মুকুন্দপুরের মনসা – ১০

১০

পকেট থেকে দেশলাই বার করে ফের হ্যারিকেনটা জ্বাললুম। তারপর ভাল করে একবার দেখে নিলুম ঘরখানা। পাশাপাশি দুটি খাট। ঘরের দু’দিকে দুটি টেবিল আর চেয়ার। টেবিলের উপরে এক প্যাকেট করে সিগারেট, একটা ছাইদান, এক বাক্স দেশলাই, লেখার প্যাড আর ডট পেন। দুটি টেবিলেরই পাশে একটা করে ইজিচেয়ার 

খাটের উপরে টান করে বিছানা পাতা। ইংলিশ নেটের মশারি খাটিয়ে বিছানায় বেশ যত্ন করে গুঁজে রাখা হয়েছে। পায়ের কাছে একটি করে লাইসাম্পি। খাটের দু’দিকে দুটি টিপাই। তাতে জলের জাগ আর কাচের গেলাশ। গেলাশের উপরে চিনেমাটির রেকাবি। 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “যত্নের ত্রুটি নেই দেখছি। প্রয়োজন আর স্বাচ্ছন্দ্য, দু’দিকেই নজর রাখা হয়েছে।” 

বললুম, “তা যা বলেছেন।” 

জাগ্ থেকে গেলাশে জল ঢেলে ঢকঢক করে খেয়ে নিলেন ভাদুড়িমশাই। বললেন, “বড্ড তেষ্টা পেয়ে গিয়েছিল। নিন, আর কথা নয়, এবারে শুয়ে পড়ুন। আলোটা বরং ওদিকের টেবিলে নিয়ে যাচ্ছি, আমি একটু পরে শোব।” 

শুয়ে তো পড়লুম। কিন্তু তক্ষুনি-তক্ষুনি যে ঘুম এসে গেল, তা নয়। সায়েবরা এই অবস্থায় ভেড়া শুনতে বলে। আমার ঠাকুমা শিখিয়েছিলেন পাখি গুনতে। ‘মনে-মনে ভাববি যে, মস্ত একটা খাঁচার মধ্যে হাজার খানেক পাখিকে আটকে রাখা হয়েছে। মনে-মনেই তুই সেই খাঁচার দরজাটা খুলে দিবি, তারপর দেখবি যে, একটার পর একটা পাখি সেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। তুইও অমনি গুনে যাবি এক….দুই…তিন…চার…।’ 

গুনতে গুনতে ঘুম এসে যায়। আজ কিন্তু এই ওষুধটা একেবারেই কাজ দিচ্ছিল না। যতবার পাখি শুনবার চেষ্টা করি, ততবারই সেই মনসামূর্তি আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। গ্রামদেশে আমি মনসাদেবীর যে মাটির প্রতিমা দেখেছি, তাতে তাঁর গায়ের রং হলুদ। কোথাও-কোথাও সেই হলুদের মধ্যে একটু লালের আভাস পাওয়া যায়। এ-মূর্তি সে-ক্ষেত্রে মাটির নয়, পাথরের। তাও কষ্টিপাথরের গাত্রবর্ণ তাই নিকষ কালো। কিন্তু সেই কালো কী আশ্চর্য কালো! কী উজ্জ্বল, কী লাবণ্যময়! চোখ আর ঠোঁটের হাসিটাই বা কী অসামান্য! স্নেহের সঙ্গে মিশেছে প্রশ্রয়; প্রশ্রয়ের সঙ্গে মিশেছে কৌতুক। চাপা সেই হাসির কথাটাই বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল আমার। 

ঘুম আসছিল না। পাশ ফিরে দেখলুম, ভাদুড়িমশাই তখনও শুয়ে পড়েননি। ওদিকের টেলিসে চুপচাপ কিছু পড়ছেন। পিঠ আমার দিকে, তাই কী পড়ছেন, ঠিক বুঝতে পারলুম না। সম্ভবত মহেশ্বর চৌধুরির সেই ডায়েরি। 

আমি যে ঘুমোইনি, ভাদুড়িমশাই সে-কথা বুঝতে পেরেছিলেন। পড়তে-পড়তেই জিজ্ঞেস করলেন, “ঘুম আসছে না বুঝি কিরণবাবু?” 

বললুম, “না।” 

“কী ভাবছেন এত?” 

“মূর্তিটির কথা। মন থেকে যেন মনসাদেবী কিছুতেই বিদায় দিতে চাইছেন না। ফলে ঘুমও আসছে না।” 

“খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।” চেয়ারটাকে ঘুরিয়ে বসলেন ভাদুড়িমশাই। মশারির জালির মধ্যে দিয়ে তাঁকে আবছা-আবছা দেখতে পাচ্ছিলুম। আলোটা এখন তাঁর পিছনে, তাই তাঁকে একটা সিলুয়েট ছবির মতো লাগছিল। মুখ-চোখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। মনে হল তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। সেইভাবেই বসে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, “কশ্যপ মুনির যিনি মানসী কন্যা, তাঁর ‘মনসা’ নামের তাৎপর্য কী, সেটা জানেন তো?” 

কন্ঠস্বরে যেন কিছুটা কৌতুক মেশানো রয়েছে। বললুম, “না।” 

“শাস্ত্রে বলেছে, মনুষ্যমনে তিনি ক্রীড়া করেন, তাই তাঁর নাম ‘মনসা’। আপাতত আপনার মনের উপরে তাঁর খেলা চলছে। খেলাটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনার ঘুম আসবে না।” 

ভাদুড়িমশাইয়ের কথা শুনে আমি আবার পাশ ফিরে শুয়ে চোখ বন্ধ করে পাখি গুনতে লাগলুম।

ঘুম এসেছিল একেবারে শেষ রাত্তিরে। তাও অতি গোলমেলে ঘুম। খুবই বিচ্ছিরি রকমের স্বপ্ন দেখেছিলুম। এমন স্বপ্ন, যার কোনও মাথামুন্ডু হয় না। স্বপ্নের মধ্যেই আমি ফিরে গিয়েছিলুম আমার ছেলেবেলায়। ‘লতা’ শব্দের তুর্থীর বহুবচন কী, সেটা বলতে পারিনি, তাই পন্ডিতমশাই একটা মস্ত বড় খাঁচার মধ্যে আমারে আটকে রেখেছেন, আর বেত উঁচিয়ে তাঁর নস্যিতে জড়ানো গলায় বললেন, ‘নর থেকে সাধু পর্যন্ত সকটা শব্দরূপ মুখস্থ বলা চাই, নইলে তোকে ছাড়ছি না।’ বলতে না বলতে এসে গেল কুচকুচে কানের এক মুশকো জোয়ান। হাতিবাগন বাজারের পাখিওয়ালা কালীচরণ। সে এসে এক ধাক্কা মেরে পন্ডিতমশাইকে হটিয়ে দিয়ে বলল, “না না, ওকে আটকে রাখা চলবে না। এতক্ষণ ও পাখি গুনছিল, এবার ও খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসুক, আমরাই ওকে গুনে ফেলব।’ বলেই সে খাঁচার দরজা খুলে দিয়ে গুনতে শুরু করল, ‘থ্রি… সিকস… নাইন… টুয়েলভ… ফিফটিন…. এইট্রিন… টুয়েন্টি!’ আমিও ততক্ষণে খাঁচা থেকে বেরিয়ে এসেছি। বেরিয়ে দেখি, কোথায় কালীচরণ, এ তো আমার ইস্কুলের বন্ধু পশুপতি, যার ডাকনাম বিল্টু। বিল্টু বলল, “পন্ডিতমশাই মারা গেছেন, তাই আজ ইস্কুল ছুটি, এখন আমরা মার্বল খেলব। আমি গিয়ে ভবানী আর বিষ্টুচরণকে ডেকে আনছি, তুই বরং গাব্বু খুঁড়ে রাখ।’ কিন্তু গাব্বুর জন্য যেই মাটি খুঁড়তে শুরু করেছি অমনি সেই গর্তের ভিতর থেকে একটা সাপ বেরিয়ে পড়ল। সাপটার মাথার উপরে কী যেন ঝকমক করছিল। পিছন থেকে কে যেন বলল, “ওটা সাতরাজার ধন মাণিক্য। আমি তো আছি, তবে আর তোর ভয় কী, ওটা তুলে নে।’ কিন্তু যেই না মণিটা তুলে নিয়ে আমার পকেটে পুরেছি, অমনি সামনের বাড়ির দরজা খুলে সত্যপ্রকাশবাবু বেরিয়ে এসে বললেন, “এই কী হচ্ছে, ওটা সাপের মাথার মণি নয়, আমার আংটির হিরে; দিয়ে দে বলছি. এক্ষুনি দিয়ে দে!’ আমি তো সত্যপ্রকাশবাবুকে দেখে অবাক। পাজামা পাঞ্জাবির বদলে তিনি একটা গেরুয়া আলখাল্লা পরেছেন, মাথার চুল জট পাকানো, হাতে একটা মস্ত ত্রিশূল। ‘কী হল, দিবি না? তবে দ্যাখ মজা!’ বলেই সেই ত্রিশূলটা আমার বুকের দিকে তাগ করে তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘জয় শঙ্কর।’

‘জয় শঙ্কর!’

বিকট একটা চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল। মড় করে বিছানার উপরে উঠে বসলুম আমি। প্রথমটায় কিছুই ঠাহর হল না। এমন কী, কোথায় এসে কার বিছানায় শুয়ে আছি, তাও না। একটু বাদেই মনে পড়ে গেল যে, এটা কলকাতা নয়, মুকুন্দপুর। 

ভাদুড়িমশাইয়ের টেবিলে তখনও আলো জ্বলছে। কিন্তু তাঁকে সেখানে দেখলুম না। কোথায় গেলেন তিনি? চাপা গলায় ডাকলুম, “ভাদুড়িমশাই।” 

ঘরের লাগোয়া বাথরুম। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে ভাদুড়িমশাই বললেন, “কী হল?”

“কিছু না। আপনি ঘুমোননি?” 

“ডায়েরি পড়ছিলুম। এমন চমৎকার লেখা যে, শোবার কথা মনেই ছিল না। এইমাত্র শেষ হয়েছে। বাথরুমে গিয়ে চোখমুখে একটু জলের ঝাপটা দিয়ে এলুম। কিন্তু আপনি উঠে পড়লেন কেন?” 

“একটা স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেল। বিচ্ছিরি স্বপ্ন। যেন সত্যপ্রকাশবাবু আমার বুকের উপরে ত্রিশূল উঁচিয়ে ধরে ‘জয় শঙ্কর’ বলে চেঁচাচ্ছেন।” 

ভাদুড়ি মশাই হেসে বললেন, “স্বপ্ন দেখেছেন ঠিকই, তাতে সত্যবাবুকে ত্রিশূল ধারণ করতেও হয়তো দেখে থাকতে পারেন, তবে চিৎকারটা স্বপ্নের ব্যাপার নয়।” 

“তার মানে?” 

“মানে এই যে ‘জয় শঙ্কর’ চিৎকারটা আমিও শুনেছি।” 

“কে চেঁচাল?” 

“সম্ভবত সত্যবাবুর সেই খুড়োমশাই।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “শেষ রাত্তিরে ঘুম থেকে উঠে দেবাদিদেব মহাদেবের জয়ধ্বনি দিচ্ছেন।” 

বলতে না বলতে আবার সেই পিলে কাঁপানো চিৎকার শোনা গেল: ‘জয় শঙ্কর, জয় শিবশম্ভু।’

ভাদুড়িমশাই বললেন, “রাত পুইয়ে এসেছে। চলুন, একটু হেঁটে আসা যাক।” 

ঘড়ি দেখে বললুম, “তা প্রায় পাঁচটা বাজে। আপনি একটু ঘুমিয়ে নেবেন না? আমি তবু ঘন্টা দুয়েক ঘুমিয়েছি, আপনার তো একটুও ঘুম হয়নি। একটু ঘুমিয়ে নিন মশাই, নইলে নির্ঘাত অসুস্থ হয়ে পড়বেন।” 

“পড়লেই হল?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “শরীরকে অত আশকরা দিতে নেই। একটা রাত্তির ঘুমোইনি তো কী হয়েছে। দুপুরে ঘন্টাখানেক ঘুমিয়ে নিলেই হবে। আপনিও তখন বাকি ঘুমটা পুষিয়ে নেবেন। চলুন এখন বেরিয়ে পড়ি।” 

অগত্যা উঠতেই হল। ঘরের সঙ্গেই অ্যাটাচ্‌ড্ বাথ। তাতে বিশাল বিশাল দুই ড্রাম জল ধরে রাখা হয়েছে। জলের কল নেই বটে, তবে বেসিন রয়েছে একটা। চটপট মুখহাত ধুয়ে, দাড়ি কামিয়ে গায়ে জাম্পার চড়িয়ে ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে চারদিকটা একটু ঘুরে দেখবার জন্যে বেরিয়ে পড়লুম। 

বাইরে তখনও আবছা অন্ধকার, ভাল করে আলো ফোটেনি, বাতাসে হালকা কুয়াশা। গাছের পাতা আর টিনের চাল থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় হিম গড়িয়ে পড়ছে। শিশিরে ভিজে রয়েছে পায়ের তলার মাটি আর ঘাস। পাখি ডাকছে, তবে মানুষজনের গলা কোথাও শোনা যাচ্ছে না। সাধুবাবা জেগেছেন ঠিকই, কিন্তু গোটা গ্রাম এখনও ঘুমে অচৈতন্য। 

যে-ঘরটায় আমাদের থাকতে দেওয়া হয়েছে, তার একদিকে ভিতরের উঠোন, আর অন্যদিকে বাইরের উঠোন। আমরা বাইরের দিকের দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছি। উত্তরে মন্দির। উঠোন পেরিয়ে আমরা মন্দিরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালুম। 

আমার কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্তু অস্বস্তিটা যে কীসের তা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলুম না। 

১১ 

কাল রাত্তিরে যখন আমরা শিলিগুড়ি থেকে মুকুন্দপুরে এসে পৌঁছই, অন্ধকারের মধ্যে তখন .কানও কিছু খুব ভাল করে দেখতে পাইনি। অন্ধকার অবশ্য এখনও পুরোপুরি কাটেনি, পুবের আকাশে সদ্য খানিকটা রক্তের ছোপ লেগেছে মাত্র। কিন্তু যে মন্দিরটির সামনে এসে আমরা দাঁড়িয়েছি, তার গঠনশৈলী যে কত সুন্দর, সূর্যোদয়ের ঠিক আগের মুহূর্তের এই কোমল আলোটুকুই তা যেন আরও স্পষ্ট করে আমাদের বুঝিয়ে দিল। 

মনসাদেবীর মূর্তিটি যতই প্রাচীন হোক, তাঁর এই মন্দির যে মোটেই পুরনো নয়, তা আমরা জানি। কতই বা বয়স হবে এর? মহেশ্বর চৌধুরি এখানে এসেইছিলেন তো ১৮৯১ সালে, আর এসেই নিশ্চয়ই এই মন্দির তোলেননি, সত্যপ্রকাশের কাছে যা শুনেছি তাতে মনে হয় মন্দির তুলবার মতো অবস্থাই তখন তাঁর ছিল না। যদি ধরে নিই যে, অবস্থা ফিরতে তা অন্তত বছর কুড়ি লেগেছিল, তো বুঝতে হবে ১৯১০ সালের আগে এ-মন্দির তৈরি হয়নি, সম্ভবত তারও পাঁচ-দশ বছর পরে তৈরি হয়ে থাকবে। 

চারু ভাদুড়ি বললেন, “এ যে তাক-লাগানো ব্যাপার মশাই!” 

আমি বললুম, “যা বলেছেন। মন্দিরটি যে এত সুন্দর তা তো ভাবতেই পারিনি।” 

“আমিও না। তবে কী জানেন,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “এমন এক-একটা ব্যাপার দেখছি মাঝে-মাঝেই ঘটে যায়! যেখানে যেটা দেখব বলে কল্পনাও করিনি, সেখানে হঠাৎ—বলা নেই কওয়া নেই—ঠিক সেটাই আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। গত মাসের গোড়ার দিকে একবার পুনে যেতে হয়েছিল…ওই আর কী, ব্ল্যাকমেলের একটা নোংরা কেস, সেই সূত্রেই যাওয়া…তা সেখানে একটা মস্ত সারপ্রাইজ।” 

“কী দেখলেন?” 

“সেও একটা মন্দির। শহরতলি এলাকায় ঘুরতে-ঘুরতে হঠাৎ চোখে পড়ে গেল। শহরতলি বলে যেন আবার ভাববেন না যে খুব খোলামেলা জায়গা; যেমন সব বড়-বড় শহর, তেমনি তাদের আউটস্কার্টগুলোও আজকাল সমান ঘিঞ্জি, ঘ্যাচবক্স-আর্কিটেকচারের দশতলা-বারোতলা সব পেল্লায়-পেল্লায় বাড়ি সেখানেও আকছার আজকাল চোখে পড়বে…তা তারই মধ্যেই হঠাৎ এককালি জমির উপর এই মন্দির দেখে তো আমি তাজ্জব। ছোট্ট মন্দির, কিন্তু কী যে সুন্দর মন্দির, সে আর কী বলব। যেমন চমৎকার তার গড়ন, তেমনি তার দেয়ালের আর পিলারের কাজ। চারদিকের ওইসব মনস্ট্রসিটির মধ্যে যে অমন একটা মন্দির থাকতে পারে, তা আমি কল্পনাও করিনি।” 

“কার মন্দির?” 

“লক্ষ্মী-ঠাকরুনের।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “বালাজি বিশ্বনাথের কথা মনে আছে তো?”

“পেশোয়া বালাজি বিশ্বনাথ?” 

“আরে হ্যাঁ মশাই, ওই যিনি শিবাজির নাতি শাহুর মন্ত্রী ছিলেন। তাঁরই অনুরোধে তাঁর এক জমিদার-বন্ধু নাকি এই মন্দিরটি তৈরি করিয়েছিলেন। শিবের ভক্ত হয়ে তিনি হঠাৎ লক্ষ্মীর মন্দির তৈরি করাতে বললেন কেন, তাই নিয়ে একটা গল্প শুনলুম।” 

গল্পটা শোনা হল না। ঘুম থেকে উঠবার পরে কেন যে অস্বস্তি বোধ করছিলুম, এতক্ষণে সেটা মনে পড়েছে। বললুম, “শিবের ভক্ত কেন লক্ষ্মীর মন্দির তৈরি করাতে বললেন, সেটা কোনও প্রশ্ন নয়, তার কারণ শিবের যিনি ভক্ত, লক্ষ্মীর ভক্ত হতেও তার কিছুমাত্র বাধা নেই, লক্ষ্মী তো শিবেরই মেয়ে। আসল প্রশ্নটা হচ্ছে, যাঁরা শিবের ভক্ত, তাঁরা মনসার উপরে খাপ্পা কি না।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “সব ভক্তই খাপ্পা কি না, তা আমার জানা নেই, তবে একজন খুবই খাপ্পা ছিলেন। বুঝতেই পারছেন, শিবের সেই ভক্তটি হচ্ছেন চাঁদ সদাগর। তাঁর কাছ থেকে পুজো আদায় করবার জন্যে মনসা কী না করেছেন! তাঁর নৌকো ডুবিয়েছেন, তাঁকে একেবারে পথের ভিখিরি বানিয়ে ছেড়েছেন, এমনকী বাপকে শায়েস্তা করবার জন্যে ছেলের প্রাণ সংহার করতেও ছাড়েননি। কিন্তু চাঁদের তবু ধনুর্ভঙ্গ পণ, কিছুতেই তিনি মনসার পুজো করবেন না। ‘মনসামঙ্গল’ পড়েছেন তো, সেখানে চাঁদ বলছেন, ‘যেই হাতে পূজি আমি শঙ্কর-ভবানী সেই হাতে পুজিব কি চ্যাংমুড়ি কানি?” আরে ছিছি, একটা কানিকে তিনি পুজো করবেন? কভি নেহি!” 

“মনসাকে তিনি কানি বলছেন কেন?” 

“বলছেন এইজন্য যে, চাঁদের কাছে মনসা তা মোটেই দেবী নন, নেহাতই সাপ!” 

“বেশ তো তা-ই না হয় হলেন, কিন্তু সাপকেই বা কানি বলবার মানে কী? সাপেরও তো দু’দুটো চোখ রয়েছে।” 

“ও, আপনি জানেন না বুঝি?” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “দু’দুটো চোখ আছে ঠিকই, কিন্তু আমরা যেমন কোনও কিছু দেখবার সময়ে দু’দুটো চোখকে একইসঙ্গে কাজে লাগাই, সাপ তা পারে না। সাপ যা-কিছু দেখুক, একচোখে দেখে। কখনও বাঁ চোখে দেখে কখনও ডান চোখে। একই সঙ্গে দু’ চোখে দেখে না। চাঁদ সদাগর যে মনসাকে কানি বলে গাল দিয়েছেন, সেটা এই জন্যেই।” 

“বুঝলুম। কিন্তু একা চাঁদ সদাগরই যে কেন মনসার সঙ্গে ঝগড়া করতে গিয়েছিলেন, সেইটে বুঝতে পারছি না। পুরনো আমলের গল্পে কি কবিতায় ঠিক এই রকমের আর-কোনও চরিত্রের কি উল্লেখ আছে?” 

“থাকতে পারে, আমি জানি না।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু ও-সব কথা থাক, মন্দিরটি ভাল করে দেখে নিন।” 

এ-শড়িতে শুধু এই মন্দিরটিই টাকা। দেওয়াল যেমন ইটের, তেমনি ছা হও ঢালাই। ছাতের উপরে ঢালা;-করা চুড়ো। দেওয়াল জুড়ে পোড়ামাটির কাজ। 

সূর্য উঠেছে। মন্দিরের গায়ে এসে পড়েছে তার প্রথম রশ্মি। সবকিছুই এখন পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছিল। 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “দেখুন দেখুন, একটু আগেই তো চাঁদসদাগরের কথা হচ্ছিল, মনসার সঙ্গে তাঁর যে বিরোধ, তারই কাহিনির নানান ঘটনাকে কী চমৎকারভাবে এখানে এই পোড়ামাটির কাজের মধ্যে ধরে রাখা হয়েছে।” 

মন্দিরটি বড় নয়, ছোট। দেওয়ালগুলোও অপরিসর। পোড়ামাটির স্ল্যাব বসাবার জন্যেও তাই ঢালাও জায়গা ছাড়া যায়নি। অথচ তারই মধ্যে দেখলুম বিস্তর ঘটনাকে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ছদ্মবেশে মনসার পুজো নেওয়া, জাহাজডুবি, লখিন্দরের বিয়ে, লোহার বাসরে সর্পদংশন, সমীর মৃতদেহ নিয়ে বেহুলার স্বর্গযাত্রা, লখিন্দরের আবার বেঁচে ওঠা, আর সর্বশেষে মনসার পূজায় চাঁদের সম্মাত, এই বড়-বড় ঘটনাগুলো তো আছেই, অনেক ছোটখাটো ঘটনাও বাদ পড়েনি। 

পোড়ামাটির কাজগুলো কে করেছেন তা জানি না, তবে কিনা যিনিই করে থাকুন, তিনি যে একজন উঁচু ধবের শিল্পী তাতে সন্দেহ নেই। অবশ্য যাঁরা বাঁশবেড়ের প্রাচীন মন্দিরের পোড়ামাটির কাজ দেখেছেন, তাঁরা হয়তো বলবেন, এ আর এমন কী। তা বলুন, কিন্তু আমার তো মনে হল, ইনি নেহাত কম যান না। 

ভাদুড়িমশাইকে সে-কথা বলতে তিনি বললেন, “অন্যান্য কাজও পাকা হাতের। যেমন মেঝের পাথরের কাজ, তেমনি পিলারের মোজাইক। চাঁদোয়ায় ঢাকা পড়েছে বলে সিলিংয়ের পঙ্কের কাজ অবশ্য সবটা এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু যেটুকু দেখতে পাচ্ছি, তাতেই বুঝতে পারছি যে, এই মন্দিরের জন্যে একেবারে এ-ওয়ান সব লোককে এখানে নিয়ে আসা হয়েছিল। পয়সা ঢালবার ব্যাপারে দেখছি মহেশ্বর চৌধুরি কিছুমাত্র কার্পণ্য করেননি।” 

মন্দিরের বারান্দার অংশ গি দিয়ে ঘেরা বটে, তবে বন্ধ নয়। জুতো খুলে বারান্দায় উঠে আমরা মেঝে, সিলিং, পিলার, পোড়ামাটির কাজ ইত্যাদির উপরে চোখ বুলিয়ে আবার উঠোনে নেমে এলুম। ভিতরের ঘরটা বন্ধ। দরজায় তা। ঝুলছে। তাই ভিতরে কী আছে, বোঝা গেল না। মূর্তিটি যে নেই, তা অবশ্য আমরা জানি। 

এ-বাড়িতে ইতিমধ্যে কাজের লোকজনেরা আসতে শুরু করেছে। রাত্তিরে যে ঘরে ছিলুম, সেই ঘরটাই দু’দিকে ভাগ করে রেখেছে ভিতরের উঠোন আর বাইরের উঠোনকে। ভিতরের উঠোন থেকে সেটা পুবদিকের ঘর, আবার বাইরের উঠোন থেকে পশ্চিম দিকের। বাইরের উঠোনের উত্তরে এই মন্দির। পুবে আর দক্ষিণে দুটি ঘর রয়েছে। পূবের ঘরে থাকে রামদাস আর দক্ষিণের ঘরে পুরোহিত গোবিন্দ ভট্টাচার্য। 

পুবের ঘর থেকে রামদাস বেরিয়ে এল। আমরা তার আগেই উঠে পড়েছি দেখে হন্তদন্ত হয়ে আমাদের কাছে এসে বলল, “বাবুরা কি অনেক আগেই উঠেছেন?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “এই তো খানিক আগে উঠলুম, বেশিক্ষণ হয়নি। তা তোমার নাতনির খবর কী?” 

“ওই একইরকম বাবু। কাউকে চিনতে পারছে না, কথাও বলছে না। 

“ওকে দেখছেন কে?” 

“হাসিমারার ডাক্তারবাবু। রোজ বিকেলে এসে দেখে যান। আজও আসবেন। …আপনাদের চা কি ঘরে দেব? বলেন তো এখানেই এনে দিই।” 

“এক্ষুনি চা খাব না। চারপাশে একবার চক্কর দিয়ে আসি। ফিরে এসে চা খাব।” 

মন্দিরের উত্তরে ফলের বাগান। ভেবেছিলুম বাগানের ভিতর দিয়ে ওদিকে বেরিয়ে যাব। কিন্তু তা আর সম্ভব হল না। 

বাগানটি অবশ্য এমনিতে বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। যাকে আন্ডারগ্রোথ বলে, বড়-বড় গাছের তলায় সেই ঘাস আর আগাছার জঙ্গল একেবারে নেই বললেই হয়। দেখলেই বোঝা যায় যে, বাগানের দেখাশোনা করবার দায়িত্ব যাকে দেওয়া হয়েছে, হয় সে নিজেই এর পিছনে বেশ খাটাখাটনি করে, নয়তো নিয়মিতভাবে লোক লাগিয়ে গোটা বাগানটা ফিটফাট করে রাখে। ভিতরে না ঢুকে কোমরসমান উঁচু বেড়ার এদিকে দাঁড়িয়ে বাগানটার উপরে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলুম আমরা। দেখলুম, নাম জাম সফেদা আর লিচুর সঙ্গে গুটিকয় কমলা আর বাতাবিলেবুর গাছও রয়েছে। একদিকে একটা কলাগাছের ঝাড়ও চোখে পড়ল। নারকেল আর সুপুরির সংখ্যাও নেহাত কম নয়। গাছগুলো যে উল্টোপাল্টা লাগানো হয়নি, সেটা বুঝতে মোটেই অসুবিধে হয় না। যিনিই করে থাকুন, সবটাই একেবারে প্ল্যান-মাফিক করেছিলেন। জঞ্জাল বলতে নেহাতই কিছু ঝরে যাওয়া পাতা এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। তা ছাড়া কোথাও এক-টুকরো ময়লা কাগজ পর্যন্ত নেই। সত্যি বলতে কী, নিজের উঠোনটুকু পর্যন্ত অনেকে এত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখে না। 

তবু যে আমরা বাগানে ঢুকলুম না, তার কারণ আর কিছুই নয়, কাদা। বেড়ার এ-পাশ থেকেই বোঝা গেল যে, বাগানের মধ্যে স্বচ্ছন্দে হাঁটাচলা করবার কোনও উপায় নেই। ক’দিন ধরে খুব বৃষ্টি হয়েছিল নিশ্চয়, বাগানের ভিতরকার পথটা তাই কাদায় পিছল হয়ে আছে। মাটি কোথাও শুকনো কিংবা শক্ত নয়। 

“অথচ মজা দেখুন।” ভাদুড়িমশাইকে বললুম, “বাগানের বাইরে এদিককার মাটি একেবারে খটখটে।” 

“তা তো হবেই।” 

গলাটা ভাদুড়িমশাই নয়, আর কারও। চমকে পিছনে তাকিয়ে দেখি, বুড়োমতন একজন ভদ্রলোক আমাদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। পরনে খাটো ধুতি, গায়ে মোটা খদ্দরের হাফ-হাতা পাঞ্জাবি, পায়ে ক্যাম্বিসের জুতো। সম্ভবত মন্দিরের পুবদিকের পথটা দিয়ে এসেছেন, তাই আমরা দেখতে পাইনি। ভদ্রলোক বললেন, “বাগানের মধ্যে বিস্তর গাছ-গাছালি রয়েছে তো, তাই খানিকটা আওতামতন হয়ে আছে, মাটি ততটা রোদ্দুর পায় না, তাই শুকোয়নি। এদিকের উঠোন সারাটা দিন রোদ্দুর পায়, তাই এদিকের মাটিও খটখটে। কিন্তু আপনাদের তো চিনলুম না। সত্যপ্রকাশের সঙ্গে এসেছেন বুঝি?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “হ্যাঁ। আমরা কলকাতার লোক। সত্যপ্রকাশবাবু অনেকক্ষন ধরেই আসতে বলেছিলেন, কিন্তু আমাদের আসা হচ্ছিল না। তাই এবারে ভাবলুম, দিন কয়েকের জন্যে ঘুরেই যাই।”

“ভাল সময়ে আসেননি।” ভদ্রলোক বললেন, “এ-বাড়ির মনসামূর্তি চুরি হয়ে গেছে, সক্কলের তাই মন খারাপ। সত্যপ্রকাশ বলেনি আপনাদের?” 

“হ্যাঁ, শুনেছি। ওঁকে তো আমরা আগে থাকতে জানিয়ে আসিনি, এখন এসে শুনছি এই ব্যাপার! আপনি বুঝি এখানেই থাকেন?” 

“হ্যাঁ, এখানেই এখন থাকি। আসলে আমি মুকুন্দপুরের লোক নই। আমার পৈতৃক ভিটে গয়েরকাটার কাছে একটা গ্রামে। কাঠের ঠিকেদারির কাজ নিয়ে এদিকে এসেছিলুম, তাতে সুবিধে না-হওয়ায় আলিপুরদুয়ারের একটা প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারির কাজে ভর্তি হয়ে যাই। সে কি আজকের কথা? রিটায়ারই তো করেছি তা প্রায় বছর পাঁচেক হল। ভেবেছিলুম এবারে গয়েরকাটায় ফিরে যাব, তা সত্যপ্রকাশই ফিরতে দিল না। বলল, মুকুন্দপুরে তো লেখাপড়া শেখাবার কোনও ব্যবস্থা নেই, আপনি বরং আমাদের পাঠশালাটার দায়িত্ব নিন। ব্যস্, আমিও রয়ে গেলুম। সত্যই পাঁচ কাঠা জমির উপরে দুখানা ঘর তুলে দিয়েছে। ছেলেপুলের ঝামেলা নেই, আমরা বুড়োবুড়ি সেখানে দিব্যি আছি।’ 

“আপনার পাঠশালা কখন বসবে?” 

“পাঠশালা এখন ছুটি। ভাইফোটার পরে খুলবে। চলুন, হাঁটতে-হাঁটতে কথা বলা যাক। মর্নিং ওয়াক হবে, সেই সঙ্গে গ্রামটাও আপনাদের দেখা হয়ে যাবে।” 

১২ 

মুকুন্দপুর গ্রামটা দেখলুম বড় নয়। বাড়ির সংখ্যা ষাট-সত্তরের বেশি হবে না। কিছু কমও ত পারে। বাসিন্দাদের পনেরো-আনাই কৃষিজীবী। কারও বা নিজের দু-পাঁচ বিঘে জমি আছে, কেউ বা অন্যের জমিতে চাষ করে, ফসলের একটা ভাগ পায়। গ্রামে অবশ্য ছোট একটা ডাকঘর আছে। একটা মাইনর স্কুলও থাকতে পারত। নেই। থাকবার মধ্যে আছে একটা পাঠশালা। 

পাঠশালা এখন বন্ধ। পুজোর ছুটি চলছে। টিনের চালওয়ালা লম্বাটে একটা ঘরের সামনে চৌকোনা একখানা ফলক আঁটা। কাঠের ফ্রেমে টিনের ফলক। তাতে লেখা রয়েছে অন্নপূর্ণা বিদ্যালয়’। শুনলুম, মহেশ্বর চৌধুরির স্ত্রীর নামে বছর পনেরো আগে এটি খোলা হয়েছিল। কিন্তু ছাত্রের অভাবে দু-তিন বছর পরেই বন্ধ হয়ে যায়। বছর পাঁচেক আগে সত্যপ্রকাশ এটিকে আবার নতুন করে চালু করছেন। মাস্টারমশাইটিও তখন থেকে এই মুকুন্দপুরে বাসিন্দা। 

ভদ্রলোকের নাম রঙ্গনাথ মজুমদার। এমন কিছু মানুষ আছেন, যাঁদের চোখ দেখলেই মনে হয় যে, ইনি একেবারে স্বচ্ছ চরিত্রের মানুষ, এঁর মনে কোনও কূটকাপট্য নেই। রঙ্গনাথকে দেখেও ঠিক সেইরকমেরই একজন মানুষ বলে মনে হয়। বর্ষার দিনে পুকুরে যেমন কালো মেঘের ছায়া পড়ে, রঙ্গনাথের চোখেও তেমনি একটা বিষাদের ছায়া আমি প্রথম থেকেই দেখতে পেয়েছিলুম। ভদ্রলোক যে হাসেন না, তা নয়, কিন্তু যখন হাসেন তখনও দেখলুম যে, সেই ছায়াটা পুরোপুরি সরে যায় না। পাঠশালা এখন কেমন চলছে; ভাদুড়িমশাইয়ের এই প্রশ্নের উত্তরে রঙ্গনাথ বললেন, “কই আর চলছে। সত্যপ্রকাশ তো নতুন করে আবার পাঠশালা চালু করল, সেই বাবদে খরচও করল নেহাত কম নয়। চাল ছিল খড়ের, সেখানে টিনের চাল হয়েছে, মেঝেটাও বেশ পোক্ত করে বাঁধিয়ে দিয়েছে, বইপত্তর কি খাতা-পেনসিলও কাউকে কিনতে হয় না, যার যা-কিছু দরকার, সত্যই সব কিনে দেয়, কিন্তু সবই আসলে ভস্মে ঘি ঢালার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।” 

“এ-কথা বলছেন কেন?” 

“বড় দুঃখে বলছি। গ্রামের ছেলেপুলেরা এসে ভর্তি হয় ঠিকই, কিন্তু দু’চার দিন বাদে তাদের বেশির ভাগই পালিয়ে যায়। একে তো মাইনে দিতে হয় না, ফ্রি ইস্কুল, তায় তাদের বইপত্রের খরচও অন্যে জোগাচ্ছে, তবু থাকে না।” 

“থাকে না কেন?”

“কী করে থাকবে?” ক্লিষ্ট হেসে রঙ্গনাথ বললেন, “পাঠশালার নামটা কী, সেটা দেখেছেন তো? অন্নপূর্ণা বিদ্যালয়। অর্থাৎ কিনা আগে অন্ন, তারপর বিদ্যা। তা মশাই, অন্নচিন্তা চমৎকারা। সেই চিন্তাতেই যারা অস্থির হয়ে রয়েছে, সেই পরিবারের ছেলেপুলেরা আর বিদ্যার পিছনে ব্যয় করবার শতো সময় কোথায় পাবে 

“বাচ্চারাও সময় পায় না?” 

“তারাও পায় না। পাঠশালা তো বসে সকালবেলায়। বড়রা তখন মাঠে। সেখানে তারা মুগুর দিয়ে পিটিয়ে শক্ত ঢেলামাটি গুঁড়ো করছে, কি লাঙল টানছে, কি বীজ বুনছে, কি ফসল কাটছে। সেইখানে তাদের সকালের ভাতটা পৌঁছে দেওয়া চাই তো। কে আর দেবে? আমার ছাত্রদেরই তাই নামতার ক্লাসে না-এসে বাবা-কাকার ভাত নিয়ে মাঠে দৌড়োতে হয়।” 

হাঁটতে-হাঁটতে কথা বলছিলেন রঙ্গনাথ। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে ফের সেই একই রকমের ক্লিষ্ট গলায় বললেন, “তার উপরে আছে ভাগ-রাখালি।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “সেটা আবার কী বস্তু?” 

রঙ্গনাথ বললেন, “আপনারা শহরে থাকেন তো, তাই শুধু ভাগচাষের কথাটাই আপনাদের কানে গিয়ে পৌঁছয়। তাও পৌঁছত না, যদি না আজকাল ভাগচাষ নিয়ে এত ফৈজত লেগে থাকত। আসলে ভাগ-রাখালিও ভাগেরই ব্যাপার। তফাত শুধু এই যে, এটা ফসলের ভাগ নয়, দুধের ভাগ।” 

“তার মানে?” 

“মানে আর কী, ধরুন আপনার গোরু কিনবার পয়সা আছে, কিন্তু গোরু চরাবার কি তার পরিচর্যা করবার সময় নেই। তখন আপনি কী করবেন? না গোরুটা আপনি এমন-কাউকে রাখতে দেবেন, যার গোরু কেনবার পয়সা নেই, কিন্তু গোরু চরাবার সময় আছে। সে আপনার গোরু চরাবে, তার পরিচর্যা করবে, তারপর সকালবেলায় গোরু দুইয়ে যে দুধ পাবে, তার অর্ধেকটা নিজে রেখে বাকি অর্ধেকটা আপনাকে দিয়ে আসবে। ওই যে অর্ধেকটা নিজে রাখল, তাও যে তার পেটে যাবে, তা নয়, সেটুকুও সে আর-কাউকে বেচে দেবে। তা নইলে সে চাল কিনবে কী দিয়ে? কিন্তু সে-কথা থাক। যা বলছিলাম, সেই কথা বলি। গ্রামদেশে এই ভাগ-রাখালির কাজটা সাধারণত সাত-আট বছরের বাচ্চারাই করে। তা এত সব খাটা াটনি করে আর লেখাপড়া করবার সময় তারা কোত্থেকে পাবে?” 

হাসিমারার কাছে হাইওয়ে থেকে বাঁ দিকে মোড় নিয়ে যে সরু রাস্তা ধরে কাল রাত্তিরে আমরা মুকুন্দপুরে এসে পৌঁছেছিলুম, সরু হলেও সেটা পিচ দিয়ে বাঁধানো। রাত্তিরে ঠিক ঠাহর হয়নি, এখন সকালবেলায় বোঝা গেল যে, মুকুন্দপুরকে পুব আর পশ্চিম, এই দুটো পাড়ায় ভাগ করে দিয়ে সেই রাস্তাটা সোজা উত্তরে চলে গিয়েছে। 

উত্তরে কোন পর্যন্ত গিয়েছে, জিজ্ঞেস করতে রঙ্গনাথ বললেন, “কথা তো ছিল যে, দমনপুর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যে-পথটা ভুটানের দিকে চলে গিয়েছে, এটাকে টেনে নিয়ে তার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু সে তো এখানে আসবার পর থেকেই শুনছি, কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। খানিকটা এগোলেই দেখবেন যে, পিচ নেই, থাকবার মধ্যে আছে খোয়া, তারপরে সেই খোয়াও নেই। স্রেফ কাঁচা রাস্তা। কে যেন একটা মামলা ঠুকে দিয়েছিল। ব্যস্, বছরের পর বছর সেই মামলা চলছে, রাস্তার কাজ বন্ধ।” 

বললুম, “মাঝে-মাঝে তো ট্রাক চলতে দেখছি। ওগুলো আসছে কোত্থেকে? এদিকে যাচ্ছেই বা কোথায়?” 

রঙ্গনাথ বললেন, “ওগুলো দূরপাল্লার ট্রাক নয়। কাছেই একটা শালজঙ্গলের ইজারা নিয়ে ঠিকেদাররা গাছ কাটছে, তারপর ট্রাক বোঝাই করে কাঠ চালান দিচ্ছে শিলিগুড়িতে। জঙ্গল তো প্রায় সাফ হয়ে গেল, শুনছি ডিসেম্বর নাগাদ ঠিকেদারদের কাজ ফুরোবে। তারপর যতদিন না আবার নতুন করে কাছেপিঠে কোনও জঙ্গল সাফ করা হয়, ততদিন আর এই রাস্তায় ট্রাক দেখা যাবে না।” 

গল্প করতে করতে আমরা রঙ্গনা নবাবুর বাড়িতে চলে এসেছিলুম। বাড়ির দাওয়ার একটা বাদুর বিছিয়ে দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, “বসুন। একটু চা করি।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “না না, চায়ের জন্য ব্যস্ত হবেন না।” 

রঙ্গনাথ হেসে বললেন, “আরে মশাই, চা আমিও খাব। আপনারা বসে গল্প করুন, শামি এক্ষুনি আসছি।” বলে তিনি উঠোন পেরিয়ে রান্নাঘরের মধ্যে ঢুকে গেলেন। 

বাড়িটি ছোট, কিন্তু পরিচ্ছন্ন। ঘর মাত্র দুটি। একটি শোবার, একটি রান্নার। দুই ঘরের মধ্যে উঠোন। উঠোনের একদিকে লাউমাচা। মাচার পাশে দুটি পেঁপেগাছ। অন্যদিকে ফুলবাগান। বেশির ভাগই গোলাপ। কিছু বেলফুলের চারাও রয়েছে। আর রয়েছে লতানে জুঁই। রান্নাঘরের চালে একটি চালকুমড়োও দেখা গেল। 

রঙ্গনাথ রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। হাতে কাঁসার থালা। তার উপরে কাচের গেলাসে চা। আমরা দুটো গেলাস তুলে নিলুম। রঙ্গনাথ বললেন, “আমার গিন্নিকে চা দিয়ে এক্ষুনি আসছি।” ঘরে ঢুকে চা দিয়ে বেরিয়ে এসে আমাদের পাশে বসে নিজের গেলাসটা তুলে নিয়ে বললেন, “চায়ের সঙ্গে কিছু দিতে পারলুম না। কী করেই বা দেব। ভদ্রমহিলা বাতের ব্যথায় শয্যাশায়ী। আজ একাদশী তো, ব্যথাটা বেড়েছে। নড়তে পারছেন না।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “একটা কথা জিজ্ঞেস করি, কিছু মনে করবেন না তো?” 

রঙ্গনাথ হেসে বললেন, “কিন্তু-কিন্তু করছেন কেন? আমরা গ্রামের মানুষ, অত মনে-করাকরির ব্যামোতে ভুগি না। কী জিজ্ঞেস করবেন করুন, উত্তরটা দিতে পারলে দেব, না দিতে পারলে দেব না, ব্যস্।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “সত্যপ্রকাশবাবুদের মনসামূর্তি যে চুরি হয়ে গিয়েছে, তা আমরা জানতুম না, এখানে এসে শুনছি। শুনে অবধি ভাবছি যে, এ-কাজ কে করতে পারে। তা আপনার কাউকে সন্দেহ হয়?” 

“কাউকে মানে এই গ্রামের কাউকে? 

“হ্যাঁ।” 

“গাঁয়ের লোক এ-কাজ করবে কেন?” 

“টাকার জন্যে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “জানেন তো, এখানে-ওখানে বিস্তর মূর্তি চুরি করে আজকাল বিদেশিদের কাছে বেচে দেওয়া হচ্ছে, আর তার জন্যে টাকাও পাওয়া যাচ্ছে বিস্তর।” 

চায়ের গেলাসে শেষ চুমুক দিয়ে গেলাসটা নামিয়ে রাখলেন রঙ্গনাথ। তারপর বললেন, “কাগজে এইরকম খবর দেখেছি বটে। কিন্তু এ-গাঁয়ের লোকদের তো দেখছেন, খবরের কাগজ পড়বার মতন বিদ্যে এদের নেই। সুতরাং মূর্তিও যে বিক্রি করা যায়, আর দামও পাওয়া যায় প্রচুর, তা এদের জানবার কথা নয়।” 

“বাইরের লোক এসে এদের জানাতে পারে।” 

“তেমন কোনও লোক এলে নিশ্চয় দেখতে পেতুম। কিন্তু কই, দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না।” 

“সত্যপ্রকাশবাবুর খুড়োমশাইটি তো এক হিসেবে বাইরের লোক।” 

“খুড়োমশাই?” অবাক হয়ে কিছুক্ষণ ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন রঙ্গনাথ। তারপর বললেন, “মানে ওই সাধুবাবা?” 

“হ্যাঁ। তা ‘খুড়োমশাই’ শুনে অবাক হয়ে গেলেন কেন?” ভাদুড়িমশাই লিলেন, “উনি যে সত্যপ্রকাশের সেই হারিয়ে-যাওয়া কাকা চিত্তপ্রকাশ, তা নিয়ে আপনার সন্দেহ আছে নাকি?” 

আচমকা এই রকমের একটা প্রশ্ন করা হবে তাঁকে, বঙ্গনাথ সম্ভবত তা আঁচ করতে পারেননি। অন্তত আমার মনে হল, ধীরস্থির ঠান্ডা স্বভাবের মানুষটি যেন হঠাৎ একটু সংকুচিত হয়ে পড়েছেন। কুণ্ঠিত গলায় বললেন, “না না, আমার কেন সন্দেহ থাকবে? আমি তো ওঁর ছেলেবেলায় ওঁকে দেখিইনি, তাই সন্দেহ থাকা না-একার কোনও প্রশ্নই আমার ক্ষেত্রে, উঠছে না। আর তা ছাড়া সত্যপ্রকাশের আমি আশ্রিত, সে যখন তার কাকা বলে সাধুবাবাকে মেনে নিয়েছে, তখন সেটাই তো আমার পক্ষে যথেষ্ট।” 

ব্যাপারটা এখানেই মিটে যেতে পারত। ভাদুড়িমশাই কিন্তু মিটে যেতে দিলেন না। বললেন, “চিত্তপ্রকাশের ছেলেবেলায় আপনি তাঁকে না-দেখে থাকতে পারেন, কিন্তু এই গ্রামের বেউ-কেউ দেখেছেন নিশ্চয়? মানে যারা বুড়োমানুষ, তাদের কথা বলছি। তাদের কারও মনে সন্দেহ নেই?” 

“এ-সব কথা না উঠলেই ভাল ছিল।” রঙ্গনাথ বললেন, “কিন্তু যখন উঠেছেই, আর আপনারা যখন সত্যপ্রকাশের বন্ধু, তার ভালই চান, তখন বোধহয় বলা-ই ভাল। হ্যাঁ, সন্দেহ তো আছেই, রাগও আছে। রাগ অবশ্য শুধু বুড়োদের নয়, বলতে গেলে প্রায় সকলেরই।” 

“রাগ কেন?” 

“বাঃ, রাগ হবে না? আপনি যাঁকে দেবতা বলে মানেন, যাঁকে পুজো করেন, যিনি আপনাকে বিপদ-আপদ থেকে বাঁচাচ্ছেন বলে আপনি বিশ্বাস করেন, কেউ তাঁর নিন্দেমন্দ করলে আপনার রাগ হবে না?” 

“সাধুবাবা আপনাদের মনসাদেবীর খুব নিন্দেমন্দ করছেন বুঝি?” 

“অতি বিচ্ছিরি ভাষায় করছেন,” রঙ্গনাথ বললেন, “তার উপরে আবার সেটা করছেন একেবারে প্রকাশ্যে। ত্রিশূল উঁচিয়ে গাঁয়ের এ-মুড়ো থেকে ও-মুড়ো পর্যন্ত চেঁচিয়ে বলে বেড়াচ্ছেন যে, ব্যাঙখেকো কানিটা বিদেয় হয়েছে, বাঁচা গেছে। ফের যদি ফিরে আসে তো ত্রিশূল দিয়ে তিনি ওটাকে গেঁথে ফেলবেন।” 

“ওরেব্বাবা,” আমি বললুম, “এ তো খুবই ভয়ঙ্কর ব্যাপার!” 

“তা তো বটেই, কিন্তু আসল ভয় তো সেখানে নয়,” রঙ্গনাথ বললেন, “ভয়টা এইখানে যে, ব্যাপারটা এখন গ্রামের লোকদেরও সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে।” 

একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন রঙ্গনাথ। তারপর নিচু গলায় বললেন, “যা বুঝতে পারছি, একটা খুনোখুনি হয়ে যাওয়াও কিছু বিচিত্র নয়।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বটে? তা সত্যপ্রকাশবাবুকে কথাটা আপনি বলছেন না কেন? ব্যাপারটা যে এতদূর গড়িয়েছে, এটা জানলে তিনি হয়তো তাঁর খুড়োমশাইকে একটু সাবধান করে দিতে পারেন।” 

রঙ্গনাথ আবার সেই কুণ্ঠিত গলায় বললেন, “সত্য আমাকে শ্রদ্ধাভক্তি করে ঠিকই, কিন্তু আমি তো ওর মাইনে খাই, সেদিক থেকে আমি ওর কর্মচারী। বুঝতেই পারছেন, কর্মচারী হয়ে মনিবকে তার কাকার বিরুদ্ধে কিছু বলা আমার শোভা পায় না।” 

কথা আর এগোল না, কেননা বছর চল্লিশেক বয়সের একটি বউ এই সময়ে রঙ্গনাথের বাড়িতে এসে ঢুকল। ঢুকে আমাদের দেখে হকচকিয়ে গেল একটু। তারপর ঘোমটা টেনে রঙ্গনাথকে বলল, “ঠানদি’র সঙ্গে একটা কথা ছিল। তিনি কোথায়?” 

রঙ্গনাথ বললেন, “ঠানদি আজ আর উঠতে পারছেন না, শুয়ে আছেন।” 

বউটি গিয়ে ঘরে ঢুকল। কিছু একটা কথা বলল রঙ্গনাথের স্ত্রীকে। তারপর ঘোমটা টানা অবস্থাতেই ঘরের চৌকাঠ পর্যন্ত এগিয়ে এসে রঙ্গনাথকে বলল, “ঠানদি আপনাকে ডাকছেন।” 

রঙ্গনাথ আমাদের বললেন, “গাঁয়ের লোকেরা আপদে-বিপদে আমাদের কাছে পরামর্শ চাইতে আসে। এরও কোনও সমস্যা হয়েছে নিশ্চয়। আপনারা একটু বসুন। আমি এখুনি আসছি।” 

রঙ্গনাথ ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলেন। 

ঘরের মধ্যে নিচু গলায় কথা হচ্ছিল। কিন্তু এতটা নিচু গলায় নয় যে, একেবারেই শোনা যাবে না।

মিনিট তিন-চার বাদেই রঙ্গনাথ বেরিয়ে এলেন। বললেন, “অনর্থক আপনাদের বসিয়ে রাখলুম। বউটির সঙ্গে আমাকে একবার ওদের বাড়িতে যেতে হবে।” 

আমরাও উঠে পড়েছিলুম। ভাদুড়িমশাই বলঢ়োন, “অনেক বেলা হল। ত্যপ্রকাশবাবু হয়তো আমাদের অপেক্ষায় রয়েছেন। আমরাও চাল রঙ্গনাথবাবু। পরে আবার কথা হবে।” 

বাড়ির বাইরে এসে ভাদুড়িমশাই বললেন, “ঘরের মধ্যে কী কথা হচ্ছিল, শুনলেন কিছু?”

বললুম, “সবটা শুনিনি। তবে শেষের দিকে রঙ্গনাথ যা বললেন, সেটা শুনেছি।” 

“কী বললেন?” 

“বললেন, ‘যেখান থেকে নিয়ে এসেছ, সেইখানেই আবার রেখে এসো।’ তারপরেই উনি মর থেকে বেরিয়ে এলেন।” 

“কথাটার মানে কিছু বুঝতে পারছেন?” 

বললুম, “ঠিক যে বুঝতে পারছি তা নয়, তবে আন্দাজ করতে পারছি।” 

ভাদুড়িমশাই তাঁর তালুতে জিভ ঠেকিয়ে আক্ষেপের শব্দ করে বললেন, “সবটাই শোনার দরকার ছিল। তা হলে আর আন্দাজ করতে হত না, স্পষ্ট বুঝতে পারতেন।” 

১৩ 

রোদ্দুর এখন আর তত মোলায়েম নয়, আস্তে-আস্তে তেতে উঠছে। জাম্পারটা পরে থাকায় একটু যেন অস্বস্তি হচ্ছিল, রঙ্গনাথের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সেটা খুলে ফেললুম। 

আটটা বাজে। সকালে স্রেফ এক গেলাস চা ছাড়া আর কিছুই পেটে পড়েনি। একটু-একটু খিদে পাচ্ছিল। খিদের কথাটা ভাদুড়িমশাইকে জানাতে তিনি বললেন, “এ তো মহা মুশকিলে পড়া গেল, গ্রামটা আর-একটু ঘুরে দেখব না?” 

বললুম, “আপনি ঘুরে দেখুন, আমার খিদে পেয়েছে, কিছু খাওয়া দরকার, আমি ফিরে যাচ্ছি।”

“ফিরলেই কি আর ব্রেকফাস্ট মিলবে? কাল অত রাত্তিরে শোওয়া হল, সত্যপ্রকাশের ঘুম সম্ভবত ন’টা-দশটার আগে ভাঙবে না।” 

“সত্যপ্রকাশের ঘুম ভাঙবার দরকার কী, কাল শিলিগুড়ি থেকে বিশাল এক প্যাকেট ক্ষীরের শিঙাড়া আনা হল, তার উপরে আবার ময়নাগুড়ি থেকে এক হাঁড়ি রসগোল্লা। তার সবই নিশ্চয় সাবাড় হয়ে যায়নি। রামদাসকে ডেকে বলব, ‘ভাঁড়ার-ঘরসে আভি চার-পাঁচঠো সামোসা অওর রসগুল্লা লে আও।’ তাতে কাজ হবে না?” 

“একশোবার হবে,” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “তবে হিন্দির বদলে বাংলায় বললে কাজটা আরও সহজে হবে। রামদাস যে বাঙালি, সেটা ভুলে যাচ্ছেন কেন?”

“ঠিক আছে, তা হলে বরং বাংলাতেই বলব।” 

“আমার মতে অবশ্য বাংলায় বলারও দরকার নেই,” ভাদুড়িমশাই তাঁর পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা চকোলেট-স্ল্যাব বার করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “আপাতত এইটে দিয়েই পিত্তরক্ষা রুন।” 

“তা নয় করলুম, কিন্তু এখন আর ঘোরাঘুরি করতে পারব না।” 

“ঠিক আছে, ঘোরাঘুরি করব না, তবে কিনা বাড়িতে গিয়ে ঢুকবার আগে একবার ফলের বাগানে ঢুঁ মারব :” 

“ফলের বাগানে কেন?” 

“আরে মশাই, ফল খাবার জন্যে নয়।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “ফল খেতে হয় তো সত্যপ্রকাশ খাবেন, আমার যে শুধু কর্মেই অধিকার. মা ফলেষু কদাচন, তা কি আর আমি জানি না?” 

“ঠাট্টা ছাড়ুন, ফলের বাগানে যাব কেন?” 

“বা রে, সাধুবাবার কথা ভুলে গেলেন? ওই বাগানেরই তো এক ধারে তাঁর আখড়া! চলুন, তাঁর সঙ্গে একবার দেখা কার দরকার। 

বেলা বেড়েছে। পথঘাট এখন আর নির্জন নয়। লোকজন হাঁটাচলা করছে। সবাই স্থানীয় লোক। আমাদের দেখে যেভাবে তারা দাঁড়িয়ে পড়ছিল, তারপর হাঁ করে তাকিয়ে থাকছিল আমাদের দিকে, ভাতে মনে হল যে, গ্রামের পথে হঠাৎ দুজন অপরিচিত মানুষকে দেখে”,তারা একেবারে অবাক হয়ে গেছে। 

বললুম, “মুকুন্দপুরে বোধহয় বাইরের লোকের দেশ। বিশেষ মেলে না।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা কেন হবে? একে তো এই গ্রামটা হাইওয়ে থেকে খুব দূরে নয়, তার উপরে আবার, যতই সরু হোক, হাইওয়ে থেকে একটা পিচের রাস্তাও এই গাঁয়ের ভিতর দিয়ে চলে গেছে। তা ছাড়া ভাবুন, যেমন হাসিমারা তেমনি আলিপুরদুয়ারেও আপনি চট্ করে এখান থেকে পৌঁছে যেতে পারছেন। অর্থাৎ কিনা গ্রাম হিসেবে মুকুন্দপুর খুবই ছোট হতে পারে, তবে ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ইন দা মিড্ল অব নোহোয়্যার’, ঠিক সেই রকমের জায়গা এটাকে বলা যাচ্ছে না। বাইরের জগতের সঙ্গে এর যোগাযোগ রয়েছে, আর সেটা যখন রয়েছে, তখন নানা ধান্ধায় সেখান থেকে কিছু-না-কিছু লোকও এখানে মাঝেমধ্যে আসে নিশ্চয়।” 

“তা যদি আসে, তবে এখানকার জিনিসেরই বা বাইরে যাওয়া বিচিত্র কী!” 

“যেতেই পারে। যারা আসে, তারা সবাই কি একেবারে খাঁটি সাধুপুরুষ? তা তো আর বলা যাচ্ছে না। নকল থাকে তাদের মধ্যেও।” 

শুনে আমি চমকে উঠলুম। ভাদুড়িমশাই কি তা হলে সত্যপ্রকাশের খুড়োমশাইকে সন্দেহ করছেন? রঙ্গনাথের যে-কথাটা আমি আচমকা শুনে ফেলেছি, তাতে তো আমার অন্য রকম সন্দেহ হয়েছিল।

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কী হল, সাধুদের মধ্যেও যে কিছু-না-কিছু ঝুটো মাল থাকে, এই কথাটা শুনে চমকে গেলেন বুঝি?” 

বললুম, “অত আভাসে-ইঙ্গিতে কথা বলছেন কেন? খোলাখুলি বলুন তো, মুর্তি-চুরির ব্যাপারে কি চিত্তপ্রকাশকে আপনি সন্দেহ করছেন?” 

“করাই তো স্বাভাবিক।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “মনসার উপরে উনি যে-রকম খাপ্পা, তাতে পুজোটা বন্ধ করবার জন্যে মুর্তি যদি উনি সরিয়ে থাকেন, তাতে অবাক হবার কিছু নেই। কিন্তু না, এখনও আমি তেমন-কোনও সন্দেহ করছি না।” 

“কেন করছেন না?” 

“এই জন্যে করছি না যে, মনসার উপরে ওঁর বিদ্বেষের কথাটা তা হলে উনি আর ফলাও করে বলে বেড়াতেন না। বরং এমন একটা ভাব দেখাতেন যে, মনসা-মুর্তি চুরি যাওয়ায় আর-সকলের মতো উনিও ভীষণ মুষড়ে পড়েছেন। …তবে কিনা এরও একটা অন্য ব্যাখ্যা সম্ভব।” 

“সেটা কী?” 

“বুঝলেন না? এই যে উনি মনসাকে গালাগাল করে বলে বেড়াচ্ছেন যে, মূর্তিটা বিদেয় হওয়ায় বাঁচা গেছে, এটাই হয়তো ওঁর মস্ত চালাকি। অর্থাৎ উনি ভাবছেন যে…কী ভাবছেন বলুন তো কিরণবাবু?” 

“ভাবছেন যে, এইভাবে গালমন্দ করলে লোকে চটবে বটে, কিন্তু ওঁকে মুর্তি-চোর বলে সন্দেহ করবে না। এই তো?” 

“ঠিক বলেছেন! একেবারে দশে দশ, ফুল মার্কস! … ব্যাপারটা তা হলে কী দাঁড়াল কিরণবাবু? “

“এই দাঁড়াল যে, সাধুবাবাকে এখনই আপনি মূর্তি-চোর বলে ভাবছেন না, আবার ওঁর অ্যাটি-মনসা হল্লা যে একটা চালাকির ব্যাপার হতে পারে, এই সম্ভাবনাটাকেও আপনি হিসেবের মধ্যে রাখনে। কেমন, ঠিক বলেছি?” 

“অ্যাবসলিউটলি।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “আরও ঠিক কবে বলতে গেলে বলতে হয় যে, কাউকেই যেমন আমি চোর ভাবছি না, তেমনি কাউকেই আমি সাধুও ভাবছি না। এমন কী, সাধুবাবাকেও না। আই অ্যাম জাস্ট কিপিং মাই মাইন্ড ওপ্‌ন।” 

কথা বলতে-বলতে আমরা বাগানের ধারে পৌঁছে গিয়েছিলুম। বাগানের এটা উত্তর দিক। কিছুটা কাদামাটি না-মাড়িয়ে বাগানের মধ্যে চলাফেলা করা শক্ত হবে, সে-কথা আগেই বলেছি। দিন কয়েক আগে খুব বৃষ্টি হয়েছিল নিশ্চয়, মাটি এখনও পুরোপুরি শুকোয়নি। তবে চারপাশে একটু নজর করে দেখে এখন মনে হল যে, পুব দিক থেকে যদি বাগানে ঢুকি, পায়ে কাদা না-লাগিয়েও তা হলে সাধুবাবার ডেরায় পৌঁছনো হয়তো অসম্ভব হবে না। উত্তর দিকে থেকে খানিকটা ঘুরে তাই পুবদিকে চলে এলুম। এ দিক থেকে পঁচিশ-তিরিশ পা হাঁটলেই সাধুবাবার চালাঘর। 

কিন্তু পাঁচ-পা হাঁটবারও দরকার হল না। মাটির দিকে চোখ রেখে, কাদা বাঁচিয়ে, অতি সন্তপর্ণে দু-তিন পা এগিয়েছি মাত্র, হঠাৎ সেই হুঙ্কার শোনা গেল : জয় শিবশম্ভো, জয় শঙ্কর! 

বুকটা যে ধড়াস করে উঠেছিল, সে-কথা স্বীকার করাই ভাল! 

সেকালের ডাকাতরা শুনেছি হাঁড়ির মধ্যে মুখ রেখে এমন বিকট আওয়াজ ছাড়ত যে, বনের বাঘও সেই হাঁকার শুনে পালাবার পথ খুঁজে পেত না। এও বলতে গেলে প্রায় সেই রকমেই পিলে চমকানো ব্যাপার। 

মুখ ফিরিয়ে দেখি, সাধুবাবা আমাদের পিছনেই দাঁড়িয়ে আছেন। পায়ে খরম, জট পাকানো চুল মাথার উপরে চুড়ো করে বাঁধা, বুকের উপরে নেমে এসেছে ধপধপে সাদা দাড়ি, হাতে ত্রিশূল। 

শেষ-রাত্তিরে প্রথম যখন তাঁর হাঁকার শুনি, তখন আমার স্বপ্নের সঙ্গে ব্যাপারটা একেবারে তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল। পরে অবশ্য ভাদুড়িমশাইয়ের কথা শুনে বুঝতে পারি যে, ওটা স্বপ্নের মধ্যে শুনিনি, সত্যপ্রকাশের খুড়োমশাই আসলে তাঁর আরাধ্য দেবতার জয়ধ্বনি দিচ্ছেন। তখন মনে হয়েছিল, বাপ রে, এমন যাঁর গলার জোর, সেই মানুষটি একজন দশাসই পুরুষ না হয়ে যান না। 

এখন কিন্তু দেখলুম যে, মানুষটি মোটেই লম্বাচওড়া নন। রোগাপাতলা শরীর, কপালের উপর মস্ত একটা কাটা দাগ, চোখ দুটি গর্তে বসা। দৃষ্টি অবশ্য ভীষণ ধারালো। হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন গর্তের ভিতর থেকে জ্বলন্ত দুটো কাঠকয়লা আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কখন কোথা থেকে এই মানুষটি যে হঠাৎ আমাদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন, আমরা তা বুঝতেই পারিনি। 

কিছু একটা বলতে হয় বলেই ভাদুড়িমশাই বললেন, “নমস্কার।” 

সাধুবাবা যে তাঁর কথা শুনতে পেয়েছেন, এমন মনে হল না। সত্যি বলতে কী, একেবারে অচেনা দুজন মানুষ যে তাঁদের বাগানের মধ্যে তাঁর ডেরার কাছে এসে ঢুকেছে, এই ব্যাপারটাকেও যেন গ্রাহ্যই করলেন না তিনি। জ্বলন্ত চোখে খানিকক্ষণ আমাদের দিকে তাকিয়ে থেকে তাঁর চালাঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। 

নিচু গলায় ভাদুড়িমশাইকে বললুম, “এই রকম টিংটিঙে লোকের ওই রকম বাজখাঁই গলা?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “এ তো দেখছি বেবি-অস্টিনের মধ্যে একেবারে মিলিটারি ট্রাকের হর্ন বসিয়ে নিয়েছে।” 

“চোখ দুটো দেখলেন? বাপ্ রে, ওই চোখে যদি আর কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেন তো নির্ঘাত আমরা ভস্ম হয়ে যেতুম। চলুন, কেটে পড়ি।” 

“কেটে পড়ব কেন?” চারু ভাদুড়ি বললেন, “এসেছি যখন, তখন কথা না-বলে যাব না।”

সাধুবাবা ইতিমধ্যে তাঁর চালাঘরের একেবারে সামনে গিয়ে পৌঁছেছিলেন। অতদূর থেকে আমাদের কথাবার্তা কারও পক্ষে শোনা সম্ভব নয়। তা ছাড়া আমরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিলুম, তাও খুব চাপা গলায়। অথচ, তাজ্জব ব্যাপার, ঘরের মধ্যে না ঢুকে সাধুবাবা হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ালেন, তারপর সেই বাজখাঁই গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “কী কথা?” 

ভাদুড়িমশাই গলা তুলে বললেন, “সে তো এত দূর থেকে বলা যাবে না। একটু কাছে যেতে পারি?” 

“চলে আয়।” 

সাধুবাবার এই ঘরটা শুনেছি রাতারাতি তোলা হয়েছিল। মেঝেটা বাঁধানো নয়, তবে মাটিরও নয়। জমির লেভেল থেকে ফুট তিন-চার ফাঁকা রেখে, শালের খুঁটির সঙ্গে ফ্রেম করে নিয়ে তার উপরে পাতা হয়েছে কাঠের পাটাতন। উত্তরবঙ্গে এই রকমের ঘর প্রচুর দেখা যায়। রাস্তার ধারে নিচু জমিতে খুঁটি পুঁতে যে সব দোকানঘর বানানো হয়, অথচ যার মেঝে থাকে রাস্তার লেভেলের থেকেও খানিকটা উঁচুতে, সেগুলোও অনেকটা এই রকমেরই। 

ঘরের সামনে এক ফালি বারান্দাও রয়েছে। তাতে একটা কম্বল বিছানো। সাধুবাবা সেই কম্বলের উপরে আমাদের বসতে বললেন, তারপর ঘরের ভিতর থেকে একটা বাঘছাল নিয়ে এসে তার উপরে বসে বললেন, “কী কথা?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কথা তো একটাই। মনসার উপরে আপনার এর রাগ কেন?” 

প্রশ্ন শুনে হেসে উঠলেন সাধুবাবা। তারপর হাসি থামিয়ে বললেন, “চাঁদ বেনের গপ্পো জানিস?”

“জানি। কিন্তু চাঁদ যখন তাঁর পুজো করতে রাজি হননি, দেবী হিসেবে মনসার তখন বিশেষ প্রতিষ্ঠাও তো ছিল না। আর তা ছাড়া, মনসা যে ছলে-বলে তাঁর কাছ থেকে পুজো আদায় করতে চেয়েছিলেন, শিবের ভক্ত চাঁদের সেটাও পছন্দ হয়নি।” 

“আরে বেটা, আমিও তো শিবের ভক্ত, আমিই বা তা হলে ব্যাং-খেকো ওই কানিটাকে পাত্তা দেব কেন?” 

“কেউ তো আপনাকে পাত্তা দিতে বলছে না। কিন্তু সরল বিশ্বাসে যারা তাঁর পূজা করছে, তাদের সেই বিশ্বাসে আপনি আঘাত করছেন কেন? এই গ্রামের লোকেরা বিশ্বাস করে যে, মনসার পুজো করলে সাপের কামড়ে মরতে হবে না। কেন সেই বিশ্বাসটা নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করছেন আপনি?” 

“সাপের কামড়ে মরবার কথা উঠছে কেন?” সাধুবাবা অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে-ধীরে সেই অবাক ভাবটা কেটে গিয়ে তাঁর মুখের উপরে একটা অদ্ভুত হাসি ছড়িয়ে পড়ল। বললেন, “এখানে আবার সাপ আছে নাকি? কই, আমি তো কখনও দেখিনি। কেউ দেখেছে বলেও শুনিনি।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তাও কি হয় নাকি? এ তো বড় অদ্ভুত কথা আপনি বলছেন। গ্রামে সাপ থাকবে না?” 

সাধুবাবা বললেন, “আমি তো আর সব গ্রামের কথা বলছি না, আমি মুকুন্দপুরের কথা বলছি। এখানে সাপ নেই। কখনও ছিল না। সত্য তবু সাপের ভয় দেখিয়ে মনসার পুজো আদায় করে। এইটে আর আমি হতে দেব না। মনসার পুজো আমি বন্ধ করে ছাড়ব।” 

“কী করে বন্ধ করবেন? বিগ্রহ উদ্ধার করতে পারলেই তো ফের পুজো শুরু হবে।” সাধুবাবার চোখ দুটো হঠাৎ সেই আগের মতো জ্বলে উঠল। চাপা গলায় বললেন, “উদ্ধার করবার জন্যেই যে তোরা এসেছিস, তা কি আর আমি জানি না? ভাল চাস তো পালিয়ে যা! নইলে, মনসাকে যেভাবে মন্তর দিয়ে মেরেছি, তোদেরও সেইভাবে মারব!” 

১৪ 

সাধুবাবার হুঙ্কার শুনে যে আমার বুকের মধ্যে ধড়াস করে উঠেছিল, আগেই সে-কথা বলেছি। এখন মনে হল যে, তাঁর চাপা-গলার শাসানিটাও সেই হাঁকারের চেয়ে কিছু কম ভয়ঙ্কর ব্যাপার নয়।

বাগান থেকে বেরিয়ে বাড়ির দিকে এগোতে এগোতে ভাদুড়িমশাই বললেন, “কী হল কিরণবাবু? ভয় পেলেন নাকি?” 

বললুম, “ভয় পাবার মতোই তো ব্যাপার। কেন, আপনি ভয় পাননি?” 

“কেন পাব না? চোখ পাকিয়ে একটা লোক বলছে যে, আমাকে মেরে ফেলবে, আর আমি ভয় পাব না? তবে হ্যাঁ, ওই যে মন্তর দিয়ে মারবে বলল, ওটা স্রেফ গাঁজাখুরি গপ্পো।” 

“আপনি বলছেন, গাঁজাখুরি গপ্পো’, কিন্তু এই বিশ শতকেও বিস্তর মানুষ বিশ্বাস করে যে, মন্তর দিয়ে মানুষ মারা যায়।”

“তা করে।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “কিন্তু অষ্টাদশ শতকের মানুষ হয়েও ভলতের বিশ্বাস করতেন না। মন্তর দিয়ে ভেড়া মারা যায় কি না, একজনের এই প্রশ্নের জবাবে ভলতের কী বলেছিলেন জানেন?”

“কী বলেছিলেন?” 

“বলেছিলেন যে, তা হয়তো যায়, তবে কিনা মন্তরের সঙ্গে খানিকটা সেঁকোবিষ মিশিয়ে দিলে আর ভাবনার কিছু থাকে না। তখন একেবারে ষোলো-আনা নিশ্চিন্ত হয়ে বলা যায় যে, ভেড়াটা মরবেই।” 

বললুম, “তা সাধুবাবাও যে মন্তরের সঙ্গে বিষ মেশাবার কথা ভাবছেন না, তা আপনি জানছেন কী করে? …ও হ্যাঁ, একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করি। সাধুবাবার ওখানে যখন বসে ছিলুম আমরা, তখন একটা গন্ধ পেয়েছিলুম। আপনি পাননি?” 

“পেয়েছিলুম বই কী?” 

“কীসের গন্ধ বলুন তো?” 

“কারবলিক অ্যাসিডের।” ভাদুড়িমশাই একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “নাঃ, সাধুবাবা বড় চিন্তায় ফেললেন দেখছি।” 

বাগানের পুব দিক দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে ততক্ষণে আমরা চৌধুরি-বাড়ির বাইরে উঠোনে এসে ঢুকেছি। দেখলুম, রামদাসের ঘরের সামনে একটি বউ আর একজন ষন্ডামতন লোক দাঁড়িয়ে আছে। বউটির বয়স বছর পঁয়ত্রিশ। চেহারা বেশ চটকদার। রামদাস তাদের সঙ্গে কথা বলেছিল। মনে হল, সে একটু উত্তেজিত। কথা বলতে-বলতেই হঠাৎ সে তার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। ষন্ডামতন লোকটি বেশ রাগত ভঙ্গিতে কী যেন বলল বউটিকে। কিন্তু বউটি তার উত্তরে কিছু বলল না। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেইখানেই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। লোকটি তাকে আরও কিছু বলত হয়তো, কিন্তু হঠাৎ আমাদের দিকে চোখ পড়ে যাওয়াতেই বোধহয় আর মুখ খুলল না। হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির দক্ষিণ দিকের রাস্তায় গিয়ে নামল। 

ভিতরের উঠোনে ঢুকতেই একেবারে হই-হই করে উঠলেন সত্যপ্রকাশ। দোতলার বারান্দায় একটা ইজিচেয়ারে তিনি বসে ছিলেন। সেইখানে থেকেই চেঁচিয়ে বললেন, “আরে মশাই, কোথায় গিয়েছিলেন আপনারা? আপনাদের কি খিদে-তেষ্টা পায় না? সেই কখন থেকে আপনাদের জন্যে বসে আছি।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “সেই কখন থেকে মানে ঠিক কখন থেকে বসে আছেন বলুন তো?” 

“তা মিনিট দশ-পনেরো তো হবেই।” সত্যপ্রকাশ লজ্জিতভাবে বললেন, “এই মানে প্রায় শেষ-রাত্তিরে শুয়েছিলুম তো, উঠতে-উঠতেই সাড়ে আটটা বেজে গেল।” 

“তা যে বাজবে, সেটা জানতুম বলেই আমরা একটা লম্বা-গোছের চক্কর মেরে এলুম।” 

“বেশ করেছেন, বেশ করেছেন,” সত্যপ্রকাশ তাঁর আরাম-কেদারা থেকে উঠে পড়ে বললেন, “ব্রেকফাস্ট রেডি, আমিও রেডি, আপনারা তা হলে আর দেরি করবেন না, ডাইনিং হলে গিয়ে বসে পড়ুন।” 

দোতলা থেকে নেমে এলেন সত্যপ্রকাশ। সবাই মিলে ডাইনিং হলে ঢুকে এক-একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লুম। থালা গেলাস বাটি সাজানোই ছিল। নিরু পরিবেশন করতে লাগল। ব্রেকফাস্ট মানে অবশ্য বিলিতি কায়দার ছোটা হাজরি নয়, একেবারে বনেদি বাঙালি কেতার লুচি, আলুর চচ্চড়ি, মাছভাজা আর পায়েস। মা আর পিসিমাও চেয়ার টেনে বসে পড়েছিলেন, তবে তাঁরা বিধবা মানুষ, আমিষের ছোঁয়া রয়েছে বলেই সম্ভবত আমাদের সঙ্গে কিছু খেলেন না, বসে-বসে শুধু নজর রাখতে লাগলেন যে, কারও পাত যেন না খালি থাকে। 

ব্রেকফাস্টের পালা চুকিয়ে আমরা আবার সত্যপ্রকাশের বসবার ঘরে এসে জমায়েত হলুম। ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনাদের পারিবারিক ইতিহাস তো কাল রাত্তিরেই আপনার কাছে শুনলুম। ডায়েরিটাও কালই পড়ে ফেলেছি। এখন আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই, চুরিটা কখন হল, কীভাবে হল, আপনিই বা কখন খবর পেলেন, সব এবারে খুলে বলুন।” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “আজ তো মঙ্গলবার, চুরিটা হয়েছে আজ থেকে ছ’দিন আগে, গত বুধবারে, যদ্দুর বুঝতে পারছি, ভোর হবার একেবারে আগের মুহূর্তের ঘটনা। ওই যাকে খনার বচনে বলে মঙ্গলে উষা বুধে পা, ঠিক সেই সময়ের ব্যাপার।”

“আপনি কখন খবর পেলেন?” 

“বুধবার বিকেলে। শিলিগুড়িতে লোক পাঠিয়ে খবর দেওয়া হয়েছিল।” 

“খবর পেয়েই আপনি চলে আসেন?”

“না,” সত্যপ্রকাশ বললেন, “আমি ব্যবসায়ী লোক, হুট্ বলতেই কি আর চলে আসতে পারি, -্যাবসার কাজকর্ম অন্যদের বুঝিয়ে না-দিয়ে আসি কী করে? তাই খবরটা পাবার পরেও কিছুক্ষণ—তা ধরুন ঘন্টাদেড়েক কি ঘন্টাদুয়েক সময় –আমি শিলিগুড়িতেই আটকে ছিলুম।’ 

“খবরটা যেখানে বাইরের কাউকে বলেছিলেন?” 

“তা বলেছিলুম বই কী। গ্রামের বাড়িতে সাধারণত আমি শনিবার-শনিবার আসি, তারপর শনি-রবি দু’রাত এখানে কাটিয়ে সোমবার সকালে আবার শিলিগুড়িতে ফিরে যাই। এবারে হঠাং বুধবার আসছি কেন, বন্ধুবান্ধবরা জিজ্ঞেস করায় সব খুলে বলতে হয়।” 

অর্থাৎ খবরটা তখুনি চাউর হয়ে যায়, কেমন?” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “হ্যাঁ। কলকাতার হরেক কাগজের যে-সব করেসপন্ডেন্ট শিলিগুড়িতে থাকেন, তাঁরাও হয়তো আমার বন্ধুদেরই কারও কাছে খবরটা পেয়ে গিয়ে কলকাতায় জানিয়ে থাকবেন?” 

আমি বললাম, “হ্যাঁ, পরশু অর্থাৎ রোববার আমরা কলকাতার কাগজে এই খবরটা দেখেছি।”

সত্যপ্রকাশ বললেন, “আমি দেখেছি পরশু বিকেলবেলায়। আপনাদের হোটেলে রেখে আমার অফিসে ফিরে গিয়ে দেখলুম। কাগজ এখানে সকালের ফ্লাইটেই আসে বটে, তবে বিকেল তিনটের আগে তো আর ডেলিভারি হয় না। খবরটা যে ছেপে বেরিয়েছে, তা অবশ্য পরশু সকালেই আমার বড় মেয়ে আমাকে ট্রাঙ্ককল করে জানিয়েছিল।” 

“যাক্ গে,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “বুধবারের কথা হচ্ছিল, সেটাই আগে শুনি। মুকুন্দপুরে সেদিন আপনি কখন এসে পৌঁছলেন?” 

“কর্মচারীদের কাজকর্ম বুঝিয়ে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে সেই রাত্তিরেই এখানে চলে এলুম। আসতে বেশ রাত হয়েছিল, তবে আমার জন্যেই বসে ছিল সবাই, কেউ ঘুমোয়নি। ঘুমোবার উপায়ও অবশ্য ছিল না।” 

“কেন?” 

“রঙ্গিলার জন্যে। মেয়েটার তখন যাকে বলে যায়-যায় অবস্থা। বেঁচে থাকবে, এমন আশাই তো কেউ +রেনি। ওই যে বলেছি, মন্দিরে ঢুকে মেয়েটা একেবারে মূর্তি-চোরের সামনে পড়ে গিয়েছিল, ওর মাথা কাটিয়ে চোর পালিয়ে যায়।” 

একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই! কী যেন ভাবলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “সবই বুঝলুম, কিন্তু একটা কথা এখনও বুঝতে পারছি না। শেষ রাত্তিরে রঙ্গিলা হঠাৎ মন্দিরে ঢুকতে গিয়েছিল কেন?” 

“হঠাৎ তো ঢোকেনি,” সত্যপ্রকাশ বললেন, “রোজই ঢোকে। বড় লক্ষ্মী মেয়ে। কাউকে কিছু বলতে পর্যন্ত হয় না, রাত থাকতেই ঘুম থেকে উঠে, চান করে, বাসী কাপড় ছেড়ে, মন্দিরে গিয়ে কাজে লেগে যায়।” 

“সেখানে ওর কী কাজ?” 

“বিস্তর কাজ। কাজের কি আর শেষ আছে। পুজোর বাসন-কোশন, কোষাকুষি, পেতলের ঘড়া, গঞ্চপ্রদীপ, ধূপদান, সব তো রঙ্গিলাই মাজে। তা ছাড়া ঠাকুরঘরের মেঝে আর বারান্দা সেই ভোর-রাত্তিরেই ও য়েমুছে একেবারে ঝকঝকে করে রাখে। তারপর চন্দন ঘষে, পুজোর ফুল তোলে, পুরুতমশাইকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে দেয়…কাজ কি কম?” 

“তারপর?” 

“তারপরেই সেই সর্বনেশে ব্যাপার। রোজকার মেতো বুধবারও সে রাত থাকতেই ঘুম থেকে উঠেছিল. চান করেছিল, বাসী কাপড় পালটে মন্দিরে গিয়ে ঢুকেছিল। আর তারপরেই তার ভয়ঙ্কর চিৎকারে বাড়ির সক্কলের ঘুম ভেঙে যায়। চিৎকার শুনে রামদাস ছুটেও এসেছিল। তবে কিনা একে তো রামদাসের বয়স হয়েছে, চোখে ভাল দেখতে পায় না, তার উপরে আবার তখন রাত পুরোপুরি কাটেনি, চতুর্দিকে অন্ধকার, তাই লণ্ঠন জ্বেলে তার মন্দিরে এসে পৌঁছতে পৌঁছতেই সর্বনাশ যা হবার তা হয়ে গেল।” 

“রামদাস এসে কী দেখল?” 

“দেখল যে ঠাকুরঘরের মেঝে একেবারে রক্তে ভেসে গেছে, আর সেই রক্তের উপরে বেহুঁশ হয়ে পড়ে রয়েছে তার নাতনি।” 

“মুর্তিটিও যে উধাও হয়েছে, তা তখনও বুঝতে পারেনি রামদাস?” 

“বোঝবার মতন অবস্থাই তখন তার ছিল না।” সত্যপ্রকাশ বললেন, “রঙ্গিলার ওই অবস্থা দেখে সে ডুকরে কেঁদে ওঠে। নিরু ইতিমধ্যে তার ঘর থেকে ছুটে চলে এসেছিল। এসে পড়েছিলেন আমার মা, পিসিমা আর পুরুতঠাকুরও। তবে, মূর্তিটি যে নেই, নিরুই সেটা প্রথম টের পায়।” 

“রঙ্গিলা কি চোরকে চিনতে পেরেছিল?” আমি প্রশ্ন করলুম, “সানে রঙ্গিলা কি তেমন কোনও কথা বলেছে?” 

“কথা?” অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন সত্যপ্রকাশ। বললেন, “সে তো এখনও কথাই বলছে না। বলতে গেলে সে তো এখনও বেহুঁশ হয়েই পড়ে আছে।” 

“একবারও জ্ঞান ফেরেনি তার?” ভাদুড়িমশাই জিজ্ঞেস করলেন। 

“তবে আর বলছি কী,” হাত উলটে সত্যপ্রকাশ বললেন, “গত বুধবার ভোর রাত্তিরের ঘটনা এটা…তারপর পুরো ছ-ছ’টা দিন কেটে গেল, অথচ অবস্থা এখনও যথাপূর্বম্। জ্ঞান যে একেবারেই ফেরেনি, তা অবশ্য নয়, তবে কিনা এখনও একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে… মানে একটা ট্রমাটিক এক্সপিরিয়েন্স তো, ধকলটা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি, ফ্যালফ্যাল করে শুধু এদিক-ওদিক দেখছে, কিন্তু কাউকে যে চিনতে পারছে, এমন মনে হয় না।” 

“হাসপাতালে দেননি কেন?” 

“কী করে দেব? এখানে হাসপাতাল বলতে তো সেই আলিপুরদুয়ার। কাছাকাছি একটা রুর‍্যাল হেল্থ সেন্টার আছে বটে, কিন্তু একে তো মাস তিনেক হল সেখানে ডাক্তার নেই, তার উপরে আবার যন্ত্রপাতি আর ওষুধপত্রের স্টকও যৎসামান্য, পারতপক্ষে তাই সেখানে কেউ যেতে চায় না।” 

“তা হলে ওকে দেখছে কে?” 

“হাসিমারার ডাক্তার সরকার। মানুষটি ভাল, অভিজ্ঞও বটেন, তা ছাড়া তাঁর দায়িত্ববোধের তুলনা নেই। রোজ বিকেলে এসে দেখে যান। মাথায় স্টিচ যা করবার তিনিই করেছেন। ব্যান্ডেজ-ট্যান্ডেজ সব তিনি নিজের হাতে করেন। আবার তা পালটাবার দরকার হলেও নিজের হাতেই পালটে দেন।” 

“তিনিই তা হলে প্রথম থেকে দেখছেন?” 

“একদম প্রথম থেকে। খবর পেয়েই ভদ্রলোক ছুটে এসেছিলেন। ওই যে বললুম, মানুষটির দায়িত্ববোধের সত্যি তুলনা হয় না।” 

একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই! তারপর প্রসঙ্গ পালটে জিজ্ঞেস করলেন, “রাত্তিরে নিশ্চয় মন্দিরের দরজায় তালা দেওয়া থাকত?” 

“বাইরের গেটে থাকত না, থাকত শুধু যে-ঘরে বিগ্রহের পুজো হয়, সেই ঘরে।” 

“তার চাবি কার কাছে থাকত?” 

“রঙ্গিলার কাছে। শেষ-রাত্তিরে সে-ই গিয়ে ঠাকুরঘরের দরজা খুলত। কিন্তু বুধবার ভোর রাত্তিরে তার আগেই কেউ নিশ্চয় তালা ভেঙে ঠাকুরঘরে ঢুকেছিল।” 

“কিন্তু বিগ্রহ নিয়ে পালাবার আগেই সে রঙ্গিলার সামনে পড়ে যায়, কেমন?” 

“তা-ই তো মনে হয়।” 

“ভাঙা তালাটা খুঁজে পেয়েছিলেন?” 

“না,” সত্যপ্রকাশ বললেন, “বিস্তর খুঁজেও সেটা পাওয়া যায়নি। এখন যেটা লাগিয়ে রাখা সেটা নতুন তালা।” 

“আগের তালার চাবিটা নিশ্চয় হারিয়ে যায়নি?” 

“সেটা কেন হারাবে, সেটা তো রঙ্গিলার কাছেই ছিল, সেই চাবি দিয়েই তো সেদিনকার মতো সেদিনও তালা খুলে ঠাকুরঘরে ঢুকতে গিয়েছিল। আমি সেটা রেখে দিয়েছি।” 

“চাবিটা একবার দেখতে পারি?” 

টেবিলের টানা খুলে বেশ বড় সাইজের একটা পেতলের চাবি বার করে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে এগিয়ে দিলেন সত্যপ্রকাশ। বললেন, “রঙ্গিলার মুঠোর মধ্যেই ছিল এটা।” 

চাবিটা হাতে নিয়ে মাত্র এক পলক সেটাকে দেখেই ভাদুড়ি শশাই বললেন, “বুঝেছি।”