মুখ বন্ধ
খুব সোজা করিয়া বলিতে গেলে নন-কো-অপারেশন হইতেছে বিছুটি বা আলকুশি, এবং আমলাতন্ত্র হইতেছেন ছাগল! ছাগলের গায়ে বিছুটি লাগিলে যেমন দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হইয়া ছুটাছুটি করিতে থাকে, এই আমলাতন্ত্রও তেমন অসহযোগিতা-বিছুটির জ্বালায় বে-সামাল হইয়া ছুটাছুটি আরম্ভ করিয়া দিয়াছেন। কিছুতেই যখন জ্বলন ঠাণ্ডা হয় না, তখন ছাগ বেচারি জলে গিয়ে লাফাইয়া পড়ে, দেয়ালে গা ঘষিতে থাকে, কিন্তু তাহাতে জ্বালা না কমিয়া আরও বাড়িতেই থাকে, উলটো ঘষাঘষির চোটে তাহার চামড়াটি দিব্যি ক্ষৌরকর্ম করার মতোই লোমশূন্য হইয়া যায়। আমলাতন্ত্রের গায়েও বিছুটি লাগিয়াছে এবং তাই তিনি কখনও জলে নামিতেছেন, কখনও ডাঙায় ছুটিতেছেন, আর কখনও বা দেয়ালে গা ঘেঁসড়াইয়া খামকা নিজেরই নুনছাল তুলিতেছেন! তবু কিন্তু জ্বলন আর থামিতেছে না, বরং ক্রমেই বাড়িতেছে। এখন এই আমলাতন্ত্রের ল্যাজের ডগা হইতে মাথার চুল পর্যন্ত সমস্ত কিছুই এত অস্বাভাবিক রকমের বিপর্যস্ত হইয়া গিয়াছে যে, তাহা দেখিলে হাসিও পায়, কান্নাও আসে। ইহা যেন বহরমপুর বা কসৌলি প্রেরণের পূর্ব লক্ষণ। একটা গান আছে, ‘ও যার কপালে আগুন ধরে, তার নাইকো কোথাও সুখ, ব্রহ্মাণ্ড বিমুখ, দুখের উপর দুখ দাও তারে।’ বাস্তবিক এখন এই রাজতন্ত্র ওরফে আমলাতন্ত্র মশাই-এর ‘অমিয়া সাগরে সিনান করিতে সকলি গরল ভেল!’ কেননা অদৃষ্টের ফেরে যাহা কিছু ভালো বুঝিয়া করিতে যাইতেছেন, তাহাই মন্দ হইয়া পড়িতেছে। কিন্তু আমরা বলি কী, এ-সমস্ত নিজেরই কর্মদোষ। কেহ যদি ইচ্ছা করিয়া গা চুলকাইয়া আলকুশি লাগায়, তাহার জন্য দায়ী সে নিজে। – দেশের লোক এখন তাহাদের ঘরের অবস্থা সাদাচোখে স্পষ্ট করিয়া দেখিতে পাইয়াছে। ঘরে যে সিঁদেলচোর ঢুকিয়াছে, এতদিনে তাহারা তাহা টের পাইয়া চোরের টুঁটি টিপিয়া ধরিয়াছে। এখন তাহার অপহৃত জিনিস ছাড়িয়া না দিলে সে কিছুতেই আর টুঁটি ছাড়িবে না। চোরে গৃহস্থে দস্তুর মতো এখন এই ধস্তাধস্তি চলিতেছে। তবে চোরের সুবিধাটা এই যে, সে বেশি জোরালো, তার হাতে হাতিয়ারও আছে, আর গৃহস্থ বেচারা একেবারে নিরস্ত্র। কিন্তু তাই বলিয়া কেহ তো প্রাণ থাকিতে ঘরের জিনিস পরকে লইয়া যাইতে দিবে না। যাক সেসব কথা। আমরা বলিতেছিলাম, এই আমলা বাবাজিরা এমন করিয়া আর কতদিন ছেলেমানুষি দেখাইবেন? তাঁহারা যেসব বুদ্ধির পরিচয় দিতেছেন, তাহার সকলগুলির পরিচয় দিতে হইলে একটি সপ্তকাণ্ড ‘আমলায়ন’ লিখিতে হয়। তবে সবচেয়ে ঝাঁজালো বুদ্ধিটা দেখাইতেছেন তাঁহারা, যাহার-তাহার যে-কোনো সময় সটান মুখ বন্ধ করিয়া দিয়া। আচ্ছা, বিবেচনা করিয়া দেখা যাউক, এই মুখ বন্ধ করাটা কি যুক্তিসঙ্গত?
ধরুণ, দুইজন লোকের মধ্যে তর্ক হইতেছে এবং তাহাদের মধ্যে একজন বেশি বলবান; কিন্তু দুর্বল বেচারার গায়ে জোর না থাকিলেও সে মনের জোর লইয়া, সত্যের জোর লইয়া বলবান প্রতিদ্বন্দ্বীকে ক্রমেই ঘায়েল করিয়া ফেলিতেছে; ঠিক ওই সময়েই অনন্যোপায় হইয়া বলবান রাগিয়া বলিয়া উঠে, ‘চুপ রও!’ অর্থাৎ কিনা তোমার মুখ বন্ধ, তুমি কোনো কথাই বলিতে পাইবে না। যাহার মনের জোর নাই – সত্যের জোর নাই, সে-ই এমন করিয়া গায়ের জোরে দুর্বলকে থামাইতে চেষ্টা পায়। যদি তাহার যুক্তিযুক্তরুপে বুঝাইবার বা মনে সত্য-দাবির জোর থাকিত, তাহা হইলে গায়ের জোর দিয়া বুঝাইবার দরকার হইত না। যাহাদের মনে পাপ, তাহারা বাহিরে যতই গদাইলশকরি চাল দেখাক, অন্তরে তাহারা খ্যাঁকশিয়ালির চেয়েও ভীরু। যেই তাহারা দেখে যে, অন্য কেউ তাহাদের আঁতে ঘা দিতেছে বা মনের পাপটাকে বাহিরে দিনের আলোতে খুলিয়া দেখিতেছে, অমনই তাহারা ‘ওই রে চিচিং ফাঁক হল’ বলিয়া চেঁচাইয়া চিল্লাইয়া হুমকি দেখাইয়া তাহাদের মুখ বন্ধ করিতে চেষ্টা পায়। কিছুতেই না পারিলে তখন আইনের সিলমোহর! আজকাল ছোটোদারোগা সাহেব হইতে আরম্ভ করিয়া বড়োলাট সাহেব পর্যন্ত সকলেই এই উপায়টাকেই ‘বিপদঞ্জন মধুসূদন’ রূপে জাপাটিয়া ধরিয়াছেন। কিন্তু এখন তাঁহারা ক্রমেই হতাশ হইয়া পড়িতেছেন। কেননা ইহাতে উক্ত শ্রীমধুসূদন প্রসন্ন হইয়া ক্রমেই ভ্রুকুটি-কুটিল হইয়া পড়িতেছেন! কী গেরো! ‘সখি হে, কী মোর করমে লিখি?’ মনে করিয়াছিলেন, এ জলে আগুন না নিভিয়া যায় না; কিন্তু তাহা না হইয়া আগুন ক্রমেই শিখা বিস্তার করিয়া বাড়িয়া চলিতেছে। ইহারা এই সোজা কথাটা বুঝিতেছেন না যে, জোর করিয়া একজনকে চুপ করাইয়া দিলে তাহার ওই না-কওয়াটাই বেশি কথা কয়। কারণ, তখন তাহার একার মুখ বন্ধ হয় বটে, কিন্তু তাহার হইয়া – সত্যকে, ন্যায়কে রক্ষা করিবার জন্য – আরও লক্ষ লোকের জবান খুলিয়া যায়। বালির বাঁধ দিয়া কি দামোদরের স্রোত আটকানো যায়?
সেদিন চিত্তরঞ্জনকে বলিলে, ‘এখানে আমার এলাকায় টুঁ-টি করিতে পারিবে না! কিন্তু যেই দেখিলে অবস্থা বড়ো বে-গতিক, অমনি সে-হুকুম বাতিল ও না-মঞ্জুর করিয়া ফেলিলে। আবার মি. আলি শেরওয়ানিকে আগ্রায় বক্তৃতা দিতে মানা করিয়াছ। এমন করিয়া খ্যাপা কুকুরের মতন করিয়া যেখানে-সেখানে হাব্সাইলে কী হইবে? উলটো জনসংঘ আরও খেপিয়া পাগল হইয়া উঠিবে। যদি তোমার ক্ষমতা থাকে, সুশীল সুবোধ বালক হও, সাধারণকে সেকথা বুঝাইয়া দাও। তাহা না হইলে অন্যায়কে ঢাকা দিয়া রাখিতে পারিবে না – পারিবে না।
জোর-জবরদস্তি করিয়া কি কখনও সচেতন জাগ্রত জনসংঘকে চুপ করানো যায়? যতদিন ঘুমাইয়াছিলাম বা কিছু বুঝি নাই, ততদিন যাহা করিয়াছ সাজিয়াছে; এতদিন মোয়া দেখাইয়া ছেলে ভুলাইয়াছ, এখনও কি আর ওরকম ছেলেমানুষি চলিবে মনে কর? আমাদের বড়ো ভয় হয়, এ মুখ-বন্ধ আমাদের নয়, তোমাদের। আশা করি আমাদের এ-ভয় মিথ্যা হইবে না!