মুকুন্দপুরের মনসা – ১৫

১৫ 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “কী বুঝেছেন?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বলছি। কিন্তু তার আগে একবার রামদাসকে ডাকুন।”

একটা প্লেটে সুপুরি, লবঙ্গ আর এলাচদানা নিয়ে নিরু এসে বসবার ঘরে ঢুকেছিল। প্লেটটাকে সেন্টার টেবিলে নামিয়ে রেখে সে-ই গিয়ে ডেকে আনল রামদাসকে। 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “রামদাস, এই চাবিটা তুমি চেনো?” 

পেতলের চাবিটা হাতে নিয়ে রামদাস বলল, “এটা তো সেই তালার চাবি, যা ভেঙে চোর সেদিন ঠাকুরঘরে ঢুকেছিল।” 

“এ-চাবি কার কাছে থাকত?” 

“রঙ্গিলার কাছে।” 

“সব সময়ে তারই কাছে থাকত? ভাল করে ভেবে দ্যাখো।” 

“ভাববার কিছু নেই বাবু,” রামদাস বলল, “সব সময়ে তারই কাছে থাকত।” 

“আর কেউ এই চানি দিয়ে ঠাকুরঘরের দরজা কখনও খোলেনি কিংবা বন্ধ করেনি?” 

“রঙ্গিলা তা আর-কাউকে করতে দিলে তো করবে। না বাবু, এ-চাবি সে কক্ষনো কাউকে দিত না। আমাকেও না। শেষ-রাত্তিরে নিজে গিয়ে ঠাকুরঘরের দরজা খুলত, তারপর সন্ধের পরে নিজেই আবার দরজায় তালাচাবি লাগাত।” 

“এ-কাজ ও কতদিন থেকে করছে?” 

“তা বছর সাতেক হল।” 

“রঙ্গিলার বয়েস এখন কত?” 

একটু ভেবে নিয়ে রামদাস বলল, “গত আষাঢ় মাসে ও সতেরো পেরিয়ে আঠারোর পড়েছে।”

“তার মানে ওর বয়েস যখন বছর-দশেক, তখন থেকেই রঙ্গিলা এ-কাজ করছে, কেমন?”

“হ্যাঁ বাবু,” রামদাস বলল, “ঠাকুরঘরের কাজ তার আগে কর্তা-মা আর পিসিমাই করতেন। তাঁরাই ভোর-রাতে দরজা খুলতেন, তারপর সন্ধের আরতি হয়ে গেলে দরজায় তালা-চাবি লাগিয়ে দিতেন। তা বয়েস হয়েছে তো, সেইজন্যে আর এত সব ঝক্কি ওঁরা সামলাতে পারছিলেন না। বছর সাতেক আগে একদিন রঙ্গিলার হাতে ঠাকুরঘরের চাবি তুলে দিয়ে ওঁরা বললেন, ‘নাগ- পঞ্চমীর রাত্তিরে তোর জন্ম, মা-মনসার কাজকর্ম এবারে তুই-ই বুঝে নে। ঠাকুরঘরের দরজা খোলা, দরজা বন্ধ করা, পুজো-আচ্চার জোগাড়যন্তর করা, সবকিছুর ভার এখন থেকে তোর উপরেই রইল।’ তা সেই চাবি ও-মেয়ে একদিনের তরেও হাতছাড়া করেনি।” 

“নাগ-পঞ্চমীর রাত্তিরে ওর জন্ম বুঝি?” 

উত্তরটা সত্যপ্রকাশ দিলেন। বললেন, “হ্যাঁ, আষাঢ় মাসের কৃষ্ণপক্ষের পঞ্চমীতে এখানে মস্ত মেলা হয়, সেই মেলার রাত্তিরেই ও জন্মেছিল।” 

ভাদুড়িমশাই কী যেন ভাবলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, “মন্দিরের কাজ তো নেহাত কম নয়। দশ বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে এত সব কাজ একাই করত?” 

রামদাস বলল, “একা করত না, বাবু, ওকে সাহায্য করবার জন্যে খোকাবাবু দু’দুজন লোক দিয়েছিলেন। এই গাঁয়েরই লোক। তা বছর দুয়েক আগে রঙ্গিলা গিয়ে কর্তা-মা’কে বলল, ‘ওদের তুমি অন্য কাজে লাগাও ঠাকুমা, ওদের কাজকর্ম আমার পছন্দ হয় না, যা পারি আমি একাই করব।’ তা সেই থেকে ও একাই সবকিছু সামলাচ্ছে।” 

“কিন্তু ছোটখাটো জ্বরজারিও তো লোকের হয়। তাও কি গত দু’বছরে ওর হয়নি।” 

“তা কেন হবে না,” রামদাস বলল, “ওরও হয়েছে। কিন্তু সে-সব যেন ও গেরাহ্যিই করত না। তারই মধ্যে শেষ-রাত্তিরে উঠে ও ঠাকুরঘরের দরজা খুলেছে, বাসনপত্র মেজেছে, ঘর-বারান্দা ধুয়ে-মুছে সাফ রেখেছে, পুজোর জোগাড়যন্তর করেছে, তারপর আরতি হয়ে গেলে সন্ধের পরে আবার চাবিও লাগিয়েছে নিজের হাতে।” 

“অর্থাৎ চাবিটা ও কক্ষনো কাউকে দিত না, কেমন?” 

“কক্ষনো দিত না।”

“কিন্তু আমরা যখন তালা কিনি, প্রত্যেকটা তালার সঙ্গেই তখন দু-দুটো চাবি পাওয়া যায়। সত্যবাবু, আপনাদের এই তালারও নিশ্চয় দু-দুটো চাবি ছিল। অন্য চাবিটা কোথায়? সেটা বেহাত হয়নি তো?” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “না, বেহাত হয়নি। যে-সব দলিলপত্র কি চাবি আমার রোজ-রোজ দরকার হয় না, গয়নাগাঁটির সঙ্গে সেগুলোও আমি লকারে রাখি। এইরকম আরও কয়েকটা চাবির সঙ্গে সেটাও শিলিগুড়িতে আমার ব্যাঙ্কের লকারে রয়েছে। না না, সেটা বেহাত হয়নি, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।” 

“চোর তা হলে তালা ভেঙেই ঢুকেছিল, কেমন?” ভাদুড়িমশাই জিজ্ঞাসা করলেন। 

“তা ছাড়া আর কীভাবে ঢুকবে?” 

“চাবি দেখে বুঝতে পারছি, তালাটা ছোট নয়, বেশ বড় মাপের। তার উপরে আবার নামী কোম্পানির তালা। ভাঙতে গেলে একটা শব্দ তো হবে।” 

“সেইটেই তো আশ্চর্য ব্যাপার বাবু,” রামদাস বলল, “কোনও শব্দই আমরা শুনিনি। ঠাকুরমশাই বলছেন, তিনি লোকজন ছুটে পালাবার শব্দ শুনেছেন, একটা গাড়ির শব্দও পেয়েছিলেন। কিন্তু তেমন-কোনও শব্দ না শুনেছেন পিসিমা, না শুনেছেন কর্তা-মা, না শুনেছে নিরুদিদি। আর আমি যে শুনিনি, সে তো বললুমই।” 

“ঠাকুরমশাই কে?” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “আমাদের মন্দিরের পুরুতঠাকুর। গোবিন্দ ভট্‌চাজ।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ভদ্রলোককে এখনও দেখিনি। দেখা হবে নিশ্চয়। তখন জিজ্ঞেস করা যাবে। এখন যা বলছি, একটু ভেবে দেখুন, মিঃ চৌধুরি। এমন হওয়া কি একেবারেই অসম্ভব যে, তালা ভাঙবার কোনও দরকারই চোরের হয়নি?” 

অবাক হয়ে সত্যপ্রকাশ বললেন, “তার মানে? যে-চাবি রঙ্গিলার কাছে থাকে, সেটা সে হাতছাড়া করেনি, আর তার ডুপ্লিকেটটা রয়েছে আমার ব্যাঙ্কের লকারে, অথচ চোরেরও দরকার হল না তালা ভাঙবার। তা কী করে হয়? এ কি পি.সি. সরকারের ম্যাজিক?”

ভাদুড়িমশাই মৃদু হেসে বললেন, “ম্যাজিক কেন হবে? খুবই সহজ ব্যাপার। ধরুন, মঙ্গলবার সন্ধের সময় রঙ্গিলা যখন ঠাকুরঘরের দরজায় তালাচাবি দেয়, তার আগে থাকতেই চোর হয়তো সেখানে লুকিয়ে ছিল। তারপর বুধবার ভোর হবার আগে রঙ্গিলা যখন ঠাকুরঘরের দরজা খুলে ভিতরে ঢোকে, চোর তখন তার মাথা ফাটিয়ে দিয়ে খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়। কী, এমনটা কি হতেই পারে না?” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “না, তা পারে না। তার কারণ, ঠাকুরঘরের মধ্যে শুধু ওই মূর্তি আর কিছু বাসনপত্র ছাড়া কিছুই থাকে না। মূর্তিটিও তো বড় নয়, নেহাতই ছোট। হাইট মেরেকেটে ফুট খানেক। এক-আধ ইঞ্চি কমও হতে পারে। তার পিছনে লুকোনো যায় না। চোর তা হলে কোণায় লুকিয়ে বসে থাকবে? না না, সেটা সম্ভব নয়।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “দরজার পাল্লার পিছনেও কি লুকিয়ে থাকা সম্ভব নয়?” 

রামদাস বলল, “তাও সম্ভব নয়, বাবু।” 

“কেন?” 

উত্তরটা সত্যপ্রকাশ দিলেন। বললেন, “ঠাকুরঘরটা খুব ছোট তো, এমনিতেই চলাফেরার জায়গা বড় কম, তার উপরে আবার দরজার পাল্লা খোলে ভিতরের দিকে, তা সেই পাল্লা দুটো যদি ঘরের মধ্যে বেরিয়ে থাকে তো জায়গা আরও কমে যাচ্ছে। সেইটে যাতে না হয়, তার জন্যে দরজার পাল্লায় এমনভাবে ফোল্ডিং কব্জা লাগানো হয়েছে, যাতে পাল্লা দুটো ভিতরের দিকে পুরোপুরি ঘুরে গিয়ে একেবারে দেওয়ালের সঙ্গে সেঁটে যায়। দরজার পাল্লার পিছনে কারও লুকিয়ে থাকার কোনও প্রশ্নই তাই উঠছে না।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “যাক্, মঙ্গলবার সন্ধেয় ঠাকুরঘরের দরজা বন্ধ হবার আগেই যে চোর সেখানে ঢুকে পড়েনি, অন্তত এই একটা ব্যাপারে তা হলে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। তাতেও অবশ্য প্রমাণ হচ্ছে না যে, ঠাকুরঘরে ঢুকবার জন্যে চোরকে তালা ভাঙতেই হয়েছিল।” 

আমি চুপ করে রইলুম। 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “আপনার কথাটা ঠিক বুঝতে পারছি না, মিঃ ভাদুড়ি। আগে থাকতেও ঢোকেনি, আবার তালাও ভাঙেনি, চোর তা হলে ঢুকল কী করে?”

ভাদুড়িমশাই এ-কথার সরাসরি কোনও উত্তর না দিয়ে বললেন, “চোর যদি তালা ভেঙেহ ঢুকে থাকে, তো সেই ভাঙা তালাটা কোথায়? ভাঙা তালাটা তো আর এমন-কিছু মূল্যবান জিন্সি নয় যে, মূর্তির সঙ্গে সেটাকেও সে নিয়ে যাবে। তালাটা ওখানে পড়ে থাকবার কথা। তাই না?” 

মাথা চুলকে সত্যপ্রকাশ বললেন, “তা বটে।”

 ভাদুড়িমশাই বললেন, “এক হতে পারে যে, তাঙা-তালায় পাছে তার আঙুলের ছাপ থেকে যায়, তাই তালাটাও সে সরিয়েছে। সে-ক্ষেত্রে আমাকে ধরে নিতে হয় যে, চোর শুধুই লোভী নয, খুব চালাকও বটে। কিন্তু অত চালাকই যদি হবে, তো খালি হাতে সে তালা ভাঙবে না, হাতে এটা দস্তানা পরে নেবে, কি অন্তত একটা কাপড় জড়িয়ে নেবে, যাতে তালায় কিছুতেই তার আঙুলের ছাপ থেকে না যায়।” 

সত্যপ্রকাশের মুখ দেখে মনে হচ্চিল, তিনি বিভ্রান্ত বোধ করছেন। চোর কীভাবে ঠাকুরঘরে ঢুকেছে, তা নিয়ে যেমন রামদাসের, তেমনি তাঁরও ছিল অতি সহজ সিদ্ধান্ত। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন যে, এটা স্রেফ তালা ভেঙে ঘরে ঢোকার ব্যাপার। ব্যাপারটাকে যে আরও হরেক দিক থেকে দেখা যেতে পারে, তা তাঁর ধারণাতেই ছিল না। সত্যি বলতে কী, ধারণায় ছিল না আমারও। ব্যাণ্ডারটা যেন ক্রমেই আরও তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। 

বললুম, “আপনার কী মনে হয় বলুন দেখি। চোর কি সত্যিই খুব চালাক?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “চালাক তো হতেই পারে, আবার না-ও পারে। কিন্তু আপাতত তা নিয়ে গবেষণা করে লাভ নেই। আপাতত যা বুঝতে পারছি, সেটা এই যে, ভাঙা-তালাটা পাওয়া যায়নি। তাই না মিঃ চৌধুরি?” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “এটা আপনি ঠিকই বলেছেন। সত্যিই সেটা পাওয়া যায়নি। তবে খোঁজাখুঁজি করবার ব্যাপারে কোনও গাফিলতি ছিল না। আমরা তো খুঁজেছিই, পুলিশও নেহাত কম খোঁজেনি। কিন্তু না, কোথাও সেটা পাওয়া গেল না।”

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “না-পাওয়াই স্বাভাবিক। তালাটা আসলে ভাঙা হয়নি, খোলা হয়েছিল।” 

সত্যপ্রকাশ অবাক হয়ে বললেন, “খোলা হয়েছিল? এ তো বড় আশ্চর্য কথা বলছেন আপনি! কী দিয়ে খুলবে?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কেন, যা দিয়ে সবাই তালা খোলে। চাবি দিয়ে।”

“চাবি সে পাবে কোথায়?” 

ভাদুড়ি শাইয়ের উত্তরটা আর শোনা হল না। নিরু এসে ঘরে ঢুকল। সত্যপ্রকাশকে বলল, “দাদাবাবু, গোপালের মা এসে বলল, থানা থেকে লোক এসেছে। এখানে পাঠিয়ে দিতে বলব?” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “আরে না না, ভিতর-বাড়িতে আর পুলিশ ঢোকাবার দরকার নেই। কাচারি ঘরে বসাতে বলে দাও। আমি আসছি।” 

তারপর সোফা ছেড়ে উঠতে-উঠতে বললেন, “আপনারাও চলুন না। পুলিশের লোক কদ্দুর কী হদিস করল, শুনবেন।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমি প্রাইভেট ডিটেকটিভ, পুলিশের লোকেরা আমাদের বিশেষ ছিন্দ করে না। কী জানি কেন, আমাদের সম্পর্কে ওদের একটু অ্যালার্জি আছে। না মশাই, আমার আর গিয়ে কাজ নেই। এমন কী, চুরির কিনারা করতে যে আমাদের এখানে ডাকা হয়েছে, তাও বোধহয় ওদের এখন না জানালেই ভাল। আপনারা যান, আমি বরং এই ভদ্রমহিলার সঙ্গে ততক্ষণ একটু কথা বলি।” 

রামদাসকে নিয়ে সত্যপ্রকাশ বেরিয়ে গেলেন। 

ভাদুড়িমশাই নিরুকে বললেন, “দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, বসুন।” 

মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল নিরু। বসল না। বলল, “আমি এ-বাড়িতে কাজ করি, আমাকে ‘আপনি’ বলবেন না।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ঠিক আছে, তুমিই বলব। তবে তুমি এ-বাড়ির কাজ করো বলে নয়, বয়সেও তুমি আমার চেয়ে অনেক ছোট, তাই বলব। তা নিরু, তোমাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করবার ছিল যে।” 

নিরু বলল, “পরে করলে হয় না? আমাকে এখুনি আবার রান্নাঘরে ফিরতে হবে।” 

“কেন, রান্নার লোক আজ আসেনি?” 

‘এসেছে, কিন্তু তাকে সব দেখিয়ে দিতে হয়। নইলে সে যা রান্না করবে, আপনারা তা মুখে তুলতে পারবেন না।” 

ঘরের দেওয়ালে এক সধবা ভদ্রমহিলার একটি রঙিন ফোটোগ্রাফ ঝুলছে। ছবির ফ্রেম ঘিরে ঝুলছে ফুলের মালা। কার ছবি, জানি না। তবে মালা দেখে মনে হয়, ভদ্রমহিলা বেঁচে নেই। কাল রাত্তিরে ছবিটা আমার চোখে পড়েনি। সম্ভবত ভাদুড়িমশাইয়েরও পড়েনি। আজ কিন্তু তিনি কথা বলতে-বলতেই ছবিটা বারবার দেখছিলেন। 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ঠিক আছে, কয়েকটা কথা জানবার ছিল, তবে পরে জানলেও ক্ষতি নেই। আপাতত শুধু দুটো প্রশ্নের জবাব দাও। বেশিক্ষণ তোমাকে আটকে রাখব না। কী, তাতে আপত্তি আছে?” 

“না না, আপত্তি থাকবে কেন, কী বলবেন বলুন?” 

“এ-বাড়িতে তুমি কত দিন হল কাজে ঢুকেছ?” 

“তা বছর পাঁচেক হল।” 

“বাঃ,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আর মাত্র একটা প্রশ্ন করব। বাস্, তারপরেই তোমার ছুটি। দেওয়ালে টাঙানো ওই ছবিটা কার?” 

মুখ না তুলেই নিরু বলল, “দাদাবাবুর স্ত্রীর।” 

“তোমার দিদির নয়?” 

এতক্ষণে মুখ তুলল নিরু। স্থির, বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে। তারপর আবার মুখ নিচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। 

১৬

ঘরে এখন আর কেউ নেই। চুপচাপ আমরা বসে আছি। মুখ ফুটে একবার জিজ্ঞেস করেছিলুম, “কী ব্যাপার বলুন তো,” কিন্তু ভাদুড়িমশাই আমার কথার কোনও জবাব দেননি। গম্ভীর থমথমে মুখ। বুঝতে পারছিলুম, কিছু একটা বিষয়ে তিনি চিন্তা করছেন। আমার প্রশ্নটা যে তিনি শুনতে পেরেছেন এমনও মনে হল না। 

মিনিট পাঁচ-দশ পরে তিনি আমার দিকে তাকালেন। দেখলুম, অদ্ভুত একটা হাসি ছড়িয়ে গিয়েছে তাঁর মুখে। চোখে ঝিলিক দিচ্ছে কৌতুকের আলো। বললেন, “কিরণবাবু, আমার অবস্থা এতক্ষণ ছিল দৃষ্টিহীন সেই মানুষটির মতো, অমাবস্যার রাত্তিরে জানালা-দরজা-বন্ধ একটা অন্ধকার ঘরের মধ্যে যে কিনা একটা কালো বেড়ালকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল।” 

বললুম, “তার মানে?” 

“তার মানে একদিকে মূর্তি উধাও, অন্য দিকে চাঁদসদাগর দি গ্রেট। আবার তারই মাঝখানে এই ব্যাপার! না মশাই, আমি আর এখন অন্ধ নই, চোখ ফুটেছে, অমাবস্যার রাত পুইয়েছে, ঘরের মধ্যে একটু-একটু আলোও ঢুকছে; তা এই রকম যদি চলতে থাকে তো বেড়ালটাকে নিশ্চয় ধরে ফেলতে পারব।” 

কিছুই বুঝতে পারলুম না। তবে এইটুকু বুঝলুম যে, কিছুক্ষণ এখন চুপ করে থাকাই ভাল। 

সত্যপ্রকাশ ফিরলেন প্রায় আধ ঘন্টা বাদে। ফিরেই ধপাস করে সোফায় বসে পড়ে বললেন, “দূর দূর, যত সব অপদার্থ! কাজের কাজ কিছু করতে পারেনি, নাহক শুধু বকর-বকর করে আমার সময় নষ্ট করা! …আর এক প্রস্ত চা হয়ে যাক্, কেমন?” 

“হোক।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু পুলিশ একটা-কিছু আন্দাজ করে তো এগোচ্ছে। সেটা কী?”

সত্যপ্রকাশ দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে চেঁচিয়ে বললেন, “আর-এক পট চা দিয়ে যাও।” তারপর ফিরে এসে ফের সোফায় বসে হাত উলটে বললেন, “কি আন্দাজ করতে পারেনি। সাধে কি আর অপদার্থ বলছি! এদিনে আবার বায়নার অন্ত নেই! কেন এসেছিল জানেন?” 

“কেন? কিছু-একটা সুবিধে আদায় করতে?” 

“ঠিক ধরেছেন! ঠিক ধরেছেন! এ্যাবসলিউটলি রাইট! কী করে বুঝলেন মশাই?”

“এর আর বোঝাবুঝির কী আছে?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা বায়নাটা কী?”

“আর বলেন কেন, দারোগাবাবুর মেজো শালা আলিপুরদুয়ারে চাকরি করে, সেখান থেকে তাকে শিলিগুড়িতে ট্রান্সফার করা হয়েছে। তা আলিপুরদুয়ারের পাট তুলে সংসারের যাবতীয় লটবহর নিয়ে তাকে এখন শিলিগুড়িতে যেতে হবে তো, তাই বলছিল যে, একটা দিনের জন্যে আমার একটা ট্রাক যদি তাকে দিই তো বেচারার বড্ড উপকার হয়।” 

“বেচারাই বটে!” 

“শুধু কি তা-ই,” তেতো গলায় সত্যপ্রকাশ বললেন, “শিলিগুড়িতে পৌঁছেই তো আর সব গুছিয়ে উঠতে পারবে না, মেজো শালাবাবুটিব হোল্ ফ্যামিলিকে তাই অন্তত দুটো দিনের জন্যে আমার হোটেলে নাকি থাকতে দিতে হবে। দু’দুটো বর চাই। বুঝুন বা পার।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ট্রাকের ভাড়া আর হোটেল চার্সে দেবে তো?” 

“তা হলে আর বলছি কী। কিস্তু দেবে না মশাই, কিসু দেবে না।” 

“যাচ্চলে! তবে আর আপনি ট্রাকই বা দেবেন কেন” হোটেলেই বা রাখবেন কেন?” 

“উপায় কী,” সত্যপ্রকাশ বললেন, “জলে থেকে এদি-বা কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করা চলে, ডাঙায় থেকে পুলিশকে চটানো চলে না। ও হ্যাঁ, একটা কণা আপনাদের বলা হয়নি। শিলিগুড়ি থেকে আমার হোটেলের ম্যানেজার সুবিমল এই খানিক আগে এখানে একটা মেসেজ নিয়ে এসেছে। তার সঙ্গে একটু বাদেই আমাকে শিলিগুড়ি যেতে হবে। এখন তো এগারোটা বাজে। এই ধরুন মোটামুটি বারোটা নাগাদ আমরা রওনা হব।” 

জিজ্ঞেস করলুম, “আমরা মানে?” 

“আমরা মানে আমি আর সুবিমল। আপনারা এখানে থাকুন, ভাবুন, বিশ্রাম করুন। আর হ্যাঁ, সুবিমল গাড়ি নিয়ে এসেছে. সেই গাড়িতেই আমি যাচ্ছি। আমার গাড়িটা রইল। ইচ্ছে হলে বিকেলে আলিপুরদুয়ার থেকে একটু ঘুরও আসতে পারেন। আপনারা ড্রাইভ করতে পারেন তো?” 

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “পারি।” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “না-পারলেও ক্ষতি ছিল না। রামদাস অতি চমৎকার গাড়ি চালায়।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আজ আর আমরা কোথাও যাচ্ছি না। কিন্তু শিলিগুড়ি থেকে আপনি ফিরছেন কবে?” 

“কবে মানে?” সত্যপ্রকাশ বললেন, “কাজটা জরুরি, না গিয়ে উপায় নেই, তাই যাচ্ছি, তবে সময় বেশি লাগবে না, রাত্তিরেই ফিরে আসছি। অবশ্য একটু বেশি-রাত হয়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে আপনারা খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়বেন, আমার জন্যে বসে থাকবেন না।” 

“ঠিক আছে। কিন্তু ‘শাপনি থাকছেন না বলেই দু-একটা কথা আপনাকে জানাতে চাই, কেননা সেই অনুযায়ী কিছু ব্যবস্থা করা দরকার।” 

চা এসে গিয়েছিল। যে নিয়ে এল, সে যে নিরু নয়, সেটা লক্ষ করলুম। পট থেকে চা ঢেলে দুধ-চিনি মেশাতে মেশাতে স্ত্যপ্রকাশ বললেন, “গোপালের মা, রান্নাঘরে বলে দাও যে, একটু বাদেই আমরা খেতে বসব।” 

গোপালের মা বেরিয়ে গেল। চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে সত্যপ্রকাশ বললেন, “এবারে বলুন কী বলবেন।” 

“খুড়োমশাইয়ের উপরে সবাই খাপ্পা হয়ে আছে, সেটা তো জানেন?”

“জানি বই কী।” 

“কিন্তু কতটা খাপ্পা হয়ে আছে, তা হয়তো জানেন না। যা বুঝতে পারছি, তাঁর উপরে একটা বিচ্ছিরি রকমের হামলা হওয়া কিছু বিচিত্র নয়। সেটা আটকাতে হবে। আপনাকে এখানে ভালবাসে সবাই। তাই সবাইকে আপনি বুঝিয়ে বলুন, দু-একটা দিন তারা একটু ধৈর্য ধরে থাকুক। সবাইকে যদি না বলা সম্ভব হয়, তো দু-চারজন প্রবীণ লোককে বলুন। নিজে যদি না সময় পান তো রঙ্গনাথবাবুকে ডেকে পাঠান। তিনি বুঝিয়ে বললেও কাজ হবে।” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “এই ব্যাপার? এতটা তো আমি বুঝতে পারিনি। ঠিক আছে। যাবার আগে রঙ্গনাথবাবুকে আমি বলে যাচ্ছি। এনি আদার প্রবলেম?” 

“অন্তত আজকের রাতটার জন্যে রঙ্গিলার ঘরে একটা ভাল রকমের পাহারার ব্যবস্থা করে দিন।”

“কেন?” 

“বুঝতে পারছেন না? চোর যদি বাইরে থেকে এসে থাকে তো ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু সে তো এই গ্রামেরও কেউ হতে পারে। তা যদি হয় তো একটা মারাত্মক বিপদের আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।” 

“এ-কথা বলছেন কেন?” 

“এই জন্যে বলছি যে, রঙ্গিলা সে-ক্ষেত্রে চোরকে যে শুধুমাত্র দেখেছে, তা নয়, চিনতে ও পেরেছে। অর্থাৎ রঙ্গিলা য?ি সুস্থ হয়ে ওঠে, তো চোরকে সে শনাক্ত করতে পারবে। চোর যে তার আগেই রঙ্গিলাকে খতম করতে চাইলে, এটা আপনি বুঝতে পারছেন না?” 

“ওরে বাবা,” শিউরে উঠে সত্যপ্রকাশ বললেন, “এটা তো আমি ভেবে দেখিনি। ঠিক আছে, জগদীশকে আমি ডেকে পাঠাচ্ছি। সে এসে আপনার সঙ্গে শো করুক। পাহারার ব্যাপারে যা-কিছু ইনস্ট্রাকশন দেবার, তাকে দেবেন।” 

“জগদীশ কে?” 

“আমার হোটেলের দরোয়ান। সুবিমলের সঙ্গে শিলিগুড়ি থেকে এসেছে। খুনের আসামি। পাঁচ বছর জেল খেটেছে। তবে বিশ্বাসী লোক।” 

“আর একটা কথা ছিল।” 

“বলুন।” 

“রঙ্গিলার ডাক্তারবাবু আজ বিকেলে আসবেন তো?” 

“নিশ্চয় আসবেন।” 

“তিনি তো শুনেছি হাসিমারার লোক, আর আপনারাও তো হাসিমারা হয়েই শিলিগুড়ি যাচ্ছেন, তা যাবার পথে তাঁকে একটু বলে যাবেন যে, আমার একটু সর্দি-জ্বরের মতো হয়েছে, রঙ্গিলাকে দেখবার আগে যেন আমাদের ঘরে এসে আমাকে একটু দেখে যান।” 

“সত্যি জ্বর হয়েছে নাকি?” 

“আরে না! আসলে ওঁর সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার।” 

“ঠিক আছে,” সত্যপ্রকাশ বললেন, “আমি বাথরুমে ঢুকছি। আপনারাও চটপট চান করে নিন। রাত্রিরের খাওয়া। হয়তো একসঙ্গে বসে হবে না, অন্তত দুপুরেরটা একসঙ্গে হোক।” 

স্নান করে বেরিয়ে ডাইনিং হলে ঢুকে দেখলুম, সত্যপ্রকাশ আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন। তাঁর পাশে যিনি বসে আছেন, থ্রি-পিস স্যুট পরা সেই যুবকটির বয়স বছর ত্রিশ পঁয়ত্রিশের বেশি হবে না। সত্যপ্রকাশ আলাপ করিয়ে দিলেন। “ইনি মিঃ সুবিমল সেন, আমাদের হোটেলের ম্যানেজার। আর এঁরা হচ্ছেন মিঃ ভাদুড়ি আর মিঃ চ্যাটার্জি। আমার বন্ধু। কলকাতা থেকে বেড়াতে এসেছেন, এদিকটা একটু ঘুরে দেখবেন।” 

লক্ষ করলুম, আমরা যে মনসামূর্তি উদ্ধারের কাজে এসেছি, সত্যপ্রকাশ সেটা চেপে গেলেন। Tমস্কার বিনিময়ের পরে অবশ্য সুবিমল সেনের সঙ্গে আমাদের আলাপ বিশেষ এগোল না। সুবিমল যে খবর নিয়ে এসেছেন, বলতে গেলে সারাক্ষণ শুধু তারই সূত্রে তাঁর মালিকের সঙ্গে তিনি কথাবার্তা বলে যেতে লাগলেন। তার থেকে যা বুঝতে পারলুম, সেটা এই যে শিলিগুড়িতে সত্যপ্রকাশ আরও ‘একটা হোটেল খুলতে চান, তার জন্যে জমি কিনেছেন, গাঁটের কড়ি খরচা করে তার ফার্স্ট ফেজের কাজ চুকিয়েও রেখেছেন, কিন্তু টাকার অভাবে কাজটা এগোচ্ছে না। ব্যাঙ্ক লোনের জন্যে যে চেষ্টা করছিলেন, তাতে বিশেষ সুবিধে হচ্ছিল না, হরেক গাঁটে আটকে গিয়ে ব্যাপারটা গত এক বছর ধরে ঝুলে ছিল। তবে কিনা এবারে হয়তো একটা সুরাহা হতে পারে। ব্যাঙ্কের জেনারেল ম্যানেজার কলকাতা থেকে মাত্র দু’দিনের জন্যে শিলিগুড়িতে এসেছেন, সত্যপ্রকাশ আজই বিকেলের মধ্যে যদি একবার তাঁর সঙ্গে দেখা করেন তো খুব ভাল হয়। 

সত্যপ্রকাশ যে খুব-একটা কথা বলছিলেন, তা নয়। যা বলবার সুবিমলই বলে যাচ্ছিলেন, আর সত্যপ্রকাশ বাঝে-মাঝে হুঁ-হ্যাঁ দিয়ে যাচ্ছিলেন মাত্র। খাওয়া যখন শেষ হয়ে এসেছে, তখন তিনি বললেন, “হোটেলের বুকিং এখন কীরকম?”

“একসেলেন্ট। এইটেই তো সিজন স্যার।” 

“দিন দুয়েকের জন্যে দুটো ঘর দিতে পারবে? …না না, ভাল ঘরগুলো চাইছি না, আলো-বাতাস ঢোকে না, এমন এঁদো ঘরও তো গোটা কয়েক আছে, তার থেকে দুটো ছেড়ে দেওয়া যায়?” 

“দিন পনরোর মধ্যে পারব না, স্যার। এখন একেবারে টোটাল বুকিং চলছে। …কেন, কার জন্যে ঘর চাই স্যার?” 

“এক দারোগার শালাবাবুর জন্যে। ব্যাটা আবার শিলিগুড়িতেই পোস্টিং পেয়েছে।” 

“ও, এই ব্যাপার?” মালিকের সামনে যতটা উঁচু গায় হাসা যায়, সুবিমল ঠিক ততটা উঁচু গলায় হেসে বললেন, “তা হলে তো একে পয়সা দেবে না, তার উপরে আবার যেখানে-সেখানে জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরো ফেলে কার্পেট দুটোও পুড়িয়ে ছাড়বে!” 

বিষণ্ণ গলায় সত্যপ্রকাশ বললেন, “হ্যাঁ, তা তো পোড়াতেই পারে।” 

“তার চেয়ে এক কাজ করা যাক,” সুবিমল বললেন, “আমাদের হোটেলে না-ঢুকিয়ে বরং কাছাকাছি কোনও শস্তার হোটেলে চালান করে দিই। তার চার্জেস না হয় আমরাই মিটিয়ে দেব।” 

“যা ভাল বোঝো করো।” 

সত্যপ্রকাশের খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। তিনি উঠে পড়লেন। আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনারা বিশ্রাম করুন। যাকে যা বলবার, সব বলে তবেই আমি শিলিগুড়ি রওনা হব; তার আগে একবার দেখাও করে যাব আপনাদের সঙ্গে। চিন্তার কিছু নেই। রাত্তিরেই তো ফিরছি। তখন সব শুনব।” 

হাতমুখ ধুয়ে আমরা আমাদের ঘরে গিয়ে ঢুকলুম। 

১৭ 

দুপুরের খাওয়ার পাট চুকতে আজ বিশেষ দেরি হয়নি। কিন্তু ঘরে ঢুকেই বুঝতে পারা গেল যে, তারই মধ্যে কেউ এখানে এসে যত্ন করে সব গুছিয়ে রেখেছে। বিছানা একেবারে টান করে পাতা, পায়ের কাছে ভাঁজ করা লাইসাম্পি, ছাইদান পরিষ্কার, বালিশে একটা ভাঁজ পর্যন্ত নেই। শিয়রের দিকের দেওয়ালে যে দুটি ওয়াল-ভাস রয়েছে, কাল রাত্তিরে তো নয়ই, আজও এতক্ষণ সেটা খেয়াল করিনি। এখন দেখলুম, কেউ তার মধ্যে টাটকা দু’গুচ্ছ গোলাপ সাজিয়ে রেখেছে। 

ঢকঢক করে এক গ্লাস জল খেয়ে নিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে সবে ভাবছি যে, এবারে একটু গড়িয়ে নিলে মন্দ হয় না, এমন সময়ে জগদীশ এল। 

এমন-কিছু মানুষ আছে, যাদের দেখলেই কেমন যেন অস্বস্তি হয়, গা’টা একটু শিরশির করে। ‘হোটেলের দরোয়ান’ শুনে ভেবেছিলুম লম্বা-চওড়া বিশাল গালপাট্টাওয়ালা জবরদস্ত পালোয়ান হবে। তা তো নয়ই, বরং সিড়িঙ্গে-গোছের চেহারা। মাঝারি হাইট, রং কালো, দুই ভুরুর একটার নীচে চোখ আছে, অন্যটার নীচে নেই। যে-চোখটা আছে, তারও চাউনি স্থির। এত স্থির যে, মানুষের চোখ বলে মনেই হয় না। 

নিজের পরিচয় দিয়ে জগদীশ বলল, “বড়বাবু আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে বললেন।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “একটা পাহারা দেবার কাজ আছে জগদীশ।” 

“কোথায় পাহারা দিতে হবে বলুন।” 

“এই বাড়িতেই।” 

“গোটা বাড়ি?” 

“না, না, ভাদুড়িমশাই বললেন, “গোটা বাড়ি নয়, শুধু একটা ঘরের উপর নজর রাখলেই চলবে। বাইরের উঠোনের পুবদিকের ঘরটা।’ 

জগদীশের স্থির চোখে যেন এতক্ষণে একটু বিস্ময় ফুটল। কিন্তু সেও মাত্র এক লহমার জন্য। পরমুহূর্তেই তার চাউনি আবার সেই আগের মতোই স্থির। বলল, “যে-ঘরে রামদাসদাদা থাকে?”

‘হ্যাঁ, যে-ঘরে রামদাস আর তার নাতনি থাকে। এখন অবশ্য আয়াও আছে একজন। সেই ঘরটার উপরে নজর রাখতে হবে তোমাকে। তবে এখন নয়, সন্ধের পর থেকে সারা রাত। নজর রাখবে, কেউ যেন ওই ঘরের ধারেকাছেও যেতে না পারে। কেউ যদি যাবার চেষ্টা করে, তাকে আটকাতে হবে। পারবে?” 

“পারব, বাবু।’ 

“কী দিয়ে আটকাবে? লাঠি চালাতে জানো?” 

আমি লাঠি চালাই না,” জগদীশ বলল, “ছোরা চালাই।” 

“বটে?” 

“আগে আমি সার্কাসে ছোরার খেলা দেখাতাম, নির্বিকার নিরুত্তাপ গলায় জগদীশ বলল, “মাঝরাত্তিরে কেউ যদি ওই ঘরের কাছে যায়, তাকে গেঁথে ফেলব।” 

“না, না,” শিউরে উঠে ভাদুড়িমশাই বললেন, “একেবারে গেঁথে ফেলবার দরকার নেই। সত্যিই যদি কেউ আসে তো তাকে আটকে দিলেই চলবে।” 

“ঠিক আছে, তা হলে আটকে দেব।” 

“মনে রেখো, কাজটা খুব জরুরি। সারা রাত জেগে থাকা চাই, আর জেগে থেকে নজর রাখা চাই ওই ঘরটার উপরে। পারবে তো?” 

জগদীশ বলল, “রাত্তিরে আমি ঘুমোই না। 

আর একটাও কথা না বলে ঘর থেকে সে বেরিয়ে গেল। 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কী মনে হয় কিরণবাবু?” 

“কী আর মনে হবে, গেঁথে ফেলার কথাটা যে-ভাবে বলল, তাতে তো আমি কেঁপে গিয়েছিলুম মশাই। উরেব্বাবা, এ তো ডেঞ্জারাস লোক।” 

“এ ডেঞ্জারাস মানে উইথ এ ওয়ান-ট্র্যাক মাইন্ড,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “এবং সেটাই হচ্ছে সবচেয়ে ডেঞ্জারাস ব্যাপার। এ-সব মানুষ দু’রকম বোঝে না, যা-কিছু বুঝবার একরকম বোঝে। অনেকটা যেন দম-দেওয়া সেই গাড়ির মতো, যার কোনও ড্রাইভার নেই। সামনে যে-ই পড়ুক, তাকে চাপা দিয়ে বেরিয়ে যাবে।” 

“ঠিক ঠিক,” আমি বললুম, “আপনি যদি না স্পষ্ট করে নিষেধ করে দিতেন তো রাত্তিরে কেউ রঙ্গিলাদের ঘরের কাছে গেলে নির্ঘাত ও তার লাশ ফেলে দিত।” 

“অর্থাৎ চুরির কিনারা করতে এসে খুনের মামলায় জড়িয়ে যেতুম আমরা।” 

ভাদুড়িমশাই হাসতে লাগলেন। 

আমি বললুম, “কিন্তু চুরির কিনারাই বা হচ্ছে কোথায়? আচ্ছা, রঙ্গনাথবাবু সেই বউটিকে যা বললেন, তার থেকে কোনও সন্দেহ হয় না আপনার?” 

“কী বললেন যেন রঙ্গনাথ?” 

“ওই যে তিনি বউটিকে বললেন, ‘যেখানে থেকে নিয়ে এসেছ সেইখানেই আবার রেখে এসো।’ কথাটা আপনার মনে নেই?” 

“ও, সেই কথাটা? তা কথাটা তো আপনি পুরো শোনেননি। তাই না?” 

“তা শুনিনি ঠিকই, কিন্তু যেটুকু শুনেছি, সেইটুকুও তো কম সন্দেহজনক নয়।” 

ভাদুড়িমশাই স্থির চোখে আমাকে দেখলেন কিছুক্ষণ। তারপর তাঁর চোখে একটু কৌতুক যেন ঝিলিক দিয়ে উঠল। বললেন, “কথাটা শুনে আপনার কী মনে হল?” 

“মনে হল যে, লোভে পড়ে ওই বউটিই সম্ভবত মনসামূর্তি চুরি করেছে।” 

“শুধু চুরি করলেই তো হবে না, সেটা বিক্রি করা চাই।” 

“বা রে, বিক্রি করবে বলেই তো চুরি করেছিল।” 

“আমার কাছে করবে?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “এ তো আর মাচার লাউ কি পুকুরের মাছ্ নয় যে, হাটে নিয়ে গেলেই খদ্দের মিলে যাবে। তা হলে?” 

“হাটে নিয়ে গিয়ে বিক্রির কথা উঠছে কেন? বাইরের লোক তো এখানে আসেই। তাদের মধ্যে মতলববাজ লোক দু’চারজন থাকাও কিছু বিচিত্র নয়। তাদেরই কেউ হয়তো বউটিকে বুঝিয়েছে যে, মূর্তিটা চুরি করে তার হাতে তুলে দিতে পারলেই বউটিকে সে হাজার দু’চার পাইয়ে দেবে। সেটা কি খুবই অসম্ভব?” 

“অসম্ভব হবে কেন? তবে কিনা মূর্তিটা চুরি হবার পরেও তো পুরো ছ’ছটা দিন কেটে গেল। বউটি তা হলে এখনও সেই লোকের হাতে মূর্তিটা তুলে দেয়নি কেন?” 

“লোকটা আর ইতিমধ্যে আসেনি হয়তো। মানে সে হয়তো সুযোগের অপেক্ষায় আছে। হয়তো ভাবছে যে, উত্তেজনাটা একটু থিতিয়ে আসুক, তারপরে এক ফাঁকে সে ফের এই গ্রামে এসে বউটির কাছ থেকে ওই চোরাই মূর্তি হাতিয়ে নেবে।”

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “কথাটা নেহাত মন্দ বলেননি কিরণবাবু। অর্থাৎ কিনা আপনার থিয়োরিটা একেবারে হেসে উড়িয়ে দেবার মতো নয়।” 

“তা হলে আপনি হাসছেন কেন?” 

“হাসছি এইজন্যে যে, তার পরেও একটা প্রশ্ন থেকে যায়।”

“এর মধ্যে আবার প্রশ্ন কীসের?” 

“প্রশ্নটা এই যে, মুর্তিটা যেখান থেকে সে নিয়ে এসেছে, রঙ্গনাথবাবু সেইখনেই আবার মূর্তিটা তাকে রেখে আসতে বলছেন কেন?” 

এবারে আমার হাবার পালা। বললুম, “তারও একটা সহজ ব্যাখ্যা আছে ভাদুড়িমশাই। কেন রেখে আসতে বলছেন জানেন?” 

“জানি না। আপনি বুঝিয়ে বলুন।” 

“বলছি। আমার ধারণা, গ্রামের চাষিবাড়ির বউ তো, আসলে খুবই ধর্মভীরু, বাইরের লোকের উশকানিতে লোভে পড়ে হঠাৎ মনসামূর্তি চুরি করেছিল, কিন্তু তারপর থেকেই সে ভয়ে ভয়ে রয়েছে। শুধু ধরা পড়বার ভয় নয়, ছেলেপুলের অকল্যাণ হতে পারে, এই ভয়টাও রয়েছে পুরোমাত্রায়।” 

“তা তো থাকতেই পারে।” 

“পারে তো? ব্যাস, সেইজন্যেই সে এখন ঘোর অশান্তির মধ্যে রয়েছে। ঠিক বুঝতে পারছে না যে, এখন কী করা যায়। আর তাই রঙ্গনাথবাবুর কাছে সব কথা খুলে বলে সে একটা পরামর্শ চাইতে গিয়েছিল।” 

“তারপর?”  

“তারপর আর কী, রঙ্গনাথ সৎ লোক, যে রকমের পরামর্শ দেওয়া তাঁর পক্ষে স্বাভাবিক, ঠিক সেই রকমের পরামর্শই তিনি দিলেন। বললেন যে, যেখানে থেকে নিয়ে এসেছ, সেইখানেই আবার রেখে এসো।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ব্রেভো। শাবাশ। চমৎকার। তা হলে তো কাজ মিটেই গেল। বউণ্ট যদি আজই এক ফাঁকে মূর্তিটাকে ফের মন্দিরের মধ্যে রেখে যায়, তা হলে আব ভাবনা কী, ‘মামবা কলকাতা ফিরে যেতে পারি।” 

ভাদুড়িমশাইয়ের কথার মধ্যে যে একটা ঠাট্টার সুর বেজে উঠল, তাতেই বুঝতে পারলুম যে, আমার থিয়োরিটা তাঁর মোটেই পছন্দ হয়নি। বললুম, “বেশ তো, আমার কথা যদি বিশ্বাস না হয়, তো আপনি কী ভাবছেন, সেটা অন্তত খুলে বলুন।” 

“আমি কি আর একরকম ভাবছি,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমি ভাবছি পাঁচ-ছ রকত্বের ভাবনা। কিন্তু মুশকিলটা কী হয়েছে জানেন, যতই ভাবছি, ততই যেন ভাবনাগুলো আরও জট পাকিয়ে যাচ্ছে। এক-একবার মনে হচ্ছে, এইবারে বোধহয় জট খুলবে; কিন্তু না, খুলছে না।” 

“বউটি তা হলে চুরি করেনি?” 

অন্যমনস্কভাবে ভাদুড়িমশাই বললেন, “কী জানি, করতেও পারে।” 

“রঙ্গনাথবাবুকে খোলাখুলি জিজ্ঞেস করব?” 

ভাদুড়িমশাই সরাসরি আমার মুখের দিকে তাকালেন। তাঁর মুখে ফের হাসি ছড়িয়ে পড়ল। বললেন, “বেশ তো, তাঁকে জিজ্ঞেস করুন।” 

রামদাস এসে ঘরে ঢুকল। বলল, “আপনাদের কিছু লাগবে? মানে সিগারেট কি দেশলাই?”

বললুম, “সবই তো রয়েছে। কিচ্ছু লাগবে না।—ও হ্যাঁ, সত্যপ্রকাশবাবু কি শিলিগুড়ি রওনা হয়ে গেছেন?” 

“না, খোকাবাবু এখন কাগজপত্তর সব গুছিয়ে নিচ্ছেন। রওনা হবার আগে আপনাদের সঙ্গে দেখা করে যাবেন।” 

“ঠিক আছে, তুমি যেতে পারো।” 

রামদাস তবু দাঁড়িয়ে রইল। বুঝলুম যে, কিছু বলতে চায়। বললুম, “আর-কিছু বলবে?”

“হ্যাঁ, বাবু,” রামদাস বলল, “মাস্টারমশাই এসেছেন। আপনাদের সঙ্গে একবার দেখা করতে চান।’ 

“মাস্টারমশাই মানে?” 

“ওই মানে আমাদের রঙ্গনাথবাবু। বললেন যে, একবার দেখা করতে পারলে ভাল হত।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আচ্ছা রামদাস, এই রঙ্গনাথবাবু মানুষটি কেমন?” 

“খুব ভাল মানুষ, বাবু।” রামদাস বলল, “সাতে-পাঁচে থাকেন না, পয়সাওলা মানুষ তো নন, তবু সাধ্যিমতো গাঁয়ের লোকদের সাহায্য করেন। আপদে বিপদে সকলেই তাই ওঁরই কাছে ছুটে যায়। আমাদের খোকাবাবুও ওঁকে খুব ভালবাসেন।” 

“তা তো বাসেনই, “ভাদুড়িমশাই বললেন, বিশ্বাসও করেন খুব। তা নইলে আর ওঁকে এখানে ডেকে এনে ইস্কুলের ভার দেবেন কেন? আর তা ছাড়া মানুষটি দেখলুম খুব হাসিখুশি। কারও বিরুদ্ধে কোনও নালিশ নেই। 

“ঠিক বলেছেন বাবু। মাস্টারমশাই একেবারে সদানন্দ মানুষ।” রামদাস বলল, “তবে কিনা দুঃখ ওঁরও কম নেই। একটামাত্র ছেলে, সেটা মানুষ হয়নি। নিজে মাস্টার, পাঁচজনের ছেলেপুলেকে লেখাপড়া শেখান, অথচ কী কান্ড দেখুন, নিজের ছেলেটা লেখাপড়া শিখল না, ইস্কুলের পড়া শেষ হবার আগেই কুসঙ্গে গিয়ে ভিড়ল।” 

“সে এখন কোথায় থাকে?” 

“তা তো জানি না। তবে শুনতে পাই যে, কোথায় কোন এক গুন্ডার দলে গিয়ে নাম লিখিয়েছে। বুড়ো বাপ-মায়ের একটা খোঁজ পর্যন্ত নেয় না।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কী আর করা যাবে, সবই অদৃষ্ট।…..তো ঠিক আছে, তুমি গিয়ে রঙ্গনাথবাবুকে পাঠিয়ে দাও।” 

রামদাস চলে গেল। 

একটু বাদে রঙ্গনাথ এসে ঘরে ঢুকলেন। কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে বললেন, “আপনাদের বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটালুম, তার জন্যে ক্ষমা চাইছি।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আরে, অত কিন্তু-কিন্তু করছেন কেন? বসুন।” 

রঙ্গনাথ বললেন, “বেশিক্ষণ বসব না। আপনাদেরও বিশ্রাম করা দরকার, ওদিকে আমিও দুজন রোগীকে আমার বাড়িতে রেখে এসেছি, ফিরে গিয়ে তাদের ওষুধ দিতে হবে।” 

বললুম, “তার মানে? আপনি তো এখানকার মাস্টারমশাই, সেই সঙ্গে ডাক্তারিও করেন নাকি?”

রঙ্গনাথ যেন আরও কুঁকড়ে গেলেন। বললেন, “ওই মানে একটু হোমিওপ্যাথি করি আর কি। এখানে তো ধারেকাছে কোনও ডাক্তার নেই, ভাল ডাক্তার বলতে সেই এক হাসিমারার ডাক্তার সরকার। মানুষটি তিনি অবশ্য খুবই ভাল, ভিজিট না-নিয়েও চিকিচ্ছে করেন, তবে কিনা সামান্য জ্বরজারিতে তো আর তাঁকে কল দেওয়া যায় না, তাই ছোটখাটো অসুখ-বিসুখ হলে…..এই ধরুন সর্দিদুর কি ওই রকমের কিছু হলে এরা আমার কাছেই ছুটে আসে…..যা-ই হোক, যে-কথাটা বলতে এসেছিলুম ..আপনারা কোনও চিন্তা করবেন না।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “অর্থাৎ সত্যপ্রকাশবাবু আপনাকে সব বলেছেন?” 

রঙ্গনাথ বললেন, “হ্যাঁ, বলেছেন। আমিও এখানকার লোকজনদের বুঝিয়ে বলব যে, ক’টা দিন তারা একটু ধৈর্য ধরে থাকুক, হঠাৎ রেগে গিয়ে যেন সাধুবাবার উপরে হামলা-টামলা না করে।” 

“আমরা যে আসলে মনসামূর্তির সন্ধান করতে এসেছি, তা বলেছেন?” 

“আজ্ঞে হ্যাঁ, তাও বলেছেন। তবে আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, আমি ছাড়া আর-কেউ তা জানে না। জানবেও না।” 

রঙ্গনাথ উঠে পড়লেন। তারপর পকেট থেকে একটা কৌটো বার করে একই রকমের কুণ্ঠিত গলায় বললেন, “সকালে আপনারা আমার বাড়িতে পরের ধুলো দিয়েছিলেন, কিন্তু তখন শুধু চা ছাড়া আর-কিছু আপনাদের দিতে পারিনি। আমার স্ত্রী তাই ক’টা নারকোলের নাড়ু পাঠিয়ে দিয়েছেন। আপনারা খেলে আমরা দুজনেই খুব তৃপ্তি পাব।” 

ভাদুড়িমশাইয়ের হাতে কৌটোটা তুলে দিয়ে বিদায় নিলেন রঙ্গনাথ। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই আবার বামদাস এসে ঘরে ঢুকল। 

১৮ 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কী ব্যাপার রামদাস?”

“খোকাবাবু আমাকে দেখতে পাঠালেন আপনারা ঘুমিয়ে পড়েছেন কি না। আসলে সুবিমলবাবুকে দিয়ে গোটা দুই চিঠি টাইপ করিয়ে নিচ্ছেন তো, তাই আসতে একটু দেরি হচ্ছে।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা হোক, আমি বরং সেই ফাঁকে তোমার সঙ্গে দু-একটা কথা সেরে নিই।”

রামদাস বলল, “কী কথা?” 

“ওই চাবির কথা। আচ্ছা রামদাস, রঙ্গিলা যে ঠাকুরঘরের চাবিটা কক্ষনো কাউকে দিত না, তা তো তুমি বলেইছ। এখন বলো তো, ঢাবিটা কি গত দু’বছরের মধ্যে কক্ষনো সে হারিয়েও ফেলেনি? মানে এক-আধ ঘন্টার জন্যেও না?” 

অবাক হয়ে রামদাস বলল, “এক-আধ ঘন্টার জন্যে? তার পর মাথা চুলকে একটু ভেবে বলল, ও হ্যাঁ, এই সেদিনই একবার হারিয়েছিল বটে, তবে ঘন্টাখানেকের মধ্যে আবার পেয়েও যায়।” 

ভাদুড়িমশাইয়ের চোখ দুটো যেন জ্বলে উঠল হঠাৎ। বললেন, “এটা কবেকার কথা?” 

“বুধবার তো সর্বনাশটা হল, এটা তার একদিন…..না না, একদিন নয়, দু’দিন আগের ব্যাপার।”

“অর্থাৎ সোমবার চাবিটা হারিয়েছিল?” 

“হ্যাঁ বাবু, কাল সোমবারের আগের সোমবার। তবে ওই যে বললুম, খানিক বাদে আবার পেয়েও গিয়েছিল।” 

“কোথায় হারিয়েছিল?” 

“ঠাকুরঘরের মধ্যে।” 

“পেল কোথায়?” 

“সেইখানেই। হোম করবার জন্যে নরম মাটির দরকার হয় তো। বালি হলেও অবিশ্যি চলে। তবে এখানে আর নিত্যি-নিত্যি বালি পাওয়া যাবে কোথায়। তাই নেঝের উপর নরম মাটির বেদীমতন করে তার উপরে ইট সাজিয়ে হোমের আগুন জ্বালতে হয়, নইলে মেঝের শান ফেটে যাবার ভয় থাকে। তো ঠাকুরঘরের মেঝেয় এক তাল নরম মাটি রাখা ছিল, খুঁজতে খুঁজতে দেখা গেল যে, সেই মাটির উপরেই চাবিটা পড়ে রয়েছে।” 

“ব্যাস, আর-কিছু জিজ্ঞেস করবার দরকার নেই। এবারে তুমি যেতে পারো।” 

রামদাস ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। 

ভাদুড়িমশাই একগাল হেসে বললেন, “জট অন্তত একটুখানি খুলে গেল। এতক্ষণ তো শুধুই সন্দেহ করছিলুম, কিরণবাবু, এবারে নিশ্চিত হয়ে বলি তালাটা ভাঙা হয়নি। যে ঢুকেছিল, সে চাবি দিয়ে তালা খুলেই ঢুকেছিল।” 

“কিন্তু সে কে?” 

“তা কী করে বলব? তবে আপনি যাকে সন্দেহ করছেন সেই বউটি বোধহয় নয়। গাঁয়ের এক চাষিবাড়ির বউয়ের মাথায় কি আর এত প্যাঁচ খেলবে? ও হ্যাঁ, রঙ্গনাথ তো এসেছিলেন, কিন্তু কই, আপনি তো তাঁকে কিছু জিজ্ঞেস করলেন না।” 

“ভুলে গিয়েছিলুম।” 

“তার জন্যে আক্ষেপ করবেন না। মাঝে-মাঝে এমন এক-আধটা কথা ভুলে যাওয়াহ্ ভাল।”

“এ-কথা বলছেন কেন?” 

“এইজন্যে বলছি যে, চাষিবাড়ির বউটিকে রঙ্গনাথ যা বলেছেন, তার ব্যাখ্যা শুনলে আপনার পিলে চমকে যেত।” 

বুঝতে পারলুম, ভাদুড়িমশাই এখন আর কিছু বলবেন না, স্রেফ য়ালির ভালায় কথা চালিয়ে যাবেন। তা হলে বরং একটু ঘুমিয়ে নেওয়াই ভাল। 

কিন্তু ঘুমোনো গেল না। চেয়ার ছেড়ে বিছানার দিকে এগোবার উপক্রম করতে-না-করতেই সত্যপ্রকাশ ঘরে ঢুকে বললেন, “একটু দেরি হয়ে গেল। রঙ্গনাথবাবু এসেছিলেন তো?”

“তা এসেছিলেন।” 

“ওঁকে যা বলবার সব বলে দিয়েছি। আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, ছেটকাকার উপরে অন্তত এখুনি কোনও হামলা হবে না। …..ও হ্যাঁ, জগদীশকে যা ইসস্ট্রাকশন দেবার, তা আশা করি দিয়েছেন?” 

“তা দিয়েছি,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু লোকটা সত্যি নির্ভরযোগ্য তো?” 

“একেবারে হানড্রেড পার্সেন্ট।” 

“রঙ্গিলার উপরে হামলা হলে আটকাতে পারবে?” 

“ওকে আপনি ছুরি চালাতে দেখেননি বলেই প্রশ্নটা করলেন। অন্ধকারেও ওর তাক কখনও ফশকায় না। জগদীশ যে খুনের আসামি, তা কি বলেছি আপনাদের?” 

“বলেছেন।” 

“কিন্তু কেন খুন করেছিল, তা বোধহয় বলিনি। আসলে খুনটা না করলে ও নিজেই সেদিন খতম হয়ে যেত। রাত্তিরবেলা ভাটিখানা থেকে একটা অন্ধকার পথ দিয়ে বাড়ি ফিরছিল, সেই সময়ে ওর উপরে হামলা হয়। লাঠি চালিয়েছিল। তবে লাঠিটা ওর মাথায় পড়েনি, কাঁধ ঘেঁষে বেরিয়ে যায়। বাস, অন্ধকারের মধ্যেই ছুরি চালিয়ে দেয় জগদীশ। চিৎকার শুনে আশপাশ থেকে লোকজন ছুটে আসে। এসে টর্চ ফেলে যা দেখতে পায়, তাতে তাদের চক্ষুঃস্থির। কুলিবস্তির রাজদেও কুর্মি রাস্তার উপরে চিত হয়ে পড়ে আছে। আর তার গলার মধ্যে পুরোপুরি ঢুকে রয়েছে একটা ছুরির ফলা।” 

বললুম, “বটে?” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “তবে আর বলছি কী। তবে কিনা স্রেফ ওই ছুরিটার জন্যেই জগদীশ ধরা পড়ে গেল। ফাঁসিই হয়ে যেত, কিন্তু আমি ভাল ল-ইয়ারের ব্যবস্থা করেছিলুম তো, তিনি প্রমাণ করে ছাড়লেন যে, ছুরিটা চালানো হয়েছিল ইন সেল্ফ ডিফেন্স। লাঠির বাড়ি লেগে ভাগ্যিস ওর কাঁধটা জখম হয়েছিল, তা সেইটেই হয়ে দাঁড়াল আমাদের ল-ইয়ারের তুরুপের তাস। ফলে আর ফাঁসি হল না, তার বদলে হল পাঁচ বছরের জেল। তারও কিছুটা মকুব হয়ে গিয়ে মাস কয়েক আগে ছাড়া পেয়েছে।” 

আমি বললুম, “ওরে বাবা, এ যে ভয়ানক ব্যাপার।” 

“ভয়ানক বলে ভয়ানক,” সত্যপ্রকাশ বললেন, “তা ছুরি চালাবার ব্যাপারে ওর হাতযশের কথাটা এখানেও সবাই জানে তো, তাই রাত্তিরে ও যদি পাহারায় থাকে, তো রঙ্গিলার ঘরের ধারেকাছেও কেউ ঘেঁষবে না। 

বুঝতে পারছিলুম যে, ভদ্রলোক আমাদের একেবারে ষোলো-আনা নিশ্চিন্ত করতে চাইছেন। হয়তো সেই কারণেই কথাবার্তাও বলছেন একটু বেশি-মাত্রায় সপ্রতিভ ভঙ্গিতে। কিন্তু তা সত্ত্বেও, কিংবা হয়তো সেইজন্যেই, আমার মনে হচ্ছিল যে, এ-ব্যাপারে সত্যপ্রকাশ নিজেও বিশেষ নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। রঙ্গিলার উপরে যে হামলা হতে পারে, ভাদুড়িমশাইয়ের মুখে এই সম্ভাবনার কথাটা শুনে একটু ভয়ও পেয়েছেন হয়তো। 

ভাদুড়িমশাইও সেটা বুঝতে পেরে থাকবেন। সম্ভবত সেইজন্যেই তিনি সত্যপ্রকাশকে বললেন, “জগদীশ যখন এতই নির্ভরযোগ্য লোক, তখন আর ভয় কী। যান, তা হলে শিলিগুড়িতে গিয়ে কাজটা সেরেই আসুন।” 

সত্যপ্রকাশ বলেন, “কী জানেন, শিলিগুড়িতে যে আজই যেতে হবে, সেটা আগে বুঝতে পারিনি। যাবার বিশেষ ইচ্ছেও আমার নেই। কিন্তু …..” 

“না গেলে ব্যাবসার ক্ষতি হবে, এই তো?” 

“এমনিতে কোনও ক্ষতি হবার কথা নয়, মিঃ ভাদুড়ি,” সত্যপ্রকাশ অন্যমনস্কভাবে বললেন, ‘ব্যাবসার কাজকর্ম যাকে যা বোঝাবার সব বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি, এখন যদি তিন-চার দিন শিলিগুড়িতে না যাই তো কোনও অসুবিধে হবে না, ওরা ঠিকই চালিয়ে নিতে পারনে।” 

“তা হলে আর যাচ্ছেন কেন?” 

“সুবিমল কী বলল শুনলে না?” 

“শুনেছি। একটা ব্যাঙ্ক-লোনের কথা বলছিলেন।” 

“ঠিকই শুনেছেন। নতুন যে হোটেলটার কাজে হাত দিয়েছি, তার জন্যে এখুনি অন্তত লাখ পঞ্চাশেক টাকা দরকার। অথচ ব্যাঙ্ক থেকে এই কাজের জন্যে যে লোন পাবার কথা, প্রায় এক বছর ধরে সেটা আটকে আছে।” 

“আটকে আছে কেন?” 

“সেইটেই বুঝতে পারছি না।” হাত উল্টে সত্যপ্রকাশ বললেন, “কাগজপত্র পরিষ্কার, কেউ কোনও অবজেকশান দেয়নি, প্ল্যানও সেই কবেই পাশ হয়ে গেছে, অ্যান্ড ইয়েট দে আর সিটিং টাইট অন মাই অ্যাপ্লিকেশান। ন্যাশনালাইজড হবার পরে ব্যাঙ্কগুলো একেবারে গোল্লায় গেছে মশাই।” 

“ঘুষ চায়?” 

“চাইতেই পারে। কাট-মানির কারবার সর্বত্র চলে, এখানেই বা চলবে না কেন? আমি তোমাকে পঞ্চাশ লাখ পাইয়ে দিচ্ছি, তার থেকে তুমিও আমাকে হাজার পাঁচ-দশ পাইয়ে দাও, এ তো অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। পঞ্চাশ হাজার চেয়ে বসলেও কিছু বলবার নেই। তা সেটা খুলে বলবে তো। তাও বলছে না, আবার লোনটাকেও নাহক আটকে রেখেছে।” 

“কেন আটকে রেখেছে, আন্দাজ করতে পারছেন কিছু?” 

“একেবারে যে পারছি না, তা নয়, সত্যপ্রকাশ বললেন, “দমদম এয়ারপোর্টে তো বিপিনবিহারী অনেকে আপনারা দেখেছেন। বিপিন যে শুধু আমার কাস্টমার, তা নয়, বন্ধুও বটে। সে তো বলছে, কলকাতার এক অবাঙালি ব্যবসায়ীও শিলিগুড়িতে একটা থ্রি-স্টার হোটেল খুলতে চায়। লোটা আসলে লোহার কারবারি, এখন সে তার কালো টাকাকে সাদা করবার জন্যে অন্য দিকে হাত বাড়াতে চাইছে। বিপিনের খবর, আমিও যে আর-একটা লাক্সারি হোটেল খুলতে চলেছি, এটা তার পছন্দ নয়। লাইন থেকে লোকটা আমাকে হটাতে চায়। তাই আমার ব্যাঙ্কের লোকাল এজেন্টকে ঘুষ খাইয়ে হাত করেছে, যাতে আ’মি লোনটা না পাই।” 

“কিন্তু সেটা না-পেলে তো আপনি খুবই অসুবিধেয় পড়বেন, তাই না?” 

“পড়ব কী মশাই, অলরেডি পড়েছি।” তেতো গলায় সত্যপ্রকাশ বললেন, “নিজের বলতে যেখানে যা-কিছু ছিল সবই তো ওর মধ্যে ঢেলেছি আমি। ফার্স্ট ফেজের কনস্ট্রাকশানও কমপ্লিট, এখন ব্যাঙ্ক যদি না লোনটা স্যাংশান করে, তা হলে তো একেবারে ধনেপ্রাণে মারা পড়ব। একদিকে যেমন আমার বিস্তর টাকা ওই লোহা আর সিমেন্টের খাঁচার মধ্যে ব্লকড হয়ে রইল, অন্যদিকে তেমনি ক্রেডিটেও তো নেহাত কম কাজ হয়নি, সেকেন্ড ফেজের কনস্ট্রাকশান শুরু হবার আগে তার অন্তত বারো-আনা পেমেন্ট করা চাই, সেটার ব্যবস্থা না হলে পাওনাদারেরা কী করবে জানেন?” 

বললুম, “মামলা করবে?” 

“সবাই করবে না। আগে যারা আমার সঙ্গে কাজ-কারবার করেনি, একমাত্র তাদেরই কেউ-কেউ হয়তো করতে পারে। কিন্তু তা নিয়ে আমি ভাবছি না, মামলার ফয়সালা তো আর তক্ষুনি-তক্ষুনি হয় না, ফরসালা হতে বছরের পর বছর কেটে যায়, তার মধ্যে আমি টাকা তোলার একটা ব্যবস্থা নিশ্চয় করে ফেলতে পারব। আমার ভাবনা লেবার-কনট্রাক্টর সম্পৎলালকে নিয়ে। তাকে আপনারা চেনেন না, সে মামলা-মোকদ্দমার ধার ধারে না, কালীপুজোর আগেই যদি না তার পাওনা মেটাই তো তিনবাত্তির কাছে গাড়ি আটকে দিয়ে সে আমার মাথা ফাটাবে।” 

ফ্লাশ খেলাকে অনেকে তিনপাত্তির খেলা বলে, সেটা জানতুম। কিন্তু এই। তিনবাত্তিটা আবার কী ব্যাপার? কথাটা জিজ্ঞেস করতে সত্যপ্রকাশ ক্লিষ্ট হেসে বললেন, “বড়রাস্তার একটা মোড়। ওই মোড় ঘুরেই তো কাল শিলিগুড়ি থেকে বেরুলুম।” 

ভাদুড়িমশাই কিছু ভাবছিলেন। বললেন, “সম্পৎলাল সম্পর্কে যা বললেন, তাতে লোকটা সম্পর্কে একটু কৌতূহল হচ্ছে। কেমন দেখতে বলুন তো? রং টকটকে ফর্সা?” 

“হ্যাঁ। কিন্তু এ-সব কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?” সত্যপ্রকাশ বললেন, “লোকটাকে আপনি চেনেন নাকি?” 

প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “ভুরু নেই, কপালে মস্ত জরুর। কী, মিলছে?”

সত্যপ্রকাশ হাঁ করে, কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে। তারপর বললন, “বুঝতে পারছি, সম্পৎলালকে আপনি চেনেন।” 

“চিনি বই কী।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “বছর বারো আগে ধানবাদে যে ব্যাঙ্ক-ডাকাতি হয়, ব্যাঙ্কের তরফে তার তদন্তের ভার আমার উপরেই পড়েছিল যে। ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ার খুন হয়েছিলেন। খুন করেছিল শুনীশ্বর। সে অবশ্য ডাকাত দলের লিডার ছিল না। লিডারের নাম ফকিরা সিং। ওযান অব দা মোস্ট নোটোরিয়াস নাফিয়া লিডারস অব ধানবাদ। আগে ছিল ওয়াগন-ব্রেকার। সেইসঙ্গে রেল-কলোনির প্রতিটি দোকান থেকে প্রোটেকশান-মানি আদায় করত। হঠাৎ পুলিশ-পাহারায় কড়াকড়ি হওয়ায় দিন কয়েক একটু চুপচাপ থেকে তারপর একদিন এই ব্যাঙ্কে এসে হানা দেয়। তাও ধরা পড়ত না, ক্যাশিয়ারটি যদি না তাঁর ডাইং ডিক্লারেশনে ফকিরার গ্যাঙের একটা লোকের চেহারার একেবারে নিখুঁত ডেসক্রিপশান দিতেন। ডেসক্রিপশান অনুযায়ী লোকটিকে তো ধরা হল। তারপর সে-ই হয়ে গেল রাজসাক্ষী। ভাগ্যিস হয়েছিল। নইলে মুনীশ্বরেরও ফাঁসি হত না আর ফকিরাকেও দশ বছরের জন্যে ঘানি ঘোরাতে হত না। সত্যি বলতে কী, লোকটা যদি না মুখ খুলত, গ্যাঙের একজনও ধরা পড়ত না তা হলে।” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “এ-সব কথা উঠছে কেন?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “এইজন্যে উঠছে যে, ধানবাদের সেই রাজসাক্ষীটিরও গায়ের রং ছিল টকটকে ফর্সা, তারও ভুরু বলতে কিছু ছিল না, আর তারও কপালে ছিল মস্ক জরুল। শুধু তা-ই নয়, নাম ছিল তারও সম্পৎলাল। অর্থাৎ কিনা ধানবাদের ওয়াগন-ব্রেকার এখন শিলিগুড়িতে এসে মিস্ত্রি-মজুর সাপ্লাইয়ের কারবার চালাচ্ছে। আশ্চর্য, লোকটা নিজের নাম পর্যন্ত পালটায়নি।” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “ওরেব্বাবা, লোকটা যে দাঙ্গাবাজ, তা আমি জানতুম, কিন্তু ওর অ্যান্টিসিডেন্ট যে এইরকম, তা তো কল্পনাও করিনি। কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার!” 

আমি বললুম, “নামটা কেন পালটায়নি বলুন তো?” 

বললুম,”নামটা 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “পালটাবার কোনও দরকার আছে বলেই হয়তো মনে করেনি। শিলিগুড়িতে “ আর জানতে যাচ্ছে যে, ধানবাদে কী হয়েছিল। আর তা ছাড়া, সম্পৎলালের ভয় তো একমাত্র ফকিরাকে। তা সেই ফকিরারও দশ বছর জেল হয়ে গেল। দশ বছর তো আর নেহাত কম সময় নয়। তার মধ্যে কত কী ওলটপালট হয়ে যায়। যায় না?” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “তা যায় বটে।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “যায়, আবার সব ক্ষেত্রে যে যায় না, তাও ঠিক। বিশেষ করে পালটে যায় না আন্ডারওয়ার্লডের কয়েকটা নিয়মকানুন, যা মান্য না-করার শাস্তি বড় ভয়ঙ্কর। যাদের সঙ্গে সে ওয়াগন ভেঙেছে, ব্যাঙ্ক লুঠ করেছে, লুঠের বখরা নিতেও ছাড়েনি, তাদের ধরিয়ে দিয়ে সেই নিয়ম ভেঙেছে সম্পৎলাল। তার শাস্তি তাকে পেতে হবে।” 

“কে শাস্তি দেবে?” আমি জিজ্ঞেস করলুম। 

“যে দেবে, বছর খানেক আগে সে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। … মিঃ চৌধুরি, সম্পংলাল যে শিলিগুড়িতে রয়েছে ফকিরা ত। নিশ্চয় জানে না। কিন্তু তা না-ই জানুক, আপনি যদি কালীপুজোর আগে সম্পৎলালের পাওনা না-ও মেটাতে পারেন, তবে তাতেও আপনার ভয় পাবার কিছু নেই।”

“এ-কথা বলছেন কেন?” 

“ট্রেচারি করে কোনও নাফিয়োসো কখনও পার পায় না বলেই বলছি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “এখন শুধু একটা কাজই আপনাকে করতে হবে।” 

“কী কাজ?” 

“যে-কাউকে দিয়ে সম্পৎলালের কানে ধু এই কথাটা একবার তুলে দিতে হবে যে, ফকিরা সিং নামের একটা লোক শিলিগুড়িতে এসে সম্পৎলালের খোঁজ করছে। বাস, তারপর কী হয় দেখুন।” 

সত্যপ্রকাশ তবুও যেন ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না। বললেন, “তারপর কী হবে?”

“আর-কিছু হবে না, স্রেফ ফকিরার হাত থেকে জান বাঁচাবার তাগিদেই সম্পৎ অন্তত কিছুদিনের জন্যে শিলিগুড়ি থেকে সরে পড়বে।” 

“তারপর যখন জানতে পারবে যে, ফকিরা বলে কেউ শিলিগুড়িতে আসেনি?” 

“তখন সে আবার শিলিগুড়িতে ফিরে আসবে। তা আসুক না, আপনি তো ইতিমধ্যে বেশ কিছুটা সময় পেয়ে যাচ্ছেন। তার মধ্যে কি আর ব্যাঙ্ক-লোনের একটা হিল্লে হয়ে যাবে না?” 

এতক্ষণে সত্যপ্রকাশের মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। চেয়ার ছেড়ে উঠে বললেন, “বাঁচালেন মশাই। কথাটা আমি আজই সম্পৎলালের কানে তুলে দেবার ব্যবস্থা করছি। ঠিক আছে, তা হলে আর দেরি করব না, বেরিয়ে পড়ি। যাবার পথে হাসিমারায় ডাক্তার সরকারকে বলে যাচ্ছি যে, বিকেলে এখানে এসে প্রথমেই যেন আপনার সঙ্গে দেখা করেন। চলি তা হলে।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “শুধু একটা কথা বলে যান। সম্পৎলালের মতন লোককে আপনি লেবার-কনট্রাক্টের কাজটা দিয়েছিলেন কেন?” 

“সাধে কি আর দিয়েছি,” সত্যপ্রকাশ বললেন, “কাজটা ও নিজে এসে চাইল যে। মুশকিল কী জানেন, একবার যে-কাজ ও-লোকটা চেয়ে বসে, অন্য-কোনও লেবার-কনট্রাক্টর সে-কাজ আর ছুঁতেও সাহস পায় না।” 

সত্যপ্রকাশ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। 

১৯ 

সত্যপ্রকাশের গাড়ির শব্দ পাওয়া গেল। বুঝতে পারলুম, সুবিমলকে নিয়ে তিনি শিলিগুড়ি রওনা হয়ে গেলেন। 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “রওনা হবার কথা ছিল বারোটায়, সেখানে দুটো বাজল। শিলিগুড়িতে পৌঁছে ব্যাঙ্কের জেনারেল ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলতে হবে; তা নেহাত শুকনো কথায় তো আর চিঁড়ে ভিজবে না, তাই ভদ্রলোককে হোটেলে নিয়ে এসে যথাসাধ্য খাতিরযত্নও করতে হবে নিশ্চয়। তার উপরে আবার শিলিগুড়ি পর্যন্ত যখন এসেছেন, ম্যানেজার-মশাই তখন কি আর একদিনের জন্যে দার্জিলিং থেকে বেড়িয়ে আসতে চাইবেন না?”

বললুম, “চাইতেই পারেন।” 

“তার জন্যে গাড়ির ব্যবস্থা করে দিতে হবে। সেটা অবশ্য সুবিমলই করে দিতে পারবে। তবে হ্যাঁ, লোনটা যাতে এবারে পাওয়াই যায়, তার জন্যে আজ রাত্তিরে যে একটা জব্বর ডিনারের ব্যবস্থা থাকবে, সেটাও আমরা ধরে নিতে পারি। ঠিক কি না?” 

“বিলক্ষণ। ডিনারের ব্যবস্থা তো থাকবেই।” 

“তার হোস্ট হচ্ছেন সত্যপ্রকাশ। সুতরাং ডিনারের পর্ব শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁর ছুটি নেই। কেমন, ঠিক বলছি তো?” 

“ষোলো-আনা বললে কমই বলা হয়, আঠারো আনা ঠিক।” 

“ভাল। তা ডিনার-পর্ব শেষ হবে কখন?” 

“এ-সব ডিনারে কি অ’র শুধু চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য থাকে ভাদুড়িমশাই?” হেসে বললুম, “পঞ্চাশ লাখ টাকা লোনের ব্যাপার তো, তাই ধরেই নেওয়া যায় যে, পেয়ও থাকবে প্রচুর। সুতরাং…” 

আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “সুতরাং রাত বারোটার আগে ডিনার শেষ হবার আশা নেই; আর তা যদি না থাকে, তো সত্যপ্রকাশ আজ আর মুকুন্দপুরে ফিরছেন না।” 

“তা হলে?” 

“তা হলে আর কী, কাল রাত্তিরে তো আপনার ঘুম হয়নি, এখন বরং একটু ঘুমিয়ে নেবার চেষ্টা করুন।” 

বললুম, “ঘুম তো কাল আপনারও হয়নি, আপনিও একটু শুয়ে পড়লে পারেন।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “দুপুরে আমার ঘুম হয় ন।।” 

বললুম, “আমার হয়, তবে আজ আর হবে না। খাওয়ার পরে দুচোখের পাতা একটু জুড়ে আছিল ঠিকই, কিন্তু যে-ভাবে লোক আসতে শুরু করল, তাতে কি আর ঘুম হয়। প্রথমে এলেন রঙ্গনাথ, তারপর এলেন সত্যপ্রকাশ। আর রামদাস তে. কাজে-অকাজে মাঝে-মাঝেই আসছে। তার উপরে আবার যে-সর্দিজ্বর আপনার হয়নি, তার ওষুধ দিতে ডাক্তার সরকারও বোধহয় খানিক বাদেই এসে পড়বেন।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ডাক্তার সরকার আসার আগে এ-ঘরে সম্ভবত আরও একজন আসবে।”

“কে আসবে?” 

“নিরু। দেখা যাক আমার অনুমানটা ঠিক কি না।” 

নিরুর কথা তুলেই গিয়েছিলুম। বললুম, “সত্যপ্রকারে স্ত্রী কি সত্যি ওর দিদি হতেন নাকি?”

“আমার তো তা-ই মনে হয়।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমি অবশ্য মুখ-চোখের মিল দেখে আন্দাজে একটা ঢিল ছুড়েছিলুম। কিন্তু সেটা বোধহয় ঠিক জায়গাতেই লেগেছে। তার ফলে কী হল বলতে পারেন?” 

“কী হল?” 

“কেসটা আরও জটিল হয়ে দাঁড়াল। অর্থাৎ এটা আর নেহাত একটা চুরির ব্যাপার হয়ে থাকল না। যা ছিল শুধুই একটা মূর্তি-চুরির ঘটনা, হঠাৎ তা একেবারে আলাদা একটা ডাইমেনশন পেয়ে যাচ্ছে।”

“আলাদা ডাইমেনশানের কথা পরে হবে। আগে বরং চুরির কথাটাই হোক। ওটার কিনারা হবে তো?” 

“না-হবার কী আছে?” ভাদুড়িমশাই নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, “চাবির ব্যাপারট। যখন ধরতে পেরেছি, তখন ওটার কিন’র।ও করে ফেলতে পারব।” 

“চাবির ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলুন দেখি।” 

“বুঝিয়ে বলবার তো বিহু নেই।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “চাবির গায়ে মাটি লেগে ছিল। শুকনো কাদামাটি। সেটা নদি আপনার নজরে পড়ত, তো আপনিও ব্যাপারটা বুঝতে পারতেন। কথা হচ্ছে, মাটি এল কোত্থেকে।” 

“আপনার কী মনে হয় 

“রামদাসের যা মনে হয়, আমার তা মনে হয় না।” 

“অর্থাৎ?” 

“রামদাস কী বলণ শুনলেন না? ওর ধারণা, সোমবার চাবিটা হারিয়ে গিয়েছিল। তবে কিনা হারানো-চাবিটা আবার খানিক বাদেই খুঁজে পাওয়া যায়। কোথায় পাওয়া যায়? না মেঝেয় ইট পেতে তার উপরে হোমের আগুন জ্বালে তো, তা সেই ইট পাতার জন্যে যে নরম মাটির দরকার হয়, ঠাকুরঘরের মধ্যে রাখা সেই মাটির উপরেই চাবিটা পড়ে ছিল। এবারে আমার কথাটা শুনুন। আমার ধারণা, চাবিটা হারিয়ে যায়নি, ওটা সরিয়ে ফেলা হয়েছিল।” 

“কে সরিয়েছিল?” 

“যে-কেউ সরিয়ে থাকতে পারে। সারাদিন ধরে তো ঠাকুরঘরের মধ্যে লোকজন নেহাত কম ঢোকে না। তাদের যে-কারও পক্ষেই কাজটা করা সম্ভব। কিন্তু মজাটা কী জানেন?” 

“কী?” 

“এমনভাবে ওটা সরানো হয়েছিল, যাতে কারও কোনও সন্দেহ না হয়।” 

আবার জিজ্ঞেস করলুম, “কে সরিয়েছিল?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আরে মশাই, সেটাই যদি জানতুম, তবে আর ভাবনা ছিল কী? এক্ষুনি গিয়ে শ্যাক করে তার ঘাড় কামড়ে ধরতুম। সেই সকাল থেকেই ভেবে যাচ্ছি যে, কে হতে পারে। আপনিও ভাবতে থাকুন। তবে কিনা, কে সরিয়েছিল, শুধু এইটুকু ভাবলেই হবে না। কেন সরিয়েছিল, অর্থাৎ মতলবটা কী, আর সেই মতলব কীভাবে হাসিল হওয়া সম্ভব, সেটাও আপনাকে ভাবতে হবে।” 

“আমার তো ধারণা, ওই বউটাই চাবি সরিয়েছিল।” 

“তা হলে আবার খানিক বাদেই চাবিটা ওখানে পাওয়া গেল কেন?” 

“কী জানি।” 

“কী জানি বললে হবে না। আসলে ওই যে একটুক্ষণের জন্যে চাবিটা সরানো হয়েছিল, তারই মধ্যে চোরের মতলব হাসিল হয়ে যায়। অন্তত এইটুকু আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু সে যে কে, সেটা বুঝতে পারছি না।” 

“বউটাকে সন্দেহ করছেন না কেন?” 

“সন্দেহের কারণ নেই বলেই করছি না।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “এ-কাজ ওর দ্বারা হয়নি।”

“কী করে বুঝলেন?”

ভাদুড়িমশাই কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু উত্তরটা আর শোনা হল না। নিরু এসে ঘরে ঢুকল। হাতে মশলার ডিবে। টিপয়ের উপর ডিবেটাকে রেখে মুখ না তুলেই বলল, “আমার কয়েকটা কথা ছিল।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বেশ তো, বলো।….কিন্তু দাঁড়িয়ে রইলে কেন, ঘরে তো বসবার জায়গার অভাব নেই। ওই তো, ওদিকের ওই টেবিলের সামনে যে চেয়ারটা রয়েছে, ওটায় বোসো। তারপর বীরেসুস্থে বলো কী বলবে।” 

নিরু বসল না। বলল, “এখন নয়। সন্ধের সময় আপনারা কি ঘরে থাকবেন?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “থাকব।” 

“মা আর পিসিমা তখন ঘন্টা দেড়-দুই ঠাকুরঘরে বসে জপ করেন। তখন আমার কোনও কাজ থাকে না। যদি বলেন তো তখন আসতে পারি।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বেশ তো, তখনই এসো।” 

নিরু বেরিয়ে গেল। 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “দেখলেন তো, ঠিকই আন্দাজ করেছিলুম। বলেছিলুম যে, ডাক্তার সরকার আসার আগেই নিরু আসবে। ভুল বলিনি, কেমন?” 

বললুম, “ঠিকই বলেছিলেন।” তারপর নিরু এসে ঘরে ঢুকবার আগে যে আলোচনা হচ্ছিল, তার জের টেনে বললুম, “দেখা যাচ্ছে, একমাত্র ওই চাষি-বউটিকেই আপনি সন্দেহ করছেন না। কী, ঠিক বলছি তো?” 

“পুরোপুরি ঠিক বলছেন না।” 

“তার মানে আরও দু-চারনকে সন্দেহ করছেন না। কেমন?” 

“আরও দু-চারজনকে নয়, তারও একজনকে।” 

“সেই ভাগ্যবানটি কে?”

“তাঁকে ভাগ্যবানই বা ভাবছেন কেন? ভাগ্যবতীও তো তিনি হতে পারেন।” একটু যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন ভাদুড়িমশাই। তারপর হঠাৎ একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “দেখুন, ঘটনা ঘটবার সময়ে মুকুন্দপুরে যারা ছিল না, এক হিসেবে তাদের কাউকেই আমার সন্দেহ করা উচিত নয়। কিন্তু তবু যে শেহ করছি, তার কারণ, ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থেকেও তারা দূর থেকে কলকাঠি নাড়তে পারে, মানে নিজের হাতে চুরি না করে অন্যকে দিয়ে করিয়ে থাকতে পারে এই কাজ। সেটা কি খুবই অসম্ভব ব্যাপার?…কী, অমন হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কেন?” 

ভাদুড়িমশাইয়ের কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলুম। বলল, “ব্যাপার কী বলুন তো? আপনি কি সত্যপ্রকাশকেও সন্দেহ করছেন নাকি?” 

“কেন করব না? ভদ্রলোক যদি সত্যি কথা বলে থাকেন, তা হলে ঠিক আছে। কিন্তু তিনি যে সত্যি কথা বলছেন তার প্রমাণ কী? এমন তো হতেই পারে যে, মঙ্গলবার রাত্তির তা ধরুন এগারোটা বারোটা পর্যন্ত তিনি শিলিগুড়িতে ছিলেন, তারপর গাড়ি হাঁকিয়ে চলে এসেছিলেন মুকুন্দপুরে। নিজে হয়তো তিনি মন্দিরে ঢোকেননি, কিন্তু যে-লোক ঢুকেছিল, সে তাঁরই লোক। মনসামূর্তি চুরি করে সে সত্যবাবুর গাড়িতে সেটা পৌঁছে দেয়। তারপর সত্যবাবু ফের গাড়ি হাঁকিয়ে শিলিগুড়িতে চলে আসেন।……কী, এটা কি হতেই পারে না?”

আমার মন কিছুতেই ভাদুড়িমশাইয়ের কথায় সায় দিচ্ছিল না। বললুম, “কিন্তু মূর্তিটা তিনি চুরি করবেন কেন?” 

“বা রে,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “সত্যপ্রকাশের টাকার দরকার নেই? শুনলেনই তো যে, তিনি একটা লাক্সারি-হোটেল খুলতে চান। সেই দ্বিতীয় হোটেলের পিছনে তিনি অলরেডি বিস্তর টাকা ঢেলে বসে আছেন, অথচ কাজটা শেষ করানোর জন্যে ব্যাঙ্ক থেকে যে লোন পাওয়া দরকার, সেটা পাচ্ছেন না। অর্থাৎ কিনা প্রচুর টাকার দরকার আছে তাঁরও।” 

“তার জন্যে তিনি নিজের জিনিস চুরি করবেন?” 

“কেন করবেন না? বিষাণগড়ের দেওয়ানের কথা ভাবুন। অর্থলোভে নিজেদের হিরে তিনি কি নিজেই চুরি করেননি?”

“সেখানে তো ইনসিওরেন্স কোম্পানিকে ধোঁকা দিয়ে ক্ষতিপূরণ পাবার লোভ ছিল।” 

“এখানেও তেমনি বিদেশিদের কাছে মূর্তি বেচে টাকা পাবার লোভ থাকতে পারে। মূর্তিটার ইতিহাস তো শুনলেন, ফোটোও দেখেছেন, অমন একটি জিনিস পাবার জন্যে পঞ্চাশ লাখ টাকা দেবার মতো বিদেশি ধনকুবেরের অভাব নেই মশাই। আর তাদের দালাল হয়ে যারা কাজ করে, তাদের সংখ্যাও বাড়ছে বই কমছে না। বলতে গেলে এখন গোটা দেশ জুড়েই তাদের জাল পাতা।”

“তা হলে কি আপনার ধারণা সত্যপ্রকাশই চোর?” 

“অমন কথা কিন্তু আমি একবারও বলিনি।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “আমি যেমন কাউকে সাধু বলছি না, তেমনি আবার কাউকে চোরও বলছি না। আমি শুধু আমার সন্দেহের কথাটাই বলছি। তবে হ্যাঁ, যাদের সম্পর্কে আমার সন্দেহ, তাদের মধ্যে সত্যপ্রকাশও আছেন বই কী।” 

আমার মুখ দিয়ে যেন কথাই সরছিল না। ভাদুড়িমশাইও চুপ করে রইলেন খানিকক্ষণ। তারপর বললেন, “দেখুন কিরণবাবু, একটা কথা তা হলে খুলেই বলি। লেবার কনট্রাক্টর হিসেবেই হোক আর যে-হিসেবেই হোক, সালালের সঙ্গে সত্যপ্রকাশের যোগাযোগটা আমার ভাল ঠে না। লোকটাকে আমি চিনি। ও একটা হাড়ে বজ্জাত লোক। ফকিরার কথা তো বলেছি; তার গ্যাংয়ের লোকরা শুধুই যে ওয়াগন ভাঙত তা নয়, ড্রাগসও পাচার করত। কখনও কোনও মূর্তি-টুর্তি পাচার করেছে বলে অবশ্য শুনিনি। তবে কিনা করতে কতক্ষণ। বিশেষ করে নেপালের বর্ডার যখন শিলিগুড়ি থেকে কাছেই। না মশাই, সত্যবাবুর সঙ্গে সম্পৎলালের কোনও যোগাযোগ না-থাকলেই ‘আমি খুশি হতুম।”