মুকুন্দপুরের মনসা – ২৫

২৫ 

নিরু চলে যাবার পরে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললুম, “রাত তো আটটা বাজতে চলল, এখন তা হলে কী করব?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “নিরু এখন একটু অস্থির হয়ে আছে, ন’টার আগে খাবার ডাক পড়বে বলে মনে হয় না। টর্চটা বার করুন।” 

“কেন, এখন আবার বেরুবেন নাকি?” 

“বেরুব, তবে দূরে যাব না, বাড়িটার চারদিকে একটা চক্কর দিয়ে আসব শুধু। আর তা ছাড়া ভট্‌চাজ-মশাইয়ের সঙ্গে একবার দেখা করা দরকার।” 

“ভট্‌ট্চাজ-মশাই মানে?”

“এঁদের পুরুতঠাকুর গোবিন্দ ভট্‌চাজ। ভদ্রলোকের সঙ্গে এখনও দেখা হয়নি। অথচ সেদিন শেষরাত্তিরে একমাত্র উনিই নাকি চোর পালাবার শব্দটা শুনতে পেয়েছিলেন। দেখি উনি কী বলেন।” 

জাম্পারটা খুলে রেখেছিলুম : পাঞ্জাবির উপরে আবার সেটাকে চড়িয়ে নিয়ে বললুম, “চলুন।”

ভাদুড়িমশাই গলায় একটা মাফলার জড়ালেন। আমাকে বললেন, “আপনি মাফলার এনেছেন তো?” 

বললুম, “শুধু মাফলার কেন, একটা আলোয়ানও এনেছি।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আলোয়ানের দরকার হবে না, তবে মাফলারটা জড়িয়ে নিন। বাইরে হিম পড়ছে, ঠান্ডা সাধারণত গলাতেই লাগে।” 

সুটকেশ খুলে মাফলারটা বার করে বললুন, “আমি রেডি।” 

ঘরের পুব দিকের দরজা খুলে আমরা বেরিয়ে এলুম। এ-ঘরের পুব আর পশ্চিম, দু’দিকেই দু’টি টানা বারান্দা। এ-দিকের বারান্দার পরেই বাইরের উঠোন। বাইরের এই উঠোনটা অন্দরের উঠোনের চেয়ে অনেক বড়। এরই উত্তরে মন্দির, পুবে রামদাসের ঘর আর দক্ষিণে কাচারি। কাচারি ঘরটাও রামদাসের ঘরের মতোই ছোট আর বড় দু’টি অংশে ভাগ করা। বড়-অংশটা বৈঠকখানা হিসেবে ব্যবহৃত হয়, বাইরের লোকজনেরা সেইখানেই বসেন। ছোট-অংশটায় থাকেন পুরুতঠাকুর। বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, পুরুতঠাকুরের থাকার একটা ব্যবস্থা করে দেবার জন্যেই ঘরটার মধ্যে একটা কাঠের পার্টিশান বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। 

পার্টিশানের ব্যাপারটা অবশ্য আগে বুঝিনি। পুরুতঠাকুরের সঙ্গে দেখা করবার জন্যে যখন তাঁর ঘরে ঢুকি, তখন বুঝেছিলুম। সে-কথায় একটু বাদেই আসব। 

বারান্দা পেরিয়ে উঠোনে নামলুম আমরা। ঠাহর করে দেখলুম, একমাত্র রামদাসের ঘরের মধ্যেই ক্ষীণ একটা আলোর আভাস পাওয়া যাচ্ছে, তা ছাড়া আর কোনও দিকেই আলোর কোনও চিহ্ন নেই। চতুর্দিকে একেবারে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। এতটুকু শব্দ কোথাও শোনা যাচ্ছে না। গাছপালাগুলোও একেবারে ছবির মতো স্থির। গাছপালার পাতা নড়লে তারও একটা শব্দ পাওয়া যায়। তাও পেলুম না। অন্ধকারের মধ্যে নড়াচড়া করতে তারাও সম্ভবত ভয় পাচ্ছে। 

আকাশের দিকে তাকিয়ে কিন্তু চোখ জুড়িয়ে গেল। এমন ঝলমলে আকাশ অনেক কাল দেখিনি। কার্ত্তিক মাস। অথচ এতটুকু কুয়াশা নেই। তারাগুলি একেবারে হিরের কুচির মতো ঝকঝক করছে। দু’দিন বাদেই কালীপুজো। চাঁদ ওঠেনি, জোৎস্নার কণামাত্র নেই কোনওখানে। কিন্তু তারই ফলে আজ নক্ষত্রের বাহার আরও বেশি খুলেছে। নক্ষত্র তো নয়, (খন লক্ষ-লক্ষ শমা-চুমকি। আর সেই শমা-চুমকি বসানো নিকষ কালো রঙের শালখানাকে গায়ে জড়িয়ে আকাশটা যেন খলখল করে হাসছে। 

টর্চটা নিবিয়ে দিয়ে বললুম, “দেখেছেন? কলকাতার আকাশে এর অর্ধেক তারাও আমাদের চোখে পড়ে না।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা পড়ে না ঠিকই, তবে কিনা একটা চাঁদে যত কাজ হয়, লক্ষ-লক্ষ তারায় তার সিকির-সিকি কাজও হয় না। একশ্চন্দ্রস্তমোহস্তি, চন্দ্রবিহনে পৃথিবী একেবারে অন্ধকার। টর্চটা জ্বালুন মশাই।” 

জ্বালবার আগেই অন্ধকারের ভিতর থেকে কে যেন আমার কব্জিতে হাত রেখে চাপা গলায় বলল, “এখন জ্বালবেন না। আমি আগে সরে যাই, তারপর জ্বালবেন।” 

চমকে গিয়েছিলুম। তার পরেই অবশ্য বুঝতে পারা গেল যে, লোকটি জগদীশ। আমাদের বারান্দার ঠিক বাইরে, উঠোনে নামবার সিঁড়ির একধারে সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। 

ভাদুড়িমশাইও চাপা গলায় বললেন, “সারাক্ষণ নজর রাখতে হবে ওই ঘরটার উপরে, মনে আছে তো?” 

“আছে বাবু।” 

“কেউ যেন ওর ধারেকাছেও যেতে না পারে।” 

জগদীশ বলল, “কেউ পারবে না।” বলেই সে হঠাৎ নিঃশব্দে সরে গেল। 

তারও খানিক বাদে টর্চ জ্বাললুম আমি। 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “জগদীশ যদি ঠিক কথা বলে থাকে তো এদিকটা নিয়ে ভাববার কিছু নেই। চলুন, মন্দিরের পুব দিকের রাস্তাটা ধরে একবার ঘুরে আসা যাক।” তারপর বললেন, “সাবধানে পা ফেলবেন। এখনও তেমন শীত পড়েনি, তার উপরে জংলা জায়গা, পথের উপরে সাপখোপ থাকাটা কিছু বিচিত্র নয়।” 

“তাতে ভয়ের কী আছে,” হেসে বললুম, “সত্যপ্রকাশ তো বলেই দিয়েছেন যে, মনসামূর্তি প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে মুকুন্দপুরে কাউকে সাপে কাটেনি।” 

“তা বলেছেন ঠিকই, তবে কিনা কোটা কার্যকারণ আর কোন্টা সমাপতন, সেটাও বোঝা চাই। আমার তো মনে হয়, সাপে কাউকে না-কাটার সঙ্গে মনসামূর্তি প্রতিষ্ঠার কোনও সম্পর্কই নেই। এটা নেহাতই সমাপতন…অর্থাৎ ইংরেজিতে ওই যাকে বলে কোইনসিডেন্স, সেই রকমের ব্যাপার আর কি।” 

“মানে সাদা-বাংলায় কাকতালীয় ঘটনা, কেমন?” 

“ঠিক বলেছেন। ঝড়ে কাক মরে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে’ বলে একটা প্রবাদ আছে না, এও একেবারে তা-ই।” 

“অর্থাৎ সাবধান থাকাই ভাল। কেমন?”

“বিলক্ষণ।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “সাধুবাবার ব্যাপারটা দেখলেন না? মুখে বলছেন মুকুন্দপুরে সাপই নেই, অথচ সাপের ভয়ে নিজে তো একেবারে কাঁটা হয়ে আছেন।” 

“সেটা কী করে বুঝলেন?” 

“আরে মশাই, সাপের ভয় যদি ওঁর না-ই থাকবে, তো ঘরের চারপাশে কারবলিক অ্যাসিড ছড়িয়ে রেখেছেন কেন?” 

“তাই তো, এটা তো খেয়াল করে দেখিনি।” 

ভাদুড়িমশাই যে হাসছেন, অন্ধকারের মধ্যেও সেটা বুঝতে পারা গেল। হাসতে-হাসতেই বললেন, “শুধু এটা কেন, অনেক কিছুই আপনি খেয়াল করে দেখেন না। কী করেই বা দেখবেন, মাটির দিকে তো আর আপনার চোখ নেই, চোখ পড়ে আছে আকাশের নক্ষত্রের দিকে!” 

এবারে আমিও হেসে উঠলুম। বললুম “ঠিক আছে, ঠিক আছে, এখন থেকে তা হলে মাটির দিকেই সারাক্ষণ চোখ রাখব।” 

“সারাক্ষণ না-রাখলেও এখন অন্তত রাখুন।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “মুখে আওড়ান আস্তিকস্য মুনের্মাতা’র মন্ত্র, কিন্তু পা ফেলুন মাটির দিকে চোখ রেখে। অর্থাৎ সাবধান থাকুন।” 

“তা না হয় থাকলুম, কিন্তু ‘আস্তিকস্য মুনের্মাতা টা কী ব্যাপার?”

আবার হেসে উঠলেন ভাদুড়িমশাই। বললেন, “বামুনের ঘরে জন্মেছেন, অথচ সংস্কৃতটাও জানেন না? এ তো বড় লজ্জার কথা মশাই! ‘আস্তিকস্য মুনেমার্তা’র অর্থ হল আস্তিক মুনির মা।” 

“তিনি আবার কে? 

“তিনি মনসা। ছেলের নাম আস্তিক হল কেন জানেন?” 

“নাস্তিক নামটা যেহেতু সুবিধের নয়, সেইজন্যে?” 

“আপনাকে নিয়ে আর পারা গেল না! তা হলে শুনুন, এই নামটা নিয়েও একটা গপ্পো রয়েছে। মনসার সঙ্গে যে জরৎকারু মুনির বিয়ে হয়েছিল, সে তো আগেই বলেছি। তা মনসা একদিন তাঁর স্বামীকে বললেন, আমাকে একটি পুত্রসন্তান দাও। স্ত্রীর প্রার্থনার উত্তরে মুনি বললেন, ‘অস্তি।’ অর্থাৎ কিনা ‘তোমার গর্ভেই রয়েছে আমার ছেলে’। বাস্, ওই ‘অস্তি’ থেকেই ছেলের নাম হয়ে গেল আস্তিক। তাবৎ সাপকে মারবার জন্যে রাজা জনমেজয় সর্পযজ্ঞ করেছিলেন, সে তো জানেন। এই আস্তিকের জন্যেই সাপেরা সেবারে রক্ষে পেয়ে যায়।” 

কথা বলতে-বলতে আমরা মন্দিরের উত্তর দিকের বাগানটাকে পাক দিয়ে আবার উঠোনে চলে এসেছিলুম। শুনেছিলুম, বাইরের উঠোনের দক্ষিণ দিকের ঘরে থাকেন পুরুতঠাকুর। আমাদের ঘর থেকে যখন উঠোনে এসে দাঁড়াই, এদিকে একমাত্র রামদাসদের ঘর ছাড়া আর-কোথাও তখন আলো জ্বলতে দেখিনি। এখন দেখলুম, রামদাসের ঘরটা অন্ধকার, তবে দক্ষিণের ঘরে আলো জ্বলছে। 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ভট্‌ট্চাজমশাই জেগে আছেন মনে হয়। চলুন, একবার দেখা করা যাক।”

যেমন অন্যান্য ঘরের, তেমনি দক্ষিণের এই ঘরের সামনেও কাঠের রেলিং দিয়ে ঘেরা টানা বাবান্দা। বারান্দায় উঠে দরজায় টোকা দিতে লন্ঠন হাতে নিয়ে ভিতর থেকে যিনি বাইরে এসে দাঁড়ালেন, বুঝতে পারলুম, তিনিই এ-বাড়ির নিত্যপুজার পুরোহিত গোবিন্দ ভট্টাচার্য। একে পুরোহিত, তায় নাম গোবিন্দ, ভেবেছিলুম যে, মানুষটি নিশ্চয় বৃদ্ধ হবেন। এখন দেখলুম, বৃদ্ধ তো ননই, এমনকী প্রৌঢ়ও নন। নেহাতই ছেলেমানুষ। বয়স মেরেকেটে সাতাশ-আঠাশ। পরনে ধুতি আর মলমলের হলুদ ফতুয়া। ফতুয়ার কাপড় পাতলা বলেই বোঝা গেল, যে, তার আড়ালে মোটা একটা পৈতে ঝুলছে। গোবিন্দ ভট্টাচার্যের গায়ের রং টকটকে ফর্সা, মুখখানিও মিষ্টি। 

আমাদের দেখেই বললেন, “আসুন, আসুন।” 

ঘরটি ছোট। একদিকে একটা সরু তক্তাপোশ। তার সামনে দুটি মোড়া। অন্যদিকের দেওয়ালে মনসার একখানা পট টাঙানো। তার সামনে মেঝের উপরে পশমের একখানি আসন পাতা। আসনের পাশে ধূপদান, কোষাকুষি, একটি শাঁখ, একটি কাঁসর আর পিতলের একটি পঞ্চপ্রদীপ। 

আমরা মোড়ায় বসলুম, গোবিন্দ ভট্টাচার্য বসলেন তক্তাপোশের একধারে। ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনার সঙ্গে এই আমাদের প্রথম দেখা হল।” 

ভট্‌চাজমশাই হেসে বললেন, “আন্দ সকালেই হতে পারত। ভেবেছিলুম চৌধুরিমশাই আমাকে ডেকে পাঠাবেন। কিন্তু পাঠাননি। আমিও তাই যাইনি। উনি না-ডাকলে আমার নিজের থেকে যেতে বড় সঙ্কোচ হয়।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “সে তো খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে চৌধুরিমশাই আপনাকে ডেকে না-পাঠালেও আপনার কথা আমাদের বলেছেন।” 

গোবিন্দ ভট্‌চাজ বললেন, “কী বলেছেন? ওঁর নিষেধ সত্ত্বেও যে নিত্য আমি আমার ঘরে বসেই পুজো করে যাচ্ছি, সেটা আবার উনি জেনে ফেলেননি তো?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “না না, ও-কথা কেউ তাঁকে বলেনি। কথা হচ্ছিল মূর্তি-চুরির ব্যাপারটা নিয়ে। চৌধুরিমশাই বললেন, একটা শব্দ আপনার কানে গিয়েছিল। লোকজন ছুটে পালাবার শব্দ। তা ছাড়া একটা গাড়ির শব্দও আপনি নাকি শুনেছিলেন। সত্যি?” 

আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল যে, চৌধুরিমশাই নন, আজ সকালে এই কথাটা বলেছিল রামদাস। কিন্তু ভাদুড়িমশাই তবু যখন রামদাসের নাম না-করে সত্যপ্রকাশের নাম করলেন, তখন তার একটা কারণ আছে নিশ্চয়। হয়তো তিনি ভাবছেন যে, চৌধুরিমশাইয়ের নাম করলে কথাটা আরও জোর পাবে। যা-ই হোক, ভুলটা আমি আর শুধরে দিলুম না। 

গোবিন্দ ভট্‌ট্চাজ বললেন, “চৌধুরিমশাই ঠিকই বলেছেন। সত্যিই আমি শব্দটা ওনেছিলুম।”

“শুনে আপনার কী মনে হয়েছিল?” 

“মনে হয়েছিল, জনাকয় লোক যেন দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে।” 

“কোনদিকে পালাচ্ছে?” 

“মন্দিরের উত্তর দিকে।” 

“তার মানে ফলবাগানের দিকে। তাই না?” 

“আজ্ঞে হ্যাঁ, বাগানের মধ্যে দিয়েই যেন হুড়মুড় করে পালিয়ে গেল তারা।” 

“আর ওই গাড়ির শব্দ?” 

“হ্যাঁ, সেটাও শুনতে পেয়েছিলুম। লোকজন পালাবার শব্দের প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই শুনেছিলুম।”

“তা হলে তো বুঝতে হয় যে, মুর্তিচোরেরা ওই গাড়িতে করেই পালিয়েছে।” 

কথাটা বলে একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর বললেন, “আপনি এখানে কতদিন হল পুজো করছেন?” 

“তা প্রায় বছর তিনেক হল।” 

“আপনার আগে এখানে কে পুজো করতেন?” 

“আমার বাবা। দু’বছর হল তিনি গত হয়েছে। তবে গত হবার আগে তা প্রায় এক বছর তিনি পুজো করতে পারেননি। করবার সামর্থ্যই তাঁর ছিল না। তখন থেকে আমিই পুজো করে যাচ্ছি।” 

“আপনারা কি এদিকের লোক?” 

ভট্‌চাজমশাই বললেন, “না, আমাদের বাড়ি বর্ধমান জেলায়। বাবাকে এঁরাই সেখান থেকে চিঠি লিখে আনিয়ে নিয়েছিলেন। বাবা আবার বছর তিনেক আগে আমাকে আনিয়ে নেন।” 

“বর্ধমানে আপনার কে আছেন?” 

“দাদারা আছেন, বৌদিরা আছেন, তাঁদের ছেলেপুলেরা আছে।” 

“আপনার মা?” 

“আমার বয়স যখন মাস ছয়েক, মা তখনই মারা যান। বাবা তার পরের বছরই মুকুন্দপুরে চলে আসেন। আমি মানুষ হয়েছি আমার এক পিসির কাছে।” 

“পিসিমা কোথায়?” 

“তিনিও বেঁচে নেই।”

আবার একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর বললেন, “এদিকে কেউ নেই আপনার?” 

“এক মামাতো দাদা থাকেন হাসিমারায়। তাঁর সেখানে দোকান আছে একটা। আগে তো আমি সেখান থেকেই রোজ যাতায়াত করতুম। কিন্তু তাতে বড় ধকল হয়। চৌধুরিমশাইকে কথাটা বলতে তিনি তাঁর কাচারিঘরটাকে পার্টিশান করে আমাকে বললেন, তুমি তা হলে এখানে থাকো। সেই থেকে এখানেই আছি।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “একটা কথা বুঝতে পারছি। সেটা এই যে, যাঁদের বাড়িতে আছেন, তাঁদের মঙ্গল-অমঙ্গলের কথাটা আপনি ভাবেন। তা নইলে নিশ্চয় চৌধুরিমশাইয়ের নিষেধ সত্ত্বেও পুজোটা আপনি চালিয়ে যেতেন না।” 

গোবিন্দ ভট্‌ট্চাজ হেসে বললেন, “তাই বলে আবার কথাটা ওকে জানিয়ে দেনে না যেন।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “পাগল! তাই কখনও বলি!” 

ভট্‌চাজমশাইয়ের ঘর থেকে নেমে উঠোন পেরিয়ে আমরা আমাদের ঘরে এসে ঢুকলুম। 

২৬ 

সাড়ে নটায় খাবার ঘরে ডাক পড়ল। নিরুই ডাকতে এসেছিল। বলল, “জামাইবাবু আজ আর বোধ হয় ফিরতে পারবেন না, শিলিগুড়িতেই থেকে যাবেন।”

আমারও তা-ই মনে হচ্ছিল। তবু বললুম, “আর কিছুক্ষণ দেখলে হত না?” 

চারু বলল, “আপনারা খেয়ে নিন। নইলে মা আর পিসিমাও খাবেন না।” 

“রাত্তিরে ওঁরা কী খান?” 

“একটু দুধ আর খই। দিতে তো গিয়েছিলুম। তা ওঁরা বললেন, আপনাদের খাওয়া আগে হয়ে যাক, তারপরে ওঁরা খাবেন।” 

নিরুকে একটু লজ্জিত দেখাচ্ছিল। খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। ঝোঁকের মাথায় এমন অনেক কথা সে আজ বলেছে, একমাত্র সত্যপ্রকাশ ছাড়া আর কাউকেই যা হয়তো সে এতদিন বলেনি। তাঁকেও সব কথা বলেছে কি না কে জানে! লজ্জা নিশ্চয় তারই জন্যে। তবে কথা বলছিল হালকা গলায়। তাতে মনে হল, যা সত্য, বছরের পর বছর তাকে গোপন করে রাখার মধ্যে একটা গ্লানি থাকে তো, আর-কিছু না হোক, সেই গ্লানিটা সে আজ ধুয়ে ফেলতে পেরেছে। তারই ফলে কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছে হয়তো। 

সত্যপ্রকাশ ছিলেন বলেই কাল খাবার টেবিল একেবারে জমজমাট ছিল। আজ তিনি নেই, তাই ছবিটা একেবারে অন্যরকম। মা আর পিসিমা অবশ্য যথারীতি এসে দুটি চেয়ার টেনে বসে আমাদের খাওয়ার তদারক করতে লাগলেন, কার কী লাগবে বলে দিতে লাগলেন নিরুকে, পেট ভরে খাওয়া সত্ত্বেও আরও কিছু-না-কিছু নেবার জন্যে আমাদের বারকয়েক অনুরোধ করলেন। রামদাসও যথারীতি এসে একধারে ঠায় সমস্তক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু সত্যপ্রকাশ না-থাকায় আহার-পর্বটা বিশেষ জমল না। প্রায় নিঃশব্দে খেয়ে উঠে বেসিনে হাত ধুয়ে আমরা ঘরে ফিরে এলুম। 

মশলার ডিবে হাতে নিয়ে একটু বাদেই এল নিরু। ডিবেটা টিপয়ের উপরে রেখে দিয়ে বলল, “আপনারা তো একটু আগে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। সেই ফাঁকে আপনাদের বিছানা আবার নতুন করে পেতে রাখা হয়েছে, জগের জলও পালটে দেওয়া হয়েছে। আর হ্যাঁ, জামাইবাবুর কথামতো দু প্যাকেট সিগারেট আর দুটো দেশলাই আপনাদের দুজনের টেবিলে রেখে দিয়েছি। এখন বলুন, আর কিছু লাগবে? কাগজ কি কলম কি অন্য কিছু? লাগে তো বলুন, এনে দিচ্ছি।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিচ্ছু লাগবে না। তুমি এবারে গিয়ে মা আর পিসিমাকে খেতে দাও।”

নিরু চলে গেল। 

ভাদুড়িমশাই একটা সিগারেট ধরিয়ে নিঃশব্দে টানলেন কিছুক্ষণ। জিজ্ঞেস করলুম, “এবারে কি শুয়ে পড়া যায়?” 

ভাদুড়িমশাই কোনও উত্তর দিলেন না। বুঝলুম, তিনি কিছু ভাবছেন। 

সিগারেটটা শেষ হবার পরে তার গোড়ার দিকটাকে অ্যাশট্রেতে পিষে দিয়ে হঠাৎ তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, “আপনার টর্চটা একবার দিন তো।” 

টর্চটা এগিয়ে দিয়ে বললুম, “আবার বেরুতে হবে নাকি?” 

“আপনার আর বেরুবার দরকার নেই। আপনি বিক্রাম করুন। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল, তাই ভাবছি যে, একটু ঘুরে আসব। যাব আর আসব, দেরি হবে না।” 

টর্চটা হাতে নিয়ে বাইরের উঠোনের দিকের দরজা খুলে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলেন ভাদুড়িমশাই। একবার ভেবেছিলুম আমিও তাঁর সঙ্গে যাই। কিন্তু গেলুম ন’। ভাদুড়িমশাইয়ের কথা থেকে আমি বুঝতে পেরেছিলুম যে, যে-কোনও কারণেই হোক, একাই তিনি বেরুতে চাইছেন। 

শুয়ে পড়লে ঘুম এসে যেতে পারে। অথচ ভাদুড়িমশাই যেহেতু বাইরে, তাই দরজায় খিল দেবারও উপায় নেই। এই অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়াটা উচিত হবে না। কলকাতা থেকে যে ম্যাগাজিনগুলো নিয়ে এসেছিলুম, বসে-বসে তারই একটার পাতা ওলটাতে লাগলুম। 

ভাদুড়িমশাই অবশ্য আধ ঘন্টার মধ্যেই ফিরে এলেন। বললেন, “যাক, ঘুমিয়ে পড়েননি দেখছি।”

“এই অবস্থায় ঘুম হয়?… তা ঘুরে তো এলেন, কিছু চোখে পড়ল আপনার?” 

“দুটো জিনিস চোখে পড়ল। এক, সাধুবাবার ঘর থেকে আমাদের রঙ্গনাথবাবু বেরিয়ে এলেন। দুই, রামদাসের কান খুবই সজাগ। অন্ধকারে আমাকে দেখতে পায়নি, কিন্তু ওদের ঘরের পিছনে গিয়ে চুপ করে একবার দাঁড়িয়েছিলুম তো, তখন আমার পায়ের একটা হালকা শব্দ নিশ্চয় পেয়ে থাকবে।” 

“কী করে বুঝলেন?” 

“তক্তাপোশে বসে ছিল, হঠাৎ ‘কে ওখানে’ বলে চেঁচিয়ে উঠল।” 

“জগদীশকে দেখতে পেলেন?” 

“পেয়েছি, কথাও হয়েছে। লোকটা যেন একটা ছায়ার মতো ঘুরে বেড়ায়। বলতে গেলে প্রায় সারাক্ষণই আমার কাছে-কাছে ছিল, অথচ প্রথম পাঁচ-সাত মিনিট সেটা আমি বুঝতেই পারিনি। ওকে নিয়ে কোনও ভাবনা নেই। ও যতক্ষণ পাহারায় আছে, রঙ্গিলার ধারেকাছে যাবারও ক্ষমতা কারও হবে না।” 

“রঙ্গনাথের ব্যাপারটা কিছু বুঝলেন? এত রাত্তিরে উনি সাধুবাবার আখড়ায় গিয়েছিলেন কেন?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কী করে বলব? আমরা শুধু আশা করতেই পারি।” 

“কী রকম?” 

“এই যেমন আমি আশা করছি যে, কোনও বদ মতলব নিয়ে উনি ওখানে যাননি। গিয়েছিলেন সাধুবাবাকে একটা অনুরোধ করতে।” 

“কী অনুরোধ?” 

“স্পষ্ট করে সেটা জানবার তো উপায় নেই। তবে অনুমান করতে পারি যে, গ্রামের লোকেরা যে সাধুবাবার উপরে বেজায় খাপ্পা হয়ে গেছে, সেটা বুঝিয়ে বলতে গিয়েছিলেন। সেইসঙ্গে এই অনুরোধটাও ওঁকে হয়তো করেছেন যে, এই অবস্থায় উনি যেন আর মনসাদেবীর নিন্দেমন্দ করে না বেড়ান।… আর-কিছু জিজ্ঞেস করবেন?”

“না।” 

“এবারে তবে আমি একটা প্রশ্ন করি আপনাকে।” 

বললুম, ‘আপনার আবার কী প্রশ্ন?” 

“দমদম এয়ারপোর্টে আপনার এক কলিগের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছিল। ভদ্রলোক আমাদের সঙ্গে বাগডোগরা পর্যন্ত আসেন। আপনিই বলেছিলেন যে, উনি আপনাদের কাগজের রিপোর্টার। নাম চন্দ্রমাধব। ঠিক বলেছি?” 

“হ্যাঁ। তা চন্দ্ৰমাধব আবার কী করল?” 

“কিছু করেনি।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “ভদ্রলোক দার্জিং যাবেন বলছিলেন না?”

“হ্যাঁ, তবে এখনও হয়তো যায়নি। চন্দ্রমাধব আসলে শিলিগুড়ির ছেলে। শিলিগুড়িতে দু’চার দিন না-কাটিয়ে নিশ্চয় দার্জিলিং যাবে না।” 

“আপনার সঙ্গে ওঁর কথা শুনে অন্তত সেইরকম মনে হয়েছিল। তা কাল যদি আমি একবার শিলিগুড়ি যাই, ওঁর দেখা পাওয়া যাবে?” 

“মনে তো হয় পাবেন।” 

“শিলিগুড়িতে কোথায় থাকেন উনি?” 

“বাবুপাড়ায়। ওর বাবা খুবই নামজাদা ডাক্তার। সূর্যশঙ্কর সেন। তবে বাবার পরিচয় দেবার দরকার হবে বলে মনে হয় না, বাবুপাড়ায় ঢুকে চন্দ্রমাধবের নাম করলেই চলবে। কিন্তু কাল আপনি শিলিগুড়ি যাবেন কেন?” 

“এখানকার কাজ মোটামুটি শেষ হয়েছে, এখন একবার শিলিগুড়ি থেকে ঘুরে এলেই ছবিটা একেবারে পরিষ্কার হয়ে যায়। আপনার যাবার দরকার নেই। একাই যাব। বিকেলের মধ্যেই ফিরে আসব আবার।…নিন, এবারে শুয়ে পড়ুন।” 

.

রামদাস না-ডাকলে নিশ্চয় ঘুম ভাঙতে অনেক দেরি হত। চোখ খুলে দেখি, হাতে চায়ের কাপ নিয়ে রামদাস দাঁড়িয়ে আছে। 

জিজ্ঞেস করলুম, “কটা বাজে?” 

“সাতটা” 

ভাদুড়িমশাইয়ের বিছানার দিকে তাকিয়ে তাঁকে দেখতে পেলুম না। বললুম, “তোমাকে দরজা খুলে দিল কে?” 

রামদাস বলল, “দরজা তো খোলাই ছিল, বাবু।” 

বুঝতে পারলুম যে, ভাদুড়িমশাই আমার আগেই ঘুম থেকে উঠে হাঁটতে বেরিয়েছেন। ভদ্রলোক নিশ্চয় ভেবেছেন, আগের রাত্তিরে ঘুম না-হওয়ায় আমার মন-মেজাজ বিশেষ ভাল নেই, তাই আমাকে আর ডাকেননি। 

বললুম, “ভাদুড়িমশাইকে চা দিয়েছ রামদাস?”

“চায়ের কথা জিজ্ঞেস করেছিলুম,” রাদাস বলল, “তা বাবু বললেন যে, এখন আর চা খাবেন না, ফিরে এসে খাবেন।” 

চা শেষ করে রামদাসের হাতে পেয়ালা-পিরিচ ধরিয়ে দিয়ে বললুম, “রঙ্গিলা কেমন আছে?”

“কাল রাতে আর জ্বর আসেনি বাবু, সকালেও দেখলুম যে, গা একেবারে পাথরের মতো ঠান্ডা। আমাকে দেখে একটু হাসলও যেন। মনে তো হয় চিনতে পেরেছ। তবে কথা বলছে না।”

“তাও বলবে নিশ্চয়। জ্বরটা যখন ছেড়েছে, তখন আর চিন্তা কোরো না, এবারে ঠিকই সুস্থ হয়ে উঠবে।” 

“তা-ই বলুন, বাবু। মেয়েটার বাপ মারা গেছে, মা’টা থেকেও নেই, পুজো-আচ্চা নিয়ে ছিল, তার মধ্যে এই কান্ড।” 

রামদাস চলে যাচ্ছিল। যেতে-যেতে দরজা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “হাত-মুখ ধুয়ে নিন বাবু, গোপালের মা’কে দিয়ে কাগজ পাঠিয়ে দিচ্ছি।” 

“কাগজ মানে?” 

“কলকাতা থেকে শিলিগুড়িতে যে খবরের কাগজ আসে, সেই কাগজ। খোকাবাবু কাল শিলিগুড়ি থেকে নিয়ে এসেছে।” 

“বলো কী! সত্যপ্রকাশবাবু কি রাত্তিরেই ফিরে এসেছেন নাকি?” 

“হ্যাঁ বাবু,” রামদাস একগাল হেসে বলল, “বারোটা নাগাদ ফিরেছে। আপনাদের কথা জিজ্ঞেস করেছিল। ঘুমিয়ে পড়েছেন শুনে আর ডাকেনি।” 

রামদাস ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমি গিয়ে বাথরুমে ঢুকলুম। মুখ-হাত ধুয়ে, দাড়ি কামিয়ে, স্নান-টান সেরে বেরিয়ে দেখি, ভাদুড়িমশাই ফিরে এসেছেন। ইতিমধ্যে কাগজ দিয়ে গিয়েছিল, ইজিচেয়ারে বসে তার উপরে চোখ বুলোচ্ছেন তিনি। 

বললুম, “কোথায় গিয়েছিলেন?” 

কাগজ থেকে চোখ না তুলেই ভাদুড়িমশাই বললেন, “এই একটু ঘুরে এলুম।” 

“হাত-মুখ ধুয়েছেন?” 

“শুধু হাত-মুখ ধোয়া কেন, স্নানও সেরে নিয়েছি। আপনি ঘুমিয়ে ছিলেন, টের পাননি। “সত্যপ্রকাশ শুনলুম রাত্তিরেই ফিরে এসেছেন।” 

“তাও শুনেছি। তবে দেখা হয়নি। দেখা হলে ব্যাঙ্কের ব্যাপারটা বোঝা যাবে।” 

চুল আঁচড়াবার জন্যে টেবিল থেকে চিরুনিটা তুলতে গিয়ে দেখি, সেখানে একটা চুলের কাঁটা পড়ে আছে। বললুম, “আরে, এটা আবার কোত্থেকে এল?” 

ভাদুড়িমশাই কাগজে চোখ রেখেই বললেন, “কাঁটার কথা বলছেন? কাল রাত্তিরে তো একা একবার ঘুরতে বেরিয়েছিলুম। তখন রঙ্গিলাদের ঘরের পিছনে এটা কুড়িয়ে পেয়েছি।” 

“কার চুলের কাঁটা?” 

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “ভূতের।” তারপর একেবারে অন্য প্রসঙ্গে গিয়ে বললেন, “একটু বাদেই ব্রেকফাস্টের ডাক পড়বে। আজ কী খাব বলুন তো?” 

“কী জানি।” 

“পরোটা আর আলুর দম। তার সঙ্গে থাকবে আতা-ক্ষীর।”

“কী করে বুঝলেন?”

“খুব সহজেই বোঝা গেল। সাত-সকালে ঘুম থেকে উঠে ভিতরের উঠোনের দিকের দরজা খুলে বারান্দায় এসে দেখি, মা আর পিসিমা আমার আগেই উঠে পড়েছেন। পিসিমা মুখ ধুচ্ছেন উঠোনের টিউবওয়েলে, আর মা রয়েছেন রান্নাঘরে। সেখান থেকে মা বললেন, ‘তোমার হাতের আলুর দম তো সতুর ভারী পছন্দ ঠাকুরঝি, তা তুমি এসে সেটার ব্যবস্থা করো, আর আমি এদিকে পরোটার জন্যে ময়দা ঠেসে রাখি।’ তাতে টিউবওয়েল থেকে পিসিমা বললেন, ‘পরোটা আর আলুর দম না হয় হল, কিন্তু মিষ্টির কী হবে বৌদি? আমি বলি কী, ঘরে তো বড়-বড় গোটাকয় আতা রয়েছে, তুমি বরং আতা-ক্ষীর করো, সতুর ওটাও খুব পছন্দের খাবার।’ তো কিরণবাবু, এই হচ্ছে ব্যাপার।” 

ভাদুড়িমশাইয়ের কথা শেষ হতে-না-হতেই ভেজানো দরজায় টোকা পড়ল। সেই সঙ্গে সত্যপ্রকাশের গলা শোনা গেল, “আসতে পারি?” 

বললুম, “আসুন, আসুন। আপনি যে রাত্তিরেই ফিরেছেন, সে-খবর একটু আগে পেলুম।”

সত্যপ্রকাশ একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন। বললেন, “ব্রেকফাস্ট রেডি। চলুন, খাবার ঘরে গিয়ে কথা বলা যাক।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কাজ হল?” 

সত্যপ্রকাশ শুকনো হেসে বললেন, “জেনারেল ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করেছিলুম, তা লোনের ব্যাপারে তিনি কিছু কমিট করেননি। ডিনারে ডেকেছিলুম। বললেন যে, সময় হবে না। অর্থাৎ লক্ষণ সুবিধের নয়। তা আমি দেখলুম, তবে আর শিলিগুড়িতে রাত কাটিয়ে কী হবে, তাই রাত্তিরেই ফিরে এলুম।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “সম্পৎলালকে খবরটা দেবার ব্যবস্থা করেছেন?” 

“যাকে পাঠিয়েছিলুম, সম্পৎলালের সঙ্গে সে যোগাযোগই করতে পারেনি।” 

“ব্যাঙ্কের জেনারেল ম্যানেজার কি কলকাতায় ফিরে গেছেন?” 

“না। শুনলুম যে, আরও দু’দিন তিনি শিলিগুড়িতে থাকবেন। এখানকার ব্রাঞ্চের ট্রানজাকশানে নাকি কীসব গন্ডগোল ধরা পড়েছে। সেইজন্যেই আরও দু’দিন থেকে যাবেন তিনি।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমার এখানকার কাজ মোটামুটি শেষ করে এনেছি। এখন একবার শিলিগুড়ি যাওয়া দরকার।” 

“শিলিগুড়ি কেন?” 

“ওখান থেকে বর্ডার খুব কাছে তো, মাল পাচার করার তাই মস্ত সুবিধে। একটু খোঁজখবর নিতে চাই।” 

“কিছু আন্দাজ করতে পেরেছেন?” 

“কিছুটা পেরেছি। মনে হচ্ছে কালকের মধ্যে বাকিটাও পেরে যাব। সেইজন্যেই একবার শিলিগুড়ি যেতে চাইছি। আপনার গাড়িটা যদি পাই, তো বিকেলের মধ্যেই ফিরে আসতে পারব।” 

“স্বচ্ছন্দে নিয়ে যান।” সত্যপ্রকাশ বললেন, “অ্যাম্বাসাডারটা তো আছেই, কাল আবার সুবিমলের ফিয়াটটা নিয়ে চলে এসেছি। দুটোই রয়েছে। যেটা আপনার খুশি।” 

“আর-একটা কথা।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আয়াটি যখন থাকতে চাইছে না, ওকেও তখন শিলিগুড়িতে নিয়ে যাই। যার থাকার ইচ্ছে নেই, তাকে না-রাখাই ভাল। শিলিগুড়ি থেকে বরং আর-কোনও আয়াকে নিয়ে আসব।” 

“সুশীলা একেবারেই থাকতে চাইছে না?” 

“না। কাল বিকেলে ডাক্তারবাবুকে অন্তত সেই কথাই বলেছিল।” 

সত্যপ্রকাশের মুখখানা একটু কঠিন দেখাল। একটু ভেবে বললেন, “ঠিক আছে, ওকে তা হলে নিয়েই যান। রামদাসকে বলে দিচ্ছি, ওকে তৈরি হয়ে নিতে বলুক।” 

কথা বলতে-বলতে আমরা খাবার ঘরে এসে ঢুকলুম। ব্রেকফাস্টের ব্যাপারে ভাদুড়িমশাই দেখলুম ঠিকই বলেছিলেন। পরোটা আর আলুর দম তো ছিলই, তার সঙ্গে ছিল আতা-ক্ষীর। তবে খাওয়ার ব্যাপারে ভাদুড়িমশাইয়ের বিশেষ উৎসাহ দেখা গেল না। 

চটপট ব্রেকফাস্ট শেষ করে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। রামদাস এসে বলল, আয়া তার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে অপেক্ষা করছে। ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমি তা হলে ফিয়াটটা নিয়ে যাচ্ছি।” 

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই তিনি শিলিগুড়ি রওয়া হয়ে গেলেন। 

২৭ 

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলুম, সাড়ে আটটা। জিজ্ঞেস করলুম, “ভাদুড়িমশাই কতক্ষণে শিলিগুড়ি পৌঁছবেন বলে মনে হয়?” 

সত্যপ্রকাশ হারলেন। বললেন, “সেটা নির্ভর করছে কী স্পিডে উনি গাড়ি চালাবেন, তার উপরে।” 

“আমাদের সেদিন শিলিগুড়ি থেকে মুকুন্দপুরে পৌঁছতে কতক্ষণ লেগেছিল?” 

“সেদিন মানে পরশুর কথা বলছেন?”

“হ্যাঁ।” 

“তিন ঘন্টা। আমার সাধারণত তিন ঘন্টাই লাগে। অবশ্য এখানে-ওখানে এক-আধবার আমাকে থামতে হয়। সেদিন যেমন ময়নাগুড়িতে থেমেছিলুম।” 

“সেদিন আপনি যে-স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছিলেন, ভাদুড়িমশাই মোটামুটি সেই স্পিডেই চালান। তবে পথের মধ্যে উনি কোথাও থামবেন বলে মনে হয় না।” 

“নন-স্টপ চালালে আড়াই ঘন্টার বেশি লাগবার কথা নয়। অর্থাৎ কিনা এগারোটার মধ্যেই পৌঁছে যাবেন। কেন যাচ্ছেন, কিছু বুঝতে পারলেন?” 

“না। যাবার ব্যাপারে যা বললেন, সে তো আপনিও শুনেছেন।”

“হ্যাঁ। কিন্তু তার থেকে তো স্পষ্ট কিছুই বোঝা গেল না।” খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন সত্যপ্রকাশ। তারপর বললেন, “উনি বোধহয় সন্দেহ করছেন যে, শিলিগুড়ি দিযে মূর্তিটা পাচার করা হয়েছে। বর্ডারের কথাটা বোধহয় সেইজন্যেই বললেন। তাই না?”

“বর্ডার তো এদিক থেকেও দূরে নয়।” আমি বললুম, “ওদিক থেকে নেপালের বর্ডার কাছে পড়ে, এদিক থেকে ভুটানের বর্ডার। মূর্তি যদি পাচার হয়েই থাকে, তবে যে তা নেপালের বর্ডার দিয়েই হয়েছে, এমন কথা তো জোর করে বলবার উপায় নেই।”

কথাটা সত্যপ্রকাশের পছন্দ হয়েছে বলে মনে হল। সম্ভবত সেই কারণেই বলেন, “তা হলে তো ভূটানের বর্ডারের কথাই ওঁর আগে ভাবা উচিত ছিল।” 

তার বদলে ভাদুড়িমশাই কেন শিলিগুড়ির দিকে ছুটলেন, স্পষ্ট করে সেটা না-বুঝলেও একটা কারণ অবশ্য আমি অনুমান করতে পারছিলুম। আমার মনে হচ্ছিল, আসলে তিনি সম্পৎলালকে সন্দেহ করছেন। লোকটা যে কুখ্যাত স্মাগলার, ভাদুড়িমশাই সেটা জানেন। সুতরাং মুর্তি-চুরির ব্যাপারে সম্পৎলালকে সন্দেহ করাটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। বরং সেটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক। 

কিন্তু চুরিটা সে কীভাবে করল? হঠাৎ একটা সম্ভাবনার কথা উঁকি দিয়ে গেল আমার মনের মধ্যে। গোবিন্দ ভট্‌চাজ শুধু চোর পালানোর শব্দ নয়, শেষ রাত্তিরে একটা গাড়ির আওয়াজও শুনতে পেয়েছিলেন। তা হলে কি সে-গাড়ি সম্পৎলালেরই? সে নিজে হয়তো আসেনি। কিন্তু যারা এসেছিল, তারা তারই দলের লোক। মুর্তিটা হাতিয়ে নিয়ে তারা নিশ্চয় সম্পৎলানের হাতে তুলে দিয়েছে। আর তা যদি দিয়ে থাকে, তা হলে শিলিগুড়ি থেকে সে-মূর্তি নেপালে পাচার করা তো তার পক্ষে আদৌ শক্ত হবার কথা নয়। 

তার পরেও অবশ্য একটা প্রশ্ন থেকে যায়। প্রশ্নটা আর কিছুই নয়, সম্পৎলাল এই মূর্তির কথা জানল কী করে? সে তো শিলিগুড়িতে লেবার কনট্রাক্টের কাজ করে। থাকে শিলিগুড়িতেই। এখানকার এই প্রাচীন মনসামূর্তির কথা তা হলে সে কার কাছে শুনল? তবে কি সত্যপ্রকাশই… 

উত্তেজনায় যেন বুকের মধ্যে টিপ-টিপ করছিল আমার। সম্পৎলালের সঙ্গে সত্যপ্রকাশের যোগাযোগের ব্যাপারটা তা হলে এইজন্যেই ভাদুড়িমশাইয়ের ভাল লাগেনি। সম্ভবত তিনি ভেবেছেন যে, নিজের হাতে সরাবার সাহস হয়নি বলে সম্পৎলালের সাহায্যে মুর্তিটিকে সরিয়ে ফেলবার ব্যবস্থা করেছেন সত্যপ্রকাশ। সম্পৎলাল তাঁর কাছে প্রচুর টাকা পায়, অথচ ব্যাঙ্ক-লোনের ব্যবস্থা না-হওয়া টাকাটা সত্যপ্রকাশ দিতে পারছেন না। অগত্যা তাঁকে ভাবতে হয়েছে মনসামূর্তি বিক্রি করে টাকা তুলবার কথা। শাঁসালো কোনও বিদেশি খদ্দেরের কাছে যদি বেচতে পারেন তা হলে ওই মূর্তির যে দাম মিলবে, তাতে সম্পৎলালের পাওনা মেটাবার ব্যবস্থা তো হবেই, উদ্বৃত্ত হিসেবে তাঁর নিজের হাতেও নেহাত কম টাকা আসবে না। ব্যাপারটা যদি তা-ই হয়, তা হলে এই যে মুর্তি-চুরির ব্যাপারটা নিয়ে থানায় ডায়েরি করেছেন সত্যপ্রকাশ, আর তার উপরে আবার ভাদুড়িমশাইকেও কলকাতা থেকে এখানে আনিয়েছেন, এ তো নেহাতই লোক-দেখানো ব্যাপার। 

আমার মনে হচ্ছিল, ভাদুড়িমশাই ঠিকই সন্দেহ করেছেন। কিন্তু একইসঙ্গে তিনি নিশ্চয় ভাবছেন যে, মুর্তিটি হয়তো এখনও নেপালে পাচার হয়নি, হয়তো সম্পৎলালের কাছেই সেটা আছে এখনও। সম্ভবত সেইজন্যেই এমন তাড়াহুড়ো করে তিনি শিলিগুড়ি চলে গেলেন। 

কিন্তু গ্রামের সেই চাষিবউটি? তার তা হলে কী ব্যাপার? রঙ্গনাথ যে তাকে বললেন ‘…যেখান থেকে নিয়ে এসেছ, সেইখানেই আবার রেখে এসো’, ও-কথার তাৎপর্য তা হলে কী? 

আবার যেন সব জট পাকিয়ে যেতে লাগল। একটু আগেই ভাবছিলুম যে অন্ধকারের মধ্যে যেন এখানে-ওখানে গোটাকয় আলো জ্বলে উঠছে। কিন্তু এখন আবার সব অন্ধকার। 

“কী ভাবছেন এত?” 

সত্যপ্রকাশের কথায় আমি চমকে উঠলুম। বললুম, “না, তেমন-কিছু না।”

“আর-এক রাউন্ড চায়ের কথা বলি?” 

“চা?…ও হ্যাঁ, আর-এক কাপ হলে তো ভালই।” 

“তা হলে চলুন ড্রইং রুমে গিয়ে বসা যাক, চা ওখানেই দিয়ে আসবে।” 

খাবার ঘর থেকে সত্যপ্রকাশের বসবার ঘরে চলে এলুম আমরা। 

আগেই বলেছি, অন্দরের উঠোনের উত্তর-দিকের এই ঘরটা দোতলা। উপরে সত্যপ্রকাশের শোবার ঘর আর নীচে তাঁর বসবার ব্যবস্থা। উপরটা এখনও দেখিনি, নীচতলাটা বেশ সাজানো-গোছানো। ঘরের উত্তর-দিকটায় দেওয়াল-বরাবর বুক-সমান উঁচু করে টানা হয়েছে বই রাখবার জন্যে কাচের পাল্লা-বসানো টানা-র্যাক। পশ্চিম-দিকে, ঘরের ভিতর থেকেই, একটা পালিশ-করা কাঠের সিঁড়ি উপরে উঠে গিয়েছে। তার উল্টো-দিকে পুরু গালচের চার পশে সাজানো সোফা-সেটি। একপাশে একটা ডিভান। আর এক পাশে একটা ছোট রাইটিং টেবিল আর হালকা একটা চেয়ার। এই রাইটিং টেবিলের দেরাজ থেকেই পরশু রাত্তিরে মনসা-মূর্তির ফোটোগ্রাফ বার করে সত্যপ্রকাশ আমাদের দেখিয়েছিলেন। 

যে-সোফাটায় আমি বসে ছিলুম, সেখান থেকে পুব-দিকের খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই মন্দিরের চুড়োটা আমার চোখে পড়ল। উঠে গিয়ে জানালার ধারে দাঁড়ালুম আমি। মন্দির আর এই ঘরের মাঝখানে একটা বড়সড় চত্বর। চত্বরটা সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো। তার মাঝখানে ইঁদারা। এরই জলের গুণের কথা সত্যপ্রকাশ খুব গর্ব করে বলেছিলেন। 

চত্বরের উত্তরে ফলের বাগান। বাগান যেখানে শুরু হয়েছে, তার এদিকে পাশাপাশি দুটি উঁচু গাছ যেন থামের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে, আর তার পত্রপল্লব সারাক্ষণ ছায়া বিস্তার করে রেখেছে চত্বরটির উপরে। দেখে মনে হয়, গাছ দুটি যেন গোটা জায়গাটার উপরে দুটো ছাতা ধরে আছে। 

এই ধরনের গাছ এ-গ্রামে আরও অনেক দেখেছি, কিন্তু কীসের গাছ তা জানি না। সত্যপ্রকাশকে জিজ্ঞেস করতে তিনি বললেন, “এ হল মুচুকুন্দ চাঁপা। এখানে এ-গাছ বিস্তর দেখবেন। কেন, কলকাতায় এ-গাছ চোখে পড়েনি?” 

বললুম, “পড়েছে বলে মনে হয় না।”

সত্যপ্রকাশ হেসে বললেন, “আমার কিন্তু পড়েছে। আমরা তো কলকাতার লোক নই, কাজেকর্মে মাঝেমধ্যে কলকাতায় যেতে হয়, তাও চোখে পড়েছে।” 

“কোথায়?” 

“টালা পার্কের ওদিকে গেছেন কখনও?” 

“মাঝেমধ্যেই তো যাই। কেন, ওদিকে এ-গাছ আছে নাকি?” 

“টালা পার্কের উত্তরের দিকটায় বেশ কয়েকটা আছে। অন্তত বছর পাঁচেক আগেও ছিল। সিক্সটি সেভেন… না না, সিক্সটি এইটে একবার কলকাতায় গিয়ে মণীন্দ্র রোডে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে দিন তিনেক ছিলুম। রোজ সকালে তখন টালা পার্কে বেড়াতে যেতুম। মনে আছে, চাঁপার গন্ধে বাতাস যেন ভারী হয়ে থাকত। আর ওই গন্ধ আমাকে মনে পড়িয়ে দিত মুকুন্দপুরের কথা। একটা মজার কথা কী জানেন?” 

“কী?” 

“আমাদের এই গ্রামের নামও আসলে মুচুকুন্দপুর। সরকারি নাথিপত্রে আর ডাকঘরের ছাপেও দেখবেন মুকুন্দপুরের কোনও উল্লেখই নেই। সর্বত্র মুচুকুন্দ।” 

“লোকে তা হলে মুকুন্দপুর বলে কেন?” 

“বলে, তার কারণ, মুখে-মুখে অনেক কাল ধরে মুকুন্দপুর নামটাই চালু হয়ে গেছে। মুকুন্দ মানে তো বিষ্ণু, নারায়ণ। তা এখানে কোনও বিষ্ণুমন্দির দেখলেন?” 

“কই, দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না।” 

“থাকলে তো দেখবেন। মুকুন্দর নামে গ্রামের নাম হলে একটা বিষ্ণুমন্দিরও এখানে থাকত। কিন্তু তা তো আর হয়নি। গ্রামের নাম হয়েছে গাছ থেকে। যেমন অনেক জায়গাতেই হয়। কলকাতাতেও তালতলা, বেলতলা, নেবুতলা, এইসব আছে না? সবই গাছের নামে নাম। এও তেমনি। মুচুকুন্দ ফুলের গাছ থেকে মুচুকুন্দপুর। আবার সেই মুচুকুন্দপুর থেকে লোকের মুখে-মুখে মুকুন্দপুর।” 

ভাবলুম, ভাদুড়িমশাই ফিরলে এটা তাঁকে বলতে হবে। অনেক-কিছুই তিনি জানে। বটে, কিন্তু এটা নিশ্চয় জানেন না। 

গোপালের মা চায়ের ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকল। সেন্টার টেবিলে ট্রেটা নামিয়ে রেখে বলল, “মাস্টারমশাই এসেছেন, দাদাবাবু। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। তাঁকে এখানে নিয়ে আসব?” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “বেশ তো, এখানেই নিয়ে এসো। আর হ্যাঁ, পটে ক’কাপ চা দিয়েছ?”

“চার কাপের মতন হবে।” 

“ঠিক আছে, তা হলে আর চা দেবার দরকার নেই। শুধু আর-একটা কাপ দিয়ে যাও। এতেই আমাদের তিনজনের হয়ে যাবে।” 

গোপালের মা কুণ্ঠিত গলায় বলল, “বলেন তো আর এক পট চi দিয়ে যাচ্ছি।” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “দরকার হবে না। যাও, মাস্টারমশাইকে নিয়ে এসো।” 

মাস্টারমশাইকে ডাকবার আগে গোপালের মা এসে আর-এক জোড়া কাপ-প্লেট রেখে গেল। তার একটু পরেই মাস্টারমশাই এসে ঘরে ঢুকলেন। 

তাঁর বসবার জন্যে আমার পাশের সোফাটা দেখিয়ে দিয়ে সত্যপ্রকাশ বললেন, “কী খবর মাস্টারমশাই? আর-কোনও গন্ডগোল নেই তো?” 

মাস্টারমশাই বললেন, “একেবারে যে নেই, তা নয়। বুড়োরা আমাকে মান্যি করে, হুট করে আমার কথাটা তারা কেউ ফেলবে বলে মনে হয় না। তবে ছোকরাদের রক্ত গরম, তারা বেজায় খেপে আছে। তার উপরে আবার খুড়োমশাইটিও বড্ড অবুঝ। এত করে তাঁকে বললুম যে, এইভাবে মা-মনসার নিন্দেমন্দ করাটা তাঁর ঠিক হচ্ছে না, তবু কাল সন্ধেবেলায় রথতলায় গিয়ে একগাদা লোকের সামনে তিনি জাঁক করে একটা বিচ্ছিরি কথা বলে বসলেন।” 

“কী বললেন?” 

“বললেন যে, তিনি মন্তর দিয়ে ব্যাংখেকো কানিটাকে ভ্যানিশ করিয়ে দিয়েছেন। ভাগ্যিস আমি সেখানে ছিলুম। নইলে সেখানেই একটা রক্তারক্তি ব্যাপার হতে যেত।।ন্তু এইভাবে আর কতদিন চলবে সত্য? একটা কিছু ব্যবস্থা করা দরকার।” 

মাস্টারমশাই একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “ব্যবস্থাটা যত তাড়াতাড়ি করা যায়, ততই ভাল।” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “কী যে করব, কিছুই তো বুঝতে পারছি না। উনি আমার কাকা হন। যতই অন্যায় করুন, সম্পর্কে গুরুজন, ওঁকে কোনও কড়া কথা বলা তো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।” 

“বেশ তো, কড়া কথা বলবার দরকার নেই। কিন্তু বুঝিয়ে তো বলতে পারো যে, এখান থেকে এবারে ওঁর চলে যাবার সময় হয়েছে। না-গেলে যে ওঁরই বিপদ ঘটতে পারে, সেটাই বা বুঝিয়ে বলতে বাধা কোথায়?” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “ঠিক আছে, একটু ভেবে দেখি।” 

ভদ্রলোককে এমন অসহায় দেখাচ্ছিল যে, একটু মায়া বোধ না-করে পারলুম না। 

চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। মাস্টারমশাই উঠে পড়লেন। আমিও বললুম, “আপনি বিশ্রাম করুন মিঃ চৌধুরি। খাওয়ার সময়ে আবার দেখা হবে।” 

বলে নিজের ঘরে চলে এসে একটা ম্যাগাজিন টেনে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লুম। শুয়েই মনে পড়ল, সত্যপ্রকাশের ঠাকুর্দার ডায়েরিটা তো এই ঘরেই রয়েছে। এই ফাঁকে সেটার উপরে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যেতে পারে। টেবিলের ড্রয়ার থেকে ডায়েরিটা বার করে আনলুম আমি। 

২৮ 

লাল রঙের মোটা কাপড় দিয়ে মোড়া শক্ত-করে বাঁধানো খাতাখানার উপরে চোখ বুলিয়ে বোঝা গেল যে, জীবনের একেবারে শেষপ্রান্তে পৌঁছে মহেশ্বর চৌধুরি এই ডায়েরি লিখতে শুরু করেন। তাও যে রোজ লিখতেন, তা নয়। মেরেকেটে মাত্রই পঞ্চাশ-ষাট দিন লিখেছিলেন। তবে অনেক লেখাই বেশ বড় মাপের। তার মধ্যে প্রথম লেখার তারিখ দেখছি ‘পহেলা বৈশাখ, সন ১৩৩৭ বঙ্গাব্দ’ আর শেষ লেখার তারিখ ‘চৌঠা আষাঢ়, সন ১৩৩৯ বঙ্গাব্দ’। অর্থাৎ ১৯৩০ সালের এপ্রিলে যার সূচনা, ১৯৩২ সালের জুনের পরে তা আর এগোয়নি। 

লেখার ধাঁচটা যে ঠিক রোজনামচার, তাও নয়। যে-দিনের লেখা, খুব গুরুত্বপূর্ণ না হলে সে-দিনের কোনও ঘটনার কথা সাধারণত আসেনি; যেখানে এসেছে, সেখানেও দেখছি মহেশ্বর চৌধুরি সেই ঘটনার সূত্র ধরে চলে গিয়েছেন তাঁর অতীত জীবনের প্রসঙ্গে। পড়তে-পড়তে আমার মনে হল যে, বর্ধমানের যে গ্রামকে একদিন তিনি ছেড়ে চলে এসেছিলেন, সেই গ্রামের কথা তিনি কোনও দিনই ভুলতে পারেননি, যেন সেই গ্রাম, যেখানে তিনি তাঁর শৈশব, বাল্য, কৈশোর, এমনকী তাঁর যৌবনেরও উন্মেষ পর্ব কাটিয়ে এসেছিলেন, সেই গ্রামের স্মৃতিই তাঁর উত্তর-জীবনেও এক প্রকান্ড প্রচ্ছায়া বিস্তার করে রেখেছে। 

মাত্রই দু’বছর এই ডায়েরি লিখেছিলেন মহেশ্বর চৌধুরি। কিন্তু তারই ভিতর থেকে যে মানুষটির মুখ বারবার আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল, সেই মানুষটি বড় দুঃখী, বড় বিধ্বস্ত। এমন নয় যে, ভাগ্য তাঁকে সাচ্ছল্য দেয়নি। হয়তো যা তশা করেছিলেন, তার চেয়ে ঢের বেশি পরিমাণেই দিয়েছিল। কিন্তু শান্তি দেয়নি কণামাত্র। ভাগ্য তাঁকে বিত্ত দিয়েছিল, কিন্তু বেদনা দিয়েছিল তার চতুর্গুণ। ডায়েরির প্রথম লেখাতেই পড়েছে সেই বেদনার ছাপ।

“জলপাইগুড়ি হইতে গত ২৭ চৈত্র যে দুঃখের খবর আসিয়া পঁহুছিয়াছে, তেমন মর্মান্তিক দুঃখ যেন কাহাকেও কখনও পাইতে না হয়। সুরেন্দ্রনাথ মারা গিয়াছে, কলিকাতার মেডিক্যাল কলেজ হইতে বড় ডাক্তার আনানো হইয়াছিল, কিন্তু যাহার যকৃৎ নষ্ট হইয়া গিয়াছে, কে তাহাকে বাঁচাইবে। 

“বড় আশা করিয়া মাত্রই বারো বৎসর বয়সে আমার প্রাণাধিক প্রিয় কন্যা সতীর বিবাহ দিয়াছিলাম। এত অল্প বয়সে আজিকালি বড় কেহ কন্যাকে পাত্রস্থ করে না। আমিই বা করিয়াছিলাম কেন? হেতু আর কিছুই নহে, পাত্রটিকে সতীর মাতাঠাকুরানির তো বটেই, আমারও বড় পছন্দ হইয়াছিল। একে তো পাত্রের পিতা ভূধরবাবু সমাজে সম্মানিত ব্যক্তি, উপরন্তু ধনাঢ্য ভূস্বামীও বটেন, তায় পাত্রটিও সাতিশয় কান্তিমান ও অল্পবয়স্ক। ভাবিয়াছিলাম, সতী সুখী হইবে। 

“হায়, যে-যুবক এত রূপবান, তাহার অন্তর যে এত অন্ধকারময় এবং আচরণ এত কদর্য, তাহা কে জানিত! তাও আশা করিয়াছিলাম যে, বিবাহের পরে সুবেন্দ্রনাথের চরিত্র ধীরে-ধীরে সংশোধিত হইবে। কিন্তু বিধাতা বিরূপ, তাহা হইল না। কৈশোর হতেই সে অমিতাচারী, ক্রমে ক্রমে সেই অমিতাচার আরও বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। 

“সতী কখনও ঘুণাক্ষরেও আমাকে ইহার আভাস দেয় নাই। সমস্ত গ্লানি ও অপমান সে নীরবে সহ্য করিত। কিন্তু এ-সব কথা কাকের মুখে ছড়ায়। ভাল খবর কেহ দিক আর না-ই দিক, বাড়ি বহিয়া মন্দ খবর পঁহুছিয়া দিবার লোকের কখনও অভাব হয় না। সবই তাই আমার কানে আসিত। যাহা শুনিতাম, তাহাতেই বুঝিয়া গিয়াছিলাম যে, অল্প বয়স হইতেই এত যাহার সুরাসক্তি, দীর্ঘায়ু হওয়া তাহার পক্ষে সম্ভব হইবে না। কিন্তু তাই বলিয়া যে মাত্র সাতাইশ বৎসর বয়সেই তাহার আয়ু ফুরাইবে, এমন ভাবি নাই। 

“সতী সবেমাত্র কুড়ি বৎসর অতিক্রম করিয়া একুশে পড়িয়াছে। এই বয়সেই তাহার সিঁথির সিঁদুর মুছিয়া গেল। আমি তো পাষাণ নহি, তাই তাহাকে দেখিতে যাই নাই, ভয় ছিল তাহার বৈধব্যবেশ আমি সহ্য করিতে পারিব না। সতীর মাতৃদেবীকে ভাগ্যবতী বলিব, একমাত্র কন্যার বৈধব্যদশা তাঁহাকে দেখিতে হইল না, গত বৎসরই তিনি স্বর্গারোহণ করিয়াছেন। 

“রামদাসকে সঙ্গে দিয়া নিত্যপ্রকাশকে জলপাইগুড়ি পাঠাইয়াছিলাম। গত পরশ্ব তাহারা ফিরিয়া আসিয়াছে। তাহাদেরই মুখে শুনিলাম, মদ্যপ পুত্রের মৃত্যুর জন্য বৈবাহিকা মহাশয়া এখন পুত্রবধূকে অহোরাত্র গালি পাড়িতেছেন ও বলিতেছেন যে, সতীর নিশ্চিত বৈধব্যযোগ ছিল, নহিলে এত অল্প বয়সে সুরেন্দ্রনাথের মৃত্যু হইত না। বলিবার কিছু নাই। আমরা তো কার্যকারণে বিশ্বাস করি না। হয় সমস্ত কিছুর জন্য ভাগ্যকে দোষ দিই, অথবা একের অপরাধ চাপা দিবার জন্য অন্যকে দোষী সাজাই। 

“কিন্তু ওই বাড়িতে সতী এখন থাকিবে কীভাবে? একটি সন্তান যদি থাকিত, তবে অন্তত তাহাকে বুকে চাপিয়া সে তাহার দুঃখভার ত্ন করিতে পারিত। কিন্তু তাহাও তো তাহার নাই। নিত্যকে বলিয়াছি, শ্রাদ্ধশান্তি চুকিয়া যাউক, তাহাার পরেই সে যেন সতীকে এখানে লইয়া আসে।” 

পরের এন্ট্রির তারিখ ৬ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩৭। মহেশ্বর সেখানে লিখছেন : 

“কয়েক দিন হইল সতী মুকুন্দপুরে আসিয়াছে। নিত্যই লইয়া আসিয়াছে। নিত্যর উপরে আমার বড় আস্থা নাই। কিন্তু বধুমাতাটি খুবই বুদ্ধিমতী। সতী এই গৃহে আসিবামাত্র বধুমাতা তাঁহার নিজের সন্তানটিকে যেভাবে সতীর কোলে তুলিন দিলেন, তাহাতেই তাঁহার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় আবার নূতন করিয়া পাইলাম। সতীও যেভাবে তাহার দুই বৎসর বয়স্ক দুগ্ধপোষ্য ভ্রাতুষ্পুত্রটিকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া অশ্রুমোচন করিতে লাগিল, তাহতে আশা হয়, এই শিশুটিই তাহার পিতৃষ্বসার বেদনাভার অনেকাংশে লাঘব করিতে পারিবে। 

“কাল ঝড় উঠিয়াছিল। জ্যৈষ্ঠ মাস। সারাদিন খুব গরম গিয়াছিল। তাহার পর মধ্যরাতে উঠিল প্রবল ঝড়। ঝড়ের পর বৃষ্টি নামিল। ঘন্টা দুই-তিন অবিশ্রান্ত বৃষ্টিপাতের ফলে গরম অনেক কমিয়া গিয়াছে, সকালের বাতাসেও একটা ঠান্ডা-ঠান্ডা ভাব। 

“তরঙ্গিণীর কথা মনে পড়িতেছে। রোজই পড়ে। তবে আজ একটু বেশি করিয়া মনে পড়িতেছে। সেই অভাগিনীও এমনই এক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাত্রিকালে গৃহত্যাগ করিয়াছিল। সে যদি না গৃহত্যাগ করিত, আমার জীবন যে তবে সম্পূর্ণ অন্যখাতে বহিত, তাহাতে সন্দেহ নাই : তরঙ্গিণী এখন কোথায় আছে? সে কি আদৌ বাঁচিয়া আছে? কিছুই জানি না। … 

“তরঙ্গিণীর কথা অদ্যাবধি কাহাকেও বলি নাই। না বলিয়াছি আমার স্ত্রীকে, না আমার পুত্রকন্যাকে। অন্য কাহাকেও বলিবার তো কোনও প্রশ্নই উঠে না। সকলেই জানে যে, আমার মাতাপিতার আমি একমাত্র সন্তান, বাল্যবয়সে অনাথ হইবা ভাগ্যান্বেষণে নানা স্থানে ঘুরিতে-ঘুরিতে এই উত্তরবঙ্গে আসিয়া নতুন করিয়া জীবনারম্ভ করিয়া। তরঙ্গিণী নামে যে আমার একটি বালবিধবা ভগ্নি ছিল, এবং সেই ভগ্নিটিকে যে আমি প্রাণাপেক্ষা ভালবাসিতাম, তাহা কেহ জানে না।… 

“তাহার কথা কাহাকেও জানাই নাই কেন? জানাইবার উপায় ছিল না, তাই জানাই নাই। তরঙ্গিণী যেদিন আমাদের কর্মচারী দিবানাথের সঙ্গে গোপনে গৃহত্যাগ করে, জগৎ-সংসার আমার চক্ষে সেদিন শূন্য হইয়া গিয়াছিল। ভগিনী কুলত্যাগিনী, গ্রাণে তাই আমাকে একঘরে করা হয়। খুব অপমান যোগ করিয়াছিলাম। কেহ আমার সহিত কথা কহিত না, আমাকে উদ্দেশ করিয়া দূর হইতে ব্যঙ্গবিদ্রুপের বাণ নিক্ষেপ করা হইত। আরও কত যে লাঞ্ছনা সহিয়াছিলাম! মাঝে-মাঝে তরঙ্গিণীর উপরে রাগও হইত খুব। সে শুধু নিজের কথাই ভাবিয়াছে; কই, আমার কী দশা হইবে, তাহা তো ভাবিয়া দেখে নাই। 

“আজ আর রাগ হয় না। আজ সতীকে দেখি, আর ভাবি, সতীই বা তাহার বৈধব্যযন্ত্রণা আমৃত্যু সহ্য করিবে কেন? তরঙ্গিণীর মতো সতীও যদি তাহার জীবনসঙ্গী হিসাবে দ্বিতীয় কাহাকেও বাছিয়া লয়, তবে লউক। না, তরঙ্গিণীর মতো কোনও ঝড়ের রাত্রে তাহাকে গৃহত্যাগ করিতে হইবে না, আমি পুরোহিত ডাকিয়া তাহার পুনর্বিবাহের ব্যবস্থা করিয়া দিব।” 

মুকুন্দপুরে কেন বসতি স্থাপন করেছিলেন, তার উল্লেখ দেখলুম ১৩৩০ বঙ্গাব্দের ১৭ শ্রাবণের লেখায়। মহেশ্বর সেখানে জানাচ্ছেন: 

“ঠিক ছিল যে কোচবিহারে যাইব। তথায় যাইয়া যদি মহারাজের দর্শন পাই, তবে আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইতে পারে। রাজকোষ হইতে কিছু সাহায্য পাইলে মন্দির প্রতিষ্ঠার কাজ সহজ হয়! তখন অন্তত তাহাই ভাবিয়াছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর কোচবিহারে যাওয়া হইল না। পথিমধ্যে এই মুকুন্দপুরের মায়াবন্ধনে আবদ্ধ হইয়া এখানেই রহিয়া গেলাম। 

“সেই সন্ধ্যাটির কথা অদ্যাপি ভুলি নাই। চল্লিশ বৎসর অতিক্রান্ত হইল, অথচ তাহার স্মৃতি আজও চিত্তপটে জাগরূক রহিয়াছে। গ্রামের নাম কী, তখনও তাহা জানিতাম না। এক চাষিগৃহস্থের বাড়ির দাওয়ায় বসিয়া আছি। ভাবিতেছি, পরদিবস প্রত্যুষে আবার কোচবিহারের পথে রওয়ানা হইব। হঠাৎ 

এক ঝলক বাতাস বহিল, আর তখনই চতুর্দিক আমোদিত হইয়া উঠিল এক চিত্তহারী সৌরভে। 

“এই গন্ধ আমার পরিচিত। গৃহস্থকে জিজ্ঞাসা করিতে সে জানাইল যে, এই গ্রামে চাপাগাছ রহিয়াছে অজস্র, গাছে ফুল আসিয়াছে, তাই কয়েকটা মাস এখন চাপাফুলের গন্ধে বাতাস একেবারে ভরপুর হইয়া থাকিবে। 

“ঠিক কথা। চাঁপাই বটে। তবে মুচুকুন্দ চাঁপা। মুচুকুন্দ চাঁপার গাছ খুবই দীর্ঘ হয়। ফুলগুলিও হয় বেশ বড় মাপের। পুরু, লম্বাটে পাপড়ি। আমাদের বর্ধমানের গ্রামেও এ-গাছ অনেক ছিল! 

“যে গ্রাম ছাড়িয়া আসিয়াছি, যেখানে আমার লাঞ্ছনা-অপমানের সীমা ছিল না, সহসা যেন তাহারই জন্য আমার মনের মধ্যে কেমন আকুলিবিকুলি করিতে লাগিল। সে-রাত্রে আমার ঘুম হইল না। স্থির করিলাম, কোচবিহারে যাইব না, এইখানেই থাকিব। 

“এই গ্রামের নাম অবশ্য মুকুন্দপুর নহে, প্রকৃত নাম মুচুকুন্দপুর। সে-কথা পরে জানিয়াছি।” পাতাগুলি দ্রুত উল্টে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ এক জায়গায় চোখ আটকে গেল। তারিখ দেওয়া রয়েছে ২৩ ভাদ্র, ১৩৩৮। মহেশ্বর সেই তারিখের নীচে লিখছেন: 

“ভাদ্রমাস শেষ হইতে চলিল। উত্তরবঙ্গ এমনিতেই বড় শ্যামল জায়গা। বৃষ্টিধারায় স্নাত হইবার ফলে তাহার নিবিড় অরণ্যানীর শ্যামশোভা যেন আরও উজ্জ্বলতা প্রাপ্ত হইয়াছে। আকাশে আজ মেঘ নাই। গোটা আকাশ যেন নীলকান্তমণির ন্যায় ঝকমক করিতেছে। শারদীয় মহাপূজার লগ্নও প্রায় আসিয়া পড়িল। 

“প্রতি বৎসরই এই সময়ে বড় বেদনা বোধ করি। চিত্তপ্রকাশ যে সংসার-আশ্রম পরিত্যাগ করিয়াছে, এই বেদনা যেন এই সময়েই আরও বেশি করিয়া বাজে। কেন যে তাহার সন্ন্যাসে মতি হইল, কে জানে। ছাত্রাবাস হইতে নিরুদ্দেশ হইবার অনেক দিন পরে হরিদ্বার হইতে সে একখানি চিঠি লিখিয়াছিল। তাহাতে কোনও ঠিকানা দেয় নাই। শুধু জানাইয়াছিল যে, ঈশ্বর-সাধনাকেই সে তাহার একমাত্র ব্রত হিসাবে গ্রহণ করিয়াছে। ঘরে থাকিয়া কি সেই ব্রতের উদ্যাপন করা যাইত না? মাতাপিতার বুকে বেদনার শেল বিদ্ধ না করিয়া যাহার উদযাপন হয় না, সে কেমন ব্রত? 

“নিত্যপ্রকাশ আর চিত্তপ্রকাশ, আমার দুই পুত্রের অবস্থান যেন পরস্পরের একেবারে বিপরীত দুই বিন্দুতে। বাল্যবয়স হইতেই নিত্যপ্রকাশ ভোজনবিলাসী, পোশাক-পরিচ্ছদেও অতিমাত্রায় শৌখিন। চিত্তপ্রকাশ তো তাহারই ভ্রাতা। অথচ আহার্যের ব্যাপারে চিত্ত কখনও কোনও বায়না করিয়াছে বলিয়া মনে পড়ে না, তাহার পরিধানেও কোনও বাবুয়ানা কখনও লক্ষিত হয় নাই। বুদ্ধি কিংবা মেধা যে নিত্যর কিছু কম, এমন বলি না, তবে লেখাপড়ায় সে কখনও মনোনিবেশই করিল না। চিত্ত সে-ক্ষেত্রে অধ্যয়নকেই তাহার তপস্যা বলিয়া জানিয়াছিল। সে ছিল সংসারে একেবারেই অনাসক্ত; আর এদিকে নিত্যর বিষয়াসক্তি দিনে-দিনে বাড়িতেছে বই কমিতেছে না।” 

সত্যপ্রকাশের কাছে শুনেছিলুম যে, এই পরিবারে ব্যাবসার পত্তন হয়েছিল তাঁর বাবার আমলে। ঠাকুর্দা নাকি জমিজমা নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন, ব্যাবসার জনে: যে সময় দেওয়া চাই, তা তাঁর ছিল না। আগ্রহও যে ছিল না, মহেশ্বর চৌধুরির ডায়েরি পড়তে-পড়তে সেটা বোঝা গেল। ৫ অগ্রহায়ণ ১৩৩৮ তারিখে তিনি লিখছেন : 

“চিত্তপ্রকাশকে হারাইয়াছি। এখন নিত্যপ্রকাশকে লইয়াও বড় আশঙ্কা হয়। এই আশঙ্কার প্রকৃতি অবশ্য একেবারেই ভিন্ন। সে ব্যবসায় করিতে চাহে। সেই কারণে আমার কাছে টাকা চাহিয়াছিল। অঙ্কটা ছোট নহে। দশ হাজার। বলিলাম, অত টাকা কোথায় পাইব, নগদ যাহা ছিল তাহা তো মন্দির নির্মাণ করিতেই ব্যয়িত হইয়া গিয়াছে। নিত্য এ-কথা শুনিয়া কহিল, চাষবাস করিয়া আমাদের কী-ই বা লাভ হয়, জমি বিক্রয় করিয়া টাকা দিন, ব্যবসায়ে খাটাইলে ও-টাকা দ্বি, হইয়া ফিরিবে। কথাটা শুনিয়া আমি স্তম্ভিত। াণিজ্যে বসতে লক্ষ্মীঃ, ইহা কে না জানে। ব্যবসায়ে-বাণিজ্যে অবশ্যই বিস্তর লাভ। কিন্তু বিস্তরে আমার দরকার নাই, কৃষিকর্মে তদর্থং পাইয়াই আমি পরিতৃপ্ত। আর তা ছাড়া, জমি বিক্রয় করাকে আমরা মাতৃবিক্রয়ের সমতুল্য পাপকর্ম বলিয়া গণ্য করিয়া থাকি। 

“হায়, নিত্যকে সে-কথা কে বুঝাইবে! অর্থই তাহার একমাত্র উপাস্য, অর্থই তাহার ধ্যানজ্ঞান। তাহাপেক্ষাও আশঙ্কার কথা এই যে, যে-ব্যক্তির অর্থসম্পদ নাই, নিত্য তাহাকে মনুষ্যপদবাচ্য বলিয়াই মনে করে না। তাহার মাতুলেরা অতি সজ্জন। কিন্তু তাহাদের সহস্র অনুরোধ সত্ত্বেও নিত্য যে কখনও মাতুলালয়ে যাইতে চাহে না, তাহার কারণ শহারা দরিদ্র। কী আর বালন, ঈশ্বর নিত্যকে সুমতি দিন।” 

মহেশ্বরের লেখার মধ্যে এতই ডুবে গিয়েছিলুম যে, ঘরের মধ্যে আর-একজনের উপস্থিতির ব্যাপারটা প্রথমে টেরই পাইনি। 

“খেতে আসুন। জামাইবাবু আপনার জন্যে বসে আছেন।” 

চমকে উঠে দেখলুম, নিরু দাঁড়িয়ে আছে। বলল, “স্নান হয়ে গেছে তো?” 

বললুম, “সে তো সাত-সকালেই সেরে নিয়েছি।” 

“তা হলে আর দেরি করবেন না। আসুন।”

বখাওয়ার টেবিলে গল্প বিশেষ জমল না। সত্যপ্রকাশ দু-একটা প্রশ্ন করেছিলেন। মামুলি প্রশ্ন। সংক্ষেপে তার জবাব দিয়ে চটপট খেয়ে নিলুম। খাওয়ায় যে বিশেষ মন ছিল, তাও নয়। তবে তারই মধ্যে লক্ষ করলুম যে, পাতে আজ নানারকমের শাকভাজা। তার সঙ্গে অন্য সব পদও অবশ্য ছিল। খাওয়া শেষ করে সত্যপ্রকাশ তাঁর নিজের ঘরে চলে গেলেন। যাবার আগে আমাকে বললেন, “আপনিও একটু গড়িয়ে নিন।” ঘরে ফিরে আমি আবার ডুবে গেলুম সেই ডায়েরির মধ্যে। 

১৬ই মাঘ ১৩৩৮ তারিখে মহেশ্বর লিখছেন : 

“আজ সতীর জন্মদিন। বড় আশা করিয়া আমার এই একমাত্র কন্যার নাম রাখিয়াছিলাম সত্যভামা। ভাবিয়াছিলাম, স্বামী পাইবে কৃষ্ণের মতো। যেমন প্রেমিক, তেমনই বিচক্ষণ। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। কয়েক দিন ধরিয়া একটা কথা চিন্তা করিতেছি। নিদ্রাভঙ্গের পর প্রত্যুষেই সতী আমাকে প্রণাম করিতে আসিয়াছিল। তখন কথাটা তাহাকে জানাইলাম। বলিলাম, আজিকালি তো আকছার বিধবাবিবাহ হইতেছে, সুতরাং উদার চরিত্রের একটি পাত্র দেখিয়া পুনরায় আমি তাহার বিবাহ দিতে চাই। এমনও বলিলাম যে, সতীর কোলে যদি একটি সন্তানও থাকিত, তবে হয়তো পুনর্বিবাহে তাহার সংকোচ হইতে পারিত, কিন্তু তাহা যখন নাই, তখন তাহার সংকুচিত বোধ করিবার কোনও কারণ থাকিতে পারে না।

“আমার কথা শুনিয়া সতী যেন চমকিয়া উঠিল। পরক্ষণে সংযত শান্ত স্বরে কহিল, ‘কে বলিল আমার সন্তান নাই? সতু কি শুধু বৌদির ছেলে? ও আমারও ছেলে। আমরা দুইজনে মিলিয়া উহাকে মানুষ করিয়া তুলিব। বৌদি আমাকে বলিয়াছে যে, আমরা দুইজনেই উহার মা। না বাবা, সতুকে লইয়া আমি দিব্য আছি। আর তুমি আমাকে পরের ঘরে পাঠাইয়ো না।’ বুঝিলাম, কপালগুণে এমন পুত্রবধূ পাইয়াছি, যে শুধুই বুদ্ধিমতী নহে, হৃদয়বতীও বটে। হৃদয় আছে বলিয়াই সতীর দুঃখ সে বুঝিয়াছে, এবং দুঃখ যাহাতে দূরীভূত হয়, তজ্জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা লইতেও তাহার ভূল হয় নাই। 

“সতুও দেখিতেছি তাহার পিতৃম্বসার কোল হইতে বড় একটা নামিতে চাহে না। পিসি স্নান না-করাইলে সে স্নান করে না, পিসি খাওয়াইয়া না-দিলে খায় না, ঘুমাইবার সময়েও পিসিকে তাহার কাছে থাকিতে হইবে।” 

সতু যে সত্যপ্রকাশ, সেটা সহজেই বুঝলুম। সোমবার রাত্রি থেকে মা আর পিসিমা, দু’জনের মুখেই সত্যপ্রকাশের এই ডাক-নাম আমরা শুনছি। মা আর পিসিমার পারস্পরিক ভাব-ভালবাসার কথা সত্যপ্রকাশের কাছেই জেনেছিলুম, এবারে মহেশ্বর চৌধুরির ডায়েরি পড়েও সে-কথা জানা গেল। ডায়েরিতে সত্যপ্রকাশের সম্পর্কেও কিছু প্রশংসা দেখতে পাচ্ছি। ১৮ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩৯ তারিখে মহেশ্বর লিখছেন: 

“সতুর বয়স এখনও চারি বৎসর পূর্ণ হয় নাই। কিন্তু ইতিমধ্যে তাহার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার নানা প্রমাণ পাইয়াছি। সেদিন একটা বাঘের গল্প বলিয়াছিলাম। আজ সেই গল্পটা সে আমাকে আদ্যন্ত শুনাইয়া দিল। এখনও হাতেখড়ি হয় নাই, অথচ অন্যের ‘বর্ণপরিচয়’ দেখিয়া একটি লোহার শিকের সাহায্যে মাটির উপরে দিব্য অ-আ-ক-খ লিখিতে আরম্ভ করিয়াছে। স্মৃতিশক্তিও দেখিলাম কম নয়। যেমন বাংলায়, তেমনি ইংরাজিতেও এক হইতে একশত পর্যন্ত নির্ভুল বলিয়া যায়। 

“সেদিন কোথা হইতে একটা সাপের খোলস কুড়াইয়া আনিয়াছিল। আমার সন্মুখে ফেলিয়া দিয়া বলিল, ‘দাদু, তুমি তো বলো যে, আমাদের গ্রামে সাপ নাই, তবে এই সাপের খোলস কোথা হইতে আসিয়াছে?’ হাসিয়া বলিলাম, ‘সাপ নাই, এমন কথা তো বলি না। বলিয়াছি যে মনসা দেবীর আশীর্বদে এই গ্রামে কাহাকেও সাপে কাটে না। কথাটা মিথ্যা নহে। এককালে এদিকে সত্যই সাপের বড় উৎপাত ছিল। আশপাশের গ্রামে এখনও সাপের কাড়ে লোক মারা যায়। অথচ যেদিন মনসাদেবীর প্রতিষ্ঠা হইয়াছে, সেদিন হইতে অদ্যাবধি এই মুকুন্দপুর গ্রামে কাহাকেও সাপে কাটে নাই।” 

পাতার পর পাতা দ্রুত পড়ে যাচ্ছিলুম, তবু শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়ে ওঠা গেল না। বাইরের উঠোনের উপরে একটা গাড়ি এসে থামল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলুম, ছ’টা বাজে। ডায়েরি বন্ধ করে জানালা খুলে দেখলুম, ভাদুড়িমশাই ফিরে এসেছেন। 

ঘরে এসে ঢুকতেই জিজ্ঞেস করলুম, “খবর কী?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “এখন নয়, পরে বলব।”

জামা-কাপড় পালটে তিনি বাথরুমে গিয়ে ঢুকলেন। 

তার আধ-ঘন্টাটাক বাদে মোটর-সাইকেলের ভট্-ভট্ আওয়াজ শুনে বুঝলুম যে, ডাক্তার সরকারও এসে গিয়েছেন। 

২৯

ডাক্তারবাবুকে আজ এ-বেলায় আর-কোথাও রুগি দেখতে যেতে হয়েছিল নিশ্চয়, তাই দিনের আলো থাকতে-থাকতে মুকুন্দপুরে আসতে পারেননি। হেমন্তকাল, দিনের আলো এখন ফুরিয়েও যায় খুব তাড়াতাড়ি, দুপুরের খানিক বাদেই যেন ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসে। বাইরের উঠোন অবশ্য এখন আর অন্ধকার নয়। ডাক্তারবাবু এসেছেন শুনেই সত্যপ্রকাশ হ্যাজাক জ্বালিয়ে বাইরের উঠোনের মাঝ বরাবর ঝুলিয়ে দিতে বলেছিলেন। চারিদিক তাই একেবারে দিনের আলোর মতো ফটফট করছে। 

ডাক্তারবাবু আজ আর কাউকে রঙ্গিলার ঘরে ঢুকতে দেননি। পার্টিশানের এদিকে রামদাসের ঘর। সেখানে তিনটে চেয়ার আনিয়ে আমরা তিনজন বসে আছি। আমি, ভাদুড়িমশাই আর সত্যপ্রকাশ। বাইরের বারান্দার একদিকে একটা তক্তাপোশ পাতা। তাতে বসে আছেন গোবিন্দ ভট্‌ট্চাজ আর রঙ্গনাথ। পার্টিশানের দরজার কাছে রামদাস একেবারে পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা যেখানে বসে আছি, সেখান থেকে রঙ্গিলার ঘর পালানো মা ঝুমরিকেও দেখতে পাচ্ছিলুম। ঝুমরি আজ বারান্দায় উঠে এসেছে। রামদাস তাকে বাধা দেয়নি। 

রঙ্গিলার ঘর থেকে ডাক্তারবাবু বেরিয়ে আসতেই আমরা, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালুম। যারা বারান্দায় ছিল, তারাও দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। সকলের মুখেই উদ্বেগের ছাপ। ডাক্তারবাবু কখন রঙ্গিলার ঘর থেকে বার হন, কী বলেন, তারই জন্যে সবাই চুপচাপ এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল। কিন্তু এখন যেন কেউ কিছু জিজ্ঞেস করতে ভরসা পাচ্ছে না। 

ডাক্তারবাবু বললেন, “আরে, কী ব্যাপার, সবাই এত গম্ভীর কেন?” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “রঙ্গিলা কেমন আছে?” 

“ভাল।… কই হে রামদাস, সাবানটা দাও।” 

রামদাস সাবান এগিয়ে দিল। ডাক্তারবাবু হাত ধুয়ে, রামদাসের হাত থেকে তোয়ালেখানা টেনে নিয়ে মুখ তুলে সত্যপ্রকাশের দিকে তাকালেন। তারপর একগাল হেসে বললেন, “ভাল মানে খুব ভাল। চমৎকার, একসেলেন্ট! সেদিন বলেছিলুম, দি ওয়র্স্ট ইজ ওভার। তারপর ফের জ্বরটা আসায় একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলুম ঠিকই, তবে এখন বলছি, রঙ্গিলাকে নিয়ে আর আমি একটুও চিন্তা করছি না।” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “জ্বরটা আর আসেনি তো?” 

“না। গা একেবারে পাথরের মতো ঠান্ডা। কিন্তু তার চেয়েও বড় খবর, জ্ঞান ফিরে আসছে।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “সেটা কী করে বুঝলেন?” 

“আমাকে যে চিনতে পেরেছে, সেটা ওর চাউনি থেকেই বুঝেছি। তা ছাড়া ঠোঁট নড়ছে। একটু গুঙিয়ে উঠল। মনে হচ্ছে, কিছু বলতে চায়…মানে জরুরি কিছু… কিন্তু ওয়র্ড-ফর্মেশানের একটা ব্যাপার আছে তো, সেটা ঠিক পেরে উঠছে না। কিন্তু পারবে, কাল সকালের মধ্যেই পেরে যাবে।…কী, আপনারা খুশি তো?” 

রামদাস হাত জোড় করে দাঁড়ি েছিল। এখানে আসা অবধি তাকে হাসতে দেখিনি। এই প্রথম তার মুখে একটু হাসি ফুটতে দেখা গেল। 

বারান্দা থেকে উঠোনে নামলেন ডাক্তারবাবু। মোটরসাইকেলে উঠে স্টার্ট দিলেন। তারপর কী যো ভেবে স্টার্ট থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আয়া যে চলে গেছে, সে তো এসেই শুনলুম। নতুন আয়া কখন থেকে কাজে লাগবে?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “শিলিগুড়িতে নতুন একজনের সঙ্গে কথা বলেছি। ভেবেছিলুম, আমার সঙ্গে করেই তাকে নিয়ে আসব, কিন্তু নার্সিংহোমে হঠাৎ একজন হার্টের পেশেন্ট এসে পড়ায় মেয়েটি আজ ছাড়া পেল না। তবে টাকা দিয়ে এসেছি, কাল সকালে নিজেই বাসে উঠে এখানে চলে আসবে।” 

ডাক্তারবাবু বললেন, “তার মানে রঙ্গিলার ঘরে আজ রাত্তিরে কেউ থাকছে না, কেমন?”

রামদাস বলল, “আমি থাকব।” 

ঝুমরি এতক্ষণ একটাও কথা বলেনি। এবারে অস্ফুট গলায় বলল, “বলেন তো আমিও থাকতে পারি।” 

ডাক্তারবাবু কী যেন চিন্তা করলেন কয়েক মুহূর্তে। তারপর বললেন, “সুস্থ অবস্থায় রঙ্গিলা তো ও-ঘরে একাই থাকত, তাই না?” 

রামদাস বলল, “হ্যাঁ।” 

“তা হলে একাই থাক।” ডাক্তারবাবু বললেন, “জ্ঞান হয়তো আজ রাত্তিরেই পুরোপুরি ফিরে আসবে। তখন যদি ঘরের মধ্যে আর-কাউকে দেখতে পায়, তা হলে হয়তো অবাক হয়ে যাবে। তার একটা খারাপ এফেক্ট হওয়া কিছু বিচিত্র নয়…মানে হঠাৎ একটা সেট-ব্যাক হয়ে যেতে পারে। সব দিক ভেবে তাই মনে হচ্ছে যে, আজকের রাতটা ওর একা থাকাই ভাল। লেট্স কিপ থিংস অ্যাজ নর্মাল অ্যাজ পসিবল।” 

রামদাস বলল, “আমিও থাকব না?” 

ডাক্তারবাবু বললেন, “বললুম তো, না-থাকাই ভাল। আর তা ছাড়া দরকারই বা কী। তুমি তো পাশের ঘরেই আছ। যদি ওর দরকার হয় তা হলে তুমি জানতেই পারবে। ঘরের মধ্যেই যে থাবতে হবে, এমন তো কোনও কথা নেই।…আর হ্যাঁ, কাল সকালেই আমি একবার আসব।” 

কুণ্ঠিত গলায় ঝুমরি বলল, “ডাক্তারবাবু, আপনি তো হাসিমারায় খাচ্ছেন?” 

‘হ্যাঁ। কেন বলো তো?” 

“এখন তো আর বাস পাব না, আপনি যদি ওই পর্যন্ত আমাকে নিয়ে যান তো ওখান থেকে আমি হেঁটেই আমাদের বাগানে চলে যেতে পারব।” 

“ওহো, তুমি তো দক্ষিণবাড়ি চা-বাগানে থাকো, তাই না?” 

“হ্যাঁ, ডাক্তারবাবু।” 

“বেশ, তা হলে উঠে পড়ো।” 

মোটরসাইকেলের পিছনের সিটে ঝুমরিকে বসিয়ে নিয়ে ডাক্তারবাবু চলে গেলেন। 

ডাক্তারবাবু যতক্ষণ ছিলেন, চুপ করে সবাই তাঁর কথা শুনছিলুম আমরা। এবারে রঙ্গনাথ তাঁর বাড়ির পথে পা বাড়ালেন। গোবিন্দ ভট্‌চাজও পা বাড়ালেন তাঁর ঘরের দিকে। সম্ভবত এবারে তিনি পুজোয় বসবেন। তবে সত্যপ্রকাশ যেহেতু বাড়িতেই রয়েছেন, তাই শাঁখ হয়তো বাজবে না, ঘন্টার আওয়াজও শোনা যাবে না। আমরা তিনজন বাইরের উঠোন পেরিয়ে ভিতর-বড়িতে চলে এলুম। আসতে-আস্পতেই দেখলুম, রামদাস হ্যাজাকটা নিবিয়ে দিচ্ছে। নিরুকে ঢায়ের কথা বলে দিয়ে সত্যপ্রকাশ বললেন, “চলুন, একটু বসা যাক।” 

ভাদুড়িমশাই শিলিগুড়ি থেকে ফিরবার পর থেকে এখনও পর্যন্ত সত্যপ্রকাশের সঙ্গে তাঁর কোনও কথা হয়নি। এবারে সত্যপ্রকাশই জিজ্ঞেস করলেন, “কিছু হদিস করতে পারলেন?” 

“কীসের হদিস?” 

“সে কী!” সত্যপ্রকাশ অবাক হয়ে বললেন, “মনসামূর্তির খোঁজেই তো আপনি শিলিগুড়ি গিয়েছিলেন, তাই না?” 

“শুধু মূর্তির খোঁজে যাব কেন? অন্য কয়েকটা ব্যাপার নিয়েও একটু খোঁজখবর করবার দরকার ছিল। তার মধ্যে দুটো খবর শুনে আপনি খুশি হবেন।” 

“কীসের খবর?” 

“প্রথম খবর ব্যাঙ্ক-লোনের। লোনটা আপনি সামনের মাসেই পেয়ে যাচ্ছেন।” 

শুনে একেবারে হাঁ হয়ে গেলেন সত্যপ্রকাশ। তারপর নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললেন, “সত্যি? খবরটা কার কাছে শুনলেন আপনি?” 

“ব্যাঙ্কের জেনারেল-ম্যানেজারের কাছে। ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করেছিলুম। তিনিই জানালেন।”

“আপনাকে চেনেন উনি?” 

“বা রে, ব্যাঙ্গালোরের লোক, অথচ চারু ভাদুড়িকে চিনবে না, তাও কি হয় নাকি?” 

সত্যপ্রকাশের মুখ দেখেই মালুম হচ্ছিল যে, তিনি কিছুই ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারছেন না। কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে একটু কিন্তু-কিন্তু করে বললেন, “কত পার্সেন্ট দিতে হবে ওঁকে?” 

“কিচ্ছু দিতে হবে না।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “সকলকেই আপনারা ঘুষখোর ভাবেন কেন বলুন তো? বিশ্বসুদ্ধ সব্বাই কি ঘুষখোর নাকি?” 

“কিচ্ছু দিতে হবে না?” সত্যপ্রকাশ যেন ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। 

“এক আধলাও না।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “কী জানেন মিঃ চৌধুরি, দোষ আপনাদেরও কম নয়, ঘুষ দিতে-দিতে স্বভাবটাই আপনাদের নষ্ট হয়ে গেছে। তাই বুঝতে পারেন না যে, সংসারে যেমন বিস্তর চোর-জোচ্চোর রয়েছে, তেমনি আবার সৎ লোকেরও অভাব নেই।” 

সত্যপ্রকাশ ইতিমধ্যে নিজেকে একটু সামলে নিয়েছিলেন। বললেন, “কিন্তু একটা কথা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। ভদ্রলোককে ডিনারে ডেকেছিলুম। বলেছিলুম যে, আমিই গাড়ি পাঠিয়ে দেব। কিন্তু তিনি নেমন্তন্নটা অ্যাকসেপ্টই করলেন না। বললেন, ফরগেট্ ইট। এটা কেন করলেন বলুন দেখি।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “এটাও আপনাকে বুঝিয়ে বলতে হবে? আশ্চর্য! আরে মশাই, আপনাদের এইসব ডিনার-ফিনারও আসলে ঘুষ ছাড়া আর কিছুই নয়। নানজাপ্পা সেটা ভালই বোঝে, তাই অ্যাকসেপ্ট করেনি। কী জানেন চৌধুরিমশাই, বিয়িং অনেস্ট ইজ নট এনাফ, লোকে যাতে অসৎ না ভাবে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হয়। আপনার হোটেলে গিয়ে ডিনার খেয়ে তারপর আপনার কাজটা করে দিলে সবাই বলত, লোকটা নির্ঘাত ঘুষ খেয়েছে। ধরে নিন, সেইজন্যেই নানজাপ্পা আসেনি।…ও হ্যাঁ, একটা কথা বলা হয়নি। লোনটা ন্যাংশান করার দুটো শর্ত আছে কিন্তু।” 

“কী শর্ত?” 

“প্রথমটা ওঁদের ইঞ্জিনিয়ারের। আপনাদের প্ল্যান দেখে ব্যাঙ্কের ইঞ্জিনিয়ার যে নোট দিয়েছেন, তাতে বলা হয়েছে যে, হোটেলে আগুন লাগার ঘটনা আজকাল আকছার ঘটছে। অথচ আপনাদের প্ল্যানে সে-দিকটায় তেমন নজর দেওয়া হয়নি। আর কিছু না করুন, ইমার্জেন্সি স্টেয়ারকেসটা আরও অন্তত এক ফুট আপনাকে চওড়া করতে হবে।” 

আমি বললুম, “সেটা করা যাবে তো?” 

সত্যপ্রকাশ হেসে বললেন, “ইট্স এ মাইনর ম্যাটার। জায়গা যা রয়েছে, তাতে এক ফুট কেন, আরও দেড় ফুট চওড়া করতে পারি। করে দেব। দ্বিতীয় শর্ত?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “সেটা ওঁরা লিখিত-পড়িতভাবে আপনাকে জানাবেন না। নানজাপ্পা বলল, শিলিগুড়িতে পৌঁছে অবধি তিনি শুনতে পাচ্ছেন যে, কনট্রাক্টর হিসেবে সম্পৎলালের বিশেষ সুনাম নেই, অনেক সময় ওরই জন্যে নাকি কন্সট্রাকশনের কাজ মাসের পর মাস পিছিয়ে যায়। তাই লেবার-কনট্রাক্টের কাজটা যদি সম্পৎলালের বদলে আর কাউকে…মানে অন্য যে-কোনও বড় কনট্রাক্টরকে দেন, ব্যাঙ্ক তা হলে নিশ্চিন্ত হতে পারে যে, কাজটা সময়মতো শেষ হবে। ফলে ক এখনকার এস্টিমেটের মধ্যেই থাকবে, ধাপে-ধাপে চড়ে যাবে না, আপনারও আর নতুন করে লোনের দরকার হবে না।” 

“সম্পৎলালকে সরিয়ে দিয়ে আর কাউকে কাজ দিতে হবে?” সত্যপ্রকাশ যেন শিউরে উঠলেন, “ওরে বাবা, তাও কি হয়?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কেন হবে না, খুব হয়। আর তা ছাড়া, সম্পৎলালকে আপনি পাচ্ছেনই বা কোথায়? কাল শিলিগুড়িতে গিয়ে আপনি যে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি, তার কারণ জানেন?” 

“কেন, সে কোথায় গিয়েছিল?” 

“আপনার পক্ষে সেটাই হচ্ছে দ্বিতীয় সুখবর। সম্পৎলালের মতো লোকরা শেষ পর্যন্ত যেখানে যায়, সেখানেই গিয়েছিল। আপাতত আছেও সেইখানেই। নরকে। পরশু বিকেলে তো শিলিগুড়ি থেকে আমাদের নিয়ে আপনি মুকুন্দপুরে চলে আসেন। সেদিন রাত থেকেই নাকি সম্পৎলালের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। থানায় গিয়ে শুনলুম, আজই সকালে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের রেল-ইয়ার্ডের একটা ওয়াগনের মধ্যে তার লাশের সন্ধান মিলেছে। গলাটা একেবারে দু-ফাঁক করা। খুন হয়েছে সম্ভবত পরশু রাত্তিরেই।” 

সত্যপ্রকাশকে দেখে মনে হচ্ছিল তাঁর মুখ থেকে যেন সমস্ত রক্ত কেউ নিংড়ে বার করে নিয়েছে। স্খলিত গলায় তিনি বললেন, “সে কী!” 

ভাদুড়িমশাই মৃদু হেসে বললেন, “এতে এত অবাক হচ্ছেন কেন? আমি তো বলেইছিলুম যে, নিজের গ্যাংকে ফাঁসিয়ে কোনও মাফিয়োসো কখনও পার পায় না। শয়তানদেরও একটা কোড অভ কনডাক্ট থাকে, মিঃ চৌধুরি। সেই কোড যে ভাঙে, একদিন না একদিন তাকে এইভাবেই মারা পড়তে হয়।” 

সত্যপ্রকাশ কথা বলতে পারছিলেন না। 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কাজটা ফকিরাই করুক আর যে-ই করুক, আপনি আপাতত নিশ্চিন্ত। যা-ই হোক, আমি এখন ঘরে যাচ্ছি। দু’একটা কাজ পড়ে রয়েছে, চটপট সেরে ফেলতে হবে। চা এলে বরং আমাদের ঘরে পাঠিয়ে দেবেন। চলুন, কিরণবাবু।” 

আমরা আমাদের ঘরে চলে এলুম। 

তার মিনিট দুয়েক বাদেই চায়ের ট্রে নিয়ে নিরু আমাদের ঘরে এসে ঢুকল। ভাদুড়িমশাই তার হাত থেকে ট্রেটা টেবিলে নামিয়ে রেখে বললেন, “কী খবর সুহাসিনী?” 

নিরু বলল, “ভাল। কিন্তু জামাইবাবু এমন হতভম্ব হয়ে বসে আছেন কেন? কী হয়েছে ওঁর?”

ভাদুড়িমশাই কপট ধমকের গলায় বললেন, “ও-সব নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না, তুমি একেবারে চুপ করে থাকো।” 

নিরু বেরিয়ে গেল। চায়ে চুমুক দিয়ে ভাদুড়িমশাইকে বললুম, “চাঁদুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল?” 

“তার আর দরকার হয়নি। অনেকদিনের চেনা একজনকে পেয়ে গিয়েছিলুম। আদালত, থানা, ব্যাঙ্ক…মানে যেখানে যেখানে যাওয়া দরকার, সে-ই নিয়ে গিয়েছিল আমাকে। এগারোটায় শিলিগুড়ি পৌঁছলুম, কাজ শেষ হতে-হতে তিনটে। নন্-স্টপ কাজ আর কাজ। বুড়ো এক উকিলের বাড়িতেও গিয়েছিলুম। রাজদেও কুর্মি কীভাবে খুন হয়েছিল, ভদ্রলোকের কাছে তার ডিটেল্স শোনা গেল।” 

“তার মানে দুপুরে আজ আর ভাত খাওয়া হয়নি।” 

“হয়নি তো কী হয়েছে? আরে মশাই, রোজ দু’বেলাই তো ভাত খাচ্ছি, একটা বেলা না হয় না-ই খেলুম। তবে কিনা আজ শাকভাজাটা খাওয়া উচিত ছিল।” 

হঠাৎ মনে পড়ে গেল, দুপুরে আজ ভাতের পাতে গুচ্ছের শাকভাজা দেওয়া হয়েছিল। বললুম, “কী ব্যাপার বলুন তো, হাজার রকমের সুখাদ্য থাকতে হঠাৎ শাকভাজা নিয়ে এত মাতামাতি কেন?” 

“বাঃ কিরণবাবু, আপনিও কি সাহেব হয়ে উঠলেন নাকি? কালীপুজোর আগের দিন যে চোদ্দোশাক খেতে হয়, ও বেমালুম ভুলে গেছেন?” 

তাই তো, কালই কালীপুজো। 

খানিক বাদেই নিরু আবার ঘরে এসে ঢুকল। চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। টেবিল থেকে ট্রেটা তুলে নিয়ে ভাদুড়িমশাইকে বলল, “একটু পরেই খেতে ডাকছি। ও-বেলা সম্ভবত আপনার কিছু খাওয়া হয়নি। এ-বেলা তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন।” 

নিরু বেরিয়ে গেল। 

ভাদুড়িমশাই একটা সিগারেট ধরালেন। চুপচাপ টানলেন কিছুক্ষণ। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “দুপুরে কী করলেন আজ?” 

বললুম, “ডায়েরিটা পড়লুম। সবটা নয়, ওই কিছু-কিছু জায়গা। গ্রামটার নাম যে আসলে মুকুন্দপুর নয়, মুচুকুন্দপুর, আজই সকালে সত্যপ্রকাশের মুখে এই কথাটা শুনে ভেবেছিলুম যে, অনেক কিছু জানলেও অন্তত এটা আপনি এখনও হয়তো জানতে পারেননি।” 

“তা ডায়েরি পড়ে দেখলেন যে, কথাটার ওখানে উল্লেখ রয়েছে। তাই না?” 

হেসে বললুম, “বিলক্ষণ। আর তা দেখেই বুঝলুম যে, ডায়েরিটা যখন আমার আগেই আপনি পড়েছেন, তখন এটাও আপনি আমার আগেই জেনে বসে আছেন। 

ভাদুড়িমশাই কিছু বললেন না। হাসতে লাগলেন।