পাঁচ
এপ্রিল বিশ
মহিলার উপস্থিতিতে স্পষ্টতই বিরক্ত হয়েছে রবিন্স। পরে, কম্পার্টমেন্টে ফেরার পথে রানাকে জিজ্ঞেস করল, ‘চেনেন মহিলাকে?’
অবাক হলো যেন রানা।
‘আরে না। কোত্থেকে উড়ে এসে রাজ্যের প্রশ্ন শুরু করল। ট্রেন কখন ছাড়বে, কখন বেল-এ পৌঁছবে-হ্যানো ত্যানো।’
‘আর কিছু আলাপ হয়নি?’
‘আমাকে চিনে ফেলেছে। জানতে চাইছিল কোথায় যাচ্ছি।’
‘বলেছেন?’ উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে রবিন্সকে।
‘হ্যাঁ।’
খুশি হতে পারল না রবিন্স। রানার ‘শখ-এর কথা শুনে উপদেশ দিল-বেল-এ পৌঁছেই ক্যামেরা কেনার জন্য। কারণ, যদ্দূর সম্ভব ইক্সানিয়ার বর্ডারে আতিপাতি করে খোঁজা হবে জিনিসটা। সে সত্যি বলেছে কিনা নিশ্চিত হতে চাইবে।
‘খুব কড়াকড়ি নাকি?’ জানতে চাইল রানা।
‘হ্যাঁ, খুবই,’ বলল রবিন্স। ইক্সানিয়ার সাম্প্রতিক অতীতের ঘটনাগুলো সম্বন্ধে রানাকে একটা স্বচ্ছ ধারণা দেয়ার চেষ্টা করল ও। জানাল, দেশটি প্রেসিডেন্ট শাসিত একটি রিপাবলিক। কিন্তু মূল ক্ষমতা বাছাই করা ক’জন মানুষের হাতে সীমিত।
‘ওরা ইক্সানিয়ার প্রতি অসম্ভব বিশ্বস্ত,’ জানাল রবিন্স। ‘বোকা ও বটে-একজন ছাড়া। বলা যায়, সে-ই ইক্সানিয়াকে চালাচ্ছে। মহিলার নাম কাউণ্টেস ক্যারেনিনা। অদ্ভুত মানুষ, ডক্টর, অসম্ভব বুদ্ধিমতীও। ইউরোপে তার সমকক্ষ পলিটিশিয়ান খুব বেশি নেই।’
‘দুর্ভাগ্য হচ্ছে,’ বলে চলল রবিন্স, ‘মহিলার সঙ্গে ব্যবসার কাজে পরিচয় হয়েছিল আমার। ইক্সানিয়ার সরকার জোভোগোরোডে আমার উপস্থিতি ভাল চোখে দেখবে না। ভেবেছিলাম সবার অজান্তে ইক্সানিয়ায় ঢুকে পড়ব। কিন্তু কাউণ্টেস লণ্ডনের সেই প্রতিনিধিকে নিয়ে জোভোগোরোড ফিরছে। আমাকে দেখেই চিনে ফেলেছে। মহিলা বড্ড ধুরন্ধর। ভান করছে, যেন চেনেনি।’
‘তো?’
‘আপনি যার সঙ্গে কথা বলছিলেন সেই মহিলাই কাউণ্টেস ক্যারেনিনা। অসুবিধা হচ্ছে,’ বলল রবিন্স, ‘আমাদের ওপর কড়া নজর রাখা হবে। ভিজিলের গোপন তথ্য আদায় করতে বারোটা বেজে যাবে। কাউন্টেস যখন চিনেই ফেলেছে আপনাকে তখন এটা রাখুন,’ কোটের ভেতর থেকে একটা ওয়ালথার পি. পি. কে আর পঞ্চাশ বুলেটের একটা প্যাকেট বার করে রানার দিকে বাড়িয়ে দিল রবিন্স।
‘অন্য রাস্তা ধরতে হবে আমাদের।’
খুশি হয়ে উঠল রানা। হাসল মনে-মনে। ‘ব্যাটা যদি জানত মাসুদ রানা তার প্রিয় অস্ত্র পেয়ে গেছে হাতে,’ ভাবল ও।
‘কী সেটা?’ রবিন্সের কথার প্রত্যুত্তরে বলল রানা।
‘ইক্সানিয়ার অফিশিয়ালদের হাত করতে হবে। সেজন্যে চাই বিশাল ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট।’
স্মিত হেসে কতগুলো কাগজপত্র খুঁটিয়ে পড়তে শুরু করল রবিন্স।
বেল-এ ঘণ্টা কয়েকের যাত্রাবিরতি। এখান থেকে বুখারেস্টের পথে রওনা দেবে আবার। গানস অ্যাণ্ড ব্লিসের অফিসে চলে গেল রবিন্স, ডক্টরের কন্ট্রাক্টের ব্যবস্থা করতে।
রানা ওদিকে কাপড়-চোপড়, স্যুটকেস, ক্যামেরা আর টুকিটাকি কিছু জিনিস কিনে নিল। রবিন্স তাকে পঞ্চাশ হাজার ফ্রাঁ দিয়ে গেছে।
ট্রেন ছাড়ার ঘণ্টাখানেক আগে ক্যাফেতে ঢুকল রানা। কফির অর্ডার দিল। একটা সুইস খবরের কাগজের ছোট্ট একটা হেডলাইন দৃষ্টি কাড়ল ওর:
ডক্টর পাশার রহস্যময় অন্তর্ধান
‘অন্তর্ধান না আরও কিছু!’ আপন মনে বলল রানা। ডক্টর আমাকে এ কাজে পাঠিয়েছেন মানবজাতিকে রক্ষা করার জন্যে। নিজের জামা- কাপড় এমনকী পাসপোর্টটা পর্যন্ত দিয়েছেন। যে করে হোক তাঁর মুখ রক্ষা করতেই হবে। অবশ্য ডক্টর ক’দিন ঘাপটি মেরে থাকতে পারবেন কে জানে।’
আরও খানিক দূর পড়ল রানা। তবে পুরোটা পড়ার আগেই চোখ চলে গেল বাইরে। রাস্তার উল্টো দিকে রবিন্স, একটা ট্যাক্সি থেকে নামছে।
তক্ষুণি বিল মিটিয়ে দ্রুত বেরিয়ে এল রানা। স্যুটকেসটা নিয়ে পিছু নিল রবিন্সের। একটা দুর্গন্ধযুক্ত, অন্ধকার প্যাসেজে না ঢোকা পর্যন্ত রবিন্সকে অনুসরণ করল ও। পুরানো একটা বাড়িতে গিয়ে সেঁধিয়েছে রবিন্স। রানার মনে হলো বাড়িটা যেন ফাঁকা। দরজার ছায়ায় দাঁড়িয়ে লক্ষ রাখছে রানা। খানিক পরে দু’জন লোককে বেরোতে দেখা গেল। রানাকে দেখেনি। পাশ কাটিয়ে চলে গেছে।
একজন রবিন্স, অন্য লোকটিকে তাৎক্ষণিকভাবে চিনল না রানা। এ সময় জ্বলে উঠল প্যাসেজের শেষ কোণের ল্যাম্প। এবার চিনল রানা। কাউণ্টেসের সঙ্গে ট্রেনে দেখেছিল একে।
ওদের কথা খুব সামান্যই কানে এল ওর। ফ্রেঞ্চ ভাষায় কথা হচ্ছে। রবিন্সকে কথা বলতে শুনল।
‘বুঝেছেন এবার? বাকিটা প্যারিসে, আপনার সুইস ব্যাঙ্কে চলে যাবে। এখন শুধু আমাদের টেকনিকাল অ্যাডভাইজার ইনফর্মেশনগুলো অ্যাপ্রুভ করলেই হলো।
তারমানে ঘুষ!
আর অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। বাড়িটিতে তল্লাশি চালানো অনর্থক। যা জানার জানা হয়ে গেছে রানার। স্টেশনে ফিরল ও।
কম্পার্টমেন্টে ঢুকে দেখতে পেল গানস অ্যাণ্ড ব্লিসের প্রতিনিধি বসে রয়েছে। খুশি-খুশি দেখাচ্ছে তাকে।