প্রথম পর্ব – এক
এপ্রিল সতেরো
দুপুর সাড়ে বারোটা। ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন ডক্টর পাশা। ক্লান্ত হওয়ারই কথা। ইতোমধ্যে প্রায় তিনশো কিলোমিটার পাড়ি দিয়েছেন, গাড়ি চালিয়ে। ঘণ্টাখানেক বাদে লন্সটনের দ্য রয়্যাল ক্রাউন হোটেলের বিশাল চত্বরে প্রবেশ করল তাঁর গাড়ি। নেমে এসে আড়মোড়া ভাঙলেন ডক্টর। লক করলেন দরজাগুলো পরী দাবি
স্ত্রী নিপুণ হাতে কাজটা সারলেন ডক্টর। তীক্ষ্ণ চোখজোড়া জরিপ করে নিল চারপাশটা। ধূসর স্যুটে চমৎকার মানিয়েছে তাঁকে। ভদ্রলোক সবারই শ্রদ্ধাভাজন। তাঁর বক্তৃতা শুনে তাক লেগে যায় শ্রোতাদের। আবেগকে মোটেই পাত্তা দেন না তিনি। যা বলার যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে বলেন।
এ মুহূর্তে তাঁর কল্পনায় ভেসে উঠল হোটেলের চমৎকার একটা ঘর—নরম বিছানা। কী দরকার গাড়ি নিয়ে দাবড়ে বেড়ানোর? এখানেই তো বিশ্রাম নেয়া যায়। পরমুহূর্তেই চিন্তাটাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করলেন তিনি। হোটেলে ঢুকে স্টেইকের অর্ডার দিলেন। ইত্যবসরে পান করলেন এক কাপ কফি।
হঠাৎই মনে পড়ে গেল অতীত দিনের কথা। কেমব্রিজে পড়ার সময় গুপ্তচর হওয়ার খুব শখ হয়েছিল তাঁর। নিজেকে হিরো, কল্পনা করতে সে সময় কী ভালই না লাগত। গোপন মিশন নিয়ে কোন দেশে ঢুকে পড়া, অ্যাডভেঞ্চার, মৃত্যুর ঝুঁকি …
স্টেইক খেতে-খেতে যৌবনের সেই দিনগুলোর কথা ভাবছেন ডক্টর। ডাইনিংরুমটা ফাঁকাই প্রায়, কেবল একজন মোটা মত, সাদা চুলের লোক লক্ষ করছে তাঁকে। সতর্ক চোখে।
‘লাভলি ডে, স্যর,’ চোখাচোখি হতেই বলে উঠল লোকটি।
‘হ্যাঁ,’ বললেন ডক্টর হিরন পাশা। তারপর ভদ্রতার খাতিরেই যোগ করলেন, ‘চমৎকার দিন।’
কথা বাড়ানোর কোন ইচ্ছে নেই ডক্টরের। কিন্তু পাকাচুলো নাছোড়বান্দা।
‘লন্সটনে থাকবেন নাকি, স্যর?’
মাথা নাড়লেন ডক্টর।
‘ট্রুরোতে যাচ্ছি। আপনি কি এই হোটেলেই আছেন?’
অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়ল লোকটি। তারপর খানিকক্ষণ ভাবল কী যেন। হঠাৎই নিজের চেয়ারটা নিয়ে এল ডক্টরের টেবিলে। ঝুঁকে পড়েছে।
‘ছ’মাস আগে চীনে ছিলাম আমি। তার আগে সাউথ আমেরিকায়, তারও আগে তুরস্কে। গত ছ’বছর ধরে ইংল্যাণ্ডের বাইরে কাটিয়েছি। প্রতিটা মুহূর্তে অপেক্ষা করেছি দেশে ফেরার জন্যে। ভেবেছিলাম ইংল্যাণ্ডে ফিরে এসে আর নড়াচড়া করব না। কিন্তু তা বোধহয় আর হলো না। মাসখানেক আগে দেশে ফিরেছি, আর এরমধ্যেই বোর হয়ে গেলাম—’
‘রিটায়ার করেছেন?’ মাঝপথে জানতে চাইলেন ডক্টর।
লোকটি নিশ্চুপ। চেয়ে রয়েছে ডক্টরের দিকে, ঠাণ্ডা চোখে। ‘স্যর,’ বলল লোকটি, ‘আপনাকে আগে কোথায় দেখেছি বলুন তো?’
‘বছরখানেক আগে,’ জবাবে বললেন ডক্টর, ‘পত্রিকায় আমাকে নিয়ে খুব লেখালেখি হয়েছিল। খামোকা। তখনই দেখেছেন হয়তো।’
‘ও হ্যাঁ, হ্যাঁ!’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল লোকটি, ‘মানুষের চেহারা সহজে ভুলি না আমি। কিন্তু নাম…কী যেন নাম…এক মিনিট…অ্যাঁ…পাশা …ডক্টর পাশা। আপনি তো, স্যর, সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন-আপনি বলেছিলেন নিউক্লিয়ার এনার্জিকে মানুষের কাজে-অকাজে দুটোতেই লাগানো যায়। তাই না?’
‘মোটেই না,’ দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন ডক্টর। ‘আমি বলেছিলাম নিউক্লিয়ার এনার্জি নিয়ে বেশি মাতামাতি করলে ক্ষতির সম্ভাবনা আছে।’
‘কফি খাবেন?’ জানতে চাইল লোকটি।
‘খেয়েছি।’
‘আবার খান।’
কফির অর্ডার দিয়েছে লোকটি। কফি পান করতে-করতে উৎসুক শ্রোতাকে নিজের দৃষ্টিভঙ্গির কথা বর্ণনা করতে ভালই লাগছে ডক্টরের। লোকটির নামও জেনে নিয়েছেন। হ্যামণ্ড রবিন্স। রবিন্স কথার রাজা। বিদেশনীতির ব্যাপারে প্রচুর জ্ঞান তার। রবিন্সের পেশা কী জানার জন্যে কৌতূহলী হয়ে উঠলেন ডক্টর। আবার কোন রিপোর্টার নয়তো? শেষমেশ রবিন্স নিজেই কৌতূহল মেটাল। জানাল ডক্টরের প্রতি তার আগ্রহের কারণ:
‘গানস অ্যাণ্ড ব্লিস-এর নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই? পৃথিবীর বড় কয়েকটা অস্ত্র কোম্পানির একটা। ম্যানুফ্যাকচারার।’ সামান্য থামল রবিন্স। ‘আপনাকে কথা দিতে হবে, আমাদের আলোচনার ব্যাপারে কাউকে কিছু জানাবেন না।’
‘বেশ, কথা দিলাম।’
চুরুটে লম্বা টান মারল রবিন্স।
‘একটা কথা কি জানেন, মানুষকে কোন বিশ্বাস নেই। কিছু একটা আবিষ্কার করলেই হলো, সেটার খারাপ দিকটাই সবার আগে কাজে লাগাতে চায়। হিরোশিমা-নাগাসাকিতে যেমন অ্যাটম বোমা ফেলে দিল।’
‘সায়েন্স কিন্তু গড়তে চায়, ধ্বংস চায় না,’ কঠিন শোনাল ডক্টরের গলা। ‘অতীতে সায়েন্সের অপব্যবহার হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সায়েন্স এখন নিজেকে প্রটেক্ট করতে শিখেছে।’
মাথা নাড়ল রবিন্স।
কথাটা ঠিক নয়, ডক্টর। বিজ্ঞানীরাই তো বিজ্ঞানকে কন্ট্রোল করে। ক্ষমতার মোহ সবারই আছে। অনেক ছোটখাট দেশও এখন সুপার নিউক্লিয়ার বোমা বানাচ্ছে।
সন্দেহ হলো ডক্টরের। লোকটা তাঁকে এসব কথা শোনাচ্ছে কেন? উদ্দেশ্যটা কী?
স্থির দৃষ্টিতে রবিন্সকে তাঁর দিকে চেয়ে থাকতে দেখে হেসে ফেললেন ডক্টর।
‘জানি। কিন্তু কারা বানাচ্ছে বলুন তো?’
তার আগে, শান্তস্বরে বলল রবিন্স, ‘একটা প্রশ্ন করি—আচ্ছা, দুনিয়ার বিখ্যাত কয়েকটা ল্যাবোরেটরির নাম করুন তো?
কয়েকটা নাম বললেন ডক্টর।
‘হলো না, ডক্টর। ওগুলোর একটাতেও ওসব বোমা তৈরি হচ্ছে না। জোভোগোরোডের নাম শুনেছেন? শোনেননি বোধহয়। জোভোগোরোড হচ্ছে ইক্সানিয়ার রাজধানী। ওখানেই তৈরি হচ্ছে বোমা।’
হাসলেন ডক্টর।
‘বোমা তৈরিতে যে খরচ পড়বে তাতে ইক্সানিয়ার তো দেউলিয়া হয়ে পড়ার কথা।’
‘আমি তামাশা করছি না, ডক্টর,’ অসহিষ্ণু শোনাল রবিন্সের কণ্ঠ। ‘ইক্সানিয়া যদিও খুব একটা উন্নত দেশ নয়, তবে ওরা খুবই উচ্চাকাঙ্ক্ষী। এতদিন ওরা অন্যান্য ধনী দেশগুলোকে হিংসে করে এসেছে, কিন্তু এখন উল্টে গেছে ছক। ইউরোপের অনেক দেশই ঈর্ষা করতে শুরু করেছে ওদের।
‘কেন?’
‘একজন লোকের জন্যে।’
আগ্রহী হলেন ডক্টর। ঝুঁকলেন সামনে।
‘কে সে?’
ভ্রূ কুঁচকে চুরুটটার দিকে চেয়ে রইল রবিন্স।
‘তার সম্বন্ধে জানা যায়নি বড় একটা,’ বলল সে। জুরিখ আর বন ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করেছে লোকটি। মেধাবী ছাত্র ছিল। বন থেকে শিকাগোতে গিয়েছিল। ওখানে প্রায় বছর ছয়েক কাজ করেছে। তিন বছর আগে শিকাগো থেকে ফিরে গিয়েছে জোভোগোরোডে। তার নাম ভিজিল।
‘ভিজিল, বিড়বিড় করে বললেন ডক্টর। ‘নাম শুনেছি। ওর একটা আর্টিকেল পড়েছিলাম। খুবই সাধারণ মানের লেখা। ও কি নিউক্লিয়ার বোমা বানাচ্ছে নাকি?’
‘বানিয়ে ফেলেছে। তিন সপ্তাহ আগে মহড়াও দিয়েছে, জোভোগোরোডের একশো কিলোমিটার উত্তরে। গানস অ্যাণ্ড ব্লিসের একজন প্রতিনিধি ছিল সেখানে-অবশ্যই ছদ্মবেশে। যে পাহাড়ে মহড়া হয়েছে সেটার অবস্থা কাহিল। পঞ্চাশ হাজার টন পাথর ছিটকে পড়েছে চারদিকে। সেটা অবশ্য কিছুই নয়। ওরা যে বোমা বানাচ্ছে তার একশো ভাগের মাত্র এক ভাগ শক্তির একটা বোমা ফাটিয়েছে।’
‘বলেন কী!’ বিস্মিত দেখাচ্ছে ডক্টরকে। ‘তবে তো অনেক দূরই এগিয়েছে। ভয়ঙ্কর!’
‘তাতে কোন সন্দেহ নেই,’ বলল রবিন্স। ‘পারমাণবিক বোমার চরম উৎকর্ষ সাধন করেছে ওরা। ইউরোপ এমনকী আমেরিকাকে পর্যন্ত নাড়িয়ে দিতে পারবে।
ডক্টর নির্বাক। জানালার ওপাশে হোটেলের বাগান। সেদিকে চোখ তাঁর। বসন্তের বিকেল। ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে। ডক্টরের হঠাৎ মনে হলো দুঃস্বপ্ন দেখছেন। চমকে উঠলেন তিনি। কাঁপছেন।
‘আমাকে এসব কথা শোনালেন কেন? আমাকে তো আপনি বলতে গেলে চেনেনই না।’
আরেকটু ঝুঁকল রবিন্স।
কিছুদিন আগে ইক্সানিয়া সরকারের এক দূত এসেছে ইংল্যাণ্ডে। এসে বলল, মেশিনারি কিনবে; একটা ফুড ফ্যাক্টরির জন্যে। গানস অ্যাণ্ড ব্লিসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে সে। লোকটি হয় খাবার তৈরির ফ্যাক্টরি সম্পর্কে কিছুই জানে না আর না হয় যন্ত্রপাতিগুলো অন্য কাজে লাগাবে। আমরা জানি কলকাঠি নাড়ছে গুরুত্বপূর্ণ কেউ একজন। টাকা কোন ব্যাপার নয় তার কাছে। ওদের সঙ্গে অবশ্য চুক্তি করা হয়েছে। ফলে ভিজিলকে অন্তত কিছুদিন ঠেকিয়ে রাখা যাবে। যন্ত্রপাতি সাপ্লাই দিতে সময় নেয়া হবে। আর সেই ফাঁকে প্রয়োজনীয় তথ্য আদায়ের চেষ্টা করব আমরা। ডক্টর, আমি আপনাকে একটা প্রস্তাব দিতে চাই। তার আগে আমার পরিচয়টা খোলসা করি: আমি গানস অ্যাণ্ড ব্লিসের ফরেন রিপ্রেজেন্টেটিভ। কোম্পানির একজন ডিরেক্টরও বটে।’
ধীরে-ধীরে মাথা নাড়লেন ডক্টর। রবিন্সকে এখন ঝানু ব্যবসায়ীর মত দেখাচ্ছে।
‘আমার প্রস্তাবটা হচ্ছে: ইক্সানিয়ান দূতকে ফলো করার জন্যে অপেক্ষা করছি আমি। সে জোভোগোরোডে রওনা হলেই ফলো করব। ইক্সানিয়ায় লোকজুন আছে আমার। তারা লক্ষ রাখবে দূতটির ওপর। জানতে চেষ্টা করবে কে রয়েছে ওর পেছনে। ইক্সানিয়ার সরকারের কাছ থেকে আসল তথ্য বার করা যাবে না। কাজটা এলেবেলে নয়, সেজন্যেই একজন টেকনিকাল অ্যাডভাইজার দরকার আমাদের। নিউক্লিয়ার এনার্জি সম্পর্কে ভিজিল ছাড়া আর যাঁর ওপর নির্ভর করা যায় তিনি হচ্ছেন আপনি। ডক্টর পাশা, আমি আপনাকে সঙ্গে করে জোভোগোরোডে নিয়ে যেতে চাই। আপনি আমাদের কোম্পানির টেকনিকাল অ্যাডভাইজারের পোস্টটা নিন, প্লিজ।’
পরিস্থিতি বুঝে উঠতে খানিকটা সময় ব্যয় করলেন ডক্টর।
‘তাই বলুন,’ শেষ পর্যন্ত বললেন তিনি।
‘চিন্তা করবেন না,’ ধীর গলায় বলে চলেছে রবিন্স, ‘আপনার কথা কেউ জানতে পারবে না। গোপনে কাজ করবেন আপনি। যত টাকা চান পাবেন।’
‘যদি আপনার প্রস্তাবে রাজি না হই?’
‘হবেন, ডক্টর। আমি জানি রাজি হবেন। মানবতার স্বার্থে রাজি না হয়ে উপায় নেই তো। ভাবুন একবার, ইউরোপের ছোট্ট একটা দেশ যদি পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হয় তবে কী ভয়ঙ্কর ব্যাপারটাই না ঘটবে। আপনি রাজি হলে বিজ্ঞান আর সভ্যতা দুটোই উপকৃত হবে, ডক্টর।’
উঠে দাঁড়ালেন দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ডক্টর। কাটা-কাটা কথায় বললেন, ‘মিস্টার রবিন্স, আগেই বলেছি সায়েন্সকে আর ইচ্ছেমত অপব্যবহার করা যাবে না। আবারও বলছি সে কথা। আপনি আমাকে সায়েন্স আর মানবজাতির উপকার করতে বলছেন-আমি শুদ্ধ করে দিচ্ছি। আসল ব্যাপার হচ্ছে, আপনি গানস অ্যাণ্ড রিসের অংশীদারদের স্বার্থ দেখছেন—মানুষের নয়। আপনারা নিজেরাই বোমা বানাতে চান, আমাকে পেলে আপনাদের উপকার হয়, তাই না? জেনে রাখুন, আপনার প্রস্তাবে রাজি নই আমি।’
হেসে উঠল রবিন্স।
‘মত আপনি পাল্টাবেনই, ডক্টর, আমার ভাল মতই জানা আছে। আমাদের জন্যে যদি কাজ না-ও করেন তবু মানবতার আবেদনকে আপনি পায়ে ঠেলতে পারবেন না।’
শক্ত হলো ডক্টর পাশার চোয়াল।
‘সামান্যতম সম্ভাবনাও নেই, মিস্টার রবিন্স, কঠিন শোনাল ডক্টরের গলা।