চার
ভ্যাম্পায়ারটা এখন এতটাই কাছে যে পরিষ্কার দেখতে পেলাম। পরনে কালো পোশাক, তবে আলখিল্লা নয়। কালো চুল কাঁধ ছুঁয়েছে। মুখের চেহারা ছায়াছবির ভ্যাম্পায়ারের মত ভয়ঙ্কর নয়, তবে নিষ্প্রাণ। সবচেয়ে সাঙ্ঘাতিক ওই রক্তলাল চোখজোড়া। জানি জান নিয়ে পালানো উচিত, কিন্তু ওর চোখ দুটো থেকে দৃষ্টি সরাতে পারছি না। শুনতে পাচ্ছি কে যেন আমার নাম একশো মাইল দূর থেকে ডাকছে। কণ্ঠটা ডেকেই চলেছে, কিন্তু আমি জবাব দিতে পারছি না। স্রেফ চেয়ে রয়েছি ওই চোখজোড়ার দিকে।
শেষমেশ, অনুভব করলাম আমাকে টেনে, ঠেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে হলওয়ে ধরে। সিমেন্টের ঠাণ্ডা মেঝেতে পড়ে গেলাম আমি। মনে হলো বিশাল কোন ঘণ্টা বেজে উঠেছে এবং আচমকা টের পেলাম আমি কোথায় রয়েছি।
‘মুসা, এসো!’ রবিন চেঁচাচ্ছে। আমাকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে।
‘কী হয়েছে?’ প্রশ্ন করলাম।
‘শিয়োর না, কিন্তু মনে হয় ভ্যাম্পায়ারটা তোমাকে হিপনোটাই করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু আমাদের পালাতে হবে, কাজেই দৌড়াও!’
রবিনের সাহায্য নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম এবং দৌড়ে ফিরে গেলাম গোলকধাঁধার ভিতরে।
‘ওরা আমাদেরকে আটকে রেখে গেছে,’ দৌড়নোর ফাঁকে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল নথি। ‘মানুষ ভিতরে রেখে দোকান বন্ধ করে কোন্ গাধা?’
‘ওরা তো জানে না আমরা ভিতরে আছি, কারণ আমরা তো ম্যানেজারের সাথে দেখা করিনি,’ জবাব দিলাম।
‘তা ঠিক,’ স্বীকার করল রবিন।
ছুটে চললাম আমরা। দেয়ালের দু’পাশে ফ্ল্যাশলাইটের আলো ফেলছি আমি, আশা করছি অন্য কোন এক্সিট পেয়ে যাব। কিন্তু চোখে পড়ল শুধু আরও স্টোরেজ লকার। এবার দৌড় থামালাম আমি, কেননা মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে।
‘এখন কী?’ রবিনের প্রশ্ন।
‘ভাবছি সারা রাত এখানে ছোটাছুটি করে কোন লাভ হবে না। তারচেয়ে বরং অপেক্ষা করে দেখি ভ্যাম্পায়ারটা কীভাবে বেরোয়, তখন একই পথে আমরাও বেরিয়ে যাব।’
‘ও বেরিয়ে যাবে মনে হলো কেন তোমার?’
‘ও নিশ্চয়ই ডিনারের দাওয়াত দেয়নি আমাদের। ও-ও আমাদের মতই অবাক হয়েছে। কিন্তু দেখলেই তো ও কীভাবে ওর ইউনিটটা আনলক করল। হয়তো সদর দরজাটাও ওভাবে খুলতে পারবে।’
‘অনেক বড় রিস্ক নিতে হবে।’
‘এখনও কি নিচ্ছি না? দেখো, রবিন, ছুটোছুটি করে অনেক শব্দ করছি আমরা। ও শুধু আমাদের পায়ের আওয়াজ ফলো করলেই আমরা শেষ। কিন্তু চুপচাপ থাকলে এত সহজে আমাদের খুঁজে পাবে না।’
রবিন শেষমেশ মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাল। ঠিক করলাম পিঠাপিঠি দাঁড়াব, দুটো পাশই নজরে রাখতে পারি যাতে। এভাবে হলওয়ে ধরে হাঁটা ধরলাম আমরা, যথাসম্ভব কম শব্দ করছি।
মনে হচ্ছে দীর্ঘ একটি ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে, কিন্তু আসলে হয়তো দু’মিনিট। স্টোরেজ বিল্ডিংটা নিঃশব্দ। এবার ধীর, অবিচল পা ফেলার শব্দ শোনা গেল আবারও। কাঠ-পুতুল হয়ে গেলাম রবিন আর আমি। পদশব্দ প্রথমে ক্ষীণ শোনাল, তারপর ক্রমেই জোরদার হতে লাগল।
‘মনে হচ্ছে আমার দিকটা থেকে আসছে,’ আমার কানে ফিসফিসিয়ে বলল রবিন। ধীরেসুস্থে ঘুরে রবিনের পাশে দাঁড়ালাম। ওর কথাই ঠিক। ওদিক থেকেই আসছে পায়ের আওয়াজ। এবং শব্দটা যে করছে সে সামনের কোনাটার ওপাশেই রয়েছে।
‘মুসা, ফ্ল্যাশলাইটটা বন্ধ করো,’ ফিসফিস করে বলল রবিন।
‘পাগল হলে?’ পাল্টা হিসিয়ে উঠলাম।
‘আলো জ্বললে ও আমাদের দেখে ফেলবে।
মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হলাম ও ঠিকই বলেছে। নিশ্ছিদ্র আঁধারে ঢাকা পড়তে মন চাইল না। তারপরও আলো নিভালাম।
ঠাণ্ডা এক কম্বলের মত আমাদের ঢেকে দিল আঁধার। পদধ্বনি মুহূর্তের জন্য থেমে গেল, কিন্তু শীঘ্রি আমরা হলওয়ের শেষ প্রান্তে ভ্যাম্পায়ারটার রক্তচক্ষু দেখতে পেলাম। খাইছে, শিউরে উঠলাম আমি। কিন্তু চোখজোড়া আর আমাদের উপর নিবদ্ধ নয়। দেখে মনে হলো সবদিকে চাইছে। হয়তো রবিনের কথাই ঠিক। ভ্যাম্পায়ারটা হয়তো আঁধারে আমাদের দেখতে পাবে না।
ক্ষণিকের স্বস্তির মুহূর্তটুকু উবে গেল যখন চোখজোড়া হঠাৎই স্থির হলো আমাদের উপর। কালো মূর্তিটা এ মুহূর্তে সোজা আমাদের দিকেই ধেয়ে আসছে!
রবিনের শার্টের পিছনটা চেপে ধরলাম, দু’জনে যাতে আলাদা না হয়ে যাই। এবার দু’বন্ধু পা টিপে টিপে পিছু হটতে লাগলাম। আমি দেয়ালে একটা হাত রেখেছি গাইড হিসেবে। ভ্যাম্পায়ারটা ক্রমেই এগিয়ে আসছে। আশা করছি রবিন কিছু একটা বুদ্ধি খাটাবে। হলওয়ের শেষ মাথায় পৌঁছে গেছি আমরা। আমার মাথায় কোন বুদ্ধি আসছে না। দেয়াল ধরে ধরে সরে যাচ্ছি, কিছু একটা ঠেকল হাতে। স্টোরেজ লকার ডোরের এক ধাতব আঙটা। খোলা এক লকার!
থেমে গেলাম আমি এবং সে সঙ্গে রবিনও। মনে প্রাণে কামনা করলাম কব্জাগুলোয় ইদানীং তেল দেয়া হয়েছে। লকারের দরজা ধরে টান দিতে লাগলাম। কোন শব্দ না করে খুলে গেল ওটা। আলগোছে রবিনকে টান দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লাম। যথাসম্ভব নিঃশব্দে দরজাটা টেনে বন্ধ করলাম। সামান্য ফাঁক রাখলাম বাইরেটা যাতে দেখতে পারি।
মাত্র ক’মুহূর্ত পরেই লাল চোখজোড়া দৃষ্টিগোচর হলো। ভ্যাম্পায়ারটা চারপাশে চোখ বুলাচ্ছে, ভাবখানা এমন যেন কিছু খুঁজছে। খুঁজছেই তো—আমাদেরকে! শ্বাস চেপে রাখলাম যতক্ষণ না মনে হলো ফুসফুস ফেটে যাবে।
এবার সত্যিকারের ভুতুড়ে একটা ব্যাপার ঘটল। লাল চোখজোড়া পাল্টে যেতে লাগল। সরু আর তেরছা হয়ে যাচ্ছে, মেঝের দিকে নেমে আসছে, ভ্যাম্পায়ারটা যেন গুটিসুটি মেরে বসছে। মুহূর্ত খানেক পরে চোখজোড়াকে মেঝের ক’ইঞ্চি উপরে দেখা গেল!
‘ব্যাপারটা অদ্ভুত,’ ফিসফিস করে বলল রবিন, আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিল ফ্ল্যাশলাইটটা। ‘কী হচ্ছে দেখা দরকার।’
‘রবিন, না!’ চেঁচিয়ে উঠলাম, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। মেঝের কাছের রক্তচক্ষুজোড়ার উপর আলো ফেলল ও, এবং সভয়ে আঁতকে উঠল।
আমিও আঁতকালাম, যখন দেখলাম ওটাকে।