বারো
মে দশ-এগারো
পরবর্তী ক’ঘণ্টা যেভাবে কাটল তা জীবনে ভুলব না আমি।
মাঝরাতে রওনা দিলাম আমরা। রবিন্সের আশা, বেলানভ দুটোর মধ্যে পৌঁছবে তার কাছে। তার মানে রাত একটার দিকে হামলাটা করবে ওরা।
রাতের আঁধারে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা রয়্যাল প্যালেসে চলে গেলাম। সেখান থেকে কাউন্টেস যে স্কয়্যারে থাকে সেখানে।
চমৎকার তারা ভরা রাত। রূপালী চাঁদও রয়েছে। শীতটাও নেমেছে জাঁকিয়ে। দ্রুত হাঁটছি দু’জনে। রাস্তায় লোক নেই। কাউণ্টেসের বাড়িটা অন্ধকারই বলা চলে। কেবল দোতলার একটা ঘরের ভারী পর্দার ওপাশ থেকে আসছে আবছা আলোর রেখা।
কাউণ্টেসের বাড়ির আঙিনা আর একটা উঁচু দেয়াল ঘেরা বাগানের মধ্য দিয়ে সরু পথ গেছে। রানার পিছে-পিছে সে রাস্তা ধরেই এগোলাম। ঢোকার মুখে লোহার গেট। তালা দেয়া।
ওভারকোটের পকেট হাতড়াল রানা। বার করে আনল কী যেন। জিনিসটা ওর হাতে ঝিলিক মারল, আক্রমণ করল তালাটাকে। ক’মিনিট বাদেই ঘরঘর শব্দে খুলে গেল গেট। চাপা গলায় গালি দিয়ে উঠল রানা। পাথরের মূর্তির মত জমে গেছি। কিন্তু সামনের গেটের গার্ড বোধহয় শব্দটা শোনেনি। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর রাস্তাটা ধরে আগে বাড়লাম আমরা।
পথটা প্রায় খাড়াভাবে নেমে গেছে নীচের দিকে। দু’পাশের দেয়ালগুলো দৈত্যের মত মাথা উঁচিয়ে দাঁড়ানো। বাইরের আলো ঢোকার পথ বন্ধই করে দিয়েছে প্রায়। দেয়ালের পাশ ঘেঁষে হাতড়ে এগোলাম আমরা। প্রায় এক কিলোমিটার হাঁটার পর থেমে ফিসফিসিয়ে বলল রানা, ‘সাবধানে হাঁটবেন। সুইমিং পুলের কাছাকাছি এসে পড়েছি আমরা।’
রানার পিছু নিয়ে সিঁড়ির দু’তিন ধাপ উঠলাম। কাছেই কেশে উঠল এক লোক, ম্যাচ জ্বেলেছে। গার্ড। পেছোলাম খানিকটা।
‘সিঁড়ির মাথা থেকে দশ মিটারের মত দূরে রয়েছে ও,’ ফিসফিস করে বলল রানা। ‘পানির দিকে সরিয়ে দিচ্ছি ওকে। আমি সিগন্যাল দিলেই ছুটবেন। তবে, শব্দ যাতে না হয়।’
সিঁড়ির ওপর পড়ে থাকা একটা বেশ বড়সড় পাথর তুলে নিল রানা। ওকে হাত ছুঁড়তে দেখলাম। খানিকটা সামনে ছলাৎ করে শব্দ হলো। আমাদের ওপর দিক থেকে পায়ের শব্দ পেলাম। রানা ফিসফিসিয়ে বলল, ‘আসুন!’
পায়ের পাতায় ভর দিয়ে ওর পেছন পেছন সিঁড়ির মাথায় চলে এলাম। সেখান থেকে বাগানে, তারপর ঘাসে লম্বা হলাম। দেখতে পেলাম একজন গার্ড আমাদের বেশ খানিকটা দূর দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। হাতে টর্চ। বাড়িটাকেও দেখা গেল হঠাৎই, যেন অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে। উঠেই এক ছুটে আমরা এক দেয়ালের ছায়ায় আড়াল নিলাম। হাঁফ ধরে গেছে। আমাকে ওখানে দাঁড়াতে বলে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেল রানা।
দশ মিনিট পরে ফিরে এল ও।
‘ভেতরে গিয়েছিলাম,’ নিচু স্বরে বলল, ‘সার্ভেন্টস কোয়ার্টারের একটা খোলা জানালা দিয়ে। দোতলার কোনার ঘরটাতেই আমাদের কাজ।’
‘কীভাবে বুঝলেন?’
‘ওটাতেই কেবল তালা দেখলাম। আসুন।’
‘সামনের গেটের গার্ডটা?’
‘নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে।
ড্রেন পাইপ বেয়ে একটা জানালার কার্নিশে উঠে পড়েছে রানা। বলাই বাহুল্য, জানালাটা বন্ধ। পকেট থেকে সেই যন্ত্রটা বার করে কাজে লেগে পড়ল ও। (পরে জেনেছি জিনিসটা ও বানিয়েছিল হোটেলের একটা কাঁটাচামচ থেকে।) মিনিটখানেক পরেই খুলে গেল জানালা, ভেতর দিকে। ওর পিছু নিয়ে নরম কার্পেট বিছানো মেঝেতে নেমে পড়লাম। জানালা বন্ধ করে দিয়েছে রানা।
ম্যাচের কাঠি জ্বালল ও। ঘরে আসবাবপত্র বিশেষ নেই। ভারী পর্দাগুলো তোলা রয়েছে।
‘পর্দাগুলোর পেছনে লুকিয়ে পড়ন,’ বলল রানা।
দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে আড়াল নিলাম দু’জনে। জানালার ঠিক পাশেই।
‘এখন?’ ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
‘অপেক্ষা করুন। দেখতে পাবেন।’
অপেক্ষা করছি। ভাবছি রানা লুকাতে বলল কেন। ও কি কিছু টের পেয়েছে? ঠিক সে মুহূর্তেই জানালার বাইরে ‘থপ’ করে পায়ের শব্দ হলো। মুহূর্ত পরেই বন্ধ জানালা খোলার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল কেউ। খুলেও ফেলল তক্ষুণি। রবিন্সের লোক পৌঁছে গেছে। নিঃশ্বাস ফেলতে ভয় পাচ্ছি, শুনে ফেলে যদি!
ঘরে পা রেখেছে এক লোক। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট তার অবয়ব। ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। এবার ঘাড় ফিরিয়ে চারদিকটা দেখে নিল। টর্চ জ্বেলেছে। এগোচ্ছে সে। চলে গেল আমার চোখের আড়ালে।
হাত বাড়ালাম আমি, রানার হাত ছোঁয়ার জন্যে। ঠাণ্ডা স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলাম। পিস্তল। পরমুহূর্তেই সরে গেল রানা। সেকেণ্ড দুয়েক পরেই মেঝেতে ভারী কিছু পতনের শব্দে আবার চমকাতে হলো।
‘জলদি,’ চাপা গলায় ডাকছে রানা।
বেরিয়ে এলাম পর্দার আড়াল ছেড়ে। আহত লোকটার ওপর ঝুঁকে রয়েছে রানা। দেয়ালের গোলাকার সেফটা খোলা।
‘কেউ নীচে আছে কিনা দেখুন তো,’ বলল রানা।
পা টিপে-টিপে জানালার কাছে গেলাম। চাইলাম নীচের দিকে। চাঁদের আলোয় একটা মাথা পরিষ্কার চোখে পড়ল। সাবধানে ফিরে এসে জানালাম রানাকে। কালো একটা ফাইলে তখন মনোযোগ তার, টর্চের আলোয় কাগজপত্র দেখছে। ইক্সানিয়ান ভাষায় লেখা। তবে নিউক্লিয়ার ফর্মুলার পৃষ্ঠাগুলো সব ভাষাতেই এক। কাজেই বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না।
আচমকা জানালার বাইরে থেকে ‘হিস’ শোনা গেল। ‘বেলানভ, ‘ একটা কণ্ঠস্বর নরম গলায় ডাকছে। তক্ষুণি টর্চ নিভিয়ে দিল রানা। কাগজগুলো সেফে রেখে দিয়ে দরজাটা লক করে দিল।
ছুরির ঝলকানিটা সময় মতই দেখতে পেয়েছিলাম। মেঝেতে শোয়া লোকটা অর্থাৎ বেলানভ আক্রমণ করতে উদ্যত হতেই লাফালাম আমি। ওর গায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছি দু’জনে। প্রচণ্ড শক্তি লোকটার গায়ে। আমাকে পেড়ে ফেলে উঠে বসল বুকের ওপর। ছুরিটা তুলেছে এমন সময় চিতার মত সামনে বাড়ল রানা। ওর প্রচণ্ড লাথিতে লোকটা একটা ডেস্কের সঙ্গে বাড়ি খেল। ফ্লাওয়ার ভাসটা ডেস্ক থেকে মেঝেতে পড়ে চুরমার হয়ে গেল।
‘জানালায় দেখুন!’ গর্জে উঠল রানা। আমি যখন উঠলাম তখন আবারও লড়াই বেধে গেছে রানা আর বেলানভের। জানালার পাশে ছায়া দেখে ছুটে গেলাম। আমার ঘুসিটা লোকটার গালের হাড়ে লাগল। বসে পড়তে বাধ্য হলো ও। কিন্তু পরক্ষণেই উঠে পড়ল আবার। জানালা গলে লাফিয়ে পড়ল নীচে। ছুটে ফিরে এলাম ঘরে। রানার মার খেয়ে চেয়ার উল্টে মেঝেতে চিতপাত হয়ে পড়ে রয়েছে বেলানভ। হঠাৎ আমার বাহু আঁকড়ে ধরল রানা। টেনে নিয়ে গেল পর্দার পেছনে। কারণটা বুঝতেও দেরি হলো না। পায়ের শব্দ দ্রুত স্পষ্টতর হচ্ছে।
শব্দটা বেলানভও শুনেছে। উঠেই জানালার দিকে ছুটেছে ও। দরজায় চাবি ঢোকানোর শব্দ হলো। দেয়ালের সঙ্গে প্রায় সেঁটে রয়েছি আমরা। জানালা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়েছে বেলানভ। দরজার কাছ থেকে দুটো গুলির শব্দ শুনে কানে তালা লেগে গেল আমার। পড়িমরি করে জানালা দিয়ে ঝাঁপাল বেলানভ। নীচে পড়ার পর ওর পা পিছলেছে, স্পষ্ট শুনতে পেলাম। বাড়ির সামনের দিক থেকে চিৎকার শোনা যাচ্ছে। কোন সন্দেহ নেই গুলির শব্দে গার্ডের ঘুম ভেঙেছে। ছুটন্ত পদশব্দ এবং তার পর-পরই আরও গুলির আওয়াজ কানে এল। এদিকে ঘরে আলো জ্বলে উঠেছে।
ধড়াস করে উঠল হৃৎপিণ্ড। ধরা পড়ে গেছি! ঘরে কোন সাড়াশব্দ নেই। তারপর পরিচিত একটা শব্দ শুনলাম, সেফটা খোলা হয়েছে। বন্ধও করা হলো। পিস্তলধারী চলে গেছে। আমাদের দেখতে পায়নি। জোর বাঁচা বেঁচে গেছি।
‘আসুন,’ বলল রানা।
দশ সেকেণ্ড পরে ঘরের বাইরে চলে এলাম আমরা। সেই পাইপটা বেয়ে জানালার নীচে এসে দাঁড়িয়েছি। আগুনের শিখা দেখা গেল, গুলি। চিৎকার।
‘ওই সরু পথটা দিয়ে গেলে ধরা পড়ে যাব,’ ফিসফিসিয়ে বলল রানা। ‘বেলানভ তার দলবলসহ ওখানেই আছে। আমাদের যেতে হবে সামনের গেট দিয়ে।
দূর প্রান্তে গোলাগুলি চলছে। লন ধরে তীরবেগে ছুটলাম আমরা। বাইরে বেরিয়ে আসতেও বেগ পেতে হলো না। ট্যাক্সিতে বসে রয়েছি তখন আমরা। শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এলে মুখ খুললাম আমি। ক’টা প্রশ্ন বড্ড খোঁচাচ্ছে আমাকে।
‘ওই লোকগুলো গার্ডদের ফাঁকি দিয়ে ভেতরে ঢুকল কীভাবে?’
‘খুব সোজা। সব ক’টাকে ছুরি মেরেছে। এ ধরনের কাজে চুরির বাড়া কিছু নেই। নিঃশব্দে কাজ সারা যায়। এসব দেশে এ অস্ত্রটার খুব চল।’
‘তাই হবে। কিন্তু ঘরে ঢুকে গুলি করল কে?’
‘কাউণ্টেস। সে নিশ্চিত হতে চাইছিল যে ভিজিলের ফর্মুলা জায়গা মতই আছে। সেজন্যে সেফ খুলে পরীক্ষা করে দেখেছে। খুব সম্ভব এখন আর সেফে নেই। নিরাপদ কোন জায়গায় ওটা রাখার চেষ্ট। করবে কাউন্টেস। গুলি কি লাগাতে পেরেছে বেলানভের গায়ে?’
‘আমার ধারণা হাতে লাগিয়েছে।’
চিন্তিত দেখাচ্ছে রানাকে। আমার দিকে চাইল। অদ্ভুত ওর চোখের দৃষ্টি।
‘আশ্চর্য মেয়ে,’ মৃদু গলায় বলল ও। ‘গুলি ঠিকই লাগিয়ে দিয়েছে। ওর চুলগুলো দারুণ না?’
আমি চুপ করে বসে রইলাম। প্রাণপণ চেষ্টা করছি হাসি চাপতে। এই দুঃসাহসী লোকটি প্রেমে পড়েছে।