পাঁচ
একটা বিড়াল! ভ্যাম্পায়ারটা বড় এক কালো বিড়ালে পরিণত হয়েছে। থাবায় লম্বা, ধারাল নখ। রক্তলাল একজোড়া চোখ। ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় ধরা পড়ে খুশি হয়নি ওটা। পিঠ বাঁকিয়ে হিসিয়ে উঠল, এমনভাবে একটা থাবা তুলল যেন আঁচড়ে দেবে। এবার আচমকা, দেয়ালে প্রায় পাঁচ ফীট উপরে এক জানালার ধারিতে লাফিয়ে উঠে পড়ল। বিড়ালরূপী জিনিসটা আমাদের দিকে ঘুরে জ্বলন্ত চোখে চেয়ে রইল। আরেকবার হিসিয়ে উঠে, জানালা ঠেলে খুলে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাইরে।
‘দেখলে! কী ভয়ঙ্কর!’ বলল রবিন। ‘ভ্যাম্পায়াররা বাদুড় হতে পারে জানি, কিন্তু বিড়াল?’
‘ব্যাটের বদলে ক্যাট হয়েছে,’ বললাম আমি, ‘ও হয়তো এ বি সি ডি গুলিয়ে ফেলেছে। বেরনোর একটা রাস্তা পাওয়া গেল মনে হয়।’
জানালা গলে বেরিয়ে আসা সহজ হলো না, কিন্তু পারলাম আমরা। সে মুহূর্তে, ওখান থেকে বেরোতে যে কোন কিছু করতে রাজি ছিলাম আমি। বাইরে ঘন কুয়াশা, কিন্তু আমি আর রবিন যথাসম্ভব দ্রুত পেডাল মেরে বাড়ির পথে রওনা হলাম।
বাড়ির গাড়িপথে যখন পৌঁছলাম, শুনতে পেলাম মা আমার নাম ধরে ডাকাডাকি করছে।
‘খাইছে, মনে হচ্ছে বকা খাব,’ রবিনকে বললাম।
‘হ্যাঁ, আমিও। মুসা, তোমার বাবা-মাকে আজকের কথা কিছু বলবে?’
‘নাহ, বললে বিশ্বাস করবে না।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল রবিন।
‘তা ঠিক।’
বলার মত আর তেমন কিছু নেই, তাই যার যার বাড়ির দিকে রওনা হলাম আমরা।
এতক্ষণ কোথায় ছিলাম তা নিয়ে বেশি ব্যাখ্যা দিতে হলো না আমাকে, কারণ নেলি খালা এসে গেছেন এবং আমি তাঁর পাল্লাতেই আগে পড়লাম।
মাথার চুল যথারীতি উস্কোখুস্কো তাঁর। পরনে জিপসি ড্যান্সারদের পোশাক। দরকার শুধু একটা খঞ্জনী
‘এই যে, মুসা, দেখি দেখি!’ আমাকে দেখে বলে উঠলেন তিনি প্রথমে দু’হাতে আমার মুখখানা ধরে পরীক্ষা করলেন। এবার এমনভাবে হাত দুটো সরিয়ে নিলেন যেন আমার মাথা আচমকা গরম হয়ে গেছে, এবং একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন আমার দিকে। ‘তোর অরা খুব তীব্র দেখতে পাচ্ছি, মুসা। তুই কি কোন ব্যাপারে আপসেট?’
‘বাইরে দৌড়াদৌড়ি করছিলাম তো তাই। এবছর স্কুলের ট্র্যাক টিমে আছি আমি।’
‘হুম,’ আওড়ালেন তিনি, মনে হলো আমার কথা বিশ্বাস করেননি, তবে আর কথা বাড়ালেন না।
অত ছুটোছুটি আর আতঙ্কের কারণে ভয়ানক ক্লান্তি বোধ করছি। রাত তেমন হয়নি, কিন্তু নতুন বিছানার জন্য মার রেখে যাওয়া শীট বিছাতে লাগলাম। একটু পরে বাবা এসে বলল, ‘নেলি খালার জন্যে তোর একটু কষ্ট হবে, কিন্তু তোর মা রিয়েল এস্টেট লিস্টিং চেক করছে, যদি ওকে আরেকটা অ্যাপার্টমেণ্ট খুঁজে দেয়া যায়। যাকগে, তোর অরা যাতে গরম থাকে সেজন্যে আরও কম্বল নিয়ে নে।’
হাসার জন্য মুখ খুলে তার বদলে হাই তুললাম। শরীর বিশ্রাম চাইছে, কাজেই হাত-মুখ-পা ধুয়ে, ব্রাশ করে পাজামা পরতে গেলাম।
কাউচটা যা ভেবেছিলাম তার চাইতে আরামদায়ক এবং সারা রাত একটানা ঘুমোলাম। পরদিন ভোরে উঠলাম। আঁধার বাড়িতে ভ্যাম্পায়ারের তাড়া খাওয়ার স্বপ্ন যদি দেখেও থাকি, কপাল ভাল এখন আর তা মনে নেই। স্টোরেজ বিল্ডিঙের গতকালের পুরো ঘটনাটাই দুঃস্বপ্ন হলে ভাল হত!
বাবা-মা এখনও ঘুমোচ্ছে, কিন্তু নেলি খালাকে কিচেনে পেলাম, কাগজের এক ব্যাগ থেকে ছোট ছোট গাছের ডালের মত কী যেন খাচ্ছেন।
‘গুড মর্নিং, ডিয়ার,’ বলে, মৃদু হেসে আমাকে ওগুলো খেতে সাধলেন। ‘নাটি ব্র্যান স্টিকস, খেয়ে দেখ।’
‘না, ধন্যবাদ, নেলি খালা,’ বলে কাবার্ড থেকে সিরিয়ালের একটা বাক্স নামালাম।
‘তো আজকে তোর প্ল্যান কী?’
‘দেখি বন্ধুদের সাথে দেখা হোক আগে।’ আসলে রবিনকে যত দ্রুত সম্ভব দেখতে চাই আমি। ওর মুখ থেকে নিশ্চিত হতে চাই আমাদের ভ্যাম্পায়ারের তাড়া খাওয়াটা নিছকই একটা দুঃস্বপ্ন ছিল। কারণ সকালের উজ্জ্বল আলোয় গোটা ঘটনাটাই অবাস্তব মনে হচ্ছে।
গোগ্রাসে সিরিয়াল গিলে দৌড়ে গেলাম ড্রেসআপ করতে। বাবা- মা যেহেতু এখনও নীচে নামেনি, নেলি খালাকে বললাম তাদের যেন জানিয়ে দেন আমি বাইরে গেছি।
রবিনের বাসায় গিয়ে দেখি ও টিভি দেখছে, কাজেই আমিও ওর সঙ্গে খানিকক্ষণ দেখলাম। একটু পরে বললাম, ‘রবিন, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই। আগেই বলে রাখছি, তোমার কাছে পাগলামি মনে হতে পারে।’
আমি আরও কিছু বলার আগেই রবিন আমার দিকে ঘুরে বলল, ‘হ্যাঁ, ব্যাপারটা সত্যিই ঘটেছিল, মুসা। বাইরে যাই চলো। আমি চাই না আমার বাবা-মা আমার মুখে ভ্যাম্পায়ারের কথা শুনুক।’
আজকের সকালটা যদিও যথেষ্ট উষ্ণ, তারপরও ঠাণ্ডা লেগে উঠল। রবিন ওর বাস্কেটবলটা তুলে নিল। ওদের গ্যারেজের সামনের হুপে পালা করে জাম্প শট নিলাম আমরা।
‘তো এখন কী করা উচিত আমাদের?’ প্রশ্ন করলাম, রিবাউণ্ডে বলটা ধরে।
‘কাউকে বলা যাবে না, কেননা কেউই বিশ্বাস করবে না।’
‘হ্যাঁ, ব্যাপারটা এমনকী নেলি খালার জন্যেও অদ্ভুতুড়ে।’
‘আমি বলি কি, আমাদের আবার ওখানে যাওয়া দরকার। ভ্যাম্পায়ারটা যে আছে তার প্রমাণ জোগাড়ের জন্যে,’ বলল রবিন, বল ছুঁড়ে দিল।
আমি থমকে দাঁড়িয়ে ওর দিকে চেয়ে রইলাম। বলটা বাস্কেট থেকে মাটিতে বাউন্স খেল।
‘কীভাবে? গিয়ে ওর কাছে বার্থ সার্টিফিকেট চাইব?’
আশা করছিলাম রবিন বলবে, না, ওর ডেথ সার্টিফিকেট। কিন্তু ও স্রেফ আমার দিকে গুরুগম্ভীর অভিব্যক্তি নিয়ে চেয়ে রইল।
‘আঙ্কলের তো একটা ক্যামকর্ডার আছে, তাই না?’ বলল। ‘হ্যাঁ, তো?’ এবার মাথায় ঘাই মারল ও কী প্রস্তাব করছে। ‘ভিডিও করার জন্যে ওখানে ফিরে যেতে চাও? অসম্ভব!’
রবিন গিয়ে বলটা তুলে নিল।
‘দেখো, মুসা, এ মুহূর্তে আমরা দু’জন ছাড়া আর কেউ ওটার কথা জানে না। কিন্তু আমরা যদি ছবি তুলতে পারি যে ভ্যাম্পায়ারটা বিড়াল হয়ে যাচ্ছে, তখন মানুষের বিশ্বাস করতে হবে। হয় এটা আর নয়তো ভান করতে হবে ওটার কোন অস্তিত্ব নেই।
যথারীতি রবিনের কথায় যুক্তি আছে।
‘ঠিক আছে, আমি বাবার ক্যামেরা নিয়ে আসব। কাজটা কখন করতে চাও?’
‘আজ রাতে।’
‘ভয় পাচ্ছিলাম তুমি এমনটাই বলবে।’
পার্কে সন্ধে সাতটায় দেখা করব ঠিক করলাম আমরা, ঠিক যখন সূর্যাস্ত হবে। মজার ব্যাপার হলো, পরিকল্পনা ছকে ফেলার পর, স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারলাম আমরা, ভাবখানা এমন যেন আজব কোন কিছুই ঘটেনি। যদিও ক’মুহূর্তের জন্য দম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আমার, রবিনদের গাড়িপথে যখন একটা কালো বিড়াল কোত্থেকে যেন এসে থমকে দাঁড়িয়ে, আমাদের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকায়। তবে ওটা একটা সাধারণ কালো বিড়াল, স্বাভাবিক চোখে চেয়ে ছিল আমাদের দিকে।
শীঘ্রি চলে গেল ওটা, এবং আমি এতটাই স্বস্তি পেলাম যে মাথা ঘামালাম না কালো বিড়াল পথ মাড়ালে কী হয় তা নিয়ে…দুর্ভাগ্য!, তবে শীঘ্রি টের পেলাম।
রবিনের বাসায় সকালটা কাটিয়ে বাড়ি ফিরলাম। বাসায় ঢোকার পর শুনতে পেলাম নেলি খালা মাকে বলছেন কীভাবে স্বাস্থ্যকর ডিমের সালাদ বানাতে হয়, ডিম কিংবা মেয়োনেজ ছাড়া।
সন্তর্পণে বাবা-মার রূমে ঢুকে পড়লাম। ক্যামকর্ডারটা কোথায় রয়েছে ধারণা আছে আমার। একটু খুঁজতেই পেয়ে গেলাম। ওটা একটা হ্যাণ্ড-সাইড্ সুপার এইট মডেল, কাজেই কারও চোখে না পড়ে সহজেই নিজের ঘরে ঢুকে পড়া গেল।
নিজের ঘর বলছি, কিন্তু দরজা খুলে ভিতরে পা রাখতেই অচেনা ঠেকল। কে বলবে এটা আমার ঘর? নেলি খালা একেবারে আপন করে নিয়েছেন। এক্সার-সাইকেলটা এত বেশি জায়গা নিয়েছে, হাঁটা-চলা করা শক্ত। নাইটস্ট্যাণ্ডে প্লাস্টারের ছোট্ট এক পিরামিড। বিছানার উপরে দাড়িওয়ালা এক বৃদ্ধের ছবি। তার পরনে আলখিল্লা। মাথায় ফুলের মালা। বালিশের উপর বসে আছে খুদে এক নীল ক্রিস্টাল, এবং সারা ঘরে আগরবাতির গন্ধ।
ক্যামকর্ডার কেসটা ডেস্কের নীচে রাখলাম, ধারণা করছি নেলি খালা ওখানে উঁকি মারতে যাবেন না। এসময় মা লাঞ্চ খেতে ডাকল। লাঞ্চে দেখা মিলল নেলি খালার ‘স্বাস্থ্যকর’ ডিমের সালাদ স্যাণ্ডউইচের। পাউরুটির উপর কাঠের গুঁড়ো ছড়িয়ে দিলে যেমন হয় তেমন স্বাদ। পটেটো চিপসের বদলে টুকরো করে কাটা শুকনো গাজর।
‘বন্ধুর সাথে সব ব্যবস্থা হয়ে গেল?’ প্রশ্ন করলেন নেলি খালা। গাজরের চিপস চিবোচ্ছেন। নেলি খালার শব্দচয়নে সামান্য শিউরে উঠলাম আমি। নেলি খালা কি আমার মন পড়তে পারছেন?
‘আমি, মানে, পরে আবার ওর সাথে দেখা করব,’ বললাম।
‘জানি,’ জবাব দিলেন খালা, আমি ভাবতে লাগলাম সত্যিই তিনি জানেন কিনা।
আমি খাওয়া শেষে যখন ডিশগুলো ধুচ্ছি তখন আবার মুখ খুললেন নেলি খালা।
‘মুসা, সবচেয়ে কাছের বাস স্টপটা কোথায় জানিস?’
‘এই রাস্তা ধরে গেলে এক ব্লক পরেই,’ জবাব দিলাম আমি।
‘আমাকে ওখানে নিয়ে যেতে পারবি?’
সোজা কাজ তাই সায় জানালাম। শুধু যদি কালো বিড়ালটার কথা মাথায় আসত!
নেলি খালা বেরনোর আগে গায়ে শাল জড়িয়ে নিলেন। এখন তাঁকে আরও বেশি করে ওয়্যারউলফ ছায়াছবির জিপসি মনে হচ্ছে। তাঁকে নিয়ে বাস স্টপে হেঁটে যাওয়ার সময় কোন কথা বললেন না তিনি। ওখানে পৌছনোর পরও নীরব রইলেন।
‘নেলি খালা, আমি এবার যাই?’
‘বাসটা না আসা পর্যন্ত একটু দাঁড়া।’
মিনিট দুয়েকের মধ্যেই বাস চলে এল। কিন্তু দরজাজোড়া খোলার পর, নেলি খালা আমার কবজি চেপে ধরলেন।
‘আয়,’ বলে টেনে বাসে তুললেন।
‘নেলি খালা, কী করছ?’
আমার দিকে মৃদু হাসিমাখা মুখে চাইলেন তিনি।
‘তোকে কিডন্যাপ করছি।’