মুকুন্দপুরের মনসা – ২০

২০

একটা মোটর-সাইকেলের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। অওাজটা ক্রমেই উঁচু থেকে আরও উঁচু পর্দায় উঠতে-উঠতে তারপর আমাদের ঘরের পুবদিকের দরজার বাইরে এসে থেমে গেল। খানিক বাদেই টোকা পড়ল দরজায়। 

দরজা খুলে যাঁকে দেখলুম, তাঁকে আগে কখনও দেখিনি। তবে হাতের ব্যাগটা দেখে আন্দাজ করলুম যে, ইনিই ডাক্তার সরকার। ভদ্রলোকের বয়স ষাট-পঁয়ষট্টি হবে। মাথায় মস্ত টাক। কানের পাশে কিছু চুল রয়েছে বটে, কিন্তু তাও প্রায় না-থাকার মতন। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। পরণে ঢোলা ট্রাউজার্স আর মোটা কাপড়ের হাওয়াই শার্ট। শার্টের পকেটে গোটা চারেক কলম। মুখ দেখে মনে হয় কোনও কূট-কাপট্য নেই। দিলদরিয়া হাসিখুশি মানুষ। 

পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে রামদাস। ভদ্রলোক তাকে বললেন, “তুমি গিয়ে আয়াকে সব রেডি করতে বলো। আমি আগে মিঃ ভাদুডিকে দেখি, তারপর তোমার নাতনির ব্যান্ডেজ পালটে দেব।” তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আসতে পারি?” 

বললুম, “আসুন, আসুন।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বসুন ডাক্তার সরকার। আমার অসুখের কথা তো সত্যপ্রকাশবাবুর কাছেই শুনেছেন।” 

“হ্যাঁ, শুনেছি যে, আপনার কিসসুই হয়নি, তবু নাকি আপনাকে খুব ‘লি করে দেখে আমাকে ওষুধ দিতে হবে। কী ব্যাপার বলুন তো?” 

“বলছি। কিন্তু ডাক্তারবু, তার আগে বরং আর-একটা কথা বলি।” 

“বেশ তো, বলুন।”

“সবাইকে কি অবিশ্বাস করা চলে : তা হলে কাজ করব কাকে নিয়ে? অন্তত এক-আধজনকে তো বিশ্বাস করা চাই। ঠিক কি না?” 

ডাক্তার সরকারকে তাঁর চিকিৎসক-জীবনে সম্ভবত আর-কখনও এমন কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়নি। মনে হল, ভদ্রলোক একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছেন। ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বিহ্বল গলায় বললেন, “মানে….আমি তো বুঝে উঠতে পারছি না যে….” 

ভাদুড়িমশাই হাসতে-হাসতে বললেন, “ঠিক আছে, অতশত আপনাকে বুঝতে হবে না। শুধু বলুন যে, আপনাকে আমি বিশ্বাস করতে পারি কি না, বাস।” 

“একশোবার পারেন, হাজারবার পারেন। আরে, বিশ্বাস তো আমাকে করতেই হবে। আপনি হচ্ছেন রোগী, আর আমি হচ্ছি ডাগের। আমাকে বিশ্বাস না করে আপনার উপায় কী। কিন্তু এ-কথা উঠছে কেন?” 

“উঠছে এইজন্যে যে, আপনাকে আমি বিশ্বাস করে কয়েকটা কথা বলব। না না, রোগের কথা নয়। সত্যপ্রকাশ তো আপনাকে বলেই দিয়েছেন যে, আমার কিছু হয়নি। আমার কথা অন্য ব্যাপারে, যার আঁচ সত্যপ্রকাশ আপনাকে হয়তো দিয়ে থাকতে পারেন।” 

“কই না, আর কিছু তো তিনি বলেননি আমাকে। শুধু বললেন যে, আপনারা ইনভেস্টিগেশানে এসেছেন। আর হ্যাঁ, যদিও আপনার জ্বরজারি হয়নি, তবু আজ এই বাড়িতে এসে প্রথমেই যেন এই ঘরে ঢুকে আপনার শরীরটা খুব ভাল করে পরীক্ষা করি।….কী যে ব্যাপার, কিছুই তো মশাই বুঝতে পারছি না। একটু খুলে বলুন তো।” 

“বলছি। একটা ব্যাপারে আমি আপনার সাহায্য চাই।” 

“কী ব্যাপার?” 

“রঙ্গিলার ব্যাপার। ডাক্তারবাবু, ওর অবস্থাটা এখন ঠিক কেমন?” 

“আগের চেয়ে অনেক ভাল। আজ তো এখনও দেখিনি। তবে কাল যা দেখেছিলুম, তাতে বলতে পারি যে, প্রাণের আশঙ্কা আর নেই। কাউকে অবশ্য চিনতে পারছে না, কথাও বলতে পারছে না। তবে আমার মনে হয়, দি ওয়র্স্ট ইজ ওভার, দু-এক দিনের মধ্যে সবাইকে চিনতে পারবে, কথাও বলতে পারবে।” 

“ঠিক এই কথাটাই কাউকে আপনার বলা চলবে না, ডাক্তারবাবু।” ভাদুড়িমশাই অনুনয়ের গলায় ডাক্তার সরকারকে বললেন, “অন্তত আজ কিছুতেই বলা চলবে না।”

ডাক্তার সরকার অবাক হয়ে বললেন, “কেন?” 

“এইজন্যে বলা চলবে না যে, রঙ্গিলার বিপদ তাতে বাড়বে। ডাক্তারবাবু, এই সহজ কথাটা আপনি ভুলে যাচ্ছেন কেন যে, একমাত্র রঙ্গিলাই চোরকে দেখেছিল, ভাল হয়ে উঠলে একমাত্র রঙ্গিলাই তাকে শনাক্ত করতে পারবে। আর তাই, রঙ্গিলা যে শিগগিরই ভাল হয়ে যেতে পারে, এই কথাটা যদি চাউর হয়ে যায়,তা হলে রঙ্গিলাকে সে-ই ভাল হয়ে উঠতে দেবে না। ভাল হয়ে উঠবার আগেই রঙ্গিলাকে সে খতম করে দেবার চেষ্টা করবে।” 

“বলেন কী?” 

“একটুও বাড়িয়ে বলছি না, ডাক্তারবাবু।” 

“ঠিক আছে।” ডাক্তার সরকার বললেন, “ব্যাপারটা আমাদের প্রফেশানের দিক থেকে একটু আনএথিক্যাল ঠিকই, কিন্তু আপনি যা বললেন, তাতে মনে হচ্ছে, সত্যিকথাটা আপাতত না-বলাই ভাল। আফটার অল, রোগীর ভালমন্দটাই প্রথমে ভেবে দেখা দরকার।…..নিন, এবারে একটু শুয়ে পড়ুন দেখি, আপনার প্রেশারটা একবার দেখব।” 

ডাক্তারবাবু প্রেশার দেখলেন, টেম্পারেচার নিলেন, বুকে আর পিঠে স্টেথোস্কোপ বসিয়ে নিশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনলেন, জিভ বার করতে বললেন, চোখের পাতা টেনে দেখলেন, অর্থাৎ যা-যা করা দরকার, সবই করলেন; তারপর হেসে বললেন, “সব নর্মাল। তবে কিনা আপনি যখন অসুখের ভান করে পড়ে আছেন, তখন গোটাকয় ট্যাবলেট দিয়ে যাচ্ছি। খাবার দরকার নেই। তবে খেলেও কিছু ক্ষতি হবে না। ভিটামিন ট্যাবলেট।” 

ব্যাগ খুলে একটা শিশি থেকে গোটা চারেক ট্যাবলেট বার করে নিলেন ডাক্তার সরকার। তারপর একখন্ড কাগজে সেগুলো মুড়ে নিয়ে ভাদুড়িমশাইয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বেশ উঁচু গলায় বললেন, “নিয়ম করে খাবেন মশাই। একটু জ্বর হয়েছে, তবে ভয়ের কিছু নেই, কাল সকালেই টেম্পারেচার সাতানব্বইয়ে নেমে যাবে।” 

ডাক্তার সরকার উঠে পড়লেন। ভাদুড়িমশাই ওঠার উপক্রম করছিলেন। আমি বললুম, “থাক থাক, আপনি আর উঠবেন না, আমি বরং ডাক্তারবাবুকে এগিয়ে দিচ্ছি।” 

উঠোন পেরিয়ে আমরা রঙ্গিলাদের ঘরের দরজায় গিয়ে উঠলুম। এটা যে বাইরের উঠোনের পুবদিকের ঘর, সে-কথা আগেই বলেছি। একতলা ঘরগুলো সব একই রকমের। এ-ঘরটারও সামনে টানা-বারান্দা, তাতে কাঠের রেলিং বসানো। ঘরের ভিতরটা দেখলুম পার্টিশান করা। কাঠের পার্টিশান, তার একধারে একটা এক-পাল্লার সরু দরজা। ওই দরজা দিয়েই পার্টিশানের এ-দিক থেকে ও-দিকে যাওয়া-আসা করতে হয়। ঘরটাকে একেবারে সমান মাপে দু’ভাগ করা হয়নি, পার্টিশানের দক্ষিণ-দিকের ভাগটা একটু ছোট। সে-দিকটায় সরু একটা তক্তাপোশ পাতা, তার উল্টোদিকে একটা ইজিচেয়ার। ঘরের এককোণে রয়েছে একটা মিটসেফ। তার উপরে গোটাকয় ওষুধের শিশি, কয়েক 

পাতা ট্যাবলেট আর ক্যাপসুল, তা ছাড়া দু’বাণ্ডিল ব্যান্ডেজ আর লিউকোপ্লাস্ট। 

তক্তাপোশে যে মেয়েটি শুয়ে আছে, সে-ই যে রঙ্গিলা, সেটা বুঝে নেওয়া গেল। মেয়েটির গায়ের রং একেবারে কুচকুচে কালো, তার উপরে ভীষণ রোগা। সম্ভবত অসুস্থ বলেই আরও রোগা দেখাচ্ছে। মাথা আর কপাল জুড়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা। বলতে গেলে বিছানার সঙ্গে একেবারে মিশে রয়েছে মেয়েটি। চোখ দুটি খোলা, কিন্তু তাতে কোনও অভিব্যক্তির চিহ্নমাত্র দেখা গেল না। শূন্য, ভাবলেশহীন চোখে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল; আমরা গিয়ে ঘরে ঢুকবার পরেও চোখ ফেরাল না, সিলিংয়ের দিকেই তাকিয়ে রইল। 

নার্স কাম আয়াটি মাঝবয়সী। শিলিগুড়ির এক নার্সিংহোমে কাজ করে, দুর্ঘটনার খবর পেয়ে সত্যপ্রকাশই একে সঙ্গে নিয়ে শিলিগুড়ি থেকে মুকুন্দপুরে চলে এসেছিলেন। ডাক্তারবাবু যে এসেছেন, এই খবর পেয়েই সে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে ছিল। জিজ্ঞাসু চোখে ডাক্তার সরকার তার দিকে তাকাতেই সে বলল, “কাল রাত্তিরে আবার জ্বর এসেছিল।” 

“টেম্পারেচার নিয়েছিলে?” 

“আজ্ঞে হ্যাঁ।” 

“কত?” 

“একশো দুই পয়েন্ট চার। সকালেই অবশ্য ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে যায়।”

“এখন কত?” 

“সাড়ে সাতানব্বই।” 

“ঠিক আছে। কাল তো ক্যাপসুলটা পড়েনি। ওটা আবার আজ থেকে দাও। আজ াত্তিরে একটা, কাল দুবেলা দুটো। যেমন আগে দিচ্ছিলে। জল গরম করেছ?” 

“আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনি এসেছেন শুনেই গরম করে রেখেছি।” 

“ঠিক আছে। জলটা তা হলে গামলায় ঢেলে দাও।” 

গামলায় গরম জল ঢালা হল। ডাক্তার সরকার তাতে খানিকটা ডেটল ঢাললেন। তারপর আয়াকে বললেন, “নাও, এবারে ব্যান্ডেজটা খোলো। তারপর গরম জলে তুলো ভিজিয়ে ইনজুরির জায়গাগুলো বেশ ভাল করে পরিষ্কার করে দাও। ব্যান্ডেজটা আজ আবার নতুন করে বেঁধে দিয়ে যাব।” 

ড্রেসিংয়ের কাজ শেষ হতে প্রায় তিরিশ-চল্লিশ মিনিট লাগল। লক্ষ করলুম যে, ক্ষতস্থানগুলি এখনও পুরোপুরি শুকোয়নি; অন্তত দু-একটি জায়গা থেকে অল্প-স্বল্প রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে। রঙ্গিলা যে সারাক্ষণই একেবারে স্থির হয়ে শুয়ে আছে, তার দৃষ্টিও যে এক লহমার জন্যেও সে অন্যদিকে ফেরায়নি, তাও আমার চোখ এড়াল না। তবে তার ঠোঁট দুটি একটু-একটু নড়ছিল। ডাক্তারবাবু সেটা লক্ষ করেছেন কি না, কে জানে। 

কাজ শেষ করে, সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ডাক্তার সরকার ঘর থেকে বারান্দায় এসে দাঁড়লেন। তোয়ালে এগিয়ে দিয়ে রামদাস জিজ্ঞেস করল, “কেমন দেখলেন ডাক্তারবাবু?” 

“একই রকম।” 

রামদাস কেঁদে ফেলল। বলল, “মেয়েটা বাঁচবে তো?” 

“কিছুই বলা যাচ্ছে না।” ডাক্তার সরকার বললেন, “ফের জ্বরটা এসেই মুশকিল হল। আর দু-একটা দিন দেখি।” 

আয়াও ইতিমধ্যে বাইরে চলে এসেছিল। একটু ইতস্তত করে বলল, “আমি আর এখানে কাজ করব না ডাক্তারবাবু।” 

“কেন?” 

“কাল রাত্তিরে কে যেন জানলা দিয়ে ঘরের মধ্যে উঁকি মেরেছিল।” 

“বটে?” ডাক্তার সরকার বললেন, “সেইজন্যে কাজ ছেড়ে দেবে তুমি?” 

“হ্যাঁ, ডাক্তারবাবু, আমার ভয় করছে।” 

রামদাসের দিকে তাকিয়ে ডাক্তার সরকার বললেন, “কী ব্যাপার রামদাস?” 

“কিছু না, ডাক্তারবাবু।” রামদাস বলল, “মিছিমিছি ভয় পাচ্ছে। পাড়ারই কেউ হয়তো উঁকি মেরেছিল। তা মারুক না। আমি তো রয়েছি। ভয় কীসের?” 

আয়া তবু গোঁ ধরে রইল। সে যাবেই। 

ডাক্তারবাবু বললেন, “বেশ তো, যেতে হয় তোমার কিন্তু সত্যপ্রকাশবাবু শিলিগুড়ি গেছেন, তাঁকে ফিরে আসতে দাও, তিনি অন্য-কোনও লোক দিয়েছেন, তারপর যেও। হুট বললেই কি আর যাওয়া হয় রে বাবা, দুটো দিন সবুর করো।” 

আয়া ফিরে গেল রঙ্গিলার কাছে। মুখ দেশে বোঝা গেল, সে খুশি নয়। 

ডাক্তারবাবু তাঁর মোটর-সাইকেলে উঠে বললেন, “কাল আবার এই সময়ে আমি আসব। তার মধ্যে যদি দরকার হয় তো রামদাসকে দিনে আমাকে একটা খবর পাঠাবেন।….আরে, তুমি কখন এলে?” 

শেষ কথাটা যাকে উদ্দেশ্য করে বলা, এতক্ষণ সে উঠোনের দক্ষিণ দিকের কাচারি ঘরের বারান্দায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। সকালবেলা রামদাসের ঘরের সামনে যাকে দেখেছিলুম, সেই চটকদার চেহারার বউটি। তখন তার সঙ্গে একজন জোয়ান পুরুষ ছিল। এখন সে একা। কুন্ঠিত ভঙ্গিতে সে ডাক্তারবাবুর সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর চোখ না তুলেই জিজ্ঞেস করল, “রঙ্গিলা কেমন আছে?” 

একটু ইতস্তত করে ডাক্তার সরকার বললেন, “খুব একটা ভাল নয়। যাও, ভিতরে গিয়ে একবার দেখে এসো।” 

কথাটা বলে ডাক্তারবাবু আর দাঁড়ালেন না। মোটর সাইকেলে স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। 

বউটির কিন্তু ভিতরে ঢোকা হল না। ঢুকতে বাচ্ছিল, কিন্তু রামদাস এবারেও সেই সকালবেলার মতোই তার মুখের উপরে দরজা বন্ধ করে দিল। 

২১ 

ঘরে ঢুকতেই ভাদুড়িমশাই জিজ্ঞেস করলেন, “রঙ্গিলাকে কেমন দেখলেন?” 

বললুম, “ঠিক বোঝা গেল না। কাল রাত্তিরে নাকি আবার জ্বর এসেছিল।’ 

“ডাক্তারবাবু কিছু বললেন?” 

“বললেন যে, অবস্থা খুব-একটা ভাল নয়। তবে কিনা ওই রকমের কথাই তো আপনি তাঁকে বলতে বলেছিলেন। জ্বর যাতে আর না আসে, তার জন্যে একটা ক্যাপসুল ফের রিপিট করতে বললেন।” 

ভাদুড়িমশাই ভুরু কুঁচকে বললেন, “ভাবিয়ে তুলন দেখছি। কে জানে, অবস্থা সত্যিই খারাপ কি না।”

বললুম, “সকালে একটি বউ আর একজন জোয়ান পুরুষকে রঙ্গিলাদের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলুম। মনে পড়ছে?” 

“পড়বে না কেন? কে ওরা?” 

“জানি না। তবে বউটি এ-বেলাও এসেছিল দেখলুম। ঘরে ঢুকতে গিয়েছিল। কিন্তু রামদাস তাকে ঢুকতে দিল না।” 

“ও-বেলাও দেয়নি। মুখের উপরে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল।” 

“এ-বেলাও সেই একই ব্যাপার।” 

শুনে ভাদুড়ি শাই কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “চলুন, একটু ঘুরে আসা যাক।” বললুম, “সে কী মশাই, আপনি তো সর্দিজ্বরের ভান করে পড়ে আছেন। বাইরে বেরুলে লোকে সন্দেহ করবে না?” 

“সন্দেহ করার কী আছে? সর্দিজ্বরে কি পায়চারি করাও নিষেধ নাকি?” 

“সন্ধের সময় নিরুর আসবার কথা।” 

“সন্ধের এখনও অনেক বাকি। সবে তো সাড়ে চারটে বাজে। ছটার মধ্যে ফিরে এলেই চলবে। চলুন, চলুন, আর দেরি করবেন ন।” 

পায়জামা আর পাঞ্জাবি পরাই ছিল। তার উপরে একটা জাম্পার চড়িয়ে নিচ্ছি, এমন সময় চায়ের ট্রে নিয়ে রামদাস এসে ঘরে ঢুকল। ভাদুড়িমশাই বললেন, “বাঃ, চা-ও এসে গেছে দেখছি।” 

ট্রে থেকে চায়ের কাপ আর বিস্কিটের প্লেট টেবিলে নামিয়ে রেখে রামদাস বলল, “আপনারা কি এক্ষুনি বেরুবেন?” 

বললুম, “চা-না খেয়ে নিশ্চয় বেরুব না। কেন, তোমার কোনও কথা ছিল?” 

“মেয়েটার জন্যে বড় চিন্তায় আছি, বাবু। বাঁচবে তো?” 

“নিশ্চয় বাঁচবে। শুনলুম কাল রাত্তিরে নাকি আবার জ্বর এসেছিল। তাতে ভয় পাবার কিছু নেই। ক্যাপসুলটা পড়লে আর জ্বর আসবে না।” 

চায়ে চুমুক দিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “একটা কথা জিজ্ঞেস করি, রামদাস। সকালবেলায় একটি বউকে তোমাদের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলুম। শুনলুম সে নাকি এ-বেলাও আবার এসেছিল। বউটি কে?” 

রামদাস বলল, “একটা বাজে মেয়েছেলে।” 

“এসেছিল কেন?” 

রামদাস এ-কথার স্পষ্ট কোনও জবাব না-দিয়ে বলল, “মাঝে-মাঝেই আমাদের জ্বালাতে আসে, বাবু। হয়তো আপনাদের কাছেও আসবে। ওকে পাত্তা দেবেন না।”

আমাদের চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। ট্রের উপরে কাপ আর প্লেট তুলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল রামদাস। ভাদুড়িমশাই বললেন, “চলুন, বেরিয়ে পড়ি।” 

ফলের বাগানটাকে বাঁয়ে রেখে বাড়ির পুব দিকের রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে-যেতে দূর থেকেই লক্ষ করলুম যে, সাধু-বাবা তাঁর ঘরের বারান্দায় পায়চারি করছেন। তিনিও আমাদের দেখতে পেয়েছিলেন। বারান্দা থেকেই চেঁচিয়ে বললেন, “কোথায় যাচ্ছিস?” 

আমিও গলা চড়িয়ে বললুম, “এই একটু ঘুরতে বেরিয়েছি।” 

সাধুবাবা হাহা করে হেসে উঠে বললেন, “ঘোর ঘোর, এই গোলকধাঁধার মধ্যে ঘুরে মর।”

ভাদুড়িমশাই হাঁটতে-হাঁটতেই নিচু গলায় বললেন, “ইনি তো দেখছি তুই-তোকারি ছাড়া কথাই বলেন না।” 

বললুম, “সাধু হবার এটাই একটা মস্ত সুবিধে।” 

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “কথাটা নেহাত মন্দ বলেননি। তবে কিনা সাধু হয়েছেন বলেই ইনি তুই-তোকারি করে বেড়াচ্ছেন, নাকি তুই-তোকারি করবার সুবিধে হবে বলেই সাধুর ভেক ধারণ করেছেন, সেটাই ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। 

উল্টো দিক থেকে একজন লোক আসছিল। আমাদের কাছাকাছি এসে লোকটা একটু থমকে দাড়াল, তারপর দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল চৌধুরিদের বাড়ির দিকে। 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “চিনতে পারলেন?” 

বললুম, “বিলক্ষণ। সকালবেলায় সেই বউটি যখন রঙ্গিলাদের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, একে তখন তার সঙ্গে দেখেছি। এ-বেলায় অবশ্য এ-লোকটি তার সঙ্গে ছিল না।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “একটু দাঁড়ান, ব্যাপারটা বুঝতে হচ্ছে।” বলে, পথের মধ্যে আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে, চৌধুরিদের বাড়ির দিকেই আবার ফিরে গেলেন। 

এক-একা দাঁড়িয়ে থাকতে অস্বস্তি হচ্ছিল। বেশিক্ষণ অবশ্য অপেক্ষা করতে হল না। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ভাদুড়িমশাই ফিরে এলেন। বললেন, “চলুন, রঙ্গনাথবাবুর সঙ্গে একবার দেখা করে আসি।” 

বললুম, “লোকটা গেল কোথায়? চৌধুরিদের বাড়িতে?” 

“না, বাড়িতে নয়, বাগানে। 

“তার মানে?” 

“তার মানে সে সাধুবাবার আখড়ায় গিয়ে ঢুকল।” 

কথা বলতে-বলতে আমরা রঙ্গনাথবাবুর বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছিলুম। দেখলুম, ভদ্রলোক একটা ঝারি হাতে নিয়ে ফুলগাছের উপর জল ঢালছেন। আমাদের দেখে ঝারিটা নামিয়ে রেখে বললেন, 

“কী সৌভাগ্য, আসুন আসুন।” 

বারান্দায় মাদুর পাতাই ছিল। আমাদের সেখানে বসিয়ে রঙ্গনাথ বললেন, “গিন্নি এ-বেলা অনেক সুস্থ। একটু চা করতে বলি?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “টা খেয়েই বেরিয়েছি। এখন আর খাব না। তা ছাড়া বসবও না বেশিক্ষণ। একটা কথা জিজ্ঞেস করবার ছিল।” 

“বেশ তো, বলুন।” 

“আজ সকালে যখন আপনার এখান থেকে চৌধুরিদের বাড়িতে ফিরে যাই, একটি বউ আর একজন জোয়ান মানুষকে তখন রামদাসের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলুম। মনে হল, রামদাস তাদের উপরে বিশেষ খুশি নয়। বউটি এ-বেলাও এসেছিল। আমি দেখিনি, তবে আমার এই বন্ধুটি দেখেছেন। তা এঁরই কাছে শুনলুম যে, এ-বেলাও নাকি রামদাস তার সঙ্গে খুব ভাল ব্যবহার করেনি।” 

চিন্তিতভাবে রঙ্গনাথ বললেন, “আপনার কথাটা ঠিক বুঝতে পারছি না। রামদাস তো এমনিতে খুবই শান্ত আর ভদ্র স্বভাবের মানুষ। তাকে তো কারও সঙ্গে কখনও দুর্ব্যবহার করতে দেখিনি। একটু বুঝিয়ে বলবেন?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “সকালবেলায় এই বউটির মুখের উপরে রামদাসকে আমরা দরজা বন্ধ করে দিতে দেখেছি।।-বেলাও নাকি সেই একই ব্যাপার। রামদাসকে জিজ্ঞেস করেছিলুম, বউটি কে। তা রামদাস বলল, একটা বাজে মেয়েছেলে।” 

রঙ্গনাথ বললেন, “কী রকম দেখতে বলুন তো?” 

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “প্রশ্নটা আপনি বরং কিরণবাবুকে করুন। মেয়েদের চেহারার বর্ণনা আমার ঠিক আসে না মশাই, ও-কাজটা কিরণবাবু অনেক ভাল পারবেন।” 

আমি বললুম, “সুন্দরী নয়, তবে বেশ চটকদার চেহারা।” 

“বয়েস?” 

“বছর পঁয়ত্রিশ হবে। এক-আধ বছর বেশিও হতে পারে।”

“রং?” 

“ফর্সা। একটু বেশি রকমের ফর্সাই বলতে হবে।” 

বউটির চেহারা যে চটকদার আর বয়স যে বছর-পঁয়ত্রিশ, এইটে শুনেই রঙ্গনাথবাবুর ভুরু কুঁচকে গিয়েছিল। রং ফর্সা শুনে বললেন, “বটে?” তারপর ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “সকালবেলায় তার সঙ্গে যাকে দেখেছিলেন, সেই পুরুষটি কি খুব ষণ্ডামতো?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ঠিক বলেছেন। চিনতে পেরেছেন নিশ্চয়?” 

রঙ্গনাথ বললেন, “ও তো ঝুমরি। সহদেব মারা যাবার মাস-খানেকের মধ্যেই ঘর ছেড়ে পালিয়েছিল।” 

আমি বললুম, “সহদেবটি আবার কে?” 

“দেখুন মশাই,” রঙ্গনাথ বললেন, “মুকুন্দপুরে আমি মাত্র বছর-পাঁচেক হল এসেছি। এখানকার সব কথা আমার পক্ষে জানা সম্ভব নয়, জানিও না। তবে গাঁয়ের লোকেরা হরেক ব্যাপার নিয়ে বলাবলি করে তো, তাই কিছু-কিছু কথা আমার কানেও পৌঁছে যায়। ঝুমরির ব্যাপারটাও ওইরকম। তা ওর সম্পর্কে যা শুনেছি, তাতে বলতে পারি যে, রামদাস কিছু অন্যায় করেনি। সত্যিই অতি বাজে মেয়েছেলে। তার উপরে আবার ঘোর বেহায়া। তা নইলে আর ওই মুখ এখানে দেখায় কী করে?” 

রঙ্গনাথবাবু কী যে বলছেন, কিছুই বুঝতে পারছিলুম না। ভাদুড়িমশাইয়ের মুখ দেখে মনে হচ্ছিল যে, তাঁর অবস্থাও তথৈবচ। তবে রঙ্গনাথ চুপ করতেই তিনি যে প্রশ্ন করলেন, তাতেই বুঝলুম, ব্যাপারটা তিনি আঁচ করতে পেরেছেন। 

“সহদেব নিশ্চয় রামদাসের ছেলে, তাই না?” 

“একমাত্র ছেলে। টাইফয়েডে মারা যায়। শুনেছি রঙ্গিলার বয়েস তখন মাত্র এক বছর। তা সেই দুধের বাচ্চাকে ফেলে রেখেই ঝুমরি পালিয়ে গিয়েছিল। অমানুষ আর কাকে বলে!” 

একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন রঙ্গনাথ। তারপর, বললেন, “অবশ্য ঝুমরির যা হিসটি তাতে বোধহয় মানুষের মতো আচরণ ওর কাছে আশাও কর যায় না।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কীরকম?” 

“কাছেই একটা চা-বাগান রয়েছে। দক্ষিণবাড়ি টি এস্টেট। মুকুন্দপুরে ঢুকবার পথে হয়তো আপনাদের চোখে পড়ে থাকতে পারে। বাগানটা ছিল সাহেবদের। ম্যানেজারও ছিল সাহেব। ঝুমরির মা ওখানে ম্যানেজারের বাড়িতে কাজ করত। বাপ ছিল চৌকিদার। লোকে বলে, সেই ম্যানেজারই ঝুমরির আসল বাপ। তা ঝুমরির গায়ের রং দেখে তো মনে হয়, কথাটা তারা মিথ্যে বলে না।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তারপর?” 

“তারপর আর কী, রামদাসের ছেলের সঙ্গে বিয়ে হল ঝুমরির। আর তারপর যা হল তা তো আগেই বলেছি। বিয়ের বছর দুই বাদে স্বামী ও মরল আর তার মাস তিনে েমধ্যেই দুধের বাচ্চাটাকে ফেলে রেখে পালিয়ে গেল ঝুমরি। কিন্তু আবার বলি, এ-সবই আমার শোনা-কথা।” 

“কার সঙ্গে পালিয়ে গেল?” 

“তা কেউ বলতে পারে না। কোথায় গিয়েছিল, তাও না। তবে গত পাঁচ-ছবছর ধরে নাকি হিরালালের সঙ্গে আছে।” 

“ওই যণ্ডামতন লোকটাই বুঝি হিরালাল?” 

“আজ্ঞে হ্যাঁ। রঙ্গনাথ বললেন, “হিরালালও দক্ষিণবাড়ি টি এস্টেটে কাজ করে। কুলির সর্দার।”

“বটে! ওরই সঙ্গে ঝুমরি তা হলে এসেছিল।” 

“সেইটেই তো মজার ব্যাপার।” রঙ্গনাথ বললেন, “ঘর-পালানো বউ, তার তো আর শ্বশুরবাড়িতে এসে মুখ দেখাবার কথা নয়, অথচ পালিয়ে যাওয়ার পরেও নাকি ঝুমরি এ-গাঁয়ে বার কয়েক এসেছিল। রঙ্গিলা জখম হবার পরে তো প্রায়ই আসছে শুনি। রামদাস তাড়িয়ে দেয়। তবু আসে।” 

আমি বললুম, “কী আর করবে। মেয়ের টানে আসতেই হবে।” 

রঙ্গনাথ বললেন, “এতই যদি টান, তো এক-বছরের মেয়েকে ফেলে রেখে পালিয়েছিল কেন?”

ভাদুড়িমশাই ক্লিষ্ট হেসে বললেন, “তা বটে।” 

২২ 

রঙ্গনাথবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “চাষিবউটিকে রঙ্গনাথ সেই যে কোথায় কী রেখে আসতে বলেছিলেন, তা নিয়ে কিন্তু এবারেও আপনি কিছু জিজ্ঞাসা করলেন না!” 

বললুম, “ফিরে গিয়ে জিজ্ঞেস করব নাকি?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “থাক, সন্ধে হয়ে আসছে, এখন ফিরে যাওয়াই ভাল।” 

চৌধুরিদের বাড়িতে ফিরে আমাদের ঘরে ঢুকে সদ্য ইজিচেয়ারে গা ঢেলে দিয়েছি, এমন সময় কোথায় যেন শাঁখ বেজে উঠল। খানিক বাদেই পাওয়া ণেল ঘন্টার আওয়াজ। 

তারও খানিক বাদে নিরু এসে ঘরে ঢুকল। 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বোসো নিরু। ওই চেয়ারটায় বোসো। কেউ দাঁড়িয়ে থাকলে আমার বড় অস্বস্তি হয়।” 

নিরু বসল। ভাদুড়িমশাই বললেন, “একটু আগে শাঁখ আর ঘন্টা বাজতে শুনলুম। মনে হল, আওয়াজটা বাইরের উঠোনের দিক থেকে আসছে।” 

নিরু বলল, “ঠাকুরমশাই পুজোয় বসেছেন। 

“মা আর পিসিমা কোথায়?” 

“একটু আগে জপ করতে বসলেন। এখন অন্তত ঘন্টা দেড়েক আমার ডাক পড়বে না। সেই জন্যেই কয়েকটা কথা আপনাকে জানাতে এলুম” 

“সত্যি তুমি তা হলে সত্যপ্রকাশবাবুর স্ত্রীর ছোট বোন?” 

“হ্যাঁ, আমি তাঁর ছোট বোন। আমার আসল নাম কিন্তু নিরু নয়। আমার নাম…..”

ভাদুড়িমশাই হাত তুলে বললেন, “দাঁড়াও দাঁড়াও, দেখা যাক এটাও আমি আঁচ করতে পারি কি না। তোমার আসল নাম সম্ভবত সুহাসিনী। কী, ঠিক বলেছি তো?”

চমকে উঠে নিরু বলল, “কী করে জানলেন?” 

“এ তো জানার ব্যাপার নয়, আন্দাজ করবার ব্যাপার। আন্দাজে একটা ঢিল ছুড়লুম, সেটা লেগে গেল, ব্যস্।” 

“কিন্তু আন্দাজটাই বা করলেন কীভাবে? এ-নাম তো এক জামাইবাবু ছাড়া এ-বাড়িতে কারও জানবার কথা নয়।” 

“তা হলে ধরে নাও যে, তোমার জামাইবাবুরই একটা কথা থেকে এটা আমি আন্দাজ করেছি।….ওই মানে হঠাৎ তাঁর মুখ ফশকে বেরিয়ে যাওয়া একটা কথা থেকে।” 

ভুরু কুঁচকে গেল নিরুর। বলল, “কী কথা?” 

“না-শুনে ছাড়বেই না?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “বেশ তা হলে শোনো। মনসার তো অনেক ভাল-ভাল নাম আছে। এই যেমন ধরো পদ্মাবতী। মনসামঙ্গলের আর-এক নাম যে পদ্মাপুরাণ, সেটা এইজন্যেই। মনসামঙ্গল কার লেখা জানো তো?….. বিজয় গুপ্তের। মনসা তাঁকে নাকি স্বপ্নে দেখা দিয়ে লিখতে বলেছিলেন এই পুঁথি। বলেছিলেন, ‘মনে ভয় না করিও দেখিয়া নাগজাতি/মহাদেবের কন্যা আমি নাম পদ্মবতী।’ তা সে-কথা থাক। আসল কথা হল, যেমন পদ্মাবতীর মতোই আরও বেশ কিছু সুন্দর নাম আছে মনসাদেবীর, তেমনি আবার একটা বিদঘুটে নামও আছে। নামটা হল জরৎকারু। কাল রাত্তিরে তোমার জামাইবাবুর কাছে আমি কথায়-কথায় এই জরৎকারু নামটার উল্লেখ করেছিলুম। তাতে তিনি কী বললেন জানো?” 

“কী বললেন?” 

“বললেন, এ যেন যে-মেয়ের এক-নাম সুহাসিনী, তার অন্য-নাম জগদম্বা।” 

হঠাৎ যেন নিরু একেবারে পাথরের মতো স্থির হয়ে গিয়েছে। ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে সে। কিন্তু কোনও কথা বলছে না। 

আমি বললুম, “বাস, অমনি আপনি বুঝে গেলেন যে, নিরুর নাম আসলে সুহাসিনী?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “না-বুঝবার কী আছে। আমরা যাকে হঠাৎ মুখ ফশকে বেরিয়ে যাওয়া কথা ভাবি, সত্যিই তো আর সেগুলি আমাদের মুখ ফশকে বেরোয় না, তার পিছনেও কাজ করে আমাদের ইচ্ছা। আর সেইজন্যেই আমার মনে হল যে, বিদঘুটে নামের বিপরীত কোনও সুন্দর নামের কথা বলতে গিয়ে সত্যপ্রকাশ হঠাৎ ‘সুহাসিনী’ নামটাই বা বললেন কেন? নিশ্চয় এটা এমন কারও নাম, যাকে তিনি খুব স্নেহ করেন, ভালবাসেন।” 

বললুম, “সুহাসিনী নামটা তো সত্যপ্রকাশের দুই মেয়ের মধ্যে এক মেয়েরও হতে পারত। তাদেরও তো তিনি কম স্নেহ করেন না। তা হলে আপনি তাদের কথা না-ভেবে বিশেষ করে নিরুর কথাই বা ভাবতে গেলেন কেন?” 

“এটা কি আপনি খুব বুদ্ধিমানের মতো কথা বললেন, কিরণবাবু?” ওঁর বড় মেয়ে…..মানে ওই কলকাতায় যার বিয়ে হয়েছে…… মালতীদের বাড়ির কাছে ট্রায়াঙ্গুলার পার্কের দক্ষিণে যার শ্বশুরবাড়ি…. তার নাম যে সুজাতা, তা তো আমরা শুনেইছি। বাকি রইল তার বোন। তা সুজাতার বোনের নাম হবে সুগতা কি সুলতা কি সুনন্দা কি ওই রকমেরই তিন অক্ষরের অন্য কোনও নাম।” 

মৃদু গলায় নিরু বলল, “সুরূপা।” 

ভাদুড়িমশাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “হল তো? আর তা ছাড়া সুহাসিনী যতই সুন্দর হোক, একটু সেকেলে তো, একেবারে এ-কালের মেয়েদের ও-নাম হয় না। তা হলে ও-নাম এ-বাড়িতে কার হতে পারে? তখন মনে হল, নিরুর হওয়া কিছু বিচিত্র নয়।…..কী নিরু, ঠিক বলিনি? হাহা!” 

নিরু যখন জড়সড় হয়ে বসে আছে, ভাদুড়িমশাই তখন এত হাল্কা গলায় কথা বলছেন কেন আর হাহা করে হাসছেনই বা কেন, প্রথমটায় আমি তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলুম না। পরে মনে হল, এটা ইচ্ছাকৃত ব্যাপার। আসলে নিরুর সঙ্কোচটাই ভেঙে দিতে চাইছেন ভাদুড়িমশাই। যাতে কিনা তার অস্বস্তিটা সে কাটিয়ে উঠতে পারে, লজ্জা না করে সমস্ত কথা খুলে বলতে পারে। 

নিরু বলল, “ঠিক বলেছেন। জামাইবাবু সত্যিই আমাকে খুব স্নেহ করেন।” 

হাসতে-হাসতে ভাদুড়িমশাই বললেন, “যাক তা হলে নামের ধাঁধাটা মিটল। এখন একটা কথা বলো তো। এ-বাড়িতে কি একমাত্র সত্যপ্রকাশই তোমার আসল পরিচয়টা জানেন? আর কেউ জানে না?” 

মুখ তুলে নিরু বলল, “রামদাসও জানে। কিন্তু জামাইবাবু নিষেধ করে দিয়েছেন তো, তাই মরে গেলেও সেটা সে কাউকে বলবে না।”

“মা আর পিসিমা জানেন না কেন?” 

“কী করে জানবেন। আমি এসে এ-বাড়িতে ঢুকবার আগে তো তাঁরা আমাকে দেখেননি।”

“সত্যপ্রকাশের শ্বশুরবাড়িতে কখনও যাননি তাঁরা?” 

“কোনও দিনই যাননি।” 

“কেন?” 

“এ-বাড়ির গিন্নিরা কখনও ছেলে কিংবা মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে যান না, যাবার নিয়মই নেই। জামাইবাবুর মা যেমন কখনও ছেলের শ্বশুরবাড়ির চৌকাঠ মাড়াননি, তেমন জামাইবাবুর ঠাকুমাও কখনও চৌকাঠ মাড়াননি পিসিমার শ্বশুরবাড়ির। দিদির বড় মেয়ের কথাই ধরুন। বছর তিনেক হল সুজাতার বিয়ে হয়েছে, বিয়েটা আমার দিদি দেখে যেতে পারেনি, তার দু’বছর আগেই সে মারা যায়। কিন্তু যদি বেঁচে থাকত, তা হলেই কি দিদি কক্ষনো সুজাতার শ্বশুরবাড়িতে যেত?” 

“যেতেন না?” 

“কক্ষনো যেত না। জামাইবাবুর সঙ্গে কলকাতায় গেলে হয় জামাইবাবুর কোনও বন্ধুর বাড়িতে উঠত, নয়তো কোনও হোটেলে। কিন্তু মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে কক্ষনো নয়।”

“তা তো বুঝলুম, কিন্তু সুহাসিনী নামে যে সত্যপ্রকাশের একটি শ্যালিকা রয়েছে, মা আর পিসিমা অন্তত সেটুকু নিশ্চয় জানতেন। তাই না?” 

“জানতেন বই কী। কিন্তু আমিই যে সেই সুহাসিনী, তা জানতেন না।” 

“তাতেও কিন্তু ব্যাপারটা পরিষ্কার হচ্ছে না, একটা খিঁচ থেকে যাচ্ছে।”

“কেন?” 

“কোথায় খিঁচ থেকে যাচ্ছে, বুঝতে পারছ না?”

“না তো।” 

“ঠিক আছে,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “বুঝিয়ে বলছি। মা আর পিসিমা নাহয় এ-বাড়ির নিয়ম মেনে কখনও সত্যপ্রকাশের শ্বশুরবাড়িতে যাননি, কিন্তু তোমার ব্যাপারটা কী? দিদির শ্বশুরবাড়িতে বোনের আসাটা তো আর কোনও পরিবারেই একটা নিয়মবিরুদ্ধ ব্যাপার বলে গণ্য হয় না, অন্তত হয় বলে আমি শুনিনি। দিদি বেঁচে থাকতে তুমিই বা তা হলে এ-বাড়িতে কখনও আসোনি কেন? অনায়াসেই তো আসতে পারতে, দু’চার দিন থেকেও যেতে পারতে। তাই না?” 

নিরু এবারে সরাসরি ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকাল। বলল, “হ্যাঁ, তা পারতুম বটে।”

“তা হলে আসোনি কেন?” 

“এই প্রশ্নের জবাব কি আমাকে দিতেই হবে?” 

“মোটেই না।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “জবাব তোমাকে দিতেই হবে, এমন কথা কি আমি বলেছি? বলিনি। জবাব দিতে তোমার যদি কোনও অসুবিধে থাকে তো দিও না।” 

আমার অস্বস্তি হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, সত্যিই কিছু অসুবিধে আছে এই মেয়েটির নিজের থেকে সব বলতে এসেও, যে-জন্যে ও সব কথা আমাদের খুলে বলতে পারছে না। 

ইজিচেয়ার থেকে আমি উঠে পড়লুম। টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর দে গলাইটা কুড়িয়ে নিয়ে ভাদুড়িমশাইকে বললুম, “আপনারা বরং কথা বলুন, আমি একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি।” 

নিরুই বাধা দিল আমাকে। বলল, “বসুন, আপনাকে বাইরে যেতে হবে না। সব কথা খুলে বলতে আমার একটু অসুবিধে আছে ঠিকই, কিন্তু সেটা আপনার জন্যে নয়।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কার জন্যে?” 

“যাঁর জন্যে, দুপুরে তিনি শিলিগুড়ি রওনা হয়ে গেছেন।” 

“অর্থাৎ সত্যপ্রকাশের জন্যে। তাই না?” 

মৃদু গলায় নিরু বলল, “হ্যাঁ, জামাইবাবুর জন্যে। তিনি অবশ্য তাঁর নিজের মান-সম্মান নিয়ে খুব টিন্তিত নন; এ-ব্যাপারে তাঁর যা-কিছু দুর্ভাবনা, আমি খুব ভালই বুঝতে পারি যে, তা শুধু আমারই জন্যে। আমারই মান-সম্মানের কথা ভেবে তিনি অনেক ব্যাপার তাঁর মা আর পিসিমার কাছ থেকে তো বটেই তাঁর ছেলেমেয়েদের কাছ থেকেও গোপন করে রেখেছেন। আমি যে কে, তা পর্যন্ত কাউকে কখনও জানাননি।” 

একটুক্ষণের জন্যে চুপ করে রইল নিরু। তারপর মস্ত একটা নিশ্বাস ফেলে ম্লান হেসে বলল, “অথচ মজা কী জানেন, নিজের মান-অপমানের কথা আমি আর এখন ভাবছি না, আমি শুধু ভাবছি যে, শিলিগুড়ির যে নরক থেকে উনি আমাকে তুলে নিয়ে এসেছেন, দরকার হয় তো সেই নরকেই আমি আবার ফিরে যাব, তবু আমার জন্যে যেন ওঁর গায়ে কোনও কলঙ্কের দাগ না লাগে। 

২৩ 

ঘর একেবারে নিস্তব্ধ। কেউই কোনও কথা বলতে পারছিলুম না। না আমি, না ভাদুড়িমশাই। নিরুর কথা শুনে আমার আরও খারাপ লাগছিল এই ভেবে যে, একটা জীবনের এমন কোনও জায়গা আমরা ছুঁয়ে ফেলেছি, যে জায়গাটা বড় বেদনার। কে জানে, কত দিনের কত অসম্মান, অপমান আর গ্লানির জজ্ঞাল সেখানে পুঞ্জীভূত হয়ে রয়েছে। সেই জঞ্জালকে এইভাবে বাইরে টেনে আনবার কি সত্যি কোনও অধিকার আছে আমাদের। 

ভাদুড়িমশাইয়ের উপরে একটু-একটু রাগও যে আমার- না হচ্ছিল, তা নয়। যে-কাজে তিনি এসেছেন, সেইটে ঠিকমতো করলেই তো গোল মিটে যায়। তা না- করে ঝোপের এদিকে-ওদিকে লাঠি চালিয়ে অনর্থক কেন আবহাওয়াটাকে এইভাবে আরও অস্বস্তিকর করে তুলছেন তিনি? সত্যপ্রকাশের ড্রইংরুমের দেওয়ালে তাঁর পরলোকগতা স্ত্রীর ফটো দেখেই তিনি আন্দাজ করেছিলেন যে, কাজের লোক বলে নিরুর পরিচয় দেওয়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আসলে সে ওই ভদ্রমহিলারই ছোট বোন। কিন্তু আন্দাজ করলেই নিরুকে সে-কথা বলতে হবে? বলে এইভাবে তাকে আরও অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিতে হবে? না না, কাজটা ভাদুড়িমশাই মোটেই ভাল করেননি। 

নিরুর কথায় আমার চমক ভাঙল। 

“যাঁর জন্যে আমার এত ভাবনা, সেই জামাইবাবু মানুষটা কী সাদাসিধে আর সরল দেখুন। দিদির সঙ্গে আমার মুখের এই যে মিল, এটা কি আর মা পিসিমা আর ছেলেপুলেদের চোখে পড়েনি? পড়েছে। কিন্তু তাঁরা ভেবেছেন যে, এমন মিল তো কত লোকের সঙ্গেই কত লোকের থাকে। এর বেশি আর কিছু ভাবেননি তাঁরা। কিন্তু তাঁরা না-ভাবলেও নামজানা একজন গোয়েন্দা যে ঠিকই এটা নিয়ে ভাববেন….শুধু যে ভাববেন, তা নয়, মিলের কারণটাও ধরে ফেলতে পারবেন, এই সহজ কথাটা পর্যন্ত জামাইবাবু বুঝতে পারেননি।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বুঝতে পারলে তিনি কী করতেন? যে ক’দিন আমরা এখানে আছি, অন্তত সেই ক’টা দিনের জন্যে তোমার দিদির ফটোখানাকে তিনি বোধহয় ড্রইং রুম থেকে সরিয়ে রাখতেন। তাই না?” 

নিরু বলল, “কী জানি। না-ও সরাতে পারতেন। যে-রকম লোক, হয়তো বলতেন, কী দরকার, বাইরের কেউ যদি বোঝে তো বুঝুক না।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা তো হল, কিন্তু অন্য-একটা প্রশ্ন তোমাকে করেছিলুম, তার জবাব এখনও পাইনি।” 

“দিদি বেঁচে থাকতে এ-বাড়িতে আমি কখনও আসিনি কেন, এই তো?” 

“হ্যাঁ, আসোনি কেন?”

“উপায় ছিল না, তাই আসিনি।” 

নিরু আবার মুখ নিচু করল। তাকে দেখে কষ্ট হচ্ছিল আমার। ভেবেছিলুম, ভাদুড়িমশাই আর এগোবেন না, তাঁর প্রশ্নে এবারে ছেদ টানবেন। ব্যাপারটা শুধুই অস্বস্তিকর নয়, প্রায় নিষ্ঠুরতার পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছচ্ছে। মনে হচ্ছিল, নিতান্ত অসহায় আর দুর্বল একটা প্রাণীকে যেন খাঁচার মধ্যে আটকে ফেলেছেন তিনি, আর তারপর খাঁচার বাইরে দাঁড়িয়ে চোখা একটা বল্লম দিয়ে ক্রমাগত তাকে খুঁচিয়ে চলেছেন। 

কিন্তু না, প্রশ্নে তিনি ছেদ টানলেন না। বললেন, “উপায় ছিল না-ই বা কেন?” 

নিরু মুখ তুলল। এবারে তাকে দেখে যেন ধাঁধা লাগল আমার। মনে হল, যতটা দুর্বল তাকে ভাবছিলুম, ঠিক ততটা দুর্বল হয়তো সে নয়। তার চোখে একটু আগে একটা অসহায়তার ছায়া ভাসতে দেখেছিলুম। সেই ছায়াটা হঠাৎ সরে গেছে। ধারালো চোখে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে সে বলল, “তার আভাস যে আপনাদের দিইনি, তা নয়। কিন্তু আপনার কথা শুনে এখন মনে হচ্ছে যে, ওইভাবে বললে হবে না, স্পষ্ট করে সবিস্তারে সবটাই আপনাকে বলতে হবে। তাই না?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কোনও-কিছু অস্পষ্ট না-রাখাই তো ভাল।” 

দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে নিরু বলল, “ঠিক আছে, সবটাই তা হলে বলব। প্রথমেই জেনে রাখুন আমার দিদি আর আমি একই বাবার মেয়ে বটে, তবে একই মায়ের মেয়ে নই।” 

আমি বললুম, “তার মানে?” 

“মানে অতি সহজ। আলিপুরদুয়ারের জনার্দন বিশ্বাস তাঁর প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পরে আবার বিয়ে করেছিলেন। দিদি তাঁর প্রথম স্ত্রীর মেয়ে, আর আমি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর। দিদি আমার চেয়ে দশ বছরের বড়। বেঁচে থাকলে তাঁর বয়েস এখন চল্লিশ হত। দিদির বিয়ে হয়েছিল সতেরো বছর বয়েসে। আমার বয়েস তখন সাতের বেশি নয়। কিন্তু তখনই আমাকে দেখে সবাই বলত যে, মেয়েটা একেবারে দিদির মতো হয়েছে।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা তো হয়েছই। নইলে আর আমি সম্পর্কটা আন্দাজ করলুম কী করে?”

নিরু বলল, “না-ও কিন্তু হতে পারতুম। আমরা দুবোন যদি যে-যার মায়ের মতো দেখতে হতুম, কিংবা আমাদের যে-কোনও একজন তার মায়ের মতো, তা হলেই আর মিলটা থাকত না। অথচ মজা কী জানেন, আমরা কেউই আমাদের মায়ের আদল পেলুম না, আমাদের দুজনের মুখেই স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল আমাদের বাবার মুখের ছাপ। তফাত শুধু একটাই। দিদি ফর্সা, আমি কালো।” 

আমি বললুম, “সে কী, তেমন কালো তো তুমি নও।” 

এতক্ষণে হাসি ফুটল নিরুর মুখে। যেন আমার কথাটা শুনে খুব মজা পেয়েছে, এইরকমের হাল্কা গলায় বলল, “ঠিক ঠিক, কাঠকয়লার মতো কালো তো আর নই, ওই যাকে কালো মেয়ের বাবা-মায়েরা উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ বলে চালাতে চায়, তা-ই আর কি। তা আমার মাও দেখেছি চিঠিপত্রে কক্ষনো ‘কালো’ লিখতেন না। লিখতেন ‘মেয়ে আমার উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা’। ভারী মজার ব্যাপার, তাই না?” 

ভাদুড়িমশাই দেখলুম, নির্বিকার। বললেন, “কিসের চিঠি?” 

“কীসের আবার,” সেই একইরকমের হাল্কা গলায় নিরু বলল, “বিয়ের সম্বন্ধের। বাবা তো বেশিদিন বাঁচেননি। দিদির বিয়ের বছর তিনেক বাদেই তিনি মারা যান। আমান বয়েস তখন দশ। তার বছর ছ’সাত বাদেই শুরু হল আমার বিয়ের চেষ্টা। বাবা বেঁচে নেই, তাই কাগজে ওই যে সব বিয়ের বিজ্ঞাপন বেরোয়, তাই দেখে-দেখে মাকেই অগত্যা পাত্রপক্ষের কাছে চিঠি লিখতে হত। চিঠি পেয়ে তাদের কেউ যে আমাকে দেখতে আসত না, তাও নয়। আসত, রসগোল্লা-সন্দেশ খেত, কিন্তু পছন্দ করত না। তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। একে তো মেয়ের গায়ের রং কালো, তার উপরে আবার গরিব বিধবার মেয়ে, চট করে কারও পছন্দ হবেই বা কেন?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “দাঁড়াও, দাঁড়াও ব্যাপারটা একটু বুঝে নেওয়া দরকার। নিজেকে তুমি ‘গরিব বিধবার মেয়ে’ বলছ কেন? সত্যপ্রকাশবাবুদের অবস্থা তো যদ্দুর বুঝতে পারছি খুবই ভাল। তাঁর তো নেহাত গরিব-ঘরে বিয়ে হবার কথা নয়। তা হলে?” 

নিরু বলল, “এতে এত অবাক হচ্ছেন কেন? রূপকথার রাজপুত্তুররা কি কখনো ঘুঁটেকুডুনির মেয়েকে বিয়ে করে না? তা নইলে তাদের মহত্ত্ব প্রকাশ পাবে কী করে? তবে হ্যাঁ, আমার মতো পেত্নি হলে চলবে না, কুঁচবরণ কন্যে হওয়া চাই। তা জামাইবাবু যেমন রূপকথার রাজপুত্তুর, আমার দিদিও তেমনি ডাকসাইটে সুন্দরী। যেমন দুধে-আলতা রং, তেমনি টানা-টানা চোখ, তেমনি টিকোলো নাক, আর তেমনি নিখুঁত মুখের গড়ন। তা হবে না-ই বা কেন, বাপ আর মা, দুজনের যা-কিছু ভাল, দিদি সবই পেয়েছিল যে। চোখে তো দেখিনি, তবে সব্বাইকে বলতে শুনেছি যে, আমার বড়মার রং ছিল নাকি মেমসাহেবদের মতো। তার উপরে দিদির আবার গুণও ছিল অনেক।” 

“যেমন?” 

“যেমন ছিল লেখাপড়ায় ভাল, তেমনি ছিল রান্না আর সেলাই-ফোঁড়াইয়ের হাত, আবার তেমনি ছিল গানের গলা। মনটাও ছিল খুব নরম। ঘটকের মুখে নিশ্চয় জামাইবাবুর বাবা সবই শুনে থাকবেন। আলিপুরদুয়ারেও তো ব্যাবসার কাজে মাঝে-মাঝে যেতেন, তাই সেখানকার লোকেদের কাছেও হয়তা শুনে থাকতে পারেন। নইলে আর আমাদের মতো গরিবমানুষের ঘরে তাঁর পায়ের ধুলো পড়বে কেন। তা মেয়ে দেখে তো তিনি মুগ্ধ। ঠিকুজি মিলে যেতেই আমার বাবাকে বললেন, ‘আপনাকে কিছু দিতে হবে না, বিশ্বাসমশাই, আপনি শুধু পুরুত ডেকে বিয়ের দিনটা ঠিক করে ফেলুন। খাপত্তর সব আমার। আমিই আমার মা-লক্ষ্মীকে রাজরানির মতো সাজিয়ে আমাদের ঘরে নিয়ে তুলব।’ তা তিনি তুলেওছিলেন।” 

একটুক্ষণ চুপ করে রইল নিরু। তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “মুশকিল কী জানেন, আমাদের জীবনটা তো সত্যিই একটা রূপকথা নয়, সবরকমের দয়া দাক্ষিণ্য আর মহত্ত্বের মধ্যেই শেষ পর্যন্ত তাই একটা ‘কিন্তু’ থেকে যায়।” 

“কী রকম?” 

“এই যে-রকম হয় আর কি। হাতের মুঠো হয়তো খোলাই থাকে, আর তাই দেখেই আমরা ধন্যি-ধন্যি করতে থাকি, ওদিকে মনের দরজায় যে খিল পড়ে গিয়েছে, সেইটে আমরা বুঝতে পারি না। আমার বাবা অবিশ্যি বুঝেছিলেন। জামাইবাবুর বাবা যেদিন বিয়ের কথা পাকা করে আসেন, আমার বাবা সে-দিন থাকে বলেছিলেন, কাজটা ভাল হল কি না কে জানে। মা যখন জিজ্ঞেস করলেন যে, হঠাৎ এমন কথা তাঁর মনে হচ্ছে কেন, তখন বাবা বললেন, “সম্পর্কটা সমানে-সমানে হলেই টেকসই হয়, তা নইলে বড়-একটা ধোপে টেকে না। বড়ঘরে যাচ্ছে বটে, কিন্তু মেয়েটা পর হয়ে গেল।” মা অবশ্য বাবার কথায় কান দেননি। সত্মা হলে কী হয়, দিদিকে ভীষণ ভালবাসতেন তো, তাই মা-মরা যে মেয়েটাকে তিনি একদিন কোলে টেনে নিয়েছিলেন, সে যে বড়লোকের বাড়ির বউ হতে চলেছে, মা তখন তাতেই দারুণ খুশি।” 

“কিন্তু পরে বুঝলেন যে, বাবার কথায় কান দিলেই ভাল হত, কেমন?” 

“কী জানি। তবে বাবা যে ভুল বলেননি, বিয়ের পরেই সেটা স্পষ্ট হয়ে গেল। কী হন। জানেন, খুব ঘটা করে আর দয়াদাক্ষিণ্য দেখিয়ে গরিবঘরের মেয়েটিকে তো চৌধুরিমশাই তাঁর ছেলে। বউ করে এ-বাড়িতে নিয়ে এলেন, কিন্তু তার পরে আর একদিনের জন্যেও তাকে তার বাপের বাড়িতে যেতে দিলেন না।” 

আমি বললুম,”সে কী!”

নিরু বলল, “আপনারা হয়তো ভাবছেন যে, আমি বাড়িয়ে বলছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, এক বিন্দুও আমি বাড়িয়ে বলছি না। দিদিকেও যেতে দেননি, জামাইবাবুকেও যেতে দেননি। এমন শী অষ্টমঙ্গলাতেও না। সরাসরি জানিয়ে দিলেন যে, অষ্টমঙ্গলার নিয়মই নাকি এঁদের নেই।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তাও কি হয় নাকি?”

নিরু বলল, “হবে না কেন? যেখানে আপনি সম্পর্ক রাখতে চাইছেন না, সেখানে সবই হয়। নিয়ম কি আর নেই। আছে। তা নইলে আর বিয়ের পরে জোড় খুলবার জন্যে সুজাতা তার বরকে নিয়ে কলকাতা থেকে এখানে এসেছিল কেন। নিয়ম আছে নিশ্চর। যেমন আমাদের আছে, তেমনি এঁদের আছে। কিন্তু আমার বাবা যখন মেয়ে-জামাইকে তাঁর ওখানে নিয়ে যাবার জন্যে মুকুন্দপুরে এলেন, জামাইবাবুর বাবা তখন স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন যে, অমন কোনও নিয়মই এঁদের বাড়িতে নেই।” 

“অর্থাৎ তিনি সত্যি-সত্যিই তোমাদের সঙ্গে আর কোনও সম্পর্ক রাখতে চাইছিলেন না?” ভাদুড়িমশাইয়ের কথা শুনে হেসে উঠল নিরু। বলল, “সত্যি-সত্যি নয় তো কি মিছিমিছি?” তারপরেই হঠাৎ বিষণ্ণ গলায় বলল, “বাবা বুঝে গেলেন যে, শুধু তাঁর মেয়েটিকে এঁরা চেয়েছিলেন আর-কারও সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখতে চাননি। বুঝে গিয়ে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু তাঁর তো কিছু করারও ছিল না। ….কী জানেন, আমার বাবার তো ঠিক মরবার বয়েস হয়নি, তবু যে এরপরে আর খুব বেশিদিন তিনি বাঁচেননি, তারও হয়তো এটাই কারণ। বড়লোকের দরজায় এসে ফিরে যাবার এই অপমানটাই তিনি সহ্য করতে পারলেন না।” 

“সত্যপ্রকাশেরও কি তাঁর বাবার কথায় সায় ছিল?” 

“ছিল কি না, তখন সেটা আমরা জানতে পারিনি। পরে জেনেছি যে, ছিল না। কিন্তু সায় না থাকলেই বা জামাইবাবু কী করবেন? বলতে গেলে তিনিও তো তখন নেহাতই ছেলেমানুষ, অন্তত নিজের পায়ে দাঁড়াবার মতো ক্ষমতা তাঁর তখনও হয়নি। এই বাড়িতে এসে ঢুকবার পরে তাঁরই কাছে শুনেছি যে, ব্যাপারটা নিয়ে কষ্ট যে শুধু দিদির ছিল, তা নয়, কষ্ট ছিল জামাইবাবুরও। কিন্তু বাবার অমতে বউকে নিয়ে আলিপুরদুয়ারে যাবেন, এমন সাহসই তাঁর ছিল না।” 

“সত্যপ্রকাশের বাবা ছেলে-বউকে যেমন তোমাদের বাড়িতে যেতে দেননি, তেমনি তোমাদেরও কখনও বলেননি এখানে এসে কয়েকটা দিন কাটিয়ে যেতে?” 

“কক্ষনো বলেননি। কিন্তু বললেই কি আমরা আসতে পারতুম? বাবা যেভাবে অপমানিত হয়ে ফিরে গিয়েছিলেন এই বাড়ি থেকে, তারপরেও কি আসা সম্ভব?” 

আবার একটুক্ষণ চুপ করে রইল নিরু। তারপর বলল, “আপনি তো জানতে চাইছিলেন, দিদি বেঁচে থাকতে এ-বাড়িতে আমি কখনও আসিনি কেন। এখন আপনিই বলুন, এই অবস্থায় কেউ আসতে পারে? আসতে কি আর ইচ্ছে হত না? ‘হত। কিন্তু সাহস হত না। দিদি তো ভীষণ ভালবাসত আমকে। বাসবে না-ই বা কেন, আমাদের তো আর কোনও ভাইবোন নেই, শুধু দিদি আর আমি। তাই দিদিকে ছেড়ে থাকতে আমারও খুব কষ্ট হত। তখন তো কিছু বুঝতে পারতুম না। রোজই বাবাকে বলতুম,দিদির কাছে নিয়ে চলো। বাবা কিছু বলতেন না, চুপ করে থাকতেন।” 

নিরু উঠে দাঁড়াল। বলল, “আপনারা কি এখুনি আবার বেরোবেন?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “এখুনি নয়। পরে হয়তো একবার রঙ্গিলাদের ওখান থেকে ঘুরে আসব।”

নিরু বলল, “তা হলে একটু বসুন। মা আর পিসিমাকে দেখে আসি একবার। সেইসঙ্গে আপনাদের চা’ও নিয়ে আসছি। এক্ষুনি যেন আবার বেরিয়ে পড়বেন না।” 

২৪

চা আর জলখাবার নিয়ে মিনিট কুড়ি বাদেই নিরু ফিরে এল। ট্রেটা টেবিলের উপরে নামিয়ে রেখে ভাদুড়িমশাইকে বলল, “জামাইবাবু বলছিলেন, আপনার সর্দিজ্বর হয়েছে। চায়ে তাই একটু আদার রস দিয়েছি। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন, জড়িয়ে গেলে বিচ্ছিরি লাগবে।” 

আমি বললুম, “আমার তো আর সর্দি-টর্দি হয়নি, তা হলে আমি কেন আদা-চা খাব?”

নিরু বলল, “খেয়ে নিন, খারাপ লাগবে না।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “জ্বর তো আমারও হয়নি।” 

নিরু বলল, “জানি। 

“কী করে জানলে?” 

“জামাইবাবু বলেছেন।” 

“জ্বর না-হওয়া সত্ত্বেও কেন জ্বরের ভান করছি, তাও বলেছেন নিশ্চয়?” 

নিরু হাসল। বলল, “তাও বলেছেন।” তারপর রঙ্গনাথবাবু যে কৌটোটা দিয়ে গিয়েছিলেন, সেটার উপরে চোখ পড়তে বলল, “ওটা কী?” 

“নারকোলের নাড়ু। রঙ্গনাথবাবু দিয়েছেন।” 

“তা-ই? মজুমদার-মাসিমা চমৎকার নাড়ু করেন। নারকোলের সঙ্গে ক্ষীর বাদামগুঁড়ো এলাচদানা, কর্পূর আরও কী-কী যেন দেন উনি। দারুণ লাগে। নাড়ু তো আমরাও করি, কিন্তু অত ভাল হয় না।….না না, আমি খাব না, আপনারা খান।” 

নাড়ুর কৌটাটা তুলে নিরুর দিকে এগিয়ে দিয়েছিলুম। খাবে না শুনে সেটা আবার টেবিলে রেখে দিয়ে জিজ্ঞেস করলুম, “মা আর পিসিমা এখন কী করছেন?” 

“জপ হয়ে গেছে। এখন পড়ছেন মনসার পাঁচালি।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “রোজই এইসময়ে পাঁচালি পড়েন ওঁরা?” 

“আগে পড়তেন না,” নিরু বলল, “গত বুধবার থেকে রোজ এই সময়ে পড়ছেন। আসলে ব্যাপার কী জানেন, জামাইবাবু তো বলেই দিয়েছেন যে, যতদিন না ওই মূর্তি উদ্ধার হয়, পুজোও ততদিন বন্ধ থাকবে, তাই এখন মন্দিরে আর পূজো হয় না, শুধু পাঁচালি পড়া হয়।” 

“খানিক আগে ওই যে শাঁখের আওয়াজ আর ঘন্টার শব্দ শুনলুম, ও তা হলে ঠাকুরমশাই কার পূজো করছিলেন?” 

“মা-মনসারই।” 

“তার মানে?” 

নিরু হাসল। বলল, “ঠাকুরমশাই ভিতু মানুষ। বলেন, মূর্তি থাক আর না-ই থাক পুজো বন্ধ করাটা উচিত হবে না। বন্ধ করলে অমঙ্গল হবে। নন্দিরে অবশ্য যান না। নিজের ঘরে মা-মনসার একখানা পট রয়েছে, তার সামনে বসে পূজো করেন।”

“সত্যপ্রকাশের নিষেধ সত্ত্বেও করেন?” 

“তা করেন বই কী। তবে জামাইব।বু যখন এখানে থাকেন তখন শাঁখও বাজে না, ঘন্টার শব্দও শোনা যায় না, ঠাকুরমশাই তখন একেবারে নিঃশব্দে তাঁর পুজোটা সেরে নেন। আজ তো দুপুর থেকেই জামাইবাবু নেই, তাই শাঁখ বাজাতে আর ঘন্টা নাড়তে ঠাকুরমশাইয়ের কোনও ভয়ও নেই।” 

“সত্যপ্রকাশের নিষেধ যে উনি মানছেন না, রোজই পুজো হচ্ছে, সেটা তাঁকে কেউ বলেনি?”

“কেন বলবে? বললেই তো জামাইবাবু রেগে যাবেন। তাঁকে রাগিয়ে কার কী লাভ? আর তা ছাড়া, ঠাকুরমশাই তো কারুর কিচ্ছুমাত্র ক্ষতিও করছেন না। পুজোটা যে তিনি বন্ধ করেননি, সে তো এই চৌধুরি-পরিবারের মঙ্গলের কথা ভেবেই।” 

“তা বটে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু নিরু, আমাদের কথাটা ক্রমেই অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। চৌধুরিবাড়ির সঙ্গে তোমাদের সম্পর্কের কথা হচ্ছিল। তোমার জামাইবাবু আর দিদিকে এঁরা বিয়ের পরে আর তোমাদের বাড়িতে পাঠাননি, তোমাদেরও কখনও আসতে বলেননি এখানে, তাই তো?” 

“হ্যাঁ।” 

“অর্থাৎ দুই পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক কি যোগাযোগ বলতে আর কিছু রইল না, কেমন?”

“কী করে আর থাকবে।” 

“দিদি কোনও চিঠিও লিখতেন না তোমাদের?” 

“বিয়ের পরে খান দুয়েক চিঠি লিখেছিল। তার উত্তরও দিয়েছিলুম আমরা। কিন্তু তারপরে আর কোনও চিঠি পাইনি।” 

“ফেন পাওনি কিছু আন্দাজ করতে পারো?” 

“আন্দাজই করতে পারি, কিন্তু সেটা সত্যি না মিথ্যে, তা কী করে বলব? হতে পারে যে, আমরা যে চিঠি লিখেছিলুম, তা দিদির হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়নি। আবার এমনও হতে পারে যে, দিদি যে-চিঠি লিখত, ডাকবাক্সে না ফেলে সেগুলো মাঝপথেই ছিঁড়ে ফেলত এরা। ঠিক করে তো কিছু বুঝবার উপায় নেই।”

“এ-বাড়িতে এসে ঢুকবার পরে জামাইবাবুকে এ নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করোনি?”

“একদিন করেছিলুম। কিন্তু জামাইবাবু তাতে এমনভাবে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে যে, বুঝতে পারলুম, গোটা ব্যাপারটা নিয়ে একটা চাপা কষ্ট রয়েছে ওঁর মনে। সেটা বুঝবার পরে আর আমি কথাটা কখনও তুলিনি। আর তা ছাড়া, কথাটা তুলতে হলে অন্তত খানিকক্ষণের জন্যেও তো ওঁকে একা পাওয়া দরকার। তা আমি পাচ্ছি কোথায়?” 

“ঠিক আছে,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “এবারে বলো তারপরে কী হল?” 

“তারপরে আর কী হবে? তারপরে আমার বাবা মারা গেলেন। এ হল দিদির বিয়ের তিন বছর পরের কথা। আমার বয়েস তখন দশ বছরের বেশি হবে না। বাড়িতে শুধু মা আর আমি। অবস্থাটা বুঝে দেখুন।” 

“তোমার বাবার শ্রাদ্ধেও এঁরা কেউ যাননি?” 

“কেউ না। মেয়েকে তো চতুর্থীর কাজ করতে হয়। দিদি সে-কাজ এই বাড়িতেই করেছিল। তবে হ্যাঁ, রামদাসদার হাত দিয়ে কিছু টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন এঁরা। মা অবশ্য সে টাকা নেয়নি।” 

“আলিপুরদুয়ারে তোমাদের কোনও আত্মীয়স্বজনও নেই?” 

“কেউ না। আসলে আমরা পুব-বাংলার লোক। পার্টিশনের সময়ে মা আর আমাদের দুই বোনকে নিয়ে বাবা এ-দিকে চলে আসেন। এ হল সাতচল্লিশ সালের কথা। দিদির বয়েস তখন চোদ্দ আর আমার চার।” 

“তোমাদের পরিবারের আর-কেউ তখন পুব-বাংলা থেকে চলে আসেননি? মানে তোমার কাকা-জ্যাঠাদের কেউ?”

“তখন আসেননি। বাবার কাছে শুনেছি যে, দু’চার বছর বাদে তাঁরা এসেছিলেন। তাঁরা নাকি কেউ মালদায় আছেন, কেউ বালুরঘাটে। কিন্তু আমাদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই।” 

শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপরে বললেন, “তোমাদের অবস্থা তো যদ্দুর বুঝতে পারছি মোটেই ভাল ছিল না। তা হলে কী করে চলত তোমাদের?” 

“গরিবদের যেভাবে চলে। ইস্কুল থেকে আমাকে ছাড়িয়ে আনা হল। বাড়িতে সেলাইয়ের কল ছিল একটা। পাড়ার লোকেরা ছিট-কাপড় দিয়ে যেত, মা তাই দিয়ে ফ্রক, ব্লাউজ আর সায়া বানিয়ে দিতেন। আমার কাজ ছিল মা’কে সাহায্য করা। তবে মজুরি তো বিশেষ পাওয়া যেত না, বাড়িটা ছাড়া বাবাও বিশেষ-কিছু রেখে যাননি, ‘তাই কষ্টেসৃষ্টে চালিয়ে নিতে হত।” 

“তারপর?” 

“তারপর আমি বড় হতে লাগলুম। কাগজে বিয়ের বিজ্ঞাপন দেখে মা চিঠি লিখতে লাগলেন। তারপর চিঠি লিখতে-লিখতে, আর নিজেদের উপোসি রেখে পাত্রপক্ষের লোকদের রসগোল্লা খাওয়াতে-খাওয়াতে একদিন তিনিও মারা গেলেন।” 

“বাড়িতে তুমি তখন একা?” 

“একেবারে একা।” 

“পাড়া-প্রতিবেশীরাও কেউ আশ্রয় দিলেন না তোমাকে? 

“কেউ না। আর তা দেবেই বা কেন। মা যখন মারা যান, আমার বয়েস তখন ষোলো-সতেরো। ওই বয়সের মেয়েকে কেউ কখনও নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেয়? প্রতিটি বাড়িতেই তো উঠতি-বয়সের ছেলে রয়েছে, আমি তাদের মাথাগুলোকে চিবিয়ে খাব, এই ভয় নেই তাদের?” 

ভাদুড়িমশাই স্থির চোখে তাকিয়ে ছিলেন নিরুর দিকে। বললেন, “তারপর?” 

“তারপর আর কী,” নিরু বলল, “তারপর আমাদের বাড়ির জানলায় রাত-দুপুরে টোকা পড়তে লাগল। দিনের বেলাতেও স্বস্তি ছিল না। রাস্তা দিয়ে যখন হাঁটতুম, তখন বুঝতে পারতুম যে, পিছন থেকে কয়েক জোড়া চোখ আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। যারা তাকিয়ে থাকত, তাদের সবাই যে নেহাত ছেলে-ছোকরা, তাও নয়, তার উপরে আবার বাসদেও এসে জুটে গেল তাদের সঙ্গে।” 

“বাসদেও কে?” 

“ট্রাক-ড্রাইভার। পাড়ায় তখন নতুন-নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে। সেইসব বাড়ির জন্য শিলিগুড়ি থেকে ট্রাকে করে লোহা, সিমেন্ট আর পাথরকুচি নিয়ে আসত বাসদেও। কুলিরা যখন তার ট্রাক থেকে মাল নামাত, তখন সেই যে সে আমাদের বাড়ির বারান্দায় এসে বসত, সহজে আর সেখান থেকে নড়তে চাইত না। অনেক সময় সে আলিপুরদুয়ারেই রাত কাটাত, আমাদের বাড়ির সামনে ট্রাক রেখে তারই মধ্যে শুয়ে থাকত সে। বিচ্ছিরি-বিচ্ছিরি গান গাইত। তাকেই সবচেয়ে বেশি ভয় পেতুম আমি। সন্ধের পর থেকেই ভয়ে একেবারে কাঁটা হয়ে থাকতুম। সাপের ভয়…ভূতের ভয়…রাত বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে ভয়ও যেন বেড়ে যেত…সারা রাত আমি দু’চোখের পাতা এক করতে পারতুম না। উঃ, 

সে যে কী ভয়, তা আমি আপনাদের কী করে বোঝাব! মনে হতে, যে-দিকে দু’চোখ যায়, পালিয়ে যাই!” আবার খানিকক্ষণ চুপ করে রইল নিরু। কী যেন ভাবল। তারপর বলল, “এ-সব কথা শুনতে নিশ্চয় খুব খারাপ লাগছে আপনাদের?” 

আমার খুব খারাপ লাগছিল। কিন্তু ভাদুড়িমশাই দেখলুম নির্বিকার। বললেন, “কেমন লাগছে, সেটা কোনও ব্যাপার নয়। তোমার যদি মনে হয় যে, আমার শোনা দরকার, তা হলে বলো। যা তোমার বলবার আছে, সবই আমি শুনব।” 

নিরু বলল, “হ্যাঁ, আপনার শোনা দরকার। না-শুনলে আমাকে আপনি ভুল বুঝবেন, জামাইবাবুকেও ভুল বুঝবেন।” 

“বেশ তো, তা হলে বলো।” 

“হ্যাঁ, আমি বলব, সবটাই বলব।… কোন্ পর্যন্ত বলেছি যেন?” 

“যে-দিকে দু’চোখ যায়, পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করত তোমার।” 

“হ্যাঁ, ইচ্ছে করত। যত রাজ্যের ভয় তো আমাকে পাগল করে তুলেছিল, তা একদিন রাতদুপুরে সেই ভয়ের হাত ধরেই আমি পালিয়ে গেলুম। পালিয়ে যে কোথায় যাচ্ছি, কোন্ ঘাটে, না কোন্ আঘাটায়, তাও তখনও জানি না। এখানে-ওখানে ঠেক খেতে-খেতে শেষ পর্যন্ত কোথায় এসে উঠলুম জানেন? শিলিগুড়ির এক বস্তিতে। একটা বাচ্চা হয়েছিল। বাঁচেনি। বাচ্চাটার বাপ মরল তার বছর খানেক বাদে। হঠাৎ একদিন জ্বর নিয়ে বাড়ি ফিরল, সেই জ্বর আর সারেনি।…কী জানেন, বাসদেও লোকটা যে খুব খারাপ ছিল, তা নয়। ওই মানে বস্তির আর-পাঁচটা মাতাল যতটা খারাপ হয় আর কি, তার চেয়ে বেশি কিছু খারাপ ছিল না। একটু বোকা, একটু গোঁয়ার, একটু রাগী, একটু সন্দেহবাতিগ্রস্ত, ..আর হ্যাঁ, আকন্ঠ মদ গিলে যে-দিন বাড়ি ফিরত, সে-দিন তো আর কান্ডজ্ঞানের বালাই থাকত না, তখন তাই বউকে ধরে খুব ঠ্যাঙাত। তা সে তো মারা গেল। তখন উড়ে এসে জুড়ে বসল তার এক ভাই। কোত্থেকে উড়ে এল, ভগবান জানেন…বাসদেও যখন বেঁচে ছিল, তখন তো তাকে একদিনও এসে তার দাদার খোঁজখবর করতে দেখিনি। তা বস্তির লোকেরা বলল, হ্যাঁ, বাসদেওয়েরই ভাই বটে। তখন আর কী করি। সাক্ষাৎ দেওর যখন, তখন তো আর থাকতে না-দিয়ে উপায় নেই। কিন্তু বিপদ কী হল জানেন, থাকতে পেলেই লোকে শুতে চায় তো, তা এই দেওরটির দেখলুম একা শুতে খুব আপত্তি।” 

টিপাইয়ের উপরে জলের জাগ ছিল। কাচের গেলাসও ছিল একটা। জাগ থেকে গেলাসে জল ঢালল নিরু। তারপর গেলাসটা উঁচু করে ঢকঢক করে জলটা খেয়ে নিয়ে গেলাসটা নামিয়ে রেখে আঁচলে মুখ মুছে বলল, “আরও শুনবেন?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “সত্যপ্রকাশ এ-সব কথা কিছুই জানতেন না?” 

“মা যে মারা গেছেন, এই খবর শুনে আলিপুরদুয়ারে এসেছিলেন। নিজের চোখেই দেখে গিয়েছিলেন যে, আমি একেবারে একা হয়ে গেলুম। দিদি তাঁর সঙ্গে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিল যে, আমি যেন মুকুন্দপুরে চলে আসি। যেমন করেই হোক, মুকুন্দপুরে আমাকে যাতে থাকতে দেওয়া হয়, তার জন্যে সে তার শ্বশুরকে যে রাজি করাবে, তাও জানিয়েছিল। কিন্তু আমি রাজি হইনি।” 

“রাজি হওনি কেন?” 

সাপের গায়ে খোঁচা লাগলে যেমন হয়, একেবারে সেইভাবেই যেন হঠাৎ ফুঁসে উঠল নিরু। বলল, “তাও আমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে? তা হলে জেনে রাখুন যে, গরিবদেরও মান-অপমান বোধ থাকে, রাগ-অভিমান থাকে। কে জানে, হয়তো বড়লোকদের চেয়ে একটু বেশিই থাকে। সব কথা আপনি শোনেননি ভাদুড়িমশাই। ধুলো-পা’র ব্যাপারটা জানেন তো, বিয়ের দিন কয়েক বাদে মেয়ে-জামাইকে একবার নিয়ে আসতে হয়। বাবা যে তারই জন্যে মুকুন্দপুরে গিয়েছিলেন, সে-কথা বলেছি। জামাইবাবুর বাবা তখন তাঁকে কী বলেছিলেন জানেন?” 

“বলেছিলেন যে, চৌধুরি পরিবারে এ-সব নিয়ম নেই। তাই না?”

“শুধু তা-ই নয়, বলেছিলেন যে, আলিপুরদুয়ারে গেলে তাঁর ছেলে আর ছেলের বউয়ের থাকা-খাওয়ার বড় কষ্ট হবে। বলেছিলেন, “বিশ্বাসমশাই, এখানে ওরা যে-ভাবে রয়েছে, সে-ভাবে তো আপনি ওদের রাখতে পারবেন না, তা হলে কেন নিতে এসেছেন?’ বলুন ভাদুড়িমশাই, এর পরেও এখানে আসা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল?” 

“সত্যপ্রকাশের বাবা যে ও-কথা বলেছিলেন, তা তুমি জানলে কী করে?” 

“বাবাই একদিন দুঃখ করে মা’কে সব বলেছিলেন, আমি আড়াল থেকে শুনেছি।” 

“মায়ের মৃত্যুর পরেও তাই সত্যপ্রকাশের সঙ্গে তুমি এখানে চলে আসতে রাজি হওনি, কেমন? “

“হ্যাঁ।” নিরু বলল, “ওইভাবে অপমানিত হয়ে আমার বাবা একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন। তা নইলে যে আরও কয়েকটা বছর হয়তো বাঁচতেন তিনি, আমার মায়ের জীবনটাও আর-একটু স্বস্তিতে কাটতে পারত, এই কথাটা যেন কিছুতেই আমি ভুলতে পারছিলুম না। জামাইবাবুকে আমি সেদিন বসতে পর্যন্ত বলিনি। বলেছিলুম, আপনি ফিরে যান, না-খেয়ে মরতে হয় তো তাতেও আমি রাজি, তবু আমি মুকুন্দপুরে যাব না।” 

“তারপর?” 

“তার কিছুদিন পরেই দিদির শ্বশুর মারা যায়। শুনেছি, দিদি নিজেই সেদিন আলিপুরদুয়ারে ছুটে গিয়েছিল। কিন্তু সেখানে আর আমার খোঁজ পায়নি। কী করে পাবে, তার আগেই তো আমি বাসদেওয়ের সঙ্গে ঘর ছেড়েছি।…দিদি নাকি ভীষণ কেঁদেছিল সব শুনে। জামাইবাবুকে খুব গালমন্দও করেছিল। বলেছিল, “তোমরা বড়লোক হতে পারো, কিন্তু মানুষ নও। তোমাদেরই জন্যে আমার বাবা মরেছেন, মা মরেছেন, এবারে হাসিটাও হারিয়ে গেল।’ কয়েকটা দিন দিদি নাকি তখন মুখেও কিছু তোলেনি। শুধু হাপুস নয়নে কাঁদত।” 

“এ-সব কথা কার কাছে শুনলে?” 

“জামাইবাবুর কাছে। জামাইবাবু নাকি কাগজে কাগজে নিরুদ্দেশের বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। কিন্তু বস্তিতে তো আর কাগজ যায় না, তাই আমার চোখে পড়েনি। আর চোখে পড়লেই যে তক্ষুনি আমি মুকুন্দপুরে চলে আসতে পারতুম, তাও তো নয়।” 

এতক্ষণে কথা ফুটল আমার মুখে। বললুম, “তোমার ডাক-নাম বুঝি হাসি?” 

“হ্যাঁ। সুহাসিনী থেকে হাসি। দিদির ভাল নাম সুভাষিণী। ডাক-নাম সুভা। দিদি কিছু ভুল বলেনি। ওদের জীবন থেকে সত্যিই তো আমি হারিয়ে গিয়েছিলুম। শেষ পর্যন্ত সেই হারানো মেয়েটার খোঁজ অবশ্য পাওয়া গেল।” 

বললুম, “কবে?” 

“আজ থেকে পাঁচ পছর আগে। দিদি আব তখন বেঁচে নেই। সুজাতার তখনও বিয়ে হয়নি, আর-দুটো ছেলেমেয়ে তো অনেক ছোট। শুনেছি মরবার আগে দিদি নাকি জামাইবাবুকে মাথার দিব্যি দিয়ে বলেছিল, ‘আমার বাপের বাড়ির জন্যে তা তোমরা কিছু করলে না, অন্তত নিজের ছেলেমেয়ে তিনটের কথা ভেবে হাসিকে তুমি খুঁজে বার করো, নইলে এদের কে দেখবে?’ তা জামাইবাবুও আমার খোঁজ কিছুতেই পেতেন না, যদি না আমি নিজের থেকেই তাঁকে একদিন খবর পাঠাতুম।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কোথায় খবর গাঠালে?” 

“কেন, শিলিগুড়ির হোটেল ফ্লোরায়। হোটেলটা তো আপনারা দেখেছেন। শুনেছি কলকাতা থেকে শিলিগুড়িতে পৌঁছবার পরে সেইখানেই কাল আপনাদের তোলা হয়েছিল। আমি অবশ্য হোটেলের কথা জানতুম না। বাসদেও কন্তু সমস্ত খবর রাখত। মাতাল অবস্থায় সে-ই একদিন আমাকে বলেছিল যে, শিলিগুড়ির হংকং বাজারের কাছে জামাইবাবু একটা মস্ত হোটেল খুলেছেন। তা সে মারা যাবার দিন কয়েক বাদেই আমি বস্তির একটা ছেলেকে দিয়ে জামাইবাবুর কাছে আমার খবর পাঠাই। না পাঠিয়ে তখন আর আমার উপায় ছিল না।” 

“কেন?” 

“তা তো একটু আগেই বলেছি।” মুখ নিচু করে নিরু বলল, “বাসদেওয়ের ভাইটা বড় উৎপাত করছিল। তা চিঠি পেয়েই জামাইবাবু ‘মামাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাবার জন্যে তাঁর একজন কর্মচারীকে পাঠিয়ে দেন। সেদিন অবশ্য আমি আসতে পারিনি। ঠিক সেই সময়ে আমি ঘরে ছিলুম না, টিউবওয়েল থেকে জল ধরতে একটু দূরে যেতে হয়েছিল। ফিরে এসে শুনি, কে একজন নাকি আমার খোঁজ করতে এসেছিল, তা বাসদে “য়ের ভাই তাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তারপর?” 

নিরু বলল, “কথাটা শুনে আহার মনে হয়েছিল যে, ওই নরক থেকে আর কোনও দিনই আমি বেরিয়ে আসতে পারব না। কিন্তু সেই রাত্তিরেই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। বাসদেওয়ের ভাই তখনও বাড়ি ফেরেনি, হঠাৎ একটা চিত্রার-চেঁচামেচি কানে যেতে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে শুনতে পেলুম যে, ‘কে একটা লোক নাকি আমারে বস্তির সামনের রাস্তার উপরে খুন হয়ে পড়ে আছে। লোকটা যে কে, খানিক বাদে তা-ও জানা গেল। বাসদেওয়ের ভাই। পরদিন সকালেই জামাইবাবু আবার লোক পাঠিয়ে আমাকে তাঁর হোটেল নিয়ে যান। তারপর সেইদিনই সেখান থেকে নিয়ে আসেন মুকুন্দপুরে।” 

ঘর একবারে নিঃশব্দ। আমি কোনও কথা বলতে পারছিলুম না। ভাদুড়িমশাইও চুপ করে বসে আছেন। কপালে ভাঁজ পড়েছে কয়েকটা। মনে হল, তিনি কিছু ভাবছেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তিনিই প্রথম মুখ খুললেন। বললেন “সুহাসিনী, তোমার আর কিছু বলার নেই?” 

“না।” নিরু বলল, “আনার যা বলবার ছিল, সব বলেছি, কিন্তু দোহাই আপনাদের, জামাইবাবু যেন কিছুতেই এ-কথা জানতে না পারেন।” 

এতক্ষণে হাসি ফুটল ভাদুড়িমশাইয়ের মুখে। বললেন, “সত্যপ্রকাশকে কতটা কী বলব না বলব, সেটা তুমি আমার উপরে ছেড়ে দাও। তবে তোমাকে বলি, সব কথা আমাদের জানিয়ে তুমি খুব বুদ্ধির কাজ করেছ, না-জানালেই ভূল করতে। এখন যাও, মা আর পিসিমা হয়তো তোমার খোঁজ করতে পারেন।” 

ট্রে-র উপরে কাপ-ডিশ গুছিয়ে নিয়ে নিরু বেরিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ কী ভেবে ভাদুড়িমশাই বললেন, “একটু দাঁড়াও।” 

দরজা থেকে আবার ফিরে এল নিরু। দেখলুম, তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। স্খলিত গলায় বলল, “কিছু বলবেন আমাকে?” 

স্থির চোখে নিরুর দিকে তাকিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “তুমি তো আমাদের অনেক কথাই বললে। এবারে বরং আমি তোমাকে একটা কথা বলি। বাসদেওয়ের যে ভাইটা আজ থেকে পাঁচ বছর আগে শিলিগুড়ির একটা অন্ধকার রাস্তায় খুন হয়েছিল, তার নাম নিশ্চয় রাজদেও কুমি। তাই না?” 

চারুর চোখে যেন আতঙ্ক ফুটে উঠল হঠাৎ। চাপা গলায় সে বলল, “আপনি কী করে জানলেন?”

“বা রে, আমি জানব না কেন,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “সব কিছু জানাই তো আমার কাজ।”