এক
কার্নিভাল গেম বুথগুলোৱ সামনে থামলাম আমরা তিনজন-মুসা, রবিন আর আমি। সবুজ-বেগুনী বিশাল সাইনটা পড়লাম: দ্য প্লে পেন। হারজিৎ বড় কথা নয়, প্রাণভরে আর্তনাদ করো!
হাতজোড়া ঘষলাম আমি।
‘দেখে মনে হচ্ছে খেলাগুলো হেভি,’ বললাম। ‘আমরা হয়তো কটা পুরস্কারও জিতে যেতে পারি।’
রবিন মাথাটা পেছনে ঝাড়া মারল।
‘ছোটবেলায় এক কার্নিভালে আমি এক গোল্ডফিশ জিতেছিলাম,’ বলল। ‘পানিভরা এক প্লাস্টিকের ব্যাগের ভেতর ছিল ওটা। একদম বাজে অভিজ্ঞতা।’
মুসা চোখ পিটপিট করে চাইল ওর দিকে।
‘খাইছে, বাজে অভিজ্ঞতা?’
মাথা ঝাঁকাল রবিন।
‘বলছি। বাসায় নেয়ার পর, ব্যাগটা ছিঁড়ে যায়। সব পানি আর গোল্ডফিশটা মেঝেতে পড়ে যায়, আর আমাদের কুকুরটা মাছটাকে কপ করে খেয়ে ফেলে। সে কী কান্না আমার!’
‘তারমানে কাঁদুনে বাচ্চা ছিলে তুমি,’ বললাম।
‘মোটেই না!’ জোরে ধাক্কা দিল ও আমাকে, এবং আমি হুমড়ি
খেয়ে পড়লাম প্লে পেন সাইনটার ওপরে।
মূর্তিমান আতঙ্ক
কাঁধ ডললাম।
‘বাপ রে, এত জোর তোমার গায়ে?!’ বলে উঠলাম অস্ফুটে।
রাশেদ চাচা আর মেরী চাচী আমাদেরকে হররল্যাণ্ডে বেড়াতে নিয়ে এসেছে। প্রথম দিনের পরে, আমাদেরকে একা ঘুরে বেড়ানোর অনুমতি দিয়েছে। জায়গাটা খারাপ নয়। ভয়ের জিনিসগুলো পছন্দ রবিনের। আমার আর মুসার ভাল লাগে সুপারহিরোদের। ডক্টর শার্ক-টুথ, কয়োটি বয়-এক্স, এবং দ্য উ আমার সবচেয়ে প্রিয়।
হঠাৎই আমার বাহু ধরে হ্যাঁচকা টান মারল রবিন।
‘কিশোর, রাইডে চড়ি চলো। মুসা, এসো।’
‘না, আমি কার্নিভাল গেমগুলো খেলব,’ বললাম। ‘প্রাইয জিততে চাই। ডনকে কথা দিয়েছি ওর জন্যে উপহার নিয়ে যাব। বেচারা ঠাণ্ডা বাধানোয় আসতে পারেনি, বাসায় রয়ে গেছে ওর নানীর কাছে।’
‘ডনের আমাদের সাথে আসার খুব ইচ্ছে ছিল,’ বলল মুসা। ‘অনেক জেদ করছিল।
‘মাঝে-মাঝে সাঙ্ঘাতিক জেদ চেপে যায় ওর,’ বললাম আমি।
হেসে ফেলল রবিন।
‘এমনিতে কিন্তু ও খুবই শান্ত-শিষ্ট ছেলে।’
‘হ্যাঁ, তাতে কোন সন্দেহ নেই,’ সায় জানিয়ে বলল মুসা।
হঠাৎ কী ভেবে ঘুরে দাঁড়ালাম আমি। দেখলাম এক আইসক্রিম কার্টের পেছন থেকে এক হরর হাত নাড়ছে আমার উদ্দেশে। এখানকার সব কটা হরর বিশালদেহী, রোমশ, সবুজ- বেগুনী চরিত্র। এরা গাইড এবং হেল্পার, হররল্যাণ্ডে চাকরি করে।
‘আমাদের আজকের স্পেশাল ফ্লেভারটা চেখেছ?’ হররটা হেঁকে বলল।
‘কী ফ্লেভার?’ প্রশ্ন করলাম।
‘কুকিয অ্যান’ কাউ ব্রেইন্স্,’ জবাব দিল ও। একটা খালি কোন বাড়িয়ে দিল। ‘আমার কাছে চকোলেট চিপ টয়লেট বোল ক্লিনারও আছে।’
‘ওহ…না, ধন্যবাদ,’ গুঙিয়ে উঠে বললাম।
স্বচ্ছ, শীতল রাত আজ। আকাশে নিচু হয়ে ঝুলে রয়েছে এক ফালি রুপোলী চাঁদ। গেম বুথগুলো ঘিরে জনতার ভিড়। একটা বেলুন ফাটার শব্দ পেলাম। ক’মুহূর্ত পরে, একটা বাচ্চা কাঁদতে লাগল।
গেমগুলোর দীর্ঘ সারির ওপ্রান্ত থেকে, কর্কশ কণ্ঠে চেঁচাচ্ছে এক হরর, ‘হারু পার্টি কে? আসুন-ভাগ্য পরীক্ষা করুন। এরপর কে হারতে চান?
প্রথম গেম বুথটার দিকে এগিয়ে গেলাম। স্কাল টস নাম ওটার।
বেগুনী ওভারল পরা প্রকাণ্ডদেহী এক হরর ঝুঁকে রয়েছে কাউন্টারের ওপর। তার পেছনে বিকট হাসি নিয়ে মানুষের খুলির পাহাড়। কাউন্টারের ওপর দিয়ে আমার উদ্দেশে তিনটে চোখের মণি ঠেলে দিল ও। ওগুলো আসলে পিংপং বল, চোখের মণির রূপ দেয়া হয়েছে রঙ করে।
কাউন্টারের কাছে এসে দাঁড়াল মুসা আর রবিন।
‘খেলাটা কী জানতে পারি?’ হররটিকে প্রশ্ন করল রবিন।
‘চোখের শূন্য কোটরে একটা মণি ছুঁড়তে হবে,’ ঘাউ করে উঠল লোকটা। ‘মণিটা আটকে গেলে এমন অসাধারণ এক পুরস্কার জিতবে, জীবনেও ভুলবে না। এক ডলারে তিনটে মণি।’
‘খাইছে, অসাধারণ পুরস্কার?’ জিজ্ঞেস করল মুসা।
‘ওটা মিথ্যে বলেছি,’ জানাল হররটা। ‘খেলবে?’ মণিগুলো ঠুকছে কাউন্টারে।
‘আমরা তিনজনই খেলব,’ বললাম।
পকেট থেকে তিন ডলার বের করলাম। টাকাগুলো তুলে দেব হররটার হাতে, এসময় মুসা বলল, ‘তোমরা খেলো, আমি দেখি।’
অগত্যা এক ডলার রেখে দিলাম পকেটে।
রবিনের ছোঁড়া প্রথম বলটা ঠক করে এক খুলির কপালে লেগে ছিটকে পড়ল। দ্বিতীয়টা নাকের খোলা গর্তে বাড়ি খেয়ে ঠিকরে গেল একদিকে। তৃতীয়বার ছুঁড়তেই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে বুথের পেছনের ক্যানভাসে গিয়ে লাগল বলটা।
‘হেরে গেছ,’ বলল হরর।
আমি একটা পিংপং বল তুলে নিলাম, তারপর হাতটা পিছিয়ে এনে ছুঁড়লাম।
‘হ্যাঁ!’ চিৎকার ছাড়লাম। শূন্য এক অক্ষিকোটরে এঁটে বসে গেছে বলটা।
পরমুহূর্তে, মুখ হাঁ করে রক্ত হিম করা গর্জন ছাড়ল মড়ার খুলিটা!
অবাক হয়ে দেখছি। সব কটা মড়ার খুলি নড়তে আরম্ভ করেছে। পিলে চমকানো খটাখট শব্দে বাড়ি খাচ্ছে ওদের চোয়াল। হু! হুউউউ! মুখ দিয়ে সশব্দে বেরিয়ে আসছে শ্বাস। আচমকা বাতাস ভরে উঠল কটু গন্ধে।
হররটা আর্তচিৎকার ছেড়ে টলমল পায়ে পিছিয়ে গেল। আতঙ্কে বিস্ফারিত ওর চোখজোড়া।
‘না! ওহ, না!’ হাহাকার করে উঠল। ‘না! তুমি মড়াদের জাগিয়ে দিয়েছ!’
দুই
মুসা, রবিন আর আমি নড়ারও সময় পেলাম না। আমার কবজি চেপে ধরল হররটা।
‘এটা কী করলে তুমি?’ গর্জন ছাড়ল। ‘এটা কী করলে?’
পরক্ষণে ফেটে পড়ল হাসিতে। খুলিগুলো একসঙ্গে চোয়াল খটখটানো থামাল।
‘একটু মজা করলাম আরকী,’ বলল হররটা। আমার কবজি ছেড়ে দিল।
‘জানতাম,’ বললাম। তবে বুকের মধ্যে ঠিকই ধুকপুক করছে।
‘খাইছে,’ বলল মুসা। ‘কিশোর কি কোন পুরস্কার জিতেছে?’ কাউন্টারের নিচে হাত ঢোকাল হররটা। ওখান থেকে বের করে ধূসর, লোমশ কী একটা দিল আমাকে। মরা শুঁয়োপোকার মত দেখাচ্ছে ওটাকে।
‘এনজয় করো!’ বলল।
খুঁটিয়ে দেখতে তুলে ধরলাম ওটা।
‘কী এটা?’ প্রশ্ন করলাম।
‘মরা পিরানহা মাছ,’ বলল। ‘সাবধান। কামড়ায় কিন্তু!’
‘লোকটা একটা আস্ত পাগল,’ শ্বাসের নিচে আওড়াল রবিন। আমরা ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটা দিলাম। ‘ওটা ডনকে দিয়ো না। জঘন্য একটা জিনিস।’
বড়সড় এক ট্র্যাশ ক্যানে ছুঁড়ে ফেললাম ওটাকে। কিছু লোম লেগে রইল আমার আঙুলে। চারপাশে চোখ বোলালাম। ‘এরপর কী খেলব আমরা?’ জানতে চাইলাম।
রবিন রাস্তার ওপাশে এক ভিড়ে ভিড়াক্কার বুথ দেখাল তর্জনী তাক করে।
‘যম্বি ডার্টস হলে কেমন হয়?’
কাছিয়ে গেলাম আমরা। বুথের পেছনে ক’জন নীলমুখো নারী-পুরুষকে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে টলতে-টলতে চলাফেরা করতে দেখলাম। মানুষজন তাদের উদ্দেশে ডার্ট ছুঁড়লে ককিয়ে, গুঙিয়ে উঠছে জিন্দালাশগুলো।
‘একদম সোজা,’ বলল মুসা। ‘হয়তো- ‘
আচমকাই যেন মাটি ফুঁড়ে এক লোক উদয় হলো আমাদের সামনে। আরেকটু হলেই আমি সোজা ধাক্কা খেতাম তার গায়ে! দীর্ঘদেহী, দশাসই চেহারার লোকটির গোল মুখে পুরু কালো গোঁফ।
তার মাথার লম্বা লাল ক্যাপটিতে লেখা: জেতার জন্য খেলো। লোকটার শার্টের সামনের দিক জুড়ে টিক-ট্যাক-টো গেমস শব্দগুলো হেলাফেলায় লেখা। তার পরনে চেকারবোর্ড ভেস্ট। বেল্টটা তাসের তৈরি।
আমাদের ওপর ঝুঁকে পড়ে ফিসফিসে স্বরে কথা বলল লোকটা।
‘ভাল কিছু খেলতে চাও?’
‘মানে?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।
‘ওগুলো তো সব বাচ্চাদের খেলা,’ বলল লোকটা। জ্বলে উঠল কালো চোখের তারা। তিরতির করে কাঁপছে পেল্লায় গোঁফজোড়া। ‘সত্যিকারের খেলা খেলবে? উত্তেজনার খোরাক চাও না তোমরা?
‘ওরা কি ভাল কোন পুরস্কার দেবে?’ মোক্ষম প্রশ্নটা করল রবিন।
মাথা ঝাঁকাল লোকটা।
‘ভাল খেলা। ভাল পুরস্কার,’ বলল। উত্তেজিত দেখাচ্ছে তাকে। এমনভাবে চারপাশে চোখ বোলাচ্ছে যেন অনুসরণ করা হচ্ছে ওকে। লোকটার কপালে বিনবিনে ঘাম ফুটে উঠেছে দেখলাম।
‘কে আপনি?’ প্রশ্ন করলাম।
প্লেইং-কার্ড বেল্টটা ঠিকঠাক করে নিল সে।
‘আমার নাম উইনার। উইনার টেইকল। আমি গেম মাস্টার। চলো, তোমাদেরকে যেখানে ভাল খেলা আছে সেখানে নিয়ে যাই।’
মুসা আর রবিনের দিকে চাইলাম।
‘যাবে?’
শ্রাগ করল রবিন। মুসাও আপত্তি করল না।
‘ওখানে সবাই জেতে-কেউ হারে না…বেশি একটা!’ চেঁচিয়ে উঠল উইনার। ‘মনে রেখো, বিজয়ী কখনও হাল ছাড়ে না, আর যে হাল ছেড়ে দেয় সে টেকে না!’
টেকে না মানে?
‘খাইছে, আপনি ঠাট্টা করছেন, তাই না?’ মুসা জিজ্ঞেস করল লোকটাকে।
‘অবশ্যই ঠাট্টা করছি, জবাব দিল সে। ‘আমার সাথে এসো।’ হাঁটার সময় দুলছে লোকটার উপচে পড়া ভুঁড়ি। বারবার চকিতে পিছু চেয়ে দেখে নিচ্ছে আমরা তাকে অনুসরণ করছি কিনা।
আমাদেরকে পেছনে নিয়ে ইঁটের দেয়াল বরাবর হেঁটে, পৌঁছে গেল কার্নিভাল গেমসের পেছনদিকে। এবার আমরা ওকে অনুগমন করে দেয়াল কেটে বসানো ছোট্ট এক কালো দরজার কাছে চলে এলাম। দরজাটা নিচু, ফলে আমাদেরকে মাথা নুইয়ে ভেতরে ঢুকতে হলো।
লম্বা, স্বল্পালোকিত এক সুড়ঙ্গ ধরে এগোচ্ছি, মেটে মেঝেতে খসখস শব্দ করছে আমাদের জুতো। বাতাস ক্রমেই শীতল হয়ে উঠছে। সুড়ঙ্গটা এবার ঢালু হয়ে নেমে গেল। লোকটা কি আমাদেরকে মাটির তলায় নিয়ে যাচ্ছে নাকি?
‘কোথায় যাচ্ছি আমরা?’ প্রশ্ন করলাম। ফাঁপা শোনাল আমার কণ্ঠস্বর। সুড়ঙ্গের দেয়ালে দেয়ালে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হলো কথাগুলো।
‘আমার স্পেশাল গেম রুমে,’ উইনার জবাব দিল। ‘তোমরা হারতে পারো না! কারণ আমার নাম উইনার!’
সরু হয়ে এল সুড়ঙ্গটা। লোকটাকে বারবার কাত হয়ে শরীর গলাতে হচ্ছে।
আমাদের উদ্দেশে হাসার সময় গোঁফজোড়া নেচে উঠল তার। ‘আমি সব ধরনের খেলা ভালবাসি,’ জানাল। ‘এমনকী বিপজ্জনক খেলাও। তোমরা?’
বিপজ্জনক খেলা?
রবিন আমার হাত চেপে ধরল।
‘ব্যাপারটা আমার ভাল্লাগছে না,’ ফিসফিস করে বলল। ‘আমরা বড় কোন ভুল করছি না তো?’
তিন
বিশালকায় লোকটির পিছু নিয়ে সুড়ঙ্গ ছেড়ে বেরিয়ে এলাম আমরা। উজ্জ্বল, হলদে আলোর বন্যা ভাসিয়ে দিল আমাদেরকে।
পিটপিট করে চোখ সইয়ে নিতে চেষ্টা করলাম। বড়সড় চারকোনা এক কামরায় দাঁড়িয়ে এখন আমরা। গেম বোর্ড দিয়ে ঢাকা দেয়ালগুলো।
লাল পর্দা ঘেরা পেছনের এক ঘরের দিকে আমাদেরকে নিয়ে চলল লোকটা।
‘এটা আমার ব্যক্তিগত গেম রুম,’ বলল উইনার। ‘কথা দিচ্ছি রোমাঞ্চকর সময় কাটবে তোমাদের। আর হ্যাঁ, আমার প্রাইযগুলো কিন্তু ওই প্লে পেন প্রাইয়ের চেয়ে অনেক ভাল।’
এবার হাসি মুছে গেল তার।
‘তার কারণ তোমাদেরকে ওগুলো আদায় করে নিতে হবে!’ চমকে উঠলাম। লোকটা আসলে কী বোঝাতে চাইছে? এই গেম রুমে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই কেন?
রবিনের দিকে চাইলাম। তারপর মুসার উদ্দেশে। ওরা উদ্বিগ্ন কিনা বুঝলাম না। ভয় কিংবা উত্তেজনার চিহ্নমাত্র নেই ওদের মধ্যে।
‘কী গেম খেলছি আমরা?’ উইনারকে জিজ্ঞেস করল রবিন। ‘রহস্যময় টাগ-অভ-ওয়র,’ বলল লোকটি। পর্দা সরিয়ে নিচু হলো, ওপাশে কী যেন খুঁজছে।
‘খাইছে, রহস্যময় কেন?’ মুসার প্রশ্ন।
চাপা হাসল লোকটা।
‘বলে দিলে তো আর রহস্য থাকল না-তাই না?’
এবার লাল পর্দার আড়াল থেকে মোটা এক রশি টেনে বের করল। শক্তভাবে কুণ্ডলী পাকানো ওটা। পাক খুলতে শুরু করল ওটার।
‘দারুণ রোমাঞ্চকর এক টাগ-অভ-ওয়র গেম হতে চলেছে এটা!’ ঘোষণা করল সে। দড়ির শেষ মাথাটা বাড়িয়ে দিল। ‘নাও, ধরো।’
দড়িটা নিজের দিকে টানলাম আমি। রবিন, মুসা আর আমি প্রান্তটা আঁকড়ে ধরেছি।
‘খেলার নিয়ম বাতলানোর দরকার পড়ে না,’ বলল উইনার। দড়িটা খুলে চলেছে। ‘সর্বশক্তিতে টানবে। দড়িটা নিজের দিকে টানবে-তাহলে আর হারার ভয় নেই!’
‘আমরা কার সাথে খেলছি?’ প্রশ্ন করলাম।
জবাব দিল না উইনার। দড়ির অপর প্রান্ত হাতে নিয়ে উধাও হলো পর্দার ওপাশে।
‘খাইছে, কী আজব কাজ-কারবার!’ বিড়বিড় করল মুসা।
‘এর নাম হররল্যাণ্ড,’ বললাম। ‘আজব কাণ্ডকারখানাই তো স্বাভাবিক এখানে। এবং সে সঙ্গে খানিকটা ভুতুড়ে।’
‘আমাদের জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল প্রাইযটা কী?’ বলল রবিন।
‘রোল দ্য ডাইস!’ পর্দার ওপ্রান্ত থেকে চেঁচিয়ে উঠল উইনার। ‘স্পিন দ্য হুইল! পুশ স্টার্ট। গেম অন! গেম অন! গেম অন! খেলার জন্যে তৈরি হয়ে যাও!’
মুসা আমাদের সামনে চলে এসে কবজিতে জড়িয়ে নিল দড়ির, প্রান্তভাগ। রবিন আর আমি দু’হাতে রশিটা ধরে তৈরি হলাম। হাঁটু ভাঁজ করে, পায়ের মাংসপেশী শক্ত করে টানার জন্য প্রস্তুত।
‘ওকে…স্টার্ট!’ চেঁচাল উইনার।
দড়িটাতে জোরাল টান টের পেলাম। আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে পাল্টা টানলাম।
‘অ্যাই!’ রশিটা হাত থেকে ফস্কে গেলে চিৎকার ছাড়ল মুসা। আবারও ওটা চেপে ধরে হেলে পড়ল পেছনদিকে। তিনজনে প্রাণপণে টানছি।
চিতিয়ে পড়ে যাওয়ার জোগাড়, সমানে টেনে চলেছি আমরা। রশিটা আমাদের দিকে চলে আসছে। এবার জোর ঝাঁকিতে ছিটকে গেল।
লাল পর্দাটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলাম আমি। ওপাশে কে? কার বিরুদ্ধে খেলছি আমরা তিনজন?
নিঃসন্দেহে খুব শক্তিশালী কোন প্রতিপক্ষ, সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম। আমাদেরকে টেনে সামনে নিয়ে যাচ্ছে। ইঞ্চি-ইঞ্চি করে পর্দাটার দিকে এগিয়ে চলেছি আমরা।
‘জোরে! জোরে!’ চেঁচাল মুসা।
‘জোরেই তো টানছি!’ পাল্টা চিৎকার ছাড়লাম। মেঝেতে পুরোদমে জুতোর ভার চাপিয়ে হেলে পড়লাম পেছনদিকে। টানছি। গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে।
‘আউ!’ রশিতে জোর ঝাঁকুনির ফলে হাতের তালুজোড়ার চামড়া পুড়ে যাচ্ছে।
মুসা, রবিন আর আমি সামনের দিকে হুমড়ি খেলাম। আরেকটা হ্যাঁচকা টান, এবং আমরা প্রায় পৌঁছে গেলাম পর্দার কাছে।
‘খাইছে, আমরা হেরে যাচ্ছি!’ চেঁচাল মুসা। ‘তোমরা আরও জোরে টানো!’
কিন্তু ইতোমধ্যে পর্দাটা হড়কে সরে যেতেই আর্তচিৎকার ছাড়লাম আমরা তিনজন। দেখতে পেলাম কার বিপক্ষে খেলছি।
কারও না!
দড়ির ওপ্রান্তে কেউ নেই!
আরেকটা জোরাল টানে ঝাঁকুনি খেয়ে সামনে বাড়লাম আমরা।
‘টানতে থাকো! ছেড়ো না! টানো!’ আমাদের পেছনে কোথাও থেকে গর্জাল উইনার।
‘কিন্তু ওখানে তো কেউ নেই!’ আমি পাল্টা চেঁচিয়ে উঠলাম তারস্বরে।
বাতাসে ভাসছে ওদিকের রশির প্রান্তটা। প্রতিপক্ষ আমাদের অদৃশ্য!
কিন্তু এ তো অসম্ভব। তাই না?
খোলা পর্দা দিয়ে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আমাদেরকে। হারতে বসেছি আমরা এই খেপাটে দড়ি টানাটানি খেলায়।
দু’হাত জ্বলে যাচ্ছে আমার। বাহুজোড়া টনটন করছে। ধড়াস-ধড়াস করে লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ড।
‘হাল ছেড়ো না!’ উইনার হুঙ্কার দিল।
‘ওকে, ওকে। শেষ চেষ্টা,’ বিড়বিড় করে বন্ধুদের উদ্দেশে বললাম। শ্বাসের ফাঁকে ফিসফিসে স্বর ফুটল, ‘তিন টান, ঠিক আছে?’
মেঝেতে আরও চেপে বসল আমার জুতোজোড়া। আরও শক্ত করে আঁকড়ালাম রশিটা।
‘এক…দুই…’
কিন্তু তিন পর্যন্ত বলার সুযোগ আর পেলাম না।
কারণ দড়িটা কিলবিল করে উঠল আমার হাতের মধ্যে। অন্যরকম এক অনুভূতি টের পাচ্ছি। আচমকা মসৃণ, মোলায়েম স্পর্শ ছড়িয়ে পড়ল আমার হাতের পোড়া জায়গাগুলোতে। মসৃণ আর শুকনো।
দড়িটা পাল্টে গেছে।
উষ্ণ, শুকনো আর কোমল এখন ওটা।
দেখলাম কালো একজোড়া চোখ নির্নিমেষে চেয়ে রয়েছে আমার দিকে। সরু এক চোয়াল বারবার হাঁ আর বন্ধ হচ্ছে।
কানে বাজল মৃদু হিসহিস শব্দ।
সাপ! আমি একটা সাপ ধরে আছি! আমার হাতজোড়া ওটার মাথাটাকে মুড়ে রেখেছে!
ছ’ফিট লম্বা এক সাপ ধরে টানছি আমি, ওটার চোয়াল হিসহিস শব্দ করে খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে।
তীব্র আতঙ্কে আর যন্ত্রণায় আর্তচিৎকার ছাড়লাম, ওটা যেই আমার কবজিতে দাঁত বসিয়ে দিল।
চার
আমরা তিনজন টলমল পায়ে পিছিয়ে এলাম। বিশাল সাপটা সড়াৎ করে পিছলে চলে গেল আমাদের হাত থেকে। থপাস করে মেঝেতে পড়ে কিলবিলিয়ে ছুটল পর্দা অভিমুখে।
কবজি চেপে ধরে মুখের কাছে তুললাম।
‘ওহহ।’ চামড়ায় দুটো গোল, লাল দাঁতের চিহ্ন ফুটে রয়েছে। আচমকা মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। মনে হলো জ্ঞান হারাব বুঝি।
চরকির মত ঘুরে দাঁড়ালাম, উইনারকে খুঁজছি।
‘এটা কোন্ ধরনের খেলা?’ চিৎকার করে বললাম। ‘সাপটা-আমাকে কামড়ে দিয়েছে! ওটা কি বিষাক্ত? কথা বলছেন না কেন?’
ওর ছায়ামাত্র নেই।
কবজিটা আবারও পরখ করলাম।
‘আরি-একী!’ দাঁতের দাগ উধাও। স্রেফ মিলিয়ে গেছে।
সাপটা কি নকল কোন কিছু ছিল? পুরোটাই কি কোন ট্রিক? যে কৌশলে রশি হয়ে যায় সাপ!
‘চ-চলো,’ তুতলে বলল মুসা। ‘চলে যাই এখান থেকে।’
আমরা তিনজন উল্টো ঘুরলাম। দোরগোড়ায়, আমাদের পেছনে দাঁড়িয়ে উইনার। গোঁফের নিচে সন্তুষ্টির হাসি তার। গটগট করে চলে এল আমাদের কাছে।
সাপটার দিকে আঙুল দেখালাম।
‘কাজটা করলেন কীভাবে?’ চেঁচিয়ে উঠলাম।
‘দড়িটা টানছিল কে?’ প্রশ্ন ছুঁড়ল রবিন।
‘খাইছে, ওটাকে সাপ বানালেন কীভাবে?’ মুসা বলল।
‘ওটা কি সত্যিই জ্যান্ত?’
প্রশ্নবাণে জর্জরিত করলাম ওকে।
উইনার দু’হাতের ইশারায় থামাতে চাইল আমাদেরকে।
‘খেলাটা কীভাবে খেলতে হয় জানা উচিত ছিল তোমাদের, ‘ বলল। ‘সরি, তোমরা হেরে গেলে।’
‘কিন্তু-জিতব কীভাবে?’ চেঁচিয়ে উঠলাম। ‘আমাদের প্রতিপক্ষ তো অদৃশ্য ছিল! আর দড়িটা হয়ে গেল বিরাট এক সাপ!’
উইনার চোখ সরু করে চাইল আমার দিকে।
‘খেলাটায় তোমরা সমান সুযোগ পাওনি বলছ? লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ছিল না বলতে চাইছ?’
‘তা বলিনি তো,’ জবাব দিলাম। ‘বলতে চেয়েছি—’
‘তো…আমরা কিছু জিতিনি, তাই তো?’ বলল রবিন।
‘প্রতিটা খেলোয়াড়ই একজন বিজেতা!’ বলার সময় গলা চড়ে গেল লোকটার। ‘সব বিজয়ীই খেলোয়াড়! যে পরাজিত সে-ও বিজয়ী! এবং প্রতিটা পুরস্কারই যোগ্য পুরস্কার!’
‘আস্ত পাগল একটা!’ ফিসফিস করে বললাম।
‘খাইছে, আমরা কিছু জিতেছি নাকি জিতিনি সেটা ‘বলুন!’ মুসা হাল ছাড়ার পাত্র নয়।
চেকারবোর্ড ভেস্টের পকেটে হাত ভরল উইনার।
‘তোমাদের জন্যে একটা সান্ত্বনা পুরস্কার আছে,’ বলল। চারকোনা, ছোট্ট এক কাগজ বের করে ধরিয়ে দিল আমার হাতে।
ভাঁজ খুলে সবুজ পটভূমির বিপরীতে কালো অক্ষরগুলো পড়লাম। ওতে লেখা:
১০% ডিসকাউন্ট কুপন
চিলার হাউসে যে কোন জিনিসের জন্য
‘খেল খতম,’ বলল উইনার। সুড়ঙ্গমুখের দিকে হাত নাড়ল মাছি তাড়াবার ভঙ্গিতে। ‘তিন স্ট্রাইক এবং তোমরা আউট।’ আমার সামনে এসে মুখটা নিয়ে এল আমার মুখের কাছে। ‘যদি না সাডেন-ডেথ ওভারটাইম চাও!’
..পিছিয়ে গেলাম। ‘সাডেন ডেথ? ওহ… না, ধন্যবাদ। আমরা এখুনি চলে যাচ্ছি।’
আমরা সুড়ঙ্গ ধরে পা চালালাম। চকিতে পেছনে চেয়ে দেখি মেঝে থেকে সাপটা তুলে নিচ্ছে উইনার। হাতে পেঁচাচ্ছে ওটাকে। ওটা কি আবারও দড়ি হয়ে গেছে? গোটা বিষয়টা কি কোন ধরনের ভেলকিবাজি?
রবিন আমার হাত ধরে টানল।
‘এসো, এখান থেকে বেরিয়ে যাই।’
আঁকাবাঁকা, ঠাণ্ডা সুড়ঙ্গটা ভেদ করে পথ চলেছি তিন বন্ধু। খাড়া চড়াই বেয়ে উঠতে হচ্ছে এদিকটাতে। ছোট কালো দরজাটা দিয়ে বেরিয়ে যখন পার্কে ফিরলাম ততক্ষণে হা-ক্লান্ত হয়ে পড়েছি আমরা।
ইঁটের দেয়াল ঘেঁষে হাঁটছি তিনজনে। প্লে পেন গেম বুথগুলো যথারীতি ভিড়ে ঠাসা
‘খাইছে, এরপর কী খেলতে চাও?’ বলল মুসা। মনে হলো ঠাট্টা করছে বুঝি।
‘আজকের মত অনেক হয়েছে,’ বললাম। সুড়ঙ্গটার দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম। ‘আরি-দেখো!’ বন্ধুরাও চকিতে উল্টো ঘুরল আমার দেখাদেখি।
‘খাইছে, কী দেখব?’ বলল মুসা।
‘কালো দরজাটা,’ বললাম। ‘ওটা নেই। দেখেছ?’
দেয়ালের কাছে দৌড়ে গেলাম আমরা, দরজাটা যেখানে ছিল। হাত বোলালাম ওটার গায়ে।
নিরেট ইঁট।
কমলা-কালো মনস্টার পুলিস ইউনিফর্ম পরা এক ঢ্যাঙা হরর লম্বা-লম্বা পা ফেলে আমাদের পাশ কাটাচ্ছিল। ওর কমলা আলখিল্লা পতপত করে উড়ছে পেছনে।
ওর বাহু আঁকড়ে ধরল রবিন।
‘আপনি কি আমাদেরকে সাহায্য করতে পারেন?’
কালো ক্যাপটা পেছনে কাত করল হররটা। বেরিয়ে পড়ল ওর মাথায় গজানো ছোট-ছোট খোদাই করা শিং।
‘কী চাই?’ ঘাউ করে উঠল লোকটা।
‘মানে…’ শুরু করল রবিন, ‘আমরা একটু আগেই গেম মাস্টারের সাথে ওখানে ছিলাম, কিন্তু…’
দু’আঙুলে একটা শিং ঘষল লোকটা। ‘কে?’
‘ওই যে, উইনার টেইকল,’ বলল মুসা, ‘গেম মাস্টার।’ হাসিতে ফেটে পড়ল হররটা।
‘উইনার টেইক অল? মজার তো!’
‘না, সত্যি,’ জোর দিয়ে বলল রবিন
দীর্ঘদেহী হরর চোখ পিটপিট করে ওর দিকে দৃষ্টি নামিয়ে চাইল।
‘কেউ তোমাদের সাথে তামাশা করেছে,’ রীতিমত গর্জে উঠল। ‘হররল্যাণ্ডে কোন গেম মাস্টার নেই।’