মার্ডার অন দি হাইওয়ে – ৫

০৫.

প্যারাডাইজ সিটি পুলিশ হেড কোয়ার্টার-এ নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। ডিটেকটিভ সার্জেন্ট জো বেগলার ঠোঁটে সিগারেট আর হাতে কফির কাপ নিয়ে ভাবছিল আজ বিকেল তিনটের রেসে কোন্ ঘোড়ার পিছনে বাজী ধরবে সে, যাতে তার ভাগ্যের চাকাটা ঘুরে যায়।

হঠাৎ ছুটে এসে ঘরে ঢুকল সেকেন্ড গ্রেড পুলিশ ডিটেকটিভ টম লেপস্কি, বেগলারের ডেস্কের সামনে। তাকে খুব উত্তেজিত মনে হচ্ছিল। মুখটা কেমন যেন থমথমে।

চীৎকার করে জিজ্ঞেস করলো লেপস্কি, জো, চীফ, আছেন, আমি আমার পদোন্নতি চাই। ডিপার্টমেন্টের সব উজবুকেরা যখন নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছ, আমি তখন একা নিজের চেষ্টায় ব্যান্ডি রিকার্ডোর গাড়ী খুঁজে পেয়েছি। তার দিকে ঝুঁকে পড়ে বেগলার জিজ্ঞেস করে, তা তুমি আমাকে উজবুক বলে মনে কর লেপস্কি? নানা তোমাকে বলতে যাব কেন?হঠাৎ লেপস্কি তার কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে আনল। সে ভাবলো বেগলারকে চটান ঠিক হবে না। কারণ চীফের অনুপস্থিতিতে সেই তো অ্যাক্টিং চীফ। সে বলে চীফ যদি বাড়ি থাকে আমি বরং তার সামনা সামনি নিজের মুখে বললেই ভাল হবে। নিশ্চয়ই তিনি খবরটা আগ্রহ সহকারে শুনবেন।

বেগলার উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠে, চীফের অনুপস্থিতিতে আমিই এখন হেডকোয়ার্টারের একমাত্র চীফ। বল, গাড়ীটা তুমি কোথায় পেলে?

মিয়ামি সেলফ-সার্ভিস স্টোরের পিছনে কারপার্কে গাড়ীটা দেখতে পাওয়া গেছে।

মিনিট দশেক পরে রিপোর্ট টাইপ করে বেগলারের ডেস্কের সামনে মেলে ধরল।

লেপস্কি বলে, জো ড্যানি ও ব্রায়েন ব্যান্ডি সোলো ডোমিনিকার মতোই পাঁচ বছর জেল খেটেছিল। আমার মনেহয়, ওকে একটু ধ্যাতানি দিলেই সেমুখ খুলবে, তিন দিন ব্যান্ডিকি করছিল এখানে।

বেগলার রিপোর্টের ওপর থেকে চোখ তুলে লেপস্কির দিকে তাকায়, তুমি মনে কর সোলো মিথ্যে কথা বলছে?

নিশ্চয়ই তবে ধরাছোঁয়ার বাইরে। কাটা দিয়ে কাটা তুলতে হবে। তাই ভাবছি ওর বন্ধু ড্যানির ওপর থার্ড ডিগ্রী প্রয়োগ করলে খবরটা নিশ্চয়ই জানা যাবে।

বেগলার বললো, ঠিক আছে তুমি দেখতে পার।

ইতিমধ্যে বেগলার পুলিশ চীফ টেরেলকে ফোন করে ব্যাপারটা জানিয়ে দিলেন, রিকার্ডোর গাড়ী খুঁজে পাওয়া গেছে, মিয়ামি পুলিশ তদন্তের ভার নিয়েছে, গাড়ীর ওপর থেকে ফিঙ্গার প্রিন্ট নেওয়া হচ্ছে। মিয়ামি পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে।

প্যারাডাইজ সিটির শহরতলীর এক এলাকার নাম মী-কুম। শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকা। এখানেই থাকে জেল ফেরত দাগী আসামী ড্যানি ও ব্রায়েন, রোম্যান আমলের সোনা রূপোর টাকা জাল করে আর্ট কালেক্টারদের কাছে বিক্রী করে বেশ মোটা রকমের রেস্ত কামাত এই ড্যানি। তবে জুলিয়াস সীজারের আমলের টাকা জাল করে একবার ওয়াশিংটন মিউজিয়ামে বেচতে গিয়ে। ধরা পড়ে যায় সে, তার পাঁচ বছরের জেল হয়ে যায়। এখন সে পুরোনো ধান্দা সব ছেড়ে দিয়ে রঙচঙে সীসের পুতুল তৈরী করে মেলমার দোকানে বিক্রী করে।

ড্যানি তিয়াত্তর বছরের বুড়ো, রোগাটে চেহারা, মুখে হাসি লেগেই আছে। লেপস্কির সঙ্গে দেখা হওয়া মাত্র মিষ্টি হেসে জানতে চায় কেমন আছেন মিঃ লেপস্কি? আমি কি আপনার পদোন্নতির জন্য অভিবাদন জানাতে পারি?

লেপস্কি একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বলে, শোন ড্যানি, তোমার কাছে একটা বিশেষ কাজ নিয়ে এসেছি। আমাদের কাছে খবর আছে ব্যান্ডি রিকার্ডো এই শহরে এসে গত মঙ্গলবার থেকে তিনদিন থেকেছিল। আমি জানতে চাই এই তিনদিন সে কি করেছিল? তার সম্বন্ধে কিছু জানা থাকলে বল।

ড্যানি চোখ বড় বড় করে তাকায়। ব্যান্ডি রিকার্ডো? না না সে আসতে যাবে কেন? তাছাড়া সে আমার কাছে আসতে যাবে কেন? প্রাক্তন ক্রিমিনালরা তাদের পুরোনো বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখতে চায় না। তারা নির্জনে একা থাকতেই ভালোবাসে।

তাই নাকি? প্রত্যেক রবিবার রাতে যে দুটো যুবতী মেয়ে তোমার ফ্ল্যাটে এসে তোমার সঙ্গে ফুর্তি করে, তোমার হারান যৌবনকে ফিরিয়ে আনার ব্যর্থ চেষ্টা করে তাদের গ্রেপ্তার করব কি?

ড্যানি শিউরে ওঠে। লেপস্কি বুঝতে পারে যে তার ওষুধে কাজ হয়েছে। ড্যানি বললো, না না অমন অন্যায় কাজ করবেন না, বলুন আপনি কি জানতে চান?

তবে একটা শর্তে আমি বলতে পারি, আমার মেয়ে দুটিকে রেহাই দিতে হবে। লেপস্কি বলে, বেশ, তাই হবে।

ড্যানি বলতে শুরু করে, ব্যান্ডি প্রথমে সোলোর কাছে যায় পাঁচশো ডলার ধার পাওয়ার জন্য। কিন্তু সোলো তাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেয়। তারপর সে আমার কাছে আসে। পাঁচশো ডলার দিয়ে ও একটা নৌকো করে কিউবায় যেতে চায়। ও ছিল একজন কমিউনিস্ট। কাস্ত্রোর সমর্থক। বাজারে গুজব, ব্যান্ডি নাকি মৃত। কিন্তু আমার তো বিশ্বাস হয় না।

তার কথাটা লেপস্কির কাছে বিশ্বাস যোগ্য বলেই মনে হলো। এক মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে লেপস্কি বলে ব্যান্ডি সব সময় পরচুলা পরে থাকতো। এর থেকে মনে হয় মেয়েদের ওপর তার নজর ছিল। তার বর্তমান মেয়েমানুষ কে ছিল জানো?

একটু ইতক্ততঃ করে ড্যানি বলে, তার নাম মাই ল্যাংগলি।

লেপস্কি এবার ভাবলো,ড্যানি সত্যি কথাই বলেছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ল্যাংগলির ঠিকানা খুঁজে পাওয়া গেল, ১৫৫৬ বি সী ভিউ বুলেভার্ড, মীকুম।

লেপস্কি ড্যানিকে সতর্ক করে দিল যেন সে কারোর কাছে মুখ না খোলে। তারপর কয়েক মিনিটের মধ্যে দ্রুত পায়ে ড্যানির আস্তানা ছেড়ে বেরিয়ে এলো।

প্যারাডাইজ সিটির পুলিশ চীফ ফ্র্যাঙ্ক টেরেল হেড কোয়ার্টারে প্রবেশ করতেই সবাই সন্ত্রস্ত হলো। লম্বা চওড়া জবরদস্ত চেহারার লোক ফ্র্যাঙ্ক টেরেল, মাথার চুল বালির রঙ, শক্ত চোয়াল, স্বচ্ছ চোখের চাহনি।

বেগলারের হাতে গ্রাহকযন্ত্র। ঘরে ঢুকেই পুলিশ চীফ জানতে চাইলেন–লেপস্কি কোথায়? আর সঙ্গে সঙ্গেই শোনা গেল দরজার কাছ থেকে লেপস্কির উত্তেজিত কণ্ঠস্বর।

ঘরে ঢুকেই ঝড়ের বেগে ডেস্কের সামনে হাজির হয়ে লেপস্কি রিপোর্ট দেয়, চীফ, আমি একটা গরম উত্তেজক খবর সংগ্রহ করে এনেছি। ব্যান্ডির পরচুলা পরার অভ্যাসের কথাটা জেনেই আমি সন্দেহ করেছিলাম ওর নিশ্চয়ই কোনো মেয়েমানুষ আছে। খোঁজ নিয়ে মেয়েটির অ্যাপার্টমেন্টের মালিকের কাছ থেকে জেনেছিবৃহস্পতিবার বিকেলে ব্যান্ডির সঙ্গে ভলকা-ওয়াগান গাড়ীতে চেপে কোথায় যেন চলে যায়।

টেরেল খুব মনোযোগ সহকারে তার কথাগুলো শুনে বেগলারের দিকে ফিরে বলেন, এই মেয়েটাকে তুলে আনতে হবে জো। মেয়েটি এক সময় ট্যাক্সি-ড্রাইভার ছিল, হেরোইন রাখার জন্য তিন তিনবার গ্রেপ্তার হয়। এখন ও এখানকার স্পেনিশ নাইট ক্লাবের হোস্টেন্স।

লেপস্কি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো এত সব খবর জো জানলো কি করে?

হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠলো,দুরাভাষে ফ্রাঙ্কের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। টেরেল এর পুলিশ চীফের কণ্ঠস্বর চিনতে কোনো অসুবিধা হলো না। অপর তিনজন অফিসার কান পেতে শুনছিল ফ্র্যাঙ্ক ও টেরেলের কথোপকথন।

গ্রাহক যন্ত্রটা নামিয়ে রেখে টেরেল-বেগলারের দিকে ফিরে বললেন–মাস্তাং গাড়ীর ওপর থেকে ফিঙ্গারপ্রিন্টগুলো কেউ খুব সাবধানে মুছে দিয়ে থাকবে। তবে হেটারলিং কোভের বালি পাওয়া গেছে। বেগলার উঠে দাঁড়িয়ে বলে, মৃতদেহ কবর দেওয়ার পক্ষে হেটারলিং কোভ খুব ভালো জায়গা।

ঠিক আছে জো, তুমি এক ডজন লোক নিয়ে ওখানে বালি খুঁড়ে, ব্যান্ডির মৃতদেহ বার করার ব্যবস্থা কর। তারপর লেপস্কিকে বলেন, শোন লেপস্কি, মাই ল্যাংগলিকে খুঁজে বার করতেই হবে। সেই সঙ্গে ওর গাড়ীর নম্বরটাও জোগাড় করতে হবে।

সেইদিন বিকাল পাঁচটার সময় বালি খুঁড়ে ব্যান্ডি রিকার্ডোর লাশটা বের করলো সার্জেন্ট জো এর লোকেরা। রাত দশটার সময় পুলিশ চীফ ফ্র্যাঙ্ক টেরেল পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট পড়ছিলেন, তখন তার সামনে বসেছিলেন সার্জেন্ট জো এবং হোমিসাইড স্কোয়াডের ফ্রেড হেস। মাস্তাং গাড়ীতে রক্তের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় নি। তাই মনে হয় খুন করার সময় অন্য কোনো গাড়ী হাইজ্যাক করা হয়েছিল। যাইহোক, এখন প্রয়োজন হাইওয়ের প্রতিটি বার,কাফে, পেট্রোল পাম্পে খোঁজ নেওয়া যে, সেদিন রাতে মাস্তাং গাড়ীটা কেউ দেখেছে কিনা। আর গাড়ীতেই বা কে ছিল? ব্যান্ডি রিকার্ডো যদি সত্যি সত্যি কমিউনিস্টহয়ে থাকে, তাহলে সে নিশ্চয়ই ফিদেল কাস্ত্রোর হয়ে কাজ করছিল। আজকাল কিউবায় যেতে হলে প্লেন হাইজ্যাকই সব থেকে সহজতর উপায়। অথচ এই ব্যান্ডি লোকটা নৌকা ভাড়া করতে চেয়েছিল কেন? তাহলে এর থেকে বোঝা যায় মালটা নিশ্চয়ই খুব ভারি ছিল, যা প্লেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় এবং মনে হয় এমন কোনো মাল যা কাস্ত্রোর একান্ত প্রয়োজন ছিল।

টেরেলকে দেখে খুব চিন্তিত বলে মনে হচ্ছিল। তিন চারদিনের মধ্যে কেসটার হদিশ করতে না পারলে মনে হয় সি. আই. এর হাতে তুলে দিতে হবে।

ভেরোবীচ একটা ব্যস্ত বন্দর মাল রপ্তানির জন্যে। ছোট শহর হলেও ভীষণ কর্মব্যস্ত। সমুদ্রের ধারেই ‘দ্য লবস্টার অ্যান্ড দ্য ক্র্যাব’ রেস্তোরাঁ কাম হোটেল, তিনতলা বিল্ডিং, ছোট বড় স্মাগলার এবং নারীলোভী ইয়াঙ্কি ছোরাদের আড্ডাখানা। রেস্তোরাঁর মালিক ডো ডো হ্যাঁমারস্টেইন জাঁদরেল দশাসই চেহারার মেয়েমানুষ। ডো ডো লেপস্কিকে খুব খাতির করে, জানতে চায় কি রকম মেয়েমানুষের প্রয়োজন।

লেপস্কি তাকে ধমকে ওঠে, ও সব ছেনালীপনা রাখ। আমি পুলিশের লোক। বুঝতেই পারছ আমি কেন এখানে এসেছি। আমি জানতে চাই মাই ল্যাংগলি এখন কোথায়?

বলবো, তবে তুমি আমাকে এতো বোকা ভেবোনা, আগে মালকড়ি ছাড়ো তারপর।

লেপস্কি দশ ডলারের একটা বিল ডো ডো-র বাতাবিলেবুর মতো স্তনজোড়ার খাঁজে খুঁজে দিল। বিনিময়ে ডো ডো তেইশ নম্বর ঘরটি দেখিয়ে দিল।

অতঃপর ডিটেকটিভ টম লেপস্কি উদ্যত রিভলবার হাতে আচমকা তেইশ নম্বর ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লো।

সোনালীচুল, বুকে এক চিলতে ব্রা,নাভির নিচে ছোট একফালি প্যান্টি, বছর পঁচিশের মেয়েটি লেপস্কিকে দেখামাত্র ভয় পেয়ে ডিভানের একপাশে গুটিশুটি মেরে সরে যায়।

পুলিশি বাজখাই গলায় গর্জে ওঠে লেপস্কি, বল ব্যান্ডি, মানে ব্যান্ডি রিকোর্ডো কোথায়?

জানি না।

ধমকে ওঠে লেপস্কি, জানো না? পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে শাসায়, এর মধ্যে কোকেন আছে। আমার প্রশ্নের উত্তর না পেলে আমার চীফকে বলবো এই প্যাকেটটা তোমার ঘর থেকে পাওয়া গেছে। তারপর তোমার বিরুদ্ধে একটা মিথ্যা মামলা সাজিয়ে দেওয়া যাবে।

মেয়েটি দারুণ ভয় পেয়ে গেল, লেপস্কির সঙ্গে প্যাঁচ কষতে সাহস পেলো না। সে স্বীকার করলো–ব্যান্ডি রিকোর্ডো ভেরো বীচ থেকে মাল পাচার করতে কিউবায় জলপথে। কারা যেন গুলি করে মালসমেত নৌকাটা ডুবিয়ে দিয়েছিলো। সোলো, ড্যানি ও ব্রায়েন কেউ তাকে বন্ধু হয়েও সাহায্য করলো না। শেষ পর্যন্ত আমাকে সে এখানে রেখে এয়ারপোর্টে গেল। ওর সাথে একটা স্যুটকেস ছিল, ঐ স্যুটকেসটার জন্য তার মনের মধ্যে খুব ভয় ছিল।

সব কথা শুনে লেপস্কির মনে হলো, একটা কু বোধহয় সে খুঁজে পেয়েছে। ল্যাংগলির দিকে ফিরে এবারে সে জানতে চায়–সেই স্যুটকেসটার জন্য কাকে সে ভয় করতে? জানি না, প্রকৃত কাকে সে ভয় করতো কিছুই বলেনি।

লেপস্কি আপন মনে মাথা দোলায় তারপর হুকুম করে, চল আমার সঙ্গে তোমাকে থানায় যেতে হবে।

ঠিক সেই মুহূর্তে সশব্দে দরজা খুলে যায়, পরে আর্তনাদ করে বুকে হাত চেপে মাই ল্যাংগলিকে ডিভান-এর ওপর আছড়ে পড়তে দেখা যায়। খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একটি লোক। মুখে রুমাল বাঁধা হাতে পিস্তল। লোকটার হাতের উদ্যত পিস্তল থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বুলেট বেরিয়ে এসে মেয়েটির বুক ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে। রক্ত ছলকে পড়ছে ডিভানে।

মুহূর্তের মধ্যে লেপস্কি তার কর্তব্য স্থির করে নেয়। মাটিতে শুয়ে পড়ে হোলস্টার থেকে রিভালবারটা বের করার চেষ্টা করে। কিন্তু ততক্ষণে ল্যাংগলির আততায়ী পালিয়েছে।

নিচে একতলায় আবার গুলির আওয়াজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডো ডোর করুণ আর্তনাদ হাওয়ায় ভেসে আসে। লেপস্কি তাকিয়ে দেখলো সী বীচের জনারণ্যে লোকটি হারিয়ে গেল।

.

০৬.

ভোরের আলো ফোঁটার আগেই হ্যারী মিচেন তার কেবিন থেকে অতি সন্তর্পনে বেরিয়ে এল। হাতে ব্যান্ডি রিকার্ডোর স্যুটকেস। দ্রুত পা ফেলে সী বীচের ওপর দিয়ে হেঁটে এসে হাঁটু অবধি সমুদ্রের জলে এসে দাঁড়াল, তখন সময় চারটে পঞ্চান্ন। ধীরে ধীরে গভীর জলে নেমে দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে সুটকেসটা অনেক দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল সে। তারপর কেবিনে ফিরে এল। তার প্রথম অপারেশন সফল, কেউ দেখতে পায়নি। কেবল সোলো ডোমিনিকোর ঘর থেকে আলোর ক্ষীণ একটা রেখা চুঁইয়ে পড়ছিল বাইরের দরজা পথে।

সোলোর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার তখনও কিছু সময় বাকি ছিল। সিগারেটের টান দিতে গিয়ে গত রাত্রের কথা মনে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে নীনার নগ্ন দেহটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। দৈহিক মিলনে যে এত সুখ, এর আগে কখনও সে অনুভব করেনি। এমনকি তার বিবাহিতা স্ত্রীর কাছেও নয়। নীনাই বোধ হয় প্রথম মেয়ে যে নিজের থেকে তাকে যৌন সংসর্গ। করতে আহ্বান জানাল। তার মতো নীনাও যৌন সুখে গা ভাসিয়ে দিতে চায়। তার এবং নীনার চাহিদা যেন একই সূত্রে গাঁথা।

হ্যারীর মনে হয়, সোলো যদি একান্তই তার সঙ্গে শক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, তার সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারবে না সে। আসলে সোলো তার কাছে কোনো সমস্যাই নয়। তাছাড়া নীনার পিতা সে। মেয়ের প্রেমিকের সঙ্গে কেনইবা সে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে যাবে। তবু জীবনটা বড় জটিল, বড় সমস্যাবহুল কথাটা ভাবতে ভাবতে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসতেই সোলোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।

সোলো হাসতে হাসতে বলে গতকাল রাত্রে আমি তোমার কেবিনে এসেছিলাম। কিন্তু তুমি তখন সেখানে ছিলে না। আমি বলতে চেয়েছিলাম আজ সকালে আমার কোনো কাজ তোমাকে। করতে হবে না। তুমি বরং হাই ডাইভিং বোর্ড তৈরীর কাজ নিয়ে ব্যস্ত থেক। কিন্তু তুমি কি তোমার আদরের মেয়েটিকে বালির ওপর ফেলে

হ্যারীর চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে, সেটা আমার বিজনেস,এ ব্যাপারে তোমার মাথানা ঘামালেও চলবে সোলো।

সোলো গম্ভীর হয়ে বললো, আমি তোমার সঙ্গে কোনো তর্কে অবতীর্ণ হতে চাই না। এখন যাচ্ছি, আবার ঠিক দশটার সময় আসবো। তৈরী থেক।

কোথায় যেন একটা গোলমাল হয়ে গেছে। হ্যারী ভাবে সোলো তাকে সন্দেহ করছেনা তো? ঠিক সেই মুহূর্তে নীনার ডাক শুনে চমকে ফিরে তাকায় হ্যারী। নীনা তখন ওর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে এক চিলতে ব্রা, হ্রস্ব নাইলনের স্বচ্ছ প্যান্টি, দুই উরুর সন্ধিস্থলের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ উদ্ভাসিত, প্রতিফলিত।নীনাকে দেখে হ্যারীর দেহের রক্ত যেন চমকে উঠলো।নীনার আহ্বান সে অস্বীকার করতে না পেরে পায়ে পায়ে কখন যে সে নীনার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল সে খেয়াল তার ছিল না। সম্বিৎ ফিরে পেলো সেনীনাকে ওর দেহের ওপর থেকে পোষাকগুলো এক এক করে তার চোখের সামনে খুলে ফেলতে দেখে। নীনা তখন সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে দুহাত বাড়িয়ে আহ্বান জানাচ্ছে তাকে ওর কাছে যেতে।

হ্যারীর ইচ্ছা হলো নীনার আহ্বানে সাড়া দিতে কিন্তু দারুণ ভয় পেলো একটু আগে সোলোর হিংস্র চাহনির কথা মনে করে। হ্যারী চোখ ফিরিয়ে নিলনীনার দিক থেকে।তারপর কৃত্রিম অনীহা প্রকাশ করে বললো, আমি বরং বাইরে অপেক্ষা করছি। তুমি সাঁতারের পোষাক পরে বেরিয়ে এসো। সী বীচে তোমার জন্য অপেক্ষা করবো।

একটু পরে নীনা এসে সমুদ্রে হ্যারীর সঙ্গে যোগ দেয়। জলের তলায় হ্যারী নীনার স্তনবৃন্তে মৃদু চাপ দিয়ে বলল, গতকালের মিলনের দৃশ্য তোমার বাবা দেখেছে। তার কথার ঝঝ শুনে মনে হল, ভীষণ চটে গেছে সে। অতএব—

তাহলে আবার কখন আমরা…

আগামী রবিবার তোমার সঙ্গে শেলডন দ্বীপে গেলে কেমন হয়?

চমৎকার আইডিয়া। ঘন্টার পর ঘন্টা আমরা মিলনে প্রবৃত্ত হতে পারব সেখানে। বাবার রক্তচক্ষু আর আমাদের দেখতে হবে না। আগামী রবিবার…..শেলডন দ্বীপ, তুমি আর আমি কেবল সেখানে।

মিয়ামি সেমিসাইড স্কোয়াডের লেফটেন্যান্ট অ্যালান লেসিকে পুলিশের কেউ সুনজরে দেখে না। লোকটা আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর, নিজের ভালো ছাড়া অন্যের সুখ-সুবিধা একেবারেই বরদাস্ত করতে পারে না সে।

সামনে তাকে তার চামচা পিটার ওয়েডম্যান সহ জাগুয়ার গাড়ী থেকে নামতে দেখামাত্র টম লেপস্কি সেখান থেকে পালাবার চেষ্টা করতে যায়, কিন্তু তার শ্যেন দৃষ্টির সামনে অদুরে ডো ডো এবং মাই ল্যাংগলির মৃতদেহের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে লেসি জিজ্ঞেস করে, তুমি এখানে? কোন খবর টবর পেলে?

লেপস্কি সিদ্ধান্ত নেয় লেসির কাছে এ ব্যাপারে মুখ খুলবেনা। তাই সে বলে, না কোন খবরই পেলাম না। ব্যান্ডির সম্বন্ধে প্রশ্ন করার আগেই হঠাৎ কোথা থেকে গানম্যান হাজির হয়ে গুলি করে বসে।

লেসি খিঁচিয়ে ওঠে, যত সব অপদার্থের দল। ভাগো এখান থেকে। রাগে ঘৃণায় লেপঙ্কি তার গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। গাড়িতে স্টার্ট দিতে যাবার আগে এক ডলারের বিনিময়ে একটি বাচ্চা ছেলের কাছ থেকে ল্যাংগলির এক বন্ধুর ঠিকানা সে পেয়ে গেলতেইশ-এ টর্টল ক্রোল, চারতলা। লেপস্কি পিছন দিকে না ফিরে বাঁ দিকের দুনম্বর রাস্তা দিয়ে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে দেয়।

চারতলায় একটা ঘরের সামনে সাইনবোর্ড ঝুলে থাকতে দেখলো টম লেপস্কি। গোলডি হোয়াইট। বিজনেস আওয়ার : রাত আটটা থেকে এগারোটা।

নক করতেই দরজা খুলে যায়। সামনে দাঁড়িয়ে গোলডি হোয়াইট। বেহায়া মেয়েটা। কমলা রঙ এর সোয়েটার-এর নীচে ওর বেঢপ স্তনজোড়া তার নিঃশ্বাসের সঙ্গে দুলে উঠছিল, উরু দেখানোর জন্য মিনিস্কার্ট পরেছে। চোখে বিলোল কটাক্ষ হেনে গোলডি বলে, বিজনেসের কথা পরে হবে, তোমাকে দেখে ভীষণ ঘেমে গেছি। এসো আমাকে একটু ঠাণ্ডা করে দাও।

সোয়েটার খোলার সঙ্গে সঙ্গে তার বেঢপ স্তন দুটি ঝুলে পড়ে। লেপস্কি আর স্থির থাকতে না পেরে গোলডির বাম গালে একটা চড় কষিয়ে দেয়। কাজের সময় এসব একেবারে পছন্দ করি না। কোন ভূমিকা না করে লেপস্কি বলে ব্যাডি রিকার্ডোর সম্বন্ধে তুমি কি জানো?

গত ২৪শে মার্চ পাঁচশো ডলার দিয়ে জ্যাকের বোট তিন সপ্তাহের জন্য ভাড়া নেয় ব্যান্ডি রিকার্ডো। তারপর আট সপ্তাহ তার কোন খোঁজ ছিল না, বোটটাও বেপাত্তা, সেই সঙ্গে বোটের দুজন ক্রু জেসি এবং হ্যাঁনস দুজনেই নিখোঁজ। শুনেছি গত মঙ্গলবার ব্যান্ডি নাকি প্যারাডাইজ সিটিতে এসেছিল, এখন সে মৃত।

এবারে লেপস্কি সেই মটর লঞ্চের আরোহী দুজনের চেহারার বিবরণ জানতে চাইলো।

হ্যানস লারসেন, দীর্ঘদেহী পুরুষ, ব্লন্ড, বয়স আন্দাজ পঁচিশ। আর জেসী স্মিথের চেহারা রোগাটে পুরু ঠোঁট, ভাঙা নাক, নিগ্রো।

লেপস্কি আরো জানতে চায়–মাই মরার আগে বলে গেছে ব্যান্ডির নৌকোটানাকি গুলি করে ডুবিয়ে দিয়েছে কোন দল। তারা কারা? এ ব্যাপারে জ্যাকি কিংবা অন্য কেউ হলে আমাদের হেড কোয়ার্টারে জানানো প্রয়োজন।

গোলডির দু চোখে বিস্ময়।

এতে অবাক হবার কিছু নেই। তুমি এবং জ্যাক যদি আমাদের খবরটা না দাও তাহলে জেনে রেখো, নির্দিষ্ট সময়ের পর তোমাদের ঠিকানা হবে জেল-হাজতে।

.

০৭.

হ্যারী ডোমিনিকো রেস্তোরাঁর বারম্যান জোর কথা ভাবছিল। সে তাকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, মিঃ হ্যারী,যত তাড়াতাড়ি পার এখান থেকে কেটে পড়। আমার বস্ সোলো ডোমিনিকো হিংস্র লোক। ওকে তুমি বক্সিং-এ নক আউট করেছিলে সেদিন, সেই পরাজয়ের শোধ ও ঠিক নেবেই। অতএব যত তাড়াতাড়ি পারো কেটে পড়।

জোকে ধন্যবাদ জানিয়ে হ্যারী চোখ ফেরাতেই দেখে র‍্যান্ডি তার কেবিনের দিকে এগিয়ে আসছে। কেবিনে ঢোকার আগে র‍্যাভি তাকে ইশারায় আহ্বান করলো, খবরের কাগজটা হ্যারীর দিকে এগিয়ে দিয়ে র‍্যান্ডি বলে, খবরের হেড লাইনটা পড়ে দেখো।

হ্যারী দ্রুত, চোখ বোলায় খবরের কাগজের ওপর : মৃত অবস্থায় লোকটাকে পাওয়া গেছে। এই লোকটাকে ১০ই মে থেকে ১১ই মে পর্যন্ত আপনি কি দেখেছেন? মৃত লোকটি সম্ভবতঃ ক্রিমিনাল, ব্যান্ডি রিকার্ডো নামে পরিচিত। দেখে থাকলে প্যারাডাইজ সিটি পুলিশ হেড কোয়ার্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।

তোমার কি মনে হয় পুলিশ আমাদের সন্দেহ করতে পারে?

হ্যারী মাথা নাড়ে, ভাগ্য বিরূপ না হলে সম্ভব নয়। মনে রেখো মাস্তাং গাড়ীটার খবর পুলিশ এখনো পায়নি।অতঃপর ওরা দুজনেই বারের প্রবেশ পথের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে ধীরপায়ে। হঠাৎ আগুয়ান সাদা মার্সিডিজ গাড়ীটা দেখতে পেয়ে পিছন থেকে র‍্যান্ডির হাত ধরে টানে হ্যারী।

মিসেস কারলোসের গাড়ীটা কারপার্কে এসে থামল। তার চোখে সান গগলস থাকার দরুণ মুখটা অনেকটা ঢাকা পড়ে গেছে। চালক গাড়ী থেকে নামল এক সময়। বেঁটে মোটা পরনে বটলগ্রীন রঙের স্যুট, মাথায় পানামা হ্যাট, মিসেস কারলোস, গাড়ী থেকে নেমে সী বীচের পথে হাঁটা দেন।

হ্যারী র‍্যান্ডিকে বিদায় দিয়ে সেও সী বীচের পথে পা বাড়ালো।

নীনা রোদ পোয়াচ্ছিল সী বীচে, আড়চোখে হ্যারীর দিকে তাকাল, হ্যারী কিন্তু ফিরে তাকায় না।

সী-বীচের উপর সান-আলোর নিচে মিসেস কারলোস একা, হাত নেড়ে আহ্বান জানায় হ্যারীকে।হ্যারী আড় চোখে এবার খুব কাছ থেকে মিসেস কারলোসকে দেখছে। সেই চোখ, সেই মুখ, স্কার্ফের আড়ালে লুকিয়ে সেদিন রাতে মাস্তাং গাড়ীটা ড্রাইভ করছিলেন মিসেস কারলোস।

কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর সে কিছুতেই বুঝতে পারছেনা, মিসেস কারলোসের মত সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন মহিলা কেন ব্যান্ডি রিকার্ডোর মত একজন পেশাদার স্মাগলারের পাল্লায় পড়তে গেল?

মিসেস কারলোস কাল সন্ধ্যাবেলা হ্যারীকে তার বাড়িতে আসার জন্য অনুরোধ জানালো। হ্যারী জানিয়ে দিল ঐ সময় অন্য একজনের সঙ্গে তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।

মিসেস কারলোস বললো, আমার স্বামীবাড়িতে নেই। আমার সঙ্গে গেলে তুমি তিনশ ডলার নগদ পাবে। এত টাকা কোন মেয়ে তোমাকে দিতে পারবে না। তাছাড়া আমার মত এমন এক সুন্দরী যুবতীর দেহ উপভোগ করা তোমার ভাগ্যের কথা।

রাস্তায় অনেক কুকুর সঙ্গিনী খুঁজে বেড়াচ্ছে, তাদের মধ্যে থেকে আপনার মনের মত সঙ্গী খুঁজে নিন মিসেস কারলোস। আমি দুঃখিত, আমি কুকুর নই। হন হন করে সমুদ্রের দিকে হেঁটে যায় হ্যারী।

.

পুলিশ চীফ টেরেলের অফিস ঘরে ঢুকে থমকে দাঁড়াল টম লেপস্কি। এক অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করছিল তখন সেখানে। অনেকক্ষণ পর টেরেল জানালো যে লেফটেন্যান্ট লেসীতার নামে অভিযোগকরে রিপোর্ট করেছেন। তার বিনা অনুমতিতে লেপস্কি তাদের সীমানায় ঢুকে অনধিকার চর্চা করে এবং বিন্দুমাত্রও তার সঙ্গে সহযোগিতা করেনি।

লেপস্কিও টেরেলকে জানায় যে, লেফটেন্যান্ট লেসীর অনুমতি নেওয়ার অবসর ছিল না, নিতে গেলে পাখী উড়ে যেত। তাছাড়া লেসী পুলিশ ডিপার্টমেন্টকে অপদার্থ বলে গালাগালি করাতে বাধ্য হয়ে ওনার সঙ্গে সহযোগিতা না করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়।

এবারে টেরেল একটু নরম হয়ে লেপস্কির কাজের প্রশংসা করলো।

এবার টেরেল এবং লেপস্কির মধ্যে ব্যান্ডির খুনের ব্যাপার নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে। গোলডি হোয়াইট খবর দিয়েছে ব্যান্ডিনাকি ২৪শে মার্চ জ্যাকি টমাসের মোটর লঞ্চ তিন সপ্তাহের জন্য ভাড়া নেয়, কিন্তু সেই লঞ্চ এবং দুজন ক্রুসমেত বেপাত্তা। মরার আগে ল্যাংগলি বলে গেছে, লঞ্চটা নাকি কেউ গুলি করে ডুবিয়ে দেয়। দুমাস পরে ব্যান্ডি আবার ভেরো বীচে ফিরে এসে সোলোর কাছে মোটর বোট ভাড়া নিতে চায়, কিন্তু সোলো তাকে ফিরিয়ে দেয়। তারপর সে একটা মাস্তাং গাড়ী ভাড়া করে উধাও হয়ে যায়। দুদিন পরে মাস্তাং গাড়ী এবং ব্যান্ডির লাশও পাওয়া যায়। এখন কথা হলো কে তাকে খুন করতে পারে? আর তার কারণই বা কি? সেই সঙ্গে জানতে হবে কি ধরনের মাল কিউবা থেকে স্মাগল করে আনত। আরও জানতে হবে, তার খুনের সঙ্গে কিউবা সরকারের কোন হাত আছে কিনা? এই সব কথা ভেবে মনে হয় কেসটা সি. আই. এ.-র হাতে তুলে দেওয়াই ভালো। মনে হয় ওরা দ্রুত কাজ সারতে পারবে।

হঠাৎ ম্যাক্স জ্যাকবি টেরেলের অফিস ঘরে এসে প্রবেশ করে হন্তদন্ত হয়ে, স্যার, এই মাত্র রেটমিক ফোন করে জানাল, ১নং হাইওয়ের উপর একটি মাস্তাং গাড়ীতে দুজন আরোহীকে দেখা যায় ব্যান্ডির নিখোঁজ হওয়ার দিন।

বেগলারের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করে টেরেল বলে, ঠিক আছে ম্যাক্স, রেটমিককে বল, সে যেন এখুনি এখানে চলে আসে।

লাল চুলওয়ালা মাথায় থার্ড গ্রেড পুলিশ ডিটেকটিভ রেড রেটমিক রিপোর্ট দিচ্ছিল, আর সার্জেন্ট জো বেগলার সেই রিপোর্ট লিখে নিচ্ছিল দ্রুত হাতে। ঘটনার বিবরণ ছিল এই রকম : গত বৃহস্পতিবার রাতে হাইওয়ের উপরে মাস্তাং গাড়ী চালাচ্ছিল দুটি লোক। গাড়ীর পেছনে ছিল একটা ক্যারাভ্যান। সেই গাড়ীটা জ্যাকসনের কাফেতে থামে। লোক দুজন সেই কাফেতে কফি খেতে ঢোকে–

জোর দিকে ফিরে টেরেল বলে, আর হ্যাঁ ক্যারাভ্যানটা তুমি তাড়াতাড়ি খুঁজে বার কর।

সোলো ডোমিনিকোর রেস্তোরাঁ। ডিটেকটিভ টম লেপস্কির যুবতী স্ত্রী ক্যারল লেপস্কি রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করা মাত্র দারুণ একটা সাড়া পড়ে গেল বহিরাগত খদ্দের এবং রেস্তোরাঁর কর্মচারীদের মধ্যে।

টম লেপস্কির মেজাজ খিঁচড়ে আছে। ব্যান্ডি রিকার্ডোর ভাড়া করা মোটরবোটের দু’জন ক্রু, ব্যান্ডির গার্লফ্রেন্ডমাই ল্যাংগলি, ডো-ডো সবাই আজ মৃত, খুন হয়েছে, অথচ এখন পর্যন্ত কোনো খুনের কিনারা হয়নি। স্বভাবতই তার মনটা এখনো বিক্ষিপ্ত। শনিবারের ভীড় সামলাতে হ্যারী মিচেলও রেস্তোরাঁর কাজে লেগে পড়েছিল। তার হাতে ড্রিঙ্কসের ট্রে।

লেপস্কি তাদের খাবারের ফরমাস করে দেয়। একটু পরেই খাবার আসে। খাওয়া শেষ করে বাথরুমে যাবার নাম করে রান্না ঘরে গিয়ে ঢেকে টম। ক্যারল তখন হাঁসের ক্যাসারোল খাচ্ছিল তারিয়ে তারিয়ে। ইন্টারকাম টেলিফোন মারফত ম্যানুয়েলকে সাবধান করে দেয় সোলো ডোমিনিকো, ডিটেকটিভ টম লেপস্কি রাউন্ডে বেরিয়েছে। সেই সময় রেস্তোরাঁর সামনে একটা সাদা গাড়ী এসে থামল, মিসেস কারলোস পিছনের সিটে বসে আছেন। গাড়ীর ড্রাইভারকে দেখে মনে হলো লোকটা চেনা। লেপস্কির মনে হলো লোকটাকে কোথায় যেন দেখেছে সে। মনে পড়েছে, মাই ল্যাংগলির খুনি সে, রিভলবার উঁচিয়ে মাইকে খুন করতে দেখেছিল সে। কথাটা মনে হতেই জ্যাকেটের ভেতরে হাত রাখে লেপস্কি। কিন্তু তার স্ত্রী তাকে পিস্তল সঙ্গে আনতে দেয়নি। অথচ পুলিশের সার্ভিস রেগুলেশন মাফিক গোয়েন্দারা যেখানেই যাক না কেন সার্ভিস পিস্তল তাদের সঙ্গে রাখতেই হবে।

বিনা অস্ত্রে এগিয়ে যাওয়া ঠিক হবে কিনা ভেবে গিয়ে লেপস্কি কার পার্কের দিকে এগিয়ে, যায়। লোকটার সামনে গিয়ে নাম জিজ্ঞেস করায় জানতে পারে তার নাম ফারনান্দো কর্টেজ, মিসেস কারলেসের ড্রাইভার।

ঠিক আছে কটেজ। হাত তুলে পিস্তলটা আমার হাতে তুলে দাও।

কর্টেজের মুখে হিংস্র হাসি, হাতে উদ্যত ওয়ালথার সেভেন পয়েন্ট সিক্সটিফাইভ পিস্তল। এই পিস্তলের গুলিতেই মাই ল্যাংগলির বুক ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল। চোখ বন্ধ করে টম লেপস্কি, পুলিশের সব কেরামতি এখন স্তব্ধ।

হঠাৎ ফারন্যান্দোর হাতের জোরাল এক ঘুষি লেপস্কির মাথায় এসে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে সে। চোখে সরষে ফুল দেখলো।

.

০৮.

ডোমিনিকো রেস্তোরাঁয় ওয়েটারদের দলপতি ম্যানুয়েল হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যায় ওর টেবিলের সামনে। মিসেস লেপস্কি আপনার স্বামী হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন, মদের মাত্রা বোধহয় একটু বেশী হয়ে থাকবে। চিন্তার কোন কারণ নেই। হ্যারী সঙ্গে যাবে আপনাদের বাড়ী পৌঁছে দেবার জন্য।

ওয়াইন্ডক্যাট গাড়ীর পিছনের সীটে ক্যারলের স্বামী টম লেপস্কি তখন নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। ক্যারল তার দিকে ঘৃণা ভরে তাকিয়ে শব্দ করে গাড়ীর দরজা বন্ধ করে চালকের আসনে গিয়ে বসা মাত্র স্টার্ট দেয়। পিছন পিছন সোলোর এস্টেট গাড়ী চালিয়ে চলেছে হ্যারী মিচেল।

এক সময় লেপস্কির ফ্ল্যাটের সামনে দুটো গাড়ীই এসে থামে। হ্যারী তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে লেপস্কির ঘুমন্ত শরীরটাকে তুলে নিয়ে গেস্টরুমের দিকে এগিয়ে যায়। একটু পরেই সে বসার ঘরে ফিরে আসে।

হ্যারীকে দেখে ক্যারল ভাবে, কি সুন্দর লম্বা চওড়া শক্ত সমর্থ চেহারার পুরুষ। ওকে আজ আমার বিছানার সঙ্গী করলে কেমন হয়। ক্যারল নিজের মনে ভাবতে থাকে, একটু পরেই হ্যারী আমার গা থেকে পোষাক ব্রা, প্যান্টি সব কিছু টেনে খুলে ফেলবে, তার পরেই ও আমার দেহটা খুশী মতো ব্যবহার করবে। আমি সেই উত্তেজনায় আনন্দে চীৎকার করে উঠবো।

হ্যারী চলে যেতে চাইলে মিসেস লেপস্কি তাকে বাধা দেয়, বলে–আজ রাতটা তুমি আমার কাছে থাক, উপভোগ কর, আমাকে গ্রহণ কর। একথা বলে একটা অদ্ভুত কাজ করে বসলো, স্কার্টটা কোমরের ওপর তুলে ধরে পা দুটো ফাঁক করে দিল হ্যারীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য।

হ্যারী ওর প্রায় নগ্ন দেহের ওপর থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে নিঃশব্দে।ক্যারল বুঝতে পারেনা, সে তখন হ্যারীর স্পর্শের অপেক্ষায় ছিল। একটু পরে গাড়ীতে স্টার্ট দেওয়ার আওয়াজ শুনেই বুঝতে পারল হ্যারী চলে যাচ্ছে। তখনই সে কান্নায় ভেঙে পড়ল।

পরদিন ভোর পাঁচটা। র‍্যান্ডির সঙ্গে কফি খেতে গিয়ে হ্যারী বলে, জান র‍্যান্ডি আমার মনে হয় ডিটেকটিভ টম লেপস্কি গতকাল মদ খেয়ে বেহুশ হয় নি। আমার ধারণা সোলো পেছন থেকে ওর মুখে ঘুষি মেরে থাকবে, তারপর ওর পোষাকে মদ ঢেলে বোঝাতে চেয়েছে লেপস্কি মাতাল হয়ে পড়েছে। যাইহোক আজ সকালে লেপস্কির জ্ঞান ফিরলে পুলিশচীফ টেরেলের কাছে রাতের সব ঘটনা খুলে বলবে। তারপর ডোমিনিকোর রেস্তোরাঁ ঘিরে ফেলবে পুলিশ। তাই বলছি র‍্যান্ডি পুলিশ এসে পড়ার আগে এখান থেকে কেটে পড়। তোমার সঙ্গে আমিও নীনাকে সঙ্গে নিয়ে শেলডন দ্বীপে পাড়ি দেবো। সেখানে গিয়ে আমরা উলঙ্গ হয়ে সাঁতার কাটবো। নীনাও আমাকে একান্ত নিবিড় করে পেতে চায়। সেই ভিয়েতনামের যুদ্ধের পর অনেকদিন মেয়েদের শরীর নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করিনি।

কিন্তু আমি যে নীনার চোখে তোমার সর্বনাশ দেখেছি হ্যারী। এ সব ঝামেলায় তুমি নিজেকে জড়াতে যেও না। হ্যাঁ, আমি যাবই। তুমি এখন এখান থেকে যেতে পার।

মুখ গোমড়া করে র‍্যান্ডি তার কেবিনে ফিরে যায়। হ্যারী ঘড়ির দিকে তাকায়। খাবার সময় হলো। ব্যান্ডির অটোমেটিক পিস্তল এবং কার্তুজের বাক্সটা ব্যাগের মধ্যে পুরে নিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে। দ্রুত সী বীচ ধরে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে চলল হ্যারী মিচেল। বোট হাউসে অপেক্ষা করছিল নীনা ডোমিনিকো। চারপাশে পাম গাছ, ঝোঁপঝাড়। ওর পরনে ছোট বিকিনি।

হ্যারী মোটরবোটে ওঠামাত্র চব্বিশ ফুট লম্বা সোলোর মোটরবোট সমুদ্রের বুকে জল কেটে কেটে চলতে শুরু করলো।

পোর্ট হোলে পর্দা খাটানো। কেবিনটা বন্ধ থাকতে দেখে হ্যারী জিজ্ঞেস করে নীনাকে, ওটা বন্ধ কেন?

ওখানে ড্যাডির মালপত্র থাকে। ড্যাডির হুকুম ছাড়া কেবিন কেউ ব্যবহার করতে পারবে না। তবে আমাদের কোন অসুবিধা হবে না।

হ্যারীর মাথায় এখন একটাই চিন্তা শেলডন দ্বীপ এবং সেই দ্বীপের ফানেলের কথা। সে নীনার কাছে জানতে চায় ফানেল বলতে ঠিক কি বোঝায়?

নীনা বলে, সমুদ্রের নিচে পাথরের খাঁজের ভিতরে ঠিক ফানেলের মত একটা প্যাসেজ আছে। তিনমাস অন্তর সমুদ্রে ভাটা পড়লে শেলডন দ্বীপের তীরবর্তী সমুদ্রের জল অনেক নীচে চলে যায়। তখন ঐ ফানেল দিয়ে সমুদ্রের নীচে একটা গুহার ভিতরে ঢোকা যায়। আমাদের লকারে দুটো অ্যাকোয়ালাং আছে, আমরা জলের নীচে সাঁতার কেটে ওখানে যেতে পারি।

দ্য ফানেল। শেলডন, এল টি জিরো। সেভেন পয়েন্ট ফরটিফাইভ, ২৭শে মে… ব্যান্ডি রিকার্ডোর স্যুটকেসের লাইনিং-এর নীচে লুকিয়ে রাখা কার্ডের ওপর লেখা কথাগুলো মনে আছে হ্যারীর। নীনা বলেছে, লকারের ভেতরে দুটো অ্যাকোয়ালাং, নাইলনের দড়ি এবং একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ আছে। সেই স্বচ্ছ প্লাস্টিকের আড়ালে অ্যান্টিভ্যাজল ড্রাইভিং গগলস, সুতির কালো শার্ট, সাদা স্কার্ফ…..চোখে পড়তেই চমকে ওঠে হ্যারী। কে, কে এই মেয়েটি, মাস্তাং গাড়ী চালিয়ে যাচ্ছিল যে মেয়েটি, কে, কে সে? হ্যারীর আর বুঝতে বাকি রইলো না যে, সেই মেয়ে মিসেস কারলোস নয়, সেই মেয়ে হলো নীনা ডোমিনিকো এবং গাড়ীর পিছনের ক্যারাভ্যানে ছিল স্মাগলারব্যান্ডিরিকার্ডোর লাশ।

ততক্ষণে ওরা পাথর ও প্রবালের একটা এবড়ো খেবেড়ো দ্বীপে এসে পৌঁছে ছিল, যার নাম শেলডন দ্বীপ।

নীনা বলে, এবারে আমাদের নামতে হবে তারপর জলের নীচে পাথুরে, ফানেলের ভেতর দিয়ে সাঁতার কেটে সেই গুহায় ঢুকতে হবে।নীনার ঠোঁটে একটা রহস্যময় হাসি দেখতে পেয়ে চমকে উঠলো হ্যারী। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে পড়লো জোর কথা, সামনেই তোমার মহাবিপদ। হ্যারী অন্যমনস্ক হয়ে যায়।

হ্যারী তার ব্যাগটা হাতে তুলে নেয়। ব্যান্ডির অটোমেটিক রিভলবারটা ঠিক জায়গায় আছে। কিনা দেখে নেয়। তারপরনীনার পেছন পেছন পাথুরে রাস্তা বেয়ে এগিয়ে চলে। ওরা চলে যাওয়ার পর মোটরবোটের কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে বোটের ডেকের ওপর দাঁড়াল মিসেসকারলোসের ড্রাইভার ফারনান্দো কর্টেজ। তার হাতে উদ্যত পয়েন্ট টোয়েন্টি টার্গেট রাইফেল।

.

সকাল হতেই টম লেপস্কির ঘুম ভেঙে যায়। সামনে দাঁড়িয়ে ক্যারল। লেপস্কি বলে, ওরা আমার মাথায় ঘুষি মেরে অজ্ঞান করে দিয়ে সারা গায়ে হুইস্কি ঢেলে দেয়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এসব কাজ সোলোরই। আর দেরী না করে সে পোষাক বদল করে গাড়ী করে প্যারাডাইজ সিটি পুলিশ হেড কোয়ার্টারের দিকে ছুটে চলে।

লেপস্কিকে দেখামাত্র পুলিশ হেড কোয়ার্টারের সার্জেন্ট জো বেগলার উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চায় তার মাথার ব্যথা কমেছে কিনা এবং এও জানায় যে কর্টেজকে গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা হচ্ছে।

ইতিমধ্যে জ্যাকবি এসে জানায় ওয়াশিংটন থেকে হ্যারী মিচেলের ব্যাপারে টেলেক্স এসেছে–হ্যারী ১৯৬৭র ১২ই মার্চ ভিয়েতনামে যায় এবং ২রা এপ্রিল যুদ্ধে মারা যায়।

হ্যারী মিচেল মারা গেছে? তাহলে ঐ লোকটাই বা কে? জ্যাকবির দিকে ফিরে বেগলার অবিশ্বাসের সুরে বলে ওয়াশিংটনে আবার মেসেজ পাঠাও। তাদের বল সঠিক খবর দেওয়ার জন্য।

সোলোর রেস্তোরাঁ রেড করার জন্য বেরোতে যাবে সার্জেন্ট বেগলার, এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে, পুলিশ হেড কোয়ার্টারে এসে ঢুকল র‍্যান্ডি।

সার্জেন্ট জানতে চাইলে কি ব্যাপার? র‍্যান্ডি জানালো যে, হ্যারী মিচেল তার বন্ধু, তার জীবন বিপন্ন। যে ভাবেই হোক তাকে বাঁচাতে হবে। র‍্যান্ডি সংক্ষেপে হ্যারীর সঙ্গে আলাপের মুহূর্ত থেকে বলতে শুরু করে–

সবশেষে বলে ব্যান্ডির স্যুটকেসের লাইনিং-এর আড়ালে একটা কার্ড পাওয়া যায়। সেই কার্ডের ওপর লেখা ছিল, দ্য ফানেল। শেলডন, এল, টি. জিরো। সেভেন পয়েন্ট ফরটিফাইভ, ২৭শে মে–

একটু পরে টেলেক্স মেশিন থেকে খট খটাখট শব্দ ভেসে এলো। ম্যাক্স জ্যাকবি টেলেক্স মেসেজটা বেগলারের হাতে তুলে দেয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধে ১৯৬৭-র ১২ই মার্চ হ্যারী নিখোঁজ হয়, কিন্তু পরে ১৯৬৭র ২রা এপ্রিল তাকে আবার খুঁজে পাওয়া যায় জীবিত অবস্থায়। তার মানে হ্যারী মিচেল বেঁচে আছে। বেগলার বড় বড় চোখ করে তাকায় লেপস্কির দিকে।

র‍্যান্ডির দিকে ফিরে বেগলার জিজ্ঞেস করে, তুমি কি নিশ্চিত নীনা ডোমিনিকো আর হ্যারী  মিচেল শেলডন দ্বীপে গেছে?

হ্যাঁ। ঐ যে ব্যান্ডির স্যুটকেসের লাইনিং-এর আড়াল থেকে পাওয়া কার্ডটা থেকে হ্যারীর মনে দারুন কৌতূহল হয়। ওর ধারণা, ব্যান্ডি নিশ্চয়ই কোন মাল হাইজ্যাক করে নিয়ে পালাচ্ছিল এবং সেই মাল ঐ দ্বীপেই লুকোনো আছে।

ঠিক আছে র‍্যান্ডি, তোমার সঙ্গে পরে আমরা আলোচনা করবো। জ্যাকবির দিকে ফিরে বলে, একে আপাততঃ লক আপে পুরে রাখো। আর শোন,চীফকে খবর দিয়ে বল, আমরা এখন সোলোর রেস্তোরাঁয় যাচ্ছি।

.

হ্যারী মিচেল এবং নীনা ডোমিনিকো, ওদের মুখে মুখোশ, পিঠে অ্যাকোয়ালাং, পরনে সুইমিং কস্টিউম, দুজনের কোমরে বেল্ট নাইলনের দড়ি দিয়ে বাঁধা। অন্ধকারে জলস্রোতে প্রাণপনে সাঁতার কাটছিল হ্যারী। প্রায় দুশো ফুট সাঁতার কাটার পর সে অনুভব করলো স্রোতের টান সেখানে একটু কম। তার চোখ পড়লো পাথরের আড়ালে একটা গুহা। দেওয়ালে ফসফরাসের নীল আলো।

হঠাৎ ডানদিকে নজর পড়তেই বড় বড় চোখ করে তাকায় হ্যারী। লম্বায় প্রায় চল্লিশ ফুট ভারী একটা জিনিস। হ্যারীর অনুমান ঠিক, একটা মোটরলঞ্চ। লেখা আছে গ্লোরিয়া ২, ভোরো বীচ। ব্যান্ডির ডুবন্ত মোটরলঞ্চের কথা মনে হতেই দ্রুত ডান দিকে মোড় নেয় হ্যারী।নীনা তাকে অনুসরণ করে। কাছে গিয়ে হ্যারী দেখে পোর্টহোলের কাঁচ ভাঙা, লঞ্চের গায়ে সারি সারি বুলেটের গর্ত, ডেকে, কপিটে শুকনো জমাট বাঁধা রক্তের কালচে দাগ।

নীনার দিকে তাকায় হ্যারী, আচ্ছা নীনা, রক্ত দেখে তুমি তো মোটেই ভয় পাও না, তাই না?

তার মানে কি বলতে চাও তুমি?

হ্যারী ওকে মনে করিয়ে দেয়, সোলো আর ফারনান্দো কর্টেজ যখন ব্যান্ডি রিকার্ডোর পা টা আগুনের উপর ধরে তার মুখ থেকে কথা আদায়ের চেষ্টা করছিল, তুমি তো তখন সেখানেই বসেছিলে। তারপর ব্যান্ডি হার্টফেল করে মারা যাওয়ার পর তুমিই তো ব্যাক্তির লাশ মাস্তাং গাড়ীর পেছনে ক্যারাভ্যানে তুলে হাইওয়ে ধরে গাড়ী চালাচ্ছিলে।

নীনার চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে ওঠে। ও সব তোমার জানার কথা নয় হ্যারী।

হ্যাঁ, আমার জানার কথা হতো না যদি না তুমি প্ল্যান করে আমাকে তোমার সঙ্গে ব্যান্ডির ডুবন্ত জাহাজ উদ্ধারের ব্যাপারে জড়িয়ে ফেলতে। তাছাড়া সোলো এবং তুমি প্ল্যান করে ব্যান্ডির মৃত্যুর ব্যাপারে আমাকে জড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করো। আমাকে দিয়ে এই শেলডন দ্বীপ থেকে ব্যান্ডির স্মাগলিং-এর মাল উদ্ধার করার চেষ্টা করো। তোমরা জানতে একমাত্র আমি ছাড়া এই অভিশপ্ত গুহায় আর কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। সেদিনের সেই মাস্তাং গাড়ীর ড্রাইভার যে তুমিই ছিলে, তোমার লকারে অ্যান্টিড্যাজল গগলস এবং পোষাক দেখেই আমি অনুমান করে নিয়েছিলাম। একয়েকদিন তুমি আমার সঙ্গে ভালোবাসার অভিনয় করেছিলে তোমার স্বার্থসিদ্ধির জন্য।

আমি এখনও তোমাকে ভালোবাসি হ্যারী।

হ্যারী নীনার কথায় কান না দিয়ে দ্রুত হাতে ব্যান্ডির মোটরলঞ্চের কেবিনের দরজা ভেঙে ফেলে। কেবিনের ভেতরে একটা বার্থে চারটি কাঠের সাজানো বাক্স হ্যারীর চোখে পড়ে। নাইলনের দড়ি দিয়ে বাঁধা বাক্স। হ্যারী তার কোমর থেকে ছুরি বার করে বাক্সের দড়ি কাটতে যায়, নীনা বাধা দেয়। হ্যারী জানতে চায়, ঐ বাক্সগুলোয় কি আছে?

ডলার। অনেক ডলার, হাজার লক্ষ কোটি ডলার। এবার চল এখান থেকে ফেরা যাক।

এখন নয়; আর একটা প্রশ্ন আমি করতে চাই। নীনার দিকে এগিয়ে গিয়ে হ্যারী বলে, কেবিনের ভেতরে আমাদের সঙ্গে সহযাত্রী কে ছিল? সোলল না কর্টেজ?

ডোমিনিকো রেস্তোরাঁয় বসে সোলোর সঙ্গে আলোচনা করছিল সার্জেন্ট বেগলার এবং টম লেপস্কি। সোলো স্বীকার করল, কোন রকম খোঁজ খবর না নিয়েই হ্যারীকে সে তার হোটেলের লাইফ গার্ডের চাকরীটা দিয়েছিল।

সোলো তোমার মেয়ে নীনা, সেই ছোঁকরী হ্যারী মিচেলের সঙ্গে শেলডন দ্বীপে গেছে। লেপস্কি তাকে ভয় দেখায় তোমার মেয়ে তার ট্র্যাপে পড়েছে।

সোলো আপত্তি করে, না, তা হতে পারে না। হ্যারী তার কেবিনেই আছে আর আমার মেয়ে নীনা অবশ্য একা সেখানে গেলেও যেতে পারে, কেননা ও প্রায়ই একা গিয়ে থাকে।

লেপস্কি পকেট থেকে ওয়াশিংটনের প্রথম টেলেক্স মেসেজটা বার করে সোলোর হাতে তুলে দিয়ে বলে, খবরটা পড়ে দেখ অবাক হবে।

সোলো চমকে ওঠে টেলেক্স মেসেজের ওপর চোখ বুলিয়ে, হ্যারী মিচেল মারা গেছে ভিয়েতনাম যুদ্ধে। তাহলে ঐ লোকটাই বা কে মিঃ লেপস্কি?

ডেভ ডোনাহর নাম শুনেছ তুমি সোলো? লেপস্কি জিজ্ঞেস করে, সেক্স-কীলার ডেভ ডোনাহ। ধর্ষণ ও হত্যাকারী ডেভ তিন সপ্তাহ আগে শেরউইনের অপরাধীদের পাগলা গারদ থেকে পালিয়েছে। বয়স তিরিশ, লম্বাচওড়া, ব্লন্ড চুল, নীল চোখ, ভাঙানাক, পেশাদার বক্সার এবং অলিম্পিক ব্রোঞ্জ মেডালিস্ট সাঁতারু। হ্যারী মিচেলের চেহারার সঙ্গে তার দারুণ মিল আছে। সেক্স ম্যানিয়াক ডেভ প্রথমে মেয়েদের উপভোগ করে, তারপর তাদের ধারালো অস্ত্র দিয়ে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলে। ইতিমধ্যে সে তিন তিনটি যুবতী মেয়েকে খুন করেছে। ভয়ে আঁতকে ওঠে সোলো। তারপর অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলে, মিঃ লেপস্কি আমার মেয়ে নির্দোষ। ভয়ে তার শরীর কাঁপতে থাকে।

লেপস্কি তাকে বাগে পেয়ে বলে, ঠিক আছে সোলো, তোমার মেয়েকে আমরা বাঁচাতে পারি, তবে একটা শর্তে, তার আগে রিকার্ডোর ব্যাপারে তোমাকে সব কথা খুলে বলতে হবে।

বেশ বলবো, তবে সে এক বিরাট ইতিহাস। শেলডন দ্বীপে যেতে গিয়ে মোটরলঞ্চে বসেই বলবো।

সোলোর মোটরলঞ্চের কেবিনে বসে সোলো বলতে শুরু করে, মিঃ কারলেসের প্ল্যান ছিল হাভানা থেকে দামীচুরুট এখানে স্মাগল করে নিয়ে এসে চড়া দামে বিক্রি করা। সেই প্ল্যান অনুযায়ী রিকার্ডোর সঙ্গে চুক্তি হয়। তিন কোটি ডলার সে ব্যান্ডির হাতে তুলে দেয় হাভানা চুরুট কেনার জন্য। তাদের সেই গোপন চুক্তির কথা মিসেস কারলোসের ড্রাইভার কর্টেজ আড়াল থেকে শুনে ফেলে। আমার কাছে সে মোটরলঞ্চ ভাড়া নেওয়ার জন্য আসে। আমি কমিউনিস্ট নই। তাই জাতীয় স্বার্থে, কর্টেজ এবং আমি প্ল্যান করি কিউবাগামী ব্যান্ডির ভাড়া করা মোটরলঞ্চ হাইজ্যাক করে পরে আমাদের সরকারের হাতে তিন কোটি ডলার তুলে দেবো। সেই প্ল্যান মত কর্টেজ ব্যান্ডির মোটরলঞ্চের ওপর আক্রমণ চালিয়ে ডুবিয়ে দেয়। কিন্তু সেটা ঠিক কোন জায়গায় ব্যান্ডি টেনে নিয়ে গিয়েছিল সে খবর আমাদের জানা নেই। তাই ব্যান্ডি ফিরে এলে খবরটা জানার জন্য আমরা তার উপর অত্যাচার চালাই। বিশ্বাস করুন মিঃ লেপস্কি আমরা তাকে ঠিক খুন করতে চাইনি। আসলে ও হার্টফেল করে মারা যায়।

শেষ পর্যন্ত হার্ট অ্যাটাক হবার আগে সে কি স্বীকার করেছিল সেই মোটর লঞ্চটা ঠিক কোথায় ডুবেছিল?

নিশ্চয়ই,দু’জন ক্রুর মৃত্যুর পর ব্যান্ডি নিজে মোটরলঞ্চটা চালিয়ে নিয়ে যায় শেলডন দ্বীপের কাছে। তারপর ফানেলের ভেতর দিয়ে অন্ধকারে ঢুকে সেই পাথরের গুহার মধ্যে ডলারের বাক্সগুলো সাবধানে রেখে আসে সে। কারলোস জানত, আগামী ২৭শে মে আবার শেলডন দ্বীপের সমুদ্রের জলে ভাটা পড়বে। সেই মত ব্যান্ডিকে সে বলে আর একটা মোটরলঞ্চ ভাড়া করে টাকাগুলো উদ্ধার করার জন্য।

তারপর?

আমার তখন একজন ভালো সাঁতারু প্রয়োজন হয়ে পড়ে, তাই র‍্যান্ডি রোচ হ্যারী মিচেলের চাকরীর জন্য সুপারিশ করতেই আমি রাজী হয়ে যাই। সেই সঙ্গে হ্যারীকে ব্যান্ডির খুনের সঙ্গে জড়ানোর প্ল্যান করে ফেলি।

এই পর্যন্ত বলে সে থামলো, লেপস্কি দ্রুত তার জবানবন্দী লেখার প্রতিটি পাতায় তাকে দিয়ে সই করিয়ে নেয় এবং নিজেও সই করে। এবারে সে ওয়াশিংটনের দ্বিতীয় টেলেক্স মেসেজটা সোলোকে দেখাল।

সোলো বিস্ময়ে চমকে উঠে বলে, তার মানে হ্যারী এখনও বেঁচে আছে? কেন আপনি আমাকে মিথ্যা কথা বললেন?

লেপস্কির ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি। হ্যাঁ বেঁচে আছে বৈকি। গতকাল রাত্রে তুমি আমার মাথায় ঘুষি মেরেছিলে, মনে আছে সোলো? এটা হলো তার প্রতিশোধ।

হ্যারী এবং নীনা জলের নীচে সাঁতার কেটে চারটে ডলার ভর্তি কাঠের বাক্সগুলোকে জলের ওপর ভাসিয়ে তোলার জন্য চেষ্টা করছে। কিন্তু বার বার তাদের প্রচেষ্টা মার খাচ্ছে, ওদিকে অতন্দ্র প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে আছে ফারনান্দো।

একটু পরে এক এক করে সমুদ্রের জলে চারটে বাক্সই ভেসে উঠতে দেখা গেল। কিন্তু হ্যারী মিচেলকে দেখা গেল না।হঠাৎকর্টেজের মনে পড়ে গেলো, মিচেলের সঙ্গে অ্যাকোয়ালাং আছে। সমুদ্র বুকে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ব্যর্থ হলো না। জলের উপর মুখোশ পরা একটা মানুষের মুখ উঁকি দিতেই কর্টেজের হাতের রাইফেল গর্জে উঠলো মুহূর্তে।

আ-আ-আ–মেয়েলি চীৎকারে সমুদ্রের পাখীগুলো ডানা মেলে এদিক ওদিক ওড়া শুরু করলো।

ওদিকে এখন নীনা ডোমিনিকোর মুখোশ থেকে রক্ত ছলকে উঠছে, সমুদ্রের জল লাল বর্ণ হতে শুরু করেছে। ওর স্পন্দনহীন দেহটা এখন সমুদ্রে ভাসতে থাকে।

কর্টেজের চোখে উদ্বেগের ছায়া কাঁপতে থাকে। হ্যারী কোথায়?

হ্যান্ডস আপ। পেছন ফিরে তাকিয়ে কর্টেজ দেখে পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে আছেটম লেপস্কি আর সার্জেন্ট জো বেগলার। ওদের দুজনের হাতেই পিস্তল।

একটু পরেই মোটর বোটের ইঞ্জিনের স্টার্ট দেওয়ার শব্দ ভেসে ওঠে বাতাসে। লেপস্কি চীৎকার করে ওঠে। সোলোর বোট নিয়ে হ্যারী মিচেল পালাচ্ছে ওকে ধর।

জো কোন গা না করেই বলে টম, হ্যারী তো কোনো অন্যায় করেনি, কাউকে সে খুনও করেনি। শুধু শুধু ওকে ধরে লাভ কি?

হাইওয়ের ওপর দিয়ে ছুটে চলেছে ফল ব্যবসায়ী ডেভ হাফনেসের নীল শেভ্রলে গাড়ীটা। দয়া করে সে হ্যারীকে লিফট দিয়েছে। হাফনেসের কাছ থেকে হ্যারী জানতে পারল, ইয়েলো একরসের টোনি মোরেলির রেস্তোরাঁটা হিপীরা পুড়িয়ে দিয়েছে। আজকাল হাইওয়ের ওপরে হিপী আর হিপীনীদের দৌরাত্ম্য ক্রমেই যেন বেড়ে চলেছে। টোনি খুন হয়েছে তাদের হাতে, আর ওর মেয়ে মারিয়া সাংঘাতিক ভাবে জখম হয়ে এখন হাসপাতালে পড়ে আছে। দিনকাল খুবই খারাপ।

হেডলাইটের আলোয় সারি সারি হিপী আর হিপীনীদের প্রায় নগ্ন দেহগুলো ভেসে উঠলো হ্যারীর চোখের সামনে। তুষার যুগ, ব্রোঞ্জ যুগ, এবার আসছে ভয়ঙ্কর বিক্ষোভের যুগ। হ্যারী ভাবে, এরকম জানলে সে আর সৈনিকের জীবন থেকে অবসর নিতো না।

সে যেন ভিয়েতনামের এক অরণ্য থেকে ফিরে এসে শহর নিউইয়র্কের বিভীষিকাময় আর-এক অরণ্যে প্রবেশ করতে চলেছে।