মাপ

মাপ

কাঁচা ইট পোড়ালে যদি শক্ত হয় তাহলে দুর্গাপুরের দুটো সাদা বেড়াল তিনটে নেংটি ধরবে না কেন?

কী রকম লাগছে যুক্তিটা?

আবোল-তাবোল আর হ-য-ব-র-ল-এর জট-পাকানো হারানো পাণ্ডুলিপি খুঁজে পেয়ে, তা থেকে টাটকা আমদানি করলাম মনে হচ্ছে?

সন্দেহ হচ্ছে কি যে হঠাৎ দুনিয়ার মাথার ঘিলু নিয়ে কেউ ঘোল বানিয়ে ফেলেছে?

এমন যুক্তি কারুর পক্ষে দেওয়া সম্ভব? সম্ভব বই কী! এমন যুক্তি দিতে পারেন শুধু একজন, আর সেই যুক্তির প্যাঁচে ফেলে নয়-কেহয় করে ফেলতে পারেন কথার ভেলকিবাজিতে। তাল নয়, সুতোয় একটু ঢিল পেলেই তিনি তিলকে পিষে একেবারে মোরগ-তন্দুরি আদায় করে ছাড়তে পারেন তা থেকে।

চালের ভুলে কি বিনা খেয়ালে তাঁর যুক্তির জাঁতাকলে একবার আটকা পড়লে আর রক্ষা নেই।

সেই বিপদ ঠেকাবার জন্যেই বাহাত্তর নম্বর বনমালি নস্কর লেনের একটা দিশেহ্বারা অবস্থা চলেছে ক দিন।

বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র—গত এই তিন দিন আমাদের চেহারা চাল-চলন দেখে কেউ কেউ বেশ একটু তাজ্জব হয়েছে নিশ্চয়ই। বনমালি নস্কর লেনের মেস বাড়িতে তো শুধু নয়, আমাদের দেখা গেছে বেপোট বেয়াড়া এমন সব জায়গায় যেখানে আমাদের উপস্থিতি সন্দেহজনক যদি না হয়, তাহলেও রহস্যজনক নিশ্চয়!

চেনা দু-চারজনের চোখে পড়ে তাদের প্রশ্নবাণে বেশ একটু বিব্রত হতে হয়েছে আমাদের সকলকেই।

তা প্রশ্ন যারা করেছে তাদেরই বা দোষ কী!

এই গরমের ঠা ঠা রোদুরে ভরা দুপুরবেলা শিবুকে যদি হঠাৎ বৈঠকখানা বাজারে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়, তাহলে চোখ একটু কপালে ওঠা অন্যায় নয়।

একটু সন্দিগ্ধ প্রশ্নও তারপর স্বাভাবিক।

বয়স্ক কেউ হলে বলেছেন, কী হে শিবদাস, ব্যাপার কী? দুপুরবেলা এ বাজারে কেন?

তা আপনিই বা এ বাজারে দুপুরবেলা করছেন কী? পালটা প্রশ্ন করবার ইচ্ছে হলেও বয়সের মর্যাদা দিয়ে শিবুকে সে লোভ সামলাতেই হয়!

তা ছাড়া তার নিজের অবস্থা যে অত্যন্ত কাহিল। দুপুর রোদে বাজারে কেন সে যে ঘুরে মরছে তার কৈফিয়ত কি সে সোজাসুজি দিতে পারবে? বলতে পারবে যে এক বিশেষ রঙের আর গড়নের এমন একটি মাটির তৈরি আধার সে খুঁজছে যার মধ্যে টিকের আগুনের ওপর তাম্রকুটের বটিকা সলিল সহযোগে পান করে স্বর্গীয় আনন্দ পাবার মতো ধুমরাশির সৃষ্টি হয়?

চোখ কান বুজে মরিয়া হয়ে এ-বাজারে এমন সময়ে মধ্যাহ্ন ভ্রমণের উদ্দেশ্য স্বীকার করে ফেললেও যে রেহাই নেই। তার পরের প্রশ্নের ফ্যাঁকড়া সামলাতেই যে প্রাণান্ত হবে।

অ্যাঁ! কলকে! কেন কাকে? এ রোগ আবার কবে থেকে হল? তা এই কাঠফাটা রোদে না কিনতে বার হলে নয়, এমন বেয়াড়া মৌতাত?

এমন অসময়ে বদনামের পয়লা ছোপ লাগানো কলকের মতো জিনিস কেন যে বাধ্য হয়ে খুঁজতে বেরুতে হয়েছে তা যখন বলা যাবে না তখন ধরাপড়া চোরের মতো কাঁচুমাচু মুখ করে যা হোক কিছু বিড়বিড় করে বলে সরে পড়া ছাড়া আর কী করবার আছে?

বৈঠকখানায় বাজারের বদলে কালিঘাটের মন্দিরের রাস্তায় ফুটপাথে পাতা ফেরিওয়ালাদের সওদা ঘাঁটতে বসলেও নিস্তার নেই।

আরে, গৌর না?

নিজে থেকে দেখাতে চাইলে চৌরঙ্গি দিয়ে ক্যাডিল্যাক হাঁকিয়ে গেলেও হয়তো কারুর চোখে পড়ে না, কিন্তু ঠিক এই বেয়াড়া সময়টিতে ঠাসা ভিড়ের মাঝখানেই বছর ভোর যার সঙ্গে দেখা নেই এমন চেনা লোকটির চোখে নির্ঘাত পড়ে যেতে হয়।

গৌর নিজের পরিচয়টা আর অস্বীকার করে কী করে? হ্যাঁ, ভাল তো! গোছের কিছু লৌকিকতার জবাব দিয়ে তাকে সরে পড়বার চেষ্টা করতে হয়। কিন্তু কমলি ছাড়বে কেন? বেয়াড়া প্রশ্নগুলো শুরু হয় এবারই।

এখানে রাস্তায় বসে কী কিনছিলি? এখানে তো পাড়াগাঁ মফঃস্বলের যাত্রী মেয়েছেলেরা ঠাকুর দেখে ফেরবার সময় ফিতেটা, মাথার কাঁটাটা, সস্তা আয়নাটা কিনে নিয়ে যায়। তোর সে সব দরকার না কি?

বিদ্রূপটা বেমালুম হজম করে, না, মানে,—এই বলে আমতা আমতা করে আবোল-তাবোল একটা কিছু বলে গৌর সরে পড়তে দেরি করে না।

শিবু কি গৌরের যেমন, আমাদের অবস্থা কি তার চেয়ে ভাল কিছু? মোটেই না।

বৈঠকখানা বা কালিঘাটের বদলে ব্যাঁটরা কি বেলেঘাটায় শিশির বা আমার সমান অপ্রস্তুত চেহারা।

শহর থেকে শহরতলির অমন সব বেয়াড়া বেপোট জায়গায় অসময়ে ঘুরে ফিরে আমরা খুঁজছি কী?

ঠিক জানি না।

কিন্তু কেন যে আমাদের এই দিশাহারা হয়ে ঘোরা-ফেরা তা বলতে পারি।

গোড়ায় যা দিয়ে শুরু করেছি, খ্যাপার মতো এ টহলদারি শুধু সেই ঘিলু ঘোলানো যুক্তির জাঁতাকল এড়াবার জন্য। কী আমরা চাই তা ঠিক জানি না, তবে জাঁতাকলের ঝাপটায় পড়া যাতে ঠেকানো যায়, তার জন্য যতটা সম্ভব সাজসরঞ্জাম নিয়ে তৈরি হয়ে থাকতে চাই।

কাঁচা ইট পোড়ালে যদি শক্ত হয় তাহলে দুর্গাপুরের দুটো সাদা বেড়াল তিনটে নেংটি ধরবে না কেন। এই তো যুক্তির নমুনা।

যত আজগুবিই হোক-এ-যুক্তি শেষ প্যাঁচ পর্যন্ত যাতে না পৌঁছোত পারে তার জন্য একেবারে গোড়াতেই কোপ বসাতে চাই আমরা।

ইট শক্ত কি না বলবার সুযোগ না দিয়ে সাদা বেড়ালের নেংটি ধরার কথা তো আসে না। যুক্তি প্রলাপের প্রথম ধাপটাই তাই আমরা পাততে দেব না ঠিক করেছি।

পাততে দেব না কাকে তা আর বোধহয় বলে বোঝাতে হবে না।

একমেবাদ্বিতীয়ম্ ঘনাদা ছাড়া আর কার পক্ষে ন্যায়শাস্ত্র নিয়ে এমন ছিনিমিনি সম্ভব?

যুক্তির প্রথম ধাপটি পাতবার জন্য তিনি যে তৈরি হচ্ছেন, বুধবার সকালেই তা টের পেয়েছি আমাদের বনোয়ারিলালের ভগ্নদূতের চেহারা নিয়ে ঘরে ঢোকা থেকেই।

ছুটির দিন নয়, কিন্তু কী একটা দারুণ কারণে বুধবারটা আমাদের পাড়া বন্ধ বলে ঘোষিত হয়েছে। সারা বাংলা কি কলকাতা নয়, বন্ধু শুধু আমাদের বারো-তেরো-চোদ্দ পল্লী। এখন থেকে পল্লী ধরেই নাকি বন্ধ চালু রাখা হবে। কাজে কর্মে যাবার তাড়া না থাকায় সকালবেলাই আড্ডা ঘরে এসে জমায়েত হয়েছি টঙের ঘর থেকে নামবার সিড়ির দিকে কান পেতে রেখে।

ঘনাদা নয়, সিঁড়ি দিয়ে নেমে ঘরে ঢুকেছে বনোয়ারিলাল। একেবারে কাঁদো কাঁদো চেহারা।

মুখে সে কিছু বলেনি। করুণ নিবেদনটা নীরব মুখেই ফুটিয়ে এসেছে।

কী রে, কী হল কী! আমাদেরই জিজ্ঞাসা করতে হয়েছে সন্ত্রস্ত হয়ে, বড়বাবুর মেজাজ গরম নাকি?

হাঁ, বড়া গরম। বনোয়ারি সরলভাবে অপরাধ স্বীকার করেছে, হামার কসুর হেইয়ে গেছে।

কী কসুর হল? আজ এই এমন দিনে সক্কাল বেলাই গণ্ডগোল বাধিয়ে বসলি। দিনটাই দিলি মাটি করে!

একসঙ্গে আমাদের সকলের প্রশ্নবাণের সামনে হতভম্ব হয়ে বনোয়ারিলালের প্রায় বোবা হবার অবস্থা। অনেক কষ্টে তার সাড়া ফেরাবার পর সে জানালে যে সকালে বড়বাবুর ঘর ঝাঁট দিতে গিয়ে সে তাঁর একটা লোকসান করে ফেলেছে।

কী লোকসান? কী? আমরা উদ্বেগে ব্যাকুল হয়ে জানতে চাইলাম।

সে হামি জানে না! বনোয়ারি যথাযথ বিবরণ প্রকাশ করলে, হামি ঝাড়ু দিতে আছিলাম, বড়বাবু আচানক গোসা হয়ে আমাকে বাহার যেতে বললে। বোললে হামি বহুৎ লোকসান কোরে দিয়েছি।

কী করেছিস, কী? ভেঙেছিস কিছু?

বনোয়ারি আমাদের প্রশ্নে প্রবল ভাবে মাথা নেড়ে জানালে যে জ্ঞানত কোনও কিছু সে ভাঙেনি, নষ্টও করেনি কিছু।

তাহলে?

বনোয়ারিকে বিদায় দিয়ে তখনই আমাদের মন্ত্রণা সভায় বসতে হল। ব্যাপারটা আসলে যে কী তা আমাদের আর বুঝতে বাকি নেই।

আহাম্মক বনোয়ারির দোষে কোনও কিছু লোকসান হয়েছে এ-ই হল প্রথম ধাপ। এই ধাপটুকু পাততে দিলেই কাঁচা ইট পোড়ালে শক্ত হয়-এর পর সাদা বেড়ালের ইদুর ধরার মীমাংসায় ঘনাদা আমাদেরও ঠেলে তুলবে।

প্রথম ধাপ পাতাটাই ভেস্তে দিতে হবে।

কী লোকসান হয়েছে ঘনাদার? তাঁর কোন রাজকীয় ঐশ্বর্যই বা খোয়া যেতে পারে?

যাক বা না যাক বনোয়ারির ঘাড়ে দোষ চাপাবার সুযোেগই তাঁকে দেওয়া হবে না। যা কিছু হারিয়েছে বা লোকসান হয়েছে তিনি বলতে পারেন, সব আগে থাকতে, এমন মজুত রাখব যে মুখের কথা খসতে না বসতে হাজির করব সামনে। বোয়ারির ঘর সাফের গলতি থেকে ঘরের দেওয়ালে একটা জানালা ফোটাবার আবদারে কিছুতে তিনি যাতে না পৌঁছোতে পারেন।

হ্যাঁ, এই আবদারই ধরেছেন ঘনাদা আজ কয়েকদিন হল। তাঁর ঘরে একটা মাত্র জানালা হাওয়া খেলবার জন্যে আরেকটা না খোলালে নয়।

বোঝাতে কিছু তাঁকে বাকি রাখিনি। বলেছি যে বাড়িওয়ালা অতি সজ্জন ব্যক্তি। পুরোেনো হোক সেকেলে হোক বছরের পর বছর নামমাত্র ভাড়ায় এ বাড়ি আমরা প্রায় মৌরসিপাট্টা নিয়ে ভোগদখল করে আসছি। ভাড়া বাড়াবার কথা তিনি ভুলেও একবার উচ্চারণ করেননি, কিন্তু স্নাদার টঙের ঘরে দক্ষিণের জানালা ফোটানে আঁয় সাধ্যের বাইরে। আগের আমলের ঝড়, এখনকার আনে জানালা খুলতে যতখানি জমি ছাড়া দরকার ততখানি দক্ষিণ দিকে নেই। সুতরাং জানালা ফোটানোর কথা উঠতেই পারে না।

কিন্তু ঘনাদা তাঁর সেই এক আবদার ধরে বসে আছেন। বাইরে ক-দিন একটু চুপচাপ থাকলেও ভেতরে ভেতরে যে তিনি ধোঁয়াচ্ছেন বনোয়ারির ওপর সেদিন সকালের হম্বিতম্বি থেকেই তা টের পাওয়া গেছে।

ঘরের জিনিস হারানোর ব্যাপারটাই যুক্তির প্যাঁচে পাকিয়ে পাকিয়ে এবার তিনি দেওয়াল কুঁড়ে জানালা ফোটাবার অস্ত্র করে তুলবেন।

কিন্তু সেটি হতে দেব না, আমাদেরও পণ।

ঘনাদার পক্ষে কী হারিয়েছে বলা সম্ভব?

আমরা তালিকা করে ফেলেছি তৎক্ষণাৎ। তক্তপোশ তোরঙ্গ শেলফ আলনা বাদে, হারাতে পারে এমন অস্থাবর জিনিস মাত্র কটিই পেয়েছি। তাঁর হুঁকোর কলকে, মাথায় চিরুনি, নখের নরুন, সেলাই-এর ছুঁচ আর…আর…কানখুশকির কাঠি! হ্যাঁ, নিরিবিলিতে ঘনাদাকে চোখ বুজে তন্ময় হয়ে এই শলাকাটি কানে দিয়ে যেন তুরীয় আনন্দ পেতে দেখা গেছে। শুধু একটু ঝাঁটা চালানোতে এই ক-টি ছাড়া হারাবার তাঁর কিছু নেই।

কজনে মিলে বাজার কুঁড়ে ওই কটা জিনিস কিনতে বেরিয়েছি সেদিন দুপুরেই। জিনিস অতি সামান্য, কিন্তু ওই সামান্য জিনিস কেনারই এত ঝামেলা তা আগে ভাবতে পেরেছি? শুধু জিনিসটা হলেই তো হবে না, ঘনাদার নিজস্ব সম্পত্তির সঙ্গে তার হুবহু মিল হওয়াও চাই।

কলকের কথাই ধরা যাক না। বাজারে অভাব নেই। কিন্তু ঘনাদার স্পেশ্যাল ব্র্যান্ডের গড়ন, রং, মাপ তো আর মুখস্থ করা নেই। কলকের বেলা যেমন—চিরুনি, নরুন, খুশকির কাঠির বেলাতেও তাই। কান-খুশকি, তামা না পেতল না নিকেলের, কী তার মাপ অত কি লক্ষ করে দেখেছি।

তা মাপ এক চুল এদিক-ওদিক হলে, ঘনাদাই বা ধরবেন কীসে? তিনি তো আর হিসেব দেখে রাখেননি।

সেই ভরসাতেই ঘনাদার উদ্ভট ন্যায়শাস্ত্রের প্রথম চালের জন্য তৈরি হয়েছিলাম।

বনোয়ারি করুণ কাতর মুখে ওপর থেকে নেমে জানিয়েছে যে বড়বাবু সকালের চা জলখাবার ফেরত দিয়েছেন।

ফেরত দিয়েছেন। কিন্তু এ পাড়ায় নয়, চার চারটে পল্লী ছাড়িয়ে ডাকসাইটে দোকান থেকে স্পেশ্যাল লড়াই-এ চপ ভাজিয়ে এনে প্রায় এক ধামা মশলা মুড়ির সঙ্গে পাঠানো হয়েছে যে।

যেতে হল তখুনি টঙের ঘরে! না, ডিমোক্রেসি অর্থাৎ রাজনীতির চালে আমরাও ভুল করব না। মশলা মুড়ি লড়াই-এ চপের খবরই আমরা যেন রাখি না। আমরা শুধু গেছি আজকের খ্যাঁটের মেনুটা কী হবে একটু পরামর্শ করতে।

তপসে উঠেছে নাকি শেয়ালদার বাজারে! শিশির যেন ডায়মন্ডহারবারের পেট্রলের খনি আবিষ্কারের খবর জানিয়েছে।

পোস্তায় বেগুনফুলিও পৌঁছে গেছে। শিবু তাল দিয়েছে সমান উৎসাহের সঙ্গে।

ঘনাদা কি বধির হয়ে থেকেছেন? না। তিনি শুধু নির্বিকার নির্লিপ্ত। আমাদের দিকে একবার চোখ তুলে চেয়ে আবার তাঁর খবরের কাগজে মনোনিবেশ করেছেন।

সকালের লড়াই-এ চপ হার মেনেছে। শেয়ালদা বাজারের তপসে আর পোস্তার নতুন আমদানি বেগুনফুলি আমও বিফল। তাই আর একটু কড়া উসকানি দিতে চেয়েছি। বলেছি, সকাল থেকে একটু মেঘলা মেঘলা আছে। ভাবছি ঠিক পোলাও-টোলাও নয়, আজ একটু ঘি-ভাত করা যাক। কী বলেন, ঘনাদা?

ওই ঘি-ভাতের কথাতেই কাজ হয়েছে! ঘি-টা ভাতে নয়, যেন ঘনাদার ভেতরে একয়দিন ধরে ধোঁয়ানো আগুনের ওপরই পড়েছে। ঘনাদা একেবারে দপ জ্বলে উঠেছেন, আমায় এসব কী শোনাচ্ছ? তোমরা আমায় এখানে খেতে বলো?

ঘনাদার মুখটা সত্যি দেখবার মতো। ইলেকশনের পর বিজয়ী পার্টির নেতাকে যেন দলত্যাগ করতে বলেছি, ভাবখানা এই রকম।

কেন? কী হয়েছে, ঘনাদা! আমরা তারস্বরে হাহাকার করে উঠেছি।

এর পর চার মাথা এক করে যেমন এঁচে রেখেছিলাম ঠিক তেমনিই সব ঘটেছে, একেবারে দাগে দাগ মিলিয়ে।

তবু শেষ পর্যন্ত ঘনাদার কাছ থেকে একেবারে কুপোকাত হয়ে ফিরতে হয়েছে।

দোষটা পুরোপুরি গৌরের। কী দরকার ছিল তার পাকামি করে ওই পাঁচকড়ার বিদ্যে জাহির করতে যাওয়ার।

নইলে, সব খুঁটি তো আমাদের জিবের মুখেই নড়ছিল। আমাদের হাহাকারে ফল ঠিক ফলেছে। ঘনাদা গণনা মাফিক বেকুব বনোয়ারির মুণ্ডপাত করতে করতে তাঁর লোকসানের কথা জানিয়েছেন।

কী লোকসান গেছে? আমরা উদ্বেগে সমবেদনায় গলা ধরিয়ে ফেলেছি।

আশ্বস্ত হয়েছি, আমাদের হিসেব ভুল হয়নি জেনে। হারিয়েছে ঘনাদার সেই মহামূল্য কান-খুশকি।

আমরা ব্যস্ত হয়ে উঠেছি, অমন জিনিসটা হারিয়ে গেল! ভাল করে খুঁজে দেখেছেন তো?

তা আর দেখিনি! বলে ঘনাদা সন্দেহের ওদিকটায় দাঁড়ি টানতে চেয়েছেন। আমরা যেন শুনতেই পাইনি। এক একজন পকেটে এক একটি মুশকিল আসান নিয়ে ঘরে ঢুকেছিলাম। কান-খুশকি খুঁজে পাওয়ার বরাত ছিল আমার ওপর। ঘরের মেঝের কোণ কানাচগুলো একটু দেখতে দেখতে হঠাৎ তোরঙ্গের তলা থেকেই যেন বার করে ফেলেছি খুশকিটা।

এই! এই তো আপনার খুশকি!

ঘনাদাও খুশকি হাতে নিয়ে একটু হকচকিয়ে গেছেন। দু আঙুলে ধরে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দেখেছেন মাত্র। মুখে আর কথা সরেনি।

শিবুর ফোড়নটাও জুতসই হয়েছে, পা গলালেই যেমন জুতোর, কানে দিলেই তেমনই খুশকির বিচার। একবার কানে দিয়েই দেখুন না, কদিন হারিয়ে পড়ে থেকেও সেই আগের সুখই দিচ্ছে।

ঘনাদা খুশকি বুঝি কানে ঢোকাতেই যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে গৌরের হিমালয় প্রমাণ আহাম্মকি!

সুখ দেবে না মানে! গৌর যেন খুশকিটাকেই ধমক দিয়েছে, যে হালেই থাক, খুশকি সুখ দেয় কানের সঙ্গে মাপের মিলে। ঘনাদা তো আর লম্বকর্ণ নন। ওঁর খুশকির মাপ একেবারে পাক্কা আট দশমিক ঊনআশি।

তার মানে? একটু অবাক হয়ে আমাদেরই জিজ্ঞাসা করতে হয়েছে, আট দশমিক উনআশি আবার কী?

কী আবার? সেন্টিমিটার! গৌর মাতব্বরের মতো বলেছে, আদর্শ খুশকির মাপ হল পাক্কা আট দশমিক উনআশি সেন্টিমিটার। একেবারে দাগে দাগে মিলে যাওয়া চাই।

কীসের দাগে দাগে?

প্রশ্নটা ঘনাদার। তিনি তখন সত্যিই খুশকিটা কানে ঢুকিয়েছেন।

বিদ্যে জাহির করবার এমন সুযোগ গৌর আর ছাড়তে পারে! মরক্কোয় বাঁধানো ঘনাদারই যেন কাগজের মলাট দেওয়া সংস্করণ হয়ে বলেছে, যে-জিনিসটি দিয়ে দুনিয়ার মাপ নির্ভুল বলে মঞ্জুর হয়, প্যারিসের কাছে ইন্টারন্যাশন্যাল ব্যুরো অফ ওয়েটস অ্যান্ড মেজার্স-এ রাখা প্ল্যাটিনম ইরিডিয়ম-এর সেই বারটির গায়ে টানা দুটি দাগের।

ঘনাদার মৃদু নাসিকাধ্বনি শোনা গেছে। এটা কানের সুখের উচ্ছ্বাস না গৌরকে উপহাস চট করে বোঝা যায়নি। ঘনাদা চোখ বুজে খুশকি নাড়তে নাড়তে থেমে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকেছেন। তারপর কান থেকে খুশকি বার করে অত্যন্ত ক্ষুণ্ণ গম্ভীর স্বরে বলেছেন, না, তিয়াত্তর ঢেউ বেশি।

অ্যাঁ! আমাদের সকালের চোখ ছানাবড়া।

তিয়াত্তর ঢেউ-এর ধাক্কা সামলাতে না সামলাতে ঘনাদা আরেকটি যা আই-সি-বি-এম ছেড়েছেন তাতে আমরা একেবারে সসেমিরে!

মেম্‌ব্রানা টিপানি ফুড়ে রেসেস এপিটিস্প্যানিকস্ কি ইউস্টেকিয়ান টিউবে গিয়ে গোল বাধাতে পারে! বলেছেন ঘনাদা।

বুদ্ধিশুদ্ধির মতো জিভটারও সাড় ফিরতে বেশ সময় লেগেছে। ঘনাদা ততক্ষণে খুশকিটার দিকে বার কয়েক ঘৃণার দৃষ্টিতে চেয়ে সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলেছেন, না, এটা আমার নয়!

কী করে বুঝলেন, ঘনাদা! একটু ধাতস্থ হয়ে কাতর কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করতে পেরেছি এবার, শুধু কানে দিয়ে?

হ্যাঁ। ঘনাদা জ্বলন্ত ক্ষুব্ধ স্বরে জানিয়েছেন, এই জাল খুশকি দিয়ে আমায় কালা করবার একটা ষড়যন্ত্র হয়েছে বলে সন্দেহ হচ্ছে।

যথার্থই প্রমাদ গুণে আমরা প্রাণপণে তাঁকে আশ্বস্ত করবার চেষ্টা করেছি, না না, সে কী বলছেন! ষড়যন্ত্র কে করবে! আর একটা খুশকি কানে দিলে কি কালা হতে হয়?

হয়। ঘনাদার স্বর জলদগম্ভীর—এ খুশকি আমার কানের পর্দা ফুটো করে ভেতরের নলে চলে যেতে পারে। এক-আধটা নয়, দস্তুর মতো তিয়াত্তর ঢেউ বড় এটা?

আমাদের বিহ্বল বিমূঢ় মুখগুলোর দিকে চেয়ে এবার বুঝি ঘনাদার একটু দয়া হয়েছে। করুণা করে বলেছেন, তিয়াত্তর ঢেউ বুঝতে পারছ না বোধহয়! ওটা হল সবচেয়ে হালফিল মাপের একটা হিসেব। এখন আর প্যারিসের কাছে রাখা দু-জায়গায় লাইন কাটা প্ল্যাটিনম ইরিডিয়ম-এর বার দিয়ে নিখুঁত মাপ ঠিক করা হয় না। ১৯৬০ সালেই ও ব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেছে। এখন এক মিটারের মাপ ঠিক করা হয় আলোর ঢেউ দিয়ে। তা-ও সাধারণ যে-কোনও আলোর নয়, দুর্লভ গ্যাস ক্রিপটন-৮৬, তারই বাতি জলের মতো তরল করা নাইট্রোজনের মধ্যে রাখবার পর যে জরদা-লাল আলো বার হয় তার-ই যোলো লক্ষ পঞ্চাশ হাজার সাতশো তেষট্টি দশমিক তিয়াত্তর তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য হল এক মিটার।

মাথায় চরকিপাক লাগার দরুনই শুধু কানে দিয়ে খুশকিটা লম্বায় তিয়াত্তর ঢেউ বেশি কী করে বুঝলেন তা আর ঘনাদাকে জিজ্ঞাসা করতে পারিনি।

ক্লোরোফর্ম গোছের অ্যানেসথেসিয়ার ওষুধে একবার অসাড় করে যা খুশি কাটা-ছেঁড়া করতে পারে ডাক্তারেরা। আমাদের অবস্থাও হয়েছে তাই।

টঙের ঘর থেকে একরকম পাকা কথা দিয়েই নেমে এসেছি।

আমাদের সদাশিব বাড়িওয়ালাকে চটাতে হয় চটাব। করপোরেশনের সঙ্গে মামলায় আসামি হতে হয়, তা-ও সই। যা ঝক্তি নিতে হয় সব নিয়ে ঘনাদার ঘরের দক্ষিণের দেওয়ালে জানালা একটা ফোটাবই।

কাঁচা ইট পোড়ালে যদি শক্ত হয়, তাহলে দুর্গাপুরের দুটো সাদা বেড়াল নিটে নেংটি ধরবে না কেন।

কেন ধরবে ঘনাদা তা আমাদের জল করে বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁর অকাট্য যুক্তির শৃঙ্খলে। বনোয়ারির বেকুফিতে ঘনাদার মহামূল্য কান-খুশকি হারালে কেন তাঁর ঘরের দক্ষিণ দেওয়ালে জানালা না ফোটালে নয়, তা বোঝাবার ধাপগুলো হল এই—এক) বনোয়ারি ঘর ঝাঁট দিতে গিয়ে কান-খুশকি হারিয়েছে। (দুই) কান-খুশকি ঘরে না থাকলে হারাতো না। (তিন) কান-খুশকি ঘরে থাকে কেন? (চার) কান চুলকোয় বলে। (পাঁচ) কান চুলকোয় কেন? (ছয়) চোখের কাজ কম! (সাত) কেন কম? (আট) ঘরে আলোর অভাব। (নয়) আলো বাড়বে কেমন করে? (দশ) দক্ষিণের দেওয়ালে জানালা ফুটিয়ে।