মার্ডার অন দি হাইওয়ে
০১.
হাইওয়ের ওপর দিয়ে চলেছে হিপী আর হিপিনীরা দল বেঁধে, চার-পাঁচজন মিলে এক একটা দল। হিপীদের কাঁধে ব্যাগ গীটার, পরনে ঢিলেঢালা শার্ট স্ন্যাক্স। আর হিপিনীদের পরনে বোম খোলা শার্ট মিনি ফুল হটপ্যান্ট। ভঙ্গী নাচের, ঠোঁটে সস্তা সুরের চটুল গান। মাঝে মাঝে ঢলে পড়া সঙ্গী পুরুষের গায়ে। পুরুষদল করতে খুব বেশি সময় এদের লাগেনা। কখনও কখনও চারজন হিপীকে একজন হিপিনী নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। পালা করে সেইহিপিনীতার চার সঙ্গী পুরুষকে সঙ্গ দিয়ে থাকে। তাদের মনোরঞ্জন ক্লান্তিবিহীন দেহ দিয়ে।
ট্রাক দেখলেই হিপীরা তাদের সঙ্গিনীকে এগিয়ে দেয় ধাক্কা দিয়ে। হিপিনী হাত নেড়ে ট্রাক থামাতে যায় কিন্তু থামে না। তাদের নাকের ডগা দিয়ে হাইওয়ের ধুলো ছড়িয়ে দ্রুত বেগে ছুটে যায় সামনের দিকে অরেঞ্জভিলে। ট্রাক থামল না দেখে পা ফাঁক করে কুৎসিত অশ্লীল ভঙ্গী করে হিপিনীটা তার আক্ৰহীন শার্টের শেষ বোতামটা খুলে নাড়া দেয় রাগে উত্তেজনায়।
তাতে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই ট্রাক ড্রাইভার স্যাম বেনজের। সে তখন দারুন বেপরোয়া। খিস্তি করল সে–বেশ্যা কোথাকার! ঘৃণায় তার মুখ বিকৃত। জানলা দিয়ে এক দলা থুথু বাইরে হাইওয়ের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে হিপী-হিপিনীদের উদ্দেশ্যে গালি-গালাজ করল। বেজন্মা এরাই নাকি দেশের ভবিষ্যৎ। এরাই এদের পর কোন আহাম্মক সন্তানের বাবা হতে চাইবে? ভালই হয়েছে আমার : বৌটি বাঁজা। পেটে সন্তান ধারনের ক্ষমতা থাকলে বৌটি নিশ্চয়ই ঐ সব বেজন্মাদের মত পুত্র সন্তান জন্ম দিত। সে এক দুর্বিসহ জীবন ভাবল স্যাম। প্রত্যেকটা ছেলে মেয়ে গাঁজার নেশায় বেসামাল হয়ে পড়েছে, রাস্তায় রাস্তায় গুণ্ডামী মাস্তানী করে বেড়াচ্ছে।
মৌতাতের জন্য এই সব হিপী হিপিনীরা তাদের মা বাবাকেও কোতল করাতে পারে। এই এক বেজন্মা শয়তানের দল প্রতি বছর গ্রীষ্মকালে দল বেঁধে মার্কিন-মুল্লুকের এই হাইওয়ের ওপর দিয়ে হেঁটে চলে হৈ-হুল্লোড় করে, বেলেল্লাপনা করে গাঁজা-মদ খেয়ে রাস্তায় মাতলামো করে মেয়েদের গায়ে ঢলে পড়ে। স্বাধীন দেশে কেউ রাস্তা দিয়ে হাঁটলে পুলিশের বলবার কিই বা থাকতে পারে! তবে পুলিশ দেখলে তারা সঙ্গে সঙ্গে তাদের ভোল পাল্টে ফেলে বন্ধ করে দেয় হৈ-হুল্লোড় বেলেল্লাপনা মাতলামো। তারপর টহলদার পুলিশ তাদের চোখের আড়াল হলেই আগের মত তারা আবার হৈ-হুল্লোড়ে মেতে ওঠে, শুরু করে দেয় গুণ্ডামী মাস্তানী আর ফিচলেমী।
এ কি অরাজকতা? নাকি শ্মশানের স্তব্ধতাই? আচ্ছা শ্মশান এখান থেকে কত দূরে? ট্রাক ড্রাইভারের পাশে উপবিষ্ট হ্যারী মিচেল ভাবছিল কথাটা। ভিয়েতনাম ফেরত সৈনিক। পরনে হাফ হাতা খাকি শার্ট খালি ড্রিলের স্ন্যাকস ধুলোমলিন জুতো।নীল চোখে সতর্ক দৃষ্টি, মাথায় ব্লু কাট চুল,বক্সারের ঘুষিতে নাক ভাঙাভঙ্গীতে তৎপর, যে কোন মুহূর্তে শত্রুপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার মানসিকতা নিয়ে।আপাততঃ চোখ বন্ধ করে আকাশ পাতাল ভাবছিল তিরিশ বছরের জোয়ান হ্যারী মিচেল। ভিয়েতনামের আর এক নাম শ্মশান। শ্মশানের স্তব্ধতা দেখে এসেছে হ্যারী সেখানে সর্বত্র যেখানে শ্মশান শহর বা গ্রাম বলে আলাদা কোন জগৎ নেই;সর্বত্র নিস্তব্ধ শ্মশানের স্তব্ধতা বিরাজ করছে সেখানে, যেখানে কেউ মরেও মরে না। নিঃশ্বাস নিতে পারে এমন তাজা প্রাণ অর্থাৎ মানুষ বেঁচে আছে সেই শ্মশানে আজো। সেই শ্মশানের চারপাশে অরণ্য এবং ধানে ভরা মাঠ, প্রান্তর, মানুষ এবং মানুষের তৈরী সব বাড়ি জ্বলছে শুধুই জ্বলছে দাউ দাউ করে।
হ্যারী, তুমি এক সময়ে ভিয়েতনামের যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র ধরেছ, শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে। আর আজ তুমি যুদ্ধ ফেরৎ ফৌজি জওয়ান। স্যাম বলে, জান হ্যারী, তোমার মত আমিও কোরিয়ার যুদ্ধে গিয়েছিলাম। যুদ্ধের বিভীষিকা আমিও দেখে এসেছি।
তোমার মত সেখানেও আমি শ্মশানের স্তব্ধতা দেখে এসেছি। আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি হ্যারী ঈশ্বরের দোহাই হাইওয়ের উপরে ঐ হারামীর বাচ্চা হিপীদের সঙ্গে টক্কর দিতে যেও না তুমি। হিপিনীদের উপর লোভ করতে যেও না। ওরা ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক। ওরা–
হিপিনীদের উপর আমার কোন লোভ নেই। জেনে রাখ স্যাম ওরকম মেয়ে ভিয়েতনামে আমি অনেক পেয়েছি। কিন্তু এখানে আমি এসেছি উন্মুক্ত আকাশের নিচে সূৰ্যাত হবার আনন্দ উপভোগ করবার জন্য বুঝলে, স্যাম।
বেশ তোমাকে আমি অরেঞ্জভিলেয় নামিয়ে দিলে সেখান থেকে পিছনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেও। পথে অন্য কোন ট্রাক কিংবা গাড়ী পেলে উঠে পড়। ওদের সঙ্গে কখনও মিশতে যেও নাযেন, সর্বান্ত হয়ে যাবে তুমি। ওদের স্বভাব হল একবার যাকে ধরবে ছাড়বে না যতক্ষণ না তারা তাদের দাবী আদায় করে নিতে পারছে। তাই আমি তোমাকে আবার বলছি হ্যারী—
ঠিক আছে আমি লক্ষ্য রাখব, হ্যারী একটু অধৈর্য হয়েই উত্তরটা দিল।
নিজের উপর পরিপূর্ণ আস্থা রেখেই কথাটা বলল সে। নিজের ভাল মন্দ সে বেশ ভাল করেই জানে।
হ্যারীর হাঁটুর ওপর স্যাম তার একটা হাত রাখল, জান হ্যারী আমার সব থেকে বেশী ভয় কোথায়? মাঝপথে গাড়িটা যদি বিকল হয়ে যায়?
এরকম বিকল হয়ে যাওয়া গাড়ির চালকদের অনেকবীরত্ব অনেক হার না মানার কাহিনী আমি শুনেছি। হিপীরা তাদের মারধোর করে টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়েছে। বীভৎস সেই অভিজ্ঞতা শুনলে আজও গায়ে কাটা দেয় যেন। আমার ক্ষেত্রে তা ঘটলে ওরা আমাকে ছিঁড়ে খাবে, এ আমি বেশ ভাল করেই জানি।
আর এও জানি এই হাইওয়েতে আমি তাদের চরম শত্রু।কত হিপী-হিপিনীআমার কাছ থেকে লিফট চেয়ে ব্যর্থ হয়েছে কেবল ছোটাই সার হয়েছে তাদের আমার ট্রাকের পেছনে। তারা নিশ্চয়ই আমাকে চিনে রেখেছে। আমাকে অমন বেকায়দায় ফেলে তারা কি আমাকে জামাই আদর করে ছেড়ে দেবে ভেবেছ? না কখখনও তা করবে না। উঃ, সে কথা মনে করলে আমার গায়ের রক্ত শীতল হয়ে যায়।
তার কথা বলার ভঙ্গী এবং ভয়কাতর কণ্ঠস্বর শুনে হ্যারী চকিতে তার দিকে তাকাল।
সত্যি কি রাস্তাটা এতই খারাপ।
হ্যাঁ, তা না হলে আর বলছি কেন, স্যাম বলতে থাকে, এ বছরটা মনে হয় তাদের জন্য চিহ্নিত হয়ে থাকবে। আমার এক বন্ধুর ট্রাক বিকল হয়ে যায়। ভাঙা এক্সেল সারাতে বেশ কিছু সময় লেগে যায়। জায়গাটা অরেঞ্জভিল থেকে মাইল কুড়ি দূরে হবে। আমার মত সে-ও ট্রাক ভর্তি কমলালেবু নিয়ে যাচ্ছিল। দুজন পুলিশ তাকে আহত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে রাস্তায়। দুটো পা-ই ভাঙা, বুকের তিনটি রিব সম্ভবতঃ ভেঙে গিয়ে থাকবে দুবৃত্তদের আক্রমণ সহ্য করতে না পেরে।
আধটন লেবু নষ্ট হয়ে গেছে। তারা আমার বন্ধুর কাছ থেকে শুধু টাকা পয়সা ছিনিয়ে নিয়ে সন্তুষ্ট হয়নি তার পোষাকও গা থেকে খুলে নিয়ে যায়। এমন কি তারা গাড়ির যন্ত্রপাতি এবং ইঞ্জিনটা পর্যন্ত খুলে নিয়ে পালায়। আমার বন্ধু প্রায় দশ সপ্তাহ হাসপাতালে ছিল। হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে ট্রাক চালানর পেশা ছেড়ে দেয়। সেই ঘটনার অনেক দিন পর পর্যন্ত সে স্নায়ুর চাপে ভুগেছিল। এখন একটা গ্যারাজে সুপার ভাইজারের কাজ করে। এখানে একটু থেমে স্যাম আবার বলতে থাকে, আমি তোমাকে আবার বলছি হ্যারী এই হাইওয়ে অত্যন্ত বিপজ্জনক জায়গা, এখানে অনেক হাঙ্গর ওৎ পেতে বসে আছে।
ঐ দ্যাখো আর এক দল হিপী-হিপিনী পথ অবরোধ করবার জন্য ছুটে আসছে সারিবদ্ধ ভাবে, তাদের দেখে সে তার ট্রাকের গতি দিল আরও বাড়িয়ে।
তারা দলে ছিল পাঁচজন। অল্প বয়সী, কাঁধ পর্যন্ত লম্বা রুক্ষ চুল, নোংরা দাড়ি, পরনে ছোট হাফ-প্যান্ট আর ঢিলেঢালা নোংরা সুতীর কোট। ট্রাক না থামালে ওরা যেতেই দেবে না। এমনি মনোভাব নিয়ে ওরা এগিয়ে আসছিল। ওরা যখন বুঝল স্যাম তার ট্রাক কোন মতেই থামাবে না, ওদের মধ্যে সবচেয়ে কনিষ্ঠ যুবকটি ট্রাকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুতি নিল। একটা দৃঢ় মানসিকতার ছাপ পড়ল তার মুখের ওপর। দম আটকে যাওয়া মুহূর্ত। এখুনি একটা দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। ভয়ে আঁতকে উঠল হ্যারী। সে দেখতে পাচ্ছে মুহূর্তের মধ্যে ট্রাকের চাকাটা ছেলেটিকে স্পর্শ করতে যাচ্ছে।
বাঃ, স্যাম বেনজ সত্যি সত্যিই দক্ষ চালক যেন ম্যাজিক জানে। চকিতে ট্রাক ঘুরিয়ে সেই হিপী ছোকরার পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। তার দলের অন্য হিপী-হিপিনীরা তখন পরিত্রাহি চেঁচাচ্ছে। কে কার কথা শোনে তখন। শেষ পর্যন্ত ট্রাকের নাগাল না পেয়ে তারা তাদের ঝাল মেটাতে ভারী এক টুকরো পাথর ছুঁড়ে মারল ট্রাক লক্ষ্য করে।
পাথরের টুকরোটা ট্রাকের ছাদে লেগে হাইওয়ের ওপর গড়িয়ে পড়ল।
দেখলে আমার কথা এবার বিশ্বাস হল। তোমার কুত্তার বাচ্চা জানে না সে কি করতে যাচ্ছে। ট্রাকের জানলা দিয়ে আর একদলা থুতু ছুড়ল স্যাম বেনজ।
কেন, এপথ দিয়ে পুলিশ টহল দিয়ে বেড়ায় না?
তাতে কি? একটু আগেই তো বললাম এটা স্বাধীন দেশ, যে কেউ যা খুশী করতে পারে। তাছাড়া পুলিশের চোখের সামনে এইসব কুত্তাদের তো ল্যাজ গুটিয়ে যায়। পুলিশ চলে গেলে তারা আবার তাদের কাজে তৎপর হয়ে ওঠে। অতএব তারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
হ্যারী বলল, সামনে পথ চলা প্রায় পুরোটাই এখনও বাকি পড়ে আছে, অথচ শুরুতেই সব আনন্দটুকু বুঝি নষ্ট হতে বসেছে।
মিয়ামি থেকে প্যারাডাইজ সিটি প্রায় একশো মাইল হবে তাই না? হ্যারী জানতে চাইল।
হ্যাঁ তাই হবে বোধহয়। অরেঞ্জভিল থেকে দুশো মাইল। আমার কাছে একটা ম্যাপ আছে। সেটা তুমি সঙ্গে রাখতে পার।
তারপর ঘণ্টা খানেক বকর বকর করল ট্রাক ড্রাইভার স্যাম বেনজ।
বেশির ভাগ সময় সরকারী সমালোচনায় খেলাধূলা সম্পর্কে আলোচনায় কাটিয়ে দিল স্যাম। তার মতে চন্দ্র অভিযান টাকার শ্রাদ্ধ ছাড়া আর কিছু নয়। গাড়ির গতি শ্লথ হয়ে এল একসময়। হাইওয়ের পথ ছেড়ে দ্বিতীয় রাস্তায় এসে নামল তারা। একসময় ট্রাক থামিয়ে হ্যারীর উদ্দেশ্যে স্যাম বনে-একটু এগুলেই তোমার রাস্তা তুমি পেয়ে যাবে।
নোংরা রাস্তার কথা বলল সে।
স্যাম আরও বলল, সেই সব নোংরা রাস্তা দিয়ে আর একটা রাস্তা বেরিয়েছে সেটা সামনে জঙ্গলে গিয়ে পড়েছে। সোজা হয়ে উঠে বসল সে।
তোমাকে একটু বাড়তি পথ হাঁটতে হবে। মাঝপথে কোন ট্রাক কিংবা গাড়ি দেখতে পেলে হাত নেড়ে থামিও। তারা তোমাকে প্যারাডাইজ সিটিতে পৌঁছে দেবে। কৃষকেরা এই পথ দিয়ে হেঁটে যায়। তবে চোখ,কান খুলে পথচল। এ জায়গায় কোথাও নিরাপদ নয়। র্যাক থেকে ম্যাপটা টেনে নিয়ে সে নিজেই দেখতে শুরু করে দিল। তারপর সেটা হ্যারীর হাতে দিয়ে সে বলল এখানকার শহরগুলো কিন্তু ভারী চমৎকার। হিপীদের ঠিক বিপরীত।
তারপর সে অন্য আর একটা র্যাক থেকে ভারী মোটা একটা কাঠের গদা টেনে নামাল। সেটার প্রতি হ্যারীর দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে গিয়ে স্যাম বলে, এ ধরনের গদা দিয়ে মারপিট করত মার্কিন মুল্লুকের আদি বাসিন্দা রেড ইন্ডিয়ানরা। কাঠের গদাটা সে হ্যারীর হাতে তুলে দিতে চায়।
হ্যারী সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়ল।
ধন্যবাদ ওটা আমার কোন কাজে লাগবে না।
রেখে দাও। বেনজ জোর করে। তুমি নিজেই জান না কখন কোনটা ভোমার কাজে লাগবে। হ্যারীর হাতে কাঠের গদাটা গুঁজে দিতে দিতে স্যাম তাকে বিদায় সম্ভাষণ জানাল। আচ্ছা তোমার যাত্রা শুভ হোক।
তারা দুজন করমর্দন করে।
ট্রাকে চড়তে দেওয়ার জন্য অজস্র ধন্যবাদ। হ্যারী কৃতজ্ঞতা জানায়। ফেরার পথে তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে। কয়েক মাসের বেশি থাকব না সেখানে।
লাফ দিয়ে ট্রাক থেকে নামল হ্যারী। নিজের উপর সম্পূর্ণ আস্থা রেখে কাঠের গদাটা সে তার পিঠের ঝোলার ভিতরে চালান করে দিল।
বেশ তো ভালই, দেখা করবে। স্যাম বলে–সারা সিজনে প্রতি সোমবার এবং বৃহস্পতিবার আমি এখানে থাকি। অরেঞ্জভিলে যে কোন লোককে জিজ্ঞেস করো আমার নাম তারা তোমাকে সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দেবে আমি কোথায়।
ফেরার পথে তোমাকে আমি আবার আমার ট্রাকে চড়িয়ে ফিরিয়ে দেব। আর সেই সময় তোমার মুখ থেকে যুদ্ধের খবর শুনব, যুদ্ধের গল্প শুনতে আমার খুব ভাল লাগে।
হ্যারী হাসল।
ট্রাকটা আবার সেই নোংরা পথ ধরে চলতে শুরু করল। হ্যারী একা একা। জনমানবশূন্য রাস্তা। ধারে কাছে একটা গাড়িও চোখে পড়ল না। ইউক্যালিপটাস গাছের জঙ্গলে যাওয়ার রাস্তা ছেড়ে দিয়ে একটা গাছের নিচে বসল এবং একটা সিগারেট ধরাল। স্যাম বেনজের দেওয়া ম্যাপটার উপর চোখ বুলাল সে। ছোট শহর অরেঞ্জভিলে যাবার পথ ধরেই তাকে হাঁটতে হবে।
স্যাম তাকে পই পই করে বলে দিয়েছে। কোন ট্রাক কিংবা প্রাইভেট গাড়ি থামিয়ে উঠে পড়তে। হাঁটতে গেলে হিপীদের পাল্লায় তাকে পড়তে হবে।
হাইওয়ে ছেড়ে ডানদিকের সরু রাস্তা দিয়ে এগুলে ইয়োলো একরস শহর। হ্যারী আন্দাজ করল এখান থেকে এখনো প্রায় কুড়ি মাইল হাঁটতে হবে তাকে সেই শহরে পৌঁছতে হলে। হাঁটতে গিয়ে সে ভাবল আজ রাতটা সেখানেই কাটাতে হবে তাকে।
তখন প্রায় একটা হবে, রাস্তার ধারে একটা গাছের ছায়ায় বসল সে।
খুব ক্ষিদে পেয়েছিল তার। টিফিন কেরিয়ার থেকে সিদ্ধ ডিম, টম্যাটো স্যান্ডউইচ বার করে খেল সে। তারপর এক কাপ কোকো খেয়ে একটা সিগারেট ধরাল। বিশ্রাম শেষে উঠতে যাবে তখন গাড়ির শব্দ শুনতে পেল। ডান দিকে ফিরে তাকাতেই সে দেখল পুলিশের একটা গাড়ি তার দিকেই ছুটে আসছে।
শক্ত সমর্থ দুজন পুলিশকে গাড়ির ভিতরে বসে থাকতে দেখল সে। গাড়ির চালক হ্যারীকে দেখা মাত্র গাড়িটা ফিক্সড করে ঠিক তার পাশে এসে ব্রেক কষল। একটা যান্ত্রিক শব্দ উঠল। গাড়ি থামবার সঙ্গে সঙ্গে দুজন পুলিশ দরজা খুলে তাকে ঘিরে ধরল। ছফুট লম্বা লালমুখ পুলিশ সার্জেন্ট একনজরে হ্যারীর আপাদমস্তক দেখে নিল। তার একটা হাত স্টিয়ারিং-এর ওপর অপর হাত বন্দুকের কুঁদোর উপর
কে তুমি! আর এখানে কিইবা করছ তুমি? বয়স্ক পুলিশ সার্জেন্ট গর্জে উঠল।
এই একটু ঘুরে বেড়াচ্ছি। শান্তভাবে বলল হ্যারী।
তাই বুঝি! সার্জেন্টের কৌতূহলী চোখ গিয়ে পড়ল হ্যারীর খেটো হাতা খাঁকি শাট খাঁকি ড্রিল স্ন্যাকসের উপর। তারপর তাকে একটু নরম মনোভাব প্রকাশ করতে দেখা গেল।
কি নাম তোমার।
হ্যারী মিচেল।
তা তুমি আসছ কোথা থেকে?
নিউইয়র্ক।
কাগজপত্র কিছু আছে?
হ্যারী শার্টের পকেট থেকে তার ফৌজি পরিচয়-পত্র, গাড়ি চালানর লাইসেন্স, পাসপোর্ট বার করে সার্জেন্টের হাতে তুলে দিল।
কাগজপত্রের ওপর দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিয়ে পুলিশ সার্জেন্ট তার দিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকাল।
আঃ ঘুরে বেড়াচ্ছিলে, প্যারাট্রুপার তুমি। আঃ। হঠাৎ সে বন্ধু সুলভ হাসি হাসল। আমার মনে হয় তুমি এখানে একটু মজা লুটতে এসেছ তাই না?
আপনি তা ভাবতে পারেন। হ্যারী শান্তভাবে উত্তর দিল। কিন্তু আমি তা মনে করি না।
সার্জেন্ট কাগজপত্র গুলো তার হাতে ফেরত দিতে গিয়ে জিজ্ঞেস করল তা তুমি এখন যাচ্ছ। কোথায়?
প্যারাডাইজ সিটি।
তা তুমি কি এভাবে হাঁটা পথেই সেখানে পৌঁছতে চাও? সার্জেন্ট নিজের থেকেই আবার বলে, হ্যাঁ তুমি তো আবার হাঁটতেই ভালবাস।
হ্যারীর রাগ হল সার্জেন্টের মুখ থেকে অমন বিদ্রুপের কথা শুনে।
তার মুখের উপর থেকে একটু আগের সেই শান্ত ভাবটা উধাও হয়ে গেল।
এটা কি জানা আপনাদের একান্ত প্রয়োজন সার্জেন্ট?
হ্যাঁ। যে কেউ প্রয়োজনীয় টাকা পয়সানা নিয়ে দক্ষিণে প্যারাডাইজ সিটির দিকে যেতে চাইলে আমরা অনুসন্ধান করে দেখতে চাই তার কাছে সেই টাকাটা আছে কিনা।
তোমার টাকা আছে তো?
হ্যাঁ আছে বৈকি।
দুশো দশ ডলার।
প্রত্যুত্তরে হ্যারী আরো বলল–আর আমি হাঁটতেও ভালবাসি।
তুমি কি ভাবছ প্যারাডাইজ সিটিতে চাকরী তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে?
না তবে খুঁজে নেব। তবে দুমাসের বেশী সময় থাকবার ইচ্ছে আমার নেই। কারণ নিউইয়র্কে আমার চাকরী ঠিক হয়ে আছে।
সার্জেন্ট মাথা নাড়াল।
তুমি হয়ত বিশ্বাস করবে না। সার্জেন্ট আরও সহজ ভাবে তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করল। এই জায়গাটা খুবই বিপজ্জনক, তোমাদের ভিয়েতনামের ধানক্ষেতের মতই বিপজ্জনক।
এবারেও বিরক্ত বোধ করল হ্যারী। আপনি হয়ত সে কথা ভাবতে পারেন। আমার মনে হয় এখানকার ব্যাপারে একটু অতিরিক্ত করে কুৎসা রটান হচ্ছে। তবে সত্যি কথা বলতে কি তার জন্য আমি মোটেই চিন্তিত নই।
সার্জেন্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে এবার সোজা হয়ে দাঁড়াল।
কয়েক ঘণ্টা আগে, বলল সে, চারজন হিপী এবং একজন হিপিনী এখান থেকে পাঁচ মাইল দূরে একটা পোলট্রি ফার্মে হামলা করে পালায়। যাওয়ার আগে তিনটি মুরগী এবং একটি ট্রানজিস্টার রেডিও লুট করে নিয়ে যায়। সেই সময় চার-চারটে লোক পোলট্রি ফার্মে ছিল। তারা তাদের চোখের সামনে হিপীদের মুরগী এবং ট্রানজিস্টার লুটকরে পালাতে দেখল কিন্তু একবারও কেউ বাধা দেয়নি।হিপীরা চলে যাবার পর তারা পুলিশকে খবর দেয়। আমি তাদের বুদ্ধির প্রশংসা করে বলেছি হিপীদের সঙ্গে ঝামেলা না বাড়িয়ে তোমরা ভালই করেছ। আমি যখন ঐ সব বেজন্মাদের মুখোমুখি হব তখন বন্দুকের সঙ্গেই মোকাবিলা করব তাদের, পিস্তল বা বন্দুক হাতে না থাকলে যেমন ভিয়েতনামীদের মোকাবিলা করা যেত না তেমনি বন্দুক ছাড়া হিপীদের সঙ্গে কথা বলা যায় না। না আমি কখনও বলব না এখানকার ঘটনা একটু বাড়িয়ে বলা হচ্ছে, আসলে আমরা চোখে যা দেখছি সেটাই বলছি।
হ্যারীর নীল চোখে হঠাৎ লাল আগুন জ্বলে ওঠে।
আমার অনুপস্থিতিতে দিনকে দিন এসব কি হচ্ছে এ দেশে?
কতকটা স্বগতোক্তি করার মত করেই হ্যারী বলে, এই সব নোংরা মেরুদণ্ডহীন হিপীদের ভয়ে আজকের সভ্য মানুষ এভাবে নিজেদেরকে গুটিয়ে নিচ্ছে কেন?
সার্জেন্ট নীরবে তার অভিযোগে সায় দেয়।
এই তিন বছরে অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের দেশে মাদকদ্রব্য সেবনের সমস্যাটা যে এখন চরমে উঠেছে এ কথা বোধহয় তুমি ভুলে গেছ। বেশির ভাগ হিপীদের ধারণা তাদের দশগুণ বয়স।
স্বপ্নেও তারা যা ভাবেনি সেটা করতে ওদের অহেতুক ব্যক্ততা অথচ দেশের জন্যে কাজের কাজ তারা কিছুই করছে না। এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ান হল ওদের কাজ। বিয়েতে তারা বিশ্বাসী নয়। একেবারে শেষ মুহূর্তে সঙ্গিনী হিপিনীদের তারা হাসপাতালে পাঠায়, অসংযমের ফসল তোলবার জন্য নয় ফসল বিনষ্ট করবার জন্য।
বুঝলে, এই সব হিপীদের ওপর নজর রেখ।এভাবে ফালতু বীরত্ব দেখাতে গিয়ে নিজের এমন সুন্দর জীবনটাকে নষ্ট করে ফেল না। আগামী দু’মাস তুমি নিশ্চয়ই চাইবেনা হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকতে চাইবে নাকি?
তারপর সে তার সঙ্গীর দিকে ফিরে তাকাল। ওকে জ্যাকসন, চল এবার যাওয়া যাক। হ্যারীর উদ্দেশ্যে মাথা নেড়ে পুলিশ গাড়িতে গিয়ে উঠল।
অপসৃয়মান পুলিশের গাড়িটা চোখের আড়াল হয়ে যাবার পর হ্যারী তার ঝোলাটা পিঠে তুলে নিয়ে একটু সময় গালে হাত দিয়ে ভাবল, তারপর কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে চলতে শুরু করল সেই নোংরা রাস্তা দিয়ে।
ইয়োলো একরসের বড় রাস্তার ধারে একটা রেস্তোরাঁ চোখে পড়ল। লাল নিয়ন আলোয় নাম লেখা–গুড ইটস। সাইন বোর্ডের নিচে বাক্সের আকারে বিল্ডিংটা, সামনে ঝুলন্ত বারান্দা। সেখানে খদ্দেররা বসতে পারে। মদ খেতে খেতে নজর রাখতে পারে রাস্তার ওপর কি ঘটছে না ঘটছে তা দেখার জন্য। তবে এসবই দিনের বেলার জন্য, রাতের ক্কচিৎ অন্ধকারে বারান্দাটা ব্যবহার হয়ে থাকে।
শহরের একমাত্র বার, রেস্তোরাঁ, রেস্তোরাঁর মালিক টোনি মোরেলি। হাসিখুশি মোটা সোটা জাতে ইটালিয়ান। বছর কুড়ি আগে এই ইয়েলো একরস শহরে সে প্রথম আসে পোলট্রির বাড় বাড়ন্ত ব্যবসা দেখে সে ঠিক করে এখানে একটা রেস্তোরাঁ খোলা দরকার। তার বরাবরের ইচ্ছে ছিল জনসাধারণকে অন্ন জোগান। অবশ্যই আগের দিনের মত নিখরচায় নয়। আর এখানকার বাসিন্দারাও তাকে আপন করে নিয়েছিল কয়েক দিনের মধ্যে। তার প্রমাণ সে পেল তার স্ত্রীর মৃত্যুর সময়। শহরের প্রায় সব লোক তার স্ত্রীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিয়ে যে ভাবে তাকে উষ্ণ সমবেদনা জানায় তাতে তার ধারণা হয়েছে সে শুধু এখানকার একজন শ্রদ্ধেয় নেতা হিসেবে স্বীকৃত নয় সবাই তাকে আন্তরিক ভাবেই ভালবাসে। এটা একটা বাড়তি প্রেরণা বলা যেতে পারে। টোনির মেয়ে মারিয়া এখন এই রেস্তোরাঁয় তার মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, খদ্দেরদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে নজর দেবার ভার তার ওপর আর ওর বাবা যথারীতি রন্ধনশালার ভার নিজের কাঁধে চাপিয়ে নিয়েছে।
মোরেলির যা কিছু কেনা-বেচা ঐ সকাল এগারটা থেকে দুপুর তিনটের মধ্যে। ইয়েলো একরসের বাসিন্দারা সেই সময়টুকুর মধ্যে এই রেস্তোরাঁয় আসে মদ আর লাঞ্চ খেতে। রাত দশটা নাগাদ রেস্তোরাঁর বেচাকেনা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ইয়েলো একরসের লোকেরা বাড়িতে নৈশভোজ সারবার পক্ষপাতি। কিন্তু মোরেলি তার রেস্তোরাঁ খুলে রাখে দশটার পরেও। মানুষের সঙ্গ তার ভাল লাগে। যদি সেই সময় কোন আগন্তুক কিংবা ট্রাক-ড্রাইভার অরেঞ্জভিলে যাবার পথে তার রেস্তোরাঁয় ক্ষুধা নিবারণের জন্য আসে তখন সে তাদের সাদর অভ্যর্থনা জানায় খুশির পসরা সাজিয়ে।
রাত তখন সাড়ে দশটা। হ্যারী মিচেল তখন বড় রাস্তা দিয়ে হাঁটছে।ক্লান্ত সে,বুঝি বা ক্ষুধার্তও। ঠাণ্ডাবীয়ার খেলে ভাল হয়। টোনি মোরেলির রেস্তোরাঁটা চোখে পড়তেই সে সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠে এল। দরজা ঠেলে রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়াল। চারিদিক তাকিয়ে দেখে নেবার জন্য।
প্রায় কুড়িটা টেবিল সাজান রয়েছে–প্রতিটি টেবিলে চারজন করে বসবার ব্যবস্থা করেছে। মোরেলি। হ্যারির ডানদিকে বার এবং একটা প্রমাণ সাইজের আয়না।
মাথায় লাল চুল মোটা-সোটা চেহারার একটি মেয়ের দুধ সাদা চামড়ায় প্রথম যৌবনের লাবণ্য, মুখে উছলে পড়া হাসি হ্যারীর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। হ্যারীর সঙ্গে তার দৃষ্টি বিনিময় হল।
ইয়েলো একরসে তোমাকে স্বাগত জানান হচ্ছে, মেয়েটা তাকে বলল, কি ধরনের ড্রিঙ্কস তুমি পছন্দ কর? তোমার চোখ মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে, তুমি খুব তৃষ্ণার্ত।
হ্যারী তার হাসির প্রত্যুত্তরে পিঠের ঝোলাটা নিচে নামিয়ে রেখে বারের দিকে এগিয়ে গেল।
তোমার অনুমানই ঠিক, হ্যারী হাসিমুখে বলল, দয়া করে আমাকে বীয়ার দাও, প্রচুর ঠাণ্ডা বীয়ার গিলতে চাই।
বোতল থেকে বীয়ার ঢালে গ্লাসে টোনি মোরেলির মেয়ে মারিয়া, তারপর বীয়ারের সঙ্গে কিছু বরফের টুকরোও মিশিয়ে হ্যারীর দিকে এগিয়ে দেয়।
তোমার চোখে আলো তোমার হাসিতে সূর্য হাসেবীয়ারের গ্লাস হাতে নিয়ে মুগ্ধ চোখে তার দিকে তাকাল হ্যারী।
এর আগে কোন পুরুষ এমন অনুরাগে ভরা ভাল ভাল কথা শোনায়নি মারিয়াকে। লজ্জায় ওর মুখ লাল হয়ে উঠল।
ধন্যবাদ–
যে কোন জিনিষ দ্বিতীয়বার পাবার আগ্রহ থাকে তীব্র, আর এক গ্লাস হবে?
মারিয়ার ঠোঁটে খুশির হাসি। দ্বিতীয়বার বীয়ার ঢালল গ্লাসে।
দ্বিতীয় দফায় বীয়ার নিঃশেষ করে চোখ মেলে তাকাতে গিয়ে হ্যারী অবাক হল।
এখন প্রায় নৈশভোজের সময় হয়ে গেছে। মেয়েটি ভাজা পেঁয়াজ ঢাকা দুটো পর্ক-চপ, এক প্লেট আলু এবং মটরসুটি তার সামনে রেখে বলল, এখন আর বীয়ার নয় চটপট খেয়ে নাও।
হ্যারীর চোখ বড় হল।দারুন খিদে পেয়েছিল তার। স্যান্ডউইচ আশা করছিল সে। সে জায়গায় এত খাবার দেখে হাসি উপচে পড়ল তার বড় বড় চোখে। তার মানে তুমি বলছ সব খাবার আমার?
ড্যাড আমরা একজন দারুন ক্ষুধার্ত খরিদ্দার পেয়েছি। যত তাড়াতাড়ি পার বিশেষ ধরনের খাবার কিছু তৈরী কর ওর জন্য, মারিয়া বলল।
মোটাসোটা উজ্জ্বল একটা মুখ রন্ধনশালা থেকে উঁকি মেরে দেখল হ্যারীকে, মোরেলি তার আপাদমস্তক জরীপ করে নিল। সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে সে বলে একটু পরেই আবার স্প্যাসেটি দিচ্ছি। পেঁয়াজ তোমার পছন্দ মিস্টার।
সব কিছুই আমার পছন্দ, ধন্যবাদ।
মারিয়া আর একবার তার মুখের দিকে তাকাল। তা তুমি এখন আসছ কোথা থেকে? নিউইয়র্ক। হ্যারী আর একবার রেস্তোরাঁর উপর চোখ বুলিয়ে নিল। সে এখন আগের থেকে অনেকটা আরামবোধ করছে। ভারী সুন্দর এই জায়গাটা। এরকম সুন্দর একটা জায়গা আমি এখানে আশা করিনি। এখানে আমার রাত কাটানোর মত কোন ঘর পাওয়া যাবে?
মারিয়া হাসল। কাউন্টারের ওপর কনুইয়ের ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ও তখন দেখছিল হ্যারীকে মুগ্ধ চোখে। ভদ্রলোককে দেখতে ঠিক যেন ছায়াছবির নায়কের মতন। সেই নীল চোখ ছোট ছোট করে চুল ছাঁটা। হ্যারী যেন ঠিক পল নিউম্যানেরই দ্বিতীয় সংস্করণ।
আমাদের একটা ঘর খালি আছে। ব্রেকফাস্ট সমেত তিন ডলার। সেই সঙ্গে বাড়তি ড্যাডের স্পেশ্যাল স্প্যাসেটি–
তোমার বাবাই সব রান্না করেন? হ্যারী জিজ্ঞেস করল।
হ্যাঁ ঠিক তাই। হ্যারীর পাশে বসে মারিয়া তার খাওয়া তদারক করতে লাগল। মাঝে মাঝে আড়চোখে অবাক হয়ে হ্যারীকে দেখে ও। যত দেখে ততই অবাক হয় সে। এমন লম্বা-চওড়া স্বাস্থ্যবান হাসিখুশি ভরা পুরুষ ছায়াছবির পর্দায় ছাড়া অন্য কোথাও ওর চোখে পড়েনি কখনও এর আগে।
তাড়াতাড়ি স্প্যাসেটি খেতে গিয়ে হ্যারী এক সময় মুখ তুলে তাকাল, এরকম সুস্বাদু স্প্যাসেটি আমি এর আগে কখনো খাইনি, সত্যি বিশ্বাস কর, আমি একটু বাড়িয়ে বলছি না।
না আমি অবিশ্বাস করব কেন! মারিয়ার চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে খুশিতে। টোনির উদ্দেশ্যে মৃদু চিৎকার করে ও বলে ওঠে, শুনলে ড্যাড আমাদের নতুন খদ্দের তোমার রান্নার প্রশংসা করছে। দারুণ।
হ্যারী তার গ্লাসের শেষ বীয়ারটুকু নিঃশেষ করে মারিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে–এ জায়গাটা তোমার ভাল লাগে?
সন্ধ্যেটা একটু একঘেয়ে লাগে, মারিয়া বলে–তবে দুপুরে লাঞ্চের সময় ছেলের দল খেতে এলে সময়টা মন্দ কাটত না হাসি-ঠাট্টার মধ্যে দিয়ে।
হ্যারীর ইচ্ছে হল, মারিয়ার সঙ্গে ভাব জমায়। মারিয়ার কথাবার্তা শুনে মনে হল ও খুব সহজ সরল প্রকৃতির মেয়ে, এই রকম মেয়েই পছন্দ হ্যারীর।
সায়গন থেকে ফেরার সময় একমাস সে নেপলস এবং ক্যাপরিতে কাটিয়ে এসেছিল। মারিয়ার মত ইটালিয়ান মেয়ের সঙ্গ সে পেয়েছিল সেখানে। ইটালিয়ান মেয়েরা সহজেই পুরুষদের মন জয় করে নিতে পারে। সহজ সরল জীবন বলে তাদের নিয়ে কোন ঝামেলা নেই। তখন মার্কিন-মুলুকে মেয়েদের নিয়ে কম ঝামেলা হতো না, নিউইয়র্কে যে সব মেয়েদের সঙ্গে মিশেছিল তারা তার কাছে যেন একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। টাকা নয় তো সেক্স, সেক্স নয় তো কি করে ডায়েটিং করে স্লিম হওয়া যায়। আর তা না হলে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্যান প্যানানি।
তাদের ধারণা সারা পৃথিবীর দায়-দায়িত্ব বুঝি তারাই কেবল বহন করছে।
পুরুষরা নিষ্কর্মা। তাদের সঙ্গে আলাপ করতে গেলে আরো অনেক ঝামেলা। বোমা,বাৰ্থকন্ট্রোল পিল, উইমেন্স লিব রাজনীতি যত্তো সব দুনিয়ার সমস্যা নিয়ে অহেতুক মাথা ঘামান।
তার থেকে ইতালিয়ান মেয়েরা অনেক সরল অনেক বেশী আন্তরিকতায় ভরপুর তাদের মন।
হঠাৎ হ্যারীর ভাবনায় ছেদ পড়ল একটা কোলাহলের শব্দ শুনে।
শব্দটা রাস্তা থেকে ভেসে আসছিল সেই সঙ্গে একটা মানুষের পায়ের শব্দ। কে যেন ছুটে আসছে মরিয়া হয়ে। মনে হয় প্রাণের ভয়ে ছুটে আসছে সে। শব্দটা হ্যারীকে সন্ত্রস্ত করে তুলল।
মুহূর্তের মধ্যে শব্দটা আছড়ে পড়ল রেস্তোরাঁর প্রবেশ পথের দরজায়। দরজার পাল্লাটা ছিটকে পড়ল দেওয়ালের গায়ে। হ্যারীর সজাগ দৃষ্টি নিবদ্ধ হল আগন্তুকের ওপর। হাঁপাচ্ছে সে। ছাব্বিশ বছরের ভরপুর মার্কিন যুবক। বয়সের তুলনায় তাকে যেন একটু খাটো বলেই মনে হল। মাথার কাল চুল তার শার্টের কলার পর্যন্ত নেমেছে। রোগা ধারাল মুখে ভয়ের মেহগিনীরং, ডান চোখের ঠিক উপরে ধারাল অস্ত্রের দাগ।রক্তের ধারা নেমেছে সেখান থেকে।কালোকালসিটে দাগ। পরনে ময়লা হাফপ্যান্ট ঘেঁড়া লাল-সাদা চেকশার্ট।বাঁ-হাত দিয়ে সে তার ক্যানভাসে ঢাকা গীটারটা বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে রেখেছে প্রাণপনে। তার কাঁধে একটা ছোট্ট পশমের ব্যাগ ঝুলছিল। এ সব এক লহমায় দেখে নিয়েছিল হ্যারী।
শিকার সন্ধানকারী জানোয়ারের মত কি যেন খুঁজছিল সে। হ্যারীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে রাস্তার দিকে আঙুল তুলে দেখাল ইশারায়।
ওরা আমাকে তাড়া করেছে। কোথায় আমি লুকোই বলুন তো?
যুবকটির ভয়ার্ত মুখ দেখে কেমন মায়া হল হ্যারীর। চকিতে উঠে দাঁড়াল সে।
বারের পিছনে গিয়ে লুকোও।
যুবকটি বারের পিছনে অদৃশ্য হয়ে যাবার পর হ্যারী তার ঝোলার ভিতরে হাত ঢুকিয়ে স্যাম বেনজের দেওয়া কাঠের গদাটা শক্ত মুঠোয় ধরে রাখে এবং অপেক্ষা করতে থাকে হিপীদের আসার। বেশ কয়েক জোড়া পায়ের শব্দ তখন রেস্তোরাঁর দিকেই এগিয়ে আসছিল।
সে সময় মারিয়া ভয়ে ভয়ে রন্ধনশালা থেকে উঁকি মারছিল। যুবকটিকে বারের পিছনে লুকোতে দেখেই ও উঠে গিয়েছিল, একটা অশুভ কিছু ঘটতে যাচ্ছে এখানে বুঝতে পেরে।
সব ঠিক আছে, নিচু গলায় হ্যারী বলল–, রন্ধনশালায় ফিরে যাও।
হয়তো একটু গণ্ডগোল হতে পারে তবে সামলাবার ভার আমার ওপর ছেড়ে দাও।
তারপর দীর্ঘ নীরবতার পর রেস্তোরাঁর দরজা খুলে গেল ধীরে ধীরে। তারা ঠিক অশরীরীমূর্তির মত নিঃশব্দে রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করল, চারজন হিপী ছেলে সতের থেকে কুড়ি বছর বয়স হবে তাদের।
প্রত্যেকের মাথায় জটাবাঁধা। এলোচুল কাঁধের নিচে ঝুঁকে পড়েছে। তাদের মধ্যে তিনজনের গালভর্তি দাড়ি। প্রত্যেকের পোষাক জীর্ণ, মলিন চেহারা, অত্যন্ত নোংরা, গায়ে বদগন্ধ।
আর তাদের সঙ্গিনী হিপিনী মেয়েটির বয়স ষোলর বেশী নয়, বেঁটে রোগাটে চেহারা বুঝিবা একটু বেহায়াও বটে। পরনে কাল রাউজ এবং টান-টান নোংরা লাল হট প্যান্ট। হিপীদের থেকে ওই হিপিনীর গায়ের বদগন্ধ বেশি তীব্র এবং অসহ্য।
চাক, লোকটা এখানেই ঢুকেছে। তাদের মধ্যে একজন হিপী ছেলে বলে–আমি তাকে এখানে ঢুকতে দেখেছি।
ওদের দলনেতা চাক। হিপীদের মধ্যে ওর বয়সই সব থেকে বেশী। লম্বাটে চেহারা কুৎসিত হিংস্র চাহনি তার চোখে। রেস্তোরাঁর ভিতরে চোখ বুলোতে গিয়ে হ্যারীকে দেখে তার দৃষ্টি থমকে গেল। অবাক হয়ে সে ভাবছে এ আবার কে? হিপীদের দেখে ভয় পায় না। এত দুঃসাহস! চাক তার স্পর্ধা দেখে রেগে গেল। অন্যরা ভিতরে ভিতরে দারুণ উত্তেজিত হচ্ছিল। চাক তাদের হয়ে খিস্তি করল হ্যারীকে, বাস্টার, গীটার হাতে এখানে কাউকে ঢুকতে দেখেছিস?
হ্যারী চেয়ার, সরিয়ে ধীরে ধীরে সরে দাঁড়াল নিঃশব্দে, তবে তার স্থির দৃষ্টি পড়ে রইল চাকের উপর।
চাক অস্থির ভাবে পায়চারি করতে করতে বলে, আরে তুই বোবা কালা নাকি?
তোদের কথা আমি সবই স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি সেই সঙ্গে তোদের গায়ের বদগন্ধও। হ্যারী শান্ত মেজাজে বলে, তুই তোর দলের ছেলেদের নিয়ে এখান থেকে চলে যা। পেটে বদগন্ধে এখানে থাকা যাচ্ছে না।
চাক চমকে ওঠে হ্যারীর স্পর্ধা দেখে। ভয় পেয়ে কিনা কে জানে, দু’পা পিছিয়ে যায় চাক, তার নিঃশ্বাসে হিস্ হিস্ শব্দ, কুৎসিত মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে ওঠে।
তোর মত আমাকে মেজাজ দেখাবার সাহস কেউ পায় না রাগে গজরাতে গজরাতে সে বলে, আমি তোকে–
যা যা কেটে পড় এখান থেকে, হ্যারীও কম যায় না। চাকের চড়া মেজাজের সুরের প্রতিধ্বনি করে সে বলে, ফিরে গিয়ে তোর মাকে বলিস সাবান মাখিয়ে তোকে যেন ভাল করে স্নান করিয়ে দেয়।
ঠিক আছে ক্রীপ! নোংরা হাত দুটো মুঠো করে চাক গর্জে ওঠে, আমরা এই রেস্তোরাঁটা ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে দেব। সেই সঙ্গে তোকে পেঁদিয়ে তোর চামড়ায় ডুগডুগি বাজাব।
কিন্তু আমি তা করব না, হ্যারী তার উদ্দেশ্যে কথাটা ছুঁড়ে দিয়ে টেবিল থেকে আর এক ইঞ্চি সরে দাঁড়াল। তার একটা হাত তখন ঝোলার ভিতরে, কাঠের গদাটা তার হাতের মুঠোয় আবদ্ধ। কেবল তুমিই আঘাত পাবে। কেবল বাচ্চা ছেলেদের মতো অহেতুক
কথার মাঝে থামতে হল হ্যারীকে। কারণ ঠিক সেই সময় সামনের টেবিলটা লাথি মেরে উল্টে দেয় চাক, ঝনঝন করে কাঁচ ভেঙে পড়ে। রেস্তোরাঁ ভেঙে গুঁড়িয়ে দাও। চাক তার সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে বলে–সবকিছু ভেঙে চুরমার করে দাও।
ঝোলার ভেতর থেকে হ্যারী তার হাতটা টেনে বার করে আনে দ্রুত গতিতে। তার হাতে এখন সেই কাঠের গদা। তেমনি আচমকা দ্রুত গতিতে যে ভাবে সে ছুটে গেল চাকের দিকে চাক সুযোগই পেলনা হাত তোলবার। হ্যারীর হাতের ঘুরন্ত কাঠের গদাটা মুহূর্তে আছড়ে পড়ল চাকের হাতে। মট করে হাড় ভাঙার শব্দ হল গাছ থেকে শুকনো ডাল ভেঙে পড়ার মত মেঝের উপর চাকের ভারী দেহ পতনের শব্দ উঠল। সে তখন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল।
মার মার ঐ শয়তানটাকে। চাক সেই অবস্থায় তার দলের ছেলেদের নির্দেশ দেয়।
তাদের ইতস্ততঃ করতে দেখে হ্যারী আবার এগিয়ে এল। তাদের দলের আর এক ছোকরার দিকে আগের মত দ্রুতগতিতে ছুটে যায় সে। বাধা দিতে এলে তার কাঁধের উপর আঘাত হানে হ্যারীতার হাতের সেই কাঠের গদাটা দিয়ে। ছোকরা ছিটকে পড়ল অদুরে। যন্ত্রণায় তার মুখ বিকৃত।
বেরিয়ে যাও। হ্যারী চীৎকার করে উঠল হিপীদের উদ্দেশ্যে।
হ্যারীর উদ্দেশে হিপিনী মেয়েটা একদলা থুতু ছুঁড়ে ছিটকে পড়ে সেখান থেকে। বাকী দুটি হিপী হুড়োহুড়ি করতে করতে দরজার দিকে ছুটে গেল, কে আগে দরজার ওপারে যেতে পারে এই আর কি। দ্বিতীয় আহত ছোকরাটা নিজেকে সামলে নিয়ে ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছিল পায়ের ওপর ভর দিয়ে। একটা হাত তার আহত কাঁধের উপর ছিল। তার লক্ষ্যও দরজার দিকে, পালাবার পথ খুজছে সে। হ্যারী তার দিকে ছুটে গিয়ে বুটশুদ্ধ ডানপাটা তুলে ছোকরার মেরুদণ্ডে সজোরে লাথি ঝাড়ল। ছোকরা সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ল।
হ্যারী এবার আহত চাকের দিকে এগিয়ে গেল। সে তখনো হাঁটু মুড়ে বসে ভাঙা হাত বুকে চেপে ধরে কাতরাচ্ছিল যন্ত্রণায়–
যা দূর হ এখান থেকে, হ্যারী তাকে শাসায়, তা না হলে—
হিপীদের দলপতির দুরবস্থা দেখে হাসি পেল হ্যারীর। চাক তখন আহত হাতটা বুকে চেপে যন্ত্রণায় টলতে টলতে দরজা পেরিয়ে রাস্তায় গিয়ে থামল। হিপীদের দল বেঁধে পলায়ন দৃশ্য দেখছিল হ্যারী নিবিষ্ট মনে। চাককে যন্ত্রনায় অত কাতরাতে দেখেও তার দলের কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে এল না। সবাই তখন যে যার প্রাণ হাতে করে নিরাপদ জায়গায় পালাবার জন্য ছুটছিল।
রেস্তোরাঁর দরজা বন্ধ করে বারের দিকে এগিয়ে গেল হ্যারী। ভয়ে কুঁকড়ে থাকা যুবকটির দিকে তাকাল সে বারের দিকে গিয়ে, ওরা আধমরা হয়ে পালিয়েছে; হ্যারী তাকে আশ্বস্ত করতে করতে বলল, আমার মনে হয় তোমার একটু ড্রিঙ্কসের খুব প্রয়োজন।
যুবকটি উঠে দাঁড়াল, তার পা কাঁপছিল, তার চোখ মুখ থেকে ভয়ের ছাপটা তখনো মিলিয়ে যায়নি।
আমার মনে হয় আমার দেখা পেলে ওরা আমাকে খুন করে ফেলবে। বারের উপর ঝুঁকে পড়ল যুবকটি।
সহজ হওয়ার চেষ্টা কর। ভয় পাবার কিছু নেই, হ্যারী বলল।
ওদিকে মারিয়া এবং ওর বাবা রন্ধনশালা থেকে বেরিয়ে এল। তারা তখনো ভয়ে কাঁপছিল।
এসবের জন্য আমি দুঃখিত, মারিয়াকে উদ্দেশ্য করে হ্যারী বলে, কাঁচটা ভাঙতে না দেওয়াই উচিত ছিল। কিন্তু কি করব।
তুমি যা করেছ চমৎকার। আমি সব দেখেছি। মারিয়া তার কাজের প্রশংসা করে বলে, তুমি আজ এখানে না থাকলে রেস্তোরাঁয় একটা জিনিসও অবশিষ্ট থাকত না।
হ্যারী হাসল।
আমাদের নবাগত বন্ধুর ভার তোমাকে নিতে হবে। হ্যারী অনুরোধের ভঙ্গীতে তাকায়। বিশ্রীভাবে কেটে গেছে ওর দেহের কয়েকটা স্থান।
এবার টোনি মোরেলির পালা। হ্যারীর একটা হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে আনন্দের আতিশয্যে বলে তোমার কাজের কোন জবাব নেই। এ তল্লাটে ওদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দূরে থাক ভয়ে কেউ মুখ পর্যন্ত খুলতে পারে না। অথচ তুমি আজ ওদের আঘাত হেনে পর্যুদস্ত করে বিদায় করলে। ধন্যবাদ মিস্টার। আজকের দিনে তোমার মত সাহসী ছেলে আমাদের একান্ত দরকার।
প্রশংসায় গদগদ হয়ে হ্যারী প্রস্তাব দেয়, আসুন এবার একটু স্কচ পান করা যাক।
আমার নাম র্যান্ডি রোচ, যুবকটি তৃষ্ণার্ত, হাত বাড়ায়, এক পেগ স্কচ আমাকেও দিও। একটু পরে রন্ধনশালা থেকে ফিরে আসে মারিয়া। ওর হাতে গরম জলের পাত্র তোয়ালে অ্যাডহেসিভ প্লাস্টার। র্যান্ডির ক্ষতস্থান থেকে ঝরে পড়া রক্ত বন্ধ করে সেখানে প্লাস্টার লাগিয়ে দেয় মারিয়া।
র্যান্ডি ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার স্কচের গ্লাসটা হাতে তুলে নেয়।
ধন্যবাদ বন্ধু তোমাকে, স্কচের গ্লাসে এক চুমুক দিয়ে র্যান্ডি বলে, গীটারটা হারালে আমার চাকরীটাও হারাতে হত।
হ্যারী তার গ্লাসে চুমুক দিয়ে এবার র্যান্ডি রোচের খবর নেয়, তা তুমি কোথায় যাবে বন্ধু?
প্যারাডাইজ সিটিতে। তোমার গন্তব্যস্থলও কি সেখানে? বেশ তো তাহলে দুজনে একসঙ্গে এখান থেকে রওনা দিলে ভাল হয়। র্যান্ডি কিছুটা আত্মস্থ হয়ে বলে, একসঙ্গে দুজনে পথ চলাটাও নিরাপদ কি বল বন্ধু।
নিশ্চয়ই! হ্যারী মাথা নাড়ে। শুনে আমি খুব খুশি হলাম।
স্প্যাসেটি স্পেশালের দুটো প্লেট হাতে নিয়ে এসে তাদের সামনে দাঁড়াল মারিয়া বাবার হাতে তৈরী, তোমাদের জন্য পাঠালেন তিনি আর তিনি জানালেন তোমাদের থাকবার জন্য ঘরের ব্যবস্থা পাকা।
হ্যারী ওর দিকে তাকাল গভীর শ্রদ্ধা জানাতে। চোখে চোখে দুজনের অনেক কথা হল বুঝি। সরবে কিছু বলার থেকে অনেক বেশি মনের কথা।
এ ওকে উজাড় করে দিল। এক সময় লজ্জা পেয়ে রন্ধনশালায় ফিরে গেল মারিয়া। হ্যারী
ওর গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে গিয়ে পলক ফেলতে ভুলে গেল।
সম্বিৎ ফিরে পেয়ে র্যান্ডির দিকে ফিরে তাকায় সে,–খুব ভাল লোক ওঁরা তাই না!
জানি না। আমি শুধু জানি এই রেস্তোরাঁ একমাত্র তুমিই রক্ষা করেছ। সেই সঙ্গে আমাকেও, র্যান্ডি বলল, গীটারটা হারালে আমাকে অনেক কষ্ট পেতে হত। জানো বন্ধু আমি প্যারাডাইজ সিটিতে সোলো ডোমিনিকোর হোটেলে কাজ করি। আমার কাজ হল গীটার বাজিয়ে গান করা। এই নিয়ে তিন বছর কাজ করছি সেখানে। চমৎকার রেস্তোরাঁ। রেস্তোরাঁর মালিক এবং মেয়ে ব্যবসাটা চালায়। মেয়েটি দারুন মিশুকে এবং পরোপকারিনী। তা তুমিও তো সেখানে চাকরীর খোঁজেই চলেছ তাই না?
হ্যাঁ। আমার কি কোন সুযোগ আছে বলে তোমার মনে হয়? যে কোন কাজ গ্রহণ করতে রাজী আমি।
র্যান্ডি একটু সময় কি যেন ভাবল। তারপর সে আবার সরব হল। হয়ত তোমার একটা চাকরী আমি করে দিতে পারলেও পারি।
সে নিজেই রেস্তোরাঁ চালায়। ডোমিনিকোতে খুব শীগগীর তার কিছু লোকের প্রয়োজন হবে। তা তুমি সাঁতার জানো?
সাঁতার? হাসল সে। হ্যাঁ মনে হয় এ ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ অভিজ্ঞ। গত অলিম্পিকে ফ্রীস্টাইল এবং ডাইভিং-এ ব্রোঞ্জ মেডেল পেয়েছিলাম।
অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ মেডেল পেয়েছিলে তুমি। বিস্ময়াবিষ্ট র্যান্ডি জিজ্ঞেস করে, কতদিন তুমি ফৌজিতে ছিলে? কবে ভিয়েতনামের যুদ্ধে গিয়েছিলে?
তিন বছর সেখানে আমি একজন সৈনিক হিসেবেই থেকেছি। র্যান্ডি তার পিঠ চাপড়ে আশ্বাস : দেয়, আলবাৎ তোমাকে চাকরী দেবে সে। এখন সীজনের সময়। টুরিস্টরা ইতিমধ্যেই এখানে আসতে শুরু করে দিয়েছে। আজকে টুরিস্টরা হোটেল রেস্তোরাঁয় ঢুকলেই সুইমিং পুলে সাঁতার কাটতে উদগ্রীব হয়ে ওঠে। সাঁতার কাটা শেখার জন্য সেখানে কয়েকজন অভিজ্ঞ সাঁতারু খুব প্রয়োজন।
এ চাকরী আমায় খুব মানাবে। হ্যারী দারুণ খুশি। কিন্তু কে জানে আমার আসার আগে অন্য কারোর সঙ্গে কথাবার্তা পাকা করে ফেলেনি তো?
আমার বিশ্বাস তা হয়নি এখনও পর্যন্ত। চাকরীতুমি ঠিক পাচ্ছই। তবে একটু ধৈর্য ধরতে হবে।
ঠিক আছে, আমার কোন তাড়া নেই, হ্যারী বলে, ভাবছি রাতের অন্ধকারে আমি হাঁটা পথে পাড়ি দেব প্যারাডাইজ সিটির দিকে। রাতে গরমের বালাই নেই। তাছাড়া রাতে পথ চলাটা এখন খুবই নিরাপদ। প্রকাশ্য দিনের আলোয় হিপীদের তাড়া খাওয়ার মত সম্ভাবনা খুবই কম রাতের অন্ধকারে।
বেশ তো কাল সন্ধ্যায় যাত্রা শুরু করা যাবেখন। রাতটা এখানে থেকে যাচ্ছি, কি বল?
হ্যারী মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়াল। আমি তাহলে মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থাটা পাকা করে নিচ্ছি।
এখানে তাদের থাকার প্রস্তাবটা শুনে মারিয়া খুশিতে ফেটে পড়ে, এব্যাপারে আমাদের অনুমতি নেওয়ার কোন প্রশ্ন কি থাকতে পারে?
মারিয়া পাল্টা প্রশ্ন করে তাকায় হ্যারীর দিকে, তুমি আমাদের যে উপকার আজ করলে তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। সত্যি কথা বলতে কি এখন এই রেস্তোরাঁর মালিক বলতে তুমিই।তাই-তোমার রেস্তোরাঁয় যতদিন খুশি তুমি থাকতে পার। এখন বলল অন্য আর কিছুর দরকার আছে কিনা।
একটু গরম জল হলে ভাল হত।
আমি জানতাম তোমার গরম জল লাগবে। তাই আগেই গরম জল তৈরি রেখেছি। চল আমার সঙ্গে। আমি ততক্ষণে তোমাদের বিছানা গুছিয়ে রাখি।
মারিয়াকে হ্যারীর সঙ্গে যেতে দেখে টোনি মোরেলি এবার রন্ধনশালা থেকে বেরিয়ে আসে র্যান্ডির সামনে।
ছেলেটি ভারী চমৎকার, র্যান্ডিকে বলে সে, ওকে আমার ছেলের মত করে যদি পেতাম
আপনি ঠিকই বলেছেন, র্যান্ডি তাকে সমর্থন করে বলে, হ্যারীর মত ছেলেকে পাত্র হিসেবে পাওয়া সত্যি গর্বের কথা।
র্যান্ডির খাওয়া তখন শেষ। টোনি মোরেলি তার সঙ্গে দু-চারটে কথা বলে আবার সে তার রন্ধনশালায় ফিরে গেছে।
একা একা বসে থেকে র্যান্ডি ভাবে, কেন যে মেজাজের মাথায় হ্যারীকে কথা দিলাম, কিন্তু সোলো যদি গররাজী হয়? তখন সে কি করবে? কথাটা মনে হতেই সে ফোনবুথে ঢুকে ফোন করে সোলোকে।
সোলো রেস্তোরাঁয় ছিল না। নিগ্রো কারম্যান জো খবরটা দিল তাকে।
শোন জো খুব জরুরী দরকার ওঁর সঙ্গে কথা বলার। ওঁকে এখন কোথায় পাব বলতে পার?
জো তাকে সোলোর বাড়ির ফোন নম্বর দিল। হ্যাঁ কে কথা বলছ?
আমাকে চিনতে পারছ? র্যান্ডি উত্তরে বলে, র্যান্ডি রোচ কথা বলছি। তোমার জন্য একজন লাইফ গার্ড সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি সোলো।
অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ান। এখন শোন…
.
০২.
প্রায় তিন ঘণ্টা হল রাস্তা দিয়ে হাঁটছেহ্যারী এবং র্যান্ডি। হ্যারীআগে এবং র্যান্ডি তার পিছনে। দুজনেই কেমন চিন্তিত।
নিমেঘ আকাশের ভাসমান চাঁদের ছায়া পড়েছিল নিচে সাদা ধুলো টাকা রাস্তায়। তখনও উষ্ণ বাতাসের অস্বস্তি বোধটা কাটেনি। রাস্তার দুধারে সুন্দর গাছের ছায়া।
সন্ধ্যা সাতটার সময় তারা হোেটল ইয়েলো একরস ছেড়ে এসেছে। আসবার সময় মোরেলি তাদের স্ন্যান্সের প্যাকেট দেয় পথ ভোজনের জন্য। ফেরার পথে মোরেলির সঙ্গে দেখা করবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছিল হ্যারী।
মারিয়ার কথা ভাবছিল হ্যারী। ওর সঙ্গে নিউইয়র্কের মেয়েদের তুলনা করছিল সে।
তারা তাদের দেহের সুখ ছাড়া অন্য আর কিছু বুঝি ভাবতে পারে না। সিগারেট খেতে খেতে তারা কেমন অবলীলাক্রমে পুরুষদের সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হয়, এ যেন ডাল-ভাত খাওয়ার মতন।
আশ্চর্য এতটুকু লজ্জা নেই। ক্লান্তি নেই, দ্বিধা নেই। হ্যারী অবাক হয়ে ভাবে মারিয়া তাদের থেকে আলাদাই শুধু নয় ওর মিষ্টি ব্যবহার এবং সরলতা সব থেকে বেশি আকর্ষণীয়।
আর একটা ব্যাপারে বিস্মিত হতে হয়, অন্য সব মেয়েদের মত মারিয়ারও হয়ত সমস্যা থাকতে পারে। কিন্তু ওর নিজস্ব সমস্যার উপর যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ আছে বলেই মনে হয়।
আজকের দিনে প্রত্যেকেরই কিছু সমস্যা আছে কিন্তু সমাধান করবার মত সাহস এবং ক্ষমতা থাকে কতজনেরই?
যাই হোক সেই স্বল্প কয়েক জনের মধ্যে মারিয়া অবশ্যই একজন। হ্যারী ভিয়েতনাম ফেরৎ সৈনিক, তিন বছর কাটিয়ে এসেছে সে সেখানে।
ভিয়েতনামের মত বিরাট সমস্যা বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে দ্বিতীয় কোন ঘটনা আজ পর্যন্ত ঘটেছে বলে মনে হয় না।
সেখানকার প্রতিটি মানুষের সমস্যা আছে সে সব সমস্যা বিভিন্ন চরিত্রের। তারাও আজ নিজেদের সমস্যা নিজেরা সমাধানে ব্যস্ত।
কিন্তু মারিয়ার সমস্যা আরও জটিল, সেদিক থেকে ওর কৃতিত্ব অনেক বেশি। তার নিজের সমস্যাও কম নয়।
কিন্তু নিজের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় এখন নয়, হ্যারী ভাবল। যাই হোক রেস্তোরাঁর চাকরীটা তার এক রকম পাকা, সোলো তার সম্বন্ধে খুবই আগ্রহী বলে মনে হয়।
মিনিট দশেক পরে তারা হাইওয়েতে এসে পৌঁছল। র্যান্ডি কাঁধ থেকে তার জলের ব্যাগ এবং গীটারটা নামিয়ে রাখল।
এস,এখানে অপেক্ষা করা যাক। আধঘণ্টার মধ্যে কোন ট্রাক কিংবা গাড়ি পাওয়া যেতে পারে। র্যান্ডি বলে, ভাগ্য প্রসন্ন হলে এখান থেকে মাইল পঞ্চাশেক দূরে একটা স্ন্যাক্সবার ভোলা পেতে পারি, সারা রাত খোলা থাকে।
বেশির ভাগ ট্রাক ড্রাইভার সেখানে ডিনার সারে। সেই স্ন্যাক্স বার পর্যন্ত গাড়ী পেলে সেখান থেকে একটা ট্রাক পেলেও পাওয়া যেতে পারে। মিয়ামি পৌঁছতে পারলে আর কোন ঝামেলা নেই।
পাহাড়ের ওপর থেকে দুরন্ত গতিতে ছুটে আসছে একটা ট্রাক, হেডলাইটের তীব্র আলোকে। চোখ ধাঁধিয়ে যায়।
তারা এতক্ষণে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। র্যান্ডি এবার রাস্তার মাঝখানে এগিয়ে গেল। চলন্ত ট্রাকটা কিন্তু থামল না। তার চিৎকার শুনেও দুরন্ত গতিতে পথের ধুলো উড়িয়ে ছুটে গেল।
হতাশ হয়ে র্যান্ডি ফিরে আসে।হ্যারী তখন পথের ধারে ঘাসের উপর বসে সিগারেট খাচ্ছিল। পরের পনের মিনিট চারটি ট্রাক সেখান দিয়ে ছুটে গেল, কিন্তু কোন ট্রাক ড্রাইভারই র্যান্ডির অনুরোধ রাখল না।
এর থেকে হেঁটে যাওয়া ভাল, হ্যারী বলে, আমার মনে হয় না কেউ তোমাকে খাতির করবে।
আরো পনের মিনিট অপেক্ষা করে দেখ, র্যান্ডি তাকে আশ্বস্ত করে বলে, মনে হয় আমার এমন বড় বড় চুল দেখে সবাই আমাকে হিপী ঠাওরাচ্ছে। তার চেয়ে এক কাজ কর, আমার বদলে তুমি একবার চেষ্টা করে দেখ, কোন ট্রাক কিংবা গাড়ি থামান যায় কিনা।
অতঃপর র্যান্ডি ফিরে যায় হ্যারীর জায়গায় আর হ্যারী উঠে আসে রাস্তায়। তোমার সাফল্য কামনা করি।
কিন্তু তাতে কোন সুবিধা হয় না। তিন তিনটি ট্রাক হ্যারীর নাকের ডগা দিয়ে ছুটে গেল, কেউ তাকে গ্রাহ্য করল না।
দূরে পাহাড়ের ওপর থেকে হেডলাইটের তীব্র আলো নেমে আসছিল নিচে ঢালু হাইওয়ের ওপরে। জীপ গাড়ীর পিছনে দুই বার্থের ক্যারাভ্যান।
যদিও কোন আশা নেই, বলল সে, তবে আমি চেষ্টা করে দেখব।
হ্যারী মাঝ রাস্তায় ছুটে গিয়ে হাত তুলে ইশারা করে গাড়ীটা থামানোর জন্য। চোখ মুখে কাতর অনুনয়, করুণ আবেদন, মনে হয় তারা সাড়া দেবার কথা ভাবল। পরমুহূর্তের একটা যান্ত্রিক শব্দ উঠল। ব্রেক কষে গাড়িটা তার সামনে এসে থামল।
র্যান্ডি তাড়াতাড়ি তার ব্যাগটা কাঁধে চাপিয়ে গীটার হাতে ছুটে এল হ্যারীর পাশে। আড় চোখে একবার তাকিয়ে হ্যারী দেখে নিল গাড়ীর চালককে।
আপনি কি মিয়ানিতে যাচ্ছেন?হ্যারী জিজ্ঞেস করল। আমাদের সেখানে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করতে পারেন?
গ্যাসবোর্ডের আলো এসে পড়েছিল চালকের মুখের ওপর। কাছে যেতেই হ্যারী একটু অবাক হল, চালক একটি মেয়ে। মেয়েটিও অবাক চোখে দেখছিল তাকে। মেয়েটির চোখে অ্যান্টি-হীট গগলস। সাদা শার্টের ভিতরে গোঁজা।
গাড়ী চালাতে জান? মেয়েটির চাপা ভাঙা ভাঙা কণ্ঠস্বর, হ্যাঁ নিশ্চয়ই।
ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে?
হ্যাঁ, সেটা আমি সঙ্গে নিয়েই সব সময় ঘুরে থাকি।
খুব ভাল কথা, মেয়েটি বলে, গাড়ী চালালে লিফট দিতে পারি। রাস্তাঘাট ভাল জানা আছে তো?
সোজা চালাতে হবে এই তো।
হ্যারীর দিকে ঝুঁকে পড়ে তাকে ভাল করে নিরীক্ষণ করতে থাকে।
তারপর র্যান্ডির দিকে তাকিয়ে মেয়েটি জিজ্ঞেস করে–তোমার ঐ সঙ্গী বন্ধু নাকি?
হ্যাঁ, ঠাণ্ডা লাগার ভয়ে মাথায় বড় বড় চুল রেখেছে অন্য কোন খারাপ মতলবটতলব অবশ্যই নেই বলেই আমার ধারণা।
বেশ তো ভালই তো!মেয়েটি বলে, মোটামুটি তোমায় পেয়ে মনে হয় আমি উপকৃত হব।
আঠার ঘণ্টা ধরে আমি এই গাড়ীটা চালাচ্ছি।
তুমি ঠিক সময় এখানে আসায় ভালই করেছ। মেয়েটি দরজা খুলে তাকে আহ্বান করতে গিয়ে বলে, একটু বিশ্রাম না নিতে পারলে পথের মাঝে ঘুমিয়ে পড়তে পারি। এই ক্যারাভ্যান গাড়ীটা মিয়ামিতে পৌঁছে দিতে হবে। এই গাড়ীর ফরমাসকারী শাসিয়েছে আমার কোম্পানিকে, আগামীকাল সকালে গাড়ীটা না দিলে অর্ডারটা সে বাতিল করে দিতে পারে।
মেয়েটির কথাবার্তা কেমন বেসুর ঠেকল।
সবকিছুই যেন মুহূর্তের মধ্যে অদ্ভুত ভাবে ঘটে গেল।
তাড়াতাড়ি উঠে পড়। আমাদের পার্টির কথা ভেবে তাড়াতাড়ি চড়ে বস। আমি ততক্ষণে ক্যারাভ্যানের ভেতরে গিয়ে শুয়ে পড়ি। মিয়ামিতে না পৌঁছন পর্যন্ত আমাকে কাঁচা ঘুম থেকে জাগিও না যেন।
ক্যারাভ্যানের ভিতরে কি দুটো বিছানার ব্যবস্থা আছে, র্যান্ডি জানতে চাইল অনেক আশা নিয়ে, অনেকটা পথ হেঁটে এসেছি, বসে থাকতে পারছি না।
তুমি যদি ঐ উদ্ভট খেয়ালী লোকটাকে সংযত করতে না পার তাহলে বাকি রাস্তা ওকে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়েই কাটাতে হবে, হ্যারীর উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলে উগরোতে থাকে মেয়েটি। তেমনি গজরাতে গজরাতে সে নিচে ক্যারাভ্যানের দরজা দিয়ে ঢুকল। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করার শব্দ শুনল তারা দুজন।
হ্যারী এবং র্যান্ডি পরস্পরের দিকে তাকাল। তারপর চালকের আসনে গিয়ে বসল হ্যারী।
দেখলে একটু আগে আমি ভাগ্যের কথা বলছিলাম না? র্যান্ডি হাসতে হাসতে বলে, সকাল সাতটার মধ্যে মিয়ামিতে পৌঁছে যাব।
হয়তো তোমার কথাই ঠিক, কিংবা যে কারণেই তোক হাঁটার হাত থেকে বাঁচা গেছে। প্রত্যুত্তরে হ্যারী বলে, যাই বল মেয়েটার সাহস আছে। দীর্ঘ আঠার ঘণ্টা ধরে একা হাইওয়ের ওপর দিয়ে গাড়ী চালিয়ে এল, হিম্মত না থাকলে কি কেউ পারে! তারপর আমরা অনুরোধ করতেই গাড়ী থামাল সে, আমাদের গাড়ী চালাতে বলল, একটুও ভয় ডর বলে কিছু নেই যেন তার।
আমরা না হয়ে কোন গুণ্ডা বদমাস লোকেদের হাতে পড়লে তারা মেয়েটিকে দল বেঁধে ধর্ষণ করে ছাড়ত নিশ্চয়ই। তখন ইজ্জৎ বলে আর কিছু থাকত না তার।
ইজ্জৎ! হায় রিপ ভ্যান উইংকল! তাহলে বন্ধু তোমায় বলি, শোন।
র্যান্ডি উত্তরে বলে–মার্কিন মেয়েদের আবার ইজ্জৎ? ওরা তো চায় পুরুষরা ওদের জোর করে ধর্ষণ করুক। এখনকার দিনে ওদের এটা অবসর-বিনোদনের নবতম পথ। ওরা এখন পুরুষদের দিয়ে ধর্ষণ করানোর জন্য নিজেরাই পুরুষ ধরার ফাঁদ পেতে থাকে। ওদের এখন নিরাবরণ করতে মুহূর্তমাত্ৰ লাগে তাই এখন ওদের ইজ্জতের কোন প্রশ্ন আসে না। একটু থেমে র্যান্ডি আবার বলে, ঐ মেয়েটা হয়তো ক্যারাভ্যানে শুয়ে শুয়ে তোমার কথা ভাবছে। আর মনে মনে তোমার শ্রাদ্ধ করছে, পেয়েও সুযোগের সদ্ব্যবহার করলে না।
আশ্চর্য!
হ্যারী হাসে। তার হাসি দেখে মনে হল, এইমাত্র বুঝি সে মেয়েটিকে সত্যি সত্যি ধর্ষণ করে এল এবং সেই তৃপ্তির রেশটুকু তার মেজাজে রয়ে গেছে এখনো।
আচ্ছা দেখতে গ্লোভ কম্পার্টমেন্টটা খুলে কিছু কাগজপত্র খুঁজে পাওয়া যায় কিনা। হ্যারী তাকে অনুরোধ করে স্পীডোমিটারের দিকে তাকাল, স্পীডোমিটারে তখন ঘণ্টা পঞ্চাশ মাইল প্রদর্শন করছিল।
অনেক খোঁজাখুঁজির পর গ্লোভ কম্পার্টমেন্ট থেকে কিছু কাগজপত্র একটা প্ল্যাস্টিকের জ্যাকেটের ভেতর থেকে পাওয়া গেল। জ্যাকেট থেকে সেই কাগজপত্রগুলো বার করে র্যান্ডি পড়তে শুরু করল।
হার্জ কোম্পানি থেকে ভাড়া করা গাড়ী। ভোয়রা বীচে মিস্টার জোয়েল ব্লচকে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। বাড়ীর ঠিকানা হল ১২৪৪,স্প্রিংফিল্ড রোড, ক্লিভল্যান্ড। আগের মাইলেজ লগবুকে লেখা
আছে কিনা দেখছে।
হ্যাঁ ১.৫৫০ মাইল।
ড্যাসবোর্ডের মাইলেজ কাউন্টারের ওপর ঝুঁকে পড়ল হ্যারী। নিজের মনেই সে বেশ চিন্তিত ভাবে মাথা নাড়ল।
এর থেকে বোঝা যাচ্ছে গাড়ীটা ভাড়া করার পর মাত্র ২৪০ মাইল চলেছে অতএব মেয়েটির কথামত দীর্ঘ আঠার ঘণ্টা গাড়ী চালানোর কোন প্রসঙ্গই উঠতে পারে না।
র্যান্ডি অবাক হয়ে তার কথা যেন গিলতে থাকে।
তুমি কি সব সময়ই এ ভাবে কথা বলে থাক নাকি? তোমার কথাগুলো যেন গোয়েন্দা উপন্যাসের ঝানু গোয়েন্দাদের মত শোনাচ্ছে।
শোন, আরও আছে, হ্যারী বলতে থাকে, মেয়েটির নাম জোয়েল নয়, তার নাম যাই হোক না কেন, দীর্ঘ আঠার ঘণ্টা তার গাড়ী সে চালায়নি কখনো। মনে হয় গাড়ীটা সে নিশ্চয়ই চুরি করে থাকবে।
দেখ হ্যারী, র্যান্ডি তার সুচিন্তিত মতামত জানায়, সাতটার মধ্যে মিয়ামিতে আমাদের যাবার দরকার ছিল, গাড়ী পেয়েছি, সেখান থেকে অন্য কোন গাড়ী কিংবা বাসে চড়ে প্যারাডাইজ সিটিতে যাওয়া যাবে অনায়াসে। অতএব কে গাড়ী চুরি করল, কি না করল অতশত খবরে কি দরকার আমাদের।
চোরাই গাড়ী চালাচ্ছি, রাস্তায় পুলিশ যদি ধরে।
আরে অত চিন্তা করতে হবে না। মাঝরাতে হাইওয়ের উপর পুলিশ পেট্রল আর দেয় না। দেখ গিয়ে ওরা এখন নাকে তেল দিয়ে ঘুমুচ্ছে।
হ্যারী একটু ইতস্ততঃ করে হাল ছেড়ে দেয়। সত্যি তো তার অতশত চিন্তা কিসের। পুলিশের ভাবনা মেয়েটির। তাছাড়া র্যান্ডি যখন ঝুঁকি নিতে চাইছে তখন আর এ ব্যাপারে মাথা না ঘামালেই। চলবে। কথাটা ভাবা মাত্র স্টিয়ারিং-এর হুইলটা শক্ত করে চেপে ধরল সে। একটু পরেই গাড়ী পঁয়ষট্টি মাইল বেগে ছুটতে শুরু করল।
হ্যারীকে ঠাণ্ডা মাথায় গাড়ী চালাতে দেখে র্যান্ডি এর পর মারিয়ার দেওয়া প্যাকেট থেকে মুরগীর ঠ্যাং বার করে চিবুতে থাকে। হ্যারীর চোখে চোখ পড়তেই সে তাকে জিজ্ঞেস করল-”তুমি কিছু খাবে নাকি?
এখন নয়।
তাহলে আমি খাই, র্যান্ডি মুরগীর ঠ্যাং তারিয়ে তারিয়ে চিবোতে শুরু করল আবার। মারিয়ার মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। আচ্ছা হ্যারী ভিয়েতনামের মেয়েরা মাল হিসেবে কেমন বল তো?
তুমি তো আর ভিয়েতনামে যাচ্ছে না, হ্যারী বেজার মুখে বলে, তাহলে জেনে কি লাভ বল?
না মানে আমি জানতে চাইছি ওরা সহজেই পুরুষদের কাছে ধরা দেয়, নাকি ওদের পাবার জন্য পুরুষদের অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়?
বললাম তো তুমি তো আর ভিয়েতনামে যাচ্ছ না। হ্যারী বেজার মুখে তার আগের কথা পুনরাবৃত্তি করে বলে, তাহলে জেনে কি লাভ বল?
র্যান্ডি বুঝতে পারে, হ্যারী তার অশালীন কথাবার্তায় ক্ষুব্ধ।
ভিয়েতনামের মেয়েদের ওপর হ্যারীর দুর্বলতা আছে কিনা জানিনা। ভিয়েতনামের মেয়েদের নিয়ে ঠাট্টারসিকতা কেউ করলে তাকে সহ্য করতে পারে না সে।
হ্যারীর মনে পড়ে সায়গন ছেড়ে আসার আগে ভিয়েতনামের এক অতি গরীব একটি মেয়ের সঙ্গে ভাব হয়েছিল তার। বড় রাস্তার ধারে এলেই তার সঙ্গে দেখা হয়ে যেত হ্যারীর।
মেয়েটি রান্না করা খাবার বিক্রী করত।
তাকে দেখে হ্যারী ভীষণ আশ্চর্য হয়ে যেত। স্টোভ, রান্নার জিনিসপত্র সব কাঠে বাঁশের তুলিতে ঝুলিয়ে ব্যালান্স রেখে কি করে যে পথ চলত চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করত না। পিঙ্ক রক্তের ঝিমিয়ে-পড়া মেয়েটিকে দেখলে তার মনে হতো, একটা দুষ্টু প্রজাপতি যেন তার চারপাশে উড়ছে। কিন্তু পরে সে জেনেছে, কি দারুণ দৃঢ়চেতা এবং কঠোর প্রকৃতির মেয়ে সে।
সেই দীর্ঘ তিন বছর মেয়েটি তার মণিহার হয়েছিল। ভালবাসা দিয়ে মেয়েটি তার দেহ-মন আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। ভিয়েতনামের মেয়ে ভালবাসা জানে। ফ্রন্ট থেকে ফিরে হ্যারী মিচেল দেখত, মেয়েটি তার জন্য আয়োজন করছে।
এইভাবে তিন বছর ধরে মেকং উপত্যকার দুর্গম অরণ্যে ভয়ের সঙ্গে মৃত্যুর সঙ্গে দিনরাত পাঞ্জা লড়তে লড়তে হ্যারী আশার দোলায় দুলত,বুকভরা ভালবাসা নিয়ে তার জন্য প্রতীক্ষা করছে ভিয়েতনামের এক রমনী, যে রমনী বঞ্চনা জানে না এবং অবিশ্বাস যাকে স্পর্শ করা দূরে থাক তারে কাছেও ঘেঁষতে পারে না।
তারপর একদিন সায়গনে বোমা পড়ল। আচমকা বিমান আক্রমণ। স্তব্ধ হতভম্ব ভিয়েতনামীরা ঘটনার আকস্মিকতায় তারা তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। ভিয়েতনাম বিমানবাহিনীর চকিত আক্রমণে বোমার ঘায়ে টুকরো টুকরো হয়ে আরো অনেক মানুষের মত পৃথিবী থেকে মুছে গেল হ্যারী মিচেলের ভালবাসার মেয়ে। তারপর সে আর অন্য কোন মেয়ের সঙ্গে ভাব জমান দূরে থাক তাকাতে পর্যন্ত পারেনি। র্যান্ডি রোচ ভেবেছে কি? মার্কিন মুলুকে বসে ভিয়েতনামের দু একজন বেশ্যার ছবি দেখে সে কি ভেবেছে সেখানকার সমস্ত মেয়েরাই বেশ্যা? সব মেয়েদেরই জন্ম পুরুষদের বিছানায় বিবস্ত্র হওয়ার জন্যে? ভিয়েতনামের একজন মেয়ের সম্মানে যা তা বলা মানে হ্যারী মিচেলের ভালবাসাকে অপমান করা সে কথা র্যান্ডি বোঝে না।
একটা গাড়ীর হেড লাইটের আলো দেখতে পেল হ্যারী।
গাড়ীটা তখন প্রায় আধ মাইল দূরে ছিল। বোধহয় সেটা পুলিশের পেট্রল কার। কিন্তু হাইওয়ের ওপরে ষাট মাইলের বেশি স্পীড তোলা আইন-বিরুদ্ধ।
পিছনে গাড়ী! র্যান্ডি মৃদু চীৎকার করে বলে উঠল-হা দেখেছি, পুলিশের বলেই সন্দেহ হয়। হ্যারী নিচু গলায় তাকে তার অনুমানের কথাটা জানিয়ে দেয়।
কি বলছ তুমি। এই শীতে পুলিশ এখন বিছানায়, র্যান্ডি তখন নিজের কথার সমর্থনে বলে, এ রাস্তায় কখনো পুলিশের গাড়ী আমি দেখতে পাইনি।
তুমি কি সত্যিই তাহলে কিছু খাবে না? র্যান্ডি জিজ্ঞেস করল।
না, তবে একটু গরম কফি পেলে ভাল হত। ও জিনিসটা আমারও খুব দরকার। মিনিট পনের পরেই আমরা একটা রাত-ডোর স্ন্যাক্সবার পাচ্ছি, ভাল কফি তৈরী করে তারা। পাঁচ মিনিট থামবো সেখানে। হয়তো মেয়েটিও কফি পান করতে পারে।
কিন্তু মিয়ামি আসার আগে ওকে ঘুম থেকে না জাগাতে বলেছে ও। হ্যারী তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়, মনে আছে তোমার? আমার মনে হয় ঘুমন্ত রমনীকে না জাগানই ভাল বোধ হয়।
র্যান্ডি হাসল। হ্যারী, এই রকম একটা বাঘিনীর খুব প্রয়োজন। কিন্তু ওকে বাগে আনার সুযোগ আমার খুব কম। তবে তোমার তা আছে, তুমি হবে ডোমিনিকোর সাঁতারের মাস্টার।
সাঁতার শেখানোর ছলে দুটো কাজ তুমি করতে পারবে, সোলোর জলের নিচে ওর অর্ধনগ্ন শরীরটা নিয়ে যা খুশি করতে পারবে। আর সেই প্রেম প্রেম খেলার ছলে ওকে তুমি সুখের চরম মুহূর্তে সোলো ডোমিনিকোর জয়েন্টে ওর যোগদানের কথাটা পাকা করিয়ে নিতে পারবে। মেয়েটা তোমার দিকে যে ভাবে তাকাচ্ছিল তাতে মনে হয় সে তোমার প্রেমে পড়ে গেছে।
তুমি দেখছি এখনো ছেলে মানুষটি আছ। হ্যারী হাসতে হাসতে বলল।
আমার কথা তুমি এখন হেসে উড়িয়ে দিচ্ছ, পরে সোলোয় ঢুকলে তোমার মাথা ঘুরে যাবে। সোলোর সুন্দরী যুবতী মেয়ে নীনাকে তুমি তো এখনো দেখনি। তুমি তার সঙ্গে মিশতে যাচ্ছ। কথাটা ভেবেই আমার কেমন হিংসে হচ্ছে তোমার ওপর। কিন্তু সেই সঙ্গে তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি নীনার ওপর খুব বেশি লোভ করতে যেও না যেন।
এ ব্যাপারে ডোমিনিকোতে সোলোর সম্বন্ধে তোমাকে কিছু বলে রাখা ভাল। হয়তো নীনার বাবার কলঙ্কময় অতীত কাহিনী শুনলে তুমি সতর্ক হয়ে যেতে পার। র্যান্ডি একটু থেমে আবার বলতে শুরু করল, আজ থেকে প্রায় বছর কুড়ি আগে সোলো সিন্দুক লকারের তালা ভাঙ্গায় ওস্তাদ ছিল। এমন কোন সিন্দুক কিংবা লকার ছিল না যা সে খুলতে পারত না। শেষ পর্যন্ত পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যায় সে এবং বিচারে তার পনের বছরের জেল হয়ে যায়।
জেলে থাকাকালীন তার স্ত্রী নীনার জন্ম দিয়ে মারা যায়।
তারপর জেল থেকে বেরিয়ে এসে সে এবং তার সঙ্গীরা মনস্থ করে তারা আর অমন খারাপ ধান্দা নিয়ে মাথা ঘামাবে না এবং প্যারাডাইজ সিটিতে এই রেস্তোরাঁটা খুলে বসে সে।
এখন তার বয়স পঞ্চাশ হলেও দৈহিক শক্তিতে তার এতটুকু ঘাটতি হয়নি। তার ওপর ভাল বক্সিং জানে সে।
আজও নানা প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে আহ্বান পেয়ে থাকে সে।
কিন্তু ব্যবসা ছেড়ে সে কোথাও যেতে চায় না।
তাছাড়া মেয়ে নীনার দৌলতে তার হোটেল ব্যবসা এখন বেশ রমরমা।
তাই বলছি নীনার সঙ্গে এমন কিছু করো না যাতে তার ব্যবসার কোন ক্ষতি হয়, মেয়ের ক্ষতি হয়। একবার তিনটে মস্তান ছোকরা নীনার পিছনে লেগেছিল। সোলো সেটা টের পেয়ে শক্তি পরীক্ষায় নেমে পড়ে একা অনেকদিন পরে। শেষ পর্যন্ত তার ঘুষি এবং রদ্দা খেয়ে সেই তিনটে রোমিও মস্তান হাসপাতালে ভর্তি হয়।
তবে লোক হিসেবে খুবই উদার প্রকৃতির মানুষ এই সোলো। তার রেস্তোরাঁয় নীনাকে নিয়ে তুমি যতবার খুশি যখন খুশি ফুর্তি করতে পার, তবেনীনার পছন্দ মত। সে যতক্ষণ পর্যন্ত তোমাকে সহ্য করতে পারবে ততক্ষণ।
কিন্তু যে মুহূর্তে তুমি নীনার বিরক্তির কারণ হয়ে উঠবে তখন সোলো তোমাকে ছেড়ে কথা বলবেনা। তুমি আমার অনেক উপকার করেছ, তুমি যাতে কোন অসুবিধেয় না পড় তাই তোমাকে এই সতর্ক করে দেওয়া।
হ্যারী তার কথা শুনছে কিনা তা দেখার জন্য র্যান্ডি একটু থেমে বলল, কই তুমি তো একটা কথাও বললে না। অথচ এতক্ষণ আমিই কেবল বকবক করে গেলাম।
হ্যারীকে চুপ করে থাকতে দেখে নিজেই সে আবার বলতে থাকে, তবে যাই বল ভায়া নীনা মালটা দারুণ খুবসুরৎ, টাইট বুক, ভারী নিতম্ব।
তুমি নিজের চোখে পরখ করে দেখে বুঝতে পারবে আমি একটুও বাড়িয়ে কিংবা কমিয়ে বলছি না।
আমি যখন ওকে প্রথম দেখি কয়েক রাত আমার চোখে ঘুম ছিল না, ওর টাইট বুকের ওপর থেকে কখনও চোখ সরাতে পারতাম না আমি।
ওয়েটারদের দলপতি ম্যানুয়েল আমাকে সতর্ক করে দিয়ে বলে,নীনা এখানকার খদ্দেরদের জন্য, কাবোর ব্যক্তিগত লালসার খোরাক হতে পারবেনা সে। আমি নাকি বেশি বাড়াবাড়ি করলে সোলো আমাকে খতম করে দেবে।
হ্যারী এবার একটু অধৈর্য হয়ে উঠল এবং মুখ খুলল দ্যাখো র্যান্ডি আমি তোমার প্রশংসা না করে থাকতে পারছি না। তবে তোমাকে একটা কথা বলে রাখি আমার আচরণে রক্তে আজও ফৌজি শিক্ষার রেশ রয়ে গেছে। সেই ফৌজি শিক্ষায় আমরা জেনেছি, নিজের ঘরের দরজার সামনে নোংরা জিনিস ফেলা উচিত নয়।
অতএব এক্ষেত্রে সোলোর কাছে কাজ করব। আর তার মেয়ের, তার ব্যবসার সর্বনাশ আমি করব এ কথা আমি কখনও কল্পনাও করতে পারি না।
অতটা নিশ্চিত হয়ো না, র্যান্ডি মন্তব্য করে। মনে রেখ তুমি তাকে এখনও দেখনি।
একথা ঠিক যে আমি তাকে এখনও দেখিনি। তোমাকেও একটা কথা মনে রাখতে হবে র্যান্ডি তোমার থেকে বছর চারেকের বড় আমি এবং সেটা অনেক পার্থক্য এনে দেয়। আমার যা প্রয়োজন হয় তা আমি নিঝঞ্ঝাটে পেয়ে থাকি। আমি এখন এমন কোন মেয়ের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করব না যে আমাকে ঝামেলায় ফেলতে পারে। যাইহোক মেয়েটির কাজ কি মানে ওর ভূমিকা কি সেখানে?
অফিসের কাজ দেখাশোনা করা, রিজারভেসন, হিসাবপত্র দেখা।
সন্ধ্যায় বার এবং রেস্তোরাঁয় গিয়ে খদ্দেরদের মনোরঞ্জন করা। আর সোলোর কাজ হল বাজার এবং রান্না করা। শহরে এই রকম তিনটে রেস্তোরাঁ আছে, দারুণ প্রতিযোগিতা। সোলো অবশ্য তাতে ভয় পায় না। সে তার নিজের কাজ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সচেতন।
সামনে হলুদ আলোর অক্ষরগুলো হ্যারীর চোখের সামনে ভেসে উঠল।
স্যাক্স দিবা-রাত্র ভোলা থাকে।
তাহলে গাড়ীটা এখানে থামাই। হ্যারী আগেই গাড়ীর স্পীড কমিয়ে দিয়েছিল। রেস্তোরাঁর সামনে চারটে ট্রাক দাঁড়িয়েছিল। একটা ট্রাকের পিছনে মাস্তাং গাড়ীটা থামাল হ্যারী।
সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি গাড়ী থেকে নেমে পড় এবার–হ্যারী নিজে গাড়ী থেকে নামতে নামতে বলল, এবং র্যান্ডি তাকে অনুসরণ করল।
তারা একটা বিরাট হলঘরে গিয়ে প্রবেশ করল। চারজন ট্রাক ড্রাইভার বার বার র্যান্ডির দিকে তাকাচ্ছিল। তাদের চোখের ভাষা পড়ে হ্যারী বুঝতে পারে, র্যান্ডির মাথায় লম্বা লম্বা চুল দেখে তারা বিরক্ত। বোধ হয় হিপীদের একদম সহ্য করতে পারে না তারা।
বাড়তি ঝামেলায় না পড়তে হয় র্যান্ডিকে নিয়ে, হ্যারী সঙ্গে সঙ্গে অশুভ দিকটার কথাও চিন্তা করল। সেই অবস্থায় ওয়েটারকে দু’কাপ কফির ফরমাস করল সে।
কফির কাপে সবেমাত্র চুমুক দিয়েছে একটা গাড়ীর শব্দ শুনতে পেল হ্যারী। সামনেই একটা জানলা ছিল রাস্তার একেবারে ধারে। হ্যারী জানলা পথে মুখ বাড়িয়ে দেখল একটা সাদা রঙের মার্সিজ এস ১৮০ তাদের মাস্তাং গাড়ীর পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল।
গাড়ীটা সামান্য কয়েক মুহূর্ত থেমেই আবার চলতে শুরু করে দেয়। হ্যারী ভাল করে দেখবার চেষ্টা করল মার্সিডিজের আরোহীদের।
কিন্তু একমাত্র চালকের মুখ ছাড়া অন্ধকারে অন্য কারোর মুখ তার চোখে পড়ল না। তাও চালকের পুরো মুখটা দেখবার উপায় ছিল না কারণ তার মাথার টুপিটা কপালের অনেকটা নিচে ঝোলানো ছিল।
মিনিট পাঁচেক পরে তারা আবার মাস্তাং গাড়ীতে ফিরে এল। এবার র্যান্ডি চালকের আসনে বসল। হ্যারী ঘুমোতে চায়।
হ্যারী তখনও অবাক হয়ে ভাবছিল মাস্তাং গাড়ীর সেই মহিলা চালকের কথা, গ্লোভ কম্পার্টমেন্ট খুলে সে এবার নিজে কাগজপত্রগুলো পরীক্ষা করতে ব্যস্ত হল।
হার্জ কোম্পানি থেকে ভাড়া করা গাড়ী। ক্লীভল্যান্ডের জোয়েল ব্ল্যাচকে গাড়ীটা ভাড়া দেওয়া হয়েছে দুদিন আগে। লগবুক থেকে আবার সে মাইলেজ পরীক্ষা করে দেখল-২৪০ মাইল মাত্র। অথচ মেয়েটি তাকে বলেছে সে নাকি আঠার ঘণ্টা ধরে গাড়ী চালিয়ে এসেছে। এটা একটা নিছক মিথ্যে কথা, হ্যারী ভাবল। কিন্তু একটা কথা তাকে বারবার ভাবিয়ে তুলছিল। মেয়েটি কেন তাকে গাড়ী চালাতে বলল? তবে কি নিজেকে তার আড়ালে রাখার মধ্যে অন্য কোন উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে? গাড়ীটা কি চুরি করে আনা? আর তাই যদি হয় যে কোন সময় পুলিশের হাতে তারা ধরা পড়লে মেয়েটিও রেহাই পাবে না নিশ্চয়ই। হ্যারী আবার এ কথাও ভাবল, মেয়েটির এমন দুঃসাহসের কারণইবা কি থাকতে পারে।
এই মুহূর্তে হ্যারীকে খুব চিন্তিত বলে মনে হচ্ছিল। তার দিকে তাকিয়ে র্যান্ডি রসিকতা করল। তুমি কি এখনও মারলোর অভিনয় করছ।
গ্লোভ কম্পার্টমেন্টে কাগজপত্র গুলো রাখতে গিয়ে হ্যারী বলে ঐ ঘুমন্ত মেয়েটা আমাকে এখন যে ধাঁধায় ফেলেছে, তাতে আর যাই কিছু মনে হোক না কেন অভিনয়ের কথা মনে করা বাতুলতা।
বেশ তো এত সব চিন্তা ভাবনা না করে মেয়েটি ঘুম থেকে জেগে উঠলে তার কাছ থেকেই তো প্রকৃত ঘটনাটা জেনে নিতে পার।
র্যান্ডি কথাটা শেষ করে সামনের রাস্তাটা ভাল করে তাকিয়ে দেখে নিল একবার। ঠিক আছে তাই হবে।
এই বলে মারিয়ার দেওয়া প্যাকেট খুলে মুরগীর ঠ্যাং ডাফনাট আর রেস্তোরাঁ থেকে আনা কফি খেতে তৎপর হল হ্যারী। একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়ল সে।
এইবার হ্যারী উঠে পড়।
র্যান্ডির চিৎকারে হ্যারীর ঘুম ভেঙে যায়, প্রকাণ্ড একটা হাই তুলে চোখ মেলে তাকায় সে। তখন পূর্বদিকের ধূসর আকাশের একটু একটু রঙ বদলাচ্ছে লাল হলুদ খয়েরী। রাস্তার দুপাশে পাম গাছের সারি, ওদিকে মাস্তাং ছুটে চলেছে আপন গতিতে।
এইমাত্র আমরা ফোর্ট লডারডেলে ঢুকে পড়েছি। র্যান্ডি তাকে বলে আর মিনিট কুড়ি পরেই আমরা মিয়ামিতে পৌঁছে যাব।
সামনের ঐ কাফেটার কাছে গাড়ি থামাও। তারপর সেখানে মেয়েটিকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে জেনে নিতে হবে মিয়ামির ঠিক কোন জায়গায় ও আমাদের ছেড়ে যেতে চায়।
হাইওয়ে সংলগ্ন কাফে। কাঠের বাড়ি। সামনে নিয়ন আলোর নিচে সাইনবোর্ডটা জ্বলজ্বল করছিল।
র্যান্ডি গাড়িটা থামাতেই হ্যারী চকিতে একবার তার কব্জির ঘড়ির ওপর চোখ বুলিয়ে নিল, পাঁচটা পনের।
গাড়ি থেকে নেমে হ্যারী বলে–আমি কফির দুটো কার্টন আনছি আর তুমি ততক্ষণে মেয়েটিকে জাগাবার ব্যবস্থা কর।
র্যান্ডি বোকার মত হাসল। এ একরকম ভালই হল, তুমি আমাকে সুযোগ করে দিয়ে গেলে কি বল? এখন বুঝছি, সত্যি সত্যি মেয়েদের প্রতি তোমার তেমন কোন আকর্ষণ নেই।
ওঃ চুপ কর।
হ্যারী ধমকে উঠল।
র্যান্ডির ভুল রসিকতায় তার এখন কোন সায় নেই। দ্রুত পা চালিয়ে কাফের দিকে এগিয়ে গেল সে।
কাউন্টারে একজন নিগ্রো ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখে টলছিল। অলস ভঙ্গিতে হ্যারীর দিকে তাকাল সে।
খুব কড়া দু কার্টন কফি। ব্ল্যাক, তবে চিনি বেশি থাকবে।
ডাফনাট চাই না? নিগ্রো যুবকটি জিজ্ঞেস করল।
হ্যারীর নিজের কোন প্রয়োজন ছিল না। তবে মেয়েটির কথা ভেবে সে বললচারটে দাও।
কফির এবং ডাফনাটের দাম দিতে হ্যারী যখন ব্যস্ত ঠিক সেই সময় মাস্তাং থেকে জোরে জোরে হর্নের শব্দ ভেসে এল।
হ্যারী চমকে কফির কার্টন দুটো এবং ডাফনাটের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে কাফে থেকে বেরিয়ে এল।
চালকের আসনে বসেছিল র্যান্ডি। হ্যারীকে আসতে দেখে দ্রুত হাত নেড়ে আহ্বান জানাল সে।
কাছে এসে র্যান্ডির মুখ দেখেই হ্যারী অনুমান করে নিয়েছিল, একটা অশুভ ঘটনা কিছু ঘটেছে নিশ্চয়। কিন্তু কোন প্রশ্ন করল না সে।
গাড়ির দরজা খুলে যাত্রী আসনে উঠে বসে দরজা বন্ধ করে দেয় সে।
হ্যারী উঠে বসতেই মাস্তাং ঝড়ের মত ছুটে চলল হাইওয়ের উপর দিয়ে। প্রকৃতপক্ষে গ্যাস প্যাভেলের ওপর দাঁড়িয়েই ছিল র্যান্ডি হ্যারীর অপেক্ষায়।
গাড়ির স্পীড ক্রমশঃ বাড়াতে থাকে র্যান্ডি। হ্যারী অবাক হয়ে বলে কি করছ তুমি? স্পীড কমাও বলছি, তুমি কি জান না, এটা রেসের মাঠ নয়। স্পীড কমাও, কি হল তোমার বলবে তো?
র্যান্ডি তার কাঁপা কাঁপা হাতে কপালের ঘাম মুছল। হ্যারীর কথায় এতক্ষণে একটু ধাতস্থ হল। গাড়ির স্পীড পয়ষট্টিতে নামিয়ে আনল।
জান হ্যারী মেয়েটি মৃত, খবরটা দিতে গিয়ে তার গলা কেঁপে ওঠে।
সেকি!
তরে আর বলছি কি?
র্যান্ডি সংক্ষেপে মেয়েটির মৃত্যুর বিবরণ দেয়। ক্যারাভ্যানের দরজা ঠেলতে প্রথমে কোন সাড়া শব্দ না পেতে নব ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকি। মেয়েটির সারা দেহ কম্বলে ঢাকা, কেবল একটি হাত ঝুলতে দেখি। ঝুলন্ত শক্ত হাত, কম্বলের ওপরে চাপ চাপ রক্ত।
হ্যারী যেন আচমকা ধাক্কা খেল। র্যাক্তির মুখ দেখেই অনুমান করছিল যে, একটা কিছু অঘটন ঘটেছে। কিন্তু এত খারাপ খবর তাকে যে শুনতে হবে ভাবতেই পারেনি সে।
কিন্তু তুমি এখন কোথায় চলেছ? গলার স্বর যতটা সম্ভব সংযত করে সে বলে, গাড়ি থামাও আমি নিজের চোখে দেখতে চাই।
হাইওয়ের উপর গাড়ি আমরা থামাতে পারি না। র্যান্ডি একটু রুক্ষসুরেই বলে, পুলিশ টহল শুরু হয়ে গেছে।
মেয়েটির মৃতদেহ নিয়ে আমি তাদের হাতে ধরা পড়তে চাই না। এ অবস্থায় তারা আমাদের দেখলে সন্দেহ করবে আমরা ওকে খুন করেছি।
হ্যারীর চোয়াল দুটো শক্ত হল। পুলিশের ব্যাপারটা আদৌ তার খেয়াল হয়নি। সত্যি তো পুলিশ তাদের গাড়ি থামিয়ে যদি দেখতে চায়।
র্যান্ডি তুমি ঠিক দেখেছ মেয়েটা সত্যিই কেঁশে গেছে?
হ্যাঁ আমি ঠিকই বলছি। প্রথমে আমি দরজায় নক করি, কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে শেষে
দরজার হাতল ঘোরালাম, দরজা খুলে গেল।
নীচের বার্থে সেই মেয়েটা, আমি ঠিক দেখেছি এ ব্যাপারে আমার কোন ভুল হতে পারে না। মাথা অবধি কম্বলে ঢাকা। আমি তাকে কয়েকবার ডাকলাম। তারপর নিঃসন্দেহ হতে ওর সেই ঝুলন্ত হাতটা স্পর্শ করলাম।
তারপর সে সব কথা তো তোমাকে একটু আগেই বলেছি। ভয়ে, উত্তেজনায় আমার তখন দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা, কোন রকমে ক্যারাভ্যানের দরজা বন্ধ করে এখানে ফিরে আসি।
র্যান্ডির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে হ্যারী উইন্ডস্কীনের ওপর দৃষ্টি ফেলতেই তার চোখে পড়ল অদূরে একটা সাইন পোস্ট। সেখানে লেখা আছে, বীচ-এখানে সাঁতার কাটা নিরাপদ।
হাইওয়ে ছেড়ে সী বীচের দিকে গাড়ি ঘোরাও। ছোট আয়নায় চোখ রেখে কয়েকবার দেখে। নেয় হ্যারী। নির্জন হাইওয়েকে এখন মরুভূমির সঙ্গে তুলনা করা যায় অনায়াসে।
গাড়ির স্পীড কমিয়ে হাইওয়ে থেকে নেমে এল ধীরে ধীরে গাড়িটা।
সে সী বীচের দিকে আরও আধ মাইল পথ চালিয়ে নিয়ে এল নিঃশব্দে, সামনেই সনালী বালুচর। সেখান থেকে সমুদ্র মাত্র দুশো গজ হবে, হয়তো।
গাড়ি থেকে নামা যাক এখানে। হ্যারী বলে, ক্যারাভ্যান বলে দেবে আমরা এখানে কি করছি। যে কেউ আমাদের এখানে এ অবস্থায় দেখলে ধরে নেবে রাতটা আমরা এখানেই কাটিয়েছি।
গাড়ি থেকে নেমে র্যাভির দিকে ফিরে সে বলে, চল ক্যারাভ্যানের ভিতরটা দেখে আসি।
র্যান্ডি মুখটা বিকৃত করে এমন ভাব দেখায় যে তার যেন বমি আসছে। মাথা নেড়ে অসম্মতি জানায় সে।
ঠিক আছে, তুমি এখানে থাক। আমি একাই দেখে আসছি।
শিশির ভেজা নরম বালির উপর দিয়ে হেঁটে চলে হ্যারী ক্যারাভ্যানের দরজার দিকে। একবার সে আকাশের দিকে তাকাল, ধূসর রঙটা অনেক আগেই উধাও হয়ে গেছে সেখান থেকে, হলুদ এবং লাল রঙটা একটু একটু করে ফিকে হয়ে যাচ্ছে আকাশের বুক থেকে, সে জায়গায় নীল রঙের প্রলেপ পড়েছে, আকাশের একের পূর্বপ্রান্তে লাল সূর্যের পূর্বাভাস।
পকেট থেকে রুমাল বার করে ক্যারাভ্যানের দরজার হাতলে জড়িয়ে ঘোরাল হ্যারী। দরজাটা খুলে যেতেই মৃত মানুষের একটা ভ্যাপসা গন্ধ তার নাকে লাগল। ভিয়েতনামের যুদ্ধক্ষেত্র ফেরৎ সে, এ ধরনের গন্ধের সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত। তাই র্যান্ডির মত নাক সিঁটকাল না সে।
ক্যারাভ্যানের ভেতরে প্রবেশ করেই সে দেখতে পেল লাশটা মাথা থেকে পা পর্যন্ত কম্বল জড়ান। কম্বলটা একবার তুলেই সঙ্গে সঙ্গে আবার চাপা দিয়ে দিল সে।
আরে এ যে দেখছি একটি পুরুষের মুখ।
বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। বাদামী রঙের চুল। পাতলা রোগাটে চেহারা। রোদে পোড়া মুখ।
ধূসর রঙের বিস্ফারিত চোখ হ্যারীর দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হয় মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত নিহত ব্যক্তি ভয়ার্ত চোখে তার ঘাতকের দিকে তাকিয়ে ছিল।কম্বলের।মৃতের মুখের ডানপাশে কালসিটে দাগ, খোলা মুখের ধারাল হলদে দাঁতের ফাঁক থেকেও রক্ত পড়েছে। এমন ভাবে রক্ত জমাট বেঁধেছে যে লোকটাকে একটা হিংস্র জানোয়ারের মত দেখাচ্ছে।
হ্যারী দ্রুত একবার ক্যারাভ্যানের ভিতরটা তাকিয়ে দেখে নিল। মৃত দেহটা ছাড়া অন্য কোন জীবিত কিংবা মৃতের চিহ্ন কোথাও নেই।
ইতিমধ্যে র্যান্ডিক্যারাভ্যানের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিল দূরত্ব বজায় রেখে নাকে রুমাল দিয়ে।
কি দেখলে মেয়েটি মূতা তো? কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল র্যান্ডি।
ক্যারাভ্যানের ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে একটা সিগারেট ধরাল হ্যারী। তারপর একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে সে বলে–মেয়েটি পালিয়েছে। মৃতদেহ একটি পুরুষ মানুষের।
র্যান্ডি আঁতকে উঠল। তার বমি পেল আবার। হ্যারী এগিয়ে গেল মাস্তাং-এর দিকে। কার্টন থেকে কফি ঢালল মুখে অনেকটা।
গাড়ির দেওয়ালে ঠেস দিয়ে ভাবছে সে এখন। আঠার ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে আসছে মেয়েটা, অথচ লগবুকে তার কোন প্রমাণ নেই।
এই মিথ্যেটা যে মুহূর্তে তার কাছে ধরা পড়ে যায় তখন থেকেই সে আন্দাজ করে নিয়েছিল, মেয়েটা খুব সহজ নয়। তবে তখন থেকে তার আরো একটু সতর্ক হওয়া উচিত ছিল।
ভিজে নরম বালির ওপরে মাথায় হাত দিয়ে বসেছিল র্যান্ডি। কাছে গিয়ে হ্যারী জিজ্ঞেস করল আমি ঘুমবার পর গাড়ি তুমি কোথাও থামিয়েছিলে?
র্যান্ডি চোখ তুলে তাকাল।
না। সারাক্ষণ আমি গাড়ি চালিয়ে এসেছি। কেন মেয়েটি কি পালিয়েছে?
হ্যারী তার পাশে বসে বলে, হ্যাঁ সে পালিয়েছে। লোকটা মনে হয় আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে খুন হয়ে থাকবে কিংবা তার আগেও হতে পারে।
আমি বাজী ধরে বলতে পারি মেয়েটি যখন আমাদের লিফট দিতে এগিয়ে আসে তখন মৃতদেহটা ক্যারাভ্যানের ভিতরে অবশ্যই ছিল। তারপর আমরা যখন কাফেতে বসে কফি খাচ্ছিলাম তখন মেয়েটি নিশ্চয়ই কেটে পড়ে থাকবে। সেই সাদা মার্সিডিজ গাড়ির কথা মনে পড়ে গেল হ্যারীর।
মনে আছে তোমার, একটা মার্সিডিজ গাড়ি ঘন্টাখানেক ধরে আমাদের গাড়িটাকে অনুসরণ করে আসছিল। তারপর সেই গাড়িটা কাফের সামনে আমাদের মাস্তাং গাড়ির পিছনে এসে থেমেও ছিল। আমরা কোথাও না কোথাও থামব এটা অনুমান করে নিয়েই মার্সিডিজ গাড়িটা আমাদের অনুসরণ করছিল। তারপর আমরা যখন কাফেতে কফির কার্টনে চুমুক দিতে ব্যস্ত মেয়েটা তখন ক্যারাভ্যান থেকে বেরিয়ে সেই মার্সিডিজে উঠে বসে থাকবে। আমরা টের পাইনি। এই ভাবেই সে আমাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে থাকবে।
এখানে একটু থেমে সমুদ্রের দিকে তাকাল হ্যারী। তার চোখে ভ্রুকুটি। আবার সে মুখ খুলল মনে হয় মৃত লোকটি জোয়েল এবং এই লোকটিই আসলে হার্জ কোম্পানির কাছ থেকে গাড়িটা ভাড়া নিয়ে আসছিল।
সহসা উঠে দাঁড়ায় র্যান্ডি, তার চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপটা স্পষ্ট।
চল এখান থেকে পালিয়ে যাই।
হ্যারী স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
বস! হ্যারীর কণ্ঠস্বরে কি ছিল কে জানে!
র্যান্ডি তার আদেশ অমান্য করতে পারল না, সে সাহস একটু আগে হারিয়ে ফেলেছে বুঝি।
হ্যারী তাকে পাশে বসিয়ে বোঝাতে থাকে অতঃপর।
শোন র্যান্ডি, তোমার কথামত ধর আমরা যদি এই গাড়িটা এখানে ফেলে রেখে পালিয়ে যাই তবুও আমাদের রেহাই নেই। আমাদের মাস্তাং গাড়ি চালিয়ে যেতে অনেকেই দেখেছে। কেউ না কেউ আমাদের মুখ আর চেহারার আদল বাতলে দেবে পুলিশের জেরার মুখে পড়ে। তখন পুলিশ কি ভাববে ভেবে দেখেছ?
তারা ভাববে, ঐ মৃতলোকটা আমাদের লিফট দিয়েছিল। তারপর আমরা সেই সুযোগ নিয়ে তার গাড়ি এবং টাকা পয়সা লুঠ করে তাকে খুন করে থাকব। এক্ষেত্রে সবাই ঠিক এমনটিই ভেবে থাকে এবং মেয়েটিও ভেবে থাকবে আমাদের সম্বন্ধে পুলিশ ঠিক এই রকম একটা কিছু ভাবুক।
একটু থেমে হ্যারী আবার বলতে থাকে–গলস্ পরা মেয়েটির চোখ আমরা দেখতে পাইনি। ও আমাদের খুব ঠকিয়েছে। এসবই তার পূর্ব পরিকল্পিত। এই লোকটাকে খতম করে ক্যারাভ্যানে ডেডবডি নিয়ে হাইওয়েতে বেরিয়েছিল মেয়েটি, যে কোন হিপী হিপিনীদের ঘাড়ে গাড়ি মৃতদেহ ক্যারাভ্যান সব চাপিয়ে দেবার জন্য।
তাহলে এখন আমাদের কি করতে হবে? র্যান্ডি জানতে চাইল।
এই মৃতলোকটার সম্বন্ধে আমি আরো কিছু জানতে চাই।
একটা সিগারেট ধরিয়ে ক্যারভ্যানের দিকে এগিয়ে গেল সে। তারপর দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে কম্বলটা সরিয়ে দিল মৃত দেহের উপর থেকে। মৃতদেহটা খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে হ্যারী।
মৃতদেহের বাঁ-পা নগ্ন। পায়ের তলার মাংস আগুনে ঝলসান হয়েছে বলে মনে হয়। হ্যারী তাড়াতাড়ি ঝুঁকে পড়ল মৃতদেহের উপরে। লোকটার প্যান্টের পকেট হাতড়াল সে, না সেখান থেকে কিছুই পেল না।
এমনকি তার পোষাকের ভেতর থেকে দর্জির দোকানের লেবেলটাও ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে।
এ কাজ উদ্দেশ্য প্রণোদিত নিশ্চয়ই।
লোকটার সারা দেহে ঐ পায়ের ক্ষত ছাড়া অন্য কোথাও আঘাতের কোন চিহ্ন তেমন নেই। এসব দেখেশুনে মনে হয় মৃত্যুর আগে বিশেষ কোন খবরা-খবর আদায় করার জন্য লোকটার পাটা আগুনে পোড়ান হয়েছিল এবং লোকটার মৃত্যুর কারণ হয়তো যন্ত্রণায় কাতর হয়ে হার্টফেল করা। তারপর যারা ঐ লোকটাকে কথা আদায় করে নেবার ধান্দায় কিডন্যাপ করে নিয়ে যায় মানে কোন অপরাধী চক্র তারা তাকে মৃত দেখে হয়তো ভয় পেয়ে গিয়ে থাকবে এবং মতলব আঁটল কোন হিপী হিচহাইকারকে গাড়িতে তুলে তার ঘাড়ে এই খুনের মামলাটা চাপিয়ে দেবে।
এমনিতেই এখনকার যা পরিস্থিতি, পুলিশ হিপীদের সুনজরে দেখতে পারে না।
র্যান্ডি তার শুকনো ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে তার মানে, মেয়েটা আমাকে দেখে হিপী ঠাওরেছিল?
ইয়া, তোমাকে সে হিপী বলে ধরে নিয়েছিল।
তাহলে এখন উপায়?
একটা উপায় আমি ঠিক করেছি। হ্যারী তার মতলবের কথা বলে।
প্রথমে আমরা এখানে বালি খুড়ে লাসটাকে কবর দেব। তারপর খানিক দূরে গিয়ে ক্যারাভ্যানটা খুলে রাস্তার ধারে ফেলে রেখে আরো খানিক দূরে গিয়ে মাস্তাং গাড়িটা রাস্তার ধারে পার্ক করে পালাব।
এস, র্যান্ডি, দুজনে মিলে বালি খুড়ে গর্ত করা যাক।
গর্ত খোঁড়ার পর হ্যারী তাকে আহ্বান জানায়, এস র্যান্ডি এবার লাসটা ক্যারাভ্যান থেকে এনে এই গর্তে ফেলা যাক।
আমাকে মাফ কর। র্যান্ডি নাক সিঁটকে বলে, ওটা ছুঁলে আমার বমি বেরিয়ে আসবে।
হ্যারী ঘড়ির দিকে তাকাল ছটা বেজে পাঁচ। তাড়াতাড়ি কাজটা সারতে হবে হাইওয়ের ওপর লোক চলাচল শুরু হওয়ার আগেই। তাই সে নিজে একা মৃত দেহটা বহন করে আনবার জন্য
ক্যারাভ্যানের দিকে এগিয়ে গেল। র্যান্ডি চোখ বন্ধ করল ঘৃণায়।
হ্যারীরও যে ঘৃণা হচ্ছিল না, তা নয়। নাক-মুখ সিঁটকে লাসটা তুলতে যায় হ্যারী, হঠাৎ সে স্তব্ধ হয়ে থমকে দাঁড়ায়। আশ্চর্য! লোকটার মাথার চুল সমেত খুলির চামড়াটা তার হাতে উঠে এল।
না, চুল নয়। মাথার খুলির চামড়াও নয়। ওটা একটা পরচুলা।
পরচুলার নিচে লোকটার মাথা জোড়া টাক। পরচুলাটা এক হাতে তুলে ধরে হ্যারী। হঠাৎ একটা জায়গায় তার দৃষ্টি স্থির নিবদ্ধ হয়। সে দেখে পরচুলার ভিতরে অ্যাডহেসিভ প্লাস্টার দিয়ে আটকান একটা ইস্পাতের চাবির ওপরে এমবস করা আছে কয়েকটা অক্ষরে, প্যারাডাইজ সিটি এয়ারপোর্ট। লকার ৩৮৮।
তার চোখ দুটো ছোট হল। তাহলে কি এই চাবিটাই খুঁজছিল লোকটার আততায়ী? আর এইজন্যেই কি তার ওপর অমন নৃশংস অত্যাচার হয়?
পরচুলাটা কবরের মধ্যে ফেলে দিয়ে চাবিটা সে তার পকেটে চালান করে দেয় র্যান্ডির অজান্তে।
এস র্যান্ডি ব্যস্ত হয়ে বলে সে, ওকে এবার কবর দেওয়া যাক।
.
০৩.
ডোমিনিকো রেস্তোরাঁ সমুদ্রের একটা গাড়ির ধারে। পাম, সাইপ্রেস এবং স্পাইডার অর্কিডের ছায়ার নিচে সেই রেস্তোরাঁ। বীচের উপরে বার। বড় রঙ বেরঙের ছাতার নিচে রবারের ম্যাট্রেস পাতা। দুটো ছাতার মধ্যে ব্যবধান যথেষ্ট। একান্তে নির্জনে বসে কপোত-কপোতীদের বকবকম করার সুযোগ করে দেওয়া এই আর কি।
ভিজে বালির ওপর দিয়ে আসতে গিয়ে দূর থেকে ডোমিনিকো রেস্তোরাঁর চাকচিক্য দেখে একটু অবাক না হয়ে পারে না হ্যারী।
র্যান্ডি গর্ব ভরে তার দিকে তাকায়, ঐ যে ঐ রেস্তোরাঁর কথাই তোমাকে আমি বলেছিলাম। রেস্তোরাঁর ধারে কাছে একটা খদ্দেরও চোখে পড়ছেনা। তবে সপ্তাহ খানেক পরেই টুরিস্ট সিজন শুরু হচ্ছে তখন হয়তো বসবার জায়গাও পাওয়া যাবে না।
রেস্তোরাঁ বিল্ডিং-এর গাড়ী বারান্দার নিচে গিয়ে দাঁড়াল তারা। সবেমাত্র তারা দুজনে এ ওকে শেষবারের মত দেখে নিচ্ছে, চোখের ভাষায় এ ওর কাজের আদান প্রদান শিখে নিচ্ছে। ঠিক সেই সময়ে দৈত্যের মত চেহারার একজন মস্তান তাদের কাছে এগিয়ে এসে হৈ চৈ শুরু করে দিল।
হাই র্যান্ডি! শেষ পর্যন্ত তুমি পৌঁছে গেলে? একটা রোমশ হাত র্যান্ডির হাত জড়িয়ে ধরে খুশির আতিশয্যে।
হ্যারীআন্দাজ করল এই লোকটাই সোলো ডোমিনিকো হবে নিশ্চয়ই, ডোমিনিকো রেস্তোরাঁর মালিক। দেখতে গরিলার মত ছ’ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা, কাঠামোয় তার শক্ত মাংসপেশী গুলো ফুলে ফুলে উঠেছে।
পুরু কালো গোঁফ নিচের দিকে বাঁকান। দেখলে মনে হবে শকুনের চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে সে যেন। খুশিতে উপচে পড়ে ডোমিনিকো।
একা আসিনি, ফোনে কথামত একজন সঙ্গীও এনেছি। তারপর সে হ্যারীর দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে, এস সোলো পরিচয় করিয়ে দিই, হ্যারী মিচেল এক্স-টপ সার্জেন্ট প্যারাট্রুপার–তিন বছর ভিয়েতনামের যুদ্ধে ছিল। অলিম্পিকে খ্যাত সাঁতারু। ওর কথা তো তোমাকে ফোনেই বলেছি। চাকরীর খোঁজে ঘুরছে।
ডোমিনিকো এবার হ্যারীর দিকে ফিরে সরাসরি তাকায় আর বলে ভিয়েতনাম ফেরত? আমার ছেলেও ভিয়েতনামে আছে স্যাম ডোমিনিকো থার্ড কোম্পানি মেরিনস্ চেনো তাকে?
না, তবে থার্ড কোম্পানির নাম শুনেছি।
কেন পারাট্রুপাররা কম কিসের? ডোমিনিকো হাত বাড়ায় হ্যারীর দিকে কাজ চাও? তা তুমি সাঁতার জান?
হ্যারী করমর্দন করে। হাতটা তার ঝনঝন করে ওঠে। উঃ কি শক্ত হাতের মুঠি। আঙুলগুলো ভেঙে যাবার উপক্রম হয়েছিল। জোর করে ছিনিয়ে না নিলে বোধহয় আঙুলগুলো অবশ হয়ে যেত।
সাঁতার! তোমাকে ফোনে তো বললাম অভিজ্ঞ সাঁতারু ও অলিম্পিক ফেরত। গাদা গাদা সোনার মেডেল পেয়েছে।
আমি তোমার সঙ্গে কথা বলছি না, ডোমিনিকো তখন হ্যারীর দিকে তাকিয়েছিল। দেহরক্ষীর কাজ পেলে হবে? সপ্তাহে তিরিশ ডলার। চাকরীটা পছন্দ?
যাতে করে বুক ভরে আলো বাতাস নিতে পারি মোটামুটি সেরকম একটা সংস্থান হলে আমার কাজের পছন্দ অপছন্দের কি এসে যায় বলুন?
কয়েক মুহূর্ত ভোমিনিকো তাকে খুব ভাল করে খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল তারপর হাসল।
তাহলে এখন থেকে তোমাকে ভাড়া করা হল। আমাকে এখুনি একটু বাজারে যেতে হচ্ছে। র্যান্ডির দিকে ফিরে সে বলে, তুমি তোমার পুরনো কেবিনে থাকবে। পাশের ঘরটায় হ্যারী থাকতে পারে। ওকে ঘরটা দেখিয়ে দাও। আসছে সপ্তাহ থেকে টুরিস্ট সীজন”শুরু হচ্ছে। হ্যারী একদিন তুমি বিশ্রাম নাও, পরের সপ্তাহ থেকে কাজে লেগে পড় কেমন? চলে যেতে গিয়ে ফিরে দাঁড়াল সোলো ডোমিনিকো।
আচ্ছা হ্যারী তুমি বক্সিং জান?
বডিগার্ডের চাকরী করতে যাচ্ছি। একটু-আধটু জানি বৈকি।
সোলোর ঠোঁটে রহস্যময় হাসি। হ্যারীকে বেকায়দায় ফেলে পরখ করতে চায় সে, কিন্তু হ্যারী ভিয়েতনাম যুদ্ধ ফেরত। শত্রুপক্ষের অতর্কিত আক্রমণের মোকাবিলা করতে ওস্তাদ সে। সোলোর ডান হাতের বিদ্যুৎগতির পাঞ্চটা তার বুকে এসে লাগার আগেই সাঁ করে সরে গিয়ে সোলোর বুকের উপরে আলতো করে ঘুষি মারে হ্যারী।
ডোমিনিকো চোখ মিটমিট করে তাকায়। তার চোখে অনেক জিজ্ঞাসা। এক সময় মনে হয় উত্তর সে পেয়ে গেছে বোধ হয়। তার মুখে হাসি ফুটে উঠতে দেখা গেল।
তারা পরস্পরের দিকে তাকাল।
স্মার্ট বয় দেখছি। ঘুষি খাও না। কিন্তু ঘুষি মারতে ওস্তাদ, তাইনা।
তারপর আচম্বিতে আর একটা ঘুষি হ্যারীর মাথায় এসে পড়ার আগেই সে ঠিক সময়ে মাথা সরিয়ে নেয়। পাঞ্চটা তার কান ঘেঁষে বেরিয়ে যায়।
তার বদলে পাল্টা ঘুষি মারে হ্যারী আলতো ভাবে সোলোর বুকে, ভোমিনিকো আবার অবাক চোখে তাকাল তার দিকে।
খুব স্মার্ট বয় দেখছি। ঠিক তোমার মত একটি ছেলেকেই খুঁজছিলাম। অপূর্ব পাঞ্চ। তুমি আমার বন্ধু হবার পক্ষে উপযুক্ত হ্যারী।
মিঃ ডোমিনিকো আমি আপনার কাছে চাকরী প্রার্থী। আমি আপনাকে আঘাত করতে আসিনি। কিন্তু কেউ আমাকে ঘুষি মারতে উদ্যত হলে তার পাঞ্চটা ফিরিয়ে দেবার জন্য হাত উসখুস করে। তার জন্য আমি দুঃখিত মিঃ ডোমিনেকে।
ডোমিনিকো বড় বড় চোখ করে তাকাল। তা তুমি অত চিন্তিত হচ্ছ কেন? হ্যারী এ ধরনের পাঞ্চ আমি ভালবাসি।
তাই নাকি? হ্যারী এবার একটু গম্ভীর হয়ে বলে, আমি তোমার বন্ধুত্ব লাভে দারুন আগ্রহী। তবে তুমি তোমার পাঞ্চ আর ব্যবহার করো না যেন।
আমার শরীরটা কেমন আনচান করে। স্থির থাকতে পারি না। পরে তোমার পাঞ্জাটার পাঞ্চ দেবার শক্তি হয়তো আর থাকবে না।
ডোমিনিকোর ঠোঁট থেকে হাসিটা উধাও হয়ে যায়। তার ছোট ছোট চোখ দুটো হঠাৎ দপ করে জ্বলে ওঠে।
তুমি আবার আমাকে পাঞ্চ করতে উদ্যত? হ্যারীকে আবার উদ্যোগী হতে দেখে সোলো বলে ঠিক আছে দেখা যাক–
অল্পের জন্য সোলোর ঘুষি হ্যারীর চোয়াল ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল।
এবার হ্যারীর পালা, সে তখন তার ডান হাতটা মুঠো করেছে।
চকিতে সোলো ডোমিনিকোর মুখের উপর ঘুষি চালাল সজোরে হ্যারী। সোলো টাল সামলাতে না পেরে টেবিলের ওপরে গিয়ে আছড়ে পড়ল। একটা ভারী জিনিস পড়ার শব্দ হল।
সোলো! র্যান্ডি আঁৎকে উঠল। তোমার কি মাথা খারাপ হল হ্যারী? সোলোর দিকে ছুটে যায় র্যান্ডি।
ওকে একা থাকতে দাও র্যান্ডি ও ঠিক আছে। হ্যারী তাকে বাধা দিয়ে বলে, সুন্দর পাঞ্চ ও ভালবাসে একটু আগেও বলেছিল শোননি?
ওদিকে ডোমিনিকো তখন সম্বিৎ ফিরে পেয়েছে। একটু একটু করে চোখ মেলে তাকাতে শুরু করেছে। তারপর এক সময় হ্যারীর চোখের ওপরে সেদৃষ্টি নিবদ্ধ করে হাসল। সত্যি হ্যারী তোমার পাঞ্চে যথেষ্ট জোরে আছে। আমি দারুন খুশি। তিরিশ নয় সপ্তাহে চল্লিশ ডলার তুমি পাবে সেই সঙ্গে রেস্তোরাঁয় সেরা খানার বন্দোবস্ত রইল তোমার জন্য। ঘরের ছেলের মত থাকবে। র্যান্ডি ওর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে তুমি নজর রেখ।
অদুরে বালির ওপরে পার্ক করা বুইক এস্টেট ওয়াগানটার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সোলো ডোমিনিকো। হ্যারী এবং র্যান্ডি দুজনেই তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
চোখের আড়াল হতেই র্যান্ডি হ্যারীর দিকে না তাকিয়েই হ্যারীর অমন পাগলামোর জন্য রীতিমত অনুতপ্ত হয়ে বলে চল, তোমার ঘরটা দেখবে চল।
না, ওকে এখান থেকে তাড়িয়ে দাও।
মেয়েলি কণ্ঠস্বর শুনেই হ্যারী পিছন ফিরে তাকায়। রেস্তোরাঁর প্রবেশ পথে একটি মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল হ্যারী। তার অনুমান মেয়েটি সোলো ডোমিনিকোর মেয়ে নীনা ডোমিনিকো। তার আবির্ভাবে হ্যারী যেন ধাক্কা খেল, যেন বিদ্যুৎপ্রবাহিত হল তারনগ্ন হাত দিয়ে। সে যেন শক খেল।
র্যান্ডির কথা মনে পড়ে গেল তার। অপরূপ সুন্দরী নীনা। না দেখলে ওর রূপ ঠিক বিচার করা যায় না। বয়স একুশ বাইশ, তবে তেইশের বেশি নয়। মেয়েটির উচ্চতা গড়পড়তা হলেও দেখলে মনে হয় বেশ লম্বা, বোধ হয় স্লিম ফিগার বলে।
পুরুষ্ট বক্ষ যুগল, সুডৌল পা। ঘন কালো চুল ছড়িয়ে পড়েছে কাঁধের ওপরে। তার চোখে মুখে সাড়া জাগান একটা বন্য লাবণ্য উপছে পড়ছে যেন। তবে এই মুহূর্তে নীনাকে খুবই উত্তেজিত দেখাচ্ছিল।
র্যান্ডি তোমার ঐ বন্ধুটিকে আমি আদৌ পছন্দ করি নি। উত্তেজনায় মেয়েটির গলা কাঁপছিল। ওকে এখান থেকে তাড়িয়ে দাও। ওর ছায়া দেখলেও আমার শরীর খারাপ হয়ে যায়।
হ্যারীর চোয়াল দুটোও ততক্ষণে বেশ শক্ত হয়ে উঠেছে। চোখের রঙ বদলেছে। নীল থেকে ধূসর।
কি ব্যাপার ডোমিনিকো? শান্তভাবে জিজ্ঞেস করল সে।
তুমি!দরজা পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল নীনা এবংহ্যারীর মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। তার ভারী নিঃশ্বাস পড়ছিল হ্যারীর বুকে।
ম্যাজেন্টা হল্টার নেক ব্লাউজের আড়াল থেকে নিটোল বক্ষযুগল ফেটে বেরিয়ে পড়তে চাইছে। সাদা স্ট্রেচ প্যান্টের আড়ালে ভারী পাছা আর দীঘল পা দুটো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এখন। তোমার বয়সী কারোর সঙ্গে লড়তে পার না?
ও, এই কথা, হ্যারী বলল, তোমার বাবা কি কচি খোকা? তিনি কি নিজের ভাল মন্দ বোঝেন না ভেবেছ?
উনি নিজেই তো স্বেচ্ছায় আমার মারাত্মক পাঞ্চ খাবার জন্য তার গলা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন দেখনি?
যাই হোক এ সবের জন্য আমি অত্যন্ত দুঃখিত বিশেষ করে আমাকে যখন তোমাদের এখানে কাজ করে খেতে হবে।
তুমি যদি ভেবে থাক এখানে তুমি চাকরী পাচ্ছ, তাহলে তোমার মত গবেট মূর্খ দুটো নেই বলে ভাববো। তোমাকে আর এক মুহূর্তও এখানে দেখতে চাই না। বেরিয়ে যাও এখান থেকে।
হ্যারীর মুখের রঙ আগের মতই ভাবলেশহীন।
তোমার মতো কচি খুকি মেয়ের হুকুম মানতে আমি রাজী নই।
তোমার বাবা আমাকে এখানকার কাজে বহাল করেছেন। তিনি যদি যেতে বলেন নিশ্চয়ই চলে যাব, তবে তোমার কথায় নয়।
হঠাৎ নীনা একটা অদ্ভুত কাজ করে বসল, হ্যারীর গালে চড় মারতে যায়, হ্যারী সময় মত একটু সরে দাঁড়াতেই নীনা ব্যালান্স হারিয়ে তার বুকের ওপর আছড়ে পড়ল। আঁটো ব্লাউজের আড়ালে নিটোল বক্ষযুগল হ্যারীর বলিষ্ঠ বুকের ওপরে চেপে বসে। হ্যারীর খুব আরাম লাগছিল।
দুহাত দিয়ে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল, নীনার পাখীর মত নরম বক্ষযুগল হ্যারীর বুকের পেষণে নিষ্পেষিত হতে থাকে।
ম্যানুয়েল দূর থেকে দৃশ্যটা লক্ষ্য করছিল। এবার সে বারান্দায় উঠে এল।
শক্ত সমর্থ চেহারার ছোট বেঁটেখাটো লোক পরনে কালো ট্রাউজার গলা খোলা সাদা শার্ট, কোমরে একটা লাল স্যাস বাঁধা। হ্যারীর ঔদ্ধত্য দেখে সে ক্রুদ্ধ।
ম্যানুয়েল ঐ বাজে লোকটাকে তাড়িয়ে দাও এখান থেকে, বলেই নীনা উধাও হয়ে যায় রেস্তোরাঁর ভিতরে।
হ্যারীর ওপর থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে র্যান্ডির দিকে তাকাল-ও-কে? তুমি সঙ্গে এনেছ ওকে?
নতুন লাইফগার্ড, এই মাত্র সোলো ওকে নিয়োগ করেছে। র্যান্ডি প্রত্যুত্তরে বলে। তাহলে এত হৈ চৈ কিসের?
সোলো আর হ্যারী বক্সিং লড়ছিল, র্যান্ডি তাকে বোঝায়, সোলো হেরে গেছে। সেটা নীনার পছন্দ নয়। তাই ওর মন খারাপ হয়ে গেছে।
ম্যানুয়েল একটু ইতস্ততঃ করে বলে, আমরা এখানে ওসব মারদাঙ্গা ঝুট-ঝামেলা পছন্দ করি না। কাজ করতে চাও তো ভদ্র হয়ে থাকতে হবে এখানে।
ঝুটঝামেলা ভাল লাগে না তোমার? হ্যারী বিদ্রূপ করে তাকে বলে। আহা কি শান্ত ছেলে আমার। তা এ ব্যাপারে মিঃ ডোমিনিকোকে বললেই তো পার!
ম্যানুয়েলের চোয়াল দুটো শক্ত হল। চোখ দিয়ে আগুন ঝরল।
এবার সে র্যান্ডির দিকে ফিরে বলে, আধঘণ্টা পরে তোমাকে বারে দরকার হবে চলে এস। তারপর হ্যারীর দিকে আর একবার অগ্নিবর্ষণ করে বলে, ব্যাপারটা এখানে একটু পরিষ্কার হয়ে যাওয়া ভাল। হ্যারী বলে আমি কোন চালাকির আশ্রয় নিতে চাই না র্যান্ডি।
র্যান্ডি তাকে বোঝায়, আলোচনা যা করার ডোমিনিকো ফিরলে তার সঙ্গে করলেই চলবে। চল, এখন তোমার ঘরটা দেখবে চল।
র্যান্ডি প্রথমে তার নিজের কেবিনে ঢুকল তারপর পাশের কেবিনটা দেখিয়ে সে বলে, হ্যারী ওটা তোমার। আর তোমার ওপাশের কেবিনটা ম্যানুয়েলের।
হ্যারী কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা তার কেবিনে রেখে বড় করে নিঃশ্বাস নিল। তারও কি কম পরিশ্রম হয়েছে সোলোর সঙ্গে বক্সিং লড়তে গিয়ে?
হ্যারীকে একটু শান্ত হতে দেখে র্যান্ডি তার পাশে এসে দাঁড়ায়।
নিচু গলায় বলে, বন্ধু, সোলোর সঙ্গে লড়াই করে কাজটা তুমি ভাল করনি। তুমি হয়তো জান না, এক সময় গুণ্ডা-মস্তানদের দলপতি ছিল সোলো, তালা সিন্দুক লকার খুলতে ওস্তাদ ছিল সে তখন। এখনও ওর ধারণা, বক্সিং-এ এই তল্লাটে ওর কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। নীনার ধারণাও তাই।
তাই স্বভাবতই ও চায়না ওর বাবা কারোর কাছে হেরে যাক। আবার ওদিকে ম্যানুয়েলও চায় তার প্রেমিকা নীনা যেন ওর বাবার ব্যাপারে কারোর কাছ থেকে আঘাত পাক। লোকটা দারুন ঝামেলাবাজ। তাই বলছিলাম এখানকার অবস্থাটা আগে একটু ভাল করে সমঝে নিয়ে তারপর সুবিধে মত সময়ে এই সব লোকগুলোকে শায়েস্তা করলে ভাল হয়।
শোন র্যান্ডি, এক সময় আমি জঙ্গলের মানুষ ছিলাম। এখন সভ্য দুনিয়ায় ফিরে এসেছি। জঙ্গলে থাকার সময় আমি দেখেছি সেখানে জানোয়ারের মাংস জানোয়ার খায়, তখন জানতাম জানোয়ারের সঙ্গে মানুষের মূল তফাত এখানেই কিন্তু এখন দেখছি কোন তফাত নেই, এখানে মানুষে মানুষের মাংস খায়। তোমাদের এই সভ্য দেশে হিপী নেশাখোর জালিয়াৎ ঠগ জোচ্চোর গুণ্ডা-মস্তানরা সেই জঙ্গলের জানোয়ারের থেকেও খারাপ। তাই সহজে আমি ওদের শিকার হব না, আমি ওদের সঙ্গে লড়াই করতে চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই।
দশটার কিছু পরে ডোমিনিকো ফিরে এল। পথে গাছের নিচে বসে হ্যারী তার জন্য অপেক্ষা করছিল ঘণ্টা দুই ধরে। এই সময়টা তাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। নীনা ডোমিনিকোর অশালীন ব্যবহারের জন্য নয়, সেই মৃত লোকটির মুখ বার বার তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল, কিন্তু কে, কে হতে পারে সে।
লোকটাকে কবর দেবার পর মাঝপথে দুটি বিভিন্ন জায়গায় ক্যারাভ্যান এবং মাস্তাং গাড়িটা পার্ক করে রেখে এসেছিল তারা, সোলো ডোমিনিকোর রেস্তোরাঁয় ঢোকার আগে। গাড়ি দুটো ফেলে আসার আগে স্টিয়ারিং হুইল ডোর লক সব ভাল করে মুছে এসেছে যাতে করে পুলিশ তাদের হাতের ছাপ আবিষ্কার করতে না পারে।
হ্যারী এখন নিশ্চিত কোন চিহ্নই সে রেখে আসেনি, পুলিশ তাদের হদিশ পেতে পারে না কোন মতেই।
এক সময় হ্যারী ট্রাউজারের পকেট থেকে সেই ইস্পাতের চাবিটা বার করল, মৃত লোকের পরচুলার ভিতর থেকে পাওয়া চাবি! চাবির খবর র্যান্ডি জানে না। তাকে চাবি পাওয়ার খবরটা বলা উচিত কি উচিত নয় ভেবে উঠতে পারেনি সে।
চাবির প্রসঙ্গ উঠতেই তার মনে হল, তবে কি এই চাবির খোঁজেই আততায়ীরা মৃতের ওপর অমন অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছিল। তার কাছ থেকে চাবির খবর আদায় করবার জন্যেই কি তার পাটা তখন আগুনে পুড়িয়ে ঝলসে ছিল? কিন্তু অত করেও তারা তার কাছ থেকে চাবিটা হাতাতে পারেনি। প্যারাডাইজ সিটি এয়ারপোর্টের একটা লকারের চাবি এটা। কিন্তু এখন কথা হচ্ছে, ঐ লকারের মধ্যে কি আছে? কিসের লোভে তারা চাবিটা তার কাছ থেকে পেতে চেয়েছিল? কোন দামী জিনিস না কি কোন গোপন কাগজপত্রের লোভে? র্যান্ডিকে সে জিজ্ঞেস করেছিল সিটি এয়ারপোর্টটা কোথায়? উত্তরে সে জানিয়েছিল শহরের একেবারে পূর্ব প্রান্তে। তার মানে হ্যারী হিসেব করে দেখেছে এখান থেকে মাইল পঁচিশ দূরে প্যারাডাইজ সিটি এয়ারপোর্ট। বাসে চেপে যাবে, না সোলোর কাছে থেকে একটা গাড়ি ভাড়া নেবে? যাইহোক একটা দিন এখানে। অপেক্ষা করার পর যা হয় একটা ব্যবস্থা করে এয়ারপোর্টে যেতে হবে, হ্যারী ভাবল কথাটা খুব মন দিয়ে।
সোলোর পায়ের ভারী বুটের শব্দ হতেই হ্যারী চোখ তুলে তাকাল। তার চিন্তায় ছেদ পড়ল। সেই সময় নীনাও বেরিয়ে এল বারান্দায়। ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল তখনও বেশ রেগে আছে।
হ্যারী ওর উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছিল। কিন্তু কি বলছে ঠিক বুঝতে পারছিল না। কেবিনের দিকে ক্রমশঃ এগিয়ে আসছিল নীনা। হ্যারী জেনে গেছে, ও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে আসছে।
তার আশঙ্কা মেয়েটি ওর বাবার কাছে অনুযোগ করে তাকে এই শহর থেকে হয়তো তাড়িয়ে দিতে পারে। মেয়েটির সেক্সি চেহারা তাকে আকর্ষণ করলেও তার ব্যবহারে মনটা তিক্ততায় ভরে উঠেছিল।
হ্যারীর সন্দেহ হয় মেয়েটি ওর বাবার সঙ্গে হাত মিলিয়ে হয়তো তাকে ঝামেলায় ফেলতে পারে। তারা কখনোই পরিস্থিতিকে তাদের হাতের বাইরে যেতে দেবে না। সব শেষে সে ভাবে আর একটা বড় সমস্যার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে সে হয়তো। হঠাৎ সে দেখল বারান্দায় দাঁড়িয়ে সোলল তার মেয়েকে হাত নেড়ে থামার জন্য ইঙ্গিত করল,–
তারপর সে তার চিন্তিত মুখের দিকে ফিরে তাকাল। নীনা গজরাতে গজরাতে তার দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়।
হ্যারী উঠে দাঁড়িয়ে বালিয়াড়ির দিকে হেঁটে চলল। দুরন্ত গতিতে পা চালিয়ে সোলো তার মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। সোলোর ঠোঁটে হাসি। মৃদুভাষে শুধোয় সেতুমি আমার মেয়ের সঙ্গে ঝগড়া করেছ?
মোটেই না, হ্যারী প্রত্যুত্তরে বলে, ভাবলেশহীন তার মুখ, বরং নীনাই আগ বাড়িয়ে আমার সঙ্গে ঝগড়া করল।
সোলোর ঠোঁটে আর এক ঝলক হাসি ঝলকে ওঠে–মেয়ে আমার খুব ভাল আমিই ওর জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছি। সোলোর কণ্ঠস্বর এবার কেমন যেন ভারী হয়ে ওঠেকথা বলতে গিয়ে। ওর মার মৃত্যুর পর কেমন যেন ও বদলে গেছে। হ্যারী তোমাকে একটু সতর্ক করে দিচ্ছি, জান ও তোমাকে আদৌ পছন্দ করে না। অথচ আমি ওকে কত বুঝিয়েছি তুমি খুব ভাল লোক, তুমি আমাদের সঙ্গে থাকতে এসেছ। হ্যারীর বুকে হাত রেখে সে বলতে থাকে, আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই হ্যারী। জান হ্যারী আমার কথা খুব ভাবে ও। ওর ধারণা আমি বুঝি কখনও বুড়ো হতে পারি না। কারো কাছে মাথা নোয়াতে পারি না।
তাই তুমি যখন আমাকে হারিয়ে দিলে স্বভাবতই আমাকে ঘিরে ওর সব স্বপ্ন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে খুঁড়িয়ে গেল।
সোলোর ঠোঁটে শুকনো হাসি, আমি কি বলতে চাইছি বুঝতে পারছ নিশ্চয়ই! হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন ডেম্পসীকে তোমার মনে পড়ে? আমি তাকে দারুণ শ্রদ্ধা করতাম ছেলেবেলায়। তাকে ঘিরে আমার অনেক স্বপ্ন ছিল তখন। সেই ডেস্পসী টুনির কাছে হেরে যাওয়ার পর আমার সব স্বপ্ন ভেঙে যায় নীনার মত। তাই বলছি হ্যারী নীনার ব্যবহারে তুমি ওর ওপরে রাগ করো না, বুঝেছ?
হ্যাঁ, আমি বুঝেছি মিঃ ডোমিনিকো। একটু ইতস্ততঃ করে হ্যারী বলে, বোধহয় আমার এখান থেকে চলে যাওয়াই মঙ্গল। আমি আপনার মেয়ের স্বপ্ন ভেঙে দিতে চাই না। এই বিরাট শহরে আমার অন্য কোথাও কি কাজ হবে না? হবে নিশ্চয়ই।
কোন মেয়ের কথায় এভাবে হার মানা তোমার শোভা পায় না হ্যারী, সোলো তাকে বোঝায় না, ঠিক তা নয়। স্বচ্ছ নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে হ্যারী তাকে পাল্টা বোঝাবার চেষ্টা করে, মুশকিল কি জানেন মিঃ ডোমিনিকো দীর্ঘদিন আমি জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরেছি সেখানকার মানুষ ওৎ পেতে থাকত অকারণে আগন্তুককে আক্রমণ করার জন্য। সব সময় তাদের সঙ্গে আমাকে যুদ্ধ করতে হয়েছে। দেশে ফিরে এসে শহরে মানুষদের সেই রকম আচরণ করতে দেখে একটু অধৈর্য হয়ে পড়েছিলাম। এখানে এসেও তার পুনরাবৃত্তি দেখে আমার ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলেও কোন অভিযোগ রেখে যাচ্ছি না। ঠিক আছে।
না ঠিক নেই। আমি তোমাকে এখানে থেকে যেতে বলছি। তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে আমি তোমার সাহায্য চাই। নীনা বড় ভাল মেয়ে। ও তোমায় ফের বিরক্ত করলে আমাকে বল, আমি ওকে নিষেধ করে দেব, ভবিষ্যতে ও যেন আরো সতর্ক হয়। ও ওর মায়ের বদমেজাজী স্বভাবটা পেয়েছে বুঝলে হ্যারী। আমি তোমাকে আবার অনুরোধ করছি। দয়া করে তুমি আমার এখানে থেকে যাও। একটু ইতস্ততঃ করে হ্যারী শেষ পর্যন্ত বলে, ঠিক আছে মিঃ ডোমিনিকো, আমি থাকছি।
সোলো খুশি হয়ে তার পিঠ চাপড়ে বলেধন্যবাদ। তবে এখন থেকে তুমি আমাকে মিস্টার বলে সম্বোধন করবে না, শুধু সোলো বলেই ডাকবে। এখানে সবাই যা বলে থাকে। একটু থেমে সোলো বলে, এখন থেকে তুমি এখানকার সী-বীচের ইনচার্জ। দায়িত্ব নিতে পারবে তো?
নিশ্চয়ই, হ্যারী বলল।
তাহলে ঠিক বারোটার সময় কিচেনে এস দুজনে এক সঙ্গে নৈশভোজ সারব। হ্যারী মাথা নেড়ে সায় দেয়।
ঘণ্টা দুই ধরে সী বীচ ঘুরে অকেজো পেডেল বোটগুলোর মেরামত এবং রঙ করানোর ব্যবস্থা করে কিচেনে ফিরে এল হ্যারী।
ইতিমধ্যে সোলো, নীনা, র্যান্ডি এবং ম্যানুয়েল খাওয়া শুরু করে দিয়েছিল।
এস, এস হ্যারী–চেয়ারে হেলান দিয়ে সোলো বলে।
তোমাকে অত পরিশ্রম করতে হবে না। এস খাওয়া শুরু করে দাও। নীনার দিকে ফিরে বলে আমার মেয়ে নীনাকে তুমি তো চেন।
নীনা ফিরে তাকাবার প্রয়োজন বোধ করল না। ও তখন বড়ো সাইজের একটা বাগদা চিংড়ির খোলা ছাড়াচ্ছিল।
চোখ পিটপিট করে সোলো এবার ম্যানুয়েলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ম্যানুয়েল তার দিকে বাগদা চিংড়ির ডিস এগিয়ে দেয়। হ্যারী কিন্তু তাকে পাত্তা দেয় না।
ম্যানুয়েল অপমানিত বোধ করে মাঝপথে খাওয়া শেষ করে অশোভন ভাবে কিচেন থেকে বেরিয়ে যায়।
ওর হয়ে সোলো ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বলে, ওর অমন ব্যবহারের জন্যে তুমি যেন কিছু মনে করো না হ্যারী। ও ঐরকম খাওয়ার টেবিলে বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারে না। একটু থেমে সে আবার বলে–কাল খুব ভোরে মার্কেটিং করতে বেরোব, তুমি কি আমার সঙ্গে যাবে?
নিশ্চয়ই।
ইতিমধ্যে র্যান্ডি বারে ফিরে গিয়েছিল এবং ম্যানুয়েলকে অনুসরণ করে নীনাও কিচেন ছেড়ে চলে গিয়েছিল। সোলো এবং হ্যারী দুজনে মুখোমুখি বসেছিল। দুজনের হাতে শাদা মদের গ্লাস। সোলো মুখর এবং হ্যারী নীরব শ্রোতার ভূমিকা নিয়ে মাঝে মাঝে গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিল।
সোলো তখন একমাত্র পুত্র স্যামের জন্যে দুঃখ করছিল। ভাল ছেলে সে, তার সাহায্য আমি খুব আশা করেছিলাম।
কিন্তু সে আমার সঙ্গে থাকল না দুঃখ আমার এখানেই, অবশ্য তাকে যেতেই হতো।
হ্যারী তার গ্লাসে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, তাই বুঝি। তা বেশ তো স্যামই তো তোমার একমাত্র ছেলে নয়? আমি রইলাম।
হ্যাঁ, হ্যাঁ তা তো বটেই, এক গাল হেসে সব জ্বালা যন্ত্রণা ভুলে গিয়ে সোলো বলে, তুমি তো আমার ছেলের মতই, আশ্চর্য কথাটা ভুলে গিয়েছিলাম। হ্যারী তোমার কোন অসুবিধে হলে আমাকে বলল।
আমি না থাকলে জোকে বলল সে তোমার প্রয়োজন মত সাহায্য অবশ্যই করবে।
সুযোগ পেয়ে হ্যারী বলে বসে, আমি একবার রাতের শহরটা দেখতে চাই। যানবাহন কি রকম? বাস পাব?
নিশ্চয়ই! প্রতি আধঘণ্টা অন্তর বাস চলে। ফেরার শেষ বাস রাত দুটোয়।
অত দেরি আমার হবে না। হ্যারী লক্ষ্য করল, সোলো তার গাড়ি দিতে চায় না। ঠিক আছে আমি যেতে পারব।
সন্ধ্যে সাতটার সময় সাঁতার কাটতে গেল হ্যারী, সাঁতার কাটার সময় একটা ডাইভিং বোর্ডের বড় অভাব অনুভব করল সে এবং মনে মনে ভাবল সে পরে এব্যাপারে সোলোর সঙ্গে আলোচনা করবে। ডাইভিং বোর্ডের আকর্ষণ মন্দ হবে না।
ডিনারের টেবিলে সোলোকে একা পেয়ে প্রসঙ্গটা তুলতেই সোলো জিজ্ঞেস করল, বেশ তো তুমি পারবে তৈরী করতে?
নিশ্চয়ই! জায়গাও ঠিক করে ফেলেছি। কোর্যাল ফাউন্ডেশনের কাছে একটা ডাইভিং বোর্ড তৈরী করলে ভাল হয়। এখন আমাদের প্রয়োজন কিছু কাঠ, নারকেল ছোবড়ার ম্যাটিং, লোহার রেলিং, সিমেন্ট এবং স্পটলাইটের ব্যবস্থা করতে পারলে আশাকরি দর্শকদের ভাল রকম আকর্ষণ করাতে পারব।
তার মানে তুমি প্রদর্শনীর কথা ভাবছ?
আমি ডাইভিং-এর টেকনিক দেখাব। যদিও অনেকদিন অনুশীলন নেই, তবু দু-চারদিন অভ্যাস করলে মনে হয় আমি আবার আমার ফর্মে ফিরে আসতে পারব।
বিস্ময় ভরা চোখ সোলোর। চমৎকার আইডিয়া তো! কাল আমার সঙ্গে তুমি মার্কেটে এস। মাঝপথে হ্যাঁমারসনের টিম্বার ইয়ার্ডে নামিয়ে দেব তোমাকে। তোমার যা দরকার তাকে বল, পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করবে সে। সেখান থেকে তুমি বাসে ফিরে আসতে পারবে।
ঠিক আছে।
রাত তখন দশটা। গ্রীষ্মের রাত্রি, হ্যারী ঠিক করল শোয়ার আগে আর একবার সাঁতার কাটতে যাবে। সী-বীচে যাবার পথে চোখে পড়ল আলোকিত রেস্তোরাঁ। তখনো প্রায় এক ডজন লোক ডিনার টেবিলের সামনে বসে ছিল। র্যান্ডি সাদা কোট পরে ড্রিঙ্কস পরিবেশন করতে ব্যস্ত। ওদিকে ম্যানুয়েল লাল সস্ হাতে নিয়ে এ টেবিল থেকে ও টেবিলে ছোটাছুটি করছিল।
র্যান্ডি কিংবা ম্যানুয়েল কারোর প্রতিই হ্যারীর লক্ষ্য ছিল না, তার একমাত্র লক্ষ্য তখন নীনা।
এক সময় তার চোখের সামনে ভেসে উঠলনীনার শরীর।লাল হল্টার নেক ব্লাউজের আড়াল থেকে ওর নিটোল গোল বক্ষযুগল ফেটে বেরিয়ে পড়তে চাইছে, সাদা প্যান্টের আড়ালে ভারী, পাছা আর দীঘল পা দুটো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
কালো চচ্চকে চুলগুলোদুকাঁধ ছুঁয়ে হাওয়ায় লুটোপুটি খাচ্ছে এবং কানের দুল দুটো আলোয় ঝলসে উঠছে মাঝে মাঝে, এই মুহূর্তে ওর মুখের গড়ন খুব সুন্দর এবংসেক্সি দেখাচ্ছিল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে হ্যারী একদৃষ্টে তাকিয়েছিল সামনের দিকে, মনে হয় ও বোধহয় তাকেই খুঁজছিল, কিন্তু তার সন্দেহ হয় নীনা তাকে দেখতে পাবে কিনা।
পলক পতনহীন চোখে হ্যারী তাকে দেখছিল একটা থামের আড়াল থেকে। এক সময় নীনাকে হঠাৎ দ্রুতগতিতে বারের দিকে ছুটে যেতে দেখল সে। সেখানে ও এক ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে দেয়, ভদ্রলোকের হাতে ড্রিঙ্কসের গ্লাস।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল হ্যারীর ভিতর থেকে। চোখের দৃষ্টি বিষয় ঝাপসা হয়ে উঠল। ক্লান্ত পায়ে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে চলল সে।
পরদিন মার্কেটিং সেরে একটা রেস্তোরাঁয় হ্যারীকে সঙ্গে নিয়ে সোলো যখন ঢুকল মার্কেটের টাওয়ার ঘড়িতে তখন গুণে গুণে দশবার শব্দ হয়। কফি খেয়ে তোমাকে হ্যাঁমারসনের টিম্বার ইয়ার্ডে নামিয়ে দিয়ে যাব।
ইতিমধ্যে হোটেল বয় খাবার দিয়ে গিয়েছিল। খাবারের প্লেটের দিকে তাকিয়ে সোলো বলে, হ্যারী এই সসেজগুলো খেয়ে দেখ এখানকার স্পেশালিটি শুয়োরের মাংস ভিজিয়ে তৈরী, প্রাতঃভ্রমণের পর দারুণ টেস্ট…। হ্যারীর চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল, এখানকার কাজে তুমি আনন্দ পাচ্ছ তো?
হ্যারী মাথা নেড়ে সায় দেয়।
তৃতীয়বার সসেজ মুখে দিতে গিয়ে হ্যারী লক্ষ্য করল মুখে স্যানট্যানের তামাটে রঙ, নীলাভ বরফের মত চোখের তারা, লম্বা ছিপছিপে হাড়ে মাংস জড়ান চেহারার একটি লোক রেস্তোরাঁর কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়াল।
হাই সোলো, তোমার কি খবর বল? হাত বাড়িয়ে দেয় লোকটা।
তার হাতে হাত মিলিয়ে সোলো জিজ্ঞেস করল, তা তুমি এই অসময়ে এখানে কি করছ?
বদমাস লোকেদের বিচরণ সর্বত্র এবং নিজের স্বার্থে তারা তাদের মায়েরও গলা কাটতে পারে। হঠাৎ এক সময় হ্যারীর দিকে নজর পড়তেই আগন্তুক বলে ওঠে তোমার ঐ সঙ্গী ছোকরাটা কে হে?
হ্যারী তার হিম-চোখের তীক্ষ্ণ চাহনি দেখেই বুঝে গিয়েছিল লোকটা একজন পুলিশ অফিসার।
হ্যারী ইনি সিটি স্কোয়াডের ডিটেকটিভ টম লেপস্কি, দারুণ স্মার্ট বয়। হ্যারীর দিকে চেয়ে সোলো এবার বলে, মিঃ লেপস্কি, ওর নাম হ্যারী মিচেল, আমার লাইফ গার্ড।
তাই নাকি? হ্যারীর চোখে চোখ রেখে লেপস্কি জিজ্ঞেস করে, তুমি সাঁতার জান? গতরার যে লোকটা লাইফ-গার্ডের চাকুরী নেয় সে ভাল করে পা চালাতেই পারত না, হা-হা-হা-।
আমার সঙ্গে থাকলে আপনি নিরাপদে সাঁতার কাটতে পারেন।
হ্যারীর দীর্ঘায়ত চোখের চাহনি নিরুত্তাপ শান্ত। আপনার প্রয়োজন হলে আমি আপনাকে উদ্ধার করব।
লেপস্কির ঠোঁটে শান্ত মিষ্টি হাসি।
তা আমার হয়তো প্রয়োজন হতে পারে, এক টুকরো সসেজ তুলে নিয়ে চিবোতে চিবোতে সোলোর দিকে ফিরে লেপস্কি জিজ্ঞেস করে ব্যান্ডি রিকার্ডোকে তুমি তো চিনতে, তার সঙ্গে শেষ তোমার কবে দেখা হয়েছে বল তো?
রিকার্ডো? তার সঙ্গে আমার বছর দুয়েক দেখা সাক্ষাৎ নেই। আবার সোলো জিজ্ঞেস করল, তার সম্পর্কে তুমি কি খুব আগ্রহী মিঃ লেপস্কি?
নিশ্চয়ই! লেপস্কি সঙ্গে সঙ্গে বলে, তবে আমার কাছে অন্য খবর আছে, তিন দিন আগে রিকার্ডো, এখানে এসেছিল।
কেন সে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসেনি? আসেনি সে? বিশেষ করে সে যখন তোমার খুব কাছের লোক ছিল?
আমার খুব কাছের লোক? অবাক চোখে তাকায় সোলো। তুমি পুলিশের লোক লেপস্কি, খুব চালাক।
কিন্তু আমাকে তুমি বোকা ভেব না। পুলিশের ধমকানিতে সত্যিকে মিথ্যে মিথ্যেকে সত্যি বানিয়ে ছাড়ব। না অত বোকা নই।
সোলো আরো বলে, তবে শোন মিঃ লেপস্কি আমার কাছে যে খবর আছে লুকবো না। শুনেছি রিকার্ডো নাকি ভেরো বীচে একটা বড় বিজনেস পেয়েছে। এর বেশি কিছু আমি জানি না। আর জানতে চাই না।
তুমি ঠিক বলছ? ভেরো বীচ? লেপস্কি স্থির চোখে তার দিকে তাকায়, কিসের বিজনেস হতে পারে?
বললাম তো জানি না। সত্যি কথা বলতে কি মিঃ লেপস্কি, ভেরো বীচে তেমন কোন বড়। রকমের বিজনেসের কথা আমি বিশ্বাসও করি না।
কেবল স্মাগলিং-এর বিজনেস ছাড়া। লেপস্কি তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
তা হতে পারে। কিন্তু আমি যত দূর জানি ব্যান্ডি একজন ছাপোষা মানুষ, স্মাগলার হতে পারে না সে।
তার কোন মানে নেই। অভাবের তাড়নায় মানুষের স্বভাব বদলাতে কতক্ষণ?
হ্যারী খুব মনোযোগ দিয়ে তাদের কথাবার্তা শুনছিল। মুখ ফিরিয়ে শুনছিল বলে লেপস্কি তার মুখের ভাব দেখতে পেল না।
দ্যাখো সোলো, আমি তোমার সাহায্য চাই, লেপস্কি বলে।
এই কেসটা হয়তো আমার ভাগ্য পরিবর্তন ঘটাতে পারে। আর আমি যদি চাকরীতে প্রমোশন না পাই, আমার স্ত্রী আমাকে শাসিয়েছে আমার খাবার করে দেবেনা। তাই আমি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে এই কেসটা তদন্ত করতে চাই কোন ফাঁক রাখতে চাই না।
আমার কাছে খবর আছে, রিকার্ডো নাকি খুন হয়েছে। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত এই শহরে ছিল। সে। আমার একটি ছেলে তাকে এয়ারপোর্ট ছেড়ে যেতে দেখেছে। খানিক দূর পর্যন্ত সে তার গাড়ী অনুসরণ করে। কিন্তু একটা মারাত্মক ভুল সে করেছে হেড কোয়ার্টারে কোন খবর না দিয়ে। রিকার্ডোর মত লোক এ শহরে থাকলে হেড কোয়ার্টারে লাল সংকেত পাওয়া যেত, কিন্তু সেরকম কোন খবর আপাততঃ নেই।
তাহলে সে নিশ্চয়ই কোন ভাড়া করা গাড়ীতে পালিয়ে থাকবে। সমস্ত ট্রান্সপোর্ট এজেন্সিতে খবর নিয়েছি। ভেরো বীচ থানার হার্জের রিপোর্ট থেকে জানা যায় রিকার্ডোর চেহারার মত ক্লীভল্যান্ডের জোয়েল ব্ল্যাচ নামে একজন তোক একটা মুতাং গাড়ী ভাড়া করে।
কিন্তু ক্লীভল্যান্ডের সেই ঠিকানায় খোঁজ নিয়ে জানা যায় জোয়েল ব্ল্যাচ নামে কোন লোক নাকি সেখানে থাকে না।
হার্জকে ব্যান্ডির একটা ফটো দেখাতে সঙ্গে সঙ্গে সে সনাক্ত করে তাকে। অতএব দেখা যাচ্ছে জোয়েল ব্ল্যাচের নামে সেই মাস্তাং গাড়ীটা ব্যান্ডিই ভাড়া করেছিল। এখন দেখা যাচ্ছে রিকার্ডো এবং মাস্তাং গাড়ী উধাও।
দুঃখ প্রকাশ করে সোলো বলে, কিন্তু মিঃ লেপস্কি আমি বোধহয়, তোমাকে কোন সাহায্য করতে পারব না। তার সম্বন্ধে আমি যা শুনেছি সব বলেছি। এর বেশি কিছু আমি বলতে পারব না। অত্যন্ত দুঃখিত।
ঠিক আছে সোলো গত পাঁচ বছর ধরে তোমার চোখ কান যেমন খুলে রেখেছিলে, সেই ভাবেই থাকবে বুঝলে। সোলোর পিঠ চাপড়ে বারের ভীড় ঠেলে সূর্যস্নাত রাস্তায় নেমে যায় সে।
লেপস্কি চলে যেতেই সোলো খিস্তি করে বাস্টার্ড পুলিশের সব লোকগুলোই এই রকম। লোভী কুত্তার জাত।
পদোন্নতি চায়? দাঁড়াও তোমার পদোন্নতি করা আমি বার করছি। হ্যারীর দিকে ফিরে সোলো বলে–আমি ওকে কোন রকম সাহায্য করতে চাই না। র্যান্ডি নিশ্চয়ই তোমাকে আমার কথা বলেছে। তাই না?
হ্যাঁ কিছু কিছু বলেছে বৈকি, হ্যারী খুব সতর্কতার সঙ্গে বলল।
ও আমার সমব্যথী বলবেই তো। জান হ্যারী লেপস্কির কথা শুনলে আমি হয়তো এতদিনে অনেক টাকা কামাতে পারতাম। হয়তো এই ব্যবসা থেকেওকবেই অবসর গ্রহণকরতে পারতাম। কিন্তু কখনই আমি অবসর গ্রহণ করতে চাই না। কিংবা জেলেও পচতে চাই না। এসব কথা আমি তোমাকে বলছি, কারণ তোমাকে আমি আমার ছেলের মত মনে করি।
আমার দুর্ভাগ্য যে আমার একমাত্র সন্তান যুদ্ধে চলে গেছে। নীনা খুবই ভাল মেয়ে আমার, কিন্তু মেয়েরা কখনই বুঝতে চায় না। কিন্তু স্যাম হলে পারত।
বুঝতে পারত, কি বুঝতে পারত? হ্যারী জিজ্ঞেস করে। উচ্চাকাঙ্ক্ষা। মেয়েরা বুঝতে চায় না, উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষ বড় হওয়ার জন্য কি অক্লান্ত পরিশ্রমই না করে থাকে। যেমন কোন সুন্দরী নারীকে দেখে তোমার নিশ্চয়ই আকাঙ্ক্ষা জাগবে তাকে জয় করার জন্যে। এক এক সময় আমি, আমার ব্যবসা এবং নীনার কথা ভাবি। আমি না থাকলে ঈশ্বর জানেন কি করে ব্যবসা চলবে। আর আমি এও জানি যে নীনা কোন মতেই ব্যবসা চালাতে পারবে না তখন ওর কি অবস্থা হবে?
ভাববার বিষয়। একটু থেমে হ্যারী জিজ্ঞেস করে, ব্যান্ডি রিকার্ডো লোকটি কে?
আমার পরেই এই ব্যবসায় একজন দক্ষ পিটারম্যান সে। এক সময় ও আর আমি দুজনে এক সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছি। কখনও একসঙ্গে জেলও খেটেছি।
কিন্তু হ্যারী একটা কথা মনে রেখ, বেআইনী ব্যবসার কখনও পার্টনার নিতে নেই, নিলেই সর্বনাশ। আজকের বাজারে ব্যান্ডির মত বৃদ্ধ লোকের নেওয়া উচিত নয়। আমার মত ওর-ও স্বেচ্ছায় চাকরীতে ইস্তফা দিয়ে চলে যাওয়া উচিত। বড় রহস্যময় লোক ছিল ঐ রিকার্ডো। আমাকে দিয়ে কোন অপ্রিয় কাজ করিয়ে না নিলেও তার হাবভাবে আমি ঠিক বুঝতে পারছি লোকটা যেন কিছু বলতে চায় আমাকে। আমাকে নিয়ে মনে হয় কোন বিপজ্জনক খেলা খেলতে চাইছে। কিন্তু আমি আর ওর ফাঁদে পা ফেলতে চাই না।
তাই বুঝি, হ্যারী বলে, তোমার কথাবার্তা হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, ব্যাভি সত্যিই তোমার কাছে এসেছিল। কিন্তু সে কথা তুমি টম লেপস্কির কাছে গোপন করতে চাইছ।
সোলোর ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠতে দেখা যায়।
দেখছি তুমি খুব স্মার্ট বয়। পুলিশের কাজে ঢুকলে খুব তাড়াতাড়ি তোমার পদোন্নতি ঘটতে পারে। হ্যাঁ হ্যারী তোমার কথাই ঠিক। কিন্তু সে কথা লেপস্কিকে বলা যায় না। হা সে আমার কাছে এসেছিল বৈকি। সে আমার নৌকা ভাড়া নিতে চেয়েছিল, ভাড়া দিলে সে আমার নৌকাশুদ্ধ উধাও হয়ে যেত এতদিনে নিশ্চয়ই।
দিইনি ভালই করেছি। আমি ওকে অন্য নৌকার মালিকদের কাছে যেতে বলেছি। নৌকোর বিনিময়ে পাঁচ গ্র্যান্ড ডলার দেবার আশ্বাস দিয়েছিল। আশ্চর্য, না, মোটেই নয়। যাইহোক অনেক আলোচনাই তো হল, কাজের কাজ কিছু হল না তেমন।
একটু থেমে সোলো বলে, এ সব কথা যেন অন্য কারোর কাছে প্রকাশ করো না। তুমি আমার ছেলের মত বলেই বিশ্বাস করে সব কথা খুলে বললাম। চুপ করে থেক।
নিশ্চয়ই।
আমার মনে হয় ব্যান্ডি সত্যি খুন হয়ে থাকবে। তুমি কোন খবরই রাখছ না আজকাল।
ইতিমধ্যে তাদের গাড়ীটা এসে থেমেছিল হ্যাঁমারসনের টিম্বার ইয়ার্ডে।
সোলো তাকে সেখানে নামিয়ে যায়।
গাড়ীতে স্টার্ট দেওয়ার আগে সোলো তাকে বুঝিয়ে যায় তোমার নৈশভোজ সেরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে যাও। খুব সাবধানে থেক। পুলিশকে কখনও বিশ্বাস করো না। তোমার আশা আছে আকাঙ্ক্ষা আছে। খুব সতর্ক হয়ে চলো। আর শোন হ্যারী খুব একটা প্রয়োজন না হলে লেপস্কির সঙ্গে যেচে কখনও আলাপ করতে যেও না। লোকটা অত্যন্ত স্মার্ট উচ্চাকাঙ্ক্ষী এসব লোক যে কোন লোককে যে কোন মুহূর্তে পুলিশ হাজতে টেনে নিয়ে গিয়ে ফেলতে পারে। অতএব–
মাথা নেড়ে সায় দেয় হ্যারী। অপসৃয়মান সোলোর গাড়ীর দিকে চেয়ে গভীর এক চিন্তায় নিমগ্ন হয় হ্যারী।
.
০৪.
ডোমিনিকো রেস্তোরাঁর সামনে স্পাইডার অর্কিডের ছাতার নীচে জনা তিরিশ বোর্ডার বসে খোসগল্প করছিল। মহিলারা তাদের সঙ্গীদের মদত দিয়ে যাচ্ছিল।
হ্যারী বসেছিল একটা স্পাইডার অর্কিড গাছের ছায়ায়। র্যান্ডি তার ঠিক পিছনে বসেছিল মুখটা তার ঢাকা। ওদিকে হ্যারী তখন গভীর চিন্তায় মগ্ন। টম লেপস্কির কথাগুলো তার মনের মধ্যে তোলপাড় করছিল তখন। ব্যান্ডি রিকার্ডো সম্পর্কে সোলোর মন্তব্যও পর্যালোচনা করছিল সে নিজের মনে এবং শেষ পর্যন্ত সে ঠিক করল র্যান্ডিকে সব খুলে বলা দরকার কারণ ব্যান্ডির খুনের ঘটনার সঙ্গে তারা নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছিল।
তবে সে যাইহোক, হ্যারী প্রসঙ্গ শেষে বলে, যেই তাকে খুন করুক না কেন এই চাবিটির জন্য নিশ্চয়ই, এবং তারা এটা পাবেনা। এটা এখন আমার হেপাজতে। ওটা ছুঁড়ে ফেলে দাও ইতস্ততঃ
করেই র্যান্ডি বলে, ঐ চাবিটাই যত অনিষ্টের মূল কারণ। ওটা আমাদের কাছে না থাকলেই আমরা মুক্ত স্বাধীন কেউ আমাদের সন্দেহ করবে না। অতএব
কিন্তু অতটা সহজনয় হ্যারীবাধা দিয়ে বলে, পুলিশ মৃতদেহের সন্ধান একবার পেলে খুনীদের সন্ধান অবশ্যই করবে জোর কদমে। এই মুহূর্তে পুলিশ জানে লোকটা খুন হয়েছে। কিন্তু কারণটা জানে না। অতএব তারা এখন খুবই সতর্ক। বিশেষ করে লেপস্কি একজন স্মার্ট পুলিশ অফিসার সে যদি একবার মাস্তাং গাড়ীটার সন্ধান পেয়ে যায়, তখন সে জোর তদন্ত চালাতে গিয়ে অবশ্যই আমাদের সন্ধান পেয়ে যাবে। মনে রেখ আমরা খুব একটা পরিষ্কার জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই।
তাই আমি দেখতে চাই এই লাগেজ লকারে কি অবশিষ্ট আছে। এখনও আমি বলছি চাবিটা ফেলে দাও। ব্যান্ডি নাকি একটা বিরাট ব্যবসা চালাত, গুজব সত্যি কিনা জানি না।
র্যান্ডির বাধা সত্ত্বেও হ্যারী বলে যেতে থাকে, আমি খবর নিয়ে জেনেছি, লোকটা সিন্দুক ভাঙ্গতে সিদ্ধহস্ত ছিল। মনে হয় সেই রকম কোন একটা বড় সিন্দুক ভাঙ্গার জন্য ব্যাক্তিকে ভাড়া করা হয়েছিল এবং কাজটা সে সম্পন্নও করে। কিন্তু সিন্দুক ভাঙ্গার পরেই হয়তো সে ডাবল ক্রস করে থাকবে এবং লুটের মাল নিশ্চয়ই এই লাগেজ লকারে লুকিয়ে রাখবে সে। এই অবস্থায় যার হয়ে সে কাজ করতে নেমেছিল তার দলের লোক তার ওপর চাপ সৃষ্টি করে থাকবে তার মুখ থেকে লুটের মালের খবর বার করার জন্যে, শেষ পর্যন্ত লোকটা মারা যায়, শোন র্যান্ডি, আমার নিশ্চিত ধারণা, এই লকারের মধ্যে মূল্যবান কোন বস্তু অবশ্যই লুকনো আছে।
আমার তা মনে হয় না, হঠাৎ র্যান্ডি সপ্রশ্ন চোখে তাকায় তার দিকে। একথা তোমার কি করে মনে হল?
এখন পুলিশের সবার সন্দেহ ব্যান্ডি নিশ্চয়ই কোন বেআইনী কাজে লিপ্ত ছিল। কিন্তু কাজটা যে কি, তা তারা এখনও জানতে পারেনি। অতএব ধরে নেওয়া যেতে পারে হাই-জ্যা বা এ ধরনের কোন আইন বিরুদ্ধ কাজে লিপ্ত ছিল ব্যান্ডি।
এবার র্যান্ডিকে একটু আগ্রহ নিয়ে শুনতে দেখা গেল।
তার মানে তুমি মনে করছ, লকারে টাকার সন্ধান পেলেই সেগুলো আমাদের হাতের মুঠোয় এসে যাবে?
কেনই বা নয়? পাল্টা প্রশ্ন করে হ্যারী তার চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে, এর পরেও কি তুমি চাবিটা ফেলে দিতে বলবে?
না, তুমি যখন বলছ লকারটা মূল্যবান তাহলে থাক। কিন্তু একটা কথা আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না হ্যারী। র্যান্ডির মুখে এক অজানা চিন্তার ছায়া পড়ে।
আচ্ছা হ্যারী, এ ব্যাপারে আমি তো তোমাকে কোন রকম চাপ দিইনি। এ ব্যাপারে কোন কথা তুমি তো আমাকে না বললেই পারতে। লকারের চাবির কথাও না তুললে পারতে আমার কাছে। তুমি তো অনায়াসে লকার খুলে টাকা কিংবা মূল্যবান যা কিছুই থাকুক না কেন বার করে সরিয়ে ফেলতে পারতে। আমি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারতাম না। তবু কেন তুমি আমাকে জড়াতে গেলে বলতো?
হ্যারী তাকে গভীর দৃষ্টি দিয়ে নিরীক্ষণ করতে থাকে।
কেন জান? আমরা দুজনে এখন একেবারে হরিহর আত্মা। পুলিশও জানে সে কথা। আমাদের সত্যি যে কেউ একজন যদি কখনও পুলিশের হাতে ধরা পড়ে অপরজনকেও পুলিশ ঠিক খুঁজে বার করবে, হয়তো অকথ্য অত্যাচার চালাবে তার ওপর। ধর আমাকেই যদি পুলিশ পাকড়াও করে, কি জবাব দেবে তুমি তখন? তাই ভাবলাম তোমাকে গোড়ার থেকে সবকিছু অবগত করা আমার কর্তব্য।
হ্যারীর কথা শুনে একবার মুগ্ধ চোখে তাকাল র্যান্ডি। তুমি একজন গ্রেট গ্রেটম্যান হ্যারী। সত্যি কি তুমি মনে কর হ্যারী আমরা ধনীলোক হতে যাচ্ছি? রাগ করে হ্যারী, ঠিক এই মুহূর্তে এভাবে স্বপ্ন দেখাটা আমাদের উচিত হবে না।
হঠাৎ নীনাকে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে আসতে দেখামাত্র প্রসঙ্গটা চাপা দেবার চেষ্টা করল হ্যারী।
নীনার পরনে লাল বিকিনি, হাতে তোয়ালে। একটু জোরে পা চালিয়ে সী বীচের দিকে নীনাকে এগিয়ে যেতে দেখে হ্যারীর বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল। দৃশ্যটা সত্যিই বড় স্পর্শ করে। ব্রা-বিহীন নীনার স্তনজোড়া এবং ভারী নিতম্বের দোলদোলানি দেখে তার দেহের উত্তাপ হঠাৎ যেন বেড়ে গেল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও নীনার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে হ্যারী এবার কেবিনে গিয়ে প্রবেশ করল পোষাক পরিবর্তন করার জন্য। তাকে এখন একবার বাইরে বেরুতে হবে।
কিছুক্ষণ পরে হ্যারীকে কার পার্কিং জোনের দিকে এগিয়ে যেতে দেখা গেল। তার পরনে শর্ট স্লিভড শার্ট এবং স্ন্যাক্স। একটা বুইক গাড়ী ভাড়া নিতে হবে তাকে। পার্ক করা ভাড়া গাড়ীগুলোর দিকে চোখ বুলোতে গিয়ে হঠাৎ একটা সাদা মার্সিডিজ গাড়ীর দিকে চোখ পড়তেই দৃষ্টি তার স্থির হয়ে গেল। গাড়ীর নম্বর এস এল ১৮০। কোথায় যেন গাড়ীটা সে দেখেছে, খুব চেনা চেনা। হ্যাঁ এবার মনে পড়েছে এই গাড়ীটাই. সেই মেয়েটিকে তুলে নেয় যে মেয়েটা সেই সময় মাস্তাং গাড়ী চালাচ্ছিল। এ এক অদ্ভুত যোগাযোগ। সৈন্য বিভাগে চাকরী করে এসে আজ তার সবকিছুতেই সন্দেহ জাগাটা খুবই স্বাভাবিক এবং সেই সন্দেহের বশেই হ্যারী গাড়ীর সামনে এগিয়ে গেল, আরোহী শূন্য গাড়ী। জানালার কাঁচগুলো নামান। তবে জানলার কাঁচের উপর থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্সটা পড়তে কোন অসুবিধে হল না তার। লাইসেন্সের নাম এবং ঠিকানাটা টুকে নিল সে।
এমানুয়েল কারলোস,
১২৭৯, পাইনট্রী বুলেভার্ড,
প্যারাডাইজ সিটি।
তবে এর থেকে কিছু বোঝা না গেলেও মুখ্যত গাড়ীটা তাকে দারুণ ভাবে ভাবিয়ে তুলল। মন থেকে গাড়ীর স্মৃতিটা কিছুতেই মুছে ফেলতে পারল না সে। এই গাড়ীটাই কি সেদিন হাইওয়ের ওপরে তাদের ফলো করছিল?কথাটা মনে হতেই চমকে উঠল হ্যারী। দ্রুত বার রুমে গিয়ে প্রবেশ করল সে।
তাকে দেখতে পেয়ে জোর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ড্রিঙ্ক চাই বস? জো এগিয়ে আসে তার সামনে।
ধন্যবাদ! এক কাপ কোকো হলেই চলবে আপাততঃ। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে হ্যারী আবার সেই মার্সিডিজ গাড়ীটার কথা ভাবতে বসল।
জোর হাত থেকে কোকোর কাপ নিতে নিতে হ্যারী জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা জো তুমি এমানুয়েল কারলোসকে চেন?
মিঃ কারলোস? হ্যাঁ চিনি বৈকি। চোখ ঘুরিয়ে জো বলে উনি আমাদের একজন দামী খদ্দের। প্রায়ই এখানে আসেন। প্রচুর টাকা আছে। এইমাত্র তিনি মিসেস কারলোসের সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন।
হ্যারীর সন্দেহ প্রশমিত হতে থাকে। ভদ্রলোকের কাজ কি জো?
কিছুই নয়। আমার তো মনে হয় না, উনি কোন কাজকর্ম করেন। ওঁর বাবার প্রচুর টাকা। কারলোসের হাভানা সিগারের ব্যবসা।
আমার যতদূর মনে হয় হাভানা সিগারের আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে এদেশে।
হ্যাঁ, আপনার অনুমান ঠিক বস, তবে মিঃ কারলোসের দয়ায় মিঃ ডোমিনিকোর কাছে প্রচুর হাভানা সিগারের স্টক আছে। কাস্টমারদের ব্যবহার করার জন্য। তাহলে তুমি বলছ মিঃ কারলোস এখন এই শহরেই আছেন।
হ্যাঁ বললাম তো বস, জো বলে,একটু আগে তিনি এখানে ফোন করতে এসেছিলেন। তারপর। স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
তাই বুঝি। হ্যারী সবজান্তার মত করে বলে, দেখছিভদ্রলোকের বেশ মোটা টাকাই রোজগার। জোর আপাদমস্তক দেখে নিয়ে হ্যারী বলে এখন চলি জো, পরে আবার দেখা হবে। বার থেকে বেরিয়ে যায় হ্যারী।
.
তখন বিকেল চারটে। হ্যারী ডাইভিং বোর্ডের জন্য ক্রোমিয়ামের হাতলের ফরমাস দিয়ে সোলোর নিজস্ব গাড়ী এস্টেট চালিয়ে এয়ারপোর্টের দিকে এগিয়ে চলল অতঃপর লাগেজ রাখার লকার খুঁজে বার করতে খুব অসুবিধে হল হ্যারীর। এক সময় বীতশ্রদ্ধ হয়ে নিচে সুদীর্ঘ অলিন্দ পথে এগিয়ে চলল সে ৩৮৮ নং লকারের খোঁজে।
শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেয়ে একবার সে ডাইনে-বাঁয়ে অতি সন্তর্পণে তাকিয়ে নিয়ে দেখে নেয়। একজন মোটাসোটা মাঝবয়সী মহিলা লকারগুলোর মধ্যে থেকে একটা বড় সাইজের লকার খুঁজে বের করতে গিয়ে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছিল।
নিশ্চিন্ত হয়ে পকেট থেকে হ্যারী তার নিজের চাবিটা বার করল এবং ৩৮৮ নং লকারটা খুব সহজেই খুলে ফেলল সে।
লকারের ভেতর থেকে একটা সুটকেস টেনে বার করতে গিয়ে হ্যারী আন্দাজ করল সুটকেসে কিছু নেই সব ফাঁকা। মনে মনে ভীষণ রাগ হল নিজের উপর, কঁকা সুটকেস বহনের জন্যে এতটা পথ সে ঝুঁকি নিয়ে চলে এসেছে। লকারে চাবি লাগিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এল হ্যারী।
এখন তার মধ্যে নেই কোন ব্যস্ততা কেবল সতর্কতা। রিসেপস্ন লবির দিকে এগিয়ে চলল সে ভয় বুকে চেপে। হাতের সুটকেসটা তার এখন ভয়ের একমাত্র কারণ। সব সময় তার মনে এখন সংশয় কেউ তাকে অনুসরণ করছে কিনা। কারোর সতর্ক দৃষ্টি তার হাতের সুটকেসের ওপর পড়ে আছে কিনা। হ্যারী খুব সাবধানে তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে পা ফেলতে থাকে দ্রুত।
ওহে, কে যায়? হঠাৎ তার নজরে পড়ে ডিটেকটিভ টম লেপস্কি তার বাঁদিক থেকে তাকে থামবার জন্য ইঙ্গিত করছে। সেই মুহূর্তে তার মনে হল, তার হাতের সুটকেসটা যেন একটা উত্তপ্ত লাল বিস্ফোরক গোলার মতন।
থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে হ্যারী। ইতিমধ্যে সামনে এসে উপস্থিত হয় লেপস্কি, তার হিমশীতল চোখের দৃষ্টি স্থির নিবদ্ধ হ্যারীর হাতের সুটকেসের ওপর।
চিনতে পারছেন আমাকে? পুলিশি বজ্র হুঙ্কার ঝংকারিত হয়ে ওঠে লেপস্কির কণ্ঠে।
নিশ্চয়ই! হ্যারী প্রত্যুত্তরে বলে। ডিটেকটিভ লেপস্কি। যে অফিসার বিস্ময়ের সঙ্গে জানতে চেয়েছিলেন আমি সাঁতার জানি কিনা।
হ্যাঁ ঠিক তাই, হ্যারীকে সংশয়মুক্ত থাকতে দেখে অবাক হয় লেপস্কি। তা আপনি, এখানে কি করছিলেন? সেটা কি আপনার জানা একান্ত প্রয়োজন? হ্যারী এবার নির্ভয়ে বলে, আমি আমার সুটকেসটা লাগেজ লকার থেকে নিয়ে যেতে এসেছিলাম। আপনার সুটকেস? হ্যারীর হাতের সাদা রঙের প্লাস্টিকের ব্যাগের উপর লেপস্কির শ্যেন দৃষ্টি পড়েছিল।
নিশ্চয়ই। জোর দিয়ে হ্যারী বলে, গতকাল রাত্রে এটা আমি লগেজ লকারে রেখে যাই। এখন আমি সোলোর হয়ে কাজ করছি। জিনিসপত্র আমার একান্ত প্রয়োজন। আর কিছু জানার আছে? মিচেল, অত স্মার্ট আমার পছন্দ নয়।
তবে আপনার কি পছন্দ স্যার? হ্যারীর কণ্ঠে ব্যঙ্গের সুর ধ্বনিত হয়।
হ্যারীর অমন তেজোদ্দীপ্ত কণ্ঠস্বর শুনে চমকে ওঠে লেপস্কি তার টান টান মুখে অন্ধকারের ছায়া ঘনিয়ে উঠতে দেখা যায়। তবু সে নিজেকে সামলে নিয়ে গলার স্বর চরমে তুলে বলে, আমি আবার বলছি, অত স্মার্ট আমার পছন্দ নয়। কোত্থেকে আপনি আসছেন? আমার কথার জবাব দিন।
হ্যারীতার পকেট থেকে কাগজ ভর্তি একটা প্লাস্টিক ফোল্ডার বার করে লেপস্কির দিকে এগিয়ে দেয়। আপনার এতই যখন কৌতূহল এর মধ্যে আমার পরিচয়পত্র আছে চোখ বুলিয়ে দেখতে পারেন।
লেপস্কি তার হাত থেকে প্লাস্টিক ফোল্ডারটা নিয়ে দ্রুত তার পরিচয় পত্রের উপর চোখ রেখে পরে ফিরিয়ে দিতে গিয়ে বলে ওহো আপনি প্যারাট্রুপার? এবার সে শ্রদ্ধার চোখে হ্যারীর দিকে তাকায়, ঠিক আছে সার্জেন্ট আমাকে ক্ষমা করবেন। আপনাকে আমি ঠিক চিনতে পারিনি। এখানে পুলিশের তরফ থেকে আমি আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।
একটু থেমে লেপস্কি আবার বলল, এই শহরে বেশ কয়েকজন স্মাগলারের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে ইদানিং, তাদের খোঁজে এসেছিলাম।
আপনার প্রতি আমাদের কোন বিদ্বেষ নেই। কিছু মনে করবেন না।
না, না, আমি কেন কিছু মনে করতে যাব বলুন।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচল হ্যারী, আপনার কর্তব্য আপনি করেছেন এর মধ্যে দোষের কি থাকতে পারে।
আপনার মত সমঝদার লোক কটা আছে বলুন, লেপস্কি এবার প্রসঙ্গ পাল্টায়। আচ্ছা সোলো কি আপনার কাছে ব্যান্ডি রিকার্ডোর কথা বলেছে সার্জেন্ট?
না লেপস্কি, সে রকম কোন কথা সে আমাকে বলেনি।
ধন্যবাদ সার্জেন্ট, তাকে বলবেন, আমি একদিন আমার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে তার কাছে যাব।
বেশ তো তিনি খুব খুশি হবেন।
আপনিও কি তাই মনে করেন? লেপস্কি শব্দ করে হাসল। অবশ্য আমার কোন দ্বিমত নেই এ ব্যাপারে। যাই হোক আজ চলি। আশা করি আপনার এখানকার দিনগুলি বেশ ভালই কাটবে। ভীড়ের মধ্যে হারিয়ে যায় টম লেপস্কি একটু পরেই।
হ্যারী তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে এস্টেট কারের সামনে এসে দাঁড়ায়।
হাতের সুটকেসটা পিছনের সীটে রেখে সামনে চালকের আসনে গিয়ে বসে সে। একটু পরেই গাড়ীর ইঞ্জিন গর্জে উঠল। ডিটেকটিভ টম লেপস্কির সঙ্গে হঠাৎ সাক্ষাৎহওয়ার ঘটনাটা হ্যারীকে বেশ একটু আড়ষ্ট করে তুলেছিল। তার কাছ থেকে সহজে ছাড়া পেলেও ভয় তার যায়নি। পুলিশের লোককে বিশ্বাস নেই। বাঘে ছুঁলে আঠার ঘা আর পুলিশে ছুঁলে!
এয়ারপোর্ট থেকে ডোমিনিকো হোটেলে ফেরার পথে হঠাৎ ড্রাইভিং মিররের ওপর চোখ পড়তেই চমকে উঠল হ্যারী। কি ব্যাপার? সবুজ আর সাদায় মেশান রঙ-এর একটি শেভ্রলে গাড়ি তার পিছন নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তার মনে পড়ল গাড়ীটা এয়ারপোর্টের সামনে পার্ক করা ছিল।
মোটাসোটা চেহারার চালকের মাথায় পানামা হ্যাট কপালের অনেকটা নিচে নামান, তার মুখ প্রায় দেখা যাচ্ছে না বললেই হয়।
ডোমিনিকো রেস্তোরাঁর কাছাকাছি শেভ্রলে তার এস্টেট গাড়ীঅতিক্রম করে গেল। হ্যারী লক্ষ্য করল গাড়ীর চালক জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে তাকে পিছনে ফেলে উধাও হয়ে গেল। তাতে হ্যারীর ভয় আরো বেড়ে যায়।
প্লাস্টিকের সুটকেসটা হাতে নিয়ে হ্যারী তার কেবিনের দিকে এগিয়ে যেতে গিয়ে বাধা পেল। সোলোর কাছ থেকে।
দাঁড়াও হ্যারী। তার কথার মধ্যে একটা কড়া হুকুমের সুর ধ্বনিত হল। থমথমে মুখে প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়ার পূর্বাভাষ। ভবিষ্যতে আমার কিনুমতিতে কখনও আমার গাড়ী ব্যবহার করবে না, বুঝলে।
হ্যারী তার দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা আন্দাজ করে নিয়ে সতর্ক হয়। র্যান্ডিকে আমি বলে গিয়েছিলাম তোমাকে বলার জন্য, কোন পরিস্থিতিতে আমি তোমার গাড়ীটা নিতে বাধ্য হই। ইস্পাতের রেলিংগুলোর ফরমাসআজইনা দিলেনয় তাই। একটু থেমেহ্যারীআবার বলতে থাকে, ঠিক আছে আমার কাজ আমি এখন থেকে করব। এরপরেও হাই ডাইভিং বোর্ডের জন্য তোমার আগ্রহ থাকলে এরপর থেকে তুমি সব ব্যবস্থা করো। কথা শেষ করা মাত্র হ্যারী তার কেবিনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। সোলোর ডাকে আবার সে থমকে দাঁড়ায়।
হে! হ্যারী! তা সেই ইস্পাতের রেলিংগুলো কবে ডেলিভারী দিচ্ছে?
দিন সাতেকের মধ্যে।
সোলোর গলার স্বর এবার খাদে নেমে আসে। হ্যারীর পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে বলে, হেঁ হেঁ ও সব কাজ আমার সাজে না। তুমিই বরং দেখাশুনা করো। এতক্ষণ যা তোমাকে বললাম ভুলে যেও।
আমার মাথা ঠিক ছিল না তখন, কি বলতে কি বলেছি। এখন থেকে যখনই তোমার প্রয়োজন হবে আমার গাড়ী তুমি ব্যবহার করতে পার। তুমি কিছু মনে করলে না তো?
না, না মনে করতে যাব কেন?হ্যারী জোর করে হাসার চেষ্টা করল, তাছাড়া তুমি তো আমার বস। হ্যারী বুঝে গেছে এরপর থেকে সোলল তেমন আর কোন ঝামেলা করবে না।
তা হতে পারে। যাই হোক তুমি কি এখন বীচে যাবে? সোলো বলে, আমি এখন রান্না করতে চললাম।
অতঃপর হ্যারী সুটকেসটা হাতে তুলে নিয়ে তার কেবিনের দিকে চলতে শুরু করল।
সোলোর এরপর নজরে পড়ল হ্যারীর সুটকেসের উপর। ওটা তোমার?
হ্যাঁ এয়ারপোর্ট লাগেজ লকার থেকে নিয়ে এলাম এখানে থাকার জন্যে।
নিশ্চয়ই তুমি এখানে থাকবে বৈকি। সোলো তার কাঁধে হাত রেখে বলে, হেঁ হেঁ হাই ডাইভিং বোর্ডের ব্যবস্থা তুমি করো।
করবে তো?
হ্যাঁ, করব বৈকি।
কেবিনে প্রবেশ করে হ্যারী একটু ইতস্ততঃ করল, সুটকেসটা খুলবে কি না। সোলো তাকে একবার বীচের কাজ তত্ত্বাবধান করতে বলে গেছে।
কথাটা মনে হতেই তাড়াতাড়ি সুটকেসটা রেখে দিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে এল হ্যারী। তারপর বীচের পথে এগিয়ে চলল অলস পায়ে।
হ্যারী দেখল চারলি এবং মাইক ড্রিঙ্ক-এর ট্রে হাতে সী-বীচের রঙীন চাতালের দিকে তখন এগিয়ে যাচ্ছিল। চতুর্থ ছাতার দিকে এক নজরে তাকিয়ে দেখে নিল দুর, থেকে যেখানে মিঃ এবং মিসেস কারলোস বসেছিল। মিঃ কারলোস নেই তবে মিসেস কারলোসকে সেখানে ম্যাগাজিন পড়তে দেখা গেল। কাছ থেকে তাকে দেখার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল। হ্যারী তার সামনা-সামনি গিয়ে থমকে দাঁড়াল।
আপনার জন্য ড্রিঙ্কসের ব্যবস্থা করতে পারি মিসেস কারলোস?
ভদ্রমহিলা তার হাতের ম্যাগাজিনটা পাশে ফেলে রেখে হ্যারীর দিকে তাকাল। চোখের বিরাট গগলসটা তার মুখের প্রায় অর্ধেকটা ঢেকে রেখেছিল। তবে তারই মধ্যে হ্যারী দেখল ভদ্রমহিলার নাক এবং মুখটা ছোট।
মনে হল ভদ্রমহিলার বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই কিংবা দু এক বছরের ছোট বড় হতে পারে।
তবে তিরিশের কোঠায় ধরে রাখার একটা অদ্ভুত প্রয়াস তার মধ্যে লক্ষ্য করল হ্যারী। যেমন করে অন্য সব বয়স্ক মেয়েরা ম্যাসেজ, সানবাথ করে, প্রতিদিন হেয়ার ড্রেসারের কাছে গিয়ে চুলের সৌন্দর্য বাড়িয়ে বয়সটাকে যৌবনের কোঠায় ধরে রাখার জন্য প্রাণপন চেষ্টা করে থাকে, মিসেস কারলোস তাদের ব্যতিক্রম নন। হ্যারী অনুভবে টের পেল গগলসের আড়াল থেকে ভদ্রমহিলা তাকে মাছের কাটা বাছার মত করে দেখতে থাকে।
ধন্যবাদ, ভদ্রমহিলার গলার আওয়াজ শোনা মাত্র হ্যারী বুঝে গেছে এই ভদ্রমহিলা নিশ্চয়ই সেদিনের সেই মাস্তাং গাড়ীর চালিকা ছিলেন। কে আপনি? ভদ্রমহিলা সঙ্গে সঙ্গে জানতে চাইলেন।
হ্যারী মিচেল; এখানকার নতুন লাইফ গার্ড।
হ্যালো হ্যারী; দীর্ঘায়িত চোখ তুলে হাসল ভদ্রমহিলা। সোলোর কাছ থেকে তুমি নিশ্চয়ই জানতে পারবে, আমি এবং আমার স্বামী প্রায়ই এখানে আসি। তা তুমি সাঁতার জান নাকি? গতবার যে ছেলেটিকে সোলো লাইফ গার্ড হিসেবে ভাড়া করেছিল–
তুমি সাঁতার জান মিসেস কারলোস?
ভদ্রমহিলা তার দিকে তাকিয়ে বললেন–সম্ভবতঃ তার থেকে ভালোই জানে। বাজী ধরলে দশ ডলার লাগবে। হ্যারী তার কথায় ভীষণ রেগে গিয়ে বললো যে ঠিক আছে এক রাউন্ড হয়ে যাক, ভদ্রমহিলার ঔদ্ধত্য দেখে তো হতবাক। ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে হ্যারী ভাবছিল যে ভদ্রমহিলা খুবচতুর তাই গোপন ভাবটা প্রকাশ করতে চাইছেনা। তাছাড়া একটা জিনিস কিছুতেই বোঝা যাচ্ছে না যে মিসেস কারলোসের সঙ্গে মৃতদেহের কি সম্পর্ক আছে? হ্যারী সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো মিসেস কারলোস এবং প্লাস্টিকের স্যুটকেসের কথা।
নৈশ ভোজের আগে হ্যারি তার কেবিনে ফিরে যেতে পারল না কেননা একের পর এক সুন্দরী, যুবতী নানারকম প্রশ্ন করে তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। হ্যারী জানে তারা তাকে বোকা বানাবার চেষ্টা করছে। একথা ঠিক যে সাঁতার কাটা শেখার সময় সে মেয়েদের খুশি করতে পেরেছে। তাদের হ্রস্ব ব্রার নিচে পুরুষ্ট স্তনজোড়া মাঝে মাঝেই ইচ্ছে করে হ্যারীর বুকের মধ্যে চেপে ধরছিল ডুবে যাওয়ার ভান করে। হ্যারীও তাদের মতলব বুঝে হাতের টিপুনি দিতে ছাড়েনি মুখোশর সদ্ব্যবহার করে। সেই মুহূর্তে যুবতীদের চোখের চাহনির মধ্যে আরও অনেক প্রত্যাশা সে লক্ষ্য করেছিল। সব মেয়েদের না হলেও হ্যারী তার পছন্দমতো দু একজনকেই কেবল তার ঠিকানা দিয়েছিল পরে দেখা করার জন্য। সোলো দূর থেকে সব লক্ষ্য করে খুশি হলো।
ডিনারের একটু আগে কেবিনে ফিরে গিয়ে হ্যারী স্নান করে পোষাক পাল্টে সোজা কিচেনে চলে এলো। খুশির আমেজ নিয়ে সোলো তার দিকে তাকালো, বললো মিসেস কারলোস তোমার কথা জানতে চাইছিলেন। ভদ্রমহিলার কথা শুনে মনে হলো তোমার ব্যাপারে খুব আগ্রহী। জো তার জন্য এক প্লেট চিকেন মেরীল্যান্ড এবং কলার ভাজী নিয়ে এলো।
চিকেনে ছুরি চালাতে গিয়ে হ্যারী শুধোয় তার সম্বন্ধে ভদ্রমহিলা কি জানতে চাইছিলেন?
সোলো বললো, মিসেস কারলোস জানতে চাইছিলেন, তুমি এখানে বাই রোড এসেছ কিনা।
চিকেনের স্বাদ নেওয়ার কথা তখন হ্যারী ভুলে গিয়েছিল কেন না তার মাথায় তখন একটাই চিন্তা–মিসেস কারলোস তার সম্বন্ধে অহেতুক কৌতূহল প্রকাশ করছে।
বারে তখন প্রায় চল্লিশজন খদ্দের মদ খেয়ে ঢলাঢলি করছিল যে যার সঙ্গীদের নিয়ে। ম্যানুয়েল টেবিলে টেবিলে ঘুরে তদারক করতে ব্যস্ত। ওদিকে নীনা একটি টেবিলের সামনে চারজন পুরুষের সঙ্গে হাসিঠাট্টা করতে মশগুল। ওর পরনে ছিল স্কারলেট পাজামা স্যুট পুরুষদের দৃষ্টি পড়েছিল ওর উদ্ধত যৌবনের প্রতীক স্তনজোড়ার ওপরে। তাদের চোখের তারায় সেই ভাবই ছিল।
র্যান্ডির সঙ্গে হ্যারীর দেখা হতেই সে তাকে আড়ালে টেনে নিয়ে গিয়ে মিসেস কারলোসের তার সম্বন্ধে আগ্রহের সব কথা খুলে বললো, সে বললো যে তার দৃঢ় বিশ্বাস যে মিসেস কারলোস সেই মাস্তাং গাড়ীর একমাত্র আরোহিনী।
মদের গ্লাস হাতে অবাক বিস্ময়ে র্যান্ডি বললো, এ নিশ্চয়ই ভুল ধারণা। মিসেস কারলোস হতেই পারে না।
হ্যারী বার থেকে বেরিয়ে এলো। কেবিনের একদিকে এগিয়ে যেতে গিয়ে হ্যারীর মনে হলো, দরজার সামনে একটা ছায়া ঘোরাফেরা করছে। একটু পরেই দেশলাই জ্বালানোর শব্দ হলো। কাঠির আগুনে নীনার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই সন্ত্রস্থ হলো সে। সিগারেটের আগুন অনুসরণ করে ওর কাছে গিয়ে দাঁড়ালো হ্যারী। অন্ধকারে নীনার মুখ দেখতে না পেলেও একটা ঝড়ের ইঙ্গিত সে শুনতে পেল নীনার দেহের উত্তাপে। সে যতটা সম্ভব নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করলে শুনতে পেল নীনার দেহের উত্তম নানার মুখ দেখতে না পেলেও এ
অন্ধকারের মধ্যে নীনার কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, তোমার সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই। নীনা আজ নাছোড়বান্দা। অন্ধকার হাতড়ে হ্যারীর হাতের কব্জির উপর ওর উত্তপ্ত হাত দিয়ে চেপে ধরল সজোরে। হ্যারীর মনে হল কিসের যেন একটা আকর্ষণ, সে আকর্ষণ কোন পুরুষই অস্বীকার করতে পারে না। হ্যারীর বুকটা কেঁপে উঠলো। সুবোধ বালকের মতো সে নীনাকে অনুসরণ করে চললো।
ওরা হাঁটতে হাঁটতে সারি সারি তাল গাছের নিচে হাজির হলো। পায়ের নীচে বালির রাশি। সামনে সমুদ্রের উপর চাঁদের আলো পড়েছে। নীনা বালির উপর বসে পড়লো এবং হ্যারী ইতস্ততঃ করলেও নীনা তার হাত ধরে টেনে নিয়ে পাশে বসিয়ে দিলো। তারপর সে বলতে শুরু করলো, জানো হ্যারী, যখন তুমি ঐ বুড়ো ভামটাকে এক ঘুষিতে নক আউট করে দিলে, আমি তখন খুব খুশি হয়েছিলাম। আমি জানতাম একদিন কেউ না কেউ ওর ঔদ্ধত্য খর্ব করবেই।তোমার মত একজন পুরুষের জন্যে বোধহয় অপেক্ষা করছিলাম। নীনা বলতে থাকে, ঐ লোকটা আমার বাবা কিন্তু আমি ওকে ভীষণ ঘৃণা করি। জান হ্যারী বছরের পর বছর ধরে ঐ বুড়ো ভামটা আমার মাকে, আমার ভাইকে, আমাকে বোঝাতে চেয়েছে ঐ একমাত্র ভগবান এবং শক্তিমান পুরুষ। লোকটার কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই কোন মমত্ববোধ নেই। অদ্ভুত ধরণের চিন্তাধারা নিয়ে সে কোনদিনও আদর্শ স্বামী বা আদর্শ প্রেমিক হতে পারবেনা। সে যদি জানতো যে তোমাকে আমার পছন্দ তা হলে আর রক্ষা থাকতো না। আমার পেছন পেছন ছায়ার মতো সে লেগে থাকতো। কিন্তু আমি তাকে বোকা বানিয়েছি। কেন জানো? আমার ভাই স্যামের পর তোমাকেই কেবল আমি পুরুষ বলে মনে করছি।
নীনার মুখ থেকে এই ধরনের অদ্ভুত রকম কথা শোনার জন্য হ্যারী মোটেই প্রস্তুত ছিল না। সে এই প্রথম কথা বললো কিন্তু এসব কথা তুমি আমাকে বলছ কেন?
কারণ একমাত্র তুমিই প্রকৃত পুরুষ। একমাত্র তুমিই আমার মনের মতো পুরুষ হতে পার। পার না?
এবারে হ্যারীর মনের বরফ গলতে শুরু করে একটু একটু করে।কিন্তু এসব সত্ত্বেও সে নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করে। চেষ্টা করে নীনার কামনার আগুনের আঁচ থেকে নিজেকে বাঁচাবার জন্য।
এদিকে নীনা তাকে কাছে টেনে নিয়ে তার ঠোঁটে ওর ঠোঁট দুটি চেপে ধরে। চুম্বন অতি দীর্ঘায়ত হয় হ্যারীর শত আপত্তি সত্ত্বেও। তারপর হঠাৎ হ্যারীকে ছেড়ে দিয়ে নিজের পায়জামা টপ এবং ট্রাউজার খুলে ফেলে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে দাঁড়াল হ্যারীর সামনে। তারপর হ্যারীর দিকে ঝুঁকে পড়ে নিজের হাতে তার জামা এবং ট্রাউজারের বোতাম খুলে দিয়ে তাকে বিবস্ত্র হতে বাধ্য করল। হ্যারী বাধা দেবার চেষ্টা করেও সফল হতে পারে নি। নীনা তখন হ্যারির মুখটা ওর পাহাড়ের চূড়ার মত সুউচ্চ একজোড়া স্তনের মাঝে চেপে ধরেছিল আর তখনি হ্যারীর সব বাধা আপত্তি ভেঙে রেনু রেনু হয়ে খুঁড়িয়ে পড়েছিল। হ্যারী শেষ পর্যন্ত নীনার কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল। তার উষ্ণ নম্র হাতের ছোঁয়ায় নীনা বার বার শিউরে ওঠে। নীনা ধীরে ধীরে সুডৌল পা দুটো ভালো করে দুপাশে ছড়িয়ে দেয় যাতে ওর নগ্ন শরীরে সে তার হাতের ছোঁয়াটা আরও স্পষ্ট অনুভব করতে পারে। নীনা বুঝতে পারে হ্যারী আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না। নীনা ওর স্তনবৃন্তের চারপাশে অনুভব করলো তার দাঁতের নিষ্পেষণ, সমস্ত শরীর ছেয়ে ধীরে ধীরে ছলকে ওঠে উষ্ণ রক্তস্রোত। নীনা অনুভব করলো তার রক্তের স্পন্দন, হ্যারীর নগ্ন দেহটা তখন ওর নগ্ন দেহতটে প্রতিটি কূলে উপকূলে আছড়ে পড়ছিল। হ্যারীর সমস্ত শরীরটাকে শক্ত করে আঁকড়ে কয়েক মুহূর্তের জন্যে ও অনুভব করলো বিপুল শিহরণ, তারপর সবকিছু ধীরে ধীরে কেমন যেন শিথিল হয়ে গেল।
হ্যারীর কেবিনে প্রবেশ করার আগে র্যান্ডি একবার চারিদিকে তাকিয়ে দেখে নিল তারপর সন্তর্পণে কেবিনে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো, তারপর নিচু গলায় হ্যারীকে সতর্ক করে দিয়ে বলল, একটু আস্তে, এইমাত্র ম্যানুয়েল বিছানায় শুতে গেল। তাহলে স্যুটকেসটা তোমার কেবিনে নিয়ে যাই চলো; হ্যারী স্যুটকেসটা হাতে তুলে নিয়ে যায়।
র্যান্ডির কেবিনে মাছকাটা ছুরি দিয়ে স্যুটকেসটা খুলতেই তাদের চোখের সামনে প্রথম থাকে ভেসে উঠল মামুলি কয়েকটি জিনিস-ধূসর রঙের স্যুট, তিনটি সাদা শার্ট, চার জোড়া কালো মোজা, শেভিং সেট, টুথব্রাশ, সাবান, এক জোড়া নীল রঙের পায়জামা, চটি এবং ছটি রুমাল। দ্বিতীয় থাকে চমকে ওঠার মত দৃশ্য ৭.৬৭ মি মি. লুগার অটোমেটিক পিস্তল, সঙ্গে বাক্সে ভরা একশোটি কার্তুজ, একশো চেস্টার ফিল্ডসিগারেট, আধ বোতল হোয়াইট হর্স হুইস্কি, পাঁচ ডলারের ছোট একটা বান্ডিল এবং একটি কালো চামড়ার ওয়ালেট।
হ্যারী ডলারের বান্ডিলটা গুনে দেখলো ২৫০ ডলার।
ওয়ালেটের ভেতর থেকে পাওয়া গেল অনেকগুলো ভিজিটিং কার্ড, আমেরিকান এক্সপ্রেস ক্রেডিট কার্ড-থমাস লরী; ১০০ ডলারের একটি বিল, একটি ড্রাইভিং লাইসেন্স, উইলিয়াম রিকার্ডোর নামে ইসু করা, ঠিকানা লস এঞ্জেলসের। অবশেষে জানা গেল, মৃত লোকটি সত্যিই ব্যান্ডি রিকার্ডো, কিন্তু এ সব থেকে কিই বা বোঝা যেতে পারে র্যান্ডির কণ্ঠস্বরে হতাশার সুর।
হ্যারী ভাবতে লাগলো এই স্যুটকেশটা কি এমন জরুরী হতে পারে যার জন্য ব্যান্ডিকে প্রাণ দিতে হল?
হঠাৎ স্যুটকেসের ঢাকনার ভেতরে অ্যাডহেসিভ দিয়ে আটকানো একটা প্লাস্টিকের কভারের ভেতরে একটি ভিজিটিং কার্ডের উপর চোখ পড়ল হ্যারীর। লেখা রয়েছে “দ্য ফানেল, শেলডন, এল, টি জিরো সেভেন পয়েন্ট ফরটি ফাইভ, ২৭শে মে।”
মনে হয় এ যেন এক রহস্যজনক সংকেত বার্তা। র্যান্ডির হাত থেকে কার্ডটা নিয়ে হ্যারী নিজের শার্টের পকেটে চালান করে দেয় এবং বলে, আমাদের এখন একমাত্র লক্ষ্য হবে এই কার্ডটা যদি কোন কু বার করতে পারে সেটা দেখা। অতঃপর স্যুটকেসটা হাতে তুলে নিয়ে নিজের কেবিনে ফিরে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ায় হ্যারী। শুভ রাত্রি জানিয়ে বেরিয়ে পড়ে।