আঠারো
অক্টোবর
সেপ্টেম্বর নাগাদ কোমাচিনের সরকার লণ্ডন, প্যারিস এবং নিউ ইয়র্কের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সাহায্য-সহযোগিতা পেয়ে গেল। ফলে আমার প্রয়োজনও ফুরিয়ে এল। অক্টোবরের গোড়ার দিকে প্যারিসে নিজের চাকরিতে ফিরে গেলাম আমি।
প্যারিসে ফিরেই গত ক’মাসের ফরাসি কাগজগুলো খুলে বসলাম। বেল-প্যারিস এক্সপ্রেসের ঘটনাটি সম্পর্কে এরা কী লিখেছে জানতে হবে। হতাশ হতে হলো আমাকে। কাগজে বিশেষ কিছুই লেখেনি। শুধু জানতে পারলাম ডক্টর পাশাকে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। মাথায় গুরুতর আঘাত দেখে অনুমান করা হয় কোন চোরের কীর্তি সেটা। তবে চোরটি নির্বিঘ্নে তার কাজ সারতে পারেনি। কারণ, ডক্টরের পকেট থেকে একটি ফুটো পয়সাও খোয়া যায়নি। কোন পত্রিকাতেই এ ঘটনার পাঁচ সপ্তাহ আগে ডক্টর পাশার ইংল্যাণ্ড থেকে নিখোঁজ হওয়ার কোন খবর পরিবেশন করা হয়নি।
দু’দিন পরে ট্রেনের ইন্সপেক্টরের সঙ্গে দেখা করলাম। নিজের মনে তৈরি করা থিয়োরিটা একটু যাচাই করবার জন্যে আকুলি বিকুলি করছিলাম আমি। ইন্সপেক্টরের কাছে জানতে চাইলাম ইংলিশ পাসপোর্টধারী আর কেউ সেই কামরায় ছিল কিনা। ছিল। ইন্স নিজেই কথা বলেছিলেন তার সঙ্গে।
‘লোকটা দেখতে কেমন মনে আছে?’ জিজ্ঞেস করলাম।
মাথা চুলকালেন ভদ্রলোক। বহুদিন আগের কথা, অন্তত তাঁর কাছে তো বটেই।
রবিন্সের বর্ণনা দিতেই চিনতে পারলেন তিনি। তবে নামটা মনে করতে পারলেন না কিছুতেই। আমার আর বিশেষ কিছু জানার নেই। আমার অনুমান সঠিক।
রবিন্সের নিশ্চিত ধারণা ছিল রানা ভিজিলের ফর্মুলা তার কাছে রেখে দিয়েছে। ফলে ওটা হাতানোর জন্যে বেপরোয়া হয়ে শেষ চেষ্টা করেছিল সে।
সপ্তাহ দুয়েক পরে পত্রিকার কাজে লণ্ডনে যাওয়ার দরকার পড়ল। ওখানে পৌঁছে ডক্টর পাশার খোঁজ-খবরও নিলাম। জানতে পারলাম ব্রাইটনের ছোট্ট একটা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন তিনি। পরের ট্রেনেই রওনা দিলাম ব্রাইটন।
নার্স ভদ্রলোক বিনয়ী হলেও কর্তব্যপরায়ণ। ডক্টরের সঙ্গে দেখা করার কোন সুযোগই দিতে রাজি হলেন না। হেড ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। আমার উদ্দেশ্য শুনে সন্দিহান হতে দেখলাম
তাঁকে।
‘আপনার এত দেখা করার কী প্রয়োজন?’ সোজাসুজি জিজ্ঞেস করলেন তিনি। ‘আপনি কি ওঁর আত্মীয়?’
গল্প তৈরিই রেখেছিলাম।
‘না। তবে ডক্টরের রহস্যজনকভাবে লাপাত্তা হওয়ার কথা কাগজে পড়েছি, ওঁর ছবিও দেখেছি। আমার ধারণা, আমি ওঁকে চিনি। ছবি দেখে মনে হলো জুরিখে মে মাসে যাঁকে দেখেছিলাম ইনিই তিনি।’
সন্তুষ্ট মনে হলো ডাক্তারকে। জানালেন, ডক্টরের ‘সাম্প্রতিক দুর্ভাগ্যজনক অসুস্থতা’-র কারণ খুঁজে বার করার জন্যে খুব সিরিয়াস তাঁরা।
‘ওঁকে ডিস্টার্ব করা চলবে না,’ বললেন ডাক্তার। ‘একদম চুপ করে থাকবেন।’
হাসপাতালের পেছন দিকের একটা ঘরে উনি নিয়ে এলেন আমাকে। নিঃশব্দে দরজাটা লাগালেন। পড়ন্ত বিকেল, ঘরে শরতের ডুবন্ত সূর্যের ম্লান আলো।
বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে রয়েছেন ভদ্রলোক। তাঁর মাথার কোঁকড়া চুলগুলো দেখা যাচ্ছে। লম্বা আঙুলগুলোর দিকে চাইলাম। মনটা চলে গেল অতীতে। ওই আঙুলগুলোই পিস্তল ঠেকিয়েছিল তাঁর নিজেরই কপালে।
ঘুমন্ত মানুষটি কেশে উঠে পাশ ফিরলেন।
‘ইনিই নাকি?’ বাইরে বেরিয়ে আসার পর জানতে চাইলেন ডাক্তার।
মাথা নাড়লাম।
‘না, ইনি অন্য লোক।
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডাক্তার।
‘অদ্ভুত কেস,’ বললেন তিনি। বিনাবাক্যব্যয়ে সায় জানালাম।
স্টেশনের দিকে যখন ফিরছি তখন রাস্তা প্রায় ফাঁকা। লোকজন নেই বললেই চলে। সূর্য ডুবে যাচ্ছে। সমুদ্রের দিক থেকে ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। ওভারকোটের কলার তুলে দিলাম। বড্ড শীত।