মুকুন্দপুরের মনসা – ৩০

৩০

রাত সাড়ে আটটায় সত্যপ্রকাশ আমাদের ডাকতে এলেন। চেহারা দেখেই বুঝতে পারছিলুম যে, ভদ্রলোক একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছেন। পর-পর যে-সব খবর তাঁকে দেওয়া হয়েছে, তার ধাক্কা তিনি এখনও ঠিক সামলে উঠতে পারেনি। যার আশা তিনি প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন, সেই পঞ্চাশ লাখ টাকা ব্যাঙ্ক-লোনের ব্যবস্থা হয়ে গেল, অথচ তার জন্যে একটা পয়সাও কাউকে খাওয়াতে হল না, তার উপরে আবার দাঙ্গাবাজ যে পাওনাদারটির ভয়ে ভদ্রলোক একেবারে কাঁটা হয়ে ছিলেন, সেই সম্পৎলালও বেঁছে নেই, তিনবাত্তির মোড়ে মাথা ফাটবার আশঙ্কাটাও অতএব এক নিমেষে ঘুচে গেল, সত্যপ্রকাশ সম্ভবত বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে, স্রেফ একটা দিনের মধ্যেই পর-পর এমন চমৎকার সব ঘটনা ঘটে যেতে পারে! 

বললেন, “খেতে আসুন।” 

খাওয়ার পর্ব যে একেবারে নিঃশব্দে সমাধা হল, তা নয়। তবে বেশির ভাগ কথা বলছিলেন মা আর পিসিমা-ই। তাও আমাদের খাওয়া নিয়েই। ভাদুড়িমশাইয়ের পাতে একটা বাড়তি-পদ দেওয়া হয়েছিল। শাকভাজা। পিসিমার দেখলুম সব দিকেই সমান নজর। বললেন, “আজ ভূত-চতুদশী, চোদ্দোশাক খেতে হয়। তুমি তো বাবা ও-বেলা এখানে ছিলে না, তাই ঠাকুরকে তোমার জন্যে আলাদা করে এ-বেলা ভাজতে বলে দিয়েছিলুম।” 

সত্যপ্রকাশের মা বললেন, “একটুখানি মুখে দাও বাবা, দিতে হয়। তাই বলে আবার বেশি খাবার দরকার নেই, অন্য-সব পদ তা হলে পাতেই পড়ে থাকবে।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনার ভাগ্যকে হিংসে হয় সত্যপ্রকাশবাবু, কী মা আর কী পিসিমাই না পেয়েছেন! ইচ্ছে ছিল, আর ক’টা দিন থেকে ওঁদের আদর-যত্নে ভাগ বসাই। কিন্তু তা তো হবার নয়, কালকেই আমাদের কলকাতায় ফিরতে হচ্ছে।” 

শেষ কথাটা শুনে সত্যপ্রকাশ যেন একটু অবাক হয়ে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকালেন একবার। কিন্তু পরক্ষণেই চোখ নামিয়ে নিলেন। কিছু বললেন না। 

খাওয়া শেষ হল। মশলার ডিবে হাতে নিয়ে দরজার কাছে নিরু দাঁড়িয়ে ছিল। বেসিনে মুখ ধুয়ে একটিপ করে এলাচ-মৌরি মুখে ফেলে আমরা ঘরে ফিরে এলুম। সত্যপ্রকাশও আমাদের সঙ্গে এলেন। মিনিট দশেক বসলেন। একটা সিগারেট ধরালেন। এখানে থাকার ব্যাপারে আমাদের সুবিধে নসুবিধে নিয়ে খুচরো কয়েকটা প্রশ্ন করলেন। তারপর, আমরা যখন ভাবছি যে, এবারে তিনি বিদায় নেবেন, তখন উঠে দাঁড়িয়ে, বলা নেই কওয়া নেই, ড়িমশাইয়ের হাত দুখানা হঠাৎ জড়িয়ে ধরলেন তিনি। বললেন, “আপনাকে যে কী বলে আমার কৃতজ্ঞতার কথা জানাব, ভেবে পাচ্ছি না। আপনি…আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন।” 

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “আরে দূর মশাই, আমি আবার কী করলুম!” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “ও-কথা বলবেন না, মিঃ ভাদুড়ি। যা করবার, আপনিই করেছেন। আমি বেশ ভালই বুঝতে পারছি যে, নানজাপ্পা আপনার শুধু চেনা মানুষ নয়, ভদ্রলোক আপনাকে যথেষ্ট মান্যি করেন। এও বুঝতে পারছি যে, আমার হয়ে এ-ব্যাপারে আপনি পার্সোন্যালি তাঁকে রিকোয়েস্ট করেছিলেন।… না না, আপনি ভাববেন না যে, এটুকু বোঝবার মতো বুদ্ধিও আমার নেই। নিশ্চয় তাঁকে আপনি বলেছিলেন যে, এটা তাঁকে করে দিতেই হবে। যে-লোন এতদিন ধরে আটকে আছে, তা নইলে কি আর আজই হঠাৎ এইভাবে সেটা স্যাংশান হয়ে যায়?” 

সত্যপ্রকাশের মুঠো থেকে নিজের হাত দুখানা ছাড়িয়ে নিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “আরে না মশাই, আমি কেন এ-সব ব্যাবসার ব্যাপারে নাক গলাতে যাব? আর তা ছাড়া এটা তো একটা নর্মাল প্রসিডিওর। ব্যাঙ্কের কাজ লোন দেওয়া। আপনি আপনার ব্যাবসার জন্যে লোন চেয়েছেন, তারা দিয়েছে। ব্যস্, মিটে গেল।” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “আপনার যা বলবার আপনি বলুন; আমার যা বুঝবার, তা আমি ঠিকই বুঝেছি। শুধু একটা কথা। আমি জানি যে, আপনি ব্যস্ত মানুষ, অনেক দাম আপনার সময়ের। তবু একটা প্রার্থনা না-জানিয়ে পারছি না। আপনি আমার জন্যে অনেক করেছেন। কিন্তু এতই যখন করলেন, তখন মুর্তিটিও উদ্ধার করে দিন। নইলে আমার পূর্বপুরুষের কাছে আমি অপরাধী হয়ে থাকব।…না না, আমি আর কোনও কথা শুনছি না। কাল আপনারা চলে যাবেন না, দয়া করে আর ক’টা দিন থেকে যান। এই শেষ কাজটা করে দিন। মিঃ ভাদুড়ি, আপনি সব পারেন। একটু যদি চেষ্টা করেন তো এটাও আপনি পারবেন।” 

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “পারব কি না জানি না, তবে কাজটা যখন নিয়েছি, তখন চেষ্টা তো করতেই হবে। মিঃ চৌধুরি, আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন যে, চেষ্টার কোনও ত্রুটি হবে না। কাল অবশ্য কলকাতায় একটা কাজ রয়েছে, ফিরতে পারলে ভাল হত, এমন দেখি কদ্দুর কী হয়।” তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওরেব্বাবা, এরই মধ্যে দশটা বেজে গেল! যান মশাই, আর রাত জাগবেন না, এবারে গিয়ে শুয়ে পড়ুন।” 

সত্যপ্রকাশ চলে যাচ্ছিলেন। পিছন থেকে ভাদুড়িমশাই তাঁকে ডাকলেন। বললেন, “সিগারেট প্রায় ফতুর, পারেন তো কাউকে দিয়ে এক প্যাকেট পাঠিয়ে দিন।” 

“এখুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি।” বলে সত্যপ্রকাশ বেরিয়ে গেলেন। 

সিগারেট নিয়ে নিরু তার মিনিট পাঁচেক বাদেই ঘরে এসে ঢুকল। 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “সত্যপ্রকাশ কী করছেন?” 

“জামাইবাবু এইমাত্র দোতলায় উঠে গেলেন।” নিরু বলল, “কেন, তাঁকে কিছু বলতে হবে?” 

“না, থাক, দরকার নেই।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “একটা কথা জানাবার ছিল, তা সেটা কাল সকালে জানালেও চলবে। তুমি বরং একটা কাজ করো। তোমার খাওয়া হয়েছে তো?” 

“এইমাত্র খেয়ে উঠলুম।” 

“তা হলে বরং রামদাসকে একটু ডেকে আনো। সেদিনকার চুরির ব্যাপারটা নিয়ে আরও দু-একটা কথা ওকে জিজ্ঞেস করতে চাই।” 

“এত রাত্তিরে?” 

“যা বলছি, করো তো সুহাসিনি। এক্ষুনি গিয়ে রামদাসকে ডেকে আনো। বলো, জরুরি দরকার।” 

নিরু বেরিয়ে গেল। 

খানিক বাদেই বাইরের দিকের দরজায় টোকা পড়ল। আমিই উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলুম। রামদাস এসে ঘরে ঢুকল। ভাদুড়িমশাই বললেন, “দরজাটা ভেজিয়ে দাও, রামদাস।” 

দরজা ভেজিয়ে দিয়ে রামদাস বলল, “আমাকে ডাকছিলেন বাবু?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “হ্যাঁ, রামদাস। একটা খুব জরুরি কথা বলবার জন্যেই ডেকেছি। আমি একটা কাজ করতে চলেছি। কিন্তু সে-কথা যদি ঘুণাক্ষরেও কেউ জানতে পারে, তা হলে রঙ্গিলা তো মারা পড়বেই, মনসাকেও উদ্ধার করা যাবে না, ফলে তোমাদের খোকাবাবুরও সর্বনাশ হয়ে যাবে। তাই আমাকে কথা দাও যে, ব্যাপারটা একমাত্র তুমি ছাড়া আর কেউ জানবে না।” 

মুখ দেখেই বুঝতে পারছিলুম যে, ভাদুড়িমশাইয়ের কথা শুনে রামদাস ভীষণ ঘাবড়ে গেছে। অস্ফুট গলায় সে বলল, “খোকাবাবুকেও জানাতে পারব না?”

“খোকাবাবু ঘুমিয়ে পড়েছেন।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তাঁকে কাল সকালে জানালেই চলবে। কিন্তু তুমি এখন কাউকে এ-ব্যাপারে কিছু বোলো না। কী, মনে থাকবে?” 

“থাকবে বাবু, কাউকে কিচ্ছু বলব না।” 

লক্ষ করছিলুম, রামদাসের মুখের উপর থেকে পলকের জন্যেও ভাদুড়িমশাইয়ের নজর অন্যদিকে সরে যাচ্ছে না। অজগরের দৃষ্টির ফাঁদে একটা খরগোশের ছানা যেভাবে আটকে যায়, রামদাসকে যেন প্রায় সেইভাবেই একেবারে নজরবন্দি রেখেছেন তিনি। আরও খানিকক্ষণ তিনি একইভাবে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “ঠিক আছে, তা হলে জেনে রাখো যে, রঙ্গিলার আয়াকে ইচ্ছে করেই এখান থেকে সরিয়ে দিয়েছি। যদি আমরা জোর করতুম, সুশীলা তা হলে হয়তো আরও দু-চার দিন এখানে থেকে যেত; কিন্তু ও যদি রঙ্গিলার ঘরে থাকত, তা হলে কাজের অসুবিধে হত আমার, তাই আমিই চাইনি যে, ও এখানে থাকুক। শুধু সুশীলা বলে কথা নেই, রঙ্গিলার ঘরে আজ রাত্তিরে আর কেউ থাকুক, এটাই আমি চাই না।” 

“কেউ থাকবে না?”

“আমি আর কিরণবাবু থাকব। তুমি থাকবে পার্টিশানের এদিকে, তোমার ঘরে। আর পার্টিশানের ওদিকে অর্থাৎ রঙ্গিলার ঘরের এক কোণে আমাদের দুজনের জন্যে দুটো মোড়া রেখে দেবে। তোমার কাছে ঘড়ি আছে?” 

“না বাবু।” 

“ঠিক আছে, আমার হাতঘড়িটা তুমি নিয়ে যাও। কিরণবাবুর ঘড়িতেই আমার কাজ চলে যাবে। এখন দশটা পঁয়ত্রিশ। রাত্তির ঠিক বারোটায় আমরা রঙ্গিলার ঘরে গিয়ে ঢুকব। তোমাদের দরজাটা যেন খোলা থাকে। স্রেফ ভেজিয়ে রেখো, ভিতর থেকে যেন খিল এঁটে দিয়ো না। কিন্তু আবার বলছি, কথাটা যেন কেউ জানতে না পারে।…ব্যাস্, এখন তুমি যাও। তবে জেগে থাকো, আমরা না-যাওয়া পর্যন্ত ঘুমিয়ে পোড়ে। না।” 

রামদাস বেরিয়ে গেল। দরজাটা বন্ধ করে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলুম, “আপনার মতলবটা কী বলুন তো?” 

ভাদুড়িমশাই হাসলেন। বললেন, “আজ ভূত-চতুর্দশী না?” 

“হ্যাঁ, তাতে কী হয়েছে?” 

“হুঁশিয়ার থাকুন, কিরণবাবু, আজ রাত্তিরে আমরা ভূত ধরব।” 

তারপর একটু থেমে গম্ভীর গলায় ভাদুড়িমশাই বললেন, “কে জানে, ভূতের বদলে শেষ পর্যন্ত একটা পেত্নিকেও হয়তো পাকড়াও করতে পারি।” 

৩১

ভাদুড়িমশাই বললেন, “পৌনে এগারোটা বাজে। ঠিক বারোটায় আমরা রঙ্গিলার ঘরে গিয়ে ঢুকব। তার মানে আমাদের হাতে এখনও সওয়া এক ঘন্টা সময় রয়েছে। কিরণবাবু, স্বচ্ছন্দে আপনি এখন ঘন্টাখানেক ঘুমিয়ে নিতে পারেন।” 

বললুম, “খেপেছেন নাকি? বারোটায় যাকে ভূত ধরতে বেরোতে হবে, এগারোটায় তার পক্ষে ঘুমোনো সম্ভব? কেউ পারে?” 

“কেন, না-পারবার কী আছে?” 

“বেশ তো, আপনি যদি পারেন তো ঘুমিয়ে নিন; ঠিক পৌনে বারোটায় আমি আপনাকে তুলে দেব। কিন্তু, মশাই, একটা কথা ভেবে দেখুন, বারোটার আগেই কিছু ঘটে যাবে না তো?” 

ভাদুড়িমশাই হাসলেন। বললেন, “বারোটা কেন, দু’টো-আড়াইটের আগে কিছু ঘটবে না।”

“কেন, তার আগে ঘটতেই বা বাধা কোথায়?” 

“বাধা নেই।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তবে কিনা রাত্তিরের প্রথম দিকটায় মানুষের ঘুমটা থাকে একটু পাতলা-রকমের, যার জন্যে চোর ওই সময় গেরস্তবাড়িতে পারতপক্ষে ঢুকতে চায় না। তারও ধরা পড়বার ভয় আছে তো। মানুষের ঘুম সবচেয়ে গাঢ় হয় কখন জানেন? রাত দু’টো-আড়াইটে থেকে চারটে-সাড়ে চারটের মধ্যে। ফলে চুরিও হয় ওই সময়টাতেই সবচেয়ে বেশি। আমার বিশ্বাস, এক্ষেত্রেও যা ঘটবার, তা ওই সময়েই ঘটবে।” 

“ঠিক আছে, তা হলে আপনি শুয়ে পড়ুন।” 

“থাক, আপনি যখন ঘুমোচ্ছেন না, তখন আমিও না হয় জেগেই রইলুম। ঠিক আছে, দরকারি জিনিসগুলোও এই ফাঁকে গুছিয়ে নিতে পারব। তবে আলোটা একেবারে কমিয়ে দিন, জানলাগুলোও বন্ধ করুন। আমরা যে জেগে আছি, বাইরে থেকে তা কেউ বুঝতে না পারে।” 

“তা তো হল, কিন্তু ঘর অন্ধকার হয়ে গেলে গোছগাছ করবেন কী করে?” 

“ও নিয়ে ভাববেন না।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “অন্ধকারেও আমি মোটামুটি দেখতে পাই। তা ছাড়া, শিলিগুড়ির হংকং-বাজারে আজ যা-যা সওদা করেছি, তার মধ্যে একটা পেনসিল-টর্চও আছে। তবে কিনা এখুনি তার দরকার হবে না। ও হ্যাঁ, একটা কথা জিজ্ঞেস করি, আপনার আলোয়ানটা কী রঙের?” 

“নস্যি-রঙের।” 

“বাঃ, ভালই হল। সাদা পোশাক পরে বার হবেন না, অন্ধকারেও দেখতে পাওয়া যাবে। ঘুমোবার সময় যে নীল পায়জামাটা পরেন, ওইটে পরে নেবেন। জামাটাও সাদা হওয়া চলবে না। রঙিন শার্ট কি পাঞ্জাবি না-থাকলে বলুন, আমার থেকে একটা দিয়ে দেব। তার উপরে ওই নস্যি-রঙা আলোয়ান দিয়ে নিজেকে যতটা পারেন ঢেকে নেবেন।” 

“আপনি কী পরবেন?”

ভাদুড়িমশাই হাসলেন। বললেন, “আমার জন্যে ভাববেন না। যেখানেই যাই, কালো এক সেট পায়জামা-পঞ্জাবি আমি সঙ্গে রাখি। অর্ডার দিয়ে কালো সিল্কের একটা মুখ-ঢাকা মাঙ্কি ক্যাপও বানিয়ে নিয়েছি। সে-সব যখন আমি পরে নেব, অন্ধকার রাতে এক-হাত দূর থেকেও তখন বুঝতে পারবেন না যে, একটা লোক আপনার একেবারে সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।…কিন্তু না, আর কথা নয়। এবারে জানালাগুলো বন্ধ করুন, আলোটাও একেবারে কমিয়ে দিন।” 

জানালা বন্ধ করে, হ্যারিকেনের ফিতেটাকে যথাসম্ভব নামিয়ে দিয়ে একদিকের একটা চেয়ারে এসে বসলুম আমি। হ্যারিকেনটা একেবারে নিবু-নিবু হয়ে জ্বলছে। আলো এখন এতই কম যে, ঘরের মধ্যে স্পষ্ট করে কিছুই ঠাহর হচ্ছিল না। শুধু আবছা-আবছা যা দেখছিলুম, তাতে মনে হল, ভাদুড়িমশাই একটা ব্যাগের মধ্যে কিছু তরে নিচ্ছেন। 

বারোটা বাজতে যখন মাত্র দু-তিন মিনিট বাকি, ঠিক তখনই নিঃশব্দে আমাদের ঘর থেকে আমরা বেরিয়ে এলুম। আর বেরিয়েই মনে হল যেন ঝুপ করে একেবারে অন্ধকারের অতলে আমরা তালিয়ে গিয়েছি। ঘরের মধ্যেও যে আলো ছিল, তা নয়, কিন্তু এ একে বারে মিশকালো নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। ভাদুড়িমশাই আমার সামনে, হাত বাড়িয়ে তাঁর কাঁধটা আমি ছুঁয়ে আছি, নইলে তিনি যে আমার থেকে মাত্র এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, সেটাও আমি বুঝতে পারতুম না। আজন্ম যারা শহরের মানুষ, এমন জমাট অন্ধকার তারা কস্মিনকালেও দেখেনি। দেখা সম্ভবই নায়। 

কথায় বলে অন্ধের কিবা রাত্রি কিবা দিন। খুবই সত্যিকথা। তবে কিনা বড়-বড় সব শহরের ক্ষেত্রে এই কথাটা একেবারে উল্টোদিক থেকেও সত্যি। সেখানেও দিন আর রাত্রির মধ্যে কোনও ফারাক নেই। থাকলেও সেই ফারাকটা খুব বড়-রকমের নয়। সেখানেও রাত্রি নামে বটে, তবে অন্ধকার নামে না। কী করে নামবে। ঘরবাড়ি আর রাস্তাঘা`ের আলো তো আছেই, তার উপরে আবার বিজ্ঞাপনের নিয়ন-সাইনের দপদপানিই যেন অন্ধকারকে কাছে আসতে দেয় না, রক্তচক্ষুর নিঃশব্দ ধমক মেরে তাকে শহরের সীমানার বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখে। এই রকমের প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকারের কথা সেখানে ভাবাই যায় না। 

মিনিট খানেক একেবারে ঝিম মেরে আমি দাঁড়িয়ে রইলুম। ভাদুড়িমশাই বলে দিয়েছিলেন, অন্ধকারটা যতক্ষণ পর্যন্ত না চোখে একটু সয়ে আসছে, ততক্ষণ যেন এক পাও না এগোই। তা আস্তে-আস্তে সেটা সয়ে এলও। কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী। চাঁদ নেই। কিন্তু গোটা আকাশ জুড়ে আজও অজস্র অসংখ্য নক্ষত্র একেবারে বিজবিজ করছে। মনের যা অবস্থা, তাতে আজ অবশ্য তারাগুলোকে আর হিরের কুচি বলে ভাবা গেল না,—মনে হল ওগুলো যেন আকাশের গা-ভর্তি ঘামাচি। তারই আবছা আলোয় চারপাশটা যেন একটু-একটু করে ঠাহর হতে লাগল। ঘষা কাচের মধ্যে দিয়ে কাউকে দেখলে যেমন একটা আবছা আভাসমাত্র পাওয়া যায়, এও অনেকটা সেইরকম। 

বারান্দা থেকে আস্তে-আস্তে পা ফেলে আমরা বাইরের উঠোনে নেমে এলুম। কিন্তু উঠোনটা সরাসরি পার না হয়ে বারান্দার ধার ঘেঁষে ঘেঁষে চলে গেলুম ইঁদারাটার দিকে। তারপর ইঁদারার চত্বর পেরিয়ে, মন্দিরের পিছন দিয়ে খানিকটা এগিয়ে, ডাইনে ঘুরে আবার উঠোনে এসে পড়লুম। দু’পা এগোলেই রামদাসের ঘর। দরজা খোলাই ছিল। পাল্লাটা আস্তে ঠেলে ভিতরে ঢুকলুম আমরা; ঢুকেই আবার পাল্লাটা নিঃশব্দে ভেজিয়ে দিলুম। 

ভাদুড়িমশাই তাঁর পেনসিল-টর্চটা জ্বেলেই আবার নিবিয়ে দিলেন। রামদাস ঘুমোয়নি। চুপ করে সে তার তক্তাপোশের উপরে বসে আছে। আবার টর্চ জ্বাললেন ভাদুড়িমশাই। রামদাস কিছু বলতে যাচ্ছিল; ভাদুড়িমশাই ঠোঁটে আঙুল রেখে তাকে বুঝিয়ে দিলেন যে, এখন একটাও কথা চলবে না। পার্টিশানের দরজা দিয়ে রঙ্গিলার ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লুম আমরা। 

রামদাসের ঘরে আলো ছিল না। এ-ঘরে কিন্তু একটা হ্যারিকেন জ্বলছে। তবে তার ফিতেটা নামানো, আলোও তাই জোরালো নয়। ভাদুড়িমশাই ফিতেটা আরও নামিয়ে দিলেন। 

এ-ঘর আগেও দেখেছি। এর দক্ষিণ আর পুব, দু’দিকে দুটো জানালা। রোগীর ঠান্ডা লাগতে পারে, সম্ভবত এই আশঙ্কাতেই জানালা দুটো বন্ধ করে রাখা হয়েছে। ঘরের এক দিকে, পার্টিশান ঘেঁষে, পুবে-পশ্চিমে লম্বালম্বি করে পাতা একটা তক্তাপোশ। পুব দিকের জানালাটা সেই তক্তাপোশের শিয়রে। তক্তাপোশের বিছানার উপরে পাতলা নাইলনের একটা মশারি খাটানো। ম্লান আলোতেও মোটামুটি ঠাহর করা গেল যে, পুবের জানালার দিকে মাথা রেখে রঙ্গিলা ঘুমিয়ে আছে। ঘরটার উপরে একবার চোখ বুলিয়ে পুবের জানালাটা খুলে দিলেন ভাদুড়িমশাই। দক্ষিণের জানালা বন্ধই রইল। 

ঘরের পশ্চিম দিকের দেওয়াল যেখানে দক্ষিণ দিকের দেওয়ালে গিয়ে মিশেছে, সেখানে কোণ-বরাবর দুই দিকের দুই দেওয়ালে দুটো পেরেক পুঁতে খাটানো রয়েছে একটা দড়ি। ঘরে আলনা নেই, দড়িটাই আলনার কাজ করে। তাতে গোটা দুই শাড়ি আর ব্লাউজ ঝুলছে। ভাদুড়িমশাই কী যেন ভাবলেন, তারপর আমার গা থেকে আলোয়ানখানা খুলে নিয়ে সেই দড়ির উপরে সেটাকে একটা পর্দার মতো করে ঝুলিয়ে দিলেন। তাঁর নির্দেশ-মতো ঘরের এক দিকে আমাদের বসবার জন্যে রামদাস দুটো মোড়া রেখে দিয়েছিল। মোড়া দুটোকে ঝুলন্ত আলোয়ানের “পছনে সরিয়ে দিলেন ভাদুড়ি মশাই। তারপর হ্যারিকেনটা একেবারে নিবিয়ে দিয়ে, পেনসিল-টর্চ জ্বেলে, একটা মোড়ায় নিজে বসে অন্যায় আমাকে বসতে ইঙ্গিত করলেন। পেনসি।-টর্চ নিবে গেল। প্রায় অস্ফুট গলায় ভাদুড়িমশাই বললেন, “চুপ করে বসে থাকুন। যা-ই ঘটুক, ভয় পাবেন না।” 

ভাদুড়িমশাই বুঝতে পেরেছিলেন, আমি ভয় পেয়েছি। পাবারই কথা। আমাদের ঘর থেকে যখন বেরিয়ে আসি, তখন থেকেই মনে হচ্ছিল যে, আজ রাতে ভয়ঙ্কর কোনও ঘটনা ঘটবে। তা ছাড়া, ডান-পায়ের হাঁটুর ব্যথাটা ক্রমেই যেন বেড়ে যাচ্ছিল। মন্দিরের পিছন দিয়ে আসবার সময় একটা হোঁচট খেয়ে পড়ে যাই। তখনই হাত বুলিয়ে বুঝতে পারি যে, হাঁটুটা ছড়ে গিয়ে রক্ত পড়ছে। ভাদুড়িমশাইকে সে-কথা জানাতে তিনি পেনসিল-টর্চ জ্বেলে তাঁর ঝোলা থেকে একে-একে কয়েকটা জিনিস বার করলেন। একটা ডেটলের শি িা, ছোট্ট একটা কাঁচি আর লিউকোপ্লাস্টের ছোট্ট একটা কাটিম। তারপর ঝোলাটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, “এটাকে খুব সাবধানে ধরুন।” ক্ষতস্থানে ডেটল লাগিয়ে কাঁচি দিয়ে একটুকরো লিউকোপ্লাস্ট কেটে নিয়ে সেই টুকরোটাকে ক্ষতস্থানে সেঁটে দিলেন ভাদুড়িমশাই। তিনি যখন এইসব করছেন, ঝোলার ভিতরে হাত চালিয়ে তখন বুঝতে পেরেছিলুম, যে, তার মধ্যে আরও তিনটে জিনিস রয়েছে। খুব বড় মাপের একটা টর্চ, এক বান্ডিল দড়ি আর একটা ভীষণ রকমের ভারী জিনিস। হাত বুলিয়ে মনে হল, একটা পিস্তল। সত্যি বলতে কী, আমার ভয় তাতে আরও বেড়েই গিয়েছিল। বুঝতে পেরেছিলুম, আজ রাত্তিরে সম্ভবত গুলিগোলা চলবে। 

চাপা গলায় ভাদুড়িমশাই বললেন, “খুব ভয় পেয়ে গেছেন। তাই না?” 

“পাবারই কথা। পিস্তলটা এনেছেন কেন?”

“কেন এনেছি, সেটা খানিক বাদেই বুঝতে পারবেন। তবে পিস্তল নয়, ওটা রিভলভার আর কথা নয়।” 

আমার বুক ঢিপঢিপ করছিল। মনে হচ্ছিল, গলাটা যেন শুকিয়ে একেবারে কাঠ হয়ে আছে। একটু জল খেতে পারলে ভাল হত। কিন্তু সে-কথা কাকে বলব? কথা বলাই তো বারণ। উঠে গিয়ে রামদাসের ঘরে ঢুকে জল খেয়ে আসব, এমন সাহস হচ্ছিল না। 

ঘরে এক ফোঁটাও আলো নেই। শুধু ঘর বলে কথা কী, গোটা বিশ্বভুবনই যেন অন্ধকার এক মহাসমুদ্রের মধ্যে ডুবে গেছে। পুবের জানালাটা হাট করে খোলা, তবু ঘরের সঙ্গে বাইরের কোনও তফাত আমার চোখে পড়ছে না। যেদিকে মুখ ফেরাই, সব অন্ধকার। কিন্তু সেই অন্ধকারও আস্তে-আস্তে সয়ে আসছে। মনে হচ্ছে, আলোয়ানের পর্দাটাকে একটু সরিয়ে দিয়ে স্থির চোখে জানালাটার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন ভাদুড়িমশাই। পেনসিল-টর্চটা মাঝখানে মাত্র এক লহমার জন্যে একবার জ্বলে উঠেছিল। কিন্তু তারই মধ্যে দেখতে পেয়েছিলুম যে, ঝোলার ভিতর থেকে সন্তর্পণে দুটি জিনিস তিনি বার করে নিলেন। বিশাল সেই টর্চ আর রিভলভার। বাঁ হাতে টর্চ আর ডান হাতে রিভলভার নিয়ে পাথরের একটা মূর্তির মতন তিনি এখন বসে আছেন। 

আমার হাতে রেডিয়াম-ডায়ালের ঘড়ি। মাঝে-মধ্যেই ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলুম। চারদিক শুধু যে অন্ধকার, তা নয়, একেবারে নিঃশব্দ। একমাত্র আমার বুকের ঢিপঢিপ ছাড়া আর কোনও শব্দ আমি শুনতে পাচ্ছি না। অনেকক্ষণ বাদে-বাদে অবশ্য ট্রাক চলার একটা আওয়াজ পাওয়া যায়। দূব থেকে ঝড়ের মতো ছুটে এসে আবার দূরে চলে যাওয়ার শব্দ। শুনেছি এখানকার জঙ্গলে নাকি রাত্তিরেও কাঠ কাটার কাজ চলে। কাঠ কেটে ট্রাকে বোঝাই করা হয়। তারপর সেই কাঠবোঝাই ট্রাক এই রাস্তা দিয়ে ছুটতে থাকে হাইওয়ের দিকে। হাতঘড়িতে এখন পৌনে তিনটে। খানিক আগে একটা মোটর-বাইকের শব্দও যেন শুনেছিলুম। দূরে একটা কুকুরও যেন কঁকিয়ে উঠেছিল একবার। তারপরেই আবার সব স্তব্ধ। 

ঘরের মধ্যে গোটা তিন-চার জোনাকি হঠাৎ ঢুকে পড়েছে। একটা গিয়ে মশারির গায়ে বসল। অন্যগুলো ওড়াউড়ি করে বেড়াচ্ছে। কুকুরটা আবার কঁকিয়ে উঠল। 

আর ঠিক সেই মুহূর্তেই, অন্ধকারের জমাট বিশাল পর্দাটাকে ফ্যাস করে ছিড়ে ফেলে, জ্বলে উঠল পাঁচ ব্যাটারির বিশাল টর্চ। টর্চের আলো পুবের জানালার উপরে গিয়ে পড়েছে। সেই আলোয় যে মুখখানা আমার চোখে পড়ল, তাতে একেবারে থ হয়ে গেলুম আমি। গোবিন্দ ভট্‌ট্চাজ। 

ভাদুড়িমশাইয়ের ডান হাতে রিভলভার। তিনি দাঁড়িয়ে উঠলেন না পর্যন্ত। বাঁ হাতের জ্বলন্ত টর্চের আলোটাকে নিষ্কম্পভাবে জানালার উপরে ধরে রেখে, স্থির কঠিন গলায় বললেন, “তোমার হাতে যা-ই থাক, সেটা ফেলে দিয়ে হাত দুখানা মাথার উপরে তুলে ধরো গোবিন্দ। পালাবার চেষ্টা করলেই গুলি চালাব।” 

গোবিন্দর হাতে একটা ডান্ডার মতো দেখতে পেয়েছিলুম। সেটা মোটা একটা লাঠিও হতে পারে, লোহার মোটা শিক কি শাবলও হতে পারে। ভাদুড়িমশাই তাকে সেটা ফেলে দেবার হুকুম দেবার পর-মুহূর্তেই ঝন্‌ঝন্ করে একটা শব্দ হল। আর প্রায় তৎক্ষণাৎ ‘উঃ, মরে গেলুম’ বলে এমনভাবে চেঁচিয়ে উঠল গোবিন্দ যে, মনে হল, আমার হৃৎপিন্ডটা যেন একটা লাফ মেরে হঠাৎ একেবারে গলার কাছে উঠে এসেছে। সে এমন আর্ত চিৎকার যে, শুনবামাত্র বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়। 

কয়েকটা ঘটনা এরপর প্রায় একইসঙ্গে ঘটে গেল। পাশের ঘর থেকে পার্টিশানের দরজা ঠেলে ছুটে এল রামদাস। যে রঙ্গিলা জখম হবার পর থেকে একটা কথাও বলেনি, বিছানায় উঠে বসে সে তারস্বরে চেঁচাতে লাগল, “কে, কে, আমার ঘরে কে তোমরা?” ভাদুড়িমশাই আর আমি একলাফে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালুম। 

টর্চের জোরালো আলো মাটির দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন ভাদুড়িমশাই। সেই আলোয় আমরা দেখতে পেলুম, জানালার বাইরের বারান্দার মেঝেয় শুয়ে ছটফট করছে গোবিন্দ, আর তার পায়ের কাছ থেকে কুচকুচে কালো একটা সাপ এঁকেবেঁকে, অতি দ্রুত গতিতে, বারান্দা পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে মাটির দিকে নেমে যাচ্ছে। একটু বাদেই সাপটাকে আর দেখা গেল না। 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কেউটে!” 

গোবিন্দ ভট্‌চাজকে বাঁচাবার চেষ্টায় কোনও ত্রুটি হয়নি। সাপ তার বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলে দাঁত বসিয়ে বিষ ঢেলে দিয়েছিল। ঝোলার মধ্যে যে দড়ির বান্ডিল ছিল, তৎক্ষণাৎ সেটা বার করে নিয়ে ভাদুড়িমশাই তার হাঁটুর নীচে আর উপরে খুব শক্ত করে কয়েকটা বাঁধন লাগিয়ে দেন। রামদাস ইতিমধ্যে ভিতরবাড়িতে গিয়ে সকলের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছিল। খবর পেয়ে সবচেয়ে আগে ছুটে এসেছিল নিরু। তার পিছনে-পিছনে প্রথমে এলেন সত্যপ্রকাশ, তার একটু পরেই মা আর পিসিমা। ঘুম থেকে উঠে এসেছেন, সত্যপ্রকাশের পরনে স্রেফ পায়জামা আর গেঞ্জি। কিন্তু তিনি পোশাকটা পর্যন্ত পালটালেন না। যে-অবস্থায় ছিলেন, সেই অবস্থাতেই গোবিন্দকে তাঁর ফিয়াটে তুলে নিয়ে ঝড়ের বেগে গাড়ি চালিয়ে হাসিমারার পথে রওনা হয়ে গেলেন। 

পুরুতমশাইকে সাপে কাটায় গোটা বাড়ি স্তম্ভিত। তারই মধ্যে শুনতে পাচ্ছি রঙ্গিলার গলা। ভাদুড়িমশাইয়ের কথা মতো রামদাস গিয়ে বসে আছে তার কাছে। রঙ্গিলা তাকে ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞেস করছে, “কী হয়েছে দাদু, কী হয়েছে? তোমরা আমাকে কিছু বলছ না কৈন?” 

মা আর পিসিমা অঝোরে কাঁদছেন। মাঝে-মাঝেই গিয়ে মন্দিরের সামনে দাঁড়াচ্ছেন তাঁরা, আর ফুঁপিয়ে বলে উঠছেন, “হে মা মনসা, এ কী হল?” 

সত্যপ্রকাশের অপেক্ষায় আমরা বসে আছি। 

৩২ 

মহেশ্বর চৌধুরি তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন, কাকের মুখে খবর ছড়ায়। ঠিকই লিখেছিলেন। গোবিন্দকে যখন সাপে কাটে, রাত ফুরোতে তখনও কয়েক ঘন্টা বাকি। অথচ খবরটা দেখলুম রাত না-কাটতেই ছড়িয়ে পড়েছে। তা নইলে আর সূর্যোদয়ের আগেই চৌধুরি-বাড়ির বাইরের উঠোনে গাঁয়ের লোকেদের ভিড় জমে যাবে কেন। 

সবার আগে এলেন রঙ্গনাথ। তারপরে একে-একে আরও অনেকে। সাধুবাবাকে অবশ্য কোথাও দেখতে পেলুম না। শেষ-রাত্তিরে ঘুম থেকে উঠে, ত্রিশূল হাতে নিয়ে, ‘জয় শঙ্কর’ হাঁকার পেড়ে যিনি গোটা গাঁয়ে টহল মারতে বেরোন, খবরটা তো তাঁরই সবচেয়ে আগে পাবার কথা। অথচ তাঁকেই কিনা দেখতে পাচ্ছি না। ব্যাপার কী? রঙ্গনাথকে জিজ্ঞেস করতে তিনি বললেন, বাগানের ধার দিয়ে আসবার সময়ে ভিতরে ঢুকে সাধুবাবাকে বারকয়েক ডেকেছিলেন, কিন্তু সাড়া পাননি। “দরজা খোলাই ছিল, কিন্তু মনে হল ভিতরে কেউ নেই; কে জানে হয়তো পাশের গাঁয়ে টহল মারতে গেছেন।” 

ইতিমধ্যে নিরু একবার উঠোনেই আমাদের চা দিয়ে গিয়েছিল। মা আর পিসিমা খানিক আগে ভিতর-বাড়িতে চলে গিয়েছেন। আমরা আর উঠোন থেকে নড়িনি। 

সত্যপ্রকাশের ফিরে আসতে-আসতে আটটা বাজল। একাই ফিরেছেন। তাঁর মুখচোখের ভাব দেখেই সব বোঝা যাচ্ছিল, আগ বাড়িয়ে তাই আর কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলুম না। শুধু ভাদুড়িমশাই বললেন, “গোবিন্দর আত্মীয়স্বজনদের একটা খবর দেওয়া দরকার।” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “হাসিমারায় ওর এক দাদা থাকে। বলত তো মামাতো দাদা, তবে গোবিন্দর আপন মামার ছেলে কি না, তা জানি না। যাই হোক, বর্ধমানের গ্রামে খবর পাঠাবার দায়িত্ব সে-ই নিয়েছে।” তারপর একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “ডাক্তার সরকারের বাড়ি তো পথেই পড়ে, ঘুম থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে হেল্থ সেন্টারে গিয়েছিলুম। এ-সব হেল্থ সেন্টারের স্টকে তো বলতে গেলে কোনও ওষুধই থাকে না, তা অ্যান্টি-ভেনম সিরাম ছিল, যাওয়ামাত্র ইঞ্জেকশান দেওয়াও হয়েছিল, কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না, ভোর হবার আগেই সব শেষ।”

“ডেড বডি এখন কোথায়?” 

“হেলথ সেন্টারেই ছিল। তা সেই দাদা নিশ্চয় লোকজন জুটিয়ে এনে এতক্ষণে সেখান থেকে শ্মশানে নিয়ে গেছে। আমি তো একেবারে একবস্ত্রে এখান থেকে বেরিয়ে পড়েছিলুম, টাকা পয়সা নিয়ে যাবারও সময় পাইনি। অথচ এখন কিছু খর্চা-পত্তর হবে, তাই ডাক্তার সরকারের কাছ থেকে পাঁচশো টাকা নিয়ে গোবিন্দর দাদাকে দিয়ে এসেছি। এখনকার মতো ওতেই সব কুলিয়ে যাবে। এরপরে শ্রাদ্ধশান্তির জন্যে যা দরকার হয়, সবই দেব। গোবিন্দর দাদাকে বলেও দিয়ে এসেছি যে, শ্মশানের কাজ মিটে যাক, তারপর কাল যেন একবার সময় করে এসে আমার সঙ্গে দেখা করে।” 

নিরু আবার চা নিয়ে এসেছিল। চায়ের কাগটা হাতে নিয়ে সত্যপ্রকাশ বললেন, “নিরু, ডাক্তার সরকার একটু বাদেই একবার রঙ্গিলাকে দেখতে আসবেন। পিসিমার কাছ থেকে পাঁচশো টাকা নিয়ে রাখো, ডাক্তারবাবুর কাছে ধার করেছি, সেটা মেটাতে হবে।” 

নিরু ভিতর-বাড়িতে চলে গেল। সত্যপ্রকাশ বললেন, “চলুন, আমরাও ভিতরে গিয়ে বসি।” বেলা বাড়ছে; তার সঙ্গে বাড়ছে রোদ্দুর। ইঁদারার চত্বরটা ছায়ায় ঢাকা বলে উঠোন থেকে খানিক আগে আমরা সরে এসেছিলুম। এবারে সত্যপ্রকাশের কথায় সেখান থেকে তাঁর ড্রইংরুমে এসে বসলুম। 

সত্যপ্রকাশকে খুব টিন্তিত দেখাচ্ছিল। বললেন, “গোবিন্দকে নিয়ে এখান থেকে রওনা হবার সময় তাড়াহুড়োর মধ্যে একটা কথা জিজ্ঞেস করা হয়নি। কিন্তু মনে হল যেন চিৎকার-চেঁচামেচির মধ্যে রঙ্গিলার গলাও তখন পেয়েছিলুম। ওর জ্ঞান কি তা হলে ফিরে এসেছে?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “পুরোপুরি ফিরেছে। কথাও বলছে খুব স্বাভাবিকভাবে।”

“বটে? এটা কী করে সম্ভব হল?” 

ভাদুড়িমশাই কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। বলা হল না। মোটর-বাইকের শব্দ শুনে বোঝা গেল, ডাক্তারবাবু এসে পড়েছেন। ড্রইংরুম থেকে আমরাও তাড়াতাড়ি বাইরে চলে এলুম। ডাক্তারবাবু সরাসরি রঙ্গিলার ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। রঙ্গিলার দৃষ্টি আজ স্বাভাবিক। ডাক্তারবাবুকে দেখে ক্লান্তভাবে একটু হাসলও। ডাক্তার সরকার তার জ্বর নিলেন, প্রেশার মাপলেন, চোখের পাতা টেনে দেখলেন, তারপর একগাল হেসে বললেন, “বাবা, খুব চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলি! কেমন লাগছে এখন?” 

“খুব দুর্বল লাগছে।” রঙ্গিলা বলল, “কী হয়েছিল আমার?” 

ডাক্তারবাবু বললেন, “কেন, তোর কিছু মনে নেই?” 

“না তো।” 

ডাক্তার সরকার এক পলকের জন্যে আমাদের দিকে তাকালেন। তারপর রঙ্গিলাকে বললেন, “শেষ-রাত্তিরে উঠেছিলি তো, ঘুম-চোখে ঘর থেকে বেরোতে গিয়ে চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলি।” 

“কবে?” 

“এই তো, কালই তো পড়ে গেলি। কেন, তোর মনে পড়ছে না?”

“কই, কিচ্ছু মনে পড়ছে না তো।” 

“থাক, এখন আর কিছু মনে করবার দরকার নেই। চুপচাপ শুয়ে থাক। তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে উঠতে হবে। নইলে পুজোর কাজ কে কর1ে?” 

“এখন পুজোর কাজ কে করছে?” 

নিরু যে কখন ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে, খেয়াল করিনি। রঙ্গিলার কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “আমি করছি, তবে তোর মতো অত সুন্দর করে তো করতে পারি না। তাড়াতাড়ি তাই ভাল হয়ে ওঠ, তারপর তোর কাজ তুই বুঝে নে।” 

রঙ্গিলার ঘর থেকে বেরিয়ে ফের সত্যপ্রকাশের বসবার ঘরে চলে এলুম আমরা। ডাক্তারবাবু আমাদের সঙ্গে এলেন। নিরু ইতিমধ্যে সত্যপ্রকাশকে একটা খাম দিয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার সরকারের হাতে সেটা ধরিয়ে দিয়ে সত্যপ্রকাশ বললেন, “সেই টাকাটা। ধার কক্ষনো ফেলে রাখতে নেই।…কিন্তু তা তো হল, রঙ্গিলাকে কেমন দেখলেন বলুন?” 

ডাক্তারবাবু বললেন, “যা দেখলুম, তাকে একটা মিরাকল বললেই হয়। ও একেবারে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছে। খুব দুর্বল, তবে তা নিয়ে চিন্তার কিছু নেই, দু’দিনে ঠিক হয়ে যাবে।” তারপর একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “কাল রাত্তিরেও তো ওকে দেখে গিয়েছিলুম। বাত্তিরের মধ্যেই যে ওর জ্ঞান পুরোপুরি ফিরে আসবে, তা তো তখন কল্পনাও করতে পারিনি।” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “সে কী, কাল রাত্তিরেই তো আপনি বললেন যে, জ্ঞান তো ফিরে আসছেই, সকালের মধ্যেই কথা বলতেও পেরে যাবে। এখন তা হলে এতে এত অবাক হচ্ছেন কেন?” 

ডাক্তারবাবু ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী মশাই, বলব?” 

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “এখন আর বলতে বাধা কীসের, বলেই দিন।” 

ডাক্তারবাবু বললেন, “তা হলে শুনুন মিঃ চৌধুরি, রঙ্গিলা সম্পর্কে কাল যা আমি বলেছিলুম, সেটা মোটেই ডাক্তার হিসেবে আমার ওপিনিয়ন নয়, ভাদুড়িমশাই আমাকে যা-যা বলতে হবে বলে শিখিয়ে দিয়েছিলেন, ঠিক তা-ই আমি কাল বলেছি। 

কথাটা শুনে আমরা অর্থাৎ আমি আর সত্যপ্রকাশ তো অবাক। তারপর দু’জনে প্রায় একই সঙ্গে বললুম, “তার মানে?”

ডাক্তারবাবু উঠে দাঁড়ালেন। ঘড়ি দেখে সত্যপ্রকাশকে বললেন, “আমার একটা জরুরি কল রয়েছে, এখুনি বেরিয়ে পড়তে হবে। মানেটা আপনারা বরং ভাদুড়িমশাইয়ের কাছে জেনে নেবেন। যাবার আগে দুটো কথা বলে যাচ্ছি। প্রথম কথাটা এই যে, রঙ্গিলাকে নিয়ে সত্যি আর চিন্তার কিছু নেই। না, এটা কারও শেখানো কথা নয়, ডাক্তার হিসেবেই এটা বলছি। তবে ওকে এখন আসল কথা না জানানোই ভাল। আর দ্বিতীয় কথাটা এই যে, গোবিন্দর জন্যে দুঃখ করে লাভ নেই। লোকটা একে চোর, তায় অকৃতজ্ঞ, তার উপরে আবার রঙ্গিলাকে খুন করতে এসেছিল। ওকে সাপে কেটে এক পক্ষে ভালই হয়েছে। মরতে তো ওকে হতই,–”থ্যাঙ্ক গড, রিভলভারের গুলি খেয়ে মরতে হয়নি।” 

কথাটা বলে ডাক্তারবাবু আর দাঁড়ালেন না, ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। 

ভাদুড়িমশাই হাসছিলেন। সত্যপ্রকাশ বললেন, “ব্যাপারটা কী বলুন দেখি।” 

হাসতে-হাসতেই ভাদুড়িমশাই বললেন, “আরে মশাই, কাল শিলিগুড়ি যাবার পথেই হাসিমারায় গাড়ি থামিয়ে ডাক্তারবাবুকে আমি বলে গিয়েছিলুম যে, রঙ্গিলার জ্ঞান যে ফিরে আসছে, আর রাত্তিরের মধ্যেই যে সে কথাও বলতে পারবে, এই কথাটাই মুকুন্দপুরে এসে সক্কলের সামনে এঁদে বলতে হবে।” 

“কেন, অমন কথা ওঁকে বলতে বলেছিলেন কেন?” 

“সেটাও বুঝলেন না? রঙ্গিলাকে যে জখম করেছিল, তাকে আমি ভয় পাইয়ে দিতে চেয়েছিলুম। আমি বুঝতে পেরেছিলুম, রঙ্গিলার জ্ঞান ফিরে আসছে আর শিগগিরই সে কথাও বলবে, ডাক্তারবাবুকে দিয়ে এই কথাটা সকলের সামনে বলিয়ে নিতে পারলেই মূর্তিচোর ভীষণ ভয় পেয়ে যাবে। ভয়টা যে শনাক্ত হবার, সে তো বুঝতেই পারছেন। আর সেই ভয়েই সে চেষ্টা করবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রঙ্গিলাকে খতম করে দেবার। ডাক্তারবাবুকে দিয়ে ওই কথাটা কেন বলিয়েছিলুম, এবারে সেটা ধরতে পেরেছেন আশা করি। আসলে ভয় পাইয়ে দিয়ে কালপ্রিটকে আমি রঙ্গিলার দিকে টেনে আনতে চেয়েছিলুম।” 

“তাতে অবশ্য রঙ্গিলারও ভালই হল। তাই না?” 

“তা তো হলই। হিতে বিপরীত বলে একটা কথা আছে না? এ হল তার উলটো ব্যাপার। বিপরীতে হিত। সাপে কেটেছে বুঝতে পেরে গোবিন্দ এমন ভীষণভাবে চেঁচিয়ে ওঠে যে, রঙ্গিলার ঘুম তাতে আচমকা ভেঙে গিয়েছিল। জেগে উঠে ও ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। ওর গোটা চেতনায় ভয়ঙ্কর একটা ঝাঁকুনি লেগেছিল। তাতে ভালই হয়েছে—মানে একটা শক-থেরাপির কাজ হয়েছে। ওর জ্ঞান ফিরে এসেছে, ও কথা বলতে পারছে। এ-রকম হয়।” 

সত্যপ্রকাশ দু’হাত জোড় করে কপালে ঠেকালেন। কার উদ্দেশে প্রণাম জানালেন, বুঝলুম না। সম্ভবত নিজের ভাগ্যকে, অথবা হয়তো মনসাদেবীকে। তারপর একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “কিন্তু মিঃ ভাদুড়ি, কালপ্রিট রঙ্গিলাকে খুন করতে আসবে, এইটে আঁচ করে যে আপনি ফাঁদ পেতে তার জন্যে ওখানে বসে অপেক্ষা করছিলেন তা তো বুঝলুম, কিন্তু গোবিন্দই যে কালপ্রিট, সেটা আপনি বুঝলেন কী করে?” 

“বুঝিনি তো, সন্দেহ করেছিলুম মাত্র। তা সেটাও তো শুধু গোবিন্দকে নয়, আরও কাউকে-কাউকে করেছিলুম।” ভাদুড়িমশাই একটা সিগারেট ধরালেন। ধোঁয়া ছাড়লেন। কী যেন ভাবলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর সত্যপ্রকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী জানেন, যখনই দেখি যে, কোনও একটা ক্রাইমের ঘটনার পরে-কাছে যারা ছিল, কিংবা সেটা করা যাদের পক্ষে সম্ভব ছিল, কিংবা সেই ঘটনাটা ঘটবার ফলে াদের পক্ষে লাভ হবার সম্ভাবনা রয়েছে, তাদের মধ্যে কেউ-একজন মিথ্যে কথা বলছে, আমাদের সন্দেহটাও তখন স্বাভাবিকভাবে তারই উপরে গিয়ে পড়ে। তা এ-ক্ষেত্রে আমি কী দেখলুম?” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “কী দেখলেন আপনি?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “দেখলুম যে, মিথ্যেকণা যে শুধু গোবিন্দই বলছে, তা নয়, বলছেন অন্তত আরও তিনজন। আলিবাবার গপ্পোটা জানেন গে? ডাকাতরা এসে আলিবাবার বাড়ির দরজায় ঢ্যারা দিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মর্জিনা তাদের মতলবটা বুঝতে পেরে সব বাড়িতেই ঢ্যারা দিয়ে রাখল। কেন? না আলিবাবার বাড়িটা তা হলে আর অলাদা করে চিনতে পারা যাবে না।। আমার হল উলটো ফ্যাসাদ। এত লোক যদি মিথ্যেকথা বলে, তো তাদের ভিতর থেকে চোরকে ‘মামি আলাদা করে চিনে নেব কী করে? কখনও যদি একে।ন্দেহ হয়, তো কখনও ওকে। তারপর তেবে দেখলুম যে, অনেকেই মিথ্যে বলছে বটে, তবে এক-একজন বলছে এক-এক কারণে। ছবিটা ত ন একটু-একটু করে পরিষ্কার হতে লাগল।” 

নিরু এসে ঘরে ঢুকল। বলল, “আপনাদের জলখাবার দিতে বলি?” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “দাঁড়াও, দাঁড়াও, ও সব পরে হবে। ভাল করে মুখই ধোয়া হয়নি, এখন কিছু দাঁতে কাটতে পারব না। ঘুমও ভাল হয়নি। বরং পারো তো বেশ কড়া করে একটু চা খাওয়াও দেখি।’ 

নিরু চা আনতে গেল। সত্যপ্রকাশ বললেন, “থামলেন কেন মিঃ ভাদুড়ি, বলে যান।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “যা বলছিলুম…….ওই মানে এক-এক জনের মিথ্যে এক-এক রকমের। প্রথমেই ধরা যাক সাধুবাবার কথা। আমি আপনাকে বলেছিলুম যে, অর্থলোভই হয়তো একমাত্র কারণ নয়, অন্য কোনও কারণেও মনসাব মূর্তিটি কেউ হয়তো সরিয়ে থাকতে পারে। এটা বলেছিলুম আপনারই মুখে এই কথাটা শুনে যে, মনসার উপরে উনি বেদম খাপ্পা। ভদ্রলোক শৈব সন্ন্যাসী। সাধনমার্গে কদ্দুর এগিয়েছেন ঈশ্বর জানেন, তবে কিনা ওঁর সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলুম যে, মানুষটি বড় অসহিষ্ণু। তার উপরে আবার চাঁদসদাগরের সঙ্গে মনসার ঝগড়ার গপ্পোটা কে না জানে। উনিও জানেন। কিন্তু তার থেকে ওঁর এই একটা উদ্ভট বিশ্বাস জন্মে গিয়েছে যে, মনসাকে যে যত গালমন্দ করতে পারবে, শিবের সে তত বড় ভক্ত। তাই এক সময়ে আমার মনেও হয়েছিল যে, কী জানি, মনসামূর্তিটিকে উনিই হয়তো মন্দির থেকে সরিয়ে কোথাও লুকিয়ে রেখেছেন। তার উপরে আবার এটাও দেখলুম যে, মানুষটির কথায় আর কাজে কোনও মিল নেই। কিরণবাবুকে সে-কথা বলেওছি। সাধুবাবা মুখে বলছেন যে, মুকুন্দপুরে সাপ নেই, এদিকে কিন্তু সাপের ভয়ে নিজের ঘরের চারদিকে কারবলিক অ্যাসিড ছড়াতেও তাঁর ভুল হচ্ছে না।” 

আমি বললুম, “সত্যি সত্যপ্রকাশবাবু, ওঁর আখড়ায় সেদিন আমরা কারবলিক অ্যাসিডের ঝাঁঝালো গন্ধে একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলুম।” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “তা তো হল, কিন্তু মিথ্যে কথাটা উনি কী বললেন?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “সেটা যে আপনি ধরতে পারেননি, তাতেই আমি অবাক হচ্ছি। আপনাকে উনি জানিয়েছেন যে, কলকাতায় হস্টেল থেকে বেরিয়ে সেই যে এক সাধুর সঙ্গে উনি পশ্চিমে চলে গিয়েছিলেন, তারপর থেকে এতকাল উনি শুধু পশ্চিমের নানান তীর্থে ঘুরে বেড়িয়েছেন, এদিকে একবারও আসেননি, বাংলার মাটিতে অ্যাদ্দিন বাদে এই প্রথম ফিরলেন। তাই না?”

“হ্যাঁ।” 

“এটাই তো একটা ডাহা মিথ্যেকথা।” 

“কী করে বুঝলেন?” 

“আরে মশাই, ওঁর কথা শুনেই সেটা বোঝা যায়। পঞ্চাশ বছর একটানা যদি উনি পশ্চিমে থাকতেন, তো ওঁর কথাবার্তার মধ্যে নির্ঘাত একটা পশ্চিমী টান এসে যেত। তা কিন্তু একেবারেই আসেনি। উনি যে বাংলা বলছেন, সে তো একেবারে চাঁচাছোলা বাংলা।” 

চায়ের ট্রে নিয়ে নিরু এসে ঘরে ঢুকল। তারপর ট্রে-টা সেন্টার টেবিলের উপরে নামিয়ে রেখে একেবারে মুখস্থ বলার মতন করে বলল, “চা খেয়েই আপনারা চান করে নিন। জলখাবার খেতে হবে না; চান করে দুটি ডাল-ভাত মুখে দিয়ে ঘুমিয়ে নিন কিছুক্ষণ। রাত্তিরে ঘুম হয়নি, এখন খেয়ে-দেয়ে বিশ্রাম করুন। নইলে শরীর খারাপ হবে। 

পট থেকে পেয়ালায় চা ঢালতে ঢালতে সত্যপ্রকাশ বললেন, “এ-সব কথা তোমাকে কে বলতে বলল? মা, না পিসিমা?” 

“পিসিমা।” 

“ওরে বাবা,” সত্যপ্রকাশ বললেন, “তা হলে তো একেবারে সুপ্রিম কোর্টের অর্ডার। ঠিক আছে, ঠিক আছে, পিসিমাকে গিয়ে বলো, এক্ষুনি আমরা চান করে নিচ্ছি।” 

৩৩ 

দুপুরের খাওয়া চটপট মিটে গেল। খাবার টেবিলে মা আর আজ আসেননি; কাকে কী দিতে হবে, পিসিমাই সব বলে দিচ্ছিলেন। পিসিমা দেখলুম শক্ত ধাতের মানুষ। পুরুতঠাকুরকে সাপে কাটায় যেমন মা তেমনি পিসিমাও প্রথমটায় ভেঙে পড়েছিলেন বটে, কিন্তু পিসিমা ইতিমধ্যেই ধাক্কাটা সামলে নিয়েছেন। 

শুধু তা-ই নয়, সত্যপ্রকাশ তাঁর মায়ের কথা জিজ্ঞেস করায় পিসিমা বললেন, “বৌদির মন যে কত নরম, তা তো জানিস সতু, এখনও মন খারাপ করে শুয়ে আছে আর বলছে, এমন হল কেন। তা আমি বললুম, হবে না-ই বা কেন, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে, পুরুত হোক আর যা-ই হোক, চোর তো বটে, তার উপরে আবার ধরা পড়বার ভয়ে ওই নির্দোষ মেয়েটাকে খুন করতে গিয়েছিল, ওর উচিত-শান্তি হয়েছে, তুমি আর ও নিয়ে মন খারাপ কোরো না ‘ 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আজ কালীপুজো। ভেবেছিলুম, কাজ মিটিয়ে আজ কলকাতায় ফিরব, সে আর হল না। কালকের ফ্লাইটে কিন্তু যেমন করেই হোক ফিরতে হবে।” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “সে কী। মূর্তি উদ্ধার না করেই?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “মূর্তি এখন বিশ-বাঁও জলের তলায়।” 

কথাটা শুনে যেন এক্ট্রোরে ভেঙে পড়লেন সত্যপ্রকাশ। কাতরভাবে বললেন, “না না, ও কথা বলবেন না। আপনি মশাই সব পারেন। আমার জন্যে আপনি অনেক করেছেন, এমনকি চোরও ধরে দিয়েছেন, এবারে মূর্তিটাও দয়া করে উদ্ধার করে দিন। নইলে আপনাকে ছাড়ছি না।” 

খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। ভাদুড়িমশাই উঠে পড়লেন। ঘড়ি দেখে বললেন, “বারোটা বাজে। কাল আমি ঘুমোইনি। কিরণবাবুও সারারাত জেগে ছিলেন। এখন আমরা ঘরে গিয়ে ঝাড়া তিন ঘন্টা ঘুমোব। নিরু, সাড়ে তিনটেয় যদি আমাদের বেশ কড়া করে দুকাপ কফি দাও তো বড্ড ভাল হয়। দুধ দেবে না, চিনিও দেবে না। স্রেফ কড়া লিকার।” 

ঠিক সাড়ে-তিনটেতেই টোকা পড়ল। আমরা অবশ্য তার খানিক আগে ঘুম থেকে উঠে, চোখ-মুখ ধুরে একেবারে রেডি হয়েই ছিলুম। ঘন্টা তিনেক একটানা ঘুমিয়ে নেওয়ায় শরীরটাও বেশ ঝরঝরে লাগছিল আমার। দরজা খুলে দিতেই কফি নিয়ে নিরু এসে ঢুকল; তার পিছনে পিছনে সত্যপ্রকাশও এসে গেলেন। 

টেবিলের উপরে ট্রে-টা নামিয়ে রেখে নিরু বেরিয়ে যাওয়ার পরে সত্যপ্রকাশ বললেন, “আমি মশাই দুধ-চিনি ছাড়া কফি খেতে পারি না। ও-বস্তু আপনারা খান, আমার কফি আমি আগেই খেয়ে নিয়েছি।” 

পট থেকে দুটো পেয়ালায় ব্ল্যাক কফি ঢেলে একটা পেয়ালা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন ভাদুড়িমশাই, তারপ নিজের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে সত্যপ্রকাশকে বললেন, “আপনিও একটু ঘুমিয়ে নিয়েছেন তো?” 

“তা নিয়েছি, কিন্তু ব্যাপারটা এখনও বোঝা গেল না। মানে সবটা আপনি এখনও বুঝিয়ে বলেননি।” 

“ওই মিথ্যেকথা বলবার ব্যাপারটা তো?’ 

“হ্যাঁ, গোবিন্দ ছাড়া আরও অন্তত তিনজন নাকি মিথ্যেকথা বলেছে। তার মধ্যে খুড়োমশাইয়ের 

কথাটা আপনি মনে হচ্ছে ঠিকই ধরেছেন। কিন্তু বাকি দুজন কে?” 

“বাকি দুজনের একজন অবশ্যই রঙ্গনাথ।” 

“সে কী।” সত্যপ্রকাশ যেন আঁতকে উঠলেন। ‘উনি তো নিপাট ভালমানুষ!” 

“রনাথবাবু যে খারাপ মানুষ, তা তো আমি বলিনি, মিঃ চৌধুরি।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “পরোপকারী লোক, গাঁয়ের লোকেরা সেজন্যে ওঁকে মান্যিও নেহাত কম করে না।…..কী জানেন, আপদে-বিপদে পরামর্শ দিতে পারেন, হাতের কাছে এমন কেউ থাকলে লোকে স্বস্তি পায়, সেটাই স্বাভাবিক। তা আপনি তো মশাই বলতে গেলে শিলিগুড়িতেই থাকেন, গাঁয়ের লোকেবা হাতের কাছে আপনাকে পাচ্ছে কোথায়, তাই পরামর্শ নেবার দরকার হলে ওঁর কাছে ছুটে যায় তারা। মঙ্গলবার সকালে ওঁর বাড়িতে গিয়েছিলুম তো, বেশিক্ষণ বসিনি, কিন্তু তারই মধ্যে দেখলুম যে, গাঁয়ের এক চাষি-বউ ওঁর কাছে পরামর্শ নিতে এসেছে। কিরণবাবুও দেখেছেন ব্যাপারটা।” 

আমি বললুম, “দেখেছি, কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক ধরতে পারিনি। রঙ্গনাথবাবু ওই যে বললেন, যেখান থেকে নিয়ে এসেছ, সেইখানেই আবার রেখে এসো, ও কথাটার অর্থ কী?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “রঙ্গনাথবাবু তখন ঘরের মধ্যে কথা বলছিলেন, আর আমরা বসে ছিলুম দাওয়ায়। তাঁর কথার সবটা আপনি শোনেননি, তাই যেটুকু শুনেছেন, তার ভুল অর্থ করেছেন। কনটেক্সট থেকে আলাদা করে নিয়ে কোনও-কিছুর অর্থ করার ওই হচ্ছে মস্ত বিপদ। সবটা শুনলে বুঝতে পারতেন যে, এটা একেবারেই অন্য ব্যাপার।” 

“অন্য ব্যাপার মানে কী ব্যাপার?” 

“একটা পারিবারিক সমস্যার ব্যাপার।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “ওই যে চাষিবউটিকে দেখলেন, ওর মেয়ের বিয়ে হয়েছে পাশের গাঁয়ে, কিন্তু শাশুড়ির সঙ্গে মেয়েটির বনিবনা হচ্ছে না, একটু-আধটু অশান্তিও হয়ে থাকবে, তাই বোধহয় কাউকে দিয়ে বাপের বাড়িতে খবর পাঠিয়েছিল। আর মেয়ের বাপও অমনি ছুটে গিয়ে মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি থেকে এখানে নিয়ে এসেছে। এ হল দিন দশ-বারো আগের ব্যাপার। তা এই দশ-বারো দিনের মধ্যে শ্বশুরবাড়ি থেকে কেউ আর মেয়েটিকে ফিরিয়ে নিতেও আসেনি, খোঁজখবরও করেনি। মেয়ের বাপ সম্ভবত গোঁয়ার টাইপের লোক। কিন্তু মা’টি বুদ্ধিমতী, সে ঠিকই বুঝতে পেরেছে যে, লক্ষণ সুবিধের নয়। তাই রঙ্গনাথকে জিজ্ঞেস করতে এসেছিল যে, এখন কী করা উচিত। রঙ্গনাথও বুঝতে পেরেছেন, গোঁয়ার্তুমির ফল ভাল হবে না, তাই বললেন, ‘যেখান থেকে নিয়ে এসেছ, সেইখানেই আবার রেখে এসো।’ অর্থাৎ মেয়েটিকে আবার নিজেরাই গিয়ে শ্বশুরবাড়িতে রেখে আসবার পরামর্শ দিলেন তিনি। আমার তো মনে হয়, ঠিক-পরামর্শই দিয়েছেন।” 

যাচ্চলে, এই ব্যাপার। আর আমি কিনা ভাবছিলুম যে, মনসামূর্তি ওই চাষিবউটি চুরি করেছে, আর রঙ্গনাথ তাকে পরামর্শ দিচ্ছেন মূর্তিটিকে আবার যথাস্থানে ফিরিয়ে রেখে আসতে। 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “তা তো হল, কিন্তু মিথ্যে কথাটা উনি কী বললেন?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “শুনুন তা হলে। ভদ্রলোক তো মানুষ মোটেই খারাপ নন, আপনি ওঁকে কাজ দিয়েছেন, বুড়ো বয়সে মাথা গোঁজার মতো একটা আশ্রয়ও দিয়েছেন, রঙ্গনাথ তার জন্যে কৃতজ্ঞও খুব। তবে কিনা ওঁর কোনও দুঃখ নেই, সেইটে জানাবার জন্যে ওই সেদিন সকালেই কথায়-কথায় উনি বলে বসলেন যে, ছেলেপুলের ঝামেলা ওঁদের নেই তো, তাই আপনি যে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন ওঁদের জন্যে, ওঁরা বুড়োবুড়ি সেখানে দিব্যি আছেন। তা ওঁরা আছেন ঠিকই, তবে কিনা ওই যে উনি বললেন, ছেলেপুলের ঝামেলা নেই, ওই কথাটা কিন্তু সত্যি নয়। রামদাসের কাছে শুনলুম, রঙ্গনাথের একটি ছেলে আছে; শুধু তা-ই নয়, ছেলেটাকে নিয়ে ঝামেলাও আছে বিস্তর। তখন মনে হল, সেই ছেলেটা? এই মূর্তিচুরির ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয় তো, আর ছেলেপুলের ঝামেলা নেই বলে রঙ্গনাথ সেই ছেলের অস্তিত্বকে আমাদের কাছে গোপন করতে চাইছেন না তো?” শুনে সত্যপ্রকাশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “কিছুই দেখছি আপনার নজর এড়ায় না। তা খুড়োমশাই আর রঙ্গনাথের ব্যাপারটা তো বুঝলুম, তৃতীয় মিথ্যুকটি কে?” 

“তৃতীয়জনের কথা পরে হবে,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আগে বরং গোবিন্দর কথাটাই বলি। মঙ্গলবার সকালে আপনার ঘরে বসে যখন কথা হচ্ছিল, তখন রামদাস বলল, আর-কেউ কিছু শুনতে পায়নি বটে, তবে গোবিন্দ নাকি বাগানের দিক দিয়ে লোকজন ছুটে পালাবার শব্দ শুনেছিল। একই দিক থেকে পেয়েছিল একটা গাড়ির শব্দও। মঙ্গলবার রাত্তিরে গোবিন্দুকে জিজ্ঞেস করতে সেও বলল যে, হ্যাঁ, লোকজন ছুটে পালাবার আর একটা গাড়ি স্টার্ট নেবার শব্দ সে শুনেছিল ঠিকই। সেই সঙ্গে এটাও বলল যে, শব্দ এসেছিল ফলের বাগানের দিক থেকে। একেবারে ডাহা মিথ্যে কথা!” 

“কী করে বুঝলেন? 

“আরে মশাই, এমন শব্দ যদি হতই, তা হলে একা গোবিন্দ কেন, অন্যেরাও তা শুনতে পেত। নিরু তো পেতই, রামদাসও পেত। শুনতে পেতেন মা আর পিসিমাও। মিঃ চৌধুরি, আপনি সম্ভবত ভাবছেন যে, রামদাস, মা আর পিসিমা বুড়ো মানুষ, কানে খাটো, তাই কিছু শুনতে পাননি, তাই না?”

সত্যপ্রকাশ বললেন, “তা তো হতেই পারে।’ 

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “না, পারে না। রামদাস যে কানে মোটেই খাটো নয়, পরশু রাতে ওদের ঘরের পিছনে টল মারতে গিয়েই সেটা আমি টের পেয়েছি। অন্ধকারে আমাকে দেখতে পায়নি ঠিকই, কিন্তু সামান্য একটু পায়ের শব্দ হয়েছে।ক হয়নি, তাতেই দেখলুম ঘরের ভিতর থেকে রামদাস হঠাৎ ‘কে ওখানে’ বলে চেঁচিয়ে উঠল। এবারে মা আর পিসিমার কথা বলি। কাল সকালে দেখলুম ননদ-ভাজে কথা হচ্ছে। একজন কথা বলছেন উঠোনের টিউবওয়েলের পাশে দাঁড়িয়ে, আর অন্যজন কথা বলছেন রান্নাঘর থেকে। দুটো জায়গার মধ্যে দূরত্ব অন্তত পনেরো ফুট, কেউ যে খুব উঁচু গলায় কথা বলছিলেন তাও নয়, অথচ দুজনের কারুরই যে অন্যের কথা শুনতে কোনও অসুবিধে হচ্ছে, এমন কিন্তু মনে হল না। আর নিরুর কথা তো ছেড়েই দিচ্ছি। এঁরা কেউই কিন্তু কোনও শব্দ শোনেননি। শুনেছে নাকি একমাত্র গোবিন্দ। আসলে গোবিন্দও কিছু শোনেনি।”

“তা হলে সে শুনেছে বলল কেন?”

“বলল আমাদের সন্দেহটাকে একেবারে অন্য দিকে চালান করে দেবার জন্যে। কিন্তু মিথ্যেটাও একটু ভেবেচিন্তে বলবে তো। গোবিন্দ কিন্তু ভাবনাচিন্তার ধারই ধারেনি ফলে সে ধরা পড়ে গেল। গোবিন্দ যদি হ্ শব্দ শোনার কথা বলত, তাতেও হয়তো আমার ততটা সন্দেহ হত না, অন্তত তক্ষুনি-তক্ষুনি হত না; এমনকি যদি ও বলত যে, লোক পালাবার আর গাড়ি স্টার্ট নেবার শব্দটা এ-বাড়ির দক্ষিণ দিক থেকে অর্থাৎ রাস্তার দিক থেকে এসেছিল, তবে সেটাও হয়তো তখনকার মতো আমি বিশ্বাস করে নিতুম। ভাবতুম যে, হবেও বা, ভোর-রাত্তিরে এ-বাড়ির বাদবাকি সবাই এমন অঘোরে ঘুমোচ্ছিল যে, শব্দটা তারা শোনেনি। কিন্তু ওই যে গোবিন্দ বলল, লোক পালাবার আর গাড়ির স্টার্ট নেবার শব্দটা এসেছিল বাগানের দিক থেকে, তাতেই আমি বুঝে গেলুম যে, লোকটা একেবারে ঘোর মিথ্যেবাদী।” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “কেন, বাগানের দিক দিয়েও তো পালানো যায়। ওদিক দিয়েও তো পৌঁছনো যায় রাস্তার উপরে। 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা যায়, কিন্তু মাটিতে সে-ক্ষেত্রে মানুষের পায়ের আর গাড়ির টায়ারের ছাপ থাকবে তো। সেটা আরও এইজন্যে থাকবে যে, যে-দিন চুরি হয়, তার আগের কদিন এখানে খুব বৃষ্টি হয়েছিল শুনলুম। এমনকি, আমরা যখন এখানে এসে পৌঁছই, উঠোন দুটো তার মধ্যে শুকিয়ে খটখটে হয়ে গিয়েছিল বটে, কিন্তু বড়-বড় সব গাছপালার আওতায় ছিল বলে বাগানের মাটি তখনও ভাল করে শুকোয়নি। অথচ সেখানে না দেখলুম কারও পায়ের ছাপ, না দেখলুম কারও জুতোর ছাপ, না দেখলুম কোনও গাড়ির টায়ারের ছাপ।” 

গোপালের মা ইতিমধ্যে চা আর ঘরে-ভাজা নিমকি দিয়ে গিয়েছিল। আমি একটা নিমকি তুলে নিয়ে বললুম, “তারপর?” 

ভাদুড়িমশাই ঢায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বললেন, “তারপর আর কী, চাবিটা তো আগেই দেখেছিলুম।” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “ঠিক, ঠিক, ভাল কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। চাবিটা দেখেই আপনি বলেছিলেন, ‘বুঝেছি’। ব্যাপারটা একটু খুলে বলুন তো।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “খুলে বলবার তো কিছু নেই। চাবির গায়ে অল্প-একটু মাটি লেগে ছিল, কাদামাটি শুকিয়ে গেলে যেমন হয় সেইরকম আর কি। ওই মাটি দেখেই সন্দেহ হয়েছিল আমার। অথচ শুনলুম, চাবিটা রঙ্গিলা সব সময়ে যত্ন করে নিজের কাছে রাখত, কক্ষনো হাতছাড়া করত না। তবে হ্যাঁ, আপনি তো মঙ্গলবার শিলিগুড়ি গেলেন, কথায়-কথায় রামদাস সেদিন বলল যে, চাবিটা এর মধ্যে একদিন ঘন্টাখানেকের জন্যে হারিয়ে গিয়েছিল। কবে? না বুধবার ভোর রাত্তিরে তো চুরিটা হল, এটা তার দু’দিন আগের অর্থাৎ সোমবারের ঘটনা। কোথায় পাওয়া গেল? না হোম করবার জেন্য আনা নরম মাটির উপরে।” 

“তাতে কী বুঝলেন?” 

“বুঝলুম যে, চাবিটা আসলে হারায়নি, ওটাকে সরানো হয়েছিল। সরিয়ে ওই মাটির উপরে রেখে দেওয়া হয়েছিল। আর রাখবার সময়ে একটু চাপও দেওয়া হয়েছিল, নরম মাটির উপরে যাতে চাবিটার একটি ছাপ পড়ে যায়। গোবিন্দ নিশ্চয় মাঝে-মাঝেই হাসিমারায় তার মামাতো দাদার কাছে যেত, তাই না?” 

“তা যেত বই কী।” সত্যপ্রকাশ বললেন, “মাঝে-মাঝেই যেত।” 

“বাঃ, তা হলে তো কথাই নেই।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমার ধারণা, নরম মাটিতে তো চাবির ছাপ পড়েছিল, শুকিয়ে যাবার পরে সেইদিন কি তার পরদিন সেই মাটি নিয়ে হাসিমারায় গিয়েছিল গোবিন্দ। গিয়ে সেখানকার কোনও কামারশালা থেকে সে নিশ্চয় ওই ছাপমতন একটা ডুপ্লিকেট চাবি বানিয়ে আনে। ফলে তাকে আর তালা ভাঙতে হয়নি, ডুপ্লিকেট চাবি দিয়েই ভোর-রাত্তিরে গিয়ে ঠাকুরঘরের তালা খুলে সে ভিতরে ঢুকেছিল।” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “ওরেব্বাবা, এই ব্যাপার? তারপর?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তারপরেই দেখা দিল সমস্যা। এমনই যোগাযোগ যে, রঙ্গিলা সেদিন নিশ্চয়ই অন্যান্য দিনের চেয়ে আরও খানিক আগেই ঘুম থেকে উঠে পড়েছিল। ঠাকুরঘর থেকে একটা শব্দও পেয়েছিল নিশ্চয়। তাই তক্ষুনি সে মন্দিরের দিকে ছুটে যায়, আর গিয়েই পড়ে যায় গোবিন্দর সামনে। বেদী থেকে মূর্তি তুলে নিয়ে গোবিন্দ তখন পালাচ্ছে। সেই অবস্থায় রঙ্গিলাকে জখম না-করে আর তার উপায় কী। একেবারে খতম করতেই চেয়েছিল, তবে পারেনি। কী দিয়ে জখম করল ভেবে দেখুন।” 

আমি বললুম, “সেটা পরে ভাবলেও চলবে। আগের কথাটা আগে ভাবা দরকার। মুর্তিটা গেল কোথায়?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কোথায় গেল, সে তো ভাবতেই হবে। কিন্তু তারও আগে যা ভাবা চাই, তা হচ্ছে গেল কী কবে? যদি ভুটানে কি নেপালে কি কলকাতায় ও-মূর্তি পাচার হয়ে থাকে, তা হলে বুঝতে হবে, কাজটা একা গোবিন্দর নয়, তার অন্তত একজন সঙ্গী ছিল। কেন না, গোবিন্দ তো আর মুকুন্দপুর থেকে কোথাও যায়নি।……দৃশ্যটা একবার কল্পনা করুন। রঙ্গিলা চেঁচিয়ে উঠল, তাকে জখমও করা হল। কিন্তু রঙ্গিলার চিৎকার শুনে রামদাস যে একেবারে তক্ষুনি সেখানে ছুটে আসতে পেরেছিল তা তো নয়, ঘুম থেকে ধড়মড়িয়ে জেগে উঠে আলো জ্বেলে তবেই সে আসে। ইতিমধ্যে অন্তত দেড়-দুই মিনিট সময় নিশ্চয় কেটে গিয়ে থাকবে। হতে পারে যে, তারই মধ্যে সেই সঙ্গীর হাত দিয়ে মূর্তিটা পাচার করেছে গোবিন্দ। সঙ্গী সরে পড়ে, কিন্তু গোবিন্দ পালায় না। মন্দির থেকে সে বেরিয়ে এসেছিল, ঢুকেও পড়েছিল নিঃশব্দে নিজের ঘরের মধ্যে। কিন্তু আলো নিয়ে রামদাস তার ঘর থেকে বেরোবার সঙ্গে-সঙ্গে গোবিন্দও নিজের ঘর থেকে আবার এমনভাবে মন্দিরের দিকে ছুটে যায়, যেন সেও ওই চিৎকার শুনেই তার ঘর থেকে ছুটে এসেছে।…..এ হল রিকনস্ট্রাকশন। যা আমরা চোখে দেখিনি, অনুমানের ভিত্তিতে তাকে আমরা রিকনস্ট্রাকট করে নিলুম, ঐতিহাসিকেরাও এইভাবে অনেক প্রাচীন ঘটনার চেহারাকে আবার নতুন করে বানিয়ে নেন। কিন্তু এ-ক্ষেত্রে যে ঠিক এইরকম হয়েছিল, তা আমার মনে হয় না।” 

“কেন হয় না?” সত্যপ্রকাশ জিজ্ঞেস করলেন। 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “দি রিজন ইজ সিম্পল। গোবিন্দর যদি সত্যি কোনও সঙ্গী থাকত, তা হলে কেউ যখন কারও পালানোর শব্দ শোনেনি, গোবিন্দও তখন আগ বাড়িয়ে ওই অন্য-লোকের পালানোর শব্দ শুনতে পাবার কথা বলত না। না মশাই, আমার ধারণা, গোবিন্দ এ-কাজ একাই করেছে, আর সন্দেহটা যাতে তার উপরে না পড়ে, তারই জন্যে বলেছে যে, অন্য লোকজনের পালানোর শব্দ সে শুনেছিল।’ 

বললুম,”মূর্তি তা হলে বাইরে পাচার হয়নি?” 

“হয়নি বলেই তো মনে হয়।” 

সত্যপ্রকাশ ব্যাকুলভাবে বললেন, “মূর্তিটা তা হলে কোথায়?” 

ভাদুড়িমশাই হাসলেন। বড় রহস্যময় সেই হাসি। একটা সিগারেট ধরালেন। ধোঁয়া ছাড়লেন। তারপর বললেন, “আমি তো গতকার নই, তাই মূর্তিটি এখন কোথায়, খড়ি পেতে তা আপনাকে বলতে পারব না। তবে হ্যাঁ, আন্দাজ একটা করতে পারি। আন্দাজের কথাটা যে আপনাকে জানাইনি, তাও নয়, দুপুরবেলায় খাবার ঘরে বসেই জানিয়েছি যে, মূর্তি এখন বিশ বাঁও জলের তলায়।” 

“তার মানে সেটা আর পাওয়া যাবে না?” আর্ত গলায় সত্যপ্রকাশ জিজ্ঞেস করলেন। 

“যাবে,যাবে,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমার আন্দাজে যদি ভুল না থাকে তো নিশ্চয় পাওয়া যাবে।” 

“কোথায় পাওয়া যাবে?” 

“অত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? এক বাঁও মানে চার হাত, তা হলে বিশ বাঁওয়ের মানে দাঁড়াচ্ছে আশি হাত। তা আপনাদের ইঁদারাটা ঠিক অতটা গভীর না হলেও অন্তত দশ বাঁও গভীর তো হবেই।” 

যেমন সত্যপ্রকাশ, তেমনি আমিও যেন ঘোর অন্ধকারের মধ্যে এতক্ষণে একটা আলোর রেখা দেখতে পেলুম। কিন্তু তবু যেন কথাটা বিশ্বাস করতে ঠিক ভরসা হচ্ছিল না। সত্যপ্রকাশ বললেন, “মূর্তিটিকে ইঁদারার মধ্যে ফেলে দিলে তো খুব জোরে একটা শব্দ হবার কথা। কিন্তু কই, তেমন কোনও শব্দ তো হয়নি।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “হবার কথা, কিন্তু হয়নি। কেন হয়নি, সেটাও আন্দাজ করা কঠিন নয়। মূর্তির হাইট তো মাত্র এক ফুট। ওজনও তাই খুব বেশি নয়। ইঁদারার জলের লেভেলও বিশেষ নীচে নেমে যায়নি। তা মূর্তিটিকে একটা দড়িতে বেঁধে ইঁদারার জল পর্যন্ত নামিয়ে দিয়ে যদি দড়িটা ছেড়ে দিই, তো শব্দ হবে কেন? টুপ করে সেটা তলিয়ে যাবে। চৌধুরিমশাই, আর দেরি না করে ইঁদারায় লোক নামান।” 

তা-ই নামানো হল। আর মাত্র আধ ঘন্টার মধ্যেই ইঁদারা থেকে উঠে এল সেই কষ্টিপাথরের মনসামূর্তি। ভাদুড়িমশাই ঠিকই আন্দাজ করেছিলেন। মূর্তির কোমরে লম্বা একটা দড়ি বাঁধা। 

সত্যপ্রকাশের মা নরম মনের মানুষ। ব্যাপার দেখে আবার তিনি ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। এবারকার কানা অবশ্য দুঃখের নয়, আনন্দের। পিসিমা বললেন, “মাগো, আমার ঠাকুর্দা তোমাকে মাটির তলা থেকে তুলে এনেছিলেন, আর আজ তোমাকে জলের তলা থেকে তুলে আনা হল। আর তুমি কোথাও চলে যেও না, মা, এই চৌধুরি-বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেও না।” 

স্থির চোখে আমি মুর্তিটিকে দেখছিলুম। দেবীর ক্ষীণ কটিদেশ বেষ্টন করে তাঁর বক্ষের উপরে উঠে এসেছে একটি সাপ, আর সেই সাপের মুণ্ডটিকে দক্ষিণ হস্তে ধারণ করে দেবী তার প্রসারিত ফণার দিকে তাকিয়ে আছেন। যেমন তাঁর চোখে, তেমনি তাঁর ওষ্ঠের বঙ্কিম ভঙ্গিমায় একটু হাসির আভাস। সে-হাসি স্নেহের হতে পারে, প্রশ্রয়ের হতে পারে, আবার কৌতুকেরও হতে পারে। 

সত্যপ্রকাশের ড্রইংরুমের আমরা বসে আছি। এ হল ঘন্টা-দুই পরের কথা। ইতিমধ্যে রঙ্গনাথবাবুকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। মূর্তি আবার শোধন করে প্রতিষ্ঠা করতে হবে, নতুন একজন পুরোহিতেরও দরকার হবে, এইসব ব্যাপার নিয়ে পরামর্শ চাওয়া হয়েছিল তাঁর। রঙ্গনাথ কথা দিয়ে গিয়েছেন, ব্যবস্থা যা যা করবার, তিনিই সব করে দেবেন। ধূপগুড়িতে তাঁর খুব চেনা একটি পরিবার নাকি রয়েছে, তাঁদের পেশাই হল পুজো-আচ্চা করা, বিশ্বাসী লোক, তাঁদেরই কাউকে এখানে নিত্য-পূজার জন্যে তিনি আনিয়ে দেবেন, সত্যপ্রকাশকে ও-সব নিয়ে কিছু ভাবতে হবে না। 

এসেছিল গোবিন্দর সেই মামাতো দাদাটিও। সে বলল, গোবিন্দর শ্রাদ্ধশাস্তির জন্যে অন্তত হাজার খানেক টাকা দরকার। নিরুকে ডেকে সত্যপ্রকাশ বলে দিলেন, পিসিমার কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে সে যেন গোবিন্দর মামাতো দাদাকে দিয়ে দেয়। 

ঘরে এখন শুধুই আমরা তিনজন মানুষ। সত্যপ্রকাশ ভাদুড়িমশাই আর আমি। সত্যপ্রকাশ ভাদুড়িমশাইকে বললেন, “অনুমতি দেন তো একটা কথা জিজ্ঞেস করি।” 

“করুন না। যা খুশি জিজ্ঞেস করুন। অত কিন্তু-কিন্তু করছেন কেন?” 

“মানে ওই যে ডাক্তারবাবু আজ সকালবেলায় এসে বললেন, থ্যাঙ্ক গড, গোবিন্দকে রিভলভারের গুলি খেয়ে মরতে হয়নি, ও-কথাটার অর্থ কী? আপনি কি সত্যি রিভলভার নিয়ে চোরের প্রতীক্ষায় বসে ছিলেন নাকি?” 

“তা ছিলুম বই কী, তবে কিনা সেটা ‘একটা জাপানি টয়-রিভলভার, শিলিগুড়ির হংকং-বাজার থেকে কাল কিনে নিয়ে এসেছিলুম। না মশাই, ওটা ভয় দেখাবার অস্ত্র, মারবার অস্ত্র নয়।” 

একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই, তারপর মুখ তুলে তীব্র চোখে সত্যপ্রকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, “মিঃ চৌধুরি, কথাটা যখন উঠল, তখন বলা-ই ভাল। যে রিভলভার দিয়ে মানুষ মারা যায়, আমার তা নেই ঠিকই, তবে আপনার বোধহয় আছে। যদি বলি যে, তা-ই দিয়ে একটা মানুষকে আপনি মেরেওছেন, তা হলে কি ভুল বলা হবে? অবশ্য মানুষ না বলে তাকে অমানুষও বলা যায়।” 

সত্যপ্রকাশ চমকে উঠলেন। বললেন, “তার মানে?” 

ভাদুড়িমশাই তাঁর চোখ সরিয়ে নিলেন না, যে-ভাবে সত্যপ্রকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, ঠিক সেইভাবে তাকিয়ে থেকে বললেন, “মানেটা মোটেই জটিল নয়, মিঃ চৌধুরি, ববং খুবই সহজ। কাল তো আমি শিলিগুড়িতে বেশিক্ষণ থাকিনি, নেহাত ঘন্টা কয়েক ছিলুম। কিন্তু তারই মধ্যে জোগাড় করেছি দুটো জরুরি খবর। প্রথম খবরটা এই যে, রাজদেও কুর্মির উপরে জগদীশ কেন, কেউই ছোরাছুরি চালায়নি; আসলে কুলি-বস্তির কাছাকাছি সেই অন্ধকার রাস্তায় সেদিন রাত্তিরে তাকে গুলি করে মারা হয়েছিল। শিলিগুড়িতে শুনলুম ব্যাপারটা নিয়ে তখন হৈ-চৈ হয়েছিল খুব।” 

সত্যপ্রকাশ কিছুই বলছিলেন না। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে ভাদুড়িমশাই বললেন, “এবারে তা হলে দ্বিতীয় খবরটা বলি। সেটা এই যে, রাজদেও ছিল সম্পৎলালের ডান হাত। সুতরাং সম্পৎ যে এই খুনের বদলা নেবে, এটাই স্বাভাবিক। বদলা নেবার কথাটা সে নাকি প্রকাশ্যে বলেওছিল। কীভাবে বদলা নেবে? না আদালতে সে প্রমাণ করে ছাড়বে যে, জগদীশ খুনি নয়, সে ছুরি চালাতে পারে ঠিকই, কিন্তু জীবনে কখনও ফায়ার আর্মস চালায়নি, আসলে সে অন্যের হয়ে আসামি সেজে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছে।” 

সত্যপ্রকাশ চুপ। পাথরের একটা মূর্তির মতো স্তব্ধ হয়ে তিনি বসে আছেন। ভাদুড়িমশাই বললেন, “সম্পৎলাল নাকি এমন কথাও তখন তিনবাত্তির মোড়ে দাঁড়িয়ে বলেছিল যে, আদালতে সে-কথা যদি প্রমাণ করা না-ও যায়, তো রাজদেওয়ের খুনির তাতেও রেহাই মিলবে না। তাঁকে তো সে চেনেই, ওই তিনবাত্তির মোড়েই সে তাঁর মাথার খুলি উড়িয়ে দেবে।” 

আবার কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর বললেন, “আসলে কিন্তু কিছুই হল না। জগদীশ রিভলভার চালাতে জানে কি না, আদালতে তা নিয়ে কোনও প্রশ্নই তুলল না কেউ। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে জগদীশ বলল, সে-ই গুলি চালিয়ে রাজদেওকে মেরেছে, আর তার হয়ে লড়বার জন্যে কলকাতার যে নামজাদা ল-ইয়ারকে লাগানো হয়েছিল, তিনি প্রমাণ করে ছাড়লেন যে, গুলি না-চালিয়ে জগদীশের উপায় ছিল না, হি হ্যাড টু ডু ইট ইন সেলফ ডিফেন্স। এদিকে সম্পৎলালও দেখা গেল নট নড়ন-চড়ন নট কিচ্ছু। অত তো সে লম্ফঝম্প করেছিল; বলেছিল যে, বদলা নিয়ে ছাড়বে। কাজের বেলায় সে কিন্তু কিছুই করল না। না গেল আদালতে সাক্ষ্য দিতে, না ওড়াল তিনবাত্তির মোড়ে আসল-খুনির খুলি।” 

সত্যপ্রকাশের মুখ একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। ঘরের মধ্যে এমন জমাট নৈঃশব্দ্য যে, একটা পিন পড়লেও বোধ করি তার শব্দ শোনা যেত। সেই স্তব্ধতাকে ভাদুড়িমশাই-ই ভাঙলেন। বললেন, “ঘটনাটাকে সম্ভবত এই চেহারা দেওয়া হল যে, রিভলভারটা আপনারই, কিন্তু দিন-কয়েক আগে সেটা চুরি হয়ে গিয়েছিল। তাই না?” 

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে মৃদু গলায় সত্যপ্রকাশ বললেন, “হ্যাঁ।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, সত্যপ্রকাশবাবু। যদ্দুর বুঝতে পারছি, জগদীশ অমানুষ নয়। সে যখন জেল খাটছিল, তার সংসারকে তখন আপনিই দেখেছেন। তার ছেলেকে আপনার কাঠের কারবারে চাকরি দিয়েছেন বলেও শুনেছি। জগদীশ কৃতজ্ঞ মানুষ, আসল কথাটা সে প্রাণ গেলেও কাউকে বলবে না। আর আমার কথা যদি জিজ্ঞেস করেন তো বলি, রাজদেও কুর্মি কীভাবে মারা গেল, ছুরি খেয়ে না গুলি খেয়ে, তার তদন্ত করতে তো ডাকা হয়নি আমাকে। আমি এসেছিলুম মূর্তি-চুরির তদন্তের কাজ নিয়ে, তো সে-কাজ মিটে গেছে। ব্যাস, অন্য কোনও ব্যাপারে আমি মাথা ঘামাতে যাব কেন?” 

ফ্যাকাশে ভাবটা কেটে গিয়ে সত্যপ্রকাশের মুখচোখ আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠছিল। বললেন, “রাজদেওকে মেরে কি আমি অন্যায় করেছি?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ওটা আপনার হিসেব, আপনি আমার চেয়ে ভাল বুঝবেন, আমার কিছু না-বলাই ভাল। আমি বরং আমার একটা আন্দাজের কথা বলি।” 

“বলুন।” 

“সম্পৎলাল যে আদালতেও গেল না, সরাসরি বদলাও নিল না, তার কারণ আর কিছুই নয়, ইউ সিম্পলি পারচেজড ইয়োর প্রোটেকশান। সম্পৎলালও বুঝে গিয়েছিল যে, আপনাকে জেলে পাঠিয়ে কি খুন করে ‘তার লাভ নেই, তার চেয়ে বরং আপনি বহাল-তবিয়তে থাকলেই তার সুবিধে। তা গত পাঁচ বছর ধরেই সে আপনাকে চুষে খাচ্ছিল, তাই না?’ 

করুণ হেসে সত্যপ্রকাশ বললেন, “চুষে চুষে আমাকে একেবার ছিবড়ে করে ফেলেছিল।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “যাক, সম্পৎলাল তো মরেছে, সুতরাং সে-দিক থেকেও এখন আপনি নিশ্চিন্ত। যা-ই হোক, এখন তা হলে নিশ্চয় বুঝতে পারছেন যে, তৃতীয় মিথ্যেবাদীটির নাম আমি করছিলুম না কেন?” 

“বুঝেছি।” সত্যপ্রকাশ বললেন, “আপনি টের পেয়ে গিয়েছিলেন যে, আমিই সেই তৃতীয় ব্যক্তি।” ভাদুড়িমশাই হো-হো করে হেসে উঠে বললেন, “বিলক্ষণ। রাজদেওয়ের মৃত্যুর ব্যাপারটা নিয়ে আপনি মিথ্যে কথা বলেছিলেন, সম্পৎলালের সঙ্গে আপনার সম্পর্কের ব্যাপারেও আপনি সত্য গোপন করেছিলেন। আর হ্যাঁ, নিরুর ব্যাপারেও আপনি সত্যি কথা বলেননি।” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “সেটাও আপনি বুঝতে পেরেছেন?” 

“বুঝব না কেন,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনি বলেছিলেন, নিরু এ-বাড়িতে বছর-দশেক হল কাজে ঢুকেছে। অথচ আমি জানতে পারলুম যে, নিরু এ-বাড়িতে কাজ করছে মোটামুটি পাঁচ বছর। আর, কাজের মেয়ে বলতে যা আপনি বুঝিয়েছেন, নিরু যে সত্যি তা নয়, আসলে সে যে আপনার স্বৰ্গতা স্ত্রী সুভাষিণী দেবীর ছোট বোন, সে তো ওই ফোটোতে আপনার স্ত্রীর মুখ দেখেই আমি বুঝেছি।” 

সত্যপ্রকাশ মস্ত একটা নিশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন, “ভুল করেছি। নিরুর ব্যাপারে আগাগোড়া আমি ভুল করেছি!” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা তো করেইছেন। কিন্তু সেটা যখন বুঝতে পেরেছেন, তখন দয়া করে আর সেই ভুলের জের টেনে চলবেন না। মা আর পিসিমাকে আজই জানিয়ে দিন যে, ও নিরু নয়, হাসি। আর ওকে ছাড়া যে আপনার চলবে না, সেও তো আমি প্রথম দিনই বুঝতে পেরেছি। স্ত্রীর মৃত্যুর পরে দ্বিতীয়বার বিয়ে না-করার যে-সব কারণ আপনি দেখিয়েছেন, তার একটাও তো সত্যি নয়, আসল কারণ হল হাসি, যার জীবনের সঙ্গে নিজের জীবনকে আপনি জড়িয়ে ফেলেছেন। তা আমি বলি কী, হাসিকে আপনি বিয়ে করে ফেলুন। লোকে কী বলবে না-বলবে, তা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। আমার তো ধারণা, যেমন আপনাব মা আর পিসিমা, তেমনি আপনার ছেলেময়েরাও তাতে খুশিই হবে। হাসির আসল পরিচয় এ-বাড়িতে একমাত্র রামদাস জানে, এবারে অন্যদেরও জানিয়ে দিন।” 

সত্যপ্রকাশ কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, ভাদুড়িমশাই তাঁকে বাধা দিয়ে বললেন, “আর কথা নয়, চলুন রঙ্গিলাকে একবার দেখে আসা যাক।” 

ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরের উঠোনে পৌঁছে দেখলুম, ঝুমরি আজও শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ভাদুড়িমশাই তার দিকে এগিয়ে গেলেন, তারপর রঙ্গিলাদের ঘরের পিছনে কুড়িয়ে-পাওয়া সেই চুলের কাঁটা তাঁর পাঞ্জাবির পকেট থেকে বার করে ঝুমরির দিকে এগিয়ে ধরে বললেন, “এটা নিশ্চয় তোমার জিনিস। সোমবার রাত্তিরে সম্ভবত পিছনের জানালা দিয়ে উঁকি মেরে তোমার মেয়েকে তুমি দেখতে গিয়েছিলে, আর রঙ্গিলার আয়াও নিশ্চয় তোমাকে দেখেই তখন ভূতের ভয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিল। তা অমন অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে দেখবার দরকার কী, মেয়ে তো তোমারই। ভয় পেও না, আমার সঙ্গে এসো, তোমার মেয়ে সুস্থ হয়ে উঠেছে, কথা বলছে, তাকে দেখে যাও, কেউ তোমাকে বাধা দেবে না।” 

৩৪ 

এই কাহিনির আর মাত্র একটুখানি বাকি, এবারে সেইটুকু বলব। তার আগে আর দু-একটা কথা সংক্ষেপে বলে নিই। সাধুবাবার আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। যেমন হঠাৎ তাঁর আবির্ভাব হয়েছিল, তেমনি হঠাৎ আবার সেদিন থেকেই তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন। রঙ্গিলা ভাল আছে, তবে সেদিন ভোর-রাতে যে কী হয়েছিল, কিছুই তার মনে নেই। শিলিগুড়ি থেকে তার নতুন আয়া এসে পৌঁছেছে। নিরু যে সুহাসিনী, মা আর পিসিমাকে তা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। দু’জনেই খুব খুশি। কাল কালীপুজো গেল। মুকুন্দপুরে কালীপুজো হয় না, তাই বোমা-পটকাও ফাটেনি। রাত্তিরে তাই চমৎকার ঘুম হয়েছিল। আজ সকালবেলায় সত্যপ্রকাশ নিজেই গাড়ি চালিয়ে আমাদের বাগডোগরায় নিয়ে এসেছেন। মুকুন্দপুর থেকে রওনা হবার সময় সুহাসিনী যে-রকম কৃতজ্ঞ চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল, চট করে সেটা ভোলা যাবে না। 

প্লেন লেট। সত্যপ্রকাশ ব্যস্ত মানুষ। তবু বারবার বলা সত্ত্বেও তিনি চলে যাননি, এয়ারপোর্টের রেস্তোরাঁয় বসে অপেক্ষা করছেন আমাদের সঙ্গে। কথায়-কথায় তিনি বললেন, “আমি আপনাদের বলেছিলুম যে, মনসামূর্তি প্রতিষ্ঠিত হবার পর মুকুন্দপুরে কাউকে সাপে কাটেনি। ওটা কিন্তু মিথ্যে কথা নয়। সত্যিই আমাদের গ্রামে সাপে কাটার ঘটনা তার পরে এই প্রথম ঘটল।” 

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “সে আর কী করা যাবে। গোবিন্দ একটা মারাত্মক খারাপ কাজ করেছিল। তার জন্যে একটা শাস্তিও পাওনা ছিল তার। তবে কিনা, মানুষের দরবারে সে-শাস্তি কবে হবে না-হবে, মনসাদেবী সম্ভবত ধৈর্য ধরে তার জন্যে আর অপেক্ষা করতে পারলেন না, নিজেই পেয়াদা পাঠিয়ে তাকে ছুলে দেবার ব্যবস্থা করলেন।” 

কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটল। তারপর সত্যপ্রকাশ বললেন, “মেয়েটাকে গোবিন্দ কী দিয়ে জখম করল বলুন তো?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “হলফ করে সেটা বলতে পারব না, তবে গোবিন্দ তো তখন মূর্তি নিয়ে পালাচ্ছিল, সেই অবস্থায় রঙ্গিলার সামনে পড়ে যায়। তা আমার বিশ্বাস, মূর্তিটা দিয়েই সে রঙ্গিলার মাথা ফাটিয়ে দেয়।” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “তা-ই হবে। সম্ভবত সেইজন্যেই মূর্তিটা একটু ড্যামেজড হয়েছে।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তাই নাকি?” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “ইঁদারা থেকে তুলে আনার পর মূর্তিটা দেখলেন না? মূর্তিকে যে সাপটা জড়িয়ে রয়েছে, তার লেজের একেবারে ডগার খানিকটা অংশ ভেঙে গেছে। তবে কিনা এমনও হতে পারে যে, ইঁদারা থেকে তুলবার সময়েই হয়তো অসাবধানে ভেঙে গিয়ে থাকবে।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তাও হতে পারে।” 

আমি আর কিছু বললুম না। কুচকুচে কালো যে সাপের কামড়ে গোবিন্দ মরেছে, ছোবল মেরে সেটা পালিয়ে গেলেও তার লেজের ডগাটাকে আমি গোবিন্দর শাবলের পাশে পড়ে থাকতে দেখেছিলুম। গোবিন্দ তার হাতের শাবলটা যখন ফেলে দেয়, তখন তারই আঘাতে হয়তো সাপের লেজের ডগার দিকটা কেটে গিয়ে থাকবে। কিন্তু সে-কথা এখন চেপে যাওয়াই ভাল। সব কণা কি সব সময় বলা যায়? না বলা উচিত? 

তা ছাড়া, বলবার সময়ই বা এখন কোথায়? এই মাত্র ঘোষণা করা হল, প্লেন এসে গেছে, ‘প্যাসেঞ্জারস ফর ক্যালকাটা, প্লিজ প্রসিড ফর ইয়োর সিকিওরিটি চেক।’ 

রচনাকাল ১৩৯৫