উরি ব্যস! কত লোক মেলায়! ভিড়ে ভিড়! কত দোকান! কত বাহার! কত হাসি! কত মজা! এত জায়গায় ঘুরেছে মিতুল কিন্তু এমন মেলা কক্ষনো দেখেনি।
তাঁবু পড়ল মেলায়। মস্ত তাঁবু।
ঢ্যাঁড়া পড়ল।
বাজনা বাজল। নাচ শুরু হয়ে গেল মিতুলের।
সানাই প্যাঁ পোঁ বাজে,
মিতুল সোনা নাচে।
দেখতে দেখতে ভিড়ে ভিড়! কী ভিড়! কী ভিড়! নাচ দেখবে কী তারা! মিতুলের নাচ দেখে নিজেরাই নাচতে শুরু করে দিল।
পুতুল নাচে, মিতুল নাচে
তাই না দেখে বাড়ি নাচে, ধেড়ে নাচে
ছোটকা নাচে, ছুটকি নাচে
বাচ্চা নাচে, কাচ্চা নাচে
হই হই কাণ্ড!
মিতুলের নাচের কথা এ-কান থেকে ও-কান গেল। এমুখ থেকে ওমুখ গেল। এ-গ্রাম থেকে ও-গ্রাম গেল।
কেউ আসছে পায়ে হেঁটে
কেউ চলেছে হাতির পিঠে
টগবগ টগ ছুটছে ঘোড়া
ছুটছে ঘোড়া এক্কাগাড়ি
ক্যাঁচ ক্যাঁচ ক্যাঁচ গোরুর গাড়ি!
অবাক! সক্কলে অবাক! এমন নাচ হয় না তো!
একবার দেখল। মন ভরল না।
দুবার দেখল। চোখ মানল না।
তিনবারের বার, আশ মিটল না।
তাই বার বার দেখল। বার বার ছুটল। রাত্তিরে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পুতুল নাচের স্বপ্ন দেখল!
কথাটা পৌঁছে গেল রাজবাড়িতে। পুতুল নাচের কথা।
প্রথমে পৌঁছল দ্বারীর কানে।
দ্বারী বলল সিপাইকে।
সিপাই শোনাল মাহুতকে।
মাহুত থেকে বামুনঠাকুর।
বামুন থেকে ঝিয়ের কানে।
ঝি বললে রানিমাকে।
রানি তুলল রাজার কানে।
রাজা বললেন, ‘তাই নাকি? তবে তো দেখতে হয় পুতুলনাচ।’
অমনি সাজ সাজ রব পড়ল। রাজা মেলায় চললেন। পুতুলের নাচ দেখতে।
নাচ দেখলেন। অবাক চোখে চেয়ে রইলেন। বললেন, ‘ডাক তো ছেলেটাকে।’
ডুংরির ডাক পড়ল।
‘তোমার পুতুল তো বেশ নাচে!’ রাজা বললেন।
ডুংরি মাথা হেঁট করল।
‘আমারও একটি পুতুল আছে। সেও নাচতে জানে। তার সঙ্গে তোমার পুতুল নাচতে পারবে? নাচে তাকে হারাতে পারবে!’ রাজা জিজ্ঞেস করলেন।
ডুংরি এবার মাথা তুলল। বুক ফুলিয়ে বলল, ‘নিশ্চয়ই!’
‘যদি তোমার পুতুল আমার পুতুলকে হারায়, তবে তোমায় রাজ্য দেব। যদি তোমার পুতুল হারে, তবে তোমার পুতুল নেব।’ রাজা বললেন।
ডুংরি বলল, ‘আমার পুতুল কোনোদিন হারে না। রাজামশাই, মিথ্যে আপনার বাজি। আমি নাচ লড়তে রাজি।’
রাজা বললেন, ‘বেশ।’ বলে গোঁফে হাত বুলালেন।
মিতুল মুচকি হাসল। রাজার গোঁফ দেখে।
তারপর?
ড্যাম কুড় কুড় বাদ্যি বাজে।
পিউ পিউ পিউ বাঁশি।
তাকদুম দুম ঢোলক বাজে।
কাঁই না না না কাঁসি।
হই হই পড়ে গেল। কাতারে কাতারে লোক জমেছে। ছাতের ওপর গাছের ডালে। পথের ধারে রথের চূড়ায়। ঘোড়ার পিঠে। হাতির মাথায়।
মেলার মাঠে দুই ধারে দুই মঞ্চ হল।
এক মঞ্চে মিতুল দাঁড়াল। আর এক মঞ্চে রাজার পুতুল ছোট্ট মেয়ে!
কী সুন্দর সেজেছে রাজার পুতুল ছোট্ট মেয়ে। রেশমি শাড়ি। রংবাহারি। গোলাপ-গোলাপ ঠোঁট। সারা অঙ্গে মুক্তাহিরা, পান্না-চুনি। ঝিলিক ঝিলিক।
আর তেমনি সেজেছে মিতুল। যেন রাজপুত্তুর! মাথায় মুকুট। যেমনি জামা তেমনি কাপড়। আলোয়-আলোয় ঝলমল। সোনায়-সোনায় টলমল।
বাজনা বাজল। মিতুল নাচ ধরল।
রাজপুত্ত্বর শিকারে যাচ্ছে। হাতে তার তিরধনুক। সামনে সোনার হরিণ। হরিণ ছোটে, মিতুল ছোটে। হরিণ নাচে, মিতুল নাচে। নাচতে নাচতে মিতুলের তির ছুটল। হরিণ অমনি টুপ করে লুকিয়ে পড়ল। অমনি একটা বাঘ! ‘গাঁক’ করে মিতুলের সামনে লাফিয়ে পড়েছে। পড়েই ঝাঁপিয়ে পড়ল।
বাঘ লাফিয়ে ডাইনে ছোটে। মিতুল ছোটে বাঁয়ে।
বাঘ যদি যায় বাঁদিকে তো মিতুল ছোটে সামনে।
বাঘে মিতুলে লড়াই লেগে গেল। সে কী কাণ্ড! একবার তিরের ফলা বাঘের চোখে যায় যায়! আর একবার বাঘবাবাজি মিতুলকে খায়-খায়!
‘মিতুল!’ কে যেন চেঁচিয়ে ডাকল আঁতকে উঠে!
কে চেঁচাল তো কে চেঁচাল! কে শুনবে কার কথা! যা লড়াই চলছে। সবাই তটস্থ। ভয়ে আড়ষ্ট।
‘মিতুল!’ আবার কে ডাকল।
‘মিতুল!’ জোরে ডাকল।
‘মিতুল!’ আরও জোরে।
‘মিতুল!’ খুব জোরে।
ওমা! কে ডাকছে? রাজার পুতুল-মেয়ে না?
মেয়ে ডাকছে? মিতুলের নাম জানল কেমন করে? ভালো করে দেখি তো!
আরে! আরে! এ যে সেই রাজকন্যা! মিতুলের বোনটি! এ কী কাণ্ড! কেমন করে রাজবাড়ি গেল? কেমন করে চিনল মিতুলকে?
মিতুল তার বোনটিকে দেখেওনি। চিনতেও পারেনি। ডাক শুনতেও পায়নি। শুনবে কী! এখন লড়াই বাঘের সঙ্গে। বাঘের সঙ্গে লড়তে গেলে অন্য কথা কানে নেয়!
দেখতে দেখতে সাঁই-ইই তির ছুটল মিতুলের হাত থেকে। লাগল বাঘের চোখে। আর একটা তির সাঁই-ই লাগল গিয়ে বাঘের আর এক চোখে। ঝরঝর করে রক্ত পড়তে লাগল। বাঘের চোখ অন্ধ। ল্যাজ গোটানো। মারল ছুট। আর এমনি গাছের ডাল ভেঙে পড়ল। হাতির শুঁড় নেচে উঠল। লক্ষ লোক ‘সাবাস সাবাস’ করে চেঁচিয়ে উঠল। মিতুলের নাচ শেষ হল! লক্ষ লোকের মাঝ থেকে তার বোনটিও খুশিতে চেঁচিয়ে উঠল। আবার ডাকল, ‘মিতুল আমি বোনটি। আবার ডাকল, ‘মিতুল। আমি তোমার বোনটি। আমার দিকে চাও।’ মিতুল শুনতেই পেল না। যা হই হই!
এবার রাজার পুতুল-মেয়ের পালা।
আবার বাজনা বাজল। সুর উঠল। গাছে গাছে ফুল। গোলাপ, টগর, উঁই। ফুলে ফুলে রং। হাওয়া দোদুল দোলা।
কিন্তু পুতুল-মেয়ে যেন কেমন কেমন নাচছে! নাচতে নাচতে থামছে। মিতুলের দিকে। চাইছে। থামছে। আবার নাচছে। বাঁশিতে সুর কাটছে। নূপুরে তাল পড়ে না। নাচতে যেন মন সরে না। হাজার হাজার লোক ছি ছি করে চেঁচিয়ে ওঠে। হিহি করে হেসে ওঠে। ছ্যাঁ ছ্যাঁ করে পালিয়ে যায়।
মেয়ে আর নাচে না। সবাই চেঁচিয়ে উঠল, ‘হেরে গেছে, হেরে গেছে।’ লজ্জায় রাজার মুখ লাল হয়ে গেল।
ডুংরি মিতুলকে বুকে নিয়ে লাফিয়ে উঠল। জয়ের আনন্দে। হাজার হাজার লোক জয়ের মালা পরিয়ে দিল ডুংরির গলায়। উৎসব লেগে গেল ডুংরিকে নিয়ে, মিতুলকে নিয়ে। রাজার পুতুল মেয়ের দিকে কেউ ফিরেও তাকাল না।
মিতুলও এতক্ষণ দেখেনি রাজার মেয়ে-পুতুলকে। এবার ঘুরে দাঁড়াল মিতুল। বুক ফুলিয়ে চাইল তার দিকে। থমকে গেল। চমকে উঠল। মুখখানি তার চেনা-চেনা লাগছে যেন!
আরও ভালো করে দেখল মিতুল।
চোখ দুটি তার জানা-জানা লাগছে যেন! মেয়েটি কাঁদছে কেন? মিতুল চিনতে পেরেছে!
লাফিয়ে উঠল মিতুল। চেঁচিয়ে উঠল, ‘বোনটি!
সাড়া দিল বোনটি, ‘মিতুল!’
সে-ডাক কেউ শুনতে পেল না। খালি শুনল মিতুল আর তার বোনটি। শুনল, কিন্তু কেউ তো কারো কাছে যেতে পারল না। পারল না তো বোনটি মিতুলের গলা জড়িয়ে খুশিতে কেঁদে উঠতে। কেমন করে পারবে? ওরা যে পুতুল! ওদের মনের কথা কে জানে! কেউ না। একজনও না।
অপমানে লজ্জায় উঠে দাঁড়াল রাজা। বলল, ‘চলো।’
রাজার পুতুল-মেয়ে রাজার সঙ্গে রথে চেপে চলে গেল। আর মিতুল ডুংরির কোলে চেপে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল। এত আনন্দেও তার মন একটুও মানছে না। এত কাছে পেয়েও সে বোনটিকে খুঁজে পেল না মিতুলের মনে হচ্ছে, বার বার মনে হচ্ছে, সে জেতেনি, সে জেতেনি, সে হেরে গেছে। কেঁদে ফেলল মিতুল। কোথায় গেলে পাবে তার বোনটিকে? কোথায়? কোথায়?
কাঁদতে কাঁদতে রাত এসে গেল। ঘুম-ঘুম রাত।
রাত এল। মেলার আলো নিভল। দোকানপাট বন্ধ হল। সব নিজকুম। চুপচাপ। কেমন। নিঃসাড়ে আসে রাত? কেমন সবাইকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়!
ঘুম এল না মিতুলের। উঠে দাঁড়াল মিতুল। দেখল ডুংরির দুটি চোখের দিকে। কী ঘুম ঘুমোচ্ছে সে! বেরিয়ে পড়ল তাঁবুর পর্দা ঠেলে রাস্তায়! চুপিচুপি। কেউ না দেখতে পায়! সে রাজার বাড়ি যাবে। যাবে সে বোনটির কাছে! কিন্তু যাবে কেমন করে? সে তো রাজার বাড়ির রাস্তা জানে না!
রথের দাগ রয়েছে রাস্তায় এখনও। রাজার রথের দাগ। মিতুল অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখতে পেল। মনে হল মিতুলের, দাগ দেখে দেখে তো চলা যায়! চলল মিতুল। চলল ওই রথের চাকার দাগের ওপর পা ফেলে ফেলে। ছোট্ট ছোট্ট পা।
অনেকক্ষণ হেঁটেছে মিতুল। ছোট্ট পা দুটি ব্যথা-ব্যথা করছে হাঁটতে হাঁটতে। তবুও যেতে হবে মিতুলকে। বোনটিকে তার খুঁজে পেতে হবে। যেমন করে হোক।
আলো দেখা গেল। একটু দূরে। আলোর দিকে চেয়ে চেয়ে এগিয়ে গেল মিতুল। ক- পা যেতে একটা আকাশ-ছোঁয়া দরজা। মিতুলের নজরে পড়ল। আরও ক-পা যেতে মিতুল স্পষ্ট দেখল রথের চাকার দাগ আকাশ ছোঁয়া দরজা দিয়ে ভিতরে চলে গেছে। তবে কি এটা রাজবাড়ি?
আরও এগিয়ে গেল মিতুল। উঁকি মারল দরজার আড়াল থেকে। দরজার দুপাশে দুজন লোক বসে আছে। বসে বসে ঢুলছে। কোমরে তাদের তরোয়াল। হাতে বর্শা। মিতুল চুপিসাড়ে টুক করে ভিতরে ঢুকে গেল। দেখতেই পেল না লোক দুটো। ঢুললে কি দেখা যায়! অত বড়ো বাড়িতে এখন বোধ হয় সবাই ঘুমোচ্ছে। জেগে আছে মস্ত মস্ত সেজবাতি! দেওয়ালের ওপর। বাবা! দালান তোনয়! এদিক থেকে ওদিক দেখাই যায় না। ঝকঝকে, তকতকে! শ্বেত পাথরের চক মেলানো। হাঁটতে হাঁটতে পা পিছলে যায়! দেওয়ালের কোণ ঘেঁষে ঘেঁষে হাঁটছেমিতুল। খুব সাবধানে। তবু দুবার পড়ে গেল।
কিন্তু এই এত বড়ো রাজবাড়িতে কোথায় খুঁজবে সে বোনটিকে? কোন দিকে যাবে? কেউ যদি দেখে ফেলে মিতুলকে!
তুব সে হাঁটল এঘর-ওঘর দেখতে দেখতে। এমহল-ওমহল ঘুরতে ঘুরতে। একটা সিঁড়ির সামনে দাঁড়াল মিতুল। ওপরে উঠতে পারলে হয়! কিন্তু উঠবে কেমন করে? সিধে ওপরে। যাওয়া কী চারটিখানি ব্যাপার! ভাবতে ভাবতে চমকে উঠল। ‘খট, খট, খট!’ পায়ে চলার শব্দ যেন! হ্যাঁ, ঠিক তাই। কে যেন হাঁটতে হাঁটতে এদিকেই আসছে! কী করবে মিতুল?
‘এই হো হো হো,’ লোকটা কী বিকট চেঁচিয়ে উঠল। দেখতে পেল নাকি! পিলে চমকে গেল মিতুলের! আগুপিছু কিছু না ভেবে,’ দে ছুট, দে ছুট।’ মিতুল ছুট দিল সিঁড়ির ওপর। টপাস টপাস করে ছোট্ট ছোট্ট পা ফেলে এক্কেবারে ওপরে। ছুটতে ছুটতে ডানদিক গেল। ডানদিক থেকে বঁদিকে গেল। সামনে ঘর। পিছনে ঘর। এধার আলো। ওধার কালো। কালো দেখে, কালো কালো অন্ধকারে চুপটি করে লুকিয়ে পড়ল। লুকিয়ে ঘাপটি মেরে বসে রইল।
একটু পরে যখন সব চুপচাপ, কোনো হাঁকডাক নেই, নিঃসাড়, তখন মিতুল ওধারের আলোর দিকে ছুটে গেল। আলোর সামনে ঘর। ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল মিতুল। ঢুকেই সামনে পালঙ্ক। পালঙ্কের নীচে চুপটি করে বসে রইল।
একটুক্ষণ বসে রইল। আর কোনো সাড়া নেই। কোনো শব্দ নেই। মিতুল উঁকি মারল পালঙ্কের নীচ থেকে। উঁকি মারল, তারপর পা বাড়াল। বাইরে এল। আহা! ঘরটি কী সুন্দর! দেওয়ালে দেওয়ালে আঁকা রং সাজানো ছবি। মাথার ওপর ফুল! একটা ফুল খুব বড়ো। পাশে ছোটো ছোটো অনেক আরও! নীল আলো ছড়িয়ে আছে সারা ঘরে! একটা দোলনা। দুলছে দুল দুল। হাওয়াতে। চোখ জুড়িয়ে গেল মিতুলের। ছোট্ট পালঙ্ক। ঝকঝকে বিছানা পাতা। কিন্তু কেউ তো শুয়ে নেই পালঙ্কে। কাউকে তো দেখতে পাচ্ছে না মিতুল!
হঠাৎ বুকটা ধক করে কেঁপে উঠল মিতুলের। জানলার ধারে যেন কে বসে আছে! গালে হাত দিয়ে। কে ও?
বোনটি! ডেকে উঠল মিতুল পিছন থেকে আচমকা!
ওমা! সত্যিই তো মিতুলের বোনটি বসে আছে!
চমকে উঠল মিতুলের বোনটি। লাফিয়ে দাঁড়াল। ছুট্টে এল। গলাটি জড়িয়ে ধরল মিতুলের। চোখে চোখে জল ভরে গেল। উপছে গেল।
‘কোথায় ছিলে এতদিন আমার ভাইটি?
মিতুল বলল, ‘লুকিয়ে লুকিয়ে!’
বোনটি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কেউ দেখতে পায়নি তো?’
মিতুল ঘাড় নাড়ল, ‘না।’ বোনটির চোখের জল মুছিয়ে দিল মিতুল।
‘চোখ কেন কাঁদে মিতুল?’ জিজ্ঞেস করল বোনটি। ‘চোখ যদি না থাকত?’
মিতুল বলল, ‘আমি তোমায় কোনোদিন দেখতে পেতুম না।’
‘আমিও তোমায় কোনোদিন দেখতে পেতুম না। বসে বসে তোমার কথা ভেবেছি কত দিন, কত রাত!’
মিতুলও বলল, ‘আমিও তোমায় খুঁজেছি কত দিন, কত রাত! কেমন করে রাজবাড়িতে এলে?’
‘সে তো অনেক গল্প!’
মিতুল বলল, ‘আজ সারা রাত শুধু গল্প করব। বলো তুমি সে গল্প!’
বোনটি বলল, ‘সেই যে ঠাকুরদাপেঁচা আমায় পিঠে নিয়ে উড়ল, আর থামল না। উড়তে উড়তে কত নদী পেরিয়েছি, কত বন পেরিয়েছি, কত পাহাড় পেরিয়েছি। ঠাকুরদাপেঁচাকে জিজ্ঞেস করেছি, ‘আমার ভাইকে কি খুঁজে পাব না?’
ঠাকুরদা বলল, ‘এই তো এত খুঁজছি, পাচ্ছি কই?”
‘তবে? কী হবে আমার?’ জিজ্ঞেস করেছি আমি ঠাকুরদাপেঁচাকে।
ঠাকুরদা বলল, ‘তাই তো!’ তারপর বলল, ‘আমার কাছেই বা থাকবি কী করে? আমার বাসা গাছে। তার চেয়ে চ, তোকে রাজবাড়িতে পৌঁছে দিই। সুখে থাকবি।’
ঠাকুরদাপেঁচা আমায় রাজবাড়ির ছাদের ওপর নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। রাজা একদিন ছাদে হাওয়া খেতে উঠলেন। আমায় দেখতে পেলেন। আমায় আদর করে ঘরে তুললেন। আমি নাচলুম। তারপর থেকে আমি এখানেই আছি। একদিন রাজা খুব ধুমধাম করে ভোজ দিলেন। দুর দুর দেশ থেকে রাজকন্যা এল। কত রাজপুত্তুর। কত রাজরানি। কত বড়ো বড়ো রাজা। রাজা তাঁদের বললেন, ‘এইটি আমার পুতুলমেয়ে। আপনাদের নাচ দেখাবে।’
‘আমি তাঁদের নাচ দেখালাম। আমার নাচ দেখে সবাই অবাক হয়ে গেল। ধন্যি ধন্যি পড়ে গেল। সবাই ভাবল পুতুল আবার এমনি করে নাচতে পারে! তারপর থেকে আমি রাজাকে রোজ নাচ দেখাই। সেই থেকে আমি রাজার পুতুলমেয়ে।’
মিতুল বলল, ‘আর আমি–’
ঘন্টা বাজল। নিজের গল্প বলতে গিয়ে থমকে গেল মিতুল। ভোরের ঘন্টা। এক্ষুনি ঘুম ভেঙে যাবে সক্কলের। কেউ যদি মিতুলকে দেখতে পায়? কী হবে তখন?
বোনটি ব্যস্ত হল। বলল, ‘মিতুল তুমি লুকিয়ে পড়ো।’
মিতুল ভয়ে ভয়ে বলল, ‘ কোথায়?
‘আমার ওই গয়না রাখার বাক্সটার পাশে।’
‘কতক্ষণ লুকিয়ে থাকব?’ জিজ্ঞেস করল মিতুল।
‘রাত আসুক। রাত্তির এলে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়বে, আমরা তখন এখান থেকে চলে যাব। রাজবাড়িতে রাজার পুতুলমেয়ে সেজে আর থাকতে ইচ্ছে করছে না।’
মিতুল বলল, ‘সেই ভালো।’ বলে গয়না রাখার বাক্সের পাশে লুকিয়ে পড়ল।
সেদিন সারারাত জেগে কেটেছে রাজার। ঘুম এল না চোখের পাতায়। লজ্জায়। অপমানে। রাগে। কী না একটা বাচ্চা ছেলে তার পুতুলকে হারিয়ে দিল! ছিঃ ছিঃ ছিঃ! সকালবেলা ডাক পড়ল মন্ত্রীর।
রাজা হুকুম করলেন, ‘আমার ওই পুতুলটা চাই। ওই ছেলেটার পুতুল।’
একশো সিপাই সাজল। ছুটল তারা ডুংরির পুতুল কেড়ে আনতে। জানতেও পারল না সে পুতুল যে রাজবাড়িতেই লুকিয়ে আছে। রাজার মেয়ে-পুতুলের কাছে!
ডুংরির তাঁবু তছনছ করে ফেলল সিপাইরা।
পুতুল পাওয়া গেল না।
ডুংরিকে তারা মেরে অজ্ঞান করে দিল।
ডুংরি কিছুতেই বলতে পারল না। ডুংরি বলবে কেমন করে? সে নিজেও জানে না। সে নিজেও অবাক! কোথায় গেল তার পুতুল?
সিপাইরা ডুংরিকে বন্দী করে নিয়ে চলল রাজার কাছে।
মিতুলের বোনটি দাঁড়িয়ে ছিল ঘরের জানলায় একা। মিতুল ঘুমিয়ে পড়েছিল বাক্সের পাশে। লুকিয়ে লুকিয়ে। জানলায় চোখ মেলে দেখছিল বোনটি। বাইরে। এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায় রাজবাড়ির সিংদরজাটা। সিংদরজার ওপর দিয়ে, আরও দূরে ছবির মতো শহর। রোজ দেখে বোনটি। রাস্তার ওপর দিয়ে উট চলেছে হেঁটে হেঁটে, দুলে দুলে। বেশ লাগে দেখতে।
মিতুলের ঘুম ভেঙে গেল। বাক্সের পাশটা যা ঘুপটি! আরাম করে ঘুমোনো যায়! মিতুল উঁকি মারল। তার বোনটিকে দেখতে পেল না। তাই আর একবার উঁকি মারল। বারে! বেশ তো। আরাম করে বসে আছে জানলার ধারে বোনটি। আলতো আলতো পা ফেলে বেরিয়ে এল। মিতুল। পিছন থেকে ঝুপ করে চোখ দুটি চেপে ধরল।
‘এ কী বেরিয়ে এলে যে!’ থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করল বোনটি!
উঃ! ওই অন্ধকারে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকতে ভালো লাগে? তুমি তো বেশ হাওয়ায় বসে। আছ!’ বলল মিতুল। হঠাৎ নজর গেল বাইরে, ‘ দেখো, দেখো বোনটি, কেমন উট হাঁটছে!’
চোখ মেলে চাইল বোনটি। বলল, ‘ দেখো, দেখো, কেমন হাতি যাচ্ছে!’
দুজনে চোখ মেলে তাকিয়ে ছিল উট আর হাতির দিকে। হঠাৎ বোনটি সিংদরজার দিকে তাকাল। বলল, ‘মিতুল, মিতুল, রাজার সিপাইরা কাকে বেঁধে আনছে দেখো!’
মিতুল চেয়ে দেখল। চমকে উঠল। বলল, ‘আরে! আরে এ যে ডুংরি!’
‘সে কে? জিজ্ঞেস করল বোনটি।
মিতুল বলল, ‘ওই তো আমার বন্ধু। ওর কাছেই তো আমি এতদিন ছিলুম। ওকে ধরল কেন সিপাই?’ ব্যস্ত হয়ে উঠল মিতুল।
বোনটি বলল, ‘আমি যে হেরে গেছি তোমার কাছে, তাই। রাগ হবেনা রাজার? লক্ষ লক্ষ লোক দেখল, কী অপমান বল তো!’
‘তার জন্যে ডুংরির কী দোষ? ও তো কিছু অন্যায় করেনি। ওকে কেন বেঁধে আনবে? জিজ্ঞেস করল মিতুল।
‘রাজা হয়তো শাস্তি দেবে।’
‘না, না’, ব্যাকুল হয়ে তার বোনটির হাত দুটি জড়িয়ে ধরল মিতুল। বলল, ‘না, না, তা হতে দেব না। কিছুতেই না। ডুংরির জন্যেই যে তোমাকে আমি খুঁজে পেয়েছি।’
বোনটি এবারে ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘তুমি আবার লুকিয়ে পড়ো। নইলে তোমাকেও ধরে নিয়ে যাবে। যা হবার সেই রাত্তিরে। সববাই যখন ঘুমিয়ে পড়বে।’
মিতুল আবার লুকিয়ে পড়ল বাক্সটার আড়ালে। লুকিয়ে লুকিয়ে ডাকল, ‘বোনটি!
‘কেন?’
‘আমায় একটু কাগজ আর দোয়াত-কলম দেবে?’
‘কী করবে?’
‘দাও না। পরে বলব।’
কাগজ আর দোয়াত-কলম এগিয়ে দিল।
মিতুল লিখতে বসল বাক্সের আড়ালে।
আজ ভারি খুশি। ভারি খুশি রাজকন্যা পুতুলটি। দোলনায় দোল খেতে লাগল রাজকন্যা। আজ যে সে মিতুলকে ফিরে পেয়েছে। দোল খাচ্ছে আর ভাবছে, ‘কী লিখছে মিতুল?’
মিতুল চিঠি লিখছে ডুংরিকে।
রাত্তির হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। মস্ত রাজবাড়িটা ঘুমে নিজঝুম। ঘুমিয়ে পড়েছে সক্কলে। ঘুমায়নি মিতুল আর তার বোনটি। দুজনেই তৈরি এখন। সময় গুনছে। আজ চলে যাবে তারা। তার আগে শেষবারের মতো মিতুল দেখে যাবে ডুংরিকে। রাজবাড়ির কয়েদখানায় সে যে বন্দী আছে!
ঘন্টা বাজল ঢং ঢং। অন্ধকার নিস্তব্ধ রাত্তিরে কত দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে ঘন্টার সুর। সময় হল। এগিয়ে এল বোনটি। বলল, ‘চলো মিতুল, যাই।’
মিতুল ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, ‘কোন দিকে?
বোনটি বলল, ‘আমার হাত ধরো।’
মিতুল বোনটির হাত ধরে বেরিয়ে পড়ল।
খুব সাবধানে যেতে হবে। সারারাত জেগে থাকে সান্ত্রিরা। সিঁড়ি দিয়ে নামতে হবে নীচে। একটু ইদিক-উদিক হলে আর রক্ষে নেই। নির্ঘাৎ বিপদ।
সিঁড়ি দিয়ে নামা, সেকি সহজ কাজ!
সিঁড়ির সামনে এসে দাঁড়াল দুজনে। মিতুল কানে কানে জিজ্ঞেস করল বোনটিকে, ‘পারবে তো?’
‘তুমি?”
মিতুল বলল, ‘আমি উঠতে পেরেছি। নামতেও পারব।’
বোনটি বলল, ‘আমি তো কোনোদিন নিজে নিজে উঠিনি। যদি পা ফসকে পড়ে যাই!’
মিতুল সঙ্গে সঙ্গে উপুড় হয়ে বসে পড়ল। বলল, ‘আমার পিঠে চাপো।
‘পারবে তো?’
‘এখন ভয় পেলে চলে!’ উত্তর দিল মিতুল।
বোনটি মিতুলের পিঠে চাপল। মিতুল একটি একটি পা ফেলল। একটি একটি সিঁড়ি টপকাল। খুব সাবধানে।
‘লাগছে মিতুল?’ বোনটি জিজ্ঞেস করল।
মিতুল বলল, ‘এখন কথা বলো না। লক্ষ রাখো কেউ আসছে কিনা!”
বাহাদুর ছেলে মিতুল। অত উঁচু সিঁড়ি। ঠিক নেমে এল বোনটিকে পিঠে নিয়ে। কেউ দেখতেও পেল না। কেউ জানতেও পারল না। কিন্তু এতখানি নামতে যা কষ্ট হয়েছে তা মিতুলই জানে। তবু তার মুখে হাসি। বোনটিকে পিঠ থেকে নামিয়ে ধরল। এগিয়ে চলল সামনে। এখন আর কথা নয়। একদম নয়।
আশ্চর্য! এত বড়ো রাজবাড়িতে একটিও মানুষের টিকি নেই। রাত্তিরে কেউ পাহারায় নেই! কী রে বাবা! সবাই একসঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল নাকি!
তাড়াতাড়ি চলল। এগিয়ে।
তারা তো জানে না কয়েদখানা কোনদিকে। দেখেওনি কোনোদিন। তবু সামনের দিকেই চলল। আঁকাবাঁকা পথে না হাঁটাই ভালো।
থমকে দাঁড়াল বোনটি। কী দেখল? মিতুলের হাত চেপে ধরল। একটা ফটক। সামনে দ্বারী। নিঃসাড় চুপচাপ দাঁড়িয়ে।
মিতুল বোনটির কানের কাছে মুখ এনে জিজ্ঞেস করল, ‘কী করা যায়? সামনে দ্বারী দাঁড়িয়ে!’
বোনটি বলল, ‘পিছন দিকে চলা যায় না?’
মিতুল বলল, ‘পিছনে ফেরার আগে সামনেটা একবার ভালো করে দেখি দাঁড়াও।’
দেখল মিতুল এগিয়ে গিয়ে।
লোকটা নড়ে না।
আরও এগিয়ে গেল। হাঁটি হাঁটি পা পা।
তবু লোকটা সরে না।
কেমন যেন সাহস হয়ে গেল মিতুলের। হাতছানি দিয়ে ডাকল। হাত ধরল বোনটির। লোকটার পায়ের ফাঁক দিয়ে গলে গেল। একেবারে সামনে। ওমা! লোকটা ঘুমোচ্ছে বেমালুম! কী ঘুম-রে বাবা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে! ছুট দিল মিতুল বোনটির হাত ধরে ফটকের ভিতরে! বুঝতেই পারল না।
ছুটতে ছুটতে থামে কেন মিতুল? থেমে সামনে দেখে কেন? কী দেখে?
এই-রে! মিতুল আর রাজকন্যা রাজবাড়ির হাতিশালে ঢুকে পড়েছে যে! অজানতে। একেবারে হাতির পায়ের নীচে দাঁড়িয়ে তারা! কত হাতি রে বাবা! শুড় তুলছে। দোল খাচ্ছে। ঝিম মারছে। ঘুম দিচ্ছে। দিল ছুট। অমনি সব চেয়ে ছোটো হাতিটা দেখতে পেয়েছে। চেঁচিয়ে উঠল।
ছোটোকে দেখে বড়ো চেঁচাল। বড়ো চেঁচাল, ধেড়ে চেঁচাল। ধেড়ে চেঁচাল, ধাড়ি চেঁচাল। বেঁটে চেঁচাল ঢ্যাঙা চেঁচাল।
হাতিদের সে কী চেঁচানি। পাঁই পাঁই ছুট দিলে মিতুল আর রাজকন্যা সেখান থেকে। চোখ কান বুজে ছুটল। আর দেখতে! বেটা ঢুকে পড়েছে ঘোড়াশালে।
ঘোড়াশালে হাজার হাজার ঘোড়া। লাল ঘোড়া, নীল ঘোড়া। সাদা ঘোড়া। হাঁদা ঘোড়া। কালো ঘোড়া। ভালো ঘোড়া। চি হি হি! চি হি হি! সব এক সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল। চার-পা তুলে নেচে উঠল। উরি ব্যস! পিলে চমকে যায়। কী করবে তারা? নির্ঘাৎ ধরা পড়ল বলে। সেখান থেকে ভোঁ কাট্টা!
সামনে পাখির ঘর। মারলে ধাক্কা মিতুল পাখির খাঁচায় অন্ধকারে। অমনি ডেকে উঠল খাঁচার পাখি কিচির-মিচির। চেঁচামেচি। এক ঝাঁক লালমন।
লালমন ডাকল। কাকাতুয়া হাঁকল। টিয়াপাখি রাগল। কিচকিচ! মিচমিচ! ক্যাঁকক্যাঁ! কোঁককোক। কান ঝালাপালা।
পালা, পালা। আর পালা! হাতি হাঁকছে। ঘোড়া নাচছে। পাখি ডাকছে। ভয় লাগছে। সে কী বিকট চিৎকার! গোটা রাজবাড়িটা যেন কেঁপে উঠল।
মিতুল দেখল ভারি বিপদ। বোনটির হাত ধরে তড়িঘড়ি ছুট দিল। দে ছুট, দে ছুট! আগুপিছু কিছু দেখল না। দেখবার উপায় আছে?
হঠাৎ থমকে দাঁড়াল মিতুল। কী যেন নজরে পড়ল! কে যেন শুয়ে আছে!
‘ডুংরি!’ চেঁচিয়ে উঠল মিতুল। ‘ডুংরি ওই তো!’
বোনটি হাত দিয়ে মুখটি চেপে ধরল মিতুলের। মিতুল জিব কাটল। বলল, ‘চেঁচিয়ে ফেলেছি!
মিতুল জানে না ছুটতে ছুটতে কয়েদখানার দিকেই চলে এসেছে। ওই তো সামনে কয়েদখানার ভিতরে ঘুমোচ্ছে ডুংরি। মাটিতে পড়ে পড়ে। তাড়াতাড়ি ঢুকে পড়ল কয়েদখানার ভিতরে। গরাদ ডিঙিয়ে। ওরা তো পুতুল। একটুও কষ্ট হল না মাথা গলিয়ে ঢুকে পড়তে! ডুংরিকে সামনাসামনি দেখে ছ্যাঁৎ করে উঠল মিতুলের বুকটা। চটপট জামার পকেট থেকে চিঠিটা বার করল। আর বার করল সেই চাবিটা। দস্যুদের কাছ থেকে এই চাবিটাই তো মিতুল চালাকি করে কেড়ে নিয়েছিল। এতদিন কাছে কাছে রেখেছে লুকিয়ে। আজ আর কোনো দরকার নেই চাবির। দিয়ে দেবে মিতুল ডুংরিকে। তাই চিঠির সঙ্গে চাবিটা বেশ করে মুড়ল মিতুল। ছুঁড়ে দিল ডুংরির দিকে। তাড়াতাড়িতে টাল সামলাতে পারল না। হাত ফসকে গেল। চাবিটাঠক করে গিয়ে পড়ল ডুংরির মাথায়। ইস! ঘুম ভেঙে গেল ডুংরির। চমকে উঠল। ঘুমচোখে চেয়ে দেখল সামনেটা। একী! এ যে তার পুতুল! আঁকপাকিয়ে হাত বাড়াল ডুংরি মিতুলকে ধরবার জন্যে। বোনটির হাত ধরে মিতুল ছুটল সঙ্গে সঙ্গে। চেঁচিয়ে উঠল ডুংরি, ‘আমার পুতুল আমার পুতুল।’ সে চিৎকার পৌঁছে গেল সকলের কানে।
ঘুম ভেঙে গেল সক্কলের। ভাঙবে না?কী চিৎকার! কী হইচই!
সিপাই এল ছুটতে ছুটতে। সান্ত্রি এল পড়তে পড়তে। মন্ত্রী এলেন। পাত্র এলেন। রাজা এলেন। রানি এলেন। ব্যাপার কী! চেঁচায় কেন হাতি-ঘোড়া, উট-ভেড়া! চেঁচায় কেন বন্দী ছেলেটা?
আর চেঁচায় কেন! একেবারে মাথা ঘুরে গেল সক্কলের! আরে বাবা! ওকী দেখেন? কী দেখেন? দেখেন, রাজার পুতুলমেয়ে, সেই ছেলে-পুতুলটার হাত ধরে ছুটছে! বাপরে বাপ! এ কোন দেশের পুতুল! মানুষের মতো ছোটে! ধর। ধর। ধর।
ছুট দিল রাজা পাঁই পাঁই পুতুল দুটোর পিছনে।
রাজাকে ছুটতে দেখে রানিও ছুটলেন।
রানিকে দেখে মন্ত্রি ছোটেন।
মন্ত্রী দেখে সান্ত্ৰী ছোটে।
সিপাই ছোটে, পেয়াদা ছোটে।
মাথায় টিকি, পুরুত ছোটে।
দাসী ছোটে, মাসি ছোটে।
মাসির পিছে মাহুত ছোটে।
মাহুত দেখে হাতি ছোটে।
হাতি ছোটে, ঘোড়া ছোটে।
ছাগল ছোটে, বাঁদর ছোটে।
সবশেষে একটা কুকুরছানা।
কিন্তু কী জোর ছুটছে মিতুল আর বোনটি! কেউ ধরতেই পারছেনা। পুতুল অত জোরে ছোটে কেমন করে? ভেলকি নাকি!
ছুটতে ছুটতে অন্দরমহল পড়ে থাকল। ধরা গেল না।
মাঝের মহল পিছিয়ে রইল। নাগাল পেল না।
বারমহলও ছাড়িয়ে গেল। তবুও না। তবুও না।
ছুটতে ছুটতে রাজবাড়ি শেষ। সিংদরজাও পার। তারপর রাজপথ।
ওমা! রাজপথেও যে রাজা থামেন না! রাজাও থামেন না, রানিও দাঁড়ান না। হাতিও থামে না, ঘোড়াও রোখে না। ছুটছে। ছুটছে। ছুটছে।
মিতুল ছোটে, বোনটি ছোটে
ছুটতে ছুটতে বাড়ি গেল।
বাড়ি গেল, রাস্তা এল।
রাস্তা পারে দোকান পসার।
দোকান ফেলেই বাজার এল।
বাজার শেষে ঠাকুরবাড়ি।
আমের বাগান, জামের বাগান।
লিচুর বাগান, পান সুপারি।
বাগান পাশেই দীঘির হাট।
হাটের গায়ে মস্ত দীঘি।
থমকে দাঁড়াল মিতুল বোনটির হাত ধরে! এই সেরেছে! কেমন করে পেরুবে এই দীঘিটা। এখুনি পেরুতে হবে! ওই তো রাজা এসে গেল ছুটতে ছুটতে।
চুপ! চুপ! পদ্মপাতায় লাফিয়ে পড়ল মিতুল আর বোনটি।
লুকিয়ে পড়ল পাতার আড়ালে।
ধাঁধা লেগে গেল রাজার চোখে! কোথায় গেল পুতুল দুটো?
এদিক দেখেন, ওদিক দেখেন। সামনে ছোটেন, পিছনে ফেরেন। কই পুতুল?
চোখে ঝাপসা লাগল। মনে হল রাস্তা ধরে সামনে দিকে ছুটছে পুতুল!
আবার ছুট। ছুট। ছুট। গোটা রাজবাড়িটা ছুটে চলেছে যেন রাস্তা দিয়ে রাজার সঙ্গে!
কোথায় গেল সত্যিই তো! কোথায় লুকাল মিতুল আর রাজকন্যা?
হাঁপাচ্ছে মিতুল লুকিয়ে লুকিয়ে পদ্মপাতায়। কাঁপছে রাজকন্যা পাতার আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। পারবে কেন এত সইতে! এত ছুটতে! ছোট্ট ছোট্ট পা-গুলি আর পারছে না। পারছে না দাঁড়াতে পারছে না বসে থাকতে। শুয়ে পড়ল মিতুল আর রাজকন্যা পাতার ওপর। আর তো ভয় নেই তাদের কিছু। খুঁজে পেয়েছে যে ভাইটি তার বোনকে। না, আর তারা কোনোদিন যাবে না এখান থেকে বাইরে। না, রাখবে না চোখের আড়ালে বোনটিকে তার ভাইটি। না, না। মিতুল আর সাজবে না। মাথায় টুপি পরবে না। রাজকন্যা নাচবে না। পায়ে নূপুর বাজবে না। কোনোদিন না। ঘুমিয়ে পড়ল নিশ্চিন্তে রাজকন্যা আর মিতুল পাতার দোলনায়। ওরা ঘুমোবে এখন। কেউ ডেকো না যেন!
সূর্যি উঠছে। পাপড়ি ফুটছে। পদ্মের পাপড়ি। একটু একটু রং লাগছে। একটু একটু নীল। একটু একটু লাল। মৌমাছিরা গুনগুনিয়ে গান গাইছে। হাওয়া-ঝুরঝুর ঢেউ দিচ্ছে দীঘির জলে।
দেখো দেখো ফুল দুটি! চেনা চেনা লাগছে যেন! হ্যাঁ তো! ওই তো মিতুল, নাচন-পুতুল নীল ফুলটি। ওই তো পুতুল রাজকন্যা, লাল ফুলটি! নীল পদ্মদুলে দুলে হাসছে। লাল পদ্ম জলের ঢেউ-এ নাচছে। আহা!
তবু রাজা ছুটছে। এখনও ছুটছে।
আর ডুংরি?
মিতুলের কথা ভাবছে আর মিতুলের চিঠি পড়ছে। মিতুল লিখেছে,
ভাই ডুংরি,
তুমি আমার জন্যে যা করেছ, ভুলব না কোনোদিন। তুমি জানোনা, আমার বোনকে খুঁজেছি কত দিন। কত রাত। সে হারিয়ে গেছিল। তাকে খুঁজে পেয়েছি। তাই আজ তোমার কাছে ছুটি আমার। চিঠির সঙ্গে যে চাবিটা দেখছ, আমি দস্যুদের কাছ থেকে কেড়ে এনেছি। তোমায় দিলুম। একটা খুব গভীর বনে তাদের গুপ্তধন লুকানো আছে। সেখানে কত যে মণি-রত্ন, হিরা-পান্না আছে বলে শেষ করা যায় না। আমি ঠিক রাস্তা জানি না। তাই বলতেও পারছি না। পারলে খুঁজে নিও। তোমার জন্যে আমার অনেক ভালোবাসা রইল। তুমি ভুলে যেও আমায়। বিদায়।
—মিতুল।
ডুংরি সে চিঠি পড়ছে এখনও। এখনও রাজা পুতুলের পিছু ছুটছে। আর নীল পদ্ম, লাল পদ্মদীঘির জলে এখনও দোল খাচ্ছে। আর হাসছে।