মানবপুত্র – ১

এ রকম ঘটনা এই শহরে এর আগে ঘটেনি।

 তার আগে শহরটার পরিচয় দেওয়া দরকার। আমাদের চেনাশোনা আর পাঁচটা শহরের সঙ্গে এই শহরটির পার্থক্য হল এখানে আইন-শৃঙ্খলা সবাই মানে, বয়স্কদের শ্রদ্ধা করে কনিষ্ঠরা, কারণ এই শহরটিকে ওঁরা নিজেদের রক্ত দিয়েই তৈরি করেছেন বলা যায়। শহরের জন্যে প্রত্যেকেরই মায়া আছে, তাই কোনও ত্রুটিবিচ্যুতি সচরাচর চোখে পড়ে না। অথচ মাত্র পঞ্চাশ বছর এই শহরটির আয়ু। হিমালয়ের ওপর এমন টাটকা বাতাসের রাজত্বে ছবির মতো এই শহরটা দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। খুব কাছের সমতলের বড় জংশন স্টেশনে পৌঁছতে বড়জোর ঘণ্টা আড়াই মতো সময় লাগে।

হিমালয়ের এই তল্লাটের আরও কিছু নামী-দামি শহর আছে যেখানে প্রতি বছর লক্ষ-লক্ষ মানুষ আসে ট্যুরিস্ট হয়ে। কিন্তু পাহাড়ি শহরের যত আকর্ষণই থাক না কেন, বেড়াতে আসা মানুষগুলো সেখানে শরীর সারাতে আসে না। প্রথম কথা : পাহাড়ের জল অনেকেরই সহ্য হয় না, দ্বিতীয় : ওইসব শহরে কিছু দিন বেশি থাকা ব্যয়সাপেক্ষ। এই পরিস্থিতিতে কী করে যে প্রচারিত হল যে আমাদের নতুন শহরটির চারদিকে যেমন অজস্র লোভনীয় প্রাকৃতিক দৃশ্যের অভাব নেই, তেমনই এখানকার জল ঠিক আর পাঁচটা পাহাড়ি শহরের চেয়ে চরিত্রে একদম আলাদা। মধুপুর, দেওঘরের মতো এই জলে শরীর সুস্থ হয়। এখানকার হোটেলগুলো মোটেই ব্যয়সাধ্যি নয়। ফলে গত বছর থেকে এখানে ট্যুরিস্টরা আসছে এবং এই শহরের মানুষেরা সারা বছরের খরচ, আশা করা যায় ট্যুরিস্টরাই দিয়ে যাবে। এ বছর ভিড় আরও বেড়েছে কিন্তু এতটুকু বিশৃঙ্খলা দেখা যায়নি। ট্যুরিস্টদের কাছে বিভিন্ন হোর্ডিং-এ আবেদন করা হয়, এই শহরটাকে নিজের বলে মনে করুন। এখানকার প্রশাসনব্যবস্থা অত্যন্ত সজাগ। দেশের সরকার ইতিমধ্যে কিছু-কিছু সাহায্য করেছেন বটে তবে তাঁরা এখানকার স্বায়ত্তশাসন যেন অনেকটাই মেনে নিয়েছেন। গণভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই শহরটিকে শাসন করেন। এখন যিনি কমিশনার তিনি সেই আদিযুগ থেকেই শহরে আছেন। নিজের রক্তের মতো মনে করেন এই শহরকে। শহরটির নাম কনকপুর।

সেই শহরে একদিন সকালে কাণ্ডটা ঘটে গেল। সবে ঘুম ভেঙেছে কিন্তু এখনও আলস্য যায়নি। এই রকম ভোরে শহরটার গায়ে কুয়াশার হালকা চাদর জড়ানো থাকে। সেই সময় একটি যুবক প্রায় ছুটতে-ছুটতে থানায় ঢুকল। রিসেপশনের অফিসারটি তখন রাত্রিজাগরণে ক্লান্ত, তাঁর বদলি অফিসারের অপেক্ষায় ছিলেন। উত্তেজিত যুবকটিকে দেখে কিন্তু সোজা হয়ে বসলেন।

যুবকটি হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল, অফিসার, আমার স্ত্রীকে বাঁচান।

অফিসার চেয়ারটি দেখিয়ে বললেন, বসুন। কী হয়েছে বলুন!

আমার স্ত্রীকে পাচ্ছি না। ছেলেটির মুখ সাদা। কাল রাত্রে একসঙ্গে শুয়েছি আমরা, ভোরে উঠে আর দেখতে পাচ্ছি না।

অফিসার হাসলেন, আরে মশাই, ভোর তো সবে হল। উনি একলা একটু বেড়াতেও তো যেতে পারেন। নতুন বিয়ে করেছেন বুঝি?

যুবকটি খুব দ্রুত মাথা নাড়ল, না-না, বেড়াতে যায়নি ও। এই দেখুন, টেবিলের ওপর এই চিঠিটা ছিল।

অফিসার হাত বাড়িয়ে চিরকুটটি নিলেন। মেয়েলি অক্ষরে লেখা রয়েছে, ‘এই সম্পর্ক মানতে পারছি না। তুমি এত ভালো তাই তোমাকে ঠকাব না। আমার কথা ভুলে যেয়ো, ক্ষমা চাইছি।’

এবার অফিসার নড়ে-চড়ে বসলেন। তারপর কাগজ-কলম নিয়ে যুবকটিকে জেরা করতে লাগলেন। এ রকম অভিজ্ঞতার কথা তিনি গল্পের বইতে পড়েছেন। কনকপুরের এমন ঘটনা প্রথম ঘটল।

ঠিক চল্লিশ মিনিট পরে ম্যাল রোডের ধারে নির্জন বাংলোর লনে সবে চা খেতে-খেতে কমিশনার গুপ্ত মুখ তুলে দেখলেন পুলিশের বড়কর্তা সেন গেটের বাইরে গাড়ি রেখে লনে পা ফেললেন। এত ভোরে ওঁর আসার কোনও অভ্যেস নেই। গুপ্ত কিঞ্চিৎ অবাক হলেও তা প্রকাশ করলেন না। মনের অভিব্যক্তি চেপে রাখায় নিপুণ তিনি। সামনে এসে স্যালুট করে দাঁড়াতেই গুপ্ত নমস্কার জানালেন, বসুন-বসুন, চা খাবেন?

ধন্যবাদ স্যার, আমরা একটু উত্তেজিত। এই শহরে যা কখনও হয়নি আজ তাই হয়েছে। সেন চেয়ারে শরীর রাখতেই বেতের শব্দ হল।

সঙ্গে-সঙ্গে কপালে ভাঁজ পড়ল গুপ্তর। এই শহরে কোনও খারাপ কিছু হলে তিনি সহ্য করতে পারবেন না। তবু গলায় স্বাভাবিক স্বর বের হল, কী হয়েছে?

একটি ট্যুরিস্ট দম্পতি এসে হিমালয় হোটেলে উঠেছিল। সদ্য বিবাহিতা। হানিমুনে এলে যেমন দেখায় তেমনি দেখতে ওদের। আজ সকালে মেয়েটি উধাও হয়েছে একটা চিঠি লিখে রেখে। তা ওই সকালে এখান থেকে নিচে কোনও ট্রান্সপোর্ট যায়নি। তার মানে মেয়েটি এখানেই আছে। ওকে খুঁজে বের করার জন্য লোক পাঠিয়েছি চারধারে। এটা আপনাকে জানানো কর্তব্য বলেই ছুটে এলাম স্যার। সেন নিবেদন করলেন।

চোখ বন্ধ করে কয়েক সেকেন্ড ভাবলেন গুপ্ত—স্ট্রেঞ্জ। মেয়েটিকে না পাওয়া গেলে শহরের ভীষণ বদনাম হয়ে যাবে। ট্যুরিস্টরা আসতে ভয় পাবে। নো-নো, আজ দুপুরের মধ্যে ওই মেয়েটিকে খুঁজে বের করুন। মনে রাখবেন এটা আমাদের ইজ্জতের ব্যাপার।

সেন বললেন, সে তো নিশ্চয়ই। আমি স্টাফদের বলেছি কনকপুরটাকে চিরুনির মতো আঁচড়াতে। আর হ্যাঁ, ছেলেটিকেও আমি আটকে রেখেছি। বলা যায় না, হয়তো মার্ডার কেস হতে পারে।

পারে। কিন্তু সেটা এই শহরের পক্ষে একটু খারাপ ব্যাপার। এখানে এলে বউ খুন হয় রটে গেলে আবার বিপদ হবে। তেমন খবর আমায় না জানিয়ে প্রেসকে রিলিজ করবেন না। মেয়েটিকে খুঁজে বার করে সমাজপতিকে বলবেন কালকের কাগজের প্রথম পাতায় খবরটা ছাপতে। প্রশাসনের তৎপরতার খবর পড়ে সাধারণ মানুষের আমাদের ওপর আস্থা বাড়বে। যান, মেয়েটিকে খুঁজে বের করুন। একটু অসহিষ্ণু গলায় কথাগুলো শেষ করে হাত নাড়লেন।

সেন আর অপেক্ষায় থাকলেন না। তিনি ভালো করেই জানেন যে গুপ্ত কোনওমতেই এখন শান্ত থাকবেন না। এই শহরের গায়ে আঁচ লাগছে এমন কিছুকে গুপ্তর পক্ষে সহ্য করা অসম্ভব। অতএব মেয়েটিকে খুঁজে বের করতেই হবে।

সেন চলে গেলে মনে হল আজকের সকালটা খুব বিশ্রী। এত জায়গা থাকতে তোর এখানে এসে হারাবার কী দরকার ছিল! ধরা যাক, ওকে কেউ খুন করেছে। খবরটা রটে গেলে আর ট্যুরিস্ট আসবে? সবাই ভাববে কনকপুরে গেলে মেয়েদের নিরাপত্তা থাকবে না। কত কষ্টে সবদিক আড়াল করে তিল-তিল করে শহরটাকে তৈরি করেছেন। যার জন্যে কোন ফাঁকে বয়স চলে যাওয়ায় বিয়েটা পর্যন্ত করা হল না।

ভারী মনে একটু বাদেই নিজের জিপ নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন গুপ্ত। বলা যায় না, রাস্তায় আচমকা তাঁর নজরেও পড়ে যেতে পারে মেয়েটা। যদিও তিনি ওকে চেনেন না, ছবিও দেখেননি, কিন্তু ওইরকম পালানে মেয়েদের দেখলেই তিনি চিনতে পারবেন বলেই তাঁর বিশ্বাস।

এখন কনকপুর রোদে ভাসছে। দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল গুপ্তর। কত পরিশ্রম এর পিছনে আছে। একটা ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামকে আজ মোটামুটি আধুনিক শহরের চেহারা দেওয়া হল, এক জীবনেই। প্রায় জঙ্গল কেটেই পত্তন। আদিবাসীরা অবশ্যই খুব সন্তুষ্ট নয়, তারা আরও জঙ্গলের গভীরে চলে গেছে। কিন্তু রুজিরোজগারের জন্যে এখানেই আসতে হয়। নির্জন সকালের রাস্তায় জিপের সামনে বসে কিন্তু খুব স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। হঠাৎ ওঁর নজরে পড়ল রাস্তার ধার ঘেঁষে একটি মেয়ে খাদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। খুব জোরে জিপ ছুটিয়ে ঠিক মেয়েটির পাশে এসে ব্রেক করতেই সে মুখ ঘোরাল। গুপ্ত মনে-মনে বললেন, যাচ্চলে। তারপর হাসিমুখে প্রশ্ন করলেন, কী খবর? কেমন আছ?

মেয়েটি সামান্য মাথা দুলিয়ে হাসল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, আপনি এত সকালে বেরিয়েছেন?

আর বলো না। ছাই ফেলতে তো এই ভাঙা কুলো। তোমার বাবা তো এখন দিব্যি নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে।

গুপ্ত মেয়েটিকে পছন্দ করেন।

মোটেই না। বাবা এখন হাসপাতালে চলে গেছেন—

মেয়েটি প্রতিবাদ করল সহাস্যে।

গুপ্ত বড়-বড় চোখ করলেন, হাসপাতাল! কনকপুরে কারও বড় কোনও অসুখ হয় না। তাই হাসপাতালে বসে তোমার বাবার তো মেডিকেল জার্নাল পড়া ছাড়া কোনও কাজ নেই।

সে আমি জানি না—

কিন্তু ওর মতো সিনসিয়ার মানুষ খুব কম দেখেছি। শোনো, আমার ভাই বলে বলছি না, অপরেশের মতো এমন কাজপাগল মানুষ পৃথিবীতে কমে গেছে বলেই মানুষের এই দুর্দশা। যেই আমি হাসপাতালটা করে ফেললাম, অমনি ওকে টেনে নিয়ে এলাম এখানে। সবাই ওর প্রশংসা করে কিন্তু ওকে আবিষ্কারের কৃতিত্বটা আমার। তুমি কী বলো? সাগ্রহে তাকালেন গুপ্ত। মেয়েটি সলাজুক হাসল, নিশ্চয়ই। বাবার প্রশংসা—

কিন্তু তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কী দেখছিলে? প্রসঙ্গ পালটালেন গুপ্ত।

স্কুলে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ বাঁদিকে তাকাতেই নিচে কুয়াশাদের গলে যেতে দেখলাম। তাই—

যাচ্চলে! কুয়াশাদের গলে যাওয়া দেখতে পেলে! তোমাদের সবই উদ্ভট। শোনো, একটি মেয়েকে পাওয়া যাচ্ছে না। স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে এসে আমাকে ঝামেলায় ফেলেছে। কোনও মেয়েকে একলা ঘুরতে দেখলেই, যদি সন্দেহ হয়, তক্ষুনি আমাকে খবর দেবে—আর দাঁড়ালেন না গুপ্ত।

তাঁর এই ভাইঝিটি খুব শান্ত। এম. এ. পাশ করে বসেছিল। তিনি এখানকার একমাত্র স্কুলে চাকরি করে দিয়েছেন। তাঁর এই ভাইটি ছন্নছাড়া। কোনও চাকরিতে বেশি দিন টিকতে পারেনি পিটপিটুনি স্বভাবের জন্য। শেষমেশ পুরুলিয়ার এক গ্রামে প্র্যাকটিস করছিল। দু-বেলা পেট ভরে ভাত জুটত না কারণ ফি-এর টাকাটা পকেটেই আসত না।

হাসপাতালের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নিচে নামলেন গুপ্ত। ওঁকে দেখে কর্মচারীরা তটস্থ। না, চেম্বারে অপরেশ নেই। বেয়ারা বলল, সে নাকি ওয়ার্ডে। গুপ্ত সেখানেই চললেন। ওষুধের কড়া গন্ধ তিনি সহ্য করতে পারেন না। যেতে-যেতে দেখলেন প্যাসেজে একটা কাগজ পড়ে আছে। বিরক্ত ভঙ্গিতে সেটাকে তুলে নিয়ে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ফেলে ওয়ার্ডে ঢুকলেন।

অপরেশ ঝুঁকে পড়ে একজন রুগির সঙ্গে কথা বলছেন।

গুপ্ত দেখলেন কোনও বেডই খালি নেই। তবে দেহাতিদের সংখ্যাই বেশি। গুপ্তকে দেখে অপরেশ এগিয়ে এলেন, কী ব্যাপার?

এত রুগি কেন?

বাঃ, অসুখ হলে চিকিৎসার জন্যে আসবে না?

গুপ্ত অসন্তুষ্ট ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন, না-না, এ ভালো কথা নয়। একটা শহরের জলহাওয়া কীরকম তা বোঝা যায় সেখানকার হাসপাতালের রুগির সংখ্যার ওপর। আদিবাসীদের কথা আমি ধরছি না, কিন্তু ওখানে তো কিছু—! কথা শেষ না করে গুপ্ত দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেলেন।

আপনার নাম?

মোটাসোটা ভদ্রলোকটি শুয়ে ছিলেন চোখ খুলে, নাম বললেন।

আপনি এখানকার লোক?

না, বেড়াতে এসেছিলাম এখানে। পেটে এত যন্ত্রণা হচ্ছে ওঃ! আগেও ছিল—

গুপ্তর মুখ উদ্ভাসিত হল। অপরেশের কাছে ফিরে এসে বললেন, না, আমাদের দোষ নেই। এরা সব শরীরে রোগ নিয়েই এখানে এসেছে। তবে হ্যাঁ, এ খবর যেন বাইরে না বের হয়। লোকে ভাববে এখানকার জলেরই দোষ। একবার রটে গেলে আর ট্যুরিস্ট আসবে না এখানে।

অপরেশ কী একটা বলতে গিয়ে চুপ করে গেলেন। অস্বস্তি হলেই উনি চশমা খুলে ফেলেন। গুপ্তর সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে আসতেই অবিনাশকে চোখে পড়ল। এই শহরের সত্যি উদ্যমী সাংবাদিক। সব সময় কাঁধে ক্যামেরা আর হাতে নোট বই নিয়ে ঘোরে। গুপ্ত ওকে ঠিক পছন্দ না করলেও অপরেশের বেশ ভালো লাগে। ওর মালিক-সম্পাদক সমাজপতিটা অবশ্য ধান্দাবাজ লোক।

সুপ্রভাত স্যার। সুপ্রভাত ডাক্তারবাবু। অবিনাশ একগাল হাসল। হাসপাতালে কী মনে করে? গুপ্ত থমকে দাঁড়ালেন। ওর দিকে তাকালেন। বাইরে আপনার গাড়িটাকে দেখে ভাবলাম ডেডবডি এসে গিয়েছে বুঝি! একবার দেখতে পারি ডাক্তারবাবু? শুনেছি মেয়েটি নাকি খুব সুন্দরী।

অবিনাশ অপরেশকে অনুরোধ জানাল।

ডেডবডি! হকচকিয়ে গেলেন অপরেশ।

গুপ্ত গর্জে উঠলেন, কী আজেবাজে কথা বলছ? এখানে কোনও ডেডবডি আসেনি। কনকপুরের কোনও মেয়ে খামোকা মরতে যাবে কেন?

অবিনাশ মাথা নাড়ল, কিন্তু স্যার, মেয়েটি তো ওই রকম লিখেই হাওয়া হয়েছে। আপনাকে এখানে দেখে মনে হল হয়তো—

অপরেশ ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলেন না। তিনি দাদার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, কী হয়েছে?

গুপ্ত সামান্য ইতস্তত করে বললেন, একটি মেয়ে এখানে বেড়াতে এসে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে হোটেল থেকে বেরিয়ে গেছে, মান-অভিমানের ব্যাপার আর কী! তা তুমি এই সক্কালবেলায় খবরটা পেলে কী করে? অবিনাশ হাসল, সাংবাদিককে সোর্স জিজ্ঞাসা করবেন না স্যার।

সাংবাদিক! যা না কাগজ তার আবার সাংবাদিক! তোমাকে তো পত্রিকা ডেলিভারিও দিতে হয়। গুপ্ত নাক টানলেন।

স্যার! কাগজ তুলে কথা বলাটা ঠিক হচ্ছে না।

অপরেশ তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, বেশ-বেশ। শোনো হে অবিনাশ, আমার এখানে কোনও ডেডবডি আসেনি।

অবিনাশ ঘুরে দাঁড়াল, ব্যস। চুকে গেল ল্যাঠা। আপনার গাড়িটাকে দেখে সন্দেহ হয়েছিল তাই ঢুঁ মারলাম। অবিনাশ চলে যাচ্ছিল, গুপ্ত তাকে ডাকলেন, কোন দিকে যাবে?

অবিনাশ হাসল, বাজারে।

ওইখানে এক মিনিট দাঁড়াও। আমার গাড়িতে যেতে পারবে। কথাটা বলে গুপ্ত অপরেশকে চাপা গলায় বললেন, শোনো, সত্যি যদি কোনও ডেডবডি আসে তাহলে আমাকে না জানিয়ে কাউকে কিছু বলবে না। আর ওই ট্যুরিস্টদের যত তাড়াতাড়ি পারো হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দাও।

অপরেশ মাথা নাড়লেন, কিন্তু ওদের দুজনের যে বেশ কিছুদিন চিকিৎসা করা দরকার। ছেড়ে দেব কী করে?

গুপ্ত গম্ভীর গলায় বললেন, নিজের দেশে গিয়ে করাক। পৃথিবীতে তুমিই একমাত্র ডাক্তার নও।

গুপ্ত অবিনাশকে নিয়ে গাড়িতে উঠে প্রশ্ন করলেন, রাগ করেছ?

না, আমার এ সব কথা অভ্যাস হয়ে গেছে।

তোমাদের কাগজ শুনছি খুব ভালো চলছে?

চলছে। ট্যুরিস্টরা খুব নিচ্ছে। আশেপাশের শহরেও যাচ্ছে।

ভালো, আমি চাই আমাদের এই শহর সব বিষয়ে স্বয়ং-নির্ভর হোক। কিন্তু সমাজপতি আমার কথা শুনছে না। আমি বলেছিলাম এই শহরের প্রশংসা করে কাগজে আরও বেশি লেখা হোক। তুমি ওকে বলো।

বলব, কিন্তু এই তো গতকালই ডাক্তারের আর্টিকেল বের হল এই শহরের পরিবেশ নিয়ে। পড়েছেন? অবিনাশ বলল।

গাড়ি চালাতে-চালাতে গুপ্ত জবাব দিলেন, পড়েছি। ও তো শুধু উপদেশ আর তথ্য। লোকে ইন্টারেস্ট পায় না। তুমি একটু জম্পেশ করে লেখো।

ট্যুরিস্ট মেয়েদের ছবি-টবি ছাপাও। আর যত বেশি ট্যুরিস্ট আসবে তত তোমার কাগজ বিক্রি হবে। আর হ্যাঁ, ওই মেয়েটিকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত কোনও নিউজ তুমি লিখে বসো না যেন।

বিকেলে অপরেশ একটু বেড়াতে বের হলেন। সারাদিন এই একটিবার হাঁটাহাঁটি হয়। খুব জরুরি প্রয়োজন না থাকলে ওঁকে বিকেলের পর হাসপাতালে যেতে হয় না। অপারেশন কেস থাকলে রাত্রে একবার ঘুরে আসেন।

সেজেগুজে বাইরের ঘরে আসতেই সুর্মা বলে উঠল, বাবা তুমি মাঙ্কি ক্যাপ পরোনি। ওটা না পরে কিন্তু বেরিও না।

অপরেশ একটু অসহায় ভঙ্গিতে তাকালেন। মাঙ্কি ক্যাপ তিনি একদম পছন্দ করেন না। কিন্তু মেয়েটা এমন গার্জেনগিরি করে! এই সময় কাজল ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন টুপিটা হাতে করে—নাও। অপরেশ বাধ্য হলেন। এখানে আসার পর তিনি কাজলকে অন্য রকম দেখছেন। এই সুন্দর কোয়ার্টার্স, ফুলের বাগান নিয়ে বেশ খুশিতে আছে ও। এত বছরের বিবাহিত-জীবনে কাজলকে এত প্রাণবন্ত তিনি খুবই কম দেখেছেন।

হঠাৎ সুর্মা বলে উঠল, জানো বাবা, আজ একটা ট্যুরিস্ট বউ এখানে হারিয়ে গেছে।

কাজলের মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল, ও মা তুই জানলি কী করে?

সুর্মা বলল, ভোরে যখন স্কুলে যাচ্ছিলাম তখন জেঠুর সঙ্গে দেখা হল। খুব ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছিলেন। উনিই বললেন। জেঠু এই শহরটাকে যা ভালোবাসেন না, যেন নিজের শরীরের চেয়ে দামি।

কাজল বললেন, মেয়েটি কোথায় যাবে! এইটুকু তো শহর।

সুর্মা বলল, খবরটা এখনও চাউর হয়নি। তা এবার কিন্তু খুব ট্যুরিস্ট আসছে এখানে। রাস্তায় পা দিলেই নতুন মুখ দেখতে পাচ্ছি।

অপরেশ একটু অন্যমনস্ক গলায় বললেন, এবার ট্যুরিস্টরা অসুখেও পড়ছে বেশ। সব পেটের গোলমাল। আজই বিকেলে দুজন নতুন পেশেন্ট হাসপাতালে ভরতি হয়েছে।

কাজল বললেন, ও মা, সে কী কথা! এখানে তো পেটের গোলমাল হয় না বলে শুনেছি। তোমার দাদা বলেন এখানকার জল নাকি অমৃত।

অমৃত কি না জানি না তবে ফুটিয়ে নিচ্ছ তো?

খাবার জল রোজই ফোটানো হয়। তোমার বাপু একটু বেশি পিটপিটুনি স্বভাব। এত লোক জলের প্রশংসা করছে আর তুমি—। কাজল কথাটা শেষ করলেন না। ওঁর নজর তখন বাইরের গেটের দিকে। ঘরে দাঁড়িয়েই জানালা দিয়ে বাগান, গেল দেখা যায়। দরজায় তখন বেশ সুন্দর চেহারার এক যুবক এসে দাঁড়িয়েছে। বললেন, এসো বাবা, এসো।

যুবক বলল, ভালো আছেন আপনারা?

অপরেশ মাথা নাড়লেন, ভালো নেই। আজ বিকেলে আবার পেটের রুগির সংখ্যা বেড়েছে হাসপাতালে।

কাজল কপট গলায় ধমক দিলেন, আঃ, সব সময় হাসপাতাল আর হাসপাতাল। অন্য কোনও চিন্তা মাথায় আসে না, বসো, তুমি দাঁড়িয়ে রইলে কেন?

যুবক সুর্মার দিকে তাকিয়ে হাসল। বোঝা যায় এদের দুজনের মধ্যে বেশ বোঝাপড়া হচ্ছে। যুবক বলল, আপনি বের হচ্ছেন মনে হচ্ছে?

অপরেশ ঘড়ি দেখলেন—হ্যাঁ, বেশ দেরি হয়ে গেছে। যাই এক চক্কর ঘুরে আসি। তা, তোমার কাজকর্ম কেমন চলছে?

ভালো। আমরা নিচের দিকে জমিটা পেয়ে গেছি। টাউন কমিটি স্যাংশন করেছে। শিগগির কাজ শুরু করব। যুবক বলল।

যুবকের নাম সুব্রত। পেশায় সে ইঞ্জিনিয়ার। কনকপুর ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের সে অধিকর্তা। এই অল্পবয়সে নিজের বিদ্যাবুদ্ধির জোরে এত ভালো চাকরি পেয়েছে। সুব্রতর বাবা এই শহরের প্রথম নাগরিকদের অন্যতম। মা-মরা এই ছেলেটি এতদিন হোস্টেলে-হোস্টেলে দিন কাটিয়ে আবার নিজের শহরে ফিরে এসেছে।

ওদের বাড়িতে রেখে অপরেশ বেরিয়ে এলেন। এখনও রোদ মরেনি। তবে যে-কোনও মুহূর্তে ছায়ারা ছড়িয়ে পড়বে। পশ্চিমের পাহাড়গুলো বেশ লালচে হয়ে পড়েছে। রাস্তায় ট্যুরিস্টদের বেশ ভিড়। চৌমাথায় কন্ডাকটেড ট্যুরের অফিসগুলোর সামনে মানুষের খুব আনাগোনা। কোনও ব্যক্তিগত উদ্যোগের ফাঁদে ট্যুরিস্টদের না ফেলে কনকপুর ডেভেলপমেন্ট নিজে থেকেই ট্যুরিস্টদের বিভিন্ন বিউটি-স্পট ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে। কে. ডি. সি. লেখা গাড়িগুলো সারাদিন ছোটাছুটি করছে চারধারে।

অপরেশ ডেয়ারি ফার্ম ছাড়িয়ে আরও ওপরে উঠে আসতেই অবিনাশকে দেখতে পেলেন। গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে ওপাশ থেকে নেমে আসছে। ওকে দেখে চিৎকার করল ডাক্তারবাবু, ও ডাক্তারবাবু!

অপরেশ দাঁড়ালেন। অবিনাশ দৌড়ে কাছাকাছি হল—কোথায় যাচ্ছেন? বেড়াতে!

এখুনি তো সন্ধে হয়ে যাবে।

তা তো যাবেই। মেয়েটির কোনও খোঁজ পেয়েছ?

না, স্রেফ হাওয়া হয়ে গেছে। কী করে স্যার কে জানে!

তুমি এখানে কী করছ?

অবিনাশ প্রশ্নটা শুনে হকচকিয়ে গেল। তারপর নার্ভাস-হাসি হাসল—এই একটু ছবি তুলছিলাম।

এদিকে আবার কীসের ছবি?

একটু ইতস্তত করল অবিনাশ। তারপর অপরেশকে খুঁটিয়ে দেখল—আপনাকে কথাটা বলছি। ওপরে মিস্টার দাশগুপ্তর যে কারখানাটা রয়েছে ওটা নাকি বেআইনিভাবে তৈরি। সুব্রত ইঞ্জিনিয়ার এই রকম একটা রিপোর্ট দিয়েছে গুপ্ত সাহেবকে। কিন্তু ব্যাপারটা স্রেফ ধামাচাপা পড়ে গেছে। আপনি তো পরিবেশ দূষিত করার ওপর প্রবন্ধ লিখেছেন আমাদের কাগজে, এই ব্যাপারে লিখুন না।

অপরেশ চমকে উঠলেন। শহরের মুখটাতে এমন একটা বড় কারখানা রয়েছে এটা তাঁর নিজেরই পছন্দ হয়নি। কিন্তু ওটা যে বেআইনিভাবে তৈরি হয়েছে এ খবর তিনি জানতেন না। যদিও কারখানা থেকে ধোঁয়া চারধারে ছড়ায় না তবু বেআইনি যখন, তখন অবিলম্বে সরিয়ে ফেলা উচিত। কিন্তু বেআইনি কেন? প্রশ্নটা করলেন তিনি।

অবিনাশ বলল, এই অঞ্চলটা হাউসিং প্লট, ফ্যাক্টরির জন্যে নয়। কিন্তু দাশগুপ্ত সাহেব এখানেই ফ্যাক্টরি বানিয়েছেন। কনকপুর ডেভেলপমেন্টের উনি ভাইস প্রেসিডেন্ট। গুপ্তসাহেবের আত্মীয়, অতএব ওঁকে কে স্পর্শ করবে? কথাটা বলেই অবিনাশের খেয়াল হল দাশগুপ্ত অপরেশেরও পরম আত্মীয়। এখন হিতে বিপরীত না হয়।

অপরেশ বললেন, চলো তো ফ্যাক্টরিটা দেখে আসি।

অবিনাশ সাহস পেল না—না, আমি আর যাব না। এইমাত্র ছবি তুলে এলাম, আর যাওয়া ঠিক হবে না।

ফ্যাক্টরির ছবি তুলেছ?

হ্যাঁ।

বেশ। আমি দেখে নিই ব্যাপারটা। তারপর কাগজে লিখব। তখন ছবিটা সঙ্গে ছেপে দিও। অপরেশ মাথা নাড়লেন।

উদ্ভাসিত হল অবিনাশ, ওফ! দারুণ হবে। একদম মৌচাকে ঢিল পড়বে। দারুণ খাবে পাবলিক। হুহু করে কাগজের সেল বেড়ে যাবে।

অপরেশ গম্ভীর গলায় বললেন, যা অন্যায় তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা মানুষের কর্তব্য। একটি খবরের কাগজের তা-ই চরিত্র হওয়া দরকার। তোমাদের মুশকিল হল ব্যবসা ছাড়া তোমরা কিছু বোঝ না।

অবিনাশকে সেখানেই দাঁড় করিয়ে রেখে অপরেশ আবার হাঁটতে লাগলেন। ডানদিকের পথটা ঘুরে উঠে গেছে ওপরে। সেখানেই দাশগুপ্তর ফ্যাক্টরি। অপরেশের খেয়াল হল একটু বাদেই সন্ধে হয়ে যাবে। তাহলে যে উদ্দেশ্যে এদিকে আসা, সেটা করা শক্ত হয়ে যাবে। রাত্রে তিনি চোখে একটু কম দেখেন। আলো থাকতে-থাকতেই সেখানে পৌঁছানো দরকার। অপরেশ ঠিক করলেন ফেরার পথে তিনি ফ্যাক্টরিটা দেখে আসবেন।

প্রায় আধমাইল উঠে এসে তিনি হাঁপাতে লাগলেন। এখন বেশ ঠান্ডা পড়েছে। ছায়ায় আর আলো মাখা নেই। একটু বিশ্রাম নিয়ে অপরেশ ধীরে-ধীরে ওপরে আসতেই চোখ জুড়িয়ে গেল। বিরাট এলাকা জুড়ে জলরাশি টলটল করছে। চমৎকার বাঁধ এই জলকে ঘিরে রেখেছে। ঠিক বাঁধের নিচে ওই জল পরিশ্রুত করে কনকপুরে পাঠানোর ব্যবস্থা আছে। অপরেশ জানেন, এই বিরাট জলাধার পাহারা দেওয়া হয়। রক্ষীরা দশ মিনিট অন্তর বাঁধের ওপর দিয়ে পাক খায়।

অপরেশ সতর্ক হলেন। জায়গাটা নিষিদ্ধ এলাকা হিসেবে ঘোষিত। বিনা অনুমতিতে এখানে আসা নিষেধ। অপরেশকে রক্ষীরা চেনে। তাঁকে দেখলে ওঁরা কিছু বলবে না কিন্তু খবরটা কানাকানি হতে পারে। এই সময় দূরে দুজন রক্ষীকে দেখতে পেয়ে অপরেশ দ্রুত একটা পিলারের পিছনে সরে দাঁড়ালেন। ওরা যতক্ষণ না দৃষ্টির আড়ালে যায় ততক্ষণ তিনি নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর দুপাশ দেখে নিয়ে সতর্ক পায়ে বাঁধ থেকে নিচে জলের ধারে চলে এলেন। অন্ধকার এখন জলের ওপরে, আকাশের পায়ে। কনকনে হাওয়ারা হঠাৎ ছুটে এল পাহাড়ের শরীর থেকে। অপরেশ পকেট থেকে বড় বোতল বের করে নিচু হয়ে লেকের জল ভরতে লাগলেন তাতে। প্রায় গলা অবধি ভরে গেলে বোতলের মুখ আটকে চোখ তুলতেই মনে হল লেকের মাঝখানে কিছু ভাসছে। হয়তো কোনও গাছের ডাল বা কাঠ স্থির হয়ে আছে। কিন্তু তার পরেই মনে পড়ল এই লেকের জলে তো ও-সব কিছু পড়ে থাকার কথা নয়। রক্ষীরা সারা দিন-রাত নজর রাখে যাতে লেকের জলে আবর্জনা না পড়ে। লোকগুলো নির্ঘাৎ ফাঁকি দিচ্ছে।

অপরেশ আবার নজর করবার চেষ্টা করলেন। আবছা আঁধারে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। হঠাৎ ওঁর শিরদাঁড়া কনকন করে উঠল। মানুষের শরীর মনে হচ্ছে! ওটা কি দুটো পা! চকিতে ওপরটা দেখে নিলেন। না, রক্ষীরা এখনও ফিরে আসেনি। দ্রুত বাঁধের ওপর ছুটে এলেন তিনি। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেও জিনিসটা স্পষ্ট হল না, কিন্তু অপরেশের সন্দেহ দৃঢ় হল, ওটি মানুষের মৃতদেহ।

বাঁধ থেকে নিচে নেমে জোরে হাঁটতে লাগলেন তিনি। ওখানে কোনও মানুষের শরীর যাবে কী করে? কাউকে মেরে জলে ফেলে দেওয়া হয়েছে? তাহলে তো রক্ষীরা টের পেত! পেত কি? এই যে তিনি চুপিচুপি গিয়ে জল নিয়ে এলেন ওরা জানতেও পারল না! দাদা খুব বড়াই করেন তাঁর অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নিয়ে, এই তো হাল। অবশ্য কেউ যদি চুপিচুপি আত্মহত্যা করতে জলে ডোবে তবে—! হ্যাঁ, সেইটেই স্বাভাবিক। অপরেশের মাথায় চমকে উঠল অবিনাশের কথাটা। সেই ট্যুরিস্ট বউটির শরীর নয় তো? সকালে যদি ডুবে যায় সন্ধেবেলায় তার শরীর ভাসতে পারে? কাল রাত্রেও ডুবতে পারে যখন ওর স্বামী ঘুমুচ্ছিল!

খবরটা গুপ্তকে দেওয়ার জন্যে অপরেশ শর্টকাটের রাস্তা ধরলেন। ওঁর কোটের পকেটে বোতলটা নড়ছে চলার ছন্দে। কদিন থেকেই মনে হচ্ছিল, কনকপুরের জলটা পরীক্ষা করা দরকার। ট্যুরিস্টরা এখানে এসে একমাত্র পেটের অসুখেই ভুগছে কেন? আগে তো এমন হতো না। বরং কনকপুরে জলের সুখ্যাতি সর্বত্র। অথচ ওই পেটের অসুখ হওয়াটা সবে শুরু হয়েছে। প্রথমে ট্যুরিস্টরা আক্রান্ত হবে। কী জন্যে এ রকম হচ্ছে এখনও জানেন না অপরেশ। শহরের মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে এর কারণ জানা তাঁর কর্তব্য। প্রথমেই সন্দেহ এসেছে জলের ওপর। দেখা যাক এই জল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কি না!

চলতে-চলতে কখন যে ফ্যাক্টরির সামনে এসে পড়েছেন নিজেরই খেয়াল ছিল না। মেইন গেটে আলো জ্বলছে, বিরাট ফ্যাক্টরি এখন চুপচাপ। মৃত জন্তুর শরীর থেকে চামড়া খুলে নিয়ে এখানে তা দিয়ে অনেক কিছু তৈরি হয়। একটা উৎকট গন্ধে চারদিকের বাতাস ভারী। ফ্যাক্টরির মালিককে কোনও দিনই তিনি পছন্দ করেন না। যদিও তিনি অপরেশের ভায়রাভাই, তবু সম্পর্কটা গুপ্তর সঙ্গেই তাঁর বেশি। ওঁদের বাড়িতে মাঝেমধ্যে যখন যান তখন যেন রাজা-বাদশা এসেছে এমন ভঙ্গিতে কাজল তার জামাই-বাবুকে খাতির করে। দেখে গা জ্বলে যায় অপরেশের। শুধু চামড়া বেচে পেট মোটা করছে লোকটা।

গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলেন অপরেশ। এখান থেকেই দাদাকে টেলিফোন করে নেওয়া যায়। সন্ধে হয়ে গেছে, এখন অতটা রাস্তা হাঁটতে তাঁর ইচ্ছে হচ্ছিল না। চৌকিদার ওঁকে দেখে এগিয়ে এসে সেলাম করল। অপরেশ জিজ্ঞাসা করলেন, সাহেব আছেন?

নেই সাব। আভি-আভি ক্লাবমে গিয়া। লোকটা তাঁকে চেনে, সসম্ভ্রমে কথাটা জানাল।

বছরখানেক হল কনকপুরে একটি সান্ধ্য ক্লাব হয়েছে। বেশ মোটা চাঁদা দিয়ে লোকে সেখানে তাস খেলে, মদ খায়। সেখানে ঢোকার সুযোগ তাঁর কোনও দিন হবে না। ওখানকার সদস্য হওয়ার ক্ষমতা তাঁর নেই। অপরেশ চৌকিদারকে বললেন, আমার একটা জরুরি টেলিফোন করা দরকার। ফোন কোথায় আছে?

একটু ইতস্তত করে লোকটা তাকে একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে আলো জ্বেলে দিল। জানলার কাছে টেলিফোন! কনকপুরে টেলিফোন চলে অপারেটারদের সহযোগিতায়। গুপ্তর বাড়ির লাইন চাইলেন অপরেশ। একটি লোক সাড়া দিতে অপরেশ নিজের পরিচয় দিলেন। গুপ্ত বাড়িতে নেই, কোথায় গেছে কেউ জানে না। রিসিভার নামিয়ে রেখে অপরেশনের মনে হল ক্লাবে আছেন কি না দেখা দরকার। ক্লাবেই পাওয়া গেল গুপ্তকে। গলাটা একটু ভারী এবং বিরক্ত—কী ব্যাপার, হঠাৎ টেলিফোন?

অপরেশ বললেন, আমি বিকেলে বেড়াতে এসেছিলাম লেকের দিকে। সন্ধে হয়ে এসেছিল, ভালো করে ঠাওর করতে পারিনি কিন্তু মনে হল লেকের জলে কিছু একটা ভাসছে।

গুপ্তর গলাটা তিরিক্ষি হল—কী ভাসছে?

মানুষের শরীর বলে সন্দেহ হচ্ছে।

ইম্পসিবল! তুমি ঠিক দেখেছ?

একটু সন্দেহ আছে। অন্ধকার হয়ে এসেছিল!

ঠিক আছে, আমি দেখছি। সন্দেহটা সত্যি হওয়ার আগে শহরময় বলে বেড়িও না। কোত্থেকে কথা বলছ?

দাশগুপ্তর ফ্যাক্টরি থেকে। ফেরার পথে এখানেই টেলিফোন আছে।

হুম! তুমি এখন কোথায় যাবে?

হাসপাতালে হয়ে বাড়ি।

হোয়াই? হাসপাতালে কেন?

বিকেলে আবার কিছু পেশেন্ট ভর্তি হয়েছে। দেখে যাই।

ট্যুরিস্ট?

হ্যাঁ। পেটের রোগ। আর-একটা কথা, আমার মনে হচ্ছে এক্ষুনি ঘোষণা করা দরকার, এই শহরের সবাই যেন জল ফুটিয়ে খায়। মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে তোমাকে জানানো আমার কর্তব্য।

আঃ! দু-তিনজনের কী-না-কী হয়েছে আর শহরসুদ্ধ লোককে প্যানিকি করে ছাড়বে! ও সব করলে কাল সকালেই ট্যুরিস্টরা পালাবে। এ ব্যাপারটা নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না। রাখছি। খট করে রিসিভার নামিয়ে রাখা শব্দ হল ওপাশে।

অপরেশ একটু বিহ্বল হয়ে পড়লেন। দাদা এই সমস্যাটার প্রকৃত চেহারাটা বুঝতেই পারল না। মহামারী হয়তো হবে না কিন্তু একটু-একটু করে একদিন এই শহরের মানুষগুলো মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে। এরকম সন্দেহ কদিন থেকেই হচ্ছে কিন্তু প্রমাণ নেই বলে তিনি প্রকাশ্যে কিছু বলতে পারেন না। জানলা দিয়ে তাকাতেই দূরে মোটা-মোটা পাইপ দেখতে পেলেন। পাশাপাশি দুটো পাইপ ওপরের পাহাড় থেকে নেমে এসে ফ্যাক্টরির তলা দিয়ে চলে গেছে।

ওগুলো কীসের পাইপ? বাইরে বেরিয়ে এসে চৌকিদারকে জিজ্ঞাসা করলেন অপরেশ।

পানিকা পাইপ সাব। লেকসে নিকালকে টাউনমে যাতা হ্যায়। চৌকিদার অপরেশের অজ্ঞতায় যেন খুশি হল।

অপরেশ মাথা নাড়লেন। তারপর আস্তে-আস্তে ফ্যাক্টরি ছেড়ে বড়রাস্তা ধরলেন। বেশ কিছুটা নেমে মুখ ঘুরিয়ে আর পাইপটাকে দেখতে পেলেন না। ও দুটো মাটির তলা দিয়ে শহরে ছড়িয়ে পড়েছে! অপরেশ দেখলেন দূরে একটা মুদির দোকানে আলো জ্বলছে। দ্রুত পা চালালেন, ওখান থেকে আরও খালি বোতল নিতে হবে।

পেটের রোগে আক্রান্ত মানুষের আনাগোনা কমছে না। রোজই চার-পাঁচ জন করে লেগেই আছে। অপরেশ এখন খুবই উদ্বিগ্ন। রোজই ডাকের খোঁজ নেন। কলকাতা থেকে দুটো চিঠি যে-কোনওদিন আসতে পারে কিন্তু কেন যে আসছে না! গুপ্ত ব্যাপারটাকে কোনও গুরুত্ব দিতেই রাজি নন। শরীর থাকলেই অসুখ-বিসুখ হবে। এত বড় শহরের মাত্র জনাকয়েক লোকের পেটের অসুখ মানেই শহরটার দোষ একথা বলা বোকামি। সেই রাত্রে তাঁর বাড়িতে এসে কী ঠাট্টাটাই না করে গেলেন গুপ্ত। সুর্মাকে ডেকে বললেন, শোন, তোর বাবার চোখ ভালো করে দেখানো দরকার। সব সময় সর্ষের মধ্যে ভূত দেখছেন। এই রাত্রে আমাকে খামোকা ছোটাল—কাজল বললেন, ওর তো ওই রকম স্বভাব দাদা!

অপরেশ জিজ্ঞাসা করলেন, জিনিসটা কী ছিল?

কলাগাছ। এই শীতের মধ্যে বোট নিয়ে কাছে গিয়ে যখন গাছটাকে দেখলাম তখন তোমাকে—। মুখ বিকৃত করলেন গুপ্ত।

হঠাৎ সুর্মা বলে উঠল, কিন্তু লেকের চারপাশে কোথাও তো কলাগাছ নেই। ওখানে কী করে গেল?

গেল তো দেখছি।

অপরেশ জিজ্ঞাসা করলেন, সেই ট্যুরিস্ট মেয়েটির কোনও খোঁজ পাওয়া গেল? পুরো একটা দিন তো কেটে গেল।

গুপ্ত চোখ কুঁচকে বললেন, না, পাওয়া যায়নি। আর যতক্ষণ না পাওয়া যাচ্ছে ততক্ষণ কোনও সিদ্ধান্তে আসতে আমি রাজি নই! বাই দি বাই লেকের দুজন প্রহরীকে বরখাস্ত করা হয়েছে।

কেন?

তুমি লেকের বাঁধে ঘুরে বেড়ালে অথচ কেউ তোমাকে দেখতে পেল না। ওরা কী জন্যে চাকরি করছে? কলাগাছটাই বা কী করে ওখানে গেল? লোক দুটোকে ওদের দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। গুপ্ত আর দাঁড়াননি। ওঁর চলে যাওয়ার পর অপরেশ নিজের মেয়ের চোখেও সন্দেহের ছায়া দেখতে পেলেন। এখানে আসা অবধি গুপ্ত যেন অস্বস্তিতে ভুগছিলেন। ওঁর কথাবার্তাগুলো থেকে কোনও বিশ্বাস জন্মায়নি ওঁদের মধ্যে। তবে একটা কথা, অপরেশ বুঝতে পারছিলেন সেই মেয়েটিকে আর কোনও দিন খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই শহরের নামের গায়ে একটু ময়লা লাগুক তা চাইবেন না গুপ্ত। এ ব্যাপারে ভীষণ স্পর্শকাতর তিনি।

বাড়ি ফেরার মুখে পিওনকে দেখতে পেলেন অপরেশ। ছেলেটি ওঁকে খামটা দিল। লম্বা খামটার কোণে ছাপানো ঠিকানা দেখে তাঁর আর তর সইছিল না। তিনি চারপাশে তাকালেন। সামনেই একটা গাছের গায়ে ঝোলানো বোর্ড নজরে এল—’এই শহর আপনার, একে যত্ন করুন।’ রাস্তায় এখন বেশ লোকজন। যাঁরা তাকে চেনেন তাঁরা নমস্কার জানিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যেই তিনি এই শহরে বেশ পরিচিত হয়ে গেছেন।

ধৈর্য রাখতে পারলেন না। খামের মুখটা ছিঁড়ে চিঠিটা বের করলেন অপরেশ। দুটো রিপোর্ট। রিপোর্ট নম্বর ওয়ানে কোনও কমপ্লেন নেই! সবকিছুই নিল। অপরেশের মনে আছে এইটে হল লেকের জল। দ্বিতীয়টির দিকে নজর দিলেন তিনি। এবং তৎক্ষণাৎ চমকে উঠলেন। এ কী! এ মারাত্মক বিষ! এখন অবশ্য খুবই সামান্য হারে রয়েছে কিন্তু আর একটু বাড়লেই। অপরেশের মাথা ঘুরতে লাগল।

সেই মুদির দোকান থেকে বোতল দিয়ে ফ্যাক্টরির নিচে থেকে যে জল নিয়েছিলেন এটি সেই জলেরই রিপোর্ট।

অর্থাৎ লেকের জল ভালো আছে কিন্তু সেটা শহরে ঢোকার সময় বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে। কেন হচ্ছে? তাহলে কি মাটির তলায় পোঁতা জলের পাইপগুলো ফেটেছে এবং সেখান দিয়ে বাইরের কিছু জলে মিশছে? কী মিশছে? যে পদার্থটির কথা রিপোর্টে পাওয়া গেছে তা জলে মিশবে কী করে? এ সব প্রশ্নের উত্তর এখনই মাথায় না ঢুকলেও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে ওই পাইপে কিছু গোলমাল হয়েছে। এখন হয়তো খুব সামান্য পরিমাণে লিক করেছে আর ওই বিষ খুব অল্পই জলে মিশতে পারছে, কিন্তু ধীরে-ধীরে যখন পাইপের ফাটলের মুখ বাড়বে তখন একদিনেই শহরের মানুষ বিপর্যস্ত হয়ে যেতে পারে।

উত্তেজনায় অপরেশের ব্লাডপ্রেশার বেড়ে গেল। তাঁর মনে হল এখনই এই খবরটা সবাইকে জানানো দরকার। প্রায় দৌড়েই বাড়ি চলে এলেন তিনি। সুর্মা আর সুব্রত বাগানে বসে ছিল। ওঁর মুখচোখ দেখে সুর্মা এগিয়ে এল—কী হয়েছে বাবা?

কী হয়েছে? শুনলে শিউরে উঠবি। এই শহরের জল সম্পর্কে তোর কী ধারণা? তোমার কী ধারণা সুব্রত? অপরেশের গলায় কাঁপুনি।

কেন? ভালো জল, ফিল্টার্ড ওয়াটার।

দ্রুত মাথা নাড়লেন অপরেশ—নো, নো, ফিল্টার্ড ওয়াটারের নামে আমরা জীবাণু ভর্তি জল খাচ্ছি।

সুর্মা চমকে উঠল—আমাদের খাবার জলে জীবাণু! কী বলছ তুমি?

ঠিকই বলছি।

সুব্রত বলল, আপনি এত বড় অভিযোগ আনছেন, আপনার হাতে তার কোনও অকাট্য প্রমাণ আছে? আমি তো ভাবতেই পারছি না। এই শহরের জলের এত সুনাম!

এতদিন হাতে প্রমাণ ছিল না বলেই চুপ করে থেকেছি। অনেক দিন থেকে সন্দেহ হচ্ছিল, হঠাৎ এত গ্যাস্ট্রিক অ্যাটাকড পেশেন্ট আসছে কেন? এবং যারা আসছে তারাই ট্যুরিস্ট। অর্থাৎ এই শহরের অরিজিন্যাল মানুষেরা ওই সামান্য জীবাণুতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কিন্তু ট্যুরিস্টরা এসেই অ্যাটাকড হচ্ছে। সন্দেহ করেছি কিন্তু বলতে পারিনি। কিন্তু এখন আমার হাতে অব্যর্থ প্রমাণ আছে। অপরেশের মুখ এখন আত্মবিশ্বাসে উদ্ভাসিত।

কী প্রমাণ বাবা? সুর্মা জিজ্ঞাসা করল।

এই যে। কলকাতায় জল পাঠিয়েছিলাম। লেকের জল আর কলের জল। ওখানকার ল্যাবরেটরিতে কেমিক্যাল এনালিসিস করে ওরা এই রিপোর্ট পাঠিয়েছে! লেকের জল স্বাভাবিক কিন্তু কলের জলে অর্গানিক ম্যাটার পাওয়া গিয়েছে। ইট ইজ ডেঞ্জারাসলি ইনজুরিয়াস টু হেলথ।

সুর্মার মুখ হাঁ হয়ে গেল। সুব্রত কিছু বলার আগে কাজলের গলা পাওয়া গেল। কখন যেন উনি বাইরে বেরিয়ে এসেছেন এঁরা কেউ লক্ষ করেননি। কাজল বললেন, ভগবান বাঁচিয়েছেন, ভাগ্যিস তুমি ধরতে পেরেছ।

সুর্মা জিজ্ঞাসা করল, এখন কী করবে বাবা?

অপরেশ মাথা নাড়লেন—সব পালটে দিতে হবে, জলের সব ব্যবস্থা বদলে দিতে হবে, পাইপ পালটাতে হবে আর ওই কারখানাটাকে ওই জায়গা থেকে তুলে দিতে হবে।

কোন কারখানা? কাজল প্রশ্ন করলেন।

তোমার জামাইবাবুর চামড়ার কারখানা। ওরই পচা জল পাইপে ঢুকছে। সুব্রত এবার উত্তেজিত হল—আপনি সিওর?

হ্যাঁ।

ওটা তো এমনিতেই বেআইনিভাবে তৈরি, শুধু—

সুব্রত! তুমি থেমে গেলে কেন? দাশগুপ্ত আমার আত্মীয় বলে? না হে, যে নিজের স্বার্থ মেটাতে সাধারণ মানুষের ক্ষতি করছে তাকে আমি কখনই আত্মীয় বলে মনে করি না। অপরেশ দৃঢ় গলায় বললেন।

সুব্রত নিচু গলায় বলল, কিন্তু পাল্টে দেওয়া কি সম্ভব?

অপরেশ বললেন, আলবত সম্ভব। নতুন করে সব করতে হবে আমাদের। এই জলের ব্যবহার এখুনি বন্ধ করে দেওয়া দরকার।

কাজল চমকে উঠলেন, ও মা! জল বন্ধ করে দিলে আমাদের চলবে কী করে? এত মানুষ জল ছাড়া বাঁচতে পারে?

ধমক দিলেন অপরেশ, জলের বদলে বিষ খাচ্ছ সে হুঁশ নেই?

এই সময় এক ঝরঝরে গাড়ি বিকট শব্দ করতে-করতে গেটের সামনে এসে দাঁড়াল। এই শহরের সমস্ত মানুষ শব্দটিকে চেনে। শহরের একমাত্র খবরের কাগজের মালিক সমাজপতি এটির মালিক। গুপ্ত অনেকবার বলেছেন গাড়িটিকে বাতিল করতে কিন্তু সমাজপতির নাকি দারুণ মায়া জন্মে গেছে গাড়ির ওপরে। ভিনটেজ কার হিসেবে লোকে এটিকে দেখছে এখন।

সমাজপতির চেহারা বেশ মোটাসোটা, গাড়িতে উঠলে একটা দিক সামান্য বসে যায়। মুখে সর্বদা অমায়িক হাসি। ওঁর আবার প্রচুর অর্থ ছিল। তাই স্বচ্ছন্দে এমন কাগজ করছেন যে ট্যুরিস্ট না থাকলে ছাপার খরচ ওঠে না। গেট খুলে এঁদের দেখে তিনি অমায়িক হাসি হাসলেন, হেসে নমস্কার করলেন।

ডাক্তারবাবুর স্বাস্থ্য ভালো আছে?

অপরেশ মাথা নাড়লেন। সমাজপতিকে দেখেই ওঁর মাথায় বুদ্ধি এসে গেছে। সমাজপতি এগিয়ে এসে সুর্মাকে বললেন, তোমার স্কুল চলছে কেমন মা? সুর্মা মাথা নাড়ল, ভালো। সমাজপতি এবার সুব্রতর দিকে ফিরতেই সে হেসে বলল, আমি ভালো আছি।

সমাজপতি এবার অপরেশের দিকে তাকালেন। ডাক্তারবাবু, আমার আসার একটি গূঢ় কারণ আছে। আপনার সঙ্গে একটু নিভৃত আলোচনা করব।

অপরেশ বললেন, কী ব্যাপারে?

এই আমার কাগজের ব্যাপারেই।

অপরেশের মাথায় তখন এ সব ঢোকাতে ইচ্ছে ছিল না। তবু বিব্রত চোখে তিনি মেয়ের দিকে তাকাতেই সুর্মা বলল, তোমরা এখানেই বোসো, আমি চা দিই?

সুব্রত বলল, আমি চলি।

অপরেশের ইচ্ছে ছিল না সুব্রত এখনই চলে যাক। ওর সঙ্গে একটু আলোচনা করার ইচ্ছে ছিল তাঁর। তিনি বললেন, এখনই?

হ্যাঁ! গুপ্তসাহেব আমাকে ক্লাবে দেখা করতে বলেছেন।

ও। ঠিক আছে।

সুব্রত চলে গেলে সমাজপতি বললেন, ছেলেটি বড় ভালো। অপরেশ হাসলেন, হ্যাঁ খুব সিনসিয়ার।

আপনার মেয়ের সঙ্গে কিন্তু চমৎকার মানাবে। দিন-টিন ঠিক হল?

অপরেশের মুখে রক্ত জমল। সুব্রত এখানে আসে, বাড়ির সবায়ের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক, কিন্তু চিন্তা করার সময় তিনি পাননি। তিনি খুব গম্ভীর গলায় বললেন, আপনি কী কথা বলতে এসেছেন?

সমাজপতি সচেতন হলেন। বললেন, কাগজের বিক্রিটা বাড়ানো দরকার। শুনলাম, হাসপাতালে নাকি ট্যুরিস্টরা পেটের অসুখের জন্যে আসছে। আপনি যদি পেটের অসুখের ওপর একটা প্রবন্ধ লেখেন তাহলে ভালো হয়। কী-কী ওষুধ খাওয়া দরকার, কী সতর্কতা নেওয়া উচিত, এই আর কী!

এ সব লোকে পড়বে? অপরেশ ভেতরে-ভেতরে খুব উত্তেজিত হলেন।

পড়বে। মানুষ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে তার নিজের শরীরকে। সেটার যদি গোলমাল হয় তাহলে তার জন্যে যে সব কিছু করতে পারে। আর এ তো পেট নিয়ে কথা। বিশেষজ্ঞর ভঙ্গিতে কথাগুলো বললেন সমাজপতি। অপরেশ মাথা নাড়লেন—লিখব। এমন লেখা লিখব যে সবাই চমকে যাবে।

হ্যাঁ! রোগ হলে সারানো নয়, রোগ যাতে আর না হয় তার ব্যবস্থা। সমাজপতি মাথা নাড়লেন—না, না! রোগ না হলে কেউ ওষুধের কথা শুনতে চায় না।

আপনি বুঝতে পারছেন না—অপরেশ তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আপনি একটা আলোড়ন তোলা লেখা চান তো? পাবেন। তবে এখন নয়, কাল দুপুর পর্যন্ত আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে।

ঠিক আছে। পরশু সকালের কাগজে বেরিয়ে যাবে আপনার লেখা। সমাজপতি কথা শেষ করে বিদায় নিতে যাবেন এমন সময় গেটে আর-একটা গাড়ি এসে থামল। গাড়ি থেকে নেমে গুপ্ত ওঁদের একসঙ্গে দেখে চোখ ছোট করলেন। গেট খুলে ভেতরে এসে গুপ্ত চাপা গর্জন করলেন, কী আরম্ভ করেছ সমাজপতি?

সমাজপতি নিরীহ ভঙ্গিতে মাথা দোলালেন—কিছু করিনি তো!

করোনি? আজকের কাগজে হেডিং কী? অ্যাঁ?

অপরেশের মনে পড়ল। ট্যুরিস্ট মেয়েটি কোথায় গেল? প্রশাসন জবাব দাও। এইরকম হেডিং ছিল। গুপ্ত যে উত্তেজিত হবেন তাতে সন্দেহ কি!

সমাজপতি বললেন, কী করব বলুন। পাবলিক প্রেশার দিচ্ছিল খুব। গুপ্ত গর্জে উঠলেন, এবার আমাদের প্রেশার পড়বে তোমার ওপর! পাবলিক দেখাচ্ছ আমাকে! তোমার কাগজ যাতে না বের হয় তাই ব্যবস্থা হবে। সমাজপতি দুহাত জোড় করলেন—মাপ করবেন স্যার। ও সব করলে ধনেপ্রাণে মারা যাব। আসলে মাঝে-মাঝে এক-একটা জ্বলন্ত প্রশ্ন না ছাড়লে কাগজটা নেতিয়ে যায়। অবশ্য মেয়েটিকেও পাওয়া যাচ্ছে না—

পাওয়া যাচ্ছে না তো আমি কী করব। কেউ যদি জেনেশুনে গা ঢাকা দেয় ভগবানও তাকে খুঁজে বের করতে পারবে না।

কিন্তু আপনি যে আমাকে শাসালেন স্যার, এটা কি ভালো হল? সংবাদপত্রে স্বাধীনতা হরণ করার চার্জে পড়ে যেতে পারেন। গণতন্ত্র বিপন্ন বলে প্রচার করলে এখানে ট্যুরিস্টরা আসবে?

যেন চোখের সামনে ভূত দেখছেন গুপ্ত এমন ভঙ্গিতে সমাজপতিকে দেখলেন। কয়েক মুহূর্ত তাঁর মুখ থেকে কোনও শব্দ বের হল না। তারপর খুব চেষ্টাকৃত শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কাগজের এখন সারকুলেশন কত?

বিশ হাজার।

এই শহরে পাঁচ হাজারেরও বেশি শিক্ষিত মানুষ নেই। খবরটা যথাস্থানে জানাতে হবে, যাতে নিউজপ্রিন্টটা ঠিকমতো পাও। গুপ্ত আর কথা না বাড়িয়ে ভাইয়ের কাছে চলে এলেন—তোমার সঙ্গে কথা আছে। চলো, ঘরে বসি।

সমাজপতি ততক্ষণে করজোড়ে গুপ্তর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, স্যার, এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে এতটা উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? আলোচনা করতে গেলে তো নানান কথা ওঠে, সবই কি মনে রাখা উচিত!

গুপ্ত ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন—উচিত নয়? বেশ, তাহলে কালকের কাগজে হেডিং দিও প্রশাসন যা চেষ্টা করছে পৃথিবীর অন্য কোনও দেশ এত তৎপরতা দেখাত না। বুঝলে?

সরাসরি এই কথাটা না লিখে, একটু উলটে-পালটে—

তাহলে কোনও কিছু সোজা থাকবে না। এবার এসো। গুপ্ত ঘুরে দাঁড়াতেই সমাজপতি পিছু ফিরলেন। মনে-মনে তিনি তখন অবিনাশকে গালাগালি দিচ্ছিলেন। পাবলিক সিমপ্যাথি পাওয়ার জন্যে বাবু জ্বলন্ত হেডিং দিয়েছেন! এখন বোঝ। ঠ্যালা সামলাবার সময় তো আর কাউকে পাওয়া যাবে না। ছোঁড়াটাকে তাড়ানোও যাচ্ছে না। কাগজটার সবকিছু ওই, জুতো সেলাই থেকে চণ্ডী পাঠ করার মতো লোক আর কোথায় পাওয়া যাবে। কিন্তু কর্তাদের চটিয়ে এই শহরে কতদিন থাকা যাবে? কিন্তু না, এই রকম মেরুদণ্ডহীন হয়ে একদল সম্পাদকের বেঁচে থাকার কোনও মানে হয় না। কালকের হেডিংটা পালটে দিয়ে শেষবার তিনি আপোস করছেন, আর নয়।