মানুষ এবং অন্ধকারের প্রশংসা

মানুষ এবং অন্ধকারের প্রশংসা

১.

আমার ধারণা, মানুষ বুদ্ধিমান— এটি রটেছে তার খুনের দক্ষতার জন্যে। মানুষের যে-প্রজাতিটি এখনো টিকে আছে, তা টিকে আছে মূলত খুন করে। গরু-ছাগল ছাড়াও সে খুন করেছে তার নিজের আরো পাঁচটি প্রজাতিকে। আগামীকাল যদি বাঘ ব্যাপকহারে মানুষ খুনের দক্ষতা অর্জন করে, তাহলে পরশু থেকে বাঘকেই বলা হবে সর্বাপেক্ষা বুদ্ধিমান প্রাণী। এক বাঘ আরেক বাঘকে বলবে: সৃষ্টির সেরা জীব বাঘ।

জাপানে যদি ওই বোমাগুলো না পড়তো, তাহলে আমেরিকানদের বুদ্ধি নিয়ে আমাদের সন্দেহ থাকতো। দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা না থাকলে, ইউরোপীয়দেরকেও আমরা নির্বোধ ভাবতাম। কলম্বাস আমেরিকায় পৌঁছে যদি ওই খুনগুলি না করতেন, তাহলে তিনি অবিস্মরণীয় হয়ে থাকতেন না।

ইতিহাস যে এতো রাজা-বাদশার নাম মনে রেখেছে, তার কারণও খুন। কালিগুলার কথাই ধরা যাক। তাঁর আসল নাম গাইয়াস সিজার। তবে সিজার উপাধিতে যেহেতু আরো সম্রাট ছিলেন, তাই তিনি নাম ধারণ করেছিলেন ‘কালিগুলা’। নামটির অর্থ ‘ছোটো জুতো’ হলেও, ভদ্রলোকের মাথা ছিলো বড়ো জুতোর সমান। কালিগুলা কি বুদ্ধিমান ছিলেন? একজন লেখক বুদ্ধিমান কি না, তা তার লেখা পড়ে অনুমান করা গেলেও, কোনো রাজার বুদ্ধি নিরূপণ করার জন্য আমাকে হিসেব করতে হবে তার দ্বারা সংঘটিত মোট খুনের সংখ্যা। দেখতে হবে খুনি হিশেবে ওই রাজার সুনাম কেমন ছিলো। যদি শোনা যায়, রাজা খুব দয়ালু ছিলেন, খুন-খারাবি তেমন করতে পারেননি, তাহলে বুঝতে হবে রাজা হিশেবে তিনি নির্বোধ ছিলেন। সে অর্থে কালিগুলাকে আমার বুদ্ধিমানই মনে হয়, কারণ মানুষ খুনে তিনি পিছিয়ে ছিলেন না।

ট্রাম্পকে নির্বোধ বলা হয় কেন? কারণ তিনি চার বছরেও একটি যুদ্ধ বাঁধাতে পারেননি। উল্টো ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে বন্দুক প্রত্যাহার করেছেন। এ জন্য ট্রাম্পের চেয়ে আমরা হিলারি এবং ওবামাকেই বেশি বুদ্ধিমান মনে করি। ট্রাম্প যদি হোয়াইট হাউসে ঢুকেই পূর্ব দিকে কয়েকটি মিসাইল ছুড়তেন, এবং হত্যা করতেন কয়েক লাখ মানুষকে, তাহলে তাঁকে নিয়ে সব হাসি-ঠাট্টা থেমে যেতো। কয়েকটি ইরাক আর দুয়েকটি লিবিয়া উপহার দিলে, ফেসবুকে ট্রাম্পের ওই কার্টুনগুলো আর দেখা যেতো না। তিনি এমনই নির্বোধ, একজন মার্কিন নাগরিককে জেল পর্যন্ত খাটাতে পারেননি। পুবের বানর-রাজারা তাঁর এ বোকামি দেখে বিস্মিত হয়েছেন। তারা রোজ কতো বানরকে ধরে খাঁচায় পুরেন, তা ভেবে ট্রাম্পের প্রতি করুণা অনুভব করেছেন।

২.

খুব দূর থেকে দেখলে, পৃথিবীকে একটি ইলেকট্রনের মতো ছোটো মনে হবে। ইলেকট্রন বেশি বড়ো নয়, আকারে করোনা ভাইরাসের চেয়েও অনেক ছোটো। পৃথিবী খুবই ক্ষুদ্র গ্রহ, যা কিছু মানুষ ও তাদের মোটরসাইকেলগুলো নিয়ে মহাবিশ্বের একটি ক্ষুদ্র গলিতে পড়ে আছে, এবং গলিটি, আমাদের চুলের চেয়ে মোটেও মোটা নয়। মহাবিশ্ব হয়তো জানেই না যে তার দেহে একটি পৃথিবী আছে। শরীর থেকে কোনো লোম খসে পড়লে যেমন আমরা টের পাই না, তেমনি হঠাৎ কোনো দুর্যোগে পৃথিবী নাই হয়ে গেলে মহাবিশ্বও তা টের পাবে না। সম্ভবত অনেক গ্রহই মহাবিশ্বে আছে, যেগুলোর শ্রেষ্ঠ প্রাণীদের সাথে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রাণীটির দেখা হলে, একটি হাস্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। মাপলে দেখা যাবে, ওই প্রাণীদের সাথে আমাদের বুদ্ধির পার্থক্য, মানুষের সাথে ছাগলের বুদ্ধির পার্থক্যের কম নয়। চাইলেই একটি মন্দির খুলে তারা শুরু করে দিতে পারে পাঁঠাবলির মতো মানুষবলি।

তবে মানুষবলি নতুন ও চমকপ্রদ কিছু নয়। অনেক দেশেই রাজারা মানুষবলির ওপর টিকে আছেন। কার্তেজীয়রা যখন পিউনিক যুদ্ধে রোমানদের কাছে হারে, তখন কারণ হিশেবে তারা দেবতা মওলকের অসন্তুষ্টিকে দায়ী করেছিলো। বলি হিশেবে মওলকের পছন্দ ছিলো অভিজাত পরিবারের শিশুরা। কিন্তু বলি দেয়ার সময় দেখা যেতো, অভিজাত কার্তেজীয়রা নিজেদের শিশুদের স্থলে শুইয়ে দিচ্ছে দরিদ্র পরিবারের শিশুদের। এতে, কার্তেজীয়দের দাবি, দেবতা মওলক ক্ষিপ্ত হয়ে যুদ্ধে পক্ষ নিয়েছিলো রোমানদের।

দেবতা হিশেবে মওলকের জন্ম হয়েছিলো, সম্ভবত দরিদ্রদের মগজে। মওলককে যে সৃষ্টি করেছিলো, তার নিশ্চয়ই কোনো রাজপুত্রকে বলি দেওয়ার মতলব ছিলো। কিন্তু ঘটেছিলো উল্টোটা। মওলক খেতে শুরু করেছিলো দরিদ্রদেরকেই। তবে পরাজয়ের পর কার্তেজীয়রা সতর্ক হয়েছিলো। শুধু অভিজাত পরিবারের শিশুদেরকেই যেন বলি দেওয়া হয়, এটি তারা নিশ্চিত করেছিলো। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। পরবর্তী যুদ্ধে, এতো শিশু খেয়েও দেবতা মওলক রোমানদেরই পক্ষ নিয়েছিলো।

কার্তেজীয়রা যদি বুদ্ধিমান হতো, তাহলে এই বিপুলসংখ্যক শিশু খুন করার প্রয়োজন পড়তো না। একটি শিশু খুন করেই তারা বুঝে যেতো- কোনো কাল্পনিক দেবতা নয়, যুদ্ধ জয়ের জন্য প্রয়োজন ভালো যোদ্ধা ও সমরাস্ত্র।

দেবতারা যে কোনো কাজের নয়, তা কার্তেজীয়রা না বুঝলেও বুঝতে পেরেছিলো আর্কেডীয়রা। আর্কেডিয়ায় যখন খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছিলো, তখন কৃষকেরা দেবতা প্যানের মূর্তিকে ধরে পিটিয়েছিলো।

৩.

মন্দিরে যখন পাঁঠা বলি দেওয়া হয়, তখন পাঁঠা ও রামদাওয়ালার মধ্যে মূল সম্পর্কটি থাকে শক্তির। যদি বলিদাতার চেয়ে পাঁঠার গায়ের শক্তি বেশি হতো, তাহলে বলির ঘটনাটি ঘটতো না। কার্তেজীয়রা যে দেবতা মওলকের উদ্দেশ্যে শিশু বলি দিতো, এর মূল কারণও ছিলো শক্তি। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের চেয়ে একজন শিশুর গায়ের শক্তি কম, ফলে তাকে বলি দেওয়া সহজ। দেবতারা বলি হিশেবে কেন শুধু শিশু আর ছাগল-ভেড়াই চান, বাঘ- সিংহ কেন চান না, এ নিয়ে একসময় খুব কৌতূহলী ছিলাম। পরে দেখলাম যে, বাঘ জবাই করা আসলে সহজ কাজ নয়। এতে পূজারি ও পূজনীয়, দুজনেরই বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

প্রথম যখন সতীদাহ প্রথার কথা শুনি, তখনো এ বিষয়টি নজরে এসেছিলো। যদি শরীরের শক্তিতে নারীরা পুরুষদের চেয়ে এগিয়ে থাকতো, তাহলে সতীদাহের নাম পাল্টে স্বামীদাহ রাখতে হতো, এবং স্ত্রীদের প্রতি স্বামীরা তাদের ভালোবাসা প্রকাশের একটি অসাধারণ সুযোগ পেতো। কারণ ভালোবাসার প্রমাণ সবসময় দুর্বলকেই দিতে হয়। মহাভারতে পাণ্ডুর দ্বিতীয় স্ত্রী মাদ্রীকে সহমরণে গিয়ে প্রমাণ করতে হয়েছিলো, পাণ্ডুকে সে কতোখানি ভালোবাসে। মানুষ যদি বুদ্ধিমান প্রাণী হতো, তাহলে এরকম প্রাণঘাতী উপায়ে সে ভালোবাসার প্রমাণ খুঁজতো না।

একটি শিশুর সাথে আমার কথা হয়েছিলো, যে বলেছিলো, আমি মুসলমানি করবো না। আমি বললাম, তোমাকে মুসলমানি করতে হবে। কারণ তোমার গায়ে শক্তি কম। তবে শিশুটির ধারণা— তার গায়ে শক্তি বেশি ( যেহেতু সে হরলিক্স খেতো)। হরলিক্সের শক্তি দিয়ে যে মুসলমানি আটকানো যায় না, তা সে হাজমের ক্ষুরের ঘা খেয়ে বুঝতে পেরেছিলো।

৪.

সম্ভবত অ্যারিস্টটলই মানুষকে প্রথম বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ বলে প্রশংসা করেছিলেন। এ প্রশংসার মূলে যে-কারণ ছিলো তা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। কারণটি শুনলে, আমার ধারণা, আপনারা অনেকেই পাটিগণিতে আগ্রহী হয়ে উঠবেন:

তখন যারা যোগ-বিয়োগ জানতো তাদেরকেই বুদ্ধিমান বলা হতো। সাত আর আটে পনেরো হয়— এ হিসাবটি করার মতো মানুষ খুব বেশি ছিলো না।

কেন কিছু মানুষ পাটিগণিত জানে, আর কিছু মানুষ জানে না, এর একটি ব্যাখ্যা অ্যারিস্টটল দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আত্মা তিন প্রকার:

১। পুষ্টিবাদী ও ভোগবাদী আত্মা, যা সকল উদ্ভিদ ও প্রাণীর ভেতর

অবস্থান করে। এর কাজ— খাবার জোগাড় ও বংশ বিস্তার করা। এই আত্মা যার ভেতর আছে, তার সকল চিন্তা রুজি-রোজগার, ভোগ-বিলাস, ও বিয়ে-শাদি নিয়ে। অ্যারিস্টটল বেঁচে থাকলে দেখতেন, বাংলাদেশে এই আত্মার সংখ্যা কোটি কোটি।

২। সংবেদনশীল আত্মা, যা মানুষ ও নিচু জাতের সকল প্রাণীর ভেতর অবস্থান করে। এই আত্মার কাজ হাঁটা-চলায় সাহায্য করা।

৩। যুক্তিবাদী আত্মা, যা ঐশ্বরিক। অ্যারিস্টটলের দাবি, এই আত্মার প্রভাব যার ওপর বেশি সে-ই যোগ-বিয়োগ জানে।

তবে অ্যারিস্টটল যদি আধুনিক ক্যালকুলেটর ও কম্পিউটারের দেখা পেতেন, তাহলে সম্ভবত আরেকটি চতুর্থ আত্মার কথা প্রস্তাব করতেন।

অ্যারিস্টটল কি বুদ্ধিমান ছিলেন? ছিলেন, তবে অতোটা নয়, যতোটা রটানো হয়। আমি গ্রামে অনেক মানুষ পেয়েছি যাদের বুদ্ধি অ্যারিস্টটল ও প্লেটোর বুদ্ধির কাছাকাছি। প্লেটো বিশ্বাস করতেন, কোনো পুরুষ এক জীবনে জ্ঞান অন্বেষণ করতে না পারলে পরবর্তী জীবনে সে নারী হয়ে জন্মাবে। প্লেটোর এ-বক্তব্য সত্য হলে, বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক মন্ত্রীকেই তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হতে হতো।

অ্যারিস্টটল বলতেন—

১। গর্ভধারণ করা উচিত শীতকালে, যখন বাতাস উত্তর দিক থেকে বয়

২। কম বয়সে বিয়ে করলে মেয়ে বাচ্চা হবে।

৩। পুরুষের চেয়ে নারীর রক্ত অধিক কালো।

৪। নারীর মুখে দাঁতের সংখ্যা পুরুষের চেয়ে কম।

এরকম নানা সত্য কথা অ্যারিস্টটল বলেছেন। তবে সত্য চিরকাল সত্য থাকে না। অ্যারিস্টটলের বহু সত্যই এখন লাভ করেছে কুসংস্কারের মর্যাদা, যেরকম আমাদের অনেক সত্যও কয়েক হাজার বছর পর পরিণত হবে কুসংস্কারে।

আমার মা যখন কোথাও যাওয়ার সময় সামনে বিড়াল পড়া নিয়ে চিন্তিত হন, তখন ভাবি— নিশ্চয়ই অ্যারিস্টটলের মতোই কোনো মনীষীর মাথা থেকে প্রথম এ সত্যটি বেরিয়েছিলো। ঝরনার জলের মতো জ্ঞানও সবসময় উঁচু থেকে নিচুর দিকে প্রবাহিত হয়। ওই মনীষী হয়তো বেঁচে ছিলেন অ্যারিস্টটলেরও অনেক আগে, কিন্তু তার জ্ঞান আমার মা পর্যন্ত এসে পৌঁছুতে লেগে গেছে কয়েক হাজার বছর।

৫.

তবে মানুষ যতোটা না বুদ্ধিমান তার চেয়ে বেশি বিশ্বাসী। যদি বিশ্বাসের পেছনে সে ভালো কোনো কারণ খুঁজে না পায়, তাহলে মনে মনে নিজেই কিছু কারণ উদ্ভাবন করে ফেলে। খুব বিপদে না পড়লে বুদ্ধিকে সে বিশ্বাসের ওপরে স্থান দিতে চায় না। আমি কিছু হোটেল পেয়েছি যেগুলোতে ১৩ নম্বর কক্ষ নেই। সংখ্যা হিশেবে ১৩ অশুভ, এর পেছনে কোনো বুদ্ধিদীপ্ত কারণ দেখি না। লন্ডনগামী একটি ফ্লাইটে, আমেরিকান এক বৃদ্ধার আসন পড়েছিলো ১৩বি; কিন্তু ১৩ ক্রমিকের কোনো আসনে বসতে তিনি রাজি ছিলেন না। আমি বললাম, মিলার্ড ফিলমোর তো ভালো প্রেসিডেন্ট ছিলেন, ১৩তম হিশেবে তো তার হিটলার বা স্তালিন হওয়ার কথা। বৃদ্ধা জবাব দিয়েছিলেন, এ জন্যই ফিলমোরের পর আর কেউ হুইগ পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি, পার্টিটাও বাঁচেনি।

ফ্লাইট থেকে নেমে যাচাই করে দেখলাম, বৃদ্ধার কথা সঠিক। ফিলমোরের পর আসলেই আর কেউ হুইগ পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। হুইগ পার্টিও আর হুইগ পার্টি থাকেনি, পরিণত হয়েছিলো অন্য পার্টিতে। কিন্তু বৃদ্ধা, হুইগ পার্টির অভ্যন্তরীণ কলহকে দায়ী না করে কেন ১৩ সংখ্যাটিকে দায়ী করেছিলেন, তা বুঝে আসেনি। কোনো কিছুর কারণ অনুসন্ধান একটি পরিশ্রমের কাজ, যা মানুষ সাধারণত করতে চায় না। এর চেয়ে বানোয়াট কোনো কুসংস্কারের কাঁধেই দায় চাপানো ভালো।

বাংলাদেশের অনেক কৃষক, বোরো মৌসুমে ধানের শিষ জ্বলে গেলে ‘নজর লাগা’ ও ‘বাঁও লাগা’-কে দায়ী করেন। এর কারণ, শিষ জ্বলে যাওয়ার প্রকৃত রোগটি তারা অনুসন্ধান করতে চান না। যদি খতিয়ে দেখা হতো, কী কারণে শিষ জ্বলে যাচ্ছে, তাহলে যে-উত্তরটি পাওয়া যেতো তা এরকম— উচ্চ তাপমাত্রায় (সাধারণত ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি) যে- শিষগুলো বের হয়, তা জ্বলে যায়, এবং এটি প্রতিরোধযোগ্য।

শিলিগুড়িতে এক বৃদ্ধকে পেয়েছিলাম, যিনি মোট বারোটি বিয়ে করেছিলেন, এবং এগারো জনকেই তালাক দিয়েছিলেন। ভদ্রলোকের ইচ্ছে ছিলো বিশটি বিয়ে করার, কিন্তু বারোতে এসে থেমে গেছেন, কারণ বাসর রাতে ১২ নম্বর স্ত্রী তাকে ভয় দেখিয়েছিলো— “স্বপ্নে দেখেছি, ১৩ নম্বর স্ত্রী আপনাকে ঘুমের মধ্যে খুন করছে।”

বৃদ্ধ এই বক্তব্য বিশ্বাস করে আর বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

৬.

মানুষ উন্মাদও বটে, এবং এই উন্মত্ততার একটি চমৎকার গোষ্ঠীবদ্ধতা রয়েছে। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন যখন বজ্রনিরোধক দণ্ড তৈরি করলেন, তখন খ্রিস্টান হুজুরেরা ঘোষণা দিলো: এটি ঈশ্বরবিরোধী কাজ। ঈশ্বর ঠাডা বা বজ্রপাত পাঠান শয়তান ও পাপীদের শায়েস্তা করার জন্যে। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন ঈশ্বরের কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছেন। বজ্রপাত কখনো ভালো মানুষকে আঘাত করে না।

২০২০ সালে এমন দাবি হাস্যকর মনে হলেও তখন তা মোটেও হাস্যকর ছিলো না। রাজা তৃতীয় জর্জ এ বক্তব্য সমর্থন করেছিলেন।

একটি লোহার দণ্ডও ঈশ্বরের কাজে ব্যাঘাত ঘটানোর ক্ষমতা রাখে, এর চেয়ে বড়ো ঈশ্বরবিরোধী কথা আর হতে পারে না। বেঞ্জামিনের দণ্ডের তো সর্বশক্তিমান হবার কথা নয়। তবে উন্মাদরা এটি বুঝতে নারাজ। তাদের ধারণা, এই লোহার দণ্ড ঈশ্বরের চেয়েও শক্তিশালী।

খ্রিস্টান হুজুররা এখন নেই, কিন্তু তাদের উত্তরসূরিরা আছেন। কিছুদিন আগে একটি দেশের রাজধানীতে আমরা তাদের দেখা পেয়েছিলাম। এক প্রেসক্লাবের সামনে তারা জড়ো হয়েছিলেন, এবং জাতিকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, ইসলামে ছোঁয়াচে কোনো রোগ নেই।

একজন ইমাম খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেছিলেন- করোনা এসেছে অমুসলিমদের জন্যে। অথচ আমি জানতাম, অমুসলিম আলেকজান্ডার ফ্লেমিংয়ের পেনিসিলিন বিশ্বে মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে।

বজ্রপাত ধার্মিকদের জন্য নয়, খ্রিস্টান চার্চের এমন বক্তব্যের সাথে ওই ইমামের বক্তব্যের মিল আছে।

তবে ব্যাপারটি শুধু আধুনিকতা বা শিক্ষা-দীক্ষার নয়। আধুনিক শিক্ষা পেয়েও কেউ কেউ এমন আচরণ করতে পারে। ভারতে একবার কয়েকটি ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিলো, এবং এ এলাকার সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যারিস্টার তাঁর সতীর্থদেরকে এই মর্মে সতর্ক করেছিলেন যে, ভূমিকম্পগুলো তোমাদের পাপের শাস্তি হিশেবে এসেছে। মিডলটেম্পলের ওই সম্মানীত ব্যারিস্টারকে সকলেই চেনেন, নাম মহাত্মা গান্ধী।

৭.

অনেক দেশে ‘পাপের শাস্তি কুসংস্কারটি বেশ জনপ্রিয়। বাংলাদেশে কারও বড়ো অসুখ হলে প্রতিবেশীরা এটিকে ধরে নেন ‘আল্লাহ্ বিচার’। তাদের ধারণা, লোকটি কোনো পাপ করেছিলো বলেই অসুখে পড়েছে। বড়ো দুর্ঘটনা ও বিপদাপদের ক্ষেত্রেও এমনটি ধরে নেওয়া হয়, যদিও সদ্য জন্ম নেয়া অনেক শিশুকে আমি বড় অসুখ ও দুর্ঘটনায় মারা যেতে দেখেছি। একজন শিশু কী এমন পাপ করতে পারে, যার জন্য ঈশ্বর তাকে দুনিয়াতে পাঠিয়েই আসমানে ফেরত নেন, তা বোধগম্য নয়। অবশ্য বুদ্ধিমানদের কাছে এগুলোরও ব্যাখ্যা আছে। সেইন্ট অগাস্টিন দাবি করেছিলেন, শিশুদের পাপ মূলত আদম-হাওয়ার পাপ। আদম-হাওয়ার পাপ বংশ- পরম্পরায় শিশুটির মা পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে, এবং মায়ের দুধ পান করার কারণে শিশুটিও সেই পাপে পাপী হয়েছে!

একবার আমার পাশের গ্রামে এক লোক খুন হলো। খুনির কোনো হদিস পাওয়া গেলো না। পরিবারের লোকজন থানায় মামলা করলো, এবং মামলায় আসামি করা হলো গ্রামের সমস্ত পুরুষকে। কিছুদিন পর এক আসামির মেয়ে, শ্বশুরবাড়ি থেকে ফেরার পাথে বাসচাপায় নিহত হলো। গ্রামবাসী ধরে নিলো যে ওই আসামিই খুনি, তা না হলে তার মেয়ে মারা যাবে কেন? বাদী পক্ষ পুলিশকেও এ বক্তব্য বিশ্বাস করিয়েছিলো, এবং লোকটিকে জিজ্ঞাসাবাদে নেয়া হয়েছিলো (পুলিশ অবশ্য লোকটির কোনো সম্পৃক্ততা পায়নি)।

আরেকজনকে চিনি, যার এক মেয়ে পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিলো। লোকটি ধানের ব্যবসা করতো। যে-মানুষজন মেয়েটির লাশ দেখে হায়- আফসোস করছিলো, তারাই গ্রামে রটিয়ে দিলো- ফজলু মিয়ার ধানের পাল্লায় ভেজাল আছে। তার ব্যবসা হালাল না বলেই মেয়েটি পানিতে ডুবে মারা গেছে!

ধরে নিচ্ছি ফজলু মিয়া (ছদ্মনাম) সত্যি সত্যি ধান মাপার সময় পাঁচ কেজির বদলে সোয়া পাঁচ কেজি নিতেন, কিন্তু কোনো বোধসম্পন্ন ঈশ্বরের পক্ষে কি বাবার পাপের শাস্তি মেয়েকে দেয়া সম্ভব? কিন্তু পাগল পার্টি বুঝাতে চায় যে, ঈশ্বরও বুঝি তাদের মতোই

কম আক্কেলসম্পন্ন ‘মানুষ’। ফিলোসোফিক্যাল থিওলোজিতে একটি প্রপোজিশন আছে এরকম: কোনো গাধাকে যদি তার ঈশ্বর সম্পর্কে বলতে বলা হয়, তাহলে সে একটি গাধার বর্ণনাই করবে। কারণ তার ধারণা, ঈশ্বরও নিশ্চয়ই গাধা সদৃশ প্রাণী।

৮.

পাগলামোকে একসময় বলা হতো জ্বিনে ধরা। কেউ অসংলগ্ন আচরণ করলে ধরে নেয়া হতো, তাকে জ্বিন আছর করেছে। মানুষ এর একটি চিকিৎসাও আবিষ্কার করেছিলো, এবং এ আবিষ্কারের ভিত্তি ছিলো বিশ্বাস। এলাকাভেদে চিকিৎসাটি নানা রকম হলেও, মোটামুটি ছিলো এরকম— যাকে জ্বিনে ধরেছে, তাকে পেটাতে হবে। এই আঘাত রোগীর শরীরে লাগবে না, লাগবে জ্বিনের গায়ে, এবং মার খেয়ে জ্বিন পালিয়ে যাবে।

তবে আমি দেখেছি উল্টো। মারের আঘাত রোগীর শরীরেই লাগে, এবং প্রাণ যাওয়ার সময় রোগীর প্রাণই যায়। মার খেয়ে রোগীর বদলে জ্বিনের মৃত্যু হয়েছে, এমনটি কখনও শুনিনি।

পাগল চিকিৎসার এ পদ্ধতি এখনো চালু আছে। কিছুদিন আগে ফেনীর ফুলগাজীতে এক জ্বিন হুজুর, নাম শহিদুল্লা, এ চিকিৎসা দিয়ে একজনকে বেহেশতে পাঠিয়ে দিয়েছেন।

রাজা তৃতীয় জর্জ যখন পাগল হয়েছিলেন, তখন তাঁর ওপরও এ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছিলো, এবং ফলাফল ছিলো ফুলগাজীর মতোই। তবে রোগীটি একজন রাজা হওয়ায় তিনি প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। তাঁর গায়ে, আমার ধারণা, খুব সাবধানে হাত ওঠানো হয়েছিলো।

জ্বিন ধর্ষণও করে। একটি মেয়েকে জানি, যে এক রাতে উঠোনে প্রস্রাব করতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। তার বদনাটি ঘরের কাছে পাওয়া গেলেও, শরীরটি পাওয়া গিয়েছিলো অনেক দূরে, ধান ক্ষেতের আইলে। বিবস্ত্র; সারা গায়ে থুথু, লালা, ও ঘাসের ভাঙা ডগা।

মেয়েটির বাবা-মা’র দাবি— জ্বিন মেয়েটিকে তুলে নিয়ে দিয়েছিলো। সুন্দর মেয়েদের ওপর জ্বিনের নজর থাকে, এবং একা পেলে তুলে নিয়ে যায়।

মেয়েটির মা যখন মেয়েটিকে নিয়ে কবিরাজের কাছে গেলো, তখন কবিরাজ বললো— ‘মেয়েটি অপবিত্র হয়ে গেছে। তাকে পবিত্র করতে হবে। এ জন্য সাত দিন সাত রাত সে এখানে থাকবে। আপনি বাড়ি চলে যান, সাত দিন পর এসে মেয়েকে নিয়ে যাবেন।

আমি জানি না, এ সাত দিন সাত রাতে মেয়েটি আরো অনেক জ্বিনের দেখা পেয়েছিলো কি না।

সম্প্রতি সিলেটের মুরারিচাঁদ কলেজে জ্বিনরা একটি মেয়েকে তুলে নিয়ে যায়। তবে দিনের বেলা হওয়ায় জ্বিনদের আমরা দেখে ফেলি, এবং ধরিয়ে দিই পুলিশে। পুলিশ আমাদের জানিয়েছে, এরা মোটেও জ্বিন না, মানুষ।

এ কুসংস্কারগুলোর জন্ম, অন্য সকল কুসংস্কারের মতোই ভয় থেকে। মানুষ যখন ভয় পায়, তখন সে তার সুবিধাজনক কিছু বিশ্বাস তৈরি করে। এ ভয় প্রাণ হারানোর হতে পারে, ফসল হারানোর হতে পারে, সম্মান হারানোর হতে পারে, ক্ষমতা হারানোর হতে পারে; এমনকি হারানোর বদলে প্রাপ্তিরও হতে পারে। যেমন খ্রিস্টান নানরা, ঐশ্বরিক শাস্তির ভয়ে (শাস্তি এক প্রকার প্রাপ্তি), গোসলের সময়ও বোরকা পরে থাকেন। তাদের দাবি— বাথরুমে আমাদেরকে আর কেউ না দেখলেও ঈশ্বর দেখেন। এ নিয়ে বার্ট্রান্ড রাসেল একবার কৌতুক করে বলেছিলেন, “তারা বুঝাতে চায় যে, ঈশ্বরের চোখ বাথরুমের দেয়াল ভেদ করতে পারলেও বোরকার কাপড়ের দেয়াল ভেদ করতে পারে না।”

৯.

মানুষের বিবেচনাবোধও উন্নত নয়। প্রাণী হিশেবে সে-ই পৃথিবীতে সবচেয়ে হিংস্র। অন্য সকল প্রাণীর ক্ষেত্রে ‘পাশবিক’ শব্দটি ব্যবহৃত হলেও, মানুষ তার হিংস্রতাকে আলাদা করতে ব্যবহার করে ‘মানবিক’ শব্দটি। মানুষ যে মানবিক তার প্রমাণ আমরা হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পেয়েছি। হিটলার ইহুদিদের প্রতি যে-মানবিকতা দেখিয়েছিলেন, তা তুলনাহীন। লেনিন, স্তালিন, মাও সে তুং, চেঙ্গিশ খান, এ চারজনও হিটলারের মানবিকতার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী।

মানুষের যা ইতিহাস তা মোটামুটি হিংস্রতারই ইতিহাস, এবং তার হিংস্র প্রবৃত্তি বিলুপ্ত হবার নয়। মানুষের সবচেয়ে জরুরি বিজ্ঞানটিও, যাকে আমরা চিকিৎসাবিজ্ঞান বলি, দাঁড়িয়ে আছে ব্যাঙ, ইঁদুর, গিনিপিগ, ও বানরের লাশের ওপর। যদিও মানুষের বয়স মোটামুটি পঁচিশ লাখ বছর, কিন্তু সে কৃষিকাজ শুরু করেছে মাত্র দশ হাজার বছর আগে। তার আগে সে বনের অন্য প্রাণীদের মতোই বুনো ছিলো, এবং বনে হেঁটে যা বুঝেছি তা হলো— ওখানে সারাক্ষণ খুন-খারাবি লেগেই থাকে। ঈগল ছোঁ মেরে যখন বানরকে নিয়ে যায়, আর হরিণ যখন বাঘের মুখে ত্যানার মতো ঝুলে থাকে, তখন বনের সৌন্দর্য কদাকার হয়ে ওঠে।

প্রকৃতিতে কোনো প্রাণী টিকে থাকবে কি না, তা প্রায়ই নির্ধারিত হয় প্রাণীটির হিংস্রতা দ্বারা। প্রশ্ন উঠতে পারে, টিকে থাকার জন্য কতোখানি হিংস্রতা জরুরি? একটি উদাহরণ থেকে এর উত্তর পাওয়া যেতে পারে।

প্যারাগুয়ের জঙ্গলে আশেই নামে একটি আদিবাসী গোষ্ঠী ছিলো (এখনো আছে)। আশেইরা ছিলো ফরেইজার। ছোটো ছোটো দলে ভাগ হয়ে প্রকৃতি থেকে সরাসরি খাবার সংগ্রহ করতো, এবং এভাবেই বাঁচতো। আর্মাডিলো, হরিণ, বানর, লিজার্ড ও তাপির ছিলো এদের প্রিয় শিকার। তবে শিকারের পাশাপাশি এরা পাম গাছের বুকুইল, পোকামাকড়ের লার্ভা, এবং মধুও সংগ্রহ করতো।

আশেইদের একটি নিয়ম ছিলো এরকম: কেউ গুরুতর অসুস্থ হলে তাকে জঙ্গলে ফেলে দিয়ে আসতে হবে, অথবা করতে হবে হত্যা। বৃদ্ধ নারীদের ক্ষেত্রে, যারা বোঝা হয়ে উঠতো পরিবার বা দলের, তাদের জন্য নিয়মটি ছিলো একটু আলাদা। দলের একজন তরুণ সদস্য, নির্ধারিত দিনে, ধারালো কুঠার নিয়ে ওই বৃদ্ধাকে পেছন থেকে অনুসরণ করতেন, এবং মাথায় হঠাৎ এক কোপ দিয়ে শেষ করে দিতেন।

নৃবিজ্ঞানীরা এরকম একজন আশেইর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন, যার কাজ ছিলো শুধু তার বৃদ্ধা চাচি ও খালাদের হত্যা করা।

এর কারণ কী? এর কারণ, আশেইদের কোনো চিকিৎসাব্যবস্থা ছিলো না। তাদের কোনো প্রাসাদ বা গাড়িও ছিলো না। প্রকৃতির সাথে প্রতিযোগিতা করে তারা বাঁচতো। নিজেদের খাবার নিজেরা সংগ্রহ করতো। এক জায়গায় অনেক দিন থাকতো না। খাবারের খোঁজে জঙ্গলে জঙ্গলে তাঁবু ফেলতো। ফলে কেউ বয়স বা অসুখের কারণে বোঝা হয়ে উঠলে, তাকে পরিত্যাগ ও হত্যা করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকতো না।

বাংলাদেশে যখন প্রথম করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়, তখন আশেইদের মতোই একটি ঘটনা দেশটির টাঙ্গাইল জেলায় ঘটেছিলো। দরিদ্র এক বৃদ্ধাকে তার দরিদ্র স্বজন ও সন্তানরা জঙ্গলে ফেলে দিয়েছিলো। তাদের বক্তব্য- ‘বৃদ্ধাটির করোনা হয়েছে, এবং তিনি বাঁচবেন না। তাকে ঘরে রাখলে আমাদেরও করোনা হবে, আর করোনা হলে, আমরাও বাঁচবো না।’ করোনা হলে কেউ বাঁচে না- এমনটি তারা শুনেছিলো ফেসবুক, টেলিভিশন, ও ইউটিউব থেকে। এ জন্য মিডিয়ার কথা আমি মানুষকে খুব সাবধানে আমলে নিতে বলি।

১০.

জঙ্গলে শিকার করে, ‘শিকার’ খুব ভদ্র শোনায়, খুন করে, মানুষ যে-আনন্দ পেতো, তা কৃষিকাজ ও ব্যবসা করে পাওয়া সম্ভব নয়। তবে খুনের যে- আনন্দ ও উত্তেজনা, তা মানুষের জিনে এখনো লুকিয়ে আছে। সুযোগ পেলেই মানুষ ওই সুপ্ত বাসনা চরিতার্থ করতে চায়। কিন্তু সরাসরি খুনের সুযোগ সীমিত হওয়ায় তারা খুনের আনন্দ অন্যভাবে নিচ্ছে।

খুন করার লাইসেন্স যাদের আছে, তাদের দিয়ে খুন করিয়েই মানুষ সে- আনন্দ উপভোগ করছে। চারদিকে যে ফাঁসির দাবি, পাথর ছুড়ে হত্যার দাবি, ক্রসফায়ারের দাবি, হাত কেটে ফেলার দাবি, ফায়ারিং স্কোয়াডের দাবি, চোখ তুলে ফেলার দাবি, খোজা করে দেয়ার দাবি, এবং আরো অনেক নিষ্ঠুর দাবির কথা শোনা যায়- তা মানুষের জিনে লুকিয়ে থাকা খুনে-প্রবৃত্তিকেই প্রমাণ করে।

যাত্রাবাড়ীতে যে-নারীটিকে, যিনি তার সন্তানদেরকে ইশকুল থেকে আনতে গিয়েছিলেন, ছেলেধরা সন্দেহে আমরা পিটিয়ে মেরে ফেলেছিলাম, তার মূল কারণও ছিলো খুনের আনন্দ লাভ।

একবার এক স্পেনিশকে জিগ্যেস করেছিলাম, একটি গরুর সাথে যুদ্ধ করে তোমরা কী মজা পাও? হোয়াট দ্যা হেল ইজ অ্যা বুল ফাইট? তার উত্তর ছিলো- দেখো, যুদ্ধ শেষে আমরা কিন্তু গরুটিকে খুনও করি, এবং ওইটিই আসল আনন্দ। মানুষ হয় নিজে খুন করতে চায়, অথবা অন্যকে দিয়ে খুন করাতে চায়। এর কোনোটিরই সুযোগ না পেলে, সে কোথাও বসে একটি খুনের দৃশ্য উপভোগ করতে চায়।

পৃথিবীতে যে-কম্পিউটার গেমগুলো আছে, তার অধিকাংশই যুদ্ধ ও খুনোখুনির গেম। গেমগুলো শিশু-কিশোরদের কাছে এতো জনপ্রিয় কেন? এর কারণও সম্ভবত তাদের জিনে লুকিয়ে থাকা খুনে-প্রবৃত্তি। আধুনিক রাষ্ট্রগুলোতে খুনোখুনি করার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো রয়েছে। মানুষের দাবি, তারা সভ্যতার চরম শিখরে অবস্থান করছে। আমার বুঝে আসে না, সভ্যতার চরম শিখরে পৌঁছেও কেন তারা এ খুনোখুনির প্রতিষ্ঠানগুলো টিকিয়ে রেখেছে? কেন কোনো রাষ্ট্রই উদ্যোগ গ্রহণ করছে না, যেন খুনের সরঞ্জামগুলো ধ্বংস করা যায়? উল্টো যাদেরকে খুন করা হবে, তাদের টাকায় রাষ্ট্রগুলো নতুন নতুন খুনের সরঞ্জাম তৈরি করছে। সভ্যতা ও খুনোখুনি- এ দুটি তো একসাথে চলতে পারে না। নাকি মানুষের সভ্যতা মূলত খুনোখুনির সভ্যতা? তার অন্য সকল অর্জন কি খুনোখুনির বাইপ্রোডাক্ট? এর উত্তর হয়তো আমরা অনেকেই জানি, কিন্তু স্বীকার করি না।

১১.

প্রাণী হিশেবে মানুষ নিষ্ঠুর কি না, তা ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইয়েমেন, আফগানিস্তান, ইরাক, ও লিবিয়ার শিশুদের জিগ্যেস করলে জানা যেতে পারে। বাংলাদেশ ও ভারতে চোর, পকেটমার, এবং ছিনতাইকারী ধরা পড়লে যে-মারধরের শিকার হয় তা অতুলনীয়। খুন করার জন্য মানুষ তখন উন্মত্ত হয়ে ওঠে। তবে চোরটির হাতে আগ্নেয়াস্ত্র থাকলে, এবং বুকে রাজনীতির প্রদীপ ঝলমল করলে, সে সুযোগ পায় নিরাপদ প্রস্থানের।

রজব আলি নামে এক চোরের সাথে আমার কথা হয়েছিলো। তাকে জিগ্যেস করেছিলাম- চুরি করতে আপনার খারাপ লাগে কি না?

তার জবাব ছিলো: “চুরি করার মধ্যে খারাপ কিছু নেই। পৃথিবীতে যতো সম্পদ আছে, তার কোনোটিই মানুষ সৃষ্টি করেনি। সে সম্পদ দখল করেছে মাত্র। আপনি যেটিকে চুরি বলছেন, সেটিকে আমি বলি দখল। রাতের আঁধারে আমি কিছু সম্পদ দখল করি মাত্র। যার সম্পদ বেশি, তার থেকে সামান্য সম্পদ দখল করা খারাপ কাজ নয়, বরং ভালো কাজ। গত রাতে কিছু বিস্কুট চুরি করেছি, সে-বিস্কুটের ভাগ আমার ঘরের ইঁদুরও পেয়েছে। চুরি করে আমি কিন্তু বিলাসবহুল জীবনযাপন করি না। আগে গার্মেন্টসে যেতাম, তবে যা বেতন পেতাম তা দিয়ে ক্ষুধাও মিটতো না, রাগও কমতো না। এখন হয়তো ক্ষুধা মেটে না, কিন্তু রাগ মেটে। আমরা যে-পোশাক তৈরি করতাম, তা খুব সুন্দর পোশাক ছিলো। এ পোশাকের সবই লন্ডন-আমেরিকা যেতো। আমাদের আশা ছিলো, অন্তত ঈদ ও পূজায়, এসব পোশাকের দুই-একটি আমরাও পাবো। ফুলতারা নামের একজন, তার মেয়ের জন্য কিছু জামা চুরি করেছিলো। এতে তার চাকরি চলে গিয়েছিলো। চাকরি তো নয়, দুটো ডাল-ভাতের উছিলা মাত্র। ফুলতারার জামাই পেটে একটা বাচ্চা ঢুকিয়ে দিয়েই ভাগছিলো, কিন্তু বাচ্চা নামক হাতিটা পোষার দায়িত্ব ফুলতারাকেই নিতে হয়েছিলো। আপনি ভাবতে পারেন, বাচ্চা কীভাবে হাতি হয়? হ্যাঁ, ধনীর ঘরে যা শিশু, গরিবের ঘরে তা হাতি। দেখুন ফুলতারা কী করল- সে তার বাচ্চাটিকে একদিন আমার ঘরে নিয়ে এসে বললো, রজব ভাই, আমি একটু বড়লেখা যাইতাছি, একটা বুয়ার কাম পাইছি, বাচ্চাটারে একটু দেইখা রাইখেন, ইশকুলে যায় কি না খেয়াল রাইখেন। পরদিন মসজিদের মাইকে শুনি, ফুলতারা গলায় দড়ি পেঁচিয়ে নিজেকে ইন্নালিল্লাহ করে ফেলেছে। এই যে ফুলতারা, যার লাশটা আমি নিজ চোখে আমগাছের ডালে ঝুলতে দেখেছি, তার দুই মাসের বেতন কিন্তু ওই গার্মেন্টসে এখনো পাওনা আছে। তার বাচ্চাটা এখন ক্লাস নাইনে পড়ে। তবে আজও রাতে মাই গো, ও মাই, বলে চিৎকার দিয়ে ওঠে। মেয়েটা যে ঘুমাবে, এরকম কোনো খাটও আমার ঘরে নেই। একটা তিন-পায়া চৌকি ছিলো, ওইটার চার নম্বর পা ঠিক করে কিছুদিন আগে মেয়েটাকে দিয়েছি। আমি আর আমার বউ মেঝেতেই থাকি। আমাদের নিজেদেরও তিনটা গ্যাদা। দেখেন, ফুলতারার মেয়েটার বিয়েও আমাকেই দিতে হবে। এ জন্য দুই বছর আগে চুরি ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু পুলিশের চোরের তালিকায় আমার নাম রয়ে গিয়েছিলো। একদিন চেয়ারম্যান বাড়ির এক চুরির মামলায় আমার নাম ঢুকিয়ে দেয়া হলো। আমি কিন্তু তার বাড়িতে চুরি করিনি। পুলিশ করলো কী, আমাকে থানায় বেঁধে শিয়াল- কুকুরের মতো পেটালো। এরপর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আবার চুরি শুরু করি। কারণ সমাজে রটে গিয়েছিলো, রজব আলি চুরি ছাড়েনি, সে চেয়ারম্যান বাড়িতে চুরি করেছে।”

রজব আলির আক্ষেপ- বাবর ও ভিক্টোরিয়াকে কেউ চোর না বললেও, তাকে নিয়মিত চোর বলা হয়; কারণ চোর হিশেবে সে ছোটো। বড়ো চোরদেরকে কেউ চোর বলে না। ইশকুলে এডওয়ার্ড ও হুমায়ুনকে কখনো ‘চোরের বাচ্চা’ গালি শুনতে হয়নি, কিন্তু তার মেয়েটিকে সারাক্ষণ ‘তোর বাপ চোর’— এটি শুনে বড়ো হতে হয়েছে।

রজব আলি মারা যান ২০১২ সালের দিকে। তার সাথে আমার কথা হয়েছিলো আঞ্চলিক ভাষায়। বাবর, ভিক্টোরিয়া, এডওয়ার্ড, হুমায়ুন – এ নামগুলোর বদলে তিনি বলেছিলেন কিছু দেশীয় নাম, যা পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তার বক্তব্যকে স্মৃতি থেকে আমি আমার ভাষায় লিখলাম।

১২.

প্রাণীদের মধ্যে একমাত্র মানুষই গোঁড়া। সে আমৃত্যু কিছু বিশ্বাসের দাস হয়ে থাকতে পছন্দ করে। কোনো কিছুতে বিশ্বাস স্থাপন করাটা আপত্তিকর কিছু নয়, কিন্তু ওই বিশ্বাসকে কারাগার বানিয়ে, তার ভেতরে বন্দি হয়ে যাওয়াটা আপত্তিকর। খুব কম মানুষই তার বিশ্বাসের কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে, যুক্তির মানদণ্ডে কোনো কিছুকে গ্রহণ অথবা বাতিল করতে পারে। গোঁড়ামির চেয়ে বিবেচনাবোধকে প্রাধান্য দেন, এমন মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। যে-সমাজে গোঁড়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠ, সে-সমাজ চিলের সমাজ। ওখানে বাঁচতে হয় মুরগির ছানার মতো লুকিয়ে লুকিয়ে।

মন্ত্র নামের একজন আমাকে একবার তার পীরের কাছে নিয়ে গিয়েছিলো। মস্তুর বিশ্বাস, একমাত্র তার পীরের মুরিদেরাই বেহেশতে যাবে, এবং বেহেশতে যাওয়ার জন্য কেবল নামাজ পড়াই যথেষ্ট নয়।

আমি বললাম, তুমি পৃথিবীতে এতো কষ্টে আছো কেন?

পৃথিবীতে যারা কষ্টে থাকে, পরকালে তাদের হিসাবনিকাশ সহজ হয়, ধনীদের চেয়ে পাঁচশো বছর আগে তারা বেহেশতে যাবে, মস্তু বলে।

তোমার পীর তো কষ্টে নেই, পাকা ঘরে থাকেন, এসি গাড়িতে করে ঢাকা যান। তিনি কি বেহেশতে যাবেন না? আমি বলি।

তিনি মুর্শিদ, তার হিসাব আলাদা, আমি পাপী, আমার হিসাব কঠিন, মস্তু বলে।

মঞ্জুর পীরকে আমার জ্ঞানী কেউ মনে হয়নি। আল্লাহ্, মস্তুর ধারণা, হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস করেন। তা না হলে মুর্শিদের (ব্রাহ্মণের) হিসাব আলাদা, এ কথা তার বলার কথা নয়।

মস্তুর ব্যাপারে আমার অভিমত হলো— সে গোঁড়া। তার পীরের বিরুদ্ধে যায়, এমন সব কথাকেই সে ফালতু মনে করে। পীর যদি মস্তুর স্ত্রীকে ধর্ষণ করে এসে বলে যে কাজটি তিনি মস্তুর মঙ্গলের জন্যই করেছেন, তাহলে মস্তু কোনো উচ্চবাচ্য করবে বলে মনে হয় না। পৃথিবীর অনেক দেশেই ক্ষমতাবানেরা, নাগরিকদের মঙ্গলের নামে এ ধরনের কাজ করে থাকেন। তাদের অনুসারীদের ধারণা— স্যার যা করেন, ভালোর জন্যই করেন।

গোঁড়ামি কী, এমন প্রশ্ন অনেকের মনে জাগতে পারে। এর উত্তর এক কথায় দেয়া সম্ভব মনে করি না। তবে আপনি গোঁড়া কি না, তা বুঝার কিছু উপায় বাতলে দিতে পারি-

(ক)

একটি বিরোধী মতের পত্রিকা নিন, যে-পত্রিকা কখনো পড়েন না। আপনি আওয়ামী লীগের লোক হলে জামায়াতে ইসলামীর পত্রিকা নিন; বা জামায়াতে ইসলামীর লোক হলে আওয়ামী লীগের পত্রিকা নিন। অথবা যদি ধর্মবিরোধী হন, তাহলে একজন ধার্মিকের লেখা বই নিন; এবং ধার্মিক হলে একজন ধর্মবিরোধীর লেখা বই নিন। পড়া শুরু করুন। যদি দেখেন লেখকের ওপর, বইটির ওপর, বা পত্রিকাটির ওপর আপনার রাগ উঠছে, তাহলে এ রাগ কীভাবে প্রকাশ করতে চান তা স্থির করুন।

রাগ প্রকাশের তিনটি উপায় আছে বলে মনে করি।

এক. রাগটি প্রথমে নিজের ওপরে ঢালা। এ প্রক্রিয়ায় শরীরকে শান্ত রেখে মগজকে উদ্দীপ্ত করতে হবে। মগজ উদ্দীপ্ত করা মানে মাথা গরম করা নয়। মাথা থাকবে ঠান্ডা, মগজ থাকবে ক্রিয়াশীল— এটিই মগজের উদ্দীপ্তকরণ। নিজের ভেতরে লালিত কোনো বিশ্বাসের দাস হয়ে নয়, মগজের আশ্রয় নিয়ে খুঁজে বের করতে হবে- আসলে কী কী কারণে ওই পত্রিকা, বই বা লেখকের ওপর আপনি রাগ করছেন? যদি দেখেন যে কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়া, শুধু নিজের পছন্দের বিশ্বাসের পক্ষ নেয়ার জন্য রাগ উঠছে, তাহলে ধরে নিতে হবে আপনি ‘ডগমা পজিটিভ’, অর্থাৎ‍ গোঁড়া।

এখানে একটি বিষয় একটু খেয়াল রাখা দরকার। ‘যৌক্তিক কারণ’ খোঁজার সময় নিজের সীমাবদ্ধতাগুলো আমলে নিতে হবে। ছাগল যখন কোনো বৃদ্ধার লাউয়ের চারা খেয়ে ফেলে, তখন ওই বৃদ্ধা ও ছাগল, দুজন দুটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনাটিকে দেখে। বৃদ্ধার কাছে যা উপকারী ফসলের চারা, ছাগলের জন্য তা কেবলই উপাদেয় ঘাস। এটি মাথায় রাখতে হবে। এমন অনেক বিষয় আছে, যা ইশকুলের পড়ার সময় আমার কাছে খুব সঠিক মনে হতো, কিন্তু এখন ওই একই বিষয়গুলোকে ভুল মনে হয়। কোনো মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি তার পড়াশোনা ও অভিজ্ঞতার ওপরই বেশি নির্ভর করে। শুধু একপেশে পড়াশোনা বা একপেশে অভিজ্ঞতা, তা যতো বিস্তৃতই হোক না কেন, মানুষের ভেতরের বিবেচনাবোধকে জাগাতে পারে না। এটি কেবল পক্ষপাতিত্ববোধেরই সৃষ্টি করে, যা গোঁড়ামির অন্যতম প্রধান কারণ। আপনার পড়াশোনা ও অভিজ্ঞতা- দুটোকেই হতে হবে বৈচিত্র্যময় এবং উদার। উদ্ভট কল্পনা ও সত্য- এ দুটির মাঝে পার্থক্য করার কৌশল জানতে হবে। যা পর্যবেক্ষণযোগ্য, তার চেয়ে যা পর্যবেক্ষণযোগ্য নয়, তা নিয়ে তোলপাড় করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। অনুমানকে পরীক্ষালব্ধ সত্যের মর্যাদা দেয়া ঠিক হবে না। যুক্তির আশ্রয় নেয়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে, নিজের মতামতকে প্রাধান্য দেয়ার জন্য কোনো সুবিধাজনক যুক্তি যেন উদ্ভাবন না করেন। ‘লজিক’ আর ‘কানভিনিয়েন্ট লজিক’- এ দুটি এক জিনিস নয়।

যুক্তি প্রয়োগের বেলায় নিজেকে রাখতে হবে আপন বিশ্বাস ও অন্যের মতামতের মাঝামাঝি স্থানে। কোনো বিষয়কে সবসময় এই মাঝবিন্দু থেকে বিশ্লেষণ করতে হবে। বিশ্লেষণের সময় নিজের বুদ্ধি ও বিবেকের কাছে সৎ থাকতে হবে। কোনো বিষয়কে যেন সুবিধাজনক ও স্বার্থপরভাবে বিশ্লেষণ করা না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। জানি, এটি বেশ কঠিন কাজ। সবার এ ধরনের বিশ্লেষণের সক্ষমতাও থাকে না। কারণ, কুয়োর তলায় বসে কুয়োর চারপাশের মানচিত্র আঁকা সম্ভব নয়। এ জন্য সবচেয়ে ভালো হলো— ভিন্নমতের ওপর রাগ করা, ওপর রাগ করা, বা রাগের বশবর্তী হয়ে ভিন্নমতাবলম্বীদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা- এ অভ্যাসগুলো একেবারে পরিত্যাগ করা। শুধু এটুকু করা গেলে, সমাজে রাজনীতিক ও ধর্মীয় মারামারি অনেকাংশে কমে যাবে।

দুই. রাগটি নিজের ওপর না ঢেলে চারপাশের সমমনা মানুষদের ওপর ঢালা, এবং তাদের ভেতর রাগটিকে সংক্রমিত করা। এ প্রক্রিয়ায় কিছু উন্মাদ জনগোষ্ঠী তৈরি হয়, যারা নিজেদের বিশ্বাসের বাইরে আর কোনো কথা আমলে নিতে চায় না। উন্মত্ততার এই গোষ্ঠীবদ্ধতা অত্যন্ত বিপজ্জনক। লেনিনের বলেশেভিক পার্টি, হিটলারের নাজি, আফগানিস্তানের তালেবান, ভারতের শিবসেনা, মধ্যপ্রাচ্যের আইএস, যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট সুপ্রিম্যাসিস্ট গ্রুপ, বাংলাদেশের সুন্নি ও কওমি সম্প্রদায়, সালাফি জিহাদি, যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল অ্যাকশন- এ গোষ্ঠীবদ্ধ উন্মত্ততার চমৎকার উদাহরণ। বাংলাদেশের রাজনীতিক দলগুলোর দিকে তাকালেও এমনটি নজরে পড়ে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, একজনের রাগ বহুজনের মধ্যে সংক্রমণ- এ ব্যাপারটি কেন ঘটে? সে ক্ষেত্রে আমার ব্যাখ্যা হলো- প্রাণীদের মধ্যে একমাত্র মানুষই সবচেয়ে ভালো শ্রোতা। তারা যেকোনো অভিনব জিনিস মনোযোগ দিয়ে শোনে। তাদের ভাষাও সমৃদ্ধ। এ সমৃদ্ধ ভাষার কারণে, তারা হয় নিজেরা গল্প বলতে চায়, অথবা অন্যের গল্প শুনতে চায়। এই কথন এবং শ্রবণ— দুটি প্রক্রিয়াতেই মানুষ কল্পনার আশ্রয় নেয়। যারা কথক, তারা নানা কাল্পনিক কথা সমাজে ছড়ায়, আর যারা শ্রোতা, তারা ওই কাল্পনিক কথাকে নিজেদের কল্পনার সাথে মিশিয়ে নতুন গল্প তৈরি করে। ফলে শ্রোতারাও একসময় কথক বা বক্তা হয়ে ওঠে।

লক্ষ করলে দেখা যাবে, যে-গল্পগুলো খুনোখুনি, মারামারি, বিদ্বেষ, দলাদলি, ও হানাহানি উস্কে দেয়, সে-গল্পগুলো সমাজে বেশি জনপ্রিয়। এর কারণ, মানুষ উত্তেজনা পছন্দ করে। আমি আগেই বলেছি, জঙ্গলে খুনোখুনি করে মানুষ যে-আনন্দ পেতো, সে-আনন্দ তারা এখনো পেতে চায়। একটি ভিডিওতে দেখেছি, মার্ক জাকারবার্গের প্রিয় খেলা তীর এবং বর্শা নিক্ষেপ। একুশ শতকেও আফ্রিকার কিছু দেশে ট্রফি হান্টিং বৈধ।

আমাদের রাজনীতিক সমাবেশে এবং ওয়াজ-মাহফিলগুলোতে যে- উত্তেজনাকর স্লোগান দেওয়া হয়, তার কারণও একই। বক্তাদের হাড়গরম বক্তব্য শুনে শ্রোতারা তাদের অবদমিত উত্তেজনা প্রকাশ করতে চায়। যেহেতু শ্রোতারা বক্তা হিশেবে পটু নন, তাই তাদেরকে মামুলি কিছু স্লোগান দিয়েই তৃপ্ত থাকতে হয়। কিন্তু তাদের ভেতর থেকে কেউ কেউ, পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণের আশ্রয় নিয়ে, পরবর্তীতে একই ঘরানার বক্তা হয়ে উঠতে পারে।

তিন. রাগটি সরাসরি ওই পত্রিকা, বই, অথবা লেখকের ওপরে ঢালা। সম্প্রতি বাংলাদেশে কিছু পত্রিকা ও বইয়ের প্রকাশকের ওপর এ রাগ ঢালা হয়েছে। একজন প্রকাশককে হত্যা করা হয়েছে, কয়েকজন সম্পাদককে জেলে ঢুকানো হয়েছে, এবং কিছু লেখককে করা হয়েছে দেশছাড়া। হুমায়ূন আজাদের খুনের ঘটনাটিও এ রাগের বহিঃপ্রকাশ। হুমায়ূন আজাদ কাউকে চড়-থাপ্পড় না মারলেও, তাঁকে ঠিকই ছুরি মারা হয়েছে। অথচ তাঁর কোনো লেখা নিয়ে আপত্তি থাকলে, সে-লেখার পাল্টা জবাব লেখা দিয়ে দেয়া যেতো। কিন্তু গোঁড়াদের লেখার শক্তি খুব একটা থাকে না। থাকলে তারা গোঁড়া হতো না। দাউদ হায়দার ও তসলিমা নাসরিন, তারাও কেবল লেখার কারণে দেশ থেকে নির্বাসিত। গোঁড়াদের দাবি- তাঁদের লেখা ‘আপত্তিকর’! অর্থাৎ গোঁড়ারা এ অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংঘবদ্ধ। বিশ্বজিৎ নামক ছেলেটিকে এ গোঁড়ারাই খুন করেছিলো। বুয়েটের আবরার, সে-ও গোঁড়াদের রাগের বলি। পেট্রোল বোমাকাণ্ডেও আমরা এ রাগ প্ৰত্যক্ষ করেছি। কানাডা, ফ্রান্স, নরওয়ে, যুক্তরাষ্ট্র, ও নিউজিল্যান্ডে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষদের ওপর যে-হামলাগুলো হলো, সেগুলোও এ রাগেরই ফসল। হ্যাঁ, এ ক্ষেত্রে ভিক্টিমরা হয়তো কোনো পত্রিকার সম্পাদক বা লেখক ছিলেন না, কিন্তু ভিন্ন মতাদর্শ, ভিন্ন ধর্ম, বা ভিন্ন রঙের কারণেই তাদেরকে নিশানা করা হয়েছিলো। এ গোঁড়ারা সম্ভবত কোনো দেবতার পূজা করেন, যিনি বলি হিশেবে শুধু মানুষের লাশ চান।

রাগের এই সহিংস প্রকাশভঙ্গী মানুষের কোনো উপকারে আসে বলে মনে হয় না। উল্টো এসব ঘটনায় তাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন বিপর্যয়ের ভেতর পড়ে। আবরারের খুনিদের কিন্তু তাদের কোনো দেবতা বাঁচাতে আসেনি। যারা বেহেশতে যাওয়ার আশায় খুনখারাবি করেন, তাদেরকে আল্লাহ্ পছন্দ করার কোনো কারণ নেই। আল্লাহ্ কি বেহেশত তৈরি করেছেন খুনিদের জন্য? নিশ্চয়ই নয়। মানুষের গায়ে হাত তোলা, কাউকে ছুরি মারা, খেয়াল-খুশিমতো গ্রেপ্তার করা- এসব কোনো পুরস্কারযোগ্য কাজ নয়।

এ জন্য লেখার জবাব সবসময় লেখা দিয়ে, কথার জবাব সবসময় কথা দিয়ে দিতে হবে। কোনো লেখা বা কথা, তা যতো খারাপই হোক না কেন, যদি সেটিকে আপত্তিকর মনে হয়, তাহলে তার বিপরীতে শুধু কলম এবং জিহ্বাই চালাতে হবে; হাত, ছুরিকা, বা হাতকড়া নয়। এমনকি সহিংসতার জবাবেও, আত্মরক্ষা বা অন্যের জানমাল রক্ষার প্রয়োজন ব্যতীত কাউকে আঘাত করা যাবে না।

(খ)

কারও সাথে তর্ক করুন। দেখুন তর্কে হারতে চান কি না। যদি হারতে না চান, তাহলে ধরে নিন আপনি গোঁড়া।

আমার কথাই শেষ কথা, আমিই সবচেয়ে বেশি বুঝি, আমার ধর্মই সেরা ধর্ম, আমার নেতাই শ্রেষ্ঠ নেতা, আমার মতামতই সঠিক মতামত- এ গোঁয়ার্তুমিগুলো যাদের মাঝে আছে, তাদেরকে কখনো তর্কে হারানো যায় না, এবং তাদের সাথে তর্ক করাও ঠিক নয়। তর্কসৈনিকদের সকল প্রস্ততি বিজয়ী হওয়া নিয়ে। হেরে যাওয়ার জন্য এদের কোনো প্রস্ততি থাকে না।

নিজের কোনো বক্তব্য সংশোধন বা বাতিল করার মানে এই নয় যে- আপনি কারও কাছে তর্কে হেরে গেলেন। বরং এটিই শেখার সবচেয়ে বড়ো সুযোগ। নতুন কিছু জানা, চিরচেনা নদীটিকে নতুন দৃষ্টিকোণ দেখা- এগুলোর সাথে হার-জিতের কোনো সম্পর্ক নেই। মানুষের বুদ্ধির আধার এ প্রক্রিয়াতেই সমৃদ্ধ হয়। কিন্তু গোঁড়ারা মনে করে, কারও কাছ থেকে মগজ সমৃদ্ধ করার মানে হলো তার কাছে ছোটো হয়ে যাওয়া। ক্ষুদ্ররা চিরকাল এ ক্ষুদ্রত্বের ভেতর বন্দি থাকে। এ জন্য আকাশের ভেতরে বাস করেও এরা কখনো আকাশের দেখা পায় না।

যদি নিজের ও নিজের বিশ্বাসের প্রতি এ পক্ষপাতটুকু মানুষ বাদ দিলে, তাহলে পৃথিবী কিছু চমৎকার সমাজ পেতো।

১৩.

একবার এক মাওলানা আমার কাছে এলেন বাহাসের পরামর্শ নিতে। সুন্নি ও ওয়াহাবি— এ দুই দ্বীপের দুই মাওলানার মধ্যে বাহাস অনুষ্ঠিত হবে। বাহাসের বিষয়— নামাজের পর হাত উঠিয়ে দোয়া করা জায়েজ কি না।

তার সাথে কথা বলে বুঝলাম, তিনি তর্কে হারতে চান না।

জানতে চাইলাম, আপনি কোন পক্ষে?

তিনি বললেন, আমি হাত ওঠানোর পক্ষে।

আমি বললাম, হাত না ওঠালে দোয়া বুঝতে আল্লাহ্ কোনো অসুবিধা হয় কি না?

তিনি বললেন, আপনি ওই পক্ষের লোক। আপনার কাছে আসা আমার ভুল হয়েছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিক সমস্যাগুলোও গোঁড়ামির ফসল। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে শুধু নির্মূল করতে চায়। বিএনপির কোনো প্রস্তাব আওয়ামী লীগ, বা আওয়ামী লীগের কোনো প্রস্তাব বিএনপি, আমলে নিয়েছে বলে মনে পড়ে না। দু’পক্ষেরই দাবি- বাংলাদেশের সকল ভালো কাজ তারা করেছে। এমন দাবি এরশাদও করে থাকেন। একই ঘটনার তিনটি সত্য থাকতে পারে না। ইতিহাস নিয়েও এক পক্ষের দাবি অপর পক্ষের দাবির সাথে মেলে না। শিশুরা একবার পড়ে ঊনসত্তর, আরেকবার পড়ে ছিয়ানব্বই। এক পক্ষের কাছে যিনি দেবতা, অপর পক্ষের কাছে তিনি অসুর।

এটি আমি চীনেও লক্ষ করেছি। তবে চীনের এক পক্ষ আরেক পক্ষ থেকে দূরে বসবাস করে বলে ব্যাপারটি অতো টের পাওয়া যায় না। বেইজিংয়ে যিনি সূর্য, তাইপেতে তিনি মাটির পুতুল। আবার তাইপেতে যা সূর্য, বেইজিংয়ে তা সিকি পয়সা। কমিউনিস্ট পার্টির কাউকে যদি জিগ্যেস করি, একজন মহামানবের নাম বলুন, তাহলে তিনি উত্তর দেবেন- মাও সে তুং। একই প্রশ্ন কুমিনতাং পার্টির কাউকে করলে, উত্তর আসবে- চিয়াং কাই শেক। ব্যক্তিগত ও রাজনীতিক হুজুগ ছাড়া, এ গোঁড়ামিগুলোর পেছনে কোনো যৌক্তিক কারণ আমার নজরে পড়েনি।

পছন্দের মানুষকে বড়ো করার জন্য অপছন্দের মানুষকে ছোটো করা- এ রোগ সব সমাজেই আছে। তবে রোগটি নিরাময়যোগ্য। ব্যক্তিত্বের উন্নয়ন ঘটাতে পারলে রোগটির চিকিৎসা নিজে নিজেই করা যেতে পারে। তবে ব্যক্তিত্বের উন্নয়ন তখনই ঘটে, যখন কোনো মানুষ সমাজে তার নিজের গুরুত্ব অনুধাবন করতে শেখে। বহু মানুষ আশি বছর বেঁচেও নিজের গুরুত্ব আবিষ্কার করতে পারে না। জন্মের পর থেকে কবরে ঢোকার আগ পর্যন্ত সে নিজেকে তুচ্ছজ্ঞান করে। নিজেকে তুচ্ছ না ভাবলে, অন্যের নামে এতো মহান মহান স্লোগান দেয়া কারও পক্ষে সম্ভব হতো না। আমাদের ছাত্ররা যদি ব্যক্তিত্বের উন্নয়ন ঘটাতে পারতো, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এতো হানাহানি থাকতো না।

একবার (যখন অনেক ছোটো ছিলাম), একটি রাজনীতিক ছাত্র সংগঠন তাদের ওয়ার্ড কমিটির প্রচার সম্পাদক পদে আমার নাম ঢুকিয়ে দেয়। আমি খুব খুশি। নানা মিছিল-মিটিংয়ে তারা ডেকে নেন। চা-শিঙারা খাওয়ান। তখন ভালো বক্তৃতা করতে পারতাম। অনেকের বক্তৃতা লিখেও দিতাম। এখন তা পারি না। এর কারণ, তখন কম জানতাম বলেই বেশি বলতে পারতাম। ওসব বক্তৃতার পুরোটা জুড়েই থাকতো প্রতিপক্ষ রাজনীতিক দলের নিন্দা। নিন্দাযোগ্য নিন্দা নয়, বলার জন্য নিন্দা আমাকে উদ্ভাবন করতে হতো। লক্ষ্য ছিলো, যে-করেই হোক নিজ দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল রাখতে হবে। এ কাজে রাজনীতিক কর্মীদের প্রধান অস্ত্র গলা। আমি আমার গলাকে ব্যবহার করেছিলাম। প্রতিপক্ষ দলের কর্মীরাও তাই করতো। গলার সর্বোচ্চ ব্যবহার তারা নিশ্চিত করতো। তবে এতো মামলাবাজি তখন ছিলো না। কথা বলার জন্য কেউ মামলার আসামি হয়েছে, এরকমটি মনে পড়ে না।

একদিন একটি লেখা পড়ে নিজের সম্পর্কে আমার ধারণা পাল্টে গেলো। মনকে জিগ্যেস করলাম, বক্তৃতায় যাদের প্রশংসা করছি, তারা কি আসলে প্রশংসার যোগ্য? যাদের নিন্দা করছি, তারা কি সত্যিই নিন্দনীয়? না কি আমাকে কেউ ব্যবহার করছে, বিশেষ কোনো মতলবে? বড়ো হয়ে আমি কী হতে চাই? যদি প্রতিপক্ষ দলের কেউ আমাকে খুন করে, তাহলে আমার পরিবার কি তার উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পাবে? আমি কি সমাজে ভালোবাসা বাড়াচ্ছি? নাকি শক্তিমান কেউ আমাকে দিয়ে চাষাবাদ করাচ্ছে ঘৃণার? আমি যা করছি, তাতে আমার প্রাপ্তি কী? যাদের পেছনে ছুটছি, তারা কি আমার চেয়ে অধিক সৃষ্টিশীল প্রাণী?

লেখাটি পড়ার পর আমি আর কোনোদিন কোনো গলাবাজি কর্মকাণ্ডে অংশ নিইনি। লেখার শক্তি কেমন, তা এ ঘটনা থেকে অনুমান করা যেতে পারে।

১৪.

গোঁড়ামি তখনই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে, যখন এর সাথে ক্ষমতার সঙ্গম ঘটে ক্ষমতাহীন গোঁড়ামি মূলত গোঁয়ার্তুমি, যা তেমন ক্ষতিকর নয়। তবে ক্ষমতা বলতে শুধু রাজনীতিক বা সামরিক ক্ষমতা বুঝলে চলবে না। মানুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষমতাও এখানে সমান গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে আমি একটু ম্যাকিয়াভেলির কথা বলতে চাই। ম্যাকিয়াভেলি যে-রাজার কথা বলতেন, তিনি ছিলেন গোঁড়া রাজা। ম্যাকিয়াভেলি ‘দ্য প্রিন্স’-এ রাজাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন: ‘A pr।nce never lacks leg।t।mate reasons to break h।s prom।se.’

কথাটিকে আমার কৌতুক বলেই মনে হয়, কারণ রাজা গোঁড়া হলে ওয়াদা ভঙ্গ করার জন্য তার কোনো আইনসিদ্ধ কারণ লাগার কথা নয়। রাজা নিজেই বৈধ-অবৈধ সকল কারণের উৎস। তিনি যদি বলেন, যাদের রাজ-আনুকূল্য নেই তারা ভোট দিতে পারবেন না, তাহলে তা বৈধ। যদি বলেন, রাজা নির্বাচনে ভোটাভুটির প্রয়োজন নেই, তাহলে তাও বৈধ।

ধরা যাক, রাজা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন: “খুনের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।”

এখন রাজা এই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতে চান, কারণ খুনটি তার নিজের লোক করেছে। ম্যাকিয়াভেলির মতে, রাজা এই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ অথবা সংশোধন করতে পারেন কাউকে কোনো কৈফিয়ত না দিয়েই। যদিও ম্যাকিয়াভেলি এসব কথা স্যাটায়ার করে বলেছিলেন, কিন্তু অনেকেই ধরে নেন যে রাজাকে বুঝি সত্যি সত্যি এসব পরামর্শ দেয়া হয়েছিলো। মূলত রাজাদের খামখেয়ালিকে আঘাত করতেই বইটি তিনি এভাবে লিখেছিলেন।

যদি আমি গোঁড়া হতাম, আর ম্যাকিয়াভেলির রাজা আমাকে তাঁর উপদেষ্টা নিয়োগ করতেন, তাহলে প্রতিশ্রুতি ভাঙার জন্য রাজাকে নিম্নরূপ পরামর্শ দিতাম:

(ক) খুন করা অপরাধ হলেও আত্মরক্ষার্থে খুন করা অপরাধ নয়। কেউ আত্মরক্ষার্থে খুন করলে তাকে খুনি বলা যাবে না। রাজার আত্মীয় আত্মরক্ষার্থে খুন করেছেন। সুতরাং রাজা তাকে শাস্তি দিতে পারেন না।

এটি একটি সংশোধিত নতুন প্রতিশ্রুতি। এর আইনি মূল্যও ভালো। আধুনিক সকল রাষ্ট্রেই আত্মরক্ষার্থে গুলি ও ছুরি চালানো বৈধ।

(খ) রাজা যখন ‘খুনের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড’ ঘোষণা করেছিলেন, তখনকার পরিস্থিতি আর এখনকার পরিস্থিতি এক নয়। চারদিকে চোর- ডাকাতের উপদ্রব বেড়েছে। তাই আজ থেকে রাজকর্মচারীরা প্রজা ও রাজ্যের মঙ্গলের স্বার্থে যে কাউকে খুন করতে পারবে।

এটিও একটি সংশোধিত নতুন প্রতিশ্রুতি, যার মাধ্যমে রাজা ভবিষ্যতে কাউকে খুন করার জন্য কিছু ফোঁকর তৈরি করলেন। এ ফোঁকরের নাম কোনো দেশে ক্রসফায়ার, কোনো দেশে বন্দুকযুদ্ধ।

তবে ম্যাকিয়াভেলির রাজা যদি গোঁড়া না হয়ে উদার ও গণতান্ত্রিক হন, তাহলে উপরের দুটি সিদ্ধান্ত, আমার পরামর্শে না নিয়ে অন্যভাবে নেবেন। নিজের কণ্ঠের ওপর ভরসা না করে তিনি ভরসা করবেন নাগরিক কণ্ঠের ওপর। দেখা যাবে, নাগরিকরা প্রথম প্রস্তাবে ‘হ্যাঁ’ ভোট দিলেও দ্বিতীয় প্রস্তাবে ‘না’ ভোট দিয়েছে। গোঁড়াদের এটিই ভয়। গোঁড়ারা ‘না’ শুনতে প্ৰস্তুত নন।

১৫.

গোঁড়াদের সম্মানবোধ প্রচণ্ড। যদি মনে হয় কোথাও তারা পর্যাপ্ত সম্মান পাচ্ছেন না, তাহলে নিজেরাই নিজেদেরকে সম্মানিত করার উদ্যোগ নেন। বাংলাদেশের একটি মন্ত্রণালয়ের সচিব, যিনি আগে আরেকটি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ছিলেন, একবার আমার মুখ থেকে ‘স্যার’ শব্দটি শোনার জন্য অভিনব উদ্যোগ নিয়েছিলেন (যদিও এ উদ্যোগ সফল হয়নি)। শুনেছি পুলিশের এক সাবেক আইজি সম্প্রতি ওই ‘স্যার’-কে কিছু ‘শিক্ষা’ দিয়েছেন। মূলত এরা দুজনই গোঁড়া। নিজেদের সম্মান উঁচুতে রাখতে, অর্থাৎ ধূলিসাৎ করতে, রেষারেষি করছেন একে অন্যের ‘মূর্তি’-র সাথে।

কিছুদিন আগে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে, এক ক্ষমতাধর নেতা দলবল নিয়ে এসেছিলেন বক্তৃতা দিতে। এসে দেখেন ওখানে প্রধান অতিথি করা হয়েছে আরেক ক্ষমতাধরকে। এতে তিনি অপমানিত বোধ করেন, এবং আয়োজকদের দেখে নেয়ার হুমকি দিয়ে অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করেন। খোঁজ নিলে, গোঁড়াদের সম্মানবোধের এরকম লাখ লাখ উদাহরণ চারপাশে পাওয়া যাবে।

একজন গোঁড়াকে আলোকিত করতে যে-পরিমাণ আলো দরকার, তা আমাদের সৌরজগতে উৎপন্ন হয় না বললেই চলে। গোঁড়ারা কৃষ্ণ গহ্বরের মতো। যা কিছু ভালো ও আলো, তার সবকিছু শুষে নিয়ে সারাক্ষণ ফুঁসতে থাকে। তাদের ধারণা, তারা কখনো মরবে না। কিন্তু হকিং বলে গেছেন অন্য কথা। তাঁর মতে, কৃষ্ণ গহ্বরেরও মৃত্যু আছে। তবে হাসান আল বশির ও অমিত শাহ- এঁরা এ কথা মানতে নারাজ। আমেরিকা যদি গোঁড়াদের পাল্লায় পড়তো, তাহলে ওয়াশিংটন ও জেফারসন এতোদিনে ঈশ্বর হয়ে উঠতেন। চার বছর পর পর হোয়াইট হাউসে ঢুকতেন তাঁদের নাতি-পুতিরা।

১৬.

মানুষ সবসময় দুটি ‘জীবন’ যাপন করে। একটি তার প্রকাশ্য সামাজিক জীবন, আরেকটি অপ্রকাশ্য গোপন জীবন। এ গোপন জীবনটির সাথে, মানুষের প্রকাশ্য সামাজিক জীবনের কোনো মিল পাওয়া যায় না। পৃথিবীতে আর কোনো প্রাণী এরকম দ্বৈত জীবনযাপন করে বলে জানা নেই। এর কারণ কী?

এর প্রথম কারণ- লজ্জা। শ্লথ বা পেঁচার লজ্জার সাথে মানুষের লজ্জাকে মেলালে চলবে না। মানুষের লজ্জাবোধ অতো সরল নয়। লজ্জা একটি অভ্যাস, যার উৎপত্তি ভয় থেকে। কোনো শিশু যখন প্রথম পৃথিবীতে আসে, তখন সে বিবস্ত্র থাকে। কিন্তু কিছুদিন পর দেখতে পায় – কয়েকটি অঙ্গে কাপড় না থাকলে বাবা-মা রাগ করেন, এবং রাগ ব্যর্থ হলে উচ্চশব্দে তিরস্কার করেন। যদি শিশুটি এতেও বিষয়টি বুঝতে না পারে, তাহলে বাবা-মা শারীরিক শক্তি প্রয়োগ করে থাকেন।

শিশুটি এ প্রক্রিয়ায় জেনে যায়, শরীরের কোন কোন অংশে কাপড় রাখতে হবে, এবং কোন কোন অংশে কাপড় না পরলেও চলবে। এটি একেক সমাজে একেক রকম। যদি শিশুটি নাইজেরিয়ার কোমা সমাজের হয়, তাহলে শরীরের স্তন ও নিতম্বে কাপড় না রাখলে তার ওপর কেউ রাগ করবে না। কারণ ওই সমাজে বাবা-মা’রা কাপড় পরিধান করেন না। ফলে স্তন ও নিতম্ব দেখে লজ্জা পেতে হবে, বা এগুলোকে গোপন রাখতে হবে- এ ধারণাও শিশুটির মগজে প্রবেশ করে না।

কিন্তু শিশুটি যদি আমেরিকা, ব্রিটেন, বা বাংলাদেশের হয়, তাহলে তাকে কোমা সমাজের অনাবৃত অঙ্গগুলো আবৃত রাখতে হবে। কারণ এ দেশগুলোতে বাবা-মা’রা তাদের স্তন, জননাঙ্গ ও নিতম্ব ঢেকে রাখেন। তবে এটি কেবল মানুষের প্রকাশ্য সামাজিক জীবনেই ঘটে। তার অপ্রকাশ্য গোপন জীবনে এমনটি ঘটে না। আমরা জানি, মানুষ যখন টয়লেটে প্রবেশ করে, তখন সে তার সামাজিক জীবন থেকে মুক্তি লাভ করে (আমি ধরে নিচ্ছি ওই টয়লেটে কোনো ক্যামেরা স্থাপন করা নেই, বা থাকলেও তার অস্তিত্ব সম্পর্কে টয়লেট-ব্যবহারকারী সচেতন নন)।

টয়লেটে একজন মানুষ কী কী করেন, এবং শরীরের কোন কোন অংশ তিনি অনাবৃত রাখেন, তা এখানে খুলে বলার প্রয়োজন বোধ করছি না; কারণ এটি সবাই জানেন। তবে জৈবিক কর্মকাণ্ড ছাড়াও মানুষ টয়লেটে আরো অনেক কিছু করে থাকে। রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ এবং বিশ্বসাহিত্যের অন্তত বিশটি গুরুত্বপূর্ণ বই আমি টয়লেটে পড়ে শেষ করেছি। আমার বহু লেখা টয়লেটে বসা অবস্থায় মাথায় এসেছে। এ জন্য কারও বাড়িতে বেড়াতে যেতে সাহস পাই না। কারণ ওসব বাড়িতে টয়লেটে একটু বেশি সময় কাটালেই কানাকানি শুরু হয়ে যায়- লোকটি এতোক্ষণ ধরে কী করছে?

তবে সবাই যে টয়লেটে গিয়ে বই পড়েন বা দার্শনিক চিন্তা করেন, এমন দাবি আমি করছি না। অনেকেই ওখানে ঢুকে নানা ‘অসামাজিক’ কাজ সম্পাদন করেন। কেউ কেউ আয়নায় এমন এমন স্থান দেখেন, যা প্রকাশ্য সমাজে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখা সম্ভব নয়। রাষ্ট্রপতিরা হয়তো ওখানে গিয়ে একা একা এমন অসভ্য হয়ে ওঠেন, যা বাইরের মানুষ জানলে তোলপাড় হয়ে যাবে।

এ অভ্যাসগুলো মানুষ শৈশবেই আয়ত্ত করে ফেলে। সে বুঝে ফেলে, কী কী করলে সমাজ তাকে কিছু বলবে না, এবং কী কী করলে নেমে আসবে তিরস্কারের খড়গ। যে-কাজগুলো পরিবার ও সমাজে গৃহীত হয় না, ওই কাজগুলো সে প্রকাশ্যে করতে লজ্জা পায়। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে সে এ কাজগুলো করে না। কাজগুলো সে নিয়মিতই করে, তবে গোপনে করে। ব্যতিক্রম থাকতে পারে, যা এখানে ধর্তব্য নয়।

কোনো দেশ পর্নো সাইট বন্ধ করেছে, তার মানে এই নয় যে দেশটির মন্ত্রীরা গোপনে ভিপিএনযোগে পর্নো সাইটে প্রবেশ করছেন না। কেউ প্রকাশ্য সমাজে উলঙ্গপনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন, এর মানে এই নয় যে তিনি গোপন জীবনে নগ্নতা উপভোগ করেন না। কেউ টেলিভিশন ও পত্রিকায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলছেন, এটি নিশ্চয়তা দেয় না যে তিনি গোপন জীবনে দুর্নীতি করছেন না। কেউ ফেসবুকে জোব্বা পরে ছবি দিয়েছেন, তার অর্থ এই নয় যে তার কোনো জাঙ্গিয়া পরা ছবি নেই। কেউ সত্যবাদিতার প্রশংসা করছেন, কিন্তু গোপনে মিথ্যে কথা বলছেন না, এটি নিশ্চিত করে বলা যায় না।

একটি মেয়ে আমাকে জানিয়েছে, সহকর্মীদের কাছে তার বাবা খুব হৃদয়বান মানুষ। কিন্তু পারিবারিক জীবনে তিনি নিষ্ঠুর। প্রায়ই স্ত্রীকে বেদম প্রহার করেন। প্রহার শেষে স্ত্রীর শাড়ি খুলে ফেলেন, এবং বস্ত্রহীন অবস্থায় তাকে তার বাবার বাড়ি চলে যেতে বলেন। চিৎকার করতে থাকেন- এ শাড়ি আমার টাকায় কেনা। এ শাড়ি পরে তুই বের হতে পারবি না।

কিছুদিন আগে আমার পরিচিত এক ইমাম, মসজিদের পাশের বাড়িতে পছন্দের নারীর সাথে সঙ্গমরত অবস্থায় আটক হয়েছিলেন। ওই নারীর স্বামী বিদেশে থাকেন। গ্রামের মুরব্বিরা গিয়ে ইমাম সাহেবকে উদ্ধার করেন। মুরব্বিদের একজন ছিলেন আমার বাবা। অথচ প্রকাশ্য সমাজে এ ইমাম জেনা-ব্যভিচারের বিরুদ্ধে কথা বলতেন। নারীরা যেন পর্দা করে, পর-পুরুষ থেকে নিজেদেরকে যেন আড়ালে রাখে, এসব বিষয়ে খুতবায় উপদেশ দিতেন। প্রেম ও বেপর্দা মেলামেশার ব্যাপারে উঁচু স্বরে ওয়াজ করতেন। অর্থাৎ ইমাম সাহেবের প্রকাশ্য জীবনের সাথে গোপন জীবনের কোনো মিল এখানে পাওয়া যাচ্ছে না।

ভিকারুন্নেসার পরিমলের গুপ্ত জীবন যখন প্রকাশ হয়ে পড়েছিলো, তখন চারদিকে রি-রি ধ্বনি উঠলেও, তার আগ পর্যন্ত পরিমলের জীবন নিয়ে সমাজের কোনো আপত্তি ছিলো না। এর কারণ- তিনি ধর্ষক, বা অল্পবয়স্কা ছাত্রীদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে তিনি শয্যায় নিতেন- এ গোপন জীবনের সাথে বাংলাদেশের প্রকাশ্য সমাজের কোনো যোগাযোগ ছিলো না।

এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরী। আমি এমন অনেক মানুষ পেয়েছি, যাদের প্রকাশ্য সামাজিক জীবন নিন্দনীয়, কিন্তু তাদের গোপন জীবনের কর্মকাণ্ড প্রশংসনীয়। ‘প্রশংসনীয়’ শব্দটি এখানে কোনো কাজ সামাজিক মানদণ্ডে গৃহীত কি না, সে অর্থে ব্যবহার করছি। যেমন- হিন্দু সমাজে উলুধ্বনি দেয়া প্রশংসনীয় হলেও মুসলমান সমাজে তা নিন্দনীয়। আবার কোনো হিন্দু যদি মন্দিরে গিয়ে নামাজ পড়া শুরু করে, তাহলে তা হিন্দু সমাজে প্রশংসনীয় বলে বিবেচিত হবে না।

আমার এলাকায় এক ব্যক্তির পরিচিতি ছিলো ‘গরুচোর’ হিশেবে। ‘আমি চোর’, এ কথা সমাজে তিনি প্রকাশ্যেই বলে বেড়াতেন। এতে সমাজ কোনো উচ্চবাচ্য করতো না। কিন্তু তিনি যে গোপনে নামাজ পড়তেন, এ কথা কাউকে বলতে পারতেন না। কারণড় মুসলিম সমাজে ‘নামাজ’ খুব গ্রহণযোগ্য কাজ হলেও, একজন চোর নামাজ পড়ছে, এটি আরামের কথা নয়। ফলে ওই ব্যক্তি লজ্জায় মসজিদে যেতেন না। এখান থেকে ধারণা পাওয়া যায়, কোনো কাজ করতে কেউ লজ্জা পাবে কি না, এটি মূলত তার সমাজ দ্বারাই নির্ধারিত হয়।

আমরা ফেসবুকে কখনো ‘আমি এই মুহূর্তে বায়ুত্যাগ করছি / ঘুষ গ্রহণ করছি / পর্নো ক্লিপ দেখছি’- এরকম স্ট্যাটাস কাউকে দিতে দেখি না। তাই বলে কি এসব ঘটছে না? ঘটছে, কিন্তু এগুলো মানুষের গোপন জীবনের অংশ বলে প্রকাশ্যে আসছে না। মামুনুল হক সাহেব (এবং আরো অনেক মাওলানা) তাদের ওয়াজে সবকিছু বলেন, কিন্তু তারা যে ঘরে সুস্থ-সবল স্ত্রী থাকার পরও লুকিয়ে একাধিক বিয়ে করে রেখেছেন, সে বিষয়টি ভুলেও বলেন না। কারণ তারা জানেন, তাদের এ কাজ অমুসলিম সমাজ তো বটেই, মুসলিম সমাজেও নিন্দনীয়। তবে মানুষ কোনো উপায়ে জেনে গেলে, তখন ধর্মের সুবিধাজনক ব্যাখ্যা দিয়ে তারা এটিকে প্রশংসনীয় করে তোলার চেষ্টা করেন। আমি বলছি না একাধিক বিয়ে করা কোনো অপরাধ, কিন্তু সমাজভেদে এটি যে নিন্দনীয় বা প্রশংসনীয় হতে পারে, এবং প্রয়োজন অনুযায়ী মানুষ এগুলো গোপন করতে পারে, তা বুঝানোর জন্যই উদাহরণটি টানলাম।

মানুষের গোপন জীবনযাপনের দ্বিতীয় কারণ নিরাপত্তা-শঙ্কা। ‘নিরাপত্তা’ শব্দটি এখানে একটু বিশেষ অর্থে ব্যবহার করছি। এ বিশেষ অর্থটি বুঝতে হলে, মানুষ কী কী বিষয়ে নিরাপত্তা সংকটে ভোগে, তা আগে জানতে হবে। এ প্রসঙ্গে আমি বেন্থামের কাছে যেতে চাই। বেন্থামের ইউটিলিটারিয়ান দর্শন ব্যবহার করে বলতে পারি- যা ঘটলে কোনো মানুষের সুখ কমে, তা ওই মানুষের জন্য নিরাপত্তা-শঙ্কা।

মানুষ যদি হিসেব করে দেখে যে, কোনো কথা প্রকাশ্যে বললে, বা কোনো কাজ প্রকাশ্যে করলে, তার সুখ কমতে পারে, তাহলে সে তা গোপনে করার চেষ্টা করবে। এ সুখ ব্যক্তিগত হতে পারে, পারিবারিক হতে পারে, এমনকি সামাজিকও হতে পারে।

তবে শুধু মানুষ নয়, আধুনিক রাষ্ট্রগুলোও এ রূপ আচরণ করে থাকে। সিআইএ বা কেজিবির ক্লান্ডেস্টাইন অপারেশনগুলোর কথা সমাজ জানতে পারে না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট যখন হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন, তখন হৃদয়ের সব কথা তিনি বলে ফেলেন না। অনেক সত্য গোপন রাখেন। এর কারণ, তিনি হিসাব করে দেখেন যে- কিছু কথা তার রাজনীতিক, পারিবারিক, ও ব্যক্তিগত সুখ নষ্ট করতে পারে। আবার কিছু কথা যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের সুখ কমাতে পারে। ক্লাসিফায়েড বা গোপনীয় তথ্য প্রকাশ হয়ে পড়লে- রাশিয়া, চীন, বা অন্য অ্যাডভার্সারি দেশগুলো তার সুযোগ নিতে পারে। বাংলাদেশের সরকারগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়। তারাও বহু বিষয়ে গোপনীয়তার নীতি অবলম্বন করে থাকে।

তবে এর সবই যে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাবিষয়ক গোপনীয়তা, তা মনে করি না। বহু রাষ্ট্র, গণরোষ সামাল দিতে সত্য গোপন করার নীতি অবলম্বন করে থাকে। সিবিএস যদি ওই ছবিগুলো প্রকাশ না করতো, তাহলে আমরা জানতাম না- আবু গারিব কারাগারে মার্কিন সেনা ও সিআইএ সদস্যরা গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটিয়েছে।

‘চুরি’ মানুষ গোপনে করে কেন? কারণ যিনি চুরি করেন, তিনি জানেন যে, কেউ এটি দেখে ফেললে সম্ভাব্য চারটি ঘটনা ঘটতে পারে:

(ক) গণপিটুনি খাওয়া,

(খ) পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া,

(গ) গণপিটুনি ও গ্রেপ্তার- দুটিরই শিকার হওয়া; এবং

(ঘ) সমাজে নিন্দিত হওয়া।

চারটি সম্ভাবনার প্রতিটিই চোরের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, ও সামাজিক সুখ কমাতে পারে। এ জন্য চারটিকেই আমি চোরের জন্য নিরাপত্তা-শঙ্কা বলবো। একই কথা যিনি ঘুষ খান বা দুর্নীতি করেন, তার বেলায়ও প্রযোজ্য।

কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, ছিনতাই ও ডাকাতি, এ কাজগুলো তো প্রকাশ্যে হয়, এটিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

দেখুন, ‘প্রকাশ্য’ শব্দটিকে সাধারণ মানুষ যে-অর্থে বোঝে, সে-অর্থে একজন দার্শনিক বুঝেন না। দার্শনিককে সবকিছুই খুব সন্দেহের চোখে দেখতে হয়, এবং যেকোনো শব্দ ও বাক্য, তাঁকে খুব সাবধানে আমলে নিতে হয়। ছিনতাই সংগঠিত হওয়ার সময় ছিনতাইকারীকে যদি কেউ চিনতে না পারে, এবং ছিনতাইকারীর পালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা যদি দর্শকদের পাকড়াও করার ক্ষমতা থেকে বেশি হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে যে ছিনতাইটি গোপনে সংঘটিত হয়েছে, প্রকাশ্যে নয়। এ কথা ডাকাতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

এ জন্য কোনো কিছু দিবালোকে সংঘটিত হওয়া মানেই তা প্রকাশ্যে সংঘটিত হওয়া নয়। ২০১৩ সালে জিম্বাবুয়েতে দিবালোকে ভোট ছিনতাই হলেও এটিকে আমি প্রকাশ্য ভোট ছিনতাই বলতে রাজি নই। কারণ মুগাবের পক্ষে যারা ভোট ছিনতাইয়ে অংশ নিয়েছিলেন, তাদের ক্ষমতা, জনগণের ক্ষমতার চেয়ে বেশি ছিলো। তাদেরকে জনগণ চিনতে পেরেছে, কিন্তু পাকড়াও করতে পারেনি। এই পাকড়াও করার ক্ষমতা না থাকার কারণে, দিবালোকের ভোট চুরিকেও গোপন ঘটনা বলতে হবে। তবে গোপন ঘটনাকেও প্রকাশ্য ঘটনায় রূপ দেয়া যায়, যা এখানে আমার আলোচ্য বিষয় নয়।

নিরাপত্তা-শঙ্কার আরেকটি রূপ হলো আইনের আগ্রাসন। কোনো রাষ্ট্রে আইনও আগ্রাসী হয়ে উঠতে পারে, যা মানুষকে ঠেলে দিতে পারে গোপন জীবনের দিকে। অনেক রাষ্ট্র পেয়েছি, যেখানে বহু সাধারণ কাজ আইন দ্বারা নিষিদ্ধ। কিন্তু মানুষ প্রাকৃতিকভাবেই এ কাজগুলো না করে থাকতে পারে না। তখন সে বাধ্য হয়ে এগুলো গোপনে করতে শুরু করে। কোনো কার্টুনশিল্পীকে যদি আইন দ্বারা স্বাধীনভাবে কার্টুন আঁকতে বাধা দেওয়া হয়, তখন ওই শিল্পী গোপন জীবন বেছে নিতে বাধ্য।

খুন, ধর্ষণ, এসবকে অপরাধ হিশেবে বিবেচনা করতে কোনো সমাজেই তেমন কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু এর বাইরে বহু কাজ আছে, যেগুলোকে অনেক দেশে আইন দ্বারা ‘অপরাধ’ হিশেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। অথচ প্রকৃত অর্থে সেগুলো অপরাধ নয়। জুরিসপ্রুডেন্সের কোনো মানদণ্ডেই এগুলোকে অপরাধ বলা যায় না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই নাগরিকরাও এসবকে অপরাধ হিশেবে মেনে নেন না। আমি এ অপরাধগুলোর নাম দিয়েছি ‘ইমাজিনারি ক্রাইম’ বা ‘কাল্পনিক অপরাধ’। এই মুহূর্তে পৃথিবীর অনেক দেশে ইমাজিনারি ক্রাইমের অস্তিত্ব রয়েছে। সভ্যতার অগ্রযাত্রার পথে এটি একটি বড়ো বাধা। অপরাধ যদি পলিটিক্যাল ইনভেনশন হয়ে ওঠে, তাহলে রাষ্ট্র টেকসই হয় না।

এ জন্য কোনো দেশ সভ্য কি না, এটি বুঝতে আমি দুটি জিনিস খেয়াল করি। এক. দেশটিতে ইমাজিনারি ক্রাইমের অস্তিত্ব আছে কি না। দুই. দেশটির মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহার করে কি না।

যে-সমাজে আইনের সংখ্যা বেশি, সে-সমাজে অপরাধও বেশি। কোনো সমাজে বেশি আইন থাকা ভালো নয়। আইনের সংখ্যা হতে হবে খুব অল্প। কোনো জিনিস সংখ্যায় বেশি হয়ে গেলে, তা এমনিতেই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। সংখ্যায় বেশি হওয়ার কারণে কাককে আমরা কেউ পাখি ডাকি না।

১৭.

সফলতা কী? এ প্রশ্ন জীববিজ্ঞানকে করলে সে উত্তর দেবে টিকে থাকাই সফলতা। যে-প্রাণী টেকসই বাচ্চা উৎপাদন করতে পারে, জীববিজ্ঞানের চোখে সে প্রাণীই সফল প্রাণী। মানুষের বাচ্চা কি টেকসই? সম্ভবত না। ইঁদুর ও তেলাপোকার মতো টেকসই বাচ্চা মানুষ জন্ম দিতে পারে না। মানুষের বাচ্চার চেয়ে গরুর বাচ্চা অধিক টেকসই ও পরিণত। গরুর বাছুর জন্মের পরপরই লাফ দিতে পারে, কিন্তু মানুষের বাচ্চা তা পারে না। এর কারণ, মানবশিশু ভূমিষ্ঠ হয় অপরিণত বয়সে।

যদি শিশুটি দশ মাসের বদলে তিরিশ মাস পেটে থাকতো, তাহলে মানুষের বাচ্চাও জন্মের পরপর গরুর বাচ্চার মতো লাফ দিতে পারতো। কিন্তু এমনটি ঘটে না, কারণ মানুষের যোনীপথের যে-আকার, তা দিয়ে তিরিশ মাসের পরিণত বাচ্চা বের হতে গেলে যে-যন্ত্রণার সৃষ্টি হতো, তা সহ্য করে মা ও শিশু উভয়ের পক্ষেই বাঁচা কঠিন হতো। এ জন্য মানুষ সফলতার এ ধারণার সাথে একমত পোষণ করে না, কারণ শুধু টিকে থাকা মানুষের লক্ষ্য নয়।

মানুষের লক্ষ্য কী, তা বুঝতে আমি একটু পান্ডার কাছে যেতে চাই।

পান্ডার পাকস্থলী ছোটো। পান্ডা যা খায় তা পুরোপুরি হজম হওয়ার আগেই কোলন দিয়ে বেরিয়ে যায়। এ জন্য পান্ডা তার দিনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করে খাবার চিবুনোতে। বেইজিংয়ে যখন প্রথম পান্ডা দেখতে যাই, তখন তার মুখে ছিলো একটি কচি বাঁশের মুগুর। পান্ডার লক্ষ্য হলো, কম সময়ে বেশি বাঁশ খাওয়া। এটিই পান্ডাকে টিকিয়ে রেখেছে। পান্ডাকে যদি জিগ্যেস করা হয়- দিনটি সফলভাবে কেটেছে কি না? তাহলে সে উত্তর দেবে- হ্যাঁ, দিনটি সফলভাবে কেটেছে; কারণ, সারাদিনে আমি পর্যাপ্ত বাঁশ খেতে পেরেছি। কিন্তু সে যদি বাঁশের অভাবে পতিত হয়, তাহলে বলবে, দিনটি খুব ব্যর্থভাবে কেটেছে

পান্ডা কী চায়? পান্ডার জীবনযাপনের দিকে যদি তাকাই, তাহলে দেখতে পাবো- পান্ডা ভবন নির্মাণ করে না, গাড়িতে চড়ে না, তেল কেনে না, কাউকে বিদ্যুৎ বিল দেয় না। প্রচুর বাঁশ, কিছু জল আর সামান্য ঘুমোনোর জায়গা পেলেই সে তৃপ্ত থাকে। তার কোনো পুরোহিত নেই, মন্দির নেই, খুব আয়োজন করে তাকে বিয়ে করতে হয় না। পান্ডা সংসার শুরু করতে পারে মুহূর্তেই। তাকে ওয়েডিং প্ল্যানার ভাড়া করতে হয় না, ছবি তুলতে হয় না, ভিডিও ধারণ করতে হয় না, ফুলশয্যার নামে নষ্ট করতে হয় না অনেক ফুল।

তার কোনো বাবুর্চি নেই, ডাইনিং রুম নেই, রান্নাঘর নেই, এয়ারকন্ডিশন নেই। বাচ্চার নাম রাখতে তাকে আকিকা করতে হয় না, মিলাদ পড়াতে হয় না। তার কোনো ধানক্ষেত নেই, গার্মেন্টস নেই, কারখানায় তাকে খাটতে হয় না উদয়াস্ত। তাকে ভোটে দাঁড়াতে হয় না, সংসদে যেতে হয় না, সে প্রয়োজন বোধ করে না বন্দুকের। তার আবাসভূমি থাকলেও কোনো রাজ্য বা রাষ্ট্র নেই, রাজা ও প্রজা নেই।

এক পান্ডা অধীনস্ত নয় অন্য পান্ডার। তাদের কোনো শহর ও গ্রাম নেই, কার্বন নিঃসরণ নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন নয়। এ জন্য তাদের কোনো গ্রেটা থুনবার্গ, জাতিসংঘ, ও প্যারিস এগ্রিমেন্টের প্রয়োজন পড়ে না। টাকা ও ব্যাংকের অভাব তারা অনুভব করে না। মুক্তির জন্য তাদের কোনো জর্জ ওয়াশিংটন বা নেলসন ম্যান্ডেলা লাগে না। তারা দাস নয় একে অন্যের। তাদের কোনো সংবিধান ও জয়নুল আবেদিন বেন আলি নেই। তারা অ্যালকোহল পান করে না, ধূমপান করে না, তাদের একমাত্র লক্ষ্য বাঁশ খাওয়া। কিন্তু বাঁশ খেতে গিয়ে তারা কখনো বাঁশ নির্মূল করে না। তারা খায় ঠিক ততোটুকু, যতোটুকু না খেলে তারা টিকবে না।

পান্ডার এ জীবনযাপনের একটি ব্যাখ্যা হলো- তার বুদ্ধি কম। তার মগজ ছোটো।

কিন্তু মানুষ পান্ডার মতো নয় (আমি আগেই বলেছি, শুধু টিকে থাকা মানুষের লক্ষ্য নয়)। মানুষের মগজের ওজন প্রায় দেড় কেজি, যা আকারে পান্ডার মগজের চেয়ে অনেক বড়ো। বড়ো মগজের সাথে সম্পর্ক আছে বড়ো চালাকি, বড়ো হিংসা, বড়ো লোভ, বড়ো ভয়, বড়ো আকাঙ্ক্ষা, বড়ো ধ্বংস, ও বড়ো ক্ষমতার। শুধু টিকে থাকার জন্য মানুষের এতো বড়ো মগজ দরকার ছিলো না। বড়ো মগজ জন্ম দেয় বড়ো আলস্যের

মানুষ যাপন করতে চায় অলস জীবন। ছুটি পেলে মানুষ পাগল হয়ে যায়, এর কারণ আলস্য। অলসতা কখনো একা আসে না। বন্যার পানির মতো এটি সাথে করে অনেক কিছু নিয়ে আসে। অলসতা কী? অলসতা হলো ক্লান্তি থেকে পালানোর ইচ্ছা। পান্ডা অলস নয়, কারণ পান্ডা ক্লান্ত নয়। পান্ডা প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো কাজ করে না।

কিন্তু মানুষ সারাক্ষণ ক্লান্ত থাকে। সে কাজ করে খুব সামান্যই, যদিও তার অকাজের পরিমাণ অসামান্য। তার অধিকাংশ কাজ অদরকারি কাজ। সে ক্লান্তি কাটাতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে আরো বেশি করে। যদিও তার লক্ষ্য থাকে অলস, অর্থাৎ আরামে থাকা, কিন্তু এ লক্ষ্য তার ভেতর একটি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। সে খুঁজতে থাকে তার চেয়ে অধিক আরামে কেউ আছে কি না, তা।

কাকে বলে আরাম? আরাম হলো সুখের অনুভূতি। সুখে থাকাই আরামে থাকা। সুখের অনুভবই আরামের অনুভব। প্রাচীন গ্রিসে, যেমন এপিকিউরাস, বলতেন- দেবতাদের পূজা করা অর্থহীন। মৃত্যুর পর আর কোনো জগৎ নেই। এ জীবনই শেষ জীবন। সব সুখ এ জীবনেই অন্বেষণ করা উচিত। এপিকিউরাসের এ বক্তব্য অনেকেই প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তবে আধুনিক যুগে, আমার ধারণা, এপিকিউরাস আবার প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন। অসুখী মানুষজন সুখের অন্বেষণে পাগল হয়ে উঠেছে।

আমেরিকার সংবিধানে একটি অদ্ভুত মৌলিক অধিকারের কথা বলা আছে। অধিকারটি হলো- সুখের সন্ধান করার অধিকার। পৃথিবীর আর কোনো দেশের সংবিধানে এ ধরনের অধিকার আগে ছিলো না। জেফারসন যে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন, তা এ অভিনব অধিকারের উল্লেখ থেকে আমি নিশ্চিত হতে পারি। জেফারসনের মূল খসড়া থেকে জুলিয়ান বয়ড যে-পাণ্ডুলিপিটি প্রস্তত করেছিলেন, সেখানে লাইনগুলো রয়েছে এরকম:

“We hold these truths to be sacred & unden।able: that all men are created equal &।ndependant, that from that equal creat।on they der।ve r।ghts।nherent &।nal।enable, among wh।ch are the preservat।on of l।fe, & l।berty, & the pursu।t of happ।ness… .

এই ‘পারসুইট অব হ্যাপিনেস’ দ্বারা জেফারসন স্পষ্ট করেছেন যে, শুধু জীবন ও স্বাধীনতার অধিকার নয়, মানুষের আরো একটি জন্মগত অধিকার আছে, যেটির নাম ‘সুখের সন্ধান করার অধিকার’।

জেফারসন কি জানতেন, সুখ সন্ধানের অধিকারই সফল হওয়ার অধিকার? বেন্থাম বলতেন- রাষ্ট্র, ব্যবসা ও বিজ্ঞানের একমাত্র কাজ হওয়া উচিত বিশ্বে সুখ বাড়ানো।

সুখ ঠিকই বেড়েছে, তবে তা মানুষের নয়। মানুষের সুখ কেড়ে নিয়ে বাড়ানো হয়েছে রাষ্ট্র ও ব্যাংকের সুখ। রাষ্ট্র তার সুখ ও সফলতা নির্ধারণ করছে মিলিটারি শক্তি ও জিডিপি দ্বারা। মানুষ সুখে আছে কি না, তা আর এখন বিচার্য বিষয় নয়। সকল ব্যাধির মতো রাষ্ট্রের এ রোগও দ্রুত বিস্তার লাভ করেছে মানুষের মাঝে। মানুষও তার সফলতা মাপছে মোট অর্জিত সম্পত্তি দ্বারা। জমি-জমা ও ব্যাংক হিসাব নিয়ে সমাজ যতোটা উদ্বিগ্ন, স্বাস্থ্য নিয়ে ততোটা উদ্বিগ্ন নয়। সম্পত্তি কি সুখ নিশ্চিত করতে পারে? পারে। একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত টাকা মানুষের আরাম-আয়েশ নিশ্চিত করে। তবে ধানের বোঝার মতো টাকারও বোঝা আছে। বোঝার ধর্ম হলো- তার আকার যতো বাড়বে, ওজনে ততো ভারী হবে। অল্প টাকা যতো সহজে বহন করা যায়, বেশি টাকা ততো সহজে বহন করা যায় না। কিছু কিছু দেশে, যেমন বাংলাদেশে, ব্যাংকশাখায় ঢুকলে একটি নোটিশ পাওয়া যায় এরকম-

“এক লক্ষের অধিক টাকা পরিবহনে পুলিশের সহায়তা নিন”

নোটিশটি কী নির্দেশ করে? এটি টাকা উত্তোলনকারীর মনে একধরনের ভীতি সঞ্চার করে। এটি দিয়ে বুঝানো হয়- টাকা বহন করা নিরাপদ নয়। যেকোনো সময় আপনার টাকা ছিনিয়ে নেয়া হতে পারে। এটি আরও বার্তা দেয়- টাকা রাখতে হবে খুব সাবধানে, টাকার জন্য ওত পেতে আছেন অনেকে। কিন্তু যে-বার্তাটি আমরা বুঝি না, তা হলো, অধিক সম্পদ সুখ নষ্ট করে। সম্পদের পরিমাণ যতো বেশি হবে, তার পাহারায় ততো বেশি সময় ও শ্রম ব্যয় হবে। সম্পদের পাহারায় যে-সম্পদ খরচ হয়, তার পুরোটিই অপচয়। আমি অনেককে ব্যাংক থেকে বেশি টাকা তুলে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বের হতে দেখেছি।

কিন্তু এ কম্পনটি পাওয়ার জন্য তারা গিয়েছে অবর্ণনীয় কষ্টের ভেতর দিয়ে। ভয়ের এ কাঁপুনিকেই তারা জ্ঞান করছে সফলতা। কারণ এটি তাদেরকে কিছু সুখের অনুভূতি এনে দিয়েছে। তারা টের পেয়েছে, টাকার বান্ডিলটি নেওয়ার সময় অনেকেই তাদের দিকে ঈর্ষার চোখে তাকিয়েছে।

ঈর্ষা অর্জন একটি গুরুতর সাফল্য। মানুষ নিজে অন্যকে ঈর্ষা করতে পছন্দ করে, এবং সেও চায় অন্যরা তাকে ঈর্ষা করুক। তলস্তয় কি চাইতেন না তাঁর লেখা পড়ে অন্য লেখকরা তাঁকে ঈর্ষা করুক? সৃষ্টিশীল মানুষরা ঈর্ষার সুখ ভালোই উপভোগ করেন মনে হয়। মানুষ বিলাসবহুল গাড়ি কিনে কেন? কারণ সে চায়, গাড়িটি দেখে অন্যরা তাকে ঈর্ষা করুক। বাংলাদেশে বিসিএসের জনপ্রিয়তার পেছনেও ঈর্ষার হাত রয়েছে। মানুষ টের পেয়েছে, বিসিএস কর্মচারীদের সমাজে ঈর্ষা করা হয়। এ জন্য তারাও চায়, ঈর্ষার সুখ উপভোগ করতে।

শুধু বিসিএস নয়, আরও অনেক পেশার ক্ষেত্রে এটি সত্য। একজন লেখকও ঈর্ষা অর্জনের জন্যই লিখেন। তিনি চান, তার লেখা ও চিন্তার আঘাত খেয়ে মানুষ তাকে ঈর্ষা করুক। একজন গবেষক চান, তার গবেষণাপত্রগুলো ভালো ইমপ্যাক্ট-ফ্যাক্টরসম্পন্ন জার্নালে প্রকাশিত হোক। এর কারণ কী? কোনো গবেষণাপত্র যদি ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে, বা স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, তাহলে কি এর বিষয়বস্তর গুরুত্ব কমে যায়? যায় না। কিন্তু ঈর্ষার সুখ অনুভব করার জন্য আমরা চাই আমাদের গবেষণাপত্র ভালো জার্নালে প্রকাশিত হোক। কারণ ভালো জার্নালের আছে ভালো শ্রোতা। স্থানীয় পত্রিকার বাজে পাঠকের প্রশংসা পাওয়া কোনো গবেষকের লক্ষ্য নয়। তার লক্ষ্য, তার মাপের, বা তার চেয়ে বড়ো মাপের গবেষকের প্রশংসা আদায় করা। এ প্রশংসা ঈর্ষার সুখ প্রাপ্তি নিশ্চিত করে। হ্যাঁ, ভালো জার্নালে গবেষণা প্রকাশের অন্য কারণও আছে, তবে তা এখানে আলোচ্য বিষয় নয়।

ঈর্ষা না থাকলে সভ্যতার গতি ধীর হয়ে থাকতো। সভ্যতার বিকাশ ও ধ্বংসে ঈর্ষার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। সোভিয়েত-আমেরিকা স্নায়ুযুদ্ধের মূলে ছিলো ঈর্ষা। চীন-আমেরিকার যে টানাপোড়েন এখন চলছে, তার কারণও ঈর্ষা। রাষ্ট্রপ্রধানরা চান, তাদের দেশকে অন্য দেশগুলো ঈর্ষা করুক। বিল গেটস যেন আমাজনের গ্রোথ দেখে ঈর্ষায় পুড়ে মরেন, এটি জেফ বেজোস চান।

বাংলাদেশের ওয়াজ-মাহফিলগুলোতে এক মাওলানা যে আরেক মাওলানাকে গালাগালি করেন, এর কারণও ঈর্ষা। কোনো মাওলানা যদি বেশি বেশি দাওয়াত পান, তাহলে তিনি বুঝতে পারেন যে অন্য মাওলানারা তাকে ঈর্ষা করতে শুরু করেছে। ঈর্ষা উপভোগের এ সুখ তিনি ধরে রাখতে চান। মুসলিমরা যে তাদের ধর্মকে শ্রেষ্ঠ ধর্ম বলে, এর কারণও ঈর্ষা। তারা চায়, নিজ ধর্মটিকে অন্য সকল ধর্মের উপরে রাখতে।

বাংলাদেশের বাবা-মা’রা তাদের সন্তানকে বুয়েট-মেডিকেলে পড়াতে মরিয়া কেন? ভালো পড়াশোনা ও জ্ঞান অর্জন করবে বলে? মোটেই না। এর মূল কারণও ঈর্ষা। বাবা-মা’রা জেনে গেছেন, তাদের ছেলেমেয়ে বুয়েট-মেডিকেলে পড়লে প্রতিবেশীদের কাছে মুখ দেখানো সহজ হয়। সন্তান পরীক্ষায় খারাপ করলে, বা নামকরা(!) কোনো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে ব্যর্থ হলে, বাবা-মা সমাজে মুখ দেখাতে পারে না। কারণ আমাদের সমাজে মানুষের সম্মান নির্ধারণের যে-কুসংস্কারটি চালু আছে, তার একমাত্র দাঁড়িপাল্লা বৈষয়িক অর্জন। অবৈষয়িক অর্জনগুলো মূল্যহীন। সুখের চেয়ে সুখের অভিনয় ও কসরত এখানে অধিক মূল্যবান।

আপনি ভেতরে ভেতরে সুখী- এটি এ সমাজে গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো, সুখের প্রদর্শনী কতোটা করতে পারেন, তা। আমি ফেসবুকে লক্ষ করেছি- বিবাহিত যুগলরা দাম্পত্য জীবনের ছবি ঘন-ঘন পোস্ট না করলে ধরে নেওয়া হয় যে তাদের সংসার ভালো যাচ্ছে না।

অনেক বাবা-মা আছেন, যারা সন্তানের বিয়েতে প্রচুর অর্থ খরচ করেন। কেউ কেউ এটি করতে গিয়ে ঋণগ্রস্তও হয়ে পড়েন। তাদের আশঙ্কা, যদি দাওয়াত করে হাজার হাজার মানুষ খাওয়ানো না যায়, তাহলে সমাজ ধরে নেবে তারা অসুখী। তাদের অর্থ-কড়ি নেই। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এরকম— যার টাকা-পয়সা নেই, সে সুখে নেই। হ্যাঁ, সুখে থাকার জন্য টাকা-পয়সার দরকার, তবে তা অতোটা নয়। একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার বেশি মানুষ খরচ করতে পারে না। পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, মানুষ যে- সম্পদ অর্জন করে, তার নব্বই শতাংশই সে ভোগ করতে পারে না। কিন্তু এই অতিরিক্ত সম্পদ অর্জন করতে গিয়ে হারিয়ে ফেলে মূল্যবান স্বাস্থ্য ও সুখ। সে বাঁচে পঞ্চাশ বছর, কিন্তু টাকা উপার্জন করে এক হাজার বছরের।

আমাদের পাশের গ্রামে এক বৃদ্ধ ছিলো, নাম মেছকা। জনাব মেছকার ছিলো কিছু সস্তা জমি, যা একটি মহাসড়ক হওয়ার পর দামি হয়ে ওঠে। জমিগুলো বিক্রি করে তিনি সাত কোটি টাকা পান। এ টাকা একটি ব্যাংকে রাখেন। আমার মনে আছে, লোকটির জীবন কোটিপতি হওয়ার আগে যেমন ছিলো, পরেও তেমনই রয়ে গিয়েছিলো। তিনি জানতেন না টাকা কীভাবে খরচ করতে হয়। তবে মানুষ যখন বলাবলি করতো- মেছকার অ্যাকাউন্টে সাত কোটি টাকা আছে, তখন তিনি তা খুব উপভোগ করতেন।

আমার আরও মনে আছে, এ টাকা জনাব মেছকার লাইফস্টাইলে কোনো পরিবর্তন না আনতে পারলেও বিচার-সালিশে তার ডাক বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিলো।

এ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, মানুষ প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থও উপার্জন করে ঈর্ষা লাভের আশায়। মেছকার জীবনে ওই টাকা কোনো কাজে আসেনি। টাকাগুলোর একটি বড় অংশই তিনি ছুঁয়ে দেখেননি। এ ছিলো শুধুই ব্যাংকে পড়ে থাকা কিছু কাগজ। আমার অনেক কাগজ আছে, এটিই ছিলো মেছকার সুখ। মানুষ তাকে এ কাগজগুলোর জন্যই ঈর্ষা করতো। কাগজকে সম্পদ হিশেবে ভোগ করতে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন।

এ জন্য বলবো, পান্ডার জীবনের লক্ষ্য বাঁশ খাওয়া হলেও, মানুষের জীবনের লক্ষ্য ঈর্ষা অর্জন করা। ওবামা টের পেয়েছিলেন, আইনজীবী পেশায় খুব বেশি ঈর্ষা পাওয়া সম্ভব নয়। ট্রাম্প দেখেছিলেন, এতো বড়ো ব্যবসায়ী হয়েও যথেষ্ট ঈর্ষা কুড়ানো যাচ্ছে না। ফলে একসময়, দুজনেরই জীবনের লক্ষ্য হয়ে উঠেছিলো আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়া। প্রেসিডেন্ট হয়ে অনেকের মাথা খারাপ করে দিয়েছিলেন- এটিই ছিলো তাদের সফলতা।

বিভিন্ন দেশে স্বৈরাচারী নেতারা যে ক্ষমতা ছাড়তে চায় না, এর প্রধান কারণও ঈর্ষা। ঈর্ষার সুখ মাদক গ্রহণের চেয়েও মিষ্টি। পুতিন ও শি ঝিনপিং জানেন যে, আজ ক্ষমতা ছাড়লে কাল তাদের মৃত্যু ঘটবে ‘ঈৰ্ষা” নামক মাদকের অভাবে। খুঁজলে এরকম উদাহরণ আপনারা আরও অনেক পাবেন।

১৮.

আধুনিক রাষ্ট্রগুলোতে ‘পার ক্যাপিটা জিডিপি’ একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকরা যথেষ্ট উৎপাদনশীল কি না, তা এ সূচকটি দিয়ে বুঝা যায়। সিঙ্গাপুরের ‘পার ক্যাপিটা জিডিপি’ ৬৪,০০০ মার্কিন ডলার, এর অর্থ হলো- একজন সিঙ্গাপুরিয়ান নাগরিক বছরে ৬৪,০০০ মার্কিন ডলারের পণ্য ও সেবা উৎপাদন করেন। চেক রিপাবলিকের ‘পার ক্যাপিটা জিডিপি’ ২৩,০০০ মার্কিন ডলার, এর অর্থ হলো- একজন চেকোস্লোভাকিয়ান নাগরিক, একজন সিঙ্গাপুরিয়ানের চেয়ে পণ্য ও সেবা উৎপাদনে বছরে ৪১,০০০ মার্কিন ডলার পিছিয়ে আছে। এ পরিসংখ্যান আমাদেরকে আরও জানায়- সিঙ্গাপুরের অর্থনীতি চেক রিপাবলিকের অর্থনীতির চেয়ে অধিক সফল।

কিন্তু কে অধিক সুখী? একজন সফল সিঙ্গাপুরিয়ান নাকি একজন ব্যর্থ চেকোস্লোভাকিয়ান? একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, সিঙ্গাপুরিয়ানদের চেয়ে চেকোস্লোভাকিয়ানরা অধিক সুখী জীবনযাপন করে। সিঙ্গাপুর ঘুরে আমার নিজেরও এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে। শুধু কাজ আর কাজ। কোনো আনন্দ নেই, উপভোগ নেই। এটি একটি সংকটময় পরিস্থিতি। আমি কি আমার সন্তানকে বলবো, সফল সিঙ্গাপুরিয়ান নয়, সুখী চেকোস্লোভাকিয়ান হও? অথবা সুখী চেকোস্লোভাকিয়ান নয়, সফল সিঙ্গাপুরিয়ান হও?

এখানে আরও একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। ২০১৬ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংখ্যা যে-তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, ইউরোপে প্রতি এক লাখ মানুষে সাড়ে পনেরো জন আত্মহত্যা করে; যা দরিদ্র আফ্রিকার তুলনায় দ্বিগুণ। আফ্রিকাতে এ সংখ্যা প্রতি লাখে সাড়ে সাতজন। পূর্ব মেডিটেরানিয়ান অঞ্চলে, যেমন সিরিয়া, মিসর, বা জর্ডানে, এ সংখ্যা আরো কম। লাখে মাত্র চারজন। আত্মহত্যার অনেক কারণ থাকতে পারে, তবে ‘সুখের অভাব’ যে একটি অন্যতম কারণ, তা অস্বীকার করা যাবে না।

অর্থনীতিক ও বৈষয়িক উন্নতি, যেটিকে আমরা সফলতা বলছি, সেটির সাথে সুখের সমানুপাতিক সম্পর্ক নেই বললেই চলে। ভালো বাসস্থান, ভালো টয়লেট, ভালো খাবার, ভালো পরিবহন, নির্বিঘ্ন বিদ্যুৎ, দ্রুত গতির ইন্টারনেট, দরকারি ইলেকট্রনিঙ্ ও চলনসই পোশাকের চাহিদা যখন মিটে যায়, তখন বৈষয়িক উন্নতির সাথে সুখের আর খুব বেশি সম্পর্ক থাকে না। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত বৈষয়িক উন্নতির সাথে সুখের সমানুপাতিক সম্পর্ক আছে। কিন্তু ওই পর্যায়টি অতিক্রম করার পর বৈষয়িক উন্নতির সাথে সুখের সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে।

সুখ উপভোগের জন্য প্রয়োজন অবসর সময়, আর সফলতা উপভোগের জন্য প্রয়োজন খেটে মরা। শুধু খেটে মরে কেউ সুখী হতে পারে না। অতিরিক্ত খাটা স্বাস্থ্যের জন্যও ভালো নয়। খাটতে হবে ততোটুকু, যতোটুকু দরকারি। বাকি সময়টুকু ব্যয় করতে হবে আনন্দদায়ক কাজে। একবার আমার এক ওয়েবসাইটে তিন মাসে অনেক টাকার টাই সেট বিক্রি হলো। এতে লাভও হলো ভালো। কিন্তু লক্ষ করলাম, এ নব্বই দিনে আমি প্রচণ্ড পরিশ্রম করেছি। বিজ্ঞাপন তৈরি করা, কারখানার সাথে যোগাযোগ রাখা, শিপমেন্ট দেখভাল করা, ওয়েবসাইট আপডেটেড রাখা, কর্মীদের সামলানো, ইত্যাদি করতে গিয়ে কোনো অবসর সময় পাইনি। ফলে ওই উপার্জনের কোনো সুখও উপভোগ করতে পারিনি। এমনকি পরিবারকেও সময় দেয়া সম্ভব হয় নি। পড়াশোনা থেকেও ছিলাম বিচ্ছিন্ন। ঘণ্টায় হাজার হাজার টাকার অর্ডার পড়ছে, কেবল এটিই উপভোগ করে যাচ্ছিলাম। কিছুদিনের মধ্যেই এটি নেশার মতো হয়ে উঠলো। অর্ডার কম পড়লে অবসাদে ভুগতে হতো। বিক্রি কমে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে মাথা উত্তপ্ত হয়ে উঠতো। দেখা যেতো- পিঙ্গে রেসপন্সে কোনো গোলমাল হয়েছে, পারচেজ ইভেন্ট ডাবল কাউন্ট হচ্ছে, বা বিজ্ঞাপনের কন্টেন্ট একঘেয়ে হয়ে গেছে। ফলে গ্রাহকদের কাছে ঠিকমতো বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হতো না। সমাধান করার পর আবার অর্ডার পড়া শুরু হতো, এবং সৃষ্টি হতো মাদকীয় উপভোগ। মিনিটে মিনিটে টাকা আয় হচ্ছে, এর চেয়ে নেশাদায়ক বস্তু আর কী হতে পারে?

একদিন হিসাব করতে বসলাম, ভালোভাবে চলার জন্য মাসে আমার কতো টাকা প্রয়োজন? অঙ্কটি বের করলাম, এবং দেখলাম যে এর চেয়ে বেশি উপার্জন করা অর্থহীন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত যা-ই উপার্জন করবো, তা-ই মেদ হিশেবে জমা হবে, এবং নষ্ট হবে সুখ। যদি অতিরিক্ত উপার্জন বন্ধ না করতাম, তাহলে এ বইটি আমি লিখতে পারতাম না। না লিখলে হয়তো আয় করতাম অনেক টাকা, কিন্তু তা হতো প্রয়োজনের অতিরিক্ত আয়, যা পেটের ওপরে জমা চর্বির মতোই ক্ষতিকর হতো।

আমি বলছি না যে উৎপাদনের সাথে বা জিডিপির সাথে সুখের কোনো সম্পর্ক নেই, তবে তা অতোটা নয়, যতোটা রটানো হয়। রাষ্ট্র নাগরিকদেরকে উদ্বুদ্ধ করছে বেশি বেশি উৎপাদন করার জন্য, কারণ নাগরিকরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত উৎপাদন না করলে রাষ্ট্রের চালকরা বাঁচবে না। বাংলাদেশ সরকার এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি খুশি হাকিমপুরী জর্দার মালিকের ওপর। সরকারের দৃষ্টিতে তিনিই সবচেয়ে বেশি উৎপাদন করছেন, কারণ তিনিই সবচেয়ে বেশি কর পরিশোধ করছেন।

সরকার কি আমার এ বইটি পড়ে খুশি হবে? মোটেই না। সরকার খুশি হতো, যদি আমিও একটি তামাক ফ্যাক্টোরি খুলে সরকারকে কোটি কোটি টাকা কর দিতাম। রাষ্ট্রের চোখে লেখকের চেয়ে তামাক বা মদ কোম্পানির মালিক অধিক গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্র কি আমাকে সফল বলবে? বলবে না। রাষ্ট্র সফল বলবে হাকিমপুরীকে; যদিও আমি মানুষের ফুসফুস উন্নত করছি, আর হাকিমপুরী ধ্বংস করছেন।

রাষ্ট্র যদি কোনোদিন আমাকে পুরস্কৃত করে, তাহলে ওই পুরস্কার রাষ্ট্রকে কিনতে হবে হাকিমপুরীর জর্দার টাকা দিয়ে, এবং পুরস্কারে তামাকের গন্ধ থাকার কারণে সেটিকে তখন প্রত্যাখ্যান করতে হবে।

১৯.

রাজারা মুকুট ব্যবহার করতেন। ব্যাপারটা এমন নয় যে মুকুট না পরলে তিনি রাজা নন। মুকুটের বদলে সাধারণ টুপি ব্যবহার করলেও তিনি রাজাই থাকেন। সিংহাসনের বদলে চৌকিতে বসলেও তার রাজ-পরিচয় ক্ষুণ্ণ হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তিনি বসতেন সিংহাসনে, এবং পরতেন রত্নখচিত মুকুট। এর কারণ কী? এর কারণ, সমাজে ক্ষমতা প্রদর্শনের একটি ভালো উপায় হলো দামি পোশাক ও দামি আসবাব ব্যবহার করা। ‘ক্ষমতা প্ৰদৰ্শন’ কথাটির অর্থ- মানুষকে ভয় পাইয়ে দেয়া। একটি রত্নখচিত মুকুট, তার চারপাশে যে-পরিমাণ ভয় সৃষ্টি করতে পারে, একটি সাধারণ টুপি তা পারে না।

ইউরোপীয় রাজারা বাহারি পোশাক পরতেন। প্রজারা পরতো স্যুট- কোট। স্যুট-কোট ছিলো শ্রমিকদের পোশাক। এগুলো পরে দীর্ঘ সময় শীতে কাজ করা যেতো। কালো কোটে বারবার মুছা যেতো ময়লা। কিন্তু রাজার পোশাক এরকম হলে অসুবিধা। রাজাকে পরতে হতো এমন পোশাক, যা সচরাচর দেখা যায় না। ওই পোশাক দেখলেই প্রজারা টের পেতো, লোকটি বিশেষ কেউ। লোকটির মানুষকে ভয় দেখানোর সামর্থ্য আছে।

আবার রাশেদুন খলিফাদের কোনো মুকুট ছিলো না। ফলে ধর্মীয় কারণ ব্যতীত তাঁদেরকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ মানুষের ছিলো না। তাঁদের শাসনামলে যে নানা দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগেই থাকতো, এর একটি প্রধান কারণ- তাঁদের সাধারণ জীবনযাপন। রাজার জীবন যখন প্রজার জীবনের সমান হয়ে যায়, তখন রাজা আর রাজা থাকেন না। তিনি নিজেও প্ৰজা হয়ে ওঠেন। ম্যাকিয়াভেলি তাঁর প্রিন্সকে এ ব্যাপারে সাবধান করেছিলেন।

প্রশ্ন উঠতে পারে, আধুনিক পোশাক-আশাকগুলিও মানুষকে ভয় দেখানোর দায়িত্ব পালন করে কি না? এ ক্ষেত্রে বলবো, আধুনিক পৃথিবীতে মানুষ যে-প্রক্রিয়ায় সমাজে ভয় সৃষ্টি করে, তা রাজা-বাদশাহ যুগের মতো অতো সরল নয়। একসময় যা ছিলো শ্রমিকদের পোশাক, এখন তা আমেরিকার প্রেসিডেন্টের পোশাক। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ভয় দেখানোর সামর্থ্য একজন শ্রমিকের ভয় দেখানোর সামর্থ্যের সমান। বরং, শ্রমিকের পোশাকে তিনিই এখন সবচেয়ে ভীতিকর রাজা। জাতিসংঘ চার্টারকে উনি ইচ্ছেমতো পড়তে পারেন, এবং পড়ে তৈরি করতে পারেন ইচ্ছেমতো অর্থ। ব্রুনাইয়ের রাজা এখনো মুকুট পরেন, কিন্তু তার ভয় দেখানোর সামর্থ্য, মার্কিন প্রেসিডেন্টের ভয় দেখানোর সামর্থ্যের একশো ভাগের এক ভাগও নয়।

সুতরাং বলা যায়, পোশাকের সামাজিক মর্যাদার একটি উল্টো বিবর্তন পৃথিবীতে ঘটেছে। শ্রমিকসুলভ পরিপাটি পোশাকগুলোর ভয় দেখানোর ক্ষমতা এখন নেপোলিয়নের গাউনের চেয়ে বেশি। লেনিনকে দেখে বুঝা যেতো না যে তিনি লেনিন। তাঁর হাতে এতো ক্ষমতা, এটি বুঝার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে কিছু একটা বলতে হতো। বললেই বুঝা যেতো যে মানুষ গ্রেপ্তারে লেনিনের ক্ষমতা অসামান্য।

বিভিন্ন দেশে যে শক্তিওয়ালা মানুষজন আছেন, তাদের স্যুটেড-বুটেড হওয়ার মূল কারণটিও মানুষকে ভয় দেখানো। বাংলাদেশের কথাই ধরা যাক। দেশটিতে ক্ষমতাহীন মানুষদের পোশাক একরকম, ক্ষমতাবান মানুষদের পোশাক আরেক রকম। লুঙ্গি পরা কেউ যখন স্যুট-বুট পরা কারও মুখোমুখি হন, তখন নিজের অজান্তেই তিনি নিজেকে সমর্পণ করে বসেন। কথা বলতে গিয়ে প্যাঁচ লাগিয়ে ফেলেন, বসতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। ব্যাপারগুলো মনস্তাত্ত্বিক। ইউনিফর্ম পরা কারও সাথে আমরা সহজে তর্ক করতে পারি না। ইউনিফর্ম আমাদেরকে জানিয়ে দেয়- লোকটির সাথে হিসেব করে কথা বলতে হবে। সেদিন টুপি-পাঞ্জাবি পরা একজন ইউএনওর ছবি দেখলাম। আমার মনে হয় না ওই ইউএনওকে দেখে কেউ ভয় পাবে। কারণ বাংলাদেশে টুপি-পাঞ্জাবি হলো ক্ষমতাহীন শ্রেণীর পোশাক।

আমি যতোবার লুঙ্গি পরে বিদেশ ভ্রমণ করেছি, ততোবারই বিমানে বাংলাদেশি মানুষদের হাসি-তামাশার শিকার হয়েছি। একবার ইমিগ্রেশন অফিসার ভেবেছিলেন- আমার দুই উরুর মাঝখানে ঘা হয়েছে, তাই লুঙ্গি পরে এয়ারপোর্টে ঢুকেছি। এর কারণ, লুঙ্গি কোনো ভীতিকর পোশাক নয়। লুঙ্গির ভয় দেখানোর ক্ষমতা শূন্য। শেখ মুজিব ও ভাসানী লুঙ্গি পরতেন- এ জন্য তাঁদেরকে কেউ ভয় পেতো না। গান্ধীর চেয়ে নেহরুর পোশাক ভীতিকর ছিলো। সিমলা কনফারেন্সে মাওলানা আজাদ যখন ভাইসরয়ের সাথে সাক্ষাতে বসেছিলেন, তখন ভাইসরয়ের পোশাক আর মাওলানা আজাদের পোশাক এক ছিলো না। জেলখানায় কয়েদিদের যে-পোশাক পরানো হয়, তা একজন মানুষকে ভেঙে ফেলার পোশাক। ওই পোশাক কয়েদিদের জানিয়ে দেয়- মানুষ হিশেবে তোমার ক্ষমতা ও মূল্য শূন্য। মিলিটারিতে সৈনিক ও অফিসার ক্লাসের যে-পার্থক্য, তা পোশাকের মাধ্যমেই ফুটিয়ে তোলা হয়। পোশাক দেখলেই একজন সৈনিক বুঝে যান- লেফটেন্যান্ট জেনারেল আসছেন। তাকে ভয় পেতে হবে। এ কথা অন্য বাহিনীগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

পোশাক একপ্রকার সামাজিক দেয়াল হিশেবেও কাজ করে। বিচারপতি যদি আদালতে বিশেষ পোশাক না পরেন, বা বিশেষ চৌকিতে না বসেন, তাহলে তার আইনি কর্তৃত্ব মানুষের মনে সহজে ফুটে উঠবে না। পুলিশ যদি লুঙ্গি পরে মারামারি থামাতে যায়, তাহলে মারামারি থামবে বলে মনে হয় না। বিয়ের আসরে জামাই যদি একটু বিশেষ পোশাক না পরেন, তাহলে তার দিকে কেউ আগ্রহ নিয়ে তাকাবে না। মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করার একটি শক্তিশালী উপায় পোশাক। আমাদের নারীরা যে প্রায়ই শাড়ি- গয়না নিয়ে তুলকালাম বাধিয়ে ফেলে, তার মূল কারণ মনোযোগ আকর্ষণ। তারা চায়, চারপাশের সমাজ তাদের দেখুক, এবং দেখে হিংসা অনুভব করুক। হিংসাও একপ্রকার ভয়, কারণ হিংসা মানুষে-মানুষে বিকর্ষণ তৈরি করতে পারে। আমরা যখন কাউকে হিংসা করি, তখন তার কাছে সহজে ভিড়তে চাই না। আবার আমরা যখন কাউকে ভয় করি, তখন তার সাথেও সহজে ঘনিষ্ঠ হতে চাই না।

ফলে দেখা যাচ্ছে, পোশাক মাঝেমধ্যে বন্দুকের বিকল্প হিশেবে কাজ করে। কোনো সমাজে পোশাকের আশ্রয় নিয়ে নিজেকে ক্ষমতাধর হিশেবে প্রচার করা সম্ভব। এ কাজে অনেকে পোশাকের সাথে একটি দামি গাড়িও সংযুক্ত করেন। বাংলাদেশে যে ড্রাইভার প্রথাটি আছে, তা মূলত মানুষের ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রবণতার দিকেই ইঙ্গিত করে। ক্ষমতাধর মানুষ, অথচ তার একজন চাকর নেই, এটি হতে পারে না। সম্ভবত এ কারণেই বাংলাদেশের অধিকাংশ স্যুট-বুট সদস্য নিজে গাড়ি চালানো শেখেন না। তারা রাখেন ড্রাইভার নামক একজন চাকর, যিনি সিট থেকে নেমে গাড়ির দরজাটি বিনীত ভঙ্গীতে খুলে দেবেন, আর মানুষের সামনে স্যার স্যার, ম্যাডাম ম্যাডাম করবেন। এতে নিজেকে একটু রাজা রাজা মনে হয়। এ দিক দিয়ে ইউরোপ-অস্ট্রেলিয়ার স্যুট-বুটরা আমাদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে। কারণ ওখানে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপ্রধান ছাড়া আর কেউ ড্রাইভার সুবিধা পান না। সব অফিসারকেই নিজের গাড়ি নিজে চালাতে হয়।

পোশাকের সাথে ভালো-মন্দের সম্পর্কটি আমি একটু খতিয়ে দেখতে চাই। ধরা যাক- কোনো বিয়েতে আমি লাল রঙের প্যান্ট, টিয়া রঙের শার্ট, সবুজ রঙের সানগ্লাস, সাদা রঙের জুতো, সোনালি রঙের ব্রেসলেট, রুপালি রঙের নেক-চেইন, এবং বড়ো বাকলের বেল্ট পরে উপস্থিত হলাম। বাংলাদেশের সমাজ আমার এ পোশাকের দিকে তাকিয়ে ধরে নেবে, আমি কোনো ধনী পরিবারের বখে যাওয়া সন্তান। আমি পড়ালেখা করি না, সারাদিন করে বেড়াই নানা অপকর্ম, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত- এ খবর রাখি না, রাস্তাঘাটে মেয়ে দেখলে শিস দিই, মুরব্বিদের সাথে বেয়াদবি করি, এবং কোনো ভদ্র ঘরের মেয়ের সাথে আমার বিয়ের সম্ভাবনা কম।

আমি বলছি না যে সবাই এরকম অনুমান করবে, কিন্তু অধিকাংশ মানুষই যে করবে, তা কয়েকবার যাচাই করে দেখেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তো মাঝেমধ্যে লাল প্যান্ট পরে যেতাম। লোকজন আমার দিকে কৌতূহল নিয়ে তাকাতো। একটি লাল প্যান্ট আমাকে সমাজ থেকে আলাদা করে দিয়েছে, এ ব্যাপারটি ভালোভাবেই টের পেতাম। পোশাকের যে- কম্বিনেশনের কথা উপরে বলেছি (টিয়া রঙের শার্ট, সবুজ রঙের সানগ্লাস, সাদা রঙের জুতো…), তা পরে বাংলাদেশের কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে আমি সহজভাবে বসতে পারবো না। ওই পোশাক পরা অবস্থায় কেউ যদি আমাকে জিগ্যেস করেন- আপনি কী করেন? আর যদি উত্তর দিই— আমি কৃষিকাজ করি, তাহলে হাসাহাসি শুরু হয়ে যাবে। যদি বলি আমি গবেষক বা লেখক, তাহলে হাসাহাসি আরো বেড়ে যাবে। বিয়ের পাত্র দেখা অনুষ্ঠানে এরকম পোশাক পরে হাজির হলে, পাত্রীপক্ষ আমার চরিত্র নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করবে। বিসিএস ভাইভা বোর্ড তো এ পোশাক দেখে আঁতকে উঠবে। সাধারণ বাঙালি প্রেমিকারা আমার সাথে একই রিকশায় পাশাপাশি বসতে রাজি হবে না। অর্থাৎ আমার দ্বারা কোনো ‘ভালো’ কাজ সম্ভব, বা আমি মানুষটা ‘ভদ্রলোক’ হতে পারি, এটি বাংলাদেশের সমাজ আমার পোশাক দেখে মানতে চাইবে না।

‘ধনী’ বা ‘অভদ্র’ পোশাক পরে যদি আমি ঘণ্টায় আশি কিলোমিটার বেগে মোটরসাইকেল চালাই, আর আমার পাশ দিয়ে কেউ ‘দরিদ্র’ বা ‘ভদ্র’ পোশাক পরে একই গতিতে মোটরসাইকেল চালায়, তাহলে ‘ভদ্ৰ’ পথচারীরা কেবল আমাকেই বেপরোয়া চালক ভাববে। ‘দরিদ্র’ বা ‘ভদ্র’ পোশাক পরা লোকটিকে তারা বেপরোয়া চালক ভাববে না। আমার গ্রামে এক ইউপি মেম্বার আছেন, যিনি তার ছেলের মোটরসাইকেলে উঠতে চান না। তার ধারণা, ছেলেটি দক্ষ চালক নয়। কারণ ছেলের পোশাক-আশাক ও চলাফেরা ‘ভদ্র’ নয়। একদিন লতিফ হোসেন নামের এক ‘ভদ্র’ চালকের মোটরসাইকেলে তিনি উঠলেন, এবং খালে পড়ে নাকানি-চুবানি খেলেন। অথচ ‘অভদ্র’ পোশাক পরা ছেলের মোটরসাইকেলে চড়লে তাকে খালের পানি খেতে হতো না, কারণ ছেলেটি পোশাকে ‘অভদ্র’ হলেও, মোটরসাইকেল চালানোয় লতিফ হোসেনের চাইতে অধিক দক্ষ ছিলো।

‘ধনী’ বা ‘অভদ্র’ পোশাকে কেউ যদি ভিক্ষা করতে বের হয়, তাহলে তাকে মারধর করা হতে পারে। ভিখেরি যে শখ করে একদিন স্যুট-কোট পরবে, বা ঘুরে বেড়াবে ভালো জামা-কাপড় পরে, এ সুযোগ আমাদের সমাজে নেই। কারণ এ সমাজ, ভিখেরিকে তার স্বাস্থ্য বা দারিদ্র্য দেখে নয়, ভিক্ষা দেয় তার পোশাক দেখে। ভিখেরির পোশাক যদি যথেষ্ট দরিদ্র না হয়, পোশাকে পর্যাপ্ত ময়লা ও জোড়াতালি যদি না থাকে, তাহলে সমাজ ধরে নেয় যে ‘লোকটি ভিক্ষা পাওয়ার উপযুক্ত নয়। সে হয়তো অন্য কোনো মতলবে ভিক্ষা করছে। একই স্বাস্থ্য, একই বয়স, একই অভাব নিয়ে দুজন ভিক্ষুক যদি দুটি ভিন্ন সজ্জার পোশাক পরে ভিক্ষা করতে বের হন, এবং তাদের একজনের পোশাক যদি সুন্দর ও পরিপাটি হয়, তাহলে সুন্দর পোশাক পরা ভিক্ষুকটির ভিক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা বাংলাদেশে কম।

এখানে পোশাক নিয়ে একজন লেখকের অভিজ্ঞতাও সামান্য বলতে চাই। ভদ্রলোক তার ফেসবুক একাউন্টে হাফ প্যান্ট পরা একটি ছবিকে প্রোফাইল পিকচার হিশেবে ব্যবহার করেছিলেন। এ অবস্থায় কিছু ধর্মযোদ্ধা ধরে নিয়েছিলেন যে, ইসলাম ধর্ম নিয়ে কোনো কথা বলার অধিকার তার নেই। তিনি সব ধর্ম, সব মতবাদ নিয়ে কথা বলতে পারবেন, শুধু ইসলাম নিয়ে কিছু বলতে পারবেন না। অথচ বাস্তবে হয়তো ওরকম কিছু লেখার সময় তিনি লুঙ্গি পরা অবস্থায় থাকেন। যেহেতু তার ফেসবুক ছবিতে হাফ- প্যান্ট আছে, তাই ধর্মযোদ্ধাদের ধারণা, তিনি নিশ্চয়ই ইসলামী কোনো বিষয়ে জ্ঞান রাখেন না। তাদের দাবি- দর্শন, সাহিত্য, আইন, ও বিজ্ঞানে তার অগাধ জ্ঞান থাকলেও ধর্ম বিষয়ে তিনি মূর্খ! বাস্তবতা হলো, তিনি আরবি জানেন, এবং নিয়মিত অর্থ ও তাফসিরসহ কোরান পড়েন। সওয়াবের আশায় পড়েন কি না জানি না, তবে প্রয়োজন অনুযায়ী পড়ে থাকেন। মুসনাদ ও সিহাহ-সিত্তাহর হাদিস বিশ্লেষণে তার ভালো দক্ষতা রয়েছে। তাফসির ইবনে কাসিরের সাথে তাফসির আল তাবারির তুলনামূলক পার্থক্যও তিনি নির্ণয় করতে জানেন। ফেসবুকের ধর্মসৈনিকদের সাথে তার পার্থক্য হলো- তিনি শুধু ইসলামি বইপত্র নিয়েই মেতে থাকেন না, তাকে ইহুদিদের হাদিসগ্রন্থ তালমুদও পাঠ করতে হয়। ওল্ড টেস্টামেন্ট, নিউ টেস্টামেন্টকে ভদ্রলোক কোরানের মতোই গুরুত্ব দিয়ে পড়েন। ফলে সহজেই বুঝতে পারেন, কোন বাণী কোন গ্রন্থ থেকে কোন গ্রন্থে গিয়েছে। কোরানের আয়াতগুলোর অর্থ বাংলাদেশ ও আরবে ভিন্ন ভিন্ন কি না, তা-ও তিনি খুঁজে খুঁজে দেখেন। বহু আয়াত আছে, যেগুলোর অর্থ ভারত অঞ্চলের লোকজন সম্পূর্ণ উল্টোভাবে করেছে। অনারব আব্দুল্লাহ ইউসুফ আলির করা অর্থের সাথে আরব আবদেল হালিম বা নেসিম দাউদের করা অর্থের মিল পাওয়া যায় না। কোনো হাদিস মাওদু বা বানোয়াট কি না, হাদিসটির সনদ- মতন বিশ্বাসযোগ্য কি না, এ অনুমানও তিনি সহজে করতে পারেন। ফলে কারও মুখে আরবি বাণী শুনেই সেটিকে তিনি অন্ধভাবে ইসলামের বাণী হিশেবে বিশ্বাস করেন না। কোনো মুহাদ্দিস বা হাদিস সংকলক, একটি হাদিসকে সহিহ বলেছেন বলেই যে হাদিসটি সত্যি সত্যি রাসুলের বাণী হয়ে গেলো, এরকমটি তিনি মনে করেন না। নিজের বুদ্ধি-বিবেচনাকে স্থান দেন সবার উপরে।

যদি প্রোফাইলে একটি ইসলামসম্মত ছবি টাঙিয়ে, আর বাস্তবে উলঙ্গ হয়ে শুয়ে শুয়ে তিনি ইসলামবিষয়ক লেখা লিখতেন, তাহলে মনে হয় না তাকে নিয়ে কারও আপত্তি থাকতো। সবাই ভাবতো লোকটি ‘ইসলামিক স্কলার’। তিনি মাদ্রাসায় পড়েছেন কি না এ প্রশ্নও কেউ তুলতো না, কারণ জুব্বা পরা ছবি দেখে কারও মাথায় সন্দেহই আসতো না যে এই লোক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারেন। ভদ্রলোক যদি মিসর বা মদিনার কোনো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে আগামীকাল একটি ডিগ্রি নিয়ে আসেন, আর ফেসবুকে রগরগে ইসলামি ভিডিও প্রচার করা শুরু করেন, তাহলে পরশু থেকেই হয়ে উঠবেন প্রখ্যাত আলেম। যদিও বাস্তবে তিনি যাপন করবেন অনৈসলামিক জীবন। অর্থাৎ অভিনয়টি ঠিকঠাক চালিয়ে যেতে পারলে অল্প দিনেই পরিণত হবেন সোনার ডিম পাড়া হাঁসে।

রফিকুল ইসলাম মাদানী নামের এক শিশুবক্তার ফোনে পুলিশ পর্নো ভিডিও পেয়েছে। আমি বলছি না পুলিশের দাবি সত্য (তবে সত্য হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না), কিন্তু ওই বক্তার ভক্তরা কল্পনাও করতে পারবে না যে একজন ইসলামি পোশাক পরা মানুষের ফোনে পর্নো ভিডিও থাকতে পারে। ইসলামি পোশাক পরা মানুষও যে বাইরে ওয়াজ-মাহফিল করে এসে ঘরে একা একা পর্নো ক্লিপ দেখতে পারে, এটি বাংলাদেশের সমাজ মানতে চায় না। শুধু ‘বখাটে’ পোশাক পরা তরুণরাই এগুলো দেখে, ‘ইসলামি’ পোশাক পরা মাওলানারা এসব দেখেন না, এমনটি ভাবা ঠিক নয়।

বাংলাদেশে কিছু উপাচার্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এ উপাচার্যদের সবাই কিন্তু শিক্ষক। আমাদের সমাজে শিক্ষকরা যে-ভদ্র পোশাক-আশাক পরেন, তাতে কেউ কল্পনাই করবে না যে তাদের মাঝেও কেউ কেউ চোর হতে পারেন। একবার একটি হাই ইশকুলে আমি ক্লাস নিতে গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ প্রধান শিক্ষকের কক্ষে বসেছিলাম। প্ৰধান শিক্ষক এক সহকর্মীকে নিয়ে উপবৃত্তির টাকা আর কিছু বেসরকারি অনুদানের হিসাবনিকাশ করছিলেন। কথোপকথন শুনে বুঝতে পারছিলাম যে, শিক্ষকতার চেয়ে ঘাউ করা টাকার গোলমাল নিষ্পত্তিতেই তাদের আগ্রহ বেশি। আমি বলছি না যে সব শিক্ষক এরকম, বরং শিক্ষকদের একটি বড়ো অংশই ভালো মানুষ, এবং তাদের দুর্নীতি করার সুযোগ অনেক কম

আমাদের সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে যে নানা অভিযোগের কথা শোনা যায়, তার কোনো প্রতিফলন কিন্তু তাদের পোশাকে থাকে না। যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে তারাই সবচেয়ে ‘ভদ্র’ পোশাক পরে হাজির হন। একজন ডিআইজি প্রিজন যখন আশি লাখ টাকাসহ আটক হয়েছিলেন, তখন তার চুলের ছাঁট ও পোশাক দেখে বুঝার উপায় ছিলো না যে লোকটি বখাটে হতে পারে। আমরা ধরে নিই, বখাটে হলো তারা, যাদের চুল লম্বা, ও পোশাক ‘অভদ্র’। একবার একটি ছিনতাইয়ের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলাম। আমার গায়ে ছিলো ‘ভদ্র পোশাক, আর ছিনতাইয়ের শিকার হওয়া লোকটিকে যিনি বাঁচাতে এসেছিলেন, তার পোশাক ছিলো “অভদ্ৰ’। সমাজের বিবেচনায় আমি ছিলাম সেখানে ‘ভদ্রলোক’ আর ওই জীবনরক্ষাকারী তরুণ ছিলো ‘বখাটে’।

শৈশবে একটি মাদ্রাসায় আমি দারুল ক্বেরাত পড়তাম। দারুল ক্বেরাত হলো শুদ্ধভাবে কোরান পড়ার কোর্স। একবার রমজানের শেষ দশ দিন ওই মাদ্রাসায় থেকে গিয়েছিলাম। মাদ্রাসার একটি পাকা উঠোন ছিলো, যেটি ব্যবহৃত হতো ঈদগা হিশেবে। ক্বেরাতের সকালবেলার মক বা প্ৰথম পাঠ, ওখানেই দেয়া হতো। যারা মাদ্রাসায় থাকতাম, তারা সবাই ওই ঈদগাতেই ঘুমোতাম। এক রাতে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে যায়। তখন আমি অনেক ছোটো, কিন্তু প্রাপ্তবয়স্কতার কিছু ব্যাপারের সাথে পরিচয় ছিলো। দেখি, আমাদেরকে ক্বেরাত পড়ান এমন একজন হুজুর, শুয়ে শুয়ে ‘অদ্ভুত কিছু একটা’ করছেন (সম্ভবত স্বপ্নের ঘোরে)। তার লুঙ্গি ছিলো কোমরের উপরে। সমাজের কোনো মানুষ, লোকটির ধর্মীয় বেশভূষা দেখে কল্পনাও করতে পারবে না যে তিনি এমন কাজ করতে পারেন। আমি বলছি না এটি কোনো অপরাধ, বরং এটিকে সাধারণ জৈবিক কার্যকলাপ হিশেবেই দেখি, কিন্তু সমাজ ধরে নিয়েছে যে এ কাজগুলো শুধু বখাটে ছেলেরাই করে, কোনো ‘ভদ্রলোক’ বা হুজুর তা করেন না।

এই যে পোশাক দেখে মানুষের চরিত্র নির্ণয়ের সামাজিক প্রবণতা, এটিকে রোগ হিশেবেই চিহ্নিত করতে চাই। কারণ স্বাস্থ্য বলতে যা বুঝি, তার আওতায় সমাজের এ আচরণকে আমি ফেলতে পারি না। এটি অবিচার উস্কে দেয়। বাংলাদেশে ধরমণ্ডল নামে একটি গ্রাম আছে। ছোটোবেলায় ওই গ্রামে একবার গিয়েছিলাম। তখন গ্রামটিতে কিছু দুর্ধর্ষ গরুচোর ছিলো। একজন আমাকে জানালেন, ওই যে জটলাটি দেখছো, যারা বসে বসে তাস খেলছে, তারা সকলেই চোর। রাতে এরা বিভিন্ন গ্রামে গরু চুরি করে। আমি তাদের পোশাক লক্ষ করলাম। দেখলাম সবাই লুঙ্গি পরে আছে, এবং কোমরে পেঁচিয়ে রেখেছে গামছা। পোশাক হিশেবে লুঙ্গি মোটামুটি সার্বজনীন। এটি কোনো বিশেষ পেশার পোশাক নয়। ফলে ‘চুরির ড্রেস কোড’ বা ‘আইডেন্টিটি ফ্ল্যাগ’ হিশেবে আমার মনে লুঙ্গির বদলে গেঁথে গেলো তাদের গামছা। যারা গরু চুরি করেন, তারা কোমরে গামছা পেঁচিয়ে রাখেন- এরকম একটি ধারণা মনে বদ্ধমূল হয়ে গেলো। কিছুদিন পর দেখলাম, আমাদের ইশকুলের মলাই স্যার কোমরে গামছা পেঁচিয়ে হালচাষ করছেন। এক বন্ধুকে বললাম, স্যার কি রাতে গরু চুরি করেন?

আমাকে যে-ভদ্রলোক গামছা পরা গরুচোর দেখিয়েছিলেন, তিনি মূলত নিজের বিভ্রান্তি আমার ভেতর সংক্রমিত করেছিলেন। কারণ ওই লোকগুলো চোর ছিলো না, ছিলো গরু পাইকার। গ্রামগঞ্জ থেকে গরু কিনে তারা হাটে বিক্রি করেন।

এবার একটু নারীদের পোশাকের দিকে তাকাতে চাই। বাংলাদেশে পোশাক দেখে ভালো-মন্দ নির্ণয়ের যে-প্রথাটি গড়ে উঠেছে, তার সবচেয়ে বড়ো শিকার নারীরা। এ অঞ্চলে সাংস্কৃতিক দাঙ্গা এতো প্রবল যে, কোনো নারী একটু ভিন্ন সংস্কৃতির পোশাক পরলেই তার চরিত্র মন্দ হয়ে ওঠে। এখানে লক্ষ করা প্রয়োজন যে, পুরুষদের ক্ষেত্রে ‘চরিত্র’ শব্দটি যে-অর্থে ব্যবহৃত হয়, নারীদের ক্ষেত্রে সে-অর্থে ব্যবহৃত হয় না। কোনো নারীর ‘চরিত্র’ খারাপ, বাংলা ভাষায় এটি দিয়ে বুঝানো হয়-

১) নারীটি বেশ্যা, অথবা ২) বহুগামী, অথবা ৩) স্বামীর প্রতি অবিশ্বস্ত, অথবা ৪) ইসলামি পর্দাপ্রথা মেনে চলে না, অথবা ৫) সামাজিক খবরদারি মানে না, অথবা ৬) তার লজ্জা কম, অথবা ৭) পুরুষদের কর্তৃত্ব স্বীকার করে না, অথবা ৮) পালিয়ে বিয়ে করেছে, অথবা ৯) ক্ষমতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তর্ক করে, অথবা ১০) সে এমন কিছু করেছে, যা সমাজের মনঃপূত নয়।

বাংলাদেশের সমাজ, নারীকে উপরের দোষগুলোতে দোষী করতে পোশাককে খুব গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নেয়। জিন্স ও বোরকা পরা দুটি মেয়ে পাশাপাশি হেঁটে গেলে, সাধারণ মুসলিমরা ধরে নেন, বোরকা পরা মেয়েটির চরিত্র জিন্স পরা মেয়েটির চেয়ে ভালো।

আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, ‘চরিত্র’ একটি সোশ্যাল কনস্ট্রাক্ট বা সামাজিক নির্মাণ। পৃথিবীতে চরিত্রের কোনো স্বাধীন অস্তিত্ব নেই। এটি একেক সমাজে একেকভাবে নির্মিত হয়, এবং এ নির্মাণ, সমাজের বাসিন্দারাই করে থাকেন। কোনো মেয়ে জিন্স পরেছে বা হাফ-প্যান্ট পরেছে, এ জন্য তার চরিত্র খারাপ- এ ধারাণা বাংলাদেশের সমাজে মানুষই তৈরি করেছে। আরো স্পষ্ট করে বললে, নারীদের ক্ষেত্রে এটি পুরুষরা তৈরি করেছে, এবং পুরুষ থেকে ধীরে ধীরে এ দৃষ্টিভঙ্গি, সাধারণ নারীদের মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছে। ধর্মীয় রক্ষণশীল জীবনযাপনে অভ্যস্ত, এমন নারীরা এখন রক্ষণশীল পুরুষদের মতোই অন্য নারীদেরকে দুশ্চরিত্রা মনে করে থাকেন, যদি ওই ‘অন্য নারী’-রা পশ্চিমা সংস্কৃতির কোনো পোশাক পরে বাইরে বের হন। এক্ষেত্রে একটি অদ্ভুত বিষয় লক্ষ করা যায়। পশ্চিমা পোশাককে বাংলাদেশে ভিন্ন সংস্কৃতির পোশাক ভাবা হলেও, মধ্যপ্রাচ্যের পোশাককে ভিন্ন সংস্কৃতির পোশাক ভাবা হয় না।

একবার একটি পাত্রী দেখা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। আমার সাথে ছিলেন পাত্রের মা। মেয়েটি দেখতে সুন্দর ছিলো। তার কথা বাচনভঙ্গী ভালো, সাংসারিক কাজকর্মও ভালো জানে, পড়াশোনাও পাত্রের চেয়ে বেশি, কিন্তু পাত্রের মা আপত্তি তুললো মেয়েটির গাঢ় লাল রঙের লিপস্টিক এবং উঁচু হিলের জুতো নিয়ে। তার সন্দেহ, এই মেয়ের অবশ্যই লাইন আছে (লাইন মানে প্রেম)। আমি বললাম, হ্যাঁ, লাইন থাকতেই পারে, কিন্তু এটি জানার ভালো উপায় লিপস্টিক বা জুতো নয়। অমুককে চেনেন না? আমি একজনের নাম বললাম। শুনেছি অমুকের মেয়ে সম্প্রতি পতিতাবৃত্তিতে লিপ্ত হয়েছে, এবং সবসময় বোরকা পরে থাকে। বোরকাকে সে পর্দা হিশেবে ব্যবহার না করে সমাজ থেকে মুখ লুকানোর উপায় হিশেবে ব্যবহার করছে।

ইংল্যান্ডে একসময় ইশকুল শিক্ষিকারা লিপস্টিক ব্যবহার করতে লজ্জা পেতো। শিক্ষিক মানুষ, তারও ওপর নারী, তিনি সাজসজ্জা করবেন কেন? এমনই ছিলো খ্রিস্টান চার্চের দৃষ্টিভঙ্গি। ইংল্যান্ডে যা বহু বছর আগে ছিলো, বাংলাদেশে তা এখনো আছে। এর অর্থ হলো, আমাদের এখানেও অনেক বছর পর তা থাকবে না।

আমি যখন স্ত্রীকে নিয়ে প্রথম গ্রামের বাড়িতে যাই, তখন তার চুল ছিলো রঙ করা। একদিন এক ভদ্রমহিলা জানালেন, “তুমি যে বউ নিয়ে রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করো, এটা মানুষ ভালোভাবে নেয় না। তার চুলের রঙ নিয়ে গ্রামে আলোচনা চলছে। নানাজন নানা ইঙ্গিত করছে।”

কোনো সমাজে নারীর পোশাক নির্ধারিত হয় ওই সমাজের সংস্কৃতি ও নিরাপত্তাবোধ দ্বারা। সংস্কৃতি একপ্রকার বিশ্বাস, যা প্রথা আকারে নানা অঞ্চলে পালিত হয় নানা রূপে। সংস্কৃতির ধর্ম হলোড় এটি স্থির থাকতে চায় না। দুটি ভিন্ন স্থান ও ভিন্ন সময়ের সংস্কৃতি একে অপরের সাথে মিশে তৈরি হতে পারে নতুন সংস্কৃতি। এ নতুন সংস্কৃতি অন্য কোনো পুরাতন সংস্কৃতির সাথে মিশে জন্ম দিতে পারে আরও একটি নতুন সংস্কৃতির। উঁচু হিলের জুতো এখন নারীরা পরলেও একসময় তা অভিজাত পুরুষরা পরতো। একটি ছবিতে দেখলাম, রাজা চতুর্দশ লুই নারীদের পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছেন। পায়ে উঁচু হিলের জুতো। সংস্কৃতির বিবর্তন এ ক্ষেত্রে চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশের অধিকাংশ পুরুষ লুঙ্গি পরেন। কিন্তু এ লুঙ্গি, পৃথিবীর বহু অঞ্চলে নারীদেরও পোশাক। ব্লাউজ ও সায়া পরার প্রচলন এ দেশে একসময় ছিলো না। সালওয়ার-কামিজের বয়সও বেশি নয়। বাঙালি নারীরা যে-শাড়ি পরেন, তার প্রসার ঘটেছিলো মূলত দারিদ্র্যের কারণে। শাড়ি বানাতে খরচ কম পড়ে। বানানোর প্রক্রিয়াও সহজ। কোনো সেলাই কাজের প্রয়োজন হয় না। তবে আধুনিক বাহারি

তবে আধুনিক বাহারি শাড়িগুলো ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশনের ফসল। পুঁজি ও সিনেমার বিকাশ এসব শাড়ির শ্রী বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে।

মাদ্রাসাগুলোতে যে পাঞ্জাবি দেখা যায়, তার আসল নাম কামিজ। তবে আমাদের সমাজে শুধু মেয়েদের ফ্রককেই কামিজ বলা হয়। কামিজ শব্দটি আরবি ভাষার। বাংলায় এর অর্থ- আচ্ছাদন, বা এমন বস্ত্র যা দিয়ে শরীর ঢাকা যায়। আরবরা যে-জুব্বা পরেন, সেটিও কামিজ। তারা এটিকে ডাকেন তোয়াব নামে। কিন্তু সুদানে তোয়াব বলতে নারীদের একটি পোশাককে বুঝানো হয়, যা দেখতে ভারতীয় শাড়ির মতো। ফিলিস্তিনের নারীরা যে- পোশাক পরেন, সেটিও তোয়াব। এ তোয়াব দেখতে আরব পুরুষদের জুব্বার মতো। নিকাব বাদ দিলে, নারীদের বোরকাও একপ্রকার তোয়াব। ‘ম্যাগনিফিসেন্ট সেঞ্চুরি’ নামক তুর্কি টিভি সিরিজে সুলতান সুলেমানকে যে- পোশাকে দেখানো হয়েছে, তার সাথে ফিলিস্তিনী নারীদের পোশাকের খুব একটা পার্থক্য নেই।

বাংলাদেশের কোনো মেয়ে যদি লুঙ্গি পরে কিছু ছবি ফেসবুকে দেয়, আর তার শরীরের কোনো সুন্দর এলাকা যদি অনাবৃত থাকে, তাহলে কমেন্ট বক্সে সমাজ ঝাঁপিয়ে পড়বে সর্বশক্তি নিয়ে। অধিকাংশ মন্তব্যেই প্রশ্ন তোলা হবে মেয়েটির চরিত্র নিয়ে (যদিও পোশাকের সাথে নারীর চরিত্রের কোনো সম্পর্কই নেই। যে-সম্পর্কটি আছে, তা সম্পূর্ণ সাংস্কৃতিক)। আজ যে-পুরুষরা লুঙ্গি পরছে, পাঁচ হাজার বছর পর তারা যে শাড়ি পরবে না, এরকম কোনো নিশ্চয়তা নেই। নারীদের পেটিকোট ও পুরুষদের লুঙ্গি – এ দুটি মূলত একই পোশাক। শুধু নাম ভিন্ন। নারীরা তাদের লুঙ্গিকে শাড়ি দিয়ে ঢেকে রাখে বলে সমাজ মনে করে- তারা লুঙ্গি পরে না!

পোশাকের ধরণ নির্ধারণে আবহাওয়া ও শিল্পায়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমি অনেক মানুষ পেয়েছি, যারা পাগড়িকে ইসলামি পোশাক মনে করেন। অথচ পাগড়ির প্রচলনের সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক আছে আবহাওয়ার। মরু অঞ্চলের লোকজন বহু আগে থেকেই রোদে পোড়া থেকে বাঁচতে পাগড়ি ব্যবহার করে আসছেন। এ পাগড়ি, একই কারণে নারীরাও ব্যবহার করেছেন। এখন যেটিকে স্কার্ফ ডাকা হয়, সেটির প্রচলন এভাবেই ঘটেছে। রোদ ও পোকামাকড়ের কামড় থেকে স্কার্ফ বা পাগড়ি বেশ ভালো সুরক্ষা দেয়। এ পাগড়িকে আরবরা ডাকেন কুফিয়া বা গুতরা। ইয়াসির আরাফাত যেটি পরতেন, সেটিও ছিলো কুফিয়া।

এ কুফিয়া আমাদের দেশের মেয়েরাও পরে। কেউ এটিকে বলে ওড়না, কেউ বলে স্কার্ফ। তবে ওড়নার রং যদি মাওলানা সাহেবদের ওড়নার ফুটফুট গোলাপি রঙের সাথে মিলে যায়, তাহলে বিপদ! বাঙালি যে শুধু রংই দেখে, জিনিস দেখে না, এটি তার বড়ো প্রমাণ। পাগড়ি এবং ওড়না- দুটি একই জিনিস। কোনো মেয়ে যদি বাংলাদেশের রাস্তায় ইয়াসির আরাফাতের মতো করে ওড়নাটি পরে, তাহলে হুলস্থুল লেগে যাবে। কথা উঠবে তার বুক নিয়ে। বলা হবে, মেয়েটি স্তন দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। ওর চরিত্র খারাপ। অথচ মেয়েটির বুক ঢাকাই আছে, এবং ওড়নার প্রচলন মোটেও বুক ঢাকার জন্য হয়নি; হয়েছিলো মুখ ও মাথা ঢাকার জন্যে, যেন রোদ ও পোকামাকড় থেকে সুরক্ষিত থাকা যায়। এ পোশাকগুলোর আবহাওয়াজনিত কারণ এখন আর নেই। প্রযুক্তির উৎকর্ষে এসব পোশাক মানুষের ফ্যাশন ও সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, নারীর সাজসজ্জাকে কেন এ সমাজে চরিত্রের অংশ ধরা হয়? এর প্রধান কারণ, পুরুষদের অবদমিত যৌন আকাঙ্ক্ষা। পুরুষের সাজসজ্জা নারীকে, আর নারীর সাজসজ্জা পুরুষকে, একে অপরের দিকে আকৃষ্ট করতে পারে। প্রকৃতিতে কোনো প্রাণীর টিকে থাকার জন্য এ আকর্ষণ জরুরি। অনেক প্রাণী আছে, যাদের সৌন্দর্যের কাছে মানুষের সৌন্দর্য তুচ্ছ। কিন্তু মানুষ বুদ্ধিমান হওয়ায়, নিজেকে পোশাক ও প্রসাধনীর মাধ্যমে ওই প্রাণীগুলোর চেয়েও সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারে।

মানুষ যখন জঙ্গলে ছিলো, তখন তার বিলাসবহুল ঘরবাড়ি ও পরিপাটি শার্ট-প্যান্ট ছিলো না। সে প্রকৃতি থেকেই সাজসজ্জার উপকরণ সংগ্রহ করতো। পাখির পালক, পশুর চামড়া, রঙিন ফুল, ট্যাটু, স্কিন কার্ভিং, ইত্যাদির সাহায্যে সে সাজগোজ করতো। বিয়ে-শাদি প্রথা খুব একটা ছিলো না। পরিবার প্রথাও গড়ে উঠতে সময় লেগেছে। যৌন আকাঙ্ক্ষা তখন অবদমিত থাকতো না।

কিন্তু এখন রক্ষণশীল সমাজগুলোতে এ আকাঙ্ক্ষা বহু বছর ধরে অবদমিত থাকছে। ফলে নারী ও পুরুষ- এ দুটি লিঙ্গের মধ্যে একধরনের শ্রেণী প্রথা গড়ে উঠেছে। এ প্রথার ভিত্তি- ক্ষমতা। ক্ষমতার তিনটি দিক আছে বলে মনে করি। প্রথমটি শারীরিক, দ্বিতীয়টি রাজনীতিক, তৃতীয়টি অর্থনৈতিক। নিরস্ত্র অবস্থায় পুরুষরা নারীদের চেয়ে অধিক ক্ষমতাবান। বাংলাদেশে কোনো ম্যাডিসন না থাকায়, আমেরিকার মতো এখানে জনগণের হাতে বন্দুক রাখার সুযোগ নেই। ফলে বেসরকারি সমাজে, শারীরিক শক্তি, ক্ষমতা প্রদর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। বাঙালি পুরুষরা, সমাজে এ মাধ্যম ব্যবহার করেই নারীর কাছে ক্ষমতা প্রকাশ করে থাকে। সামাজিক প্রথাগুলোর নির্মাণেও এ ক্ষমতা বড়ো নিয়ামক। যৌন আবেদন আছে, এরকম কোনো নারীকে ঐতিহাসিকভাবেই অনেক পুরুষ একসাথে পেতে চান। কিন্তু পরিবার প্রথা গড়ে ওঠায় এ সুযোগ সীমিত হয়ে গেছে। ফৌজদারি আইনের কারণে, এক পুরুষ আরেক পুরুষের সাথে মারামারি করে নারী ভাগিয়ে নেবেন, এমন সুযোগও নেই। ফলে এক নারীকে বহু পুরুষের পাওয়ার বাসনাটি অবদমিত থেকে যায়। এ জন্য, আমি যখন পাবো না, তাহলে অন্য কাউকেও পেতে দেবো না- এরকম একটি মনোভাব রক্ষণশীল পুরুষ সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এ মনোভাব থেকেই তারা নারীকে সাধারণ ও নীরস পোশাকে দেখতে চায়। তাদের ধারণা, এতে করে ভবিষ্যৎ স্ত্রী ও পুত্রবধূরা অন্য পুরুষদের ছোঁয়া থেকে সুরক্ষিত থাকবে।

এ কারণে কোনো নারী যখন সাজগোজ করে রাস্তায় বের হন, তখন মনস্তাত্বিক তাড়না থেকেই কিছু পুরুষ ভীত হয়ে পড়েন, এবং ভাবেন – হায়, এ নারীকে হয়তো আমি পাবো না, পাবে অন্য কেউ, বা ইতোমধ্যেই অনেকে পেয়ে গেছে। সমাজ যদি বদ্ধ ও রক্ষণশীল হয়, তাহলে পুরুষরা এমন ব্যবস্থা করেন, যেন নারীরা সমাজে তাদের সৌন্দর্য খুব একটা প্রদর্শন করতে না পারে। এরই অংশ হিশেবে, পোশাককে ভিত্তি ধরে হনন করা হয় নারীর চরিত্র। এ হননকর্মের মূল উদ্দেশ্য- নারীটিকে সামাজিকভাবে লজ্জা দেয়া, যেন সমাজে সৌন্দর্য প্রকাশ করতে সে ভয় পায়।

পোশাক দেখে কেউ কারও প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে কি না, এদিকটিতেও একটু নজর দেওয়া দরকার। বিদ্বেষ বিষয়টি তৈরি হয় আশঙ্কা থেকে। আমি আপনার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করছি, এর মূল অর্থ- আমি আশঙ্কা করছি যে আপনি আমার জীবন, সম্পত্তি, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল, ধৰ্ম, রাজনৈতিক স্বার্থ, বা পছন্দের কোনো প্রথার প্রতি হুমকি হয়ে উঠতে পারেন।

ঢাকার রাস্তায় কোনো নারী হাফ-প্যান্ট পরে বের হলে তার ওপর ঢাকাবাসীর যে-বিদ্বেষ তৈরি হবে, তা মূলত তাদের সাংস্কৃতিক ভয় থেকে তৈরি হবে। তারা আশঙ্কা করবে- এ হাফ-প্যান্ট সমাজে আরো অনেক নারীর কাছেই জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। ফলে শাড়ি, কামিজ, বুরকা, এ পোশাকগুলোর সংখ্যা ধীরে ধীরে কমতে থাকবে। এ ভয়ের কারণ, মানুষ অবচেতনভাবে ধরে নেয় যে তার নিজস্ব সংস্কৃতির পোশাকে সে সৰ্ব্বষ্ট নয়। যদি সৰ্ব্বষ্ট হতো, তাহলে ভিন্ন সংস্কৃতির পোশাক-আশাককে তারা এতো ভয় পেতো না।

এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন দেখা দেয়। প্রশ্নটি হলো- ভিন্ন সংস্কৃতির প্রতি মানুষের যে-ভয়, সে-ভয় শুধু সাংস্কৃতিক ভয়ে সীমাবদ্ধ না থেকে অন্য কোনো ভয়ে রূপ নিতে পারে কি না? যেমন- কারও পোশাক দেখে তাকে আমি ভয়ে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করবো কি না?

মানুষের পোশাক পরার পেছনে দুটি কারণ আছে বলে মনে করি প্রথমটি ব্যক্তিগত, দ্বিতীয়টি রাজনীতিক। ব্যক্তিগত কারণটি এখানে আলোচনা করবো না, যেহেতু এর রূপ আপনারা সকলেই জানেন। সাধারণত লজ্জাস্থান ঢাকা, রোদ থেকে বাঁচা, পরিচয় লুকানো, আরামে থাকা- এগুলোই ব্যক্তিগত কারণ।

কিন্তু রাজনীতিক কারণটি এরকম সরল নয়। এ কারণটির উৎপত্তি বাধ্যবাধকতা বা কম্পালসন থেকে। রাষ্ট্র, ধর্ম, রাজনীতি, ট্রাইবাল আইডেন্টিটি, ইত্যাদি এ কম্পালসনের উৎস হতে পারে। এশিয়ার এক দেশে, একটি বিশেষ বাহিনীকে মানুষ খুব ভয় পায়। বাহিনীটি যখন প্রথম সৃষ্টি হয়েছিলো, তখন মানুষ তাদেরকে এতো ভয় পেতো না। বাহিনীটির বয়স খুব বেশি নয়। কিন্তু তাদের কার্যক্রম দেশবাসীকে দ্রুতই ভয় পাইয়ে দেয়। ফলে ওই বাহিনীর পোশাক দেখলে মানুষ এখন আতঙ্কিত বোধ করে। একজন লেখক জানিয়েছেন, বাহিনীটির কোনো সদস্য ফেসবুকে তাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালে তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিলো না। নিরাপত্তাবাহিনীর পোশাক দেখে কেউ যদি অনিরাপদ বোধ করে, তাহলে তা গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত।

এর মানে কী দাঁড়ালো? পোশাক যদি নির্দিষ্ট কোনো সম্প্রদায়ের আইডেন্টিটি বা পরিচয়-নির্দেশক হিশেবে ব্যবহৃত হয়, এবং সে-সম্প্রদায়ের সদস্যদের সাধারণ কার্যক্রম যদি ভীতিকর হয়, তাহলে ওই পোশাক মানুষের মনে ফোবিয়া বা ভীতির জন্ম দিতে পারে। ইসলামিক স্টেট বা আইএসের সদস্যরা (তাদের প্রকাশিত ভিডিও অনুযায়ী) যে-পোশাক ও পতাকা ব্যবহার করেন, তা এখন ফোবিয়া। এ ফোবিয়ারই একটি ভিন্ন রূপ- ইসলামোফোবিয়া। ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ইলহান ওমর বা রাশিদা তালাইবের বিপক্ষে অবস্থান নেন, তখন মূলত এ ফোবিয়ার কারণেই নেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাস্তবতা আমলে নিলে, ট্রাম্পের এমন আচরণের কোনো যৌক্তিক ভিত্তি আছে মনে হয় না।

আইএস সদস্য শামিমা বেগমের ছবি যখন ফাঁস হলো, তখন দেখা গেলো- তিনি বোরকা পরে আছেন। শামিমা যাদের কাছে গিয়েছিলেন, তারা যে তাকে ভালো রাখতে পারেনি, এটি তার চেহারায় স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছিলো। তারা শামিমার গর্ভে শুধু কিছু বাচ্চাই জন্ম দিয়েছিলো। শামিমার জবানবন্দি পড়লে এটি পরিষ্কার হয়- আইএসের সমাজে তার ভূমিকা একজন যৌনদাসীর চেয়ে বেশি ছিলো না। শামিমা অনুতপ্ত হয়ে যুক্তরাজ্যে ফিরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ তার নাগরিকত্ব বাতিল করেছিলেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সিদ্ধান্তকে শামিমা বেগম আইনি প্রক্রিয়ায় চ্যালেঞ্জ করলে, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্পেশাল ইমিগ্রেশন আপিলস কমিশন (S।AC) রায় দেয় যে, সরকারের সিদ্ধান্ত বৈধ। শামিমা বেগম যুক্তরাজ্যের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তিনি ‘এই মুহূর্তে’ যুক্তরাজ্যে ফিরতে পারবেন না।

শামিমার আইনজীবীরা এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে কোর্ট অব আপিল শামিমার পক্ষে রায় দেন। আমি মামলার রায়টি পড়েছিলাম। লর্ড জাস্টিস ফ্লক্স মন্তব্য করেছিলেন:

“Fa।rness and just।ce must, on the facts of th।s case, outwe।gh the nat।onal secur।ty concerns, so that the leave to enter appeals should be allowed.”

অর্থাৎ, শামিমার ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার, এবং শামিমা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি— এ দুটি বিষয়কে দাঁড়িপাল্লায় মাপলে, ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারের পাল্লাটি ভারী হয়ে পড়ে। এ জন্য ন্যায়বিচারের স্বার্থে শামিমাকে যুক্তরাজ্যে ঢুকতে দিতে হবে।

তিনি আরো মন্তব্য করেছিলেন, ‘জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি শামিমা যুক্তরাজ্যে ফিরলে খতিয়ে দেখা যাবে’।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করলে, সুপ্রিম কোর্ট সর্বসম্মতিক্রমে রায় দেন যে, শামিমা বেগম এই মুহূর্তে যুক্তরাজ্যে ফিরতে পারবেন না। তাঁদের মতে, কোর্ট অব আপিল শামিমার ন্যায়বিচার পাওয়ার যে-অধিকার, সেটির ওজন মাপতে ভুল প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছে। এ জন্য ওরা ভুল রায় দিয়েছে। লর্ড রিডের ভাষায়:

“Court of Appeal had ‘mistakenly believed that, when anindividual’s right to have a fair hearing cameinto conflict with the requirements of national security, her right to a fair hearing must prevail’…. the right to a fair hearing did not trump all other considerations, such as the safety of the public’.”

অর্থাৎ, ন্যায়বিচার পাওয়ার যে অধিকার, সেটি গণমানুষের নিরাপত্তার সাথে সাংঘর্ষিক হলে, গণমানুষের নিরাপত্তার বিষয়টি প্রাধান্য পাবে।

এখানে ‘ন্যায়বিচার’ শব্দটিকে আমি ‘রাইট টু অ্যা ফেয়ার হিয়ারিং’ বা ‘উভয় পক্ষের সমান সুযোগ পাওয়ার অধিকার’ অর্থে ব্যবহার করেছি। শামিমার আইনজীবীদের যুক্তি ছিলো, আবেদনকারী সিরিয়ায় যে-ক্যাম্পে আছেন, সেখানে তার আইনজীবীদের যাওয়া সম্ভব নয়। এ জন্য আইনজীবীদের সাথে কথা বলার জন্য তাকে যুক্তরাজ্যে ঢুকতে দিতে হবে। কিন্তু সরকারের আশঙ্কা— শামিমা একবার যুক্তরাজ্যে ঢুকতে পারলে, তাকে যুক্তরাজ্য থেকে পুনরায় বের করা অসম্ভব হবে।

আইনজীবীর সাথে কথা বলার যে-অধিকার, সেটিও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার। সুপ্রিম কোর্ট এ অধিকার বাতিল করেননি। রায়ের আরেক জায়গায় লর্ড রিড মন্তব্য করেছেন:

“…the appropriate answer was not to force the government to bring Ms Begum back to the UK but to pause her legal fight over citizenship until sheisin a safer position to take partin her appeal….”

অর্থাৎ, যতোদিন পর্যন্ত না শামিমা একটি নিরাপদ পরিবেশ পাবেন (যেন আইনজীবীরা ওখানে গিয়ে তার সাথে দেখা করতে পারেন), ততোদিন পর্যন্ত নাগরিকত্ব নিয়ে শামিমার আইনি লড়াই স্থগিত থাকুক। এ লড়াইয়ে অংশ নিতে, আবেদনকারীকে যুক্তরাজ্যে আনতে সরকারকে বাধ্য করা যাবে না।

আমি জানি না শামিমা ভবিষ্যতে তার নাগরিকত্ব ফিরে পাবেন কি না, কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলো যে, একজন আইএস সদস্য, যুক্তরাজ্যের গণমানুষের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। সরল করে বললে, যেকোনো রাষ্ট্রের গণমানুষের জন্যই হুমকি। যুক্তরাজ্য সুপ্রিম কোর্টের রায়গুলোর সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ও আরো অনেক অঞ্চলের বিচারিক সিদ্ধান্তগুলোতে যুক্তরাজ্য সুপ্রিম কোর্টের জাজমেন্ট অনুসরণ করা হয়ে থাকে।

এখন এ হুমকিকে শামিমার যে-পোশাক (বোরকা), তার সাথে গুলিয়ে ফেলা ঠিক হবে কি না? অর্থাৎ বোরকা পরা কাউকে দেখলেই ভয় পাওয়া সমীচীন কি না? এ ক্ষেত্রে আমার উত্তর হলো- না।

পোশাক হিশেবে বোরকার দুটি আইডেন্টিটি রয়েছে। একটি ধর্মীয় বা রাজনীতিক, আরেকটি ব্যক্তিগত।

কয়েক দিন আগে, বোরকা কি ধর্মীয় কারণে পরা হয় নাকি ব্যক্তিগত কারণে পরা হয়, তা বুঝতে ফেসবুকে একটি জরিপ করেছিলাম। ইনবত্ত ও কমেন্টবডে অনেকেই জানিয়েছিলেন, ধর্মীয় কারণের পাশাপাশি ব্যক্তিগত কারণেও বোরকা পরা হয়। কারণ বোরকা পরে হুটহাট বের হয়ে যাওয়া যায়, কোনো সাজসজ্জার প্রয়োজন পড়ে না। কেউ রান্নাঘরে কাজ করছেন, তার জামা-কাপড় পরিপাটি নয়- এ অবস্থায় বোরকা পরে নিলে তিনি দ্রুত বাইরে যেতে পারেন।

কিন্তু শামিমা বেগমের বোরকা পরার কারণটি স্পষ্টত ধর্মীয় ও রাজনীতিক। তিনি যে-সংগঠনে যোগ দিয়েছেন, সে-সংগঠন নারীদেরকে বোরকা বা বোরকা-সদৃশ পোশাক পরতে বাধ্য করে। সংগঠনটির রাজনীতিক উদ্দেশ্য আছে। এ জন্য শামিমা বেগমের বোরকাটি কেবলই ধর্মীয় পোশাক নয়। এটি আইএসের রাজনীতিক পরিচয়ও বহন করে। আইএসের যারা পুরুষ সদস্য, তাদের পোশাকেরও রাজনীতিক গুরুত্ব রয়েছে। অর্থাৎ পোশাক এ ক্ষেত্রে অনেকটা ইউনিফর্মের ভূমিকা পালন করছে।

কিন্তু বোরকা, পাগড়ি, ও জোব্বা- এ পোশাকগুলো আইএস যোদ্ধাদের অঞ্চলে ইউনিফর্মের ভূমিকা পালন করলেও, সাধারণ সমাজে এগুলো রাজনীতিক পোশাক নয়। বিশ্বে কোটি কোটি মানুষ ধর্মীয় ও ব্যক্তিগত কারণে এসব পোশাক পরে থাকে। তাদের অধিকাংশের সাথেই আইএসের রাজনীতিক ইডিওলোজির কোনো সম্পর্ক নেই। এ জন্য শামিমা বেগমের পোশাককে, সার্বজনীনভাবে ‘ফোবিয়া’ হিশেবে বিবেচনা করার সুযোগ কম।

পুলিশ একটি বড়ো বাহিনী। কয়েকটি দেশে বাহিনীটির কিছু ছোটো অংশের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা যে সংখ্যাগরিষ্ঠ, এমন নয়। শামিমা বেগমদের মতোই তারা সংখ্যালঘু। বেশিরভাগ পুলিশই কমবেশি পেশাদারিত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করে থাকে। তবে ওই সংখ্যালঘু অংশটির কারণে, পুলিশের পোশাক দেখলে দৌড় দিতে হবে— এমন মানসিকতা নাগরিকদের জন্য ক্ষতিকর। এতে ভালো পুলিশদের মনোবল ভেঙে যায়, যা আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর সামাজিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি। সম্প্রতি একটি দেশে, পুলিশ দেখে আতঙ্কে পালাতে গিয়ে এক ব্যক্তি হার্ট এটাকে মৃত্যুবরণ করেছেন। এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যেন না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে ভালো পুলিশ সদস্যদেরকে উদ্যোগ নিতে হবে। ভীতিপ্রদর্শনমূলক আচরণ সম্পূর্ণ পরিহার করতে হবে। কারণ গণতন্ত্র দুর্বল হলে, সমাজে অন্য যেকোনো পোশাকের চেয়ে পুলিশের পোশাক অধিক ভয় তৈরির ক্ষমতা রাখে।

এ পর্যায়ে পোশাক দেখে ভয় না পাওয়ার একটি সীমানা নির্ধারণ করতে চাই। কৃষকদের কথাই ধরা যাক। কৃষকগণ যে-পোশাক আশাক পরেন, তা দেখে কেউ ভয় পেয়েছে, এরকমটি কোথাও শুনি নি। কোনো গার্মেন্টস কর্মীর পোশাক দেখে লোকজন ভয়ে পালিয়েছে, এমনটিও কানে আসে নি। ফলে বলা যায়, পোশাক পরা কোনো মানুষ কারও নিরাপত্তার জন্য হুমকি কি না, এটি নির্ধারিত হয় ওই পোশাক পরা মানুষদের গড় ক্ষমতা ও ইতিহাস দ্বারা। কৃষক এবং গার্মেন্টস শ্রমিক, এরা ক্ষমতাহীন শ্রেণীর মানুষ। এদের রাজনীতিক পরিচয় তুচ্ছ। এ জন্য তাদের পোশাক কোনো ভীতিকর রাজনীতিক পরিচয় বহন করে না। তারা নিজেদের মধ্যে মারামারি করলেও, সে-মারামারিকে রাজনীতিক মারামারি বা পলিটিক্যাল ভায়োলেন্স বলা যায় না।

কোনো ভায়োলেন্সের রাজনীতিক পরিচয় আছে কি না, তা নিশ্চিত হতে আমাদেরকে তাকাতে হবে ওই ভায়োলেন্সে অংশগ্রহণকারী এজেন্টদের দিকে। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে, মার্কিন ক্যাপিটলে যে-দাঙ্গা হলো, সে- দাঙ্গার রাজনীতিক পরিচয় আছে। কারণ দাঙ্গাটির যারা এজেন্ট বা লাঠিয়াল, তাদের সুস্পষ্ট রাজনীতিক পরিচয় ছিলো। রাজনীতিক পরিচয়ের সাথে জড়িত থাকে রাজনীতিক উদ্দেশ্য। রাষ্ট্রীয় কোনো বাহিনী যখন যুদ্ধে অংশ নেয়, তখন সে-যুদ্ধেরও রাজনীতিক পরিচয় থাকে। আল-কায়েদা, ইসলামিক স্টেট, শিবসেনা, বুকু হারাম, হোয়াইট সুপ্রিম্যাসিস্ট গ্রুপ- এ সংগঠনগুলোর সদস্যরা যখন ভায়োলেন্সে অংশ নেয়, তখন সে- ভায়োলেন্সেরও রাজনীতিক পরিচয় প্রকাশিত হয়। মানুষ বুঝতে পারে, এ সৈন্যরা অদম্য। শয়তান তাদেরকে ঘোড়া হিশেবে ব্যবহার করছে। ভিন্নমত ও ভিন্ন সংস্কৃতির, যে কেউ, তাদের নির্বিচার আক্রমণের লক্ষ্যবস্ত হতে পারে।

রাজনীতিক ভায়োলেন্সের যারা পার্টিসিপ্যান্ট বা অংশগ্রহণকারী, তারা যদি কোনো নির্দিষ্ট ডিজাইনের পোশাক পরেন, এবং এ পোশাক যদি তাদের সংগঠনের অধিকাংশের পোশাক হয়, তখন পোশাকটির রাজনীতিক আইডেন্টিটির পাশাপাশি একটি ভায়োলেন্ট বা ভীতিকর আইডেন্টিটিও তৈরি হয়। পোশাকের এ ভায়োলেন্ট আইডেন্টিটিই একসময় ফোবিয়াতে রূপ নেয়।

প্রশ্ন জাগতে পারে, পোশাকের যে-ভায়োলেন্ট আইডেন্টিটি, সেটি ঠিক কখন সমাজে ফোবিয়া বা ভীতির জন্ম দেয়?

এ প্রশ্নের উত্তরে ইতিহাসের বিষয়টি সামনে চলে আসে। মানুষ যদি একই সংগঠনের ব্যাপারে বারবার ভীতিকর সংবাদ পায়, তাহলে ওই সংগঠন থেকে সাবধান থাকার একটি চেতনা তাদের ভেতর প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম নেয়। এ চেতনা মূলত আত্মরক্ষার চেতনা, যা শত্রু শনাক্ত করতে সাহায্য করে। শত্রু শনাক্ত করা না গেলে, মানুষ শত্রু থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে না। এই শত্রু শনাক্তকরণ প্রক্রিয়ার অনেক উপায়ের একটি হলো- পোশাকের দিকে তাকানো।

হিটলারের বাহিনী যখন গণহারে ইহুদি নিধন শুরু করলো, তখন তা ইহুদি সমাজে মারাত্মক ভীতির সঞ্চার করেছিলো। এ ভীতি থেকেই জন্ম নিয়েছিলো নাজিদের প্রতি ইহুদিদের ফোবিয়া, যা ইহুদি সমাজে ধীরে ধীরে আত্মরক্ষার চেতনা সৃষ্টি করেছিলো। এ চেতনা থেকেই ইহুদিরা পোশাক দেখে শত্রু শনাক্ত করতো। নাজি ইউনিফর্ম দেখলেই তারা সতর্ক হয়ে উঠতো।

কিন্তু নাজি বাহিনী যদি একটি দুটি ইহুদি পাকড়াও করার পর ইহুদি ধরা বন্ধ করে দিতো, তাহলে ভায়োলেন্সের যে-ইতিহাস তৈরি হতো, তা ইহুদিদের মনে ফোবিয়া সৃষ্টি করতে পারতো না। কারণ ইহুদি সমাজ তখন ধরে নিতো, এগুলো বিচ্ছিন্ন গ্রেপ্তারের ঘটনা। কিন্তু যখন পরিষ্কার হলো যে, নাজিরা সিস্টেম্যাটিকলি ইহুদি নিধন শুরু করেছে, তখনই নাজি ইউনিফর্ম হয়ে উঠলো ফোবিয়া।।

যারা পলিটিক্যাল সাইকোলোজি পড়েছেন, তারা হয়তো ‘আউট-গ্রুপ’ ধারণাটির সাথে পরিচিত থাকবেন। ‘আউট-গ্রুপ’ কী? ‘আউট-গ্রুপ’ হলো কোনো সম্প্রদায়, যে-সম্প্রদায়কে আমরা এড়িয়ে চলি বা অপছন্দ করি; এবং কোনো কারণে ওই সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করি। একজন পাকিস্তানবিদ্বেষী ভারতীয়ের কাছে পাকিস্তান হলো আউট-গ্রুপ, ভারত হলো ইন-গ্রুপ। আবার একজন ভারতবিদ্বেষী পাকিস্তানির কাছে পাকিস্তান হলো ইন-গ্রুপ, ভারত হলো আউট-গ্রুপ। এরকম আউট-গ্রুপ বাংলাদেশেও আছে। আওয়ামী লীগ কর্মীরা বিএনপি-জামাতকে আউট-গ্রুপ মনে করে থাকে। বিএনপি কর্মীরাও আওয়ামী লীগকে বিবেচনা করে আউট-গ্রুপ। এক পক্ষের কাছে ‘জয় বাংলা’ আউট-গ্রুপের স্লোগান, এবং ‘মুজিব কোট’ আউট-গ্রুপের পোশাক। অপর পক্ষের কাছে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ আউট- গ্রুপের স্লোগান, এবং ‘মধ্যপ্রাচ্যের বেশভূষা’ আউট-গ্রুপের পোশাক।

একইভাবে নাজি ইউনিফর্ম ছিলো ইহুদিদের জন্য আউট-গ্রুপের পোশাক, যা দেখলে ইহুদিরা সতর্ক হয়ে উঠতো। পোশাক দেখে সতর্ক হওয়ার চেতনাটি সমাজে ধীরে ধীরে আসে, হুট করে নয়। কোনো আউট- গ্রুপের ইউনিফর্ম বা পোশাক তখনই ফোবিয়া হয়ে ওঠে, যখন এ পোশাক পরে কেউ একের পর এক ভীতিকর কাজ করতে থাকে। আমরা যেটিকে ‘আউট-গ্রুপ ডিজরিগার্ড’ বা ‘আউট-গ্রুপ ইনডিফারেন্স’ বলি, সেটি সে- সময় রূপ নেয় ‘আউট-গ্রুপ হোস্টালিটি’-তে। অর্থাৎ, যে-সম্প্রদায়কে আগে গুরুত্ব না দিয়ে বা আমলে না নিয়ে বা কেবল অপছন্দ করে চলতাম, সে- সম্প্রদায়কে হঠাৎ শত্রু ভাবতে শুরু করি।

আইএস যখন ২০১৫ সালে প্যারিসে হামলা চালিয়ে ১৩০ জন বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছিলো, তখন সারা বিশ্বে মুসলিম রিফুজিদেরকে সন্দেহের চোখে দেখার কিছু প্রবণতা তৈরি হয়েছিলো। কারণ আইএস যাদের দিয়ে এ হামলা চালিয়েছিলো, তারা ছিলেন রিফুজি। ফলে মুসলিম রিফুজিরা, পশ্চিমা সমাজে একটি আলাদা ‘আউট-গ্রুপ’ হিশেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলো। এ জন্য বেলজিয়ামে হামলার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প মন্তব্য করেছিলেন— ‘আমি হলে বর্ডার বন্ধ করে দিতাম। কোনো রিফুজি ঢুকতে দিতাম না।’ ট্রাম্পকে না হয় অনেকে পাগল বলেন, কিন্তু সিনেটর টেড ক্রুজ মন্তব্য ছিলো:

“We need toimmediately halt the flow of refugees from countries with a significant al Qaida oriSiS presence.”

অর্থাৎ, যেসব দেশে আল-কায়েদা ও আইএসের বড়োসড়ো কার্যক্রম আছে, সেসব দেশ থেকে রিফুজি নেয়া এখনই বন্ধ করতে হবে।

সিনেটর ক্রুজ ও ডোনাল্ড ট্রাম্প, ঝুঁকি মূল্যায়ন করতে গিয়ে যে-প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছেন, তার সাথে আমি একমত নই। কারণ এ-প্রক্রিয়ায় সত্যিকার রিফুজিদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। তবে রিফুজি বেশে আল- কায়েদা জঙ্গিদের প্রবেশ রোধ করতে, একজন রাজনীতিকের এ ধরনের মন্তব্য অস্বাভাবিক কিছু নয় (এ বিষয়ে এখানে আলোচনা করবো না, এতে মূল আলোচনা থেকে বিচ্যুত হতে পারি)।

প্রশ্ন উঠতে পারে, শিবসেনা বা হোয়াইট সুপ্রিম্যাসিস্ট গ্রুপের কর্মকাণ্ডে সিনেটর ক্রুজ ও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এমন মন্তব্য করেন না কেন? এর প্রধান কারণ- এ সংগঠনগুলোর ভায়োলেন্সের ইতিহাস। শিবসেনা ও হোয়াইট সুপ্রিম্যাসিস্ট গ্রুপের জঙ্গিপনা সাধারণত ডোমেস্টিক। তারা কেউ এক দেশ পেরিয়ে আরেক দেশে গিয়ে হামলা চালিয়েছে, এমনটি শোনা যায় না। এতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ধারণা হয়েছে, তাদের জঙ্গীকাজের ট্রান্সন্যাশনাল ইফেক্ট কম বা নেই। আবার নিউজিল্যান্ড ও কানাডায় মুসলিমদের ওপর যে-হামলাগুলো হয়েছে, সে হামলাগুলোর যারা পার্টিসিপ্যান্ট বা অংশগ্রহণকারী, তারা সংগঠিত নয়। তারা মূলত ব্যক্তি, যাদের কোনো সুস্পষ্ট রাজনীতিক আইডেন্টিটি নেই। ফলে তাদের ভায়োলেন্সকে পলিটিক্যাল ভায়োলেন্সের কাতারে না ফেলে, ফেলা হয় হেইট-ভায়োলেন্সের কাতারে। পলিটিক্যাল ভায়োলেন্সের চেয়ে হেইট- ভায়োলেন্সের পোশাক-ফোবিয়া তৈরির ক্ষমতা কম। কিন্তু কোনো সম্প্রদায় যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে, সমাজের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর ধারাবাহিকভাবে হেইট-ভায়োলেন্স সংগঠিত করে, তাহলে ওই হেইট- ভায়োলেন্স, পলিটিক্যাল ভালোলেন্সের সমান অথবা তার চেয়েও বেশি ফোবিয়া সৃষ্টি করতে পারে। ভারতের মুসলিমরা স্থানীয় হিন্দুদের দ্বারা, এবং বাংলাদেশের হিন্দুরা স্থানীয় মুসলিমদের দ্বারা, প্রায়ই এ ধরনের হেইট- ভায়োলেন্সের শিকার হচ্ছে। কোনো একটা উছিলা পেলেই মার মার কাট- কাট শুরু হয়ে যাচ্ছে।

এখানে লক্ষ রাখা প্রয়োজন, পারসোনাল হেইট আর পলিটিক্যাল হেইট এক জিনিস নয়। আমি হেইট-ভায়োলেন্স বলতে এখানে যা বুঝিয়েছি, তা মূলত পারসোনাল হেইট। পারসোনাল হেইট বা ব্যক্তিগত ঘৃণা— এটি কারও ঘাড়ে ভর করে একসাথে একশো মানুষ মেরে ফেললেও এর ফোবিয়া তৈরির ক্ষমতা সামান্য। ২০১১ সালে নরওয়েতে, ব্রেইবিক নামের এক জঙ্গি, বোমা ও বন্দুক হামলা চালিয়ে ৭৭ জনকে হত্যা করেছিলো। এ হামলা সে অভিবাসন ও ইসলামবিদ্বেষ থেকে চালিয়েছিলো। ব্রেইবিকের কোনো ডিস্টিংক্ট রাজনীতিক আইডেন্টিটি ও ডিস্টিংক্ট ইউনিফর্ম ছিলো না। তার হামলাটি যদি রাজনীতিক কোনো সংগঠনের ক্রমাগত হামলার অংশ হতো, তাহলে এটি নরওয়ের সমাজে বড়ো ধরনের ফোবিয়া তৈরি করতে পারতো।

সুতরাং বলতে পারি, ভায়োলেন্সে অংশগ্রহণকারীদের রাজনীতিক আইডেন্টিটি থাকলে, এবং এ আইডেন্টিটি কোনো নির্দিষ্ট পোশাক দ্বারা প্রকাশিত হলে, সে-পোশাকের ফোবিয়া তৈরির সক্ষমতা আছে। এ ভায়োলেন্স যদি ডোমেস্টিকও হয়, অর্থাৎ কোনো ট্রান্সন্যাশনাল ইফেক্ট যদি এর না-ও থাকে, তাহলেও সেটি ফোবিয়া তৈরি করতে পারবে। যেমন ভারতীয় শিবসেনার জঙ্গি কর্মকাণ্ড। শিবসেনা সদস্যদের ডিস্টিংক্ট পলিটিক্যাল আইডেন্টিটি আছে, যা তাদের বেশভূষার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। ফলে ভারতীয় মুসলিম সমাজে, শিবসেনার পোশাক ও স্লোগান ফোবিয়া তৈরি করার ক্ষমতা রাখে।

একইভাবে আল-কায়েদা বা আইএসের পোশাকেরও অমুসলিম সমাজে ফোবিয়া সৃষ্টির ক্ষমতা আছে। এমনকি এ ফোবিয়ার আন্তর্জাতিক ব্যাপ্তি থাকতে পারে, কারণ এ দুটি সংগঠনের হামলা কোনো নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলে সীমাবদ্ধ নয়। এদের রাজনীতিক আইডেন্টিটিও ডিস্টিংক্ট। ফলে সহজেই তাদের কার্যক্রমের রাজনীতিক পরিচয় শনাক্ত করা যায়। কোনো সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীর রাজনীতিক মতলব সহজে শনাক্ত করা গেলে, তাদের দ্বারা সৃষ্ট আশঙ্কাকেও সহজে শনাক্ত করা যায়। এ জন্য সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলো অন্যদের চেয়ে দ্রুত ফোবিয়া তৈরি করতে পারে।

এখানে আরেকটি ব্যাপার একটু উল্লেখ করতে চাই। আনুষ্ঠানিক যুদ্ধে যারা অংশ নেন, অর্থাৎ পেশাদার সেনা হিশেবে যারা বিভিন্ন রাষ্ট্রের হয়ে খুনোখুনি করেন, তাদের কর্মকাণ্ড সমাজে ফোবিয়া তৈরি করতে পারে না কেন? বা পারলেও, তা এতো দুর্বল কেন? এর কারণ হলো, যুদ্ধাবস্থার যে- ভায়োলেন্স, তার একটি ভৌগোলিক সীমা থাকে। এটি বিচ্ছিন্ন কোনো ভয় সৃষ্টিকারী হামলা নয়। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে দাঙ্গা চললেও, ফিলিস্তিনিদের প্রতি পশ্চিমা সমাজে তেমন কোনো ফোবিয়া কাজ করে না। এর কারণ, সমাজ জানে যে ফিলিস্তিনিরা একটি আনুষ্ঠানিক যুদ্ধে লিপ্ত, এবং এ যুদ্ধ কেবল একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। কোনো ফিলিস্তিনি যোদ্ধা, ইসরায়েল ব্যতীত অন্য কোনো রাষ্ট্রে ইনডিস্ক্রিমিনেট বা নির্বিচার হামলা চালিয়েছে, এমন ধারাবাহিক ইতিহাস পাওয়া যায় না। ফলে, কোনো ফিলিস্তিনিকে দেখলে ইউরোপীয় বা আমেরিকান সমাজের কেউ অনিরাপদ বোধ করেন না। একই কারণে, ইসরায়েলিদের প্রতিও তাদের কোনো ফোবিয়া কাজ করে না।

আমেরিকানদের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। সমাজ ধরে নিয়েছে যে, আমেরিকা বা ব্রিটেন কাউকে মারলে, যুদ্ধ ঘোষণা করেই মারবে। এ কারণে কোনো আমেরিকান সৈন্য, কোথাও ইনডিস্ক্রিমিনেট হামলা চালিয়ে সিভিলিয়ান নাগরিক হত্যা করবে, এ আতঙ্ক সমাজে বিরাজ করে না। ফলে, আমেরিকান সৈন্যদের প্রতি সমাজে উল্লেখযোগ্য কোনো ফোবিয়াও নেই। এ কথা মোটামুটি সকল দেশের সামরিক বাহিনীর ক্ষেত্রেই সত্য (যদি এক দেশের সাথে আরেক দেশের যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব না থাকে)।

কিন্তু এ বাহিনীগুলো কোনো সমাজে নাজি বাহিনীর মতো ভীতি সৃষ্টি করলে, তাদের পোশাক ওই সমাজে ফোবিয়া তৈরি করতে পারবে। যেমন ইরাকে যখন যুদ্ধাবস্থা চলমান ছিলো, তখন ইরাকে মার্কিন সেনাবাহিনীর পোশাক ছিলো একটি ফোবিয়া। এ ফোবিয়া বা ভীতির একটি ভৌগোলিক সীমানা আছে। এ সীমানার কারণে একই বাহিনী যখন দক্ষিণ কোরিয়ায় অবস্থান করে, তখন দক্ষিণ কোরিয়ানরা ফোবিয়ায় আক্রান্ত হয় না। অর্থাৎ তারা জানে যে, মার্কিন বাহিনী বাগদাদে বিপজ্জনক হলেও সিউলে বিপজ্জনক নয়।

আমাদের মনে রাখতে হবে, ফোবিয়া একপ্রকার আবেগ বা ইমোশান। বলা যেতে পারে, এটি নেগেটিভ ইমোশান। এ ইমোশান র‍্যাশোনাল বা যৌক্তিক হতে পারে, আবার ইর্যাশোনাল বা অযৌক্তিকও হতে পারে। কোনো ফোবিয়া যৌক্তিক কি না, তা বুঝার একটি সাধারণ উপায় হলো- আমি যে ‘আউট-গ্রুপ’-কে ভয় পাচ্ছি, সে ‘আউট-গ্রুপ’-এর আনুমানিক কতো শতাংশ সদস্য আমার নিরাপত্তার জন্য হুমকি, তা জানা। যদি দেখা যায়, ওই ‘আউট-গ্রুপ’-এর অধিকাংশ বা একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্যের ভায়োলেন্সে অংশগ্রহণের ইতিহাস আছে, তাহলে আমার ফোবিয়াটি র‍্যাশোনাল মাত্রা পাবে। তখন নিজেকে রক্ষার জন্য আমি ওই ‘আউট-গ্রুপ’-এর সদস্যদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করবো, এবং এ সময় পোশাক খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। হিটলার ও স্তালিনের পুলিশ, এবং এশিয়ার একটি দেশের বিশেষ বাহিনীর ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেছিলো। ফিলিস্তিনে এই মুহূর্তে ইসরায়েলের পুলিশ বাহিনীর ক্ষেত্রেও এটি ঘটছে। সাধারণ ফিলিস্তিনিরা, ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর পোশাক পরা কাউকে দেখলে আত্মরক্ষার তাগিদে সতর্ক হয়ে উঠছে। একইভাবে পশ্চিমা অনেক দেশে, র‍্যাশোনাল বা ইর্যাশোনালভাবে, আল-কায়েদা ও আইএসের পোশাক পরা কাউকে দেখলে মানুষ সতর্ক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। এটি বাংলাদেশেও ঘটছে। অনেককে পেয়েছি, যারা ফেসবুকে বাঙালি তরুণের নাম আরবি হরফে দেখলে, বা আইএস-সদৃশ পোশাক পরা কোনো প্রোফাইল থেকে বন্ধুত্বের আহ্বান আসলে, ভয়ে তা গ্রহণ করেন না।

২০.

খেলার কাজ আনন্দ দেয়া— এমন ধারণা ক্ষমতাহীন মানুষদের জন্য আত্মঘাতী। কোনো কিছু থেকে আনন্দ লাভ করা, আর তাতে বুঁদ হয়ে থাকা- এ দুটি এক জিনিস নয়। খেলাধুলার বড়ো অনুষ্ঠানগুলোতে সাধারণ মানুষের কোনো অংশগ্রহণ থাকে না। এ অংশগ্রহণ একচেটিয়াভাবে রাষ্ট্রের দখলে। খেলা আয়োজনের যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, তার রাজনীতিক ও ব্যবসায়িক গুরুত্ব রয়েছে। পাকিস্তানের ইমরান খান ও লাইবেরিয়ার জর্জ ওয়েহ, সফলভাবে খেলার জনপ্রিয়তাকে রাজনীতিক জনপ্রিয়তায় রূপদান করেছেন। দেশগুলোতে তারা এখন প্রেসিডেন্ট (২০২২)।

বাংলাদেশেও এ কাজে অনেকে সফলতা দেখিয়েছেন। মাশরাফি বিন মর্তুজা, আরিফ খান জয়, তারা জনগণকে খেলা খাইয়ে এমপি ও প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন। গণতন্ত্রে এটি দোষের কিছু নয়। আবার রাজনীতিক হিশেবে তারা উপযুক্ত নন, এমন দাবিও আমি করছি না। খেলার মতো রাজনীতিতেও তারা সমান পারদর্শী হতে পারেন। এটি একটি সম্ভাবনা মাত্র। নাটক সিনেমা থেকে আসা রাজনীতিকদের ক্ষেত্রেও এ কথাই বলবো। তবে আইনপ্রণেতা হিশেবে তাঁদের গুণগত মান ভালো কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার।

খেলার মাদকীয় গুণাবলি আছে কি না- এ প্রশ্ন অনেকের মনে জাগতে পারে। কোনো কর্মকাণ্ড মানুষের স্বাভাবিক বিচার-বুদ্ধিকে প্রভাবিত করতে পারলে, সেটিকে আমরা মাদক বলতে পারি। এ ক্ষেত্রে খেলা, সিনেমা, রসালো ওয়াজ, কিশোর থ্রিলার- এগুলোর মাদকীয় গুণাবলি

আছে। মানুষ দীর্ঘ সময় এগুলোর সংস্পর্শে থাকলে, সে আর মানুষ থাকে না। পরিণত হয় মোহাবিষ্ট জীবে। তার বিচার-বিবেচনাবোধ লোপ পায়। কিছুদিন আগে এর নমুনা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দেখা গিয়েছে। দুই তরুণ, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা নিয়ে মারামারি করে একে অন্যের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। ব্যান্ডেজে ভরিয়ে তুলেছে পরস্পরের নাক-মুখ।

শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়া নয়, ২০২১ সালের ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপে, ইংল্যান্ড যখন ইতালির কাছে টাইব্রেকারে হারে, তখন ভক্ত নামক খেলাসেবীরা ইতালি সমর্থকদের ওপর নির্বিচার হামলা চালিয়েছিলো।

এখানে নেশা ও আনন্দ- এ দুটির মাঝে আমি একটু পার্থক্য নির্ধারণ করতে চাই। আনন্দ হলো বেদনার এমন অনুপস্থিতি, যা মানুষের স্বাভাবিক চেতনাকে উদ্দীপ্ত করতে পারে। একই সাথে, এ উদ্দীপনা মানুষের মনে একপ্রকার ক্রোধহীন হাসির জন্ম দিতে পারে। অন্যদিকে নেশা হলো বেদনা লাঘবের, বা আনন্দ পাওয়ার, এমন সব অভ্যাস, যা চরিতার্থ না হলে মনে ক্রোধ ও হতাশার সৃষ্টি হয়।

নেশা থেকে তৈরি ক্রোধ ও হতাশা, মানুষকে পরাধীন করার ক্ষমতা রাখে। যেকোনো পরাধীন মানুষ রাজনীতিকভাবে ব্যবহৃত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। মাশরাফির খেলা দেখে তার ভক্তদের মনে যে-নেশা তৈরি হয়েছে, সে-নেশা তাদেরকে মাশরাফির অধীন করে দিয়েছে। এ কথা মেসি বা রোনালদো ভক্তদের জন্যও প্রযোজ্য। মেসি ও রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ, বাংলাদেশে কোথাও ভোটে দাঁড়ালে, হামিদ সাহেব পাস করতে পারবেন বলে মনে হয় না। মেসির মদ খেয়ে এ অঞ্চলে অনেকেই বেহুঁশ। আমি লক্ষ করেছি, ঢাকার কোনো হাসপাতালের আহাজারির চেয়ে মেসির একটি হাঁচি এখানে বেশি শোরগোল তোলার ক্ষমতা রাখে। এ বিষয়ে কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটি জরিপ করেছিলাম, এবং জরিপের ফলাফল আমার ধারণাকে সমর্থন করেছে।

খেলার আনন্দের স্তরটি খুব উঁচু নয়। একটু অসাবধান হলেই এ স্তর পেরিয়ে আপনি পৌঁছে যেতে পারেন নেশার স্তরে। আনন্দের স্তরের চেয়ে নেশার স্তরটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কোনো দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ এ স্তরে ঢুকে গেলে, সেটির কিছু রাজনীতিক ও ব্যবসায়িক উপযোগিতা তৈরি হয়। এ উপযোগিতা নেশাগ্রস্ত মানুষ ধরতে পারে না। ধরতে পারে তারা, যারা এটি থেকে লুটবে একের পর এক অশুভ ফায়দা।

আপনি যখন খেলার আনন্দের স্তরে থাকবেন, তখন আপনার ভেতরে থাকবেন আপনি। বিধ্বংসী শয়তান ওখানে থাকবে না। খেলার মুহূর্তগুলোকে আপনি উপভোগ করবেন সুখ ও দুঃখের নির্মল উপকরণ হিশেবে। কিছুটা উত্তেজিত হয়তো হবেন, তবে সে-উত্তেজনা কারও মাথায় বাড়ি দেয়ার উত্তেজনা হবে না। এ উত্তেজনা শরীরকে মনের উচ্ছ্বাসের সাথে দুলিয়ে নেয়ার উত্তেজনা। মাঝেমধ্যে একটু-আধটু আফসোসের আগুন জ্বলবে, কিন্তু এ আগুন আপনার পাশে বসা মানুষটিকে এক হাত দেখে নেয়ার উপলক্ষ হবে না। কোনো খেলোয়াড়কে আপনার ভালো লাগতে পারে, ধীরে ধীরে তার প্রতি কিছুটা ভক্তিও আসতে পারে, কিন্তু সে-ভক্তি আপনার বিচার-বুদ্ধির গালে চড় লাগাবে না। আপনার মনে হবে- আমি বোধ হয় সেই কলেজগামী বালিকাটির একশো অনুরাগীর একজন, যার খবর কোনোদিন সে জানবে না।

তবে যখনই খেলার আনন্দের স্তর অতিক্রম করে নেশার স্তরে প্রবেশ করবেন, তখন আপনি আর আপনি থাকবেন না। আপনি হয়ে উঠবেন শয়তানের হাতের খুঁটি। কেউ রোনালদোর প্রশংসা

করলে রাগ করবেন, মেসির নিন্দা করলে তার মাথা ফাটিয়ে দিতে চাইবেন, আর্জেন্টিনাকে ‘আর জিতি না’ বললে লাঠির সন্ধান

করবেন, ব্রাজিলকে ‘সেভেন-আপ’ ডাকলে চোখ লাল করবেন, এবং ক্রিকেট খেলায়, বাংলাদেশি কোনো তরুণ পাকিস্তানের পক্ষ নিলে, তার কবর খুঁড়তে চাইবেন। অর্থাৎ আপনার আচরণ হয়ে উঠবে মধুর ঘ্রাণ পাওয়া ভাল্লুকের মতো।

এ অবস্থায় খেলার একটি পলিটিক্যাল ইউটিলিটি তৈরি হবে। যা ছিলো শুধুই খেলা, তা হয়ে উঠবে রাজনীতিক অস্ত্র। খেলার আয়োজকরা তখন ভাল্লুকদেরকে খেলার মেশিনে ঢুকিয়ে দিয়ে আড়ালের কাজগুলো সম্পাদন করবে। এ আড়ালের কাজের খবর, খেলা খাওয়া মাতালদের পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব নয়।

২১.

আমার গ্রামে যে ঈদগাটি আছে, সেটির ঠিক পূর্ব দিকে গোরস্থান। একবার নামাজ শেষে ইমাম সাহেব দোয়া করছিলেন। তার মুখ ছিলো গোরস্থানের দিকে ঘোরানো। অর্থাৎ ভদ্রলোক হাত তুলেছিলেন পূর্বমুখী হয়ে। আমার অবস্থান ছিলো ঈদগার ঠিক মাঝখানে। আমিও ইমাম সাহেবের দেখাদেখি গোরস্থানমুখী হয়ে হাত ওঠালাম। এমন সময় একটি ঘটনা ঘটলো। এক তরুণ, মোনাজাত চলার সময়েই উচ্চৈঃস্বরে হাঙ্গামা শুরু করলো- “দোয়া করতে হবে কেবলামুখী হয়ে, কেবলা পেছনে রেখে গোরস্থানের দিকে মুখ দেয়ার নিয়ম আপনারা কোথায় পেয়েছেন?’

তরুণটি ছিলো আমার ঠিক সামনে বসা। সে ও তার কিছু বন্ধুবান্ধব মিলে পশ্চিমমুখী হয়ে দোয়া করতে লাগলো, এবং দোয়ার ফাঁকে ফাঁকে বলতে লাগলো— ‘আপনারা সবাই পশ্চিম দিকে মুখ ঘোরান। পূর্ব দিকে মুখ থাকলে দোয়া হবে না।’

তরুণটির কথা দ্রুতই অনেকের মনে সংক্রমিত হলো। মুসল্লিরা ভাগ হয়ে গেলো দুই ভাগে। এক ভাগের মুখ পশ্চিম দিকে তাক করা, আরেক ভাগের মুখ পূর্ব দিকে।

আমি পড়ে গেলাম বিপদে। কোন দলে যোগ দেবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ইমাম সাহেব এবং ওই তরুণ, দুজনই আমার স্নেহের মানুষ। পূর্ব দিকে মুখ করলে তরুণটির সাথে চোখাচোখি হয়ে যায়, পশ্চিম দিকে মুখ করলে চোখ পড়ে যায় ইমামের দিকে। অগত্যা মুখ ঘোরালাম পূর্ব ও পশ্চিম দিকের মাঝ বরাবর। অর্থাৎ কোনাকুনি। আমার দলে কেউ যোগ দিলো না।

মোনাজাত শেষে দুই পক্ষের মধ্যে শুরু হয়ে গেলো হট্টগোল। কামের পূর্বরাগ যেমন প্রেম, তেমনি হট্টগোল হলো বাঙালির হাতাহাতির পূর্বরাগ। বাঙালি কোথাও হট্টগোল শুরু করলে দর্শকদের নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে হয়। তাই আমি একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালাম।

ঢিল ছোড়াছুড়ির মতো মাসালা ছোড়াছুড়ি হতে লাগলো। বুখারি, বায়হাকি, ইবনে মাজাহ ও আরো অনেক কিতাবের নাম, উভয় পক্ষ হতে উচ্চারিত হতে থাকলো। কিন্তু হট্টগোল থামলো না। বুঝতে পারলাম, কিতাব ব্যর্থ হতে চলেছে— অর্থাৎ যেকোনো মুহূর্তে তশরিফ আনতে পারে শয়তান। আমি আরো একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালাম।

অমনি শুরু হয়ে গেলো ঘুষাঘুষি। প্রথম ঘুষিতেই গোরস্থানমুখী একজনের নাক ফেটে গেলো। এ দৃশ্য দেখে গোরস্থানমুখীরা কেবলামুখী একজনের মাথা ফাটিয়ে দিলো।

প্রায় আধা ঘণ্টা পর, আট-দশ জনকে হাসপাতালে পাঠিয়ে শয়তান বিদায় হলো।

আমি গ্রামবাসীকে বললাম- দেখুন, পৃথিবী গোল। আপনারা যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, সেখান থেকে পূর্ব ও পশ্চিম, উভয় দিক ধরে হেঁটেই কাবায় পৌঁছানো সম্ভব। দুটি পথই বাঁকা, পূর্ব দিকেরটা একটু বেশি বাঁকা, কিন্তু কোনোটিই সোজা নয়। বিষয়টি আপনাদের বুঝতে অসুবিধা হতে পারে, কিন্তু আল্লাহর বুঝতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আপনাদের উভয় দলের মোনাজাতই হয়েছে।

এ সময় একজন আমাকে বললো- আমাদের মোনাজাত হলেও আপনার মোনাজাত হয়নি। আপনি যেদিকে মুখ করে দোয়া করেছেন, সেদিকে হিন্দুপাড়া। আপনি মন্দির সামনে রেখে দোয়া করেছেন।

আমি বললাম, কাবা যাওয়ার পথে আপনাদের সামনেও অনেক মন্দির- গির্জা পড়েছে।

২২.

‘আল্লাহর সৈনিক’, কথাটি অত্যন্ত আপত্তিকর। এর চেয়ে বড়ো আল্লাহ্- বিরোধী কথা আর হয় না। যারা দাবি করেন- আমরা আল্লাহ্ সৈনিক, তারা মূলত আল্লাহকে তাদের মতোই মানুষ মনে করেন। তাদের ধারণা- আল্লাহ্ বুঝি কোনো অত্যাচারী রাজা, যিনি তাঁর রাজ্য রক্ষার ভার পৃথিবীর কিছু তুচ্ছ মানুষের কাঁধে দিয়েছেন। তারা এটুকুও বুঝতে পারেন না, যিনি মহাবিশ্বের দেখভাল করতে জানেন, তিনি নিজের সম্ভ্রমও নিজে রক্ষা করতে পারেন। এ কাজে তাঁর পৃথিবী থেকে সৈন্য নিয়োগ দেয়ার দরকার নেই।

সৈন্য দরকার মানুষের। আল্লাহর নয়। সৈন্যদের কাজ মারদাঙ্গা ও খুনোখুনি বাধানো, যা আল্লাহর পছন্দ হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সৈনিকদের ধারণা, গণ্ডগোল বুঝি আল্লাহর খুব পছন্দের কাজ। এক লাখ বছরেও আল্লাহ্ কোনো মানুষের মাথায় একটি বাড়ি দেননি, কিন্তু সৈনিকেরা প্রতিদিন আল্লাহর নাম ভাঙিয়ে একে ওকে বাড়ি মারছে।

আল্লাহর চাওয়া ছিলো অনুগত বান্দা, আর সৈনিকেরা সেজেছে উদ্ধত বান্দা। আল্লাহ্ কোনো কথাকেই তারা তোয়াক্কা করছে না। আল্লাহ্ যদি বলেন ‘পড়ো’, তারা শোনে- ঘুমিয়ে থাকো। পড়াশোনার মতো পরিশ্রমের কাজ তারা করতে রাজি নয়। দুই লাইন ফেসবই ও গুগল পড়ে এরা ধরে নেয়- পড়ালেখা হয়ে গেছে। যাই, কোথাও একটু পড়ালেখাটা ফলিয়ে আসি।

কেউ কেউ এক-দুইটি কিতাবের বাইরে আর কিছু পড়তে রাজি নয়। কারণ বেশি পড়লেই এরা বুঝে যাবে যে এতোদিন তারা আল্লাহ্ বিরুদ্ধে কাজ করে এসেছে। আল্লাহ্ যে সৈনিক চান না, বান্দা চান, এটি বুঝে ফেলার ভয় থেকেই ওরা পড়াশোনা থেকে দূরে থাকতে চায়। এতে অবশ্য শয়তানের খুব সুবিধা হয়। শয়তান তাদের কানে কানে বলতে থাকে, তুমি ঠিক পথেই আছো। তুমি তোমার সৈনিকগিরি চালিয়ে যাও। সৈনিকরা শয়তানের এই আওয়াজকে আল্লাহ্ আওয়াজ মনে করে অনলাইন- অফলাইনে তাদের লাঠিসোটা বৃদ্ধি করে চলছে।

আল্লাহ্ বলেছিলেন, আমি কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করবো না, যতোক্ষণ পর্যন্ত না ওই জাতি নিজেদের অবস্থা নিজে পরিবর্তন করে*। কিন্তু সৈনিকরা আল্লাহর কথা না শুনে সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকে আসমানের দিকে। পরিশ্রমের চেয়ে দোয়া-দরুদে তাদের অধিক আস্থা। এতে শয়তান খুব আনন্দ অনুভব করে। শয়তান বলে- তোরা আজীবন আমার সৈনিক হয়ে থাক! শ্রমহীন দোয়াই তো আমি চাই!

আল্লাহ্ বেকুবদের কখনো সাহায্য করেন না। ইতিহাসে একটিও প্রমাণ পাওয়া যাবে না, যেখানে আল্লাহ্ কোনো বেকুবের পক্ষ নিয়েছেন। কিন্তু সৈনিক নামক বেকুবদের ধারণা, আল্লাহ্ নিশ্চয়ই বেকুবদের বন্ধু। তারা জানে না, আল্লাহ্ তাদের জন্য ঘোষণা করে রেখেছেন- আমার পাকড়াও অত্যন্ত কঠিন*।

একবার এক সৈনিক, আমাকে নিয়ে গেলো তার পীরের কাছে। গিয়ে দেখি, পীর একজনকে মুরিদ বানাচ্ছেন। ব্যক্তিটিকে পীর নির্দেশনা দিচ্ছেন, মুরিদ হতে হলে এই এই কাজ করতে হবে:

এক জোড়া লাল রঙের মোরগ ও দুই কেজি মিষ্টি দিতে হবে। কোনো বছর ওরস মিস করা যাবে না। ওরসে গরু অথবা খাসি আনার চেষ্টা করতে হবে। ধানের মৌসুমে এক মণ ধান খানকা শরিফের জন্য তুলে রাখতে হবে। অসুখ-বিসুখ হলে দাওয়াইয়ের জন্য পীরের কাছে আসতে হবে।

পীর লোকটিকে আশ্বাস দিলেন– “তোমাকে সাথে না নিয়ে আমি কখনো বেহেশতে পা রাখবো না, এবং আমি থাকতে তোমার গায়ে আল্লাহ্ একটি ফুলের টোকাও দিতে পারবেন না। মুর্শিদের ওপর ভরসা রাখো।

আরেক সৈনিককে দেখলাম, সারাদিন ইউটিউবে ওয়াজ শোনেন। আমি বললাম, ইউটিউবে ওয়াজ শোনা কি জায়েজ? তিনি বললেন, অবশ্যই জায়েজ। আপনিও দেখুন- এই বলে আমাকে একটি ওয়াজ শোনানোর জন্য প্লে বাটনে ক্লিক করলেন, আর অমনি শুরু হলো পাঁচ সেকেন্ডের ‘অশ্লীল’ টিকটক বিজ্ঞাপন!

আমি বললাম, ইউটিউবে ওয়াজ শোনা জায়েজ তাদের জন্য, যাদের পেইড সাবস্ক্রিপশন রয়েছে। অন্যথায় ইসলামি বৃত্তের ভেতরে থেকে, আপনার ওয়াজ শোনা জায়েজ হবে মনে হয় না। এমনকি পেইড সাবস্ক্রিপশন থাকলেও কাজটা কঠিন হবে। কারণ অটোমেটিক প্লে লিস্টে ধার্মিক ও অধার্মিক ভিডিও স্বয়ংক্রিয়ভাবে একসাথে চলে আসতে পারে। ভিডিও সাজেশনে, আহমাদুল্লাহ সাহেব ও সানি লিওনের ভিডিও পাশাপাশি অবস্থান নিতে পারে। তখন একটিতে চোখ না দিয়ে আরেকটি দেখা সম্ভব হবে না। এ কথা ফেসবুকের ক্ষেত্রেও সত্য।

আল্লাহর বান্দা চরিত্রে জুন্দুশ শয়তানদের অভিনয় চমৎকার। তারা ভাবে, আল্লাহ্ নিশ্চয়ই আমাদের মতো চালাক নন। তিনি আমাদের অভিনয় ধরতে পারবেন না। আল্লাহর নির্দেশনা ছিলো- তোমরা এক থাকো। কিন্তু সৈনিক সাজতে গিয়ে, তারা হয়ে গেছে বিভাজিত। ছোটো শয়তান, মাঝারি শয়তান, বড়ো শয়তান- এরকম নানা গোত্রে তারা ভাগ হয়ে গেছে। এক ভাগ আরেক ভাগকে ফতোয়া দিচ্ছে- তোমরা জাহান্নামি।

আল্লাহ্ যে দোজখিদেরকে আগুনের কাঁটা খাওয়ানোর কথা বলেছেন* সেটি এই সৈনিকদের কথা মাথায় রেখেই বলেছেন। কারণ যারা পৃথিবীতে খেয়েছে মানুষের কাঁটা, তারা যদি দোজখে এসে দেখে খাওয়ার মতো কাঁটা নেই, তাহলে হাঙ্গামা শুরু করে দেবে।

সৈনিকরা মনে করে, আল্লাহ্ তাদের নিজস্ব সম্পত্তি। তারা ছাড়া আল্লাহর ওপর ভাগ বসানোর অধিকার কারও নেই। ক্ষেতের আইল নিয়ে মারামারি করা জাতি, আল্লাহকেও যে ক্ষেতের আইলই মনে করবে, তা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু আল্লাহ্ কারও ক্ষেতের আইল নন। তিনি সমস্ত সৃষ্টিকুলকেই তাঁর জমির ভাগ দিয়েছেন। এ জমি শিয়া সৈনিকেরা শিয়াদের, আর সুন্নি সৈনিকেরা সুন্নিদের দাবি করলে আল্লাহর কী করার আছে? আল্লাহ্ কি এতো অবসর যে সারাদিন কীটপতঙ্গের দাঙ্গা নিয়ে মাথা ঘামাবেন? যেদিন সৈনিকরা দোজখে ঢুকে দেখবে, তাদের চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে*, তখন বুঝবে- আরে, আমরা এতো নামাজ-কালাম পড়েও তাহলে শয়তানের অনুসারী ছিলাম?

দোজখ বলবে, হ্যাঁ, তোমরা নিজেদের মধ্যে যে পরিমাণ দাঙ্গা-ফ্যাসাদ করেছো, যে পরিমাণ ফতোয়া দিয়েছো, যে বিপুল মিথ্যা ছড়িয়েছো, তাতে তোমরা আর আল্লাহর দলে থাকোনি। তোমরা হয়ে উঠেছিলে হিজবুশ শয়তান। তোমরা ইবনে রুশদকে আল্লাহ্ বান্দা মনে করোনি, আব্দুস সালামকে আল্লাহর বান্দা মনে করোনি, তোমরা আল্লাহর বান্দা মনে করেছো শুধু তাদেরকে, যারা তোমাদের সৈনিকগিরির প্রশংসা করেছে। তোমরা বহু আল্লাহ্ বান্দাকে নাস্তিক-মুরতাদ উপাধি দিয়েছো, যদিও বুঝোনি যে তোমরা নিজেরাই নাস্তিক। কিন্তু তাও ঠিকমতো হতে পারোনি। দাঙ্গাবাজ অসৎ আস্তিকের চেয়ে শান্তিপ্রিয় সৎ নাস্তিকের দাম যে আল্লাহর কাছে বেশি, এ খবর তোমরা রাখোনি।

দোযখের কথা শুনে শয়তান মিটিমিটি হাসবে, আর বলবে- হে জুন্দুশ শয়তান, ফেসবুকে মারামারি করে যা আয় করেছো, তার ফসল এখন বুঝে নাও। ফসলের রূপ দেখে, সৈনিকরা আল্লাহকে খুব খুঁজবে। কিন্তু আল্লাহ্ ততোক্ষণে অন্য কাজে মনোযোগ দেবেন। তারা বলতে থাকবে, হে আল্লাহ্, আমাদেরকে আরেকবার পৃথিবীতে পাঠান। আমরা আগের পাপগুলো আর করবো না।

অনেক বছর আগুনে পুড়ে ছাই হওয়ার পর আল্লাহ্ যখন বিরক্ত হয়ে একটু রাজি হবেন, তখনই ওরা বলবে- না, না, না, বাংলাদেশে না, আমাদেরকে এবার আমেরিকাতে পাঠান। বাংলাদেশে পাঠালে পুনরায় আমরা একই কাজ করবো।

২৩.

মানুষের বুদ্ধি নিয়ে আমার প্রথম সন্দেহ জেগেছিলো ঢাকা যাওয়ার পর। ঢাকা গিয়ে শুনি, এক টুকরো জমির দাম একশো কোটি টাকা। কিন্তু সুনামগঞ্জে ওই দামে একটি হাওড় কেনা যাবে।

ঢাকায় জমির এতো দাম কেন? এ জমিতে কী কী ফলে?

কিছুই ফলে না, শুধু বিল্ডিং ফলে। ঢাকার মানুষ বিশ্বাস করে, বিল্ডিংই ঈশ্বর। যার বিল্ডিং নেই, তার দাম দুই আনা।

বাবাকে জিগ্যেস করলাম, আমাদের যে ছাড়া-বিছরাটি আছে, সেটির দাম কতো হবে? বাবা বললেন, কুড়ি হাজার তো হবেই।

যে জমিতে মরিচ ফলে, পেঁয়াজ ফলে, ধনেপাতা ফলে, রসুন ফলে, ফুলকপি ফলে, পুঁইশাক ফলে, এবং মানুষ যা যা খায় তার সবই ফলে, সে জমির দাম মাত্র কুড়ি হাজার? আর যে জমিতে শুধু ইট ফলে, ময়লা ফলে, সে জমির দাম একশো কোটি?

পরে দেখেছি, যারা ভোগ করেন, তাদের জমির দাম, যারা উৎপাদন করেন, তাদের জমির দামের চেয়ে সবসময়ই বেশি। অধিকাংশ দেশেই এটি সত্য।

যিনি শাক ফলান। আর যিনি শাক খান, তারা দুইজন একই জীবন যাপন করেন না। তারা যাপন করেন দুটি ভিন্ন জীবন। একজন থাকেন গ্রামে, দূরে, সম্ভবত কুঁড়েঘরে; আর অন্যজন থাকেন প্রাসাদে, চড়েন শীতাতপ গাড়িতে। দুজনের কখনো দেখা হয় না। তবে খাবার টেবিলে তাদের একজনের শাকের সাথে, মাছের সাথে, চালের সাথে, ধনেপাতার সাথে, আরেকজনের নিয়মিত সাক্ষাৎ ঘটে।

সতেরো শতকে, ইউরোপে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি ও ঘরবাড়ি তেমন ছিলো না। সবকিছুর মালিক ছিলেন রাজা। জন লক প্রস্তাব করেছিলেন- আমাদের দেহের নিয়ন্ত্রণ যেহেতু আমাদের হাতে, তাই আমরা যা কিছু উৎপাদন করবো, তার নিয়ন্ত্রণও আমাদের হাতেই থাকা উচিত। রাজা আমাদের দেহের মালিক নন, তাই তিনি আমাদের সম্পদের মালিকও নন। আমাদের সম্পদের মালিক আমরা। আমাদের গরুর গাড়ি আমাদের, আমাদের কুঁড়েঘরও আমাদের। আমাদের ফসল ভোগ করবো আমরা।

কান্টও অনেকটা একই কথা বলেছিলেন। তাঁর মতে, ব্যক্তিসম্পত্তির মাধ্যমে মানুষ সমাজে নিজেকে সহজে প্রকাশ করতে পারে। সমাজে কারও অস্তিত্ব আছে কি না, সেটি আমরা বুঝতে পারি তার মালিকানাধীন সম্পত্তি দ্বারা। যার কোনো সম্পত্তি নেই, তার অস্তিত্ব সমাজ সহজে স্বীকার করতে চায় না।

আমাদের পাশের ঘরে এক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, যার কোনো জমিজমা ছিলো না। এক আত্মীয়ের উঠোনে, একটি শণের ঘর নির্মাণ করে তিনি বাস করতেন পরিবার নিয়ে। কারও সাথে ঝগড়া হলে, তাঁকে গালি দেয়া হতো ‘বাদাইম্যা’ বলে। বাদাইম্যা শব্দের অর্থ— এলাকায় যার কোনো নিজস্ব জমিজমা নেই, যিনি বাস করেন অন্যের আশ্রয়ে। ওই মুক্তিযোদ্ধা যখন মারা যান, তখন থানার ইউএনও একটি পতাকা ও কিছু পুলিশ নিয়ে এসেছিলেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিতে। কনস্টেবলদের দিয়ে তিনি অনেক স্যালুট দেয়ালেন, কিন্তু নিজে কোনো স্যালুট দিলেন না (সরকারি বিধি অনুযায়ী ইউএনওরা অন্যকে স্যালুট দেবেন, এমন নিয়ম নেই, তবে কাউকে ‘রাষ্ট্রীয় মর্যাদা’ দেয়ার অনুষ্ঠানে ইউএনওদেরও স্যালুট দেয়ার নিয়ম থাকা দরকার। চাইলে সেদিন তিনি বিশেষ পোশাক বা ইউনিফর্ম পরে আসতে পারেন)। ইউএনওর মুখভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিলো, এমন দিনে মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুতে তিনি খুব বিরক্ত হয়েছেন। ইউএনও যখন চলে যাচ্ছিলেন, তখন জিগ্যেস করেছিলাম- জানাজা পড়বেন না? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, আপনি কী করেন? আমি কী করলে ভদ্রলোক ওই মুক্তিযোদ্ধার জানাজায় অংশ নিতেন, তা অবশ্য জানতে পারি নি।

পরে দেখলাম যে, ইউএনও জানাজায় অংশ নেননি, এর প্রধান কারণ জমিজমা, দ্বিতীয় কারণ ক্ষমতা। মুক্তিযোদ্ধা সাহেবের জমিজমা ও ক্ষমত- কোনোটিই ছিলো না। যদি তিনি সম্পদশালী কোনো মন্ত্রী, সাংসদ, বা আমলা হতেন, তাহলে নিশ্চয়ই জানাজায় ইউএনও, ডিসি, এরা অংশ নিতেন (ওই ইউএনও মুসলিম ছিলেন)।

তবে মার্ড বলেছেন অন্য কথা। তাঁর দাবি, ব্যক্তি-সম্পত্তি মূলত পুঁজিবাদীদের তৈরি করা একটি ফাঁদ, যা দিয়ে শোষণ করা হয় শ্রমিকদের। নির্বোধ মানুষ মারে বক্তব্য অর্ধেক বুঝে, ও বাকি অর্ধেক না বুঝে, বিপ্লবের পর বিপ্লব ঘটিয়েছে, এবং লাশ দিয়ে উর্বরতা বৃদ্ধি করেছে মাটির সোলঝিনিৎসিন আমাদেরকে দেখিয়ে গেছেন, শয়তানের সাথে লেনিনবাদী ফেরেশতাদের আত্মীয়তা কতোটা গভীর হতে পারে।

২৪.

মানুষের হিংসার প্রশংসা না করলেই নয়। একবার গুজব রটেছিলো- নিউটন পাগল হয়ে গেছেন। এ খবরে বিমর্ষ হয়েছিলেন অনেকেই, তবে আনন্দিত হয়েছিলেন হাইগেন ও লাইবনিজ। তিনজনই খ্যাতনামা গণিতবিদ, বিজ্ঞানী, ও দার্শনিক; কিন্তু হিংসা তাদেরকে করে তুলেছিলো একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী।

হিংসা একপ্রকার আবেগ, যার অস্তিত্ব কেবল মানুষের মাঝেই প্রকটভাবে দেখা যায়। অন্য প্রাণীতেও এর অস্তিত্ব আছে, তবে তা বিরল। তিতি বানর ও পোষা কুকুরের হিংসার সাথে মানুষের হিংসার তুলনা আমি করতে চাই না।

হিংসার জন্ম খ্যাতি থেকে। অনেকের এমন কিছু দক্ষতা থাকে, যা সমাজের অন্য মানুষরাও অর্জন করতে চায়। তাদের ধারণা, দক্ষতাগুলো অর্জন করতে পারলে তারাও বিখ্যাতদের মতো ঈর্ষণীয় হতে পারবে। কিন্তু যারা জানে যে, ওই দক্ষতাগুলো তারা অর্জন করতে পারবে না, তারা পরিণত হয় খ্যাতিমান ব্যক্তির ভক্ত বা অনুরাগীতে; আর যারা সন্দেহ করে যে- না, আমিও সে-দক্ষতাগুলো অর্জন করতে পারবো, তাদের মনে জন্ম নেয় হিংসা। তারা নিজের ভেতর শুরু করে অন্য মানুষের লালন।

‘দক্ষতা’ ও ‘খ্যাতি’– এ শব্দ দুটিকে এখানে একটু সংজ্ঞায়িত করতে চাই।

দক্ষতা হলো কোনো কিছু অর্জন বা সম্পাদন করার সক্ষমতা। মেসিকে অন্য ফুটবলাররা হিংসা করেন, কারণ তাঁর ব্যালন ডিওর জয়ের সক্ষমতা, গড়মানের সাধারণ ফুটবলারদের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশে হুমায়ূন আহমেদকে, তাঁর ঘরানার অন্য লেখকরা হিংসা করেন, কারণ তার বই বিক্রি করার সক্ষমতা, ওই লেখকদের চেয়ে বেশি। রবীন্দ্রনাথকে হুমায়ূন ঘরানার লেখকরা হিংসা করেন, কারণ রবীন্দ্রনাথের লেখার টিকে থাকার সক্ষমতা বেশি। আয়শূন্য মানুষজন কর্মজীবী মানুষদের হিংসা করেন, কারণ আয়ের মুখ দেখা মানুষদের জীবনমান উন্নয়নের সক্ষমতা বেশি।

এমবিবিএস ডাক্তারদের কবিরাজরা হিংসা করেন, কারণ রোগী ভালো করার সক্ষমতা কবিরাজের চেয়ে ডাক্তারদের বেশি। একজন মনোযোগী ছাত্রকে অমনোযোগী ছাত্ররা হিংসা করেন, কারণ মনোযোগী ছাত্রদের সফল হওয়ার সক্ষমতা অমনোযোগী ছাত্রদের চেয়ে বেশি।

বাংলাদেশে ও ভারতের সমাজে, সোনার গহনা পরা নারীকে গহনাহীন নারীরা হিংসা করেন, কারণ তারা বুঝতে পারেন, মানুষের নজর কাড়ার সক্ষমতা গহনা পরা নারীদের বেশি। ঘরে রেফ্রিজারেটর আছে, এমন পরিবারকে, রেফ্রিজারেটর নেই, এমন পরিবারেরা সদস্যরা হিংসা করেন, কারণ তারা জানেন, রেফ্রিজারেটরওয়ালা পরিবারের খাবার সংরক্ষণের ক্ষমতা তাদের চেয়ে বেশি।

একজন ধর্মীয় বক্তা আরেকজন ধর্মীয় বক্তাকে হিংসা করেন, কারণ একজনের ধারণা, অপরজনের মানুষ আকৃষ্ট করার ক্ষমতা তার চেয়ে বেশি। একজন বিসিএস ফেইল তরুণ আরেকজন বিসিএস পাস তরুণকে হিংসা করেন, কারণ ফেইল করা তরুণ বুঝতে পারেন, ব্যতিক্রম কিছু না ঘটলে, বাংলাদেশের সমাজে পাস করা তরুণটির ভালো থাকার সক্ষমতা ফেল করা তরুণটির চেয়ে বেশি। লেখক হিশেবে আমাকে যারা হিংসা করেন, তারা জানেন যে, তাদের চেয়ে আমার লেখার দীর্ঘায়ু হওয়ার সক্ষমতা বেশি। ডিসি হতে না পারা উপসচিবরা, ডিসি হতে পারা উপসচিবদের হিংসা করেন, কারণ তারা জানেন, ক্ষমতার স্বাদ নেয়ার সক্ষমতায়, ডিসিদের চেয়ে তারা পিছিয়ে আছেন। আমার মনে হয় বিষয়টি আর খুলে বলার প্রয়োজন নেই। আপনারা বুঝতে পেরেছেন আমি কী বলতে চেয়েছি।

এবার ‘খ্যাতি’ শব্দটির দিকে একটু নজর দেয়া যাক।

খ্যাতি হলো দক্ষতার প্রচারণা। যে দক্ষতা প্রচারিত হয় না, সে দক্ষতা কারও মনে হিংসা সৃষ্টি করতে পারে না। ওয়ালকট নোবেল পেয়েছেন, এ খবর প্রচারিত না হলে কবিরা তাঁকে হিংসা করতো না। নিউটন ও লাইবনিজ, উভয়েই ক্যালকুলাস আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু এ খবর প্রচারিত না হলে তাদের মনে হিংসা জন্ম নিতো না।

দক্ষতার এ প্রচারণা একেক সমাজে একেকভাবে ঘটে। তবে আধুনিক সমাজে পত্রিকা, টেলিভিশন, ফেসবুক, ইউটিউব, বই, জার্নাল, সমাবেশ, ঝগড়া, ইত্যাদি মাধ্যমেও দক্ষতার প্রচারণা চালানো যায়। বাংলাদেশে যে সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো হয়, সেগুলোও এক অর্থে দক্ষতা বা সক্ষমতার প্রচারণা। একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে, আয়োজক তার সর্বশক্তি নিয়োগ করেন, কীভাবে আমন্ত্রিত অতিথিদের মনে হিংসা জাগানো যায়। অতিথিরাও এমনভাবে সেজেগুজে আসেন যে, তাদের পোশাক-আশাক ও গয়নাগাটি দেখে অন্য অতিথিরা হিংসায় ছারখার না হয়ে পারেন না।

আধুনিক জার্নালগুলোর যে ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর, এবং গবেষকদের যে সাইটেশন রেকর্ড, সেগুলোও দক্ষতার প্রচারণা। এ প্রচারণা দেখে অন্য গবেষকেরা হিংসায় শুকনো পাতার মতো জ্বলতে থাকেন।

শাহরুখ খানের সিনেমাগুলো যদি দক্ষতার প্রচারণায় বলিউডের অন্য সিনেমার চেয়ে পিছিয়ে থাকতো, তাহলে শাহরুখ খানকে কেউ হিংসা করতো না। বাংলাদেশে জায়েদ খান নামে যে একজন শাহরুখ খান আছেন, তাকে কেউ হিংসা করে না কেন? কারণ প্রচারণা চালানোর মতো কোনো অভিনয়-দক্ষতা তার নেই। এ জন্য হিংসাযোগ্য কোনো খ্যাতি, জায়েদ খানের দখলে নেই।

বাংলাদেশে এনায়েতুল্লাহ আব্বাসি এবং নুরুল ইসলাম ওলিপুরি নামে দুই ধর্মীয় বক্তা আছেন; যারা একে অপরকে প্রায়ই কথার স্যান্ডেল দিয়ে আক্রমণ করেন। এক মাহফিলে আমি নিজে তাদের বাকযুদ্ধের সাক্ষী হয়েছিলাম। একজন আরেকজনকে ডাকছিলেন ‘বুইড়া ছাগল’। বাংলাদেশের সমাজে দুজনই জনপ্রিয় বক্তা। কিন্তু তাদের ওয়াজের দক্ষতা, এবং এ দক্ষতার প্রচারণা, তাদেরকে একে অন্যের হিংসুটে প্রতিদ্বন্দ্বী বানিয়ে দিয়েছে। একজনের আশঙ্কা, আরেকজন বুঝি ওয়াজের বাজার দখলে নিয়ে নিলো।

বাংলাদেশের রাজনীতিক পরিমণ্ডলে যে কথা ছোড়াছুড়ি দেখা যায়, তাও দক্ষতার প্রচারণা। এ দক্ষতা মূলত প্রতিপক্ষকে অপমান করে নিজেকে ভাল্লুক সাজানোর দক্ষতা। বাংলাদেশে ভোটারদের যে বাজার রয়েছে, সেখানে রাজনীতিকদের মনুষ্য আচরণের চেয়ে, ভাল্লুকি আচরণের জনপ্রিয়তা বেশি। এ জন্য মঞ্চে উঠেই নেতা-নেত্রীরা মুখ থেকে ভাল্লুকের আওয়াজ বের করতে থাকেন। এ আওয়াজই তাদের খ্যাতিমান করে তোলে। আমাদের রাজনীতিক বাজারে যে হিংসাগুলো আছে, তা মূলত আওয়াজের হিংসা। এ আওয়াজ এক পক্ষ থেকে আসে ক্ষমতা ভোগের দম্ভ হিশেবে, অন্য পক্ষ থেকে আসে ক্ষমতা হারানোর শোক রূপে।

তবে সাধারণ মানুষজন তাদের দক্ষতা ও সক্ষমতা একটু ভিন্নভাবে প্রচার করে থাকে। সফলতার খবর তারা প্রতিবেশীদের কাছে পৌঁছে দিতে কিনে আনে দামি আসবাব, দামি ইলেকট্রনিঙ দামি গাড়ি। একটি লেখায় মনে হয় আমি বলেছিলাম, বাংলাদেশের সমাজে সফলতা মূলত দামি জিনিস কেনার ক্ষমতা। কারও ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে, অর্থাৎ কেউ সফলতা লাভ করলে, এ খবর মহল্লায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ফ্ল্যাটবাড়ি হলে বাসিন্দারা তক্ষে তক্ষে থাকেন, কীভাবে পাশের ফ্ল্যাটের কাউকে দাওয়াত দিয়ে এনে নতুন সোফা সেটটি দেখিয়ে দেয়া যায়। কেউ কেউ নতুন গাড়ি কিনে রাস্তায় উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি করে থাকে। মতলব, পরিচিত কাউকে পেলে গাড়ি থামিয়ে কুশলাদি জিগ্যেস করা। এই ফাঁকে, গাড়ি কেনার দক্ষতাটি প্রচার হয়ে গেলো।

এই খ্যাতিগুলোর পরিধি অতো বিস্তৃত না হলেও ছোটোখাটো সামাজিক গণ্ডিতে এগুলো ভালো মাত্রার হিংসা ছড়াতে পারে। বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীরা তাদের টাইমলাইন এমনভাবে সাজান, যেন প্রোফাইলে কেউ ঢুকলেই হিংসায় ছাই হয়ে যান।

এখানে আরেকটি বিশেষ ধরনের হিংসার কথা আমি বলতে চাই। হিংসাটির নাম- যৌন হিংসা। এ হিংসা স্বামী-স্ত্রী এবং প্রেমিক-প্রেমিকার মাঝেই বেশি দেখা যায়। তবে বাংলাদেশে এসব সম্পর্কের বাইরেও যৌন হিংসা প্রত্যক্ষ করেছি

যৌন হিংসা কী? যৌন হিংসাও এক প্রকার আবেগ, যার উৎপত্তি সঙ্গী হারানোর আশঙ্কা থেকে। সঙ্গী বলতে এখানে আমি বিবাহিত স্বামী-স্ত্রী, অবিবাহিত প্রেমিক-প্রেমিকা, ও লিভ-টুগেদার পার্টনারদের বুঝাচ্ছি। মানুষ যখন দেখে যে তার সঙ্গীকে অন্য কেউ নিজের করে পেতে চাইছে, অথবা তার সঙ্গী নিজে থেকেই অন্য কারও সাথে ঘনিষ্ঠ হতে চাইছে, তখন এ হিংসা দেখা দেয়।

আধুনিক সমাজে হিংসাটির উৎপত্তি পরাজয়বোধ থেকে। মানুষ ভাবে, কেউ যদি তার সঙ্গী ভাগিয়ে নেয়, বা তার সঙ্গী তাকে পরিত্যাগ করে, তাহলে সে তার সঙ্গীর কাছে, বা সঙ্গীটি যার সাথে ভেগে গেলো তার কাছে, পরাজিত হয়েছে। সে কল্পনা করে, তার সঙ্গীকে সুখে রাখার ক্ষমতা তার চেয়ে অন্যদের বেশি। এ উপলব্ধি থেকেই তার মনে জন্ম নেয় যৌন হিংসা। সে তৎপর হয়ে ওঠে, কীভাবে এড়ানো যায় পরাজয়।

মানুষের যৌন হিংসা তার অন্য হিংসাগুলো থেকে আলাদা। সুলতান সুলেমান বা ম্যাগনিফিসেন্ট সেঞ্চুরি নামক যে টিভি সিরিজটি এ অঞ্চলে জনপ্রিয় হয়েছে, তার মূল উপজীব্য যৌন হিংসা। তুরস্কে এটি প্রচারিত হয়েছিলো ‘মুহতিশাম ইউজিল’ নামে। সিরিজটিতে সুলেমান নামের এক নারীভোগী রাজা, তার হেরেম ভরে ফেলেছিলো নারী দিয়ে। কিন্তু হুররাম ও মাহি দেবরান নামের দুই নারী, যৌন হিংসায় পুরো প্রাসাদটিকে করে তুলেছিলো নরক।

যদি দুর্ঘটনার ব্যাপারটি মিথ্যে হয়ে থাকে, তাহলে ডায়নার মৃত্যুর ঘটনাটিও যৌন হিংসার ফসল। যৌন হিংসা যে খুব প্রাণঘাতী, এ প্ৰমাণ ইতিহাসে ভূরি ভূরি আছে। ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস, দেশটিতে সংঘটিত মোট ইভেরিসাইডের একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছিলো (স্বামী-স্ত্রী বা প্রেমিক-প্রেমিকারা একে অন্যের হাতে নিহত হলে সেটিকে ইভেরিসাইড বলে)।

পরিসংখ্যানটিতে দেখা যায়, ওই বছর যুক্তরাষ্ট্রে ২৩৪০ জন মানুষ, নিজেদের স্বামী-স্ত্রী বা প্রেমিক-প্রেমিকার হাতে খুন হয়েছিলেন (ভিক্টিমদের ৭০ শতাংশই নারী)। আমার ধারণা, এ খুনগুলোর প্রধান কারণ যৌন হিংসা। বাংলাদেশে এ ধরনের জরিপ চালালে ভীতিকর ফল পাওয়া যাবে।

প্রশ্ন হলো, মানুষ কেন তার সঙ্গী বা সঙ্গিনীর ক্ষেত্রে যৌন হিংসা পোষণ করে থাকে?

এর একটি ব্যাখ্যা হতে পারে মানুষের ‘মেইট গার্ডিং বিহ্যাভিয়ার’ বা ‘সঙ্গী পাহারা দেয়ার মনোভাব’। মানুষ চায়, তার স্বামী-স্ত্রী বা প্রেমিক- প্রেমিকা, অন্য কোনো মানুষের সাথে যেন যৌনভাবে ঘনিষ্ঠ না হয়। ডেভিড বুস (ভদ্রলোক মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন), এ ব্যাপারে একটি গবেষণাপত্র লিখেছিলেন। গবেষণাপত্রটিতে দেখলাম, তিনি অনেকগুলো কৌশলের কথা উল্লেখ করেছেন, যেগুলো ব্যবহার করে মানুষ তার সঙ্গীকে, প্রতিদ্বন্দ্বী নারী ও পুরুষের সংসর্গ থেকে দূরে রাখতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: এক. গালাগালি করে বা গায়ে হাত তুলে প্রিয় মানুষটিকে শাসানো, বা প্রিয় মানুষটির সাথে মেলামেশা আছে এমন প্রতিদ্বন্দ্বীকে একই পদ্ধতিতে হুমকি-ধামকি দেয়া; দুই. সঙ্গীকে সবসময় নানা কাজে ব্যস্ত রাখা, যেন অন্য কোনো নারী বা পুরুষের সাথে তিনি মেলামেশার ফুরসত না পান; তিন. সঙ্গীকে আবেগের সাহায্যে বশীভূত রাখা; চার. সঙ্গীকে নিয়মিত দামি পোশাক-আশাক ও গহনা কিনে দেয়া।

চারপাশের সংসারগুলোর দিকে তাকালে, আর আমাদের প্রেমিক- প্রেমিকাদের আচরণ বিশ্লেষণ করলে, বুসের কথার সত্যতা পাওয়া যাবে।

তবে এ ব্যাপারে আমি একটু অন্যদিকে আলোকপাত করতে চাই। কারণ বুসের বক্তব্যে লক্ষণ পাওয়া গেলেও মূল রোগটি পাওয়া যায় না। মূল রোগটি পাই ডারউইনের কাছে গেলে।

ডারউইন লক্ষ করেছিলেন- ময়ূরের পেখম, কার্ডিনালের পাখনা, হরিণের বাহারি শিং, এগুলো তাদের জীবনের জন্য একপ্রকার হুমকি। কারণ দেহের এ বৈশিষ্ট্যগুলো শিকারি প্রাণীদের আকৃষ্ট করে থাকে, যা ‘সার্ভাইভাল সিলেকশন’ তত্ত্বের সাথে সাংঘর্ষিক।

ডারউইন আরো লক্ষ করেছিলেন, বহু প্রজাতিতে নারী ও পুরুষ প্রাণীর আকার এক নয়। যেমন- পুরুষ এলিফ্যান্ট সিলের ওজন ১৮০০ কেজি, কিন্তু নারী এলিফ্যান্ট সিলের ওজন মাত্র ৪৫০ কেজি। আবার পুরুষ বেবুন, নারী বেবুনের তুলনায় দ্বিগুণ বড়ো।

মানুষের ক্ষেত্রেও এ পার্থক্য চোখে পড়ে। পুরুষ মানুষের গড় উচ্চতা, নারী মানুষের গড় উচ্চতার চেয়ে প্রায় ১২ শতাংশ বেশি।

যেহেতু কোনো প্রজাতির নারী ও পুরুষ- উভয় লিঙ্গের প্রাণীই প্রকৃতিতে একসাথে বিবর্তিত হয়েছে, সেহেতু ওই প্রজাতিতে তাদের আকার-আকৃতিতে এতো পার্থক্য থাকার কথা নয়। এর কারণ কী?

এ প্রশ্নের উত্তর ডারউইন দিয়েছেন তাঁর ‘সেয়াল সিলেকশান’ তত্ত্বে। তিনি দেখিয়েছেন- প্রাণীর বিবর্তন শুধু ‘সার্ভাইভাল সিলেকশন’-এর ওপর ভিত্তি করে হয় না। এর পেছনে ‘সেয়াল সিলেকশন’-ও দায়ী। প্রকৃতিতে কোনো প্রাণী টিকে থাকতে হলে, তাকে সন্তান জন্ম দিতে হয়। আর সন্তান জন্ম দিতে প্রয়োজন সঙ্গমের। কে কার সাথে সঙ্গম করবে- এ নিয়ে পুরুষ প্রাণীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে। কারণ একই নারী প্রাণীর সাথে একাধিক পুরুষ প্রাণী সঙ্গম করতে চাইতে পারে। ফলে শুরু হতে পারে মারামারি। এ মারামারি একসময় মানুষের মাঝেও ছিলো। এখনো যে নেই তা বলা যাবে না। প্রায়ই শোনা যায়- নারীর মন দখল নিয়ে তরুণদের মাঝে দাঙ্গা বেধেছে। আমার এক বন্ধু, তার বিয়ে হয়ে যাওয়া প্রেমিকার দখল নিতে গিয়ে বিষ খেয়ে মৃত্যুবরণ করেছে।

বনে দেখা যায়, পুরুষ হরিণেরা পছন্দের নারী হরিণের সাথে সঙ্গম করতে চাইলে, আগে নিজেদের মধ্যে ঢুশাটুশিতে জড়ায়। একটির শিং আরেকটির শিংয়ের সাথে পেঁচিয়ে গুঁতোগুঁতি করে। এ গুঁতোগুঁতিতে যে হরিণটি জয়ী হয়, সেটিই কাঙ্ক্ষিত নারী হরিণের সাথে সঙ্গম করার সুযোগ পায়। পরাজিত হরিণটি এ সুযোগ পায় না। সে বুঝতে পারে, তার আরো শক্তিশালী শিং দরকার।

সিংহ সমাজে এ মারামারি নিয়মিত ঘটনা। নারী সিংহের দখল নিতে, পুরুষ সিংহ, সিংহীর আগের সংসারের শাবকও মেরে ফেলে। যারা গ্রামে বাস করেন, তারা এ ধরনের যৌনযুদ্ধ মোরগের ক্ষেত্রে লক্ষ করে থাকবেন। পুরুষ মোরগরা, মুরগির উপর সওয়ার হওয়া নিয়ে প্রায়ই একে অপরের সাথে বিবাদে জড়ায়।

কিছু প্রাণী, মারদাঙ্গা এড়াতে সৌন্দর্যের বিকাশ ঘটিয়েছে। ময়ূর চায়, সে অন্য পুরুষদের সাথে হাঙ্গামা না করে, তার সৌন্দর্য দিয়েই ময়ূরীর হৃদয় জয় করতে। কিন্তু এক ময়ূরীকে দুই সৌন্দর্যবান ময়ূর নিশানা করলে, যুদ্ধ অনিবার্য।

এই ইন্টারসেয়াল কম্পিটিশন, জঙ্গলে এখনো আগের মতোই আছে; তবে মানুষের সমাজে তা পাল্টে গেছে। পুরুষরা নারী নিয়ে এখন আর উন্মুক্ত জঙ্গলে মারামারি করে না। অর্থ-বিত্ত, রাজনীতিক ক্ষমতা, শিক্ষা, সামাজিক মর্যাদা- এ ব্যাপারগুলোই নির্ধারণ করে, কোনো পুরুষ তার পছন্দের নারীর সাথে মিলিত হতে পারবে কি না।

ট্রয় নগরী ধ্বংসের পেছনে হেলেন দায়ী- এরকম একটি কথা যে বাংলার মাস্তানেরা বলে থাকে, তারা কি জানে, ট্রয় ধ্বংস করেছিলো যৌন হিংসাতাড়িত পুরষরা? নারীর কারণে ট্রয় ধ্বংস হয়েছিলো, এ কথা বলে হয়তো একধরনের বিড়িসুখ পাওয়া যায়, কিন্তু তা সত্যজাত সুখ নয়। এসব প্রলাপ যারা বলে, তারা মনে হয় না কোনোদিন মনোযোগ দিয়ে ইলিয়াড পড়েছে। যদি পড়তো, তাহলে বুঝতো— হেলেন নয়, হেলেনকে যে পুরুষরা অপহরণ করেছিলো, তারাই ধ্বংস করেছিলো ট্রয়।