দুই
এক্সার-সাইকেলটা বের করা বেশ কষ্টসাধ্য হলো, কেননা ওটাকে কাত করে আমাদের স্টোরেজ ইউনিটের দরজা দিয়ে বাইরে আনতে হয়েছে। তা ছাড়া আমার পিঠে ব্যাকপ্যাক ছিল বলেও সমস্যা হয়েছে। ডোর জ্যাম্বে কয়েকবার গুঁতো খাওয়ার পর বাবা বলল, ‘ওটাকে ভ্যানে রেখে আসিসনি কেন?
বাবাকে বলতে পারিনি এতটাই ভীত-সন্ত্রস্ত ছিলাম, কথাটা আমার মাথাতেই আসেনি। তবে প্যাকটা আমি খুলে নামিয়ে রাখি, যাতে ইস্পাতের এক্সারসাইয মেশিনটার সঙ্গে কুস্তি চালিয়ে যেতে পারি।
ওটাকে বের করে হলওয়েতে রাখার পর, বাবা অন্যান্য জিনিস খুঁজতে লাগল। ওগুলো ছিল বাক্সের মধ্যে, স্তূপের একেবারে নীচে। মিনি-ভ্যানে যখন সব বোঝাই দেয়া হলো, পাঁচটার কুয়াশা তখন ঘন হচ্ছে। এই কুয়াশা জিনিসটা আমার ভয়ানক অপছন্দ।
বাসায় যখন ফিরলাম আকাশ তখন যথেষ্ট গোমড়া। গাড়িপথে ভ্যান থামার পর দেখতে পেলাম রবিন আমাদের গ্যারেজের সামনে দাঁড়িয়ে, আমার জন্য অপেক্ষা করছে। ওর হাতে বাস্কেটবল। আমি ভ্যান থেকে নামতেই চেঁচিয়ে উঠল ও, ‘ধরো!’ এবং বলটা ছুঁড়ে দিল আমার দিকে।
বলটা লুফে নিয়ে পাল্টা ছুঁড়ে দিলাম।
‘বাবার সাথে একটু কাজ আছে, তারপর আসছি,’ বললাম।
মা এসময় বেরিয়ে এল বাসা থেকে।
‘সব কিছু পেয়েছ?’ প্রশ্ন করল।
‘হ্যাঁ,’ বাবা গুঙিয়ে উঠল। মিনি-ভ্যান থেকে এক্সার-সাইকেলটা নামালাম আমরা।
‘তুমি যাওয়ার পর নেলি আবার ফোন করেছিল,’ বলল মা। ‘জানতে চাইছিল আমরা ঘরে একটা সান ল্যাম্প লাগিয়ে দিতে পারব কিনা।’
‘সান ল্যাম্প?’
‘ও বলল এখানে এত কুয়াশা যে গায়ের চামড়া নষ্ট হয়ে যাবে।’
‘সান ল্যাম্প,’ বাবা পুনরাবৃত্তি করে মাথা ঝাঁকাল।
‘ওহ, মুসা,’ মা বলে চলল, ‘তুই এখুনি গিয়ে তোর ঘরটা গুছিয়ে ফেল।’
‘খাইছে, এখনই?’ আমি বললাম।
‘তোর নেলি খালা শীঘ্রি এসে পড়বে আর আমি চাই ঘরটা রেডি থাকুক। কীগো, তুমি ওকে সব বলেছ তো, তাই না?’
মাথা ঝাঁকাল বাবা। আমি রবিনের দিকে চেয়ে স্রেফ শ্রাগ করলাম।
‘মুসা, আমি তোমাকে ঘর গোছাতে হেল্প করব,’ প্রস্তাব করল রবিন। ‘এতে জানা যাবে অতশত জঞ্জালের নীচে সত্যিই কোন মেঝে আছে কিনা।’
‘দারুণ আইডিয়া,’ বললাম, ‘কিন্তু আমি বেটার আরেকটা আইডিয়া দিচ্ছি। তুমি না হয় গিয়ে আমার রূম গোছাও, আমি এখানে কয়েকটা হুপ ড্রপ করি?’
‘প্রশ্নই ওঠে না!’
‘ঠিক আছে, তা হলে হেল্প করতে পারো। মা, রবিন আমাকে হেল্প করুক?’
‘তোরা যদি সত্যি সত্যি ঘর গোছাস তা হলে করুক। কিন্তু বসে বসে কম্পিউটার গেম খেললে হবে না,’ মা বলল।
‘প্রমিয!’ চেঁচিয়ে উঠে, বাড়ির ভিতরে দৌড়ে ঢুকে পড়লাম আমরা।
স্বীকার করাই ভাল, আমার কামরাটার যা তা অবস্থা। প্রথম পনেরো মিনিট গেল আমার কাপড়চোপড় তুলে তুলে হ্যাম্পারে ঢুকাতে। এবার দেয়াল থেকে ছবি আর অন্যান্য জিনিসপত্র নামাতে লাগলাম আমি। ধারণা করলাম, আমি না নামালে নেলি খালা নামাবেন, তারপর আর এগুলোর হদিস মিলবে কিনা কে জানে।
‘তোমার নেলি খালা কী সব রাশি-টাশি নিয়ে কাজ করেন, তাই না?’ রবিনের প্রশ্ন।
‘হ্যাঁ, এবং তিনি গাছের চারাদের সঙ্গেও কথা বলেন,’ বললাম। ‘অদ্ভুত সব ড্রেস পরেন আর চুলগুলো ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের বৌয়ের মত।’
‘কুল!’ বলল রবিন। ও হরর ছবির ভক্ত। ‘কিন্তু তোমার খালা তোমার ঘরে হাঁটাচলা করলে তুমি ঘুমাবে কোথায়?’
‘মনে হয় কাউচে। অন্তত টিভি তো দেখতে পারব।’
আমরা কাজ করে গেলাম। শেষমেশ ঘরটা গোছানো হয়ে গেল। আমার দরকারি সব জিনিসপত্র এক কোণে জড় করলাম, যতক্ষণ না ঠিক করতে পারছি কোথায় রাখব ওগুলো। গাদার শেষ জিনিসটা হলো আমার ব্যাকপ্যাক। কিন্তু ওটার চেইন লাগাতে যেতেই টের পেলাম কিছু একটা নেই। আমার জ্যামিতি নোটবইটা পেলাম না!
‘স্কুলে রেখে এসেছ?’ রবিন জিজ্ঞেস করল।
‘না, ডবল চেক করেছি। এখানেই ছিল! খাইছে, সোমবারে বড় টেস্ট, এখন কী হবে!’
এবার মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। নোটবইটা কোথায় আছে জানি আমি। একমাত্র ওখানেই আমি ব্যাকপ্যাকটা নামিয়েছিলাম। একমাত্র ওখানেই জিনিসটা পড়ে গিয়ে থাকতে পারে।
স্টোরেজ বিল্ডিং।
বাবাকে বলতে পারি আমাকে গাড়িতে করে ওখানে নিয়ে যেতে, কিন্তু মনে হয় না সে ভাল মুডে আছে। হয়তো লেকচার ঝাড়বে, আমার উচিত ছিল ব্যাকপ্যাকটা মিনি-ভ্যানে রেখে যাওয়া। না, নোটবইটা ফিরে পেতে হলে আমাকেই ওখানে যেতে হবে। কিন্তু ও নিয়ে আরও দুশ্চিন্তা করার আগেই মা উদয় হলো দোরগোড়ায়।
‘বাহ, ভাল কাজ দেখিয়েছিস তো, ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে বলল। ‘রবিন, তুমি আমাদের সাথে ডিনার করে যাবে।’
‘আজকে না, আণ্টি,’ বলল রবিন। ‘মা তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে বলেছে।’
রবিন চলে গেল। ও থাকলে এক্সার-সাইকেলটা আমার বেডরূমে ঢোকাতে বাবার আর আমার সঙ্গে হাত লাগাতে হত। আমরা যখন কাজটা শেষ করলাম, মা ততক্ষণে ডিনারের টেবিল সাজিয়ে ফেলেছে। মা আমাকে তিনবার বলল অত তাড়াহুড়ো করে না খেতে, কিন্তু আমার পক্ষে সম্ভব হলো না। তাড়া আছে আমার। স্টোরেজ বিল্ডিং বন্ধ হওয়ার আগেই ওখানে আমার যেতে হবে।
খাওয়া শেষ হতেই টেবিল থেকে লাফিয়ে উঠে পড়লাম।
‘বাইরে যাচ্ছি,’ বললাম, এবং কথাটা মিথ্যে নয়। বাইরেই তো যাচ্ছি। শুধু এটা চেপে গেলাম সাইকেল চালিয়ে শহরের মধ্য দিয়ে মাইল খানেক যাব। কিন্তু কপাল ভাল থাকলে, বাবা-মা কিছু টের পাওয়ার আগেই ফিরে আসতে পারব।
ব্লকের অর্ধেকটা গিয়ে মনে হলো স্টোরেজ বিল্ডিঙে কীভাবে যাওয়া যায় জানা নেই। বাবা আর আমি চলতি পথে পার্কটার পাশ কাটিয়েছিলাম, কাজেই আমি নিশ্চিত ওখান থেকে জায়গাটা খুঁজে বের করতে পারব। ওটা অবশ্য সরাসরি রাস্তা নয়, তবে আমার সামনে অন্য কোন বিকল্পও নেই। পার্কের উদ্দেশে চললাম।
আঁধার ঘনাচ্ছে। কুয়াশা গাঢ় হচ্ছে। রাস্তার গাড়িগুলোকে দেখাচ্ছে বিশাল হলদে চোখের দানবের মত। পার্কের দূর কোণে পৌছে বাঁয়ে ঘুরলাম এবং পেডাল মারতে লাগলাম। মনে হলো পথ যেন আর ফুরোবে না। ভয় হচ্ছে কোথাও বোধহয় একটা ভুল বাঁক নিয়েছি। এসময় চোখে পড়ল নীল আর সাদায় বড় বড় করে লেখা সাইন: স্টোর-ফোর-লেস। যাক!
পার্কিং লটে সাইকেল রেখে সোজা দরজার দিকে পা বাড়ালাম। খোলাই ছিল ওটা। দু’মুহূর্ত ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম ওখানে, আচমকা গ্রাস করা গা শিরশির ভাবটাকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলাম। ভয় কীসের! নিজেকে বললাম। এটা তো স্রেফ একটা বিল্ডিং! কিন্তু দরজাটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছি, ওটাকে খোলা, ক্ষুধার্ত হাঁয়ের মত দেখাল-আমাকে গিলে খাবে যেন।
‘বোকামি কোরো না,’ নিজেকে শোনালাম, ‘এখানে ভয় পাওয়ার মত কিছু নেই।’
ঠিক এসময় কুয়াশা ফুঁড়ে কিছু একটা বেরিয়ে এসে আমার বাহু চেপে ধরল!