মার্কিনি তাত
মার্কিনিরা হন্যে হয়ে উঠেছে। বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়েছে। যেদিকে তাকায় সেদিকেই কমুনিস্ট-জুজু দেখে। দেশে যেরকম ছেলে-ধরার জুজু দেখা দিলে মানুষ কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে যাকে তাকে ধরে বেধড়ক মার লাগায়, অনেকটা সেই রকমই। তফাত এই যে, এদের কর্তাব্যক্তিরা এরকম মারধর থেকে দূরে থাকেন, আর যতখানি পারেন জুজুর ভয়টা তাড়াবার চেষ্টা করেন। মার্কিন মুলুকে কিন্তু কমুনিস্ট-ডাইনি পোড়ানোর ভারটা আপন হাতে তুলে নিয়েছেন এই দেশের কর্তাব্যক্তিরা।
তা তারা আপন দেশে যা খুশি করুন, আমরা রা-টি কাড়ব না। আমরা বলি–
‘হরি হে রাজা কর রাজা কর
যার ধারি তারে মার
যার ধারি দু চারখানা
তারে কর দিন-কানা
যার ধারি দু শ চার শ
তারে কর নির্বংশ
যে আমার আধলা ধারে
ব্যাটা যেন দিয়ে মরে!’
কম্যুনিস্টরা আমাকে কিছুই ধারে না, তারা এখন মরুক তখন মরুক আমার কিছুটি যায়-আসে না।
কিন্তু মার্কিনরা যখন এদেশে এসে দাবড়াতে থাকে, তখন আমি বিদ্রোহ করি। ভারতবর্ষের যত্রতত্র আজকাল দেখতে পাবেন মার্কিন অধ্যাপক অমুক তার তমুক ‘গণতন্ত্র’, ‘নবীন জীবনপদ্ধতি’, ‘দর্শনের নব সূত্রপাত’ সম্বন্ধে বক্তৃতা দিচ্ছেন। ওগুলো হচ্ছে মুখোশ যে কোনও বক্তৃতায় যান, দেখতে পাবেন তিন মিনিট যেতে-না-যেতেই, দর্শন, বিজ্ঞান, কলাশিল্পের বাহানা ধরে তারা ঠিক পৌঁছে গেছেন আসল মোকামে, ‘এস ভাই ভারতীয়, তোমরা-আমরা সবাই মিলে রুশকে ঘায়েল করি।’
ইংরেজিতে একেই বলে ‘ওয়ার মঙ্গারিং’, বাংলায় বলে, ‘তাতানো’, ‘ওসকানো’, ‘খ্যাপানো’।
ধর্মসাক্ষী, স্বেচ্ছায় যাইনি। অকালে বৃষ্টি নেমেছিল, আশ্রয়ের সন্ধানে বারান্দায় উঠেছিলুম। যজ্ঞির জজমানরা আমার আসল মতলব ধরতে না পেরে সভাস্থলে বসিয়ে দিলেন। ভোজনের নিমন্ত্রণে নয়, পঞ্চাশি আইনে পড়ে না। বক্তৃতার সারাংশ পূর্বেই নিবেদন করেছি। অবাক মানলুম দেশের লোক এই ‘তাতানো’টা ধরতে পারল না। যে রকমভাবে তাবৎ বক্তৃতাটা গলাধঃকরণ করে মিষ্টি মিষ্টি প্রশ্ন শুধাল, তার থেকে মনে হল তারা যেন আরও মণ্ডাটা মিঠাইটা চাইছে।
থাকতে না পেরে শুধালুম, ‘সায়েব, তোমার আসল মতলব, আমরা যেন তোমাদের সঙ্গে এক হয়ে বলশিদের সঙ্গে লড়ি–নয় কি? ঠিক বুঝেছি তো?’
সায়েব একগাল হেসে আমার বুদ্ধির তারিফ করলেন। আমি শুধালুম, ‘বলশিদের সঙ্গে কোনও সমঝোতা হয় না? আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেন, “অসম্ভব নয়”। তাই তিনি কোনও দলেই ভিড়ছেন না।’
সায়েব বললেন, ‘রুশরা চলে যাক চেকোশ্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, রুমানিয়া, পোল্যান্ড ছেড়ে। তারা কীরকম সেখানে রাজত্ব চালাচ্ছে জান? সেখানে তারা সর্বপ্রকার স্বাধীনতার টুটি চেপে তার দম বন্ধ করে মারছে, জান সে কথা? এবার আমি পাল্টা একগাল হেসে বললুম, বিলক্ষণ জানি সায়েব। কিন্তু বল তো, তোমারই রুজভেল্ট আর চার্চিল যখন ইয়ালটা, তেহরান, পৎসদামে এসব দেশ রুশের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, তখন কি তাঁরা এত গবেট ছিলেন যে জানতেন না, রুশ সেখানে কোন ধরনের রাজত্ব কায়েম করবে? তোমারই মার্কিন জাত, ইংরেজ আর ফরাসি বেরাদর পশ্চিম জার্মানিতে কি বলশি প্যাটার্ন বুনছেন, না নিজেদের প্যাটার্ন? তা নয় সায়েব, রুজভেল্ট-চার্চিল বিলক্ষণ জানতেন রুশ-নাগর বলকান-সুন্দরীকে নিয়ে কোন রঙ্গরস করবেন। কিংবা বলতে পারি, শেয়ালকে যদি দাওয়াত করে মুরগির খাঁচায় ঢোকাও, তবে সকালবেলাকার মমলেটের আশাটা সঙ্গে সঙ্গে ত্যাগ করাই ভালো।’
সায়েবের মুখ সেদ্ধ-হ্যামবর্ণ; সেটা লিপস্টিক হল কি না বুঝতে পারলুম না– চোখে চশমা ছিল না। তবে কণ্ঠে উম্মা প্রকাশ পেল। বললেন, “তোমরা গণতন্ত্র মানো। বিশ্বজোড়া গণতন্ত্রের বিপদে তোমরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে?’
বললুম, ‘তাতে করে তো আমরা মার্কিনেরই অনুসরণ করব। ভুলে গেছ, ১৯৩৪ সালে লয়েড জর্জ যখন তোমাদের দরজায় ধরনা দিয়ে কান্নাকাটি করেছিলেন, পাশ্চাত্য গণতন্ত্র বাঁচাও, তখন তোমরা সাড়া দিয়েছিলে? না বলেছিলে, “ও ইয়োরোপের ঘরোয়া ব্যাপার”। শেষটায় ঢুকেও বেরিয়ে পড়লে। লীগ অব নেশন্সে যোগ তো দিলেই না, উল্টো তার খয়ের খা উইলসনকে তাড়ালে। তার পর ১৯৩৯ সালে যখন চেম্বারলেন-চার্চিল একই কান্না কাঁদলেন, ফ্যাসিজমের হাত থেকে গণতন্ত্র বাঁচাও, তখনও কি পত্রপাঠ লক্ষিত হয়ে লড়াইয়ে যোগ দিয়েছিলে? না পার্লহারবারের আঁতে যখন ঘা পড়ল, তখন “গণতন্ত্র বাঁচাবার” টনক নড়ল? এখন দেখছ রুশ বড্ড বেশি তাগড়া হয়ে উঠেছে, তাতেই এত শিরঃপীড়া। সে কথা থাক। কিন্তু এ কথাও মানবে যে, আজ যদি আমরা কোনও পক্ষে যোগ না দিই, তবে সে শুধু তোমাদের ইতিহাস থেকে হদিস নেওয়ার মতো হবে। ইংরেজ, ফরাসি, জর্মন, জাপান লড়াই করে মরল, তাই আজ তোমরা পয়লা নম্বর। এবার তোমরা আর রুশরা মারামারি করে দুর্বল হও তখন আমরা পৃথিবীতে রাজত্ব করব।’
কথাটা সায়েবের বড্ড টক লাগল। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলল, ‘কিন্তু এই যে লড়াইয়ের বিপদ ঘনিয়ে আসছে, তার থেকে নিজেকে আলাদা করে রাখতে পারবে কি?’
আমি বললুম,’ সে হচ্ছে অন্য কাহিনী। দুর্ভিক্ষের সময় বাঙালি ডাস্টবিন থেকে ভাত কুড়িয়ে খেয়েছে তাই বলে ওটা তার কর্তব্য একথা তো কেউ বলতে যাবে না। লড়াই এড়াতে পারব না, তাই তৈরি হয়ে জেতার পক্ষ নিই, সে হচ্ছে এক কথা; আর তোমাদের পক্ষে স্বেচ্ছায় খুশ এক্তেয়ারে, বহালতবিয়তে “কর্তব্যবোধে” “গণতন্ত্র বাঁচাতে” যোগ দিই, সে হচ্ছে অন্য কথা। আমাদের সে বোধটা হচ্ছে না।’
ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে। দেশ তো আমি চালাইনে। কেটে পড়লুম।
.
কিন্তু প্রশ্ন, এই যে হরেকরকম চিড়িয়া নানারকম মুখোশ পরে এদেশে এসে ‘ওয়ার-মঙ্গারিং’ করে তার কি কোনও দাওয়াই নেই??