মামা-ভাগ্নীর স্বপ্নভঙ্গ
কর্নেল বিকেলে ছাদে গিয়ে একটা ক্যাকটাসের দিকে মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। অ্যারিজোনার মরু অঞ্চল থেকে সংগৃহীত ব্যারেল ক্যাকটাস। দেখতে ব্যারেল বা পিপের মতো। বাংলার কোমল জলবায়ুতে কিছুদিন কষ্ট পাওয়ার পর এখন সামলে উঠেছে। মাথায় গোলাপী মুকুট পরে নিয়েছে। কাটাগুলোর রঙেও সবুজের ঘোর লেগেছে। তবু চেহারা দেখে হাসি পায়। যেন ইউরোপের মধ্যযুগের সেই রাজসভার ভড়। পেটমোটা কুমড়োপটাস। কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, না ডার্লিং! তোমাকে বরং বলা যাক্ গাগাঁতুয়া পাতাগ্রুয়েল। কী? খুশি তো?
ষষ্ঠী এসে দেখল, বাবামশাই বিড় বিড় করে কী বলছেন আর হাসছেন। আজকাল কী যেন হয়েছে ওঁর। মাথার গণ্ডগোল হয়নি তো? সে খুক করে কাসল।
কর্নেল ঘুরে তাকে দেখতে পেয়ে বললেন, ষষ্ঠী, মজা দেখে যা।
বাবামশাই, এক ভদ্রলোক এয়েছেন। সঙ্গে মেয়েছেলেও রয়েছেন।
কর্নেল ভুরু কুঁচকে তাকালে ষষ্ঠী ঝটপট বলল, মাথায় নম্বা-লম্বা চুল, মোটা করে। আর মেয়েছেলেটা কেমন যেন জংলি-জংলি ভাব। গেরামের মেয়েছেলের মতো। কেমন যেন
কর্নেল নেমে গিয়ে ড্রইংরুমে ঢুকলেন। আরে! বনবিহারীবাবু যে! বলে ওঁর পাশে বসে থাকা ঊনিশ-কুড়ি বছর বয়সের এবং সত্যিই জংলি-জংলি ভাবের মেয়েটির দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। সম্ভবত আপনার ছোট ভাগ্নী অপালা?
বনবিহারীবাবুও হাসলেন। আপনার চোখকে ফাঁকি দেওয়া কঠিন স্যার!
মৃগাঙ্কবাবুকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে শুনেছেন, কি?
শুনেছি। ডি সি সায়েবের কাছ থেকেই আসছি। উনি আপনার কাছে আসতে বললেন।
কর্নেল অপালাকে সস্নেহে বললেন, তুমি কখন এসেছ?
অপালা লজ্জিতভাবে মুখ নামিয়ে বলল, আজ ভোরবেলা।
বোঝা যাচ্ছিল, সে যথেষ্ট আড়ষ্ট হয়ে রয়েছে। বনবিহারীবাবু বললেন, প্রথমে ডি সি সায়েবের কাছে ওকে সঙ্গে করে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, ওঁরা যদি বিহার পুলিসকে একটু বলে দেন তাতে কাজ হবে। কিন্তু ডি সি সায়েব বললেন, কিছু দরকার নেই। কর্নেলসায়েব হয়তো সেতাপগঞ্জ যাবেন। ওঁকে বলুন।
কর্নেল চুরুট জ্বেলে বললেন, নতুন কিছু ঘটেছে ওখানে?
ঘটেছে মানে–অপালা এসে যা বলল, তাতে তো আমি হতভম্ব হয়ে গেছি। প্রথমে বিশ্বাস করতেই পারিনি, মানুষ এমন জানোয়ার হতে পারে। আপনাকে ইন্দু ভটচায়ের কথা বলেছিলাম। এখন বুঝতে পারছি, রুদ্রদাকে সেই খুন করেছে। দুধ দিয়ে কালসাপ পুষে গেছে রুদ্রদা! বনবিহারীবাবু উত্তেজিতভাবে বললেন, তার এমন সাহস যে সে অপুর গায়ে হাত ওঠায়?
মারধর করেছে বুঝি?
চোখ জ্বলে উঠলে বনবিহারীবাবুর। ইন্দু হারামজাদা অপুকে বিয়ে করতে চায়! স্পর্ধাটা দেখুন একবার। অপুর বাপের বয়সী ব্যাটা! নেমকহারাম! আবার বলেছে, আমার নাকি এতে সায় আছে। বুঝুন!
কর্নেল অপালার দিকে তাকালেন। অপালা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। অনেকদিন থেকে আমার পেছনে লেগেছে ইন্দুকাকা। বাবা খুন হওয়ার পর থেকে। আমার। শরম বাজত। তাই কাউকে কিছু বলিনি। কাল দয়ালদা চুপি চুপি বলল, মামার কাছে চলে যাও। নইলে বিপদ হতে পারে।
কে দয়াল?
বনবিহারীবাবু বললেন, রাঁধুনি। একমাত্র ওই লোকটাই খাঁটি মানুষ ওদের বাড়িতে।
অপালা চোখ মুছে বলল, আর মনিয়াও ভাল। সে না থাকলে বড়দি মরে যেত।
কর্নেল চোখ বুজেছিলেন। হঠাৎ চোখ খুলে বললেন, তুমিই তোমার বাবার একটা চিঠি পোস্ট করেছিলে কি অপালা–আমার নাম-ঠিকানা লেখা চিঠি?
অপালা আস্তে বলল, হ্যাঁ। চিঠিটা বাবার বিছানার তলায় পেয়েছিলাম। খামের মুখ আঁটা ছিল। ভাবলাম, চিঠিটা বাবা পোস্ট করতে ভুলে গিয়েছিল।
তুমি জানতে না চিঠিতে কী, লেখা আছে?
কর্নেলের চোখের দিকে তাকিয়ে অপালা মুখ নামালো। তেমনি মৃদুস্বরে বলল, খামটার মুখ জলে ভিজিয়ে খুলেছিলাম। তখন অতকিছু বুঝতে পারিনি। ভাবছিলাম, বাবা তো খুন হয়ে গেছেন। আর কী হবে চিঠিটা পাঠিয়ে? তারপর মেজদি খুন হবার খবর পেলাম। তখন খামটা এঁটে পোস্ট করে দিলাম।
তোমার কাকে সন্দেহ হয়, অপালা? তোমার বাবাকে কে খুন করেছে মনে হয়?
বনবিহারীবাবু কী বলতে ঠোঁট ফাঁক করলেন। কর্নেল ইশারায় তাকে থামিয়ে বললেন, বলো, অপালা!
অপালা বলল, ইন্দুকাকা।
ষষ্ঠী যথারীতি কফি ও স্ন্যাক্স রেখে গেল। কর্নেল কফির পেয়ালা এগিয়ে দিলেন অপালার দিকে। অপালা অনিচ্ছা-অনিচ্ছা করে চুমুক দিল। বনবিহারীবাবু বললেন, ওকে ইন্দু একেবারে জংলি করে ফেলেছে ছোটবেলা থেকে। রুদ্রদা তো কিছু দেখতেন না। শুধু জমিজমা, মামলা-মোকদর্মা আর হাঙ্গামা।
কর্নেল বললেন, যে রাতে তোমার বাবা খুন হন, তখন তুমি কোথায় ছিলে?
অপালা বলল, পাশের ঘরে। ভোরবেলা রোজ বাগান থেকে ফুল এনে বাবাকে দিই। বাবা ফুল ভালবাসতেন। যাবার সময় কিছু লক্ষ্য করিনি। ফুল। এনে দেখি, বাবার ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে একটা হাত দেখা যাচ্ছে। ভাবলাম, বাবা দরজা খুলতে এসে পড়ে গেছেন। তারপর কপাট ঠেলে দেখি, বাবা চিত হয়ে পড়ে আছেন। গলায় চাপচাপ রক্ত।
সেরাতে কোনো সন্দেহজনক কিছু ঘটেছিল? কোনো শব্দ শুনেছিলে?
না। আমার ঘুমটা খুব বেশি।
তোমার বাবা পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী ছিলেন?
হ্যাঁ। একটুও চলাফেরা করতে পারতেন না। বিছানা ছেড়ে নামতেও পারতেন না। আমি থাকলে আমিই বাবার মুখ ধুইয়ে গা মুছিয়ে দিতাম। খাইয়ে দিতাম। আমি না থাকলে দয়ালদা বা মনিয়াই ওসব করত।
তুমি কোথায় থাকতে?
প্রায় সারাটাদিন আমাদের ফার্মে। ইন্দুকাকা যেতে বলত। আমার ভালও লাগত যেতে। ফিরতাম সন্ধ্যাবেলায়।
হুঁ–তোমার বাবা বিছানা ছেড়ে নামতে পারতেন না বলছ। তাহলে কেমন। করে তিনি দরজা খুলেছিলেন?
অপালা একটু চুপ করে থেকে বলল, পরে আমার অবাক লেগেছিল। কারণ, বাবার ঘরের দরজা ভেতর থেকে আমি রোজ বন্ধ করে দিতাম। ও ঘরের ভেতর দিয়ে আমার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়তাম। বাবার ঘর আর আমার ঘরের মাঝের দরজাটা খোলা থাকত। ভোরে যখন বেরুতাম, তখন আমার ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় যেতাম। বারান্দার মুখেই সিঁড়ি। বাবার ঘুম হয় না সারা রাত। ভোরে একটু ঘুমোন। বাগান থেকে ফুল এনে আমার ঘর হয়ে বাবার ঘরে ঢুকতাম। বাবা জেগে উঠলে তখন ওঘরের দরজা আমিই খুলে দিতাম।
তুমিই বাবার ডেডবডি প্রথম দেখেছিলে?
হ্যাঁ। বাড়িতে তখনও সবাই শুয়ে।
কে কোথায় শুয়ে?
আমি আর বাবা ওপরতলায়। ইন্দুকাকা, বড়দি, শ্যামা, দয়ালদা, মানিয়া– সবাই নিচের তলায় যে যার ঘরে। এখন ইন্দুকাকা বাবার ঘরটা দখল করেছে।
বাবার গলায় রক্ত দেখেছিলে। টাটকা রক্ত, না জমাটবাঁধা রক্ত?
টাটকা রক্ত। তখনও চুঁইয়ে পড়ছিল।
তোমার মনে হয়নি তুমি বেরিয়ে যাওয়ার পর কেউ ওঁকে খুন করেছে।
তখন কিছু মাথায় আসেনি। এখন আপনি বললেন বলে তাই মনে হচ্ছে।
তাহলে তো তোমার ঘর দিয়ে ঢুকে ওঁকে খুন করতে পারে?
বনবিহারী কান করে শুনছিলেন। হু। তাই করেছিল। আমি গিয়ে সব শোনার পর পুলিশকে সেটাই সাজেস্ট করেছিলাম। ওখানকার পুলিশ বড় অদ্ভুত। পাত্তাই দিল না আমাকে। ওদের মাথায় রঘুয়া ঢুকে বসে আছে।
তুমি বাগান থেকে ফুল আনার সময় যখন বাড়ি ঢুকেছিলে কাউকে দেখতে পাওনি?
না। সবাই শুয়েছিল তখনও। অত ভোরে আমাদের বাড়ির কেউ ওঠে না।
তোমার বড়দি–
অপালা দ্রুত বলল, তার কিছুদিন আগে একরাত্রে বড়দি বাবার দরজায় জোরে ধাক্কা দিচ্ছিল আর খারাপ-খারাপ কথা বলে বাবাকে গাল দিচ্ছিল। আমি বাবার ডাকাডাকিতে জেগে গেলাম। বাবার ঘরের দরজা খুলে দেখি, বড়দি একটা লম্বা ছুরি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছুরি মারতে এল আমাকে। আমি ওর হাত ধরে ছুরিটা কেড়ে নিয়ে ফেলে দিলাম। বড়দিকে ধাক্কা দিলাম। বড়দি পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। কিন্তু কথাটা কাউকে বলতে বারণ করেছিল ইন্দুকাকা। শুধু কলকাতা এসে মেজদিকে বলেছিলাম।
ইন্দুবাবু বারণ করেছিলেন?
হুঁ। বড়দির হাতে অনেকসময় ওই ছুরিটা দেখতে পেতাম। কেড়ে নিতে গেলে অজ্ঞান হয়ে যেত। তাই ইন্দুকাকা আমাকে বকত। বলত, কেন ওকে ঘাঁটাতে যাচ্ছিস? যা খুশি করুক না।
তোমার বাবা খুন হওয়ার পর তোমার বড়দির রি-অ্যাকশন কী হয়েছিল?
বড়দি সবার সঙ্গে ওপরে এসে বাবাকে দেখেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।
যখন সুস্থ থাকত, তখন কিছু বলত না তোমাকে বাবার সম্পর্কে?
কৈ, তেমন কিছু বলে অপালা ঢোক গিলল। হ্যাঁ–একদিন মন্দিরতলায় গিয়ে বসেছিল। ডাকতে গেলাম। তখন হঠাৎ বলল, অপু, তুই পালিয়ে যা শিগগির! নইলে তোর গলা কেটে ফেলবে। কে গলা কাটবে, কিছুতেই বলল না। তারপর থেকে আমি রাত্রে ভাল করে দরজা এঁটে শুতাম। কেউ কোনো কারণে ডাকলেও দরজা খুলতাম না।
বনবিহারীবাবু বললেন, লজ্জা করিসনে। ইন্দু ব্যাটার ব্যাপারটা বল্ ওঁকে!
অপালা মুখ নামিয়ে বলল, ইন্দুকাকা রোজ রাতে আমার ঘরের দরজা নক করতেন। পরশু রাতেও খুব জ্বালাচ্ছিলেন। আমি দরজা খুলিনি।
কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, তোমাদের বাড়িতে রাত্রে ঢিল পড়ত শুনেছি?
হ্যাঁ। বড়দি বদমাইসি করত।
বনবিহারীবাবু অবাক হয়ে বললেন, খুকু ঢিল ছুড়ত? কৈ, বলিসনি তো?
বলে কী লাভ? বড়দি তো ওইরকমই চিরদিন। ওর যত রাগ ছিল বাবার ওপর। রাত্তিরবেলা নিচে থেকে বাবার ঘরের দিকে ঢিল ছুঁড়ত। বাবা চেঁচামেচি করতেন।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, তোমাদের বাগানে পাথরের মূর্তিটা নাকি চলাফেরা করে বেড়ায় রাত্রিবেলা?
অপালা বলল, সেও বড়দির কাণ্ড। মূর্তিটার পায়ের কাছে রাতদুপুরে গিয়ে বসে থাকত। কেউ খুঁজতে গেলেই লুকিয়ে যেত। সবাই ভাবত বুঝি মূর্তিটা জ্যান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এক রাত্রে বাবাও সেই ভুল করে বন্দুক নিয়ে। দৌড়ে গিয়েছিলেন। আছাড় খেয়ে প্যারালেসিস হয়েছিল।
আচ্ছা বনবিহারীবাবু, রুদ্রেন্দুবাবু কি কোনো উইল করে গেছেন?
বনবিহারীবাবু বললেন, উইল করবেন বলে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। আমি যাবার আগেই তো খুন হয়ে গেলেন।
তাহলে ওঁর সব সম্পত্তি প্রচলিত আইনে তিন মেয়েই পাবে?
হ্যাঁ। তার মানে, মেয়েদের বিয়ে হলে কার্যত তাদের স্বামীরাই মালিক হবে।
তাহলে মৃগাঙ্ক ব্যানার্জি এক-তৃতীয়াংশের মালিক হয়ে গেছে?
হয়েছে বৈকি। বনবিহারীবাবু গলার ভেতর বললেন। তবে মৃগাঙ্ক তো এখন খুনের আসামী। তাছাড়া বিহারমুল্লুকে গিয়ে সম্পত্তি দখলের হাঙ্গামা সামান্য নয়। ইন্দু ব্যাটাচ্ছেলে বাগড়া দেবার জন্য তৈরি আছে। ওই লোকটা থাকতে কারুর সাধ্য নেই ওখানে গিয়ে নাক গলায়। ক্রমশ খুঁটি গেড়ে বসে গেছে যে।
কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট ধরিয়ে ধোঁয়ার মধ্যে বললেন, ঠিক আছে। অপালা আপাতত আপনার কাছেই থাক। আমি আগামীকাল সেতাপগঞ্জ রওনা হব, ভাবছি। আশা করি, একটা ফয়সালা হয়ে যাবে।
বনবিহারীবাবু করজোড়ে বললেন, মা-বাবা হারা অনাথা দুই বোন, কর্নেল! একজন তো মরার দিন গুনছে। চোখে জল এসে গেল বনবিহারীবাবুর। ওই মগের মুল্লুকে আর অপুকে পাঠাচ্ছি না। আমার ছেলেমেয়ে নেই–নিঃসন্তান মানুষ আমি। অপু থাক আমার কাছে। এখন ওই হতভাগিনী খুকুকে আপনি উদ্ধারের ব্যবস্থা করুন। চুলোয় যাক সম্পত্তি! বলবেন, আমি গিয়ে ওকে নিয়ে এলেই পারি। চেষ্টা করেছি বহুবার। মেয়েটা কিছুতেই আসবে না। এই অপুও কি আসত? তাছাড়া এখন যদি আমি যাই, ইন্দু আমাকে মেরে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেবে। অপু চলে আসাতে সে এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে। আপনি অভাগা মেয়েটাকে আমার কাছে এনে দিন কর্নেল!
কর্নেল আস্তে বললেন, দেখা যাক।..
.
ছুরি ও চাবুক
সুনেত্রা স্টেশনে গিয়ে হতাশ হয়ে ফিরেছে কয়েকটা দিন। সকাল-দুপুর-বিকেল সন্ধ্যা কত আপ ট্রেন এসে থামছে। কত যাত্রী নামছে। কিন্তু কোথায় সেই সৌমদর্শন বৃদ্ধ, মুখে সাদা একরাশ দাড়ি, মাথায় চুপি, কাঁধে প্রকাণ্ড কিটব্যাগ, বুকে ঝুলন্ত বাইনোকুলার আর ক্যামেরা, হাতে ছড়ি, উজ্জ্বল ফর্সা মুখে অমায়িক হাসি-লম্বা-চওড়া এক মানুষ!
বিকেলে বেজারমুখে ফিরে আসছিল সুনেত্রা। অভ্যাসমতো রেললাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে ফটক পেরিয়ে মন্দিরতলায় আসতেই দেখল, শ্রাবন্তী চুপচাপ বসে আছে।
গত পরশু সন্ধ্যার ট্রেনে অপালা কলকাতা চলে গেছে। বসন্ত নিবাসের আনাচেকানাচে ঘুরে এসেছে সুনেত্রা। ভেতরে ঢোকেনি। কাল একবার দেখেছিল ইন্দু ভটচায দোতালার বারান্দা থেকে কাকে বকাবকি করছে। ওকে এত ঘেন্না। করছিল বলেই সুনেত্রা ঢোকেনি ও বাড়িতে।
আজ শ্রাবন্তীকে দেখে সে এগিয়ে গেল। তারপর আঁতকে উঠল। শ্রাবন্তী একটা লম্বাটে ছুরি নিয়ে বসে আছে। সুনেত্রা থমকে দাঁড়াল। শ্রাবন্তী তার দিকে অদ্ভুত চাউনিতে তাকিয়ে হি হি করে হেসে বলল, আয় আয়। তোর গলা কাটি!
সুনেত্রা ভয়ে ভয়ে বলল, ও কী বলছ খুকুদি? আমার গলা কাটবে কেন? কী করেছি তোমার?
শ্রাবন্তী একই সুরে বলল, তোর গলা কাটব। অপুর গলা কাটব। সব্বাইর গলা কাটব। তারপর উঠে দাঁড়াল।
সুনেত্রা পিছিয়ে এল। বলল, খুকুদি! ভাল হবে না বলছি! ছুরি ফেলে দাও।
শ্রাবন্তী তার দিকে এগিয়ে আসতে থাকল। অস্বাভাবিক দৃষ্টি চোখে, ঠোঁটের কোনায় বিকৃত হাসি। সুনেত্রা ভীষণ ভয় পেয়ে খোয়াঢাকা এবড়োখেবড়ো রাস্তায় হন্তদন্ত হাঁটতে থাকল বাড়ির দিকে। মাঝে মাঝে সে পিছু ফিরে দেখছিল, শ্রাবন্তী সমানে এগিয়ে আসছে। বসন্তনিবাসের কাছাকাছি আসতেই শ্যামার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সুনেত্রা ব্যস্তভাবে বলল, শ্যামা! খুকুদিকে জলদি পাকড়ো। ওই দেখ, ছুরি নিয়ে আমার গলা কাটতে আসছে।
শ্যামা হ্যা হ্যা করে হেসে বলল, আরে না না দিদিজী! গলা কাটবে কেন? ভয় দেখাচ্ছে।
না ওই দেখ আসছে ছুরি নিয়ে।
শ্যামা শ্রাবন্তীকে দেখে নিয়ে হাঁক দিল, ছোটবাবু! ছোটবাবু!
দোতলা থেকে ইন্দু ভটচাযের সাড়া এল, কী হয়েছে রে শ্যামা?
বড়দিদি আবার পাগলামি করে বেড়াচ্ছে!
ইন্দু ভটচায হন্তদন্ত বেরিয়ে এলেন। সুনেত্রা শিউরে উঠে দেখল, ওঁর হাতে একটা চাবুক। ইন্দুবাবু চাবুকটা সপাং সপাং করে এপাশে ওপাশে আস্ফালন করতে করতে এগিয়ে গেলেন। তাকে দেখে শ্রাবন্তী দাঁড়িয়ে গেল। ইন্দুবাবু বললেন, ফেলে দাও ছুরি! নইলে চাবকে ছাল ছাড়িয়ে নেব। ফেলো বলছি!
শ্রাবন্তী হঠাৎ রাস্তার ওপাশে আগাছাভরা জমির ভেতর দিয়ে দৌড়তে শুরু করল। ইন্দুবাবুর হাঁক-ডাক শাসানি গ্রাহ্য করল না। একটু পরে তাকে আর দেখা গেল না। তখন ইন্দু ভটচায বললেন, এস তুমি বাড়ি, তারপর দেখাচ্ছি মজা। বড়বাবু নেই। আমি তো আছি।
শ্যামা বলল, ছোটবাবু, বড়দিদির একটা ব্যবস্থা করুন। পাগলাগারদে পাঠিয়ে দিন। নইলে কখন কী সাংঘাতিক কাণ্ড করে ফেরে যে?
ইন্দু ভটচায বললেন, তাছাড়া আর উপায় কী? তারপর ঘুরে বাড়ির গেটের দিকে যেতেই সুনেত্রাকে দেখতে পেলেন। বিবি, তোমার সঙ্গে একটা কৃথা আছে। বলে এগিয়ে গেলেন ইন্দুবাবু।
সুনেত্রা গম্ভীর মুখে বলল, বলুন!
কাছে এসে ইন্দুবাবু চাপা গলায় বললেন, অপুকে দেখেছ? পরশু বিকেল থেকে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কেলেঙ্কারির ভয়ে এখনও চেপে রেখেছি। দেখনি অপুকে?
সুনেত্রা বলল, না।
তাহলে দেখছি, পুলিশে খবর দিতেই হবে।
সুনেত্রা বলল, কেন? কলকাতায় ওর মামার বাড়িও তো যেতে পারে। আগে খোঁজ নিন সেখানে।
ইন্দুবাবু হাসলেন। হ্যাঁ–তাও যেতে পারে। তুমি ঠিকই বলেছ। বলে চলে গেলেন।
সুনেত্রা বাড়ির দিকে পা বাড়াল। ইন্দুবাবুর সঙ্গে কথা বলেছে বলে যেন তার মুখটা বিষিয়ে গেছে। ঘৃণায় সে থুথু ফেলল। এই শয়তানটাকে বাধা দেবার কেউ নেই ভেবে রাগে তার মাথার ভেতরটা গরম হয়ে উঠছিল। সে এবার বুঝতে পেরেছে, ইন্দু ভটচা শ্রাবন্তাকে চাবুক পর্যন্ত মারে। এত স্পর্ধা তার হল কিসের জোরে? অপালা কলকাতা গিয়ে মামাকে সব কথা কি বলেনি এখনও?
বললে তো ওর মামার ছুটে আসা উচিত ছিল। হয়তো বলেনি, অপালা যা মুখচোরা বোকা মেয়ে! মাঠঘাট ঘুরে আর দেহাতীদের সঙ্গে মিশে ও ভীষণ গেঁয়ো হয়ে গেছে। এতদিন ধরে ইন্দু ভটচায ওকে জ্বালিয়েছে, অথচ সব মুখ বুজে সহ্য করেছে অপালা।
তাহলেও ওর মামার সব বোঝা উচিত ছিল। অন্তত শ্রাবন্তীকেও তো উনি নিয়ে গিয়ে কলকাতায় চিকিৎসা করাতে পারতেন। অথচ ভদ্রলোক একেবারে চুপচাপ বসে আছেন। সুনেত্রা ভীষণ আশা করেছিল, উনি এসে ভাগ্নীদের মাথার ওপর দাঁড়াবেন। কিন্তু সেই একবার এসেছিলেন রুদ্রবাবু খুন হবার পর। তারপর আর এলেনই না।
সুনেত্রা বাড়ি ঢুকেই থমকে দাঁড়াল।
তার মা লনের ওধারে পেয়ারাতলায় বেতের চেয়ারে বসে আছেন আর শ্রাবন্তী একটু তফাতে ঘাসের ওপর পা দুমড়ে বসে সুস্থ মানুষের মতো কথা বলছে। সুনেত্রা ওর হাতে এখন ছুরিটা দেখতে পেল না। কিন্তু তার বুক কেঁপে উঠল। যদি হঠাৎ মায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
তাকে দেখে সুনয়নী বললেন, শুনেছিস বিবি? ইন্দু খুকুকে চাবুক মারতে তাড়া করেছিল! লোকটার স্পর্ধা কী রে বিবি! দেশে কি আইন বলতে কিছু নেই?
সুনেত্রা একটু তফাতে দাঁড়িয়ে হাসবার চেষ্টা করে বলল, খুকুদি ছুরি নিয়ে আমার গলা কাটতে আসছিল, সেটা বলছে না বুঝি!
শ্রাবন্তী ক্ষীণ কণ্ঠস্বরে বলল, না জেঠিমা! বিবি মিথ্যা বলছে। আমি ওর গলা কাটব কেন?
সুনয়নী হাসলেন। কখন কী করে, ও কি জেনেশুনে করে? ওকে করান, তাই করে। দেবদেবীদের লীলা। বলে ঘুরলেন শ্রাবন্তীর দিকে। হু, শোন খুকু! অপু কলকাতা চলে গেছে। তুইও চলে যা। আর বাড়ি ঢুকিসনে। হাবুলবাবুকে ডেকে পাঠাচ্ছি। তোকে সঙ্গে করে তোর মামার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসবে। এখানে থাকলে তুই যে মরে যাবি, মা! একেবারে কংকাল হয়ে গেছিস যে!
শ্রবন্তী মাথাটা আস্তে নাড়ল।
যাবি না?
না।
ইন্দুর হাতে মার খাবি, তাও ভাল?
শ্রাবন্তী চুপ করে বসে রইল। সুনেত্রা বলল, খুকুদি, ছুরিটা কী করলে?
জানি না।
কাপড়ের ভেতর লুকিয়ে রাখোনি তো?
সুনয়নী ধমক দিলেন, কী আজেবাজে বলছিস ওকে, বিবি? ওকে ওপরে নিয়ে যা। মুখ দেখে মনে হচ্ছে, ওর খাওয়া জোটেনি আজ। গরিকে বলেছি, খানকতক গরমগরম পুরি ভেজে দিতে। তুই ওপরে যা মা খুকু! গিয়ে গল্প কর বিবির সঙ্গে। আমি যাচ্ছি।
সুনেত্রা ইতস্তত করছে দেখে ফের তাড়া দিলেন, আঃ! হাঁ করে দেখছিস কী? নিয়ে যা। খুকু, যাও ওর সঙ্গে।
শ্রাবন্তী হঠাৎ দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠল। আমাকে তোমরা লুকিয়ে রাখো জেঠিমা। আমার বড় ভয় করছে। আমি আর বাড়ি যাব না।
সুনয়নী উঠলেন। শ্রাবন্তীকে টেনে তুললেন। তারপর ওকে নিয়ে যেতে যেতে বললেন, চলো, আগে খেয়ে নেবে। তারপর দেখছি, কী করা যায়। এর একটা বিহিত করতেই হবে।…
.
অবশেষে সান্তাক্লজ
অস্থির সুনেত্রা আবার স্টেশনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সকালের আপট্রেনে যদি কর্নেল এসে পৌঁছান! সে কর্নেলের ওপর খাপ্পা হচ্ছিল। অদ্ভুত লোক তো! আসব বলে আর আসবার নাম নেই। নাকি তাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না উনি? বসন্তনিবাসে এমন একটা সাংঘাতিক ব্যাপার চলেছে। কত কথা মনে গিজগিজ করছে। তবে যে। তার বাবা বলতেন, যেখানে রহস্য, সেখানেই কর্নেল নীলাদ্রি সরকার!
আপট্রেনের দেরি আছে আধ ঘণ্টা–যদি সময়মতো আসে! ডাউন দিল্লি হাওড়া প্যাসেঞ্জার এসে গেল উল্টোদিক থেকে। তত বেশি যাত্রী নামল না। সুনেত্রা অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে ছিল ডাউন সিগন্যালের দিকে। হঠাৎ তার পিঠে কেউ মৃদু স্পর্শ করতেই ঘুরে দাঁড়াল এবং অবাক হয়ে গেল।
এসে গেছি ডার্লিং!
সুনেত্রা হেসে ফেলল। কী অদ্ভুত মানুষ আপনি! প্রতিদিন আপনার জন্য স্টেশনে এসে হয়রান! বলে সে চঞ্চল হয়ে উঠল। কিন্তু আপনি তো আসবেন এদিক থেকে! উল্টোদিক থেকে এলেন যে?
কর্নেল মুখ টিপে হেসে বললেন, তোমাকে চমক দেব বলে!
উঁহু আপনার গতিবিধি সন্দেহজনক। বলে সুনেত্রা উৎসাহে পা বাড়ালো।
তাই বুঝি? হুঁ–আমি হঠাৎ একটা জরুরি ট্রাঙ্ককল পেয়ে মুঙ্গেরে গিয়েছিলাম।
মুঙ্গেরে কী ব্যাপার? সুনেত্রা গেট পেরিয়ে রিকশো ডাকতে লাগল। কর্নেল বললেন, হাঁটার চেয়ে স্বাস্থ্যকর আর কোন প্রক্রিয়া নেই, বিবি! এস, হাঁটি।
দুজনে হাঁটতে লাগল। সুনেত্রা আবার বলল, মুঙ্গেরে কী ব্যাপার?
অবাক হয়ো না। হিমাদ্রি ওখানেই নিরাপদে আছে এক বন্ধুর বাড়িতে।
হিমুদা ওখানে আছে? সর্বনাশ!
সর্বনাশের কারণ নেই, ডার্লিং। কর্নেল সংক্ষেপে ঊর্মির হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ও মৃগাঙ্ক ব্যানার্জিকে গ্রেফতারের বিবরণ দিয়ে বললেন, যাই হোক, পুলিশের হঠকারিতায় ওর কেরিয়ারের খুব ক্ষতি হয়েছে। আমি পুলিশকে অনুরোধ করেছি, ও বেচারার দোষস্থালন করে যেন সব কাগজে বিবৃতি দেওয়া হয়। সম্ভবত দু একদিনের মধ্যে পুলিশ কমিশনার সাংবাদিক সম্মেলন ডাকবেন এব্যাপারে।
তাহলে হিমুদাকে নিয়ে এলেন না কেন?
ওবেলা এসে যাবে। ভাগলপুরে ও কী একটা কাজে গেল।
সুনেত্রা হাসল। কর্নেল! আপনার দাড়ি কি ওয়াশ করেছেন? এত সাদা দেখাচ্ছে কেন? একেবারে ক্রিসমাসের সান্তাক্লজ!
ওই দেখ ডার্লিং, বাচ্চাগুলো আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে!
রাস্তার দুধারে দোকানপাট। এটা বাজার এলাকা। ডাইনে প্রায় নির্জন সংকীর্ণ রাস্তায় ঘুরে সুনেত্রা চাপা গলায় বলল, খুকুদি–মানে শ্রাবন্তী কাল বিকেল থেকে আমাদের বাড়িতে এসে লুকিয়ে আছে। আমি তো ভীষণ ভয়ে-ভয়ে কাটাচ্ছি। মা কিন্তু নির্বিকার। মায়ের ব্যাপার জানেন তো? বলে কী, তোর বাবা মরার সময় সব সাহস আমাকে দিয়ে গেছেন!
সুনেত্রা কাল যা ঘটেছিল, শোনাতে থাকল। গোয়েন্দা কৃতান্ত হালদারের বৃত্তান্ত মনে পড়ছিল কর্নেলের। সবটা শোনার পর বললেন, ছুরিটা তাহলে এখন নেই শ্রাবন্তীর কাছে?
সুনেত্রা বলল, না। জিগ্যেস করলে বলছে, কিচ্ছু জানিনে। কিন্তু কাল বিকেল থেকে একটা আশ্চর্য ব্যাপার লক্ষ্য করছি, খুকুদি বেশ নর্মাল হয়ে গেছে যেন। ভর-টর ওঠেনি। অজ্ঞানও হয়নি। আবোল-তাবোল কোনো কথাও বলছে না আগের মতো। অথচ ওদের বাড়িতে থাকার সময় কী যে করত। ভুতুড়ে সব কাণ্ড, ভাবতে পারবেন না!
কর্নেল কান করে শুনছিলেন। বললেন, সম্ভবত বসন্তনিবাসেই ওর অস্বাভাবিক আচরণের কারণ লুকিয়ে আছে।
ঠিক এই কথাটাই আমি ভেবেছি, জানেন?
বাড়ির সামনে পৌঁছে কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, তুমি আর ভুল করেও খোট্টাই বুলি বলছ না যে?
সুনেত্রা হেসে ফেলল। ক্যাবলু জী? এত্তা খতরনাক হরবখত–মেরি হাড্ডি ভি পিলি হো গেয়ি!
সুনয়নী পেয়ারাতলায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। কর্নেলকে দেখে তাঁর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আসুতে পারলেন তাহলে! আপনার জন্য বিবি আহার-নিদ্রা ছেড়ে দিয়েছিল! ওকে যে সেবার কী যাদু করে গেলেন কে জানে!
ব্যস্ত হয়ে উঠলেন সুনয়নী। ওপরের সবচেয়ে সাজানো ঘরটায় নিয়ে গিয়ে তুললেন কর্নেলকে। এটা বরদাবাবুর ড্রয়িং রুম। দেয়াল জুড়ে এবং আনাচেকানাচে জীবজন্তুর স্টাফ-করা মাথা বা পুরো শরীর। একটা আস্ত রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার পর্যন্ত।
সুনয়নী বললেন, একটু আগে ওদের চাকর শ্যামা খুকুকে খুঁজতে এসেছিল। বললাম, জানি না।
সুনেত্রা বলল, খুকুদি কোথায় মা?
আমার ঘরে শুয়ে আছে। ঘুমুচ্ছে। সারারাত ঘুমোয়নি বেচারী। আমাকেও ঘুমোতে দেয়নি। হঠাৎ আঁকড়ে ধরে ফিসফিস করে বলে কী, ইন্দুকাকা খুঁজতে আসেনি তো? সুনয়নী আস্তে বললেন, ওদের বাড়িটাই অভিশপ্ত। রুদ্রবাবুর পাপ আর কী! আমি তো কম দেখিনি আর কম শুনিনি। জমিদারি আমলে দিনকে রাত করেছেন রুদ্রবাবু। কত খুনখারাপি করেছেন। কত মেয়ের সর্বনাশ করেছেন। সে-সব হিসট্রি সময়মতো বলব আপনাকে। আমাদের এ অঞ্চলটা চিরদিন এমনি মগের মুলুক। আমাদের বাংলাদেশের মতো শিক্ষিত লোক তো নেই বিশেষ। তাই প্রতিকার হয়নি। ইদানীং যদি বা কিছু শিক্ষাদীক্ষা দেখা যাচ্ছে, তো ওই রাজনীতি! রাজনীতির দাপটে অস্থির।
সুনেত্রা বলল, আঃ! মা! তুমি দেখছি সত্যি হিসট্রি নিয়ে বসলে। কর্নেলজেঠু ট্রেন জার্নি করে এসেছেন! বিশ্রাম করতে দাও।
সুনয়নী হাসলেন। পরে বলবখন। …কর্নেল তো কফির ভক্ত। কড়া কফি। হুঁউ–আমার সব মনে আছে। সারাদিন দুই বন্ধুতে গঙ্গার চরে টো টো করে ঘুরে এসে এই ঘরে–ঠিক ওই ইজিচেয়ারে বসে বলতেন, বউঠান! এবার কফি চাই। কড়া কফি!
মেয়ে মায়ের দিকে চোখ কটমটিয়ে তাকালে মা হন্তদন্ত বেরিয়ে গেলেন। এই মুহূর্তে কর্নেলের মনে হল, শ্রাবন্তী-ঊর্মি-অপালার মা যদি বেঁচে থাকতেন, হয়তো বসন্তনিবাসে এই সাংঘাতিক সর্বনাশগুলো ঘটত না। মায়ের চেয়ে। রক্ষাকর্তী আর কে আছে পৃথিবীতে?
চাপা শ্বাস ছেড়ে কর্নেল বললেন, বিবি, শ্রাবন্তীদের ফার্মটা কতদূর?
যাবেন নাকি? সুনেত্রা বলল। যে রাস্তায় এলাম, কিছুটা দক্ষিণে গেলে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের শালজঙ্গল। ওটা একসময় ছিল রতুয়ার টাঁড়-মাইল দেড়েক লম্বা বাঁজা ডাঙ্গা। এখন, শালগাছ লাগিয়েছে। তারপর ক্যানেল। ক্যানেলের ওধারে ওদের ফার্ম। দুখানা ছোট-ছোট ঘর আছে। ব্যস, ওই হল ফার্ম। কিন্তু ফার্মে কেন? পাখি দেখতে, না প্রজাপতি ধরতে? … হ্যাঁ, উড্ডাক দুটো কালও দেখে এসেছি। আর সেই প্রজাপতিগুলোও আছে কিন্তু। ও কর্নেল, আমি আপনার সঙ্গে যাব।
সুনেত্রা কচি মেয়ের মতো আব্দার জানাল। কর্নেল একটু হেসে বলল, এ বেলা আমি একা বেরুচ্ছি। কারণ তোমাকে থাকতে হবে বাড়িতে। হিমাদ্রি আসবে। তার অবশ্য পুলিশের ভয় আর নেই। আসার আগে কলকাতা পুলিশের মারফত এখানকার পুলিশকে ব্যাপারটা জানিয়ে দিতে বলেছি। নিশ্চয় জানিয়ে দিয়েছে। যাই হোক, তুমি বাড়িতে থেকে হিমাদ্রিকে রিসিভ করবে। নাইস চ্যাপ! তোমাদের বাল্যসঙ্গী আফটর অল। …
কিছুক্ষণ পরে যৎকিঞ্চিৎ খাওয়া-দাওয়া করে কর্নেল বেরোলেন। শ্রাবন্তী তখনও সুনয়নীর ঘরে ঘুমোচ্ছে।
কর্নেলের বুকে ঝুলছে বাইনোকুলার, কাঁধে ঝুলছে ক্যামেরা। হাতের ছড়িটা আসলে প্রজাপতি ধরা জালের হ্যান্ডেল। প্যান্টের পকেটে ভাঁজ করা আছে সুক্ষু জালখানা।
রতুয়ার টাঁড়ে কচি শালগাছের জঙ্গল। মাঝখানে একফালি নির্জন পথ। বাইনোকুলারে পাখি দেখতে দেখতে কর্নেল হাঁটছিলেন। ক্যানেলের ধারে পৌঁছে দেখতে পেলেন হলুদ রঙের ছোট্ট ফার্মহাউস-চৌহদ্দিতে কাটাতারের বেড়া। সবুজ ধান-পাট আর আখের ক্ষেত উজ্জ্বল রোদে ঝকঝক করছে। ফার্মহাউসের পাশে কচি তাড়হর আর ভুট্টার ক্ষেতের ধারে একটা লোক চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। বাইনোকুলারের লেন্স অ্যাডজাস্ট করতেই তার চেহারা স্পষ্ট হয়ে উঠল।
কর্নেল ক্যানেলের ব্রিজ পেরিয়ে গেলেন। লোকটা ফার্মে গিয়ে ঢুকেছে এখন। ফার্মের সামনে একটুকরো ফুলবাগিচা। মন্দ না। নদীয়ার মাকড়দহে অবশ্য আরও বড় ফার্মহাউস ছিল। তার সঙ্গে পোলট্রি, ডেয়ারি এবং একটা সাংঘাতিক হরিয়ানা ষাঁড়। ইন্সপেক্টর কৃতান্ত হালদার একটু বোকামানুষ হলেও দুর্দান্ত সাহসী। যাঁড়টা যখন কর্নেলকে তাড়া করে পাঁচিলে চড়িয়ে ছেড়েছে, কৃতান্ত হালদার তখন খড়ের পাঁজাটা বুড়ি করে ঘুরছেন। যাঁড়টাও ঘুরছে। আর। শিঙের গুঁতোয় খড়ের পাঁজাটা ছত্রখান করে ফেলছে।
গেটের কাছে যেতেই রুক্ষ চেহারা লম্বাটে গড়নের প্যান্ট-শার্ট আর পায়ে গামবুট পরা একটা লোক বেরিয়ে এল। কাঁহাসে আয়া আপলোগ?
ভাগলপুরসে।
কিসকো ঢুঁড়তা আপ?
ইন্দুবাবুকো।
তো বলিয়ে?
কর্নেল নমস্কার করে একটু হেসে বললেন, আপনি মিঃ ইন্দুমাধব ভট্টাচার্য?
ইন্দুবাবু নির্বিকার মুখে বললেন, হ্যাঁ। বলুন স্যার, কী দরকার?
এভাবে দাঁড়িয়ে তো বলা যাবে না মিঃ ভট্টাচার্য। ভেতরে গিয়ে—
আমার সময় নেই, স্যার। যা বলার এখানে বলুন!
লোকটা তো ভারি অভদ্র। কর্নেল বললেন, আহা! আমি কৃষিদফতর থেকে—
কথা কেড়ে ইন্দুবাবু বললেন, ছাড়ুন স্যার! আপনি পুলিশের লোক–আমি জানি। বড়বাবুর মার্ডার কেসে তো এফ আর আই হয়ে গেছে রঘুনাথ সাহুর নামে। যা হবার, কোর্টে হবে।
কর্নেল গলা নামিয়ে বললেন, মিঃ ভট্টাচার্য, আপনি বিপন্ন। তারপর দ্রুত ঘুরে হনহন করে চলে এলেন। ক্যানেলের কাছাকাছি এসে পিছু ফিরে দেখলেন, ইন্দু ভটচায তখনও দাঁড়িয়ে আছেন গেটে।
কর্নেল ক্যানেলের পাড় ধরে পুবে হাঁটতে থাকলেন। দুধারে সবুজ ক্ষেত। ক্যানেল ক্রমশ উত্তরে ঘুরেছে। তারপর রেললাইন ও পিচের সড়কের তলা দিয়ে গঙ্গায় মিশেছে।
ঘণ্টা দুই পাখি দেখে এবং বিস্তর চেষ্টা করে একটি প্রজাপতি ধরার পর সেটা সচ্ছিদ্র ছোট্ট কাঁচের কৌটোয় বন্দী করে কর্নেল সর্বমঙ্গলার মন্দিরতলায় পৌঁছুলেন। কল্কেফুলের জঙ্গলে প্রচুর প্রজাপতি। কিন্তু চেষ্টা করে একটাও ধরা গেল না। হু হু করে বাতাস বইছে। আর প্রজাপতিগুলোও বড় বেশি চঞ্চল।
বসন্তনিবাস কি ওই বাড়িটা—আগাছা ভরা ছোট্ট মাঠের পর ভাঙাচোরা পাঁচিলে ঘেরা হানাবাড়ির মতো দেখতে? আগাছার জঙ্গলেও কত প্রজাপতি রঙ-বেরঙের! সেতাপগঞ্জের প্রকৃতির কোনো তুলনা হয় না। কিন্তু এমন ধড়িবাজ সচরাচর দেখা যায় না।
কর্নেল থমকে দাঁড়ালেন। প্রকাণ্ড একটা কালো পাথরের ওপর মস্ত বড় শাদা একটা প্রজাপতি বসে আছে। তার সংগ্রহশালায় এক দুর্লভ সংযোজন ঘটবে যদি–
জাল রেডি করে পা বাড়াতে গিয়ে চোখ নিস্পলক হয়ে উঠল। পাথরটার নিচে পড়ে আছে একটা লম্বা ছুরি। প্রজাপতিটা পালিয়ে গেল। ছুরিটা তুলে নিলেন। ইঞ্চি আষ্টেক লম্বা এবং ইঞ্চিটাক চওড়া ছুরিটার বাঁট জীর্ণ হয়ে গেছে। ভীষণ ধারাল। কিন্তু উল্টো দিকটায় মরচে ধরে গেছে। হু, শ্রাবন্তী এই পাথরটাতে বসেছিল সম্ভবত। ছুরিটা তার হাত থেকে পড়ে গেছে বা ফেলে দিয়েছে। সুনেত্রার বিবরণ অনুসারে ব্যাপারটা গতকাল বিকেলেই ঘটা সম্ভব। এই পাথরে বসলে বসন্তনিবাস থেকে কেউ দেখতে পাবে না। ওদিকে সামনে ঘন গাছপালার আড়াল রয়েছে।
আতসকাচ বের করে ছুরিটা পরীক্ষা করতে গিয়ে একবার হাত কেঁপে উঠল। এই ক্ষুরধার ছুরি দিয়েই কি এপ্রিলের এক নিঝুম ভোরবেলায় নিষ্ঠুর আততায়ী রুদ্রেন্দুপ্রসাদ রায়চৌধুরির শ্বাসনালী কেটে দিয়েছিল? শ্রাবন্তী কি বলতে পারবে, এ ছুরি সে কোথায় পেল?
বৃষ্টি এবং হাতের ঘষা খেয়ে রক্ত মুছে যাওয়া সম্ভব। তবু পিঠের দিকে ভঁজে কালচে জমাট আর সূক্ষ্ম এই ছোপগুলো হয়তো মরচে নয়। ফরেন্সিক টেস্ট করানো দরকার। ছুরিটা রুমালে জড়িয়ে সাবধানে প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে রাখলেন কর্নেল।
ঊর্মিকে যে ছুরি দিয়ে খুন করা হয়েছিল, সেটা বিদেশী ছুরি। পশ্চিম জার্মানির তৈরি। মৃগাঙ্কের আমদানি-রফতানির কারবার থাকায় ব্লেডের মতো ধারালো অমন একটা ছোট্ট চার ইঞ্চি ছুরি যোগাড় করা খুব সহজ ছিল। এই ছুরিটা দেশী। দ্বিগুণ লম্বা।
ঊর্মির কাছে তার বাবার হত্যাকাণ্ডের পদ্ধতি জেনে নিয়েছিল মৃগাঙ্ক। একটা হত্যা থেকে আরেক হত্যার প্রেরণা লাভ করেছিল সে। প্রেরণা ছাড়া আর কী। বলা যাবে–যদিও প্রেরণার সঙ্গে শুভের সম্পর্ক রয়েছে। আসলে হয়তো। কালের নিয়ম। অধুনা সবকিছুর সঙ্গে অশুভ জড়িয়ে যাচ্ছে। স্নেহ পাওয়ার কথা যেখানে, সেখানে এসে পড়ছে কদর্য ব্যাভিচার।…
সুনেত্রা ওপরের জানালা থেকে চেঁচিয়ে উঠল, কর্নেল জেঠু!
কর্নেল বুঝতে পারেননি অন্যমনস্কতায় আগাছার জঙ্গল ঠেলে বসন্তনিবাসের পেছন ঘুরে কোথায় এসে পড়েছেন। হ্যাঁ, এই তো সুনেত্রাদের বাড়ি। হাত তুলে হাসলেন।
হিমুদা এই মাত্র এসে গেছে। সুনেত্রা ঘোষণা করল।
ওপরের ঘরে হিমাদ্রি, শ্রাবন্তী ও সুনেত্রা আড্ডা দিচ্ছিল। কর্নেলকে দেখে হিমাদ্রি বলল, কর্নেল, এভরিথিং পজিটিভ। কম্পাউন্ডার ভদ্রলোক আমার চেনা। উনি—
এক মিনিট। এই ভদ্রমহিলাকে সামলাই। বলে কর্নেল সচ্ছিদ্র কাঁচের কৌটোটা বের করলেন। হিমাদ্রি ও সুনেত্রা প্রজাপতিটা দেখতে থাকল। কর্নেল বাইনোকুলার, ক্যামেরা টেবিলে রাখলেন।
শ্রাবন্তী ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছিল কর্নেলকে। কর্নেল তার দিকে মনোযোগ দিচ্ছিলেন না ইচ্ছে করেই। কিন্তু এ কী দেখছেন! এ যেন জীবন্ত এক কংকাল মূর্তি। কোটরগত চোখ। চোখে কী অস্বাভাবিক–যেন অপার্থিব দৃষ্টি জ্বল জ্বল করছে।
সুনেত্রা বলল, কর্নেল জেঠু, শ্রাবন্তী।
কর্নেল পকেট থেকে রুমালে জড়ানো ছুরিটা বের করছিলেন। ছুরিটা শ্রাবন্তীর দিকে বাড়িয়ে যেই বলেছেন, এটা চিনতে পারছ কি শ্রাবন্তী?–অমনি শ্রাবন্তী দু হাতে মুখ ঢেকে অস্ফুট চিৎকার করে উঠল।
সে পড়ে যাচ্ছিল, সুনেত্রা ধরে ফেলল। অজ্ঞান হয়ে গেছে। হিমাদ্রি ও সুনেত্রা তাকে ডিভানে শুইয়ে দিল। ফ্যানটা জোরে চালিয়ে দিল।
কর্নেল একটু হাসলেন। এই রি-অ্যাকশনটাই দেখতে চেয়েছিলাম। হু, তোমরা অবাক হয়ো না। এটা আমি কুড়িয়ে পেয়েছি। বলে শ্রাবন্তীর মাথার কাছে গিয়ে বসলেন।
শ্রাবন্তী হঠাৎ উঠে বসল ডিভানে। এক ধাক্কায় কর্নেলকে সরিয়ে দিল। তারপর সে মাথা দোলাতে শুরু করল। চুলগুলো খুলে ছড়িয়ে পড়ল। সে। প্রথমে বিড় বিড় করে দুর্বোধ্য কী সব বলতে থাকল। তারপর ক্রমশ তার কথা স্পষ্ট হচ্ছিল। ভুতুড়ে কণ্ঠস্বরে শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে হাঁফাতে হাঁফাতে সে বলল এবার ইন্দুর পালা। ইন্দুর, গলা কাটব। তারপর শ্যামার গলা কাটব। দয়ালের গলা কাটব মনিয়ার গলা কাটব। ইন্দুর গলা কেটে রক্ত খাব। রক্ত খেয়ে আমি নাচব। আমাকে কেউ ছুঁয়ো না। আমি বলি খেতে এসেছি। আমি কে জানো? আমি সর্বমঙ্গলা। আমি সব্বাইর গলা কেটে রক্ত খাব। রক্ত খেয়ে নাচব। ইন্দুর গলা কাটব।
কর্নেল তার কিটব্যাগ খুলে একটা ছোট্ট শিশি নিয়ে এলেন। সুনেত্রা বলল, স্মেলিং সল্টে কিছু হয় না শুনেছি।
স্মেলিং সল্ট নয়। আরও তেজী জিনিস। কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন। কলকাতার এক বড় সাইকিয়াট্রিস্টের কাছ থেকে নিয়ে এসেছি। দেখা যাক রেজাল্ট কী হয়।
নাকের কাছে ধরতেই শ্রাবন্তী ছিটকে ধনুকের মতো বেঁকে চিত হয়ে গেল। তার বুক ও পেট খুব ঝাঁকুনি দিতে থাকল। ক্রমশ ঝাঁকুনি থেমে এল। দু-তিন মিনিট পরে সে স্বাভাবিক কণ্ঠস্বরে বলল, জল খাব।
সুনেত্রা জলের গ্লাস নিয়ে এল তক্ষুনি। কর্নেল শ্রাবন্তীকে জল খাইয়ে দিয়ে বললেন, চুপচাপ শুয়ে থাকো। কেমন?
শ্রাবন্তী শুয়ে রইল। সুনেত্রা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল।
কর্নেল হিমাদ্রিকে বললেন, খবর পজিটিভ?
হ্যাঁ। কম্পাউন্ডার ভদ্রলোক বললেন, উনি আঙুলে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছিলেন। আঙুলের ডগা প্রায় দুভাগ হয়ে হাড়ে ঠেকেছিল। তবে লোকটার নার্ভের প্রশংসাও করলেন। রুমালে জড়িয়ে অতক্ষণ ধরে যন্ত্রণা সহ্য করেছে–আর হ্যাঁ, হাতের তালু চিরে গিয়েছিল একটুখানি।
সুনেত্রা বলল, কার হিমুদা?
হিমাদ্রি কর্নেলের দিকে তাকিয়ে হাসল। একটা লোকের।
সুনেত্রা অভিমান করে বলল, যাও, বোলো না।
কর্নেল বললেন, শ্রাবন্তীর বাবার হত্যাকারীর ডান তর্জনী কেটে গিয়েছিল, বিবি। রুদ্রেন্দুবাবু তার মতলব টের পেয়ে একটু ধস্তাধস্তি করেছিলেন। এমন কী পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থাতেও প্রাণ বাঁচাতে মরিয়া হয়ে দরজার দিকে ঝুঁপিয়ে পড়েছিলেন। হয়তো সেটাই ভুল হয়েছিল। আততায়ী তাকে বাগে পেয়েছিল।
সুনেত্রা দম আটকানো গলায়, বলল, কে সে?
সম্ভবত আজ রাতের মধ্যেই তাকে ধরে ফেলতে পারব, যদি আমার অনুমান সঠিক হয়।
সে তো ইন্দুবাবু!
কর্নেল তার কথার জবাব না দিয়ে শ্রাবন্তীর দিকে ঘুরলেন। শ্রাবন্তী, কেমন বোধ করছ?
শ্রাবন্তী আস্তে বলল, ভাল।
ছুরিটা কোথায় কুড়িয়ে পেয়েছিলে শ্রাবন্তী?
বাড়ির পেছনে খিড়কির কাছে ঘাসের ভেতর পড়েছিল। টাটকা রক্ত লেগে ছিল। খিড়কিও খোলা ছিল।
তুমি কাউকে দেখাওনি ছুরিটা?
তারপর কী হয়েছিল আমার মনে পড়ছে না।
ঠিক আছে। স্মরণ করতে হবে না আর। ও সব কথা ভুলে যাও।
সুনেত্রা উঠল। সর্বনাশ! কর্নেল জেঠু বাইরে থেকে ফিরেই কফি খান। ভুলে গেছি। বলে সে হন্তদন্ত বেরিয়ে গেল।
হিমাদ্রি হাসতে হাসতে বলল, মাত্র দুদিন আগে আমিই পুলিশের ভয়ে লুকিয়ে থেকেছি। আজ দিব্যি পুলিশের ডিটেকটিভ সেজে সারা ভাগলপুরের সব ডিসপেন্সারি আর হাসপাতাল চষে বেড়িয়েছি। তবে ভয় হচ্ছিল, যদি কেউ বলে বসত, কৈ, দেখি আইডেন্টিটি কার্ড? স্মার্টলি চালিয়ে গেছি শেষ পর্যন্ত।
কর্নেল বললেন, আমার ধারণা ছিল সেতাপগঞ্জের কোনো ডিসপেন্সারিতে ঢুকবে না লোকটা। কারণ ছোট্ট জায়গা। তার ওপর অনেকেই চেনাজানা। ধরা পড়ার ভয় ছিল। কাজেই কাছাকাছি–তার মানে, পরবর্তী কোনো চেনা জায়গায় সে ছুটে যাবে, যেখানে কেউ আঙুলকাটা নিয়ে সন্দেহ করবে না। কাল বিকেলে সেতাপগঞ্জে নেমে দেখি, বিবি গেটে দাঁড়িয়ে। ওর চোখ এড়িয়ে আড়ালে চলে গেলাম। কিছুক্ষণ পরে স্টেশন মাস্টারের ঘরে গিয়ে হাজির হলাম। ভাগ্যক্রমে আগেরবার এসে যে স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, তিনি বদলি হননি। কাজেই তদন্তে অসুবিধা হল না। সন্ধ্যা সওয়া ছটায় মুঙ্গেরে তোমার কাছে চলে গেলাম। আজ সকালে ফিরে দেখি, বিবি যথারীতি এসে দাঁড়িয়ে আছে গেটে।
আপনার জন্য ও ভীষণ অস্থির হয়ে উঠেছিল।
বুঝতে পারছি। কিন্তু ঊর্মির হত্যাকাণ্ডের ফয়সালা না করে তো আসা যাচ্ছিল না।
আপনি তাহলে বুঝতে পেরেছিলেন দুটো আলাদা কেস?
হ্যাঁ। শুরুতেই। দ্বিতীয়টা ঘটেছে প্রথমটা থেকে শিক্ষা নিয়ে।
হিমাদ্রি দুঃখিত ভাবে হাসল। পৃথিবীটা কী হয়ে যাচ্ছে, কর্নেল! দয়ামায়া স্নেহভালবাসা–এ সব মানবিক বোধের আর কোনো ঠাঁই নেই। টাকাকড়ি সম্পত্তি এ সব জিনিসই বড় হয়ে উঠছে।
কে জানে! কর্নেল অন্যমনস্কভাবে উঠে গেলেন। বাইনোকুলার নিয়ে একটা জানালার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন, হয়তো আবহমান কাল ধরে পৃথিবীটা এরকমই, ডার্লিং! বিশ্ব প্রকৃতিতে পাপ-পুণ্য মিলেমিশে আছে। হয়তো থাকবে–যতদিন না পৃথিবীটা ধ্বংস হয়ে যায়। আমরা মানুষ। আমাদের মধ্যে
সুনেত্রাদের বাগানে উড ডাকের চিৎকার শুনতে পেয়েছেন কর্নেল। চোখে বাইনোকুলার রেখে খুঁজতে থাকলেন।…
.
মধ্যরাতের আততায়ী
সন্ধ্যায় আকাশ কালো করে মেঘ উঠেছিল। তারপর ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছিল। সেই বৃষ্টি আর থামতেই চায় না। রাত দশটাতেও টিপ টিপ করে পড়তে থাকল। তারপর ক্রমশ কমে গেল। তখন রাত এগারোটা বেজে গেছে। আরও কিছুক্ষণ পরে মেঘ সরে ঝলমলে চাঁদ বেরিয়ে এল আকাশে। বৃষ্টিভেজা প্রকৃতিকে রহস্যময় করে ফেলল তার জ্যোৎস্না।
বসন্তনিবাসের ভাঙা পাঁচিল পেরিয়ে কেউ সাবধানে নামল বাগানের ভেতর। একটু দাঁড়াল ফোয়ারাটার কাছে। তারপর সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে গেল বাড়ির সামনের দিকে।
শ্যামা গাঁজা টেনে মড়ার মতো পড়ে আছে বারান্দার খাঁটিয়ায়। দয়াল ঠাকুর বাড়িতে খুন হবার পর বাইরে শুতে পারে না। কপাট বন্ধ করে ঘুমোচ্ছে। শুধু মনিয়ার চোখে ঘুম নেই। রোগা মেয়েটা কোথায় গেল, সেই ভাবনায় কষ্ট পাচ্ছে। রান্নাঘরের পাশের ঘরে শুচ্ছে সে গত রাত থেকে। এখন তার শ্বাস। ফেলতেও ভয় হচ্ছে। ঘাপটি পেতে পড়ে আছে।
মরাইগুলোর আড়ালে ছায়া জমেছে। সেই ছায়ার ভেতর লোকটা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর পা টিপেটিপে বারান্দায় উঠল। রাত একটায় গয়াপ্যাসেঞ্জার। হঠাৎ মনে পড়ল কথাটা। একটু চঞ্চল হল সে। তারপর সাবধানে বারান্দায় উঠল। চওড়া সিঁড়ির প্রথম ধাপে উঠে সে পিছু ফিরে দেখে নিল চারদিক। গাছের পাতা থেকে বৃষ্টির ফোঁটা ঝরে পড়ার শব্দ ব্যাঙ আর পোকামাকড়ের ডাক আর দুরের শব্দ।
স্টেশনের শান্টিং ইয়ার্ডে একটা কোনো ইঞ্জিনের হুইসি। আরও দূরে গঙ্গার ধারে শ্মশানে শেয়ালের চিৎকার। সর্বমঙ্গলার মন্দিরের বটগাছে পাচা ডেকে উঠল ক্রাও…ক্রাও…ক্রাও!
সিঁড়ি বেয়ে নিঃশব্দে ওপরের বারান্দায় পৌঁছুল লোকটা। তারপর মাঝের ঘরের দরজায় নক করল। বারকতক নক করার পর চাপা গলায় ডাকল, ইনু, ইনু! ইনু ঘুমুচ্ছ নাকি? ও ইনু!
একটু পরে ভেতর থেকে সাড়া এল, কে?
আমি। বড়দা!
বড়দা! মাঠে ঘুম হল না বুঝি? খ্যা খ্যা খ্যা!
না রে। বড্ড মশা! সত্যি বলছি।
খ্যা খ্যা খ্যা!
হাসছিস যে? মশার কামড় খেলে বুঝতিস। নে, দরজা খোল।
খুলি।
দরজা খুলে গেল। খোলার সঙ্গে সঙ্গে বড়দা ঝাঁপিয়ে পড়ল। খড় খড় খস। খস অদ্ভুত শব্দ হবার সঙ্গে সঙ্গে দুটো টর্চ জ্বলে উঠল এবং প্রায় একই সঙ্গে ঘরের আলোর সুইচও কেউ টিপে দিল। মাত্র একটা সেকেন্ড।
জামাকাপড় পরানো খড়ের তৈরি ডামি মূর্তিটার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেছে বড়দা এবং হাতে চকচকে একটা ছোরা। পেঁচিয়ে গলা কাটতে গিয়ে মুহূর্তে এই নাটকীয় উপদ্রব। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখেই একলাফে যেই বেরুতে গেছে, দরজায় হিন্দুস্থানী সেপাই ডাণ্ডা উঁচিয়ে বলল, আবে ভেসড়িবালে, চুপ সে খাড়া যা! তখন বড়দা কাচুমাচু মুখে ঘুরল এদিকে।
তিনজন পুলিশ অফিসার ঘরের ভেতরে ওত পেতে ছিলেন। রিভলবার দেখে হাত থেকে ছুরি পড়ে গেল বড়দার। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার সামনে এসে বললেন, জানতাম আজ রাতেই যে কোনো সময়ে আপনার আবির্ভাব ঘটবে। তাই সন্ধ্যা থেকে আমরা তৈরি ছিলাম। যাই হোক, ফঁদটা কেমন দেখছেন?
একজন পুলিশ অফিসার হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিলে বড়দা মুখ নামিয়ে ঘোঁত-ঘোত করে বলল, ইনুর সঙ্গে ইয়ার্কি করছিলাম। আমি কি মানুষ খুন করতে পারি?
ইন্দু ভটচায ভেংচি কেটে বললেন, পারো না? তুমি সব পারো! ওঃ, এতক্ষণ আমি গলাকাটা হয়ে বড়বাবুর মতো দরজার কাছে পড়ে থাকতাম। আর নাম হত রঘুয়ার! এবার তো সব জানা গেল। তুমি অপুর পেছনে আমাকে। লেলিয়ে দিয়েছিলে! লোভ দেখিয়েছিলে অপুর সঙ্গে আমার বিয়ে দেবে। আর আমিও এক রামপাঁঠা-তাই বিশ্বাস করে–ছ্যা ছ্যা ছ্যা! ছ্যাঃ! ওয়াক থুঃ!
বড়দার পরনে প্যান্ট-শার্ট, পায়ে রবার সোলের হান্টিং বুট, দুহাতে রবারের দস্তানা, মাথার চুল ঢেকে রুমাল বাঁধা। বড়দা ফুঁসে উঠল। থাম রে লম্পট মাতাল! তোরও রেহাই নেই। তুই-ও ধোয়া তুলসীপাতা নোস। তুই যা যা করেছিস, সব ফাঁস করে দেব কোর্টে।
ইন্দু ভটচায তেড়ে এলেন। কী? কী ফাঁস করবি কোর্টে? কী করেছি আমি? তোর মতো মানুষ খুন করেছি? আপনারা শুনে নিন স্যার! লখনউতে বাইজীদের দালালী করে খেত। পদ্মাবতাঁকে খুন করে ধরা পড়েছিল হাতেনাতে। বড়বাবু এই নেমকহারামকে পুলিশের হাত থেকে ছাড়িয়ে এনেছিলেন। জিগ্যেস করুন, কেন ভাগলপুর ছেড়েছিল চিরকালের মতো? নিজের বউটাকে মেরে কড়িকাঠে ঝুলিয়ে কালীবাবুর বিধবা বোনকে ইলোপ করেছিল। বড়বাবুর জোরে সে দিন ওর ধড় থেকে মুণ্ডুটা খসে যায়নি। উঃ এতটুকু যদি জানতাম, এ ব্যাটাই বড়বাবুকে খুন করে গেছে, আমি তখনই সাবধান হয়ে যেতাম! ভাবতেও পারিনি, বুঝলেন স্যার–যে লোকটা ওর সব সময় মাথা বাঁচিয়েছে, সাহায্য করেছে, নেমকহারাম তারই গলায় ছুরি চালাবে! আমি ভেবেছিলাম রঘুনাথ সাহুর কাজ! ছ্যা ছ্যা ছ্যা! ওয়াক থুঃ!
বড়দা লাল কুতকুতে চোখে তাকিয়ে ছিল। ইন্দু ভটচায আবার গায়ে থুতু ফেলতে এলে সে হাতকড়াআঁটা দুহাত বাড়িয়ে ওঁর গলা টিপে ধরল।
কর্নেল ও পুলিশ অফিসাররা মুখ টিপে হেসে দুজনের বাকযুদ্ধ উপভোগ করছিলেন। এবার কর্নেল বড়দার পেছন থেকে জামার কলার ধরে এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে বললেন, মিঃ শর্মা! মিঃ বড়দাকে যথাস্থানে নিয়ে চলুন। আর ইন্দুবাবু, আপনিও আসুন।
ইন্দু ভটচায ফেঁসে যাওয়া বেলুনের মতো নেতিয়ে গিয়ে বললেন, আমি… আমি কেন স্যার? আমি তো নিজে থেকেই কো-অপারেশান করলাম আপনাদের সঙ্গে। ফার্মে গিয়ে যখনই বলে এলেন আমি বিপন্ন, তখনই চলে আসিনি আপনার সঙ্গে দেখা করতে? সব কথা খুলে বলিনি, বলুন? তারপর আপনার কথামতো শ্যামাকে দিয়ে খড়ের ডামি তৈরি করিয়ে–কী করলাম না স্যার?
হ্যাঁ। যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন খুনীকে ফাঁদ পেতে ধরতে।. ধন্যবাদ ইন্দুবাবু। তবু আপনাকে দরকার। পুলিশের কাছে স্টেটমেন্ট দিতে হবে আপনাকে।
বড়দাকে নিয়ে যাচ্ছিল দুজন কনস্টেবল। বড়দা দরজার কাছে ঘুরে বলল, তুইও বাঁচবি না। আমার চেয়ে তোর পাপ আরও সাংঘাতিক। সব ফাঁস করে দিচ্ছি। আয় না তুই!
ইন্দু ভটচায ভেংচি কাটলেন। আরে যা যা উল্লুকের বাচ্চা ভল্লুক!
চোপ ব্যাটা রামপঠা। লম্পট! মা-মাসি জ্ঞান নেই–লজ্জা করে না?
ইন্দুবাবু গর্জালেন, খুনী! নেমকহারাম! কসাই!
গিদ্ধড়! উজবুক! গাড়োল!…
এইরকম চলতে থাকল বাড়ির গেট অব্দি। শ্যামাকে ওঠানো যায়নি। মনিয়া দয়ালকে জাগিয়েছে। বারান্দায় দুজনে কাঠপুতুল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইন্দুবাবু পিছু ফিরে বললেন, আমি ফেরা না অব্দি জেগে থাকবি মনিয়া! দেখবি চোর ডাকাত না ঢোকে। সদর দরজা এঁটে দিয়ে যা এক্ষুনি।
রাস্তায় পৌঁছে কর্নেল বললেন, ইন্দুবাবু উনি আপনার কোন সম্পর্কে বড়দা?
ইন্দু ভটচায বললেন, রামোঃ! ভাগলপুরে থাকতে পাড়া সম্পর্কে কেউ কেউ বড়দা বলত। আমিও বলতাম। তা যদি বলেন, বরং বড়বাবু–মানে অপুর বাবার সঙ্গে একটুখানি সম্পর্ক ছিল। জ্যাঠামশাই বলতে পারেন কিংবা নাও পারেন–এইরকম আর কী!
আপনি এখনও বিয়ে করেননি?
আজ্ঞে না।
বয়স কত হল?
তা উনপঞ্চাশ হয়ে এল।
আপনি শ্রাবন্তীকে চাবুক মারতেন শুনেছি!
ইন্দু ভটচায ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, বড় জ্বালাত যে মেয়েটা। ছুরিটুরি নিয়ে হাঙ্গামা করত। একরাত্রে তো আমাকে স্ট্যাব করার জন্য ঝুঁপিয়ে পড়েছিল। তবে ভেবে দেখুন, আমি ওর গায়ে হাত তুলি সাধ্য কী? ওই নেমকহারামটা আমাকে বলেছিল, বাড়াবাড়ি করলে চাবুক মেরো। ভূত ছেড়ে যাবে।
সুনেত্রাদের বাড়ির সামনে উত্তেজনায় অস্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সুনেত্রা ও হিমাদ্রি। এঁদের দেখে রাস্তায় নেমে এল। এ রাস্তায় ল্যাম্পপোস্ট নেই। চাঁদটা আবার মেঘে ঢেকেছে। কিন্তু গেটের মাথায় একটা বাল্ব জ্বলছে। সেই আলোয়। হাতকড়া পরা বড়দাকে দেখেই থমকে দাঁড়াল দুজনে। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না ওরা।
কর্নেল সামনে এসে বললেন, ফাঁদ পাতা ব্যর্থ হয়নি, ডার্লিং!
সুনেত্রা প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, এ কী কর্নেল জেঠু! ওই লোকটা যে খুকুদির কর্নেল জবাব দেবার আগেই পিছন থেকে হিমাদ্রি বলে দিল, খুকুদির মামা বনবিহারী চক্রবর্তী। ১১ এপ্রিল খুকুদির বাবাকে খুন করে কাটা আঙুল রুমালে জড়িয়ে ভাগলপুর গিয়েছিল ব্যান্ডেজ বাঁধতে।..
.
কার কী ভূমিকা
থানা থেকে কর্নেল ফিরলেন, তখনও সুনেত্রা, হিমাদ্রি আর সুনয়নী জেগে আছেন। শ্রাবন্তী ঘুমিয়ে গেছে নিচের ঘরে। রাত প্রায় সাড়ে বারোটা।
ফেরার সঙ্গে সঙ্গে গরম কফি পেয়ে গেলেন কর্নেল। সুনয়নী বললেন, ওই গুণধর মামার কীর্তির কথা বলছিলাম এতক্ষণ এদের। কিন্তু ভাবতেও পারিনি সে নিজের ভগ্নীপতিকে খুন করবে!
সুনেত্রা বলল, তুমি চুপ করো তো, মা! তারপর সে কর্নেলের দিকে তাকাল। কেমন করে বুঝলেন ওই লোকটাই খুনী?
কর্নেল একটু হাসলেন। ১৮ জুলাই সকালে ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ীর সঙ্গে ভবানীপুরে বনবিহারীবাবুর বাড়ি গিয়েছিলাম। ওঁর ডান তর্জনীর ডগায় কাটা দাগ দেখতে পেলাম। মাথায় বাবরি চুলও আছে। মনে হল সেতার বাজান ভদ্রলোক। তাই মেজরাবের দাগ। জিগ্যেস করলে সায় দিলেন। কিন্তু আমার চোখ রয়ে গেল ওখানে। একটু পরে বুঝলাম, ওটা মেজরাবের দাগ হতেই পারে না। দাগটা মোটা এবং আঙুলের পেছন অব্দি রয়েছে। তাহলে ওটা কাটার দাগ। অথচ ভদ্রলোককে সেতারশিল্পী বলায় মেনে নিলেন দিব্যি। খটকা লাগল। আমার চোখ গেল ওঁর স্ত্রীর দিকে। দেখলাম, মুখের রেখা হঠাৎ বদলে গেছে। খটকা বেড়ে গেল। ব্যস, এই থেকে শুরু।
হিমাদ্রি বলল, কম্পাউন্ডার রুনুবাবু সাক্ষী দেবেন।
সুনেত্রা বলল, শুধু ওই একজনের এভিডেন্স আদালত মেনে নেবে?
কর্নেল চুরুট জ্বেলে বললেন, হুঁ–তুমি ল পড়লে উকিল হতে পারতে, বিবি। ঠিকই বলেছ। তবে আমার হাতে এভিডেন্স একাধিক। দশ এপ্রিল বিকেল পাঁচটার আপ দিল্লি পাসেঞ্জারে বনবিহারীবাবু সেতাপগঞ্জ স্টেশনে নেমেছিলেন। স্টেশন মাস্টার হরিদপদবাবু সাক্ষী। রাতে রেস্ট রুমে ছিলেন। তার রেকর্ড আছে। তারপর গতকাল বিকেল পাঁচটায় একই গাড়িতে পৌঁছে বনবিহারীবাবু ফের রেস্টরুম বুক করেন। রাতে রেস্টরুমে ছিলেন। আজ ভোরে সোজা মাঠের ফার্মে চলে যান। আমি দূর থেকে বাইনোকুলারে ওঁকে দেখতে পেয়েছিলাম। তখনই বুঝেছিলাম, ওঁর মতলব খারাপ। কারণ ইন্দু ভটচাযকে এবার না সরালে জোতদার বাচ্চু সিংকে জমিজমা বেচতে বাগড়া পড়বে।
আপনি বাচ্চু সিংয়ের কথা জানতেন বুঝি?
হিমাদ্রি বলল, আমি বলেছিলাম কর্নেলকে। তারপর ওঁর কথামতো ভাগলপুরে গিয়ে এই কাজটাও সেরে ফেললাম। বাচ্চু সিংয়ের ওখানে ট্রান্সপোর্টেরও কারবার আছে। সোজা বলে দিল, রুদ্রবাবুর সব প্রপার্টি শিগগির কিনে নিচ্ছে। রুদ্রবাবুর শ্যালক নাকি আইনত গার্জেন।
কর্নেল বললেন, বনবিহারীবাবু আমাকে বলেছিলেন, রুদ্রেন্দুবাবু কোনো উইল করে যাননি। অথচ এখানকার পুলিশের সঙ্গে কলকাতা পুলিশের মারফত যোগাযোগ করে জানতে পেরেছিলাম, উইল করে গেছেন। তাতে তিন মেয়ের গার্জেন করা হয়েছে মামা বনবিহারী চক্রবর্তীকে। রুদ্রেন্দুবাবু জানতেন শ্যালক কী জিনিস। তবু উপায় ছিল না হয়তো। ইন্দুবাবুকে বিশ্বাস করতে পারেননি। কারণ ইন্দুবাবু লম্পট প্রকৃতির লোক। আফটার অল, মামা হয়ে ভাগ্নীদের সর্বনাশ করবেন, কে ভাবতে পারে?
সুনেত্রা বলল, ইন্দু ভটচাযের হাতে হ্যান্ডকাফ পরানো হয়নি যে? কর্নেল হাসলেন। ইন্দুবাবু রাজসাক্ষী হবেন।
কিন্তু ও অসভ্যতা করেছে অপুর সঙ্গে। খুকুদিকে চাবুক মেরেছে!
ইন্দুবাবু যাতে আর বসন্তনিবাসে না ঢুকতে পারেন, তার ব্যবস্থা করা হবে। কর্নেল সুনয়নী দেবীর দিকে ঘুরলেন। মিসেস ত্রিবেদী! শিগগির অপালার জন্য বুদ্ধিমান এবং শক্তিমান পাত্র দেখে দিন। স্থানীয় ছেলে হওয়াই ভাল। তেমন। নেই কেউ?
সুনয়নী বললেন, আছে বৈকি। পাত্র আবার নেই। দেখবেন, খুকুর অসুখ সেরে গেলে তার জন্যও বর ঠিক করে দেব।
সুনেত্রা হাসল। মা এ সব ব্যাপারে খুব এক্সপার্ট!
সুনয়নী ফোঁস করে উঠলেন, শুধু তোমার ব্যাপারেই এক্সপার্ট হতে পারলাম না, এই দুঃখ। তবে থামো একটুখানি। বর্ষার মাসটা যাক।
সুনেত্রা তক্ষুনি খাপ্পা হয়ে বলল, ছোড় দো জী ফালতু বাত। আননেসেসারি টকিং! এখন একটা সিরিয়াস কথাবার্তা হচ্ছে। আর ওঁর মাথায় খালি–
হিমাদ্রি মুখ ফিরিয়ে আস্তে বলল, কপালে শেষ পর্যন্ত খোট্টা বর আছে, বিবি। সাবধান! তারপর সে একটু কেসে কর্নেলের দিকে ঘুরল। নাও সিরিয়াস টকিং! কর্নেল, বলুন!
সুনেত্রা চোখ কটমট করে হিমাদ্রির দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ ফিক করে হেসে বলল, হ্যাঁ কর্নেলজেঠু, বলুন–কেন সন্দেহ হয়েছিল খুকুদির মামাকে?
কর্নেল চোখ বুজে ইজিচেয়ারে বসে দুলছিলেন। ঠোঁটে কামড়ানো চুরুট। চোখ খুলে বললেন, ওই তো বললাম। তবে তাছাড়া আর কিছু ব্যাপারে খটকা বেধেছিল। যেমন ধরো, এখানে ভাগ্নীদের এই অবস্থা–অনাথ, নিঃসহায় দুটি অবিবাহিতা মেয়ে। এক বোন রুগ্ণ। মানসিক ব্যাধিতে ভুগছে। অন্য বোন বলতে গেলে একা। মাথার ওপর একজন–অনাত্মীয়ই বলা যায়, নেহাত কর্মচারী। অতসব জমিজমা দেখাশোনা, সংসার, টাকাকড়ি–সব তার হাতে। এই অবস্থায় তাদের মামা চুপচাপ সুদূর কলকাতায় বসে আছেন। এসে মাথার। ওপর দাঁড়াচ্ছেন না। এটা কি অস্বাভাবিক নয়? আমি ভেবেছি–ভেবে কোনো সূত্র পাইনি। কেন বনবিহারীবাবু সেতাপগঞ্জে গিয়ে থাকছেন না?
হিমাদ্রি বলল, অথচ ওঁর এখানে এসে থাকাটাই তো উচিত। কারণ বাচ্চু সিংকে ভগ্নিপতির জমিজমা বেচে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই খুন করেছেন ভগ্নিপতিকে।
তুমি ঠিকই বলেছ। এখানে এসে আইনমোতাবেক অর্থাৎ উইল অনুসারে গার্জেন হয়ে থেকে অপালা আর শ্রাবন্তীকে মিথ্যা বুঝিয়ে শাদা স্ট্যাম্পড পেপারে সই করিয়ে নেওয়াও এমন কিছু কঠিন ছিল না। অথচ বনবিহারীবাবু আসছিলেন না।
সুনেত্রা বলল, কিন্তু কেন? অসুবিধেটা কী ছিল?
কর্নেল নিভন্ত চুরুট ফের জেবেলে নিয়ে বললেন, ছিল। অসুবিধেটা হল ইন্দুমাধব ভটচায। লোকটার অনেক দোষ। লম্পট, কিছুটা নির্বোধও বটে, গোঁয়ারগোবিদ প্রকৃতির এবং হঠকারী। কিন্তু সে সিনসিয়ার। নিজেকে সে ও বাড়ির প্রকৃত গার্জেন ভেবে বসেছিল। কারণ তাকে হাতে রাখার জন্য তার মনে লোভ জাগিয়ে দিয়েছিলেন বনবিহারীবাবু–অপালার সঙ্গে তার বিয়ে দেবেন বলে। ইন্দুবাবু তাই বিশ্বাস করে বসেছিলেন। তাছাড়া অপুর প্রতি তার বহুদিনের। লোভও ছিল। তাকে সঙ্গে নিয়ে মাঠঘাটে থেকেছেন। জংলি স্বভাব গড়ে উঠেছে অপুর। ইন্দুবাবুর মেঠো মানসিকতায় এই টাইপের মেয়েকে পছন্দ করা স্বাভাবিক।
সুনেত্রা বলল, বাপের বয়সী, সেটা ভাবেনি ছোটলোক?
কর্নেল হাসলেন। পুরুষচরিত্র এরকমই, ডার্লিং! বলে চোখ বুজলেন আবার। দুলতে দুলতে বললেন, ইন্দুবাবু ভেবেছিলেন, শিগগির তো বাড়ির জামাই হয়ে যাচ্ছেন! তাই মন দিয়ে চাষবাসে মেতে উঠেছিলেন। অপুদের জমি যে বেদখল হয়ে যায়নি, সেটা এই লোকটার জন্যই। কাজেই বুঝতে পারছ, বনবিহারীবাবু যতদিন না ইন্দুবাবুকে সরাতে পারছেন, ততদিন তাঁর এখানে এসেও লাভ হত না। ইন্দুবাবুর হাতেও লোকজন আছে। একজন আউটসাইডারকে সহজে ঘেঁসতে দিতেন না। তাই বনবিহারীবাবু সুযোগের অপেক্ষায় বসে ছিলেন। অথবা মনঃস্থির করতে পারছিলেন না। তারপর অপালা পালিয়ে গিয়ে ওঁর আশ্রয় নিতেই টের পেলেন, ইন্দুমাধবের তর সইছে না জামাই হতে। অপালা হাত ফসকে যেতে লোকটা এবার খচে গেছে। বনবিহারীবাবুকে আর ঘেঁসতেই দেবে। না ওখানে। তখন আর অপেক্ষা করা যুক্তিযুক্ত মনে করলেন না বনবিহারীবাবু। সটান এসে হাজির হলেন।
হিমাদ্রি বলল, ফার্মেই তো ইন্দুবাবুকে খুন করতে পারত সে!
পারতেন না। ফার্মে লোক থাকে। ফসল পাহারা দেয় সবসময়। ক্ষেতের কাজকর্ম করে। দিনদুপুরে ওখানে ইন্দুবাবুকে খুন করা অসম্ভব। তাই রাতে এসে হানা দিয়েছিলেন।
সুনেত্রা বলল, দুপুরে হন্তদন্ত এসে ইন্দুবাবু আমাকে জিগ্যেস করল আপনার কথা। তখন আপনি বেরিয়ে গেছেন–
থানায় গিয়েছিলাম। থানা থেকে বেরুতেই দেখা হল। বললেন, কথা আছে।
সুনয়নী হাই তুলে বললেন, দেড়টা বাজতে চলল। কর্নেলসায়েবের কি ক্ষিদে পায়নি?
সুনেত্রা বলল, তুমিও তো অদ্ভুত। মা! চুপচাপ বসে আছ! লক্ষ্মীদি দেখ গে ঘুমিয়ে পড়েছে।
সুনয়নী উঠলেন। না। ওকে খুকুর পাহারায় রেখেছি। লক্ষ্মী ঘুমোবার মেয়ে নয়।
সুনয়নী বেরিয়ে গেলে হিমাদ্রি বলল, ইন্দু ভটচায আপনাকে খুকুদির মামার কথা বলল নাকি?
কর্নেল বললেন, প্রথমে বলতে চাননি। পরে কবুল করলেন। বললেন, অপুর মামা এসে আমাকে কলকাতা নিয়ে যেতে চাইছেন। ওখানে গিয়েই বিয়েটা হয়ে যাবে। জোর করে মেজভাগ্নীর বিয়ে দিয়েছিলেন। ছোটরও দেবেন।
তাই বলেছিল বুঝি?
কিন্তু ইন্দুবাবু মাঠঘাট ছেড়ে নড়ার পাত্র নন। সেই নিয়ে কথা কাটাকাটি। শেষে গোঁ ধরে বললেন, ভাগ্নীকে এখানে এনে বিয়ে না দিলে আর বিয়েই করবেন না। বুঝতে পারছ তো? বনবিহারীবাবুর মতলব ছিল, কলকাতা নিয়ে গিয়ে কিংবা পথেই খতম করে ফেলবেন ইন্দুবাবুকে।
সুনেত্রা তাড়া দিল। এনাফ অফ ইট! খেতে চলুন তো এবার। কান ঝালাপালা হয়ে গেল। আর ভাল লাগে না ওসব কথা।
বলল ভাল লাগে না, কিন্তু কিছুক্ষণ পরে নিচের ডাইনিং রুমে সুনেত্রাই আবার ওই কথা তুলল। হঠাৎ বলল, কর্নেলজেঠু! একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছেন?
কর্নেল তাকালেন। হাতে মুর্গির ঠ্যাং।
সুনেত্রা বলল, খুকুদিদের ফ্যামিলিতে ১১ তারিখটা অপয়া।
হিমাদ্রি বলল, কেন?
১১ এপ্রিল খুকুর বাবা খুন হলেন। ১১ জুলাই টুকু খুন হল!
কর্নেল তো বলেই দিয়েছেন ১১ এপ্রিল প্রেরণা দিয়েছিল ১১ জুলাইকে।
আর আজ ইন্দুবাবু খুন হতে যাচ্ছিল–আজও ১১ তারিখ।
যাঃ! আজ পঁচিশ জুলাই।
না বুঝে কথা বলো না তো! সুনেত্রা রেগে গেল। আজ বাংলা শ্রাবণ মাসের ১১ তারিখ, তা জানো?
কর্নেল মুর্গির ঠ্যাংয়ে কামড় দিয়ে মন্তব্য করলেন, বিপজ্জনক ১১।
.
উপসংহার
মাসদুই পরের কথা। কর্নেল এলিয়ট রোডে তার অ্যাপার্টমেন্টের ছাদে বিকেলবেলায় সেতাপগঞ্জ থেকে সংগৃহীত একটা অর্কিডের পরিচর্যা করছিলেন। যষ্ঠী এসে বলল, বাবামশাই, ফোং!
সর্বনাশ! তোর নালবাজারের নাহিড়ীসায়েবের নয় তো রে?
ষষ্ঠী দাঁত বের করল। আজ্ঞে না বাবামশাই, পাগলাগারদের।
কী বলছিস হতভাগা?
হ্যাঁ গো! পাগল ভাল করেন, সেই ডাক্তারবাবুর। দেখুন না গিয়ে!
ডাঃ ভাদুড়ীর ফোন! হাসতে হাসতে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালেন কর্নেল। থা, তোকে ওঁর পাগলাগারদে পাঠাবার ব্যবস্থা করে আসি।
ষষ্ঠী বলল, আগে আপনি গিয়ে ঢুকবেন। পেছন পেছন বরঞ্চ আমি গিয়ে ঢুকব।
আমাকে তুই পাগল বলছিস?
সবাই বলে।
বড় সাহস বেড়েছে দেখছি। বলে হাসতে হাসতে কর্নেল ড্রইং রুমে ঢুকলেন।
ফোন তুলতেই সাইকিয়াট্রিস্ট ডাঃ ভাদুড়ীর সাড়া পেলেন। কর্নেল! আপনার পেমেন্টের সাইকো-অ্যানালেটিক রেজাল্ট শুনুন। একডজন সিটিংয়ের পর সাকসেসফুল হয়েছি। ভেরি ইন্টারেস্টিং!
বলুন ডাঃ ভাদুড়ী!
বারো বছর বয়সে একদিন সন্ধ্যাবেলা প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টির সময় বাড়ির একতলার একটা ঘরে পেসেন্ট ওয়াজ ব্লুট্যালি রেপড বাই এ ম্যান বুঝলেন তো? যাকে সে কাকা বলত। ভয়ে লজ্জায় কাউকে বলতে পারেনি। সেদিন তার বাবা-মা বাড়িতে ছিলেন না। পুওর গার্ল! ভীষণ শক পেয়েছিল। তারপর ক্রমশ হিস্টেরিক সিম্পটম ডেভলাপ করতে থাকে। অবদমনের প্রতিক্রিয়া।
বুঝতে পারছি। আর কিছু?
একটা সাংঘাতিক কথা ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। আপনার কাজে লাগতে পারে।
কী?
ওর বাবাকে যে ছুরি দিয়ে মার্ডার করা হয়েছিল, সেটা কুড়িয়ে পেয়ে লুকিয়ে রেখেছিল।
জানি। আর কিছু?
খিড়কির দরজা দিয়ে ঠিক ওইসময় একপলকের জন্য ওর মামাকে দেখতে পেয়েছিল–জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন ভদ্রলোক। সেই থেকে মামার প্রতি আতঙ্ক এবং ঘৃণা।
এনিথিং এলস?
দিস ইজ মোর ইমপর্ট্যান্ট। আজ দুপুরে হিপোটিজম প্রয়োগ করেছিলাম। বাবা মার্ডার হবার আগের দিন সন্ধ্যায় দোতলার জানালা থেকে মামাকে পেছনের জঙ্গলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল। পরে ভেবেছিল, চোখের ভুল। কারণ ভদ্রলোক তখনই ঝোঁপের আড়ালে সরে যান। কিন্তু সন্দেহটা থেকে গিয়েছিল, তার মামা কেন ওভাবে লুকিয়ে থাকবে? আমি বারবার প্রশ্ন করে জানতে পারলাম, ওর মামা লোকটি মোটেও সৎ লোক ছিল না। জিগ্যেস করলাম, বাবাকে ব্যাপারটা জানিয়েছিল কি না। বলল, জানায়নি। কাউকে জানায়নি। কারণ ফিটের ঘোরে আবোল তাবোল কথা বলত বলে কেউ ওর কথা গ্রাহ্য করত না। তাই এসব কথা চেপে রেখেছিল। আসলে এসব– পেসেন্টের অসুখের উৎপত্তি সাপ্রেশান থেকে এবং যত দিন যায়, সাপ্রেশান তত বাড়তে থাকে। সজ্ঞান অবস্থায় আর মুখ খুলতেই চায় না। যা কিছু দেখে, সবই সাপ্রেসড হয়ে যায়–চলে যায় অবচেতনায়। ফলে একটা আগে দেখা কোনো ঘটনা সঙ্গে সঙ্গে ভুলে যায়। সাইকলজি শাস্ত্র বড়–
ধন্যবাদ ডাঃ ভাদুড়ী! ছাড়ি।
ভাববেন না। মাস তিনেকের মধ্যে নর্মাল করে তুলব। মিস প্যাটির ব্যাপারটা দেখেছেন তো?
কর্নেল ফোন রেখে ছাদে উঠে গেলেন। পড়ন্ত বেলার শেষ আলোয় হঠাৎ আবিষ্কার করলেন, শরৎকাল আসন্ন। এবার শরতে সেতাপগঞ্জেই যাচ্ছেন। কালো ডানার ওপর লাল-হলুদ ফুটকিওলা প্রজাপতিগুলো–তাছাড়া হিমাদ্রি ও সুনেত্রার বিয়ের নেমন্তন্নও আছে। সত্যি, প্রজাপতি বড় রহস্যময় জীব।