মরুদস্যু – ৪

চার

‘কিশোর-রবিন, জলদি!’ ঝট্ করে গাড়ির দরজা খুলেই ছুট দিল মুসা।

গাড়ি থেকে নেমে পড়ল কিশোর-রবিন, পিছু নিল বন্ধুর।

সবার আগে পৌছল মুসা, ধাক্কা দিয়ে খুলল অফিসের দরজা।

চওড়া কবাট সরে যেতেই ভিতর অংশ দেখা গেল।

একহাতে রেঞ্জার ফিলিপ রায়ানের কলার পেঁচিয়ে ধরেছে ডোনাল্ড ওয়াইলি, মনিবকে ঠেসে ধরেছে পিছন-দেয়ালে। বামহাতে ঘুষি তুলেছে, এবার ভচকে দেবে রায়ানের নাক।

আরও খারাপ কিছু ঘটতে পারে ভেবে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়ল কিশোর-মুসা-রবিন।

মুখ ঘুরিয়ে ওদেরকে দেখল ওয়াইলি, কয়েক সেকেণ্ড পর আস্তে করে কলার থেকে সরিয়ে নিল হাত। মুঠো করা বামহাত নামাল। বুঝতে শুরু করেছে মস্ত ভুল হয়ে গেছে!

‘কী করছিলেন, মিস্টার ওয়াইলি?’ জানতে চাইল মুসা।

ডেস্কের পিছনে নিজের চেয়ারে বসে পড়ল ফিলিপ রায়ান, মুখ ফ্যাকাসে।

অস্বস্তি নিয়ে কী যেন ভাবছে ডোনাল্ড ওয়াইলি।

কোঁচকানো পোশাক ঠিক করে নিতে চাইল হেড রেঞ্জার। আড়ষ্ট স্বরে বলল, ‘মনে করি না আরও ঝামেলা হবে। কারও ক্ষতিও হয়নি। মিস্টার ওয়াইলি আর আমার ভেতর সামান্য ঝগড়া হয়েছে। ঠিক, ওয়াইলি?’ ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ফিলিপ। কিশোর-মুসা-রবিন, তোমরা কিছুক্ষণের জন্য বাইরে যাবে?’ হাতের ইশারায় দরজা দেখাল সে।

উঠানে বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা।

পিছনে ভিড়িয়ে দিয়েছে অফিসের দরজা।

‘ব্যাপারটা কী হলো?’ বিরক্ত হয়ে বলল মুসা।

বিড়বিড় করল রবিন, ‘কে জানে!’

‘বিকেলে মরুভূমিতে যা ঘটল, এসব বোধহয় তারই প্রতিক্রিয়া,’ নিচু স্বরে বলল কিশোর।

অফিস থেকে ভেসে এল আরেকটা বুনো চিৎকার।

ব্যাপারটা ঝগড়া নাকি তুমুল মারামারি, নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই। আবারও অফিসে গিয়ে ঢুকবে কি না, ভাবছে তিন গোয়েন্দা।

ঠিক তখনই দড়াম করে খুলে গেল কবাট, ঝড়ের বেগে বেরুল ডোনাল্ড ওয়াইলি। ঘাড় ঘুরিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আপনি ভাল করেই জানেন আমি কী বলেছি!’

থামল না সে, গটমট করে গিয়ে উঠল নীল পিকআপে। ইঞ্জিন চালু করে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে রওনা হয়ে গেল। সিমেন্টে পিছলে গেল ঘুরন্ত চাকাগুলো। দেখতে না দেখতে আঁধারে মিশে গেল নীল পিকআপ। হারিয়ে গেল ইঞ্জিনের আওয়াজ।

জানালায় দেখা গেল ডেস্কের পিছনে হেড রেঞ্জার ফিলিপ রায়ান। কয়েক মুহূর্ত পর তিন গোয়েন্দা অফিসে ঢুকতেই নির্বিকার চোখে ওদেরকে দেখল সে। বলল, ‘তখন একেবারে ঠিক সময়ে এসেছিলে। আমার কপাল ভাল, নইলে হাতাহাতির ভেতর জড়িয়ে যেতাম।’ ডানহাতে ঘাম মুছল ভুরু থেকে।

‘আসলে কী হয়েছিল?’ জানতে চাইল মুসা।

জবাবে ফিলিপ জানাল, মরুভূমিতে ডোনাল্ড ওয়াইলি দায়িত্ব- জ্ঞানহীন ভাবে ড্রাইভ করেছে, এ কথা বলতেই তেড়ে এসেছিল সে।

‘তখন কোদালের কথা তোলেন আপনি?’ জানতে চাইল কিশোর।

‘হ্যাঁ,’ আস্তে করে মাথা দোলাল ফিলিপ। আর যেই বললাম, ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর। …তোমরা অফিস থেকে যেতেই আবারও ওর সঙ্গে আলাপ করতে চাইলাম। তখনও কোদাল নিয়ে কথা উঠল। আর অমনি মাথা গরম করে ইস্তফা দিয়ে দিল চাকরিতে!’

‘‘‘আপনি ভাল করেই জানেন আমি কী বলেছি!” এ কথাটা বুঝে বলেছে সে?’ বলল কিশোর।

‘যদি জানতাম কী বলেছে,’ আফসোস করে মাথা নাড়ল ফিলিপ রায়ান। ‘ব্যাপারটা আমার কাছে কঠিন শব্দ-ফাঁদের মত লাগছে। প্রথমে বিপজ্জনক ড্রাইভিং নিয়ে কথা বললাম, তারপর কোদাল নিয়ে যে মুহূর্তে কোদালের কথা উঠল, অমনি ফাঁৎ করে জ্বলে উঠল।’

‘অদ্ভুত! এসবের মানে কী?’ বলল মুসা।

‘আমিও জানি না,’ বলল ফিলিপ রায়ান। ‘যাই হোক, মন ছোট হয়ে গেছে, এখন আর কোথাও যেতে চাই না। তোমরা কিছু মনে না করলে আজ আর তোমাদের আমন্ত্রণে যাব না।’

‘বেশ, আজ না-ই গেলেন, সমস্যা নেই,’ বলল কিশোর। ‘ওমর ভাইও বুঝবেন।’

‘আর এতক্ষণে ওমর ভাই মুসার হটডগ আগুন থেকে না নামালে ওগুলো পুড়ে ছাই হয়ে গেছে,’ বলল রবিন।

‘অথবা ওগুলো এখন বরফ-ঠাণ্ডা,’ বলল মুসা। ‘তাতে কী, মোবাইল হোমে মাইক্রোওয়েভ আভেন আছে। আবারও খাবার গরম করে নেব নিউক্লিয়ার বাক্সের গুণে।’

‘গুড, ভেরি গুড,’ বলল ফিলিপ, ‘কিন্তু আজ আর কোথাও যাব না। কালকে অফিসে চলে এসো ওমরকে নিয়ে। তোমাদের জন্য তৈরি রাখব ম্যাপ। ওটা থাকলে সহজেই বুঝবে পার্কের কোথায় হাইকিং বা ক্লাইমিঙের সুবিধা পাবে।’

রেঞ্জারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা।

ক্যাম্প সাইটের দিকে রওনা হয়ে কিশোর বলল, ‘আমার ধারণা ফিলিপ রায়ানকে আমাদের যতটা দরকার, তার চেয়ে অনেক বেশি দরকার ওঁর আমাদেরকে।’

‘আমারও তাই ধারণা,’ বলল মুসা।

‘কিন্তু ডোনাল্ড ওয়াইলির ব্যাপারে কী করবে?’ বলল রবিন, ‘লোকটা তো চাকরি ছেড়ে দিল। এখন আর চোখে চোখে রাখতে পারব না।’

‘আগেও পারিনি, কাজটা আরও কঠিন হলো— এই যা,’ বলল কিশোর।

ক্যাম্প সাইটে পৌঁছে মোবাইল হোমের পিছনে গাড়ি রাখল মুসা।

তখনই রবিন বলল, ‘একটু পিছিয়ে যাও, মুসা। বামে সরে হেডলাইট ফেলো।’ প্রফেসর জর্জ আর্নল্ডের পিকআপ দেখাল ও।

পিছিয়ে সামান্য বাঁক নিয়ে গাড়ি রাখল মুসা।

হেডলাইটের আলো পড়ল পাশের ক্যাম্প সাইটে।

‘ব্যস, আলো এখানেই রাখো!’ বলল রবিন।

জ্বলজ্বলে আলোয় দেখা গেল প্রফেসরের পিকআপের নীচে দুই ফুট দৈর্ঘ্যের কাঠের তক্তার মত কী যেন।

গাড়ি থেকে নেমে পড়ল মুসা। কয়েক পা যেতেই পরিষ্কার বুঝল, ওটা আসলে ভাঙা এক অর্গান পাইপ ক্যাকটাসের ডাল।

দ্রুত পিকআপের কাছে চলে গেল মুসা। কাঁটার খোঁচা এড়িয়ে সাবধানে গাড়ির নীচ থেকে বের করে আনতে চাইল ডালটা।

আর ওমনিই পিকআপের পাশের মোবাইল হোমের দরজা থেকে এল গম্ভীর কণ্ঠ, ‘অ্যাই ছেলে! এখানে কী!

সোজা হয়ে দাঁড়াবার ফাঁকে ভাবল মুসা, ওই বাঘের মত গলা প্রফেসর আর্নল্ডের!

‘সরি, স্যর,’ নরম স্বরে বলল ও, ‘বিরক্ত করতে চাইনি। কিন্তু আপনার পিকআপের নীচে এক টুকরো ক্যাকটাস। ওটা বের করে আনছিলাম।’

‘কী বলতে চাও, ছেলে! কীসের ক্যাকটাস!’ এবার সিংহের মত গরগর করে উঠলেন প্রফেসর। মোবাইল হোমের সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন মাটিতে। লম্বা লোক, মাথার চুলগুলো ধূসর, ঝুঁকে আছে দুই কাঁধ, জোরালো আলোয় কুঁচকে রেখেছেন চোখ। ‘আমার পিকআপের নীচে ক্যাকটাস? তাতে এত আগ্রহী কেন তুমি?’ গাড়ির পিছনে চলে এলেন তিনি, এক সেকেণ্ড পর টের পেলেন মুসা কী দেখেছে। আড়ষ্ট হয়ে গেলেন প্রফেসর। নিচু স্বরে বললেন, ‘দেখো ছেলে, অন্যের ব্যাপারে নাক গলাতে এসো না!’

‘কিন্তু স্যর, আপনি তো জানেন, আইন অনুযায়ী…’

‘আমি কিন্তু তোমাকে একবার বলেছি— খামোকা ঝামেলা করছ, ‘ বললেন প্রফেসর, ‘আবারও বলছি, ভুলেও নাক গলাবে না অন্যের বিষয়ে।’

প্রফেসর আর্নল্ডের মোবাইল হোমের দরজা খুলে গেল, ওখানে এসে দাঁড়িয়েছে সুন্দরী এক কিশোরী মেয়ে। বয়স চোদ্দ মত হবে। লম্বা কালো চুলগুলো হাঁটুর পিছনে ঝুলছে। ‘বাবা?’ মিষ্টি স্বরে বলল, ‘কী হয়েছে?’

‘কিছুই না, লিলি,’ বললেন প্রফেসর। ‘ঝামেলা দূর করছি, ভেতরে যাও।’ ঘুরে মুসার দিকে চাইলেন তিনি। ‘যেখান থেকে এসেছ, তোমার কিন্তু সেখানেই ফেরা উচিত।’

‘আমি আপনার পাশের ক্যাম্পে এসেছি,’ বলল মুসা। ‘নাম মুসা আমান। আমরা তিন বন্ধু এবং এক সিনিয়র বন্ধু এখন আপনার প্রতিবেশী। আপনিই তো প্রফেসর জর্জ আর্নল্ড?’

ভদ্রলোকের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল মুসা।

কিন্তু হ্যাণ্ডশেক করলেন না তিনি। জানতে চাইলেন, ‘কীভাবে জানলে আমার নাম?’

গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে কিশোর ও রবিন।

ওরা থামল মুসার পাশে।

‘এক ভদ্রলোকের কাছ থেকে জেনেছি আপনার নাম,’ বলল কিশোর। ‘প্রতিবেশীদের সম্পর্কে জানা ভাল।’

‘তোমরা আবার কারা?’ ভুরু কুঁচকালেন প্রফেসর।

‘ওরা কিশোর পাশা আর রবিন মিলফোর্ড,’ বলল মুসা। ‘আমরা ঘনিষ্ঠ বন্ধু।’

কিশোর হ্যাণ্ডশেক করবার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল।

কিন্তু অবহেলার সঙ্গে হাতটা প্রত্যাখ্যান করলেন প্রফেসর।

‘আমার ভুল না হয়ে থাকলে আপনার গাড়ির নীচে ওটা অর্গান পাইপ ক্যাকটাস, ঠিক?’ বলল কিশোর।

‘এখনও জানি না ওটা কী,’ বললেন আর্নল্ড। ‘যাই হোক, এখান থেকে সরিয়ে ফেলা হবে, তোমরা নিজেদের কাজে যাও।’

‘জানতে পারি কি ওটা কীভাবে…’ নরম স্বরে শুরু করেছিল কিশোর, কিন্তু থামতে হলো ওকে।

‘তোমাদেরকে আগেই বলেছি বাড়ি ফিরতে!’ খেঁকিয়ে উঠেছেন প্রফেসর, ‘মনে রাখবে এই ক্যাম্প আমার! তোমরা খামোকা ঝামেলা করছ!’

কিশোরদের মোবাইল হোমের কোনা ঘুরে বেরিয়ে এল ওমর শরীফ। ‘কী ব্যাপার, কিশোর-মুসা-রবিন? চেঁচামেচি কীসের?

‘আমার ক্যাম্পে এসে আপনারা সবাই মিলে পার্টি শুরু করেছেন?’ গলা চড়ে গেল প্রফেসরের। ঘুরে চাইলেন বেদুঈন বৈমানিকের দিকে। ‘আপনার সঙ্গেই এসেছে এসব ছেলে?’

‘হ্যাঁ,’ শান্ত স্বরে বলল ওমর। ‘আসলে কী হয়েছে, বলুন তো?’

‘কী আবার হবে!’ গলা স্বাভাবিক হলো না আর্নল্ডের, ‘বারবার বলছি বিদেয় হও, যাওয়ার নাম নেই— নিয়ে যান এদেরকে! খুশি হব আপনাদের গাড়ির হেডলাইট বন্ধ করলে! চোখে এসে আলো পড়ছে!’

গাড়ির কাছে ফিরল কিশোর, অফ বরে দিল বাতির সুইচ।

দপ্ করে নিভে গেল ধবধবে সাদা আলো।

‘ওমর ভাই, চলুন বাড়ি ফিরি, বলল কিশোর। প্রফেসর পরে সরিয়ে নেবেন তাঁর ভাঙা ক্যাকটাসের ডাল।’

কিশোর কী ইঙ্গিত করেছে, খেয়াল করেছে রবিন ও মুসা।

‘ঠিক আছে, সরি, বিরক্ত করলাম আপনাকে, প্রফেসর,’ বলল মুসা।

ফিরতি পথে রওনা হয়ে গেল রবিন-মুসা ও ওমর।

এদিকে গাড়ি সরিয়ে আনল কিশোর।

দু’মিনিট পর মোবাইল হোমে উঠে পড়ল তিন গোয়েন্দা ও ওমর। পিছনে বন্ধ করে দিল দরজা।

‘জলদি!’ চাপা স্বরে বলল কিশোর। ‘অন্য সব বাতি নিভিয়ে দাও, শুধু জ্বলুক পিছনের বাতি।’

ঝটপট বাতিগুলোর সুইচ অফ করে দিল মুসা ও রবিন।

মোবাইল হোমের জানালা দিয়ে সাবধানে উঁকি দিল কিশোর। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, ‘কম্বল দিয়ে ক্যাকটাসের ডাল মুড়িয়ে নিলেন। রাখলেন পিকআপের ভেতর।’

ওর পাশ থেকে উঁকি দিল রবিন ও মুসা।

গাড়িতে চড়ে বসেছেন প্রফেসর, ইঞ্জিন চালু করে কয়েক সেকেণ্ড পর উধাও হয়ে গেলেন আঁধার রাতে।

‘মনে হচ্ছে আগেও এমন ক্যাকটাসের ডাল সরিয়েছেন,’ বলল মুসা!

‘আমারও মনে হচ্ছে, কী যেন লুকাতে চাইলেন,’ বলল ওমর।

‘প্রফেসর খুবই ব্যস্ত… কিন্তু… কেন?’ নীচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। ‘শুনেছি তিনি মরুভূমির গাছের বিশেষজ্ঞ। তাঁর জানার কথা কঠোর আইন আছে ক্যাকটাসের জন্যে। হয়তো তাই ভয় পেয়েছেন নিজের গাড়ির নীচে ক্যাকটাসের ডাল দেখে।’

‘বোধহয় কোনওদিকে যাওয়ার সময় ওটা ভেঙে রয়ে যায় পিকআপের নীচে,’ বলল মুসা।

ভুরু নাচাল রবিন। ‘কিন্তু সেক্ষেত্রে কথা হচ্ছে: তাঁর মত জ্ঞানী মানুষ রাস্তা থেকে নেমে মরুভূমির ভেতর কেন ঢুকলেন?’

‘হয়তো গবেষণার কারণে,’ বলল কিশোর।

‘হতে পারে ক্যাকটাস ডাকাতির সঙ্গে জড়িত,’ বলল মুসা। ‘কিন্তু মনে হচ্ছে না হাত নোংরা করবে। বড় সব গাছ সরাতে হলে…’ চুপ হয়ে গেল ও।

‘কিন্তু রাসলিঙের পিছনে মূল মগজ তাঁর হতে পারে,’ বলল রবিন। ‘পিকআপের নীচে ডাল দেখে চিন্তিত হয়ে ওঠেন।’

‘বারো ঘণ্টাও পার হয়নি, এরই ভেতর তিনজন সন্দেহজনক লোক পেয়ে গেছি,’ বলল মুসা। ‘প্রফেসর, ডোনাল্ড ওয়াইলি আর রাসেল ভালদারেজ।’

‘আর এরই ফলে না খেয়ে মরতে বসেছি সবাই,’ মন্তব্য করল ওমর শরীফ। ‘মুসা, তুমি কি গ্রিল থেকে তোমার হটডগ নামিয়েছিলে?’

‘নাহ্!’ দরজা লক্ষ্য করে ছুট দিল মুসা। ‘ভুলেই গেছি!’

‘দাঁড়াও-দাঁড়াও!’ বলল ওমর, ‘ওরা এখন ফ্রিযে ঘুমাচ্ছে। ভাজি হওয়ার পরও যখন তোমরা এলে না, আমি সরিয়ে ফেলি। বিনগুলোও রক্ষা পেয়েছে।’

‘বাঁচলাম!’ খুশি হয়ে হাসল মুসা।

পাঁচ মিনিট পেরুবার আগেই গরম করা হলো সব খাবার, পরের দশ মিনিটে ওগুলো উধাও হলো সবার পেটের ভিতর।

বাসন-বাটি ও চামচ ধুয়ে রাখবার পর কোনও কাজ থাকল না ওদের। ভারী খাবারের কারণে ঝিমুনি এল। নতুন করে জমল না আলাপ। যে যার বাঙ্কে উঠে শুয়ে পড়ল স্লিপিং ব্যাগে।

সহজেই এল ঘুম।

দূরে তীক্ষ্ণ চিৎকার করছে কয়োটি। একটার হাহাকার থামলে শুরু হয় আরেকটার বিলাপ।

প্রায় একইসময়ে ঘুমিয়ে পড়ল ওমর শরীফ, রবিন ও মুসা।

কিছুক্ষণ জেগে রইল কিশোর, তারপর কখন যেন তলিয়ে গেল ভাঙা ভাঙা ঘুমে।

আবারও সচেতন হয়ে উঠল বেশ কিছুক্ষণ পরে, চট্ করে দেখে নিল হাতঘড়ি।

রাত একটা।

ওর ঘুম ভেঙেছে দূরে কীসের যেন আওয়াজে।

কান পেতে অপেক্ষা করল কিশোর।

কিছুক্ষণ পর টের পেল, ওটা কীসের আওয়াজ।

ভারী ইঞ্জিন, গুঙিয়ে চলেছে মরুভূমির ভিতর

ট্রাক ধীরে ধীরে এগুতে শুরু করলে এমন গোঁ-গোঁ শব্দ হয়। আওয়াজটা পশ্চিমে, হাইওয়ের দিকে নয়।

বাঙ্ক থেকে নেমে আস্তে করে উঠে দাঁড়াল কিশোর, টোকা দিল মুসার কাঁধে। ফিসফিস করে বলল, ‘মুসা, ওঠো! আওয়াজটা পাচ্ছ?’

চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসল মুসা। কয়েক সেকেণ্ড পর হালকা চাপড় দিল পাশের বাঙ্কে শোয়া রবিনের কাঁধে। ‘উঠে পড়ো, রবিন, ইঞ্জিনের আওয়াজ!’

‘কীসের?’ ধড়মড় করে উঠে বসল রবিন।

‘গাড়ির আওয়াজ… শুনছ, রবিন?’ ফিসফিস করল মুসা।

‘পুবে হাইওয়ে, ওদিকে না,’ বলল কিশোর। ‘জোরে গাড়ি চালিয়ে গেলে হারিয়ে যেত সে-আওয়াজ। কিন্তু একই জায়গায় ঘড়ঘড় করছে ইঞ্জিনটা।’

‘শুনে মনে হচ্ছে ট্রাকের উইঞ্চ চালু করেছে,’ নিচু স্বরে বলল রবিন।

একবার ঘুমন্ত ওমর শরীফকে দেখে নিয়ে বলল কিশোর, হয়তো তাই। ক্যাকটাস সরিয়ে নিচ্ছে একদল ডাকাত।’

‘ওমর ভাইকে ডাকি?’ ফিসফিস করল রবিন।

‘বিরক্ত করবে?’ আপত্তি তুলল মুসা, ‘ঘুমিয়ে আছে থাকুক, পরে দরকার পড়লে ডাকব।’

মাথা নাড়ল কিশোর। ওঁকে জাগাতে হবে। যাওয়ার সময় গাড়ি থেকে সিবি রেডিয়ো নেব। যদি ডাকাত দেখি, ওমর ভাইকে জানাব। তিনি আবার ডেকে আনবেন ফিলিপ রায়ানকে।’

‘ঠিক আছে, তবে দেরি কীসের?’ বলল মুসা।

ওমর শরীফকে ডেকে তুলল ও-ই।

চটপট জানাল কী করতে চাইছে।

আপত্তি তুলল না বৈমানিক। তবে বলে দিল, খুব সাবধানে থাকতে। দস্যুদল দেখলে যেন ধারে-কাছে না যায় ওরা, রেডিয়ো করলেই রেঞ্জার অফিস থেকে লোক নিয়ে হাজির হবে ওমর। হাতের নাগালে চালু রাখবে সিবি রেডিয়ো।

মোবাইল হোম থেকে নেমে পড়ল তিন গোয়েন্দা।

গাড়ি থেকে নিল সিবি ওয়াকি-টকি।

দূরের ওই ইঞ্জিনের আওয়াজ লক্ষ্য করে রওনা হলো মরুভূমি মাড়িয়ে। জমি এবড়োখেবড়ো, মাঝে মাঝেই হোঁচট খাচ্ছে ওরা। তবে ক্ষীরের মত উজ্জ্বল জোসনা ঢালছে গোল রুপালি চাঁদ।

ইঞ্জিনের আওয়াজ ছাড়া পুরো রাত থমথমে।

শব্দ অনুসরণ করছে ওরা।

কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ যাওয়ার পর মনে হলো আওয়াজ কাছে আসছে না।

আরও মিনিট তিনেক হাঁটবার পর থেমে দাঁড়াল কিশোর। ‘মুসা-রবিন, ইঞ্জিনের শব্দ কিন্তু আর পাওয়া যাচ্ছে না।’ কান পাতল মুসা। ‘তাই তো!’

‘হয়তো কয়েক মিনিটের জন্যে ইঞ্জিন বন্ধ করেছে?’ বলল রবিন, ‘আমরা কি হাঁটতে থাকব?’

‘জানি না,’ অনিশ্চিত স্বরে বলল কিশোর। চাঁদের আলোয় চাঁদের দেশের মতই লাগছে মরুভূমিকে। চারপাশে কোথাও শহরের বাতি নেই, নিকষ কালো আকাশে ঝলমল করছে লাল-নীল-হলদে-সাদা নক্ষত্র। ইঞ্জিনের কারণে বোধহয় ভয় পেয়েছে রাতের প্রাণীরা, কোথাও কোনও আওয়াজ নেই।

নড়ছে না কিছু।

নিচু স্বরে বলল কিশোর, ‘বোধহয় আলাপ করে নেয়া উচিত ওমর ভাইয়ের সঙ্গে।’

‘তাই করো,’ বলল রবিন।

সিবি রেডিয়োর সুইচ অন করল কিশোর। হিসহিস আওয়াজ অ্যাডজাস্ট করে নিয়ে ট্র্যান্সমিট করল: ‘ওমর ভাই?’

‘রওনা হচ্ছ?’ বলল অপরিচিত কণ্ঠ।

কয়েক সেকেণ্ড পর আরেকজন বলল, ‘হ্যাঁ। কাজ শেষ। ভাল একটা পাওয়া গেছে। এবার কাজ শেষে আরাম করে ঘুমাব বাকি রাত।’

‘ঠিক আছে,’ বলল প্রথম কণ্ঠ। ‘পরে দেখা হবে মোটেলে।’

চুপ হয়ে গেছে তিন গোয়েন্দা। অপেক্ষা করল আরও কিছু জানবার জন্য, কিন্তু থেমে গেছে রেডিয়ো।

‘কী বুঝলে?’ বলল মুসা।

‘বোধহয় মরুদস্যুদের ভেতর কথা হলো,’ বলল রবিন।

আনমনে বলল কিশোর, ‘রেডিয়োর চ্যানেল মনে রেখো।’

‘কত নম্বর?’ জানতে চাইল মুসা।

‘দশ।’

ফিরতি পথে রওনা হয়ে গেল ওরা।

কিছুক্ষণ পর ফিরে এল মোবাইল হোমে।

ওদের কথা শুনবার পর ওমর বলল, ‘ওই গলার আওয়াজ কিন্তু অন্যদেরও হতে পারে। হয়তো ক্যাকটাস ডাকাত নয়। পার্কের ভেতরের হাইওয়েতে অনেক ট্রাক চলে, নিজেদের ভেতর কথা বলে ড্রাইভাররা। আবার হতে পারে, কাজ শেষে বাড়ি ফিরছে স্থানীয় কর্মীরা। যাই হোক, কালকে ফিলিপকে জানাব আমরা।’