।
নীলা লুজ-ফিটিং জিন্সের ওপর সাদা সুয়েট শার্ট পরেছে। চাঁদের আলোয় বুকের ওপর ঝিলিক দিচ্ছে তার অ্যাম্বার লকেট।
মুসারা এগিয়ে আসতে মামার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল নীলা সুমাইয়া। মামার মুখ দেখে মুসা বুঝল, নীলাকে তাঁর বেশ ভাল লেগেছে।
হেসে বলল নীলা, মদিনা, মুসার চেয়ে তুমি লম্বা, তা-ই না?’ হাসল মদিনা।
মুসার চেয়ে লম্বা সে, এ-জন্য মদিনা গর্বিত।
‘এক ইঞ্চিরও কম,’ চট করে মুসা বলল।
মামাকে বলল নীলা, ‘মানুষ ক্রমে একটু একটু করে লম্বা হচ্ছে। খুব খাটো ছিল প্রিন্স খোর-রো। বলতে গেলে বামন ছিল।’
হাসল মামা। ‘আপনি নিশ্চয় ভেবে অবাক হচ্ছেন, এরকম বেঁটে মানুষগুলো কীভাবে অত উঁচু পিরামিড তৈরি করল, তা-ই না?’
হেসে উঠল নীলা সুমাইয়া। মামার হাত ধরল সে।
মুসা আর মদিনা চোখ চাওয়া-চাওয়ি করল। মুসা বুঝতে পারছে, মদিনা এখন কী ভাবছে।
চমৎকার হয়েছে ডিনার। বীফ রোস্ট একটু বেশি ঝলসে ফেলেছেন মামা, কিন্তু তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি কেউ। বরং তাতে স্বাদ বেড়ে গেছে।
মদিনা মাঝারি আকারের তিন প্লেট রোস্ট সাবাড় করল। মুসা মাত্র দুই প্লেট, তাতেই পেট ভরে হাঁসফাঁস অবস্থা।
মুসা মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হলো, মেয়েটা খেতে পারে বটে। যেমন দ্রুত খায়, তেমনি বেশি।
ওদিকে মামা আর নীলা হাসি-ঠাট্টায় ব্যস্ত।
‘সমাধি-কক্ষটা দেখতে মুভি সেটের মত,’ বলল নীলা। ‘একেবারে অবিকল। তেমনি ঝকঝকে। সে-কথাই লিখব আমি আমার আর্টিকেলে।’
হেসে উঠল মদিনা। মুসার দিকে ঘুরল। ‘মমিটা ভাল করে দেখেছ তো, মুসা? হাতঘড়ি নেই তো?’
‘না,’ সংক্ষিপ্ত জবাব দিল মুসা।
‘শুনলেন?’ নীলার দিকে তাকাল মদিনা। ‘হাতঘড়ি নেই ওটার। অর্থাৎ ওটা সত্যিকারের সমাধি-ক্ষেত্র, ছবি তৈরির সেট নয়। মমিটাও অকৃত্রিম।’
‘আমারও তা-ই মনে হয়,’ বলল নীলা সুমাইয়া।
‘বাবা, তুমি মমি জীবন্ত করার মন্ত্রটা জানো?’ মদিনা জিজ্ঞেস করল। ‘তোমার পার্টনার কবরে খোদাই করা যে শব্দগুলোর কথা বলছিলেন?’
রোস্টের শেষ টুকরোটা মুখে পুরলেন আর্কিওলজিস্ট। তারপর ন্যাপকিন দিয়ে মুখ মুছলেন। প্রায় বিড়বিড় করে বললেন, ‘কোনও বিজ্ঞানী কুসংস্কারে বিশ্বাস করে, ভাবতেই পারি না আমি।’
‘কিন্তু আসলে শব্দ দুটো কী?’ জানতে চাইল নীলা। ‘বলুন না, জানতে খুব ইচ্ছে করছে।’
‘বলা যাবে না,’ এক টুকরো রহস্যময় হাসি দিলেন মামা। ‘আমি বলে দিই, আর আপনি মমি জীবন্ত করে ছবি তুলে কাগজে ছাপাবেন- তা-ই না? ওসব চলবে না।’
হেসে উঠল সবাই। ওরা ক্যাম্পফায়ারের পাশে বসে আছে। সবার মুখে কমলা রঙের আগুনের আভা নেচে বেড়াচ্ছে।
‘টেকি কাহরু, টেকি কাহরু, টেকি কাহরু,’ মন্ত্র পড়ার মত উচ্চারণ করলেন মামা। একই সঙ্গে হাত নাড়ালেন আগুনের ওপর। ‘প্রায় মাসখানেক আগে খোঁড়াখুঁড়ির সময় একটা প্রাচীন শিলালিপি পেয়েছিলাম আমি। ওটা পাঠাই আমার এক লিপি বিশারদ বন্ধুর কাছে। আমেরিকায়। সে জানায়, এই শব্দ দুটো পরপর তিনবার খোদাই করা আছে সেই শিলায়। শব্দগুলো পরপর পাঁচবার উচ্চারণ করলে নাকি মমি জীবন্ত হয়ে ওঠে।’
‘সত্যি নাকি?’ বিস্মিত হলো মদিনা।
‘হ্যাঁ,’ হাসিমুখে মাথা ওপর-নীচ করলেন আর্কিওলজিস্ট। ‘শুধু শিলাতেই নয়, এগুলো খোর-রো’র সমাধি-কক্ষের দরজায়ও খোদাই করা আছে।’
মদিনার বিস্ময় আরও বাড়ল। ‘উচ্চারণ করলেই মমি নড়েচড়ে উঠে বসবে? জ্যান্ত মানুষের মত উঠে দাঁড়াবে?’
মামা জবাবে বললেন, ‘জানি না। সত্যিই যদি দাঁড়ায়, তা হলে খুব অবাক হব।’ উঠে দাঁড়ালেন। শব্দ দুটো পরপর পাঁচবার উচ্চারণ করতে হবে।’
টেকি কাহরু, টেকি কাহরু, টেকি কাহরু, মনে মনে বারবার আওড়াল মুসা। কয়েকবার আওড়াতেই মুখস্থ হয়ে গেল। ওর মাথায় মদিনাকে ভয় দেখাবার সুন্দর একটা বুদ্ধি এসেছে। সেটা কাজে লাগাতে হবে।
‘কোথায় যাচ্ছেন?’ ডক্টর মোর্শেদকে প্রশ্ন করল নীলা।
‘কমিউনিকেশন টেণ্টে, জরুরী একটা টেলিফোন করতে হবে।’ বালির মধ্যে হাঁটতে শুরু করলেন মামা। খুব দ্রুত কমিউনিকেশন টেন্টের দিকে এগিয়ে চললেন।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল নীলা। ‘গুড-নাইট জানিয়ে গেলেন না।’
‘বাবা ওরকমই,’ জবাব দিল মদিনা। ‘মাথায় জরুরি কিছু ঢুকলে আর সব ভুলে যান।’
‘আমিও এখন যাব,’ উঠে দাঁড়াল নীলা সুমাইয়া। ভাবছি আজ রাত থেকেই তোমার বাবার আবিষ্কার নিয়ে লিখতে শুরু করব।’
ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাঁটতে শুরু করল নীলা।
আগুনের দিকে চেয়ে আছে মুসা আর মদিনা।
আকাশে বাঁকা চাঁদ হাসছে। পিরামিডের চুড়োয় পড়েছে তার ম্লান আলো। প্রকাণ্ড কাঠামোটাকে আধিভৌতিক করে তুলেছে।
মদিনাকে লক্ষ করে বলল মুসা, ‘নীলা ম্যাডাম ঠিকই বলেছেন। সমাধি-কক্ষটা মুভি সেটের মতই লাগছিল।’
জবাব দিল না মদিনা। অপলকে চেয়ে আছে আগুনের দিকে। কী যেন ভাবছে।
আগুনের মধ্যে সশব্দে জ্বলন্ত কাঠ ফুটল। আওয়াজটা মুহূর্তে মদিনাকে সচকিত করল। বাস্তবে ফিরে এল ও, গভীর দৃষ্টিতে মুসার দিকে তাকাল, ‘তোমার কী মনে হয় মুসা, মহিলা বাবার দিকে ঝুঁকে পড়ছেন?’
‘মনে হয়,’ মুসা বলল। ‘সবসময় মামার দিকে আড়ে আড়ে তাকান, মিটিমিটি হাসেন, প্রায় সময় ঠাট্টা-মশকরাও করেন।’
মুসার জবাব নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবল মদিনা। ‘বাবা কী ওঁকে পছন্দ করেছেন?’
হাসল মুসা। ‘খুব সম্ভব,’ বলে উঠে দাঁড়াল। তাঁবুতে ফেরার তাড়া আছে ওর।
মদিনাকে ভয় দেখাতে হবে।
মদিনাও উঠে দাঁড়াল।
নীরবে তাঁবুর দিকে হেঁটে চলেছে ওরা।
মুসা জানে, এখনও মদিনা বাবা আর নীলার কথা চিন্তা করছে। রাতের বাতাস ঠাণ্ডা। তবে তাঁবুর ভেতরটা বেশ গরম। ক্যানভাসের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো ঢুকছে।
মদিনা নিজের কটের সামনে হাঁটু গেড়ে বসল, তলা থেকে সুটকেস বের করে আনল। ডালা খুলে কাপড়-চোপড়ের মধ্যে খুঁজতে লাগল কিছু একটা।
‘মদিনা!’ আচমকা ফিসফিস করে বলে উঠল মুসা। ‘প্রাচীন শব্দ দুটো পাঁচবার উচ্চারণ করি?’
‘কী?’ মুখ তুলে তাকাল ও।
‘শব্দগুলো পাঁচবার উচ্চারণ করব ভাবছি!’ মুসা বলল। ‘দেখতে চাই কী ঘটে।’
মুসা ভেবেছিল, ওকে নিষেধ করবে মদিনা। ভীষণ ভয় পেয়ে আকুতি-মিনতি শুরু করে দেবে, ‘প্লিজ মুসা, ও-কাজ কোরো না! ও-কাজ কোরো না! মারাত্মক বিপদে পড়ব আমরা!’
সেসব কিছুই ঘটল না। নীরবে মুখ ঘুরিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে হাতের কাজে। মুসা ভাবল, চালটা মাঠে মারা গেল।
তখনই ওকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠল মদিনা, ‘ঠিক আছে, করো দেখি!’
‘সত্যি করব?’
মদিনা একজোড়া ডেনিম কাটঅফ বের করতে করতে পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘হ্যাঁ, কেন করবে না?’
তীক্ষ্ণ চোখে ওর দিকে তাকাল মুসা। একটু ভয়ের আভাস দেখা যাচ্ছে না মদিনার চোখে? ভয় লুকাতে চেষ্টা করছে না ও? হ্যাঁ, ভয় পেয়েছে মদিনা। অল্প হলেও পেয়েছে। অবশ্য ভয় লুকাতে প্ৰাণপণ চেষ্টা করছে।
মুসা মদিনার দিকে কয়েক পা এগিয়ে গেল। চেহারা গম্ভীর করে তুলল। মামা যেভাবে উচ্চারণ করেছিলেন, ঠিক সেভাবে থেমে থেমে বলতে লাগল, ‘টেকি কাহরু, টেকি কাহরু, টেকি কাহরু!’
কাটঅফটা ফেলে মুসার দিকে ঘুরল মদিনা।
‘টেকি কাহরু, টেকি কাহরু, টেকি কাহরু!’ দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করল মুসা।
তৃতীয়বার!
চতুর্থবার!
মুসা নিজেই ইতস্তত করল। মেরুদণ্ড বেয়ে ভয়ের ঠাণ্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল ওর। অজান্তেই একটা ঢোক গিলল। ও কী আবার মন্ত্রটা উচ্চারণ করবে? সেটা কি ঠিক হবে?
পঞ্চমবারের মত উচ্চারণ করলে যদি সত্যি সত্যি…
সতেরো
পরাজিত মুসা দ্বিধাগ্রস্ত চেহারায় মদিনার দিকে তাকাল।
ট্রাঙ্ক বন্ধ করে ওটার গায়ে হেলান দিয়ে চেয়ে আছে সে মুসার দিকে। চোখেমুখে চাপা উত্তেজনা।
মুসা বুঝল, বেশ ভয় পেয়েছে মদিনা। ঘন ঘন নীচের ঠোঁট কামড়াচ্ছে।
ভেবে চলেছে মুসা, পঞ্চমবারের মত শব্দগুলো উচ্চারণ করা কী ঠিক হবে?
আরেকটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল মেরুদণ্ড বেয়ে।
স্রেফ একটা কুসংস্কার এটা, মনে মনে নিজেকে শোনাল ও। চার হাজার বছরের পুরানো কুসংস্কার।
একটা প্রাচীন মন্ত্র পরপর পাঁচবার আওড়ালেই ব্যাণ্ডেজ মোড়া, সুপ্রাচীন প্রিন্স খোর-রো জ্যান্ত হয়ে উঠবে, একেবারেই অবাস্তব।
একেবারেই অসম্ভব।
প্রাচীন মিশরীয় মমির ওপরে দেখা একটা ছায়াছবির কথা মনে পড়ে গেল মুসার। কাহিনি অনেকটা এ ধরনের। সমাধি-ক্ষেত্রে খোদাই করা সতর্কবাণী অগ্রাহ্য করেছিল এক বিজ্ঞানী। মমি জীবন্ত হয়ে ওঠে। বিজ্ঞানীকে মেরে ফেলে।
একেবারেই অবাস্তব। তবে দেখার সময় বাস্তব লেগেছে।
এই মুহূর্তে বোনের মুখের দিকে চেয়ে মুসা বুঝতে পারল, বেশ ভয় পেয়েছে সে।
লম্বা একটা দম নিল মুসা। বুঝতে পারছে, ভয় ও নিজেও পাচ্ছে। কিন্তু দেরি করে ফেলেছে ও। ফেঁসে গেছে। বুঝতে পারছে, আরও আগে নিজেকে সামাল দেয়া উচিত ছিল।
অনেক দূর এগিয়ে গেছে।
এখন থেমে গেলে চলবে না।
মদিনা ওকে নিয়ে তামাশা করার চমৎকার একটা কারণ পেয়ে যাবে। তা হতে দেয়া যায় না।
‘টেকি কাহরু, টেকি কাহরু, টেকি কাহরু!’ দম বন্ধ করে পঞ্চমবারের মত উচ্চারণ করল ও।
পরক্ষণেই বুঝল ভয়ে জমে আসছে ওর হাত পা। জানা নেই কী আশা করছে ও, কী ঘটবে এরপর।
বাজ-টাজ পড়বে এক-আধটা?
অথবা ভূমিকম্প শুরু হয়ে যাবে?
নাকি …
উঠে দাঁড়াল মদিনা। চিন্তান্বিতভাবে ঘন চুলে হাত চালাচ্ছে।
‘স্বীকার করো,’ জোর করে হাসল মুসা, ‘ভয় পেয়েছ তুমি।’
‘একেবারেই না,’ জোর দিয়ে বলল মদিনা। ‘বলে যাও। আবার উচ্চারণ করো শব্দগুলো। তুমি শতবার উচ্চারণ করেও ভয় দেখাতে পারবে না আমাকে। একটুও না।’
একই মুহূর্তে চমকে উঠল ওরা একযোগে।
একটা ছায়া!
গাঢ় ছায়া!
তাঁবুর পুরু আবরণের ওপর একটা ছায়া পড়েছে!
আসছে ওটা!
গম্ভীর, চাপা একটা কণ্ঠস্বরে হৃৎস্পন্দন থেমে গেল ওদের।
‘ভেতরে তুমি আছ?’ বলল কণ্ঠটা।
আঠারো
মদিনার গা ঘেঁষে দাঁড়াল মুসা।
বিস্ময়ে, ভয়ে মদিনার কাঁপুনি শুরু হয়ে গেছে!
ছায়ামূর্তিটা ধীরে ধীরে তাঁবুর প্রবেশপথের দিকে এগিয়ে আসছে!
চেঁচানোর সময় পেল না ওরা। কাউকে ডাকারও সময় পেল না। হাঁ করে তাকিয়ে থাকল ওরা বাইরের অন্ধকারের দিকে।
ফাঁক হয়ে যাচ্ছে টেণ্ট ফ্ল্যাপ। দেখতে পেল ওরা, ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢুকেছে একটা মাথা!
‘মা-গো!’ আলো আঁধারিতে মাথাটার দিকে তাকিয়েই অস্ফুটে গুঙিয়ে উঠল মদিনা
মমি জীবন্ত হয়ে উঠেছে ভেবে প্রচণ্ড এক ঝাঁকি খেল ওরা। জীবন্ত হয়ে উঠেছে মমি!
‘আঙ্কেল ওমর!’ বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠল মদিনা।
‘কী?’ চোখ কচলে ভাল করে মাথাটার দিকে তাকাল মুসা।
হ্যাঁ, ডক্টর ওমর মাথা ঢুকিয়ে দিয়েছেন ভেতরে।
আহাম্মকের মত দাঁড়িয়ে থাকল মুসা। নিজের বুকের ধুকপুকুনি শুনতে পাচ্ছে স্পষ্ট। মুখ দিয়ে কোনও কথা বের করতে পারল না।
‘তোমার বাবাকে খুঁজছি,’ মদিনাকে বললেন আসাদ ওমর। ‘এখনই দেখা করা দরকার। খুব জরুরি।
‘বাবা ক-কমিউনিকেশন টেন্টে আছেন,’ কোনওমতে বলল মদিনা। ‘ফোন করতে গেছেন।’
তৎক্ষণাৎ মাথাটা অন্ধকারে হারিয়ে গেল। বাইরে বালিতে তাঁর পায়ের আওয়াজ শোনা গেল।
ওরা বুঝল, দ্রুত কমিউনিকেশন টেন্টের দিকে যাচ্ছেন ডক্টর ওমর।
মদিনার দিকে ঘুরল মুসা। বুক কাঁপছে এখনও। ‘ভদ্রলোক আমাকে ভীষণ ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন,’ অকপটে স্বীকার করল। ‘আমি ভেবেছিলাম উনি কায়রো গেছেন। যখন তাঁর টাকমাথাটা উদয় হলো…’
হেসে উঠল মদিনা। উনি সত্যিই মমির মত দেখতে, তা-ই না?’ হাসি চওড়া হলো ওর। ‘কিন্তু ভেবে পাচ্ছি না এত ব্যস্ত হয়ে বাবাকে খুঁজছেন কেন।’
‘চলো আমরাও যাই,’ মুসা বলল। ‘শুনে আসি ব্যাপারটা কী।’
মদিনাও চট করে রাজি হয়ে গেল। টেণ্ট ফ্ল্যাপের দিকে এগোতে শুরু করল ওরা।
মদিনার পেছন পেছন মুসা তাঁবু থেকে বেরিয়ে এল।
শীতল রাত। বাতাসে একটু একটু করে নড়ছে তাঁবুগুলোর ক্যানভাস।
গা ছমছমে পরিবেশ।
‘কোনদিকে গেলেন ভদ্রলোক?’ অনিশ্চিত গলায় বলল মুসা। দূরের নির্দিষ্ট টেন্টের দিকে তাকাল মদিনা। ‘কমিউনিকেশন টেন্টের দিকেই মনে হয়, আর কোথায় যাবেন?’
দ্রুত পা চালাল ওরা। পায়ের আঘাতে বালি উড়ছে।
মামার ওয়ার্কারদের তাঁবু থেকে গানের সুর ভেসে আসছে। গান গাইছে ওরা। দীর্ঘদিনের শ্রম সফল হওয়ায় আনন্দ করছে।
আকাশের চাঁদ মরুভূমির বুকে রুপোলি আলোর কার্পেট বিছিয়ে দিয়েছে যেন।
‘হ্যাঁ, ওই তো ডক্টর ওমরের রুগ্ন ছায়ামূর্তিটা দ্রুত বেগে এগিয়ে যাচ্ছে,’ বলল মদিনা।
শেষ তাঁবুতে ঢুকে গেলেন তিনি।
ওটার একটু দূরে আরেকটা তাঁবুর আড়াল নিল ওরা। চট করে কেউ দেখতে পাবে না।
একটু পর কমিউনিকেশন টেণ্ট থেকে ডক্টর ওমরের উত্তেজিত কণ্ঠ ভেসে এল। কোনও কারণে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন তিনি।
‘কী বলছেন উনি?’ ফিসফিস করে বলল মদিনা I
জবাব দিল না মুসা। ভেতরের খবর ও জানে না। কী জবাব দেবে?
কয়েক সেকেণ্ড পর তাঁবু থেকে বেরিয়ে এল দুটো ছায়া। তাদের হাতে উজ্জ্বল ফ্ল্যাশলাইট জ্বলছে। তারা হলদেটে চাঁদের আলো পেরিয়ে জোর পায়ে সামনের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
মুসার মনে হলো ডক্টর ওমর জোর করে মামাকে পিরামিডের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন।
‘ব্যাপার কী?’ ভাইয়ের আস্তিন আঁকড়ে ধরল মদিনা। ‘উনি কী বাবাকে জোর করে নিয়ে যাচ্ছেন?’
বাতাস যেন মরুভূমির বুকে শিস কেটে ছুটছে।
মুসার সারা দেহ ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠল.
দূর থেকে দু’জনের উত্তেজিত কণ্ঠে কথা বলতে শুনল ওরা। কিছু নিয়ে তীব্র বিতর্ক চলছে। ফ্ল্যাশলাইটের আলো হাঁটার ছন্দে ঘনঘন জায়গা বদল করছে।
তর্ক করছেন ওঁরা? ভাবছে মুসা। ডক্টর ওমরের এক হাত মামার কাঁধে। তিনি কি মামাকে ঠেলে পিরামিডের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন? নাকি মামাই তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছেন?
অন্ধকারে বোঝা কঠিন।
ব্যস্ত হয়ে উঠল মদিনা। ‘জলদি চলো, ব্যাপারটা কী দেখতে হবে।’
তাঁবুর আড়াল থেকে বেরিয়ে ওঁদেরকে অনুসরণ করতে শুরু করল ওরা। ধীরে ধীরে এগোচ্ছে, নজর সামনের দু’জনের ওপর। বেশ দূরত্ব বজায় রেখে চলছে।
‘এদিকে তাকালেই আমাদের দেখে ফেলবেন ওঁরা,’ মদিনা নিচু গলায় বলল।
ভাই-বোন প্রায় গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বালির ওপর দিয়ে হাঁটছে।
ঠিক বলেছে মদিনা, মুসা ভাবল।
খোলা মরুভূমি। লুকানোর মত কোনও গাছ বা ঝোপজঙ্গল নেই।
‘ওঁরা পেছন ফিরবেন বলে মনে হয় না,’ বলল মুসা।
ওরা সতর্ক পায়ে এগোল।
এলোমেলো বাতাসে বালি উড়ছে। অদূরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে পিরামিড।
ওরা ডক্টর ওমর আর সায়েম মোর্শেদকে প্রিন্স খোর-রো’র সমাধি- ক্ষেত্রের প্রবেশ-পথের সামনে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখল। ওঁদের অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। এলোমেলো বাতাসের জন্য শোনা যায় না। তবে দু’জন যে তর্ক করছেন তা বেশ বোঝা যাচ্ছে।
প্রথমে মামা পিরামিডের মধ্যে ঢুকলেন। ডক্টর ওমর তাঁকে অনুসরণ করলেন।
‘ভদ্রলোক বাবাকে জোর করে ভেতরে ঢোকালেন বলে মনে হলো না?’ প্রশ্ন করল মদিনা। গলা কাঁপছে। ভয় পেয়েছে ও। বুঝতে পেরেছি, বাবাকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে ভেতরে ঢোকানো হয়েছে।’
মুসা নার্ভাস কণ্ঠে বলল, ‘কী জানি।’
আরেকটু এগিয়ে গেল ওরা, তারপর দাঁড়িয়ে পড়ল। চেয়ে রইল অন্ধকার প্রবেশপথের দিকে। একই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে দু’জনের মাথায়। একই প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে দু’জনের মনে- ভেতরে ঢুকবে?
উনিশ
মুসা ও মদিনা চোখ চাওয়া-চাওয়ি করল।
রাতের আঁধারে পিরামিডটাকে ভয়াবহ লাগছে। ওটা প্রাগৈতিহাসিক দানবের মত মনে হচ্ছে। পিরামিডের দেয়ালে বাতাসের ঘর্ষণে পিলে চমকানো গোঁ-গোঁ আওয়াজ উঠছে। সে-আওয়াজ যেন মুসা আর মদিনাকে দুর্বোধ্য ভাষায় সতর্ক করে দিচ্ছে।
যেন বলতে চায়, সামনে এগিয়ো না! বিপদ আছে!
একটা ঢিবির আড়ালে বসল ওরা।
‘এখানেই লুকিয়ে থাকি,’ চাপা গলায় মদিনা বলল। ‘ওঁদের বেরিয়ে আসার অপেক্ষায় থাকব।’
দ্বিমত করল না মুসা।
সঙ্গে ফ্ল্যাশলাইট নেই। ওই ভয়াবহ অন্ধকার সুড়ঙ্গে ঢোকার চেয়ে এখানে লুকিয়ে অপেক্ষা করা ভাল।
পাথরের আড়ালে বসে পড়ল ওরা, তাকাল পিরামিডের প্রবেশ- পথের দিকে।
আকাশের আধখানা চাঁদের দিকে চোখ ফেরাল মদিনা।
সাদা, হালকা মেঘ চাঁদটাকে ঢেকে ফেলেছে। মেঘের ভৌতিক ছায়া পড়েছে ওদের ওপর।
‘আমার মন বলছে বাবা কোনও ঝামেলায় পড়েছেন, ‘ শুকনো গলায় বলল মদিনা। ‘তোমার কী মনে হয়, মুসা? লোকটাকে একদম ও সহ্য করতে পারেন না বাবা। উনি জোর করে বাবাকে…’
‘আমার মনে হয় অনর্থক দুশ্চিন্তা করছ তুমি। ডক্টর আসাদ ওমর একজন বিজ্ঞানী, ক্রিমিনাল নন।
‘বুঝলাম, কিন্তু এত রাতে কেন বাবাকে জোর করে পিরামিডে ঢোকালেন? কী নিয়ে তর্ক হচ্ছিল ওঁদের মধ্যে?’
জবাবে কাঁধ উঁচু করল মুসা। মামাতো বোনকে আগে কখনও এভাবে ভয় পেতে দেখেনি ও। মদিনার ভীত-বিহ্বল মুখটা দেখতে ওর ভালই লাগছে। সবসময় বাহাদুরি করে মদিনা, সাহসী বলে বড়াই করে। অথচ এখন? ভয়ে মুখ শুকিয়ে আমসি।
তবে এ-মুহূর্তে ব্যাপারটা পুরোপুরি উপভোগ করতে পারছে না মুসা। কারণ ও নিজেও ভয় পেয়েছে।
মামা আর ডক্টর ওমরের উত্তেজিত তর্কাতর্কি শুনে মনে হয়েছে, হয়তো দুই বিজ্ঞানী মারামারি বাধিয়ে বসবেন।
মদিনার সন্দেহ মিথ্যে নয়। সত্যিই ডক্টর ওমর জোর করে মামাকে ঠেলে নিয়ে গেছেন খোর-রো’র সমাধির দিকে।
বুকের ওপর আড়াআড়িভাবে হাত রেখেছে মদিনা। জোরে জোরে দম নিচ্ছে। সঙ্কুচিত চোখে তাকিয়ে আছে পিরামিডের প্রবেশপথের দিকে। বাতাসে ওর চুল উড়ছে এলোমেলো ভাবে। কপালের ওপর এসে পড়েছে চুল। কোনদিকে খেয়াল নেই ওর। চিন্তায় ডুবে আছে।
‘হঠাৎ এই অসময়ে কেন ওঁদের ওখানে যাওয়ার প্রয়োজন হলো?’ প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে মুসার দিকে ফিরে ভুরু নাচাল মদিনা। ‘তোমার কী মনে হয় মুসা, সমাধি-ক্ষেত্র থেকে মূল্যবান কিছু খোয়া গেছে? ওই জায়গা পুলিশ অফিসাররা পাহারা দিচ্ছে না?’
‘আমি তাঁদের চলে যেতে দেখেছি,’ মুসা বলল। ‘ডিনারের আগে নিজেদের গাড়িতে উঠেছেন। মনে হয় কোনও কারণে কায়রো থেকে ওঁদেরকে ডেকে পাঠানো হয়েছে।’
‘কী জানি,’ অনিশ্চিত ভঙ্গিতে বলল মদিনা। পরিস্থিতি ঘোলাটে মনে হচ্ছে। ডক্টর ওমরের চাউনি কেমন যেন রহস্যময় মনে হয়েছে আমার। ভদ্রলোক যেভাবে হুড়মুড় করে তাঁবুর মধ্যে ঢুকে পড়লেন, একেবারেই পছন্দ হয়নি আমার। ঢোকার আগে একটা কাশি পর্যন্ত দেননি।’
‘শান্ত হও,’ নরম সুরে বলল মুসা। ‘বেশি চিন্তা করছ তুমি। এসো, অপেক্ষা করি। সব ঠিক আছে।’
নীরবে অপেক্ষা করতে থাকল ওরা। সময় বয়ে চলেছে। মিনিটের পর মিনিট কেটে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা। চাঁদ এক টুকরো মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। পিরামিডের চারদিকে ভীতিকর আওয়াজ তুলে ছোটাছুটি করছে দুরন্ত বাতাস।
‘কোথায় বাবা?’ নীরবতা ভাঙল মদিনা। ‘এতক্ষণ ধরে কী করছেন ভেতরে?’
উত্তর দিতে গিয়ে থেমে গেল মুসা। দৃষ্টি ওর স্থির হয়ে আছে প্রবেশপথের ওপর। একটা আলো দেখা যাচ্ছে। মদিনার বাহু জাপটে ধরে মুসা বলল, ‘দেখো! দেখো!!’
ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে আলোটা। অবশেষে ওরা একজন মানুষের অস্পষ্ট অবয়ব দেখতে পেল। দ্রুত এগিয়ে আসছে ওটা। আরও এগিয়ে এলে চাঁদের আলোয় তাঁকে চিনতে পারল ওরা।
ডক্টর আসাদ ওমর!
রীতিমত উত্তেজিত। কুঁতকুঁতে দু’চোখে বিস্ময় ফুটে আছে তাঁর কপাল কুঁচকে আছে। একটু ফাঁক হয়ে আছে ঠোঁট দুটো। দম নিতে কষ্ট হচ্ছে তাঁর। দেহে লেগে থাকা ধুলো ঝাড়লেন ডক্টর ওমর। চেহারা উদ্ভ্রান্তের মত। লম্বা লম্বা পা ফেলে দ্রুত এগিয়ে আসছেন। প্রায় দৌড়াচ্ছেন।
মুসার দিকে চেয়ে ভয়ার্ত গলায় ফিসফিস করে বলল মদিনা, ‘বাবা কোথায়?’
মুসা কিছু বলার আগেই মদিনা আড়াল থেকে বেরিয়ে দ্রুত ছুটল ডক্টর ওমরের দিকে।
‘আঙ্কেল!’ চেঁচিয়ে উঠল সে। ‘বাবা কোথায়?’
মদিনার পেছন পেছন মুসাও দৌড় দিল।
ডক্টর ওমরের ভয়ে, উত্তেজনায় বিস্ফারিত দু’চোখ দেখতে পেল সে।
মদিনাকে পাত্তা দিলেন না ডক্টর ওমর। উত্তর দিলেন না।
‘বাবা কোথায়?’ আবার প্রশ্ন করল মদিনা।
কিন্তু ওকে যেন দেখতেই পাননি তিনি। মদিনাকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত সামনে এগিয়ে গেলেন। আড়ষ্ট, এলোমেলো পায়ে এগোচ্ছেন ভদ্রলোক। দু’হাত শিথিল ভঙ্গিতে ঝুলছে।
‘আঙ্কেল ওমর!’ পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠল মদিনা।
সাড়া না দিয়ে আঁধার চিরে তাঁবুর সারির দিকে এগিয়ে চলেছেন বিজ্ঞানী।
মুসার মুখোমুখি হলো মদিনা। ‘বাবার কিছু একটা হয়েছে!’ কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল ও। ‘নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে।’
বিশ
ঘুরে পিরামিডের প্রবেশ-পথের দিকে তাকাল মুসা।
অন্ধকার!
চারদিকে নীরবতা!
‘উনি পাত্তাই দিলেন না আমাকে,’ মদিনার কণ্ঠে রাগ প্রকাশ পেল, ‘আমাকে ঠেলে সরিয়ে এমনভাবে চলে গেলেন যেন আমি মানুষ না!’
‘দেখেছি,’ বলল মুসা। ‘থামাইনি বলে এখন খারাপ লাগছে।’
‘মানুষটার চাউনি লক্ষ করেছ?’ বলল মদিনা। ‘কেমন যেন আচ্ছন্নের মত তাকাচ্ছিলেন! দেরি না করে এখনই আমাদের ভেতরে ঢোকা উচিত। তাড়াতাড়ি চলো। দেরি করলে…’ কথা শেষ না করে মুসার হাত ধরে টানাটানি শুরু করে দিল ও।
‘দাঁড়াও, মদিনা, দাঁড়াও!’ ওকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করল মুসা। বোনের শক্ত মুঠো থেকে হাত ছাড়িয়ে নিল। ‘অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। আমরা ঢুকলে নির্ঘাত পথ হারিয়ে ফেলব।’
‘কিন্তু তা-ই বলে বসে থাকব এখানে?’ কাঁপা গলায় বলল মদিনা। ‘বাবার যদি সত্যিই কিছু একটা হয়ে গিয়ে থাকে?’
‘কিন্তু… কিন্তু অন্ধকারে আমরা তাঁকে খুঁজে বের করতে পারব বলে মনে হয় না,’ বলল মুসা। ‘আমরা যদি ফিরে গিয়ে…..
‘দেরি হয়ে যাচ্ছে, মুসা,’ মদিনার চোখের কোণে পানি টলমল করছে দেখতে পেল ও। ‘বাবার যদি…’
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, এক কাজ করি। তাঁবু থেকে আগে আলো নিয়ে আসি। তারপর না হয়…’
জবাব না দিয়ে নীরবে অন্ধকার প্রবেশ পথের দিকে চেয়ে থাকল মদিনা।
দেরি না করে মুসা তাঁবুর দিকে দৌড়াতে শুরু করল। বুক ধকধক করছে ওর।
তাঁবুর প্রবেশ-পথে থমকে দাঁড়াল মুসা। আশপাশে চোখ বুলিয়ে ডক্টর ওমরকে খুঁজল।
নেই!
কোথাও নেই লোকটা!
তাঁবুর ভেতরে ঢুকে পড়ল মুসা। দুটো ফ্ল্যাশলাইট নিয়ে তক্ষুণি বেরিয়ে পড়ল। ফিরতি পথে ছুটল।
মুসা দৌড়ের মধ্যে মনে মনে প্রার্থনা করছে, হে খোদা! মামার যেন খারাপ কিছু না ঘটে। হে খোদা! মামাকে রক্ষা করো।
মুসা দূর থেকেই দেখতে পেল, আগের জায়গায় মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে মদিনা।
ওর ভীত-বিহ্বল চেহারা দেখতে পেল মুসা।
ও চিন্তিত চেহারায় দাঁড়িয়ে অপলকে চেয়ে আছে পিরামিডের দিকে।
মামা, কোথায় আপনি? ভাবছে মুসা। কেন বেরিয়ে আসছেন না? কিছু হয়েছে মামার?
মদিনার পাশে দাঁড়িয়ে কয়েক মুহূর্ত হাঁপিয়ে নিল মুসা।
কেউ কোন কথা বলল না। কথা বলার প্রয়োজনও নেই।
এগিয়ে চলল ওরা পিরামিডের দিকে। ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে ভেতরে ঢুকে পড়ল।
মুসার মনে হলো সুড়ঙ্গের মেঝে আগের চাইতে আরও ঢালু হয়ে গেছে। ঘাড় গোঁজ করে হাঁটতে হচ্ছে। হোঁচট খেয়ে পড়লে…
হাজার হাজার বছরের ময়লা-আবর্জনা জমেছে।
মাথা বাঁচিয়ে যতটা পারা যায় খাড়া হলো মুসা। আলো উঁচু করে আঁকাবাঁকা সুড়ঙ্গ ধরে আগে আগে এগিয়ে চলল। একহাতে দেয়াল ধরে নিজের ভারসাম্য রক্ষা করছে। ঠাণ্ডা দেয়ালটাকে ভঙ্গুর আর নরম মনে হচ্ছে।
ঠিক পেছনে লেগে আছে মদিনা। ওর ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় সামনের দেয়ালে মুসার আঁকাবাঁকা, প্রকাণ্ড ছায়া পড়েছে।
ছোট্ট এক উন্মুক্ত জায়গায় পৌছে থমকে দাঁড়াল ওরা। এদিক- ওদিক তাকাল।
‘আমরা ঠিক পথে চলেছি তো?’ মুখ খুলল মদিনা।
লম্বা করে দম নিয়ে কাঁধ উঁচু করল মুসা। ‘কী মুশকিল! আমি তো মনে করেছি রাস্তা তোমার চেনা!’
‘এত ভেতরে মাত্র একবার এসেছি, তাও বাবার সঙ্গে,’ বলল মদিনা। মুসার কাঁধের ওপর দিয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে সে।
‘মামাকে না পাওয়া পর্যন্ত এগোতে থাকব আমরা,’ মুসা বলল। বুক কাঁপছে ওর। কিন্তু বাইরে তা প্রকাশ করছে না।
দেয়ালে আলো ফেলল মদিনা। ‘বাবা?’ চেঁচিয়ে উঠল সে। ‘বাবা, শুনতে পাচ্ছ?’
ওর কথার গুরুগম্ভীর প্রতিধ্বনি শোনা গেল।
জবাবের আশায় অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়ে থাকল ওরা।
জবাব নেই!
ডক্টর সায়েম মোর্শেদের কোনও সাড়া নেই!
‘এসো,’ মদিনার হাত ধরে এগোতে শুরু করল মুসা।
মাথা নিচু করে হাঁটছে ওরা।
ভাবছে মুসা, সুড়ঙ্গটা কোনদিকে গেছে? প্রিন্স খোর-রো’র সমাধি কক্ষের দিকে? ওখানেই কী পাওয়া যাবে মামাকে?
প্রশ্ন আর প্রশ্ন, জবাব জানা নেই।
চেষ্টা করেও মুসা প্রশ্নগুলো মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছে না। বারবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে মনের কোণে।
যতই ভাবছে ততই উতলা হচ্ছে।
এমন সময় হঠাৎ…
পেছন থেকে পায়ের শব্দ ভেসে এল কানে।