মুখ্য আর গৌণ
আমার কিছু দেবার আছে, আমি তা দিয়ে যেতে চাই—এইভাবে আর্টের শুরু। আর্টের গোড়ার কথা অন্তরের পূর্ণতাবোধ ও পূর্ণতার অঞ্জলি শূন্য করার কামনা।
এ যেমন গোড়ার কথা তেমনি মাঝখানকার কথা হচ্ছে কেমন করে শূন্য করব সেই কৌশল জানা ও প্রয়োগ করা। কেমন করে দিতে হয় সেবিদ্যা আমি শিখেছি, সেলীলা আমি সেধেছি—এইভাবে আর্টের চলা।
তার পরের কথা দান। আমার যা দেবার ছিল আমি তা দিয়েছি, সেই সূত্রে আপনাকে দিয়েছি—এইভাবে আর্টের সারা। আর্ট যখন সারা হয় তখন দেখা যায় অঞ্জলি শূন্য করে একজন তার পূর্ণতার দান দিয়ে গেছে, সেই ছলে নিজেকেও দিয়ে গেছে। এই হচ্ছে শেষ কথা।
শুরু ও সারার মাঝখানে দীর্ঘ পথ। এ পথ যে কেবল দীর্ঘ তাই নয় দুর্গমও বটে। সুতরাং শুরু করার আগে দশ বার ভাবা উচিত এ পথে পা দেব কি দেব না। জগতে করবার মতো কাজ অনেক আছে, আর্টই একমাত্র করণীয় নয়। যদি কেউ সব জেনেশুনে এ পথে পা দেন তবে তাঁকে মনে রাখতে হবে এ পথের অন্য নাম কলাবিদ্যা বা লীলাসাধনা। এর কোনো শর্টকাট বা একলম্ফ নেই।
কিন্তু এই সামান্য কথাটা অনেকের মনে থাকে না। তাঁদের ধারণা যেমন-তেমন করে বাজালেই তার নাম বীণাবাদন, যেমন-তেমন করে গাইলেই তার নাম মার্গসংগীত, যেমন-তেমন করে লিখলেই তার নাম কথাসাহিত্য। না, আর্টের মধ্যে ‘যেমন-তেমন করে’র স্থান নেই। এর আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত ‘কেমন করে’র রাজত্ব।
কেমন করে লিখব বা গাইব বা আঁকব বা গড়ব এ চিন্তা যাঁর কাছে তুচ্ছ চিন্তা তাঁর উচ্চ চিন্তা নিয়ে তিনি দর্শন বিজ্ঞান ধর্মনীতি সমাজনীতি করুন, আর্ট তাঁকে দিয়ে হবে না। এ রাজ্যে উচ্চ চিন্তার মূল্য আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু যতক্ষণ-না সে-জিনিস আর্টে রূপান্তরিত হচ্ছে ততক্ষণ তাকে আর্ট বলার উপায় নেই। সে-জিনিস এক লম্ফে আর্ট হয়ে ওঠে না। মহাবীর মারুতি রামনাম বুকে এঁকে এক লম্ফে সাগর পার হয়েছিলেন, কিন্তু রামায়ণ বা রামচরিতমানস যাঁরা লিখে গেছেন তাঁরা কেবল রামনামের মহিমায় কালসাগর পার হননি। কেমন করে লিখতে হয় সে-বিদ্যা শিখেছেন ও তার সাহায্য নিয়ে কালসাগর পার হয়েছেন।
এর থেকে যদি কেউ সিদ্ধান্ত করেন যে আর্টের আসল কথাটা হল কলাবিদ্যা, কোনো মহান সত্য বা গভীর প্রেরণা থাকলেও চলে, না থাকলেও চলে, তবে তিনি ভুল করবেন। সেকালের অনেকে এ ভুল করেছিলেন, একালের অনেকে করছেন, ভাবীকালের অনেকেও করবেন। আমরা আর্টিস্টরা মায়া দিয়ে মনোহরণ করি, সেটা আমাদের স্বধর্ম। কিন্তু তাই বলে সত্যকে গৌণ ও মায়াকে মুখ্য করতে যাইনে, যদি যাই তো আমরা সত্যিকার আর্টিস্ট নই, আমরা মায়াবী। মায়া যাঁদের সম্মোহিত করেছে তাঁরা আর্ট সৃষ্টি করতে অক্ষম। তাঁরা নিজেরাও মজেন, অপরকেও মজান; শেষপর্যন্ত কোথাও পৌঁছোন না, পৌঁছে দেন না। শুরু থেকে সারা অবধি যে মাঝখানকার পথ সেই পথই তাঁদের বেঁধে রাখে, মুক্তি দেয় না। কী করে তাঁরা মুক্তপুরুষ হবেন! আর আর্টিস্টের অন্য নাম তো মুক্তপুরুষ। যে পুরুষ দানভার মুক্ত। যে কিছু হাতে রাখেনি, হাত খালি করে দিয়ে গেছে।
এই পথপাশবদ্ধদের কালোয়াত বলা যেতে পারে। কালোয়াতি সংগীত আমাদের কানেই পশে, কানের ভিতর দিয়ে মরমে পশে না। কালোয়াতি কবিতারও সেই স্বভাব। কালোয়াতি চিত্র, কালোয়াতি ভাস্কর্য, কালোয়াতি নৃত্য—যতরকম কালোয়াতি আর্ট আছে তাদের সকলেরই সেই প্রকৃতি। তারা মরমে পশে না। আর্টের যেখানে সারা তাদের সেখানে প্রবেশ নেই, ততদূর তারা পৌঁছোয় না, মধ্যপথেই বঁাধা পড়ে। বিশুদ্ধ কালোয়াতিরও একপ্রকার রস আছে, সেটা কলাবিদ্যার নিজস্ব রস। কলারসিকরা সেরসের সমঝদার। তাঁরা একখানি বিশুদ্ধ আলাপ শুনলে ধন্য হয়ে যান, তাঁকেই বলেন পিওর আর্ট। এই যদি হয় পিওর আর্ট তো শুধু অল্পসংখ্যক গন্ধর্বের জন্যে। এঁরা মানুষ হলে এঁদের হৃদয় থাকত এবং হৃদয়ের সমঝদারি অত সহজে মিটত না, হৃদয় চাইত হৃদয়ের নিবেদন। সত্যকারের সমঝদার হচ্ছেন হৃদয়রসিক, সেইসঙ্গে কলারসিক। আর মায়ামুগ্ধ সমঝদার হচ্ছেন বিশুদ্ধ কলারসিক। পিওর আর্ট বলতে যদি বোঝায় হৃদয়-বিরহিত কালোয়াতি তবে তাকে আমি উঁচুদরের আর্ট বলতে কুন্ঠিত। জয়দেবের গীতগোবিন্দ আমাকে মুগ্ধ করে, অবাক করে, কিন্তু আমার হৃদয়ে পৌঁছোয় না। শ্রুতিসুখে আচ্ছন্ন করে, কিন্তু মর্ম স্পর্শ করে মর্মান্তিক সুখী করে না। সেইজন্যে মনে হয় জয়দেবও পথপাশবদ্ধ মায়াবী পুরুষ, মুক্তপুরুষ নন। চন্ডীদাস তাঁর বিপরীত।
আর্টের মধ্যে একটা মুক্তি আছে। যাতে তা নেই তা আর্ট হতে হতেও হল না, কোনো এক জায়গায় ঠেকে গেল। হয়তো কলাবিদ্যার একান্ত অভাব, নয়তো কলাবিদ্যার একান্ত আতিশয্য। কিংবা এমনও হতে পারে যে গোড়াতেই গলদ। দান করবার মতো অন্তঃসার নেই। পূর্ণতাবোধ নেই। দান করার কামনা নেই। কামনার বেদনা নেই। যা আছে তা অন্য জাতের কামনা, যেমন ধনকামনা যশকামনা শক্তিকামনা। শুরুতেই যদি ছাই থাকে তো সারাতেও তাই থাকে। মাঝখানে থাকে ভস্মে ঘি ঢালা। কলাবিদ্যার অপচয়।
তবে অনেক সময় ছাইঢাকা আগুনও থাকে। ঘি ঢালতে ঢালতে জ্বলে ওঠে। ঘৃতের কিছু অপব্যয় হয়, কিন্তু একেবারে অপচয় নয়। সেইজন্যে কোনো কবিযশঃপ্রার্থীকে উপহাস করতে নেই। উৎসাহ দিয়ে বলা উচিত, ‘লিখুন, লিখতে থাকুন, লিখতে লিখতেই হবে।’ এটা স্তোকবাক্য নয়। লিখতে লিখতে কত লেখক নিজেকে পেয়ে গেছেন। পেয়ে গেছেন নিজের বাণী, নিজের ধ্যান, নিজের যা শ্রেষ্ঠ, নিজের যা সত্য। কিন্তু লিখতে লিখতে মানে যেমন-তেমন করে লিখতে লিখতে নয়। কেমন করে লিখতে হয় তার প্রতি দৃষ্টি রেখে লিখতে লিখতে। কলাবিদ্যার অনুশীলন করতে করতে। গাইতে গাইতে কেউ গুণী হয় না, কেমন করে গাইতে হয় তার প্রতি লক্ষ রেখে গাইতে গাইতে গুণী হয়; যদি তার ভিতরে গুণ থাকে, আগুন থাকে।
‘তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী—’ রবীন্দ্রনাথের এই লাইনটিতে ঝোঁক পড়েছে ‘কেমন করে’র উপর। গানের উপর নয়। এই ‘কেমন করে’ আছে বলেই গুণ আছে। চর্চা করতে করতে গুণ ফুটে ওঠে, আগুন জ্বলে ওঠে। সুরের আগুন তো বটেই, হৃদয়মনের আগুন। বৈষ্ণবকবিরা যাকে বলেন, ‘হিয়া দগদগি অন্তরদাহনি’। তারপরে আর ভস্মে ঘি ঢালা নয়, আগুনে ঘি ঢালা।
আর্টের ইতিহাসে সবরকম পথিক দেখা যায়। কেউ পথকেই সর্বস্ব করে কালোয়াত হলেন, কেউ পথসংক্ষেপ করতে গিয়ে বেরসিক। সেই যিনি বলেছিলেন, ‘শুষ্কং কাষ্ঠং তিষ্ঠত্যগ্রে’, তাঁর যে কিছু বলবার ছিল না তা নয়। তবু তিনি হলেন চিরকাল হাস্যাস্পদ, অথচ সেই কথা আরেক জনের মুখে রূপ নিল ‘নীরসঃ তরুবরঃ পুরুতঃ ভাতি’ আর তিনি হলেন কবির কবি। সেই থেকে একটা সূত্র রচিত হল বাক্যং রসাত্মকং কাব্যং। অন্যান্য সূত্রের মতো এটিও মনে রাখার সুবিধার জন্যে। এর মধ্যে কাব্যের সব কথা নেই। রস যার আত্মা এমন যে বাক্য সেই হচ্ছে কাব্য। কিন্তু কোন রস? কথার পর কথা সাজিয়ে গেলেও তাঁরও তো একটা রস আছে। ‘না জানি কতেক মধু শ্যাম নামে আছে গো’ এটা শুধু নায়িকার অত্যুক্তি নয়। শব্দের মধ্যে, ধ্বনির মধ্যে, উপমার মধ্যে, অলংকারের মধ্যে স্বকীয় একটা রস আছে। সেটা বিষয় নিরপেক্ষ। প্রেরণা নিরপেক্ষ। কালোয়াতেরা এ রসের সন্ধান রাখেন। কিন্তু শুধুমাত্র এই রসই কাব্যের মূলতত্ত্ব নয়। কবির হৃদয় থেকে উৎসারিত হৃদয়রসই সেই রস যাকে বলা যেতে পারে কাব্যের আত্মা। সেই রসে রসাত্মক না হলে বাক্য কখনো কাব্য হতে পারে না, কলা কখনো আর্ট হতে পারে না।