সশব্দে গাড়িটা বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত গুপ্ত অপেক্ষা করলেন। তারপর ঘরে ঢুকে দেখলেন সুর্মা চায়ের ট্রে নিয়ে ঢুকছে—ও মা, জেঠু আপনি কখন এলেন। সমাজপতিবাবু চলে গেছেন?
গেছেন। চা কি ওর জন্যে করেছিলে? গুপ্ত বললেন।
হ্যাঁ, মানে—
তাহলে আমাকে দিয়ে দাও। তোমার বাবার সঙ্গে আমার কথা আছে।
সুর্মা হাসল, বাবার সঙ্গে দেখছি আজ সবার কথা আছে।
এতক্ষণে অপরেশ কথা বললেন, ও সমাজপতির কথা বলছে।
সমাজপতির সঙ্গে কী কথা তোমার? গুপ্ত ভাইকে জিজ্ঞাসা করলেন।
ওঁর কাগজে লেখার ব্যাপারে—
কী বিষয়ে?
জনস্বাস্থ্য। অপরেশ চায়ের কাপ তুলে নিলেন। সুর্মা ভেতরে চলে গেল। গুপ্ত মাথা নাড়লেন—জেনারেল আলোচনা করো আপত্তি নেই। কিন্তু এই শহরের মেডিক্যাল অফিসার হিসাবে তুমি শহরের স্বাস্থ্য নিয়ে কোনও কথা লেখবার আগে একটু ভাববে। হ্যাঁ, যে জন্যে তোমার কাছে এলাম, তোমার চিঠি আজ কমিটি পেয়েছে।
অপরেশ জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা আলোচনা করেছেন?
হুঁ! কিন্তু তুমি আমার সঙ্গে প্রথমে কথা বললে না কেন?
আপনি তো কান দিচ্ছিলেন না।
তাই বলে সরাসরি কমিটিকে লিখবে? কমিটি মানে তো আমরাই এবং আমি।
কিন্তু মেডিক্যাল অফিসার হিসাবে সেটাই আমার কর্তব্য। তাই না?
ও! শোনো, আমরা আলোচনা করে দেখলাম তুমি যা লিখেছ তার কোনও প্রমাণ নেই। তোমার সন্দেহ ট্যুরিস্টদের পেটের অসুখের কারণ এখানকার জল। কিন্তু জল নিয়ে কোনও কমপ্লেন নেই। এই জল আশেপাশে সব শহরের। সেরা ট্যুরিস্টরা এখানে আসে ওই ভালো জলের জন্যেই। তোমার কথা যদি জানাজানি হয়ে যায় তা হলে ট্যুরিস্টরা প্যানিকি হয়ে যাবে। শুধু সন্দেহের বশে এ সব কথা বললে তুমি শহরের ক্ষতি করবে। এই জন্যে তোমাকে আমি এখানে নিয়ে আসিনি। গুপ্ত চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। গুপ্তর কথা চুপচাপ শুনছিলেন অপরেশ। এবার খুব শান্ত গলায় বললেন, না সন্দেহ নয়, নিশ্চিত প্রমাণ আছে আমার হাতে।
কী প্রমাণ? চমকে উঠলেন গুপ্ত। ওঁর কাপের চা চলকে উঠল।
এই শহরের জল জীবাণুযুক্ত। এবং এর পরিমাণ বেড়ে গেলে মহামারী দেখা দেবার আশঙ্কা আছে। স্পষ্ট গলায় বললেন অপরেশ।
কী বলছ! লেক থেকে জল তুলে শোধন করে আমরা পাইপে করে সেই জল শহরে পাঠাই। লেকের জলে যদি জীবাণু থেকেই থাকে তবে তা পরিশোধিত হয়ে যায়। তুমি এতে জীবাণু পেলে কোত্থেকে?
অপরেশ মাথা নাড়লেন—না, লেকের জলে জীবাণু নেই। খুব স্বাভাবিক আর পাঁচটা পাহাড়ি জলের মতনই। কিন্তু পাইপের জলেই জীবাণু পাওয়া যাচ্ছে।
কী করে বুঝলে?
এই কাগজগুলো দেখুন। আমার সন্দেহ হওয়াতে আমি ওই জল পরীক্ষার জন্যে কলকাতায় পাঠিয়েছিলাম। সেখান থেকে আজ রিপোর্ট এসেছে। ওরা বলছে পাইপের জল বিষাক্ত। সগৌরবে হাসলেন অপরেশ। সবিস্ময়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন গুপ্ত। ক্রমশ ওঁর মুখের পেশি শক্ত হয়ে উঠল। হাত বাড়িয়ে বললেন, কোথায় রিপোর্ট?
অপরেশ খামটা বাড়িয়ে দিলেন। গুপ্ত রিপোর্টটায় চোখ বুলিয়ে মুখ বিকৃত করলেন—এটা তো ভুলও হতে পারে।
অপরেশ মাথা নাড়লেন, না, নিচে লেখা আছে ওরা ডবল চেক করেছে। রিপোর্টটা ভাঁজ করে নিজের পকেটে রেখে গুপ্ত বললেন, আমার অনুমতি ছাড়া তোমাকে জল পরীক্ষা করার জন্যে পাঠাতে কে বলল?
আমার বিবেক।
তুমি কী চাও? গুপ্ত দাঁতে দাঁত রাখলেন।
এই শহরের জল জীবাণুমুক্ত হোক।
আমি মনে করি না জীবাণু আছে। অবশ্য তোমার এই কাগজের লেখা যদি সত্যি হয় তা হলে কীভাবে তা মুক্ত হবে বলে মনে করো?
পুরো ব্যবস্থাটাই পালটাতে হবে। প্রথমে ওই চামড়ার কারখানাটা ওখান থেকে সরানো দরকার। ওই চামড়া ধোওয়া জল চুঁইয়ে-চুঁইয়ে হয় রিজারভারে পড়ছে, না হয় ফাটা পাইপের জলে মিশছে। দ্বিতীয়ত, এই শহরের জলের পাইপগুলো পালটানো দরকার। এগুলো এখন দূষিত হয়ে গেছে। ব্যস। এই কথাগুলো বলতে পেরে অপরেশ তৃপ্ত হলেন।
ইউ আর ম্যাড! কমপ্লিটলি ম্যাড!
কেন?
এই শহরের জলের পাইপ পালটানোর কথা বলছ, পাগল না হলে কেউ এ কথা বলে! কত খরচ পড়বে জানো? কনকপুর ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন দেউলিয়া হয়ে যাবে। অসম্ভব প্রস্তাব। আর ওই ফ্যাক্টরির জল থেকেই যে এই ব্যাপারটা ঘটছে তার কোনও নির্দিষ্ট প্রমাণ আছে?
আছে। লেকের জল একরকম আর ঠিক ফ্যাক্টরির নিচের জল অন্য রকম। এ থেকেই বোঝা যায় গোলমালটা ওখান থেকেই হচ্ছে।
তুমি ভুলে যাচ্ছ ফ্যাক্টরিটা কার!
না, মোটেই ভুলছি না। দাশগুপ্ত আমার ভায়রাভাই কিন্তু তাতে আমার কিছু এসে যায় না। যে জনস্বার্থ-বিরোধী কাজ করছে তার কোনও ক্ষমা নেই।
তোমার স্ত্রীও কি একই মত পোষণ করে?
জানি না।
গুপ্ত এবার উঁচু গলায় ডাকলেন, বউমা?
কাজল বোধহয় কাছাকাছি ছিলেন। দুবার ডাকতেই দরজায় এসে দাঁড়ালেন, আমাকে ডাকছেন দাদা?
হ্যাঁ। গুপ্ত মাথা নাড়লেন, তোমার জামাইবাবুর চামড়ার ফ্যাক্টরিটা এখান থেকে তুলে দিলে তুমি কি খুশি হবে?
ওমা! সে কি কথা! দিদির এত বড় সর্বনাশ করবেন কেন?
আমি করছি না, করছে তোমার স্বামী।
মানে? কাজল স্বামীর দিকে তাকালেন।
অপরেশ বললেন, তোমার জামাইবাবুর ফ্যাক্টরির জন্যে এই শহরের মানুষের জীবন বিপন্ন। চামড়া ধোওয়া জল পানীয় জলের সঙ্গে মিশে বিষাক্ত করছে। তা ছাড়া, ওই ফ্যাক্টরিটা বেআইনিভাবে তৈরি হয়েছে।
কে বলল? গুপ্ত জিজ্ঞাসা করলেন।
সুব্রত।
হুম। সে ছোঁড়াও পেছনে লেগেছে দেখছি। গুপ্ত স্বগতোক্তি করলেন।
না দাদা, কেউ পিছনে লাগেনি। তুমি এই শহরটাকে গড়েছ, একে সন্তানের মতো ভালোবাস, আমি জানি। তাই একে বাঁচানোর জন্যে তোমাকে কঠোর হতেই হবে। অপরেশ পরম আবেগে কথাগুলো বললেন।
কাজল বললেন, ফ্যাক্টরিটা না তুলে দিয়ে কিছু করা যায় না?
না, ওটাই সব কিছুর মূলে।
কাজল জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি এত নিশ্চিত হচ্ছ কী করে?
হচ্ছি কারণ তার প্রমাণ আছে।
আমার ভালো লাগছে না। জামাইবাবু একেই তোমাকে পছন্দ করেন না, তারপর যদি শোনেন তমি এ সব কথা বলছ তা হলে—। তুমি তো দাদাকে সব বললে, এবার যা ভালো হয় দাদাই সব করবেন, তোমার আর মাথা ঘামানোর কী দরকার! অপরেশের কাছে দাঁড়ালেন কাজল।
তা তো নিশ্চয়ই। দাদা যদি কোনও ব্যবস্থা নেন তাহলে তো সব মিটেই গেল। অপরেশ গুপ্তর দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
এতক্ষণ গুপ্ত স্বামী-স্ত্রীর সংলাপ শুনছিলেন। এবার খুব ধীর গলায় প্রশ্ন করলেন, এই ব্যাপারটা আর কে-কে জানে?
আমাদের পরিবারের বাইরে কেউ নয়। আর হ্যাঁ, সুব্রত জেনেছে।
বাঃ! চমৎকার! তা শুনছি সুব্রত নাকি তোমার পরিবারের একজন হয়ে পড়েছে। তুমি কি জানো ওর বাবা পাগল ছিল?
পাগল! কাজল চমকে উঠলেন—কই জানি না তো!
জানবে কী করে? তোমরা তো অ্যাদ্দিন বাইরে-বাইরে ঘুরেছ। যা করবে বুঝে-সুঝে করো। সুব্রত ছোঁড়াটার সঙ্গে মেয়েকে বেশি মেলামেশা করতে দেওয়া উচিত হচ্ছে না। এমনিতেই শহরে এ নিয়ে নানান কথাবার্তা চলছে। গুপ্ত উঠলেন।
অপরেশ বললেন, দাদা, সুব্রত এ বাড়িতে আসে, ভালো ব্যবহার করে। ওকে আমাদের পছন্দ হয়েছে। এ ছাড়া অন্য সম্পর্ক তৈরি করার কথা আমার মাথায় কখনও আসেনি। তবে সুর্মা যদি ওকে নির্বাচন করে তাহলে আমার আপত্তি নেই।
ওর বাবার খবরটা শোনার পরও এ কথা বলছ?
হ্যাঁ। কারণ আমি ওর মধ্যে কোনওরকম অসুস্থতা দেখছি না।
কাজল বলল, কথাটা বলে আপনি খুব ভালো কাজ করেছেন দাদা। আমাদের একটু খোঁজখবর নিতে হবে এ ব্যাপারে।
অপরেশ স্ত্রীর দিকে তাকিয়েই মুখ ফিরিয়ে নিলেন। এই সব আলোচনা তাঁর পছন্দ হচ্ছিল না। তিনি সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন, তাহালে দাদা, আপনি, আপনারা কি আমার প্রস্তাব মেনে নিচ্ছেন?
কী বিষয়ে? গুপ্ত খুব সহজ গলায় শুধোলেন।
অপরেশ এক মুহূর্ত চুপ করে দাদাকে দেখলেন। তারপর নিজেকে সংযত করে জবাব দিলেন, জলের ব্যাপারে?
গুপ্ত বললেন, শোনো—তোমার কর্তব্য হল হাসপাতালে যেসব মানুষ অসুস্থ হয়ে আসবে তাদের সেবা করা, সারিয়ে তোলা। এর বাইরে কোথায় কী হচ্ছে তা জানার কোনও দরকার নেই।
অপরেশের মেজাজ গরম হয়ে গেল, আপনি ভুলে যাচ্ছেন দাদা আমি শহরের মেডিকেল অফিসার। এই পদের জোরে আমি ওই বিষয়ে মাথা ঘামাতে পারি। কারণ তাতে জনস্বাস্থ্য জড়িয়ে আছে।
জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকালেন গুপ্ত। তারপর কাজলের দিকে তাকিয়ে বললেন, বউমা, তোমার স্বামীকে সাবধান করে দাও। এই মুহূর্তে শহরের জলের পাইপ আর কারখানা পালটাতে হলে আমরা শেষ হয়ে যাব। আমার রক্ত জল করে গড়া শহরটায় আর কখনও ট্যুরিস্ট আসবে না। এ আমি কিছুতেই সইতে পারব না। ও অযথা ভয় পাচ্ছে। কিন্তু তা সত্বেও এ ব্যাপারে যদি বাড়াবাড়ি করে তা হলে আমি ছেড়ে কথা বলব না।
গুপ্ত আর দাঁড়ালেন না। একটু বাদেই তাঁর গাড়ির আওয়াজ উঠল রাস্তায়। অপরেশ দু হাতে মাথা চেপে চেয়ারে বসে পড়লেন। কাজল নিঃশব্দে পাশে এসে দাঁড়ালেন—শোনো!
অপরেশ মুখ তুললেন না।
কেন মিছে অশান্তি ডেকে আনছ?
অপরেশ মুখ তুললেন—অর্থাৎ?
সারাজীবন তো ওই একগুঁয়ে মনের জন্যে কষ্ট পেলে। আজ যখন একটু স্বাচ্ছন্দে আছি তখন খামোকা গোলমালে যাওয়ার কী দরকার?
অপরেশ চিৎকার করে উঠলেন, চমৎকার! বিষ খেয়ে সমস্ত শহরে মানুষ আগামীকাল ছটফট করবে জেনেও আজ আমি চুপ করে বসে থাকব? আমি বিজ্ঞানকে মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করতে শিখেছি। না, না। অন্যায়ের সঙ্গে আমি আপোস করতে পারব না।
কিন্তু তুমি একা কী করবে? দাদার কত ক্ষমতা জানো? তা ছাড়া, আর কেউ যখন এগিয়ে আসছে না তখন তোমার মাথাব্যথা কেন?
আর কেউ জানে না তাই এগিয়ে আসছে না। সবাইকে জানাতে হবে। মানুষ যখন বুঝবে ওই জল থেকে তার আশু সর্বনাশ, তখন সবাই এগিয়ে আসবে। না, তুমি আমাকে বাধা দিও না।
কাজলকে অবাক করে অপরেশ উঠে দাঁড়ালেন। তারপর আচমকা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন। পেছন থেকে কাজল চিৎকার করে উঠলেন, কোথায় যাচ্ছ তুমি?
অপরেশ উত্তর দিলেন, ভয় পেও না। এমন কিছু আমি করব না, যাতে তোমার কোনও ক্ষতি হয়। রাত হবে ফিরতে।
এরই মধ্যে পাহাড়ে বেশ অন্ধকার নেমেছে। হুহু করে কনকনে ঠান্ডা বইছে। না বাতাস নেই, শুধু ঠান্ডার ঢেউ যেন। অপরেশের একটু কাঁপুনি এল কিন্তু তিনি জোরে হাঁটতে লাগলেন। একটু জোরে হাঁটলেই শরীর গরম হয়ে যায়।
রাস্তায় একটাও মানুষ নেই। ঠান্ডা বাড়লেই আর কেউ বাইরে থাকে না। অপরেশ ভাবছিলেন, দাদা ওকে শাসিয়ে গেলেন। হ্যাঁ, তাঁর পরিবার দাদার কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু তিনি নন। তিনি তো বেশ ভালোই ছিলেন পুরুলিয়ায়। হয়তো দুবেলা ভাত জুটত না কিন্তু গ্রামে মানুষের ভালোবাসা পেয়েছিলেন। এই শহরের সুখ-স্বাচ্ছন্দে তাঁর কোনও লোভ নেই। তিনি যতক্ষণ মানুষ ততক্ষণ অবশ্যই অন্যায়ের প্রতিবাদ করে যাবেন।
বাঁক পেরিয়ে পা ফেলতেই হঠাৎ তাঁর কানে একটা কাতরানি এল। কেউ যেন ককিয়ে-ককিয়ে গোঙাচ্ছে। জায়গাটায় রাস্তার আলো কম। শব্দটা লক্ষ করে চারপাশে তাকাতে লাগলেন অপরেশ। কোনও প্রাণীর চিহ্ন নেই কোথাও। শব্দটা যেদিক থেকে আসছে সেদিকে কান পাতলেন তিনি। তারপর সেটা লক্ষ করে পায়ে-পায়ে এগোলেন। ডানদিকে পাহাড়ের গা ঘেঁষে ট্যুরিস্টদের বসবার জন্যে একটা সিমেন্টের বেঞ্চি করা আছে। শব্দটা আসছে তার তলা থেকে। ঝুঁকে পড়ে তিনি লোকটাকে দেখতে পেলেন। বেঞ্চির তলায় লোকটা কুঁকড়ে শুয়ে-শুয়ে কোঁকাচ্ছে। অপরেশ ডাকলেন, এই তুমি কে? কী হয়েছে?
সঙ্গে-সঙ্গে শব্দটা আরও বেড়ে গেল। অপরেশ এবার ভালো করে লক্ষ করলেন। না, পোশাক দেখে বোঝা যাচ্ছে লোকটা ভিখিরি নয়। জুতো-মোজা পরা, প্যান্টটিও অক্ষত। পরনে সোয়েটার আছে। অপরেশ এবার যেন জোরে ধমকে উঠলেন, অ্যাই চুপ করো! কী হয়েছে তোমার?
সঙ্গে-সঙ্গে লোকটা নির্বাক হয়ে গেল। গলা থেকে শব্দ বের হচ্ছে না। মুখ ঢেকেই প্রশ্ন করল, কে বাবা তুমি—ঈশ্বর?
অপরেশের এই ঠান্ডাতেও হাসি পেল—না, ডাক্তার।
ও, তা দুটো একই কথা।
কী হয়েছে?
ঠান্ডায় কষ্ট পাচ্ছি। এত কষ্ট আগে কোনও দিন পাইনি মাইরি।
তা এখানে কী করছ? বাড়িতে যাও।
কী জ্ঞান দিচ্ছ বাবা। আরে সেটা পারলে তো চলেই যেতাম।
কী হয়েছে তোমার?
হাঁটতে পারছি না। কোমর থেকে পা জমে গেছে।
এবার অপরেশের নাকে ভকভক করে মদের গন্ধ এল। লোকটা মদ খেয়ে এখানে পড়ে আছে। সঙ্গে-সঙ্গে মন বিরূপ হয়ে উঠল! কোনও কথা না বলে অপরেশ সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। এই লোকটার ওপর কোনও সহানুভূতি দেখানোর মানে হয় না।
অপরেশ পা ফেলে এগিয়ে যেতেই লোকটা আবার কোঁকাতে লাগল—যাবেন না, চলে যাবেন না, আমাকে বাঁচান।
অপরেশ ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, মদ খেয়ে নেশা করেছ, লজ্জা করে না!
করছে। মাইরি জীবনে কখনও আউট হইনি আর শেষপর্যন্ত আজই হলাম। কী লজ্জা! তা ঈশ্বর, তুমি আমাকে ফেলে যেও না মাইরি। মিনতি করতে লাগল লোকটা। অপরেশ একটু ভাবতে গিয়েই দুর্বল হয়ে পড়লেন। তিনি আবার পিছিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, কোন দিকে যাবে? আমি সামনের দিকে এগোচ্ছি।
আমিও পেছন দিকে এগোব না। আমার হাত ধরো ঈশ্বর!
লোকটা বেঞ্চির তলা থেকেই হাত বাড়িয়ে দিল। অগত্যা অপরেশ হাত ধরলেন। লোকটা গুঁড়ি মেরে বেঞ্চির তলা থেকে কোনওরকমে বেরিয়ে এসে অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলল, আমার পাদুটো ঠিক আছে?
ঠিক থাকবে না কেন?
কী জানি। মনে হচ্ছিল নেই, তাই বললাম। শালা এই মনটাই সবচেয়ে বেইমান। এটাকে অপারেশন করে বাদ দেওয়া যায় না, ঈশ্বর?
অপরেশের আবার হাসি পেল। এরকম প্রশ্নের সামনে তিনি কখনও পড়েননি। তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করলেন, আমার কাঁধে হাত রেখে তুমি হাঁটতে পারবে?
লোকটার পা টলছিল। শরীর রীতিমতো ঠান্ডা। মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। কয়েক পা এগিয়েই অপরেশের হাঁফ ধরে গেল। একটু দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি ওই বেঞ্চির তলায় ঢুকেছিলে কী করতে?
লোকটা এবার হাউ-হাউ করে কেঁদে ফেলল। অপরেশ এর জন্যে প্রস্তুত ছিলেন না। হকচকিয়ে গিয়ে ওকে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হল?
কান্না থামতে লোকটা বলল, সেইটেই তো লজ্জা। বেশ যাচ্ছিলাম পথ দিয়ে। হঠাৎ ওইখানটায় এসে আছাড় খেলাম। মাইরি, জীবনে প্রথম। পড়ে মনে হল আমি নেই। অনেকক্ষণ পরে বুঝলাম আছি। কিন্তু কোমর থেকে পা পর্যন্ত নেই। আর পা না থাকলে আমি হাঁটব কী করে? চিৎকার করলে লোকে টের পেয়ে যাবে, পাঁচজনে ছ্যা-ছ্যা করবে। ওই সময় বেঞ্চিটা নজরে এল। গড়িয়ে-গড়িয়ে ওর তলায় চলে গেলাম। ভাবলাম পা ফিরে এলে কেটে পড়ব। মাইরি, কী বলব? মাথার ওপর বেঞ্চির ছাদ, তবু শালা এত কনকনে ঠান্ডা যে বাপের নাম খগেন হয়ে গেল। কিন্তু পা নেই যার, তার কী করার আছে! এই সময় তুমি এলে।
অপরেশের মনে হল লোকটার মন সরল। তিনি সস্নেহে বললেন, ও সব ছাইপাঁশ খাও কেন?
লোকটা সজোরে মাথা নাড়ল—যাঃ শালা! আবার জ্ঞান! আরে আমি যদি না খেতাম তাহলে কি তোমার দেখা পেতাম, ঈশ্বর?
চৌমাথায় এসে নিষ্কৃতি পেলেন অপরেশ। একটা দোকানের সামনে লোকটা নিজে থেকেই চলে গেল। অপরেশের মনে হল লোকটা মদ খাওয়ার নাম করে নিজেকে ভুলিয়ে রেখেছে। আমি নেশা করেছি এই বোধ ওকে হয়তো অনেক কিছু থেকে আড়াল করে দূরে সরিয়ে রাখে।
হাসি পেল অপরেশের, আচ্ছা দাদারও কি একই অবস্থা নয়? শহরটাকে আমি তৈরি করেছি, ভালোবাসি, এই নেশা তাঁকে বাস্তব বোধ থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে নাকি?
সমাজপতির অফিসে আলো জ্বলছিল, কিন্তু সমাজপতি নেই। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে অপরেশ দেখলেন অবিনাশ টেবিলে উপুড় হয়ে প্রুফ দেখছে। পায়ের শব্দ পেয়ে সে মুখ তুলতেই অবাক হল। তড়িঘড়ি উঠে এসে জিজ্ঞাসা করল, আরে, আপনি হঠাৎ? কী ব্যাপার?
সমাজপতি কোথায়?
ঘুমুচ্ছেন।
ঘুমুচ্ছেন! এই সন্ধেবেলায়? দেওয়াল ঘড়িতে তখন আটটা বাজে।
ফার্স্ট রাত্রে উনি লাস্ট রাত্রে আমি, এই নিয়ম।
ডাকো ওঁকে। চেয়ার টেনে বসলেন অপরেশ।
অসম্ভব। এখন ডাকা নিষেধ আছে।
কিন্তু আমার যে জরুরি দরকার ছিল!
কী ব্যাপারে বলুন? ওঁর ঘুমের সময়ে যে-কোনও ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আমার আছে। জেগে থাকলে নেই।
অবিনাশ নিজের টেবিল-চেয়ারে ফিরে গিয়ে বসে বেল বাজাল। একটি ছোকরা ঢুকতেই সে প্রুফগুলো তাকে ধরিয়ে দিয়ে হুকুম করল, ছাপা শুরু হবে আধঘণ্টার মধ্যে, ওদের বলে দাও।
ছোকরা চলে গেলে অপরেশ বলল, অবিনাশ, আমার কাছে এমন তথ্য আছে যা ছাপা অত্যন্ত জরুরি।
ঘাড় নাড়ল অবিনাশ, ওই ওষুধের ব্যাপারে তো? ওটা অবশ্য এমন কিছু জরুরি নয়। আমার তো ওষুধ খেতে একদম ভালো লাগে না।
মাথা নাড়লেন অপরেশ, ওষুধ নয়। এই শহরকে বাঁচাতে হবে। তোমরা জানো না কী ভীষণ বিপদের মুখে এই শহর দাঁড়িয়ে। এইভাবে যদি চলে তাহলে আগামী এক বছরের মধ্যে এই শহরের প্রতিটি মানুষ রোগে আক্রান্ত হবে এবং একবার আক্রান্ত হলে শেষ হয়ে যাবে শহরটা।
সোজা হয়ে বসল অবিনাশ—কী বলছেন আপনি!
ঠিকই বলছি। আমি সমস্ত ব্যাপারটা তোমাদের কাগজে ছাপাতে চাই।
উত্তেজনা এসে ভর করল অবিনাশকে। চট করে সে তার ডায়েরি আর কলম টেনে নিল—বলুন, বলুন, আমি এক্ষুনি লিখে নিচ্ছি।
তুমি লিখবে? আমি ভাবলাম নিজেই বিস্তারিত লিখব। অপরেশ আড়ষ্ট বোধ করলেন। ডিক্টেশন দেওয়ার জন্যে তিনি ঠিক তৈরি ছিলেন না। অবিনাশ বলল, তা হলে তো কালকের কাগজে ছাপা যাবে না। আমার পেজ মেকাপ হয়ে গেছে বললেই হয়। ঠিক হ্যায়, সর্বনাশা খবর বলে অ্যানাউন্স করে দিচ্ছি। পরশুদিন তাহলে মারকাটারি সেল হবে। আগে থেকে বাজার গরম করে রাখা ভালো। কিন্তু খবরটা কী বলুন তো?
অপরেশ হাসলেন, আমাকে তুমি একটা কাগজ আর কলম দাও।
দেড়ঘণ্টা লাগল লেখাটা তৈরি করতে। সমস্ত ঘটনা স্পষ্ট ভাষায় লিখলেন অপরেশ। কিন্তু লেখাটার হেডিং তৈরি করতে গিয়ে বিপদে পড়লেন। কোনও শব্দই তাঁর পছন্দ হয় না। শেষমেশ হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, নাও, এটা পড়ে ভালো হেডিং দিয়ে দাও। ওটা আমার আসছে না।
এতক্ষণ নিজের চেয়ারে বসে জুলজুল করে তাকিয়ে ছিল অবিনাশ। এবার এক ফাঁকে কাছে এসে লেখাটাকে তুলে নিল, নিয়ে বলল, ইস, আপনাদের মানে ডাক্তারদের, হাতের লেখা খুব খারাপ হয়। বলে পড়তে লাগল লেখাটা। পড়া শেষ করে চিৎকার করে উঠল, আই বাপ! এ সব কী লিখেছেন ডাক্তারবাবু? এগুলো সব সত্যি কথা?
হ্যাঁ, সূর্য-চন্দ্রের মতো সত্যি।
ওই কলের জলে বিষ আছে আর আমরা সবাই নিশ্চিন্তে তাই খাচ্ছি? তাই কদিন থেকে আমার পেটটা কেমন লুজ হচ্ছিল।
অপরেশ জিজ্ঞাসা করল, হেডিংটা কী হবে?
দাঁড়ান, দাঁড়ান! ওঃ, এ লেখা তো একটা আগ্নেয়গিরি। চারধারে যা হইচই পড়ে যাবে না! হ্যাঁ, প্রতিষেধক হল চটপট জলের লাইন পালটাও আর ওই চামড়ার ফ্যাক্টরি সরাও। ওহো, এই লেখার সঙ্গে আমার তোলা সেই ফ্যাক্টরির ছবিটা ছেপে দেব। ক্যাপশন দেব—বিষ সরবরাহ কেন্দ্র। এই শহরের অ্যাডমিনিস্ট্রেশন যা ধাক্কা খাবে না! অবিনাশের বোধ হয় নাচতে ইচ্ছে করছিল। লেখাটা নিয়ে সে ছটফট করছিল। তারপর হঠাৎ কথাটা মনে আসতেই জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু এই সব তথ্যের যথার্থতার প্রমাণ আছে?
আছে, আমি তো লিখেছি কলকাতা থেকে জল পরীক্ষা করে এনেছি। কথাটা বলতে গিয়ে অপরেশের অস্বস্তি হল। ওঁর মনে পড়ল একটু আগে গুপ্ত রিপোর্টটা পড়ে নিজের পকেটে নিয়ে চলে গেছেন। অর্থাৎ এই মুহূর্তে কোনও প্রমাণ তাঁর হাতে নেই। সঙ্গে-সঙ্গে কথাটাকে নিজেই বাতিল করলেন। —এই জল যে-কোনও সময়ে কলকাতায় পাঠালে ওই একই রিপোর্ট আসবে। অতএব প্রমাণ নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।
অবিনাশ বলল, কিন্তু ডাক্তারবাবু, আপনার নামে এই লেখা ছাপলে আপনার দাদা খুব রেগে যাবেন। হয়তো আপনার বিপদ হবে।
অপরেশ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, দেখো অবিনাশ, পৃথিবীতে জন্মাবার পর অনেক বিপদ পার হয়ে এলাম। আর ও সবের ভয় করি না। এই শহরের মানুষ যদি এই লেখা ছাপানোর ফলে সুস্থভাবে বাঁচতে পারে তাহলেই আমি খুশি হব। আমার একার কষ্টের জন্যে হাজার মানুষের জীবন বিপদগ্রস্ত জেনেও নির্বাক হয়ে থাকব? এত বড় কাপুরুষ আমি? তা হলে আর মানুষ হয়ে জন্মালাম কেন?
অবিনাশ এতখানি আপ্লুত হয়ে পড়েছিল যে এগিয়ে এসে সে অপরেশকে প্রণাম করল, সত্যি ডাক্তারবাবু, আপনার মতো মানুষ আমি এর আগে কখনও দেখিনি!
অপরেশ হাসলেন, তা এই লেখা ছাপলে তোমাদের কাগজের কোনও অসুবিধে হবে না তো?
হোক, তবু ছাপাতে হবে। সংবাদপত্র যদি তার চরিত্র হারায় তাহলে—অপরেশ বাধা দিলেন, মনে রেখো, আমি যেমন এই শহরকে বাঁচাতে চাই, মানুষের জীবন নিয়ে ছেলে-খেলা বন্ধ করতে চাই, ওই লেখা ছাপিয়ে তোমরা সেই একই কাজ করতে চলেছ। হেডিংটা কী দেবে?
অবিনাশ চটপট জবাব দিল, মৃত্যুর মুখোমুখি কনকপুর, জল বিষাক্ত। কেমন মনে হচ্ছে? লোকে নেবে?
অপরেশ মাথা নাড়লেন। তারপর নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়লেন অফিস থেকে। অবিনাশ একটা স্লিপে লিখল, ‘কনকপুর সম্পর্কে একটি ভয়ঙ্কর তথ্য আগামীকাল প্রকাশিত হবে। লক্ষ রাখুন।’ তারপর স্লিপটা নিয়ে ছুটল প্রেসের দিকে। আগামীকালের কাগজের প্রথম পাতার মাঝখানে এটাকে ছাপতে হবে।
লনে বসে চা খাচ্ছিলেন গুপ্ত। এমন সময় কাগজ এল। কলকাতার কাগজ এখানে আসে একদিন পরে। তার ছাপা এবং খবরের কাছে সমাজপতির কাগজ লিলিপুটের চেয়েও ছোট। কিন্তু তবু সকালবেলায় চায়ের সঙ্গে কাগজ পড়ার অভ্যাসেই এই বদখত ছাপা কাগজটায় চোখ রাখতে হয়। গুপ্ত খুব অবহেলার সঙ্গে কাগজটা টেনে নিয়ে ওপরে নজর দিলেন। প্রধানমন্ত্রী বিদেশ যাচ্ছেন। হুম, ব্যাটারা রেডিও থেকে শুনে ছেপেছে। আর-একটু নিচে নামতেই তাঁর চোখ স্থির হল—’কনকপুর সম্পর্কে একটি ভয়ঙ্কর তথ্য আগামীকাল প্রকাশিত হবে। লক্ষ রাখুন।’ এ আবার কী ধরনের রসিকতা! ভয়ঙ্কর তথ্য! মানেটা কী?
প্রথমে ভাবলেন এটা, সমাজপতির স্টান্ট দেওয়ার চেষ্টা। যাতে কাল লোকে কাগজটা কেনে। আগামীকাল হয়তো থাকবে, বিশ হাজার বছর আগে এখানে কুমির হাঁটত। এই রকম মজা আর কী! কিন্তু তারপরেই মনে হল, অন্য কিছু যদি হয়? কী হতে পারে? সঙ্গে-সঙ্গে ভাইয়ের মুখ মনে পড়ল। গতরাতে ভালো করে ঘুমুতে পারেননি তিনি। মাঝরাতে নিজে অর্ডার লিখে পাঠিয়েছেন। আজ সকালে এতক্ষণে নিশ্চয়ই অপরেশ পেয়ে গেছে। আজ থেকে তাঁকে মেডিক্যাল অফিসারের পথ থেকে বরখাস্ত করা হল। অপরেশ এখন শুধু হসপিটালের ডাক্তারের চাকরিতে থাকবে! শহর নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও দরকার নেই। এটা প্রথম ওয়ার্নিং। এ থেকে নিশ্চয়ই শিক্ষা পাবে সে। কিন্তু গুপ্তর মনে পড়ল, সমাজপতি কাল বিকেলে অপরেশের কাছে এসেছিল। এই সব তথ্য কি সে সমাজপতিকে দিয়েছে? কালকের কাগজে কি ওই খবরটা ছাপানোর আয়োজন করছে সমাজপতি? ধীরে-ধীরে চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল গুপ্তর। যদিও খবরটা সত্যি হয় তবু তা জনসাধারণকে কখনই জানানো যাবে না। না, তিনি কিছুতেই খবরটা ছাপতে দেবেন না। ওটা যদি কাগজে বের হয় তাহলে পরশু দিনই শহরটা ফাঁকা হয়ে যাবে। ভুলেও কেউ আর কনকপুরে পা দেবে না। এই মৃত্যুপুরী নিয়ে তিনি তখন কী করবেন? এইজন্যেই কি তিনি এত বছর ধরে তিল-তিল করে শহরটাকে গড়েছেন? যতই জলের পাইপ পালটাও আর কারখানা সরাও সাধারণ মানুষের মন থেকে সন্দেহ দূর হবে না। তা ছাড়া, এই জলের পাইপ পালটাবার অর্থ তাঁর নেই। কনকপুর ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনে দাশগুপ্তর যা শেয়ার আছে তাতে ওঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কারখানা সরানোর প্রশ্নই ওঠে না। দাশগুপ্ত রাজি হবে না। সেটা করতে গেলে অবশ্যই ওঁর কয়েক লক্ষ টাকা নষ্ট হয়ে যাবে।
না, খবরটাকে বন্ধ করতে হবে। মৃত্যুর মুখোমুখি কনকপুর—! হ্যাঁ এতক্ষণে স্পষ্ট হয়ে গেল গুপ্তর কাছে। এইটেই যে খবর তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ক্রোধে উন্মাদ হয়ে উঠলেন গুপ্ত। এতবড় স্পর্ধা সমাজপতির যে তাঁর সঙ্গে পরামর্শ পর্যন্ত করল না এটা ছাপার আগে? এই লেখা যে সোজা তাঁর বিরুদ্ধে যাবে এটা বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কিছু নেই। আর তাঁর নিজের ভাই? পুরুলিয়ার গ্রামে না খেয়ে মরছিল, তিনি দয়া দেখিয়ে তাকে তুলে নিয়ে এলেন নিজের সর্বনাশ করার জন্যে? অকৃতজ্ঞ, বেইমানের দল। এই মুহূর্তে দুজনকে তিনি শহর থেকে ছুড়ে দিতে পারেন বাইরে। চাই কী পাহাড়ের কোণে খাদের গভীরে মাটি চাপা দিয়ে রাখতে পারেন ওই মৃত মেয়েটির মতো।
মেয়েটির কথা মনে আসতেই চা শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন গুপ্ত। তিনজন ছাড়া আর কেউ জানে না মেয়েটি সত্যি লেকের জলে আত্মহত্যা করেছিল। কিন্তু সেই সামান্য খবরটাও তিনি প্রচারিত হতে দেননি। বাঁধের দুই প্রহরীকে দিয়ে মৃতদেহ জল থেকে তুলিয়ে খাদের মধ্যে সমাধি দিয়েছেন। তারপর প্রহরী দুজনকে মোটা বকশিস দিয়ে তাদের দেশে পাঠিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছেন। কেউ আর ওই দেহ খুঁজে পাবে না। কনকপুরের চরিত্রের ওপর সামান্য আঁচড় পড়ার আর সম্ভাবনা রইল না।
ওটা তো সামান্য ব্যাপার ছিল, তাও তিনি ঝুঁকি নেননি আর এতবড় সর্বনাশ তিনি সহ্য করবেন? এখনি পুলিশ কমিশনার সেনকে ডাকবেন নাকি? একটা ছোট্ট হুকুমে সব শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে নিজেকে সতর্ক করলেন। না, এটা একটা বড় রকমের বোকামি হয়ে যাবে। খবরটা অপরেশের স্ত্রী এবং সম্ভবত মেয়ে জানে। সুব্রত ছোকরাও জেনেছে। ওদিকে সমাজপতির সেই রিপোর্টার ছোঁড়াও নিশ্চয়ই সব জেনে গেছে। অতএব খুব ধীর মাথায় কাজ করতে হবে। কোনওরকম উত্তেজনা নয়। এই শহরটাকে বাঁচাতে প্রতিটি পদক্ষেপ ভেবেচিন্তে নিতে হবে।
মিনিট পনেরোর মধ্যে গাড়ি নিয়ে ভাইয়ের বাড়িতে পৌঁছে গেলেন গুপ্ত। গেট খুলে বন্ধ দরজায় কড়া নাড়তেই চাকরটা এসে দরজা খুলে দিল। অপরেশ নাকি হাসপাতালে আর সুর্মা স্কুলে। খবর পেয়ে কাজল ছুটে এলেন—দাদা, এ কী হল? ওকে মেডিক্যাল অফিসারের পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে! এ কী করলেন দাদা?
নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে গুপ্ত বললেন, কী আর এমন হয়েছে তাতে। মাত্র দুশো টাকা মাইনে কমবে এতে।
কাজলের গলার স্বর ভাঙছিল, দাদা, আর আমাকে কষ্ট দেবেন না।
গুপ্ত আস্তে-আস্তে বললেন, বউমা। আমি তোমাদের বাঁচাতে চেয়েছিলাম। তোমরা যখন না খেয়ে মরছিলে তখন আমি তোমাদের এখানে এনে রাজার হালে রেখেছিলাম। কিন্তু তোমার স্বামী তার বিনিময়ে কী দিলে আমাকে? সে আমার এই শহরটাকে তছনছ করে দিতে চাইছে। আমি তো আর চুপ করে থাকতে পারি না। যে আমার এই শহরটার ক্ষতি করতে চাইবে আমি তাকে সহ্য করতে পারব না।
কাজল বললেন, আমি জানি দাদা, কিন্তু ও যে বুঝতে পারছে না। ওর মতে যা অন্যায় তার প্রতিবাদ ও করবেই। কিন্তু আমি আপনার কাছে ভিক্ষে চাইছি, আমার এই সুখটুকু আপনি কেড়ে নেবেন না।
গুপ্ত বললেন, আজকের কাগজে একটা ঘোষণা রয়েছে, দেখেছ?
কাজল মাথা নাড়লেন। হ্যাঁ।
ওটা কি অপরেশ লিখছে?
কাজল একটু ইতস্তত করলেন। মিথ্যে কথা বলতে পারলেন না তিনি। নিচু গলায় জবাব দিলেন, সেই রকম শুনছিলাম।
তাহলে? তাহলে বোঝ। না, না আমি আর কিছু করতে পারি না। বউমা, তোমার বাড়ির ছাদে যদি ক্র্যাক হয় আর ছাদ সারানোর টাকা যদি তোমার না থাকে তাহলে কি বাড়িটাকে ভেঙে গুঁড়ো-গুঁড়ো করে দেবে তুমি? গুপ্ত হাসলেন, তোমার স্বামী সেইরকম পাগল। ঠিক আছে, তুমি তাকে বলো যদি সে আজই গিয়ে ওই লেখাটা তুলে নিয়ে চুপ করে থাকে তাহলে আমি কিছু বলব না। এর চেয়ে আর কোনও ভালো প্রস্তাব আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব হবে না।
কথাটা বলে গুপ্ত আর দাঁড়ালেন না। সোজা গাড়ি চালিয়ে সমাজপতির অফিসে এসে উপস্থিত হলেন। অফিসের সামনে হকারদের বেশ ভিড়। গুপ্ত বুঝলেন আগামীকালের কাগজের জন্যে অর্ডার নেওয়া হচ্ছে। অবিনাশ ছোকরাই ওই সব দেখাশোনা করে। কিন্তু সে নেই। নতুন একটা ছেলে এই কাজ করছে। তার মানে সমাজপতি নতুন লোক রাখার মতো ক্ষমতায় এসেছে। চমৎকার।
ঘরে ঢুকে নিরাশ হলেন গুপ্ত! সমাজপতি নেই। কোথায় যে গিয়েছে তা কেউ বলতে পারল না। তার মানে গা-ঢাকা দিয়েছে লোকটা। সে ফিরলেই যেন অবিলম্বে তাঁর সঙ্গে দেখা করে এই নির্দেশ দিয়ে তিনি আবার গাড়িতে উঠলেন। ঠিক করলেন, বেলা একটা পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন আর তারপরেই সেনকে বলবেন ওকে খুঁজে বের করতে।
রাস্তায় এসে চারিদিকে তাকাতেই চোখ জুড়িয়ে গেল গুপ্তর। ওদিকে নতুন রোদ গায়ে মেখে কাঞ্চনজঙ্ঘা ঝকঝক করছে আর রাস্তায় রঙিন জামাকাপড় পরা ট্যুরিস্টদের ভিড়। আর এই ছবিটাকে ওরা নষ্ট করতে চায়, মনে-মনে বললেন গুপ্ত। না, কিছুতেই তা হতে দেবেন না তিনি।
হাসপাতালে আজ আরও চারজন ট্যুরিস্ট ভর্তি হল। অপরেশ বুঝতে পারছিলেন সময় খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে। অবিলম্বে চামড়ার কারখানাটা বন্ধ করা দরকার। এই হাসপাতালে যেক’টা বেড আছে তা ভর্তি হয়ে যেতে বেশি সময় লাগবে না। তখন কী অবস্থা হবে চিন্তা করতে পারছেন না তিনি। দুপুরে বাড়িতে খেতে আসবার সময় মনে-মনে এই সব চিন্তা করছিলেন অপরেশ।
ওরা তাঁর কথা শুনল না। কয়েক লক্ষ টাকা মানুষের জীবনের চেয়ে বড় হল। আজ সকালে তাঁকে মেডিক্যাল অফিসারের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। হাসি পেল অপরেশের। তাতে তাঁর কী এসে যায়! দুশো টাকা আয় কমবে, তার বেশি কিছু ঘটবে না। সমাজপতি যদি লেখাটা ছাপে তাহলে নিশ্চয়ই শহরের মানুষ তাঁর পাশে এসে দাঁড়াবে। সেই জনমতের চাপে দাদারা মেনে নিতে বাধ্য হবেন দাবিগুলো।
বাড়িতে ফিরতেই কাজল কাছে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর মুখ ফোলা এবং চোখ লাল! বোঝা যাচ্ছে কান্নাকাটি হয়েছে বেশ।
অপরেশ উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করলেন, কী হয়েছে?
কাজল স্বামীর মুখের দিকে চোখ তুলে তাকালেন, তুমি কী চাও?
মানে? বুঝতে পারলেন না অপরেশ।
বিয়ের পর থেকে একটা দিনের জন্যে তুমি আমাকে সুখ দাওনি। চিরদিন তোমার বাউন্ডুলেপনার জন্যে অতিষ্ঠ হয়ে মরেছি। তোমার ওই পরোপকারের ঠেলায় আমার সমস্ত সুখ বিসর্জন দিয়েছি। শেষপর্যন্ত এখানে এসে ঠাকুর আমাকে যখন স্বাচ্ছন্দ দিতে চাইলেন তখন তুমি আবার আমাদের সর্বনাশের পথে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছ। কেন, জবাব দাও, আমরা কী ক্ষতি করেছি তোমার! তীক্ষ্ণ গলায় প্রশ্ন করলেন কাজল। তাঁর চোখদুটো জ্বলছিল।
অপরেশ স্ত্রীর এই চেহারা আগে কখনও দেখেননি। কিছুক্ষণ ওঁর দিকে তাকিয়ে বিব্রত গলায় শুধোলেন, কী বলছ তুমি!
কী বলছি বুঝতে পারছ না? তোমার কী দরকার দাদার পেছনে লাগার? এই শহরের মানুষ তোমাকে দেখবে? তোমাকে খেতে-পরতে দেবে? না, কেউ দেবে না। তোমার দাদা সেটা দিয়েছেন। আজ উনি আমায় স্পষ্ট বলে গেলেন, তুমি যদি এসব করো তাহলে উনি ছেড়ে কথা বলবেন না। তার ফল নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ। জোরে-জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলেন কাজল।
অপরেশ বললেন, কাজল, এতদিন যখন তুমি আমার সঙ্গে কষ্ট ভাগ করে নিয়েছ তখন কালও পারবে। তুমি যদি আমার পাশের না দাঁড়াও তাহলে আমি অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ব কী করে?
কাজল এবার কেঁদে ফেললেন, তোমার কী দরকার একা-একা লড়াই করার! পৃথিবীতে অনেক লোক আছে, তারা করুক। দোহাই তোমার, তুমি আমার এই সুখ কেড়ে নিও না।
অপরেশ এগিয়ে এসে স্ত্রীর মাথায় হাত রাখলেন, পৃথিবীতে অনেক লোক, ঠিক কথা, কিন্তু একজনকে না একজনকে প্রথমে লড়াই শুরু করতে হয়। তাই না? কনকপুরে সেই কাজটা না হয় আমিই করলাম। তুমি এত চিন্তা করো না। আমরা তিনটে তো প্রাণী, একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হয়ে যাবে। মেয়ে তো চাকরি করছে, তোমার ভয় কী!
এইরকম মিষ্টি কথায় কাজলের মন ভরছিল না। তিনি নিশ্চিত নিরাপত্তা আর হারাতে চান না। স্বামীকে বারংবার বোঝাতে চাইলেন তিনি। কিন্তু কোনও কথা শুনতে চাইলেন না অপরেশ।
ওঁদের যখন কথা কাটাকাটি তুঙ্গে তখন সুর্মা ফিরল। হাতে দুটো বই, মুখে হাসি। কাজল তাকে দেখে এগিয়ে গেলেন, তুই তোর বাবাকে বুঝিয়ে বল, আমার কথা শুনতেই চাইছেন না।
সুর্মা ঈষৎ অবাক হল, কী ব্যাপার?
অপরেশ কথা বললেন, আমাকে অন্যায়ের সঙ্গে আপোস করতে বলছে তোর মা। এই শহরের মানুষগুলো বিষে আক্রান্ত হবে জানা সত্বেও আমাকে চুপ করে থাকতে হবে। না, এ অসম্ভব। ও এই বাড়ি, স্বাচ্ছন্দ হারাতে চাইছে না। আমি বললাম, তুমি শক্ত হও, আমার পাশে এসে দাঁড়াও।
তুই কী বলিস?
সুর্মা বলল, বাবা ঠিকই বলেছে মা।
কাজল ফুঁসে উঠলেন, তুইও একই কথা বলছিস?
অপরেশ পরিহাসের গলায় বললেন, এখন তোমার মেয়ে চাকরি করছে, তুমি তো আর জলে গিয়ে পড়বে না।
সুর্মা একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল, না বাবা, এই মুহূর্তে আমি আর চাকরি করছি না। আমাকে স্কুল থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
কাজল প্রায় দৌড়ে এলেন মেয়ের কাছে, কী বললি? তোর চাকরি নেই?
সুর্মা মাথা নাড়ল, না। স্কুল কমিটি আমার কাজ সম্পর্কে সন্তুষ্ট নয়, আজ একটু আগে জানিয়ে দিয়েছে আমাকে।
ফ্যাকাশে গলায় কাজল বললেন, কেন, তুই তো খুব ভালো পড়াস, সবাই কত সুখ্যাতি করে, তা হলে—? স্বামীর দিকে তাকালেন তিনি, মেয়েটার চাকরি গেল কেন? কেন তোমাকে মেডিক্যাল অফিসারের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল বুঝতে পারছ না? এর পরেও তুমি তোমার গোঁ ছাড়বে না! দোহাই, তোমার পায়ে পড়ি তুমি একটু বুঝতে চেষ্টা করো।
কিন্তু এসব কথা অপরেশের মাথায় ঢুকছিল না। তিনি বিস্ময়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলেন। কর্তৃপক্ষ তাহলে যুদ্ধ ঘোষণা করল! কিন্তু সুর্মা কী দোষ করল? ওর ওপর আঘাত হানল কেন ওরা? ছিছি! ক্রমশ উত্তপ্ত হতে আরম্ভ করলেন তিনি। চোখ রাঙিয়ে তাঁকে থামিয়ে রাখতে চায় ওরা? মূর্খের দল সব। কাজল বোকামি করছে, এই ঠুনকো সুখের জন্যে কান্নাকাটি করছে। কিন্তু এত বড় একটা সর্বনাশ আসছে জেনেও কী করে চুপ করে থাকবেন তিনি? নিজের বিবেকের কাছে কী জবাব দেবেন?
না, যুদ্ধ যখন শুরু হয়েছে তখন আর থামার কোনও প্রশ্ন ওঠে না। সমাজপতির কাগজে কালকে লেখাটা বের হলে ওদের টনক নড়বেই। বাধ্য হবে এই সব দাবি মেনে নিতে। অপরেশ ঠিক করলেন, খেয়ে-দেয়ে হাসপাতালে যাওয়ার আগে একবার সমাজপতির ওখান থেকে ঘুরে যাবেন।
সমাজপতি অফিসে ছিলেন না। অবিনাশও নেই। পথে আসবার সময় সিংজির দোকানে একটু দাঁড়িয়েছিলেন। সেখানে গুঞ্জন শুনছিলেন, খুব মারাত্মক কিছু ঘটতে যাচ্ছে কনকপুরে। কালকের কাগজে জানা যাবে। লোকে জল্পনা-কল্পনা করছিল কী হতে পারে। সেটা লোভ হচ্ছিল অপরেশের, বলেই ফেলবেন নাকি! তারপর ভাবলেন, না, লোকে কালকের কাগজটা নিজেরাই পড়ুক। অর্থাৎ উদ্দীপনা শুরু হয়েছে খবরটাকে ঘিরে।
বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর অবিনাশ এল। এসে তাঁকে দেখে একগাল হাসল, ওফ, সারা শহর পাগল হয়ে গেছে ওই খবরটা জানার জন্যে। আমি তো রাস্তায় হাঁটতে পারছি না পাবলিকের জ্বালায়।
অপরেশ জিজ্ঞাসা করলেন, সমাজপতি কোথায়?
অবিনাশ ওঁর চোখে চোখ রাখল। কিছু একটা বলতে গিয়ে ইতস্তত করল। শেষপর্যন্ত সত্যি কথাটা না বলে পারল না, আঙুল দিয়ে পিছনের একটা ঘর দেখিয়ে দিল। ঘরটার দরজা বন্ধ।
অপরেশ বললেন, সে কি! ওখানে আছেন কেন?
পালিয়ে আছেন। ঘন-ঘন লোক আসছে ওঁকে ধরতে। স্বয়ং গুপ্তসাহেব হানা দিয়ে শাসিয়ে গেছেন। আমরা বলেছি, উনি নেই। অবিনাশ হাসল।
আমার লেখাটা কম্পোজ করা হয়ে গেছে?
অনেকক্ষণ। প্রুফ দেখে দিয়েছি।
অপরেশের স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল। যাক বাঁচা গেল! তিনি উঠলেন, তাহলে সমাজপতির সঙ্গে দেখা করা যাবে না?
খুব দরকার আছে?
না, ওঁকে আমি ধন্যবাদ জানাতাম।
ধন্যবাদ তো আপনিই পাবেন। আপনার জন্যেই আজ কাগজের এত নাম। অবিনাশ অপরেশকে দরজা অবধি পৌঁছে দিয়ে ফিরে এসে একটা কাগজে লিখল, ‘ডাক্তারবাবুর এসেছিলেন। ধন্যবাদ জানিয়ে গেলেন। বাইরে দারুণ পাবলিসিটি হয়েছে। দশ হাজার ছাপব?’ তারপর কাগজটা দরজার তলা দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দিল।
ঠিক তখনই দরজায় শব্দ হতে চমকে ফিরে তাকিয়ে অস্বস্তিতে পড়ল অবিনাশ। গুপ্ত এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর চোখ দরজার নিচে। অবিনাশ দ্রুত উঠে এল। —কী সৌভাগ্য, আসুন-আসুন!
গুপ্ত সেখানেই দাঁড়িয়ে বললেন, ওখানে কী করছিলে?
একটা পিন পড়ে গিয়েছিল, খুঁজছিলাম। চটপট মিথ্যে বলে ফেলল অবিনাশ।
পিন খুঁজছিলে?
হ্যাঁ।
পেলে?
না। অবিনাশ বুঝল গুপ্ত তাকে সন্দেহ করছেন। সে চেয়ারটা টেনে নিয়ে গেল অকারণে—বসুন।
তোমার মালিক কোথায়?
জানি না। সকাল থেকে যে কোথায় গেলেন, কী জ্বালা আমার।
সেই ট্যুরিস্ট মেয়েটির মতো অবস্থা হয়নি তো!
মানে?
মেয়েটিকে আর কখনও খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।
অবিনাশের অস্বস্তি বেড়ে গেল। ওই মেয়েটি সম্পর্কে গুপ্ত আরও কোনও খবর জানেন নাকি! মার্ডার হয়ে থাকলে জব্বর নিউজ হবে। কিন্তু সেটা জানার কোনও উপায় নেই। সে চেষ্টা করল ভালোমানুষের মতো মুখ করতে, আপনার যা দরকার তা আমার দ্বারা মিটতে পারে না?
না। চাকর-বাকরদের সঙ্গে আমি কথা বলি না।
অবিনাশ অপমানটা হজম করল। খুব জরুরি কিছু?
গুপ্ত তাকালেন। তারপর শীতল গলায় প্রশ্ন করলেন, কালকের কাগজে কী খবর বের হচ্ছে?
এইটেই আশঙ্কা করছিল অবিনাশ। সে বুঝল মিথ্যে বলে কোনও লাভ হবে না। তবু সামান্য ব্যাপার এমন ভঙ্গিতে বলল, ও ডাক্তারবাবুর একটা আর্টিকেল। কেন বলুন তো?
সেটাই সন্দেহ করেছিলাম। কী আছে তাতে?
আমি জানি না! সমাজপতিবাবু আমাকেও পড়তে দেননি।
মিথ্যে কথা বলছ।
সত্যি-মিথ্যে জানি না। কিন্তু আপনার এভাবে জানতে চাওয়া উচিত হচ্ছে? এতে কি সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় আপনি হস্তক্ষেপ করছেন না?
তাই নাকি? খুব শীতল গলা গুপ্তর।
নিশ্চয়ই, এসব করলে সারা দেশে ঝড় উঠবে। স্বয়ং প্রেসিডেন্টও এত সাহস পান না। এটা আপনার উচিত হচ্ছে না।
হচ্ছে। কারণ যে সংবাদপত্র এতদিন ভাঁওতা আর ভণ্ডামি করে বেঁচেছিল তার স্বাধীনতা বলে কিছু থাকতে পারে না। স্বাধীনতার কথা সে-ই বলতে পারে যে সৎ, আদর্শবান। তোমার মালিককে জিজ্ঞাসা করো অ্যাদ্দিন সে কী করেছে। ঝড় উঠবে? ওঠাচ্ছি ঝড়! কই লেখাটা দাও। গুপ্ত হাত বাড়ালেন।
আমার কাছে নেই। তা ছাড়া, সেসব ছাপা হয়ে গেছে।
ছাপা হয়ে গেছে! তোমাদের তো রাত্রে ছাপা হয়।
হয়, কিন্তু এটা ইমার্জেন্সি বলে—
কত কপি ছেপেছ সত্যি কথা বলো!
দশ হাজার।
মিথ্যে কথা।
কথাটা বলা মাত্র অবিনাশ ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকাল। সেখানে একটা ছোট ভাঁজ করা কাগজ পড়ে আছে। ওর দৃষ্টির অনুরসণ করে গুপ্ত কাগজটা দেখলেন। তারপর গম্ভীর গলায় আদেশ করলেন, ওটা তুলে আনো।
কোনটা?
ওই কাগজটা। তুমি ওটা নিয়ে তখন কিছু করছিলে। কী ওটা আমি দেখব। যাও নিয়ে এসো। গুপ্ত চেঁচিয়ে উঠলেন।
অবিনাশ হতাশ গলায় বলল, ওটা এমনি কাগজ। মূল্যহীন।
গুপ্ত নিজেই উঠলেন। নিচু হয়ে কাগজটা কুড়িয়ে ভাঁজ খুললেন, পাঁচ হাজার। তারপর হতভম্ব গলায় বললেন, পাঁচ হাজার মানে? ওহো, পাঁচ হাজার ছেপেছি। অবিনাশ ম্যানেজ করার চেষ্টা করল।
হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ালেন গুপ্ত—ওই দরজাটা বন্ধ কেন?
দরজা! ফ্যাকাশে গলায় বলল অবিনাশ, এমনি!
খোলো।
কেন?
আমি দেখব। কথাটা শেষ করেই গুপ্ত এগিয়ে গিয়ে দরজায় আঘাত করলেন। ভেতর থেকে বন্ধ, কোনও সাড়া এল না। গুপ্ত অবিনাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, পুলিশ কমিশনারকে টেলিফোন করো এখনই যেন ফোর্স নিয়ে চলে আসে। মনে হচ্ছে যে মেয়েটিকে পাচ্ছি না সে এখানে আছে।
কী বলছেন! হাঁ হয়ে গেল অবিনাশ—সেই মেয়েটি ওখানে থাকতে যাবে কেন? আমরা তো তাকে চিনিই না। দেখিনি।
সেটা খুললেই প্রমাণিত হবে। আমরা সন্দেহ করছি, সন্দেহের বশে আমরা যে-কোনও জায়গা সার্চ করতে পারি। ফোন করো।
অবিনাশ এবার হাল ছেড়ে দিল। সে বুঝল, ধরা পড়ে গেছে। নিশ্চয়ই গুপ্ত দরজায় দাঁড়িয়ে তাকে কাগজ ঢোকাতে দেখেছেন। শালা, ওটা বন্ধ না করে কী ভুলই হয়েছে। পুলিশ ডাকলে কেলোর কীর্তি হবে যখন, তখন নিজে থেকেই ধরা দেওয়া ভালো। সে একটা কাগজ টেনে নিয়ে লিখল, ‘উপায় নেই বেরিয়ে আসুন।’ তারপর কাগজটাকে ভাঁজ করে দরজার তলা দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দিল।
গুপ্ত সেটা লক্ষ করে সরে এলেন। এসে একটা চেয়ারে বসে বললেন, বাইরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে তুমি বেরিয়ে যাও।
বেরিয়ে যাব? আমার যে এখানে অনেক কাজ আছে।
আমি বলছি নেই তাই যাবে। যাও—
অবিনাশের মনে হল এই মুহূর্তে সমাজপতির মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে বেরিয়ে যাওয়াই মঙ্গল। সে আর দাঁড়াল না, দরজা ভেজিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল। একটু বাদেই ভেতরের দরজার পাল্লা নড়ল। একটু-একটু করে সমাজপতির মাথাটা বাইরে বেরিয়ে এল। তারপরেই গুপ্তকে দেখতে পেয়ে সট করে সেটা ভেতরে চলে গেল। গুপ্ত ডাকলেন সমাজপতি—
বলুন স্যার। গলায় বেশ কাঁপুনি।
ওখানে কী করছ?
ধ্যান করছিলাম। সপ্তাহে একদিন আমি দরজা বন্ধ করে ধ্যান করি স্যার। আপনি আমার ধ্যানভঙ্গ করলেন কেন, কী প্রয়োজন? আস্তে-আস্তে বাইরে বেরিয়ে এলেন সমাজপতি।
পালিয়ে আছ কেন? আমায় বাঁশ দিতে?
গুপ্তর মুখে এ ধরনের সংলাপ কখনও শোনেন নি সমাজপতি। তিনি কোনওরকমে বললেন, আপনি কী বলছেন স্যার?
কালকের কাগজ শুনলাম ছাপা হয়ে গেছে, তাই নাকি?
কী উত্তর দেবেন বুঝতে না পেরে সমাজপতি ঘাড় নাড়লেন। যার দুটে অর্থ হতে পারে।
গুপ্ত জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি চাও তোমার কাগজটা উঠে যাক?
না। আমি চাই না।
কিন্তু ওই লেখা ছাপলে তাই হবে। লেখা পড়ামাত্র শিক্ষিত মানুষরা শহর ছেড়ে পালাবে। তখন কার কাছে কাগজ বিক্রি করবে? জঙ্গলের আদিবাসীরা নিশ্চয়ই তোমার কাগজ কিনবে না। মূর্খ।
সমাজপতির মনে হল গুপ্ত বাড়িয়ে বলছেন কিন্তু তিনি প্রতিবাদ করতে চাইলেন না।
গুপ্ত কোনও জবাব না পেয়ে আবার জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি আমার কাছে কৃতজ্ঞ?
হ্যাঁ স্যার।
তা হলে নিজেকে বাঁচাও, শহরটাকে বাঁচাও। কালকের যত কাগজ ছেপেছ তা যেন বাজারে বের হয় না। তোমার ক্ষতি হোক আমি চাই না। তোমার যত খরচ হয়েছে আমি তা পুষিয়ে দেব। টাকাটা আমার বাড়ি থেকে বিকেলে গিয়ে নিয়ে এসো। রাত্রে একটা লরি আসবে, সেখানে সব কাগজ তুলে দিও, বুঝলে?
কী করবেন ওগুলো নিয়ে?
পুড়িয়ে ফেলব।
কিন্তু আগামীকাল কাগজ না বের হলে পাবলিক আমাকে মেরে ফেলবে। কত অ্যাডভান্স নিয়ে বসে আছি জানেন? সমাজপতি প্রায় আর্তনাদ করলেন।
কাগজ বের হবে না কেন? নিশ্চয়ই হবে।
কিন্তু কী ছাপব? লোকে তো খবরটার জন্যে উৎসুক হয়ে রয়েছে।
হেডলাইন দাও, পঞ্চাশ হাজার বছর আগে কনকপুরে তিমিদের আড্ডা ছিল। সম্প্রতি লেকের জলে—না-না লেক নয়, উত্তরের পাহাড়ে তাদের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। ব্যস। গুপ্ত উঠে দাঁড়ালেন।
সমাজপতি হাঁ হয়ে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখলেন গুপ্ত মাথা উঁচু করে বেরিয়ে গেলেন।