তেরো
একটা ব্যাপার মাথায় খেলল কিশোরের। চট্ করে বলল, ‘ট্রাক এগুলেই ট্রেইলার পেছাবে উইনটন, আর সে সুযোগে পিছনের দরজা খুলে বের করে আনব ওমর ভাইকে।
‘এরাই ক্যাকটাস রাসলার?’ ফিসফিস করে বলল লিলি।
কুঁজো হয়ে দাঁড়াল কিশোর, এবার দুই লাফে চলে যাবে ট্রেইলারের পিছনের দরজার কাছে।
কিন্তু ট্রাক পিছিয়ে না নিয়ে সামনে বাড়ল কাউবয়, বাঁক নিতে শুরু করেছে দ্রুত। সামনের বাংলোর সব গাড়ির নাকের ডগা দিয়ে বন করে ঘুরে গেল সে। প্রধান সড়ক ধরে চলল ফ্ল্যাটবেডের পিছনে।
দুই ট্রাক রওনা হতেই খপ্ করে লিলির হাত ধরল কিশোর, ছুট দিল নিজেদের গাড়ি লক্ষ্য করে।
তিন মিনিট পেরুবার আগেই পৌঁছে গেল গন্তব্যে।
লাফ দিয়ে গাড়িতে উঠল ওরা।
দেরি হলো না ইঞ্জিন চালু করতে, গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়েই রওনা হয়ে গেল কিশোর। সর্বোচ্চ গতিবেগ লেখা সাইনবোর্ড দেখে সে-গতিই তুলল।
হাইওয়ে গেছে অর্গান পাইপ পার্কের দিকে।
কিন্তু আশপাশে কোথাও কোনও ট্রাক দেখতে পেল না ওরা।
বেশি দূরে থাকার কথা নয় ওই দুই ট্রাকের।
কিশোর ভেবেছিল সহজেই পিছু নেবে, কিন্তু তা অসম্ভব।
‘অন্য কোনও রুটে গেছে,’ মন্তব্য করল কিশোর।
গতি কমাল ও, ইউ টার্ন নিয়ে আবারও চলল শহরের দক্ষিণ প্রান্ত লক্ষ্য করে।
‘অর্গান পাইপ পার্ক দক্ষিণ-পুবে,’ ড্রাইভ করবার ফাঁকে বলল, ‘এদিক দিয়েই যাওয়ার কথা তাদের।’
ধুলোময় আবাসিক এলাকা দু’পাশে। ওরা এমন কোনও রাস্তা খুঁজছে, যেদিক দিয়ে যাওয়া যায় পার্কে।
ক্রমেই আরও গম্ভীর হয়ে গেল কিশোর।
প্রতিটি সেকেণ্ডে দূর থেকে আরও দূরে সরছে দুই ট্রাক।
একটার ভিতর বন্দি হয়ে আছে ওমর শরীফ।
বেরুবার উপায় নেই তার।
ফোন থাকলেও পুলিশের কাছে সাহায্য চাইতে পারবে না।
‘আমাদের এখন ভাল একটা ম্যাপ দরকার,’ হতাশা চেপে বলল কিশোর। ‘এদিক দিয়ে পার্কে গেছে এমন রাস্তা থাকার কথা।’
‘আশ্চর্য!’ বলল লিলি, ‘ট্রাকগুলো উধাও হলো কীভাবে!’
আরও কিছুক্ষণ দক্ষিণে যাওয়ার পর আবারও গাড়ি ঘুরিয়ে নিল কিশোর, পার্কের ফিরতি পথ ধরল।
ক্যাকটাস ডাকাতির সূত্র নিয়ে ভাবছে।
নিশ্চয়ই কারও হয়ে কাজ করে ট্রাকের দুই ডাকাত?
তাদের নেতা জানে তিন গোয়েন্দা ডাকাত ধরতে চায়।
কিন্তু আসলে সে কে?
প্রফেসর জর্জ আর্নল্ডকে সন্দেহ করা যায় না।
প্রফেসর ডাকাতির সঙ্গে জড়িত থাকলে সবই বুঝত লিলি।
আসলে এসব বিষয়ে কিছুই জানে না লিলি বা তার বাবা।
রবিন ও মুসার কথা ভাবল কিশোর।
ভালদারেজের সঙ্গে কথা বলেছে ওরা?
এখন প্রায় প্রমাণিত: ডাকাত দলের লোক ডোনাল্ড ওয়াইলি।
তারই পিকআপ ও কোদাল ব্যবহার করছে উইনটন ও তার সঙ্গী।
ওয়াইলির সঙ্গে খাতির আছে রাসেল ভালদারেজের, কাজেই ধরে নেয়া যায় সে-ও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত।
অন্য চিন্তায় সরে গেল কিশোর।
পার্কে ফিরেই আলাপ করতে হবে মুসা ও রবিনের সঙ্গে।
ভেবে বের করতে হবে কীভাবে উদ্ধার করা যায় ওমর শরীফকে।
ফিলিপ রায়ান হয়তো বলতে পারবেন শহর থেকে কীভাবে পার্কে ফিরেছে ডাকাতরা।
তাতে হয়তো জানা যাবে কোথায় নিয়েছে ওমর শরীফকে।
‘আমরা পার্কে পৌছেই পুলিশ ডাকব?’ লিলির কথা শুনে সচেতন হলো কিশোর। ‘সাহায্য করতে পারবে না তারা?’
‘হয়তো পারবে,’ বলল কিশোর। ‘হেড রেঞ্জারের অফিস থেকে যোগাযোগ করব। তার আগে আলাপ করব মুসা ও রবিনের সঙ্গে।’
‘আমরা ওসব ট্রাকের লাইসেন্স নাম্বার জানলে…’ হতাশার কারণে চুপ হয়ে গেল লিলি।
‘জানি, দুই ট্রাকের নাম্বার প্লেটের সবক’টা সংখ্যা মনে আছে, ‘ বলল কিশোর। ‘কিন্তু অন্য কথা ভাবছি: হয়তো শেষ ক্যাকটাস তোলার আগে ট্রেইলারই খুলল না তারা। সেক্ষেত্রে বাড়তি কয়েক ঘণ্টা পাব।’
‘একটু পর সন্ধ্যা হবে,’ বলল লিলি। ‘তার মানেই ট্রেইলারের কোণে লুকাতে পারবেন শরীফ। পরে হয়তো সরেও পড়বেন।’
‘আর আমরাও বসে থাকব না,’ বলল কিশোর, ‘খুঁজব কোথায় আছে ডাকাত দল এবং ওমর ভাই।’
কিছুক্ষণ পর পার্ক অফিসের কাছে পৌঁছে গেল ওদের গাড়ি।
ওখানে থামল না কিশোর, চলল ক্যাম্প গ্রাউণ্ডের দিকে।
ঠিক করেছে, মুসা-রবিনের সঙ্গে আলাপ সেরে অফিসে গিয়ে ফিলিপ রায়ানকে সব খুলে বলবে।
একবার দেখল অফিসের সামনে হেড রেঞ্জারের জিপ।
পাঁচ মিনিট পেরুবার আগেই ওদের মোবাইল হোমের সামনে কড়া ব্রেক কষে থামল কিশোর।
বাইরের টেবিলের পাশে বসে আছে মুসা ও রবিন।
কিশোর গাড়ি থেকে নামবার আগেই জানতে চাইল মুসা, ‘এত তাড়া কীসের, কিশোর— কী হয়েছে?’
‘ওমর ভাই আটকা পড়েছেন ডাকাতের ট্রেইলারের ভেতর!’ গাড়ি থেকে নেমে পড়ল কিশোর
বাবাকে পরিস্থিতি জানাতে ওদের ট্রেইলারে চলে গেল লিলি।
এদিকে রবিন ও মুসাকে সব খুলে বলতে লাগল কিশোর।
বাদ পড়ল না ওয়াইলির কোদালের ব্যাপারটাও।
‘হেড রেঞ্জার রায়ানের দেয়া টপোগ্রাফিক ম্যাপ আমাদের লাগবে,’ বলল কিশোর। ‘শহর থেকে অন্য কোনও পথে পার্কে ঢুকেছে ডাকাতরা। আমি তাদের পিছু নিতে পারিনি।’
ম্যাপ আনতে মোবাইল হোমে উঠল রবিন।
নিজেদের ট্রেইলার থেকে বাবাকে নিয়ে বেরিয়ে এল লিলি।
‘আসলে কী হয়েছে?’ জানতে চাইলেন প্রফেসর, চিন্তিত দেখাল তাঁকে। লিলি বলল তোমাদের সঙ্গের যুবককে কিডন্যাপ করেছে একদল ডাকাত?’
‘ঠিক কিডন্যাপ নয়,’ বলল কিশোর, ‘উনি আটকা পড়েছেন ডাকাতের ট্রেইলারের ভেতর।’
ম্যাপ নিয়ে মোবাইল হোম থেকে নেমে এল রবিন।
ওর হাত থেকে পুরু কাগজটা নিয়ে টেবিলে বিছিয়ে দিল কিশোর। সংক্ষেপে প্রফেসরকে খুলে বলল, কীভাবে আটকা পড়েছে ওমর শরীফ।
‘স্যর, হাইওয়ে ছাড়া এমন কোনও পথ চেনেন, যেদিক দিয়ে অ্যাজো থেকে পার্কে আসা যায়?’ জানতে চাইল ও।
ম্যাপের একটা দিক দেখালেন প্রফেসর। ‘অ্যাজো এদিকে। না, এদিকে আসার সহজ পথ নেই। কিন্তু তারা যদি নিজেরাই পথ তৈরি করে নেয়, তো আলাদা কথা। এভাবে পুরো এলাকায় আমি নিজেই ঘুরি।’
‘কোথায় গিয়ে থাকতে পারে তারা?’ আনমনে বলল লিলি। ‘মিনিটখানেক আগে ছিল, পরের মিনিটে উধাও।’
‘এখন মনে হচ্ছে শহরেই কোথাও থাকতে পারে,’ বলল কিশোর।
‘স্যর, আপনার কী ধারণা?’ প্রফেসরের কাছে জানতে চাইল রবিন।
শ্রাগ করলেন জর্জ আর্নল্ড। ‘হয়তো পেট্রল নিতে গেছে।’
‘পেট্রল স্টেশন,’ বিড়বিড় করল কিশোর, পরক্ষণে বলল, ‘শহরে যাওয়ার হাইওয়ে ছাড়া অন্যদিকেও পেট্রল স্টেশন আছে?’
‘বেশ কয়েকটা,’ বললেন প্রফেসর, ‘খেয়াল না করলে চোখেই পড়বে না সেসব।’
বারকয়েক নীচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর, বলল, ‘হয়তো পেট্রল নিতে গেছে, তারপর আবারও ফিরেছে মোটেলে, বা এসেছে পার্কে।’
‘যে-কোথাও যেতে পারে,’ হতাশ স্বরে বলল মুসা।
রবিনের কাছ থেকে চেয়ে কলম ও কাগজ নিল কিশোর
দুই ট্রাকের নম্বর প্লেটের সংখ্যাগুলো লিখল, কাগজটা তুলে দিল প্রফেসরের হাতে। ‘দস্যু ট্রাকের লাইসেন্স প্লেটের। হয়তো এতেই ধরা পড়বে লোকগুলো।’
‘এসব যখন আছে, পুলিশ ডাকতেই পারি,’ বললেন প্রফেসর। ‘আর দেরি করা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না।’
সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিশোর, চুপ করে বসে থাকবে না ওরাও। কিন্তু ওদেরকে ঝুঁকি নিতে নিষেধ করতে পারেন প্রফেসর।
‘স্যর,’ বলল কিশোর, ‘আমাদের বদলে আপনি নিজে পুলিশ ডাকলেই ভাল। আপনার কথায় গুরুত্ব দেবে তারা। হেড রেঞ্জার ফিলিপ রায়ানের অফিসে গেলে আলাপ করতে পারবেন তাঁর সঙ্গেও।’
কিশোরের মনোভাব বুঝে গেছে রবিন ও মুসা।
‘জী, স্যর, ঠিকই বলেছে কিশোর,’ বলল রবিন।
‘আপনি বা হেড রেঞ্জার ডাকলেই চলে আসবে পুলিশ,’ বলল মুসা।
‘এখনই আপনার গাড়ির ফিউয়েল ফিল্টার পাল্টে দেবে মুসা, ‘ বলল কিশোর। ‘সময় লাগবে না রেঞ্জার অফিসে পৌঁছুতে।’
গম্ভীর মুখে মাথা দোলালেন প্রফেসর। মেয়েকে বললেন, ‘তুমি যেতে চাও আমার সঙ্গে?’
‘না,’ মাথা নাড়ল লিলি, ‘আমি যাব কিশোরদের সঙ্গে।’
‘পরে রেঞ্জার অফিসে আপনার সঙ্গে দেখা হবে, স্যর,’ বলল কিশোর। ‘আপনি রেঞ্জার রায়ানকে জানান কী ঘটেছে।’
মাথা দোলালেন প্রফেসর।
তাঁর সঙ্গে পিকআপের দিকে পা বাড়াল মুসা। দুই মিনিটে ফিউয়েল ফিল্টার পাল্টে দিল ও।
দেরি না করে পিকআপ নিয়ে রওনা হয়ে গেলেন প্রফেসর।
নিজেদের ক্যাম্পে ফিরল মুসা।
রবিনের সঙ্গে আলাপ করছে কিশোর।
ওর কথার শেষে বলল নথি, ‘না, সত্যিই ভালদারেজ শিল্পী। মোবাইল হোম ভরা তৈলচিত্র। পার্কে পড়ে আছে কম খরচে থাকতে পারছে বলে।’
‘আরও কোনও কারণ নেই তো?’ জানতে চাইল কিশোর।
‘না, নেই,’ বলল রবিন। ‘সে ক্যাকটাস ডাকাত নয়, জিজ্ঞেস করেছিলাম কীভাবে পরিচয় ওয়াইলির সঙ্গে। বলেছে কিছুদিন ধরেই চেনে। জেনে গিয়েছিল, সন্দেহ করা হচ্ছে ওয়াইলিকে। বন্ধুকে বলেওছিল। তখন দু’জন মিলে ঠিক করেছিল, অন্যদিকে সরিয়ে দেবে ফিলিপ রায়ানের চোখ। তখনই প্রফেসরের দিকে আমাদের মন সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল ভালদারেজ।
শুনছে লিলি, মন্তব্য করল, ‘এ কাজ কেন করল ওরা?’
‘কারণ তোমরা অনেক দিন এখানে, তোমাদের ওপর সন্দেহ ফেলা সোজা,’ বলল মুসা। ‘আমার ধারণা ভালদারেজই তোমার বাবার পিকআপের নীচে অর্গান পাইপ ক্যাকটাস রেখেছিল।’
‘পরে মরুভূমিতে তোমাদের গাড়ির কাছে পাথরের চিহ্ন রেখেছিল,’ বলল রবিন। ‘অবাক হয়েছিল আমরা সিরিয়াসলি নিয়েছি ব্যাপারটা। পরে রাতও কাটালাম পাহাড়ে।’
‘ফিউয়েল লাইন সে কাটেনি,’ বলল মুসা। ‘আমাদের ক্লাইমিং রোপও স্যাবোটাজ করেনি।’
‘সত্যিই মিলছে না কিছু ব্যাপার,’ বলল কিশোর। ‘ডোনাল্ড ওয়াইলির গাড়ি নিয়ে ঘুরছে ডাকাত দলের লোক। শহরে চোরাই ক্যাকটাস ভরা ট্রাকের ভেতর তারই কোদাল…’
মাথা দোলাল মুসা। ‘অবিশ্বাস্য মনে হলেও ডোনাল্ড ওয়াইলি ও রাসেল ভালদারেজ বোধহয় আসলেই নিরাপরাধ।’
তখনই মোবাইল হোমের পাশ দিয়ে এল ভালদারেজ, গম্ভীর মুখ। ‘সত্যি দুঃখিত, আবারও কান পেতে ফেলেছি,’ দুঃখিত স্বরে বলল। ‘চাইনি, কিন্তু আসার পথে অনেক কথাই কানে এল। …হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ, ক্যাকটাস ডাকাত নয় ডোনাল্ড ওয়াইলি। আমার ধারণা, কেউ ফাঁসিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে ওকে।
চুপ হয়ে গেছে সবাই।
ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল কিশোর, ‘কিন্তু এ কাজ কে করবে?’
‘সে কে… আমি জানি না,’ বলল ভালদারেজ।
কাঁধ ঝাঁকাল রবিন ও মুসা।
‘হয়তো তিনি স্বয়ং হেড রেঞ্জার ফিলিপ রায়ান, হঠাৎ করেই বোমা ফাটাল কিশোর। ‘বারবার বলেছেন ওয়াইলি জড়িত।’
‘নাহ্, ফিলিপ রায়ান…’ চুপ হয়ে গেল মুসা। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, ‘তিনিই না তদন্ত করছেন এ কেসের? ওমর ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু?’ কিশোরের চোখে চাইল মুসা। ‘অবশ্য, তাঁর অফিসে দেখেছি ওই কাউবয় উইনটনকে।’
‘হয়তো ফিলিপ হলদে ভ্যানের লোক পাঠিয়েছেন আমাদের গাড়ির ফিউয়েল লাইন কাটতে?’ বলল কিশোর।
ওর কথাটা শুনে আস্তে করে মাথা দোলাল মুসা।
চুপ করে আছে রবিন।
‘তিনি জানতেন আমরা কোথায় আছি,’ বলল কিশোর।
‘গতকাল রাতে আমরা মোবাইল হোমে ওঠার পর আমাদের ক্লাইমিং রোপ কাটার সময় তাঁর ছিল,’ বলল রবিন। ‘ওমর ভাইও কথা বলতে উঠে আসেন।’
‘তদন্তের আবিষ্কৃত প্রতিটি সূত্র জানেন,’ বলল কিশোর।
‘ঠিক,’ সায় দিল মুসা।
‘হায় ঈশ্বর!’ হঠাৎ আঁৎকে উঠল লিলি। ‘সত্যিই যদি হেড রেঞ্জার ডাকাত হয়? …আমার বাবা এখন তাকে বলছেন: ডাকাত ধরতে পুলিশবাহিনী আনা দরকার!’
‘দেরি না করে ওই অফিসে যেতে হবে,’ বলল কিশোর।
গাড়িতে উঠতে দেরি হলো না ওদের কারও।
সামনের সিটে মুসা ও কিশোর।
পিছনের সিটে ভালদারেজ, রবিন ও লিলি।
ড্রাইভ করল মুসা, বন বন করে পিছলে গেল চার চাকা, ছিটকে সামনে বাড়ল গাড়ি।
‘ও ঈশ্বর, বাবার যেন ক্ষতি না হয়!’ বিড়বিড় করছে লিলি। ‘কেন যে মানুষটা মাঝে মাঝে এত জেদি হয়ে ওঠেন!’
‘ফিলিপ রায়ান সত্যিই ভয়ঙ্কর লোক,’ মন্তব্য করল মুসা। ‘আগেও আমাদের ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে।’ কথাটা বলে লজ্জা পেল ও। মেয়েটাকে আরও ভয় পাইয়ে দিতে চায়নি।
ওরা হেড রেঞ্জারের অফিসের সামনে পৌছুতেই দেখতে পেল ফিলিপ রায়ানকে। অফিস থেকে বেরিয়ে আরেকদিকে ছুটে চলেছে। ঘুরেও চাইল না ছেলেদের দিকে, লাফ দিয়ে উঠল জিপে, গাড়ি চালু করে রওনা হয়ে গেল দেরি না করেই। পিছনে তৈরি হলো মেঘের মত ধোঁয়া ও ধুলো।
উঠানে পড়ে আছে প্রফেসরের পিকআপ।
‘আমার মন কু ডাকছে,’ চাপা স্বরে বলল কিশোর।
‘আমারও…’ চুপ হয়ে গেল লিলি। পরক্ষণে বলল, ‘হঠাৎ করে চলে গেল হেড রেঞ্জার, আর পিকআপ রেখে কোথায় গেলেন আমার বাবা!’
থমথম করছে চারপাশ।
তারই ভিতর সামান্য গোঙানির আওয়াজ শুনতে পেল ওরা।
গাড়ির চার দরজা খুলে ছিটকে বেরিয়ে এল সবাই।
হেড রেঞ্জারের অফিস লক্ষ্য করে ছুটতে শুরু করেছে লিলি বারান্দা পেরিয়ে গিয়ে ঢুকল ভিতরে। দুই সেকেণ্ড পর আঁৎকে উঠবার আওয়াজ এল ওদিক থেকে।
ঝড়ের গতিতে অফিসে ঢুকল কিশোর, মুসা, রবিন ও ভালদারেজ, দরজা পেরিয়েই থমকে গেল ওরা।
সামনেই লিলি।
হাঁটু গেড়ে বসে আছে পড়ে থাকা এক দেহের পাশে।
মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন প্রফেসর।
মাথা ফেটে কুলকুল করে গড়াচ্ছে তাজা রক্ত।
তার ভিতর পড়ে আছে মোবাইল ফোন।
‘বাবা!’ বিড়বিড় করছে লিলি, নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করেছে।
ঝুঁকে প্রফেসরের গলার শিরা টিপে পালস খুঁজল কিশোর, ক’ মুহূর্ত পর বলল, ‘হৃৎস্পন্দন দুর্বল, কিন্তু বাঁচবেন।’
‘ফিলিপ রায়ান মাথায় বাড়ি দিয়েছে,’ বলল ভালদারেজ।
‘হেড রেঞ্জারের সঙ্গে আলাপ শেষ করে বোধহয় পুলিশে যোগাযোগ করতে চেয়েছিলেন প্রফেসর,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল কিশোর। ‘দু-চার কথা হতেই ফিলিপ রায়ান বুঝে ফেলল পুলিশকে কী বলবেন প্রফেসরঃ তাঁর কাছে আছে ডাকাতদের দুই ট্রাকের লাইসেন্স প্লেটের নম্বর। পুলিশ ফোর্স এলে ধরা পড়বে দলের ডাকাতরা, রক্ষা পাবে না ফিলিপ নিজেও। তখনই ঠিক করল প্রফেসরকে খুন করে সরিয়ে ফেলবে লাশ। মাথা ফাটিয়ে মেরে ফেলতে চাইল, কিন্তু তখনই গাড়ি নিয়ে এসে পৌঁছলাম আমরা। বাধ্য হয়ে পালাতে হলো তাকে।’
‘খাইছে!’ বিড়বিড় করল মুসা, ‘মস্ত বিপদে ওমর ভাই!’
‘জানতে হবে কোথায় গেল ফিলিপ রায়ান,’ বলল রবিন।
রক্তে ভেজা মোবাইল ফোন তুলে নিয়েছে কিশোর।
‘আমি পুলিশের সঙ্গে কথা বলছি, কিশোর,’ বলল লিলি, শক্ত করে ফেলেছে মন। ‘দেরি কোরো না, পিছু নাও রক্ত-পিশাচটার!’
‘ঠিক আছে,’ লিলির হাতে ফোন দিল কিশোর, দুই বন্ধুকে বলল, ‘চলো, দেখা যাক পিছু নেয়া যায় কি না।’ ভালদারেজের উদ্দেশে বলল, ‘আপনি লিলির সঙ্গে থাকুন। ফিলিপ আবারও হাজির হতে পারে।’
‘কিন্তু তোমরা কী করবে, শেষে তো ভয়ঙ্কর বিপদে পড়বে, ‘ আপত্তির সুরে বলল ভালদারেজ।
‘দুশ্চিন্তা করবেন না,’ বলল মুসা। ‘আমরা গোপনে ডাকাতের পিছু নেব, পরে পুলিশকে জানাব কোথায় আছে তারা।’
‘পুলিশ এলে সব খুলে বলবেন, বলল কিশোর। ‘আমাদের গাড়িতে সিবি ওয়াকি-টকি আছে। দরকারে জানাব কোথায় আছি বা কী করছি।’
তিন মিনিট পেরুবার আগেই গাড়ি ঘুরিয়ে রওনা হয়ে গেল তিন গোয়েন্দা। ড্রাইভ করবার ফাঁকে বলল মুসা, ‘এবার? আমরা জানব কী করে কোথায় গেছে লোকটা?’
‘আঁধার নেমে এসেছে,’ বলল কিশোর, ‘এদিকের রাস্তা ধরেই চলো। লোকটা হেড লাইট জ্বাললে তার আলো দেখব।’
‘হয়তো আবারও শহরে গেছে,’ বলল রবিন। ‘কিশোর, তুমি না বলেছিলে ওই মোটেলের সামনে আরও গাড়ি আছে?’
‘ছিলই তো,’ বলল কিশোর। ‘হলদে ভ্যান, তা ছাড়া ডোনাল্ড ওয়াইলির পিকআপও ছিল।’
‘ওই মোটেলের দিকে যাওয়াই বোধহয় ভাল,’ বলল মুসা, ‘হয়তো পথে দেখা হবে ফিলিপ রায়ানের সঙ্গে।’
‘হয়তো একইসঙ্গে মোটেল থেকে রওনা দেবে ডাকাতরা,’ বলল রবিন।
আস্তে করে মাথা দোলাল কিশোর। ‘বুদ্ধি থাকলে এই পার্ক থেকে বহু দূরে সরে গেছে তারা।’ পরক্ষণে মাথা নাড়ল। ‘কিন্তু তার উল্টোও হতে পারে। কেউ সন্দেহ করবে না এদিকে আছে।’ মুসাকে বলল ও, ‘চলো যাই শহরের দিকেই।’
গাড়ি ঘুরিয়ে রওনা হয়ে গেল মুসা।
‘কে ভেবেছিল মরুভূমি রক্ষা করতে ব্যস্ত হেড রেঞ্জার নিজেই ভয়ঙ্কর ক্যাকটাস ডাকাত- মরুদস্যু?’ বলল রবিন, ‘জানতে পারলে ভাল হতো, কেন এমন অপরাধে জড়িয়ে গেল।’
‘কঠিন মরুদস্যু!’ মন্তব্য করল মুসা।
‘টাকার জন্যে ওই পথে নেমেছে,’ বলল কিশোর, আমাদের বলেছিল বড় ক্যাকটাসের দাম অনেক।’
‘তাই বলে…’ চুপ হয়ে গেল রবিন।
‘আরও কোনও কারণ থাকতে পারে,’ বলল কিশোর। ‘হয়তো কোনও কারণে কোণঠাসা হয়ে গেছে।’
‘সত্যিই যদি বুদ্ধি থাকে, আজ ক্যাকটাস ডাকাতি না করে লেজ তুলে পালাবে,’ মন্তব্য করল মুসা।
‘তাকে খুব বুদ্ধিমান বলে মনে হয়নি আমার,’ বলল কিশোর, ‘নইলে এসবের ভেতর থাকতই না।’
নীরব হয়ে গেল ওরা।
তুমুল গতি তুলে ছুটছে গাড়ি।
ওমর শরীফের কথা ভেবে চিন্তা বাড়ছে ওদের।
একটা একটা করে নক্ষত্র ফুটে উঠছে আঁধার আকাশে।
মরুভূমিতে পড়তে শুরু করেছে ঠাণ্ডা কুয়াশা।
বিশ মিনিট পর শহরের প্রান্তে পৌঁছে গেল গাড়ি।
তারপর আবারও ওই মোটেলের সামনে হাজির হলো ওরা।
হলদে ভ্যান এখনও আগের জায়গায় রাখা, পাশেই ওয়াইলির পিকআপ।
‘পার্কিং লটের আরেক দিক দেখো, বলল কিশোর। ‘ওই যে ফিলিপ রায়ানের জিপ।
‘ভাল হোত না আমরা পুলিশ ডাকলে?’ জানতে চাইল রবিন।
‘হ্যাঁ, তাই,’ মাথা দোলাল কিশোর। ‘তবে তার আগে একবার বাংলোর জানালা দিয়ে….
কথাটা মাত্র বলতে শুরু করেছে, তখনই খুলে গেল মোটেলের দরজা।
কাঁধে মোড়ানো, লম্বা কার্পেট নিয়ে বেরিয়ে এল দীর্ঘদেহী এক লোক।
হলদে ভ্যানের পিছনে চলে গেল সে।
দরজা খুলে ভিতরে ধুপ্ করে ফেলল কার্পেট।
পিছনের দরজা বন্ধ করে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসল লোকটা, রওনা হয়ে গেল।
দূর থেকে দেখতে তাকে লাগল ফিলিপ রায়ানের মতই।
‘ওই লোক হয়তো কার্পেটে মুড়িয়ে ওমর ভাইকে নিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু মোবাইল ফোনে পুলিশ ডাকলে ধরা পড়বে,’ বলল মুসা।
‘বড় বেশি সহজ লাগছে না সব?’ আনমনে বলল কিশোর।
গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে ভ্যানের পিছু নিয়েছে মুসা।
গ্লাভ্স কমপার্টমেণ্ট খুলে ওদের মোবাইল ফোন নিল কিশোর, চোখ তুলে দেখল হাইওয়ের দূরের বাঁকে হঠাৎ থেমেছে ভ্যান।
খুলে গেল পিছনের দরজা, ফেলে দেয়া হলো কার্পেটের বাণ্ডিল। কয়েক সেকেণ্ড পর আবারও রওনা হয়ে গেল ভ্যান।
একটু পর রাস্তার পাশে ফেলে যাওয়া মোড়ানো কার্পেটের সামনে ব্রেক কষে থামল মুসা।
লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল তিন বন্ধু।
‘কার্পেটের বাণ্ডিলে ভেতর আপনি, ওমর ভাই?’ জানতে চাইল রবিন।
‘নইলে আর কে হবে?’ বলল মুসা।
বাণ্ডিলের ভিতর থেকে কোনও আওয়াজ এল না।
‘খোলো দেখি ভেতরে কে,’ বাণ্ডিলের পাশে বসে পড়েছে কিশোর। দেখল, বহু দূরের বাঁকে হারিয়ে গেল হলদে ভ্যান।
ফাঁকা রাস্তায় কিশোরের পাশাপাশি কাজে নেমেছে রবিন ও মুসা। বাণ্ডিল গড়িয়ে দিয়ে খুলতে শুরু করেছে।
দশ সেকেণ্ড পর মুড়িয়ে রাখা দেহটা বেরিয়ে এল।
মুখ-হাত-পা টেপ দিয়ে বাঁধা।
কিন্তু এই লোক ওমর শরীফ নয়!