মহাকাশযান টাইটুন
কন্ট্রোল প্যানেলের ওপর ঝুঁকে বসেছিল মহাকাশযান টাইটুনের কমিউনিকেশন অফিসার রাটুল। ক্যাপ্টেন রন তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কোনো সমস্যা রাটুল?
না-ঠিক সমস্যা নয়। তবে
রাটুল বাক্যটা শেষ না করে থেমে গেল।
তবে কী?
যোগাযোগ এন্টেনাতে একটা সিগন্যাল আসছে।
কার সিগন্যাল?
সেইটাই বুঝতে পারছি না।
বুঝতে পারছ না মানে? এবারে ক্যাপ্টেন রন প্রথমবারের মতো কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, কী বুঝতে পারছ না?
ডপলার শিফট দেখে মনে হচ্ছে আরেকটা মহাকাশযান এদিকে আসছে। কিন্তু সিগন্যালটা বুঝতে পারছি না। কোনো মাথামুণ্ডু নেই।
সম্ভবত এনক্রিপ্টেড। গোপনীয়তার জন্যে অনেক সময় করে।
উঁহু। কমিউনিকেশন অফিসার রাটুল বলল, আমি আমাদের মেগা প্রসেসর দিয়ে বিশ্লেষণ করেছি, তথ্যটাই দুর্বোধ্য।
দুর্বোধ্য?
হ্যাঁ। আমি শেষ পর্যন্ত সুপার কম্পিউটারে দিয়েছি, দেখি কিছু বের করতে পারে কি না।
ঠিক আছে। যদি কিছু জানতে পার আমাকে জানিও।
জানাব। নিশ্চয়ই জানাব।
ক্যাপ্টেন রন মহাকাশযান টাইটুনের যাত্রাপথ নির্দিষ্ট করার কাজে ব্যস্ত হয়ে কিছুক্ষণের জন্যে দুর্বোধ্য সিগন্যালের কথা ভুলে গিয়েছিল কিন্তু কমিউনিকেশন অফিসার রাটুল একটু পরেই আবার তাকে সেটা মনে করিয়ে দিল। সে এসে উত্তেজিত গলায় বলল, ক্যাপ্টেন রন, সুপার কম্পিউটারের বিশ্লেষণ শেষ হয়েছে।
শেষ হয়েছে?
হ্যাঁ।
কী আছে সিগন্যালে?
একটা বিপদগ্রস্ত মহাকাশযান সাহায্যের জন্যে সিগন্যাল পাঠাচ্ছে।
ও। ক্যাপ্টেন রন ভুরু কুঁচকে বলল, সাহায্যের জন্যে সিগন্যাল দুর্বোধ্যভাবে কেন পাঠাচ্ছে? সহজ কোডিংয়ে কেন পাঠাচ্ছে না?
আসলে মহাকাশযানটা সহজ কোডিংয়েই পাঠাচ্ছে আমাদের কাছে দুর্বোধ্য মনে হচ্ছে।
ক্যাপ্টেন রন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কমিউনিকেশন অফিসার রনের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কী বলতে চাইছ?
এটা আমাদের কোনো মহাকাশযান নয়। এটা মহাজাগতিক কোনো প্রাণীর মহাকাশযান।
ক্যাপ্টেন রন চমকে উঠে বলল, কী বলছ তুমি?
আমি ঠিকই বলছি ক্যাপ্টেন। আপনি এলেই দেখতে পারবেন। সুপার কম্পিউটারের প্রথমবার অর্থ বের করতে সময় লেগেছে। এখন আর সময় লাগছে না। আমরা কি তার সাহায্যের আবেদনে সাড়া দেব?
দাঁড়াও আমি নিজে একবার দেখে নিই।
ক্যাপ্টেন রনের সাথে সাথে মহাকাশযানের অন্য কুরাও যোগাযোগ মডিউলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। দূরের মহাকাশযান থেকে যে সিগন্যালটি পাঠানো হয়েছে সেটা এরকম :
বাঁচাও আমাদের বাঁচাও। বিধ্বস্ত
শক্তি ক্ষেপণ কেন্দ্র।
নিঃশেষিত রসদ। ধ্বংসের মুখোমুখি মহাকাশযান।
বাঁচাও আমাদের বাঁচাও।
ক্যাপ্টেন রন সাহায্যবার্তার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা কেমন করে বুঝতে পারলে এটা মহাজাগতিক প্রাণীর সিগন্যাল।
পৃথিবীর কোনো মহাকাশযান থেকে এই সিগন্যাল পাঠালে আমাদের বিশ্লেষণ করতে কোনো সময় লাগত না। এটা আমাদের সিগন্যাল না।
এটা যেদিক থেকে আসছে সেদিকে আগে কখনো আমাদের কোনো মহাকাশযান গিয়েছে?
না যায় নি।
এই মহাকাশযানটা এখন আমাদের কাছ থেকে কত দূরে আছে?
মহাজাগতিক হিসেবে খুবই কাছে। আমরা এখন যে গতিতে যাচ্ছি তাতে এক সপ্তাহের ভেতর পৌঁছাতে পারব।
যদি এত কাছে আছে তা হলে সিগন্যালটা আগে কেন পেলাম না?
টাটুল বলল, সিগন্যালটা খুবই দুর্বল, সেজন্যে।
ক্যাপ্টেন রন অন্যমনস্কভাবে তার গাল চুলকাল। মহাকাশযানের কোডে পরিষ্কার লেখা আছে কোনো বিপদগ্রস্ত মহাকাশযান যদি সাহায্য চায় তা হলে সাথে সাথে সাহায্যের জন্যে ছুটে যেতে হবে। কিন্তু মহাকাশযানটি যদি মানুষের না হয়ে মহাজাগতিক কোনো প্রাণীর হয় তা হলে কী করতে হবে সেটা পরিষ্কার করে লেখা নেই। যে সিদ্ধান্তটা নেয়ার সেটা তাকেই নিতে হবে। ক্যাপ্টেন রন চোখ বন্ধ করে এক মুহূর্ত ভাবল তারপর ঘুরে কমিউনিকেশন অফিসার রাটুলের দিকে তাকিয়ে বলল, রাটুল তুমি একটা উত্তর পাঠাও।
কী বলব সেখানে?
বল আমরা আসছি।
কন্ট্রোল প্যানেল ঘিরে মহাকাশযানের কুরা দাঁড়িয়েছিল ক্যাপ্টেন রন তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা সবাই এস। কীভাবে তাদের সাহায্য করা যায় সেটা নিয়ে একটু কথা বলি।
মহাকাশযানের কন্ট্রোল রুমে বড় টেবিলটা ঘিরে সবাই বসেছে। ক্যাপ্টেন রন সবার দিকে একবার তাকিয়ে বলল, তোমরা সবাই শুনেছ আমরা বিপদগ্রস্ত মহাকাশযানটিকে সাহায্য করার জন্যে যাচ্ছি। ঠিক কীভাবে সাহায্য করব আমি সেটা নিয়ে তোমাদের সাথে কথা বলতে চাই।
ইঞ্জিনিয়ার শুরা বলল, তাদের সমস্যাটা কী সেটা না জানা পর্যন্ত আমরা তো কোনো পরিকল্পনা করতে পারছি না।
ক্যাপ্টেন রন মাথা নেড়ে বলল, ঠিকই বলেছ। আমরা প্রথমেই জানতে চাইব তাদের সমস্যাটা কী।
তথ্যপ্রযুক্তিবিদ লানা বলল, মহাজাগতিক প্রাণীদের মহাকাশযানের নিশ্চয়ই নিজস্ব তথ্যকেন্দ্র আছে। আমাদের তথ্যকেন্দ্রের সাথে সেই তথ্যকেন্দ্রের তথ্য বিনিময় করা দরকার। আমাদের জানা উচিত তাদের সভ্যতা কোন ধরনের।
জীববিজ্ঞানী কায়াল মাথা নাড়ল, বলল, আমার আর তর সইছে না। আমি প্রাণীগুলোকে দেখতে চাই। ঠিক কীভাবে প্রাণের বিকাশ হয়েছে আমি বুঝতে চাই। এটাও কি জিনমকেন্দ্রিক? কার্বনভিত্তিক নাকি সিলিকনভিত্তিক।
ক্যাপ্টেন রন জীববিজ্ঞানী কায়ালকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তুমি তোমার কৌতূহল মেটানোর অনেক সুযোগ পাবে। আগে বাস্তব সমস্যাগুলোর কথা বলি। আমাদের কী কী ঝুঁকি আছে?
যেহেতু প্রাণীগুলো সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না, নিরাপত্তার জন্যে অবশ্যই কোয়ারেন্টাইন করতে হবে। আমাদের একটা নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে নিতে হবে। সবার আগে দরকার…
মহাকাশযানের সকল ক্রু, ইঞ্জিনিয়ার আর বিজ্ঞানীরা অস্থির গলায় কথা বলতে থাকে। সবার ভেতরে এক ধরনের উত্তেজনা, মানবজাতির ইতিহাসে যেটা ঘটে নি সেটা প্রথমবারের মতো ঘটতে যাচ্ছে। পৃথিবীর মানুষ প্রথমবারের মতো একটা মহাজাগতিক প্রাণীর মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। দীর্ঘ আলোচনার পর যখন সবাই নিজের কাজে ফিরে যাচ্ছিল তখন হঠাৎ ক্যাপ্টেন রন আবিষ্কার করে বড় টেবিলের এক কোনায় গালে হাত দিয়ে পদার্থবিজ্ঞানী খ্রাউস বসে আছে। ক্যাপ্টেন রন তার দিকে তাকিয়ে বলল, উস তুমি কিছু বলবে?
নাহ্। খ্রাউস মাথা নাড়ল, আমার বলার কিছু নেই।
আমরা একটা মহাজাগতিক প্রাণীকে দেখতে পাব সেটা নিয়ে তোমার কোনো আগ্রহ নেই?
এত বড় বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, আমরা ছাড়া আরো কত মহাজাগতিক প্রাণী আছে-আগে হোক পরে হোক তাদের সাথে আমাদের দেখা হবেই।।
আমরা আগামী এক সপ্তাহের মাঝে প্রথমবারের মতো এই মহাজাগতিক প্রাণীদের দেখতে পাব। কত কী হতে পারে-নিরাপত্তার ব্যাপারে তোমার কোনো বক্তব্য আছে?
নাহ্! শুধু
শুধু কী?
তাদের ডান হাত কি ডান দিকে না বাম দিকে সেটা জানা থাকলে ভালো হত।
কন্ট্রোল ঘরে বসে থাকা সবাই ঘুরে খ্রাউসের দিকে তাকাল। মানুষটি ঠাট্টা করে কিছু বলছে কি না কেউ বুঝতে পারল না। জীববিজ্ঞানী কায়াল বলল, এই প্রাণীগুলো কী রকম আমাদের জানা নেই। তাদের হাত-পা আছে না অক্টোপাসের মতো শুঁড় আছে আমরা কিছুই জানি না। ডান হাত বাম হাত থাকবে তোমাকে কে বলেছে?
তথ্যপ্রযুক্তিবিদ লানা বলল, তুমি এরকম হেঁয়ালি করে কেন কথা বলছ? ডান হাত আবার বাম দিকে কেমন করে হয়?
ইঞ্জিনিয়ার শুরা হাসার ভঙ্গি করে বলল, আমাদের বিজ্ঞানী খ্রাউস সব সময় সবকিছু নিয়ে ঠাট্টা করে। কাজেই মহাজাগতিক প্রাণী নিয়েও ঠাট্টা করবে এতে অবাক হবার কী আছে?
খ্রাউস দুর্বল গলায় বলল, আমি আসলে ঠাট্টা করছিলাম না।
ক্যাপ্টেন রন বলল, এর মাঝে ডান বামের ব্যাপারটা কেমন করে আসছে? একটা মহাজাগতিক প্রাণীকে ডান বা বাম কেমন করে বোঝাবে? ডান মানে কী? বাম মানে কী?
খ্রাউস বলল, ডান বাম বোঝানো কঠিন নয়। একটা নিউট্রন থেকে যখন বেটা বের হয় তখন স্পিনের সাথে যে সম্পর্ক থাকে সেটা দিয়ে বাম ডান বোঝানো যায়। প্রকৃতি স্পষ্টভাবে জানে বাম মানে কী ডান মানে কী-
ক্যাপ্টেন রন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, জানা থাকলে ভালো। আমার সেটা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। আমার কাছে ডান আর বামের কোনো পার্থক্য নেই। যারা ডান হাত দিয়ে কাজ করে আর যারা বাম হাত দিয়ে কাজ করে তারা সবাই আমার কাছে সমান।
খ্রাউস বলল, আমি সেটা বলছিলাম না। আমরা যখন তথ্য বিনিময় করব তখন যদি পদার্থবিজ্ঞানের তথ্য বিনিময় করি তা হলেই আমরা ডান বা বাম বলতে কী বুঝি সেটা বুঝে যাব। আমি বলছিলাম সেখান থেকে–
ক্যাপ্টেন রন হাত নেড়ে খ্রাউসকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ঠিক আছে। তুমি লানাকে বল তথ্যকেন্দ্র থেকে যেন পদার্থবিজ্ঞানের তথ্য বিনিময় করা হয়।
লানা হতাশার মতো ভঙ্গি করে বলল, আমি যখন এই মহাকাশযানে যোগ দিয়েছিলাম তখন ভেবেছিলাম আর বুঝি পদার্থবিজ্ঞান আমাকে উৎপাত করবে না। স্কুলে কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পদার্থবিজ্ঞান বিষয়টা আমাকে কী কষ্ট দিয়েছে জানো?
খ্রাউস অপরাধীর মতো বলল, আসলে বিষয়টা এত খারাপ না। স্কুল-কলেজে ঠিক করে পড়ায় না তো সেজন্যে কেউ পছন্দ করে না। যাই হোক আমি যেটা বলছিলাম–
খ্রাউস কী বলছিল সেটা কেউ শুনতে চাইল না। সবারই অনেক কাজ, কারো এখন পদার্থবিজ্ঞানের হেঁয়ালি শোনার সময় নেই।
.
পরবর্তী ছয় দিনও কেউ ব্রাউসের কথা শোনার সময় পেল না। মহাকাশযানটি বিধ্বস্ত, তাদের জন্যে তথ্য বিনিময় করাও খুব সহজ ছিল না। তারপরেও তার চেষ্টা করা হল। মহাজাগতিক প্রাণীটি সিলিকনভিত্তিক, বুদ্ধিমত্তা মানুষের মতো মস্তিষ্কে কেন্দ্রীভূত নয়, সেটা পরিব্যাপ্ত। মহাকাশযানের ইঞ্জিনে সমস্যা হয়েছে-এক ধরনের জ্বালানি সংকট রয়েছে। খ্রাউসের একান্ত ইচ্ছার কারণে পদার্থবিজ্ঞানেরও কিছু তথ্য বিনিময় করা হয়েছে। বিজ্ঞানে তারা মানুষ থেকে খানিকটা পিছিয়ে আছে দশ মাত্রার স্ট্রিং থিওরির সমাধান করেছে কিন্তু চৌদ্দ মাত্রার অবতল থিওরি এখনো সমাধান করতে পারে নি।
সপ্তম দিনে যখন মহাকাশযান টাইটুনের ক্রুরা প্রথমবার সরাসরি মহাকাশযানটিকে দেখতে পেল তখন তাদের উত্তেজনার কোনো সীমা ছিল না। আকৃতিটা অত্যন্ত বিচিত্র, পৃথিবীর কোনো কিছুর সাথে তার কোনো মিল নেই। পৃথিবীর প্রযুক্তিতে কোনো কিছু তৈরি করতে হলে তার মাঝে জ্যামিতিক কিছু আকার থাকে–এই মহাকাশযানে সেরকম কিছু। নেই, মনে হয় পুরোটাই বুঝি একটু একটু করে নিজে থেকে গড়ে উঠেছে। মহাকাশযানটির ইঞ্জিন বিধ্বস্ত তাই সেটি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না, নির্দিষ্ট একটা গতিতে অসহায়ভাবে এগিয়ে আসছে।
ক্যাপ্টেন রন মহাকাশযান টাইটুনকে মহাজাগতিক প্রাণীদের মহাকাশযানটির গতিপথের সাথে একই সরলরেখায় উপস্থিত করে। তারপর খুব ধীরে ধীরে তার গতিপথ কমিয়ে আনতে থাকে-যখন দুটো মহাকাশযান একটি অন্যটিকে স্পর্শ করবে তখন একটি মহাকাশযানের তুলনায় অন্যটির গতিবেগ হবে শূন্য। মহাকাশে ভিন্ন ভিন্ন মহাকাশযানের একত্রিত হওয়ার এটি একটি পরীক্ষিত পদ্ধতি।
কন্ট্রোল প্যানেলে সবাই এসে ভিড় করেছে, সবার ভেতরেই এক ধরনের উত্তেজনা। খুব ধীরে ধীরে মহাকাশযান দুটো একটি আরেকটির দিকে এগিয়ে আসছে আর কিছুক্ষণের ভেতরেই মানবজাতির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটতে যাচ্ছে। এরকম সময়ে কন্ট্রোল প্যানেলে একটা সংকেত ধরা পড়ল, ক্যাপ্টেন রন জিজ্ঞেস করল, কী পাঠিয়েছে?
রাটুল বলল, সামনের মহাকাশযান থেকে একটা বার্তা।
কী বলেছে বার্তায়?
রাটুল পড়ে শোনাল, তোমাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। তোমাদের প্রতি ভালবাসা। তোমাদের প্রতি শুভেচ্ছা। তোমাদের প্রতি কাজামিনু।
কাজামিনু? কাজামিনু অর্থ কী?
সুপার কম্পিউটার এটা অনুবাদ করতে পারে নি। মানুষের ভাষায় এটা নেই। নিশ্চয়ই। কৃতজ্ঞতা, ভালবাসা বা শুভেচ্ছার মতো একটা শুভ কামনা।
ক্যাপ্টেন রন বলল, ঠিক আছে। আমরাও তাদের জন্যে একটা বার্তা পাঠাই। তাদেরকে বল, পৃথিবীর মানবজাতির পক্ষ থেকে শুভ কামনা। এই মিলনমেলায়–
খ্রাউস হঠাৎ বাধা দিয়ে বলল, না।
ক্যাপ্টেন রন অবাক হয়ে বলল, না? না কেন?
খ্রাউস অস্থির গলায় বলল, ভালবাসা শুভ কামনার অনেক সময় আছে। একটু পরেও সেটা পাঠানো যাবে। এখন যেটা দরকার সেটা পাঠাও।
এখন কী দরকার?
তাদের কাছে একটা বার্তা পাঠিয়ে বল তারা যেন তাদের ডান দিকের লাইটটা জ্বালায়।
ডানদিক?
হ্যাঁ।
কেন ডানদিক?
তোমাকে সেটা পরে বলছি-আমাদের হাতে এখন সময় নেই। আমরা একে অপরকে স্পর্শ করার আগেই একটা জিনিস জানা দরকার। ডান বলতে তারা কী বোঝায় সেটা জানা দরকার।
ক্যাপ্টেন রন একটু অধৈর্য হয়ে বলল, কিন্তু আমরা ডান বলতে কী বোঝাই সেটা কি তারা জানে?
জানে। আমরা পদার্থবিজ্ঞানের তথ্য বিনিময় করেছি। প্যারিটি ভায়োলেশন থেকে সেটা জানা সম্ভব। তারা জানে-আমি সেটা নিশ্চিত করেছি।
কমিউনিকেশন অফিসার রাটুল ক্যাপ্টেন রনের দিকে তাকিয়ে বলল, কী করব ক্যাপ্টেন?
ঠিক আছে আগে ব্রাউসের বার্তাটা পাঠাও। বল, তারা যেন তাদের ডান দিকের বাতিটি জ্বালায়।
রাটুল ক্ষীপ্র হাতে একটা কি-বোর্ডে কথাগুলো লিখে সুপার কম্পিউটারে পাঠাল। সুপার কম্পিউটার সেই তথ্যটি মহাজাগতিক প্রাণীদের উপযোগী করে সাজিয়ে নিয়ে মূল এন্টেনা দিয়ে পাঠিয়ে দেয়।
কিছুক্ষণের মাঝেই বার্তাটি মহাজাগতিক প্রাণীদের মহাকাশযান গ্রহণ করে। খ্রাউস অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে এবং অন্যেরা খানিকটা কৌতুকভরে এগিয়ে আসা মহাকাশযানটির দিকে তাকিয়ে থাকে। মহাকাশযানটির ডান বা বাম কোনো দিকেই বাতি জ্বলল না, তার বদলে কন্ট্রোল প্যানেলে নূতন একটি বার্তা এসে হাজির হল। সেখানে লেখা, তোমরা কেন ডান দিকে বাতি জ্বালাতে বলছ? আমাদের জ্বালানি সংকট। বাতি জ্বালিয়ে জ্বালানি অপচয় করতে চাই না।
ক্যাপ্টেন রন খ্রাউসের দিকে তাকিয়ে বলল, খ্রাউস, তোমার কথামতো আমরা চেষ্টা করেছি। তারা এখন তোমার সাথে এই খেলাটি খেলতে চাইছে না!
খ্রাউস উত্তেজিত মুখে বলল, কিন্তু এই খেলা তাদের খেলতে হবে। খেলতেই হবে– তা না হলে আমরা কিছুতেই তাদের স্পর্শ করতে পারব না! তাদের আবার বল। যেভারে হোক সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে হলেও ডান দিকের একটা বাতি জ্বালাতে হবে! জ্বালাতেই হবে।
ক্যাপ্টেন রন একটু অবাক হয়ে ব্রাউসের দিকে তাকিয়ে রইল, কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে হঠাৎ সে একটু অস্বস্তি অনুভব করতে থাকে। সে কমিউনিকেশন অফিসার রাটুলের দিকে তাকিয়ে বলল, রাটুল আরেকটা বার্তা পাঠাও।
কী পাঠাব?
লিখো যেভাবেই হোক তোমাদের ডান দিকের বাতিটি জ্বালাতে হবে। অত্যন্ত জরুরি।
রাটুল ক্ষীপ্র হাতে বার্তাটি পাঠিয়ে দেয় এবং কিছুক্ষণের মাঝেই একটা উত্তর চলে আসে, আমাদের অত্যন্ত জ্বালানি সংকট কিন্তু তোমাদের অনুরোধে আমরা আমাদের ডান দিকের একটা জিনন ল্যাম্প জ্বালাচ্ছি।
মহাকাশযানটি তখন এত কাছাকাছি চলে এসেছে যে তার নকশাকাটা দেয়ালটিও স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। তার গঠনটি এত বিচিত্র যে দেখে মনে হয় এটি বুঝি মহাকাশযান নয়, এটি বুঝি কোনো বিমূর্ত শিল্পীর হাতে গড়া বিশাল একটি ভাস্কর্য।
খ্রাউস চোখ বড় বড় করে মহাকাশযানটির দিকে তাকিয়ে ছিল, ভেতরকার উত্তেজনা হঠাৎ করে সবাইকে স্পর্শ করেছে। সবাই দেখল ধীরে ধীরে এগিয়ে আসা মহাকাশযানটিতে একটা জিননের নিষ্প্রভ বাতি জ্বলে উঠল। আশ্চর্যের ব্যাপার সেটি মহাকাশযানটির ডান দিকে জ্বলে ওঠে নি সেটি জ্বলে উঠেছে বাম দিকে।
খ্রাউস মহাকাশযানের চেয়ারের হাতলটি খামচে ধরে চিৎকার করে উঠে বলল, থামাও! থামাও মহাকাশযান। থামাও!।
ক্যাপ্টেন রন অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে? কেন থামাব?
খ্রাউস হাত দিয়ে মহাকাশযানটা দেখিয়ে বলল, এটা প্রতি পদার্থের তৈরি।
ক্যাপ্টেন রন হতচকিতের মতো সামনে তাকিয়ে রইল, সে দেখতে পেল খুব ধীরে ধীরে দুটি মহাকাশযান এগিয়ে আসছে, আর কয়েক সেকেন্ডের ভেতরেই একটা আরেকটাকে স্পর্শ করবে। কোনোভাবেই সে এখন তার মহাকাশযানকে থামাতে পারবে না। দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই, সামনের মহাকাশযানটি প্রতি পদার্থের তৈরি। যখন একটি আরেকটিকে স্পর্শ করবে মুহূর্তের মাঝে দুটি মহাকাশযানই ভয়ংকর বিস্ফোরণে অদৃশ্য হয়ে যাবে, থাকবে শুধু অচিন্তনীয় শক্তি।
মহাকাশযানের সবাই স্থির দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে রইল। খ্রাউস ভেবেছিল সবাইকে বলবে, সেই বিংশ শতাব্দীতে রিচার্ড ফাইনম্যান কৌতুক করে বলেছিলেন যদি কখনো কোনো মহাজাগতিক মানুষ করমর্দন করার জন্যে ভুল হাত এগিয়ে দেয় তার সাথে করমর্দন কোরো না–সেই মানুষ সম্ভবত প্রতি পদার্থে তৈরি। কিন্তু কেউ খ্রাউসের সেই গলাটি শুনতে আগ্রহী হয় নি। পদার্থের বেলায় যেটি ডান দিক প্রতি পদার্থের বেলায় সেই ডান দিক উল্টো দিকে।
মহাকাশে পদার্থ ও প্রতি পদার্থের তৈরি দুটো মহাকাশযানের সংস্পর্শে বিস্ফোরণের কারণে যে শক্তির সৃষ্টি হয়েছিল সেটি কয়েক আলোকবর্ষ দূর থেকে দেখা গিয়েছিল।