মরহুম মৌলানা
মরহুম (স্বর্গত) মৌলানা আবুল-কালাম মহীউদ্দীন আহমদ আল আজাদ সম্ভ্রান্ত বংশের যোগ্য সন্তান। এ বংশের পরিচয় এবং বিবরণ বাদশা আকবরের আমল থেকে পাওয়া যায়।
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে এঁর পিতা জড়িয়ে পড়েন। দিল্লির ওপর ইংরাজের বর্বর অত্যাচার আরম্ভ হলে পর তিনি তার অন্যতম ভক্ত রামপুরের নবাবের সাহায্যে মক্কা শরিফে গিয়ে আশ্রয় নেন। সেখানে তিনি এক আরব কুমারীকে বিবাহ করেন। আবুল কালাম এই বিবাহের সার্থক সন্তান।
তাঁর মাতৃভাষা আরবি, পিতৃভাষা উর্দু। পরবর্তী যুগে তিনি ফারসি এবং তুর্কিতেও অসাধারণ পাণ্ডিত্য সঞ্চয় করেন। ইংরেজি থেকেও তিনি সে সঞ্চয়ে সাহায্য গ্রহণ করেছেন। তবে এদেশে ফেরার পর তিনি উর্দু সাহিত্যের এমনি একনিষ্ঠ সাধক ও প্রেমিক হয়ে যান যে শেষের দিকে আরবি বা ফারসিতে নিতান্ত বাধ্য না হলে কথাবার্তা বলতেন না।
তাঁর বয়স যখন দশ তখন তাঁর পিতা ভারতবর্ষে ফিরে আসেন। সমগ্র ভারতবর্ষেই তাঁর বহু শিষ্য ও ভক্ত ছিলেন। এই কলকাতা শহরেই তার প্রচুর অনুরাগী শিষ্য ছিলেন এবং তাদেরই অনুরোধে তিনি এখানে স্থায়ী বাসভবন নির্মাণ করেন। পুত্র আবুল কালাম এখানেই তাঁর শিক্ষা সমাপ্ত করেন। তাঁর পরলোকগমনের পর বেতারে যে একাধিকবার বলা হয়, তিনি মিশরের অল আজহর বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন সে সংবাদ ভুল। উপরন্তু মৌলানা সাহেব নিজেকে সবসময়ই কলকাতার অধিবাসী ও বাঙালি বলেই পরিচয় দিয়েছেন। বাঙলা তিনি বলতেন না, কিন্তু বাঙলা কথোপকথনের মাঝখানে তিনি উর্দুতে প্রশ্নোত্তর করতেন এবং কিছুক্ষণ পর কারওই খেয়াল থাকত না যে তিনি অন্য ভাষায় কথা বলছেন।
চৌদ্দ বছর বয়সেই তিনি ‘লিসান উল্-সিদক’ (সত্য-বচন) নামক কাগজের সঙ্গে সংযুক্ত হন এবং অতি অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর খ্যাতি ভারতবর্ষের সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ে। চব্বিশ বৎসর বয়সে তার ‘অল্ হিলাল’ (অর্ধচন্দ্র) পত্রিকা ইংরেজের মনে ভীতির সঞ্চার করতে আরম্ভ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পর তাঁর কাগজ ইংরেজের শত্রু তুর্কি এবং মুসলিম বিশ্ব-আন্দোলনের অকুণ্ঠ প্রশংসা করার ফলে তাঁকে অন্তরীণ হতে হয়। মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি মহাত্মা গান্ধী ও অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে সংযুক্ত হন এবং সে আন্দোলনের সঙ্গে সাদ জগলুল পাশার মিশরের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং গাজী মুস্তফা কামাল পাশার তুর্কির নবজাগরণের সঙ্গে সেতু নির্মাণ করেন।
এরপরের ইতিহাস ভারতীয় মাত্রই জানেন।
শ্বেত সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ এবং বিশ্ব-মুসলিম প্রেম মৌলানা আজাদের পরিবারের অবিচ্ছিন্ন অংশরূপে গণ্য করা হত। তিনি জন্মগ্রহণ করেন মক্কায়– যেখানে হজ উপলক্ষে বিশ্বের তাবৎ মুসলিম প্রতি বৎসর সম্মিলিত হয়ে প্রাচ্যভূমি থেকে কী করে শ্বেতাঙ্গ ও শ্বেত-স্বৈরাচার দূরীভূত করা যায় তার পরিকল্পনা করত এবং ভারত, মালয়, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশকে আপন কর্তব্য ও জিম্মাদারি ভাগ করে দেওয়া হত। এ পরিকল্পনা কোনও বিশেষ দেশে সীমাবদ্ধ ছিল না বলে একে ন্যাশনালিজম না বলে প্যান্ইসলামিজম (বিশ্ব-মুসলিম-সংহতি) নামে পূর্ব-পশ্চিম সর্বত্রই সুপরিচিত ছিল। দশ বৎসর বয়স পর্যন্ত মৌলানা এ মন্ত্রই অহরহ শুনেছিলেন।
কলকাতা আসার সঙ্গে সঙ্গেই মৌলানার পরিবর্তন আরম্ভ হয়। একথা সত্য যে বিশ্ব-মুসলিমের প্রতি তাঁর দরদ কখনও শুকিয়ে যায়নি, কিন্তু ক্রমে ক্রমে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় উৎসাহ ও উদ্দীপনার উৎস হয়ে উঠল স্বদেশপ্রেম। উর্দু ভারতবর্ষের ভাষা। তাঁর মাতৃভাষা আরবিকে তার জীবনাদর্শ এবং রাজনৈতিক সাধনার মাধ্যমরূপে গ্রহণ না করে তিনি সর্বান্তঃকরণে বরণ করে নিলেন উর্দুকে। এ বড় সহজ কুরবানি বা আত্মবিসর্জন নয়। স্বাধীনতা সংগ্রামের যুগেই শুধু নয়, আজও দেখতে পাই বহু লোক স্বার্থলাভের জন্য স্বদেশি ভাষা বর্জন করে বিদেশি ভাষার সাধনা করেন এবং আমাদের মতো বাঙালি তাঁদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে না বলে আমাদের প্রতি রুষ্ট হন।
এবং সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি, এই উর্দু গ্রহণের জন্য জীবনসায়াহ্নে মৌলানাকে আবার অকরুণ কটুবাক্য শুনতে হল সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকমণ্ডলীর কাছ থেকে। হিন্দি ভাষা কেন রাতারাতি ভারতবর্ষের তাবৎ ভাষার কণ্ঠরুদ্ধ করে ‘জাতীয় ভাষা’ রূপে জগদ্দল প্রতিমার মতো ভারতের মন্দিরে মন্দিরে পূজা পাচ্ছেন না, অপেক্ষাকৃত অনুন্নত শিশু ভাষাগুলোকে কেন কচি কচি পাঁঠার মতো তাঁর সামনে বলি দেওয়া হচ্ছে না, তার কারণ অনুসন্ধান করে তাঁরা আপন ‘বুদ্ধি’তে আবিষ্কার করলেন ‘হিন্দি-বিদ্বেষী’ ‘হিন্দি-ভাষাকা কট্টর দুশমন’ মৌলানা আজাদকে। যেহেতু মৌলানা উর্দু-ভাষী তাই তিনি শিক্ষামন্ত্রীরূপে হিন্দির প্রচার এবং প্রসার কামনা করেন না– এই হল তখন তাদের ‘যুক্তি’। হিন্দি যে দুর্বল, কমজোর ভাষা সেকথা স্মরণ করবার অস্বস্তিকর প্রয়োজন কেউ বোধ করলেন না। পণ্ডিত নেহরুও যে উর্দুভাষী একথা বলতে তাঁরা সাহস পেলেন না– একথা বললে উভয়ের হৃদ্যতা বেড়ে যাবে যে!
মাত্র একবার মৌলানা লোকসভায় তাঁর বক্তব্য সুস্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করেছিলেন। এবং যাঁরা সেদিন এই সভায় ছিলেন তাঁরা সবাই দেখেছিলেন মৌলানার আবেগময়ী আন্তরিক বক্তৃতার ফলে প্রতিপক্ষ কীরকম লজ্জায় আধোবদন হয়েছিলেন- শত্রু-মিত্র কারও দিকেই মুখ তুলে তাকাবার সাহস পর্যন্ত সেদিন তাদের আর হয়নি।
জগলুল পাশা, কামাল আতাতুর্কের সঙ্গে মৌলানার পত্রবিনিময় সবসময়ই ছিল, কিন্তু মৌলানা ক্রমে ক্রমে তাঁর সমস্ত শক্তি নিয়োগ করলেন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে। সেই ইতিহাস লেখবার শক্তি আমার নেই; আমি শুধু এস্থলে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, মক্কা শরিফের প্যান-ইসলামি বালক যৌবনে পরিপূর্ণ জাতীয়তাবাদী হয়ে গেল। মৌলানার যেসব বিপক্ষ দল একদা মুসলিম জাহানের স্বপ্ন দেখতেন তাঁরা পর্যন্ত আজ কঠিন অভিজ্ঞতার স্বাদ পেয়ে বুঝতে পেরেছেন, সে স্বপ্ন গেছে– এখন তাঁরা পুরো পাকিস্তানি হয়ে গিয়ে জাতীয়তাবাদের আদর্শই বরণ করেছেন। দুঃখ এই, তাঁরা এ আদর্শটি কয়েক বৎসর আগে বরণ করে নিলেই তাদের মঙ্গল, আমাদের মঙ্গল, সকলেরই মঙ্গল হত।
এস্থলে কিন্তু আরেকটি বিষয় লক্ষ করা উচিত।
স্বরাজলাভের পর মৌলানা তাঁর জাতীয়তাবাদ বিশ্ব-মানবের কল্যাণে নিয়োগ করেছিলেন। দেশপর্যটন মৌলানা অত্যন্ত অপছন্দ করতেন, কিন্তু বিশ্বজনের সঙ্গে সক্রিয় যোগস্থাপনার জন্য তিনি কয়েক বৎসর পূর্বে পাকিস্তান-ইরান হয়ে ইয়োরোপে যান– পূর্বে বহুবার বহু দেশে নিমন্ত্রিত হয়েও যাননি। এবং সবচেয়ে বড় কথা, জাতিসজ সম্মেলন (ইউ.এন.ও.) এবং তার ভিন্ন ভিন্ন শাখার যে প্রতিনিধি ভারতে এসেছেন তাঁরা তাঁদের সর্বোত্তম সখারূপে চিনতে শিখলেন মৌলানা আজাদকে। তাঁরা আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, যে মৌলানা ইংরেজের বিরুদ্ধে তিক্ততম লড়াই করেছেন আজীবন, তার ভিতর সে তিক্ততা আর নেই। ইংরেজ হোক, মার্কিন হোক আর রুশই হোক, যেজন বিশ্বকল্যাণের জন্য সম্মুখীন হয়, তার বহু দোষ থাকলেও সে আজাদের বন্ধুজন। এবং আরও আশ্চর্য! ইংরেজ দেখে, মৌলানা ইংরেজি না বলেও ইংরেজের মিত্র, রাশা দেখে, তার ভাষা না জেনেও অন্যের তুলনায় মৌলানা রাশাকে চেনেন অনেক বেশি। তিনি তাদের সঙ্গে কথা বলতেন উর্দুতে, কিন্তু সে উর্দু তো উর্দু নয়। সে উর্দু বিশ্বপ্রেমের সর্বজনীন ভাষা, কিংবা বলব, বিশ্বপ্রেমের ভাষা উর্দুর মাধ্যমে স্বপ্রকাশ হল। একদা তিনি আরবি বর্জন করে উর্দু গ্রহণ করেছিলেন; এখন তিনি উর্দু বর্জন করে অন্য এক ভাষা গ্রহণ করেছেন, যার নামকরণ এখনও হয়নি, কারণ সে ভাষাতে কথা বলতে আমরা এখনও শিখিনি।
অথচ তাঁর জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তাঁরই নির্দেশ অনুযায়ী চলত তিনখানি ত্রৈমাসিক। প্রথমখানি আরবিতে– আরবভূমির সঙ্গে ভারতের সাংস্কৃতিক যোগসূত্র স্থাপনা ও প্রাচীন যোগ দৃঢ়তর করার জন্য, দ্বিতীয়-খানা ফারসিতে– ইরান ও আফগানিস্তানের জন্যে; তৃতীয়খানা ইংরেজিতে বৌদ্ধ জগতের সঙ্গে যোগস্থাপনা করার জন্য (বৌদ্ধভূমি এক ভাষায় আশ্রিত নয় বলে তিনি মাধ্যমরূপে ইংরেজি গ্রহণ করেছিলেন)। এই তিনটি পত্রিকাই ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনস দিল্লি থেকে প্রকাশিত হয় এবং মৌলানা ছিলেন তার প্রধান। শুধু প্রধান বললেই যথেষ্ট বলা হয় না কোন দেশে কখানি পত্রিকা যাবে সেটুকু পর্যন্ত তার নির্দেশানুযায়ী হত। আজ ভাবি, এ সবকটি পত্রিকার নীতি-নির্দেশ, মানরক্ষা, তাদের সামঞ্জস্য রক্ষা করতে পারে এমন সর্বগুণ মেশানো আরেক পণ্ডিত পাওয়া যাবে কোথায়? ভারতবর্ষের ভিতরে, বাইরে?
বস্তুত আসলে এ লোকটি হৃদয় এবং মস্তিষ্কের অন্তস্তলে ছিলেন পণ্ডিত। স্বাধীন মক্কা ত্যাগ করে পরাধীন ভারতে না এলে তিনি যে রাজনীতির চতুঃসীমানায় যেতেন না, সেকথা আমি স্থিরনিশ্চয় জানি। স্বাধীনতা লাভের পরও তিনি জ্ঞানমার্গেই ফিরে যেতেন কিন্তু দেশে তখন (এবং এখনও) উপযুক্ত লোকের অভাব। মৌলানা কখনও কর্তব্য অবহেলা করতে চাইতেন না। এমনকি যখন তার বিরুদ্ধপক্ষ মুখর হয়ে উঠতেন, এবং আমরা ভাবতুম তিনি পদত্যাগ করলেই পারেন, এখনও তিনি কর্তব্যবোধের দায়েই আপন কাজ করে যেতেন- লোকনিন্দার তোয়াক্কা-পরোয়া না করে। পূর্বেই বলেছি, মাত্র একবার তিনি হিন্দিওয়ালাদের কর্কশ-কণ্ঠে ব্যথিত হয়ে, আপন কাহিনী নিবেদন করেছিলেন। এ অবসরে আরেকটি ঘটনা মনে পড়ল। সেটা কিন্তু কিঞ্চিৎ হাস্যরসে মেশানো।
বিরুদ্ধ দল শিক্ষা-দফতরের বিরুদ্ধে দুনিয়ার তাবৎ অভিযোগ-ফরিয়াদ জটল্লা করে শেষটায় বলল, ‘শিক্ষা-দফতরের দ্বারা কিছুই হবে না তাদের মগজের বাক্সটি (ব্রেনবটি ) একদম ফাঁপা।’
মৌলানা স্পর্শকাতর লোক– পণ্ডিতগণ সচরাচর তা হন। উষ্মা প্রকাশ করে তিনি কিন্তু দাঁড়ালেন হাস্যমুখে। বার কয়েক ডান হাত দিয়ে মাথার ডান দিক চাপড়ে বললেন, না জি, এখানে তো আছে’, তার পর হাত নামিয়ে নিয়ে দীর্ঘ আগুলফলম্বিত আচকানের ডান পকেটে থাবড়া মারতে মারতে বললেন, ‘এখানে নেই, এখানে কিছু নেই।’ অর্থাৎ মগজে মাল যথেষ্ট আছে, কিন্তু পকেটে কিছুই নেই। তার আরও সরল অর্থ, কেবিনেট শিক্ষাবিভাগকে যথেষ্ট পয়সা দেয় না।
পূর্বেই বলেছি, মৌলানা আসলে পণ্ডিত। কর্তব্যের তাড়নায় তিনি প্রবেশ করেছিলেন রাজনৈতিক মল্লভূমিতে অতি অনিচ্ছায়। তার সে পাণ্ডিত্যের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দিতে আমার কুণ্ঠা বোধ হচ্ছে, কারণ তার সে পাণ্ডিত্য-সায়রে সন্তরণ করার মতো শক্তি আমার নেই।
আরবি এবং সংস্কৃত জ্ঞানচর্চায় বহু সাদৃশ্য রয়েছে। তার প্রধান মিল, উভয় সাহিত্যের পণ্ডিতগণই অত্যন্ত বিনয়ী। কারও কোনও নতুন কিছু বলার হলে কোনও প্রাচীন ধর্মগ্রন্থের সাহায্যে তারা সেটি প্রকাশ করেন। লোকমান্য টিলক গীতার ভাষ্য লিখে সপ্রমাণ করলেন, কর্মযোগই সর্বশ্রেষ্ঠ যোগ এবং এদেশ থেকে ইংরেজকে বিতাড়নই সর্বশ্রেষ্ঠ কর্ম; মহাত্মা গান্ধী তাঁর গীতাভাষ্য দিয়েই প্রমাণ করতে চাইলেন যে অহিংসাই সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম, এবং শ্রীঅরবিন্দ গীতাপাঠ লিখে প্রমাণ করতে চাইলেন যে জ্ঞানযোগের দ্বারা চিত্তসংযম আত্মজয় করতে পারলেই স্বাধীনতা লাভ অনিবার্য। মৌলানা আজাদ তাঁর ‘কুরান ভাষ্য’ দিয়ে বিশ্ব-মুসলিমকে মুক্ত করতে চাইলেন তার যুগ-যুগ সঞ্চিত অন্ধসংস্কার এবং ক্রিয়াকাণ্ডের সংকীর্ণ গণ্ডি থেকে। এবং তারই সঙ্গে সঙ্গে অতি কৌশলে তিনি তাকে তার কর্তব্য কোন দিকে সেইটে সহজ সরল ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন।
এ ভাষ্য তিনি অনায়াসেই আরবিতে লিখতে পারতেন, এবং আরবি ভাষার মাধ্যমে তিনি পাঠকসংখ্যা পেতেন উর্দুর তুলনায় অনেক, অনেক বেশি। দ্বিতীয়, কুরান আরবি ভাষায় লেখা, এবং তাবৎ বিশ্বমুসলিম আরবিতেই তার ভাষ্য লিখে আসছে (গীতার ভাষ্য যেরকম এক শতাব্দী পূর্বেও সংস্কৃতেই রচিত হয়েছে) তৃতীয়ত, মুসলিম-জাহানের কেন্দ্রভূমি মক্কার ভাষা আরবি, চতুর্থত, সে ভূমি আজাদের জন্মস্থল– আপন জন্মস্থলে যশ প্রতিষ্ঠা করতে চায় না কোন পণ্ডিত?
এ সমস্ত প্রলোভন উপেক্ষা করে মৌলানা তার তফসির ভাষ্য লিখলেন উর্দুতে। মক্কাতে জন্ম নিয়েছিল তাঁর দেহ, কিন্তু তাঁর চৈতন্য এবং হৃদয় গ্রহণ করেছিল তাঁর পিতৃ-পিতামহের ভূমি ভারতকে স্বদেশরূপে। তাই স্বদেশবাসীর জন্য তাঁর ভাষ্য লিখলেন উর্দুতে (টিলকও ইচ্ছা করলে তার ভাষ্য সংস্কৃতে লিখতে পারতেন। কিন্তু লিখেছিলেন মারাঠিতে। পরবর্তী যুগে আজাদ-ভাষ্য আরবিতে অনূদিত হয়, এবং তখন আরব-ভূমিতে সে ভাষ্যের যে জয়ধ্বনি উঠেছিল তা শুনে ভারতীয় মাত্রই না কী গর্ব, কী শ্লাঘা অনুভব করেছিল। পাকিস্তানিরাও এই পুস্তক নিয়ে গর্ব অনুভব করেন। তাঁরা পাকিস্তান যাবার সময় তাজমহল ফেলে যাওয়ার মতো কিন্তু এ ভাষ্য ভারতে ফেলে যাননি। ১৯১৭-এর পরও আজাদ-ভাষ্য লাহোর শহরে লক্ষাধিক সংখ্যক ছাপা এবং বিক্রি হয়েছে।
পাণ্ডিত্য ও সাহিত্য সচরাচর একসঙ্গে যায় না। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে মুগ্ধ হয়েছি মৌলানার সাহিত্য রসবোধে, সাহিত্যসৃষ্টি দেখে। মৌলানার সঙ্গে লোকমান্য টিলকের বহু সাদৃশ্য বর্তমান, কিন্তু টিলকের চরিত্রে ছিল দার্ঢ্য, মৌলানার চরিত্রে ছিল মাধুর্য, টিলককে যদি বলা হয় কট্টর কঠিন শৈব, তবে মৌলানাকে বলতে হয় মরমিয়া মধুর বৈষ্ণব। কারণ মৌলানা ছিলেন সুফি অর্থাৎ ভক্ত রহস্যবাদী (মিসটিক)। তাঁর সাহিত্যের উৎস ছিল মাধুর্যে, এবং কে না জানে মধুর রসই সর্বশ্রেষ্ঠ রস।
তাই তাঁর চেহারায় ছিল লাবণ্য, কুরান-ভাষ্যের মতো পণ্ডিত্যপূর্ণ পুস্তকে মাধুর্য, এবং তাঁর বক্তৃতায় অদ্ভুত অবর্ণনীয় সরলতার সৌন্দর্য।
কিন্তু তাঁর যে সরল সৌন্দর্যবোধ তার পরম প্রকাশ পেয়েছে তাঁর রম্য রচনাতে। উর্দুতে এরকম রচনা তো নেই-ই, বিশ্বসাহিত্যে এরকম সহৃদয় রসে ভরপুর লেখা খুঁজে পাইনে। তার সঙ্গে বাঙালি পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেওয়া বক্ষ্যমাণ অক্ষম লেখকের সাধ্যাতীত।
তবে এই শোকের দিনে একটি সান্ত্বনার বাণী জানাই। সাহিত্য আকাদেমি এ পুস্তকের বাঙলা অনুবাদকর্মে লিপ্ত হয়েছেন। কিন্তু এর সঙ্গে একটি সাবধানবাণীও শুনিয়ে রাখি। সে অনুবাদে বাঙালি পাবে কাশ্মিরি শালের উল্টো দিকটা। পাবে মূলের অসম্পূর্ণ পরিচয়, এবং হয়তো পাবে, অসম্পূর্ণের উল্টো সম্পূর্ণ পরিচয় পাবার আকাঙ্ক্ষা। তাই যদি হয়, তবে হয়তো কোনও কোনও বাঙালির অনাদৃত উর্দু ভাষা শেখার ইচ্ছাও হতে পারে। আমাদের সে প্রচেষ্টা হয়তো শোকদুঃখের অতীত অমর্ত্য লোকে মৌলানা আবুল কালাম মহীউদ্দীন আহমদ আল-আজাদকে আনন্দ দান করবে।