০১.
চন্দ্রনাথ দেববর্মন একটা ব্লু-ফিল্মের ক্যাসেট চালিয়ে দিয়ে হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিলেন। প্রিন্টটা ঠিক ওরিজিনাল নয়। তবে উজ্জ্বল এবং রঙিন। ছবির শুরুটা এমন স্বাভাবিক আর শালীন যে বোঝা যায় না শেষাবধি কিছু পাওয়া যাবে। একটা সেতুর দৃশ্য। পেছনে পাহাড়ি জঙ্গল। সেতুর ওপর পেছন ফিরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে হাত তুলে ঘড়ি দেখছে। বিরক্তিকর। রঙ্গনাথন ভুল করেছে, নাকি ইচ্ছে করেই তাকে ঠকিয়েছে? লোকটা ধড়িবাজ। হংকংয়ের কারবারি। মাসে অন্তত দুবার কলকাতা আসে। এলেই একটা করে ক্যাসেট দেয় এবং ফেরার সময় চেয়ে নিয়ে যায়।
চন্দ্রনাথের বয়স ষাট পেরিয়েছে। বেঁটে, শক্তসমর্থ গড়নের মানুষ। মোঙ্গলোয়েড চেহারা। মাকুন্দে মুক। যৌবনে পুনঃপুনঃ প্রেমে ব্যর্থ এবং দু দফা লিভ টুগেদার করেছেন। এও ব্যর্থতা। তাঁর ব্যক্তিত্ব ও সহবাসে এমন কিছু থাকতেও পারে, যা কোনও নারীই সহ্য করতে পারে না। এই তাঁর সিন্ধান্ত। কিন্তু ক্রমশ রক্তমাংসের নারীর প্রতি তার প্রচণ্ড বিদ্বেষ জন্মে গিয়েছিল। সে কারণে বাকি জীবন একা কাটাতে চেয়েছিলেন। কাটাচ্ছেনও তাই। তবু অভ্যাস। এখনও ছায়ায় কায়ার উত্তাপ পেতে চান।
ডিলাক্স মার্কেটিং রিসার্চ ব্যুরোর মালিক চন্দ্রনাথ। এটা তার নতুন কারবার। এই ব্যুরো কোনও কোম্পানির লেজুড় নয়। একেবারে স্বাধীন। কম লোক দিয়ে অনেক বেশি কামানো যায়। ছোট ও মাঝারি কনজুমার গুডস প্রস্তুতকারীরা তার মক্কেল। কোনো মক্কেলের বাজার পাওয়া পণ্যের চাহিদা হঠাৎ পড়তে শুরু করেছে কেন, উপাদানে গণ্ডগোল ঘটছে এবং কেউ বা কারা এটা ঘটাচ্ছে, ট্রেড ইউনিয়নের কোনও নেতার কারচুপি, নাকি শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী বাজারে ঢুকেছে, কিংবা ডিস্ট্রিবিউটারের বদমাইশি এসব ছাড়াও নতুন কোনও পণ্যের চাহিদার বাজার কেমন, ইত্যাদি অংসখ্য তথ্য চন্দ্রনাথের ব্যুরোকে সংগ্রহ করতে হয়। প্রয়োজনে ডিকেটটিভ এজেন্সির সাহায্য নিতে হয়। আজকার ডিটেকটিভ এজেন্সিরও অভাব নেই। চন্দ্রনাথের সম্পর্ক তিনটির সঙ্গে, যাদের নাম দেখে কিছু বোঝা যাবে না। কেয়ার, ডিয়ার এসকর্ট এবং ফিনিক্স।
একটা বাস এসে থামল সেতুতে। এক তরুণী নামল। চন্দ্রনাথ হুইস্কিতে চুমুক দিয়ে সিগারেট ধরালেন। বাসটা চলে গেলেই দুজনে পরস্পরের হাত ধরল। মার্কিন উচ্চারণ বুঝতে অসুবিধা হয় না চন্দ্রনাথের। বছর তিনেক আমেরিকায় ছিলেন। অনেক পোড় খেয়েছেন এবং অনেক ঘাটের জল।
তরুণ-তরুণী কথা বলতে বলতে হাঁটছে। জলের ধারে একটা পার্ক। পার্ক জনহীন নয়। কমবয়সীরা খেলা করছে। বিরক্তিকর! অন্তত একটি চুমুও–
টেলিফোন বাজল। ফোন তুলতে গিয়ে দেয়াল ঘড়ির দিকে চোখ গেল। রাত দশটা তিরিশ। সাড়া দিলেন অভ্যাসমতো, ইয়া।
মিঃ দেববর্মন? কোনও নারীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল। স্মার্ট ইংরেজি। আপনি কি একা?
চন্দ্রনাথ একুট সতর্ক হয়ে বললেন, হ্যাঁ। আপনি কে?
আপনাকে আমি চিনি।
তাতে কী?
এই যথেষ্ট নয় কি মিঃ দেববর্মন?
কী চান আপনি?
একুট গল্প করতে। না, না মিঃ দেববর্মন। এটা জরুরি।
কেন? বলে পর্দায় চোখ বুলিয়ে নিলেন চন্দ্রনাথ, কিছু মিস করছেন কি না। নাহ্। তরুণ-তরুণী পার্কের শেষ প্রান্ত দিয়ে হেঁটে চলেছে। কখনও ক্লোজ শট, কখনও লং। মৃদু আবহসঙ্গীত এবং পাখির ডাক এবং প্রকৃতি।
মিঃ দেববর্মন! আপনি এখন কি করছেন?
উত্তেজনামেশা কৌতূহল চন্দ্রনাথকে ফোন রাখতে দিল না। একটু হাসির সঙ্গে বললেন, এটা কি কোনও ফাঁদ?
না, না মিঃ দেববর্মন! আমি আপনার শুভাকাঙ্খী।
ঠিক আছে। আনেক ফাঁদ আমি দেখেছি। বলুন।
আমার প্রশ্নের উত্তর দিন প্লিজ!
আমি টি ভি দেখছি এবং হুইস্কি খাচ্ছি। আপনার কোনও প্রস্তাব আমি গ্রহণ করব না। বুঝলেন?
মিঃ দেববর্মন! আপনার কি আগ্নেয়াস্ত্র আছে?
আছে।
দরজা ঠিকমতো লক করা আছে?
আছে। কিন্তু কেন এসব কথা? আপনি কি আমাকে হুমকি দিচ্ছেন? কে আপনি?
আপনি উত্তেজিত। শান্ত হোন। আর হাতের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি রাখুন।
তরুণ-তরুণী জলের ধারে হাঁটছে। গতি পাহাড়টার দিকে। আছড়ে পড়া জলের শব্দ এবং আবহসঙ্গীত ক্রমে জোরালো হচ্ছে। চন্দ্রনাথ খাপ্পা হয়ে বললেন, পুলিশ দফতরে আমার লোক আছে। এখনই আপনার নাম্বার জেনে নেওয়ার ব্যবস্থা করছি। আর আমার টেলিফোনে টেপরেকর্ডার ফিট করা থাকে, জানেন তো?
মিঃ দেববর্মন! কেউ দরজায় নক করলেও
হঠাৎ কথা থেমে গেল। চন্দ্রনাথ কয়েকবার উত্তেজিতভাবে হ্যালো হ্যালো করেও আর সাড়া পেলেন না। কোনও শব্দও শোনা গেল না। একটু অপেক্ষা করে ফোন রাখলেন। হুইস্কিতে চুমুক দিয়ে পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। দৃষ্টিতে শূন্যতা ছিল।
তরুণ-তরুণী পাহাড়ি রাস্তার চড়াইয়ে উঠছে। দূরে গাছপালার ভেতর একটা বাড়ির আভাস। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থেমে এতক্ষণে চুম্বন।
কিন্তু চন্দ্রনাথের মনে অন্য উত্তাপ। উঠে গিয়ে টেবিলের ড্রয়ার থেকে পয়েন্ট বাইশ ক্যালিবারের খুদে রিভলবার বের করলেন। ৬টা গুলি ভরে এগিয়ে গেলেন ড্রয়িংরুমের দরজার দিকে, যেটা বাইরে যাওয়ার দরজা এবং চওড়া করিডর আছে। দরজা ঠিকমতো লক করা আছে। আইহোলে দেখলেন আলোকিত করিডর নির্জন। দুধারে দুটো অ্যাপার্টমেন্ট। বাঁদিকেরটা এক বাঙালি অধ্যাপক দম্পতির। ডানদিকেরটায় থাকেন এক পার্শি বৃদ্ধা মিসেস খুরশিদ এবং তার অ্যাংলোইন্ডিয়ান পরিচারিকা। চন্দ্রনাথ বেডরুমে ফিরে এলেন। এখন তরুণ-তরুণী বাড়িটাতে ঢুকছে। খুব পুরনো কাঠের বাড়ি। এবার তাহলে চরম মুহূর্তের দিকে এগোচ্ছে ওরা।
নাহ্। কাট করে একটা রান্নাঘরের দৃশ্য। এক প্রৌঢ়া ওভেনে কিছু রান্না করছেন। বিজ্ঞাপন।
এরা এভাবেই সময় নষ্ট করে। অনেক ঘুরিয়ে তবে ঠিক জায়গায় পৌঁছায়। চন্দ্রনাথের এ বয়সে অত ঘোরপ্যাঁচ অসহ্য লাগে। সোজাসুজি সেক্সের পক্ষপাতী তিনি এবং এসব ব্যাপার পাপ বলে মনে করেন না। শরীর আছে। কাজেই জৈবতার ধর্ম আছে। প্রকৃতির স্বাভাবিক দান। এত ঢাকঢাক গুড়গুড় করার মানে হয় না। অথচ এই সব ক্যাসেট যারা তৈরি করে, তারা ঝানু ব্যবসায়ী। সেক্সের সঙ্গেও বিজ্ঞাপন। তেল সাবান স্নো, কিংবা রান্নার কড়াই তার সঙ্গেও মিউজিক! অসহ্য!
কিন্তু মেয়েটি কে? কেন ওভাবে হঠাৎ টেলিফোন করে তাকে ভয় দেখাল? হঠাৎ থেমে গেলই বা কেন? চন্দ্রনাথ উদ্বিগ্নভাবে হুইস্কিতে চুমুক দেলেন। অটোমেটিক রিভলভারটা হাতের কাছেই বিছানায় রেখে দিলেন। তার হাত কাঁপছিল।
পুলিশকে জানাবেন কি? তার একটা সুন্দর রাত্রি খুন হয়ে গেল। সেক্সে মন বসবে বলে মনে হচ্ছে না। একটা অনুসন্ধান চলছে মনের ভেতর। কে বা কারা তাকে খুন করতে চাইবে? এ ধরনের কারবারে প্রতিপক্ষ অবশ্যই থাকে। তই বলে সাংঘাতিক কিছু করে ফেলবে? অবিশ্বাস্য। ব্যক্তিগত শত্রুতাও তো তাঁর কারও সঙ্গে নেই।
তরুণটিকে আগে নগ্ন করেছে তরুণী। তাকিয়ে থাকতে থাকতে আবার একটা সিগারেট ধরালেন চন্দ্রনাথ। কিন্তু আবার কাট এবং পোশাকের বিজ্ঞাপন।
সেই সময় টেলিফোন বাজল। চন্দ্রনাথ আস্তে টেলিফোন তুলে সাড়া দিলেন, ইয়া!
আপনি তৈরি হয়ে আছেন তো মিঃ দেববর্মন?
একই কণ্ঠস্বর। চন্দ্রনাথ বললেন, হঠাৎ ফোন ছেড়ে দিয়েছিলেন কেন?
আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।
হ্যাঁ। আমার হাতে সিক্সরাউন্ডার। অটোমেটিক। কিন্তু আমি জানতে চাই, কে বা কারা আমাকে
আপনি নিশ্চয় জানেন।
জানি না। যতটা সম্ভব শক্ত গলায় চন্দ্রনাথ বললেন। আমি বুঝি না।
তাই বুঝি? …একটু বিরতির পর শোনা গেল, মুখোমুখি হলে আভাস দিতে পারতাম যেটুকু আমি জানি। ফোনে তা সম্ভব নয়। আমি আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী।
আপনি কোথা থেকে কথা বলছেন?
কাছাকাছি।
একটু ভেবে নিয়ে চন্দ্রনাথ বললেন, আসতে চাইলে আসতে পারেন।
আমি জানি আপনি শক্তিমান মানুষ মিঃ দেববর্মন! কিন্তু
তাহলে ছেড়ে দিন। বিরক্ত করবেন না।
ঠিক আছে। ঝুঁকি নিয়েই আমি যাচ্ছি। কিন্তু আমাকে রক্ষার দায়িত্ব আপনার।
চন্দ্রনাথ শক্ত গলায় বললেন, আসুন। হ্যাঁ, একটা কথা। আপনি গাড়িতে আসবেন, না হেঁটে আসবেন? এত রাতে সিকিউরিটি স্টাফ আপনাকে ঢুকতে দেবে না।
তা নিয়ে ভাববেন না মিঃ দেববর্মন! আমি এই হাউসিং কমপ্লেক্সের মধ্যেই আছি।
তা-ই? তাহলে আসুন।
টেলিফোন রেখে ক্যাসেট বন্ধ করলেন চন্দ্রনাথ। হুইস্কিতে আরও দুটো চুমুক দিয়ে আবার একটা সিগারেট ধরালেন। তারপর ড্রয়িংরুমে গেলেন। হাতে রিভলভার। দরজার আইহোলে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি দরদর করে ঘামছিলেন রাত-পোশাকের ভেতরে।
এটা তিনতলা। অটোমেটিক লিফট আছে। সেটা এখান থেকে দেখা যায় না। বাইরের মুখোমুখি দুটো অ্যাপার্টমেন্টের পর করিডর বাঁদিকে বেঁকেছে। তারপর আবার বাঁদিকে একটা অ্যাপার্টমেন্ট সবগুলোই প্রায় দেড় হাজার বর্গফুটের বেশি। শুধু চন্দ্রনাথেরটা ৯ শো বর্গফুট। কার্পেট এরিয়ার হিসেব। এটা ১৩ নম্বর অ্যাপার্টমেন্ট। আনলাকি থারটিন।
প্রতীক্ষা– এই ধরনের প্রতীক্ষা বড় অসহ্য। চন্দ্রনাথ আলোকিত নির্জন করিডরের দিকে তাকিয়ে আছেন। একটু নেশা হয়েছে। নেশা এবং উত্তেজনা তার দৃষ্টিকে যেন অস্বচ্ছ করে দিচ্ছে ক্রমশ। দরজা খুলে দাঁড়ালেই বা ক্ষতি কী? হাতে আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি।
লিফটের সামনে ১০ নম্বর অ্যাপার্টমেন্টে গরগর শব্দে মিঃ অগ্রবালের পাজি কুকুরটা গর্জন শুরু করেছে। মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে দরজা খুলে বেরুলেন চন্দ্রনাথ দেববর্মন। তিনি চিরকালের দুর্ধর্ষ লড়ুয়া…
.