মুকুন্দপুরের মনসা – ১

বছর পনরো আগের কথা। বেশ-কিছুদিন আগেই পাক-ভারত যুদ্ধ শেষ হয়েছে। প্রতিষ্ঠা হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের। খান-সেনাদের অত্যাচারে যারা সীমান্ত পার হয়ে এদিকে চলে এসেছিল, তাদেরও অধিকাংশই আবার যে যার জায়গায় ফিরে গেছে। বাতাসে আর বারুদের গন্ধ নেই। 

আমি তখন পার্ক সার্কাস এলাকার একটা গলিতে থাকি। খবরের কাগজে কাজ করি; তা ছাড়া আছে নিজের লেখালেখির কাজ। পুজো-সংখ্যা বেরিয়ে যাওয়ায় হাত তখন অনেকটা হালকা। বারোয়ারি পুজোর হট্টগোলে অবশ্য দিন কয়েক আগেও প্রাণ একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। সত্যিই তা-ই। আমাদের এই সরু গলির মধ্যেও একটা বারোয়ারি পুজো হয়। সেখানে অষ্টপ্রহর যে ফিল্মি গানার দাপট চলছিল, তাতে প্রতি মুহূর্তে ভয় হচ্ছিল যে, আর নয়, প্রাণপাখি এবারে নির্ঘাত খাঁচা ভেঙে পালাবে। 

তা সেই হট্টগোল এখন অনেকটা ঝিমিয়ে এসেছে। লক্ষ্মীপুজোও শেষ। রেলগাড়িতেও আর সেই আগের মতো ভিড় নেই। এর মধ্যে এক আত্মীয়কে একদিন দিল্লি মেলে তুলে দেবার জন্যে হাওড়া স্টেশনে যেতে হয়েছিল। গিয়ে দেখলুম, তিনি যেখানে জায়গা পেয়েছেন, সেই কিউবিকূলের চারটে বার্থের মধ্যে দুটোই খালি। দেখে মনে হল, রিজার্ভেশনের জন্যে এখন আর তিন মাস আগে থাকতে লাইন লাগাবার, কি সেটা না-পারলে রেল কোম্পানির কোনও কর্তাব্যক্তির কাছে গিয়ে উমেদারি করবার, দরকার নেই। তা হলে তো দিন পনরো-কুড়ি ছুটি নিয়ে আমিও একটু বাইরের হাওয়া গায়ে লাগিয়ে আসতে পারি। দফতরে এখন কাজের চাপও অনেক কম। হাওড়া স্টেশন থেকে ফিরে আসতে-আসতে তাই ভাবছিলুম যে কলকাতা থেকে এবারে বেরিয়ে পড়লে নেহাত মন্দ হয় না। 

সেদিন রাত্তিরেও তাই নিয়ে কথা হচ্ছিল। খাওয়ার পাট চুকিয়ে, মুখে এক কুচি সুপুরি ফেলে, একটা সিগারেট ধরিয়ে ইজিচেয়ারে এসে গা ঢেলে দিয়েছি, ছেলেপুলের মা বললেন, “বেরিয়ে যে পড়বে বলছ, যাবেটা কোথায়?” 

“কেন, সে তো ঠিক করাই আছে। ব্যাঙ্গালোর। চারু ভাদুড়ি ফি-বছর বিজয়ার চিঠিতে শুভেচ্ছা জানিয়ে লেখেন যে, এবারে যেন দিন কয়েকের জন্যে ওঁর ওখানে গিয়ে ছুটি কাটিয়ে আসি। তা কোনও বারেই কি আমাদের যাওয়া হয়? হয় না। একটা-না-একটা ঝঞ্ঝাটে শেষ পর্যন্ত আটকে যাই। চলো, এবারে গিয়ে ওঁকে চমকে দেব।” 

“তা হলে তো ভালই হয়। তবে কিনা মাদ্রাজ হয়ে তারপর যাব।” 

ভদ্রমহিলা যে কেন মাদ্রাজ যেতে চান সেটা আর তাঁকে ব্যাখ্যা করে বলতে হল না। মাদ্রাজে তাঁর দিদি থাকেন। তিনিও ফি-বছর বিজয়ার চিঠিতে মাথার দিব্যি দিয়ে জানান, দিন কয়েকের জন্য আমরা যেন অতি অবশ্য তাঁর কাছে গিয়ে ছুটি কাটাই। যদি যাই, তা হলে মাদ্রাজের স্নেক-পিট আর ক্রোকোডাইল পার্কে তো তিনি আমাদের নিয়ে যাবেনই, উপরন্তু গোল্ডেন বিচ রিজর্ট থেকে মহাবলীপুরম পর্যন্ত ধারেকাছে যা-কিছু দর্শনীয় জায়গা আছে, সবই দেখিয়ে দেবার ব্যবস্থা করবেন। 

বললুম, “বেশ তো। দিন কয়েক মাদ্রাজে থেকে তারপরেই নাহয় ব্যাঙ্গালোর যাওয়া যাবে। বৃন্দাবন এক্সপ্রেসের নাম শুনেছ তো? অতি চমৎকার ট্রেন। মাদ্রাজ থেকে ব্যাঙ্গালোর যাওয়াটা কোনও ব্যাপারই নয়।” 

“কবে নাগাদ রওনা হব?” 

“যে-দিন বলবে, সেই দিনই। কী জানো, আমারও মন বড্ড যাই-যাই করছে। বলো তো পরশু দিনই রওনা হতে পারি। টুকিটাকি যা-কিছু কেনাকাটা করবার, কাল করে নেব। তারপর পরশু দিনই ট্যাক্সি ডেকে হাওড়া স্টেশন। গুডবাই ক্যালকাটা!” 

“বা রে, রিজার্ভেশন করতে হবে না?” 

“রিজার্ভেশন এখন আর কোনও সমস্যাই নয়। ভিড় কেটে গেছে।” 

“ঠিক আছে, পরশু না-হলে তরশু। তবে কিনা…।” 

“আবার ‘তবে’ কেন? আটকাচ্ছেটা কোথায়?” 

“আটকাবার কথা তো বলিনি। তবে কিনা ভাদুড়িমশাই এখন ব্যাঙ্গালোরে আছেন কি না, সেটা ঠিক জানো তো?” 

“নেই, এমন কথা ভাবছ কেন?” 

“এই জন্যে ভাবছি যে, ফি-বছর তো বিজয়ার পর দিন-দুয়েকের মধ্যেই তাঁর চিঠি পাই। এবারে কিন্তু লক্ষ্মীপুজোও চলে গেল, তবু তাঁর চিঠি পাইনি।” 

ভদ্রমহিলা ভুল বলেননি। সত্যিই এবার চিঠি আসেনি ব্যাঙ্গালোর থেকে। কেন আসেনি, কে জানে। ভাদুড়িমশাই অসুস্থ হয়ে পড়েননি তো? নাকি ব্যাঙ্গালোর থেকে কোনও কাজ নিয়ে তিনি অন্য কোথাও গেছেন? নাকি চিঠি লিখেছিলেন, কিন্তু ডাক-বিভাগের গাফিলতিতে সে-চিঠি আজও আমাদের কাছে এসে পৌঁছয়নি? সেও কিছু বিচিত্ৰ নয়। 

বললুন, “তাই তো, বড় চিন্তায় ফেললে দেখছি। যাঁর কাছে থাকব বলে যাওয়া, গিয়ে যদি দেখি যে, তিনিই নেই, তবে তো চিত্তির!” 

ভদ্রমহিলা বললেন, “এত ভাবছ কেন? ওঁর ব্যাঙ্গালোরের বাড়ির ফোন নাম্বার তো তোমার ডায়েরিতে টোকাই আছে, রাতও বেশি হয়নি, একটা ট্রাঙ্ক-কল করলেই তো হয়।” 

পকেট-ডায়েরি থেকে ফোন-নাম্বারটা দেখে নিয়ে রিসিভার তুলতে যাব, ঠিক তখনই আমাকে চমকে দিয়ে ঝন্‌ঝন্‌ করে ফোন বেজে উঠল। 

“হ্যালো…”

“কেমন আছেন মশাই?” 

গলা শুনে চমকে উঠলুম। চারু ভাদুড়ি। এমন কিছু মানুষ আছেন, আড়াল থেকে কথা বললেও যাঁদের কন্ঠস্বর থেকেই চোখের কৌতুক আর ঠোঁটের বঙ্কিম রেখাটি পর্যন্ত স্পষ্ট দেখে নেওয়া যায়। ভাদুড়িমশাই সেই রকমের মানুষ। বললুম, “আগে বলুন, কোত্থেকে ফোন করছেন। তারপরে আমি বলব, ভাল আছি না মন্দ আছি।” 

“ব্যাঙ্গালোর থেকে নয়, আপনাদের এই কলকাতা শহর থেকেই।” 

“তা হলে আমি ভাল নেই।” 

“কেন, কেন?” 

“আরে, মশাই, আমি তো কলকাতা থেকে বেরিয়ে পড়বার প্ল্যান এঁটেিেছ। এখান থেকে মাদ্রাজ যাব। তারপর সেখানে বাসন্তীর দিদির বাড়িতে দিন তিন-চার কাটিয়ে চলে যাব ব্যাঙ্গালোর। সেঁই জন্যে আপনাকে ট্রাঙ্ক-কলও করতে যাচ্ছিলুম। তা ঠিক তক্ষুনি আপনার ফোন এল। কোত্থেকে এল? না কলকাতা থেকে। অর্থাৎ কিনা আমি যাঁর টানে ব্যাঙ্গালোর যাবার প্ল্যান আঁটছিলুম, ছুটি কাটাবার জন্যে তিনিই চলে এসেছেন কলকাতায়। তা হলে আর ব্যাঙ্গালোর যাওয়া হল না, প্ল্যানের দফা রফা হয়ে গেল। এই অবস্থায় আর ভাল থাকি কী করে?” 

শুনে হোহো করে হেসে উঠলেন চারু ভাদুড়ি। তারপর বললেন, “এই কথা? তা হলে নিশ্চিন্ত থাকুন, আপনার প্ল্যান মোটেই ভেস্তে যাচ্ছে না। আমি মোটেই ছুটি কাটাতে আসিনি। একটা কাজ নিয়ে এসেছিলুম। সেটা মিটেছে। কালই ফিরে গেলে হয়।” 

“কবে এসেছেন?” 

“তা দিন পনরো তো হবেই।” 

“আমাকে জানাননি কেন?” 

“সময় পেলুম কোথায়? আরে মশাই, সকাল থেকে রাত বারোটা অবধি হন্যে হয়ে গোটা শহর ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। না না, প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঠাকুর দর্শনের জন্যে নয়, মহা ধুরন্ধর এক স্মাগলারের খোঁজে। এর মধ্যে একদিন আবার চন্দননগরেও যেতে হয়েছিল। সময় পেলে কি আর আপনাকে একটা ফোন করতুম না? নিশ্চয় করতুম। তা মশাই, বিশ্বাস করুন, দম ফেলবারও সময় পাইনি। যাই হোক, কাজটা আজ বিকেলে মিটল।” 

“কালই চলে যাবেন?”

“কালও যেতে পারি, পরশু গেলেও ক্ষতি নেই। কী জানেন, অনেক কাল বাদে এলুম তো, তাই ভাবছিলুম যে, আরও দু’চারটে দিন এখানে কাটিয়ে গেলে নেহাত মন্দ হত না। আবার কবে আসা হবে, কে জানে।” 

“আমি তো পরশুই কলকাতা ছাড়ার কথা ভাবছি।” 

“বটে? তা বেশ তো, আপনারা মাদ্রাজে গিয়ে তিন-চারদিন কাটিয়ে তারপর ব্যাঙ্গালোরে চলে আসুন। তার আগেই আমি ব্যাঙ্গালোরে পৌঁছে আপনাদের প্রতীক্ষায় থাকব।” 

“কোথায় উঠেছেন?” 

“যতীন বাগচি রোডে, আমার ছোট বোন মালতীর বাড়িতে।” 

“তারা তো বেহালায় থাকত, যতীন বাগচি রোডে উঠে এল কবে?” 

“তা বছর তিন-চার তো হলই,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “নিন, নম্বরটা লিখে রাখুন… চোদ্দর সাতের দুয়ের বি। হলদে রঙের তিনতলা বাড়ি, পার্কের খুব কাছে। বোনের ফ্ল্যাট দোতলায়। কাল তো রবিবার। হাতে কোনও জরুরি কাজ না থাকলে সকাল সাতটার মধ্যেই এখানে চলে আসুন। জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে।” 

বললুম, “অত সকালে যাব কী করে? আমি দেরিতে ঘুমোই, আটটার আগে ঘুম ভাঙে না। চা-টা খেয়ে ওখানে পৌঁছতে পৌঁছতে অন্তত নটা বাজবে।” 

“আরে মশাই,” ভাদুড়িমশাই অনুযোগের গলায় বললেন, “বাড়ি থেকে চা খেয়ে বেরুবেন কেন, ও-বস্তু কি আমরা খাই না? এখানে এসে চা খাবেন। আর চেষ্টা যদি করেন, তা হলে একটা দিন নিশ্চয়ই একটু তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠাও বিশেষ শক্ত হবে না। দরকার হয় তো ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে শোবেন। দাঁড়ান, দাঁড়ান, একটু ধরুন তো…” 

বুঝলুম,পাশে কারও সঙ্গে কথা বলছেন। একটু বাদেই আবার তাঁর গলা পাওয়া গেল। “শুনুন কিরণবাবু, কাল আমার ভাগ্নে কৌশিকের জন্মদিন, তাই মালতী বলছে, দুপুরের খাওয়াটাও আপনাকে এখানেই সেরে নিতে হবে। …না না, বিশেষ কিছু আয়োজন করা হয়নি। আর হ্যাঁ, মালতী বলছে, বাসন্তীকেও নিয়ে আসুন।” 

“বাসন্তী কী করে যাবে? পরশু মাদ্রাজ যাব, তার গোছগাছ আছে না? 

“ঠিক আছে, তা হলে আপনি একাই আসুন। মোট কথা,দেরি করবেন না, আটটার মধ্যে আপনাকে এক্সপেক্ট করছি।” 

ভাদুড়িমশাই ফোন নামিয়ে রাখলেন।

ছেলেপুলের মা পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। সব শুনে তিনি বললেন, “কী গেরো রে বাবা! পরশু কলকাতা ছাড়ছি, ভাবলুম কাল দু’জনে মিলে কিছু কেনাকাটা করে নেব, তা তুমি তো কাল সারাটা দিনই আড্ডা দিয়ে কাটাচ্ছ, রাজ্যের ঝক্কি এখন আমাকে একাই সামলাতে হবে। তাও নাহয় সামলালুম, কিন্তু ছুটির দরখাস্তটা তো তোমাকেই করতে হবে, সেটা করবে কখন?” 

“ওটা এখনই করছি না। সন্তোষকে কাল এক সময় ফোন করে জানিয়ে দেব যে, দিন কয়েকের জন্যে একটু বাইরে যাচ্ছি, তাড়াহুড়োর মধ্যে এখন লিভ অ্যাপ্লিকেশনটা দিয়ে যেতে পারলুম না, ফিরে এসে দেব।” 

“অর্থাৎ কিনা তুমি একটা বেআইনি কাজ করবে, তোমার বন্ধুরা সেটার সামাল দেবেন, এই তো? চমৎকার চাকরি।” 

ভদ্রমহিলা মুখ টিপে হাসলেন। আমিও হাসলুম। এইসব টিপ্পনী শুনে এককালে খুব রেগে যেতুম, এখন আর রাগি না। 

রবিবারের সকাল। ঘুম থেকে উঠতে-উঠতে বেলা হয়ে গেল। ভাদুড়িমশাই ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে শুতে বলেছিলেন। বাসন্তীই এ-বাড়ির অ্যালার্ম ঘড়ি, তাকে বলেছিলুম, ভোর ছ’টায় যেন আমাকে তুলে দেয়। তা তুলে দেবার চেষ্টা সে নাকি করেছিল, কিন্তু আমিই নাকি উঠিনি। যতবার আমাকে ঠেলাঠেলি করেছে, ততবারই আমি নাকি পাশ ফিরে শুয়ে বলেছি, ঠিক আছে, ঠিক আছে।’ হবেও বা। 

এখনও শীত পড়েনি। গরম জলের দরকার হয় না। চটপট দাড়ি কামিয়ে, মাথায় দু মগ জল ঢেলে কাকস্নান সেরে যখন বাথরুম থেকে বার হলুম, রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বাসন্তী তখন জানিয়ে দিল, ‘সাড়ে সাতটা’। এ যখনকার কথা বলছি, ‘সুকুমার সমগ্র’ তখন সদ্য বেরিয়েছে। আর-একজনকে দেব বলে তার প্রথম খন্ড কিনে রেখেছিলুম, কৌশিকের জন্মদিনের উপহার হিসেবে সেটাই একখানা রঙিন কাগজে মুড়ে নিয়ে, গলি থেকে বড়রাস্তায় বেরিয়ে, অনেক কষ্টে একটা ট্যাক্সি ধরে যখন যতীন বাগচী রোডের ফ্ল্যাটে গিয়ে কলিং বেল টিপলুম, ঘড়িতে তখন একেবারে কাঁটায় কাঁটায় আটটা। 

মালতীই দরজা খুলে দিল। 

চারু ভাদুড়ির ভাই নেই। থাকবার মেধ্যে তিন বোন। তাদের মধ্যে একমাত্র এই ছোটটিকেই আমি চিনতুম। এম. এ. পাশ করে আমাদের কাগজে ট্রেনি হয়ে ঢুকেছিল, কিন্তু শিক্ষানবিশির পর্ব শেষ করেনি। অধ্যাপনার চাকরি পেয়ে খবরের কাগজ ছেড়ে দেয়। কাগজে যখন কাজ করত, তখন অবশ্য জানতুম না যে, চারু ভাদুড়ি ওর দাদা। পরে একদিন ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে দেখা করবার জন্যে যখন তাঁর ভবানীপুরের বাড়িতে গিয়ে কড়া নাড়ি, আর দোতলার জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে মালতী বলে যে, দাদা বাড়িতে নেই, তখন অবাক হয়ে যাই। ভবানীপুরের সেই বাড়িতে থাকতেই মালতীর বিয়ে হয়েছিল। স্বামী ডাক্তার। শ্বশুরবাড়ি শুনেছিলুম বেহালায়। সে কি আজকের কথা! মালতী অবশ্য তার দাদার সঙ্গে আমার পরিচয়ের কথা জানত। কিন্তু কাগজে কাজ করবার সময়ে ঘুণাক্ষরেও তা আমাকে জানায়নি। 

দরজা খুলে দিয়ে, একপাশে একটু সরে দাঁড়িয়ে মালতী বলল, “আসুন, কিরণদা।” 

আমি তো অবাক। মালতী বলল, “কী হল, চিনতে পারছেন না?”

চেনা সত্যিই শক্ত। বেণী-দোলানো ছিপছিপে যে মেয়েটিকে আমি চিনতুম, এ তো সে নয়, রীতিমতো ভারিকে চেহারার এক ভদ্রমহিলা। বললুম, “মা যা হইয়াছেন!” 

মালতী বলল, “মা যা হইয়াছেন নয়, মালতী এখন মা হইয়াছেন!” বলে হো হো করে হেসে উঠল। তাতে বুঝলুম, চেহারা পালটেছে বটে, কিন্তু হাসিটা কিছুমাত্র পালটায়নি। 

কথা শুনে ভাদুড়িমশাই ইতিমধ্যেই ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। এগিয়ে এসে বললেন, “আরে আসুন, আসুন।” তাঁর সঙ্গেও অনেক বছর বাদে দেখা। কিন্তু ভদ্রলোকের চেহারা দেখলুম সেই আগের মতোই রয়েছে। বয়স হয়েছে। অথচ শরীরে কোথাও বাড়তি একটুও মেদ নেই। তেমনি সটান, ঋজু দেহ। তেমনি জ্বলজ্বলে দুটি চোখ, আর তেমনি তীক্ষ্ণ চাউনি। 

ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে প্রথম যখন আমার সাক্ষাৎ হয়, তখন ওই চোখ দুটি দেখেই বুঝতে পেরেছিলুম যে, মানুষটি নেহাত সাধারণ নন, আর পাঁচজন লোকের থেকে একটু আলাদা। সাক্ষাৎটা হয়েছিল বিষাণগড়ে। বি. এ. পাশ করবার পর কিছুদিন স্রেফ বেকার বসে ছিলুম। তারপর বিষাণগড়ের রাজবাড়িতে একটা কাজ পেয়ে যাই। কেয়ার টেকারের কাজ। কাজটা অবশ্য বেশিদিন করিনি। তবে ‘করিনি’ না বলে ‘করা সম্ভব হয়নি’ বললেই হয়তো ঠিক বলা হয়। সেখানকার পোলিটিক্যাল এজেন্ট যে পাকা চোর, তা বুঝবার সঙ্গে সঙ্গে স্রেফ প্রাণ বাঁচাবার তাগিদে আমি বিষাণগড় থেকে পালিয়ে আসি। চুরিটা ধরে ফেলেছিলেন ভাদুড়িমশাই। কিন্তু ধরেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, এর পরে আর ওই ভয়ঙ্কর জায়গায় থাকা তাঁর পক্ষে বিশেষ নিরাপদ হবে না। ফলে, চাকরি ছেড়ে তিনিও কলকাতায় চলে আসেন। এখানে তিনি একটা প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সির হয়ে কাজ করতেন। গোটা দুই-তিন রহস্যের কিনারা করে তখন তাঁর খুব নামও হয়েছিল। তবে কলকাতাতেও তিনি বেশিদিন থাকেননি। বড় একটা চাকরির অফার পেয়ে ব্যাঙ্গালোরে চলে যান। মাঝেমধ্যে কলকাতায় আসতেন। এলে যোগাযোগও করতেন। তা ছাড়া, বিজয়ার চিঠি লিখতেন নিয়মিত। এবারে তা প্রায় বছর-পাঁচেক বাদে তিনি কলকাতায় এলেন। 

ড্রইংরুমে ঢুকে বললুম, “ডাক্তারবাবু কোথায়?” 

চারু ভাদুড়ি বললেন, “কে, অরুণ? কল্-এ বেরিয়েছে। এক্ষুনি এসে পড়বে। …তারপর বলুন খবর কী? সবাই ভাল আছেন তো?” 

“বেঁচেবর্তে আছি, এই বাজারে এটাই সবচেয়ে ভাল খবর।” 

ট্রে-র উপরে চা আর জলখাবার সাজিয়ে মালতী ইতিমধ্যে ড্রইংরুমে এসে ঢুকেছিল। বলল, “খাবারগুলো ফেলে রাখবেন না। খেতে-খেতে গল্প করুন। একটু বাদে আবার আমি চা দিয়ে যাব।” 

গল্প জমে উঠতে দেরি হল না। 

কার্তিক মাস। হেমন্তকাল। গরম এখনও কাটেনি, তবে আকাশ ধোঁয়াটে, সকালে আর সন্ধেবেলায় ময়দানে, গঙ্গায় আর লেকের ধারে অল্পস্বল্প কুয়াশা জমতে শুরু করেছে। বারোয়ারি পুজোর জগঝম্পের ঠেলায় কিছুদিন আগেই সকলের কানের পর্দা ফাটবার জোগাড় হয়েছিল। তারপর লক্ষ্মীপুজোও শেষ হয়েছে। আপাতত কোথাও ঢাকের বাদ্যি শোনা যাচ্ছে না। পুজোর ছুটির চারটে দিনের সঙ্গে আরও কয়েকটা দিন জুড়ে দিয়ে যাঁরা মারদাঙ্গা করে ট্রেনের টিকিট কেটে বাইরে পাড়ি দিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই আবার গুটিগুটি এই শহরের খাঁচায় এসে ঢুকতে আরম্ভ করেছে, আর সেই সঙ্গে ফের শুরু হয়েছে কলকাতাবাসীদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। ইস্কুল-কলেজ বন্ধ বটে, তবে অফিস-কাছারি বিজয়ার পরেই খুলে গেছে। রাস্তাঘাটে জ্যাম যে একেবারেই হচ্ছে না তা নয়, তবে কিনা পুজোর দিনগুলোর মতো গাড়িগুলো আর ঘন্টার পর ঘন্টা কোথাও নট নড়নচড়ন-নট-কিচ্ছু হয়ে আটকে থাকছে না। অর্থাৎ আবহাওয়া এখন আর সরগরম নয়, মোটামুটি ঠান্ডা। 

কালীপুজোর দিন-দুই আগে পর্যন্ত এই ঠান্ডা ভাবটাই বজায় থাকবে বটে, কিন্তু তারপরেই আবার আকাশে হাউই উড়বে, মাথার উপরে আচমকা নেমে আসবে উড়ন-তুবড়ির খোল, ছুঁচোবাজির দাপটে রাস্তাঘাটে সবাইকে একেবারে তটস্থ হয়ে থাকতে হবে, মুহুর্মুহু পটকা, দোদমা আর বোমা ফাটবে, আর শহর জুড়ে চলতে থাকবে শ্যামা-মায়ের চেলাচামুন্ডাদের উদ্দাম নৃত্য। 

ভাদুড়িমশাইয়ের কাছে তাই নিয়ে আক্ষেপ করায় তিনি অবাক হয়ে বললেন, “আরে, এতে এত রেগে যাচ্ছেন কেন?” 

“আপনার রাগ হয় না?” 

“মোটেই না। আমি তো এই হইচইটা ভীষণ মিস করি কিরণবাবু। ব্যাঙ্গালোরে থাকি, সেখানে সারাটা বছরই যে খুব নিরানন্দে কাটে তা বলব না, আমোদ-আহ্লাদ উৎসব-টুতসবের বিস্তর উপলক্ষ আছে সেখানেও, আলো জ্বলে, মাইক বাজে, সবই হয়, কিন্তু বিশ্বাস করুন মশাই, এই পুজোর সিজনটা এলেই মন ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। খালি মনে হয়, দুর ছাই, কেন যে দুটো পয়সার লোভে এখানে এলুম, কলকাতায় থাকলেই ভাল হত।” 

মালতীর স্বামী অরুণ সান্যাল ইতিমধ্যে রোগী দেখে ফিরেছিলেন। হাসিখুশি মানুষ। বসবার ঘরে ঢুকে স্টেথোস্কোপ আর ব্লাড প্রেশার মাপবার যন্ত্রটাকে সেন্টার টেবিলে নামিয়ে রেখে বললেন, “তা কলকাতায় থাকলে যে ভাল হয়, সে তো আমরাও বলি। থাকেন না কেন?” 

“উপায় নেই রে ভাই,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “যেখানে যার ভাতের থালা, সেখানেই তাকে থাকতে হবে। ভগবান অমার জন্যে ব্যাঙ্গালোরে ভাত বেড়ে রেখেছেন, ফলে সেইখানেই আমাকে থাকতে হয়। তবে কিনা খুব-একটা আনন্দে থাকি না। মনটা বড্ড ছটফট করে।” 

বললুম, “এই হুল্লোড়ের জন্যে?” 

“সব কিছুর জন্যে। এমন কী, যে ঢাকের বাজনায় এত আপত্তি আপনার, সেই বাজনাটা শুনবার জন্যেও মাঝে-মাঝে বড় ব্যাকুল হয়ে পড়ি, মশাই। আপনি একাই যে অ্যান্টি-ঢাক, তা অবশ্য নয়, দলে হয়তো আপনারাই ভারী, এই তো…মালতীও সেদিন কানে আঙুল দিয়ে বলছিল যে, ঢাকের বাজনা থামলে মিষ্টি, কিন্তু কী জানেন, এই বাজনাটা আমার জীবনে একেবারেই থেমে গেছে তো, তাই এবারে দু’কান ভরে শুনে নিলুম।” 

মালতী ইতিমধ্যে দ্বিতীয় প্রস্ত চা নিয়ে এসেছিল। ট্রে থেকে তুলে হাতে-হাতে চায়ের পেয়ালা ধরিয়ে দিয়ে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে সে বলল, “আর হাসিও না, দাদা! এমনভাবে কথা বলছ যে মনে হচ্ছে, ব্যাঙ্গালোর বোধহয় ইউরোপ কি আমেরিকার কোনও শহর। কেন, ব্যাঙ্গালোরে বুঝি ঢাক বাজে না?”

“তা কেন বাজবে না? একশো বার বাজে!” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “কিন্তু তেমন করে বাজে না।” 

অরুণবাবু বললেন, “অ্যা, টাকডুম টাকডুম বাজে’ বলে শচীন দেববর্মনের একটা গান আছে না? সেই গানের মধ্যে যেন এই রকমের একটা কথা শুনেছি।” 

চারু ভাদুড়ি বললেন, “ঠিকই শুনেছ। তেমন করে বাজে না।” 

আমি বললুম, “যার জন্মদিন, তাকে দেখছি না কেন? কৌশিক কোথায়?” 

মালতী বলল, “দাদার সঙ্গে জগিং করতে বেরিয়েছিল। এমনিতে তো বাবুর ঘুমই ভাঙতে চায় না। কিন্তু দাদা আসবার পর থেকেই দেখছি ভোর পাঁচটায় বিছানা থেকে উঠে দাদার সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আজও আমরা মামা-ভাগ্নে ঠিক পাঁচটাতেই উঠেছি। তারপরে মাইল দুয়েক দৌড়েছিও। লেক থেকে ফেরার পথে ও রিক্তাদের বাড়িতে ঢুকল। বলল, রিক্তামাসি ওর জন্যে পায়েস রেঁধে রেখেছে। খেয়ে ফিরবে। 

আমি বললুম, “রিক্তা কে মালতী?” 

“আমার বন্ধু। ইউনিভার্সিটিতে একসঙ্গে পড়তুম। ওর ছেলে বুবনু আর কৌশিক তীৰ্থপতিতে একই ক্লাসে পড়ে। দুজনে খুব বন্ধুত্ব। ওদের বাড়িতে গেলে তাই আর আসতেই চায় না। আজ অবশ্য তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে বলেছি।” 

বলতে-না-বলতে কৌশিক এসে পড়ল। সুকুমার সমগ্র’ পেয়ে সে দারুণ খুশি। বইয়ের পাতা ওলটাতে-ওলটাতে বলল, “যাই মা, বুবনুকে একবার দেখিয়ে আনি। এক ছুটে যাব আর চলে আসব।” 

মালতী বলল, “কিরণদা, আমার মাংস রান্না হয়ে গেছে। একবার এসে একটু টেস্ট করে যান তো আমার কর্তাটি তো কিছুই বোঝেন না, আপনি ঠিক বলতে পারবেন, আর একটা স্টিম লাগবে, নাকি এই ঠিক আছে।” 

বলে আমাকে রান্নাঘরের দিকে নিয়ে গেল মালতী। গিয়ে প্রেশার কুকারের ভিতর থেকে হাতায় করে এক টুকরো মাংস তুলে একটা প্লেটে ঢেলে প্লেটটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “আসলে কিন্তু ঠিক এইজন্যে আপনাকে ডেকে আনিনি, কিরণদা। অন্য একটা কথা আছে।” 

অবাক হয়ে বললুম, “কী কথা?” 

“অরুণের স্বাস্থ্য মোটেই ভাল যাচ্ছে না। মাস খানেক আগে ছোটখাটো একটা স্ট্রোক হয়ে গেছে। ডাক্তার বিশ্রাম নিতে বলছে, ও নিজেও ডাক্তার, জানে যে, বিশ্রাম নেওয়া দরকার, তবু নেবে না। ভেবেছিলুম, ওকে আর কৌশিককে নিয়ে দাদার সঙ্গে আমিও মাসখানেকের জন্যে ব্যাঙ্গালোরে গিয়ে থাকব। কিন্তু ও রাজি নয়। বলে, ওর রোগীদের মধ্যে দু-তিনজনের অবস্থা মোটেই ভাল যাচ্ছে না, এই সময়ে ও যদি কলকাতা ছেড়ে বাইরে যায় তো তাদের কী হবে।” 

বললুম, “ওর জানাশোনা অন্য কোনও ডাক্তারের হাতে ওদের তুলে দিয়ে গেলেই তো পারে। সেটাই তো রীতি।”

মালতী বলল, “তো সেই কথাটাই ওকে একটু বুঝিয়ে বলুন। দাদা আর আপনি, দু’জনে মিলে যদি বলেন তো আমার মনে হয় আপনাদের কথা ও ফেলতে পারবে না।” 

বললুম, “বলব।” তারপর প্লেট থেকে তুলে মাংসের টুকরোটা মুখে ফেলে বললুম, “ঠিক আছে, আর স্টিম দেবার দরকার নেই।” 

বসবার ঘরে ফিরে এসে দেখি, বাংলাদেশের ঢাকের বাজনা থেকে ভাদুড়িমশাই এসে শান্তিপুরী শাড়ির প্রসঙ্গে ঢুকেছেন। শাড়ির থেকে সঙ্গীত। সঙ্গীত থেকে মন্দির-স্থাপত্য। এমনকি, তাতেও নাকি বাঙালির প্রতিভার স্বাক্ষর একেবারে জ্বলজ্বল করছে। 

এই শেষ কথাটায় অরুণবাবু আর আমি একটু সংশয় প্রকাশ করেছিলুন। ভাদুড়িমশাই আমাদের থামিয়ে দিয়ে বললেন, “সত্যিই তা-ই। আরে বাবা, আমি কি কোণার্কের সূর্য-মন্দির দেখিনি? নাকি ভুবনেশ্বরের লিঙ্গরাজ টেম্পল না-দেখেই আমি আমাদের মন্দির-স্থাপত্যের মহিমা কীর্তন করতে বসেছি? শুধু ওই দুটি মন্দির কেন, ভারতবর্ষের হরেক এলাকায় এমন আরও বিস্তর মন্দির রয়েছে, যার উচ্চতা তো বটেই, শিল্পশোভা দেখেও আমাদের তাক লেগে যায়। তা থাক না। আমরা সমতল এলাকার বাসিন্দা, আমাদের এদিকে পাহাড় নেই, তাই পাহাড় কেটে পাথর এনে বড় বড় সব মন্দিরও আমরা বানাতে পারিনি। কিন্তু তাতে হলটা কী? মাটি পুড়িয়ে ইট বানিয়ে তাই দিয়ে যে-সব মন্দির আমরা গড়েছি, তার স্থাপত্যের বাহার কি কারও চেয়ে কিছু কম? আর শিল্প-শৈলীর কথাই যদি তোলেন কিরণবাবু, তো আমি বলব, আমাদের টেরাকোটার মন্দিরের কোনও তুলনাই আমি খুঁজে পাই না। ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি, এবারে যে আমি কলকাতায় এলুম, তাও আসলে একটা মন্দিরের ব্যাপারেই।” 

“মন্দিরের ব্যাপারে?” অবাক হয়ে বললুম, “মানত-টানত ছিল নাকি?” 

“আরে না, মশাই,” একগাল হেসে চারু ভাদুড়ি বললেন, “মন্দিরের ব্যাপারে মানে তার বিগ্রহের সন্ধানে। তিনশো বছরের পুরনো অষ্টধাতুর বিগ্রহ, হঠাৎ একদিন দেখা গেল, তিনি উধাও।” 

“খোঁজ পেলেন?” 

“পেলুম বই কী। কোথায় পেলুম জানেন? স্ট্র্যান্ড রোডের এক গুদামের মধ্যে। সেখান থেকে সেটিকে ক্যালকাটা এয়ারপোর্টে নিয়ে গিয়ে প্লেনে তুলে দেবার ব্যবস্থা হচ্ছিল। যদি আর একটা দিনও দেরি হত, তা হলে আর দেখতে হত না, বীরভূমের মন্দিরের বিগ্রহ তা হলে আমস্টার্ডামের মিউজিয়ামের শোভাবর্ধন করত।” 

বললুম, “বিগ্রহ চুরির যেন একটা হিড়িক পড়ে গেছে, তাই না?” 

“পড়েছেই তো। এই তো, আজকের কাগজটাই দেখুন না। একই দিনে দু’দুটো মন্দির থেকে বিগ্রহ উধাও। একটা খবর আলিপুরদুয়ারের কাছের এক গ্রামের, আর একটা খবর বাঁকুড়ার।” 

অরুণবাবু বললেন, “এ তো দেখছি সর্বনেশে কান্ড!” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “সর্বনাশ বলে সর্বনাশ, এককালে এ-দেশ থেকে হিরেমুক্তো যেভাবে লোপাট হয়েছে, এখন সেইভাবে লোপাট হচ্ছে আমাদের প্রত্নদ্রব্য। আসলে ব্যাপারটা কী জানো, অরুশ, এ-সব মোটেই ছোটখাটো ছিঁচকে চোরের কান্ড নয়, এর পিছনে বড়-বড় সব মাথা রয়েছে। দেশের সম্পদ লুঠ করে নিয়ে বিদেশে বেচে দিতে তাদের বিবেকে কিছুমাত্র বাধে না। বিদেশিরাও কোটি-কোটি টাকা ঢালছে। তিনশো বছরের পুরনো একটা গণেশমূর্তির জন্যে তারা কত টাকা অফার করেছিল জানেন কিরণবাবু?” 

জানা হল না, কেন না তার আগেই কৌশিক এসে বলল, “মামাবাবু, তোমার ফোন, শিলিগুড়ি থেকে কারা যেন কথা বলতে চান। বললেন যে খুব জরুরি।” 

ফোনে কথা বলে ড্রইংরুমে ফিরে ভাদুড়িমশাই বেজার গলায় বললেন, “ওই যে একটা কথা আছে না, আমি যাই বঙ্গে তো আমার কপাল যায় সঙ্গে, তা সেই কথাটা একেবারে অক্ষরে-অক্ষরে ফলে গেল। ব্যাঙ্গালোর থেকে বঙ্গে এলুম, কিন্তু কপালের লেখা তো আর খন্ডানো যায় না, একটা তদন্তের কাজ শেষ হতে না হতেই আর-একটা তদন্তের কাজ ঘাড়ে চাপল। ছুটির বারোটা বেজে গেল, মশাই।” 

আমি বললুম, “কোথায়? কিসের তদন্ত?” 

“ফের সেই বিগ্রহ-চুরির তদন্ত। একটু আগেই আলিপুরদুয়ারের কাছে এক গ্রামের মন্দির থেকে বিগ্রহ উধাও হবার কথা বলছিলুম না? ওই যে মশাই, আজকের কাগজে যার খবর বেরিয়েছে। আসলে ওটা এক ধনী ব্যবসায়ীর পৈতৃক বাড়ির মন্দিরের বিগ্রহ। ব্যবসায়ী ভদ্রলোক তাঁর গাঁয়ের বাড়িতে থাকেন না, শিলিগুড়িতে থাকেন। সেখান থেকেই ফোন করেছিলেন। মূর্তিটা উদ্ধার করে দিতে হবে, তা সে যত টাকাই লাগুক।” 

“যাবেন?” 

‘যেমন কাতর গলায় অনুরোধ জানালেন, তাতে আর ‘না’ বলতে পারলুম না। পরশুর বদলে দিন-সাতেক বাদে মাদ্রাজ গেলে হয় না কিরণবাবু?” 

“তা হয়। কিন্তু এ-কথা কেন বলছেন বলুন তো?” 

“আপনিও তা হলে আমার সঙ্গে চলুন না। সাত দিন হয়তো লাগবে না, তার অগেই হয়তো ফিরে আসব।” 

“কবে যেতে হবে?”

“কালকেই। সকালের ফ্লাইটে।” চারু ভাদুড়ি বললেন, “আপনি রেডি হয়ে থাকবেন, এয়ারপোর্টে যাবার পথে আমি আপনাকে তুলে নেব।” 

সাংবাদিকতার কাজে মাঝে-মাঝেই আমাকে বাইরে যেতে হয়। যখনই যাই, হালকা হাতে যাই, বোঝা বাড়াই না। এবারে যে-জন্যে যাচ্ছি, তার সঙ্গে অবশ্য আমার কাজের কোনও সম্পর্ক নেই। যাঁর কাজ, আমি তাঁর সঙ্গী মাত্র। কোথায় থাকব, কে জানে। তবে থাকব তো মাত্রই কয়েকটা দিন। তাও, যতদূর আঁচ করতে পারছি, গাঁয়ের মধ্যেই থাকতে হবে। রোজ-রোজ অতএব ধুতি-পাঞ্জাবি পালটাবার কোনও দরকার হবে না! 

বাসন্তীও সে-কথা বুঝতে পেরেছিল। একটা হ্যান্ড-ব্যাগের মধ্যে যৎসামান্য জামাকাপড় গুছিয়ে দিতে দিতে সে তাই বলল, “মনে হচ্ছে, এতেই হয়ে যাবে। তবে কিনা যাচ্ছ তো নর্থবেঙ্গলে, সেখানে এই সময়ে একটু একটু শীত পড়ে, তাই একটা সোয়েটার আর হাল্কা একটা আলোয়ানও দিয়ে দিলুম। আর এই দেখে নাও, গতবারে তো বাইরে যাবার সময় শেভিং কিট্‌টা নিতে ভুলে গিয়েছিলে, সেটাও এখানে ব্যাগের এই একধারে ঢুকিয়ে দিয়েছি। একটা চিরুনি আর তোয়ালেও রইল। একটা টর্চও দিলুম। দ্যাখো, আর-কিছু লাগবে?” 

লাগবে কি না, ভাবার সময় পাওয়া গেল না, রাস্তায় হর্ন বেজে উঠল। বোঝা গেল, ট্যাক্সি নিয়ে ভাদুড়িমশাই হাজির। 

ছেলেমেয়েরা তখনও ঘুমোচ্ছে। বাসন্তীকে বললুম, “মাদ্রাজ যাওয়ার দিনটা দু’-চার দিন পিছিয়ে গেল। ভালই হল। তুমি এবারে ধীরে-সুস্থে গোছগাছ করে নিতে পারবে।” 

বাসন্তী বলল, “সন্ধের পরে যদি বাইরে বেরুতে হয় তো টর্চটা সঙ্গে নেবে; আলোয়ান মুক্তি না-দিয়ে বেরুবে না!” 

বললুম “হ্যাঁ, হ্যাঁ, একেবারে আপাদমস্তক একটি নকুড়মামা হয়ে বেরুব।” বলে নীচে এসে গাড়িতে উঠে পড়লুম। 

সকালবেলার শহর। রাস্তায় ভিড়ভাট্টা নেই। মোড়ের দোকান থেকে দু’প্যাকেট সিগারেট কিনে নিলুম। তারপরেই বড়রাস্তায় পড়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে আমাদের ট্যাক্সি ছুটল এয়ারপোর্টের দিকে। 

রাত্ত্বির থেকেই একটা কথা মাঝে-মাঝে মনে হচ্ছিল। কাল তো ছিল রবিবার, তা হলে প্লেনের টিকিট জোগাড় হল কীভাবে? 

কথাটা ভাদুড়িমশাইকে জিজ্ঞেস করতে তিনি বললেন, “টিকিট তো জোগাড় হয়নি।” 

“তা হলে?” 

“অত ভাবছেন কেন, টিকিট অনেক সময় এয়ারপোর্টেও পাওয়া যায়। তবে হ্যাঁ, আসন খালি থাকা চাই। তা যদি না থাকে তো পাওয়া যাবে না।” 

“ধরুন পাওয়া গেল না। সে-ক্ষেত্রে কী করব?” 

“সে-ক্ষেত্রে আজ না-গিয়ে কাল যাব। শিলিগুড়ির ক্লায়েন্টকেও সে-কথা জানিয়ে রেখেছি। তবে এখনই সে-কথা উঠছে কেন? দেখাই যাক না, কপালে থাকলে পেয়েও তো যেতে পারি। অনেকেই তো পেয়ে যায়।… আর হ্যাঁ, এয়ারপোর্টে পৌঁছে আগেই দুজনের ভিতরে ঢুকবার দরকার নেই। আপনি বরং হ্যান্ড-ব্যাগ দুটো নিয়ে বাইরে একটু অপেক্ষা করবেন, আমি ভিজিটর’স টিকিট কেটে ভিতরে গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসব যে, বাগডোগরার দুটো টিকিট পাওয়া যাবে কি না।” 

ভিজিটর’স টিকিট কাটবার অবশ্য দরকারই হল না। এয়ারপোর্টে নেমে ট্যাক্সি ভাড়া মেটাচ্ছি, এমন সময় এক ভদ্রলোক আমাদের সামনে এসে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনি কি মিঃ ভাদুড়ি।” 

“হ্যাঁ,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু আপনাকে তো চিনতে পারলুম না।”

“নমস্কার।” ভদ্রলোক বললেন, “আমার নাম বিপিনবিহারী সেন। শিলিগুড়ির মিঃ চৌধুরিকে তো আপনি চেনেন, তা কাল বিকেলে তিনি আমাকে ফোন করে বললেন, আপনারা দুজন আজ সকালের ফ্লাইটে বাগডোগরা যাবেন, আমি যেন এয়ারপোর্টে এসে দুখানা টিকিট আপনাদের পৌঁছে দিই।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু আমিই যে চারু ভাদুড়ি, তা আপনি জানলেন কী করে?” 

বিপিন সেন বললেন, “খুব সহজেই জানা গেল। আজকের ‘দৈনিক সমাচার’ দেখেননি বুঝি? তাতে বীরভূমের মন্দির থেকে চুরি যাওয়া মূর্তির উদ্ধারের খবর ছাপা হয়েছে। সেই সঙ্গে বেরিয়েছে এ-ব্যাপারে আপনার কৃতিত্বের কাহিনি আর ফোটোগ্রাফ। তা ফোটোগ্রাফ যখন দেখেছি, আসল মানুষটাকে তখন চিনতে পারব না কেন?”

আমি বললুম, “খবরের কাগজের ছাপা আজকাল অনেক পরিষ্কার হয়েছে, তাই চিনতে পারলেন, আগেকার দিন হলে পারতেন না। সেকালের এক নিউজ এডিটরের কাছে শুনেছি, তিনি যখন তাঁর চাকরি-জীবন শুরু করেন, অনেক কাগজই তখন নাকি আন্দাজে পড়তে হত। আর ছবি যা ছাপা হত, তা দেখে নাকি বোঝাই যেত না যে, কোনটা সম্রাট পঞ্চম জর্জের ছবি আর কোনটা…”

বলতে যাচ্ছিলুম ‘হিন্ডেনবুর্গের’। কিন্তু বলা হল না। বিপিনবাবু আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “দাঁড়ান দাঁড়ান, কী একটা অ্যানাউন্সমেন্ট হচ্ছে।” 

“এয়ারপোর্টের প্রবেশ-পথের ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলুম আমরা। পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে যা ঘোষণা করা হচ্ছিল, তার প্রথমটা ভাল করে শুনতে পাইনি। শুধু শেষটা শুনলুম, প্রসিড ফর ইয়োর সিকিওরিটি চেক্।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমাদের ফ্লাইট। তা হলে আর দেরি করব না। মিঃ সেন, আপনার কোনও মেসেজ আছে? মানে শিলিগুড়িতে মিঃ চৌধুরিকে কিছু বলতে হবে?” 

বিপিনবাবু বললেন, “না না, তেমন কিছু বলবার নেই। শুধু জানিয়ে দেবেন যে, আমার আর সঞ্জীববাবুর তো এই ফ্লাইটে বাগডোগরা যাবার কথা ছিল। তা আমাদের টিকিট দুখানা তো আপনাদের দিয়ে দিলুম, আমরা তাই এ-সপ্তাহে না-গিয়ে সামনের সপ্তাহে গিয়ে ওঁর সঙ্গে দেখা করব। ব্যাবসার কথাবার্তা যা হবার, তা তখনই হবে।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “টিকিট দুখানার দামটা তা হলে রাখুন।” 

“আরে ছি ছি,” বিপিনবাবু তিন-পা পিছিয়ে গিয়ে বললেন, “দাম নিয়ে আপনি ব্যস্ত হবেন না। ও-সব আমার আর চৌধুরির ব্যাপার, আমরা বুঝব। আচ্ছা, তা হলে আমি চলি। আপনারা এগোন।” 

বিপিনবাবুকে ধন্যবাদ দিয়ে আমরা ভিতরে ঢুকে কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালুম। 

যাঁদের সঙ্গে মালপত্রের ঝামেলা নেই, তাঁদের জন্যে আলাদা লাইন। সেখানে নেহাতই জনা পাঁচ-ছয় লোক দাঁড়িয়ে আছেন। ফলে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। টিকিট দেখিয়ে বোর্ডিং কার্ড নিয়ে সিকিওরিটি পেরিয়ে আমরা ডিপার্চার লাউঞ্জে ঢুকে পড়লুম। 

ঢুকেই আমাদের কাগজের রিপোর্টার চন্দ্রমাধবের সঙ্গে দেখা। চন্দ্রমাধব বাগডোগরা থেকে দার্জিলিং যাবে। বলল, “আপনিও দার্জিলিং যাচ্ছেন নাকি কিরণদা?” 

বললুম, “না চাঁদু, আমি তোমার মতো ভাগ্যবান নই। গেলে অবশ্যই ভাল হত, কিন্তু না, অন্তত এ যাত্রায় আমি দার্জিলিং যাচ্ছি না।” 

“তা হলে কোথায় যাচ্ছেন?” 

“আপাতত শিলিগুড়ি যাচ্ছি।” 

“সে তো আপাতত। শিলিগুড়ি থেকে যাচ্ছেন কোথায়?” 

বললুম, “তুমি যে পুলিশের লোকেদের মতো জেরা করতে শুরু করলে! তা হলে শোনো, আমার বন্ধুটি যদি শিলিগুড়ি থেকে কলকাতায় ফিরতে চান তো কলকাতায় ফিরব। আর যদি শিলিগুড়ি থেকে জলপাইগুড়ি যেতে চান তো অগত্যা আমাকেও সেখানে যেতে হবে।” 

ভাদুড়িমশাই ইতিমধ্যে আমাদের কাছ থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে একটা চেয়ারে বসে পড়েছিলেন। হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা ম্যাগাজিন বার করে নিয়ে চুপচাপ তার পাতা ওলটাচ্ছিলেন তিনি। চন্দ্রমাধব একবার আড়চোখে তাঁকে দেখে নিয়ে বলল, “আপনি কিছু লুকোচ্ছেন দাদা। নিশ্চয় কোনও ক্রাইম-ডিটেকশানের ব্যাপারে কোথাও যাচ্ছেন। কিন্তু কোথায় যাচ্ছেন, সেটা ফাঁস করছেন না।” 

হেসে বললুম, “ডিটেকশানের কথা উঠছে কেন?” 

নিচু গলায় চন্দ্রমাধব বলল, “আপনার বন্ধুটি তো একজন ফেমাস ডিটেকটিভ। সেইজন্যেই উঠছে।” 

আশ্চর্য হয়ে বললুম, “বটে? তা তুমি সে-কথা কী করে জানলে?” 

“বা রে,” চন্দ্রমাধব বলল, “আমাদের কাগজেই তো আজ তিনের পাতায় ওঁর ছবি বেরিয়েছে। কেন, আপনি দেখেননি?” 

“কাগজ পড়বার সময় পেলে তো দেখব।” 

ছবিটা মনে হচ্ছে সবাই দেখেছে, একমাত্র আমি আর ভাদুড়িমশাই ছাড়া। ভাদুড়িমশাইকে সে-কথা বলতে তিনি বললেন, “আপনার বন্ধুটি আমাকে চিনতে পেরেছেন?” 

“নিশ্চয়।” 

“এবং এটাও তিনি দেখলেন যে, আমরা বাগডোগরা যাচ্ছি।” 

“তা তো দেখলই! কেন, তাতে কি কোনও ক্ষতি হবার আশঙ্কা আছে?” 

“ক্ষতি কেন হবে?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “বরং আপনার বন্ধুটি এই ফ্লাইটে আমাদের সহযাত্রী হওয়াতে আমি নিশ্চিন্ত বোধ করছি। না মশাই, ক্ষতির আশঙ্কা আর নেই।” 

কথাটার মানে বুঝতে পারলুম না। 

প্লেন ছাড়ল আরও আধ ঘন্টা বাদে। 

মাথার উপরকার লকারের মধ্যে হ্যান্ডব্যাগ দুটোকে ঢুকিয়ে রাখতে-রাখতে দেখলুম, চন্দ্ৰমাধব যেখানে জায়গা পেয়েছে, আমরা তার থেকে বেশ কিছুটা দূরে রয়েছি। অর্থাৎ আমাদের কথাবার্তা যে ও শুনতে পাবে, এমন কোনও সম্ভাবনা নেই। ভাদুড়িমশাইও সেটা লক্ষ করেছিলেন। সিট-বেলট বাঁধতে-বাঁধতে তবু তিনি গলাটা একটু নামিয়ে নিয়ে বললেন, “ওই যে তখন আপনাকে বললুম, আপনার বন্ধুটি এই ফ্লাইটে যাওয়াতেই বরং আমি নিশ্চিন্ত বোধ করছি, আমার এই কথাটার অর্থ বোধহয় আপনি ধরতে পারেননি। তাই না?” 

টফি আর লজেন্সের থালা নিয়ে এয়ার-হোস্টেস আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। থালা থেকে দুটো লজেন্স তুলে নিয়ে একটি ভাদুড়িমশাইকে দিলুম, তারপর নিজেরটাকে মুখের মধ্যে চালান করে দিয়ে বললুম, “সত্যিই পারিনি। কেন ও-কথা বললেন বলুন তো?” 

“বলছি। তার আগে বরং আর-একটা কথা বলি। এই ফ্লাইটে যারা আমাদের সহযাত্রী, তারা সব্বাই যে নিজের-নিজের টিকিটে যাচ্ছে, তা ভাববেন না। যেমন আমরা দুজনে, তেমনি আরও দু’-চারজন প্যাসেঞ্জার নিশ্চয় অন্যের টিকিটে ট্রাল করছে।” 

“তা করুক না। তাতে ক্ষতি কী।” 

“কাজটা বেআইনি।” 

“তা হোক না, ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের তো তাতে কোনও লোকসান হচ্ছে না। যার নামে যে-ই ট্রাল করুক, টিকিটের দাম তো তারা পেয়েই গেছে।” 

“তা যে পেয়েছে, সে তো আমিও জানি।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “কিন্তু বিপদ তাতে কমছে না। কাজটা শুধু বেআইনি নয়, ঘোর বিপজ্জনকও বটে।” 

“এ-কথা বলছেন কেন?” 

‘এইজন্যে বলছি যে, আমি একটু সন্দেহবাতিকগ্রস্ত মানুষ। সেটা অবশ্য অস্বাভাবিক নয়। যে-ধরনের কাজ আমাকে করতে হয়, তাতে কাউকেই একেবারে ষোলো-আনা বিশ্বাস করা চলে না।” 

অবাক হয়ে বললুম, “এ-ক্ষেত্রে কাকে অবিশ্বাস করছেন?” 

প্লেন আকাশে উঠে পড়েছে। সিট-বেল্ট খুলতে খুলতে চারু ভাদুড়ি বললেন, “কাকে নয়? এই ধরুন, শিলিগুড়ি থেকে যিনি আমাকে ফোন করেছিলেন, সেই সত্যপ্রকাশ চৌধুরিকে কি আমি চিনি? চিনি না। তারপরে এই যে বিপিনবিহারী সেন নামে যে ভদ্রলোকটি এয়ারপোর্টে এসে দুখানা টিকিট আমাদের হাতে তুলে দিয়ে গেলেন, তিনিও আমার সম্পূর্ণ অচেনা মানুষ। বিপিনবাবু আমাদের যে দুটি টিকিট দিয়েছেন, তার একখানা তাঁর নিজের নামে, আর অন্যখানা সঞ্জীব বিশ্বাসের নামে কেনা হয়েছিল।” 

“তাতে হয়েছে কী?”

“কিছুই হত না, যদি এঁরা আমার চেনা মানুষ হতেন। মুশকিল এই যে, এঁদের একজনও আমার চেনা নন। সত্যি বলতে কী, এঁরা ভাল লোক না মন্দ লোক, সরল লোক না মতলববাজ, সে-বিষয়ে কোনও ধারণাই আমার নেই। হতে পারে যে, এঁরা খুবই ভাল লোক; আবার শেষ পর্যন্ত যদি দেখা যায় যে, এঁরা প্রত্যেকেই একেবারে হাড়ে-বজ্জাত, তো তাতেও আমি অবাক হব না। আসলে এই দ্বিতীয় সম্ভাবনাটার কথা ভেবেই আমি প্রথম-দিকটায় একটু সতর্ক থাকার পক্ষপাতী।” 

“তা তো বুঝলুম, কিন্তু চন্দ্রমাধব এই ফ্লাইটে থাকায় আপনি নিশ্চিন্ত হচ্ছেন কেন?” 

“বলছি। ধরুন, আমরা তো এখন কলকাতার বাইরে, তা আজই দুপুরে বিপিন বিহারী সেন কলকাতায় একটা ব্যাঙ্ক লুঠ করলেন কি কাউকে খুন করলেন।” 

শিউরে উঠে বললুম, “সে কী?” 

“অবাক হচ্ছেন কেন?” চারু ভাদুড়ি বললেন, “এমনটা তো হতেই পারে। কিন্তু ভদ্রলোক যদি পরে কখনও ধরাও পড়েন, তো আদালতে ওঁর অপরাধের কথাটা প্রমাণ করা সহজ হবে না।” 

“কেন হবে না?” 

“এইজন্যে হবে না যে, খুব সহজেই উনি একটা অ্যালিবাই খাড়া করতে পারবেন। উনি বলতে পারবেন যে, ব্যাঙ্ক লুঠ কিংবা খুনটা যে দিন হয়, উনি সেদিন কলকাতায় ছিলেন না, সকালের ফ্লাইটে উনি বাগডোগরা চলে গিয়েছিলেন। ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসও তাদের খাতাপত্র দেখে বলবে যে, হ্যাঁ, ওই নামের একজন প্যাসেঞ্জার সেদিন বাগডোগরার ফ্লাইটে ছিলেন বটে।” 

“ফলে ব্যাঙ্ক লুঠ কিংবা খুন করেও উনি বেকসুর খালাস পেয়ে যাবেন?”

“না, তা পাবেন না।” চারু ভাদুড়ি হেসে বললেন, “কেননা, আপনার বন্ধুটিই সে-ক্ষেত্রে আদালতে এই সাক্ষ্য দেবেন যে, টিকিটটা বিপিনবাবুর নামে কাটা হয়েছিল বটে, কিন্তু সেই টিকিটে বিপিনবাবুর বদলে আমি সেদিন বাগডোগরা গিয়েছিলুম। তবে হ্যাঁ, বাগডোগরায় নেমেই আপনার বন্ধুকে সে-কথা জানিয়ে রাখতে হবে।” 

একটু বাদেই আমাদের প্লেন বাগডোগরায় ল্যান্ড করল। প্লেন থেকে নেমেই চন্দ্রমাধবকে জানিয়ে দিলুম যে, আমরা অন্যের টিকিটে বাগডোগরায় এসেছি। চন্দ্রমাধব বলল, “সে তো অনেকেই অন্যের টিকিটে ট্রাভল করে, তাতে হয়েছে কী?” 

কী যে হতে পারে, ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে কথা বলে সেটা বুঝতে পেরেছিলুম। তাই গম্ভীর গলায় চন্দ্রমাধবকে বললুম, “না হে চাঁদু, কাজটা তারা ভাল কবে না।” 

কথা বলতে-বলতে এয়ারপোর্টের বাইরে চলে এসেছিলুম। 

চন্দ্রমাধব তার লাগেজ কালেক্ট করতে গিয়েছে। তাকে বলেছিলুম যে, আমাদের জন্যে সম্ভবত একটা গাড়ি আসবে। ইচ্ছে করলে সেই গাড়িতে সে শিলিগুড়ি শহর পর্যন্ত একটা লিফ্‌ট পেতে পারে। তাতে সে বলল, “আমার দেরি হবে কিরণদা। আপনারা এগোন।” 

এয়ারপোর্টের বাইরে আসতেই ট্যাক্সিওয়ালারা ছেঁকে ধরেছিল আমাদের। তাদের সরিয়ে দিয়ে মধ্যবয়সী একজন ভদ্রলোক আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন, তারপর ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আশা করছি আপনারাই মিঃ ভাদুড়ি আর মিঃ চ্যাটার্জি? 

ভাদুড়িমশাই ‘হ্যাঁ’ বলতেই ভদ্রলোক বললেন, “নমস্কার। আমি সত্যপ্রকাশ চৌধুরি। পথে কোনও কষ্ট হয়নি তো?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “না না, কষ্ট হবে কেন? তা ছাড়া প্লেন আজকে ঠিক সময়েই ছেড়েছিল, দমদম এয়ারপোর্টে অনর্থক বসে থাকতে হয়নি।” 

“বিপিন ঠিক সময়ে টিকিট পৌঁছে দিয়েছিল?” 

“বিলক্ষণ। ভদ্রলোক আমাদের আগেই এয়ারপোর্টে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু উনি কে?” 

“বিপিন আর সঞ্জীব আমার অনেক দিনের চেনা লোক। কলকাতায় ওদের দুজনেরই মস্ত বড় কাঠের ব্যাবসা। পরস্পরের ওরা খুব বন্ধুও বটে। ওরা আমার কাছ থেকে কাঠ কিনে সেই কাঠ চেরাই করে বিক্রি করে। কাঠ কেনার ব্যাপারেই মাঝে-মাঝে ওদের শিলিগুড়িতে আসতে হয়। যখন আসে তখন একসঙ্গেই আসে।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কাল আমাকে ফোন করে আপনি যখন জানলেন যে, আমরা দুজনে আসব, তখন টিকিটের জন্যে ওঁকে ফোন করলেন বুঝি?” 

“হ্যাঁ।” সত্যপ্রকাশ বললেন, “আমি তো জানতুমই ওরা আজ সকালের ফ্লাইটে শিলিগুড়িতে আসবে। তাই ফোন করে বিপিনকে বললুম যে, তার আর সঞ্জীবের টিকিট দুখানা যেন আপনাদের দিয়ে দেয়। ওরা দু-চার দিন পরে এলেও ক্ষতি নেই।” 

“ভদ্রলোককে টিকিটের দাম দিতে গিয়েছিলুম। কিন্তু উনি নিলেন না।” 

“কেন নেবে? ওদের সঙ্গে তো আমার টাকা-পয়সার লেনদেন হয়, সেই খাতে এই টিকিট দুখানার দাম অ্যাডজাস্ট করে নেব। এমন তো আমরা হামেশাই করি।” 

প্রাইভেট গাড়িগুলো যেখানে পার্ক করা রয়েছে, কথা বলতে বলতে সেইখানে এসে দাঁড়িয়েছিলুম আমরা। সত্যপ্রকাশ একটা অ্যাম্বাসাডারের দরজা খুলে দিয়ে বললেন, “উঠে পড়ুন। গাড়ি আমি নিজেই চালাই, সুতরাং একজন এসে সামনে বসতে পারেন।” 

কাল সকালে যখন চারু ভাদুড়িকে ফোন করেন, সত্যপ্রকাশ তখন তাঁর ব্যাবসার বিবরণও জানিয়ে রেখেছিলেন। ভদ্রলোক মূলত কাঠের কারবারি। তা ছাড়া, শিলিগুড়ি শহরের যে-বাজারটাকে ‘হংকং বাজার’ বলে, অর্থাৎ যেখানে দোকানে দোকানে বিদেশি জিনিসপত্রের ছড়াছড়ি দেখে তাক লেগে যায়, তার খুব কাছেই তাঁর একটা বড়সড় হোটেলও রয়েছে। আর আছে গোটা পাঁচেক ট্রাক। তার মধ্যে দুটো তাঁর নিজেরই কারবারের কাজে লাগে, বাকি তিনটেকে তিনি ভাড়া খাটান। 

সত্যপ্রকাশের বয়স বছর-পঁয়তাল্লিশের বেশি হবে না। চেহারা এখনও শক্তসমর্থ, তবে মাথার চুল সামনের দিকে কিছুটা পাতলা হয়ে এসেছে। মানুষটি যে শৌখিন, তা তাঁর গাড়ি দেখলেই বোঝা যায়। এয়ার-কন্ডিশন্ড গাড়ি, ড্যাস-বোর্ডে ইলেকট্রিক ঘড়ি বসানো, আমরা উঠে বসতেই ক্যাসেটে কিশোরকুমারের গান শুরু হয়ে গেল। ক্যা হুয়া, ক্যায়সে হুয়া…। ‘অমর প্রেম’-এর হিট্-গান। 

ভদ্রলোকের পোশাকও একেবারে ফিটফাট। মিহি সুতোর ধুতির সঙ্গে সাবুদানার কাজ করা আদ্দির পাঞ্জাবি পরেছেন, পায়ে জরির কাজ করা কোলাপুরী চপ্পল। স্টিয়ারিং হুইল ডাইনে-বাঁয়ে ঘোরানোর সঙ্গে-সঙ্গে বাঁ বাতের অনামিকায় যে আংটিটি বার-বার ঝকমক করে জ্বলে উঠছিল, তার নীলচে আভাযুক্ত হিরেটা নেহাত ছোট নয়। 

বাগডোগরা থেকে গাড়ি চালিয়ে সত্যপ্রকাশ একেবারে সরাসরি তাঁর হোটেলে আমাদের নিয়ে এলেন। হোটেলের বার-লাইসেন্স রয়েছে, আর শিলিগুড়ি তো কাঁচা-পয়সার জায়গা, ফলে সন্ধের পর এই হোটেলে নাকি কাঁঠালে মাছি পড়ার মতো ভিড় জমে যায়। সত্যপ্রকাশ আমাদের ড্রিংকস অফার করেছিলেন, আমরা ও-রসে বঞ্চিত শুনে আর পীড়াপীড়ি করলেন না, নিজের জন্যে একটা জিন অ্যান্ড লাইম নিয়ে বেয়ারাকে বললেন, “তা হলে যা, কে কী খাবেন জেনে নিয়ে লাঞ্চের ব্যবস্থা কর।” 

খাওয়া-দাওয়া শেষ হবার পরে সত্যপ্রকাশ বললেন, “একটা ডাল-বেড ঘর আপনাদের খুলে দিচ্ছি, আপনারা একটু বিশ্রাম করে নিন, আর সেই ফাঁকে আমি আমার ব্যাবসার কাজটা একটু দেখে আসি। বিকেল নাগাদ শিলিগুড়ি থেকে আমরা বেরিয়ে পড়ব।” 

সত্যপ্রকাশ চলে গেলেন। 

হোটেলে যে ঘরটা আমাদের দেওয়া হয়েছিল, সেটা চারতলায়। যে বেয়ারাটি আমাদের সঙ্গে এসেছিল, তার কাছে শুনলুম, আকাশ যেদিন পরিষ্কার থাকে, সেদিন সকালবেলায় আমাদের ঘরের সামনের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালে কাঞ্চনজঙ্ঘা একেবারে স্পষ্ট দেখা যায়। বেলা বাড়লে অবশ্য কিছুই আর চোখে পড়ে না। 

ঘরখানা চমৎকার। অ্যাটাচ্‌ড বাথ তো আছেই, তার ফিটিংসও একেবারে হ’ল-ফ্যাশানের। বিছানার পাশে একটা টেলিফোনও দেখলুম। মস্ত জানালা। তাতে ব্রোকেডের কাজ করা মোটা কাপড়ের বাহারি পর্দা ঝুলছে। বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, এটা বেশ চড়া-ভাড়ার শৌখিন হোটেল : তা শিলিগুড়িতে এখন এমন হোটেলও নেহাত একটি-দুটি নয়, বেশ কয়েকটি রয়েছে। তাও নাকি আগে থাকতে বুক্ করে না রাখলে ঘর মেলে না। 

সেটা অবশ্য অস্বাভাবিকও নয়। তার কারণ দেশ স্বাধীন হবার পরে জলপাইগুড়ি শহরের যদিও বিশেষ পরিবর্তন ঘটেনি, শিলিগুড়ি একেবারে হু-হু করে বেড়েছে। যেমন বেড়েছে ব্যাবসা, তেমনি বেড়েছে লোকসংখ্যা, আর লোকসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে শহরের আয়তন। তিপ্পান্ন সালে একবার শিলিগুড়িতে এসেছিলুম। মনে আছে, রাত আটটার সময়ে সেবারে স্টেশন থেকে বেরিয়ে শুধু অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই বিশেষ চোখে পড়েনি। সেই শিলিগুড়ির সঙ্গে এই শহরের বিস্তর ফারাক। ব্যাবসার সঙ্গে বেড়েছে চোরাই কারবার। তার সূত্রেও নেহাত কম লোক এখন শিলিগুড়িতে আসে না। থলি বোঝাই করে যেমন তারা টাকা নিয়ে যাচ্ছে এখান থেকে, তেমনি আবার উড়িয়েও দিচ্ছে তাড়া-তাড়া নোট। শিলিগুড়িও তাই আর সেই মফস্বল-বাংলার ছোট শহরটি নেই, ভারতবর্ষের হরেক এলাকা, হরেক কিসিমের ব্যবসায়ী আর ধান্দাবাজ মানুষদের সে এখন নতুন আর-একটি বড়বাজার। 

ভাদুড়িমশাই জিজ্ঞেস করলেন, “কী ভাবছেন এত?” 

বললুম, “শিলিগুড়ির কথা। সত্যি, জায়গাটা একেবারে পালটে গেছে। কিন্তু সে-কথা থাক, আপনি কী ভাবছিলেন বলুন।” 

“আমি ভাবছিলুম সত্যপ্রকাশবাবুর কথা।” 

“মানুষটিকে কেমন লাগল?” 

“এখনও খারাপ লাগেনি। উদ্যমী, পরিশ্রমী মানুষ। তা ছাড়া, কথাবার্তাতেও বেশ সজ্জন বলেই মনে হয়। তবে হ্যাঁ, কাজের কথা তো কিছুই হল না।” 

বললুম, “সেটা বোধহয় ওঁদের সেই গ্রামের বাড়িতে যেতে-যেতে হবে।” 

বলতে-না-বলতে সত্যপ্রকাশ এসে গেলেন। হাতে একটা প্যাকেট। বললেন, “এখানকার কোন মিষ্টি বিখ্যাত, আপনারা জানেন?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ক্ষীরের শিঙাড়া।” 

“শাবাশ!” সত্যপ্রকাশ বললেন, “আপনাদের জন্যে সেই ক্ষীরের শিঙাড়া নিয়ে এসেছি। খেয়ে নিন, তারপরেই আমরা মুকুন্দপুর রওনা হব।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “এখন খাব না। প্যাকেটটা সঙ্গে নিয়ে চলুন, যেখানে যাচ্ছি, সেখানে পৌঁছে খাওয়া যাবে।” 

আমি বললুম, “আপনাদের গ্রামের নাম কি মুকুন্দপুর?” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “হ্যাঁ, এই মুকুন্দপুরেই আমাদের পৈতৃক বাড়ি। জায়গাটা আলিপুরদুয়ারের খুব কাছে।” 

বেরিয়ে পড়লুম। রাস্তা নেহাত কম নয়। ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে খানিকটা এগোবার পরে ময়নাগুড়িতে একবার গাড়ি থামানো হল। কিনা সেখানকার রসগোল্লা অতি চমৎকার। রসগোল্লার সঙ্গে খেতে হল চা। বলা বাহুল্য, এর চেয়ে খারাপ কম্বিনেশন আর কিছুই হতে পারে না, কিন্তু তবু যে একেবারে সুবোধ বালকের মতো খেয়ে নিলুম, তার কারণ, আমার মনে হচ্ছিল যে, একে তো ক্ষীরের শিঙাড়া এখনও খাইনি, তার উপরে যদি রসগোল্লাও না-খাই তো ভদ্রলোক খুবই দুঃখিত হবেন। 

ময়নাগুড়ির পরে গয়েরকাটা এবং আরও কয়েকটা জায়গা ছুঁয়ে হাসিমারা ছাড়িয়ে বাঁ-দিকে মোড় নিয়ে, হাইওয়ে থেকে সরু একটা রাস্তায় পড়ে আরও বেশ কয়েক মাইল পেরিয়ে যখন আমরা মুকুন্দপুরে পৌঁছলুম, তখন রাত হয়ে গেছে। 

কৃষ্ণপক্ষের রাত। চাঁদ ওঠেনি। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলুম, এই কার্তিকমাসেও বিশেষ কুয়াশা জমেনি, নক্ষত্রগুলি যেন হিরের কুচির মতন ঝকমক করছে। নীচের অন্ধকার তাতে অবশ্য কিছুমাত্র কাটছে না। গাড়ি যেখানে থামল, তার কাছেই বড়-বড় ঝুপসি কয়েকটা গাছ। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে তবে গাছপালার আড়ালে কয়েকটা ঘরবাড়ি চোখে পড়ে। তবে সে-সব ঘরবাড়ি যেন অন্ধকারের মধ্যে ডুবে আছে। রেডিয়াম-ডায়ালের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলুম, ন’টা বাজে। এরই মধ্যে কি সবাই ঘুমিয়ে পড়ল নাকি? 

একটু বাদেই অবশ্য একটা আলো দুলে উঠল। লন্ঠন হাতে কে একজন এগিয়ে এল আমাদের দিকে। কাছে এসে দাঁড়াতে সত্যপ্রকাশ বললেন, ‘কী রামদাস, এরই মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছিলে?” 

রামদাসের মাথার চুল যেমন ধবধপে সাদা, গায়ের রং তেমনি কুচকুচে কালো। বয়স মনে হল সত্তর-পঁচাত্তর, তবে শরীর এখনও সটান। সত্যপ্রকাশের কথা শুনে একটু কুণ্ঠিতভাবে বলল, “না খোকাবাবু, ঘুমোব কেন? মা আর পিসিমা এই খানিক আগে শুয়ে পড়েছেন, কিন্তু আমি তো জানি যে, তোমার কথার নড়চড় হয় না, যখন আসবে জানিয়েছ তখন ঠিকই আসবে। তাই জেগেই ছিলুম।” 

“তা হলে আলো নিয়ে আসতে এত দেরি হল কেন? গাড়ির শব্দ পাওনি?” 

“পেয়েছিলুম। কিন্তু রঙ্গিলার জ্বর নিচ্ছিলুম তো। তাই একটু দেরি হয়ে গেল।” 

হঠাৎ পালটে গেল সত্যপ্রকাশের গলা। একটু ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কেমন আছে রঙ্গিলা এখন? জ্বর নেই তো?” 

“আছে। তবে কম। একশো।” 

“কথা বলছে?” 

রামদাস বলল, “না, যখন জেগে থাকে, তখন শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কাউকে যে চিনতে পারছে, তাও মনে হয় না।” 

ভাদুড়িমশাই জিজ্ঞেস করলেন, “রঙ্গিলা কে?” 

সত্যপ্রকাশ বললেন, “রামদাসের নাতনি।”