মৃতেরা কথা বলে না – ৯

০৯.

 ঋতুপর্ণা দরজা খুলে আস্তে বললেন, আমি সন্ধ্যা ছটায় এসে অপেক্ষা করছি। এখন নটা বাজে। তাছাড়া হঠাৎ একটু আগে টিনা এসেছে।

টিনা এখানে আসে নাকি? চন্দ্রনাথ একুটু হকচকিয়ে বললেন। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁঝালো সুগন্ধ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তার ওপর। ফের বললেন টিনা–

আসে। ওর কাছে এ ফ্ল্যাটের একসেট চাবি আছে। ঋতুপর্ণা শ্বাস ফেলে বললেন, ভেতরে এস।

চন্দ্রনাথ একটু দ্বিধার সঙ্গে বললেন, নাহ। থাক।

ঋতুপর্ণার চোখ উজ্জ্বল দেখাল। মুখে কড়া প্রসাধন। কিন্তু চোখের ওই উজ্জ্বলতা তীব্র ক্ষোভের। ঠোঁটের কোনা বেঁকে গেল। বললেন, তুমি আমার তিনটে ঘণ্টা নষ্ট করেছ। দাম দিয়ে যাও।

কথা হচ্ছিল ইংরেজিতে। চন্দ্রনাথ ভেতরে ঢুকে বললেন, আসার পথে আমার অ্যাডভোকেটের বাড়ি হয়ে এলাম। আড়াই ঘণ্টা আটকে রাখল সে। ছারপোকা! যাই হোক, আমার একটা সাংঘাতিক মিসহ্যাপ হয়েছে।

তোমার জীবনটাই তো মিসহ্যাপে ভর্তি। বলে ঋতুপর্ণা কোণের দিকে সোফায় বসলেন। বলো!

হাল্কা স্যুটকেসটা পাশে রেখে চন্দ্রনাথ মুখোমুখি বসলেন। টিনা কী করছে?

কিছু ঘটে থাকবে, কিংবা কারো পাল্লায় পড়ে ড্রিঙ্ক করে সামলাতে পারেনি। নিউ আলিপুরের বাড়িতে গিয়ে আমাকে পায়নি। তারপর তো ওকে একটা সেডাটিভ দিয়েছি। কিছু খেতে চাইল না। ঘুমোচ্ছে! ঋতুপর্ণা একটা সিগারেট ধরালেন। তোমার কথা বলো।

টি ভি-র শব্দ কমিয়ে দাও।

ঋতুপর্ণা শব্দ কমিয়ে বললেন, আমি ওয়াইন খাচ্ছিলাম। হুইস্কি আছে, খাবে?

এনেছি। জনি ওয়াকার। চন্দ্রনাথ সুটকেস থেকে হুইস্কির বোতল বের করলেন। আইসকিউব আনন।

কোথায় পেলে?

 রঙ্গনাথনের উপহার। কিন্তু আজ বেচারা হঠাৎ খুন হয়ে গেছে। পরে বলছি। উত্তেজিত হয়ো না।

ঋতুপর্ণা উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। ঘরে আলো কম। কিন্তু তার চোখে চমক ছিল। একমুহূর্ত চন্দ্রনাথের দিকে তাকিয়ে থাকার পর ডাইনিং কাম-কিচেনে ঢুকলেন। সঙ্গে সুগন্ধ নিয়ে ঘুরছেন ঋতুপর্ণা।

চন্দ্রনাথ তাঁর সিগারেট প্যাকেট বের করে টেবিলে রাখলেন। সিগারেট ধরিয়ে ঘরের ভেতরটা লক্ষ্য করলেন। সল্টলেকের এই ফ্ল্যাটে এক মাস আগে একদিন এসেছিলেন। তেমনই সাজানো আছে। কোণে প্রায় তিন ফুট উঁচু নগ্ন যক্ষীর ভাস্কর্য নির্লজ্জ দাঁড়িয়ে আছে। দেয়ালে একটা ফ্রেস্কো। চুম্বনরত দুটি মুখ। ঈষৎ বিমূর্ত। ডাঃ মুখার্জি কি এই ফ্ল্যাটে কখনও আসেন? নিশ্চয় সময় পান না। একবার একটা পার্টিতে স্বামীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন ঋতুপর্ণা। অবশ্য বলেননি– বলা সম্ভবও ছিল না, চন্দ্রনাথ দেববর্মনের সঙ্গে ঋতুপর্ণা বাইশ বছর আগে লিভ টুগেদার করেছিলেন।

ঋতুপর্ণা এলেন সোডা, আইসকিউব এবং গ্লাস নিয়ে। টেবিলে একটা প্লেটে কিছু স্ন্যাক্স ছিল আগে থেকে। নিপুণ হাতে জনি ওয়াকারের ছিপি খুলে গ্লাসে ঢেলে দিলেন ঋতুপর্ণা। সোডাওয়াটার এবং তিন টুকরো আইস দিয়ে একটু হাসলেন। আমার লোভ হচ্ছে। কিন্তু নাহ। এ বয়সে আর কেলেঙ্কারি শোভা পায় না। তবে ওয়াইন আমার রাতের বন্ধু! আমার স্বামী বিদেশি ওয়াইন উপহার পায়। এটা ইতালির জিনিস। স্কচ দিয়ে আমাকে উঁট দেখাতে পারবে না কিন্তু!

চন্দ্রনাথ গ্লাস তুলে বললেন, কাল সারারাত ঘুমোইনি। আজ সারাদিনও একটু বিশ্রাম পাইনি।

চিয়ার্স! ঋতুপর্ণা তার গ্লাস দিয়ে চন্দ্রনাথের গ্লাস স্পর্শ করলেন। তুমি তো আমার স্বামীর চেয়েও বেশি ব্যস্ত মানুষ।

গ্লাসে চুমুক দিয়ে চন্দ্রনাথ বললেন, কাল দুপুর রাত থেকে আজ বিকেল অব্দি আমি পুলিশ হাজতে ছিলাম।

সে কী! কেন?

খুনের দায়ে।

ঋতুপর্ণা উঠে এসে কাছে বসলেন। রঙ্গনাথন খুন হয়েছে বলছিলে। তুমি খুন করেছ নাকি?

সব বলছি পর্ণা! আমাকে একটু চাঙ্গা হতে দাও।

ঋতুপর্ণা উত্তেজিতভাবে বললেন, আমার ভয় হচ্ছে, তুমি আমাকেও নোংরা খুনখারাপির ব্যাপারে জড়াবে। পুলিশ তোমার ওপর নজর রেখেছে কি না তুমি নিশ্চিত?

 জানি না।

ঋতুপর্ণা প্রায় আর্তনাদ করলেন, ও ডনি! এভাবে তোমার আসা উচিত ছিল না। তুমি জানো আমি সোশ্যাল ওয়ার্ক করি। আমার ইমেজের দাম তোমার জানা উচিত, ডনি!

উত্তেজিত হয়ো না পর্ণা! আগে সব শোনো।

বলো! উত্তেজনায় ঋতুপর্ণা চন্দ্রনাথের একটা হাত আঁকড়ে ধরলেন। চিরোল রক্তিম নখ চন্দ্রনাথের কবজির চামড়ায় বিধে গেল যেন। তবে চন্দ্রনাথের চামড়া অনুভূতিহীন।

হুইস্কিতে কয়েকটা চুমুক দেবার পর চন্দ্ৰনাথ শান্ত কণ্ঠস্বরে গতকাল রাত দশটা পনের থেকে যা-যা ঘটেছে, সব বললেন। কিছু গোপন করলেন না। পুলিশ তাকে রঙ্গনাথনের লাশ সনাক্ত করতে নিয়ে গিয়েছিল। তা-ও বললেন। তিনি যে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছেন, তা বলতেও দ্বিধা করলেন না।

ঋতুপর্ণা জোরে শ্বাস ফেলে বললেন, তুমি ওই মহিলার বডি তো তখনও লক্ষ্য করোনি বলছ। শুধু একটা লোককে লিফট থেকে বেরুতে দেখেছিলে। কিন্তু দেখামাত্র তাকে গুলি করতে গেলে কেন?

করিডরের বাঁকে যেতেই দেখি, সে লিট থেকে বেরুচ্ছে। তখন আমার মাথার ঠিক ছিল না। আসলে ওই মহিলা, মিসেস দাশগুপ্ত আমার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, কেউ আমাকে খুন করতে আসছে। তাছাড়া লোকটা আমার অচেনা। তাই তাকে দেখামাত্র রিভলভার তাক করেছিলাম। অমনই সে সিঁড়ির দিকে প্রায় ঝাঁপ দিয়ে পালাতে গেল। আমি গুলি ছুড়লাম। তাকে মিস করলাম। বলে চন্দ্রনাথ হুইস্কিতে চুমুক দিলেন।

ঋতুপর্ণা সোজা হয়ে বসে বাঁকা হাসলেন। ডনি! আমি বিশ্বাস করতে পারছি না ওই মহিলা তোমার অচেনা। এটা তোমার বানানো গল্প। আলবাৎ সে তোমার প্রেমিকা। চালাকি করো না ডনি! আমি তোমাকে চিনি।

চন্দ্রনাথ কষ্ট করে হাসলেন। আমি বুড়ো হয়ে গেছি পর্ণা! ভদ্রমহিলা সুন্দরী যুবতী।

কিন্তু তুমি চিরকালের শিকারি, ডনি! চিরযুবক।

 চন্দ্রনাথ একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, আমি সেক্সের জন্য আসিনি।

 তুমি নির্বোধ! অসভ্য! জানোয়ার!

 পর্ণা! কোনও-কোনও সময় বুঝতে পারি, আমি একা একা! তাই

 চুপ করো! তোমার টাকার অভাব নেই। এ বয়সেও তুমি অনায়াসে কোনও তরুণীকে বিয়ে করতে পারো। বলো! তুমি চাইলে আমি আমার অনাথ আশ্রমের কোনও তরুণীর সঙ্গে বিয়ের ঘটকালি করতে পারি। চাও?

আহ্! এই দুঃসময়ে বড় বাজে তামাশা করছ!

ঋতুপর্ণা তার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকিয়ে বললেন, তুমি কি এখানে সত্যিই রাত কাটাতে এসেছ?

ইচ্ছা ছিল। কিন্তু তোমার মেয়ে এসে গেছে।

 টিনা এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। তাছাড়া ওকে সেডাটিভ দিয়েছি। ঘুম ভাঙতে দেরি হবে। তুমি খুব ভোরে চলে যেতে পারো। ওয়াইনে চুমক দিয়ে ঋতুপর্ণা আস্তে ফের বললেন, কোনও-কোনও সময়ে আমিও এত একা হয়ে পড়ি! জীবনের মানে খুঁজে পাই না। হ্যাঁ, তোমার জন্য ডিনার এনে রেখেছি। দুজনে একসঙ্গে খাব।

তুমি খেয়ে নাও। আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।

প্রিয় উনি! আমার প্রাণ! ঋতুপর্ণা সহসা সরে এসে চুম্বন করলেন চন্দ্রনাথকে। নাহ্ কোনও কথা শুনব না। তুমি আমার সঙ্গে খাবে।…

চন্দ্রনাথ ক্ষুধার্ত ছিলেন। কিন্তু অন্যমনস্কতা তাকে খাদ্যের স্বাদ থেকে বঞ্চিত করল। ঋতুপর্ণার শরীর বরাবর যেন একই সুরে বাঁধা। মেদহীন, ঋজু এবং শীর্ণ। কড়া প্রসাধনে কৃত্রিম মানবী দেখায় যদিও। মৃদু আলোয় সহসা যুবতী বলে ভ্রম হয়। কিন্তু একটু পরে বয়সের ছাপ ধরা পড়ে যায়। মূল্যবান সেন্ট একটা গোপন আর্তি মনে হয়।

খাওয়ার পর রাত-পোশাক পরে এলেন ঋতুপর্ণা। চন্দ্রনাথ একটু দ্বিধার পর তাঁর রাত-পোশাক পরে নিয়েছিলেন ড্রয়িংরুমে। সোফায় প্যান্ট শার্ট রেখেছিলেন। ঋতুপর্ণা তা গুছিয়ে রাখলেন। পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে বললেন, আর হুইস্কি খেও না।

চন্দ্রনাথ হাসলেন। নাহ্। বলে তার সুটকেসের ভেতর থেকে সেই ব্লু ফিল্মের ক্যাসেটটা বের করলেন। কাল রাতে পুরোটা দেখা হয়নি। তোমার ভি সি আরটা আছে তো?

আছে। তোমার দেখার মতো ফিল্মও আছে। তবে তোমারটা দেখা যাক। একঘেয়ে লাগলে আমার একটা চালিয়ে দেব। ঋতুপর্ণা ক্যাসেটটা নিয়ে টি ভি-র কাছে গেলেন। তারপর ঘুরে বললেন, এটাই কাল রাতে দেখছিলে নাকি?

হ্যাঁ। রিমোটটা আমাকে দাও। গোড়ার দিকটা বাজে। তেমন কিছু নেই। ঋতুপর্ণা হাসলেন। তুমি এখনও সেই অভ্যাসটা ছাড়তে পারোনি দেখছি। সরাসরি আঁপ দিতে চাও!

দেখছ তো, দিচ্ছি না। আজকাল আমার শরীর কেন জানি না বরফের চেয়ে ঠাণ্ড। আমি আসলে জীবিতদের মধ্যে এক মৃত মানুষ।

ফিল্মটা রিওয়াইন্ড করে পাশে এসে বসলেন, ঋতুপর্ণা। চন্দ্ৰকান্তের কাঁধে হাত রাখলেন। চন্দ্রকান্ত রিমোটের বোতাম টিপে রিওয়াইন্ড বন্ধ করে দিলেন। ফাস্ট ফরোয়ার্ড বোতাম টিপলেন। বললেন, তোমাকে বললাম না? গোড়ার দিকটায় কিছু নেই।

ঋতুপর্ণা শ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যে বললেন, আমারও আজকাল এসব অসহ্য লাগে। কিন্তু অভ্যাস!

চন্দ্রনাথ মাঝে মাঝে বোতাম টিপে পর্দায় দেখে নিচ্ছিলেন কী ঘটছে। হঠাৎ বললেন, এ কী!

কী?

ছেলে-মেয়ে দুটো বদলে গেল। দৃশ্যও আলাদা। ভারতীয় মনে হচ্ছে। লক্ষ্য করো! বাঙালি চেহারা না? অবশ্য একটা ক্যাসেটে শর্ট ফিল্মও থাকে। কিন্তু মেয়েটিকে চেনা মনে হচ্ছে!

ঋতুপর্ণা চমকে উঠলেন। বললেন, ছেলেটিকেও আমার চেনা মনে হচ্ছে! হ্যাঁ, ও তো রঞ্জন।

তুমি চিনতে পারছ?

হ্যাঁ। রঞ্জন। আমার স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে আসে মাঝে মাঝে।

 চন্দ্রনাথ বললেন, মেয়েটিকে চিনতে পারছি। কাল রাতে যার বডি লিফটে পড়ে ছিল। হ্যাঁ– সেই। চেহারায় তত পরিবর্তন হয়নি। আশ্চর্য! কিন্তু রঞ্জন কে?

বললাম তো! আমার স্বামীর কাছে মাঝে মাঝে আসে। টিনা ওকে পছন্দ করে। একদিন গাড়িতে লিফ্ট দিয়েছিল। তুমি তো জানো, আমি আমার স্বামীর বা মেয়ের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাই না। তবে টিনাকে ওর সম্পর্কে সাবধান করে দেব। আশ্চর্য! রঞ্জনকে প্রথম দেখার পরই মনে হয়েছিল, বাজে ছেলে।

আমার অবাক লাগছে। জেনিথ ফার্মাসিউটিক্যালসের চিফ এক্সিকিউটিভের স্ত্রী চন্দ্রনাথ ফিল্ম বন্ধ করে উত্তেজিতভাবে বললেন, পর্ণা! আমি যার দিকে গুলি ছুঁড়েছিলাম, সে তোমার চেনা রঞ্জনই। কয়েক সেকেন্ডের জন্য মুখটা দেখেছি। কিন্তু আমি নিশ্চিত। এই ছবিতে যাকে দেখলাম, তারই মুখ আমি দেখেছি। আমি একটা টেলিফোন করতে চাই।

ঋতুপর্ণা তার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, এই সুন্দর রাতটাকে নষ্ট করো না। সব ভুলে যাও। হুইস্কি ঢেলে দিচ্ছি। আমিও এক চুমুক খাব। প্রিয় উনি। আমার প্রাণ!

 চন্দ্রনাথ সিগারেট ধরিয়ে বললেন, এবার বুঝতে পেরেছি ওই শুওরের বাচ্চা আমার কাছে এই ক্যাসেটটা হাতাতেই আসছিল। মিসেস দাশগুপ্ত জানত তার উদ্দেশ্য কী। তাই আমাকে সাবধান করে দিয়েছিল। কিন্তু আমি তাকে গ্রাহ্য করছি না বুঝতে পেরে সে আমার অ্যাপার্টমেন্টে আসছিল। লিম্ফটে ওঠার পর ওই শুওরের বাচ্চা তাকে গুলি করে মুখ বন্ধ করে দেয়। এর পর সে আমার ঘরে আসছিল। আমার হাতে রিভলভার না থাকলে সে আমাকেও গুলি করে–ওঃ!

ঋতুপর্ণা গ্লাসে হুইস্কি ঢেলে দিলেন। সোড়া এবং আইসকিউবসহ চন্দ্রনাথের হাতে গ্লাসটা তুলে দিলেন। তারপর নিজের গ্লাসেও একটু হুইস্কি ঢাললেন।

চন্দ্রনাথ অনিচ্ছাসত্ত্বেও চিয়ার্স করে হুইস্কিতে চুমুক দিলেন। তারপর বললেন, রঞ্জন কেমন করে জানতে পারল এই ক্যাসেটে তার এবং মিসেস দাশগুপ্তের মিলনদৃশ্য আছে? রঙ্গনাথন আমাকে ক্যাসেটটা দিয়েছিল। রঞ্জন কি রঙ্গনাথনের পরিচিত? রঙ্গনাথন কি তাকে বলেছিল এই ক্যাসেটটা এখন আমার কাছে আছে?

তুমি চুপ না করলে আমি গিয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ব ডনি!

অগত্যা চন্দ্রনাথ ঋতুপর্ণার কাঁধে হাত রেখে আলতোভাবে চুম্বন করলেন। বললেন, ঠিক বলেছ। সব কিছু ভুলে যাওয়ার জন্যই তোমার কাছে এসেছি পর্ণা!

ঋতুপর্ণা চন্দ্রনাথের হাত থেকে রিমোটটা নিয়ে সুইচ টিপলেন। একটু হেসে বললেন, রঞ্জনের কীর্তি দেখি। তুমিও দেখ। কানও-কোনও সময় সেক্স জীবনকে অর্থপূর্ণ করে। প্রকৃতির উপহার। তাই না প্রিয় উনি?

ইয়া।

দুজনে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলেন। ঋতুপর্ণা চাপা চঞ্চল কণ্ঠস্বরে বললেন, ড্রিঙ্ক শেষ করো শিগগির! আমার ঘুম পাচ্ছে। হুইস্কি আমার সহ্য হয় না। শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে।

কথাটা চন্দ্রনাথ বুঝলেন। ঋতুপর্ণা এই বয়সেও একই আছে। এই আতিশয্যই চন্দ্রনাথের কাছে বাইশ বছর আগে লিভ টুগেদারকে অসহনীয় করে ফেলেছিল। এখন চন্দ্রনাথ নিরুত্তাপ। নিজের শরীর থেকে পৃথক হয়ে গেছেন দিনে দিনে। হঠাৎ অসহায় বোধ করলেন। কিন্তু ইচ্ছে করেই বাঘিনীর খাঁচায় ঢুকেছেন।

ছবিটা বন্ধ করে ঋতুপর্ণা উঠে দাঁড়ালেন। চন্দ্রনাথকে টেনে ওঠালেন। চন্দ্রনাথ বলতে চাইছিলেন, ক্যাসেটটা বের করে নিই। বলার সুযোগ দিল না। বাঘিনী শিকারের ঘাড় কামড়ে ধরে নিয়ে যেতে চাইছে আড়ালে।

ঠিক সেই সময় টেলিফোন বাজল। ঋতুপর্ণা খাপ্পা হয়ে একটা অশালীন শব্দ উচ্চারণ করলেন। তারপর বললেন, রিং হোক। একটু পরে থেমে যাবে। কিন্তু বেডরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছেন, তখনও রিং হয়ে যাচ্ছে। চন্দ্রনাথ বললেন, তুমি এখানে আসছ তোমার স্বামী জানেন?

না।

অন্য কেউ?

মলিনা জানে। এখানে এলে তাকে বলে আসি। বিশ্বাসী মেডসারভ্যান্ট। টিনা তার কাছে শুনেই এখানে এসেছে।

মনে হচ্ছে, তোমার ডেসারভ্যান্টের জরুরি ফোন। তা না হলে এখনও রিং হতো না। ফোনটা ধরো।

আমার মেজাজ নষ্ট করে দিল! কী এমন জরুরি যে আমি মেয়েটাকে তাড়াব।

ফোনটা ধরো। বাইরের ফোন হলে থেমে যেত। তা ছাড়া এখন রাত সাড়ে দশটা বাজে।

ঋতুপর্ণা কুঁসতে ফুঁসতে ড্রয়িংরুমে গেলেন। চন্দ্রনাথ তাঁকে অনুসরণ করেছিলেন।

ঋতুপর্ণা ফোন তুলেই ধমকের সুরে বললেন, মলি?

 পুরুষের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। সরি টু ডিসটার্ব ইউ ম্যাডাম!

 হু দা হেল ইউ আর?

আমি নিউ আলিপুর পুলিশ স্টেশন থেকে অফিসার-ইন-চার্জ শোভন চ্যাটার্জি বলছি। আপনি কি মিসেস ঋতুপর্ণা মুখার্জি?

হ্যাঁ। কী ব্যাপার? চমকে উঠে ঋতুপর্ণা চন্দ্রনাথের দিকে তাকালেন।

আপনাকে একটু কষ্ট করে আপনাদের নিউ আলিপুরের ফ্ল্যাটে আসতে হবে ম্যাডাম। একটু অপেক্ষা করুন। পুলিশভ্যান পাঠিয়েছি। আপনাকে এবং আপনার মেয়েকে এসকর্ট করে আনবে।

 ঋতুপর্ণা প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, কেন? কী হয়েছে? পুলিশভ্যান এসকর্ট করতে আসছে কেন?

ডাঃ মুখার্জি–আই মিন, ইওর হাজব্যান্ড ইজ ডেড।

মুহূর্তে ঋতুপর্ণা অস্বাভাবিক শান্ত এবং শক্ত হয়ে গেলেন। কিন্তু কণ্ঠস্বর ঈষৎ বিকৃত। শ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যে বললেন, ডেড? ইউ মিন–

হ্যাঁ ম্যাডাম! ডাঃ মুখার্জি ফেল্ড অ্যান আনন্যাচারাল ডেথ। আই অ্যাম। সরি টু

সুইসাইড করেছে?

 হি ইজ মার্ডারড।

 হোয়া-ট? দ্যাটস ইমপসিবল! অনির্বাণকে কে মার্ডার করবে? কেন করবে?

আমি জানি আপনার নার্ভ স্ট্রং। হ্যাঁ, আধঘণ্টা আগে কেউ ওঁকে খুন করেছে। আপনার মেয়েকে কথাটা বলার দরকার নেই। আপনি অপেক্ষা করুন। পুলিশভ্যান না পৌঁছালে আপনি যেন বেরুবেন না, প্লিজ!

ঋতুপর্ণার হাত থেকে চন্দ্রনাথ ফোন কেড়ে নিয়ে রেখে দিলেন। তারপর দ্রুত প্যান্ট-শার্ট পরে নিলেন। রাত পোশাক স্যুটকেস ভরলেন। ভি সি আর থেকে ক্যাসেটটা বের করে নিয়ে এলেন। স্যুটকেসের ভেতর ঢুকিয়ে রিভলভার বের করলেন। অস্ত্রটা প্যান্টের পকেটে ভরে একটু ভাবলেন। স্কচের বোতল, সিগারেট প্যাকেট, লাইটার পড়ে আছে। সেগুলো যথাস্থানে ভরে নিয়ে নিজের হুইস্কির গ্লাসটা ডাইনিংয়ের বেসিনে ধুলেন। গ্লাসটা টেবিলে রেখে এসে দেখলেন, ঋতুপর্ণা পাশের ঘরে মেয়েকে জাগানোর চেষ্টা করছেন।

এখন সেন্টিমেন্টের প্রশ্ন অবান্তর এবং বিপজ্জনক। পুলিশভ্যান আসছে মা-মেয়েকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যেতে। আর একমুহূর্ত দেরি করা ঠিক নয়। চন্দ্রনাথ বেরিয়ে গিয়ে ডান হাতে পকেটের রিভলভার স্পর্শ করলেন। চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে এগিয়ে গেলেন সিঁড়ির দিকে।

নিচের গ্যারাজের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকালেন। এখনও বাড়িটা সম্পূর্ণ তৈরি হয়নি। সামনেটা ভোলা এবং স্টোনচিপস, ইট, হরেক সরঞ্জন এলোমেলো রাখা আছে। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দ্রুত এলাকা ছাড়িয়ে গেলেন চন্দ্রনাথ।

রিভলভারটা বাঁ পাশে সিটের ওপর ফেলে রেখে চন্দ্রনাথ দেববর্মন ড্রাইভ করছিলেন। সল্টলেকের রাস্তা গোলকধাঁধা। কিন্তু তাঁর নখদর্পণে। ই সেক্টরের একটুকরো জমি কেনা আছে। সেখানে কোনোদিনই বাড়ি করবেন না আর ভাল দাম পেলে বেচে দেবেন।

এবং ঠিক এই কথাটা মাথায় এলে কেন যেন তার মনে হলো, বেঁচে থাকার দরকার আছে তার। জীবনের অন্য অনেক রকম মানে আছে। কেউ-কেউ বোঝে না। কেউ-কেউ বোঝে না। কেউ-কেউ বোঝে….

.