এগারো
বরফের মূর্তির মত জমে গেল রবিন। এক সেকেণ্ড পর বুঝল, ওর মতই ভীষণ চমকে গেছে ওই কয়োটি। ঝটকা দিয়ে পিছিয়ে গেল ওটা, পরক্ষণে ঘুরেই হারিয়ে গেল আঁধারে।
হেসে ফেলল রবিন।
খুব কাছ থেকে কয়োটি দেখতে সাধারণ কুকুরের মতই। কিন্তু আসলে পুরোপুরি বুনো, আগুনের গোলার মত দুই চোখে ছিল চাতুরীর ঝিলিক।
আঁধার কেটে ধূসর ভোর আসছে।
অদ্ভুত লাগছে মরুভূমির আকাশ, ক্রমেই হয়ে উঠছে রুপালি- নীল। পাথর-গাছ-পাহাড় বড় অস্বাভাবিক লাগছে, যেন বাস্তবের নয়— ছায়াছবির দৃশ্য।
স্লিপিং ব্যাগে ঘুমিয়ে আছে মুসা।
ওকে না ডেকে উঠে পড়ল রবিন।
পড়ছে হিম কুয়াশা।
ক্লিফের ধারে দাঁড়িয়ে নীচে চাইল রবিন।
আগেই জেগেছে কিশোর। জিজ্ঞেস করল, ‘কখন উঠলে, রবিন?’
‘এইমাত্র,’ বলল নথি, ‘আর সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম গায়ের উপর এসে পড়েছে এক কয়োটি!’
তিরিশ ফুট নীচে কিশোর। কার্নিস থেকে দড়ির অংশ তুলে দেখাল। ‘এমনি ছেঁড়েনি, কেটে দিয়েছে কেউ। স্যাবোটাজ করা হয়েছে।’
যেখান থেকে ছিঁড়েছে দড়ি, ওই অংশ তুলে আনল রবিন।
হ্যাঁ, ছুরি ব্যবহার করেছে কেউ!
মুসাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল রবিন।
ছেঁড়া দড়ি দেখে ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেল মুসা।
দড়ির গিঁঠ দেয়া হতেই ক্লাইমিং রোপ নীচে ফেলল রবিন ও মুসা পাহাড়ের মাথায় উঠে এল কিশোর। বড় এক বোল্ডারে দড়ি বাঁধল ওরা। গুছিয়ে নিল নিজেদের সবকিছু, তারপর ঠিক করল র্যাপেল করে নামবে।
এমন সময় দূরের রাস্তায় দেখা গেল ওদের গাড়ি।
‘আমরা সিবি রেডিয়োতে যোগাযোগ করিনি বলেই বোধহয় চিন্তিত হয়ে পড়েছেন ওমর ভাই,’ বলল কিশোর।
‘চলো এবার নেমে পড়ি,’ বলল রবিন।
সায় দিল মুসা, ‘আর থেকে লাভ নেই।’
হার্নেসের ভিতর দিয়ে কোমরের বেল্ট নিল রবিন, তারপর সাবধানে নামতে লাগল পাহাড় থেকে। দুই পা রাখছে ক্লিফের বুকে। নামছে প্রায় হাঁটবার ভঙ্গিতে। ও মাটিতে নেমে যাওয়ার পর নামল কিশোর। শেষে মুসা।
রাস্তার পাশে গাড়ি রেখে অপেক্ষা করছে ওমর শরীফ।
মাত্র দু-চার কথা হলো ওদের।
গাড়ির ভিতর বসবার পর ওরা বুঝল মরুভূমি কত হিমঠাণ্ডা।
ফ্লাস্ক থেকে ওদেরকে প্রচুর চিনি দেয়া গরমা গরম কোকোর পানীয় দিল ওমর শরীফ।
কাপে আরাম করে চুমুক দেয়ার ফাঁকে রাতের সব ঘটনা বলল মুসা-রবিন-কিশোর।
ওমর বলল, অনেক রাত পর্যন্ত সিবি রেডিয়োর সামনে বসে ছিল, কিন্তু কোনও ট্র্যান্সমিশন শুনতে পায়নি। গাড়ি চালাবার ফাঁকে বলল, ‘শুধু স্ট্যাটিক ছিল। শেষে ভোর চারটের সময় উঠে ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে অ্যান্টেনা দেখলাম। কে যেন ভেঙে দিয়ে গেছে ওটা!’
‘আমরাও ভাবছিলাম কোনও না কোনও সমস্যা আছে,’ বলল মুসা।
‘মুসা, কারা সিবি রেডিয়োতে কথা বলল আন্দাজ করতে পারো?’ জানতে চাইল কিশোর।
‘না,’ বলল মুসা, ‘তবে আবারও শুনলে হয়তো চিনে ফেলব।’
‘হয়তো আমাদের দড়ি কেটেছে ওই লোকই,’ বলল রবিন। ‘আবার মোবাইল হোমের সিবি অ্যান্টেনাও ভেঙেছে।’
‘দড়ি কাটার সুযোগ ছিল রাসেল ভালদারেজের,’ বলল মুসা। ‘তোমরা সব গুছিয়ে নিতে মোবাইল হোমে উঠেছিলে।’
‘কিন্তু ওর কাছে ছুরি দেখিনি,’ বলল কিশোর।
‘প্রফেসরের কাছে ছুরি ছিল কি না কে জানে,’ বলল রবিন। ‘কিন্তু ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিল দড়ির ওপর। এ ছাড়া সুযোগ ছিল ফিলিপ রায়ানেরও। অবশ্য তিনি হিসাবের বাইরে।’
ওরা যখন ক্যাম্প গ্রাউণ্ডে পৌঁছুল, দেখতে পেল ওদের ক্যাম্প সাইটে অফিশিয়াল জিপের পাশে দাঁড়িয়ে আছে হেড রেঞ্জার ফিলিপ রায়ান। ক্লাইমিং দড়ি কাটা পড়বার কথা শুনে ভীষণ রেগে গেল সে।
‘যথেষ্ট হয়েছে, তোমাদেরকে সরিয়ে দিচ্ছি আমি এ কেস থেকে, বলল ফিলিপ। ‘এখন যখন-তখন ঘটতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা। অফিসে গিয়েই আসতে বলব স্টেট এগ্রিকালচারাল ইনভেস্টিগেটরদের।’ এবার ওমর শরীফকে বলল, ‘কিছু মনে কোরো না, কিন্তু মনে হচ্ছে তোমাদের ফিরে যাওয়াই বোধহয় ভাল রকি বিচে।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে, জিপে উঠতে গিয়ে তাকে দেখাল দ্বিধান্বিত। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, ‘কিশোর-মুসা-রবিন, অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে পরিস্থিতি। আমি চাই না তোমরা তদন্ত করতে গিয়ে ভয়ঙ্কর কোনও বিপদে পড়ো। …আমার কথা বুঝতে পেরেছ?’
‘পরিষ্কার, স্যর,’ বলল কিশোর।
‘গুড,’ মাথা দোলাল ফিলিপ। একবার দেখল বন্ধুকে, জিপে উঠে বলল, ‘অফিসে দেখা হবে, ওমর।’
নীল ধোঁয়া ছেড়ে রওনা হয়ে গেল তার গাড়িটা।
‘এবার?’ বলল ওমর, ‘কী করবে?’
‘তদন্তের মাঝে থামা অনুচিত হবে,’ বলল গম্ভীর কিশোর। ওর চোখ পড়েছে প্রফেসরের ক্যাম্পে। পিকআপের ড্রাইভিং সিটে বসেছেন জর্জ আর্নল্ড। ইঞ্জিন চালু করবার চেষ্টা করছেন।
কিশোরের মত ওদিকে চোখ পড়েছে মুসার। গলা উঁচু করে বলল, ‘প্রফেসর, আমরা কি সাহায্যে আসতে পারি?’
জবাব দিলেন না প্রফেসর, ক্যাবের জানালা বন্ধ। বোধহয় শুনতে পাননি। পাশের সিটেই বসেছে লিলি। চালু হচ্ছে না ইঞ্জিন।
‘মনে হচ্ছে কারবুরেটরে পেট্রল নেই,’ বলল মুসা। ‘চলো সাহায্য করি।’
‘চলো,’ রাজি হয়ে গেল কিশোর।
দ্রুত পায়ে ওরা পৌছে গেল পিকআপের ক্যাবের পাশে।
জানালা নিচু করে ওদেরকে দেখলেন প্রফেসর। মনে হলো রেগে আছেন।
‘আমরা কোনও সাহায্যে আসতে পারি, স্যর?’ জানতে চাইল কিশোর। ‘আপনার তেলের মিটার ঠিক আছে তো, স্যর?’
‘হ্যাঁ, ঠিক আছে,’ নাক কুঁচকালেন প্রফেসর। ‘অনেক পেট্রল থাকার কথা।’
‘কিন্তু কারবুরেটরে যাচ্ছে না,’ বলল মুসা, হুড খুলুন, সমস্যাটা দেখি।’
আড়াই মিনিট পর মুসা জানাল: ময়লায় বুজে গেছে ফিউয়েল ফিল্টার। ‘সোজা কাজ,’ বলল, ‘অবশ্য যদি নতুন ফিল্টার থাকে।’
আলাপে ঠিক হলো: ছোট শহর অ্যাজো-তে গাড়িতে করে লিলিয়ান ও ওমরকে নিয়ে যাবে কিশোর।
মেয়েটা কিনবে ফিল্টার, আর ক্যাম্পের রসদ জোগাড় করবে ওমর ও কিশোর।
এ সময়ে ক্যাম্প গুছিয়ে ক্লাইমিং ইকুইপমেন্ট তুলে রাখবে মুসা ও রবিন।
গজগজ করতে করতে নিজ মোবাইল হোমে গিয়ে উঠলেন প্রফেসর। পিছন পিছন গেল লিলিয়ান।
‘তোমাদের আরেকটা কাজ আছে, কথা বলবে ভালদারেজের সঙ্গে,’ বন্ধুদের বলল কিশোর। ‘জানা দরকার আসলেই ছবি আঁকে কি না!’
‘ঠিক আছে,’ মাথা দোলাল রবিন।
‘যদি বোঝ ডোনাল্ড ওয়াইলির সঙ্গে ওর সম্পর্ক আছে, তখন করবে?’ জানতে চাইল ওমর।
‘যদি সত্যি অপরাধী হয়, ভিড়তেই দেবে না তার মোবাইল হোমের কাছে,’ বলল মুসা। কোনও তৈলচিত্রও দেখাবে না।’
‘সেক্ষেত্রে ওখানে ঢোকা কঠিন হবে,’ বলল ওমর।
‘তা ঠিক, কিন্তু প্রমাণও হবে ও কালপ্রিট,’ বলল রবিন।
‘কী নিয়ে এত কথা তোমাদের?’ নিজেদের মোবাইল হোমের দরজা থেকে বলল লিলিয়ান। ‘কীসের কালপ্রিট?’
বন্ধুদের একবার দেখে নিয়ে বলল কিশোর, ‘সে বিশাল লম্বা কাহিনি, লিলি। চলে এসো। চলুন, ওমর ভাই, রওনা হয়ে যাই।’
‘আমরাও ব্যস্ত হয়ে উঠি,’ বলল রবিন।
মাথা দোলাল মুসা।
ওদেরকে দেখছে কৌতূহলী লিলিয়ান, উঠে পড়ল গাড়ির সামনের সিটে। আরাম করে পিছনে বসেছে ওমর শরীফ। ড্রাইভিং সিটে ইঞ্জিন চালু করে চুপচাপ রওনা হয়ে গেল কিশোর।
.
‘চলো এবার আমাদের অভিযানে,’ মোবাইল হোমের দরজায় তালা দিল মুসা।
‘হুঁ, যাওয়া যাক,’ সায় দিল রবিন।
হাঁটতে লাগল দুই বন্ধু। তিন মিনিট পেরুনোর আগেই পৌঁছে গেল রাসেল ভালদারেজের ক্যাম্পে।
মোবাইল হোমের দরজায় টোকা দেয়ার আগেই কবাট খুলে বেরিয়ে এল তরুণ। হাসি-হাসি মুখে বলল, ‘আরে, কেমন লাগল তোমাদের ক্লাইমিং?’
‘ভাল না,’ বলল রবিন।
‘কেন?’ আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল ভালদারেজ, ‘দেখতে পাওনি ক্যাকটাস ডাকাত?’
‘পরে বলব,’ জানাল মুসা। ‘আগে দেখান আপনার তৈলচিত্র। ওগুলো দেখার ফাঁকে বলব আমাদের অভিযানের কথা।’
‘হঠাৎ আমার আঁকা ছবি দেখতে চাইছ যে?’ ঠাট্টার সুরে বলল ভালদারেজ। অবশ্য এক মুহূর্ত পর বুঝল রবিন ও মুসা সিরিয়াস। আস্তে করে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল তরুণ। চট্ করে একবার দেখল মোবাইল হোমের ভিতর।
রবিন ও মুসা খেয়াল করেছে, এখন গায়ে পড়া আচরণ করছে না সে।
‘আমি আর কী বলব?’ কাঁধ ঝাঁকাল ভালদারেজ, ‘আজ পর্যন্ত কেউ আগ্রহ নিয়ে দেখতে চায়নি… ঠিকাছে, এসো।’ হাতের ইশারা করে আবারও মোবাইল হোমে ঢুকে পড়ল তরুণ।
মুসার পর পর চাকাওয়ালা বাড়িতে ঢুকল রবিন।
দেয়ালের পাশে একের পর এক ঠেস দিয়ে রাখা রয়েছে তৈলচিত্র। কিচেন টেবিল ভরে গেছে, খোলা সব কাবার্ডের দরজার হ্যাণ্ডেল থেকে ঝুলছে পেইণ্টিং।
সবই মরুভূমির।
সূর্য উঠছে-ডুবছে, পাহাড়, ক্যাকটাস ও ঝোপঝাড়।
‘তা হলে এসব আপনার তৈলচিত্র?’ বলল রবিন।
ভীষণ হতাশ হয়েছে মুসা।
দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরে মাথা দোলাল রাসেল ভালদারেজ।
কয়েকটা পেইণ্টিঙে চোখ বোলাল রবিন।
দরজার কাছে তৈলচিত্রের পুরু বাণ্ডিল।
কিছু ঝুলছে ক্যানভাসে।
সিঙ্কে মস্ত এক ডিনার প্লেট, মেখে আছে নানান রঙে।
আরেকটা ডিনার প্লেটে দারুণ ক্যাকটাসের বাগান এঁকেছে ভালদারেজ।
মোবাইল হোমের ভিতর সতর্ক নজর বোলাল রবিন ও মুসা।
এমন কিছু নেই যে কারণে মনে হবে ডোনাল্ড ওয়াইলির সঙ্গে ভালদারেজের সম্পর্ক আছে, বা ক্যাকটাস ডাকাতি করে সে।
‘আপনি অনেক ছবি এঁকেছেন,’ নীরবতা ভাঙল মুসা।
‘তা ঠিক,’ বলল ভালদারেজ। ‘আসলে টুকসনের ইউনিভার্সিটির আর্ট স্কুলে এখন থাকার কথা আমার। কিন্তু কী করব, ফুরিয়ে গেছে টাকা। আমার এক বন্ধু ধার দিয়েছে এই পুরনো মোবাইল হোম, আর বলতে পারো বাধ্য হয়েই আশ্রয় নিয়েছি এখানে। সবচেয়ে কম খরচে এই পার্কে থাকা যায়। টাকা জোগাড় করতে পারলে আবারও আর্ট স্কুলে ফিরব।’
‘আপনি কোনও চাকরি জুটিয়ে নিলে ভাল হতো না?’ জানতে চাইল মুসা।
‘চেষ্টা করিনি তা নয়, কিন্তু কেউ চাকরি দিতে চায় না,’ বলল ভালদারেজ। ‘আমার মনে হয়েছে: শহরের ক্ষুধার্ত শিল্পী হওয়ার চেয়ে মরুভূমিতে ক্ষুধার্ত শিল্পী হওয়া ঢের রোমাণ্টিক কাজ।’
‘আপনার ছবিগুলো কিন্তু সত্যিই ভাল,’ অন্তর থেকেই বলল রবিন।
ওরা বুঝে গেছে, আসলেই রাসেল ভালদারেজ আর্টিস্ট। তবে এমনও হতে পারে, সে জড়িত ক্যাকটাস ডাকাতির সঙ্গে।
খিদের জ্বালায় মানুষ কী-ই না করে!
‘আমার ছবি তোমাদের কাছে ভাল লেগেছে শুনে খুশি হলাম, ‘ বলল ভালদারেজ। ‘যাই হোক, এবার বলো রাতে কী করলে?’
‘নিশ্চয়ই বলব,’ চট করে বলল রবিন। ‘কিন্তু তার আগে বলুন, কীভাবে পরিচয় হলো ডোনাল্ড ওয়াইলির সঙ্গে।’
‘ক্ব-কী বললে?’ চমকে গেল ভালদারেজ।
চাপ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে বলল মুসা, ‘কেমন করে চিনলেন ডোনাল্ড ওয়াইলিকে? আমাদের মনে হয়েছে আপনারা দু’জন ঘনিষ্ঠ বন্ধু।’
‘কীভাবে যে পরিচয় হলো, মনে করতে পারছি না,’ বলল ভালদারেজ। একটু দ্বিধা নিয়ে আবারও বলল, ‘তবে পরিচয়টা হয়েছিল ক্যাম্প গ্রাউণ্ডেই। কী কাজে এসেছিল একদিন এদিকে।’
‘গতকাল টিলা থেকে নেমে কী করেছেন?’ জানতে চাইল মুসা।
‘কিছুই না,’ মাথা নাড়ল ভালদারেজ। ‘কেন, ঘুরে দেখেছি চারপাশ।’
‘আমরা হয়তো খুব বোকা নই, ভালদারেজ,’ নরম স্বরে বলল রবিন। ‘আমরা জানি আপনি ওয়াইলির সঙ্গে কথা বলেছেন।’
‘তোমরা জানলে কী করে…’ চুপ হয়ে গেল ভালদারেজ। কয়েক মুহূর্ত, পর বলল, ‘সত্যি, তোমরা ভাল গোয়েন্দা। ঠিকাছে, খুলেই বলছি। পার্কে ঘুরতে ঘুরতে একদিন খাতির হয়ে গেল ডোনাল্ড ওয়াইলির সঙ্গে। খুব কঠিন মানুষ, খুব কম কথা বলে। এই সেদিন ওয়াইলিকে বললাম তোমরা গোয়েন্দা, আর সন্দেহ করছ ওকে। তারপর গতকাল চোখ রাখতে চাইলে ওয়াইলির ওপর। টিলা থেকে নেমে ওকে বললাম কেন তোমরা গেছ। পরে যখন প্রফেসরের সঙ্গে দেখা করতে গেলে, সে সুযোগে পাথরের চাঙড় দিয়ে চিহ্ন দিলাম, যাতে তোমাদের সন্দেহ গিয়ে পড়ে প্রফেসরের ওপর।’
দরজার কাছে গিয়ে কবাট খুলে ফেলল রবিন, জিজ্ঞেস করল, ‘এ কাজ কেন করলেন?’
‘কারণ আমি জানি ডোনাল্ড ওয়াইলি সম্পূর্ণ নিরাপরাধ। চাই না বিপদে ফেলা হোক ওকে। সে একাকী মানুষ, আমারই মত, আর আমাদের মত লোক একে অপরের উপকারে আসবে এটাই তো স্বাভাবিক।’
‘ভালদারেজ, আপনি এই কেস নিয়ে আলাপ করেছেন ওয়াইলির সঙ্গে— এটা জানলে আপনাকে পার্কে থাকতে দেবেন না হেড রেঞ্জার রায়ান,’ বলল রবিন। ‘আমাদেরকে তদন্ত থেকে সরিয়ে দিয়েছেন তিনি। সতর্ক থাকুন, কাউকে একটা কথাও বলবেন না এই তদন্তের বিষয়ে। এমনিতেই ক্ষতি যা হওয়ার হয়েছে।’
চুপ করে আছে মুসা। ওর মনে পড়ল, গোপনে তদন্ত করতে চেষ্টা করেছে হেড রেঞ্জার ফিলিপ রায়ান। হয়তো সফলই হতো, কিন্তু মুখ খুলেছে রাসেল ভালদারেজ।
ওদের আর কিছু করার নেই, বুঝতে পারছে রবিন ও মুসা।
ঊষর মরুভূমিতে মানুষ নামের ওই কয়োটিগুলোকে ধরতে পারল না ওরা।
‘চলি, পরে দেখা হবে,’ বলে সিঁড়ি বেয়ে নেমে পড়ল রবিন।
চুপচাপ ওর পাশে হাঁটতে লাগল মুসা, মন খারাপ।
.
অ্যাজো শহরের কাছে পৌঁছে গেছে ওদের গাড়ি। ভালদারেজ র্যাটলস্নেকের ব্যাপারে লিলিয়ানের বাবাকে সন্দেহ করেছিল বলে এইমাত্র মেয়েটির কাছে দুঃখপ্রকাশ করেছে কিশোর।
‘জানি রাসেল ভালদারেজ বদ্ধ-উন্মাদ, তোমরা তার মত নও, ‘ বলল লিলি। ‘জানি, বিশেষ করে তোমার ওপর পুরো ভরসা রাখা যায়।’ রিয়ারভিউ মিররে চোখ রাখল কিশোর।
মুচকি মুচকি হাসছে ওমর শরীফ।
প্রশংসা পেয়ে লজ্জায় লাল হয়ে গেল কিশোরের দুই গাল।
‘আমার বাবা খুব পরিশ্রম করেন,’ বলল লিলি। ‘আমার মা’র ভীষণ কঠিন আরথ্রাইটিস আছে, চিকিৎসা করাতে হচ্ছে নার্সিং হোমে রেখে। তাতে মেলা খরচ। আগে এমন ছিলেন না বাবা, কিন্তু মা’র চিকিৎসার জন্যে টাকা জোগাড় করতে না পেরে… খুব চিন্তা করতে করতে…’ চুপ হয়ে গেল মেয়েটা। একটু পর সামলে নিয়ে বলল, ‘কেউ বুঝবে না কেন এমন হয়ে গেলেন বাবা। এখন যদি ওঁর এবং আমার চাকরিটাও চলে যায়…’ আর একটা কথাও বলল না লিলি, চেয়ে রইল রাস্তার দূরে।
‘আগে তোমার কথাগুলো স্পষ্ট বুঝিনি, এখন জানি কেন স্কুল বাদ দিয়ে চাকরি করছ,’ বলল কিশোর। কেন যেন খারাপ হয়ে গেল ওর মনটা।
শহরে ঢুকবার আগে একটা অটো পার্টসের দোকানে থামল কিশোর।
ওর বাবার পিকআপের ফিল্টার কিনল লিলি।
ফিউয়েল লাইনের পাইপ নিল ওমর।
আবারও শহর লক্ষ্য করে রওনা হওয়ার পর লিলি বলল, ‘কিশোর, ক্যাম্প গ্রাউণ্ডে বলছিলে কালপ্রিটদের কথা। এর সঙ্গে তোমাদের মোবাইল হোমের র্যাটলস্নেকের সম্পর্ক আছে?’
কিশোরের মন বলছে লিলি ভাল মেয়ে, কোনও অপরাধের সঙ্গে জড়িত নয়— কিন্তু কখনও কখনও তদন্ত করতে গিয়ে দেখা যায়, আপাত সরল মানুষ আসলে ভয়ঙ্কর অপরাধী। কাজেই কিশোর ঠিক করল, স্পষ্ট জবাব দেবে না।
‘আচ্ছা, লিলি, তুমি কি গতকাল বিকেলে আমাদের ক্যাম্প সাইটের আশপাশে কাউকে দেখেছ?’ জানতে চাইল ও।
‘গতকাল এ কথাই বলতে চেয়েছিলাম,’ বলল লিলি, ‘তখনই বাধা দিল ভালদারেজ। তোমরা ফেরার একটু আগে তোমাদের ক্যাম্পে এসেছিল চিকন এক লোক, মাথায় কাউবয় হ্যাট। হয়তো সে রেখেছে র্যাটলস্নেক। …অবশ্য ওই সাপ রাখতে হলে মরুভূমি সম্পর্কে অনেক জ্ঞান থাকতে হবে তার।’
‘একটু খোলাসা করে বলবে?’ জানতে চাইল ওমর।
‘জানুয়ারি মাসে র্যাটলকে খুঁজে আনতে হলে সত্যিকারের মরুভূমির ইঁদুর হতে হবে,’ বলল লিলি, ‘এখন ওরা হাইবারনেট করে।’
‘ওই লোকের যে বর্ণনা দিলে তুমি, তার সঙ্গে মিলবে হাজার মানুষের,’ একটু হতাশ হয়েছে কিশোর।
গাড়ি চলেছে অ্যাজোর প্রধান সড়ক ধরে।
সামনেই চারকোনা এক প্লাযা।
বাদামি শুকনো ঘাস মাড়িয়ে হাঁটছে বয়স্করা।
খেলছে বাচ্চারা।
পুরুষদের পরনে নীল জিন্স।
যারা দোকান-রেস্টুরেন্ট চালাচ্ছে, তাদেরও ওই একই পোশাক।
অনেকেই আমেরিকার আদি বাসিন্দা— রেড ইণ্ডিয়ান। মাথায় কাউবয় হ্যাট বা বেসবল ক্যাপ।
‘ওই যে লোকটা জিপে উঠছে, তার সঙ্গেও বর্ণনা মিলবে তোমার বলা লোকটার,’ বলল কিশোর। ‘আবার রাস্তার ওদিকের ওই লোকটা… বা রেস্টুরেন্টে যে লোকটা ঢুকছে…’
‘আরেহ্!’ চমকে গিয়ে আঙুল তাক করল লিলি। ‘কিশোর! ওই যে! ওই লোক!’