আমার সামনে টেবিলের উপর এক টুকরো চিনি পড়িয়াছিল। একটা মাছি খুব মন দিয়া সেইটাকে পরীক্ষা করিতে আরম্ভ করিয়াছে। চিনির কাছে মুখ রাখিয়া সে অনেকক্ষণ স্থির হইয়া আছে, মনে হয় সে একটা ভারি ভাবনায় পড়িয়া হঠাৎ যেন গম্ভীর হইয়া গিয়াছে। কিন্তু একটু ভাল করিয়া দেখিলে বোঝা যায় যে সে এখন আহারে ব্যস্ত। তাহার মুখের তলায় শুঁড়ের মতো কি একটা জিনিস বারবার ওঠানামা করিতেছে। একবার চকিতে চিনির উপর ঠেকিয়া আবার মুহূর্তের মধ্যে কোথায় ঢুকিয়া যাইতেছে। কাজটা এত চট্পট্ তাড়াতাড়ি চলিতেছে যে ভাল করিয়া না দেখিলে চোখে ধরাই পড়ে না।
ভাবিলাম এই বেলা মাছিটাকে ধরিয়া ফেলি। কিন্তু মাছিটা আমার চাইতেও অনেকখানি চট্পটে, আমার হাত একটু নড়িতেই সে ব্যস্ত হইয়া উড়িয়া গেল। বাস্তবিক, মাছির চোখ এড়ান খুবই শক্ত। ঐ যে তাহার লালমত মাথাটি দেখিতে পাও ঐ সমস্ত মাথাটি তাহার চোখ। একটি নয়, দুটি নয়, হাজার হাজার চোখ। অনুবীক্ষণ দিয়া বেশ বড় করিয়া দেখিলে মনে হয়, মাথাটি যেন অতি সূক্ষ্ম জাল দিয়া মোড়া। আরো বড় করিয়া দেখিলে দেখা যায় সেই জালের প্রত্যেকটি ফোকর এক একটি আস্ত চোখ। প্রত্যেকটি চোখের ভিতর একটি পর্দা—প্রত্যেকটি পর্দার উপর বাহিরের জিনিসের এক একটি অতি ক্ষুদ্র ছায়া পড়ে। এইরকম হাজার হাজার চক্ষু মেলিয়া না জানি সে জগৎটাকে কিরকম দেখে।
অনুবীক্ষণ দিয়া মাছিকে পরীক্ষা করিয়া দেখ, যেখানে দেখিবে সেখানেই সূক্ষ্ম কৌশলের অদ্ভুত কাণ্ড। ঐ যে শূঁড়ের মতো তাহার জিভটি, সেও একটা কম আশ্চর্য ব্যাপার নয়। পাখার মতো ছড়ানো জিনিসটি তাহার জিভের আগা। শিরার মতো জিনিসগুলির প্রত্যেকটি এক একটি নল। সে নল দিয়া সে খাবার জিনিস চুষিয়া খায়। নলগুলি সমস্তে মিলিয়া গোড়ার দিকে মোটা চোঙার মতো হইয়াছে, সেই চোঞার ভিতর দিয়া খাবার জিনিস তাহার মুখের মধ্যে ঢুকিতে পায়। যদি আরও সূক্ষ্মভাবে খুব ভালো অনুবীক্ষণ দিয়া দেখ, দেখিবে প্রত্যেকটি নলের মধ্যে আবার আরও কত সূক্ষ্ম কারিকরি। এক একটি নল যেন অসংখ্য আংটির মালা—আংটির উপর আংটি বসান, তাহাতে অসম্ভবরকম পাতলা চামড়ার ছাউনি। ঐ নলগুলার গায়ে দুপাশে যে দুইটি কালো দাঁড়ার মতো দেখিতেছ, ঐ দুইটি গুটাইলে সমস্ত জিভটা ছাতার মতো গুটাইয়া যায়। জিভটা যখন মুখের ভিতর থাকে তখন তাহাকে এমনিভাবে মুহূর্তের মধ্যে ছড়াইয়া ঝাড়ের মতো ঝুলিয়া বাহির হয়। গরু বা ঘোড়ার গায়ে একরকম বড় মাছি বসে, তাহাদের ডাঁশ বলে। ডাঁশেরা রক্তপায়ী, সুতরাং তাহাদের জিভের সঙ্গে একজোড়া করিয়া হুল থাকে। জিভটাও মাছির জিভের চাইতে অনেকখানি সরু—দেখিতে কতকটা বোতলের মতো। হুলের খোঁচায় জন্তুর গায়ে ফুটা করিয়া সেই ফুটার মধ্যে জিভের আগাটুকু ঢুকাইয়া রক্তপান করে।
তারপর দেখ মাছির চরণখানি। ইহার মধ্যেও দেখিবার মতো জিনিস অনেক আছে। প্রথমেই চোখে পড়ে ঐ শিঙের মতো অদ্ভুত জিনিস দুইটি। কিন্তু বাস্তবিক দেখিবার মতো জিনিস চাও ত পায়ের ঐ উঁচু ঢিবলি দুইটিকে দেখ। ঐ দুইটি নরম তেলোর উপর ভর দিয়া মাছি আমাদের খাবারের উপর দিয়া হাঁটিয়া যায়। খাবার জিনিসে যে পা ঠেকাইতে নাই, অন্তত পা-টাকে যে ভাল করিয়া সাবান দিয়া ধোয়া উচিত, সে খেয়াল র মাছির নাই। সে অখাদ্য ময়লা জিনিসের উপর তিন জোড়া চরণ চাপাইয়া সেই চরণের ধূলি আবার আমাদের খাবারের উপর ঝাড়িয়া যায়। তাহার সঙ্গে কত যে রোগের বীজ চলিয়া আসে, তাহা ভাবিলেও ভয় করে। ঐ পায়ের তেলোটিকে অনুবীক্ষণ দিয়া পরীক্ষা করিলে অনেক সময় দেখা যায় উহাতে সাংঘাতিক রোগের বীজ কিল্বিল্ করিতেছে। সেইজন্য লোকে বলে যে মাছিকে খাবারের উপর বসিতে দিয়ো না। পায়ের তেলোটি আগাগোড়া বোলতার চাকের মতো অসমান—তাহার গায়ে অসংখ্য ছিদ্র—সেই ফুটা দিয়া সে যে-কোন জিনিসকে চুষিয়া ধরিতে পারে। তাই কাচের মতো পালিশ জিনিসের উপরেও চলাফিরা করিতে তাহার কোন অসুবিধা হয় না। দরকার হইলে ঐ ফুটাগুলির ভিতর হইতে সে একরকম আঠাল রস বাহির করিতে পারে, তাহাতে পা আরও মজবুতভাবে আঁটিয়া বসাইবার সাহায্য হয়।
মাছি উড়িবার সময় প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ছয়শত বার ডানা ঝাপটায়। খুব ব্যস্ত হইলে এক সেকেন্ডে সে প্রায় বিশ পঁচিশ হাত উড়িয়া যাইতে পারে। অতটুকু প্রাণীর পক্ষে ইহা বড় সামান্য কথা নয়। মাছিটাকে যদি একটা ঘোড়ার মতো কল্পনা করা যায় তাহা হইলে তাহার দৌড়টি হয় যেন কামানের গোলার মতো।
বাতাস ছাড়া মানুষ যেমন বাঁচে না—মাছিরও তেমনি নিশ্বাস না লইলে চলে না। আমরা নিশ্বাস লই ফুসফুসে বাতাস পাইবার জন্য। আমাদের বুকের দুপাশে দুটি হাপরের মতো যন্ত্র আছে, তাহারই নাম ফুসফুস বা Lungs । ঐ ফুসফুসের মধ্যে বাতাস ঢুকিয়া শরীরের রক্তকে তাজা করিয়া তোলে। মাছির সমস্ত শরীরটাই যেন একটা প্রকাণ্ড ফুসফুস। তাহার শরীরের দুপাশে ছোট ছোট ফুটা থাকে—সেইগুলিই তাহার নিশ্বাস লইবার ছিদ্র বা নাক। শরীরের ভিতরে সরু সরু শিরার মতো অসংখ্য প্যাঁচান নল তাহার গায়ের রক্তের মধ্যে ডুবান রহিয়াছে। সেই নলের ভিতর দিয়া বাতাস চলে আর রক্ত তাজা হইয়া উঠে।
আমাদের যেমন অসুখ-বিসুখ আছে, মাছিরও তেমনি। এই এখন আমকাঁঠালের সময় এত মাছি দেখিতেছ, আর কিছুদিন পরেই তাহারা কমিতে আরম্ভ করিবে। একরকম ছাতাপড়া ব্যারামে প্রতি বৎসর হাজার হাজার মাছি মারা যায়।
মাছির কথা বলিতে গেলে তাহার জন্মের কথাও বলিতে হয়। আঁস্তাকুড়ের ময়লার মধ্যে বা গোবরের গাদার মধ্যে মাছিরা ডিম পাড়িয়া যায়। খুব ছোট সাদা সাদা চালের মতো ডিমগুলি চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ফুটিয়া তাহার ভিতর হইতে একরকম পোকা বাহির হয়। সপ্তাহখানেক ধরিয়া এই পোকাগুলি অল্পে অল্পে বাড়িতে থাকে আর বারবার খোলস বদলায়। তারপর পোকাটা শুকাইয়া কেমন গুটি পাকাইয়া যায়—তাহাতে তামাটে রং ধরিয়া আসে। এইভাবে আরও কয়েকদিন থাকিলেই সেই গুটির ভিতর হইতে আস্ত মাছিটা বাহির হইয়া আসে। তারপর তাহার চেহারার আর কোনও পরিবর্তন হয় না। জন্মিবার সময় তার শরীরটি যতটুকু থাকে মরিবার সময়ও ঠিক ততটুকু। সাধারণত আমরা যেসব মাছি দেখি, তাহাদের ডিমগুলি দেখিতে নিতান্তই সাধাসিধা—তাহার গায়ে কোন কারিকরি নাই। কিন্তু এক একরকম মাছি আছে অতি আশ্চর্যরকমের সুন্দর ডিম পাড়ে।
ছারপোকা এবং মশা কামড়াইতে জানে, মাছির সে বিদ্যা নাই। সেইজন্য মানুষে ছারপোকা ও মশা তাড়াইতে যত ব্যস্ত হয়, মাছির ভয়ে ততটা ব্যস্ত হয় না। কিন্তু উৎপাত হিসাবে মাছিকে কাহারও চাইতে কম বলা চলে না। মেসোপটেমিয়ার যেখানে ইংরাজদের সহিত তুর্কীদের লড়াই চলিতেছে সেখানে গ্রীষ্মকাল আসিলেই মাছির উপদ্রব এমন সাংঘাতিক হইয়া উঠে যে, কেবল মাছি মারিবার জন্যই হাজার হাজার টাকা খরচ করিয়া নানারকম কল-কৌশল খাটাইতে হয়। মাছি যেখানে হাজারে হাজারে লাখে লাখে ঘুরিয়া বেড়ায় সেখানে কেবল হাতে মারিয়া তাহাদের কর শেষ করিবে? নানারকম ফাঁদ পাতিয়া বিষাক্ত খাবারের লোভ দেখাইয়া একেবারে দলে দলে তাহাদের বংশকে বংশ উজাড় করিতে হয়। তা না হইলে সে দেশে মানুষের তিষ্ঠান দায় হয়।