ভ্যাম্পায়ারের পদধ্বনি – ৩

তিন

আর্তনাদ ছেড়ে ঝটকা মেরে সরে গেলাম। বাইকের উপর ছিটকে পড়ে, ভারসাম্য হারিয়ে মাটিতে পড়লাম। এবার একটা গলা শুনতে পেলাম, ‘কী হয়েছে তোমার? সমস্যাটা কী?’

‘রবিন!’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম। আমার ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে ও, বাইকের দু’পাশে মাটিতে পা রেখে। ‘খাইছে! আরেকটু হলে হার্টফেল করতাম!’

‘তুমি ঠিক আছ তো?’ বলে আমাকে উঠতে সাহায্য করল।

‘হ্যাঁ, কিন্তু তুমি এখানে কী করছ?’

‘তোমাকে দেখলাম ডিনারের পর বাইক নিয়ে তাড়াহুড়ো করে বেরোতে, তাই ভাবলাম দেখি কী ব্যাপার। তুমি এখানে কী করছ?’

শ্বাস ফিরে পেয়ে ওকে বললাম, স্টোরেজ লকারের কাছে ব্যাকপ্যাক রেখেছিলাম। তারপর থেকে আর জ্যামিতি নোটবইটা পাচ্ছি না। এবার অফিসের উদ্দেশে হাঁটা দিলাম।

‘এসো, ম্যানেজারের সাথে কথা বলি।

‘তাকে বিরক্ত করার দরকার কী,’ রবিন বলল, ‘দরজা তো খোলাই আছে। আমাদের মাত্র কয়েক মিনিট লাগবে। চলো ভিতরে ঢুকে পড়ি, কেউ কিছু মনে করবে না।’ তর্ক করতে চাইলেও পারতাম না। রবিন ইতোমধ্যে দরজা দিয়ে ঢুকে পড়েছে।

স্টোরেজ বিল্ডিংটাকে দিনদুপুরেও ভুতুড়ে দেখায়, কিন্তু সন্ধের পর মনে হলো কোন দুঃস্বপ্ন ঘটার অপেক্ষায় আছে। ওভারহেড বাতিগুলোর বেশিরভাগ অফ, কাজেই কোথায় যাচ্ছি জানার জন্য টিমটিমে আলোই ভরসা। গোটা বাড়িতে বাসি একটা গন্ধ। দুপুরে বাবার সঙ্গে যখন এসেছিলাম তখন পাইনি। বেশিরভাগ লকার ইউনিট ডোরে তালা, তবে কয়েকটায় তালা নেই। যতবারই তালাহীন লকারগুলোর পাশ দিয়ে যাচ্ছি, আশঙ্কা হচ্ছে এই বুঝি ওটা দড়াম করে খুলে যাবে এবং কেউ—কিংবা কিছু-হাত বাড়িয়ে আমাদের ধরার চেষ্টা করবে।

প্রথম হলওয়ে পেরনোর পর ভয়ে রীতিমত কাঁপতে লাগলাম আমি। কিন্তু বাড়িটা যেন রবিনের উপর অন্যরকম এক প্রভাব ফেলেছে।

‘এখানে এসে আমার একটা হরর ছবির কথা মনে পড়ছে,’ মৃদু হেসে বলল ও। ‘পুরানো এক কবরস্থানে আটকা পড়ে হাইস্কুলের এক দল ছেলে-মেয়ে। আর কবরস্থানের লাশেরা তাদেরকে মারার চেষ্টা করে!’

‘আমাদের লকারটা এদিকে। আসবে তুমি?’ সত্যি কথাটা হচ্ছে, আমাদের লকারটা কোথায় জানি না আমি। চাইছি রবিন কবরস্থান আর লাশেদের নিয়ে কথা বলা বন্ধ করুক। একটা কোনা ঘুরলাম আমরা। আরও বেশি আঁধার এক হলওয়ে ধরে পা বাড়ালাম। ‘হ্যাঁ, এদিকেই,’ বললাম। কিন্তু শীঘ্রি এক নিরেট দেয়ালে শেষ হলো হলওয়েটা।

‘কোথায় যাচ্ছ ঠিক জানো তো?’ রবিন প্রশ্ন করল।

‘মনে হয় উল্টো পথে এসেছি। এসো।’

ফিরতি পথ ধরলাম আমরা। পরিচিত কোন কিছু চোখে পড়ে কিনা নজর রাখলাম আমি-দেয়ালে কোন দাগ, লকার ডোরের নম্বর—যাতে বোঝা যায় আমরা এ জায়গাটা আগে পেরিয়েছি। প্রতিটা কোনা নতুন পথে এগিয়েছে, আমরা যেখান দিয়ে চলিনি।

‘দেখো, মুসা, প্রথম প্রথম ভাল লাগছিল, কিন্তু এখন ঠাণ্ডা লাগছে,’ বলল রবিন। ‘চলো বেরিয়ে যাই।’

রবিন ঠিকই বলেছে। এটা বোকার মত একটা চিন্তা। বাড়ি ফিরে গিয়ে বাবার সঙ্গে কাল আসা উচিত। এবার এমন একটা ভাবনা মাথায় উদয় হলো, নিজেকে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ বোকা মনে হলো। আমাদের স্টোরেজ লকারটা যদি খুঁজে পাইও, ভিতরে ঢোকার চাবি পাব কোথায়? ওটা তো বাবার কাছে।

‘খাইছে!’ গুঙিয়ে উঠলাম।

‘কী হলো?’

‘কিছু না। চলো বেরোই।’

আমরা আরেকটা কোনায় এলাম। এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোনদিকে যাব, ডানে-বাঁয়ে, নাকি যেখান থেকে এইমাত্র এসেছি। আমরা এ নিয়ে তর্ক করে চলেছি এসময় ঘটল সবচাইতে বাজে ঘটনাটা।

সব আলো নিভে গেল।

রবিনকে আর দেখতে পাচ্ছি না, শুধু ওর শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ কানে আসছে। কিংবা বলা উচিত কারও শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ পাচ্ছি, এবং মনে প্রাণে আশা করছি ওটা যাতে রবিন হয়।

‘রবিন, তুমি?’ প্রশ্ন করলাম।

‘আর কাকে আশা করছ?’ আঁধার থেকে জবাবটা দিল রবিন। ‘এখন কী করা, মুসা?’

‘এখানে দাঁড়িয়ে সাহায্যের জন্যে চেঁচালে কেমন হয়?’ বাতলে দিলাম, প্রাণপণ চেষ্টা করলাম গলা যাতে না কাঁপে। ‘ম্যানেজার শুনতে পাবে। তখন লাইট জ্বেলে আমাদের খুঁজতে আসবে।’

রবিন এরচেয়ে ভাল কোন বুদ্ধি দিতে পারল না, কাজেই আমরা পালা করে চেঁচাতে লাগলাম। কিন্তু পাঁচ মিনিট পর পরিষ্কার বোঝা গেল কেউ শুনতে পাবে না। চেঁচানি থামালাম আমরা। গলায় বড়সড় একটা দলা পাকিয়ে উঠছে আমার, এবং সেটা স্রেফ চেঁচামেচির জন্য নয়।

‘অ্যাই, চিন্তা নেই, বলল রবিন, ‘তোমার ফিরতে দেরি দেখলে আঙ্কল তোমার খোঁজে এখানে চলে আসবেন।’

‘আসত, যদি বলে আসতাম এখানে আসছি,’ কর্কশ শোনাল আমার কণ্ঠ।

‘বুদ্ধির ঢেঁকি!’

একটা মিনিট আমরা কেউ কোন কথা বললাম না। এবার আমরা ওটাকে দেখতে পেলাম।

‘অ্যাই, দেখো, দেখো,’ রবিন বলল।

হলওয়ের শেষ প্রান্তের দেয়ালে যে আলোটা জ্বলছে ইতোমধ্যেই সেদিকে চোখ পড়েছে আমার। নড়ছে আলোটা, কেউ যেন ধীরেসুস্থে ফ্ল্যাশলাইট ঘোরাচ্ছে। আলোটা সবজে-হলদে।

‘কেউ নিশ্চয়ই আছে এখানে,’ বলল নথি। ‘ওরা আমাদের চিৎকার শুনতে পেয়েছে! এসো!’ রবিন আলোটার দিকে দৌড় দিয়ে চেঁচাতে লাগল, ‘এখানে, এখানে!’ কিন্তু কেউ পাল্টা চেঁচাল না। হলওয়ের শেষ প্রান্তের কোনাটা ঘোরার পর বুঝতে পারলাম কেন।

কেউ নেই ওখানে।

‘দেখো!’ শ্বাসের ফাঁকে বললাম। সবুজ আলোটা চুইয়ে বেরোচ্ছে এক স্টোরেজ লকারের ভিতর থেকে!

‘কী ওটা?’ রবিন বলল।

জানার জন্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। ঘাড়-পিঠ কাঁটা দিয়ে উঠল আমার। সবুজ আলোটা সরু হয়ে একটা আকৃতি শুরু করেছে। আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়ে থাকলে রবিনেরও হয়েছে, কারণ ও-ও ওটা দেখেছে।

‘মুসা, একটা চাবি তৈরি হচ্ছে!’ বলল রবিন।

মনে হলো শরীরের প্রতিটা কোষ ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। শিটান উঠলাম। সবুজ আলোর চাবিটা এবার দরজার তালায় ঢুকে গেল শব্দ করে তালাটা খুলে গেল এবং খসে পড়ল মেঝেতে।

এবার আরেকটা শব্দ হলো, ছবিতে কিংবা টিভিতে যেমন শব্দ আমি অসংখ্যবার শুনেছি। মরচে ধরা কব্জা ক্যাঁচকোঁচ শব্দে খুলে যাচ্ছে। এবং ওটা আসছে স্টোরেজ লকারের ভিতর থেকে!

‘কী হচ্ছে, মুসা?’ রবিন বলছে, কিন্তু আমি জবাব দিতে পারলাম না।

ক্যাঁচকোঁচ শব্দটা হঠাৎই থেমে গেল এবং আরও তীব্র হলো সবুজ আলোটা। এবার নিঃশব্দে লকারের দরজাটা খুলে যেতে লাগল।

মুহূর্তের জন্য মনে হলো রবিন দেয়ালে ড্রাম পিটাচ্ছে কেন, তারপর উপলব্ধি করলাম ওটা আমার হৃৎপিণ্ডের শব্দ। ঘুরে দাঁড়িয়ে দৌড় দিতে চাইলাম, ওখান থেকে বেরিয়ে যেতে চাই, কিন্তু পাজোড়া যেন রবার দিয়ে তৈরি।

দরজাটা পুরোপুরি খুলে গেল এবং রবিন আঁতকে উঠে বলল, ‘মুসা, এটা একটা-একটা-’

কফিন। ঢাকনাটা খোলা এবং ভিতরে একটা দেহ! তবে এটাই সবচাইতে খারাপ অংশ নয়। খাইছে, সবচেয়ে খারাপ ব্যাপারটা ঘটল এক সেকেণ্ড পরে। দেহটা ঝট করে সিধে হয়ে বসল, চোখ মেলে একদৃষ্টে চেয়ে রইল আমাদের দিকে! চোখ বললাম, কিন্তু আসলে ও দুটোকে দেখাল রক্তের গোল চক্রের মতন।

রবিন আর আমি দু’জনেই আর্তচিৎকার ছেড়ে দৌড় দিলাম। আঁধারের জন্য কাজটা কঠিন হলো। রবিনের আগে হলওয়ের শেষ মাথায় পৌঁছলাম আমি এবং ওর জন্য থেমে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু ও আমাকে দেখতে পেল না এবং সোজা এসে আমার গায়ে সজোরে ধাক্কা খেল। দু’জনেই ছিটকে পড়লাম মেঝেতে।

‘খাইছে! তুমি কি ওই জিনিসটার আগেই আমাকে খতম করতে চাও?’ চেঁচিয়ে উঠলাম।

‘ওটা জিনিস নয়, মুসা,’ পাল্টা চেঁচাল রবিন। ‘ওটা একটা ভ্যাম্পায়ার!’

‘তুমি জানলে কীভাবে?’

‘কফিনে ঘুমায়, রাতে জাগে—ভ্যাম্পায়ার ছাড়া আর কী? এসো, এখান থেকে পালাতে হবে!’

আমরা উঠে দাঁড়িয়ে দৌড় দিলাম আবারও। এবার ছোটার সময় দেয়ালে এক হাত রেখে। হলওয়ে ধরে অল্প কয়েক গজ গিয়েছি, কীসে যেন সামান্য হোঁচট খেলাম।

‘দাঁড়াও, এখানে কী একটা যেন পড়ে আছে,’ বলে হাঁটু গেড়ে বসলাম। হাতড়াচ্ছি জিনিসটা কী বোঝার জন্য। এবার খুঁজে পেলাম এবং মুহূর্তে জেনে গেলাম কী ওটা।

‘রবিন, দেখো!’ বলে, খুঁজে-পাওয়া ফ্ল্যাশলাইটটা জ্বাললাম। ‘ভেরি গুড!’

বড়, চারকোনা, হেভি-ডিউটি এক ফ্ল্যাশলাইট। হাতলটা উপরে। যে-ই ফেলে গিয়ে থাকুক তাকে ধন্যবাদ।

পরের কোনাটা ঘুরতেই, সহসা থমকে দাঁড়াল রবিন।

‘মুসা, দাঁড়াও, দম নিয়ে নিই,’ হাঁফাতে হাঁফাতে বলল ও।

বলতে যাচ্ছিলাম জিরানোর সময় নেই, কিন্তু তার দরকার পড়ল না। পায়ের শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে গোটা বিল্ডিঙে। ক্রমেই জোরাল হচ্ছে আর কাছিয়ে আসছে।

‘ও এদিকে আসছে। এসো!’ বলে রবিনের কবজি চেপে ধরলাম। তারপর হলওয়ে ধরে ছুট দিলাম। এসময় ঠিক সামনে কিছু একটা দেখতে পেলাম। ‘রবিন, দেখো!’

সদর দরজা!

‘মুসা, পিছনে!’ চেঁচিয়ে উঠল রবিন। বোঁ করে ঘুরে দাঁড়াতেই, হলওয়ের শেষ প্রান্তে কালো এক অবয়ব দেখতে পেলাম। চোখের জায়গায় একজোড়া উজ্জ্বল লাল ফোঁটা।

‘নো প্রবলেম, এখুনি বেরিয়ে যাব!’ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললাম, আছড়ে পড়লাম দরজার উপরে।

‘মুসা, ও এসে পড়েছে!’

নিজেকে আবারও ছুঁড়ে দিলাম দরজার গায়ে। আবার। আমরা দু’জনেই চেষ্টা করলাম-বৃথা।

দরজাটা বন্ধ। ভিতরে আটকে গেছি আমরা!