মান

মান

দেয়ালের দিকে কচি আঙুল তুলে তিন বছরের ছেলে জিজ্ঞাসা করত–ও কে?

বিষ্ণুচরণ বলত, তোর মা। আর, ওই তুই, মায়ের দুধ খাচ্ছিস।

কচি ছেলেটা দুষ্টু চোখে চেয়ে চেয়ে দেখত। কবে মায়ের বুকের দুধ খেত মনে নেই, কিন্তু একটু স্মৃতির মতো কিছু যেন লেগে আছে। তাই ওই মস্ত ছবিটার মধ্যে মজার এক খোরাক পেত সে। স্তনভারের একটি তার মুখে গোঁজা, মুখের চারভাগের তিন ভাগ ওর আড়ালে পড়ে গেছে। বুকের কাপড়ের আধখানা সরিয়ে অন্যটিও তার কচি হাতের দখলে রেখেছে। অর্থাৎ ওটিও তারই সম্পত্তি।

অবোধ শিশুর এই কৌতূহলের আরো একটা কারণ থাকতে পারে। তিন বছর বয়সেই এই মাকে ত্রাসের চোখে দেখত। উঠতে বসতে কর্কশ ধমক, কিল চড়, আছাড়-ঝকানি ছাড়া আদর-টাদর বড় একটা জোটে নি। সেই মা একদিন তাকে এমনি কোলে শুইয়ে দুধ খাওয়াতো, এও হয়ত শিশু-মনের কম বিস্ময় নয়।

বিষ্ণুচরণের তখন আজকের মতো ছবি-বাঁধাই আর ছবি-বিক্রির দোকান ছিল না। সে তখন এক নামকরা ফোটো-স্টুডিওর খাস বেয়ারা ছিল। তার সততা কর্ম তৎপরতা আর উপস্থিত-বুদ্ধির জন্য স্টুডিওর বিদেশী-মালিক পছন্দ করত তাকে, অন্যান্য কর্মচারী আর ফটোগ্রাফাররাও ভালোবাসত। সকলের মাথার উপর তার মাথাটা আধহাত উঁচিয়ে থাকত বলে, স্টুডিওর অনেকে তাকে ডাকত লম্বাচরণ।

বিষ্ণুচরণের চেহারাটা ভব্যসভ্য ছিল, থাকতও বেশ পরিচ্ছন্ন। সাহেবপাড়ায়। স্টুডিও। কত সাহেব-মেম হোমরাচোমরা মেয়েপুরুষ ছবি তোলাতে বা ক্যামেরা কিনতে আসত ঠিক নেই। এর মধ্যে মলিন বেশ-বাস নিজের চোখেই বেখাপ্পা লাগত বিষ্ণুচরণের, তাছাড়া মালিকও অখুশী হত। জামা-কাপড় কেনা বা সে-সব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার বাড়তি খরচটা সে মালিকের ওপর দিয়েই পুষিয়ে নিত।

বিষ্ণুচরণের ভিতরে ভিতরে একটা সহজাত কৌতূহলের উৎস ছিল। ফোটোগ্রাফাররা কেমন করে ছবি তোলে, সুন্দর সুন্দর মেয়ে-পুরুষেরা এমন হুবহু ছবির মধ্যে কি করে ধরা পড়ে–এই সব জানার প্রতি তার বিষম ঔৎসুক্য। হেড ফোটোগ্রাফারের সঙ্গেই ছিল তার সব থেকে বেশি খাতির। ভদ্রলোক সত্যিকারের শিল্পী ছিল বলেই বিষ্ণুচরণের কৌতূহল প্রশ্রয় পেত। বিনিময়ে বিষ্ণুচরণও তার পাদমূলে অজস্র তৈল সিঞ্চন করত, সর্বদা তোয়াজ তোষামোদ করত তার। অসুখ বিসুখ হলে তার বাড়ি গিয়ে খোঁজ-খবর নিত, এমনকি সেবা-শুশ্রূষাও করত। তার কাছ থেকেই বিষ্ণুচরণ গোপনে অনেক সুন্দরী মেয়ের ছবির কপি সংগ্রহ করেছিল। আর এই ভদ্রলোকই তার ছবি-তোলা শেখার গুরু।

মালিকের অগোচরে এবং অনুপস্থিতিতে স্টুডিওর দরজা বন্ধ করে গোপনে তার। শিক্ষার মহড়া শুরু হয়েছিল। প্রথমে সস্তা ক্যামেরায় হাত পাকিয়েছিল সে। শিক্ষা-গুরুটি তার মধ্যেও বোধ করি একটা সুপ্ত শিল্পিসত্তা আবিষ্কার করেছিল। তার তৎপরতা, বিচার-বিবেচনা, সহজাত পরিমিতি বোধ, ইত্যাদি দেখে অনেক সময় সে অবাক হয়েছে। অবকাশ সময়ে গোপনে প্রায় কেঁকের বশেই ক্রমশ দামী দামী ক্যামেরায় হাত দিতে দিয়েছে তাকে।

কয়েক বছর যেতে গুরু নিজেই তাকে পরামর্শ দিয়েছে–এখানে বেয়ারাগিরি না করে কোনো ছোটখাটো ফোটোগ্রাফির দোকানে ঢুকে পড়, অনেকের থেকেই ভালো। ছবি তুলবে তুমি।

গুরুটি একাধিকবার তাকে দিয়ে ফ্লাশ-বালবে কোনো প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরের ছবি তুলিয়ে নিজের বলে চালিয়েও ধরা পড়ে নি।

কিন্তু বিষ্ণুচরণ এতবড় স্টুডিও আর এই গুরু ছেড়ে নড়তে চায় নি। এখানে থেকে উঁচু নজর হয়ে গেছে তার। ক্যামেরা প্রাণের জিনিস, চেষ্টাচরিত্র করে গুরুর সাহায্যে ধারে সস্তার ক্যামেরা একটা অনায়াসে সে কিনতে পারত, কিন্তু অতকাল আগেরও সেই দামী দামী ক্যামেরায় হাত মক্স হওয়ার ফলে সস্তার ক্যামেরা তার মনে ওঠে নি। ভগবান দিন যদি দেন কখনো, ওই দামী ক্যামেরাই একটা হবে তার।

ইতিমধ্যে বিষ্ণুচরণ ঘরে বউ এনেছিল। তাদের ঘরে বেশ সুন্দরী বউ বলতে হবে। মোটা-সোটা গোলগাল গড়ন, ফরসা। বউয়ের রূপ দেখে গুণের দিকে তাকানোর কথা মনেও হয় নি তার। এই না-তাকানোর খেদ ঘোচবার নয়। যাই হোক, বিষ্ণুচরণ। বিয়ে করেছিল এবং যথাসময়ে ছেলে শম্ভুচরণের আবির্ভাব ঘটেছিল।

ছেলের যখন সাত-আটমাস বয়েস, তখনই সেই অভিনব ব্যাপারটা ঘটেছিল। স্টুডিওর মালিক দিন কয়েকের জন্য বাইরে গিয়েছিল। ফলে বিষ্ণুচরণের গুরু সর্বেসর্বা। তখন। সে কাকুতি মিনতি করে ধরেছিল গুরুকে, দুঘণ্টার জন্য একটা ভালো ক্যামেরা দিতে হবে, দুঘণ্টার আগেই সে ফিরিয়ে দিতে চেষ্টা করবে

-কার ছবি তুলবি?

— বিষ্ণুচরণ সলঙ্কে জবাব দিয়েছে–আজ্ঞে বউ-ছেলের

ক্যামেরা হাতে পেয়ে হাওয়ায় উড়তে উড়তে বাড়ি এসেছে। বাড়ি বলতে ব্যারাকের মতো একটা একতলা দালানের দেড়খানা ঘর। আশপাশের ঘরের বাসিন্দারাও সব তারই মতো স্বল্পবিত্তের মানুষ।

দুপুর ভালো করে গড়ায় নি তখনো। ক্যামেরা হাতে বিষ্ণুচরণ ঘরে ঢুকে দেখে বউয়ের ওই মূর্তি। মেঝেতে বসে আছে, মুখের ঘুমের দাগ ভালো করে মিলায় নি তখনো। আদুড় গা। শাড়ির আঁচলটা বুকের একদিক ঢেকে কাঁধে জড়িয়ে আছে অন্যদিকটা অনাবৃত। ঈষৎ ঝুঁকে ছেলের মুখে বুকের আহার যোগাচ্ছে। ছেলের মুখের বেশীর ভাগ ঢাকা পড়ে গেছে, কাপড়ের তলা দিয়ে তার একটা কচি হাত আহারের দ্বিতীয় সম্পদটি আগলে আছে।

দেখা মাত্র বিষ্ণুচরণের বউকে সাজগোজ করিয়ে ছবি তোলার জল্পনা-কল্পনা উবে গেল। ওদিকে কুসুমবালাও এ-সময়ে লোকটাকে দেখে অবাক হয়েছে, আরো অবাক হয়েছে তার হাতের অচেনা বস্তুটা দেখে। কিন্তু বিস্ময় প্রকাশ করার আগেই বিষ্ণুচরণ গম্ভীর মুখে বলল–চুপ। কথা বোলো না! নোড়ো না! ঠিক অমনি থাকো! কি মজা। হয় এক্ষুণি দেখো!

কিছু না বুঝেই কুসুমবালা অবাক চোখে চেয়ে ছিল তার দিকে।

কিন্তু কয়েক মুহূর্ত যেতেই মজার চোটে সে আঁতকে উঠল প্রায়। মুখের ওপর আচমকা ফ্ল্যাশ-বাল ঝলসে উঠেছে। বৃন্তচ্যুত ছেলেটাও কেঁদে উঠল। কিন্তু বিষ্ণুচরণের কাজ ততক্ষণে সারা। জীবনের একটা পরম মুহূর্তকেই সে যেন ধরে ফেলেছে। দাঁত বার করে সে হাসতে লাগল। আর একটা ছবি তোলার কথাও মনে হল না তার। হাসতে হাসতে, উড়তে উড়তে আবার স্টুডিওয় ফিরে চলল।

সব অভিনব শিল্প-সৃষ্টিই এমনি আকস্মিক কিনা বলা যায় না। যে ছবি তুল বিষ্ণুচরণ, সমস্ত জীবনের সচেতন চেষ্টায় অমন আর দ্বিতীয়টি তুলতে পারবে কিন ঠিক নেই। ছবি দেখে তার গুরু অবাক। ছোট ছবি বড় করা হল, তারপর আরো বড়। শেষেরটা দেড় হাত প্রমাণ হল প্রায়। গুরু বলল–এটা আমায় দাও, স্টুডিওর শো-কেসে রাখি–কেউ জানবে না।

বিষ্ণুচরণ রাজী হল না। ঘরের পরিবারের ছবি যে…

রুচি আছে তার। বড় ছবিখানার ওপর স্টুডিওর সব থেকে সেরা আর্টিস্টকে ধরে-পড়ে পাকা-রঙের কাজ করিয়ে নিল। কার ছবি বা কে তুলেছে ব্যক্ত না করে তাকে দিয়ে এই কাজ করাতে বেশ কয়েক টিন দামী সিগারেট উপঢৌকন দিতে হল। কাজে হাত দিয়ে শিল্পের টানেই যত্ন করে রঙের কাজটুকু করে দিয়েছিল শিল্পী। বিষ্ণুচরণ তখনো বাড়িতে কিছু বলে নি।

দামী ফ্রেমে ছবিটা একবারে বাঁধিয়ে কাগজে মুড়ে ঘরে নিয়ে গিয়ে হাজির হল। একদিন। বউ তখন রান্নায় ব্যস্ত। দেয়ালেও অনেক পেরেক লাগানই আছে।

জায়গা বেছে ছবিটা একেবারে টাঙিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত।

ছবি দেখে কুসুমবালা প্রথমে হতভম্ব খানিকক্ষণ। তারপর তার স্বভাবসুলভ রসনা খনখনিয়ে উঠেছিল।

এই রস করা হয়েছিল সেই দিন, আঁ! আদুড় গায়ে পরিবারকে সকলের চোখের সামনে টাঙিয়ে রাখার সখ–বলি স্বভাব-চরিত্তির কি একেবারে খেয়ে বসেছ? কি ঘেন্না, কি ঘেন্না, শীগগির নামাও বলছি ওটা, নইলে আছড়ে ভাঙব আমি

বউয়ের বচসায় সচরাচর চুপ করেই থাকে বিষ্ণুচরণ। অসীম ধৈর্য তার। বলতে গেলে মুখ বুজেই সহ্য করে। কিন্তু ক্কচিৎ কখনও সহ্যের সীমা ছাড়ালে তখন একেবারে মারমুখী মূর্তি। তখন অতবড় কুঁদুলে বউও ঘাবড়ে যায়। কিন্তু এই সামান্য কথায় যে ওই মূর্তি দেখবে ভাবে নি।

বিষ্ণুচরণ ছবির দিকে দুপা এগিয়ে গেল, তারপর বউয়ের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। অস্বাভাবিক রুক্ষ কঠিনম্বরে শাসালো–ওতে হাত দিবি তো তোর ওই হাত আমি দুমড়ে ভেঙে দেব।

রাগ হলেই তুমি ছেড়ে তুই তুকারি করে।

তবু সামলাতে না পেরে কুসুমবালা অস্ফুট ঝঝে বলে উঠতে যাচ্ছিল–গলায় দড়িও

–যা গলায় দড়ি তুই নিজে দে-গে যা, আমার হাড় জুড়োয় তাহলে।

দিনে দিনে তারপর ওই ছবি কুসুমবালার চোখেও সয়ে গেছে। আড়াল থেকে এক এক সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকে ছবিটা দেখতেও দেখেছে বিষ্ণুচরণ। আর বছর তিনেক বয়েস না হতে ছেলেও ওটা চিনে ফেলেছে। ফেললেও বাপের কোলে উঠলেই আঙুল দিয়ে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করত–ও কে?

.

বিষ্ণুচরণের সংসার-সুখ বলতে কিছু ছিল না। দেখতে দেখতে একদিন সবই ছারখার হয়ে গেল। দুর্যোগ যেন হাঁ করে গিলতে এল তাকে। গিলেই ফেলল। তাকে আর তার সাড়ে তিন বছরের ছেলে শম্ভুচরণকে। বউ জন্মের শোধ নিল।

বউয়ের বুকে বিষ ছিল। মুখে বিষ ছিল। বিষে বিষে বিষ্ণুচরণের হাড় মাস কালি। কারণে অকারণে কোনো স্ত্রীলোকের এত রাগ সে বোধহয় আর দেখে নি। হয়ত রূপের জোরে আরো একটু সচ্ছল ঘরে পড়বে, এ-রকম আশা ছিল বউয়ের। তা না হলে বিষ্ণুচরণের অস্তিত্বটাই ওর চোখে এমন চক্ষুশূল হবে কেন! অবশ্য শুধু তার ওপর নয়, তপ্ত রসনার ঝাটা সে সকলের ওপরেই বুলোয়–ওর ভয়ে তার ঘরে একটা ফেরিঅলা পর্যন্ত আসে না।

অতি ক্ষুদ্র কারণে বিপর্যয় ঘটল একদিন। ঘটবে বলেই হয়ত বিষ্ণুচরণেরও কাঁধে। শনি ভর করেছিল সেদিন।

কি কারণে তার তালা-বন্ধ ট্রাঙ্ক খুলে এক পাঁজা ছবি হাতে পেল বউ। যে ছবিগুলো সে তার গুরুর কাছে চেয়ে-চিন্তে সংগ্রহ করত। বেশির ভাগই নতুন বয়সের ছেলে-মেয়ের ছবি, বিচিত্র বেশ-বাসের অবাঙালী এবং বিদেশী মেয়ের ছবিও আছে। অনেকগুলো। স্বামীর চরিত্রহীনতার এমন জলজ্যান্ত প্রমাণ আর বুঝি হয় না। তার ওপর বিষ্ণুচরণ ভুল করল বউয়ের হাত থেকে ছবিগুলো ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে। তার ভয়, বউ ওগুলো নষ্ট করে ফেলবে।

ব্যস, তুমুল ব্যাপার শুরু হল। গলা ছেড়ে স্বামীর গুণকীর্তন বর্ণনা করতে লাগল কুসুমবালা, চরিত্রহীন লম্পট মাতাল বলে তারস্বরে গাল পাড়তে লাগল। আশপাশের বাসিন্দারা সব সচকিত হয়ে উঠল। তারাও কৌতূহলী হয়ে ভাবল, কুঁদুলি বউ হাতে নাতে এমন কিছুই ধরেছে, যার দরুন সাত-সকালে এই সম্ভাষণ আর এমন কুরুক্ষেত্র। তাদের উঁকিঝুঁকি দিতে দেখে কুসুমবালার স্বামী-ঝাটানোর ক্ষিপ্ত উদ্দীপনা ক্রমশ চড়তেই লাগল।

কতক্ষণ সহ্য করেছিল বিষ্ণুচরণ জানে না। উঠল হঠাৎ। মাথার মধ্যে। দাউদাউ আগুন জ্বলছে।

 হাতের পাঁচটা আঙুল আচমকা সাঁড়াশীর মতো বউয়ের গলায় বসে গেল। ঠেলতে। ঠেলতে তাকে খুপরি ঘরটার মধ্যে নিয়ে ঢোকাল। বউয়ের দম বন্ধ, হাত ছাড়ানোর বিফল চেষ্টা–মুখ লাল।

বিষ্ণুচরণ এক ধাক্কায় দেয়ালের দিকে ঠেলে দিল তাকে। দেয়ালের সঙ্গে লাগল ঠাস করে। বলল, ফের গলা খুলবি তো ওই গলা আমি চিরকালের জন্য বন্ধ করে দেব।

বউ গলা আর খোলে নি। বিষ্ণুচরণ জামা গায় চড়িয়ে তক্ষুণি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে।

রাগ পড়তে ফিরল ঘণ্টাখানেক বাদে। কাজে বেরুতে দেরি হয়েই গেছে, চাটা করে না-খেয়েই ছুটতে হবে।

বাড়ির কাছে এসে হতভম্ব। লোকে লোকারণ্য। চিৎকার চেঁচামেচি। একটা অজ্ঞাত ভয় বিদ্যুৎকষার মতো আঘাত করল তাকে। তারপরেই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এল।

সেই খুপরি ঘরের দরজা ভেঙে কুসুমবালাকে বার করতে হয়েছে। কুসুমবালাকে নয়, বীভৎস দগ্ধ একটা নারীদেহকে। সর্বাঙ্গে কেরোসিন ঢেলে গায়ে আগুন দিয়েছে কুসুমবালা। তখনো প্রাণ আছে, তখনো আর্ত-যাতনায় প্রাণান্তকর ছটফট করছে।

হাসপাতালে দুদিন বেঁচে ছিল। বেহুস অবস্থায় ভুল বকেছে। এই পরিণামের সমস্ত আক্রোশ সে স্বামীর মাথায় ঢেলে দিয়ে গেছে।

বিষ্ণুচরণের চোখ দিয়ে এক ফোঁটা জল পড়ে নি। কাদার অবকাশও সে পায় নি। একটা মৃত্যু তাকেও নিঃসীম মৃত্যুর দিকেই টেনেছে। পুলিশের টানা-হেঁচড়ায় একটানা দেড়মাস দেহের রক্ত শুকিয়েছে, রাতের ঘুম গেছে। দুধের ছেলেটাকে পাশের ঘরের একজন আশ্রয় দিয়েছে বটে, কিন্তু তার কান্না সে-যেন কোর্ট আর থানায় দাঁড়িয়েও শুনেছে।

দেড় মাস বাদে মুক্তি পেল। মুক্তির বোঝ টেনে টেনে কোনো রকমে বাড়ি এল। প্রথমেই চোখে পড়ল দেয়ালে টাঙানো কুসুমবালার সেই মস্ত বাঁধানো ছবিটা। একটানে দেয়াল থেকে ছিঁড়ে নিয়ে এল সেটা। আছড়ে ভাঙতে গিয়েও ভাঙতে পারল না। ওটা শুধু কুসুমবালাই নয়, তারও ভিতরের একটা সৃষ্টি। কিন্তু ছবিটার দিকে আর তাকাতে পারল না, যে আগুনে কুসুমবালা মরেছে তার থেকে বেশি আগুন ওর বুকে সে জ্বেলে রেখে গেছে।

ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটা একটা বড় কাগজে প্যাক করে ঘরের কোণে চোখের আড়ালে রেখে দিল। পরে ঘর থেকে সরাবে। দেয়ালের গায়ে চৌকো কালো দাগ পড়ে আছে একটা। গামছা ভিজিয়ে ঘষে দাগটা তুলে ফেলল। তারপর ছেলে শম্ভুচরণকে নিয়ে এল।

গোড়ায় গোড়ায় ছেলে কয়েকদিন আঙুল দিয়ে শূন্য দেয়ালটা দেখিয়ে ছবির খোঁজ করেছে, তারপর ভুলে গেছে।

দুর্যোগ একা আসে না। আসেও নি। স্টুডিওতে গিয়ে শোনে তার ফোটোগ্রাফার গুরু বড় কাজ নিয়ে বাইরে কোথায় চলে গেছে। সেই সুযোগে ঈর্ষা যারা করত, তার মালিককে জানিয়েছে প্রশ্রয় পেয়ে বিষ্ণুচরণ কি-ভাবে দামী দামী ক্যামেরা নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করত। ফলে মালিকও আর তাকে নেয় নি।

 দুই-একটা ছোটখাটো দোকানে বিষ্ণুচরণ ফোটোগ্রাফার হতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু নিজেই অবাক হয়ে দেখল, মূর্খ হয়েও ভিতরের আগ্রহের তাড়নায় যেটুকু শিখেছিল, পেশাদারীর পরীক্ষায় তার সবটাই অচল। কাঁপা হাতে দুই একটা ছবি যা তুলেছে তারপর আর কোনো প্রত্যাশা নিয়ে নিজেই দাঁড়ায় নি।

.

প্রায় বিশ বছর কেটে গেছে তারপর।

বড় রাস্তার ফুটপাথের গা-ঘেঁষা ছবি-বাঁধাই আর ছবি-বিক্রির দোকান বিষ্ণুচরণের। আগে ফুটপাথে ঘুরে আর বসেই ছবি, রঙিন ক্যালেণ্ডার, ম্যাপ ইত্যাদি বিক্রি করত। তারপর দেড়-হাত প্রমাণ বসার জায়গা পেয়েছিল একটা, পেয়েই ছবি বাঁধাইয়ের কাজ শুরু করেছিল।

এখন মাঝারি সাইজের দোকান-ঘর হয়েছে একটা। ঘর ভরতি ছবি ঠাসা–ছবির ছোটখাটো গুদাম একটা। সারি সারি তাকে থাকে-থাকে ছবি–আর এত ছবি টাঙানো যে দেয়াল দেখাই যায় না। দেশ-বিদেশের মনীষীদের ছবি, রাজপুরুষদের ছবি, রাজনীতিজ্ঞদের ছবি, ধর্মাত্মাদের ছবি, পৌরাণিক ছবি, যৌবনোজ্জ্বল চিত্রতারকাদের ছবি, দেব-দেবীর ছবি, স্বর্গের ছবি, নরকের ছবি, কল্পিত যৌবনাভিসারিকাদের ছবি –নেই এমন ছবি নেই।

ছবি বাঁধাইয়ের জন্য স্বল্প বেতনে কারিগর রাখতে হয়েছে একজন। সারাক্ষণ মুখ গুঁজে বসে সে ছবির মাপে ফ্রেম ঠিক করে, বোর্ড কাটে, কাঁচ কাটে, হাতুড়ি দিয়ে চুক চুক করে। অবকাশ সময়ে ছেলে শম্ভুচরণ নিজেও ছবি বাঁধে-বাঁধাইয়ের কাজ সেও শিখেছে।

সম্প্রতি বাপ আর ছেলের একটাই বাসনা সর্বদা বুকের তলায় শিখার মতো জ্বলছে। পাশের চিলতে খুপরিটা খালি হয়েছে, সেটা পেয়ে গেলে দোকানটা মনের মতো করে সাজানো চলে। এই স্বল্প পরিসরে খদ্দের নড়তে চড়তে পারে না, অনেক খদ্দের ফিরেও যায়। ওই জায়গাটুকুর মালিকের পায়ে তেল দিয়ে দিয়ে হন্যে হয়েছে। বাপ ছেলে। ওই চিলতে খুপরির জন্য সাড়ে সাতশ টাকা সেলামী হেঁকে বসে আছে। সে–এক কপর্দকও নামাবে না। কায়ক্লেশে ঘরের জিনিস বেচে সাড়ে তিনশ টাকা সংগ্রহ করে তার হাতে-পায়ে ধরেছে বিষ্ণুচরণ–বাকি টাকাটা মাসে মাসে ভাড়ার সঙ্গে মিটিয়ে দেবে কথা দিয়েছে। কিন্তু মালিক কর্ণপাত করে নি।

 বাকি চারশ টাকা ধার পাবারও অনেক চেষ্টা করেছে বাপ-ছেলে মিলে, কিন্তু তাদের ধার দেবে কে?

তবু বিষ্ণুচরণ আশা ছাড়ে নি এখনো, মালিকের আড়ালে অশ্লীল কটু-কাটব্য করে। তার এই মস্ত ঢ্যাঙা শুকনো পাকানো দেহের কোথাও কমনীয়তার লেশমাত্র নেই। ছেলেকেই শুনিয়ে বলে, ওটা না পেলে শালাকে খুন করব আমি।

শম্ভুচরণের বয়স এখন তেইশ। বাপের মতো লম্বা নয় আদৌ। সুশ্রী সভ্যভব্য। তার ওপর অনেক মেহনত করে আর দোকানে খেটেও তৃতীয় বিভাগে একটা পাস দিয়েছে। অর্থাৎ রীতিমতো শিক্ষিত সে। ফলে বাপের সঙ্গে আদৌ বনে না তার। এক ধরনের সতোর আদর্শ কেমন করে যে ছেলের ভিতরে দানা বেঁধেছে, সেটা আশ্চর্য। ওদিকে বাপ ঠিক উল্টো। সতোর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। মুখের দিকে তাকিয়েই খদ্দেরের মন আর পকেট ওজন করতে পারে যেন। সুবিধে বুঝে দরও হাঁকে। খদ্দের চালাক না হলে রাতকে দিন বানায়, নকলকে মৌলিক বলে চালায়। অল্পবয়সী মেয়েরা আসে ছবি কিনতে, সভ্য-ভব্য ছেলের দিকে আড়ে আড়ে তাকায় বিষ্ণুচরণ। ছেলে সবিনয়ে দর বলার আগেই একটা দর হেঁকে বসে সে। বলে–ওই ছবির ওই দাম…মায়েরা বাজার ঘুরে দেখে আসুন, তফাৎ বুঝবেন।তারপরই সেই ছবির প্রসঙ্গে মিথ্যে আজগুবি গল্প ফেঁদে বসে। শম্ভুচরণ অস্বস্তি বোধ করে।

শুধু এই নয়। খদ্দের বুঝে নিরিবিলিতে গুদামের কোণাঘুপচি থেকে এমন সব ছবি বার করে বাবা, যা দেখলে শম্ভুচরণের কান লাল হয়। অশ্লীল, নগ্ন ছবি। কোথা থেকে যে এসব সংগ্রহ করে ভেবে পায় না। আর এই সব ছবিই চড়া দামে বিকোয়। এক একটার অবিশ্বাস্য দামও মেলে। এই সব কারণে, ছেলে কোনোদিন শ্রদ্ধার চোখে দেখে নি বাপকে।

.

সেদিন এই বাপ-ছেলের বিধাতা একটা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন বোধ করি। নইলে এ রকম হবে কেন!

রাত নটা বাজে। দোকান বন্ধ করার উদ্যোগ করছিল তারা। পাঁচ-ছটি বিদেশী শ্বেতাঙ্গ খদ্দের এসে ঢুকল। বয়েস কারো বেশী নয়। শাঁসালো টুরিস্ট সম্ভবত। খাঁটি দেশীয় নিদর্শন সংগ্রহের আশায় এসেছে। দুই-একজনের মুখ থেকে মদের গন্ধও নাকে আসছিল।

বিষ্ণুচরণ লাফিয়ে উঠল–আইয়ে আইয়ে সাব

এদের থেকে প্রিয় আর বোধ হয় কেউ নয় বিষ্ণুচরণের। গেল যুদ্ধে এদের মতো দিলদরিয়া খদ্দেরের কল্যাণেই তার দোকানঘর হয়েছে।

তারা মিটি মিটি হাসে আর ছবি দেখে। কিন্তু লাস্যময়ী অপ্সরা থেকে হাস্যময়ী চিত্রতারকা পর্যন্ত কারো ছবি পছন্দ হয় না তাদের। মাথা নাড়ে আর বলে, দিশি জিনিস দেখাও।

এবারে গোপন সংগ্রহের দিকে হাত দিল বিষ্ণুচরণ। নির্ভেজাল জিনিসই বার করল। একটা চোখে লাগাতে পারলে দূর যা হাঁকবে সে-ই জানে। ঘাড় বাঁকিয়ে সেই সব ছবির দিকে তাকিয়ে শম্ভুচরণের মুখ লাল। কুৎসিৎ সব ছবি।

কিন্তু যে দেশের লোক এই খদ্দেররা, তাদের চোখে এসব ছবি কিছুই নয়। তা ছাড়া এ জিনিসও ঠিক চায় না তারা। এ বিষ্ণুচরণের রোখ চেপেছে। কয়েকটা অর্ধনগ্ন আদিবাসীর বড় ছবি শিল্পী দিয়ে আঁকিয়ে এবং বাঁধিয়ে কোনো এক থাকে লুকিয়ে রেখেছিল। খুঁজে খুঁজে একটা বড় ফ্রেম টেনে বার করল। একটানে ওপরের কাগজটা টেনে ছিঁড়ে ফেলল।

তার পরেই তড়িৎস্পৃষ্টের মতো কাঠ একেবারে। বিমূঢ় হতভম্ভ।

শ্বেতাঙ্গ খদ্দেররা বাঁধানো ছবিটা তার হাত থেকে টেনে নিল। সঙ্গে সঙ্গে তাদের চোখে-মুখে আগ্রহ দেখা গেল। এই ধরনের দিশি জিনিসই তারা চেয়েছিল যেন। ফ্রেমের ওপরে কিছু ধুলো জমেছিল নিজেরাই রুমালে করে মুছে দিল। ছবির তাজা রঙ ফুটে বেরুলো। ওটা হাতে হাতে ঘুরল তাদের। ভারি পছন্দ হয়েছে। খাঁটি দিশি জিনিস –আদুড় গায়ে শাড়ি জড়িয়ে সুশ্রী স্বাস্থ্যবতী গৃহস্থবধু বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে ছেলেকে –কচি শিশুর অন্য হাতে খাদ্য আগলানো দেখেও খুশীতে আটখানা তারা।

একজন জিজ্ঞাসা করল, দাম কত?

অনুভূতিশূন্য মূর্তির মতো ছবিটা হাতে নিল বিষ্ণুচরণ। দেখল ফ্রেমটায় ছাতা পড়েছে শুধু, নইলে এতকাল আগের ছবি ঠিক তেমনি জীবন্ত এখনো। বিমূঢ় নেত্রে ছেলের দিকে তাকালো একবার। ছেলেও বাপের হঠাৎ এই মূর্তি দেখে অবাক হয়েছে।

বিষ্ণুচরণ দেখছে। বউ চেয়ে আছে তার দিকে। তার চোখে যেন ভৎর্সনা। সে যেন ফিস ফিস করে বলছে-ছিঃ আমি না-হয় অন্যায়ই করেছি একটা, তা বলে নিজের পরিবারকে বেচে দেবে?

ক্রেতারা অসহিষ্ণু হচ্ছে। বিষ্ণুচরণ একটা উদগত অনুভূতি সামলে নিয়ে বিড়বিড় করে জানালো, এ ছবি বিক্রির না।

লোকটা দাও মারতে চায় ভেবে একবারেই চড়া দাম হাঁকল একজন।

 বিষ্ণুচরণ মাথা নাড়ল।

তারা আরো দাম বাড়ালো।

 আরো।

বিষ্ণুচরণ মাথা নাড়ল।

আরো খানিকটা দামাদামি করে তারা রাগতভাবে হুড়মুড় করে নেমে গিয়েও তখুনি আবার ফিরে এল। যে লোকটা বেশি মদ খেয়েছিল সে বিষ্ণুচরণের মুখের সামনে ধবধবে পাঁচটা আঙুল তুলে বলল, দেখো পাঁচশো রুপয়া দেগা, উইল ইউ সেল?

বিষ্ণুচরণের মাথাটা ঘুরে উঠল। চোখের সামনে তার বড় দোকান ভাসছে পাশের চিলতে খুপরি পেয়েছে। শুধু তার চোখে নয়, ছেলের চোখেও তাই ভাসছে।

..ছিঃ, আমি না হয় অন্যায়ই করেছি একটা, তা বলে নিজের পরিবারকে বেচে দেব?….

বিষ্ণুচরণ মাথা নাড়ল। হঠাৎ রেগে গিয়ে জোরেই ঝঝিয়ে উঠল–এ ছবি বিক্রির নয়!

তারা চলে গেল। ছেলে বিমূঢ় বিস্ময়ে চেয়ে আছে তার দিকে। এক ঝটকায় ছবিটা হাতে নিয়েই বিষ্ণুচরণ দোকান থেকে বেরিয়ে গেল।

দোকান বন্ধ করে শম্ভুচরণ ঘরে ফিরল। দেখল ছবিটা দেয়ালে টাঙিয়ে বাপ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। ছেলেও ভিতরে এসে দাঁড়াল। পিছন থেকে দেখল ছবিটা। গোটা মুখ থমথমে গম্ভীর। তেইশ বছরের ছেলে জিজ্ঞাসা করল, ও কে?

বিষ্ণুচরণ আস্তে আস্তে ফিরল তার দিকে। চোখ দুটো অস্বাভাবিক চকচক করছে। বলল–তোর মা। আর, ওই তুই-মায়ের দুধ খাচ্ছিস।

দুজনেই নির্বাক। ছেলের থেকে বাপ অনেক লম্বা। মুখ তুলে মুখ দেখতে হয়। আজ এই বাপের মাথাটাই হঠাৎ এত উঁচুতে মনে হল শম্ভুচরণের যে ঘাড় উঁচিয়েও ভালো করে দেখা যায় না।