নয়
এক মুহূর্ত পর ঝটপট কবাট ভিড়িয়ে দিল মুসা। তিক্ত স্বরে বলল, ‘মোবাইল হোমের ভেতরে র্যা স্নেক!’
‘বলো কী!’ ওর পাশে উঠে এল ওমর, ভিতরে উঁকি দিল সাবধানে। ‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। দরজা থেকে দুই ফুট দূরে কুণ্ডলী পাকিয়েছে। যে-কোনও সময়ে ছোবল দেবে।
‘কপাল খারাপ, মোবাইল হোমের ভেতরে রয়ে গেছে ঝাড়ু,’ বলল কিশোর।
‘কিশোর, রবিন, আশপাশের কারও কাছ থেকে ঝাড়ু আনো,’ বলল ওমর। ‘লম্বা ডাণ্ডা আছে এমন কিছু হলেও চলবে।’
‘রওনা হয়ে গেল কিশোর ও রবিন।
আবারও-দরজা খুলে দিল মুসা। বেশ দূরে দাঁড়িয়েছে, সাপ ছোবল দিতে চাইলেই ছিটকে সরবে।
সাপের পাশে পড়ে আছে একটা বস্তা।
‘ওটার ভেতর সাপ রেখে এখানে পাচার করেছে,’ বলল মুসা। ‘মুখ খুলে দিয়েছে বস্তার। আর সুযোগ পেয়ে ওটা বেরিয়ে এসেছে।’
মুসার কথা শেষ হতে না হতেই মোবাইল হোমের কোনা ঘুরে বেরিয়ে এল রাসেল ভালদারেজ। খুশি-খুশি সুরে বলল, ‘হাই, মুসা। ভাল আছেন, মিস্টার শরীফ? কী করছেন?’
হাত তুলে চুপ করতে ইশারা করল ওমর। ‘সমস্যা আছে। পিছিয়ে দাঁড়াও।’
‘কী হয়েছে…’ বলতে শুরু করে থেমে গেল ভালদারেজ।
লেজের র্যাটল বা ঝুনঝুনি দিয়ে সর্-সর্-সর্-সর্ আওয়াজ তুলেছে আমেরিকার বিখ্যাত সাপ।
চোয়াল ঝুলে গেল ভালদারেজের। চাপা স্বরে বলল, ‘ঝাড়ু বা মপ আছে, মুসা? লম্বা হ্যাণ্ডেল আছে এমন কিছু…’
‘চেয়ে আনতে গেছে কিশোর আর রবিন,’ বলল মুসা। ‘দরজা থেকে দূরে থাকুন।’
‘আমি আগেও বহু সাপ ধরেছি,’ বলল আর্টিস্ট। ‘সরে যাও, আমি এদিকটা দেখছি।’
‘খুশি মনে,’ দরজা বন্ধ করে লাফ দিয়ে সিঁড়ি থেকে নেমে গেল মুসা। ‘ধরার পর দূরে নিয়ে গিয়ে ফেলতে হবে।’
তখনই কিশোর ও রবিনের সঙ্গে হাজির হলো লিলিয়ান। ওর দুই হাতে লম্বা ডাণ্ডাওয়ালা ঝাড় ও বড় একটা কাঠের চামচ।
‘জিনিস বুঝে নাও, মুসা,’ বলল কিশোর
ওদের ভিতর মুসা বুঝতে পারে নানা জন্তুর মেজাজ।
‘লিলিয়ান রান্না করছে, এমন সময় ওর কাছ থেকে অস্ত্র জোগাড় করে এনেছে কিশোর,’ বলল রবিন।
‘আমি সাপ সামলাতে পারি,’ বলল ভালদারেজ। লিলিয়ানের কাছ থেকে প্রায় জোর করেই ঝাড়ু নিল সে। ঘুরে দাঁড়াল দরজার দিকে।
‘রাসেল, এত ঝুঁকি নেবেন না,’ বলল রবিন। ‘ঝাড়ু দিয়ে দিন মুসার হাতে।’
কবাট খুলে ফেলল তরুণ, বিপজ্জনক সাপের দিকে চেয়ে হাসল। ‘হীরামানিক,’ আদরের সুরে ডাকল, ‘এরা তোমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে?’ ঝাড়ুর ডাণ্ডা শক্ত করে ধরে স্ট্রগুলো নামিয়ে দিল সাপের ওদিকে। ঝাড় দেয়ার ভঙ্গিতে সাপটাকে টেনে আনছে দরজার দিকে। কাছ থেকে শুনে মনে হলো দূরে ঝমঝম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঝুনঝুনি ভীষণ নাড়ছে সাপ, কিন্তু মেঝের ওপর ছেঁচড়ে যাওয়ার সময় ছোবল দিতে চাইল না।
‘সবাই পিছিয়ে যাও!’ সতর্ক করল ভালদারেজ। একবার দেখে নিল কেউ দরজার কাছে আছে কি না, তারপর দ্রুত হ্যাঁচকা টান দিল ঝাড়ুতে। দরজা পেরিয়ে থপ্ করে মাটিতে পড়ল সাপ। মুহূর্তে পাকিয়ে ফেলল কুণ্ডলী, বিপদ দেখলেই ছোবল দেবে। লেজের ডগা থেকে ঝমঝম আওয়াজ বেরুচ্ছে।
‘সুপের চামচের মত লম্বা ডাণ্ডাওয়ালা কিছু লাগবে,’ বলল ভালদারেজ। ‘তোমাদের কাছে এমন কিছু আছে? ….লিলিয়ান?’
কাঠের চামচ বাড়িয়ে দিল প্রফেসরের মেয়ে।
জিনিসটা নিল ভালদারেজ। আনন্দে চকচক করছে ওর চোখ। ‘এবার দেখো খেলা, বাড়িতে আবার এসব করতে যেয়ো না। এ কাজ প্রশিক্ষিত পেশাদার লোকের।’ সে ঝাড়ু দিয়ে খোঁচাতে শুরু করেছে সাপকে। ওটা ছোবল দিল স্ট্র-র উপর। তখনই ওটাকে ঠেলে সরিয়ে দিল ভালদারেজ। নিজে নিচু হয়ে দাঁড়িয়েছে, পরক্ষণে সাপের মাথার পিছনে দক্ষ হাতে চেপে ধরল চামচ। ওটা দিয়ে টিপে ধরেছে বলে ছাড়া পাচ্ছে না মাথাটা, মাটিতে কিলবিল করছে সাপ।
পিছন থেকে ওটার মাথা দুই আঙুলে টিপে ধরল ভালদারেজ, কিলবিলে প্রাণীটাকে খপ্ করে তুলে নিল উপরে। রাবারের মত শরীর দিয়ে তরুণের হাত পেঁচিয়ে ধরেছে র্যাটলস্নেক।
‘এবার দেখি রূপসীর ঝিকমিকে দাঁত,’ হাসি-হাসি সুরে বলল ভালদারেজ। ‘নিয়মিত দাঁত মাজতে ভুল হয় না তো?’
মোবাইল হোম থেকে বস্তা এনেছে মুসা, খুলে ধরল মুখটা। ভিরে ফেলুন।’
বস্তার ভিতর সাপ ছেড়ে দিল ভালদারেজ। বলল, ‘তোমাদের মনে হতে পারে সামান্য খেলা, কিন্তু আসলে মস্ত বিপজ্জনক সাপ ওটা। বহুবার এ জিনিস ধরেছি, জানি কী করতে হয়। কপাল ভাল যে তোমাদের কাউকে ছোবল দেয়নি।’
মাথা দোলাল ওমর শরীফ। ঝাড়ু ও চামচ তুলে লিলিয়ানের হাতে দিয়ে দিল।
‘আপনার লেকচারের জন্য ধন্যবাদ, ভালদারেজ,’ গম্ভীর মুখে বলল মুসা। ‘এবার অন্য প্রসঙ্গে আসি: যে সাপ রেখেছে, সে আমাদের জন্যে একটা চিঠিও দিয়েছে।’ হাত বাড়িয়ে মোবাইল হোমের মেঝে থেকে কাগজ তুলে নিল ও। উজ্জ্বল সবুজ কালিতে লেখা:
তিন গোয়েন্দা, বাঁচতে চাইলে ভাগো এখান থেকে!
‘আমরা এই ক্যাম্পে আছি বলে কেউ খুব অখুশি,’ নোট পড়ে বলল কিশোর।
চুন হয়ে গেছে লিলিয়ানের মুখ। ‘কেউ… এমন করতে পারে? …বিশ্বাস করতে পারছি না!’
মুসার কাছ থেকে সাপের বস্তা নিল ওমর। ‘ফেলে আসি মরুভূমিতে। কিন্তু আগে রিপোর্ট করব রেঞ্জার অফিসে। টাইট করে বস্তার ফিতা বাঁধল ও। গাড়ির দিকে পা বাড়িয়ে বলল, ‘পনেরো মিনিটের ভেতর ফিরছি।
গাড়ি নিয়ে রওনা হয়ে গেল ওমর।
‘তোমাদের মোবাইল হোমে কে পারে র্যাটলস্নেক রাখতে?’ বলল লিলিয়ান।
‘তুমি বুঝি জানো না?’ টিটকারির ভঙ্গিতে বলল ভালদারেজ।
কথার সুর শুনে রাগে লাল হয়ে গেল লিলিয়ানের দু’গাল। ‘আপনি কি বলতে চাইছেন আমিই ওটা রেখেছি?’
‘তোমাকেই করতে হবে কেন,’ বলল ভালদারেজ। ‘তোমার বাবা যে কিশোর-মুসা-রবিনকে খুব পছন্দ করেন, তা তো নয়।’
বিস্ফারিত হলো মেয়েটার চোখ, কয়েক মুহূর্ত পর তোতলাতে শুরু করে বলল, ‘ভাবতে পারছি না এসব বলা হবে আমাকে!’ ঝট্ করে ঘুরেই রওনা হয়ে গেল নিজেদের মোবাইল হোমের উদ্দেশে।
হেসে ফেলল ভালদারেজ। ‘আমি বোধহয় কূটনীতিকদের মত করে ভদ্র ভাষায় বলতে পারিনি ওকে।’
‘সাপ ধরে দেয়ায় ধন্যবাদ,’ বলল কিশোর। ‘আপাতত অন্য কাজ আছে আমাদের, পরে আপনার সঙ্গে আলাপ করব। …এখন বোধহয় বাড়ি ফিরছেন?’
‘কিন্তু…’ আপত্তি তুলল ভালদারেজ।
তাকে কোনও সুযোগ না দিয়েই থামিয়ে দিল কিশোর, ‘আজকের মত যথেষ্ট উত্তেজনা হয়েছে। তা ছাড়া আমাদের কাজ আছে।’
‘কী ধরনের কাজ?’ আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল ভালদারেজ।
‘দেখুন ভাই,’ এবার বলল মুসা, ‘আপনি যান। একটু পর সূর্য থাকবে না, তার আগেই আপনার ক্যামেরা দিয়ে তুলে ফেলুন ওই ক্যাকটাসের গোটা বিশেক ছবি।’
‘সকালে আপনার সঙ্গে কথা হবে,’ বলল কিশোর।
সন্দেহ নিয়ে ওদের দিকে চাইল ভালদারেজ। কেউ কিছু বলছে না দেখে শেষে হতাশ হয়ে কাঁধ ঝাঁকাল। ‘দেখা যাক আবারও কোনও বিপদে তোমাদের সাহায্যে আসি কি না। …একটা কথা মনে রেখো, সাপ, মরুভূমির সবচেয়ে বিপজ্জনক জানোয়ার নয়। সবচেয়ে বিপজ্জনক মানুষ। আজ রাতে চোখ খোলা রেখো। হয়তো চিনে ফেলতে পারবে মরুদস্যুদেরকে।’
‘এত চমৎকার পরামর্শের জন্যে ধন্যবাদ,’ বলল মুসা।
ভালদারেজ হতাশ হয়ে চলে যাওয়ার পর বলল রবিন, ‘যে আমাদের পিছনে লেগেছে, সে জানে না আমরা হাল ছাড়ি না।’
‘সুযোগ পেলে দেরি না করে অনুসরণ করব ওয়াইলি, প্রফেসর, ভালদারেজ বা ওই হলদে ভ্যানের লোকগুলোকে,’ দৃঢ় স্বরে বলল কিশোর। ‘দরকার পড়লে কাজ ভাগ করে নিয়ে তিনদিকে যাব।’
‘আরেকটা কথা,’ বলল রবিন, ‘তোমরা জানো কার কথা বলছি, তার ওপর নজর রাখা দরকার।’ ইশারায় প্রফেসরের মোবাইল হোমের দিক দেখিয়ে দিল। ‘ওমর ভাই ফিরলেই ওঁকে রাজি করিয়ে চলে যেতে পারি প্রফেসরের ওই পাহাড়ে।’
‘ওমর ভাই হয়তো পৌঁছে দেবেন মরুভূমিতে,’ বলল মুসা, ‘আর উঁচু ক্লিফ থেকে পরিষ্কার দেখব আমরা পুরো এলাকা। হয়তো চোখে পড়বে দস্যুদের কুকীর্তি।’
‘সঙ্গে করে সিবি রেডিয়ো নেব,’ বলল রবিন।
সামান্য ভেবে নিয়ে বলল কিশোর, ‘গুড! সেক্ষেত্রে এসো গুছিয়ে ফেলি সব গিয়ার।’
‘স্লিপিং ব্যাগ তো লাগবেই, আর লাগবে যথেষ্ট খাবার,’ বলল মুসা।
দেরি না করেই মোবাইল হোমে গিয়ে উঠল ওরা।
কিশোর-রবিন নিল পাকানো ক্লাইমিং রোপ, ট্রেইলার থেকে নেমে বিছিয়ে দিল মাটিতে। তখনই শুনল, লিলিয়ানদের ট্রেইলারে রাগারাগী করছেন প্রফেসর।
কিশোর বুঝল: মেয়েটাকে ভালদারেজ না-খোঁচালেই ভাল হতো। প্রফেসরই সাপ রেখেছেন বলা খুবই অনুচিত হয়েছে। বাবাকে এসব বলেছে লিলিয়ান, ফলে লেগে গেছে ঝগড়া।
পরে লিলির কাছে সবার হয়ে ক্ষমা চেয়ে নেব, ভাবল কিশোর। দূরের ক্যাম্পে দেখতে পেল ভালদারেজকে। প্রফেসরের মোবাইল হোমের দিকে চেয়ে আছে সে। বোধহয় শুনতে পেয়েছে রাগী লোকটার উত্তপ্ত কণ্ঠ
তখনই জোরালো শব্দে দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন প্রফেসর, সিঁড়ি বেয়ে নেমে চলে গেলেন টয়লেট লক্ষ্য করে।
একমিনিট পেরুলো না, তার আগেই প্রায় নাচতে নাচতে আবারও ফিরল রাসেল ভালদারেজ। দুই চোখ কপালে তুলল ক্লাইমার গিয়ার ও স্লিপিং ব্যাগ দেখে।
‘তোমরা পাহাড়ে উঠবে? …আমার এই জীবনে কম করিনি, কিন্তু কখনও শিখতে পারিনি পাহাড়ে ওঠা। আমাকে শিখিয়ে দেবে? চুপচাপ শিখব, বিরক্ত করব না।’
‘পরে কখনও,’ নীরস সুরে বলল রবিন।
চুপ করে থাকল কিশোর।
নিজেদের মোবাইল হোম থেকে উঁকি দিল লিলিয়ান। যেই দেখল ভালদারেজকে; ধুপ্ করে বন্ধ করে দিল দরজা।
ওই মেয়ে আর কখনও আমাদের সঙ্গে কথা বলবে? –ভাবল কিশোর।
সরছে না ভালদারেজ।
‘বিকেলে বা সন্ধ্যায় পাহাড়ে ওঠা খুবই বিপজ্জনক,’ বলল কিশোর। ‘একটু পর রওনা হবো। তার আগে সব গুছিয়ে নিতে হবে। কালকে সকালে দেখা হবে। গুড নাইট, ভালদারেজ।’
উঠে পড়ল ও, হাতের ইশারা করল রবিনকে।
দু’জন গিয়ে উঠল মোবাইল হোমে।
কিচেনে খাবার গুছিয়ে নিচ্ছে মুসা। বন্ধুদের দেখে বলল, ‘ভাল কিছু নেই, কিন্তু পেট ভরবে এমন জিনিস নিচ্ছি।’
‘ভালদারেজ সঙ্গে যেতে চায়, ক্লাইমিং শিখবে,’ বলল রবিন।
‘খাইছে! ব্যাটা তো সত্যিকারের শুয়োপোকা!’ ভুরু কুঁচকে ফেলল মুসা। ‘জঘন্য, বিরক্তিকর প্রাণী!’
‘মনে হলো লিলিয়ান কিছু বলতে চেয়েছিল, কিন্তু সরে গেছে ভালদারেজকে দেখে,’ বলল কিশোর।
‘কে জানে, হয়তো ভালদারেজের ব্যাপারেই কিছু বলবে,’ কাঁধ ঝাঁকাল মুসা।
‘অথবা বাবার ধমক এড়াতে চেয়েছে,’ বলল কিশোর, ‘রবিন, দেখো তো ওদিকে আছে কি না মেয়েটা।’
দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকি দিল রবিন।
ক্লাইমিং রোপগুলোর উপর ঝুঁকে কী যেন দেখছেন প্রফেসর।
‘আপনার জন্যে কী করতে পারি, স্যর?’ প্রশ্ন করল রবিন।
ওর কথা শুনে চমকে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন প্রফেসর, রাগের ছাপ পড়ল চেহারায়। ‘শুনলাম তোমরা আমার মেয়ের কাছে জঘন্য সব মিথ্যা বলছ! তোমাদের মোবাইল হোমে র্যাটলকে রেখেছি আমি? …এসব ডাহা মিথ্যার অর্থ কী?’
‘আমরা কিছুই বলিনি, স্যর,’ নরম সুরে বলল রবিন, সতর্ক। ‘তবে তখন এখানে আরেকজন ছিল, সে বলেছে। অবশ্য ওসব দিয়ে কী বোঝাতে চেয়েছে, আমরা তা জানি না।’
‘একটা কথা মন দিয়ে শুনে নাও, ছোকরা,’ বললেন আর্নল্ড। ‘আমার মেয়ে আর আমি বিজ্ঞানী, ফালতু লোক নই যে খুশিমত ফাজলামো করবে। তোমাদের কোনও ঝামেলার ভেতর জড়াবার সময়ও নেই আমাদের। … তুমি কি পরিষ্কারভাবে বুঝতে পেরেছ কী বলেছি?’
রবিন কিছু বলবার আগেই ক্যাম্প সাইটে এসে পৌঁছুল ওমর শরীফের গাড়ি। পিছনে পিছনে এল ফিলিপ রায়ানের জিপ।
‘মনে রেখো কী বলেছি,’ বেচারা রবিনকে আবারও ধমকের সুরে বললেন প্রফেসর। দেরি না করে পাশ কাটালেন ওমর ও ফিলিপকে, সামান্যতম নড না করেই হন হন করে চলে গেলেন নিজ ক্যাম্পে।
‘আবার কী হলো?’ গাড়ি থেকে নামল ওমর শরীফ।
‘প্রফেসর জানালেন, কেউ মিথ্যা অভিযোগ করলে তা খুবই অপছন্দ করেন তিনি,’ বলল রবিন। চিন্তিত হয়ে পড়েছে ও।
মোবাইল হোম থেকে নেমে এসেছে কিশোর, সবই শুনেছে। বুঝতে পারছে, যখন এসেছে রেঞ্জার রায়ান, জানতে চাইবে কেন ওরা বের করেছে ক্লাইমিং ইকুইপমেন্ট। ব্যাখ্যা দিতে গেলে অনেক সময় লাগবে। তার চেয়ে বড় কথা, বাগড়া দিতে পারে রেঞ্জার।
‘ভদ্রলোক আসলে কী বোঝাতে চাইলেন?’ গাড়ি থেকে নেমেই সামনের মাটিতে চোখ পড়ল ফিলিপ রায়ানের। ‘আরে, এসব দড়ি আর ইকুইপমেণ্ট কীজন্যে?’ সন্দেহ নিয়ে কিশোর-রবিনকে দেখল সে। ‘যা ভাবছি তাই করতে চাও নাকি তোমরা?’
‘তেমন কিছুই না,’ চাপা শ্বাস ফেলল কিশোর।
গলা নিচু করল ফিলিপ রায়ান: ‘ভুলে যেয়ো না তদন্তের দায়িত্ব আমার। আর আমি চাই না ডাকাতের কবলে পড়ে কেউ আহত বা নিহত হোক। …খুলে বলো তো কী করতে চাও।’
মিথ্যা বলতে চাইল না কিশোর, দু’চার কথায় সারল।
মরুভূমির মেঝে থেকে নয়, পাহাড় থেকে চোখ রাখবে ডাকাতের উপর। এখনই রওনা হলে ভাল জায়গা বেছে নিতে পারবে, বিপদও হবে না কোনও।
‘কিশোর-রবিন, একটু সাহায্য করো,’ ট্রেইলার থেকে গলা ছাড়ল মুসা। অন্য দু’জন মোবাইল হোমে উঠে আসতেই বলল ও, ‘যদি যেতে হয়, এখনই। নইলে রাতের আঁধারে পাহাড়ে উঠতে পারব না।’
ওরা কী করছে দেখবার জন্য উঠে এসেছে ওমর শরীফ।
‘ওমর ভাই, আঁধার নামার আগেই পাহাড়ে উঠতে হবে, আপনার সহায়তা দরকার,’ নিচু স্বরে বলল কিশোর।
আস্তে করে মাথা দোলাল বৈমানিক, নেমে গেল ট্রেইলার থেকে। দরজা-জানালা থেকে বাইরে চাইল তিন গোয়েন্দা।
‘বুঝলে, ফিলিপ,’ উঠানে বন্ধুর উদ্দেশে বলল ওমর, ‘তিন গোয়েন্দা কিন্তু খুবই দক্ষ ক্লাইমার। তার চেয়েও বড় কথা, ওরা জানে কী করা উচিত। আর তাই ভাবছি যেখানে যেতে চায় পৌঁছে দেব ওদেরকে। এতে খারাপ কিছুই হবে না, বড়জোর রাতে ঠাণ্ডা লাগিয়ে হাঁচি মারতে মারতে ক্যাম্পে ফিরবে।’
দরজায় কিশোরকে দেখে মাথা দোলাল ফিলিপ রায়ান। কয়েক মুহূর্ত পর কাঁধ ঝাঁকাল। ‘বেশ, তবে খুব সতর্ক থাকবে। তোমরা পাহাড় থেকে পড়ে আহত হলে সে দায় আমি নেব না।’
‘ভাববেন না,’ বলল কিশোর, ‘নিরাপদেই পাহাড়ে উঠব-নামব।’
ফিলিপ রায়ান চলে যাওয়ায় পরের দশ মিনিট গাড়ির ট্রাঙ্কে ইকুইপমেণ্ট, দড়ি ও অন্যান্য জিনিস তুলল ওরা। সবার পর গাড়িতে উঠতে যেতেই কিশোর দেখল, ওদের মোবাইল হোমের দিকে আসছে লিলিয়ান।
অবশ্য কয়েক সেকেণ্ড পর মেয়েটা বুঝল ওরা বাইরে যাচ্ছে। আবারও নিজেদের ট্রেইলারে ফিরল লিলিয়ান।
রবিন ও মুসার দিকে চাইল কিশোর।
ওরাও মেয়েটার অস্বাভাবিক আচরণ খেয়াল করেছে।
গাড়ির ইঞ্জিন চালু করেছে ওমর, পিছন সিটে উঠল কিশোর।
‘সিবি রেডিয়োতে কোন্ চ্যানেল সেট করব?’ জানতে চাইল মুসা। ‘ফাইভ?’
কাঁধ ঝাঁকাল ওমর। ‘যেটা তোমাদের ইচ্ছে। আমি মোবাইল হোমেই থাকব, যে-কোনও সময়ে যোগাযোগ করতে পারবে।’
‘আর তাই আমাদের দুশ্চিন্তাও নেই,’ বলল রবিন।
‘কথা হবে পাঁচ নম্বর চ্যানেলে,’ বলল মুসা, ‘আর চ্যানেল দশে গতকাল যারা কথা বলেছে, তাদের চ্যানেলেও কান পাতব।’ ওয়াকি- টকির ডায়াল অ্যাডজাস্ট করে নিল ও।
‘যদি সন্দেহজনক কিছু দেখি, আলাপ করব ওমর ভাইয়ের সঙ্গে; তিনি আবার যোগাযোগ করবেন ফিলিপ রায়ানের সঙ্গে— এই তো?’ জানতে চাইল রবিন।
জবাব দিল না কেউ।
‘আমি ভাবছি লিলিয়ান কী বলতে চেয়েছিল,’ বলল কিশোর।
‘হয়তো গোপনে কিছু জানাতে চেয়েছে,’ বলল মুসা।
পনেরো মিনিট পর নির্দিষ্ট পাহাড়ের পায়ের কাছে গাড়ি রাখল ওমর শরীফ। শুধু বলল, ‘সাবধানে থেকো।’
‘জী, ওমর ভাই,’ বলল রবিন।
‘চিন্তা করবেন না,’ বলল মুসা।
আস্তে করে মাথা দোলাল কিশোর।
ওরা রওনা হবে সেজন্য অপেক্ষা করল ওমর শরীফ।
কিশোর-মুসা-রবিন তুলে নিল নিজেদের ব্যাগ। ওটার ভিতর রয়েছে খাবার, পানি, বাড়তি সোয়েটার ও টুকটাক বহুকিছু। কাঁধে ঝুলিয়ে নিল ক্লাইমিং গিয়ার, রওনা হয়ে গেল ক্লিফ লক্ষ্য করে। পিছন থেকে বলল ওমর শরীফ, ‘সকালে দেখা হবে!’
ঘুরে চাইল তিন গোয়েন্দা।
রওনা হয়ে গেল ওমর, একটু পর আর দেখা গেল না গাড়িটা।
হঠাৎ এই মরুভূমি অনেক নির্জন, নিঝুম ও নীরব লাগল কিশোর- মুসা-রবিনের কাছে।
‘চলো ওঠা যাক,’ বলল রবিন। ওদের ভেতর সেরা পর্বতারোহী ও।
কিছুক্ষণের ভিতর খাড়া ক্লিফের সামনে পৌঁছে গেল ওরা।
‘পানির মত সহজ কাজ,’ বলল মুসা।
‘হয়তো তোমার কাছে, আমার কাছে নয়,’ বলল কিশোর।
ঠিকভাবে পা ও কোমরে ক্লাইমিং হার্নেস আটকে নিল রবিন ও মুসা, বেয়ে উঠতে লাগল দেয়ালের মত খাড়া পাহাড়। উঠবার সময় হার্নেসের সঙ্গে দড়ি আটকে নিচ্ছে ওরা। যদি কোনও কারণে পা পিছলায়, ওই দড়ি ওজন নেবে ওদের।
প্রথমে উঠে চলেছে রবিন।
নীচে মুসা।
মরুভূমির মাটিতে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর। বেলেয়ারের কাজ ওর। ধীরে ধীরে ছাড়বে দড়ি।
মুসা থেকে ছয় ফুট উপরে রবিন। গিয়ার থেকে একটা গোঁজ নিল, পাথরের ভাঁজে ভালমত গেঁথে নিল। খাড়া ক্লিফের বুকে নোঙরের কাজ করবে ওই চোক, আটকে রাখবে ক্লাইমিং রোপ। ওরা পড়তে শুরু করলে সঙ্গে সঙ্গে থামিয়ে দেবে পতন।
পাহাড়ের বুকে চোক গুঁজে দেয়ার পর ডি শেপের রিঙের ভিতর দিয়ে দড়ি ঘুরিয়ে এনেছে রবিন। ওই ক্যারাবিন বা রুপালি রিং ঝুলছে চোক থেকে, ওটা উঠবে পর্বতারোহীর সঙ্গে। প্রতি পাঁচ বা ছয় ফুট উঠে একটা করে চোক ব্যবহার করে দড়ি স্থির রাখছে রবিন।
ছয় ফুট নীচে মুসা।
মাটিতে দাঁড়িয়ে দড়ি ছাড়া খুব জরুরি, নইলে দড়ি পাবে না উপরের ওরা। আবার যদি উপর থেকে পড়তে শুরু করে, ওই দড়ি শক্ত হাতে ধরে পতন ঠেকাবে কিশোর। ধৈর্য ধরে উপরে চেয়ে আছে ও।
‘
সরু, ছোট সব ফাটল ও সামান্য বেরিয়ে থাকা পাথর ব্যবহার করে ধীরে ধীরে উঠছে রবিন ও মুসা।
নীচ থেকে কিশোরের মনে হচ্ছে খাড়া দেয়াল বেয়ে টিকটিকির মত উঠছে ওর দুই বন্ধু। কিন্তু আসলে ও জানে, নিজে যখন উঠবে, দেখবে পেয়ে গেছে ধরার মত জায়গা।
দিগন্তের দিকে নামছে সূর্য।
চিন্তিত হয়ে পড়ল কিশোর।
যা ভেবেছে, তার চেয়ে অনেক দ্রুত আঁধার ঘনিয়ে আসছে।
‘রাত নেমে গেলে বিপদে পড়ব,’ নীচ থেকে বলল কিশোর।
চুপচাপ উঠছে রবিন।
মুসা পৌঁছে গেছে একটা চওড়া তাকে।
ডুবতে থাকা সূর্যের দিকে তাকাল ওরা।
ভাবছে কতক্ষণে উঠবে পাহাড়ের চূড়ায়।
আর বড়জোর তিরিশ ফুট, ভাবল রবিন। উপর থেকে বলল, ‘আলো থাকবে, সমস্যা হবে না, একটু পরে উঠে পড়ব চূড়ার ওপর।’
‘আমি উঠে গেলেই আসবে, কিশোর,’ জানাল মুসা।
কিছুক্ষণ পর পাহাড়ের মাথায় উঠে পড়ল রবিন।
বড় এক বোল্ডারকে পেঁচিয়ে দড়ি বাঁধল।
তার কয়েক সেকেণ্ড পর উঠে এল মুসা।
‘কিশোর,’ ডাক দিল রবিন। ‘এবার তুমি!’
পাথরের ফাটলে পা রেখে দুই হাত ব্যবহার করে উঠতে শুরু করল কিশোর। উঠবার সময় রবিনের গুঁজে দেয়া চোকগুলো ছুটিয়ে নিয়ে রেখে দিচ্ছে ইকুইপমেন্ট স্লিঙে। জানা আছে, চোকের নিরাপত্তা ওর লাগবে না। রবিন ও মুসা মিলে এখন ধরে রাখবে দড়ি। আর সকালে বড় কোনও পাথরে দড়ি বেঁধে ঝুলতে ঝুলতে নেমে যাবে ওরা।
দিগন্তের ওপাশে টুপ করে ডুবে গেছে সূর্য।
আকাশে লালচে আলো।
উঠবার গতি বাড়ল কিশোরের।
কিছুক্ষণ পর পৌছে গেল পাহাড়ের পেটের কাছে।
‘ব্যাগ থেকে ফ্ল্যাশলাইট বের করে নাও,’ বন্ধুদের উদ্দেশে বলল কিশোর। ‘আমি উঠে আসতে আসতে সব আঁধার হয়ে যাবে।’
‘ঠিকাছে, ভেবো না,’ চেঁচাল মুসা। ‘সাবধানে উঠে এসো!’
ঝুঁকে কিশোরকে দেখছে রবিন ও মুসা।
বেশ দ্রুত উঠছে কিশোর। থামল একটা তাকে।
এ সুযোগে ফ্ল্যাশলাইট বের করে ফেলল মুসা ও রবিন।
ওদের মত করে বিশ্রাম নিতে থামেনি কিশোর। ঘনিয়ে আসছে রাতের আঁধার। এদিকে ব্যথা হয়ে উঠেছে ওর হাতদুটো।
চূড়া এখনও তিরিশ ফুট।
নীচ থেকে বলল কিশোর, ‘শক্ত করে টেনে ধরো দড়ি, ব্যথা হয়ে গেছে আমার আঙুল। বিশ্রাম নেব।’
রবিন ও মুসা মিলে টানটান করল দড়ি, এখন বিপদ হবে না কিশোরের। ঝুলবে দেয়ালের মত খাড়া ক্লিফের বুকে।
কিছুক্ষণ পেরুল, তারপর বলল কিশোর, ‘হাঁফ ধরে গেছে। এরপর নিয়মিত জগিং করব, রকি বিচে ফিরেই প্রতি ভোরে…
বক্তব্য শেষ করতে পারল না কিশোর, হাঁ হয়ে গেল ওর মুখ।
হঠাৎই সব বুঝতে পেরেছে।
পট্ করে ছিঁড়ে গেছে দড়ি!
সতর্ক হওয়ার সুযোগই নেই, আঁধারে খসে পড়তে শুরু করেছে কিশোর অনেক উপর থেকে!