এগারো
মে দশ-এগারো
সেদিন বিকেল। তিনটা বাজতে মিনিট পাঁচেক বাকি। রানার ঘরে পৌঁছে গেলাম আমি। উদ্গ্রীব হয়ে বসে ছিল ও। প্রায় কেড়ে নিল রিসিভার দুটো।
‘ছুরিটা সঙ্গে আছে?’ জানতে চাইল ও।
দিলাম ওটা। বিছানার পাশে যে বেলটা রয়েছে সেটার তার কেটে নিল ও। দেয়াল থেকে চার মিটারের মত তার ছিঁড়ে ফেলল।
‘ভাববেন না। পাগল হইনি আমি,’ বলল রানা। ‘ওদের কথা শুনব আমরা। সেজন্যেই দুটো রিসিভার আনতে বলেছিলাম।’
‘মাইক্রোফোন কোথায় পাবেন?’
‘দেখাচ্ছি।’
দরজা খুলল ও। আঙুল দেখাল করিডরের উল্টো দিকের দরজাটার দিকে।
‘ঘরটা রবিন্সের। ভেতরে টেলিফোন আছে। ওটাই আমাদের মাইক্রোফোন।’
বেলের তারের শেষাংশটা আমাকে দেখাল ও।
‘ওর দরজার বাইরেই টেলিফোনের তার আছে। আপনি দাঁড়ান এখানে। পাহারা দিন। কাউকে আসতে দেখলেই শিস দিয়ে সাবধান করবেন।’
করিডরের শেষ প্রান্তে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। অপেক্ষা করছি। দেখতে পেলাম টেলিফোন কেবলে কী যেন করছে রানা। করিডরের কার্পেটের তলা দিয়ে তার ঢুকিয়ে দিল ও। তারপর হাতছানি দিয়ে তার বেডরূমে ডেকে নিল আমাকে। তারের শেষ প্রান্তটা টেনে এনেছে সে। এবার দরজা বন্ধ করে দিল।
‘তারগুলো জোড়া দিলাম,’ বলল ও। রিসিভার দুটোয় এখন ওদের সব কথা শুনতে পাব।’
‘রবিন্সের টেলিফোন কি হুকে ঝোলানো?‘
মাথা নেড়ে হাসল রানা। বিজ্ঞের হাসি।
‘ও লাঞ্চ করতে যাওয়ার পর ক’টা ম্যাচের কাঠি আটকে দিয়েছি হুকের নীচে-দেখার উপায় নেই। তবে যতটুকু প্রয়োজন তোলা গেছে হুকটাকে।’
‘আর নীচের টেলিফোন অপারেটর? ওর ব্যাপারে কিছু ভেবেছেন?’
‘হ্যাঁ। হলের ক্লার্ক টেলিফোনটা ব্যবহার করে। ওকে পাঠিয়েছিলাম আমার জন্যে একটা টাইম টেবল আনার জন্যে। ও চলে গেলে ইণ্ডিকেটরে একটা পিন গুঁজে দিয়েছি। ফলে, হুকটা যে ওঠানো তা ধরার আর কোন রাস্তা নেই।’
‘রবিন্স যদি ফোন করার চেষ্টা করে?’
‘জানতেই পারব। দরজার তলা দিয়ে তার টেনে নিলেই ডিসকানেক্ট হয়ে যাবে।’
ওর প্রশংসা না করে পারলাম না।
রিসিভার দুটো শীঘ্রিই কানেক্ট করা হলো। দরজার পাশে বসে রইলাম আমরা, শোনার জন্যে।
সাড়ে তিনটার দিকে ঘরে ঢুকল রবিন্স। শুনতে পেলাম, পায়চারি করছে। তারপর নৈঃশব্দ। তিনটে পঞ্চাশের দিকে বেয়ারা ঢুকল ঘরে। রবিন্স তাকে বলে দিল কোথায় ড্রিঙ্কের ট্রে রাখতে হবে।
চারটের সামান্য পরে প্রথম লোকটিকে স্বাগত জানাল রবিন্স। ফ্রেঞ্চ ভাষায় কথা হতে শুনলাম। ভাগ্যিস রবিন্স ইক্সানিয়ান ভাষা জানে না। পরবর্তী ক’মিনিটে আরও কয়েকজন ঘরে ঢুকল। নিচু স্বরে কথাবার্তা চলছে। সাড়ে চারটের মধ্যে হাজির হয়ে গেল সবাই। শুনতে পাচ্ছি রবিন্স সবার মনোযোগ আকর্ষণ করছে। মুহূর্তে সবাই নিশ্চুপ। এবার কথা বলতে শুরু করেছে রবিন্স।
‘মাই ফ্ৰেণ্ডস,’ বলছে ও, ‘আপনারা জানেন আমি কী চাই। এটাও জানেন সেফটা কোথায় রয়েছে। এ ব্যাপারে কোন ভুল হলেই মরণ। ব্লখিন সবই বলে দিয়েছে বেলানভকে। কাজেই চিন্তার কারণ নেই। আমি শুধু কাগজগুলো চাই, আর কিছু না। টাকা-পয়সা বা গয়নাগাটি যা-ই পাওয়া যাক না কেন সেটা আপনাদের। আপনারা ভাগাভাগি করে নেবেন। টাকার খাঁই নেই আমার।’
বলে চলেছে রবিন্স, ‘পেমেন্টের অর্ধেকটা পাবেন এখন। বাকিটা পাবেন বেলানভ কাগজগুলো আমাকে ডেলিভারি দেয়ার পর।’
বিড়বিড় করে অসন্তোষ প্রকাশ করছে লোকগুলো। কিন্তু মসৃণভাবে বলে চলেছে রবিন্স:
‘পেমেন্ট ক্লিয়ার করার আগে আমার এক্সপার্টকে দিয়ে কাগজগুলো পরীক্ষা করিয়ে নেয়া হবে। সে অবশ্য জোভোগোরোডেই আছে।’
পিন পতন নিস্তব্ধতা। বলছে রবিন্স: ‘কাগজ হাতে পেলেই সোজা আমার কাছে চলে আসবে বেলানভ; ধরুন রাত দুটো নাগাদ। তারপর আমার সঙ্গে এখানেই থাকতে পারে সে, আমাকে পাহারা দেয়ার জন্যে। আমি যাতে পালিয়ে যেতে না পারি সেটা দেখবে ও। আরেকটা কথা, খুব দরকার ছাড়া খুনোখুনি করতে যাবেন না। ব্যস, আমার কথা শেষ। টাকাটা আমি…’
আর শোনা গেল না। রানা তার টেনে নিয়েছে। ঘরে চলে এসেছে ওটা।
‘কুইক,’ বলল ও, ‘ওরা বেরিয়ে আসার আগেই ক্যাফেতে চলে যাব আমরা। আমি চাই না রবিন্স আপনাকে এখানে দেখুক।’
পকেটে তার ঢোকাল রানা। আর আমি রিসিভার দুটো ওভারকোটের পকেটে রেখে দিলাম। ট্যাক্সি নিয়ে সোজা কুডবেক। রানার চাপাচাপিতে একটা টেলিফোন বক্সে রেখে দিয়ে এলাম রিসিভার দুটো। তারপর গিয়ে বসলাম ক্যাফেতে।
কফি পান করতে-করতে পরবর্তী পরিকল্পনার কথা আলাপ করে নিলাম।
‘বুখিন নিশ্চয়ই সেফের দরজা খোলার নম্বর বলে দিয়েছে ওদের,‘ বলল রানা। ‘কেউ যাতে বোমা বানাতে না পারে সেটা দেখাই আমাদের প্রথম কাজ। প্রতিটি কপি নষ্ট করে ফেলতে হবে। ভিজিলের দায়িত্ব আপনি আমার ওপর ছেড়ে দিতে পারেন।’
‘আমার মনে হয়, রানা, বললাম, ‘খুব বেশি ঝুঁকি নিয়ে ফেলছেন আপনি। ব্যাপারটা আন্তর্জাতিক। তা ছাড়া পলিটিক্সে জড়ানো আমার ঠিক হবে না।’
ওকে বোঝাতে চাইলাম সংখ্যায় আমরা খুবই কম। সাহায্য ছাড়া এক পা-ও আগে বাড়া অসম্ভব।
এক মুহূর্ত ভাবল রানা।
‘ঠিকই বলেছেন। আপনার কথা মানতেই হবে। সাহায্য দরকার আমাদের। আলেন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।’
জানালাম, আলেন্দে দেখা করতে আগ্রহী নয়। শান্তভাবে খবরটা হজম করল রানা।
‘সময় আসুক,’ বলল ও, ‘ঠিকই লাইনে এনে ফেলব ওকে।’
আমার সন্দেহ আছে। চাইলে তর্ক করতে পারতাম। করলাম না।
‘আমরা মাত্র দু’জন। দশজনকে ঠেকাব কীভাবে? আমাদের উপস্থিতি জানতে পারলেই তো খতম করে দেবে।’
‘একটা বুদ্ধি আছে,’ সহজ গলায় বলল রানা। কাউণ্টেসের বাড়ির বর্ণনা দিল ও। আজ সকালে দেখে এসেছে। তার মতে, খুব সহজেই ঢোকা যাবে ও বাড়িতে।
‘সুখবর,’ বললাম আমি, ‘কিন্তু রবিন্সের অতগুলো লোকের সঙ্গে এঁটে উঠবেন কীভাবে?’
সামনে ঝুঁকে পড়ল রানা। একনাগাড়ে মিনিট দশেক কথা বলে গেল। ওর কথা শেষ হলে ডাঙায় আটকা পড়া মাছের মত অবস্থা হলো আমার। দুর্দশাগ্রস্ত। লোকটার প্রতি আর ভরসা রাখতে পারছি না। ‘ওভাবে পার পাবেন ভেবেছেন?’ তিক্তকণ্ঠে জানতে চাইলাম। ‘কেন নয়?’ বিস্মিত দেখাচ্ছে তাকে।
‘সরি, রানা। আমাকে বাদ দিতে হবে। ঝুঁকি নিতে আপত্তি নেই আমার। কিন্তু আপনার প্ল্যান অনুযায়ী চললে সোজা জেলে যেতে হবে।’
হাসল ও।
‘বেশ, একাই যাব আমি।’
হঠাৎই মেজাজ চড়ে গেল আমার। ওর প্ল্যানটা স্রেফ পাগলামি। সাধ্যমত বাধা দিয়েছি, যুক্তি দেখিয়েছি, কিন্তু কোনই কাজ হয়নি।
‘যা আছে কপালে,’ বেপরোয়া হয়ে উঠলাম আমি, ‘আমরা রওনা হচ্ছি কখন?’