দাশগুপ্ত হাসলেন—কী ব্যাপার, অমন করে তাকিয়ে আছ কেন? খুব অবাক হয়েছ মনে হচ্ছে?
হচ্ছি। আজকাল তো তোমার দেখাই পাওয়া যায় না।
তা অবশ্য। ব্যবসা নিয়ে এত ব্যস্ত থাকি। আসলে আমি যদি সমতলে কারখানা করতাম তা হলে অনেক খরচ কম হতো, নিশ্চিন্তে ব্যবসা করতে পারতাম। কিন্তু এই শহরটাকে এমন ভালোবেসে ফেলেছি যে এখান থেকে চলে যেতে ইচ্ছে করছে না। তাই আর সময় পাই না। তা তোমরা আছ কেমন? আমাদের ওদিকে তো আর যাও না।
কাজলের বাড়িয়ে দেওয়া চেয়ারে সন্তর্পণে বসলেন দাশগুপ্ত। বয়স হয়েছে, অপরেশের চেয়ে বড়, কিন্তু চেহারা দেখে বোঝা যায় না।
ভালো নয়।
কেন?
তুমি জানো না!
উঁহু।
তা হলে এসেছ কেন?
ও! তা হলে তোমরা প্রস্তুত হয়েই লড়ছ। দাশগুপ্তর গলা শক্ত হল।
লড়ছি?
লড়ছ না? আমার আত্মীয় হয়ে আমার বিরুদ্ধে পাবলিককে উস্কানি দিচ্ছে তোমার স্বামী। সেটাকে কী বলে?
কাজল বললেন, আমি এসব কিছু জানি না। উনি বলছেন, তোমার কারখানার চামড়া ধোওয়া জলের জন্যে শহরের জল দূষিত হয়েছে।
অসম্ভব। হতেই পারে না। আমার কারখানার সমস্ত ব্যাপারই বৈজ্ঞানিক মতে তৈরি। আমার চামড়ার জল শহরের জলের পাইপে মিশবে কী করে? কিছু মনে করো না, তোমার স্বামী দেবতাটির মাথায় একটি বিশেষ পোকা আছে, সেটি মাঝে-মাঝেই কামড়ায়। আমি ব্যবসা করি বলে ও বোধহয় কোনওদিনই আমাকে পছন্দ করল না। তোমার দিদি এসব শোনা অবধি কান্নাকাটি শুরু করেছে। দাশগুপ্ত হাসলেন।
কাজল বললেন, কী করব জামাইবাবু জানি না। উনি তো কারও কথা শুনতে চাইছেন না। এমনকী মেয়েটার যে চাকরি গেল তাতেও ভ্রূক্ষেপ নেই।
সে কি কথা! সুর্মার চাকরি নেই! কী হয়েছে?
জানি না। আজ স্কুল থেকে ফিরে এসে বলল বরখাস্ত হয়েছে।
দাশগুপ্ত একটু যেন চিন্তা করলেন—যাক-যাক, ওরকম বকবকানির চাকরি না করাই ভালো। ওকে একটু ডাকো তো। আমি কথা বলি।
কাজল সুর্মাকে ডেকে আনতেই দাশগুপ্ত বললেন, আয় মা, কেমন আছিস?
সুর্মা সামান্য ঘাড় নাড়ল—ভালো। আপনি?
আমি? তোর বাবা কি আর আমাকে ভালো থাকতে দিচ্ছে? যাক সে কথা, শুনলাম স্কুলের চাকরি নাকি আর নেই? দাশগুপ্ত ভ্রূ কোঁচকালেন।
ঠিক শুনেছেন।
চাকরির জন্যে চিন্তা করিস না। তুই এক কাজ কর, কাল থেকে আমার কারখানায় লেগে যা। কদিন থেকে ভাবছিলাম একটা পাবলিক রিলেশন অফিসার রাখব। আমি একা সব সামলাতে পারছিলাম না। তুই আয়, তোকে সব বুঝিয়ে দেব। স্নেহের হাসি হাসলেন দাশগুপ্ত।
কাজল বললেন, সত্যি জামাইবাবু! আঃ, ভগবান তুমি কী ভালো।
দাশগুপ্ত হাত ঘুরিয়ে বললেন, বাঃ, আমি চাকরির খবর দিচ্ছি আর ভালো হয়ে যাচ্ছে ভগবান! কী রে, তুই কী বলিস?
সুর্মা নিচু গলায় উত্তর দিল, অফিসে চাকরি নেওয়ার ইচ্ছে নেই আমার।
কেন? দাশগুপ্ত অবাক হলেন—অফিস কী অপরাধ করল? ও, নিরাপত্তার কথা বলছিস? আরে আমার ফ্যাক্টরিতে তোর কোনও অসুবিধে হবে ভাবছিস কেন? ও তো তোর নিজেরই অফিস!
তা নয়। আমি বাবার সঙ্গে আলোচনা না করে কিছু বলতে পারব না।
তাই নাকি? সে যদি রাজি না হয়?
সেটাই স্বাভাবিক। বাবা মনে করেন আপনার কারখানাটা শহরের জল বিষাক্ত করছে। সেই কারখানায় আমি কাজ করলে আপনাকেই সাহায্য করা হবে। যদি আপনি অন্য জায়গায় কারখানা সরিয়ে নিয়ে যান তখন অবশ্য এই বাধা থাকবে না। সুর্মা কথাগুলো বলল কাটা-কাটা, স্পষ্ট গলায়।
দাশগুপ্ত উঠে দাঁড়ালেন, বুঝলাম। বাপ-মেয়ে সব এক পালকের।
সুর্মা জবাব দিল, শুধু পালক বলছেন কেন মেসোমশাই, রক্তও তো এক, লাল রঙের।
কাজল তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, কী বলছিস, তুই! বয়স্ক লোকের সঙ্গে এভাবে কথা বলতে হয়! আপনি কিছু মনে করবেন না জামাইবাবু। চাকরি যাওয়ার পর ওর মাথা ঠিক নেই।
দাশগুপ্ত ব্যঙ্গের হাসি হাসলেন, না কাজল, ওর মাথা ঠিক আছে। কিন্তু এই তেজ আর বেশি দিন থাকবে না। আমি তোমাদের ভালো করতে চেয়েছিলাম কিন্তু তোমরা শুনলে না।
কাজলের বারংবার অনুরোধ সত্বেও দাশগুপ্ত আর দাঁড়ালেন না। ওঁর গাড়ি চলে গেলে কাজল মেয়ের দিকে ফিরে তাকালেন। সুর্মা দাঁতে ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হিসহিসে গলায় কাজল জিজ্ঞাসা করলেন, এটা তুই কী করলি?
কেন মা?
যেচে এসে চাকরি দিতে চাইল, তুই পায়ে ঠেললি?
ওটা একটা টোপ, বাবাকে ফাঁদে ফেলবার।
কাজল ফুঁসে উঠলেন, না খেয়ে শুকিয়ে মরার চেয়ে টোপ খাওয়া ঢের ভালো, ওতেও খাবার থাকে। তোরা বাপ-মেয়েতে মিলে আমাকে জ্বালিয়ে শেষ করে ফেললি! ও ভগবান, তুমি এত কষ্ট দেবে আমাকে!
সে কি! একটু আগে বললে ভগবান তুমি কি ভালো—সুর্মা হাসল।
চুপ কর! তোমাদের এই সব পাগলামি আমি সহ্য করব না। আসুক সে আজ, আমি হেস্তনেস্ত করব। এই বুড়ো বয়সে আমি আর ভিখিরি হতে পারব না!
তুমি মিছিমিছি ভয় পাচ্ছ মা! অন্যায়ের সঙ্গে আপোস করে সারাজীবন মেরুদণ্ড খুইয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে এটা অনেক ভালো।
কাজলের চোখ জ্বলছিল—শোনো, তোমাকে একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছি। ওই সুব্রতর সঙ্গে তোমার আর মেলামেশা চলবে না। তাকে এই বাড়িতে আসতে নিষেধ করে দিও।
সুর্মা চমকে উঠল—সে কি! কেন? সে আবার কী দোষ করল?
তুমি জানো না? ওর বংশটাই পাগল। আমি চাই না তোমার ভবিষ্যত ঝরঝরে হয়ে যাক।
তা তো ঠিক। কিন্তু সুব্রত তো পাগল নয়।
পাগলের ছেলে পাগল হয়।
তা হলে তো কবির ছেলে কবি, ডাক্তারের মেয়ে ডাক্তার হতাম।
বাজে কথা ছাড়, যা বললাম তাই করবে।
না মা, সুব্রত যদি কখনও পাগল হয়েই যায় তখন ওকে সারানোর জন্যে ওর পাশেই আমার থাকা দরকার।
তা হলে তোরা কেউ আমার কথা শুনবি না! চিৎকার করে উঠলেন কাজল। সেই সময় সুর্মার চোখ বাইরের দিকে গিয়েছিল। সে নিচু গলায় বলল, চুপ করো মা, বাবা আসছে।
কাজল মুখ ঘুরিয়ে দেখলেন গেট খুলে অপরেশ ঢুকছেন। এখন তাঁর মোটেই হাসপাতাল থেকে ফেরার কথা নয়। খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাঁকে, অন্যমনস্ক। প্রায় বারান্দার কাছাকাছি এসে অপরেশ ওদের দেখতে পেলেন যেন।
সুর্মা ততক্ষণে এগিয়ে গিয়ে ওঁর হাত ধরেছে, কী হয়েছে বাবা?
অপরেশ ম্লান হাসলেন—যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে মা। আমাকে একটু বসতে দে।
সুর্মা চেয়ার টেনে আনল কাছে। অপরেশ সেটায় শরীর এলিয়ে দিয়ে সামনে তাকালেন। বিকেলের পরিষ্কার রোদ পড়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপর। কী নির্মল দেখাচ্ছে তাকে। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি—ভালোই হল। এখন আর কোনও বাধা রইল না।
কাজল ওঁকে এতক্ষণ দেখছিলেন। এবার কাছে এসে শুধোলেন, কী হয়েছে তোমার? ওঁর গলার স্বর এখন খুব নরম।
অপরেশ বললেন, আজ থেকে আমি বেকার হলাম। আমার কাজকর্মে অসন্তুষ্ট হয়ে কর্মকর্তা আমাকে বরখাস্ত করেছে।
সঙ্গে-সঙ্গে কাজলের মুখ থেকে আর্তনাদ বেরিয়ে এল। তিনি আর দাঁড়ালেন না, এক ছুটে ভেতরে চলে গেলেন। অপরেশ নীরবে তাঁর যাওয়া দেখলেন। তারপর দু হাতে মাথা চেপে বসে রইলেন।
একটু সময় নিয়ে সুর্মা বাবার মাথায় আলতো করে হাত রাখল—বাবা! অপরেশ মুখ তুললেন—আমি বোধহয় তোর মায়ের ওপর অবিচার করলাম। আমার হাতে পড়ে বেচারি কোনওদিন সুখী হতে পারল না।
সুর্মা গাঢ় গলায় বলল, মা এখন বুঝছেন না, পরে নিশ্চয় ওঁর ভুল ভাঙবে। তুমি তো কোনও অন্যায় করোনি বাবা।
অপরেশ এবার সোজা হয়ে বসলেন—না, আমি কোনও অন্যায় করিনি। কালকের কাগজটা বের হোক তারপর দেখবি সমস্ত শহর আমার পাশে এসে দাঁড়াবে। এদের হাত থেকে সাধারণ মানুষকে বাঁচাতেই হবে।
সুর্মা জিজ্ঞাসা করল, ওরা কি আমাদের বাড়ি ছেড়ে দিতে বলেছে?
হ্যাঁ, তবে একমাস সময় দিয়েছে। এর মধ্যে কোথাও একটা বাড়ি খুঁজে নিতে হবে। সে একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে, কী বলিস?
হ্যাঁ। আমি আজই সুব্রতকে বলব।
সুব্রতকে? ওকে আমাদের সঙ্গে জড়ালে ওর কোনও ক্ষতি হবে না তো?
আমরা জড়াব কেন? ওর যদি ইচ্ছে হয় তবে—
অপরেশ ধীরে-ধীরে উঠলেন। তারপর নিঃশব্দে ভেতরের ঘরে এলেন। সুর্মা বাবাকে একা যেতে দিল। ও জানে অপরেশ কাজলের সঙ্গে কথা না বলা পর্যন্ত স্বস্তি পাবেন না।
কাজল শুয়েছিলেন বিছানায় উপুড় হয়ে, ওঁর পিঠ কাঁপছিল। অপরেশ বিছানায় বসে ওঁর পিঠে হাত রাখতেই কাঁপুনিটা থেমে গেল। ভাঙা গলায় অপরেশ বললেন, তুমি যদি এমন করে ভেঙে পড়ো তা হলে আমি কী করে সোজা হয়ে দাঁড়াই? আমাকে তুমি অন্ধ হয়ে থাকতে বলো?
হঠাৎ কাজল ঘুরে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন স্বামীর কোলে। মুখ গুঁজে হু-হু করে কেঁদে যেতে লাগলেন। ওঁর দুটো হাত স্বামীকে আঁকড়ে ধরে ছিল।
খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল অপরেশের। তখনও অন্ধকার কাটেনি। কিছুক্ষণ ছটফট করে উঠে পড়লেন তিনি। আজ সকালের কাগজটার জন্যে বাড়িতে বসে অপেক্ষা করতে ইচ্ছে করছিল না। কাউকে কিছু না বলে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলেন তিনি। যে ছেলেটি কাগজ দেয় সে সাতটার আগে যেন আসতেই চায় না।
বেশ কনকনে ঠান্ডা এখন বাইরে, ট্যুরিস্টরাও বের হয়নি। হাঁটতে-হাঁটতে অপরেশের এই সকলের চেহারায় কনকপুরকে নতুন করে ভালো লাগল। এত সুন্দর জায়গাটাকে কিছুতেই নষ্ট করতে দেবেন না তিনি। আজকের খবরের কাগজ বের হলেই কীরকম প্রতিক্রিয়া হবে ভাবতে পারছেন না তিনি। সাধারণ মানুষ কি ক্রুর হয়ে ভয়ঙ্কর কিছু করে বসবে? না, সেটা করা উচিত হবে না। তিনি সবাইকে বুঝিয়ে বলবেন, যাতে কেউ মাথা গরম না করে। কর্তৃপক্ষ বাধ্য হবেন মেনে নিতে।
কাগজের অফিসের সামনে এসে দেখলেন সেখানে বেশ ভিড়। প্রচুর হকার এসেছে কাগজ নিতে। কিছু-কিছু সাধারণ মানুষও এসেছে কৌতূহলী হয়ে। সমাজপতি আজ কয়েকজন লোক রেখেছে বাড়তি কাজের জন্যে। অপরেশ দূরে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা দেখছিলেন। একটু বাদেই কাগজ এল। হকাররা হুড়োহুড়ি করছে কাগজের জন্যে। যে লোকটা বিতরণ করছে সে চিৎকার করছে, জবর খবর! জবর খবর!
অপরেশ আর অপেক্ষা করতে পারলেন না। দৌড়ে কাছে গিয়ে পকেট থেকে পয়সা বের করে একটা কাগজ কিনে নিলেন। ভাঁজটা খুলে চোখের ওপর হেডলাইন ধরতেই ওঁর মাথাটা ঘুরে গেল। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না তিনি। এ কী লেখা রয়েছে?
সমস্ত শরীর টলছিল তাঁর। আঙুলগুলো শিথিল হয়ে যাওয়ায় কাগজটা মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। আবার ঝুঁকে পড়ে তুলে নিলেন কাগজটা। ‘পঞ্চাশ হাজার বছর আগে কনকপুরে তিমিরা ঘুরে বেড়াত।’ ভেতরের বিস্তারিত বিবরণ আর পড়তে প্রবৃত্তি হল না। নিশ্চয়ই কিছু ভুল হয়ে গিয়েছে। সমাজপতি, অবিনাশরা আগামীকালের জন্যে কি খবরটা চেপে রেখেছে? অপরেশ প্রায় দৌড়ে, মানুষের গায়ে ধাক্কা দিয়ে কাগজের অফিসে ঢুকলেন। ঘরে তখনও আলো জ্বলছে। টেবিলের ওপর দুটো পা তুলে সমাজপতি চুরুট খাচ্ছিল। ওঁকে দেখে যেন চুপসে গেল। তাড়াতাড়ি পা নামিয়ে হাসবার চেষ্টা করল—কী ব্যাপার?
সেটাই তো জিজ্ঞাসা করছি! অপরেশের গলা বুজে আসছিল।
ও, আপনি তিমিদের কথা বলছেন? হ্যাঁ তিমি ছিল, অক্টোপাস ছিল। মানে এখানে তো ওই সময় সমুদ্রের ঢেউ খেলত। আর সমুদ্র থাকলেই—
চুপ করো। আমার লেখাটার কী হল? চিৎকার করলেন অপরেশ।
কী লেখা? সমাজপতির মুখে না বোঝার ভান।
তুমি জানো না! যে লেখা পেয়ে তোমরা কাল অ্যানাউন্সমেন্ট দিলে সে লেখা তুমি পড়োনি? আজ সেইটাই ছাপা হওয়ার কথা ছিল না?
ছিল। ছেপেছিলাম। সব বিক্রি হয়ে গেছে।
কী বলছ! ছাপা হলে এটা কী?
এটা নেক্সট এডিশন। দেখুন ডাক্তারবাবু, আমি আপনার সঙ্গে তর্ক করতে পারব না। আমাকে বেঁচে থাকতে হবে, কাগজটাকে চালাতে হবে। আপনার কল্পনার ওপর তৈরি খবর ছেপে বিপদে পড়তে চাই না। এতক্ষণে সাফ জানিয়ে দিলেন সমাজপতি।
কল্পনা! এ কী বলছ! কলকাতা থেকে পরীক্ষা করিয়ে রিপোর্ট এনেছিলাম। অবিনাশ, অবিনাশ কোথায়?
সে ঘুমুচ্ছে। রিপোর্টটা লেখার আগে দেননি কেন?
ওটা যে আমার কাছে নেই।
ডাক্তারবাবু, এসব চিন্তা ছেড়ে দিন।
ছেড়ে দেব! কক্ষনও না। আমি জনে-জনে বলে বেড়াব, মিটিং করব, কনকপুরের মানুষের কাছে নিজে যাব, তাদের বলব, ওই জলে বিষ আছে তোমরা খেও না। জল ফুটিয়ে বিষমুক্ত না করলে মহামারী হবেই। দেখি আমায় কে ঠেকায়! সমাজপতি, তুমিও শেষ পর্যন্ত বিক্রি হয়ে গেলে! ছি-ছি-ছি! পাগলের মতো মাথা নাড়ছিলেন অপরেশ।
সমাজপতির গলা আচমকা পালটে গেল, সত্যি বলছেন, জল না ফুটিয়ে আর খাব না?
অপরেশের কানে প্রশ্নটা যেতে তিনি স্থির হয়ে গেলেন। তার পরে এক ছুটে বেরিয়ে এলেন বাইরে। এদিকে সেখানে তখন চেঁচামেচি চলছে। হকাররা এর মধ্যে ভাঁওতাটা বুঝে গিয়েছে। তারা আগের অর্ডার অনুযায়ী কাগজ নিতে চাইছে না।
অপরেশ ভারী পায়ে পুরোটা পথ হেঁটে বাড়ি এলেন। ওঁর শরীর টলছিল। বারান্দায় সুর্মা দাঁড়িয়ে ছিল। ওঁকে দেখে চিৎকার করে দৌড়ে এল—তোমার কী হয়েছে বাবা!
অপরেশ হাসলেন—প্রথম রাউন্ডে হেরে গেলাম মা।
হেরে গেছ? মানে?
সমাজপতি খবরটা ছাপেনি। ভয় পেয়েছে সে। কনকপুরের মানুষকে জানানোর সহজ পথটা তোর জেঠু বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু তাতে আমি দমছি না। এর পরের রাউন্ড তো আমার হাতের মধ্যে। সেখানে আমায় কে হারায় দেখি! তুই এক কাজ করবি মা?
বলো?
দোকান খুললেই শ’খানেক পোস্টার সাইজের কাগজ কিনে আন। সেই সঙ্গে রঙ তুলি কিংবা ওই যে সব রঙিন কলম বেরিয়েছে তার কয়েকটা। আমাতে-তোতে মিলিয়ে আজ পোস্টারগুলি লিখে ফেলি। রবিবার বিকেলে চৌমাথায় আমি একটি ভয়ঙ্কর সংবাদ জানাব। সেই জন্যে সবাই যেন সেখানে আসে। তারপর পোস্টারগুলো সমস্ত শহরে ছড়িয়ে দেব। আর-একটা কাজ করতে হবে। সুধীরের দোকানে বলে দিতে হবে রবিবার বিকেলে আমার একটা ভালো মাইক চাই। পারবি তো?
নিশ্চয়ই পারব বাবা।
গুড, আমরা কনকপুরের পাড়ায়-পাড়ায় সভা করে মানুষকে বলব ঘটনাটা। খবরের কাগজ যারা পড়তে পারে না তারাও শুনবে।
ঘরময় পোস্টারের কাগজ, বাপ-মেয়েতে মিলে জনসভায় যোগদানের কথা লেখা হচ্ছিল। লেখাগুলো অগোছালো হলেও আন্তরিকতা ছিল। কাজল এসে দরজায় দাঁড়ালেন। এই সব কাণ্ড দেখে তাঁর অবাক-বোধও কাজ করছিল না। এই সময় সুব্রত এল। এসে বলল, কাকাবাবু, আমার এখানকার পাট চুকল। কাজল ওকে দেখে ভ্রূ কুঁচকে ছিলেন, কথাটা শুনে আগ্রহী হলেন।
সুর্মা বলল, তার মানে?
এতদিন কনকপুর ছেড়ে বাইরে চাকরি নিয়ে যাওয়ার কথা হলেও যেতে পারতাম না। জায়গাটার ওপর মায়া পড়ে গিয়েছিল বড্ড, চাকরিটা পিছু টানত। আজ থেকে মুক্ত হলাম। কনকপুর ডেভেলপমেন্ট আমাকে আর চায় না। সুব্রত হাসল।
কাজল বলে উঠলেন, তোমারও চাকরি গেল?
হ্যাঁ। কর্তৃপক্ষ আমার কাছে সন্তুষ্ট নয়।
অপরেশ বললেন, পোস্টার লিখছি। এই শহরের মানুষকে বাঁচাতে হবে। ওরা আমার লেখাটা কাগজে ছাপাতে দেয়নি। কিন্তু পোস্টার লেখা তো বন্ধ করতে পারবে না।
সুব্রত ঝুঁকে পোস্টারগুলো দেখল, আর-একটু ডাইরেক্ট করলে হতো না?
কীরকম? অপরেশ বুঝতে পারলেন না।
উদ্দেশ্যটা আরও স্পষ্ট লিখলে লোকের ইন্টারেস্ট বাড়ত।
সুর্মা মুখ ঘুরিয়ে বলল, উপদেশ না দিয়ে নিজে কলম ধরলেই তো হয়। অপরেশ হেসে উঠলেন, হ্যাঁ-হ্যাঁ, এখন তো তুমি আমাদের চাকরি-হারাদের দলে ভিড়ে গেছ। অতএব এসো, বসে পড়ো, একসঙ্গে প্রতিবাদ লিখতে শুরু করি।
সুব্রত সুর্মাকে বলল, তুমি সরো, বরং এক কাপ চা করে নিয়ে এসো।
দরজায় এতক্ষণ দাঁড়িয়ে এদের কথা শুনছিলেন কাজল। এবার বললেন, না তুই থাক, আমিই করে দিচ্ছি।
সবাই হঠাৎ চুপ হয়ে গেল। তারপরেই অপরেশের উচ্চস্বর শোনা গেল, বাঃ গুড, আমাদের দলে আর-একজন সৈনিক বাড়ল, নে হাত চালা সব। যুদ্ধে আমাদের কে হারায় তা দেখব!
এইদিন বিকেলে কনকপুরে দুটো ঘটনা ঘটল। একদল উত্তেজিত যুবক সমাজপতির কাগজের অফিস আক্রমণ করে আগুন ধরিয়ে দিল। তেমন কিছু ক্ষতি হওয়ার আগেই অবশ্য দমকলবাহিনী আগুন নিভিয়েছে। সমাজপতির মাথায় পাথর পড়েছিল, ফলে দুটো সেলাই করতে হয়েছে। ছেলেরা খুব উত্তেজিত ছিল এই কারণে তারা এই ধরনের তথ্য আশাই করেনি যা ওই দিন ঢাক পিটিয়ে কাগজে ছাপা হয়েছে। গুপ্ত নিজে ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদের বুঝিয়েছেন যে, এইভাবে সংবাদপত্র যাতে জনসাধারণকে অকারণে উত্তেজিত না করে সেদিকে তিনি বিশেষ নজর দেবেন। এ ব্যাপারে তিনি কনকপুরের জনগণের সহযোগিতা কামনা করেন। তিনি বলেন, আজ যে ঘটনা ঘটল তা থেকে সংবাদপত্রের মালিক ভবিষ্যতে শিক্ষা গ্রহণ করবে। যুবকরা সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে যায়। পুলিশের বড়কর্তা অবশ্য তাদের গ্রেপ্তার করতে চেয়েছিলেন কিন্তু গুপ্ত তাঁকে নিষেধ করেন।
কিছু পরে মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে সমাজপতি যখন কাগজের অফিসে ফিরে এলেন তখন গুপ্তই তাঁকে অভ্যর্থনা করলেন, কনকপুরের জন্যে তোমার এই আত্মত্যাগ মনে থাকবে।
আত্মত্যাগ? সমাজপতি মিনমিন করছিল, ওরা আমার কী সর্বনাশ করল। হায়-হায় কত কী যে পুড়ে গেল! এ সব আপনার কথা শোনার ফল। আজ অর্ধেক কাগজ বিক্রি হয়নি, সব ওরা পুড়িয়ে দিয়েছে। হায়-হায়, কী দুর্মতি হল আমার! এ আপনি কী করলেন স্যার!
গুপ্ত হাসলেন—ঠিকই করেছি। কনকপুরের ইতিহাসে তোমার নাম লেখা থাকবে। শোনো নার্ভাস হয়ো না, দাশগুপ্ত বলেছে তোমার যা ক্ষতি হয়েছে সব সে পূরণ করে দেবে। তুমি ক্ষতির হিসেব-নিকেশ করে কালই টাকাটা নিয়ে এসো।
কথাটা শোনামাত্রই সমাজপতির মুখ উজ্জ্বল হল—ওঃ, সত্যিই আপনি মহৎ মানুষ। কিন্তু ওই গুণ্ডাগুলোকে কখনই ছাড়বেন না, ওদের অন্তত দশ বছর করে ঘানি ঘোরাবেন।
না হে, ওদের ধরিনি।
ধরেননি!
না। কেননা এটা করতে আমিই ওদের পাঠিয়েছিলাম।
সে কি! সমাজপতি বোবা হয়ে গেল যেন।
হুম। এটা না করলে কনকপুরের যুবসমাজের প্রাণশক্তি কতটা উদ্দাম তা বোঝানো যেত না। এ সব তুমি বুঝবে না সমাজপতি। কথাটা বলে গুপ্ত চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ালেন, তোমার ওই অবিনাশ ছোঁড়াটাকে যত তাড়াতাড়ি পারো বিদায় করো।
দ্বিতীয় ঘটনাটা ঘটল আর-একটু বাদে। সন্ধের অন্ধকার সামান্য গাঢ় হলে দুজন মানুষ দেওয়ালে-দেওয়ালে পোস্টার মারছে দেখা গেল। একজন আঠা লাগাচ্ছে, অন্যজন সেটাকে দেওয়ালে সাঁটছে। এখন ঠান্ডার কারণে সন্ধের পরই কনকপুর নির্জন হয়ে যায়। ফলে এদের কাজকর্ম তেমন নজর করে দেখার মতো কেউ ছিল না।
পরদিন সকালে সমস্ত কনকপুর যেন নড়েচড়ে বসল। বিকেলে চৌমাথায় জনসভা ডাকা হয়েছে। ডাক্তার অপরেশ গুপ্ত কনকপুরের মানুষকে আসন্ন বিপদ সম্পর্কে অবহিত করবেন। সেই সঙ্গে স্লোগান, জল ফুটিয়ে পান করুন। কারণ ওতে বিষ আছে।
আটটা নাগাদ গুপ্তর গাড়ি এসে থামল অপরেশের বাড়ির সামনে। একটু আগে সুর্মা শহরের একটা দিক ঘুরে এসেছে। লোক যেতে-যেতে পোস্টারগুলো পড়ছে। অপরেশ বারান্দায় বসে সেই বৃত্তান্ত শুনছিলেন। তাঁর ইচ্ছে হচ্ছিল নিজের চোখে দেখেন মানুষের আগ্রহ কতটা। শোনার পর বললেন, হুঁ, ওরা কাগজে ছাপেনি তো কী হয়েছে, আমাদের আটকাতে পারল! ঠিক সেই সময় গাড়ির শব্দ হল।
গেট খুলে গুপ্ত দেখলেন ওরা খুব অবাক চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে।
এবার কাজল এসে দরজায় দাঁড়ালেন।
বারান্দায় উঠে কেউ কিছু বলার আগে গুপ্ত চেয়ার টেনে বসে বললেন, তুমি বক্তৃতা দিতে চাও সে কথা আমাকে বললে না কেন?
অপরেশের বিস্ময় আরও বেড়ে গেল। তিনি বলতে পারলেন, মানে?
আজ বিকালে বৃষ্টি হতে পারে। তা ছাড়া, চৌমাথায় ইলেকশানের সময় ছাড়া বক্তৃতা করা নিষেধ। তুমি পুলিশের অনুমতি পর্যন্ত নাওনি। গুপ্ত অনুযোগ করলেন।
আমি জানতাম না। তা ছাড়া, সবাই ওই জায়গাতেই সভা করে থাকে।
করে। কিন্তু তুমি আমার ভাই হয়ে বৃষ্টিতে ভিজে—না, না, সেটা খুব খারাপ দেখায়। বরং এক কাজ করো, আমাদের মিউনিসিপ্যালিটির বিরাট হলঘর খালি আছে সেখানেই আজ তোমার বক্তৃতা দাও। গুপ্ত অন্যান্যদের দিকে তাকালেন।
সুর্মা বলল, শীতকালে অ্যাদ্দিন বৃষ্টি হয়নি, আজ হঠাৎ হবে যে!
গুপ্ত কাঁধ নাচালেন—তা আমি কী করে জানব। আবহাওয়া অফিস থেকে তো এই রকমই জানিয়েছে।
অপরেশ বললেন, সবাই জেনেছে আমি চৌমাথায় বলব, হঠাৎ যদি সভার জায়গা পালটে ফেলি তাহলে লোকে জানবে কী করে?
গুপ্ত বললেন, এটা কোনও কথা হল! লোকে যাতে জানতে পারে তাই করব। মাইকে করে সারা শহরে ঘোষণা করে দিচ্ছি তোমার সভার জায়গা পালটাচ্ছি। সবাই জেনে যাবে।
হঠাৎ কাজল বললেন, আপনি যে বড় ওর সভা নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছেন! আমার সব সর্বনাশের মূলে তো আপনি!
গুপ্ত যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। কয়েক মুহূর্তে চেয়ে থেকে বললেন, ও, শেষপর্যন্ত তুমিও! চমৎকার। তোমাকে আমি সাবধান করে গিয়েছিলাম, আমার যে সর্বনাশ করবে আমি তাকে ছেড়ে দেব না।
তা হলে এসেছেন কেন? সুর্মা ফুঁসে উঠল।
এসেছি, কারণ তোমার বাবা আমার ভাই। আমি চাই না পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করুক। ওর বিরুদ্ধে এর মধ্যেই একটা ডায়েরি হয়েছে। আজ বিকেলে কতকগুলো গুণ্ডাকে দিয়ে ও সমাজপতির অফিসে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে ওর লেখা ছাপা হয়নি বলে। সারা শহর সেই খবরটা জেনে গেছে। পুলিশ কাল রাত্রেই ওকে অ্যারেস্ট করতে চেয়েছিল, আমিই তাদের থামিয়ে রেখেছি। কথাটা বলে গুপ্ত হতভম্ব মুখগুলোর দিকে তাকালেন।
কী! অপরেশ সোজা হয়ে বসলেন, আমি আগুন লাগিয়েছি! দাদা, এ রকম মিথ্যে কথা তুমি বলতে পারলে?
আমি বলছি না, সমাজপতিই পুলিশের কাছে এ-কথা বলেছে।
মিথ্যে কথা! ষড়যন্ত্র! ওঃ ভগবান! অপরেশ চিৎকার করে উঠলেন। গুপ্ত মাথা নাড়লেন—আমিও তাই মনে করি। কিন্তু মুশকিল হল, পুলিশের কাছে কোনও অভিযোগ এলে তার তদন্ত না করে কোনও উপায় থাকে না। যাক, আমি চাই না তোমাকে নিয়ে এই শহরে কোনও কেচ্ছা হয়। ওই চৌমাথায় বক্তৃতা করাটা ঠিক হবে না। মিউনিসিপ্যালিটি হলঘরে সভা হলে তুমি তোমার বক্তব্য বোঝাতে পারবে, আমরাও আলোচনায় অংশ নিতে পারব। যদি প্রমাণ করতে পারো তুমি সঠিক তা হলে সমস্ত সমস্যার সমাধনা হয়ে যাবে।
অপরেশ এক মুহূর্ত ভাবলেন। তাঁর মনে হল প্রস্তাবটা ভালো। হলঘরে বক্তৃতা করতে পারলে তিনি অনেক গুছিয়ে কথা বলতে পারবেন এবং ব্যাপারটাও বেশ গুরুত্ব পাবে। তিনি বললেন, বেশ কিন্তু জনসাধারণ যেন জানতে পারে যে সভার জায়গা বদল হয়েছে।
গুপ্ত উঠে দাঁড়ালেন। তারপর কাজলের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার জন্যে খুব দুঃখ হচ্ছে বউমা। তবে হ্যাঁ, বলছ যখন, তখন আর মাথা ঘামাব না।
দুপুরবেলায় কনকপুরের মানুষ সভার নতুন জায়গাটার কথা জেনে গেল। সমাজপতির কাগজের একটা বিশেষ সংখ্যা বেরিয়েছে। তাতে ওই সভার খবর আছে এবং জনগণকে সাবধান করা হয়েছে যে অপপ্রচারে যেন না ভোলেন কেউ। এই শহরের জল পবিত্র, স্বাস্থ্যকর। এ নিয়ে কোনও মতভেদ থাকতে পারে না।
বিকেলে মিউনিসিপ্যালিটির হল লোকে লোকে ভরে গেল। অপরেশ সপরিবারে এসেছিলেন একটু আগেই। গুপ্ত, দাশগুপ্ত এসে গেছেন। এই সময় একটি মাতাল সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে লাগল, আমাকে যেতে দাও, আমি একজন সৎ করদাতা। বক্তৃতা শোনার অধিকার আমার আছে। লোকেরা তাকে নিয়ে হাসাহাসি করছিল কিন্তু কেউ পথ দিচ্ছিল না। শেষপর্যন্ত মরিয়া হয়ে লোকটা বলল, না যেতে দিলে আমি বমি করে ফেলব বলে দিচ্ছি। তখন কাজ হল। সরু প্যাসেজ তৈরি হয়ে গেল আচমকা। লোকটি সেটা দিয়ে টলতে-টলতে সামনে এসে ধপ করে বসে পড়ল।
প্রচণ্ড হট্টগোল চলছি। হঠাৎ সুব্রত মঞ্চে এসে দাঁড়িয়ে মাইকে ঘোষণা করল, আপনারা শান্ত হোন। সভার কাজ এখনই শুরু হচ্ছে।
লোকেরা তাতেও শান্ত হচ্ছিল না। কারণ তারা তখন দুপুরের কাগজটার বিষয়ে আলোচনা করছিল। এই সময় সমাজপতি সারা মাথায়, হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে স্টেজে উঠে এলেন। তাঁর ওই চেহারা দেখে আলো নেভার মতো সব শব্দ থেমে গেল। সমাজপতির পা টলছিল, এত লোকের সামনে কথা বলার অভ্যেস তাঁর নেই। কিন্তু সবাই ভাবল অসুস্থতার জন্যেই ও রকম টলছেন। সুব্রত ওঁকে মাইক ছেড়ে দেবে কি না ভাবছিল কিন্তু জনতা চিৎকার করে ওঁর কথা শুনতে চাইল। বাধ্য হয়ে সুব্রত সরে দাঁড়ালে সমাজপতি মাইক ধরলেন। এতে তাঁর টলানিটা কমল। প্রায় কাঁদো-কাঁদো গলায় সমাজপতি বললেন, আমার অবস্থা তো দেখছেন। মরতে-মরতে বেঁচে আছি। আপনাদের সেবা করি বলে ওরা আমাকে মেরে ফেলেছিল!
কারা-কারা? সমস্বরে চিৎকার উঠল।
মাথা নাড়লেন সমাজপতি—বলা নিষেধ, আদালত অবমাননা হবে। যা হোক, আমার আবেদন, অপপ্রচারে ভুলবেন না। এটা যখন সভা, আমাদের প্রাক্তন ডাক্তারবাবু যখন সভায় কিছু বলতে চেয়েছেন তখন এই সভার একজন সভাপতি থাকা উচিত। আমি প্রস্তাব করছি শ্রদ্ধেয় প্রবীণ নেতা গুপ্তসাহেব এই সবার সভাপতির পদ গ্রহণ করুন।
সমর্থন করছি, সমর্থন করছি। সমস্ত হল একসঙ্গে জানাল।
এরপর নতমস্তকে মঞ্চে উঠে এলেন গুপ্তসাহেব। খুব বিনীতভাবে নমস্কার করে তিনি অপরেশকে মঞ্চে আহ্বান করলেন। অপরেশ সপরিবারে এতক্ষণ একপাশে অপেক্ষা করছিলেন। এবার ধীরে-ধীরে মঞ্চে উঠে চেয়ারে বসলেন। সঙ্গে-সঙ্গে শ্রোতারা চুপ করে গেল। তারা অপরেশকে দেখছিল।
গুপ্ত মাইকের সামনে এসে বললেন, বন্ধুগণ! এখানে এই সভায় বক্তৃতা করার কোনও বাসনা আমার ছিল না। কিন্তু যে সমস্যা নিয়ে আজকের এই সভা তাকে এড়িয়ে যাওয়া আমি কর্তব্যের গাফিলতি বলেই মনে করি। কনকপুর ডেভেলপমেন্টের প্রধান হিসেবে আমি তাই এসেছি। আমার ভাই এবং প্রাক্তন ডাক্তার মনে করেন এই শহরের জল দূষিত। অথচ আমরা বেশ ভালোভাবেই রয়েছি। এই জল নিয়ে অভিযোগ পাওয়ার পর আমি পরীক্ষা করিয়ে কোনও বিরূপ ফল পাইনি। আমি মনে করি এটা অপপ্রচার এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আপনারা তো জানেন, ভারতবর্ষের ইতিহাসে ভাই হয়ে ভাইয়ের ক্ষতি করার ঘটনা খুবই স্বাভাবিক।
শেম, শেম! চিৎকার করে উঠল জনতা।
আমি এই শহরকে রক্ত দিয়ে তৈরি করেছি। পাহাড় কেটে আমার চোখের সামনেই শহরটা গড়ে উঠল। আমি চাইব না এই শহরের সামান্য ক্ষতি হোক। জল যদি দূষিত হতো তাহলে আমিই তার ব্যবস্থা নিতাম। অতএব বন্ধুগণ, আমি প্রস্তাব করছি, এই সভা মনে করে কনকপুরের জল স্বাস্থ্যকর এবং তা নিয়ে যে-কোনও অপপ্রচার ঘৃণার যোগ্য।
সমাজপতি বলে উঠলেন, আমি এই প্রস্তাব সমর্থন করছি।
সঙ্গে-সঙ্গে মনে হল লক্ষ পায়রা যেন হলঘরে উড়ছে। হাততালি থেমে গেলে গুপ্ত আবার বললেন, কিন্তু আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। আমরা মনে করি বেঁচে থাকার অধিকার যেমন সকলের সমান তেমনি কথা বলারও সমান অধিকার আছে সকলের। তাই এবার ডাক্তারের মুখে আপনারা তাঁর কথা শুনুন। অনুরোধ করছি আপনারা অধৈর্য হবেন না।
গুপ্ত অপরেশকে ইঙ্গিত করে পিছনের চেয়ারে গিয়ে বসলেন।
অপরেশ যেই উঠতে যাবেন, অমনি চিৎকার শুরু হল।
মাইকের সামনে এসে দাঁড়িয়ে কয়েক মুহূর্তে নার্ভাস ভাবটা কাটিয়ে উঠলেন তিনি। তারপর গলা তুলে বললেন, বন্ধুগণ! আপনারা আমার কথা শুনুন। আমি যে কথা বলতে এসেছি তা আমার কোনও স্বার্থ মেটাতে নয়। আপনাদের জন্যে, আপনাদের বিপদের কথা ভেবে এই সভা ডাকা হয়েছে।
কী এমন পরোপকারী রে! কে একজন চিৎকার করে উঠলেও শ্রোতারা শব্দ কমাল। অপরেশ বললেন, আপনারা জানেন আমি এই শহরের ডাক্তার ছিলাম। আপনারা আমার কাছে আসতেন চিকিৎসার জন্যে। কিছুদিন থেকে লক্ষ করছিলাম অনেকেই পেটের গোলমালে ভুগছেন। সন্দেহ হওয়ায় জল পরীক্ষা করালাম। এই জলই হল সমস্ত গোলমালের মূলে। আমাদের শহরের খাবার জল আসে লেক থেকে। পরিশ্রুত সেই জল পাইপে করে বাড়িতে-বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়। কিন্তু ঠিক লেকের কাছেই একটি চামড়ার কারখানা আছে। তার নোংরা জল কোনওক্রমে পাইপের জলের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। এখন সেই পরিমাণ কম, কিন্তু আরও বেশি মিশলে শহরের সব জল বিষাক্ত হয়ে যাবে। অপরেশ দম নেওয়ার জন্যে থামতেই একটা বড় গুঞ্জন উঠল। কেউ একজন চিৎকার করে উঠল, মিথ্যে কথা! আমাদের কনকপুরের জলের এত সুনাম আর ডাক্তার তার উলটো কথা বলছে।
আর একজন চেঁচিয়ে উঠল, বিপ্লবী এসেছে রে!
অপরেশ আবার বলা শুরু করলেন, না, আমি বিপ্লবী নই। আমি যা বলছি তা বৈজ্ঞানিক মতে সত্যি। আমি কলকাতা থেকে জল পরীক্ষা করিয়ে এনেছি। জীবাণু দেখতে পেয়ে আমি কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি, কিন্তু তাঁরা গুরুত্ব দেননি। এইভাবে কিছুদিন চললে এখানে মহামারী দেখা দিতে বাধ্য। তাই বন্ধুগণ, আজকের এই সভায় আপনাদের কাছে অনুরোধ করছি কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করতে যাতে আমরা ভালো জল পাই। এর দুটো উপায় আছে। এক : শহরের সমস্ত জলের পাইপ পালটে ফেলা। মনে হয় ওগুলোকে মরচে পড়ে গেছে। দুই : ওই চামড়ার কারখানাকে তুলে দেওয়া। আপনারা আমার পাশে এসে দাঁড়ান, আসন্ন সর্বনাশ থেকে শহরকে রক্ষা করতে কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করুন। সমস্ত হলঘর এবার নিশ্চুপ হয়ে গেল। অপরেশের মনে হল জনতা তাঁর বক্তব্য উপলব্ধি করতে পেরেছে।
এই সময় গুপ্ত চেয়ার ছেড়ে উঠে এলেন। ইঙ্গিতে অপরেশকে সরিয়ে মাইক হাতে নিলেন, বন্ধুগণ, আমার ডাক্তার ভাই যে এত চমৎকার বক্তৃতা করতে পারেন জানা ছিল না। আমার প্রথম প্রশ্ন, এই জল বিষাক্ত তার প্রমাণ কী? তিনি কোনও রিপোর্ট দিতে পারেননি। এরকম অপপ্রচারের ফলে ট্যুরিস্টরা যদি এখানে না আসেন তাহলে আপনাদের ব্যবসা মার খাবে। আপনারা কী বলেন? জলের পাইপ পালটানোর কথা বলছেন উনি। আমি মনে করি না এই শহরের জলের পাইপ খারাপ হয়েছে। কোথাও হয়তো সামান্য লিক করতে পারে, কিন্তু সে তো মেরামত করে নিলেই চলবে। তা ওঁর আবদার মতো যদি জলের পাইপ পালটাতে হয় তাহলে আমাদের কুড়ি লক্ষ টাকা খরচ হবে। এই টাকাটা কোত্থেকে আসবে? জলের পাইপ পালটাতে হলে আপনাদের অতিরিক্ত ট্যাক্স দিতে হবে। তার পরিমাণ মাথাপিছু চারশো টাকা। উনি চামড়ার কারখানার কথা বললেন। আমরা দেখছি ওই কারখানা অত্যন্ত যত্নে পরিচালিত হয়। কোথাও কোনও ত্রুটি নেই। শুধু সন্দেহের বশে যদি কারখানা সরিয়ে নিতে বলা হয় তাহলে প্রায় একশো পরিবার বেকার হবে। কারণ আমাদের অনেক অনুরোধে দাশগুপ্ত এখানে কারখানা করেছেন। বিরক্ত হয়ে তাঁর পক্ষে সমতলে চলে যাওয়া স্বাভাবিক। তিনি এখানে থেকে চলে গেলে কনকপুরের ওপর ভীষণ অর্থনৈতিক চাপ আসবে। এসব সত্বেও আপনারা যদি চান তো ডাক্তারের পাগলামি আমরা মেনে নেব। দু-হাত দু-দিকে বাড়িয়ে ঝুঁকে দাঁড়ালেন গুপ্ত।
এবার বিস্ফোরণ হল। যেন আগুনের ছ্যাঁকা লেগেছে শ্রোতাদের গায়ে—পাগলটাকে বের করে দাও, তাড়িয়ে দাও কনকপুর থেকে। চারধারে এমন একটা গোলমাল পাকিয়ে উঠল যে অপরেশ নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারলেন না। সুব্রত এসে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছে। তিনি আবার মাইকের সামনে যেতে চাইলে গুপ্ত তাঁকে বাধা দিলেন, কী আরম্ভ করেছ? দেখছ না পাবলিক তোমাকে অপছন্দ করছে। আমাকে সামলাতে দাও। বন্ধুগণ, আপনারা এরকম উত্তেজিত হবেন না। আমাদের ঠান্ডা মাথায় সব ভাবতে হবে। আমি অনুরোধ করছি আপনারা শান্ত হন।
বারংবার আবেদনের পর জনতা একটু ঠান্ডা হলে সামনের সারিতে বসা একটা লোক উঠে দাঁড়াল, আমি কর দিই, তাই একটা কথা বলব।
তারপরেই উত্তরে অপেক্ষা না করে বলে উঠল, আমি জল খাই না, জলে বিষ থাকল কি না থাকল তাতে বয়েই গেল। ডাক্তারবাবু যদি জলের বদলে পাইপে মাল চালান দেয় তা হলে আমি ওঁর দলে আছি। এই হল গিয়ে আমার কথা। সঙ্গে-সঙ্গে সবাই হো-হো করে হাসতে লাগল, কয়েকজন জোর করে লোকটাকে মাটিতে বসিয়ে দিল। লোকটা চেঁচাতে লাগল, আমার গণতান্ত্রিক অধিকার—
মাইকে তখন গুপ্তর গলা শোনা গেল, হ্যাঁ, গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু সেটা প্রয়োগ করার সময় মনে রাখতে হবে অন্যের ক্ষতি যেন না হয়। ডাক্তারকে আমরা সেই অধিকার দিয়েছিলাম কিন্তু তিনি তার বদলে কী করলেন? না, মিথ্যে কথা বললেন। বন্ধুগণ, মনে রাখবেন তিনি আমার ভাই, দয়াপরবশ হয়ে পুরুলিয়ায় গ্রাম থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে এসে এই শহরের ডাক্তারের চাকরিতে দিয়েছিলাম শুধু তাঁর পাণ্ডিত্যের জন্যে। কিন্তু তিনি যখন আপনাদের ক্ষতি করতে চাইছেন তখন আমি তাঁকে ক্ষমা করতে পারি না। প্রচণ্ড হাততালির মধ্যে গুপ্ত বললেন, তাই আমি প্রস্তাব করছি, অবিলম্বে তিনি এই শহর পরিত্যাগ করুন। এই সভা তাঁকে এই জন্য আটচল্লিশ ঘণ্টা সময় দিল।
শেষপর্যন্ত পুলিশের গাড়িতে তাঁদের বাড়ি ফিরতে হল। অপরেশ বিধ্বস্ত, মাথা তুলতে পারছেন না। আসার সময় জনতা তাঁকে বিদ্রূপ করেছে। মাথা নিচু করে নিজের চেয়ারে বসে ছিলেন। সুব্রত কথা বলছিল না। কাজল পাথরের মতো দাঁড়িয়ে।
সুর্মা বলল, বাবা, তুমি ভেঙে পড়ো না। চললেন কাল সকালে আমরা এই শহর ছেড়ে চলে যাই। অপরেশ উত্তর দিলেন না। সুব্রত এবার বলল, কাকাবাবু আমরা তো আছি। আপনাদের কোনও অসুবিধে হবে না।
অপরেশ এবার মুখ তুললেন—তোরা আমাকে পালিয়ে যেতে বলছিস! সুর্মা বলল, পালানোর কথা বলছ কেন? এখানকার মানুষ তোমার কথা বুঝবে না। অর্থের ওপর হাত পড়লেই এরা অন্ধ হয়ে যায়। তার চেয়ে যেখানে গিয়ে তুমি মনের মতো কাজ করতে পারবে সেখানে চলে যাওয়াই তো ভালো। এবার কাজল কথা বললেন, সে-রকম জায়গা কোথায় আছে?
জানি না। কিন্তু পৃথিবীতে ভালো মানুষও তো আছে। যেমন প্রয়োজন যদি হয় তবে আমরা জঙ্গলের আদিবাসীদের কাছে যাব। ওরা সরল। এই শহর করতে গিয়ে আমরা ওদের তাড়িয়ে দিয়েছি। সুর্মা উত্তেজিত গলায় জবাব দিল।
আর সেই সময় পাশের জানলার কাচ ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল। ঘরের মধ্যে ছিটকে এল একটা বড় পাথর। মেয়েরা আর্তনাদ করে উঠতেই সুব্রত ছুটে গেল বাইরে। আর ঠিক তখনই আর-একটা পাথর এসে পড়ল অপরেশের মাথায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল। কাজল চিৎকার করে ছুটে এলেন। নিজের আঁচল স্বামীর মাথায় চেপে ধরে বললেন, এ কী হচ্ছে? কে ঢিল ছুড়ছে!
অপরেশ বিহ্বল ভাবটা কোনওক্রমে কাটিয়ে উঠে বললেন, এ সব তো এখন হবেই। সুর্মা, মা, যা ব্যান্ডেজ আর তুলো নিয়ে আয়।
অপরেশের মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা হলে সুব্রত ফিরে এল। এসে চমকে উঠল, এ কী! কী হয়েছে আপনার?
ও কিছু না। কী দেখলে?
দুটো লোক। অল্পের জন্য ধরতে পারলাম না।
চেনো?
না। সাধারণ লোক। আপনার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে ওরা?
হুম!
কাদের জন্যে আপনি এত ভাবছেন? যাদের উপকার করতে আজ আপনার চাকরি গেল, অপদস্থ হলেন, তারাই আপনাকে আহত করল।
অপরেশ হাসলেন—সুব্রত! পৃথিবীর নিয়মই তো এটাই। কিন্তু ওরা জানে না কী সর্বনাশ আসছে ওদের। না-না, পালিয়ে যেতে পারব না আমি। ওদের বাঁচাতেই হবে আমাকে।
কাজল জিজ্ঞাসা করলেন, কীভাবে? কেউ তো তোমার কথা শুনছে না। অপরেশ উঠে দাঁড়ালেন—রাস্তা আছে। তোমরা যদি চাও তো শহর ছেড়ে চলে যেতে পারো।
সুর্মা বলল, তোমাকে ফেলে আমরা চলে যাব ভাবছ কী করে?
সুব্রত জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু রাস্তাটা কী?
অপরেশ ধীরে-ধীরে ভাঙা জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন, দেখো কী সুন্দর আকাশ, কত পবিত্র। আজও কিন্তু বৃষ্টি হয়নি। আমার তো দিন ফুরিয়ে এল, কিন্তু তোমাদের এখনও অনেক পথ যেতে হবে। চোখ খোলা রেখো, দেখবে নোংরা যেমন আছে সুন্দর পবিত্র জিনিসেরও অভাব নেই পৃথিবীতে। সুর্মা চাপা গলায় বলল, বাবা!… অপরেশ এগিয়ে এসে মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন—তোর ওপর ভরসা আছে মা। তুই কখনও ভুল করিসনি। কাজল, তোমার কি মনে আছে কিছু দিন আগে একটা লোক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল কোমরে গুলি খেয়ে!
কাজল বললেন, হ্যাঁ, লোকটা ডাকাত। মরে গিয়েছিল তো!
হ্যাঁ। ও না মরলে পুলিশ ওকে ফাঁসিতে ঝোলাত। সেই লোকটা মরার আগে একটা কথা বলে গিয়েছিল আমাকে। প্রতিজ্ঞা করিয়েছিল পুলিশকে যেন খবরটা না দিই। আজ আমি সেই খবরটাকে কাজে লাগাব। অপরেশের মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।…কী খবর? কাজল প্রশ্ন করলেন।
কিছু গড়তে গেলে ভাঙতেই হয়। না হলে এই শহরের মানুষকে বাঁচানোর কোনও উপায় নেই। আমি চলি। অপরেশ পা বাড়ালেন।
কোথায় যাচ্ছ? কাজল এগিয়ে এসে ওঁর হাত ধরলেন।
বললাম তো, এই শহরের মানুষকে বাঁচাতে। ডাকাতটা বলেছিল, ও পাহাড় ভাঙার ডিনামাইট চুরি করতে এসেছিল। ওর সঙ্গীও ভয়ে পালিয়েছে। ও একটা বাক্স উত্তর পাহাড়ের মাঝখানে তিনটে সাদা পাথরের খাঁজে লুকিয়ে রেখেছে। সেখানে কীভাবে যেতে হয় আমি জানি। অস্বাভাবিক হাসলেন অপরেশ।
কী করবে ডিনামাইট দিয়ে? কাজল হাত ছাড়ছিলেন না।
অহিংস পথে তো হল না। ওই ডিনামাইট দিয়ে আমি চামড়ার কারখানা উড়িয়ে দেব। তাতে জলের পাইপও আস্ত থাকবে না। তখন ওরা বাধ্য হবে পাইপ পালটাতে আর কারখানা সরাতে।
কিন্তু যদি ডাকাতটা মিথ্যে কথা বলে থাকে! যদি সেখানে ওরকম বাক্স সে না লুকিয়ে রাখে! উত্তেজনায় সুর্মা এগিয়ে এল।
না মা, মৃত্যুপথযাত্রী কখনও মিথ্যে কথা বলে না।
সুব্রত বলল, কাকাবাবু, আপনি থামুন, দায়িত্বটা আমাকে দিন।
অপরেশ হাসলেন, না হে। তুমি কেন, আমিই যাব। তোমার সামনে এখন কত উজ্জ্বল দিন, তুমি কেন যাবে?
কাজল বললেন, বেশ। তা হলে আমি যাব তোমার সঙ্গে!
তুমি! বিস্ময়ে তাকালেন অপরেশ।
হ্যাঁ। তোমার একার পক্ষে সব কাজ হয়তো সম্ভব হবে না। আমি তোমাকে সাহায্য করব। কাজল জোরের সঙ্গে বলে স্বামীর হাত ছেড়ে দিলেন।
কিন্তু পাহাড়ের পথ কষ্টকর, তা ছাড়া, ধরা পড়ার যথেষ্ট ভয় আছে।
দুজনে থাকলে সে সম্ভবনা কম। লোকে সন্দেহ করবে না।
কিন্তু এর পরিণামের কথা জানো? আমরা আর না-ও ফিরতে পারি।
সে তো খুবই ভালো। দুজনেই একসঙ্গে যাব। কেউ কারও জন্য কাঁদব না। শুধু যাওয়ার আগে জেনে যাব আমরা হাজার-হাজার মানুষকে বাঁচিয়ে গেলাম। না গো, তুমি আর না বলো না। মা হিসেবে এই দায়িত্বটুকু পালন করতে দাও।
সেই কনকনে ঠান্ডায় কনকপুরে সেদিন মানুষেরা যে যার ঘরের মধ্যে। হিম বাতাস চারপাশে নড়েচড়ে বেড়াচ্ছিল। আকাশে সাদাটে চাঁদের হাড়ে হয়তো ঘুণ লেগেছিল, কারণ, কুয়াশারা ক্রমশ ঘোলাটে হয়ে উঠেছিল। দুটো প্রৌঢ় শরীর যা পৃথিবীর জল-হাওয়ায় জীর্ণ হতে চলেছে, ওই অন্ধকারে তারুণ্য নিয়ে দ্রুত যাচ্ছিল উত্তরের পাহাড়ের দিকে। এই ঘুমন্ত শহরটাকে বাঁচাবার জন্যে ডিনামাইট দরকার। এই রাত্রেই।
.
(হেনরিক ইবসেনের নাটক ‘এনিমি অফ দি পিপল’-এর অনুপ্রেরণার রচিত উপন্যাস)
***