মৃতেরা কথা বলে না – ৫

০৫.

 সিকিউরিটি অফিসার রণধীর সিংহ একটা ফলে ভরা গুলমোহরের তলায় পঁড়িয়ে ছিলেন। তার হাতে ওয়াকিটকি। কার সঙ্গে ওয়াকিটকিতে কথা বলছিলেন। কর্নেলকে দেখে কথা বন্ধ করে স্যালুট করলেন। তারপর কর্নেল কাছে গেলে আস্তে বললেন, কথা হলো?

কর্নেল বললেন, স্ট্রং নার্ভের মানুষ। সত্যিই ইয়াপ্পি।

ওঁর অ্যালিবাইও স্ট্রং। কিন্তু চিন্তা করুন স্যার! ী অমন একটা সাংঘাতিক চিঠি লিখে গেছেন। অথচ উনি নিজে খোঁজ নিতে না গিয়ে আমাকে ফোন করেছিলেন। পুলিশ যাই বলুক, আমার খটকা লেগে আছে। চিঠিটা সম্পর্কে কী বললেন উনি?

চিঠিটার কথা তুলিনি। বলে কর্নেল চারিদিকটা দেখে নিলেন। ই ব্লক কোনটা?

ওই তো! বি ব্লকের পেছনে। পাশে একটা ছোট পুকুর আছে। একসময় পুরো তিন একর জলা ছিল। ভরাট করে এই হাউজিং কমপ্লেস গড়া হয়েছিল। পুকুরটা তার চিহ্ন।

চলুন। স্পটটা একটু দেখে যাই।

এ এবং বি ব্লকের মাঝখানে একটা সংকীর্ণ রাস্তা। দুধারে কেয়ারি কার গুল্মলতা। রাস্তাটা গিয়ে বেঁকেছে একটা পাঁচতলা বাড়ির সামনে। সুদৃশ্য একালীন স্থাপত্য। তবে অন্য ব্লকের বাড়িগুলোর চেয়ে এটা ছোট। বোঝা যায়, পুকুরটা টিকিয়ে রাখার প্ল্যান বাড়িটাকে ছোটো করেছে। দুজন সিকিউরিটি গার্ড উর্দি পরে ঘাসে বসেছিল। উঠে দাঁড়িয়ে সেলাম দিল। একটা বিশাল নাগকেশরের গাছ ছায়া ফেলেছে সামনের লনে।

কর্নেল বললেন, এটা শেষ প্রান্ত?

রণধীর বললেন, হ্যাঁ স্যার! ওই দেখুন বাউন্ডারি ওয়াল। কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে আসা যায় না। দেওয়াল যথেষ্ট উঁচু এদিকটায়।

দেওয়ালের ওপারে কি আছে?

মাছের ভেড়ি। কাজেই খুনী বাইরের লোক হতেই পারে না। আপনাকে আগেই বলেছি রাত নটার পর সিকিউরিটি চেকিং ছাড়া কেউ ঢুকতে পারে না সানশাইনে। এদিকে আসুন!

বাড়ির নিচের তলায় গাড়ির গ্যারাজ এবং পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। একপাশে দুটো লিস্ট। লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে কর্নেল চারদিক দেখছিলেন। মাত্র দুটো গাড়ি। তেরপলের কভারে একটা গাড়ি ঢাকা। অন্যটার গায়ে হেলান দিয়ে উর্দিপরা ড্রাইভার দাঁড়িয়ে আছে। সে আপন মনে খৈনি ডলছিল।

রণধীর বললেন, ২ নং লিফট আগামীকাল সারাতে লোক আসবে। আজ এসেছিল। কিন্তু পুলিশ তাদের কাজ করতে দেয়নি।

১ নং লিট ওপরে তিনতলায় আছে। কারণ ২ নম্বরে লাল আলো। কর্নেল বোতাম টিপলেন। লিফট নেমে এল। রণধীর বললেন, একটুখানি রক্ত ছিল, ধুয়ে ফেলা হয়েছে। মিসেস দাশগুপ্তের মাথার ডানদিকে গুলি করা হয়েছিল। লিফটের বাঁ-কোনায় কাত অবস্থায় বডি ছিল। সেকেন্ড ফ্লোর?

কর্নেল মাথা দোলালেন।

তিনতলায় লিফট থেকে বেরিয়েই কর্নেল লিফটের দিকে তাকালেন। সেই সময় উল্টেটাদিকের ঘরে কুকুরের গর্জন শোনা গেল। দরজা বন্ধ হয়ে গেলে কর্নেল বাইনোকুলারে খুঁটিয়ে লিফটের ওপরটা, দুই পাশ এবং নিচের অংশ লক্ষ্য করলেন। তারপর বাঁদিকে সিঁড়ির কাছে গেলেন। দেওয়ালে চৌকো সিমেন্টের ঝরোকা। ফাঁক দিয়ে বিশাল ভেড়ি চোখে পড়ে। ঝরোকার একটা ফাঁকে ইঞ্চিটাক জায়গা খসে গেছে। কর্নেল তিন ধাপ নেমে সেখানটা ছুঁলেন।

রণধীর একটু হেসে বললেন, মিঃ দেববর্মন সত্যিই এক রাউন্ড ফায়ার করেছিলেন। তার ফায়ার আর্মসের গুলি এখান দিয়ে বেরিয়ে জলে ঝাঁপ দিয়েছে। তার মানে, খুনীকে তিনি সত্যিই সিঁড়ি দিয়ে পালাতে দেখেছিলেন।

কিন্তু ১০ নম্বরের অগ্রবালজি কোনও গুলির শব্দ শোনেননি!

কুকুরের গর্জন। তাছাড়া তার মন ছিল কুকুরের দিকে। ওই তো শুনছেন! আমার মতে কুকুরটার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো দরকার। ভদ্রলোককে বলবেন।

রণধীর গম্ভীরমুখে বললেন, বলব।

অগ্রবালজির কীসের কারবার জানেন?

ল্যাক এক্সপোর্ট করেন শুনেছি। আপনি ওঁর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে

নাহ কুকুরটা বড় বাজে। নিশ্চয় কোনো অসুখে ভুগছে। আর কুকুর সম্পর্কে আমার অ্যালার্জি আছে।

রণধীর হাসলেন। আমি কিন্তু ডগ-লাভার সোসাইটির মেম্বার স্যার!

কর্নেল সিঁড়ি থেকে উঠে করিডর ধরে এগিয়ে গেলেন। করিডর বাঁক নিয়ে শেষ হয়েছে ১৩ নং অ্যাপার্টমেন্টের সামনে। নেমপ্লেটে লেখা আছে সি এন দেববর্মন। বাঁদিকেরটায় লেখা মিসেস আর খুরশিদ। ডানদিকেরটাতে প্রোফেসর এস কে রায়, এম, এ, পি-এইচ. ডি। লকে একটা কালো প্লেট ঝোলানো। তাতে লেখা আছে প্লিজ ডোন্ট ডিসটার্ব।

কর্নেল ভাবছিলেন চন্দ্রনাথ দেববর্মনের স্টেটমেন্টের কথা। অরিজিৎ লাহিড়ির মুখে সেটা শুনেছেন। মিলে যাচ্ছে। চন্দ্রনাথ মিথ্যা কিছু বলেননি। কিন্তু মউ কেন তাকে টেলিফোন করেছিল এবং কেনই বা ছুটে এসেছিল প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে–তাকে বাঁচতে? এই জটটা ছাড়ানো যাচ্ছে না। চন্দ্রনাথ তাকে নাকি চিনতেনই না। বলেছেন, দেখে থাকতে পারি, আলাপ ছিল না।

রণধীর বললেন, পুলিশ মিঃ দেববর্মনের ঘর সিল করে গেছে।

হুঁ! দেখতে পাচ্ছি। তো এই প্রোফেসর ভদ্রলোকের বয়স কত আনুমানিক?

 ওঁকে খুব কম দেখেছি। ত্রিশ-বত্রিশের মধ্যেই হবে। খুব দাম্ভিক টাইপ।

একা থাকেন?

না স্যার! ওঁর স্ত্রী সানশাইন কালচারাল কমিটির সেক্রেটারি। নাচ গান নাটক এসব নিয়ে থাকেন। এ ব্লকে কালচারাল কমিটির অফিস। এখন ঘরেই থাকার কথা। আলাপ করবেন?

কর্নেল কালো প্লেটটার দিকে আঙুল তুলে সকৌতুকে চাপাস্বরে বললেন, প্লিজ ডোন্ট ডিসটার্ব।

এই সময় বাঁদিকে মিসেস খুরশিদের ঘর থেকে জিনস ব্যাগি শার্টপরা এক তরুণ বেরুল। হঠাৎ দেখলে সাহেব মনে হয়। সে কর্নেলের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে রণধীরকে বলল, হাই সিনহা!

হাই কুমরো!

সে হাসল। মাই গ্র্যান্ডমা ইজ ওয়েট।

ও নটি বয়! সি ইজ অ্যান অনারেবল লেডি, মাইন্ড দ্যাট!

ম্যান! ইউ আর কিলিং লাভূলি গার্লস হোয়াটস হার নেম, আই থিং সি ওয়াজ আ ফিল্মস্টার ইজ ইট? ও কে! বাই!

সে চলে গেল শিস দিতে দিতে। রণধীর বিকৃত মুখে বললেন, ডার্টি জেনারেশন!

মিসেস খুরশিদ পার্শি মহিলা।

হ্যাঁ স্যার! বড় ব্যবসা আছে। ছেলেরা চালায়। বৃদ্ধা মাকে এখানে রেখেছে। একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মহিলা তার দেখাশুনা করেন।

কর্নেল ঘুরে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, আশ্চর্য তো!

কী স্যার?

কলকাতার পার্শিরা নিজস্ব এরিয়া গড়ে নিয়েই বাস করেন। তাদের নিজস্ব সোসাইটি আছে। অথচ এখানে এই বৃদ্ধা মহিলাকে নির্বাসনের মতো রাখা হয়েছে। কেন? উনি চলাফেরা করতে পারেন?

হুইলচেয়ারে চলাফেরা করেন। পায়ের অসুখ আছে।

আমরা এবার সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাব।

ও কে।

 সিঁড়িতে নামতে নামতে কর্নেল বললেন, সিঁড়ি ধোয়া হয়েছে মনে হচ্ছে?

হ্যাঁ স্যার! তবে গত রাতে আমি নিজে থরো চেক করেছিলাম। পুলিশও করেছিল। সিঁড়িতে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। নাথিং।

ফার্স্ট ফ্লোরটা একটু দেখতে চাই।

এ ফ্লোরে কোনও অ্যাপার্টমেন্ট নেই। নটা ঘর আর একটা কমন বাথরুম আছে। সারভ্যান্টস রুম। কোনওটাতে কারও ড্রাইভারও থাকে। আসলে অফিস হিসেবে ভাড়া দেওয়ার প্ল্যান ছিল। কিন্তু কর্পোরেশন হাউজিংয়ের প্ল্যানেই স্যাংশন করেছে। কাজেই

বুঝেছি।

নিচের লনে পৌঁছে রণধীর বললেন, যদি কিছু মনে না করেন, আপনার লাঞ্চ আমার কোয়ার্টারে সেরে নিলে কৃতার্থ হব।

থ্যাঙ্কস্! আরেকদিন হবে। আজ চলি।

গেটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে রণধীর বললেন, আমাকে একটু মনে রাখবেন স্যার! তাই অ্যাম নট ফিলিং ওয়েল হিয়ার।

বুঝতে পারছি।

রাতের ঘটনার পর সিকিউরিটি কঠোর করা হয়েছে। বড় রাস্তায় একটা পুলিশভ্যানও দাঁড়িয়ে আছে। কর্নেলকে খাতায় ফের নাম সই করে ডিপারচার টাইম লিখে বেরুতে হলো। কয়েক পা এগিয়েই একটা ট্যাক্সি পেলেন। কোনও খালি ট্যাক্সি এ পর্যন্ত তাকে না করে না।

ইলিয়ট রোডে তিনতলায় নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরলে ষষ্ঠী বলল, নালবাজারের নাহিড়িসায়েব ফোং করতে বলেছেন।

কর্নেল চোখ কটমটিয়ে বললেন, করছি ফোং। তুই খাবার রেডি কর।

টেলিফোনে অরিজিৎকে পেয়ে বললেন, নতুন কিছু ঘটেছে?

 রঙ্গনাথনকে ট্রেস করেছি।

 কোথায়?

 হোটেল কন্টিনেন্টালে। তবে নজর রাখা হয়েছে মাত্র।

কত নম্বরে?

সুইট নাম্বার ১২৭। সিক্সথ ফ্লোর। আমি বলি কী, প্রথমে আপনি গিয়ে কথা বলুন।

ঠিক আছে। শোনো! সানশাইনে গিয়েছিলাম। এখনই ফিরছি।

 খবর পেয়েছি। কিছু পেলেন নাকি?

নাহ্।

ওঃ ওল্ড বস! হাতের কার্ড এখন শো করবেন না জানি। ও কে!

 আমি ক্ষুধার্ত, ডালিং!

সরি। ছাড়লাম…

 খাওয়ার পর কর্নেল চুরুট ধরিয়ে ড্রয়িংরুমে ইজিচেয়ারে হেলান দিলেন। শান্তশীলকে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল কেন সে অমন সাংঘাতিক চিঠি পেয়েও নিজে ছুটে যায়নি ই ব্লকে এবং সিকিউরিটি অফিসারকে বলেছিল খোঁজ নিতে?

সন্দেহের তালিকায় এখন সে এক নম্বরে উঠে এল। চিঠিটা পাওয়ার পর ছুটে গিয়ে বউকে গুলি করে মেরে ভালমানুষ সেজে সে সিকিউরিটিতে ফোন করে থাকবে। তার কোনও লাইসেন্ড আর্মস নেই, তা ঠিক। কিন্তু তার বউ প্রাক্তন ফিল্মস্টার। চরিত্র সম্পর্কে সন্দেহ থাকতেই পারে। মেলশোভিনিস্ট টাইপের ইয়াপ্পি। সুন্দরী মেয়েদের সে কেরিয়ারের অংশ হিসেবেই করায়ত্ত করতে পারে এবং গণ্য করতে পারে এও অর্জিত সম্পদ বলে।

তার ড্রাইভার আক্রাম বলেছে, সকালে সায়েব-মেমসায়েবের বহরমপুরে যাওয়ার কথা ছিল। এটা অবশ্য শান্তশীলের একটা চাল হতেও পারে। ভুবনেশ্বরে বসেই বউকে কোনও ছলে খুন করার প্ল্যান ছকে থাকতেও পারে।

শুধু ওই চিঠিটা

 কিন্তু হঠাৎ চিঠিটা শান্তশীলকে খুন করার দৈবাৎ সুযোগ দেয়নি তো? মার্ডার উইপন পাঁচিলের পেছনে ছুঁড়ে ফেললেই ভেড়ির অগাধ জলে তলিয়ে যাবে।

কর্নেল চোখ বুজে টাকে হাত বুলোচ্ছিলেন। একসময় চোখ খুললেন। নাহ্। ইয়াপ্পিরা খুন-খারাপির পথে কদাচ হাঁটে না। এ যুগের এক প্রজন্মের এই বিচিত্র মানসিকতা! তা শুধু পেশাগত দক্ষতাকেই উচ্চাকাঙ্ক্ষার অবলম্বন গণ্য করে। পেশাগত দক্ষতাই তার মূলধন। আগের দিনের নিষ্ঠাবান কারিগরদের মতো সে ক্রমাগত কুশলী হতে চায়।

শান্তশীল বলছিল ভুবনেশ্বরের রিপোর্ট তৈরি করতে ব্যস্ত সে। এটাই প্রকৃত ইয়াপ্পির চরিত্রলক্ষণ। নাহ্। কর্নেলের চোখে এযাবৎকাল দেখা অতি ধূর্ত খুনীর আদলেও মেলানো যায় না এক ইয়াপ্পির মুখে।

সন্দেহের তালিকা থেকে নেমে গেল শান্তশীল।

এবার প্রশ্ন, চন্দ্রনাথ কি সত্য কথা বলেছেন পুলিশকে? যাকে চেনেন না, সে কেন তাকে বাঁচানোর জন্য অত ঝুঁকি নিয়ে তার কাছে ছুটে যাবে?

চন্দ্রনাথের জামিন পেতে অসুবিধে হবে না। কোটিপতি লোক। তাছাড়া পাবলিক প্রসিকিউটার পুলিশের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জামিনে আপত্তি করবেন না সম্ভবত। তিনি আপত্তি না করলে ম্যাজিস্ট্রেটেরও আপত্তির কথা নয়। চন্দ্রনাথ সিগগির জামিন পেলেই ভাল হয়। তাঁর সঙ্গে কথা বললে কোনও সূত্র মিলতেও পারে। তার আগে

কর্নেল টেলিফোন তুলে হোটেল কন্টিনেন্টাল ডায়াল করলেন। মহিলা রিসেপশনিস্টের মিঠে গলা ভেসে এল। কর্নেল বললে, প্লিজ পুট মি টু সুইট নাম্বার ওয়ান টু সেভেন।

প্লিজ হোল্ড অন, স্যার।

ওকে!

কিচুক্ষণ পরে রিসেপশনিস্ট বলল, সরি স্যার! রিং হচ্ছে কেউ ধরছেন না।

কর্নেল ফোন রেখে উঠে দাঁড়ালেন। পোশাক বদলাতে গেলেন পাশের ঘরে।..

.