ত্রিশ
‘নাআআআ!’ ভয়ার্ত আর্তনাদ বেরোল আমার গলা দিয়ে।
দৌড়নোর চেষ্টা করলাম-কিন্তু পা বেধে গেল কিছুতে। হাঁটুর ওপর আছড়ে পড়লাম। ঘুরে চাইতেই দেখলাম কীসে হোঁচট খেয়েছি।
এক গার্ডেন হোস।
ওটা আঁকড়ে ধরে রীতিমত যুঝে উঠে দাঁড়ালাম। পরমুহূর্তে, নযলে হড়কে চলে গেল আমার হাত। কী করছি তাও জানি না। স্রেফ নটা তুলে হাতলটা চাপলাম-
এবং পানির শক্তিশালী ফোয়ারা ছেটালাম অগ্নিমানবের বুকে।
বারান্দার মাঝখানে থমকে দাঁড়িয়েছে ও। বাতাস যেন নিভিয়ে দিচ্ছে ওর শরীরের সমস্ত অগ্নিশিখা।
দু’হাতে শক্ত করে হোসটা চেপে ধরে ওর শরীর বরাবর তাক করলাম। ওটা ওপর-নিচ করে পানিতে ভিজিয়ে দিচ্ছি ওকে। ওর জ্বলন্ত মাথা থেকে পা অবধি কিছুই রক্ষা পেল না। একরকম ভাসিয়ে দিলাম ওকে। পানির তোড়ে।
অগ্নিস্ফুলিঙ্গগুলো দপ করে নিভে যেতেই ওর বাহুজোড়া এক ঝটকায় প্রসারিত হলো। তারপর ধোঁয়া উঠে, হিসহিস শব্দ তুলে ম্লান হয়ে গেল।
‘অ্যাইইই!’ টলমল পায়ে পিছু হটার সময় বুনো চিৎকার ছাড়ল ও। এবার দড়াম করে চিতিয়ে পড়ল। মরে গেল অগ্নিশিখা। ওর বুক থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে। নিস্পন্দ পড়ে রইল অগ্নিমানব।
‘সাবাস, ছেলে!’ বাজখাঁই এক কণ্ঠস্বর বলে উঠল পেছন থেকে।
পিছু ফিরে চাইতেই দেখলাম ইয়ার্ড পেরিয়ে দুপদাপ এদিকেই আসছে উয। বইটা শূন্যে তুলে দোলাচ্ছে।
‘পেয়েছি!’ চেঁচিয়ে উঠল খুশিতে আত্মহারা সুপারভিলেন। ‘ভাল দেখিয়েছ, জলোচ্ছ্বাস-জল-জগতের রাজা!’
নটা তখনও ধরে রয়েছি শক্ত হাতে। এবার ছেড়ে দিতেই হোসটা বারান্দায় পড়ে গেল।
কাঁপছি আমি। অল্পের জন্য রক্ষা পাওয়ায় বিস্ময়ের ধাক্কাটা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি।
‘তো…বইটা আপনি পেয়েছেন যখন,’ বললাম। গলা কেঁপে গেল। ‘তারমানে আমি এখন মুক্ত?’
‘পাগল?! জবাবে বলল ও। ‘তুমি অনেক বেশি জেনে ফেলেছ।’
‘কিন্তু-কিন্তু-’ তোতলাচ্ছি।
‘খারাপ লাগছে। খুব খারাপ লাগছে, বাছা। কিন্তু কী করা, তোমাকে আমার উযায়ন না করে উপায় নেই। তোমার শেষ কোন কথা আছে?’
‘এক মিনিট!’ চেঁচিয়ে উঠলাম। ‘আপনি তা পারবেন না! সুপারপাওয়ারের আইন আছে না?’
‘ওটা আমার বানানো,’ অম্লান বদনে সাফ জানিয়ে দিল নির্লজ্জ বদমাশটা। ‘অমন কোন আইনের অস্তিত্ব নেই।’
‘কিন্তু আপনি তো বলেছিলেন-’
‘তুমি যদি সহযোগিতা না কর সেই ভয়ে বলেছিলাম,’ বলল ও। ‘ভেবেছিলাম তুমি হয়তো পালিয়ে-টালিয়ে যাবে। তাই ফালতু এক কোডের কথা বানাই। খুব ধোঁকা খেয়েছ, তাই না? জানই তো আমি একটা ভিলেন-সুপারভিলেন। কী, বুঝলে কিছু?’
ওর দিকে চোখ তুলে চাইলাম, মাথা ঝাঁকাচ্ছি।
আবারও বুদ্বুদ ছড়িয়ে বেড়ে উঠতে লাগল ও। আমার সামনে খাড়া হয়ে উঠতেই ওর শরীর থেকে ছড়াতে শুরু করল প্রচণ্ড উত্তাপ।
বোঁ করে ঘুরে দাঁড়ালাম। ওকে দৌড়ে পেছনে ফেলতে পারব না জানি।.
সাক্ষাৎ মৃত্যু। আর কোন গতি নেই। নেই বাঁচার দ্বিতীয় কোন সুযোগ।
এবার আমার গলা দিয়ে বিস্ময়ের চিৎকার বেরোল: ‘মুসা? রবিন? তোমরা?’
একত্রিশ
বারান্দার দিকে দৌড়ে এল মুসা আর রবিন। কালো লেগিঙের ওপরে গাঢ় হলুদ টি-শার্ট পরেছে রবিন। আর মুসার পরনে জিন্স আর লাল টি-শার্ট। রবিনের চোখজোড়া উযের চোখে স্থির।
‘না! পালাও এখান থেকে!’ চেঁচালাম গলা ফাটিয়ে। ‘পালাও! এখানে মহাবিপদ!’
থমকে দাঁড়াল রবিন। ক্রুদ্ধদৃষ্টিতে চাইল উযের উদ্দেশে।
‘ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক!’ আর্তনাদ ছাড়লাম। ‘পালাও! পালাও!’
রবিন এবার চোখ নামিয়ে আমার দিকে চাইল।
‘কিশোর, বইটা আমিও পড়েছি,’ বলল। ‘মনে নেই? হররল্যাণ্ড থেকে ফেরার পথে গাড়িতে।’
‘খাইছে, আমিও,’ বলল মুসা।
‘হ্যাঁ, মনে আছে,’ বললাম। ‘তাতে কী? জান বাঁচানো ফরয। তোমরা বরং—’
ঝুঁকে কাছিয়ে এল উয। ওর ছায়া পড়তেই শিউরে উঠলাম আমি।
‘বাসায় গিয়ে সুপারপাওয়ার চ্যাপ্টারগুলো ট্রাই করেছি আমি,’ বলল রবিন। মুসা নিশ্চুপ। তারমানে ও করেনি।
চোখ পিটপিট করে চাইলাম রবিনের দিকে।
‘কী বলছ তুমি?’
‘ওগুলো মুখস্থ করে ফেলি আমি,’ বলল ও। ‘বাতাসের শক্তির চর্চা করে আয়ত্ত করে ফেলেছি। এবং এখন…আমার নাম হচ্ছে টর্নেডোমানব!’
উয হেসে উঠল।
‘আমার ভয় করছে! গা কাঁপছে!’ ঠাট্টা করে বলল।
‘রবিন-ও আমাকে উযায়ন করতে যাচ্ছে,’ তুতলে বললাম। ‘তোমার ক্ষমতা কি সত্যিই-’
‘দেখোই না,’ বলল নথি।
চোখ বুজে, এক পায়ে ভর দিয়ে লাটিমের মত বনবন করে ঘুরতে লাগল ও। দ্রুত…আরও দ্রুত…এতটাই জোরে ঘুরছে, এক পর্যায়ে ঝাপসা দেখাল ওকে। ওর ঘূর্ণি-দেহ থেকে জোরাল বাতাসের ঝাপটা ধেয়ে এল হুঙ্কার তুলে।
‘হ্যাঁ!’ চেঁচিয়ে উঠলাম। ‘হ্যাঁ!’
ঝোড়ো বাতাসে চুল খাড়া হয়ে গেল আমার। টলতে টলতে সামনে এগোলাম-এবং উড়ে গিয়ে প্রায় উযের গায়ের ওপর পড়লাম!
দমকা বাতাসে উড়ে গেল বারান্দায় রাখা চেয়ারগুলো। একটা টেবিল উল্টে পড়ে ঘষটে গেল উঠন দিয়ে। গাছের পাতারা কাঁপছে, নড়ছে।
চরকির মতন ঘোরার বেগ আরও বাড়াল রবিন। ওকে এখন প্রায় দেখতেই পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে ও যেন বাতাস হয়ে গেছে!
উয দু’বাহু তুলে নিজেকে আড়াল করতে চাইল। দাপুটে বাতাসের দমকে বারান্দায় ইতস্তত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ল ওর বড়- বড় তৈলাক্ত, আঠাল দলা।
‘হ্যাঁ,’ খোশমেজাজে চেঁচালাম বাতাসের উদ্দেশে। ‘চালিয়ে যাও! চালিয়ে যাও! ওকে বাগে পাওয়া গেছে, রবিন!’ এবার হঠাৎই থেমে গেল শন-শন বাতাস।
পেছনের উঠনে এখন মৃত্যুশীতল নীরবতা T
রবিন এক পায়ের ওপর ঘুরছে…ধীরে…ধীরে…যতক্ষণ পর্যন্ত না ভারসাম্য হারিয়ে, হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল মাটিতে।
দশ সেকেণ্ড। মাত্র দশ সেকেণ্ড পরেই ওরও কেরামতি শেষ।
গুঙিয়ে উঠল রবিন। মাথা তুলল।
‘ওহহো। সব মনে হয় গুলিয়ে ফেলেছি।’
মুসা দৌড়ে গেল ওর কাছে। হাত বাড়াল ওকে টেনে তুলতে।
এসময় আমাদের তিনজনের ওপরে ছায়া ফেলল উয। আবারও অট্টহাসি দিল ও।
‘আহা, ঝিরিঝিরি বাতাসে গা-টা একেবারে জুড়িয়ে গেছে,’ বলল। ‘গর্দভ কোথাকার! এখন তোমাদের দু’জনকেই উযায়ন করতে হবে আমার। আর উপায় নেই! কী, বুঝলে কিছু?’
আবারও ভুড়ভুড়ি উঠতে লাগল ওর শরীরময়, ক্রমেই বেড়ে উঠছে ও।
মুসার হাত চেপে ধরে এক লাফে উঠে দাঁড়াল রবিন এবং আমার পাশে চলে এল দু’জনেই।
‘খাইছে—পালাও!’ চিৎকার ছাড়ল মুসা।
অনেক দেরি হয়ে গেছে। বাড়ির পেছন দেয়ালে আমাদেরকে কোণঠাসা করে ফেলেছে উয।
ক্রুদ্ধ হুঙ্কার ছাড়ল ও-এবং গরম বাতাসের হলকা ভেসে এল ওর শরীর থেকে। মনে হলো কোন ভোঁদড়ের গা থেকে আসা তীব্র, কটু দুর্গন্ধ মিশে গেল বুঝি বাতাসে। কিংবা হাজারটা ভোঁদড়ের!
শ্বাস নিতে পারছি না। চোখে পানি জমেছে। আমরা তিন বন্ধু উৎকট গন্ধে হাঁসফাঁস করছি দস্তুরমত।
আরেকটা ঝাপটা এল তপ্ত বাতাসের। উয নিজেকে ছড়িয়ে দিল আমাদের ওপরে…ভীতিকর আঁধারে ঢেকে ফেলল আমাদেরকে। বুদ্বুদ ছড়াচ্ছে, হিসহিস শব্দ হচ্ছে…নিজেকে তৈরি করছে ছলাৎ করে আছড়ে পড়ার জন্য।
গায়ের চামড়া পুড়ে যাচ্ছে আমার। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। নাকে এসে বারবার ধাক্কা মারছে দুর্গন্ধের ঢেউ।
‘ওহহহ!’
আমি কি গুঙিয়ে উঠলাম ওভাবে?
এবং এর পরপরই আঁধারের পর্দা চিরে দিল ফ্ল্যাশলাইটের উজ্জ্বল আলো।
ঘাড় কাত করলাম। জলভরা চোখ পিটপিটিয়ে ফ্যাবুলাস ফ্লেমকে দেখলাম। আবারও জ্বলছে ও। ওর চারপাশে নাচছে অগ্নিশিখা।
গনগনে উজ্জ্বল আগুন ঝরিয়ে আমাদের দিকে ধেয়ে এল অগ্নিমানব।
পুরো শরীর জুড়ে দপদপে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, গটগটিয়ে উযের পাশে এসে দাঁড়াল ও।
উয নিজেকে পেছনদিকে উঁচু করল। প্রবল বুদ্বুদ ফাটছে, টলতে-টলতে সরে গেল আগুনের কাছ থেকে। পালাচ্ছে।
‘কোথায় ওটা?’ আমার উদ্দেশে হাঁক ছাড়ল অগ্নিমানব। ‘কোথায় লুকিয়ে রেখেছ, পাঙ্ক?’
উযের উদ্দেশে তর্জনী দেখালাম।
‘ওর কাছে!’ চিৎকার করলাম। ‘বইটা ওর কাছে!’ ফুলকি ছিটকে উঠল অগ্নিমানবের মাথা থেকে।
‘আরে, আমি ওই বইটার কথা বলছি না!’ আর্তচিৎকার ছাড়ল। ‘কী চাই বোঝনি? কোথায় ওটা?’
‘ওকে দিয়ে দাও,’ গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলল উয।
‘আপনারা কী বলছেন আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!’ চেঁচিয়ে উঠলাম
‘খুব খারাপ কথা,’ বলল অগ্নিমানব। ‘তোমাদেরকে একই সাথে পোড়ানো আর উযায়ন করা হবে! এখুনি!’
ওরা দু’জনেই আমাদের উদ্দেশে ঝাঁপালে তিন বন্ধু প্রাণভরে আর্তনাদ ছাড়লাম।
এবং আমাদের আর্তস্বর ছাপিয়ে, পরিচিত এক কণ্ঠ কানে এল:
‘আপনারা কি এটা খুঁজছেন?’
ঝট করে ঘুরে দাঁড়ালাম বাড়ির পার্শ্বদিক লক্ষ্য করে। এবং গর্জে উঠলাম।
‘তুমি এখানে কী করছ, ডন?’
বত্রিশ
ঘাস মাড়িয়ে ছুটে এল ও। হাতে দোলাচ্ছে কী যেন।
‘আপনারা মনে হয় এটা চান, তাই না?’ তারস্বরে চিৎকার ছাড়ল। সামনে-পেছনে সমানে নাড়াচ্ছে হাতে ধরা জিনিসটা।
উয আর অগ্নিমানব, দু’জনেই পিছিয়ে গেল। ডনের হাতের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে ওরা।
আমি চিনলাম না জিনিসটা।
‘কী ওটা, ডন?’ চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলাম।
‘বুকমার্ক,’ বলল ডন।
চোখ পিটপিট করে চাইলাম ওটার দিকে
‘কী?’
‘উযের বইয়ের সেই বুকমার্কটা,’ জানাল ডন। ‘তোমার মনে নেই? অদ্ভুত সব শব্দ লেখা আছে যেটায়। ছোট-ছোট টাইপের লেখাগুলো পড়নি? ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে পড়েছি আমি। এখানে লিখেছে এই শব্দগুলো না আওড়ালে দশ সেকেণ্ডে ক্ষমতা শেষ!
পরস্পর চোখাচোখি করলাম আমরা তিন বন্ধু।
‘এবার ব্যাখ্যা মিলছে,’ বলে, দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম।
ডনের দিকে চাইলাম।
‘তো, তোমার কাছে পুরোটা সময়ই ওই বুকমার্কটা ছিল?’
মাথা ঝাঁকাল ও।
‘বইটা থেকে ওটা বের করে নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম কখনও হয়তো কাজে আসবে।’
‘ওহ, ডন!’ আর্তনাদ ছাড়লাম। ‘তোমার কারণেই এত কিছু!’ শ্রাগ করল ও।
‘তো?’ ভাবখানা এমন যেন কিছুই হয়নি।
তেল চটচটে, প্রকাণ্ড এক থাবা বাড়াল উয।
‘বুকমার্কটা আমাকে দিয়ে দাও,’ ঘাউ করে উঠল।
‘ভুল হাতে যেন না পড়ে ওটা,’ যোগ করল অগ্নিমানব। ‘ওটা পেলে আমার ক্ষমতা আরও বাড়বে।’
‘তোমার না, বলো আমাদের!’ গমগমে গলায় বলে উঠল উয। ‘কার্ডটা আমাকে দাও, ডন। অগ্নিমানবকে বিশ্বাস করা যায় না।’
‘দেব না!’ কঠোর কণ্ঠে জানাল ডন।
‘দিয়ে দাও বলছি!’ বজ্রকণ্ঠে হুকুম করল উয। ছোঁ মেরে কেড়ে নিতে চাইল বুকমার্কটা।
ডন ঝট করে ওটা সরিয়ে ফেলল সুপারভিলেনের নাগালের বাইরে।
এসময় অগ্নিমানব এক ঘূর্ণি অগ্নিগোলক ছুঁড়ল ডনের মাথা বরাবর।
ডন চোখের পলকে মাথা নোয়াতেই ওটা উড়ে গেল ওর ওপর দিয়ে।
‘পারেননি! পারেননি!’ চেঁচিয়ে উঠে এক পাক নেচে নিল ও।
এবার উয আর অগ্নিমানব দু’জনেই ঝাঁপাল ওর উদ্দেশে।
কিন্তু ডন দু’হাত দোলাল। ওপরদিকে উড়ে যাওয়ার ভঙ্গি দেখাল বাহুজোড়া নেড়ে।
এবং পরমুহূর্তে, দুই সুপারভিলেন ভেসে উঠল বাতাসে। ‘অ্যাইইই!’ প্রাণপণে তৈলাক্ত হাত-পা ছুঁড়ছে উয। ‘নামাও আমাকে!’
‘আমাকে নামাও, কথা দিচ্ছি বেশি কষ্ট দিয়ে মারব না!’ বিকট চিৎকার ছাড়ল অগ্নিমানব।
কিন্তু কে শোনে কার কথা! ডন আবারও দু’হাত শূন্যে দোলাল। মাথার ওপরে তুলে নাড়ছে।
এবং দুই ভিলেন উড়ে উঠল…উড়ছে বাড়িঘরের ওপর দিয়ে…রাস্তাঘাট পেরিয়ে….উঁচু-উঁচু গাছপালার মাথা ছাড়িয়ে- উড়তেই থাকল যতক্ষণ অবধি না আকাশের পটভূমিতে ছোট্ট দুটো বিন্দুতে পরিণত হলো। তারপর একদম উবে গেল।
রবিন, মুসা আর আমি হতবিহ্বল হয়ে কাঠপুতুলের মত দাঁড়িয়ে রয়েছি, আকাশে দৃষ্টি মেলে। এবার ডনের দিকে ফিরলাম। বিজয়ের নির্মল হাসি শোভা পাচ্ছে ওর মুখে।
‘দেখলে আমার ক্ষমতা!?’ চিৎকার ছাড়ল খোশমেজাজে। ‘মাধ্যাকর্ষণ ফেইল!’
‘হুম! সাব্বাস, ডন!’ খুশিতে চেঁচিয়ে উঠল রবিন।
‘খাইছে, ডন, তুমি আমাদের বাঁচিয়েছ,’ বলল মুসা।
‘কী অদ্ভুত কাণ্ড!’ চিৎকার করে বললাম আমি। ‘দারুণ দেখিয়েছ, ডন!’
‘আমি হাতজোড়া নাড়লেই লোকে চিরদিনের জন্যে উড়ে চলে যায়,’ বলল ডন। ‘আর আমার ক্ষমতা টেকে, কারণ আমি তোমাদের মত বোকামি করিনি। বুকমার্কের কথাগুলো মন দিয়ে পড়েছিলাম!’
বারান্দা থেকে কুড়িয়ে নিলাম উযের বইটা। হাত দিয়ে ডলে প্রচ্ছদ থেকে তেলতেলে কালো আঠা মুছলাম।
বুকের মধ্যে আমার এখনও ড্রাম বাজছে। কিন্তু দুই আপদ আর বিপদ তো বিদেয় হয়েছে। এখন হাঁফ ছাড়া যায়।
তোমরা সবাই এখন আমার বশে!’ চেঁচাল ডন। ‘দেখো তোমাদেরকে আমি কীভাবে উড়িয়ে নিয়ে ওই গাছটার মগডালে চড়িয়ে দিই!’
ও হাত তোলার আগেই আমি চেপে ধরলাম।
‘রাখো, রাখো, অনেক হয়েছে,’ বললাম। ‘তোমাকে আর ভেলকি দেখাতে হবে না। এখন বাসায় চলো আর জীবনের তরে ভুলে যাও যা ঘটেছে!’
.
কিন্তু অবশ্যই আমি ভুলতে পারলাম না।
আমিও যে সত্যিকারের সুপারহিরো হতে চাই।
ডনকে আমার হিংসে হচ্ছে না। ওর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। রবিন আর মুসার পেছন-পেছন গিয়ে ও সবার জীবন বাঁচিয়েছে। তবে আমি চাই না এ বাসায় একজনই মাত্র সুপারহিরো থাকুক।
তাছাড়া ওকে কি বিশ্বাস করা যায়? ছেলেমানুষ, কখন কী ভূত মাথায় চাপে কে জানে। আমি না কখন আবার বিপদে পড়ি ওর ভুলে!
।তাই নিজেকে রক্ষার জন্য আমার নিজস্ব শক্তি চাই। আমাকে জলোচ্ছ্বাস ওরফে জল-জগতের রাজা হতে হবে।
তো পরদিন বিকেলে গোপনে ডনের ঘরে ঢুকলাম। বিশেষ ওই বুকমার্কটা খুঁজলাম সবখানে। ওটা কোথায় লুকিয়ে রেখেছে ও?
ডনের ড্রেসারের সব কটা ড্রয়ার হাতড়ালাম। ওর বুকশেলফের প্রতিটা বই টেনে বের করলাম। ওর বিছানার তলায়ও তন্ন-তন্ন করে খুঁজলাম। ওর ক্লজিটের মেঝের সমস্ত জঞ্জাল ঘাঁটলাম।
শেষমেশ ওটা যখন পেলাম তখন রীতিমত দরদর করে ঘামছি আর হাঁফাচ্ছি আমি। জিনিসটা ওর বালিশের নিচে ছিল।
চোখের সামনে তুলে ধরলাম বুকমার্কটা। শব্দগুলো পড়ার সময় টের পেলাম হাত কাঁপছে-এ শব্দ কটার কল্যাণেই হয়তো স্থায়ী হবে আমার জলোচ্ছ্বাস ঘটানোর ক্ষমতা।
‘অ্যাই!’ আমার হাত থেকে বুকমার্কটা উড়ে গেলে চেঁচিয়ে উঠলাম।
থাবা মারলাম ওটাকে চেপে ধরতে। লক্ষ্যভ্রষ্ট। ঘরের ছাদের কাছে ভেসে উঠল ওটা।
পাঁই করে ঘুরতেই দেখলাম ডন বেডরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে। এক হাত তোলা ওর, বুকমার্কটাকে ভাসিয়ে রেখেছে।
‘ওটা দিয়ে দাও, ডন!’ চেঁচিয়ে বললাম। ‘নিচে ফেলো। আমাকে দাও-এখুনি!’
মাথা নাড়ল ও।
‘না, কিশোরভাই, দেব না। এক বাড়িতে একজন সুপারহিরোই যথেষ্ট! এবং সেটা আমি। আমি, আমি, আমি!’
‘অবুঝের মত কথা বোলো না তো!’ বললাম। ‘বইটা আমার। বুকমার্কটাও। কাজেই দিয়ে দাও!’
‘তোমার লাগবে ওটা?’ চিৎকার ছেড়ে, কামরায় ঢুকল ডন। ‘চাও? তাহলে যাও পেড়ে আনো গে!’
দু’হাত দোলাল ও-এবং অনুভব করলাম মেঝে থেকে ভেসে উঠেছি আমি।
‘অ্যাই! কী করছ?’
একটা হাত ওঠাল ও-এবং নিজেকে থামাতে পারলাম না। আমি এখন পুরোপুরি ওর কব্জায়। অসহায়। ভাসতে ভাসতে কামরার ছাদে গিয়ে ঠেকলাম।
‘আমাকে নামাও, ডন!’ গর্জালাম। ‘নামাও বলছি। আমি—’s এবং ঠিক এমনিসময় ঘরে প্রবেশ করল চাচা-চাচী।
প্রথমটায়, তারা শুধু ডনকেই দেখল। কিন্তু তারপর ওপরদিকে চাইতেই আমাকে ভেসে থাকতে দেখতে পেল, আমার বাহুজোড়া পাখির ডানার মত ছড়ানো।
চাচা বিস্ময়ে অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল।
‘কিশোর! এসব কী হচ্ছে?’ চাচী জবাব চাইল।
‘উম…আসলে…’ মগজ চলছে আমার। চোখ নামিয়ে চাইলাম তাদের দিকে। ‘এটা সায়েন্স ক্লাসের একটা এক্সপেরিমেন্ট। বাড়তি ক্রেডিট-এর জন্যে!
শেষ কথা
ডন অবশেষে নামাল আমাকে। তবে তার আগে কথা দিতে হলো বুকমার্কটা আর হাত করতে চাইব না।
তো কী আর করা…
আমার সুপারহিরো হয়ে কাজ নেই। এখন থেকে বরং আমি ডনকেই তোয়াজ করে চলব, খেয়াল রাখব ও যেন কিছুতেই না খেপে।
ঠিক করেছি উইয়ার্ড অভ উয বইটা লুকিয়ে রাখব গোপন কোন জায়গায়। আমার ক্লজিটের পেছনদিকে আলগা এক প্যানেল আছে। ওটা দেয়াল থেকে হড়কে খুলে বইটা লুকিয়ে রাখলাম।
ওটা অন্তত আর কোন ঝামেলা পাকাবে না, নিজেকে বললাম।
প্যানেলটা যথাস্থানে বসালাম। এবার উল্টো ঘুরলাম ক্লজিট ত্যাগের জন্য।
এসময় মেঝেতে পড়ে থাকা কিছু একটা দৃষ্টি কাড়ল। হলদে- সবুজ এক দীপ্তি।
ঝুঁকে পড়ে তুলে নিলাম ওটা। ক’মুহূর্ত লাগল জিনিসটা চিনতে। হররল্যাণ্ড হররের খুদে এক মূর্তি। আমার বইয়ের মোড়কে যেটা জুড়ে দিয়েছিল গিফ্ট্ শপের সেই বুড়ো।
মূর্তিটা আমার হাতে জ্বলজ্বল করছে এবং তাপ ছড়াচ্ছে।
একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছি, আভাটা ছড়িয়ে পড়তে লাগল। আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠে ভুতুড়ে আলোয় ভরিয়ে তুলল ক্লজিটের ভেতরটা। হররটাকে ফেলে দিতে চাইলাম, কিন্তু আমার হাত আঁকড়ে ধরে রইল ওটা।
এবং টের পেলাম জিনিসটা টানছে আমাকে…টানছে আলোর মধ্যে…হলদে-সবুজ গাঢ় দীপ্তিটার ভেতরে।
এসময় হুশ করে এক শব্দ হলো। শরীরে দমকা বাতাসের জোর ধাক্কা অনুভব করলাম।
ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছি, চোখ পিটপিট করছি, পা কাঁপছে। আমি আবার ফিরে এসেছি সেই বৃদ্ধের গিফ্ট শপটিতে। চিলার হাউস। হররল্যাণ্ড।
নাকের ডগায় মান্ধাতা আমলের চারকোনা চশমাটা নিয়ে, সেকেলে সুট পরা লোকটা দাঁড়িয়ে রয়েছে কাউন্টারের পেছনে।
আমার উদ্দেশে দাঁত কেলিয়ে হাসল সে। জন চিলার। নামটা মনে পড়ল। সোনায় বাঁধানো এক দাঁত ঝিকিয়ে উঠল
‘স্বাগতম, কিশোর,’ খসখসে কণ্ঠে বলল লোকটা। ‘এখন উপহারের দাম চুকানোর পালা।’
.
দাম মিটিয়ে দিতেই আমার কামরায় খুঁজে পেলাম নিজেকে। যেভাবে ভোজবাজির মত গিয়েছিলাম হররল্যাণ্ডে, সেভাবেই আবার ফিরে এসেছি-অলৌকিক কোন উপায়ে।
***