মুকুন্দপুরের মনসা – ৫

শিলিগুড়ির হোটেলেই ভাদুড়িমশাই একবার সত্যপ্রকাশকে তাঁদের বিগ্রহের কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন। তাতে সত্যপ্রকাশ বলেছিলেন, “এখন আপনারা খেয়ে-দেয়ে একটু বিশ্রাম করুন, পরে সব বলব।” 

পরে আর বলা হয়নি। শিলিগুড়ি থেকে মুকুন্দপুরে আসবার পথে প্রসঙ্গটা আবার উঠেছিল। কিন্তু তখনও সত্যপ্রকাশ বলেছিলেন, “দেখুন ভাদুড়িমশাই; যা ঘটেছে, তার জিটা আমি বলতে পারি; কিন্তু এইভাবে সাঁটে বললে তো ব্যাপারটার তাৎপর্যই আপনারা বুঝতে পারবেন না। সেটা বুঝতে হলে গোটা ব্যাকগ্রাউন্ড আপনাদের জানা দরকার। ব্যাকগ্রাউন্ড মানে আমাদের ফ্যামিলি হিস্ট্রির সঙ্গে এই মূর্তির সম্পর্ক, আবার এই মূর্তির সঙ্গে মুকুন্দপুর গ্রামের মঙ্গল-অমঙ্গলের সম্পর্ক, কোনওটাই তো বাদ দেওয়া চলবে না, সবই আপনাদের জানা চাই। তা সে-সব কি আর গাড়ি চালাতে-চালাতে আমি আপনাদের বলতে পারব?” 

পারা সত্যিই সম্ভব নয়। একে তো হাইওয়ের উপরে মাঝে-মাঝেই দেখা যাচ্ছে বিরাট-বিরাট সব গর্ত, তার উপরে আবার উল্টোদিক থেকে যে রকম কড়া হেডলাইট জ্বেলে ঝড়ের বেগে সব বিশাল বিশাল ট্রাক ছুটে আসছিল, আর সত্যপ্রকাশকে সারাক্ষণ রাস্তার উপরে চোখ রেখে যে রকম সন্তর্পণে তাদের সঙ্গে সংঘাত বাঁচিয়ে চলতে হচ্ছিল, তাতে আমার অন্তত মনে হল যে, স্টিয়ারিং হুইল যাঁর হাতে রয়েছে, তাঁকে আর এখন পারিবারিক ইতিহাস বলবার জন্য অনুরোধ না করাই ভাল। 

বললুম, “ঠিক আছে। পরেই না হয় শুনব।” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “সেটাই ভাল। খানিক বাদেই তো আমরা মুকুন্দপুর পৌঁছে যাচ্ছি, সুতরাং তাড়াহুড়ো করে লাভ নেই, রাত্তিরে খাওয়া-দাওয়ার পরে বরং ধীরেসুস্থে ডিটেলসে সব বলব। একটা ছবি আপনাদের দেখা দরকার। সেটাও তখন দেখানো যাবে।” 

স্বীকার করা ভাল যে, মুকুন্দপুরে পৌঁছে আমি প্রথমটায় একটু দমে গিয়েছিলুম। জানি না মুকুন্দপুরে এখন ইলেকট্রিক লাইট আছে কি না, তবে এ যখনকার কথা বলছি, তখন ছিল না। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই অবশ্য ঘরে-ঘরে হ্যারিকেন আর শেজবাতি জ্বলে উঠল। তা ছাড়া উঠোনের ঠিক মাঝ বরাবর দুটি খুঁটি পুঁতে তাতে একটা তার খাটিয়ে রাখা হয়েছিল, সেই তারে ঝুলিয়ে দেওয়া হল মস্ত বড় হ্যাজাক বাতি। তার ফলে অন্ধকার তো দূর হলই, সারা বাড়ি একেবারে আলোয় আলো হয়ে গেল। 

বাড়িটা অবশ্য সেদিন রাত্তিরে ভাল করে দেখা হয়নি, দেখেছিলুম তার পরদিন ভোরবেলায়। তবু এখানেই তার একটা বর্ণনা দিয়ে রাখি। 

চৌধুরিদের বাড়িটা বেশ ছড়ানো গোছের। এদিকে গ্রামাঞ্চলে পাকাবাড়ি করবার রেওয়াজ নেই। সত্যবাবুরাও পাকাবাড়ি করেননি। ভিতরের ও বাইরের উঠোন ঘিরে ঘর দেখলুম অনেকগুলি। অধিকাংশ ঘরই একতলা। ঘরগুলির ভিত যেমন বাঁধানো, মেঝেগুলিও তেমনি পুরোদস্তুর মোজেইক করা, তবে সে-সব ঘরের দেওয়াল যেমন ইটের নয়, কাঠের, উপরেও তেমনি ঢালাই করা ছাতের বদলে রং-করা করোগেটেড টিনের চাল। ভিতরের উঠোনের চারদিকে চারটে ঘর; প্রতিটি ঘরের সামনে কাঠের রেলিং-এ ঘেরা বারান্দা। যেটা সবচেয়ে বড় ঘর, সেটা অবশ্য একতলা নয়, দোতলা, তার একতলার মেঝে বাঁধানো হলেও দোতলার মেঝে পালিশ করা কাঠের। একতলার ঘরেরই একদিক থেকে চমৎকার কাজ করা একটা কাঠের সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে। এটা সত্যপ্রকাশের এলাকা। একতলাটা তাঁর বসবার ঘর, দোতলাটা শোবার। উঠোনের বাদবাকি তিন-দিকের তিনটে ঘরই একতলা। তার একটায় সত্যবাবুর মা আর পিসিমা থাকেন, একটায় কোনও অতিথি এলে তাঁকে থাকতে দেওয়া হয়। আর বাকি ঘরটার মাঝখানে পার্টিশান করা। পার্টিশানের একদিকে রান্নাঘর আর ভাঁড়ার, অন্যদিকে ডাইনিং টেবিল। 

চৌধুরিদের উপাস্য দেবী মনসা। বাইরের উঠোনের একদিকে রয়েছে তাঁর মন্দির; অন্য দু’দিকের দুটো ঘরের একটায় থাকে সত্যপ্রকাশের বাবার আমলের পুরনো ভৃত্য রামদাস, আর অন্যটায় থাকেন পুরোহিত গোবিন্দ ভট্টাচার্য। ভট্টাচার্যমশাই এঁদের বেতনভোগী পুরোহিত, নিত্যপূজা ছাড়া তাঁর আর অন্য কোনও কাজ নেই। মন্দিরের একপাশে একটি বাঁধানো ইঁদারা। ভিতর-বাড়ির পিছনে একটি পুকুর কাটানো হয়েছিল। তবে সেটা এতই ছোট যে, পুকুর না বলে ডোবা বললেই ঠিক হয়। তাতে বাসন-কোসন মাজা ছাড়া অন্য কোনও কাজ হয় না। বাড়িতে একটা টিউবয়েলও আছে। কিন্তু তার জল কেউ খায় না। তার কারণ, মন্দিরের পাশের ওই ইঁদারার জল শুনলুম দারুণ ভাল। ও-জল খেলে নাকি পাথরও হজম হয়ে যায়। খিদেও হয় প্রচন্ডরকম। সত্যবাবু অন্তত খুব জাঁক করে তাঁদের ইঁদারার জলের এই গুণের কথাটা আমাদের শুনিয়ে রেখেছেন। 

ভোরবেলায় উঠে ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে আমাদের ঘর থেকে বেরিয়ে যখন গোটা বাড়িটা ঘুরে দেখছি, তখন মন্দিরের পিছনে অর্থাৎ বাড়ির উত্তরদিকে একটা বিশাল বাগানও আমাদের চোখে পড়েছিল। বাগানের মধ্যে আর-একখানা ঘরও দেখেছিলুম আমরা। কিন্তু সে-কথায় পরে আসছি। রাত্তিরের কথাটাই বরং আগে সেরে নিই 

ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে রবিবার সকালবেলায় টেলিফোনে কথা বলবার পরে সত্যপ্রকাশ সেইদিনই লোক পাঠিয়ে তাঁর মাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, সোমবার সকালের ফ্লাইটে আমরা শিলিগুড়িতে পৌঁছচ্ছি, তবে শিলিগুড়িতে আমরা রাত কাটাব না, সেখানে দুপুরের খাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নেব মাত্র, তারপর সেখান থেকে সত্যপ্রকাশের সঙ্গে রওনা হয়ে মুকুন্দপুরে চলে আসব, আর রাত্তিরের খাওয়া সারব মুকুন্দপুরেই। আমাদের জন্য রান্নাবান্না তাই করেই রাখা হয়েছিল। তবে পৌঁছতে দেরি হচ্ছে দেখে বাড়ির লোকেরা ভাবছিলেন যে, প্লেন হয়তো সেদিন খুবই দেরি করে শিলিগুড়িতে পৌঁছেছে, আমরা আর সেখান থেকে রওনা হতে পারিনি, রাতটা শিলিগুড়িতে কাটিয়ে পরদিন সকালে আমরা মুকুন্দপুরের দিকে রওনা হব। 

আমরা এসে পড়ায় তাই সবাই দেখলুম দারুণ খুশি। সবচেয়ে বেশি খুশি রামদাস। তার কারণ, একমাত্র সে-ই নাকি বলেছিল যে, খোকাবাবুর কথার কখনও নড়চড় হয় না, একবার যখন আসবে বলেছে, তখন যত রাতই হোক, খোকাবাবু আসবেই। 

সত্যপ্রকাশ তাঁর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “সত্যি নাকি মা?” 

মা বললেন, “তা রামদাস একথা জাঁক করে বলতে পারে বটে। আমি তো এত দেরি দেখে ভাবছিলুম যে, আজ আর তোদের আসা হল না। কাজের লোকদের ছুটি দিয়ে তোর পিসিমাকে নিয়ে শুয়েও পড়েছিলুম। তা রামদাস বলল, ‘শুয়ে তো পড়ছ কর্তা-মা, একটু বাদেই তোমাকে আবার উঠতে হবে।’ এখন দেখছি, ঠিকই বলেছিল।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কাল সকালে এলেই পারতুম। রাত্তিরে এসে আপনাদের অসুবিধে ঘটানো হল।” 

মা বললেন, “অসুবিধে আবার কিসের। রান্নাবান্না তো করাই আছে, শুধু একটু গরম করে দিতে হবে। আপনারা ততক্ষণে হাত-মুখ ধুয়ে নিন।” 

বাথরুমে জল ধরে রাখাই ছিল। হাতমুখ ধুয়ে যে যার হ্যান্ডব্যাগ থেকে একপ্রস্ত পায়জামা আর পাঞ্জাবি বার করে নিয়ে, জামাকাপড় পালটে আমরা ডাইনিং টেবিলে এসে এক-একখানা চেয়ার টেনে বসে পড়লুম। 

সত্যপ্রকাশ দেখলুম পাঞ্জাবির উপরে হালকা একটা জাম্পার চড়িয়ে এসেছেন। বললেন, “আপনারাও গরম কিছু পরলে পারতেন। একটু-একটু হিম পড়ছে, রাত বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে ঠান্ডাও বাড়বে। তার মানে যে শাল-দোশালার দরকার হবে তা নয়, পাতলা-মতো কিছু একটা গায়ে জড়িয়ে নেবেন, এখনকার ঠান্ডায় তাতেই কাজ চলে যাবে। তেমন কিছু সঙ্গে আছে তো? না থাকলে বলুন, আমি দিয়ে দিচ্ছি।” 

বললুম, “না না, সঙ্গে করে বা এনেছি তা-ই যথেষ্ট।” 

রামদাস এক কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। সত্যপ্রকাশ তাকে বললেন, “বাবুদের বিছানার মশারি 

খাটিয়ে দিয়েছ তো?” 

“দিয়েছি খোকাবাবু।” 

“গায়ে দেবার জন্যে হালকা একটা করে লেপও দিও। শেষ রাত্তিরে দরকার হতে পারে।”

“দুটো লাইসাম্পি দিয়েছি, তাতেই হবে।” 

“তা হলে তুমি দাঁড়িয়ে থেকো না, রঙ্গিলার কাছে যাও, মেয়েটা একা রয়েছে।” 

“একা থাকবে কেন, সেখানে তো আয়াই রয়েছে। তোমাদের খাওয়া শেষ হোক, তারপর এই বাবুদের শোবার ঘরে পৌঁছে দিয়ে আমি যাব।” 

রামদাস দাঁড়িয়েই রইল। বোঝা গেল, আমাদের খাওয়া যতক্ষণ না শেষ হচ্ছে, ততক্ষণ সে এখান থেকে নড়বে না। 

যে মেয়েটি পরিবেশন করছিল, তার নাম বোঝা গেল নিরু। সুশ্রী চেহারা, চালচলন সপ্রতিভ। বয়েস মনে হল বছর তিরিশ হবে। সিঁথিতে সিঁদুর নেই। তা সে বিধবা বলেও হতে পারে, আবার আদৌ বিয়ে হয়নি বলেও হতে পারে। 

নিরু এঁদের কে হয়। রঙিলারই বা অসুখটা আসলে কী হয়েছে, এই দুটো প্রশ্ন আমার মনের মধ্যে দু-একবার উঁকি মেরেছিল ঠিকই, কিন্তু ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলুম, মুখ নিচু করে একেবারে চুপচাপ তিনি খেয়ে যাচ্ছেন, আমিও আর তাই এ নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলুম না। শুধু একবার বলেছিলুম যে, রান্না অতি চমৎকার হয়েছে, সবই কি এই মেয়েটি করেছে কি? তাতে সত্যপ্রকাশ বললেন, “আরে না, মশাই, তার জন্যে তো আলাদা লোকই রয়েছে, এই গ্রামের লোক, সকালবেলায় এসে সারাটা দিন থাকে, তারপর রাতের রান্নার পাট চুকিয়ে আটটা নাগাদ নিজের বাড়িতে চলে যায়।” 

রান্না সতিই চমৎকার হয়েছিল। সত্যপ্রকাশ যে আমাদের জন্যে পঞ্চাশ ব্যঞ্জনের ফরমাশ দিয়ে রেখেছিলেন, তা নয়, তবে মাছই দেখলুম তিনরকম। তার মধ্যে রুই আর চিংড়িটাকে শনাক্ত করা গেল বটে, তবে তৃতীয়টাকে চিনতে পারলুম না। 

সত্যপ্রকাশকে জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেন, “এখানকার নদীর মাছ। চেপটি। সর্ষে-ঝালের পক্ষে একেবারে আদর্শ। খেয়ে নিন। এ মাছ কলকাতায় পাবেন না।” তারপর একটু থেমে বললেন, “মাংস না থাকায় একটু অসুবিধে হল, তাই না? 

আমি বললুম, “সে কী কথা, এত চমৎকার মাছ পেলে কেউ মাংস চায়?” 

“চাইলেও পেতেন না মশাই,” সত্যপ্রকাশ বললেন, “এ তো শহর নয়, গ্রাম। এখানে মাছ মেলে, মাংস মেলে না। মাংস যদি খেতে চান তো সেই আলিপুরদুয়ার থেকে কিনে আনতে হবে।” 

ভাদুড়িমশাই এতক্ষণ একটাও কথা বলেননি, এইবারে মুখ তুলে বললেন, “আলিপুরদুয়ার এখান থেকে কতদূর?” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “তা নেহাত কম হবে না, বরং হাসিমারাই কাছে।” 

“মুকুন্দপুর কোথায়, সেটা বোঝাতে গিয়ে তা হলে আপনারা ‘আলিপুরদুয়ারের কাছে’ বলেন কেন?” 

“হাসিমারার চেয়ে আলিপুরদুয়ার যেহেতু বেশি বিখ্যাত, তাই ওই নামটাই করতে হয়।” সত্যপ্রকাশ হাসলেন। 

খাওয়ার পর্ব চুকেছে। রামদাস বলল, “চলুন, আপনাদের শোবার ঘর দেখিয়ে দিই।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “সত্যবাবু কি এখনই শুয়ে পড়বেন?” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “আরে না মশাই। সবে তো দশটা বাজে। এত সকাল-সকাল আমি ঘুমোই না। আমার ঘুমোতে-ঘুমোতে সেই রাত বরোটা-একটা বাজবে।” 

“এখন তা হলে কী করবেন?” 

“সঙ্গে একটা হ্যাডলি চেজ রয়েছে। সেইটে পড়ব।” 

“তার চেয়ে বরং যে কাজে এসেছি, সেই কাজে আমাদের সাহায্য করুন।” চারু ভাদুড়ি বললেন, “ঘুণ আমাদেরও পায়নি, সুতরাং সময়টাকে কাজে লাগানো যাক। মনসাদেবীর মূর্তি কীভাবে নিখোঁজ হল, শুনি।” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “বেশ তো, চলুন, ড্রইংরুমে গিয়ে বসা যাক।”

মশলার ডিবে হাতে নিরু এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। ডিবের ভিতর থেকে এক টিপ মৌরি আর এলাচদানা তুলে নিয়ে সদ্য খাবার-ঘরের বাইরে পা বাড়িয়েছি। ঠিক সেই মুহূর্তে একটা চিৎকার শোনা গেল। 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “কী ব্যাপার? চিৎকারটা তোমারই ঘরের দিক থেকে এল না রামদাস? চলো তো একবার।” 

আমরাও ওঁদের সঙ্গে যাচ্ছিলুম, সত্যপ্রকাশ আমাদের বাধা দিয়ে বললেন, “ব্যস্ত হবেন না, নিরুর সঙ্গে আপনারা ড্রইংরুমে গিয়ে বসুন, আমরা এখুনি গিয়ে দেখে আসছি ব্যাপারটা কী।”

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই সত্যপ্রকাশ ফিরে এলেন। মুখ গম্ভীর। ভাদুড়িমশাই বললেন, “কী হল?”

“ঝামেলা হল।” হাতের টর্চটা নামিয়ে রেখে সত্যপ্রকাশ বললেন, “যে মেয়েটি আয়ার কাজ করে, সে আর এখানে থাকতে চাইছে না।” 

“সে-ই চেঁচিয়ে উঠেছিল বুঝি?” 

“হ্যাঁ। ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিল।” 

“কীসের ভয়?” 

“ভূতের। বলছে, জানলা দিয়ে কে যেন ঘরের মধ্যে উঁকি মেরেছিল। সে চেঁচিয়ে উঠতেই লোকটা পালিয়ে যায়। আয়া বলছে, মানুষ নয়, ভূত।” 

“হঠাৎ ভূতের কথা উঠল কেন?” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “আর বলবেন না। এরা গ্রামের লোক, এমনিতেই এক-একটা কুসংস্কারের ডিপো, সন্ধে হতে না হতেই ভূতপেত্নির ভয়ে একেবারে কাঁটা হয়ে থাকে, তার উপরে আবার মন্দির থেকে বিগ্রহ চুরি যাওয়ার পরে এদের ভয়টা আরও বেড়েছে। গাছ থেকে পাতাটা খসে পড়লেও বলছে যে, ভূতে পাতা ফেলছে।” 

ভাদুড়িমশাই হাসলেন। বললেন, “বিগ্রহের কথা বলুন। ঠিক কবে ওটি উধাও হয়েছে?” 

“বলছি।” সত্যপ্রকাশ একটি সিগারেট ধরিয়ে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে রইলেন। তারপর বললেন, “সবই আপনাদের বলব। প্রথমে ভেবেছিলুম, দু-একটা কথা চেপে গেলেও ক্ষতি নেই, কিন্তু পরে মনে হল, সবই আপনাদের জানা দরকার, তা নইলে এই ব্যাপারটার তাৎপর্য আপনারা ঠিক ধরতে পারবেন না। আবার সব কথা যদি শোনেন, তা হলে এমনও আপনাদের মনে হতে পারে যে, কুসংস্কার আমারও কিছু কম নয়।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “অত কিন্তু-কিন্তু করবেন না। কুসংস্কার সকলেরই কিছু-না-কিছু থাকে। ইউরোপ-আমেরিকার লোকরা তো ভাবে….শুধু ভাবে কেন, খোলাখুলি বলওে যে, এই প্রাচ্য পৃথিবীই হচ্ছে কুসংস্কারের সবচেয়ে বড় আড়ত। অথচ…” 

আমি বললুম, “অথচ কুসংস্কার ইউরোপ-আমেরিকাতেও কিছু কম নেই।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “নেই-ই তো। সেখানকার বিস্তর লোক আজও কালো-বেড়ালকে অমঙ্গলের দূত বলে ভাবে, আর পারতপক্ষে তেরো-তারিখে কোনও শুভকর্মে হাত দিতে চায় না।” 

“তা ছাড়া,” আমি বললুম, “এ দেশে এলে মঘা-অশ্লেষাকেও তারা এড়িয়ে চলে। প্রভাত মুখুজ্যে মশাই এই নিয়ে বড় চমৎকার একটি গল্প লিখেছিলেন।” 

“সুতরাং কুণ্ঠিত হবেন না, সত্যবাবু।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “যা বলবার, নির্ভয়ে বলুন।” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “প্রথমেই জানিয়ে রাখি যে, আমরা এই অঞ্চলের মানুষ নই। অনেক কাল এদিকে আছি তো, তাই এখানকার লোকদের কথাবার্তায় যে একটা অন্যরকমের টান থাকে, আমাদের কথাবার্তাতেও সেটা ঢুকে পড়েছে। আমরা আসলে অন্য জায়গা থেকে এখানে এসেছি।” 

আমি বললুম, “সে তো অনেকেই এসেছে। বিশেষ করে পার্টিশানের পর থেকে। আপনারাও নিশ্চয় পুব-বাংলা থেকে এসেছিলেন?” 

“না না, আমরা পুব-বাংলার লোক নই,” সত্যপ্রকাশ বললেন, “পার্টিশানের অনেক আগে থেকে আমরা এখানে আছি। তা সেই নাইনটিন্‌থ সেঞ্চুরির একেবারে শেষ দিক থেকে।” 

“ওরে বাবা,” চারু ভাদুড়ি বললেন, “এ তো দেখছি মহারানি ভিক্টোরিয়ার আমলের ব্যাপার।”

“তা বলতে পারব না, তবে এগজ্যাক্ট সময়টা বলতে পারি, এইট্রিন নাইনটিওয়ান।”

“আপনাদের আদি বাড়ি কোথায় ছিল?” 

“বর্ধমান জেলায়।” সত্যপ্রকাশ বললেন, “গ্রামের নামটা আর বলছি না, বললেও আপনারা চিনতে পারবেন না। তা সেই গ্রাম থেকে আমার ঠাকুরদাই প্রথমে এদিকে এসে এই মুকুন্দপুর গ্রামে বসবাস করতে শুরু করেন। সঙ্গে টাকাপয়সা বেশি আনেননি, তবে যা এনেছিলেন তা-ই যথেষ্ট। সেই টাকায় যেমন এখানে, তেমনি আশেপাশেও একেবারে জলের দরে কিছু জমিজমা কিনেছিলেন। তার কিছুটা তিনি ভাগচাষিদের দিয়েছিলেন বটে, তবে বেশির ভাগই মাইনে-করা লোক দিয়ে চাষ করাতেন। ফসল যা পেতেন, তাতে সংসারের দরকার তো মিটতই, বিক্রিও হত প্রচুর। সত্যি বলতে কী, বর্ধমানে থাকতে আমার ঠাকুর্দার অবস্থা খুব ভাল ছিল না, এখানে আসবার পর থেকেই তাঁর কপাল ফিরে যায়।” 

ঘরের মধ্যে হ্যারিকেন জ্বলছে। তাতে খানিকটা জায়গা আলো হয়েছে বটে, কিন্তু বাকিটা অন্ধকার। তাই, নিরু যে কখন ঘরে এসে ঢুকেছে, আমরা বুঝতে পারিনি। সত্যপ্রকাশ বললেন, “কিছু বলবে?” 

নিরু বলল, “আপনাদের কি কিছু লাগবে, দাদাবাবু? উনুনে আগুন রয়েছে, বলেন তো কফি করে দিতে পারি।” 

সত্যপ্রকাশ আমাদের দিকে তাকালেন। আমরা মাথা নাড়লুম দেখে সত্যপ্রকাশ বললেন, “না, আর কিছু লাগবে না। মা আর পিসিমা শুয়ে পড়েছেন তো?” 

“হ্যাঁ।” 

“তুমিও শুয়ে পড়ো গিয়ে।” 

চারু চলে গেল। সত্যপ্রকাশ বললেন, “যা বলছিলুম। আমার ঠাকুর্দার নাম মহেশ্বর চৌধুরি। তাঁর দুই ছেলে। নিত্যপ্রকাশ আর চিত্তপ্রকাশ। মেয়ে একটি। নাম সত্যভামা। ঠাকুর্দা খুব ঘটা করে জলপাইগুড়িতে এক বড়লোক ব্যবসায়ীর ছেলের সঙ্গে তাঁর বিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর দাম্পত্য জীবন খুব সুখের হয়নি। জামাতা বাবাজীবনের হরেক রকমের দোষ ছিল, তার মধ্যে একটা হচ্ছে মাত্রাহীন সুরাসক্তি। অতি অল্প বয়স থেকেই তিনি মদ্যপান করতে শুরু করেছিলেন, কিন্তু ওই যা বলছিলুম, এ ব্যাপারে তাঁর কোনও মাত্রাজ্ঞান ছিল না। ফলে তিরিশে পৌঁছবার আগেই লিভারের বারোটা বাজিয়ে তিনি ফৌত হয়ে যান। আমার পিসিমার বয়স তখন কুড়ি-বাইশ। তারপরে আর তিনি জলপাইগুড়িতে থাকেননি। ছেলেপুলে না-হওয়ায় শ্বশুরবাড়ির উপরে তাঁর বিশেষ টানও ছিল না। বিধবা হবার মাসখানেকের মধ্যেই তিনি বাপের বাড়িতে চলে আসেন।” 

আমি বললুম, “তিনিই তো আপনার একমাত্র পিসিমা। খাবার ঘরে তা হলে আপনার মায়ের সঙ্গে তাঁকেই আমরা দেখেছি।” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “আমার মা আর পিসিমার বয়েস প্রায় একই, এক-আধ বছর এদিক-ওদিক হতে পারে। দুজনে খুব ভাব। পিসিমা যেমন শ্বশুরবাড়িতে যাননি, তেমনি মা-ও কখনও তাঁকে যেতে দেননি।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “এই নিরু মেয়েটি কে? আপনাদের কোনও আত্মীয়া?” 

“না মশাই,” সত্যপ্রকাশ বললেন, “নিরু আমাদের কেউ নয়। পাশের গাঁয়ের মেয়ে। ওর বয়েস যখন কুড়ি-বাইশ, তখন টাইফয়েডে ওর স্বামী মারা যায়। তা সে প্রায় বছর দশেক আন্দ্রে কথা। একটা দেওর ছিল, কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর দিন-দশেকের মধ্যেই নিরু বুঝতে পেরে যায় যে, দেওরের মতলব খুব ভাল নয়। আমার মা-কে সেই কথা বলে এখানে আশ্রয় চেয়েছিল। বাস, সেই থেকে নিরু এ-বাড়িতে রয়েছে।” 

“ওর ছেলেপুলে নেই?” 

“একটা ছেলে ছিল। কিন্তু ছেলেটা মারা গিয়েছিল স্বামীর মৃত্যুর আগের বছরেই। সেও টাইফয়েডের ব্যাপার।” 

“নিরু এ-বাড়িতে কী কাজ করে?” 

“মা আর পিসিমার সেবাযত্ন করে। দুজনেই বুড়োমানুষ, নিরুকে পেয়ে ওঁদের ভালই হয়েছে।”

“আপনার ঠাকুর্দার কথা বলুন। আপনি তাঁর জমিজমার কথা বলেছেন। কিন্তু আপনাদের আয় তো শুধু জমি-জমা থেকে নয়, ব্যাবসাও বেশ বড় মাপের। এই ব্যাবসার পত্তনও কি তাঁর আমলেই হয়েছিল?” 

“না।” সত্যপ্রকাশ বললেন, “আমার ঠাকুর্দার চরিত্র যা আমি আন্দাজ করতে পারি, তাতে মনে হয়, শুধু জমিজমা বাড়িয়ে সন্তুষ্ট থাকবার মতো মানুষ তিনি ছিলেন না, জমি থেকে যা আয় হত, তার থেকে কিছু-না-কিছু সঞ্চয় করে সেই পুঁজি নিয়ে হয়তো ব্যাবসাতেও নামতেন তিনি। কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনি। আসলে তাঁর মন ইতিমধ্যে ভেঙে গিয়েছিল।” 

“কেন?” 

“একটা কারণ আমার পিসিমা। একমাত্র মেয়ে, মাত্র কুড়ি-বাইশ বছরে সিঁথির সিঁদুর মুছে, হাতের শাঁখা ভেঙে, থানকাপড় পরে সে শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে এল, বলতে গেলে কোনও সাধ-আহ্লাদ তার মিটল না, এই ধাক্কাটা ঠাকুর্দা সামলে উঠতে পারেননি।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনার কথা থেকে বুঝতে পারছি, মহেশ্বর চৌধুরির মন ভেঙে যাওয়ার আরও একটা কারণ ছিল। সেটা কী?” 

“দ্বিতীয় কারণ আমার কাকা।” সত্যপ্রকাশ বললেন, “আপনাদের আমি বলেছি যে, আমার ঠাকুর্দার পুত্রসন্তান হয়েছিল দুটি। বড় ছেলে নিত্যপ্রকাশ আমার বাবা। তাঁর লেখাপড়া বিশেষ এগোয়নি। সেই তুলনায় ছোট ছেলে চিত্তপ্রকাশ ছিলেন অনেক মেধাবী ছাত্র। আলিপুরদুয়ার থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে তিনি জলপানি পান। ঠাকুমা তখন জিদ করতে থাকেন যে, তাকে কলকাতায় রেখে পড়াতে হবে।” 

“তা-ই হয়েছিল?” 

“ঠাকুর্দার তাতে মোটেই সায় ছিল না। কিন্তু মায়ের সঙ্গে ছেলেও বায়না ধরে বসল যে, কলকাতায় সে যাবেই। ফলে ঠাকুর্দা তাকে কলকাতার এক নাম-করা কলেজে ভর্তি করে দিয়ে আসতে বাধ্য হলেন। কলেজের কাছেই হস্টেল। সেইখানে তাকে রাখার ব্যবস্থা হল।” 

“তারপর?” 

“তারপর সেই হস্টেল থেকেই একদিন নিখোঁজ হয়ে গেলেন চিত্তপ্রকাশ। গেলেন তো গেলেনই, কোনও খোঁজই আর তাঁর পাওয়া গেল না। পিসিমার বিয়ের বছর দুই-তিনের মধ্যেই এই ঘটনা। বুঝতেই পারেন, ঠাকুর্দা এই ঘটনায় কতটা আঘাত পেয়েছিলেন। তারপর তাঁর একমাত্র মেয়েরও যখন কপাল পুড়ল, শোকে দুঃখে ঠাকুর্দা তখন প্রায় উন্মাদ হয়ে যান। মায়ের কাছে শুনেছি, দিবারাত্রি ঠাকুর্দা তখন নাকি ঠাকুরঘরেই পড়ে থাকতেন। কারও সঙ্গে কোনও কথা বলতেন না, শুধু মাঝে-মাঝে তাঁর বুক-ফাটা হাহাকার শোনা যেত—মা, এ .তুই আমার কী করলি?” 

সত্যপ্রকাশ আবার একটা সিগারেট ধরালেন। তারপর হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, “রাত এগারোটা বাজে। আপনাদের ঘুম পায়নি তো?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “না। আপনার বাবার কথা বলুন।” 

“বাবার লেখাপড়া যে বিশেষ এগোয়নি, তা তো আপনাদের বলেছি। তবে তিনি উদ্যোগী মানুষ ছিলেন। পিসিমা বিধবা হয়ে এখানে চলে আসার পরে আমার ঠাকুর্দা বেশিদিন বাঁচেননি, তার বছর দুয়েকের মধ্যেই তিনি মারা যান। সংসারের দায়িত্ব তখন পুরোপুরি বাবার উপরে এসে পড়ে। তাঁরই আমলে পত্তন হল আমাদের কাঠের ব্যাবসার। জমিজমার উপরে নির্ভর করে যে বেশিদিন থাকা যাবে না। সেটা তিনি বুঝতে পরেছিলেন। তা ছাড়া তাঁর ব্যাবসা-বুদ্ধি ছিল খুবই ধারালো। সেইসঙ্গে জনাকয় সৎ লোকের সাহায্য পেয়েছিলেন তিনি। ফলে, জঙ্গলের ইজারা নেওয়া কি কাঠ কেনা-বেচার ব্যাপারে কখনও তিনি মার খাননি। বছর কয়েকের মধ্যেই তাঁর ব্যাবসার ভলুম হু হু করে বেড়ে যায়। বছর দশেক আগে তিনি মারা গেছেন।” 

“শিলিগুড়িতে যে আপনার হোটেল আর ট্রাকের ব্যাবসার কথা শুনেছি, তারও শুরু কি আপনার বাবার আমলেই?” 

“না, ও দুটো আমি শুরু করেছি।” সত্যপ্রকাশ বলেলেন, “টাকা তো ফেলে রাখতে নেই, তাকে খাটাতে হয়। শিলিগুড়িতে এখন হোটেলের ব্যাবসায় মার খাবার কোনও ভয় নেই, আর ট্রাকের ব্যাবসার সঙ্গে তো এখানকার কাঠের ব্যাবসা একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে, ফলে সেখানেও কোনও লোকসানের কথা উঠছে না। আমি তো আরও গোটা দুই-তিন ট্রাক কেনার কথা ভাবছি।” 

আমি বললুম, “মাঝে-মাঝে যে ট্রাক থেকে মাল লুঠ হয়ে যাবার খবর পড়ি?” 

“সে তো ইনসিওর-করা মালপত্র। লুঠ হলেই বা লোকসান কী? অন্তত ব্যক্তিগতভাবে তো কারও কোনও লোকসান হবার কথা নয়।” সত্যপ্রকাশ হাসতে লাগলেন। 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “একটা ব্যক্তিগত কথা জিজ্ঞেস করছি। আপনার স্ত্রী আর ছেলেমেয়েরা কি শিলিগুড়িতেই থাকেন?”

সত্যপ্রকাশ বললেন, “বছর পাঁচেক আগে আমার স্ত্রী মারা গেছেন। ছেলেমেয়ে তিনটি। দুটি মেয়ে আর একটি ছেলে। ছেলেটিই সবার ছোট।” 

“তারা কোথায় থাকে?” 

“বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। সে কলকাতায় থাকে। ছোট মেয়ে আর ছেলেটি থাকে দার্জিলিঙে। দুজনেই হস্টেলে থেকে পড়াশুনো করে।” 

“আপনার ভাইবোনেরা?” 

“আমার ভাইও নেই, বোনও নেই,” সত্যপ্রকাশ বললেন, “বাপ-মায়ের আমিই একমাত্র সন্তান।”

“স্ত্রী মারা যাবার পরে আপনি আর বিয়ে করার কথা ভাবেননি?” 

“আমি ভাবিনি, তবে মা আর পিসিমা ভেবেছিলেন। ভাবছিলেন আমার বন্ধুবান্ধবরাও।” সত্যপ্রকাশ হাসতে-হাসতেই বললেন, “ওই যে একটা কথা আছে না, যার বিয়ে তার হুঁশ নেই, পাড়াপড়শির ঘুম নেই, এ হল সেই ব্যাপার। আমার বিয়ের ভাবনায় আমার বন্ধুবান্ধবদের ঘুম হচ্ছিল না। তা ঘুম তাঁদের না-হতেই পারে। খোঁজ নিয়ে দেখুন, তাঁদের প্রত্যেকেরই একটি করে গলগ্রহ ভাগ্নি কি ভাইঝি কি শালি রয়েছে, সেটিকে আমার ঘাড়ে না চাপানো পর্যন্ত তাঁদের ঘুম হবার আশা নেই। না মশাই, ব্যাবসা-ট্যাবসা নিয়ে এই দিব্যি আছি। ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে, বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছি, দু-দিন বাদে তারও ছেলেপুলে হবে, এখন বুড়োবয়সে টোপর পরে আমি যদি ছাঁদনাতলায় গিয়ে দাঁড়াই, লোকে তো তা হলে ছ্যা-ছ্যা করবে!” 

“এখানে আপনাদের এই পৈতৃক বাড়িতে তা হলে থাকেন কে?” 

“থাকেন আমার মা আর পিসিমা! তা ছাড়া থাকে রামদাস আর তার নাতনি রঙ্গিলা। তা ছাড়া থাকে নিরু। আর হ্যাঁ, বাড়িতে নিত্যপূজার একটা ব্যবস্থা আছে তো, তাই একজন পুরুতঠাকুরও থাকেন। শিলিগুড়িতে খুব কাজের চাপ না থাকলে সপ্তাহান্তে আমিও একবার করে আসি। শনিবার রাতে চলে আসি। তারপর রোববারটা এখানে কাটিয়ে সোমবার আবার শিলিগুড়িতে ফিরে যাই। তবে কিনা ওই যা বললুম, হাতে তেমন কাজ না থাকলে আসি, কাজের চাপ থাকলে আসতে পারি না।” 

“এখানেও তো অনেক কাজ। সে-সব কে করে?”

“বাড়ির কাজকর্ম যারা করে, তারা গ্রামেরই লোক। কেউ রান্নার কাজ করে, কেউ কাপড় কাচে, কেউ বাসন-কোশন মাজে, কেউ জল তোলে, কেউ ঝাঁট-পাট দেয়। তবে তারা কেউ রাত্তিরে এ-বাড়িতে থাকে না, কাজকর্ম সেরে যে যার বাড়িতে চলে যায়।” 

“জমিজমার কাজ?” 

“কিছুটা ভাগচাষিরা করে, আর নিজেরা জন খাটিয়ে যে জমিতে চাষ করাই, তার তদারকি করে রামদাস। ও আমার বাবার আমলের বিশ্বাসী লোক,” সত্যপ্রকাশ বললেন, “ওকে নিয়ে কোনও চিন্তা নেই। জানেন, আমি যখন ইস্কুলে পড়ি, তখন ও একবার বাঘের মুখ থেকে আমাকে ছিনিয়ে এনেছিল।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বটে?” 

সত্যপ্রকাশ তাঁর পাঞ্জাবির আস্তিন গুটিয়ে বাঁ-হাতটা আমাদের সামনে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “এই দেখুন।” 

কনুই আর কব্জির মাঝখানে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে একটা শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতচিহ্ন। চামড়া এখনও কুঁচকে আছে। দেখে বোঝা যায়, জখমটা বেশ বড় রকমেরই হয়েছিল। হাতটা সরিয়ে নিয়ে সত্যপ্রকাশ বললেন, “লছাড়া হয়ে একটা লেপার্ডের মুখে পড়ে গিয়েছিলুম। রামদাস যদি না টাঙ্গি নিয়ে লাফিয়ে পড়ত, তা হলে সেইদিনই আমার খেল খতম হয়ে যেত।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আর কেউ তা হলে থাকেন না আপনাদের এই বাড়িতে?” 

সত্যপ্রকাশ একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “থাকতেন না, কিন্তু এখন থাকেন।”

“কে?” 

“আমার সেই কাকা। চিত্তপ্রকাশ। মূর্তিটি যেদিন নিখোঁজ হয়, তার দিন সাতেক আগে ফিরে : এসেছেন।” 

৭ 

সত্যপ্রকাশের কথা শুনে তো আমি অবাক। ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে কিন্তু মনে হল যে, এই রকমের একটা তাজ্জব ব্যাপারও তাঁকে বিশেষ বিচলিত করতে পারেনি। যেন এমন কান্ড নিত্যই ঘটছে, এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। 

তবে, মুখের রেখা পালটে না-গেলেও, তাঁর চোখের চাউনিটা যে পালটেছে, ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে এক-পলক তাকিয়েই সেটা আমি বুঝতে পেরেছিলুম। তীব্র চোখে সত্যপ্রকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন তিনি; যেন সত্যপ্রকাশকে নয়, তাঁর ভেতর দিয়ে আর-কাউকে তিনি দেখে নিচ্ছেন। বেশ কিছুক্ষণ সেইভাবে তিনি তাকিয়ে রইলেন। তারপর ধীরে-ধীরে তাঁর দৃষ্টি আবার স্বাভাবিক হয়ে এল। সত্যপ্রকাশকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “যিনি ফিরে এসেছেন, তিনিই যে আপনার সেই হারানো-কাকা, তা আপনি বুঝলেন কী করে?” 

“আমি বুঝতে পারিনি। মা আর পিসিমা বুঝতে পেরেছিলেন। আর বুঝতে পেরেছিল রামদাস। সে-ই শিলিগুড়িতে লোক পাঠিয়ে আমাকে খবর দেয় যে, কাকা ফিরে এসেছেন।” 

“ব্যাপারটা ঠিক কী হয়েছিল বলুন তো।” 

“ব্যাপার আর কী, জটাধারী একজন বুড়োমতন লোক একদিন আমাদের এই বাড়িতে এসে বললেন, যে, তিনি চিত্তপ্রকাশ চৌধুরি, মহেশ্বর চৌধুরির ছোট ছেলে। সকলকে একবার দেখবার জন্যে তিনি নাকি হরিদ্বার থেকে কামাখ্যা যাওয়ার পথে এখানে এসেছেন, হপ্তাখানেক এখানে থেকে কামাখ্যা যাবেন, তারপর কামাখ্যা থেকে আবার হরিদ্বারে ফিরবেন।” 

“সকলেই সে-কথা বিশ্বাস করল?” 

“প্রথমটায় করেনি।” সত্যপ্রকাশ বললেন, “কিন্তু মা যখন রামদাসকে বললেন যে, ছেলেবেলায় পেয়ারাগাছ থেকে পড়ে গিয়ে তাঁর দেও বের কপাল ফেটে গিয়েছিল, সেই দাগটা এখনও মিলিয়ে যায়নি, আর রামদাস যখন দেখল যে, যিনি এসেছেন তাঁর কপালে সত্যি মস্ত একটা কাটা-দাগ রয়েছে, তখন আর তাঁকে চিত্তপ্রকাশ বলে মেনে নিতে কারও আপত্তি হল না।” 

“অর্থাৎ তিনি এখানেই রয়ে গেলেন?” 

“হ্যাঁ,” সত্যপ্রকাশ বললেন, “সবাই মেনে নিল যে, এটা ইপার্সোনেশানের ব্যাপার নয়। সত্যিই তিনি মহেশ্বর চৌধুরির কনিষ্ঠ পুত্র – নিত্যপ্রকাশের ছোট ভাই।” 

“আপনার মা তাঁকে ছেলেবেলায় পেয়ারাগাছ থেকে পড়ে যেতে দেখেছিলেন?” 

“তা কী করে দেখবেন? মা’র তো তখনও বিয়েই হয়নি। তবে হ্যাঁ, পিসিমা দেখেছিলেন। মা শুনেছিলেন বিয়ের পরে তাঁর শাশুড়ি অর্থাৎ আমার ঠাকুমার কাছে।” 

“খাবার সময়ে তো তাঁকে দেখলুম না। আগেই খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়েছেন নাকি?” 

“তিনি সন্নিসি মানুষ, তাই আমাদের সঙ্গে খান না। আমাদের এই বাড়ির মধ্যে থাকেনও না তিনি।” 

“আপনারা থাকতে বলেছিলেন?” 

“বিলক্ষণ।” সত্যপ্রকাশ বললেন, “তিনি আমার কাকা, তাঁকে থাকতে বলব না?”

“তাতে তিনি কী বললেন?” 

“বললেন, ওরেব্বাবা, একবার যখন সংসারের খাঁচা থেকে বেরিয়ে পড়েছি, তখন আর ওর মধ্যে ঢুকি? আমাকে নিয়ে ভাবিস না, আমি গাছতলাতেই দিব্যি থাকব।” 

“তা-ই রয়েছেন?” 

“তাও কি হয়? মন্দিরের উত্তরে আমাদের একটা ফলের বাগান আছে, লোকজন ডেকে সাত-তাড়াতাড়ি সেই বাগানের মধ্যে একটা একচালা ঘর তুলে দেওয়া হল। কাকা এখন তাতেই থাকেন। পুজো-আচ্চা করেন, আর মাঝে-মাঝে হাঁক ছাড়েন ‘জয় শিবশম্ভু, জয় শঙ্কর’।” 

“আপনার কাকার বয়েস এখন কত?” 

“দাঁড়ান মশাই,” সত্যপ্রকাশ বললেন, “একটু হিসেব করে বলতে হবে। আমার যখন জন্ম হয়, আমার মায়ের বয়েস তখন সতেরো। তা আমার বয়স এখন ছেচল্লিশ। তা হলে আমার মায়ের বয়স হল গিয়ে ছেচল্লিশ প্লাস সতেরো অর্থাৎ তেষট্টি বছর। কাকা শুনেছি আমার মায়ের চেয়ে পাঁচ বছরের বড়। তা হলে হি শুড বি সিক্সটি এইট নাউ। 

“অর্থাৎ কলেজে পড়তে-পড়তে যিনি নিখোঁজ হয়েছিলেন, বছর পঞ্চাশেক বাদে তিনি ফিরে এসেছন। তা এই পঞ্চাশটা বছর তিনি ছিলেন কোথায়?” 

“হরিদ্বার, কনখল, ঋষিকেশ, এইরকম নানান জায়গায়। এক রমৃতা সাধুর সঙ্গে হস্টেল ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন, এলাহাবাদে তাঁর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। সেখান থেকে যান হরিদ্বারে। বলেন যে, ওই হরিদ্বারেই এক শৈব সাধুর কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন।” 

“শৈবদের তো নানান সম্প্রদায় রয়েছে,” ভাদুড়িমশাই জিজ্ঞেস করলেন, “ইনি কোন সম্প্রদায়ের সাধু?” 

“তা তো জানি না। তবে শুনেছি যে, সেই সাধুর সঙ্গেই তিনি ভৈরোঘাটে গিয়েছিলেন। ভৈরোঘাটের নাম শুনেছেন নিশ্চয়, জায়গাটা গঙ্গোত্রীর খুব কাছে। সেখানে এক গুহার মধ্যে বসে নাকি পুরো পাঁচ পছর একটানা তপস্যাও করেছেন। আর তার ফলে এমন একটা শক্তি পেয়েছেন, যা নাকি কেউ পায় না।” 

“শক্তিটা কী?” 

“তা কিছুতেই বলতে চান না। জিজ্ঞেস করলে শুধু হাসেন, আর বলেন, ‘জয় শঙ্কর’।”

“কদ্দিন এখানে থাকবেন বলেছিলেন?” 

“হপ্তাখানেক। এদিকে দিন দশ-বারো তো কেটে গেল, কিন্তু…” 

“কিন্তু এখান থেকে আর নড়তে চাইছেন না, কেমন?” 

“ঠিক ধরেছেন,” সত্যপ্রকাশ একটু কুণ্ঠিতভাবে বললেন, “আর সেটাই হয়ছে সমস্যা।”

ভাদুড়িমশাইয়ের চাউনিটা আবার ধারালো হয়ে উঠল। বললেন, “সমস্যা কীসের?” 

সত্যপ্রকাশ সেই একইরকম কুণ্ঠিতভাবে বললেন, “এমনিতে তো কোনও সমস্যা হবার কথা নয়। খান তো শুধু ফলমূল আর দুধ, যার জোগান আমরা হাসিমুখেই দিচ্ছি। আর থাকেনও তো বাড়ির বাইরে, বাগানের মধ্যে; কারও তাতে কোনও অসুবিধা হবার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আর তা ছাড়া, এটাও তো ঠিক যে, এখানকার যা-কিছু জমিজমা, তা আমার বাবা করেননি, করেছেন আমার ঠাকুর্দা। এই বাড়িও তাঁরই করা। তার মানে এই ভূসম্পত্তি আর এই ঘরবাড়ি, এর উপরে আমার যতটা অধিকার, কাকার অধিকার তার চেয়ে এক-কড়াও কম নয়। একেবারে ফিটি-ফিফটি মালিকানার ব্যাপার। সুতরাং তিনি তো থাকতেই পারেন।” 

“তা হলে তো মিটেই গেল, সমস্যাটা কোথায়?” 

“সমস্যা ওঁর চালচলন নিয়ে, সমস্যা ওঁর বিশ্বাস নিয়ে, সমস্যা ওঁর কথাবার্তা নিয়ে। মনসা আমাদের উপাস্য দেবী, আমার প্রপিতামহ বীরেশ্বর চৌধুরীর সময় থেকে আমরা মা-মনসার পুজো করে আসছি, সেই মনসাকেই উনি দু’চক্ষে দেখতে পারেন না। কী বলেন জানেন?” 

“কী বলেন?” 

“বলেন যে, ওটা দেবী নয়, ওটা ব্যাং-খেকো সাপ! শুধু যে আমাদের বাড়ির লোককেই বলেন, তা নয়, ত্রিশূল হাতে নিয়ে গোটা গাঁয়ে টহল মেরে বেড়ান, আর প্রত্যেককে বলেন, ‘ওটাকে ফেলে দে, তারপর ওই মন্দিরের মধ্যে শিব প্রতিষ্ঠা করে শিবের পুজো শুরু কর!’ মূর্তিটি নিখোঁজ হওয়ায় সবাই যখন ভয়ে একেবারে কাঁটা হয়ে আছে, আর ভাবছে যে, গোটা গ্রামের এতে ঘোর অমঙ্গল হবে, তখন কাকা কিন্তু দারুণ খুশি। আনন্দে তিনি লাফিয়ে বেড়াচ্ছেন। ভাবতে পারেন?” 

“পারব না কেন, খুব পারি। রামকৃষ্ণদেব বলেছেন, যত মত তত পথ। কিন্তু তাঁর মতো সহিষ্ণুতা আর ক’জন সাধক দেখাতে পেরেছেন? সাধকরা যদি-বা পারেন, তাঁদের চেলারা পারে না। চেলারা ভাবেন যে, তাঁরা যে ধর্মপন্থায় চলেছেন সেটাই ঠিক, আর বাদবাকি সমস্ত পথই ভুল পথ। অন্যের মত, অন্যের পথকে ব্যঙ্গবিদ্রুপ না করে তাঁদের শান্তি নেই। যদ্দুর বুঝতে পারছি, আপনার খুড়োমশাইটিও এই রকমের অসহিষ্ণু একজন মানুষ। তিনি সাধু হতে পারেন, কিন্তু সহিষ্ণু নন।” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “সহিষ্ণু নয় এখানকার গ্রামের লোকজনও। রামদাসের কাছে শুনলুম, মা-মনসা সম্পর্কে কাকা যে-সব ব্যঙ্গবিদ্রুপ করে বেড়াচ্ছেন, তারা তাতে খেপে গেছে। এমন কথাও তারা নাকি বলছে যে, এবারে ওই বাগানে ঢুকে তারা চালাঘরে আগুন লাগিয়ে দেবে। মা-মনসার নিন্দে তারা সহ্য করবে না।” 

ভাদুড়িমশাই একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “আপনি বলছিলেন যে, আপনার প্রপিতামহ বীরেশ্বর চৌধুরির আমল থেকে আপনারা মনসার পুজো করে আসছেন। তাই না?” 

“হ্যাঁ।” 

“তাঁর আগে আপনাদের পরিবারে এই পুজোর প্রচলন ছিল না?” 

“হয়তো ছিল, আমি জানি না।” সত্যপ্রকাশ বললেন, “তবে এইটে জানি যে, মনসা দেবীর এই মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আমার প্রপিতামহের আমলেই। মূর্তিটি তিনি কীভাবে পেয়েছিলেন, সেই গল্পও আমি বাবার মুখে শুনেছি। বাবা শুনেছিলেন আমার ঠাকুর্দার কাছে।” 

“কীভাবে পেয়েছিলেন? কোনও সাধু-সন্নিসির কাছ থেকে?” 

“না না,” সত্যপ্রকাশ বললেন, “আপনারা হয়তো বিশ্বাস করবেন না, আর বিশ্বাস না করলে আমি আপনাদের দোষও দেব না, তার কারণ, আমার নিজের মনেই এ নিয়ে অনেক দ্বিধা-সংশয় আর সন্দেহ রয়েছে। আমি বিশ-শতকের মানুষ; যা শুনেছি, আমি নিজেই তা বিশ্বাস করে উঠতে পারিনি। কোনও সাধু-সন্নিসি যদি একদিন আমার প্রপিতামহের দরজায় এসে দাঁড়াতেন আর তাঁর ঝোলার থেকে একটা মনসা মূর্তি বার করে আমার প্রপিতামহের হাতে তুলে দিয়ে বলতেন, ‘নে ব্যাটা, এই যে মুর্তিটা তোকে দিলুম, একে প্রতিষ্ঠা করে পুজো করতে থাক, তাতেই তোর দুঃখ-কষ্ট ঘুচে যাবে,’ তো সেটাকে আমি খুব অবিশ্বাস্য ব্যাপার বলে মনে করতুম না। এমন তো কতই ঘটে। কিন্তু যা শুনেছি, তা যে সত্যিই অবিশ্বাস্য ব্যাপার। কী বলব, এটা একেবারে অলৌকিকের পর্যায়ে পড়ে।” 

আবার সেই একই রকম তীব্র চোখে সত্যপ্রকাশের দিকে তাকালেন ভাদুড়িমশাই— বললেন, “কী শুনেছেন?” 

তখনই এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না সত্যপ্রকাশ। খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “আমার প্রপিতামহ একদিন রাত্তিরে একটা স্বপ্ন দেখেন। অদ্ভুত সেই স্বপ্ন। যেন এক। অন্ধকার পথ দিয়ে তিনি হাঁটছেন। কোথাও কোনও বাড়িঘর নেই, দু’পাশে শুধু উঁচু-উঁচু সব গাছ। যেন সেটা কোনও লোকালয় নয়, বিরাট একটা জঙ্গল। সেই জঙ্গল হঠাৎ আলোয় ঝলমল করে উঠল। ‘অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ যখন তীব্র কোনও আলোর ঝলক এসে পড়ে, তখন প্রথমটায় কিছুই ঠাহর হয় না। আমার প্রপিতামহেরও কিছু ঠাহর হয়নি। তাঁর দৃষ্টি বাঁধিয়ে গিয়েছিল, তিনি চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলেন। তারপর যখন চোখ খুললেন, তখন দেখতে পেলেন যে, সেই আলোর মধ্যে এক নারীমূর্তি দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাঁর গায়ের রঙ আবলুস কাঠের মতো কালো, কিন্তু রঙ কালো হলে কী হয়, তাঁর রূপের নাকি কেনাও তুলনা হয় না। চোখ দুটি টানা-টানা, নাকটি টিকোলো, ঠোঁট দুটি পাতলা, আর শরীর অসম্ভব রকমের সরু।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “জরৎকারু নামটা তো এইজন্যেই।” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “তার মানে?” 

“পরে বলব। স্বপ্নের সবটা আগে শুনি।” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “স্বপ্নে আমার প্রপিতামহ নাকি এও দেখতে পেয়েছিলেন যে, একটি সাপ সেই নারীমূর্তিকে বেষ্টন করে রয়েছে। সেই নারী তবু সারাক্ষণ হাসছিলেন। হাসতে হাসতেই আমার প্রপিতামহকে তিনি বললেন, ‘বীরেশ্বর, আমাকে তুমি উদ্ধার করো।’ প্রপিতামহ বললেন, তুমি কে?’ সেই নারী বললেন, ‘আমি মনসা। যে গ্রামে তুমি থাকো, তার দক্ষিণে যে ডাঙাজমি রয়েছে, তার বটগাছের তলায় আমি বন্দি হয়ে আছি। তুমি আমাকে উদ্ধার করে আনো।’ বলেই তিনি আলোর মধ্যে মিলিয়ে গেলেন, আর আমার প্রপিতামহেরও ঘুম তৎক্ষণাৎ ভেঙে গেল। তিনি দেখলেন যে, সকাল হয়েছে, সূর্য উঠেছে, জানলা দিয়ে রোদ্দুর এসে পড়েছে তাঁর ঘরের মধ্যে।” 

আমি বললুম, “তারপর?” 

“তারপরেই ঘটল আশ্চর্য সেই ঘটনা।” সত্যপ্রকাশ বললেন, “আমার প্রপিতামহ যে অমন একটা স্বপ্ন দেখেছিলেন, এর মধ্যে তো বিস্ময়ের কিছু নেই, এই ধরনের দেবদেবীর স্বপ্ন অনেকেই দেখে থাকে। কে জানে, সেই সময়ে তাঁদের গ্রামে হয়তো সাপের উপদ্রব খুব বেড়ে গিয়েছিল, গ্রামের লোকেরাও হয়তো বলাবলি করছিল যে, মা-মনসা নিশ্চয়ই খুব কুপিত হয়েছেন, তা নইলে এমন হত না, আমার প্রণিতামহের মনও হয়তো এই ধরনের চিন্তাতেই তখন তোলপাড় হচ্ছিল, আর তারই ফলে হয়তো অমন একটা স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। না মশাই, এমন স্বপ্ন অনেকেই দেখতে পায়, শুধু যে দেখতে পায় তা নয়, ঘুম ভাঙবার পরে স্বপ্নের উপরে আরও কিছু রং চড়িয়ে ফলাও করে সবাইকে তা বলেও বেড়ায় তারা। এই ধরনের স্বপ্নের গপ্পো আমি অনেক শুনেছি, আপনারাও নিশ্চয় শুনে থাকবেন। কিন্তু বীরেশ্বর চৌধুরির ক্ষেত্রে ঘটল এক আশ্চর্য ঘটনা। যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, বাস্তবের সঙ্গে সেটা মিলে গেল। তাঁদের গ্রামের দক্ষিণ দিকের মাঠের মধ্যে সতিই একটা উঁচু ডাঙাজমি ছিল। ডাঙাজমির উপরে বটগাছও ছিল একটা। সেই বটগাছের কাছে, স্বপ্নে যেমন-যেমন নিশানা পেয়েছিলেন সেই অনুযায়ী হাত-চারেক গভীর করে মাটি খুঁড়তেই ঠং করে একটা আওয়াজ হল, আর বীরেশ্বর চৌধুরিও অমনি শাবল ফেলে দিয়ে হাত দিয়ে সেখানকার ঝুরো-মাটি সরিয়ে গর্তের ভিতর থেকে তুলে আনলেন একটি পাথরের মুর্তি।” 

সত্যপ্রকাশ খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। আমরাও কেউ কোনও কথা বলছিলুম না। হাত বাড়িয়ে সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বার করলেন সত্যপ্রকাশ। সেটা ধরিয়ে বেশ বড় করে একটা টান দিলেন। গলগল করে ধোঁয়া ছাড়লেন। তারপর বললেন, “স্বপ্নে যে নারীমূর্তি তিনি দেখেছিলেন, অবিকল সেই মুর্তি। অতি অশ্চর্য মুর্তি। …এই ছবিটা দেখুন, তা হলেই বুঝতে পারবেন।” 

সত্যপ্রকাশ তাঁর টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটি ফোটোগ্রাফ বার করে আমাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “আমাদের মন্দির থেকে এই মূর্তিটা চুরি হয়েছে। মিঃ ভাদুড়ি, যেমন করেই হোক, এই মূর্তি আপনাকে উদ্ধার করে দিতে হবে।” 

৮ 

ফোটোগ্রাফটির দিকে তাকিয়ে আমার নিশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছিল। ভারতবর্ষের নানা জাদুঘরে আর মন্দিরে-মন্দিরে কত অসংখ্যা দেবদেবীর কত অসংখ্য মূর্তিই তো দেখেছি, কিন্তু এত অপরূপ মুর্তি আমি এর আগে কখনও দেখেছি বলে মনে হল না। দেবীমূর্তি এত অবিশ্বাস্য রকমের সুন্দর হয়। মনসার যে শারীর বিভঙ্গ এই বিগ্রহের মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠেছে, শুধু তা-ই যে আমার বিস্ময় জাগিয়েছিল, তা নয়, আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলুম তার গঠনসৌকর্য দেখেও। মূর্তিটির গড়ন একেবারে ষোলো-আনা নিখুঁত। কে এই কষ্টিপাথরের মূর্তি তৈরি করেছিলেন, তা হয়তো কোনও কালেই কেউ জানবে না, কিন্তু সেই ভাস্করের যে রূপকল্পনা এই মূর্তির মধ্যে ধরা পড়েছে, শুধু সেইটুকুর পরিচয় পেয়েই তাজ্জব মানবেন যে-কোনও শিল্প-সমালোচক। দন্ডায়মানা মনসা দেবীর কটিদেশ বেষ্টন করে তাঁর বক্ষের উপরে উঠে এসেছে একটি সাপ, আর সেই সাপের মুন্ডটিকে দক্ষিণ হস্তে ধারণ করে দেবী তার প্রসারিত ফণার দিকে তাকিয়ে আছেন। যেমন তাঁর চোখে, তেমনি তাঁর ওষ্ঠের বঙ্কিম ভঙ্গিমায় একটু হাসির আভাস। সে হাসি স্নেহের হাতে পারে, প্রশ্রয়ের হতে পারে, আবার কৌতুকেরও হতে পারে। 

চারু ভাদুড়ির চোখে যেন পলক পড়ছিল না। স্থির দৃষ্টিতে তিনি ফোটোগ্রাফটির দিকে তাকিয়ে ছিলেন। একসময়ে তিনি মুখ তুলে সত্যপ্রকাশের দিকে তাকালেন, তারপর মস্ত একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “পালযুগের মূর্তি।” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “অ্যাবসলিউটিলি রাইট।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “পন্ডিতদের কেউ-কেউ বলেন যে, মনসা পূর্ব-ভারতের দেবী নন, দক্ষিণ-ভারতে ‘মন্‌চা-অন্মা’ অর্থাৎ ‘মন্‌চা মা’ বলে যে দেবীর পুজো হত, তিনিই পরে এক সময়ে ‘মনসা’ নামে এই পূর্ব-ভারতের ধর্মজীবনের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন। তবে অনেকেই এ-মত মানতে চান না। একটা কথা অবশ্য ঠিক। সেটা এই যে, আমাদের এই বঙ্গভূমিতে এ-পুজোর প্রচলন বিশেষ ছিল না। অন্তত সমাজের যেটা উঁচু স্তর, তাতে ছিল না। দ্রাবিড়ভূমি থেকেই আসুক আর অন্য যে-কোনও জায়গা থেকেই আসুক, সমাজের সেই উঁচু স্তরে এ পূজার প্রচলন হয়েছে মোটামুটি পালযুগ থেকেই। তবে সেক্ষেত্রেও বলতে হবে যে আপনাদের এই মনসা-মূর্তির বয়স নেহাত কম হবে না।” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “মাস কয়েক আগে এক অধ্যাপক এদিকে এক চা-বাগানে তাঁর আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। ভদ্রলোক ইতিহাসের অধ্যাপক, ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে এনসেন্ট ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি পড়ান। তা খবর পেয়ে তিনি এই মূর্তিটিকে দেখতে আসেন। বললেন যে, ইন্ডিয়ার সব ক’টা বিখ্যাত মিউজিয়াম তাঁর দেখা আছে, কিন্তু কষ্টিপাথরে গড়া এমন আশ্চর্য মনসা-মূর্তি তিনি কোথাও দেখেননি।” 

আমি বললুম, “সত্যিই আশ্চর্য।” 

চারু ভাদুড়ি বললেন, “ভদ্রলোক আর-কিছু বলেননি?”

সত্যপ্রকাশ বললেন, “তখন-তখন বলেননি। পরে বলেছিলেন। আমি তো অনেকদিন আগেই এই মনসামূর্তির ফোটো তুলে অনেকগুলি প্রিন্ট করিয়ে রেখেছি, তা তার থেকে একটি প্রিন্ট তিনি চেয়ে নিয়ে যান। তার মাসখানেক বাদে কলকাতা থেকে একখানা চিঠি লিখে ভদ্রলোক আমাকে জানান যে, পালযুগ সম্পর্কে যে দু’জন অধ্যাপককে একালে অথরিটি বলে গণ্য করা হয়, তাঁদের দু’জনকেই তিনি প্রিন্টটি দেখিয়েছেন, আর দু’জনেই একবাক্যে বলেছেন, এ মূর্তি পালযুগের; সম্ভবত প্রথম মহীপালের সময়ে এটি তৈরি হয়েছিল।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “প্রথম মহীপাল তো পালবংশের দশম রাজা, যদ্দুর মনে পড়ছে ৯৮৮ থেকে ১০৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর আমলের একেবারে শেষ বছরেও যদি তৈরি হয়ে থাকে তো এ মূর্তির বয়েস তা প্রায় সাড়ে ন’শো বছর হল।” 

আমি বললুম, “একে তো এত সুন্দর মুর্তি, তায় আবার এত পাচীন, বিদেশের যে-কোনও জাদুঘর তো এমন মূর্তি পেলে সঙ্গে-সঙ্গে লুফে নেবে।”

“জাদুঘর তো আছেই,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “ব্যক্তিগত সংগ্রহের জন্যে যারা যে-কোনও দাম দিতে রাজি, আছে সেই কোটিগতিরাও। সত্যি বলতে কী, প্রত্নদ্রব্যগুলিকে আগলে রাখার ব্যাপারে আমাদের মতো গরিব দেশগুলির পক্ষে এখন ইউরোপ-আমেরিকার এই প্রাইভেট কালেকটররাই সবচেয়ে ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিউজিয়ামগুলো তবু আইন-কানুন মেনে চলে, এরা সে-সবের ধারই ধারে না।” 

“আপনাদের কি মনে হয় যে, তাদেরই কেউ এই মুর্তিটি সরিয়েছে?” 

সত্যপ্রকাশের প্রশ্ন শুনে ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “নিজের হাতে তারা সরাবে কেন, তার দরকারই বা কী? তাদের হয়ে যারা দেশের শিল্প চোরাই পথে বিদেশে চালান করে, সেই এজেন্টরাই তো রয়েছে।” 

“এটা তাদেরই কাজ?”

“তাদের কাজ হতে পারে, আবার নাও হতে পারে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনাদের মনসামূর্তির উপরে হামলাটা এসে থাকতে পারে একেবারে অন্যদিকে থেকেও।” 

দরজায় কে যেন টোকা মারল। 

হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলুম, সাড়ে বারোটা বাজে। এত রাতে কার কী দরকার পড়ল?

সত্যপ্রকাশ বললেন, “কে?” 

চাপা উত্তর এল, “আমি নিরু।” 

সত্যপ্রকাশ উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিয়ে বললেন, “কী ব্যাপার? …ও, এইজন্যে? তা ভালই করেছ।” 

নিরু এসে ঘরে ঢুকল। হাতে মস্ত ট্রে। তাতে তিন কাপ কফি, আর বড় দুটো প্লেট। একটা প্লেটে কিছু বিস্কুট, আর একটা প্লেটে শিলিগুড়ি থেকে আনা সেই ক্ষীরের শিঙাড়া। 

সেন্টার টেবিলে ট্রেটা নামিয়ে রাখল নিরু, তারপর সত্যপ্রকাশকে বলল, “খানিক আগে মা একবার ঘুম থেকে উঠেছিলেন। জানলা দিয়ে দেখলেন যে, আপনার বসবার ঘরে আলো জ্বলছে। তাই আমাকে তুলে দিয়ে বললেন, ‘সতু এখনও ঘুমোয়নি, বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছে, রাত জাগলে খিদে পায়, ওদের জন্যে বরং কফি আর হালকা কিছু খাবার দিয়ে আয় নিরু।’ আপনাদের যদি আরও কফি লাগে তো আমাকে ডাকবেন, আমি এসে দিয়ে যাব।” 

ভাদুড়িমশাই শশব্যস্ত হয়ে বললেন, “না না, এই যথেষ্ট, আর লাগবে না।” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “আমারও লাগবে না। তোমাকে তো সকাল-সকাল উঠতে হয়, তুমি শুয়ে পড়ো গিয়ে। মায়ের ঘরেই আজ শুয়েছ তো?” 

মৃদু গলায় নিরু বলল “হ্যাঁ।” তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। 

সত্যপ্রকাশ দরজা বন্ধ করে ফিরে এলেন। 

রাত জাগলে সত্যিই অনেকের খিদে পেয়ে যায়। সারা রাত্তিরের ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটে এইজন্যেই হয়তো ডিনার সার্ভ করার পরেও ঘন্টা তিন-চার বাদে আবার স্টুয়ার্ডেসরা হালকা কিছু-না-কিছু খাবার নিয়ে আসে। আমার অন্তত একটু-একটু খিদে পাচ্ছিল। প্লেট থেকে তাই একটা ক্ষীরের শিঙাড়া তুলে নিলুম। ভাদুড়িমশাই কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বললেন, “যা বলছিলা। মুর্তিটা যে চোরাই পথে চালান দেবার জন্যেই সরানো হয়েছে, এমন নাও হতে পারে। এমনও হতে পারে যে, বিদেশি ধনকুবেরদের কাছে বিক্রি করে পয়সা পিটবার কোনও অভিসন্ধিই এক্ষেত্রে ছিল না, অন্য কোনও কারণে আপনাদের মনসা-মূর্তি চুরি করা হয়েছে। তা-ই যদি হয়, তো আমি অন্তত অবাক হব না।” 

কফি খেতে-খেতে যেন বিষম খেলেন সত্যপ্রকাশ। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “অন্য কোনও কারণে? কী বলছেন আপনি, আমি তো ঠিক বুঝতে পারছি না। আর কী কারণ থাকতে পারে মশাই?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “পরে বলব। আর তা ছাড়া, এখনই যে আমি তেমন কোনও কারণ সম্পর্কে একেবারে নিশ্চিত হতে পারছি, তাও তো নয়। সুতরাং পরে তা নিয়ে ভাবলেও কোনও ক্ষতি নেই। অর্থলোভে এই ধরনের চুরি আজকাল আকছার হচ্ছে, এটাই স্বাভাবিক ব্যাপার, সুতরাং আপাতত এই নিয়েই ভাবনা-চিন্তা করা যাক। কিন্তু তার আগে একটা কথা আমায় বলুন। জরৎকারু তো বর্ধমানের গ্রামে ছিলেন, সেখান থেকে এই মুকুন্দপুরে তিনি এলেন কবে?” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “দেখুন মশাই, হেঁয়ালি করবেন না। এই জরৎকারু নামটা আপনি আগেও একবার বলেছেন, কিন্তু আমি তো ও নামে কাউকে চিনি না। কে তিনি?” 

ভাদুড়িমশাই আমার দিকে তাকালেন। চোখে কৌতুকের ঝিলিক। বললেন, “আপনি জানেন কিরণবাবু?”

বললুম, “আমার কৌলিক পদবি যখন চাটুজ্যে, আর গোত্র যখন কাশ্যপ, তখন আর আমার না জেনে উপায় কী?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “থাক থাক, যেটুকু বলেছেন, তাতেই বুঝতে পারছি যে, আপনি জানেন। শুনুন সত্যপ্রকাশবাবু, মনসা হচ্ছেন মহর্ষি কশ্যপের মানসী কন্যা, আর এই কন্যাটির আর-এক নাম হল জরৎকারু। তবে কিনা জরৎকারু নামে এক মুনিও ছিলেন, আর সেই মুনির সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল মনসা দেবীর। ব্যাপারটা তা হলে কী দাঁড়াল?” 

হেসে বললুম, “কী আর দাঁড়াল, জরৎকারুর সঙ্গে জরৎকারুর বিয়ে হল।” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “যাচ্চলে, স্বামী-স্ত্রীর একই নাম? এমনও হয় নাকি?” 

“হবে না কেন,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ যেখানে কলকাঠি নাড়ছেন, সেখানে সবই হয়। আসলে আমাদের এই জরৎকারু-মুনি ছিলেন খুবই রোগাভোগা পাতলা চেহারায় মানুষ। হয়তো সেই জন্যই তিনি ঠিক করেছিলেন যে, বিয়ে-থা করবেন না। পরে অবশ্য পাঁচজনের চাপে পড়ে তিনি মত পালটালেন, কিন্তু সেই সঙ্গে আবার এমন একটা শর্ত দিলেন যা মেটানো শক্ত। কিনা যাঁকে বিয়ে করবেন, সেই কন্যাটির নামও জরুৎকারু হওয়া চাই। মুনি বোধহয় ভেবেছিলেন যে, অমন নামের মেয়ে কোথাও মিলবে না, ফলে তাঁকেও আর বিয়ের ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে হবে না।” 

“কিন্তু পড়তে তো হল।” 

“হবেই তো। না হয়ে উপায় কী। কশ্যপের একটি কন্যা হয়েছে শুনে শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে দেখতে এলেন। দেখে বললেন, আরে, মেয়ে তো অতি সুন্দরী, তবে কিনা বড্ড রোগা, একেবারে জরুৎকারু মুনির মতো হয়েছে দেখেছি। ঠিক আছে, আমি ওকে জরৎকারু বলেই ডাকব।” 

আমি বললুম, “আমার তো মনে হয় কৃষ্ণ এ-কাজটা সব জেনেশুনেই করেছিলেন।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “সে আর বলতে! জরৎকারুর শর্তের কথাটা জেনে গিয়েছিলেন নিশ্চয়, তাই মনসার ওই একই নামকরণ করে পথটা একেবারে মেরে রাখলেন, যাতে কিনা বিয়েটা মুনিকে করতেই হয়, কিছুতেই তিনি ছটকে বেরিয়ে যেতে না পারেন।” 

বললুম, “তা-ই হবে। নইলে ভাবুন, ‘মনসা’র মতো সুন্দর যাঁর নাম, তাঁকে আবার ‘জরৎকারু’র মতো বিদঘুটে নাম দেবার কোনও মানে হয়?”

সত্যপ্রকাশ বললেন, “এ যেন যে-মেয়ের এক নাম সুহাসিনী, তার আর-এক নাম জগদম্বা।”

আমি বললুম, “প্রাচীন পুরাণে অবশ্য মনসার কোনও উল্লেখ নেই। দেবী মনসার জন্ম, বিবাহ আর নামের যে-কথা ভাদুড়িমশাই শোনালেন, তার সবই পাওয়া যাচ্ছে অনেক পরবর্তী কালের পুরাণে। সেখানেও অবশ্য মতভেদের অন্ত নেই।”

“ও কথা থাক,” ভাদুড়িমশাই হাই তুলে বললেন, “একটা বাজে। আমার প্রশ্নের উত্তরটা এখনও পাইনি।” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “মনসা-মূর্তি কবে বর্ধমানের গ্রাম থেকে এখানে এল, এই তো? এখুনি সেটা বলছি। বাকি কথা না হয় কাল হবে। মনে হচ্ছে আপনাদের ঘুম পেয়েছে। তা হলে বরং শুয়ে পড়ুন।” চারু ভাদুড়ি বললেন, “না না, ঘুম একটু পাচ্ছিল বটে, তবে কফি খেয়ে সেটা কেটে গেছে। আপনি বলে যান।”

“বলুন বলুন, ভাদুড়িমশাইয়ের একটা হাই উঠেছিল বটে,” আমি বললুম, “কিন্তু আমার একটুও ঘুম পায়নি।” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “আমার প্রপিতামহ বীরেশ্বর চৌধুরি খুব বেশিদিন বাঁচেননি। মাটি খুঁড়ে এই মনসা-মূর্তি উদ্ধার করবার বছর পাঁচেক বাদেই তিনি মারা যান। তাঁর বয়স তখন বছর পঞ্চাশ, আর আমার পিতামহ মহেশ্বর চৌধুরির বয়স তখন বছর কুড়ি।” 

ভাদুড়িমশাই জিজ্ঞেস করলেন, “বীরেশ্বর চৌধুরির কি তিনিই একমাত্র সন্তান?” 

“না,” সত্যপ্রকাশ বললেন, “আমার পিতামহের জন্মের আগে আরও দুটি ছেলে হয়েছিল বীরেশ্বরের, কিন্তু শৈশব পেরোবার আগে তাদের মৃত্যু ঘটে। ছেলে বলতে একমাত্র আনার ঠাকুর্দাই তখন জীবিত। আর ছিল এক মেয়ে। মেয়েটি বালবিধবা। আমার ঠাকুর্দার চেয়ে বছর দুয়েকের ছোট। দশ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়েছিল; তার মাত্র এক বছর বাদেই তাঁর সিঁথির সিঁদুর মুছে যায়। যেমন আমার গিসিমা, তেমনি আমার বাবার পিসিমাও তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পর আর শ্বশুরবাড়িতে থাকেননি, পিত্রালয়ে চলে এসেছিলেন।” 

“আপনার ঠাকুর্দার ইতিমধ্যে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল নিশ্চয়?” 

“না। বিয়ে করবার কোনও ইচ্ছাও তখন নাকি তাঁর ছিল না। সংসারে এই বিধবা বোনটিই তখন তাঁর একমাত্র আপনজন। বোনকে তিনি ভীষণ ভালবাসতেন। হয়তো তাঁর ভয় ছিল যে, দাদার সংসারে বোন যতটা স্নেহ আর আদর-যত্ন পাচ্ছে, বৌদির সংসারে সেটা পাবে না। হয়তো সেইজন্যেই তিনি বিয়ে করতে চাননি। হয়তো ভেবেছিলেন যে, বিয়ে না করেও তো স্বচ্ছন্দে কত লোকের জীবন কেটে যায়, তাঁরও কেটে যাবে।” 

“কিন্তু কাটেনি, কেমন?”

“সত্যিই কাটেনি।” সত্যপ্রকাশ বললেন, “আমার প্রপিতামহের মৃত্যুর মাত্র বছর দেড়েক বাদেই তিনি গৃহত্যাগ করেন। যাবতীয় স্থাবর সম্পত্তি পিছনে পড়ে রইল। শুধু যা-কিছু তিনি সঞ্চয় করেছিলেন কিংবা আমার প্রপিতামহের কাছ থেকে পেয়েছিলেন, সেই টাকাকড়ি আর মনসাদেবীর মূর্তিটিকে সঙ্গে নিয়ে একদিন রাত-দুপুরে তিনি তাঁর গ্রাম থেকে বেরিয়ে পড়লেন। প্রথমে বর্ধমান শহর, তারপর কলকাতা, তারপর আরও কয়েকটা জায়গায় ঠেক খেতে-খেতে চলে এলেন এই মুকুন্দপুরে।” 

জিজ্ঞেস করলুম, “চলে তো এলেন। কিন্তু কেন? নেহাতই ভাগ্যান্বেষণে?” 

এক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন সত্যপ্রকাশ। তারপর ভীষণ ক্লান্ত গলায় বলেন, “সকলকে আমরা তা-ই বলি বটে, কিন্তু আপনারা তো আর সকলের মতো নন, ভীষণ একটা বিপদে পড়ে আমি আপনাদের ডেকেছি, সেই বিপদ থেকে আমাকে উদ্ধার করবার জন্যে আপনারা এখানে এসেছেন, তাই আপনাদের কাছে কিছু গোপন করা আমার উচিত হবে না।” 

ভাদুড়িমশাই ব্যস্ত হয়ে বললেন, “না না, আপনার যদি কোনও অসুবিধে থাকে তো…” 

সত্যপ্রকাশ সেই একই রকমের ক্লান্ত গলায় বললেন, “সুবিধে-অসুবিধের ব্যাপার তো নয় মিঃ ভাদুড়ি, এটা একটা লজ্জার কথা, যা হয়তো আমাদের পরিবারেও আর কেউ জানে না, সম্ভবত আমার বাবাও জানতেন না, একমাত্র আমিই জানি। আসলে আমাদের পরিবারের একটা স্ক্যান্ডাল এই ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে।” 

৯ 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “দেখুন সত্যবাবু, মূর্তি উধাও হবার সঙ্গে যদি আপনাদের এই পারিবারিক ঘটনা…মানে ওই যাকে আপনি ‘স্ক্যান্ডাল’ বলছেন সেই ব্যাপারটার কোনও সম্পর্ক না থাকে, তা হলে তার বিষয়ে আমাদের কোনও কৌতূহল থাকবে কেন? না না, ও-সব আমরা শুনতে চাই না।” 

সত্যপ্রকাশ ইতিমধ্যে কিছুটা সামলে উঠেছিলেন। বললেন, “বলতে যখন বসেছি, তখন সবটাই বলব। আর তা ছাড়া মূর্তিটিকে সঙ্গে করে আমার ঠাকুর্দা কেন তাঁর পৈতৃক ভিটে ছেড়ে হঠাৎ উত্তরবঙ্গে চলে এসেছিলেন, সব কথা খুলে না বললে হয়তো তা নিয়েও আপনাদের মনের মধ্যে কিছু না কিছু সন্দেহ থেকে যেতে পারে।” 

আমি বললুম, “আরে ছিছি, সন্দেহ আবার কিসের?” 

“এই ধরুন, আপনারা ভাবতে পারেন যে, ও-সব স্বপ্নাদেশ-টপ্নাদেশ সব বাজে গালগপ্পো, আসলে একেবারে গোড়াতেই এই মনসামূর্তি একটি চোরাই মাল, যা কিনা বর্ধমানের কোনও মন্দির থেকে আমার কোনও পূর্বপুরষ একদিন হাপিস করে দিয়েছিলেন।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা আমরা ভাবব না।” 

“কেন ভাববেন না? ভাবাটা তো কিছু অস্বাভাবিক নয়।” 

“এই জন্যে ভাবব না যে, চোরাই মালের পাবলিসিটি কেউ চায় না। তাই না?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “অথচ আপনি যখন কলকাতার সেই ইতিহাসের অধ্যাপককে আপনাদের মনসামূর্তির একটি ফোটোগ্রাফ দিয়েছিলেন, তখন আপনি ভালই জানতেন যে, মূর্তিটি যদি সত্যিই খুব প্রাচীন হয়, তা হলে তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হবে, চাই কী খবরের কাগজে সেই ছবিটা হয়তো ছাপাও হয়ে যেতে পারে। আর তা যদি হয়, তা হলে বর্ধমান থেকেই কেউ হয়তো বলে বসবে যে, সেখানকার এক মন্দির থেকে ওই মূর্তি চুরি গিয়েছিল। বলুন, এমন একটা সম্ভাবনা কি ছিল না?” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “হ্যাঁ, তা ছিল বটে।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু তবু আপনি ফোটোগ্রাফটি তাঁকে দিয়েছিলেন। ফোটোগ্রাফটি যে ছাপা হতে পারে, তা জেনেও দিয়েছিলেন। তার কারণ, আপনি একেবারে ষোলো-আনা নিশ্চিত ছিলেন যে, অমন কথা কেউ বলবে না, কেননা মূর্তিটি সত্যিই মাটি খুঁড়ে পাওয়া, ওটি চোরাই মাল নয়।” 

“তা হলে কি সেই ঘটনাটার কথা বলব না?” 

“বলবার দরকার এমনিতে নেই। কিন্তু ঠিক আছে, না-বলা পর্যন্ত যখন একটা অস্বস্তি আপনার থেকেই যাচ্ছে, তখন বলুন।” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “হ্যাঁ, বলাই ভাল। ব্যাপারটা আসলে আমার বাবার সেই বালবিধবা পিসিকে নিয়ে। আমি তো বলেছি যে, মাত্র এগারো বছর বয়সে তাঁর স্বামীকে হারিয়ে তিনি বাপের বাড়ি চলে আসেন। আমার পিসির সঙ্গে আমার বাবার পিসির এইখানে মস্ত মিল। আর মস্ত অমল এইখানে যে, আমার পিসি যেমন এই সংসারটাকে তাঁর নিজের সংসার করে নিলেন, আর সেই সঙ্গে পুজো-আচ্চা নিয়েই হাসিমুখে কাটিয়ে দিলেন তাঁর জীবন, আমার বাবার পিসি সেটা পারেননি।” 

এই পর্যন্ত বলে একটুক্ষণের জন্য চুপ করে রইলেন সত্যপ্রকাশ। আবার একটা সিগারেট ধরালেন। চুপচাপ সিগারেট টানলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, “আমার পপিতামহ বীরেশ্বর চৌধুরির মৃত্যুর কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর সেই বালবিধবা কন্যাটি গৃহত্যাগ করেন।”

আমি বললুম, “এই ব্যাপার? এর জন্যে আপনি এত সংকোচ বোধ করছিলেন কেন? এ তো অতি স্বাভাবিক ঘটনা। একটি মেয়ের স্বামী মারা গেছে, তাও সে মারা গেছে মেয়েটির বয়স যখন নেহাতই অল্প, তখন। স্বামীর সঙ্গে তার যে কোনও সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তাও নয়। নতু। করে সে যদি আবার কারও সঙ্গে সংসার পাততে চায় তো পাতুক না, এর মধ্যে তো অস্বাভাবিক কিছু নেই। আর তা ছাড়া, যদ্দুর মনে পড়ছে বিদ্যাসাগরমশাইয়ের চেষ্টায় ১৮৫৬ সালেই তো বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয়েছিল। তাই না?” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “তা হয়েছিল।” 

“তবে আর তার গৃহত্যাগেরই বা দরকার হল কেন? আইনমোতাবেকই তো আপনার প্রপিতামহ আর পিতামহ একটু উদ্যোগী হয়ে তার বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারতেন।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনি কি স্বপ্নলোকে বাস করছেন নাকি কিরণবাবু? সেখান থেকে একটু বাস্তবে নেমে আসুন। নামলে বুঝতে পারবেন যে, আইন পাশ করানোই যথেষ্ট নয়, সমাজকে দিয়ে সেটা গ্রহণ করিয়ে নেওয়া চাই। বিদ্যাসাগরমশাই তার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন, কষ্টও নেহাত কম ভোগ করেনি, কিন্তু এই পোড়া সমাজ যে তবু বিধবা বিবাহের ব্যাপারটাকে দীর্ঘকাল ধরে মেনে নেয়নি, এখনও নানা জায়গায় মেনে নেয় না, এটাই হচ্ছে সত্যি কথা। তার উপরে আবার যেখানকার কথা হচ্ছে, সেটা কলকাতা শহর নয়, নেহাতই গ্রামঞ্চল।” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “ঘটনাটা নিয়ে গোটা তলাটে একেবারে ঢিঢি পড়ে যায়। সমাজের যাঁরা কর্তাব্যক্তি, আমার পিতামহকে তাঁরা জাতিচ্যুত করলেন, তাঁকে একঘরে করা হয়েছিল। তাঁর বাড়িতে কেউ জলগ্রহণ করত না, তাঁরও কোনও অধিকার ছিল না অন্য কারও বাড়িতে ঢুকবার। এই যে ঘটনা, এর বেদনা, অপমান আর গ্লানি তিনি সহ্য করতে পারেননি! জমিজমা ঘরবাড়ি সব পিছনে ফেলে রেখে শুধু কিছু টাকাকড়ি আর মনসামূর্তিটি সঙ্গে নিয়ে একদিন গভীর রাত্রে তিনি তাঁর পিতৃপুরুষের ভিটে ছেড়ে চলে আসেন।” 

“তখনও তিনি বিবাহ করেননি?” 

“না। সে-কথা বোধহয় আগেই আপনাদের বলেছি। বিবাহ করেন তার বেশ কিছুকাল পরে।”

“আপনি এত সব কথা জানলেন কী করে সত্যবাবু?” ভাদুড়িমশাই জিজ্ঞেস করলেন, “বিশেষ করে আপনার প্রপিতামহের বালবিধবা কন্যাটির গৃহত্যাগের কথা? একটু আগেই আপনি বলছিলেন যে, আপনাদের এই পারিবারিক স্ক্যান্ডালের কথা আপনার বাবাও সম্ভবত জানতেন না। তা হলে আপনি কী করে জানলেন?” 

“আমি জেনেছি আমার পিতামহের ডায়েরি পড়ে।” সত্যপ্রকা। বললেন, “পুরনো কিছু বইপত্তর, পঞ্জিকা আর কাগজপত্রের সঙ্গে এই ডায়েরিখানাও একটা তোরঙ্গের মধ্যে আমি পেয়ে যাই। ঠাকুর্দার মৃত্যুর পর বাবা একদিন তোরঙ্গটা খুলেছিলেন। কিন্তু বই-টই সম্পর্কে তাঁর তো স্টিশেষ আগ্রহ ছিল না, তাই আর কিছু হাট্‌কে দেখেননি। যেমন খুলেছিলেন, তেমনি আবার ডাল। বন্ধ করে তালাচাবি দিয়ে দেন। আমি একদিন তোরঙ্গটা সম্পর্কে বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলুন, শতে তিনি বললেন, ওর মধ্যে সেকানে লেখা গুটিকয় বই ছাড়া আর কিছু নেই।” 

“তোরঙ্গটা ছিল কোথায়?” 

“এই বাড়িতেই ছিল। আমাদের ঘরগুলো সব দেখেছেন তো, এর ছাত টিনের, কিন্তু সিলিং কাঠের। ওই টিন আর কাঠের মাঝখানে বিস্তর জায়গা থেকে যায়, ওই মানে নিচু ছাতের অ্যাটিকের মতন অনেকটা জায়গা। নিত্য যেসব জিনিসের দরকার হয় না, সেগুলো আমরা ওইখানে তুলে রাখি। তোরঙ্গটাও ছিল ওইখানেই।” 

“ওটা খুলবার কথা আপনার মনে হল কেন?”

“এমনিতে তো মনে হবার কথা নয়,” সত্যপ্রকাশ বললেন, “মনে হতও না। কিন্তু হল কী, বছর তিনেক আগে কলকাতা থেকে এক ভদ্রলোক এদিকে এলেন। ভদ্রলোক পুরনো বইয়ের কারবারি। যে-কোনও পুরনো বই নয়, ওই যাকে আপনারা ‘দুষ্প্রাপ্য’ বলেন আর কী। তা জেলায় জেলায় তিনি সেই ধরনের রেয়ার বুকসের সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন।” 

বললুম, “পেয়েও যাচ্ছিলেন নিশ্চয়?” 

“তা পচ্ছিলেন বই কী! বেশির ভাগই পাচ্ছিলেন পুরনো আমলের সব জমিদার-বাড়ি থেকে। সেকালের জমিদারদের সব্বাই যে শুধু ফূর্তিফার্তা করে আর বাই নাচিয়ে সময় কাটাতেন তা ভাববেন না, তাঁদের অনেকেই রীতিমতো লেখাপড়ার চর্চা করতেন, বাইরে থেকে নিয়মিত বই আনাতেন, বাংলা বই তো ছিলই, থ্যাকার স্পিংক আর নিউম্যানের দৌলতে তাঁদের ইংরেজি বইনের কালেকশন ও নেহাত খারাপ ছিল না।” 

“ভদ্রলোক সে-সব বই কিনে নিচ্ছিলেন?” 

“জলের দরে কিনছিলেন।” সত্যপ্রকাশ বললেন, “বংশধরদের অনেকেই তো অপদার্থ। ফলে যা হয় আর কি।” 

ভাদুড়িমশাই জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার সঙ্গে তাঁর আলাপ হল কোথায়?” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “কোচবিহারে। একটা কাজে ওদিকে গিয়েছিলুম। ঘটনাচক্রে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল। তা আলাপ হবার পরে তাঁর পরিচয় জেনে ভাবলুম, ভদ্রলোক তো জহুরি মানুষ, আমার ঠাকুর্দার তোরঙ্গে যে-সব বই রয়েছে, সেগুলি একবার ওঁকে দেখিয়ে নিলে মন্দ হয় না। তা তিনিও খুব উৎসাহ করে আমার সঙ্গে আমাদের এই বাড়িতে চলে এলেন। রামদাসকে দিয়ে সিলিংয়ের উপর থেকে নামানো হল সেই তোরঙ্গ। খুলে দেখা গেল, বই যা রয়েছে, তার কোনওটাই খুব দুষ্প্রাপ্য নয়, বাজারে তার প্রায় সবগুলিরই রিপ্রিন্ট পাওয়া যায়, ওই শুধু ফার্স্ট এডিশনের বই বলেই তার যা-কিছু দাম। বইয়ের সঙ্গে অবশ্য পুরনো দুখানা পুঁথিও পাওয়া গিয়েছিল। দুখানাই মনসামঙ্গলের। মূল নয়, সে-কথা বলাই বাহুল্য। হাতে লেখা কপি। বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গলের কপি। তা সেই কপির বয়সও নাকি তা প্রায় আড়াইশো বছর হল। ভদ্রলোক সে দুখানা কিনতে চেয়েছিলেন। আমি বেচিনি। ভাবছি, এশিয়াটিক সোসাইটিকে দিয়ে দেব। তোরঙ্গের মধ্যে আর যে বস্তুটি পেয়েছি, তা আমার পিতামহের ওই ডায়েরি।” 

“ডায়েরিটি এখন কোথায়?” ভাদুড়িমশাই জিজ্ঞেস করলেন। 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “পাছে আর কারও হাতে পড়ে, তাই শিলিগুড়িতে আমার ব্যাঙ্কের লকারে রেখে দিয়েছিলুম। তবে আপনাদের কাজে লাগতে পারে ভেবে লকার থেকে আজই বার করে আমার সঙ্গে নিয়ে এসেছি। আপনারা দেখবেন?”

“এখন দেখব না,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “যদি দরকার বুঝি তো পরে দেখব। আপাতত শুধু দুটি প্রশ্ন করব আপনাকে।” 

“করুন।” 

“আমার প্রথম প্রশ্ন, আমি যে কলকাতায় আছি, তা আপনি জানলেন কী করে? কলকাতার কোন্ ফোন-নম্বরে ট্রাঙ্ককল করলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে তা-ই বা আপনাকে কে জানাল?” 

একগাল হেসে সত্যপ্রকাশ বললেন, “আরে মশাই, আপনি বিখ্যাত লোক, বীরভূমের মন্দির থেকে উধাও হওয়া বিষ্ণুমূর্তির সন্ধান করতে যে আপনি ব্যাঙ্গালোর থেকে কলকাতায় এসেছেন, সে খবর তো দিন সাতেক আগেই কাগজে দেখেছিলুম।” 

বললুম, “মূর্তিটি যে উদ্ধার হয়েছে তা জানেন?”

“জানি বই কী। যে প্লেনে আপনারা কলকাতা থেকে এলেন, সেই প্লেনেই তো আজকের কাগজ এল। আপনাদের হোটেলে রেখে আমার অফিসে ফিরে গিয়ে কাগজ খুলে দেখি, খবরটা তাতে খুব ফলাও করে বেরিয়েছে।” 

“কিন্তু কলকাতায় যে বাড়িতে আমি উঠেছি,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তার ফোন নাম্বার আপনাকে কে দিল?” 

“দিল আমার বড়মেয়ে সুজাতা। একে তো তার শ্বশুরবাড়ি আপনার বোনের বাড়ির খুব কাছেই, ট্রায়াঙ্গুলার পার্কের দক্ষিণে, তার উপরে আবার তার ছোট দেওর রন্টু নাকি আপনার ভাগ্নের ক্লাস-ফ্রেন্ড। সকালবেলা সুজাতাকে ফোন করেছিলুম, তাতে সে রন্টুর কাছ থেকে আপনার বোনের বাড়ির ফোন-নাম্বারটা জেনে নিয়ে আমাকে বলল, ‘এক্ষুনি এই নাম্বারে একটা ফোন করো, বাবা, রন্টুর বন্ধুর মামা মিঃ ভাদুড়ি একজন নামজাদা গোয়েন্দা, তিনি নিশ্চয় আমাদের মনসামূর্তি উদ্ধার করে দিতে পারবেন।’ ব্যাস, তার আধঘন্টার মধ্যেই সেই নাম্বারে আমি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করলুম।” 

বলে হোহো করে হেসে উঠলেন সত্যপ্রকাশ। হাসতে হাসতে বললেন, “ইট্‌স এ স্মল ওয়ার্লড, মিঃ ভাদুড়ি!”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন রঙ্গিলা সম্পর্কে। তার অসুখটা কীসের?” 

সত্যপ্রকাশের হাসিটা নিমেষে মুছে গেল। বিষণ্ণ গলায় বললেন, “মূর্তিটি চুরি করবার জন্য মন্দিরে যে ঢুকেছিল, রঙ্গিলা তার সামনে পড়ে যায়, মেয়েটাকে জখম করে সে পালিয়েছে। মাথা ফেটে মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে যায়।” 

“এখন কেমন আছে?” 

“বেঁচে আছে। কিন্তু কাউকে চিনতে পারছে বলে মনে হয় না। সম্ভবত স্মৃতিভ্রংশের ব্যাপার। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কোনও কথাও বলছে না।” 

“চোরকে সে দেখেছিল?” 

“মনে তো হয় দেখেছিল। অবশ্য পিছন থেকে যদি আঘাত করে থাকে তো অন্য কথা। তবে মাথার যে জায়গায় লেগেছে তাতে মনে হয়, সামনে থেকেই ভারী কিছু দিয়ে মেরেছে।” 

ভাদুড়িমশাইয়ের চাউনি আবার ধারালো হয়ে উঠেছে। তবে একটু বাদেই সেটা আবার স্বাভাবিক হয়ে এল। বললেন, “রঙ্গিলা যদি সুস্থ হয়ে ওঠে, তা হলে একমাত্র ওর পক্ষেই মূর্তিচোরকে শনাক্ত করা সম্ভব, তাই না?” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “সে তো বটেই। অবশ্য চোর যদি স্থানীয় লোক হয় তবেই রঙ্গিলা তাকে শনাক্ত করতে পারবে।” 

“আমার ধারণা, চোর স্থানীয় লোক।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “অন্তত সেই সম্ভাবনাই চোদ্দো আনা।” 

“কিন্তু ও তো এখন কাউকে চিনতেও পারছে না, কথাও বলতে পারছে না।” 

এতক্ষণে একটু হাসি ফুটল চারু ভাদুড়ির মুখে। রহস্যময় হাসি। বললেন, “সেই জন্যেই আপাতত ওকে নিয়ে আমার কোনও দুশ্চিন্তা নেই।” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “কথাটার মানে বুঝলাম না।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “এখন আপনার না-বুঝলেও ক্ষতি নেই। শুনুন সত্যবাবু, আপনাদের পারিবারিক ইতিহাস তো শুনলুম, মনসামূর্তির পশ্চাৎপট সম্পর্কে স্পষ্ট একটা ধারণাও তাতে হল, তবে চুরির ব্যাপারে ডিটেলস আর এখন শুনব না, কালকের জন্যে ওটা মুলতুবি থাক। রাত দুটো বাজে, এবারে আমরা শুয়ে পড়ব।” 

তারপব কিছু একটা ভেবে বললেন, “ঠিক আছে, ডায়েরিটা দিন, কিছু একটা ক্ল হয়তো ওর মধ্যে পেয়েও যেতে পারি।” 

সত্যপ্রকাশ তাঁর টেবিলের টানা থেকে ডায়েরিটা বার করে আনলেন। মোটা লাল কাপড়ে মোড়া একটা খাতা। সেই খেরোর খাতাখানা ভাদুড়িমশাইয়ের হাতে দিয়ে বললেন, “সাবধানে রাখবেন, আপনারা ছাড়া আর কারও হাতে না পড়ে।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বিলক্ষণ। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। কোথায় শোব, সে তো জেনেই গেছি। আপনাকে আর কষ্ট করে পৌঁছে দিতে হবে না। আসি তা হলে।” 

সত্যপ্রকাশ তবু বারান্দা পর্যন্ত এলেন। 

উঠোনে যে হ্যাজাক জ্বালানো হয়েছিল, সেটা নিবিয়ে দেওয়া হয়েছে। টর্চের আলোয় পথ দেখে আমরা ভিতরকার উঠোনের পুব দিকের ঘরে এসে ঢুকলুম। 

ঘরের মধ্যে হ্যারিকেন জ্বলছে। তবে জানালাগুলো সবই বন্ধ। সম্ভবত ঠান্ডা আটকাবার জন্য। ঘরের দরজায় খিল তুলে দিয়ে বললুম, “বড্ড গুমোট লাগছে। অন্তত একটা জানালা খুলে দেওয়া দরকার।” 

ভাদুড়িমশাই চাপা গলায় বললেন, “তার আগে হ্যারিকেনটা নেবান। এক্ষুনি। কথা বলবেন না।” আলোটা নিবিয়ে দিতে-দিতেই লক্ষ করলুম, ভাদুড়িমশাই ভিতরের উঠোনের দিকের একটা জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। ঘর অন্ধকার। তবু তারই মধ্যে ঠাহর করা গেল যে, সেই জানালার একটা পান্না সামান্য ফাঁক করে সেখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। মিনিট দুয়েক সেইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে তিনি পাল্লাটা ফের নিঃশব্দে ভেজিয়ে দিয়ে আপন মনেই বললেন, “ও, এই ব্যাপার।” 

আমি বললুম, “কী ব্যাপার?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিছু না। নিন, এবারে আলো জ্বালুন। তারপর যতগুলি খুশি জানালা খুলে দিন।”