মরণ-ফাঁদ

মরণ-ফাঁদ

মৃত্যুর রঙিন ফাঁদ!

ভাগ্যের পরিহাস!…

দুই বন্ধু যদি জানত যে পর্দার বুকে ডোরাডো মাছের সোনামাখা দেহের রং ছড়িয়ে মৃত্যু। তাদের জন্য অপেক্ষা করছে তাহলে নিশ্চয়ই তারা কলোন থেকে বিমানযোগে ব্রিটিশ গায়নার হাইড পার্ক নামক অঞ্চলের দিকে যাত্রা করত না…।

ঘটনাটা খুলেই বলছি–

আমেরিকার একটি ক্লাবঘরে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী দেখে মুগ্ধ হয়েছিল দুজন ইয়াংকি যুবক। উক্ত ছায়াচিত্রের প্রধান দ্রষ্টব্য ছিল অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারী একটি অসাধারণ মৎস্য

গোল্ডেন ডোরাডো
বা
সোনালি ডোরাডো মাছ!

ছায়াচিত্রের পর্দায় বহুবর্ণরঞ্জিত রঙিন ফিল্মের কল্যাণে সোনার বরণ ডোরাডো মাছের অঙ্গশোভা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল দুটি যুবক–তারা ঠিক করলে কয়েকটি ডোরাডো মাছকে তারা ছিপ ফেলে ধরবে। অতএব, কলোন থেকে রওনা হয়ে তারা অবতীর্ণ হল ব্রিটিশ গায়নার হাইড পার্ক অঞ্চলে। হাইড পার্ক নামক স্থানটির চতুর্দিকে বনভূমি ভেদ করে ছুটে গেছে বিভিন্ন নদীর জলধার এবং ওইসব নদীর জলে সাঁতার কেটে ঘুরে বেড়ায় অসংখ্য সোনালি মাছ গোল্ডেন ডোরাডো!

হার্মান বেয়ার ও জন পিঙ্কনাম নামের মানুষ দুটি মাছের সন্ধানে যথাস্থানেই উপস্থিত হয়েছিল বটে কিন্তু তারা জানত না যে গোলাপের সঙ্গে কাটার মতো সোনারং ডোরাডোর আশেপাশে নদীর জলে হানা দিয়ে ঘুরে বেড়ায় ক্ষুধিত মৃত্যুর জীবন্ত অভিশাপ

সে-কথা ক্রমশ প্রকাশ্য..

এসো কুইবো নদীর উপর দিয়ে একটি পুরাতন মোটরবোটে মৎস্য-শিকারের যাবতীয় সাজসরঞ্জাম চাপিয়ে দুই বন্ধু যেখানে এসে উপস্থিত হল সেই জায়গাটির নাম রকস্টোন। পূর্বোক্ত স্থান ছাড়িয়ে তারা আরও ভিতরের দিকে মোটরবোট চালিয়ে দিলে।

সন্ধ্যার একটু আগেই হল বিপত্তির সূত্রপাত।

মোটরবোটের ঘূর্ণায়মান প্রপেলার সবেগে ধাক্কা খেল জলের নীচে অদৃশ্য কোনো কঠিন বস্তুর সঙ্গে তৎক্ষণাৎ ঘটাং ঘট!

সশব্দে ভেঙে গেল প্রপেলারের একটি পাখা। জন চেঁচিয়ে উঠল, নিশ্চয় জলে-ডোবা কোনো পাথরে ধাক্কা লেগেছে… কী আশ্চর্য! কোনো পাথর-টাথর তো দেখতে পাচ্ছি না!

হার্মান বোটের উপর থেকে দৃষ্টিকে চালিত করলে নদীর বুকে

কয়েক ফিট নীচে পর্যন্ত যতদূর নজর যায় চোখে পড়ে শুধু জল আর জল, নিমজ্জিত কোনো প্রস্তরখণ্ডের অস্তিত্ব সেখানে নেই।

দুজনেই হতভম্ব!

কঠিন কোনো বস্তুর সঙ্গে ঘূর্ণিত প্রপেলারের সংঘাতে যে শব্দের সৃষ্টি হয়েছিল তারা দুজনেই সেই আওয়াজ শুনেছে, কিন্তু স্বচ্ছ জলের মধ্যে পাথর-টাথর তো কিছুই তাদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। না। দুই বন্ধু আবার ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে।

না কিছু নেই–মোটরবোটের প্রপেলার যতদূর নাগাল পায় ততদূর পর্যন্ত সব কিছুই দেখা যায় নদীর জলে, কিন্তু নিমজ্জিত কোনো প্রস্তরখণ্ড তাদের দৃষ্টিপথে ধরা দিল না।

রহস্যের সমাধান হল না। প্রপেলারে নূতন শেয়ার-পিন লাগিয়ে আবার তারা বোট ছুটিয়ে যাত্রা শুরু করলে। সেইদিনই তারা পৌঁছে গেল রেড-ইন্ডিয়ানদের একটি গ্রামের কাছে।

নদীর দুই ধারে এখন অরণ্যের রাজত্ব।

 বন হয়ে উঠছে ক্রমশ গভীর ও দুর্গম।

অজানা জায়গায় গভীর জঙ্গলের মধ্যে তাঁবু খাঁটিয়ে রাত্রিযাপন করার ইচ্ছা তাদের ছিল না; লোকালয়ের কাছে স্থানীয় অধিবাসীদের হাতে-গড়া একটা ছোটো ঘরে তারা এক রাতের জন্য আশ্রয় গ্রহণ করলে…।

পরদিন সকালে দুই বন্ধু আবার নদীর জলে মোটরবোট ভাসিয়ে দিলে। তারা শুনেছিল একটু দূরেই খরস্রোতা নদীর একটা বাঁকে ডোরাডো মাছের আড্ডা আছে। নির্দিষ্ট স্থান লক্ষ করে ছুটল মোটরবোট। কিন্তু নিশ্চিন্ত নৌবিহার তাদের ভাগ্যে ছিল না, আবার বিঘ্ন ঘটল।

কয়েক মাইল যেতে-না-যেতেই সশব্দে ভেঙে গেল প্রপেলারের শেয়ার-পিন।

মোটরযোটকে চালনা করছিল হার্মান আর জন তখন মাছ ধরার সরঞ্জাম সাজিয়ে রাখছিল। দুর্ঘটনার জন্য বন্ধুকে দায়ী করে জন ক্রুদ্ধকণ্ঠে বললে, তুমি কি চোখ বুজে বোট চালাও? আবার কীসের সঙ্গে ধাক্কা লাগল? শেয়ার-পিন আর কটা আছে শুনি?

হার্মান উত্তর দিলে না। মোটরবোটের গলুই-এর উবু হয়ে শুয়ে সে জলের ভিতরটা শ্যেনদৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল… প্রথমে কয়েকটা বুদ্বুদ ভেসে উঠল, তারপরই নদীর জলে জাগল গাঢ় লাল রং-এর আভাস রক্ত?

লাল রং-এর তরল ধারা যেখানে জলের উপর ভেসে উঠেছে সেই জায়গায় একটা আঙুল ডুবিয়ে দিলে হার্মান–তারপর সিক্ত অঙ্গুলিটিকে সে চোখের সামনে তুলে ধরলে…হ!রক্তই বটে!

জন! হার্মান চেঁচিয়ে উঠল, আমরা কোনো জীবন্ত প্রাণীর দেহে আঘাত করেছি। এই দেখো রক্ত!

সে জনের দিকে তার আঙুল বাড়িয়ে দিলে।

জন বন্ধুর রক্তমাখা আঙুল পরীক্ষা করার চেষ্টা করলে না, তার দৃষ্টি এখন মোটরবোটের পিছনদিকে নিবদ্ধ

জলের উপরিভাগে আত্মপ্রকাশ করেছে একটা ধূসর গাছের গুঁড়ি।

হ্যাঁ, গাছের গুঁড়ি বটে কিন্তু নিশ্চল নয়!

সেই জীবন্ত বৃক্ষকাণ্ড প্রচণ্ড বেগে আলোড়ন তুলেছে নদীর বুকে–তপ্ত রক্তধারায় লাল হয়ে উঠেছে নদীর জল!

কেম্যান!

ব্রিটিশ গায়নার জলরাজ্যের বিভীষিকা এই কেম্যান হচ্ছে কুম্ভীরবংশের সবচেয়ে হিংস্র, সবচেয়ে ভয়ংকর জীব!

স্তম্ভিত নেত্রে দুই বন্ধু কেম্যান-কুম্ভীরের মৃত্যুযাতনা দেখতে লাগল। প্রপেলারের ঘূর্ণিত শেয়ার-পিন কুমিরের মাথার পিছনে ঠিক ঘাড়ের উপর আঘাত করেছে

সরীসৃপের স্থূল ও কঠিন স্কন্ধদেশ ভেদ করে গ্রীবা পর্যন্ত কেটে বসেছে প্রপেলার এবং তারপরই প্রবল সংঘাতে ভেঙে গেছে যন্ত্র।

দুই বন্ধুই বুঝল কুমিরটা বেশিক্ষণ বাঁচবে না।

শেষ দৃশ্যের জন্য তারা অপেক্ষা করলে না, কোনোরকমে প্রপেলারে নতুন শেয়ার-পিন লাগিয়ে তারা অকুস্থল ত্যাগ করে সবেগে মোটরবোট চালিয়ে দিলে…

মোটরবোট চলছে, চলছে আর চলছে। দুই বন্ধু বসে আছে বোবার মতো। কেউ কথা কইছে না। হঠাৎ চলমান মোটরবোটের উপর থেকে নদীর ধারে একটি জায়গায় তাদের চোখ পড়ল, সঙ্গেসঙ্গে তাদের মেরুদণ্ড বেয়ে ছুটে এল আতঙ্কের শীতল স্রোত

কর্দমাক্ত তীরভূমির উপর শুয়ে আছে অনেকগুলো কেম্যান-কুম্ভীর।

মোটরবোটের শব্দে আকৃষ্ট হল কুমিরগুলো–দুই বন্ধু দেখল তীরবর্তী নকুলের চোখে চোখে জ্বলে উঠেছে হিংস্র ক্ষুধিত দৃষ্টি!

একটা মস্ত বড়ো কেম্যান হঠাৎ জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে বোট লক্ষ করে সাঁতার কাটতে লাগল দ্রুতবেগে।

খুব সম্ভব তার উদ্দেশ্য খারাপ ছিল না, হয়তো নবাগত অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাতে চেয়েছিল সে, কিন্তু দুই বন্ধু আতিথ্যের মর্যাদা রাখল না, এত জোরে তারা মোটরবোট ছুটিয়ে দিলে যে প্রাণপণে সাঁতার কেটেও কেম্যান তাদের নাগাল পেল না..

অনেক দূর এসে একটা বাঁকের মুখে নোঙর ফেলল তারা। দুই দুইবার ব্যর্থ চেষ্টার পর তৃতীয়বার ভাগ্যদেবতার কৃপা লাভ করলে হার্মান, একটা সোনালি রেখা বিদ্যুচ্চমকের মতো জল থেকে লাফিয়ে উঠে আবার নদীগর্ভে অদৃশ্য হল–গোল্ডেন ডোরাডো!

স্বর্ণখচিত দেহের অধিকারী ডোরাডো মৎস্য কেবল অসাধারণ রূপবান নয়, সে বিলক্ষণ শক্তিশালীও বটে। ছিপের সুতো টেনে সে ছুটতে লাগল তিরবেগে হার্মান তাকে খেলিয়ে তুলতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠল।

উত্তেজিত জন বন্ধুর পাশে দাঁড়িয়ে তাকে উৎসাহ দিতে লাগল–

এতক্ষণে তাদের চেষ্টা সফল হল, সোনা-রং-মাখা ডোরাডো মাছ এখনই এসে পড়বে তাদের হাতের মুঠোর মধ্যে…

হঠাৎ হার্মান অনুভব করলে ছিপের সুতো শিথিল হয়ে পড়েছে, ডোরাডো বুঝি সুতো কেটে তাদের ফাঁকি দিলে! হার্মান তাড়াতাড়ি ছিপ ধরে টান মারল। বঁড়শির দিকে দৃষ্টিপাত করেই দুই বন্ধুর চক্ষুস্থির!

মাছের দেহহীন মুণ্ডটা ঝুলছে বঁড়শির মুখে! গলার তলা থেকে বাকি অংশটা কে যেন কেটে নিয়েছে।

বন্ধুর দিকে ফিরে শুদ্ধস্বরে হার্মান প্রশ্ন করলে, আমি যা ভাবছি তুমিও কি তাই ভাবছ?

 অবসন্নকণ্ঠে উত্তর এল, দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি তোমার অনুমান নির্ভুল।

জন বঁড়শি থেকে মাছের মুণ্ডটা খুলে নিয়ে নদীর জলে ছুঁড়ে ফেলল। তৎক্ষণাৎ জল তোলপাড় করে আবির্ভূত হল একজোড়া দন্ত-ভয়াল বীভৎস চোয়াল!

চোয়াল দুটো মুহূর্তের মধ্যেই আবার জলের ভিতর অদৃশ্য হল; হার্মানের প্রথম শিকার সোনালি ডোরাডোর দেহহীন মুণ্ডটা জলে পড়তে-না-পড়তেই সেই চোয়াল দুটির ফাঁকে অন্তর্ধান করলে! বীভৎস দৃশ্য!

মাছ ধরার উৎসাহ আর রইল না, হার্মান নোঙর খুলে বোট চালিয়ে দিলে..

..আচম্বিতে এক প্রকাণ্ড ধাক্কা খেয়ে মোটরবোট লাফিয়ে উঠল। বোটের প্রপেলার জল ছেড়ে শূন্যে উঠেও তার কর্তব্য করতে ভুলল না–প্রপেলারের পাখা বাতাস কেটে ঘুরতে লাগল প্রচণ্ড শব্দে।

মোটরবোটের দুই আরোহী আছড়ে পড়ল পাটাতনের উপর।

ব্যাপারটা বুঝতে দেরি হল না তাদের জলের নীচে কোনো একটি কেম্যানের গায়ে ধাক্কা মেরেছে মোটরবোট এবং তার ফলে এই বিপর্যয়!

হার্মান তাড়াতাড়ি মোটর থামিয়ে দিলে।

 প্রপেলারের আর্তনাদ বন্ধ করল, শান্তভাবে মোটরবোট ভাসতে লাগল নদীর জলে।

সঙ্গেসঙ্গে আর্তস্বরে চিৎকার করে উঠল জন, আরে! আরে! করছ কী! ভগবানের দোহাই বোট চালাও!

বোটে তখন জল উঠছে।

এই ভয়ংকর জায়গায় বোট ডুবলে আর নিস্তার নেই–সাঁতার কেটে তীরে ওঠার আগেই কেম্যানের আক্রমণে তাদের মৃত্যু অবধারিত

নিকটস্থ তীরভূমি লক্ষ করে বোট চালাল হার্মান।

অসংখ্য ছিদ্রপথে তখন হুহু করে জল উঠছে বোটের মধ্যে…

তীরের খুব কাছাকাছি এসে হঠাৎ কাদার মদ্যে আটকে গেল মোটরবোট।

 দুই বন্ধু তাড়াতাড়ি বোট ছেড়ে নেমে পড়ল।

 প্রায় দশ ফুট দূরেই রয়েছে মৃত্তিকার আশ্রয়, এইটুকু ব্যবধান কোনোরকমে পার হতে পারলে তারা নিরাপদ–হাঁটু পর্যন্ত জল ভেঙে দুই বন্ধু তীরভূমির দিকে অগ্রসর হল।

হঠাৎ হার্মান শুনতে পেল তার পিছনেই জেগে উঠেছে একটা আলোড়ন-ধ্বনি–সঙ্গেসঙ্গে ফোয়ারার মতো জল ছিটকে এসে তার সর্বাঙ্গ ভিজিয়ে দিলে। হার্মান পিছন ফিরে চাইল না, সে তখন ব্যাপারটা অনুমানেই বুঝে নিয়েছে এক লাফ মেরে সে এগিয়ে গেল। পরক্ষণেই পিছন থেকে ভেসে এল কর্কশ শব্দ

একটা প্রকাণ্ড লোহার সিন্দুকের ডালা যেন সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল!

হার্মান বুঝল পিছন থেকে এক পাষণ্ড কেম্যান তাকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছিল, কিন্তু শিকার করতে না-পেরে দন্তসজ্জিত দুই চোয়াল ব্যর্থ দংশনে পরস্পরকে আলিঙ্গন করছে!

অগভীর জল ঠেলে সে দ্রুত অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করতে লাগল প্রাণপণে…

শক্ত মাটির উপর পা রেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল হার্মান আর ঠিক সেই মুহূর্তে তার পায়ের উপর চেপে বসল বিকট একজোড়া দাঁতালো চোয়ালের বজ্র-দংশন!

হার্মানের কণ্ঠ ভেদ করে নির্গত হল কাতর আর্তনাদ!

বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো ঘুরে দাঁড়িয়ে জন দেখল কেম্যান তার বন্ধুর পা কামড়ে ধরে গভীর জলে টেনে নিয়ে যাওয়ার উপক্রম করছে।

একলাফে এগিয়ে এসে সে চেপে ধরলে হার্মানের দুই হাতের কবজি। শুরু হল যমে মানুষে টানাটানি!…

হঠাৎ একটা পাথরের উপর হোঁচট খেয়ে পড়ে রইল জন, সঙ্গীর হাতের উপর থেকে খুলে গেল তার বজ্রমুষ্টির বন্ধন–হার্মান বুঝল আর রক্ষা নেই, নক্ৰদানব তাকে এইবার নিয়ে যাবে গভীর জলের মধ্যে।

আর ঠিক সেই সঙ্গিন মুহূর্তে তার কানে এল অপরিচিত মানুষের কণ্ঠস্বর। কথাগুলোর অর্থ সে বুঝতে পারল না–কারণ কণ্ঠস্বরের মালিক যে-ভাষায় কথা কইছে সেই ভাষা হার্মানের পরিচিত নয়।

..কেম্যান এতক্ষণ শিকারকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল জলসিক্ত ভূমির ওপর দিয়ে হঠাৎ হার্মান অনুভব করলে তার পায়ের উপর শিথিল হয়েছে কুম্ভীরের দংশন, সরীসৃপ আর তাকে আকর্ষণ করছে না!

দানবটার ভাবান্তরের কারণ অনুসন্ধান করার জন্য মুখ তুলল হার্মান, সঙ্গেসঙ্গে তার চোখের সামনে ভেসে উঠল এক বিস্ময়কর দৃশ্য–

কেম্যানের পিঠের উপর বসে আছে একটি প্রায়-কৃষ্ণবর্ণ মানুষ।

পরক্ষণেই কুম্ভীর হার্মানের দেহটাকে সজোরে শূন্যে নিক্ষেপ করলে

শক্ত মাটির উপর আছড়ে পড়ল হার্মান, কঠিন মৃত্তিকার সংঘাতে এক মুহূর্তের জন্যে সে অনুভব করলে তীব্র যন্ত্রণার ঢেউ ছড়িয়ে পড়ছে তার সর্বাঙ্গে

তারপরই লুপ্ত হয়ে গেল তার চৈতন্য…

চোখ মেলে হার্মান দেখল একটা নৌকার পাটাতনে দেহ ছড়িয়ে সে শুয়ে আছে এবং দাঁড় বেয়ে নৌকাটিকে চালনা করছে দুটি রেড-ইন্ডিয়ান। জন কাছেই ছিল, বন্ধুর জ্ঞান হয়েছে দেখে সে সামনে এগিয়ে এল।

জনের মুখ থেকেই সমস্ত ঘটনা শুনল হার্মান :

এই অঞ্চলের রেড-ইন্ডিয়ানরা কুমিরের সঙ্গে হাতাহাতি করতে অভ্যস্ত। এটা তাদের কাছে। একধরনের খেলা।

কেম্যান যখন হার্মানকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ঠিক সেই সময়েই অকুস্থলে আবির্ভূত হয়ে দুজন রেড-ইন্ডিয়ান শিকারি। হার্মানের অবস্থা দেখে তারা চিৎকার করে ওঠে (অজ্ঞান হওয়ার আগে তাদের কণ্ঠস্বর হার্মান শুনেছিল), তারপর মিলিতভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে কেম্যানের উপর। একজন রেড-ইন্ডিয়ান কুমিরের চোখে বর্শা বিধিয়ে দেয়। আহত কেম্যান মুখের শিকার ছুঁড়ে ফেলে নবাগত শত্রুদের আক্রমণ করার চেষ্টা করে।

প্রায় পনেরো ফুট দূরে ছিটকে পড়ে হার্মান জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল।

ইতিমধ্যে বর্শার খোঁচা খেয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল কেম্যান। এই অঞ্চলের রেড ইন্ডিয়ানরা জলবাসী ওই দানবকে মোটেই ভয় পায় না–জলের মধ্যে কেবল বর্শা ও ছোরার সাহায্যে তারা কুমিরগুলোকে হত্যা করে থাকে।

এমন আশ্চর্য কৌশলের সঙ্গে তারা কেম্যানের পিঠের উপর উঠে বসে যে নক্ৰদানবের দাঁতালো চোয়াল এবং লোহার চাবুকের মতো সাংঘাতিক লাঙ্গুল কিছুতেই তাদের শরীর স্পর্শ করতে পারে না–

কিন্তু পৃষ্ঠদেশে উপবিষ্ট শিকারির তীক্ষ্ণ অস্ত্র বারংবার বিদ্ধ হয় কেম্যানের দেহে অবশেষে রক্তপাতের ফলে অবসন্ন হয়ে মৃত্যুবরণ করে কেম্যান।

অদ্ভুত সাহস! আশ্চর্য বীরত্ব!…

না, ও-রকম অদ্ভুত সাহস বা বীরত্বের পরিচয় দিতে পারবে না হার্মান আর জন। ব্রিটিশ গায়নার নদীতে আর কখনো তারা মাছ ধরতে যায়নি।

জলে নেমে জলের রাজা কুমিরের সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করার শখ তাদের নেই।

[শ্রাবণ ১৩৭৭]